আমার চেতনার রঙে রাঙানো এই খেলা ঘরে:

~0~0~! আপনাকে স্বাগতম !~0~0~

*******************************************************************************************************

Monday 24 May 2010

বিহুঃ অসমিয়া সমাজের আয়ুরেখা নির্মাণের এক সংক্ষিপ্ত ইতিকথা।


From Bihu: Sushanta


 ( উত্তরবাংলার ছোট কাগজ 'মুখোমুখি'র জন্যে লিখলাম । লেখাটা গুরুচণ্ডালীতেও বেরুলো।)                             
                অতি চেনেহৰ মুগাৰে মহুৰা অতি চেনেহৰ মাকো।
                 তাতকৈ চেনেহৰ বহাগৰ বিহুটি নাপাতি কেনেকৈ থাকো ।।
           মাঠের ফসল ফলানোর বীজ ছড়ানো থেকে ফসল ফলে উঠার প্রক্রিয়ার সঙ্গে গোটা পৃথিবীতেই মানুষের জন্ম তথা যৌন  জীবনের সাদৃশ্য কল্পনা করাটা এক স্বাভাবিক  প্রাকৃতিক প্রবণতা। তার ফলে  সভ্যতার উন্মেষ লগ্ন থেকেই গোটা পৃথিবীর প্রায় সমস্ত আদিম মানুষেরাই কিছু আচার সংস্কার আর উৎসবের সূচনা করেছিল। সে আমরা জানি। সূচনা লগ্নের সেই উৎসবের রেশ এখনো আমাদের উন্নত সংস্কৃতিতেও থেকে গেছে। বাংলা অসমের তান্ত্রিক আচার বা অসমের কামাখ্যা ধামের অম্বুবাচি তেমনি একটি। সারা ভারতের রঙের উৎসব হোলিও তাই । পরে যদিও এদের সঙ্গে সতীর দেহত্যাগের কাহিনি, রামায়ণের কাহিনি , ভক্ত প্রহ্লাদের কাহিনি ইত্যাদি জুড়ে দিয়ে এক ব্রাহ্মণ্য আভিজাত্য দেবার চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু কৃষিই যাদের জীবিকা সেই গ্রাম ভারতে সংস্কার গুলো নানা চেহারাতে তার আদিম প্রকৃতিতে এখনো রয়ে গেছে। এখনো দীর্ঘ খরার থেকে মুক্তি পেতে লোকে বেঙের বিয়ে দেয়। কুমারি মেয়েকে নগ্ন করে মাঠে শুইয়ে রাখে বা ঘুরিয়ে নিয়ে আসে।বস্তুত জন্মান্তরবাদ থেকে শুরু করে প্রায় কোনো হিন্দু আচার ও বিশ্বাসই নিজেকে আদিম প্রকৃতি পূজোর পরম্পরা থেকে বিচ্ছিন্ন করতে পারেনি, কিম্বা করেনি।   
            অসমের ‘বিহু’ তেমনি এক সূচনার রূপান্তরিত শিল্পীত  রূপ। অসম বললেই আজকাল প্রথমেই মনে পড়ে ‘বিহু’র কথা। চোখের সামনে ভেসে উঠে ‘ঢোল-পেঁপা-গগনা’ বাজাচ্ছে একদল ছেলে আর তাদের সঙ্গে কোমর দুলিয়ে নেচে চলেছে কয়েক জোড়া তরুণ তরুণী। পরনে তাদের ধুতি পাঞ্জাবি, মাথায় লাল সুতোতে ফুলের কাজ করা  গামোছা ( ওরা বলেন ‘ফুলাম গামোছা’) বাঁধা, মেয়েদের পরণে মেখেলা চাদর আর গায়ে সোনা রূপার অসমিয়া ছাঁদের গহনা। তাই দেখে মনে হয়ে বটে এ যেন এক প্রেমের উৎসব। আর মনে হবেই না কেন, গান গুলোও তো তেমনি ঃ কোমোৰা বগালে চালত,/জীৱনে মৰণে নেৰিবা লাহৰী/নেৰিবা বিপদৰ কালত।/চাইনো চাই থাকিলে হাবিয়াস নপলায়/নেখালে নুগুচে ভো্‌ক,/কিনো খায়ে যাবি বালিহাটৰ বেঙেনা/দলিয়াই দি যাম তোক।”(বুলজিত)১ কিন্তু উপমা-রূপকগুলো লক্ষ্য করুন—উঠে এসছে একেবারেই কৃষি জীবন থেকে। এবারে, কৃষি জীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত একটা উৎসব কেবল এক নির্দিষ্ট ভাষিক গোষ্ঠীর উৎসব হতে পারে না।
               ‘বিহু’ সম্পর্কে পূর্বোত্তরের আন্তর্জালিক অভিধান ‘শব্দে’ লেখা হয়েছে , “বিহু অসমীয়াৰ জাতীয় তথা স্বকীয় উৎসৱ ৷ ‘বিহু’ শব্দটো সংস্কৃত ‘বিষুবত’ শব্দৰ পৰা অহা বুলি ধাৰণা কৰা হয় ৷ বৈদিক ‘বিষুবন’ শব্দই এবছৰ ব্যাপী হোৱা ‘সত্ৰ’ বা ‘যজ্ঞ’ৰ মাজৰ দিনটোক বুজায় ৷ অৰ্থাৎ দিন আৰু ৰাতি সমান হোৱা দিনটোক বুজায় ৷ এই দিনটোক মকৰ সংক্ৰান্তি বুলি কোৱা হয় ৷ কিছুমান পণ্ডিতে অসমীয়া ‘বিহু’ শব্দটি সংস্কৃত ভাষাৰ ‘বিষুবন’ শব্দৰ লগত মিল থকা বুলি ধাৰণা কৰিছে ৷ বিহু প্ৰধানত অসমীয়াৰ কৃষিৰ লগত জৰিত এটা উৎসৱ।” (www.xobdo.org)  বেশির ভাগ অসমিয়া অভিধানের এবং পন্ডিতদের সেরকমই মত। হতে পারে সংস্কৃত ‘বিষুবত বা বিষুবন’ থেকে শব্দটি এসছে। বাংলাতেও ‘বিষুব সংক্রান্তি’ কথাটা রয়েছে। আর সে শব্দও কৃষি সভ্যতার সঙ্গেই সংযুক্ত। ভোরে স্নান করে সূর্যদেবতাকে প্রণাম করা হচ্ছে সারা ভারতের সমস্ত সংক্রান্তিতে করণীয় প্রথম কাজ। এই জল আর সূর্য কৃষিকাজের জন্যেই দরকার। কিন্তু অসমে বিহু শব্দটির অন্য উৎসও রয়েছে। আর সেই উৎসগুলো দেখায় ‘বিহু; কেবল অসমিয়াদের উৎসব নয়। পূর্বোত্তরের প্রায় সমস্ত জনজাতির উৎসব। মায় সিলেটি কাছাড়ি বাঙালিদের পৌষ সংক্রান্তির সঙ্গে ‘ভোগালি’ বা মাঘ বিহুর পার্থক্য অতি সামান্য। সুপরিচিত অসমিয়া ভাষাতাত্বিক ড০ উপেন রাভা হাকাচাম দেখিয়েছেন বিহুর সঙ্গে সম্পৃক্ত ‘গগণা’, পেঁপা, হুঁচরি, মেজি, হারলি ইত্যাদি শব্দগুলোর উৎস, তিব্বত বর্মী শাখার ভাষা বডো গারো, ডিমাসা, মিশিং, তাই আহোম ইত্যাদি। ‘বিহু’শব্দের সংস্কৃত উৎসের কথা তিনি জানেন। তারপরেও তিব্বত বর্মী ভাষাগুলোর থেকে আসা আপাত ভিন্নার্থক শব্দের উল্লেখ করেছেন। যেমন তাই আহোম পয়হু/পিহু/বিহু। এবারে, ‘পয়’ শব্দের অর্থ কিন্তু ‘বিষুব’ জাতীয় কিছু নয়। ঠাট্টা তামাস। রং ধেমালি। তেমনি তাই-আহোম ‘বৈহু’র ‘বৈ’ অর্থ পুজো ‘হু’ অর্থ গরু। বডো মূলীয় ‘বিহু’ শব্দের ‘বি’ মানে হাটা, হু মানে দেওয়া ( বি-খোজ, হু-দি)।  দেউরি ‘বিচু’ শব্দের ‘বি’ অর্থ অতি, চু  অর্থ  আনন্দদায়ক । ( উপেন রাভা)২ বডোরা বৈশাখের বিহুকে বলেন ‘রংজালী বৈশাগৌ’। এতে বাড়ি বাড়ি গিয়ে ‘হৌচৌৰি হৌচৌৰি বিহৌ মাগি ফুৰাৰ’ প্রথা রয়েছে। অসমীয়াতে এসে সেই প্রথার নাম হয়েছে ‘হুঁচরি’। রাভাদের বিহুর জনপ্রিয় নাম ‘বাইখ’, সনোয়াল কাছাড়িদের ‘বাইথ’, মিশিংদের ‘আলি আই লৃগাং’। বডোদের  এদের বেশির ভাগ জনগোষ্ঠীই যদিও নিজেদের অসমিয়া বলে পরিচয় দেয় তাদের উৎসবের দিন ক্ষণ আর রকম সকম মোটেও হুবহু এক নয়। বডোরা নিজদের অসমিয়া বলে পরিচয় দেয় না। তাই আহোমরা যদিও সে পরিচয়  দেয় তারাও আজকাল ‘তাই বিহু’বলে স্বতন্ত্র আয়োজন করে থাকেন। চাকমাদের মধ্যে ‘বিজু’, মারলাদের ‘সাংগ্রাই’ আর ত্রিপুরিদের ‘বৈসুক’ এর থেকে আদ্যাক্ষর নিয়ে আজ ক’বছর ধরে বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের এই তিন জনগোষ্ঠী একত্রে পালন করছেন ‘বৈসাবি’ উৎসব। সেটি নিশ্চয় অসমিয়া ব্যাপার নয়।
                    বাকি ভারতের লোকেদের কাছে যে ‘বিহু’ বললেই আজকাল অসম আর অসমিয়াদের কথা মনে পড়ে তার কারণ গেল অর্ধ শতক ধরে এরা একে সফলতার সঙ্গে লৌকিক উৎসব থেকে জাতীয় উৎসবে রূপান্তরিত করেছেন। সেটি অসমিয়া মধ্যবিত্তের এক রাজনৈতিক উদ্যোগ। রাজনীতি বললে অনেকেই দলীয় রাজনীতির কথা বুঝে থাকেন আমরা সেরকম কিছু বোঝাতে চাইছিনা। বাকি ভারতের থেকে বিশেষ করে বাঙালিদের থেকে নিজদের স্বতন্ত্র বলে তুলে ধরাটা একসময় অসমিয়া মধ্যবিত্তের অনিবার্য প্রয়োজন হিসেবে দেখা দিয়েছিল। জাতীয় উৎসব ‘বিহু’ সেই প্রয়োজনের ফসল। নইলে একসময় অসমিয়াদের  অজনজাতি অভিজাত অংশ ‘বিহু’কে মোটেও শ্রদ্ধার চোখে দেখতেন না। ভাটি অসমে বিহু তেমন কোনো জনপ্রিয় উৎসব ছিলনা এই সেদিন অব্দি। আজো গোয়াল পাড়ার ‘বিষুয়া উৎসবে’ আর সবই আছে, নেই শুধু কোনো নৃত্যগীত। বাংলা ভাষাতে প্রথম ইতিহাস গ্রন্থের অসমিয়া লেখক হলিরাম ঢেকিয়াল ফুকন তাঁর ‘আসাম বুরঞ্জী’তে লিখেছিলেন , “ বিহুর গান একটা হইয়া থাকে তাহাতে সাধারণ লোকের স্ত্রীলোক ও লম্পট পুরুষসকল একত্র হইয়া জুগুপৎচিত নৃত্যগীত করিয়া থাকে।” অসমিয়া জাতীয়তাবাদের পিতৃপুরুষ আনন্দরাম বরুয়ার জীবনী লেখক গুণাভিরাম বরুয়া লিখেছেন , “ অশ্লীলতা তেঁও বৰ ঘৃণা কৰিছিল। বৈশাখৰ বিহুত নগাঁওৰ স্থানে স্থানে অশ্লীল নৃত্যগীত হৈছিল সেইসকলক তেঁও নিবাৰণ কৰালে আৰু এইৰূপ কার্য যে অনিষ্টজনক তাক তেঁও সকলোকে বুজাই দিছিল।” (দেবব্রত)৩                   অসম সাহিত্য সভার দু’একজন প্রাক্তন সভাপতিও ছিলেন বিহু বিরোধী। এরা প্রায় প্রত্যেকেই বাংলার নবজাগরণের দ্বারা বিশেষ করে ‘ব্রাহ্ম ধর্ম’ আন্দোলনের দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। বাংলাতে যেমন রবীন্দ্রনাথের আগে পুরোনো লোক সংস্কৃতিকে প্রত্যাখ্যানের এক আয়োজন পূর্ণদ্যমে চলছিল। এখানেও তাই হচ্ছিল। ড০ দেবব্রত শর্মা লিখেছেন অসম সাহিত্য সভার প্রাক্তন সভাপতি কমলাকান্ত ভট্টাচার্য বিহু বিরোধীতা করেছিলেন এই ভয়ে, “ জানোচাঁ ‘বিহুর গীতবোৰ বৰ নিলাজ অভং’ শুনি সতীৰ মতিভ্রম হয়। তেওঁ নিলাজ (বিহু) গীতৰ ঠাইত বীৰ-গীত গাবলৈহে আহবান জানাইছিল। মন কৰিবলগীয়া যে অসমীয়া ভাষা-সাহিত্যর কামত একাণপতীয়াকৈ আত্মনিয়োগ করা এই সকল ব্যক্তির সম্পর্কে কোনো আঁচনি বা চিন্তা নাছিল। সংস্কৃতি সম্পর্কে কোনো আঁচনি নাছিল। সংস্কৃতি সম্পর্কে তেঁওলোকৰ ধাৰণা আছিল হয় বাংলা সংস্কৃতি কেন্দ্রিক, নহয় ব্রাহ্মণ্য/সত্রীয়া সংস্কৃতি কেন্দ্রিক। (দেবব্রত)৪
    বস্তুত মেয়েরা প্রকাশ্য বিহু নৃত্যে যোগ দিত অতি অল্পই। ছেলেরাই মেয়ে সেজে বিহুর নানা নৃত্যে যোগ দিত। আজ যখন গাছ তলার বিহুকে এক পাশে সরিয়ে দিয়ে মঞ্চ বিহু নামে এক নতুন ধারা ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়ছে, মেয়েদের যোগদান ব্যাপক ভাবে বেড়েছে, তখনো একে বিকৃত  প্রথা বলবার লোকের অভাব নেই। এই সেদিন চাও দেবেন্দ্রচরণ বরবরুয়া ‘প্রান্তিকে’৫ লিখেছেনঃ  “...বুঢ়াচেওৰ বিহুত ছোয়ালীৰ ( মেয়েদের-লেখক) স্থান নাছিল । আজিকালি ডেকা ( জোয়ান ছেলে),বুঢ়া, ল’ৰা, চেমনীয়া ( কিশোর-লেখক) গোট খাই লগত সৰু ডাঙৰ ছোয়ালী লৈ ঘৰে ঘৰে বিহু মৰা বিকৃত প্রথা এটা ওলাইছে। এনে প্রথাক বিশিষ্ট সাহিত্যিক ড০  নির্মলপ্রভা বৰদলৈয়ে ধিক্কাৰ দি কৈ গৈছে যে ‘আগতে হুঁচুৰি ( বিহুর আরম্ভ অংশের এক আবশ্যিক অংগ-লেখক) গাবলৈ মানুহৰ ঘৰলৈ যাওঁতে ল’ৰা লগত ছোয়ালী নানিছিল। ল’ৰাক কোনোয়ে ছোয়ালী সজাই নচুয়াইছিল। এতিয়া হুঁচৰি গাওঁতে ছোয়ালিয়েও বিহু মাৰিবলৈ যায়, বাঃ আধুনিকতা।”    বিশ শতকের ষাটের দশক অব্দি ‘হুঁচরি’তে- যাতে বাড়ি বাড়ি গিয়ে নাচ গান করা আর গৃহস্থকে আশীর্বাদ জানানো হয়—তাতে মেয়েরা যেমন অংশ নিতনা তেমনি গানের বিষয়েও প্রেমপ্রীতির আধিক্য ছিলনা।ষাটের দশক থেকে ছেলেদের মেয়ে সাজিয়ে নিয়ে যাবার প্রথা প্রচলিত হয়। তখন থেকেই এতে প্রেমের গানের আধিপত্য বাড়তে শুরু করে। আশির দশকে সেই সাজানো মেয়েদের প্রতিস্থাপিত করে রীতি মতো কৈশোরোত্তীর্ণ যুবতিরা। ৬
From Bihu: Sushanta
         স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় জাতীয়তাবোধে উদ্দীপিত অসমীয়ারা যখন নানা গোষ্টীতে বিভক্ত জাতিকে একত্রে বাঁধবার প্রয়োজনে এক জাতীয় উৎসবের প্রয়োজন বোধ করছিলেন, তখন অনেকেই বাঙালি হিন্দুর  আদর্শে দুর্গা পূজাকে সে জায়গা দেবার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। ঢাকার থেকে প্রকাশিত কালীপ্রসন্ন ঘোষের সম্পাদিত বাংলা পত্রিকা ‘বান্ধবে’র অনুসরণে ডিব্রুগড়ের চা-বাগিচা মালিক গংগারাম চৌধুরী ‘আসাম বান্ধব’ প্রকাশ করতেন। ঐ কাগজ দুর্গা পূজার পক্ষে জোর সওয়াল করেছিল। ‘আলোচনী’ নামে অন্য এক কাগজের নেতৃত্বে আরো অনেকে তখনই বিহুর পক্ষে উঠে পড়ে লাগেন। লক্ষীনাথ বেজবরুয়া, রজনীকান্ত বরদলৈ, জ্ঞানদাভিরাম বরুয়া প্রমুখ লেখক বুদ্ধিজীবিরা অনেক লড়াই করে ‘বিহু’ মতো এক ধর্ম নিরপেক্ষ উৎসবকে অসমীয়াদের জাতীয় উৎসবের মর্যাদাতে উন্নিত ও প্রতিষ্ঠিত করতে সমর্থ হন। তাঁদের লক্ষ্য ছিল এমন এক উৎসব যার ছায়াতলে নানা জনগোষ্ঠীতে বিভক্ত অসমের সমাজ মিলনের স্বাদটুকু নিতে পারে। সাহিত্য সভার ১৯৫৯সনের সভাপতি  অতুল চন্দ্র হাজারিকা বলেছিলেন, “আজি কেই বছৰ মানৰ পৰা অসমৰ বহু ঠাইত ৰাজহুয়াভাবে বিহু উৎসব পালন কৰা হ’ব ধৰিছে সাংস্কৃতিক উৎসব হিচাপে। নতুন যুগৰ নতুন বিহুতলীক ( যেখানে বিহু উদযাপিত হয়-লেখক) উদ্দেশ্য কৰি আমি ক’ব পাৰোঁ  মিকিৰ কচাৰী বড়ো/আবৰ মিছিমি গাৰো/ খাচীয়া, জয়ন্তীয়া, মিৰি নগা/ জনমে মৰণে সতে লগা-ভগা আহাঁ আহাঁ আহাঁ/ আমার এই বিহুতলী যাউতিযুগীয়া/ সকলোৰে উমৈহতীয়া ( সার্বজনীন-লেখক)।”  (দেবব্রত)৭
             পৌষ সংক্রান্তি বা নববর্ষের মতো ব্যাপারকে নিয়ে বাংলারও এক ধর্ম নিরপেক্ষ জাতীয়  উৎসব গড়ে উঠতে পারত। আধুনিক বাংলাদেশের ‘নববর্ষ’ সেটিকে প্রমাণ করে। কিন্তু বর্ণহিন্দু বাঙালি সেরকম কোনো উদ্যোগকে  প্রশ্রয় দিলনা। অথচ সেই কাজই অসমিয়াদের মধ্যে করতে সফল হলেন এক বিশাল মাপের বাঙালি ভদ্রলোক ও গণ সঙ্গীত শিল্পী হেমাঙ্গ বিশ্বাস। তাঁর সেই বিখ্যাত উক্তি, “যি নাই অসমত সি নাই বিহুগীতত”  এখনো অসমিয়া সমাজে প্রবাদের মতো শোনা যায়। তাঁর ‘অসম আৰু বংগৰ লোকসঙ্গীত সমীক্ষা’ বইতে যা লিখেছেন তাকে বাংলা করলে দাঁড়ায় , “ অসমে যা নেই তা বিহু গানেও নেই। অসম এবং অসমিয়া জনমানসের নির্ভুল দর্পণ এই বিহু.।.. ধর্মপ্রভাবমুক্ত ইহজগত   এবং শ্রমশীল জীবনের প্রতি অসীম মমতা—এই হলো বিহুর দর্শন। ...শারদীয় উৎসব, দীপান্বিতা, দোল এই সবগুলো হিন্দুদের উৎসবে পরিণত হয়েছে। জাতীয় উৎসবের মর্যাদা  এগুলো হারিয়েছে...। বর্ণহিন্দু সমাজের বিধি নিষেধ আর বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদই হলো বিহুর প্রধান উপজীব্য...।দুঃখের বিষয় ভারতের সবগুলো উৎসবই সাম্প্রদায়িক। বসন্ত উৎসব রূপান্তৰিত হয়েছে হোলি বা চৈতন্য উৎসব ইত্যাদিতে। শারদীয় উৎসব পরিণত হয়েছে দুর্গোৎসব ইত্যাদিতে। কারবালার কাহিনীমূলক মহরম হলো মুসলমান সম্প্রদায়ের। কিন্তু বিহু তার মধ্যেও এর ধর্মনিরপেক্ষ প্রকৃতি অক্ষুন্ন রাখতে পেরেছে। এটাই বিহুর গৌরব, অসমিয়া জনগণের গৌরব।” সেই গৌরবকে সম্মানিত করে চূড়ান্ত গানটি গাইলেন হেমাঙ্গ বিশ্বাসেরই এককালের শিষ্য ভূপেন হাজারিকাঃ ‘বিহু মাথোঁ এক ঋতু নহয়  , নহয় বহাগ এটি মাহ। অসমিয়া জাতিৰ ই আয়ুস ৰেখা...”
From Bihu: Sushanta
          ‘লোক সংস্কৃতি’র থেকে ‘জাতীয়  উৎসব’ হয়ে উঠতে গিয়ে কিছু পরিবর্তনতো বিহুর মধ্যে হয়েইছে। উজান অসমের মূল স্রোতের অসমিয়াদের ‘বিহু’ই প্রচারের মুখ দেখেছে বেশি। আগে যেখানে বাড়ি বাড়ি গিয়ে ‘হুঁচরি’ গেয়ে সংগৃহীত ধনে গাছতলাতে বিহু হতো, এখন সেখানে সংগঠিত কমিটির অধীনে  ‘দুর্গাপূজা’ ও তার পরবর্তী অনুষ্ঠানের মতো চাঁদা তুলে মঞ্চে বিহু আয়োজিত হয়। জাতীয় রাজনীতির প্রয়োজনে বিহুর এই যে রূপান্তরণ তার পূর্ণ সুযোগ নিয়েছে আধুনিক রাষ্ট্র ও ব্যবসায়িক কোম্পানীগুলো। গ্রামের বিহু এখন নগর কেন্দ্রিক এবং কোটি টাকার আয়োজনে রূপান্তরিত হয়েছে। বিহুর একধরণের ব্যবসায়িক রূপান্তরো ঘটছে । যাকে বলতে পারি বিহুর পণ্যায়ন। বিহুকে পণ্য করে  বিকৃত করবার অভিযোগও আজকাল সরবে শোনা যাচ্ছে। একে আটকানো কতটা যাবে সেটি বলা মুস্কিল।  দেবব্রত শর্মা আক্ষেপ করে লিখেছেন , “ড০ ভূপেন হাজাৰিকার দৰে একালৰ গণশিল্পীয়ে (আজিৰ গেৰুয়া নির্বাচন প্রার্থী) বিহু সন্মিলনত এৰাতি গোয়াৰ বাবদ গণি গণি আদায় লৈছে লাখৰ হিচাপত টকা। তার বিপৰীতে গাঁওবোৰ নিজম পৰি আহিছে। অভাব অনাটনে বিহুৰ হৰিষ হৰিছে ( আনন্দ হরণ করেছে-লেখক)।” (দেবব্রত)৮
    আর সমস্ত জনগোষ্ঠির লোক সংস্কৃতির বেলাতে যেমন বিহুর বেলাতেও তেমনি কোনো ধরাবাঁধা ‘শাস্ত্রীয়’ নিয়ম নেই।  না আছে তার নাচের গানের কিম্বা বাদ্যের কোনো জটিল তত্ব কথা। হাজার বছরের পরম্পরা পরিবর্তনের মধ্যি দিয়ে যেতে যেভাবে তাকে গড়ে তুলেছে সে সেভাবেই গড়ে উঠেছে।  ফসল উৎপাদনের সঙ্গে মানুষের যৌনজীবনের সাদৃশ্য কল্পনার থেকে যার যাত্রা শুরু সে সেখানেই মোটেও থেমে থাকেনি কোনোদিনই।এমন কি অনেক সময় আজ বিহুর সঙ্গে যে কৃষি কাজের কোনো সম্পর্ক রয়েছে তাকেই বেশ খোঁজে বের করতে হয়। এই যেমন বিহু নাচের ব্যাপারটি। একে  অসমিয়া স্বতন্ত্র নাচের শৈলী বলে গোটা বিশ্ব জানে। বড় যৌন উত্তেজক বলে মুখরোচক আলোচনাও হয়। ভাবনা ওইখানেই থেমে যায়। আসলে কিন্তু এই নাচে বৈশাখের গাছে গাছে নতুন ডাল পালা মেলা আর পাতা গজানোর উৎসব শুরু হয় তারই এক শৈল্পিক পুনস্থাপন করা হয়। নিচের ছবিটি দেখুন আর বিহু নাচের সঙ্গে তার সাদৃশ্য কল্পনা করুন। ব্যাপারটা স্পষ্ট হবে। মহিষের শিঙে তৈরি পেঁপাতে ( কৃষি সমাজের জনপ্রিয় বাদ্য। বাংলাদেশের কৃষির দেবতা শিবের শিঙার থেকে আকারে সামান্য ছোট আর সুসজ্জিত) মুক্তি নাথ বরগোঁহাই লিখেছেন ,” আমাক অগ্রজ তথা সমল ব্যক্তিয়ে ১৯৬০-৬১ চনতে এনেদৰে শিখাইছিল...পেঁপাৰ প্রথম লহৰ বজালে দুয়োখন হাত কঁকালত থৈ হাউলি ঢেঁকি খোজৰ দোপন দি ঢোলৰ তাল আৰু লয়ৰ লগত সংগতি ৰাখি,ঠাইতে ঘুৰি ঘুৰি নচা আৰু পেঁপাবাদকে উশাহ সলাওঁতে ঢোলৰ বুলনীত থিয় হৈ হাত মেলি নচা।” ৯ অর্থাৎ ঢেঁকিতে পাড় দেবার
From Bihu: Sushanta
অনুকরণ করে এক  সুন্দর এক নৃত্য ভঙিমা গড়ে তোলা হচ্ছে। হাত মেলে নাচাটাও আসলে শিল্পী শিখেছেন বসন্তের নতুন পাতাভরা ডালের থেকে। এমন কি ‘নাচনী’রা ( নৃত্যাঙ্গনা-লেখক) যখন কোমরটাকেও একটু পেছনে ঠেলে মাথা এক পাকে উপরে আবার পরের পাকে নিচে নামিয়ে হাত মেলে নিজের চারদিকে ঘুরছে তখন আসলে ওরা বসন্তের শেষদিনগুলোতে বড় বড়  গাছে  স্বর্ণলতার প্যাঁচিয়ে ওঠাকে নৃত্যশৈলীতে  রূপান্তরিত করছে। বিহুনামে ( বিহুগানে-লেখক) রয়েছেঃ গছত বগোয়া ক’লীয়া লতা চ’তে গৈয়ে গৈয়ে/গছত বগোয়া ক’লীয়া লতা বহাগে পালেহি/ গছত  বগোয়া ক’লীয়া লতা ফুলিলে ভেবেলি লতা। কিম্বা ধরুন এই গানটি ঃ ৰাঙলী মদাৰৰ পাতে ঐ নাচনী/ৰাঙলী মদাৰৰ পাত। কঁকাল ঘূৰাই ঘূৰাই নাচিবি নাচনী লগাইছো নামৰে জাত। 
    এই যে ‘নামৰে জাত’—জাত কিন্তু বিহু গানের এক রকমফেরের নাম। তেমন কোনো শাস্ত্রীয় বিধিবিধান না থাকলেও স্থানে কালে বিহু নাচের যেমন তেমনি গানেরও বেশ রকমফের প্রচলিত রয়েছে। বিহু গানের ঘোষা, পদ, যোজনা, চুটি, বা খন্ড ছিগা নাম , যোরা নাম, জাত (জাত নাম), বহুয়া নাম ইত্যাদি বেশ ভাগ রয়েছে। চুটি মানে ছোট, ছিগা মানে ছেঁড়া, নাম কথাটার অসমিয়া অর্থ গীত , এসছে বৈষ্ণব পরম্পরার থেকে। এই চুটি নামই মূল বিহু। শুরুতে শুধু এগুলোই ছিল। সাধারণত এগুলো চার পংক্তির স্তবক হয়। চুটি নাম দিয়ে বিহুনাম ‘পকি উঠে’ মানে জমে উঠে। বাংলা কবির লড়াইর মতো বিহুতে জোরানামের প্রচলন পরবর্তী ঘটনা। লোকসংস্কৃতির গবেষকেরা একে কী বলবেন জানিনা। এ হলো বিহুর মূল কারক থেকে অপসারণ বা বিস্তার। জোরানামের সময় অব্দি এসে তরুণ জিজ্ঞেস করছে, বাঁহৰে আগলৈ চাই পঠিয়ালো/ বাঁহৰ কোনডাল পোন ( সোজা-লেখক)/ সঁচাকৈ সুধিছো মিছাকৈ নক’বা / তোমাৰ মৰমিয়াল কোন? । তরুণী যেন জলের ঘাটে দাঁড়িয়ে জলাজমিতে মহিষ চরাতে  ব্যস্ত তরুণকে শুনিয়ে জবাব দিচ্ছেঃ তিৰোতাৰ জনম দি বিধাতাই স্রজিলে/ পুৰুষৰ লগতে যোৰ/ আয়ো লোকৰ বোপায়ো লোকৰ/ তোমাকে বুলি যাওঁ মোৰ।
    মুল কারক থেকে অপসারণ এখানেই থেমে থাকেনি। ব্যক্তি, পরিবার, গ্রাম ও স্বদেশের সংস্কৃতি, রাজনীতি, ইতিহাস সমস্ত কিছুকেই বিহু নিজের মধ্যে ধারণ করে হয়ে উঠেছে আক্ষরিক অর্থেই অসমিয়া সমাজের দর্পণ।  আনন্দের উৎসব বিহুতে অসমিয়া মানুষ নিজের দারিদ্র্যের নিরানন্দের কথা জানিয়ে এও গেয়ে উঠেছেঃদেউতা অ’ খুজি মাগি এমুঠি রান্ধো/ মাহ হালধিরে, গরু গা ধুয়াই লৈ, তরালি পঘারে বান্ধো। কিংবা গেয়েছেঃ টকাৰ সৰু সৰু মাত সমনীয়া /টকাৰ সৰু সৰু মাত/ম’হঘূলি চাপৰিত টকাৰ মাত শুনি/এৰি যাওঁ পেটৰে ভাত।        ( বুলজিত) ইতিহাসের স্বাক্ষর ধরে রেখেছে এমন গানঃ স্বর্গদেউ ওলালে বাটচৰাৰ মুখলৈ/ দুলীয়াই পাতিলে দোলা/ কাণত জিলিকিলে নৰা জাংফাই/ গাতে গোমেচেঙৰ চোলা। কিম্বা দিখৌত গুমগুমাই  কোম্পানীৰ জাহাজ ঐ/ঢেঁকীত গুমগুমাই থোৰা/ গাত জুই জ্বলিছে সৰিয়হ ফুটিছে/ তোমাক দেখিবৰে পৰা। সিপাহী বিদ্রোহ বা দেশের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় মণিরাম দেওয়ান আর পিয়লি বরুয়া ফাঁসি কাঠে ঝুলেছিলেন। সেই ঘটনাকেও অসমিয়া শিল্পী বিহু গানে ধরে রাখতে ভুল করেনিঃ সোণৰ ধোঁয়াখোয়াত খালি ওই মণিৰাম/ৰূপৰ ধোঁয়াখোয়াত খালি/ কোম্পানীৰ ঘৰতে কিনো দায় লগালি/ ডিঙিত চিপেজৰী ল’লি। সুতরাং  কেউ যখন বিহুর দিনগুলোতে গেয়ে উঠেঃ আমি অসমীয়া গাতে মুগা-ৰিহা/খোপাত আমাৰ কপৌফুল,/আমাৰে চিনাকি ব’হাগৰ বিহুটি/হাততে জেতুকা বোল।–এই কথাগুলোর ব্যঞ্জনা বিস্তর , অর্থ ব্যাপক। অন্য কাউকে খাটো না করে  নিজের সমাজের এর চেয়ে সুন্দর পরিচয় আর কিসেই বা কেউ তুলে ধরতে পারে! 


*********


তথ্যসূত্রঃ
 ১) বুলজিত বুড়াগোহাইর সংগ্রহ থেকে;http://buljit.blogspot.com/
 ২) ড০ উপেন রাভা হাকাসাম;অসমীয়া আরু অসমর তিব্বত বর্মীয় ভাষা; পৃঃ১০১।
 ৩)ড০ দেবব্রত শর্মার ‘অসমীয়া জাতি গঠন প্রক্রিয়া আরু জাতীয় জনগোষ্ঠীগত অনুষ্ঠানসমূহ’ তে ব্যবহৃত উদ্ধৃতি; পৃঃ ৩২৮) 
 ৪)  ঐ; পৃঃ ৩২৯
 ৫)অসমৰ লোকসমাজ লোক উৎসৱ বিহুৰ হুঁচৰি, পদ, ঘোষা। যোজনা, নাম , জাত নাচ আদিৰ চমু মর্মকথা; প্রান্তিক; ১৬-৩০  
   এপ্রিল, ২০১০ সংখ্যা; পৃঃ১২ ।
 ৬) ড০ প্রদীপ নেওগ; গৃহস্থৰ চোতালত হঁচৰি মৰা প্রথাটো চলি থকা প্রসংগত;প্রান্তিক; ১৬-৩০ এপ্রিল, ২০১০ সংখ্যা;পৃঃ১৭ ।
       ৭) ঐ; পৃঃ৩৩১)
        ৮)ঐ; পৃঃ৩৩৩)
        ৯)  পেঁপাবাদন আৰু নাচোনশৈলী; প্রান্তিক, ১৬-৩০ এপ্রিল সংখ্যা, পৃঃ ২৬ 
      

Saturday 15 May 2010

আমাদের অত্যন্ত প্রিয় এই যে মাতৃভাষাগুলো

( ১৯শে মে, ভাষা শহিদ দিবসকে মনে রেখে এই অনুবাদ)
ঋতুরাজ কলিতা




আমাদের ভারতবর্ষের এই অংশটির এই যে মাতৃভাষাগুলোঃ
অসমিয়া,মণিপুরি, বাংলা, বডো, ভোজপুরি, মিশিং, সিলেটি,নেপালি, খাসি, হিন্দি,রাজস্থানী,
কার্বী,তিওয়া, ডিমাসা,জেমি নাগা, তাংখুল, আংগামি, কুকি, মিজো,মনপা,ককবরক...
আমাদের অত্যন্ত প্রিয় তথা পূজনীয়। ইতিহাস আর ভাষাবিজ্ঞান আমাদের জানিয়েছে যে
হাজার হাজার বছর ধরে বিকশিত আমাদের এই সমস্ত ভাষাই
সমস্ত সামাজিক এবং মানবিক ভাব প্রকাশ তথা  বিনিময় করবার জন্যে পুরোপুরি উপযুক্ত
জীবনের সমস্ত আনন্দ বেদনা, দয়া করুণা, ক্ষোভ প্রীতি সবগুলো অনুভূতির পরিপূর্ণ বাহন

তবুও , কাগজের পৃষ্ঠা তথা দূরদর্শনের পর্দাতে নানারকম খবরগুলো দেখে শুনে
জায়গায় জায়গায় অহরহ যে সব ছোট বড় আন্দোলন হচ্ছে সেগুলোর  স্লোগান পড়ে শুনে
আমাদের মনে কেন জানি এই সন্দেহ জাগে যে
আমাদের এই ভাষাগুলো
সত্যি বুঝি একই রকম করে নানা রকম মানুষের মর্মবেদনাকে প্রকাশ করতে পারে?

একই রকম প্রকাশ করতে পারে কি সেনা আতিশয্যের বলি নিরীহ অসমিয়া কৃষকের যন্ত্রণাকে?
আর উগ্রপন্থীর মাইন আক্রমণে পা কাটা পড়া তেলেগু সেনার দুর্ভাগ্যকে?
( যদি তাই হয়, তবে কেন অসমিয়া বর্ণমালাতে  এক বিশেষ ধরণের খবরই দেখি বেশি বেশি করে?)
একই রকম বর্ণনা করতে কি পারে থৌবাল গ্রামে পুলিশের হাফাজতে     মৃত কাঠ মিস্ত্রি ছেলেটির
তথা ইম্ফলে সন্ত্রাসবাদি বোমা বিস্ফোরণে মৃতা মণিপুরি ব্যাবসায়ী মায়ের কাহিনিকে?
( যদি তাই হয়, তবে কেন মণিপুরি স্লোগানগুলোতে আমরা এক বিশেষ ধরণের প্রতিবাদই দেখি
বেশি বেশি  করে?)


মা বাবাকে হঠাৎ করেই হারিয়েছে যে ডিমাসা বা জেমি নাগা বা মাড় কিংবা ভোজপুরি কিশোরীটি
তার হৃদয়ের হাহাকারকে কি সেই একই রকম ব্যক্ত  করতে পারে?
(যদি তাই হয়, তবে কি জেমিনাগা গণহত্যার বিরুদ্ধেও  একই রকম প্রতিবাদে সোচ্চার হতো না ডিমাসা নারী?)
উদ্যত অস্ত্রের সামনে হতবাক নাগা বা কুকি বাসযাত্রীদের হাহাকারকে কি একই রকম বোঝাতে পারে?
একই রকম বোঝাতে পারে কি উগ্রপন্থীর আকাশছোঁয়া টাকার দাবিতে বিভ্রান্ত
অসমিয়া আর রাজস্থানী মূলের ব্যবসায়ীদের কিংকর্তব্যবিমূঢ়তাকে?

যদি প্রতিটি ভাষা সবার সুখ দুঃখ একই সমান করে প্রকাশ করে পারত
তিনসুকিয়ার গ্রামবাসিদের কন্ঠে কি আর শুনতে পেতাম সেই সংগঠন আর সেই ব্যক্তির জন্যে
জিন্দাবাদ ধ্বনি, যাদের নির্দেশে গণহত্যাতে মারা গেছে তিনসুকিয়ারই শতাধিক অন্যভাষী
যার সন্ত্রাসবাদি আক্রমণে হতাহত হয়েছে নিম্ন অসমের শহর গুলোর শত সহস্র আম জনতা
( অর্থাৎ তোমরা সেদিন স্লোগান দিয়েছিলে গণহত্যা জিন্দাবাদ, বোমা বিস্ফোরণ জিন্দাবাদ)
ধরা বাঁধা কতকগুলো শব্দ এবং শব্দজোড়কে গেঁথে গেঁথে
আজ আমরা আমাদের ভাষাগুলোর যে অবস্থা করেছি...
সেগুলো কি আর বোঝাতে পারল গুয়াহাটির বেলতলাতে
দুর্বৃত্তের অপ্ররোচিত আক্রমণে জীবিকা হারানো শত শত ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর বেদনাকে?
বোঝাতে পারল কি অসমের চর অঞ্চলের থেকে উজানের ইটভাটাতে ট্রাকে করে যাবার বেলা
বিদেশি আখ্যা দিয়ে যেখানে সেখানে ঘন্টার পর ঘন্টা খিদে তৃষ্ণাতে আবদ্ধ করে রাখবার যাতনা?
ঠিক ঠিক করে কি বোঝাতে পেরেছে গ্রামে গ্রামে বাঁদরের দলে
আর শোনিতপুর-নগাঁও-গোলাঘাটের গ্রামাঞ্চলে হাতিতে দলিত মথিত করে
যাদের খেত খামার ধ্বংস করেছে সেই জনতার ভবিতব্যকে?

রাষ্ট্রযন্ত্র, নিপীড়িত জাতিসত্তা, নারী-নির্যাতন, সন্দেহযুক্ত বিদেশী, হাতি মানুষের  সংঘাত
ইত্যাদি কিছু শব্দবন্ধের অকারণ আধিক্য তথা অহরহ চাপে
আমাদের পূজনীয় মাতৃভাষাগুলো কি তাদের স্বাভাবিক ন্যায় অন্যায় বোধ হারিয়ে ফেলেছে
এমন কি আমাদের ...এই ভাষাগুলোর প্রিয় সন্তানদের--- জীবন মৃত্যুর পার্থক্য বোঝার ক্ষমতা?

এগুলো কি চমস্কি যেমনটি বলেছেন,
মানুষের সত্য সন্ধানের পথে  জীব বৈজ্ঞানিক ভাবে অপ্রতিরোধ্য এক একটা সিড়ি...
না, হয়ে পড়েছে আমাদের অহরহ আত্ম প্রবঞ্চনার নীরব সাক্ষী এবং অসহায় সহায়ক ?

( কবিতাটি ড০ হীরেন গোঁহাই সম্পাদিত ‘নতুন পদাতিক’ কাগজের  এপ্রিল,২০১০ সংখ্যাতে প্রকাশ পেয়েছে। ঋতুরাজ নিজেও কাগজটির সহ সম্পাদক।)
অনুবাদঃ ১৫-০৫-১০

Friday 14 May 2010

‘হৃদয়ে রবীন্দ্রনাথ, চেতনায় উনিশ’ : বাঙালির আত্মাভিমান, অসমিয়া উগ্রজাতীয়তাবাদ এবং রবীন্দ্রনাথের হৃদয় কথা



                   
             “আমাৰ ,ভাৰতবর্ষৰ এই খণ্ডৰ অধিবাসিসকলৰ, এই যে মাতৃভাষাবোৰঃ/অসমীয়া,মণিপুৰি,বাংলা,বডো,ভোজপুৰী,মিছিং,চিলেটী,নেপালী,খাচি,হিন্দী, ৰাজস্থানী,/কার্বী,তিৱা,ডিমাছা,জেমিনাগা,টাংখুল,আঙ্গামী,কুকি,মিজো,মনপা,ককবৰক…/আমাৰ অতিকৈ প্রিয় তথা পূজ্য।...” এভাবেই শুরু হয়েছে সুপরিচিত অসমিয়া তরুণ কবি ঋতুরাজ কলিতার এক আশ্চর্য সুন্দর গদ্য কবিতা। কবিতাটি দীর্ঘ। সবটা তুলে দেয়াটা এই প্রবন্ধের পক্ষে বিরক্তিকর হবে। আমি বরং প্রাসঙ্গিক ক’টা পংক্তি তুলে দিচ্ছি।“…তথাপি, কাকতৰ পাত তথা দূৰদর্শনৰ পর্দাত ভিন ভিন বাতৰিবোৰ দেখি-শুনি…আমাৰ মনত কিয় জানো এই সন্দেহ আহে/যে আমার এই ভাষাবোৰ/সঁচাকৈয়ে জানো প্রকাশ কৰিব পাৰে সকলোধৰণৰ মানুহৰ মর্মবেদনা?...।যদি প্রতিটো ভাষাই সকলোৰে সুখদুখ সমানেই প্রকাশ কৰিব পাৰিলেহেতেন/তিনিচুকীয়াৰ গাঁওবাসীৰ কণ্ঠত শুনিলোহেঁতেন জানো সেই সংগঠন আৰু সেই ব্যক্তিৰ বাবে জিন্দাবাদ ধ্বনি, যাৰ নির্দেশিত গণহত্যাত নিহত হৈছে তিনিচুকীয়াৰেই শতাধিক অন্যভাষী…বুজাব পাৰিছে জানো অসমৰ চৰ অঞ্চলৰ পৰা উজনিৰ ইটাভাটালৈ ট্রাকেৰে গৈ থাকোঁতে/বিদেশী আখ্যা দি যেয়ে –সেয়ে ঘন্টাৰ পিচত ঘন্টা ভোকে-পিয়াহে আৱদ্ধ কৰি ৰখাৰ যাতনা?...।”               
                    স্পষ্ট যে উগ্রজাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে কবি কন্ঠ সোচ্চার। ঋতুরাজ অসমের সর্বজন শ্রদ্ধেয় লেখক বুদ্ধিজীবী হীরেন গোহাঁই সম্পাদিত বহুল প্রচারিত ছোট কাগজ , ‘নতুন পদাতিকে’র অন্যতম সহযোগী সম্পাদকও বটে। কবিতাটি সে কাগজেরই সাম্প্রতিক সংখ্যাতে ( ১০ এপ্রিল,১০) প্রকাশিত হয়েছে। সুতরাং তিনি একেবারে যে সে ব্যক্তি নন।
               না, না। ঋতুরাজ কিম্বা তাঁর কবিতা আমাদের আলোচনার বিষয়ই নয়। আমাদের বিষয়, ‘সিলেটি’ শব্দটি। সে আবার বাংলার থেকে স্বতন্ত্র উল্লেখ করবার মতো আলাদা মাতৃভাষা হলো কবে? অনেক অসমিয়া লেখক বুদ্ধিজীবী ‘সিলেটি’কে বাংলার থেকে স্বতন্ত্র পূর্বোত্তর ভারতীয় ভাষা হিসেবে ভাবতে ভালোবাসেন। ‘নিন্দুকে’রা বলেন  এ হলো বাংলার থেকে আলাদা করে পরে অসমিয়ার স্বগোত্রীয় বলে চালিয়ে দিয়ে সেই ভাষাতেই মিলিয়ে দেবার পরিকল্পনা মাত্র। ঋতুরাজ কিম্বা তাঁর মতো বাম প্রগতিশীলদের কলমেও যখন সেই পরিকল্পনার ছায়ার দেখা মেলে তখন চোখ আমাদের একটু কোঁচকায় বটে। মনে হয় যেন বাম দক্ষিণ নির্বিশেষে অসমিয়া মানেই উগ্রজাতীয়তাবাদি। কিন্তু ব্যাপার এতো সহজ নয়। সে নিয়ে আমরা পরে আসছি।
   
                   সাম্প্রতিক অসমে ময়মন সিংহ থেকে ১৯৭১এর মার্চের আগে আসা মুসলমানেরা আদমসুমারীতে নিজেদের মাতৃভাষা কী লেখাবেন তাই নিয়ে আলো হাওয়া বেশ উত্তপ্ত হয়েছে। বছরের আগামীদিনগুলোতে  আরো হবে এই আশঙ্কাই করা যায়। যারা বলছেন, ‘বাংলা লেখান’ তাদের সম্পর্কে অসমিয়া ভাষার পক্ষের লোকেরা বলছেন এসব বরাক উপত্যকার বাঙালি উগ্রজাতীয়তাবাদীদের প্ররোচনা। অসমিয়া জাতিকে ভাঙ্গার ষড়যন্ত্র।এক বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য গড়বার সৎপ্রয়াসে বাঙালিরা জল ঢালছেন। অন্যদিকে এই ‘সৎপ্রয়াসকে’ বাঙালি মাত্রেই উগ্রজাতীয়াতাবাদ আখ্যা দিয়ে আসছেন। বলছেন,  এ হলো বাঙালির সংখ্যা কমিয়ে আধিপত্য বিস্তারের প্রয়াস মাত্র।  মুসলমানদের মধ্যে  যারা বলছেন, ‘অসমিয়া লেখান’-তাদের সম্পর্কে বাংলার পক্ষের লোকেরা বলছেন ‘বিশ্বাসঘাতক’! আর যারা বলছেন, ‘বাংলা লেখান’ তাদের সম্বন্ধেও অসমিয়ারা অন্যকোনো শব্দ ব্যবহার করছেনই না। অসমিয়ারা বলছেন এতোদিন ঘরের বাইরে অসমিয়া লিখে পড়ে কথা বলে এই মুসলমানেরা অসমিয়া হয়েই গেছেন। বিরুদ্ধবাদিরা জিজ্ঞেস করছেন, তবে যে মূলস্রোতের অসমিয়ারা ঘরের বাইরে ইংরেজিতে লেখা পড়া করছেন, কথা বলছেন তারা কি ইংরেজ হয়ে গেলেন?   ভোটের বাজার তাতে কতটা সরগরম হবে তাতো আগামি দিনে দেখাই যাবে। কিন্তু আপাতত যে এতে পত্রিকা কাগজগুলোর বাজার বেশ জমে উঠেছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।   কিন্তু যে ব্যাপারটি খোদ মুসলমানদেরকে ভাবাচ্ছে, বাঙালি বলে লিখলেও বরাকে ‘বাঙাল’ আর ব্রহ্মপুত্রে ‘বাংলাদেশি’ এই অবিধা তাদের যাবার নয়। কেউই তাদের পুরো বাঙালি কিম্বা পুরো অসমিয়া বলে মেনে নেবার মতো অবস্থাতে নেই। মেনে নেবেন এই আস্থাও কেউ যোগাবার মতো কোনো আয়োজন করছেন না। যার মারটা জোরালো, তার হাত থেকে বাঁচবার জন্যে তাঁদের দিকেই ঝুঁকে পড়বার সম্ভাবনাই বেশি এই মুসলমান মানুষগুলোর । অসমিয়ারা সংখ্যাগরিষ্ঠ । সুতরাং তাদের দিকেই ভিড়ে যাবার সম্ভাবনা যথারীতি প্রবল। যেমনটি তারা এতোদিন করে এসছেন। যদি তা না করেন তবে সে হবে এক ঐতিহাসিক ঘটনা। সেটি ভালো কি মন্দ হবে সে তর্ক আমরা আপাতত না হয় তুলছি না।
       এই মুসলমানেরা থাকেন মূলত ব্রহ্মপুত্রের চর অঞ্চলে। তাদের বেশির ভাগ আসলে গরীব কৃষক, জেলে। জল জমিতে কাজ না মিললে তারা পাথর ভেঙে বড়লোকদের গাড়ি চলবার পথ তৈরি করে দিতে ছড়িয়ে পড়েন পূর্বোত্তরের অন্যত্র। সেখানে তাদের কপালে কী জোটে ঋতুরাজ লিখেছেন সেটিই, “বুজাব পাৰিছে জানো অসমৰ চৰ অঞ্চলৰ পৰা উজনিৰ ইটাভাটালৈ ট্রাকেৰে গোই থাকোঁতে/বিদেশী আখ্যা দি যেয়ে –সেয়ে ঘন্টাৰ পিচত ঘন্টা ভোকে-পিয়াহে আৱদ্ধ কৰি ৰখাৰ যাতনা?...।” এসব দেখে শুনে অন্নদা শঙ্করের সেই কবিতাকে খানিকটা পালটে দিয়ে আবৃত্তি করতে ইচ্ছে জাগে, “তেলের শিশি ভাঙল বলে খোকার পরে রাগ করো?/ তোমরা যে সব বুড়া খোকা ‘অসম’ ভেঙে ভাগ করো।    তার বেলা? ”  এই গরীব মুসলমানেরা নিজেদের অসমিয়া লিখিয়ে পিঠ বাঁচাবার যে সংগ্রামটি করেন তা খুব কম বাঙ্গালি জাতি ভাইয়ের চোখে পড়ে। কেন না ভাষা কিম্বা ধর্ম যার আধারেই ‘জাতি’ গড়বার স্বপ্ন দেখুন সেই স্বপ্নদ্রষ্টারা শ্রেণিগত ভাবেই মধ্যবিত্ত। সেই শ্রেণি অবস্থান থেকে উপরে যত দূরেই তাদের চোখ যাক না কেন তলার দিকে সে চোখ পড়ে অতি অল্প।
           আমাদের নিজেদের ‘চোখ’কে নিয়ে খুব অহঙ্কার রয়েছে। নিজেদের খুব সত্যদ্রষ্টা বলে ভাবতে আমরা ভালোবাসি। প্রায়ই ধমকে দিয়ে পরকে বলি, ‘তুমি কি আমার থেকে বেশি জানো?” সত্য হলো, আমরা কেউই বেশি জানি না। ঋতুরাজ জানেন না যে ‘সিলেটি’ বাংলার এক উপভাষা মাত্র, আলাদা কারো মাতৃভাষা নয়। এই না জানার উপর ঋতুরাজের নিজের খুব একটা দখল নেই। তিনি সেই ছেলে বেলা থেকে স্কুল পাঠ্য সমস্ত অসমিয়া বইতে, সভা সমিতিতে সেরকমই শুনে এসছেন। অত্যুৎসাহীরা ‘সিলেটি’কেও অসমিয়ার উপভাষা  বলে বৃহৎ অসমিয়া জাতি গড়বার স্বপ্ন দেখেছেন , দেখিয়েছেন। কিন্তু যারা জানেন যে সিলেটিদের মধ্যে গরীব শ্রমিক, কৃষক থাকলেও এক শক্তিশালী মধ্যবিত্ত বৌদ্ধিক সমাজ রয়েছেন তারা সে উৎসাহ  খানিকটা দমিয়ে এনে একে বাংলার থেকে আলাদা ভাষা হিসেবে ভাবতে ভালো বেসেছেন। বানীকান্ত কাকতি কে বাদ দিলে আমি এখনো কোনো অসমিয়া বইতে একে বাংলারই এক উপভাষা বলে সানন্দ স্বীকৃতি দিতে দেখিনি। । ব্যাপারটার শুরু হয়েছিল সেই ১৯১৩তে । যখন বেনুধর রাজখোয়া সিলেট জেলা মেজিষ্ট্রেট ছিলেন, তিনি তখন একটি বই লেখেন যার নাম ছিলঃ Notes on the Sylheti Dialect . তিনি দেখিয়েছিলেন যে সিলেটি উপভাষাটি আদর্শ বাংলার থেকে অসমিয়ার অনেক কাছের ভাষা । তিনি বিশেষ করে উল্লেখ করেছিলেন যে সিলেটিরা শিষ ধ্বনি স (s) কে অসমিয়াদের মতো 'স' (X) উচ্চারণ করে । এরা অল্প /h/-এর দিকে হেলে পড়ে, আদর্শ বাংলার -'সে', 'ঐ',' সেইটি'---র বদলে তারা বলে, 'হি' /he/ ( অস. সি /xi/), হউ /hou/ (অস. সৌ /xou/) , হেইটো ( অস. সেইটো /xeito/) ইত্যাদি । বেনুধর রাজখোয়া অসমিয়া লিপিতে লেখা এক পুরোনো সিলেটি 'পদ্মাপুরাণে'র পাণ্ডুলিপিও দেখেছিলেন । তার পর একেবারেই সাম্প্রতিক গুয়াহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অসমিয়া বিভাগের অধ্যাপক ভাষাবিদ উপেন রাভা হাকাসামের বই ‘অসমীয়া আৰু অসমৰ তিব্বত বর্মীয় ভাষা’ এবং ‘অসমীয়া আৰু অসমৰ ভাষা-উপভাষা’ বই দুটিতেও বেনুধর রাজখোয়ার  সেই শতাব্দি প্রাচীন তত্বের প্রতিধ্বনি শোনা যাবে। মাঝখানের ভাষাবিদেরা এ নিয়ে কী লিখে গেছেন উপেন রাভা হাকাচাম থেকেই না হয় তার নজির টানা যাক , “ অবশ্যে পৰবর্তী কালত ড০ উপেন্দ্র নাথ গোস্বামীয়ে তেওঁৰ ‘অসমীয়া ভাষা আৰু উপভাষা’ (১৮৮৬)নামৰ পুথিত ড০  প্রমোদচন্দ্র ভট্টাচার্যৰ সুৰতে সুৰ মিলাই ক’বলৈ অকণো সংকোচ বোধ কৰা নাই যে “ কাছাৰী উপভাষাটো কামৰূপী উপভাষা আৰু অসমীয়া মান্য ভাষাৰ ওচৰ চপা। ইয়াত শতকৰা পয়সত্তৰটা শব্দ সজাতীয় শব্দ।” ( পৃঃ ১১; ‘অসমীয়া আৰু অসমৰ তিব্বত বর্মীয় ভাষা ) । এরা পণ্ডিত মানুষ। কিন্তু তা সত্বেও তাঁদের ‘চোখ’ যে সর্বত্রগামী হয় নি সেতো বেনুধর রাজখোয়ার ঐ ছোট্ট উল্লেখটিতেই স্পষ্ট। হেইটো ( অস. সেইটো /xeito/) সিলেটি শব্দই নয়। সিলেটি শব্দ হবেঃ হকটা বা হটা বা হিটা। তাঁর অসমিয়ার সাদৃশ্য সন্ধানী চোখ ‘হিটা’কে ‘হেইটো’ শুনেছিল।
          এমন সীমাবদ্ধতা প্রায় শতাব্দী পরের উপেন রাভাতেও রয়েছে। তিনি বাংলা বলে যে ভাষার নজির দিয়ে তুলনা টেনেছেন তা প্রায়ই বাংলা সাধু ভাষা। মুখের বদলে কৃত্রিম ভাবে গড়ে তোলা সাহিত্যের ভাষা। যেমন তিনি লিখেছেন, “ অসমীয়াৰ সৈতে সাদৃশ্য থকা প্রধান কেতবোৰ ৰূপতাত্বিক বৈশিষ্ট হ’ল—ভবিষ্যত কালৰ প্রথম পুৰুষৰ ৰূপ –ইমু ( যাইমু, কৰিমু),তু,অসমীয়া –ইম/ম কিন্তু বাংলা –ইব, দ্বিতীয় পুৰুষৰ ৰূপ –ইবা ( যাইবা, কৰিবা) তু, অসমীয়া-ইবা/বা কিন্তু বাংলা –ইবে, তৃতীয় পুৰুষৰ ৰূপ –ইব (কৰিব) ,তু অসমীয়া –ইব/-ব কিন্তু বাংলা –ইবে...” ( পৃঃ ১২’ঐ) এমন নজির তাঁর দুটো বইতেই প্রচুর রয়েছে। বস্তুত প্রায় সবই এরকম। প্রথম,দ্বিতীয়, তৃতীয় পুরুষ বিভাজন বাংলাতে নেই। আমি যদ্দুর জানি অসমীয়াতেও নেই। আসলে তিনি প্রথম বলতে উত্তম পুরুষ,দ্বিতীয় বলে মধ্যম আর তৃতীয় বলে প্রথম পুরুষ বুঝিয়েছেন সেটি অসমীয়া নজির থেকে স্পষ্ট। তাই যদি হয়, তবে উত্তম পুরুষে  আদর্শ চলিত বাংলার রূপ আসলে –ইব নয় -ব ( আমি যাব, খাব।) সাধু বাংলাতে –ইব ( যাইবে, খাইবে), তেমনি মধ্যম পুরুষের চলিত বাংলার ইবে নয়, বে ( তুমি যাবে, খাবে), প্রথম পুরুষের চলিত বাংলার রূপ  ইবে নয়, মধ্যম পুরুষের মতোই –বে ( সে যাবে, খাবে)। সিলেটি উদাহরণও যথাযথ নয় এখানে। মধ্যম পুৰুষৰ ৰূপ –ইবা এবং তার দৃষ্টান্ত মোটেও  যাইবা, কৰিবা –কোনোটাই নয়। সে হবে –ইও ( যাইও, করিও) । তৃতীয় পুরুষের ৰূপ অসমীয়ার মতোই –ইব/ব হয় বটে । কিন্ত ‘কৰিব’ শব্দটি তার দৃষ্টান্ত হতে পারে না। এটি একেবারেই উত্তম পুরুষের সাধু বাংলার রূপ, সিলেটি মোটেও নয়। সিলেটি হবে ‘ হে যাইব, করব, খাইব, মরব ইত্যাদি। অসমিয়াতে ‘সি কৰিব’, কিন্তু সাধু বাংলাতে , ‘আমি করিব’ ।  এ ধরণের দৃষ্টান্ত দেয়া আর সিদ্ধান্ত টানা থেকে একটা কথাতো পরিষ্কার যে উপেন রাভা অবরোহী পদ্ধতিতে অনুসন্ধান চালিয়েছেন।  অর্থাৎ, সিদ্ধান্ত কী টানতে হবে তাঁর আগেই জানা ছিল, পরে তিনি তার অনুকূলে দৃষ্টান্ত সংগ্রহ করে গেছেন। সেটি করতে গিয়ে সিলেটিকে যতটা পারেন অসমিয়ার মতো করে ফেলেছেন, আর বাংলাকে যতটা সম্ভব সাধু করে দূরে ঠেলে দিয়েছেন। তাতে অসমীয়া অক্ষত থাকলেও বাংলা বা সিলেটি কেউই তাদের যথাযথ রূপ এবং চরিত্রে তাঁর গ্রন্থে এসে উপস্থিত হয় নি।  বৈজ্ঞানিক নৈরাসক্তি তাঁর অধ্যয়নে পাওয়া যাবে না। তাঁর পরেও কিন্তু তাঁর মন্তব্য আমরা সিলেটিরা বুঝি যথেষ্ট বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান না করেই একটা ভুল ধারণা নিয়ে বসে আছি যে আমাদের মাতৃভাষা বাংলা। প্রমোদ চন্দ্র ভট্টাচার্যের একটি উদ্ধৃতি দিয়ে তিনিও   লিখেছেন, “এনেদৰে কাছাৰ অঞ্চলৰ ভাষা-উপভাষাৰ তুলনামূলক বিচাৰ-বিশ্লেষণ কৰিলে কাছাৰীয় উপভাষা সীমান্তৰ মাত -কথা  ৰূপে বঙলাতকৈ অসমীয়া ভাষাৰ ওচৰ চপা আৰু ঘনিষ্ঠ ৰূপ বুলি প্রমাণ কৰিব পাৰি... কিন্তু কাছাড় আৰু কৰিমগঞ্জ অঞ্চলৰ কথিত ভাষা-উপভাষাৰ বৈজ্ঞানিক আৰু ক্ষেত্র অধ্যয়নমূলক বিচাৰ বিশ্লেষণ নোহোৱাৰ বাবে,... পুৰণি ভুল ধাৰণাই এই অঞ্চলৰ কথিত ভাষা-উপভাষাক বঙলা  বুলিহে অভিহিত কৰি চৰকাৰী ব্যৱস্থা লোৱা হৈছে।” ( পৃঃ১২; ঐ)
            তাঁর নিজের অধ্যয়নই যে যথেষ্ট বৈজ্ঞানিক নয় সেতো পাঠক মাত্রেই আগে দেয়া নজির থেকে ধরে নেবেন। বোঝাই যায়  জাতীয়তাবাদ  তাঁর দৃষ্টিকে নিয়ন্ত্রিত আর সীমাবদ্ধ করেছে। এমন জাতি, বর্ণ, অঞ্চল, শ্রেণি বা অন্যান্য সামাজিক স্বার্থ আমাদের দৃষ্টিকে নিয়ন্ত্রিত করে বলেই সমাজ বিজ্ঞান আজো বিশুদ্ধ বিজ্ঞান বলে স্বীকৃতি পেলনা।“কাছাৰীয় উপভাষা সীমান্তৰ মাত -কথা  ৰূপে বঙলাতকৈ অসমীয়া ভাষাৰ ওচৰ চপা আৰু ঘনিষ্ঠ ৰূপ বুলি প্রমাণ কৰিব পাৰি...”-- তাঁর এই কথাৰ সঙ্গে কোনো বাঙালিই দ্বিমত পোষণ করবেন না। রবীন্দ্রনাথ অব্দি তাঁর প্রথম জীবনের এক রচনাতে  লিখেছেন, “ বীরভূমের কথিত ভাষার সহিত ঢাকার ভাষার যে প্রভেদ, বাংলার সহিত আসামির প্রভেদ তাহা অপেক্ষা খুব বেশি নহে।” (পৃঃ ৭৩৯, ভাষাবিচ্ছেদ;পরিশিষ্ট,শব্দতত্ব; রবীন্দ্ররচনাবলী, ৬ষ্ঠ খন্ড;১২৫তম জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে বিশ্বভারতী প্রকাশিত সুলভ সংস্করণ) ।   এই কথা প্রতিষ্ঠার জন্যে উপেন রাভার দরকার ছিলনা সিলেটি উদাহরণকে অসমিয়াপ্রায় আর বাংলা উদাহরণকে সাধু বাংলা করে দূরে ঠেলবার। এর পক্ষে তিনি  বহু বাংলা ভাষাবিদদের থেকেও নজির পেয়ে যেতেন। চাইকি শুধু সিলেটি কেন পূর্ব বাংলার আরো আরো উপভাষার অধ্যয়ন করলেও তিনি সেটা প্রমাণ করতে পারতেন। সম্ভবত চট্টগ্রামের ভাষার সঙ্গে আর বেশি। উপরে উল্লেখ করা প্রবন্ধেই রবীন্দ্রনাথই লিখেছেন, “ আসামিরা চ-কে দন্ত্য স ( ইংরেজি s) জ-কে দন্ত্য জ ( ইংরেজি z) রূপে উচ্চারণ করে , পূর্ববাংলাতেও সেই নিয়ম । তাহারা শ-কে হ বলে, পূর্ববঙ্গেও তাই। তাহারা বাক্য-কে ‘বাইক্য’, মান্য-কে ‘মাইন্য’ বলে, এ সম্বন্ধেও তাহার প্রভেদ দেখি না।”( (পৃঃ ৭৪১, ভাষাবিচ্ছেদ;ঐ) উপেন রাভা  বা বেনুধর রাজখোয়া কেউ ওতো দূর অব্দি তাকানই নি, কেননা তাঁদের দৃষ্টিকে নিয়ন্ত্রিত করেছে গেল এক দেড় শতকের অসমের রাজনৈতিক ইতিহাস আর মানচিত্র। সিলেট ১৮৭৪থেকে অসমের একেজেলা ছিল। আজো তার একটা অংশ অসমেরই অংশ। কিন্তু উপেন রাভা হাকাসামের, “পুৰণি ভুল ধাৰণাই এই অঞ্চলৰ কথিত ভাষা-উপভাষাক বঙলা  বুলিহে অভিহিত কৰি চৰকাৰী ব্যৱস্থা লোৱা হৈছে।” এই কথাতে অন্য বাঙালিতো বটেই সিলেটি মাত্রকেই ক্ষেপিয়ে তুলবার পক্ষে যথেষ্ট।  অথচ তাঁর উদ্দেশ্য এক বৃহত্তর  ঐক্য গড়ে তোলা।
             গেল বছর (১ সেপ্টেম্বর,২০০৯) তিনি আমাদের তিনসুকিয়া কলেজে ভাষা উপভাষার উপর এক বক্তৃতা দিতে আমন্ত্রিত হয়ে এসছিলেন। সেই সভাতে সিলেটি শ্রোতার সংখ্যা ছিল অতি নগন্য,ময়মনসিংহী কেউ তো ছিলেনই না। তাদের তুষ্ট করবার কোনো প্রশ্নই উঠেনা। তবুও তিনি  বেশ জোর দিয়েই নানা ভাষাতাত্বিক উদাহরণ দিয়ে দিয়ে বলেছেন, কৌনোজ থেকে আসা বহু মূলস্রোতের অসমিয়াদের থেকেও সিলেটিরা, ময়মনসিংহের লোকেরা এই অসমের মাটিতে বেশি প্রাচীন। বেশি ‘খিলঞ্জিয়া’।  মজার কথাটা হলো, এই সত্য কথাটা অসমের বহু সিলেটিও জানেনই না। তিনিতো ‘বাংলাদেশি’ বলে ময়মনসিংহীদের হেনস্থা করবার প্রয়াসের বিরুদ্ধেও তাঁর ক্ষোভ প্রকাশ্যেই জানিয়ে গেলেন।
              উপেন রাভার এই ‘সৎ উদ্দেশ্য’কে বহু সিলেটি তথা বাঙ্গালি  সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখতে চাইবেন। তাঁরা  ভেবে নেবেন যে যতই ভালো ভালো কথা বলুন লিখুন অসমিয়া মাত্রেই উগ্রজাতীয়তাবাদি। এই বাঙালিদের জন্যে এবারে আমরা বাংলার উগ্রজাতীয়তাবাদিদের খবর  জানাবো।
                 বরাক উপত্যকার ভাষাকে বাংলা বলে চালিয়ে দেবার চেষ্টাকে নিয়ে উপেন রাভার আক্ষেপের প্রতিধ্বনি শোনা যাবে বাংলার তথা কথিত কামরূপী উপভাষা তথা কামতাপুরি ভাষা নিয়ে সুধীর কুমার বিষ্ণুর করা এই মন্তব্যে , “ কামরূপী উপভাষাকে একটি প্রাচীন ও স্বতন্ত্র ভাষা রূপে দাবি করা হয়েছে, এর পেছনে দু’টি কারণ আছে  বলে আমার মনে হয়। প্রথমত, মাতৃভাষা সম্পর্কে মানুষের আবেগকে কাজে লাগিয়ে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনের চেষ্টা, দ্বিতীয়ত, ভাষা ও উপভাষা সম্পর্কে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির অভাব।” (পৃঃ ১৫৮, কামরূপী উপভাষা; সুধীর কুমার বিষ্ণু; উত্তর বঙ্গের ভাষা; সম্পাদক-রতন বিশ্বাস।)পাঠককে আমরা মনে করিয়ে দিতে চাই অসমের বরাকউপত্যকার রাজনৈতিক আর সামাজিক অবস্থান থেকে পশ্চিম বাংলার উত্তর ভাগের চেহারা চরিত্র খুব একটা পৃথক নয়। পিছিয়ে পড়া উত্তর বাংলাতেও কামতাপুরি ভাষার আন্দোলনকে কঠোর ভাবে দমন করে আসছে সেখানকার সরকার আর বাঙালি মধ্যবিত্ত। তবু বরাকে যারা ভাষার প্রশ্নে প্রচণ্ড আবেগিক,  যারা মুলতঃ লেখক বুদ্ধিজীবি, রাজনীতির সঙ্গে চোখে পড়ার মতো  সম্পর্ক যাদের অতি অল্প তাদের আমরা সেই উত্তর বঙ্গের বাস্তবতার সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করতে  দেখিই না। তাঁরা মাঝে মধ্যে স্লোগান তোলেন বটে , “মাতৃভাষা প্রাণের ভাষা। এ ভাষায় আছে অধিকার সকল জাতির সকল জনতার।” কিন্তু সেটি কতটা আন্তরিক তাঁর পরীক্ষা দেবার এখনো অনেক বাকি। বরাকের মণিপুরি ভাষাকে সরকারি ভাষা করবার প্রস্তাব সম্ভবত এখনো তাদের কোনো কল্পনাতেই নেই। কেউ সে প্রস্তাব দিলেও তিনি কতটা সমাদৃত হবেন তা এখনো দেখার বাকি।    তাঁরা বরং অতি আগ্রহী কলকাতার প্রতি। কারণ কলকাতাই বাংলার সাংস্কৃতিক রাজনীতির রাজধানী! যার একটা শাখা তারা খুলে চালাতে চাইছেন শিলচরে।  কথাগুলো কটু, অপ্রিয়। কিন্তু সত্য।
             খুব কম বাঙালিই সুধীর বিষ্ণুর মন্তব্যে সহজে কোনো ত্রুটি দেখতে পাবেন, বরং বৃহৎ বাঙালি ঐক্যের স্বার্থকে উর্ধে তুলে ধরবার জন্যে বাহবাই  দেবেন। তবু যদি কেউ ভেবে থাকেন যে অধ্যাপক সুধীর বিষ্ণু নিশ্চয়ই কোনো এলেবেলে লোক তাদের জন্যে আমরা এবারে এক মোক্ষম উদাহরণ তুলে ধরব। সেটি আর কেউ নন, স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের থেকে । রবীন্দ্রনাথের যে উদ্ধৃতি দু’টো এ অব্দি তুলে দিলাম যাতে মনে হতে পারে যে তিনিও ভাষাদু’টোর মিত্রতার    জয়ধ্বজা তুলবার মহান ব্রত কাঁধে তুলে নিয়েছেন, তাঁর সেই লেখার মধ্যেই পাওয়া যাবে বেনুধর রাজখোয়া বা উপেন রাভা হাকাসামের মন্তব্যগুলোর শেকড় বাকড়ের খোঁজ , “... আসাম ও উড়িষ্যায় বাংলা যদি লিখন পঠনের ভাষা হয় তবে তাহা যেমন বাংলা সাহিত্যের পক্ষে শুভজনক হইবে তেমনিই সেই দেশের পক্ষেও। কিন্তু ইংরেজের কৃত্রিম উৎসাহে বাঙ্গলার এই দুই উপকণ্ঠবিভাগে একদল শিক্ষিত যুবক বাংলা প্রচলনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহধ্বজা তুলিয়া স্থানীয় ভাষার জয়কীর্তন করিতেছেন।” অসমিয়া বা ওড়িয়া ভাষাতে যে কোনো বড় কাজ করা যেতে পারে সেটি রবীন্দ্রনাথ তখন ( ১৩০৫ বাংলা) বিশ্বাসই করতে পারতেন না । তিনি লিখেছেন, “ এ কথা আমাদের স্মরণ রাখা উচিত যে দেশীয় ভাষা আমাদের রাজভাষা নহে, যে ভাষার সাহায্যে বিদ্যালয়ের উপাধি বা মোটা বেতন লাভের আশা নাই। অতএব, দেশীয় সাহিত্যের একমাত্র ভরসা তাহার প্রজাসংখ্যা, তাহার লেখক ও পাঠক সাধারণের ব্যাপ্তি। খন্ড বিচ্ছিন্ন দেশে কখনোই মহৎ সাহিত্য জন্মিতে পারে না। তাহা সংকীর্ণ গ্রাম্য প্রাদেশিক আকার ধারণ করে। তাহা ঘেরো এবং আটপৌরে হইয়া উঠে, তাহা মানব-রাজদরবারের উপযুক্ত নয়।” (পৃঃ ৭৪১, ভাষাবিচ্ছেদ;ঐ)
             এ বছর সমগ্র অসমেও রবীন্দ্রনাথের সার্ধশতবর্ষ যথেষ্ট সম্মানের সঙ্গে পালিত হচ্ছে আর হবে। অসমিয়া মানুষও তার উদ্যোগ নিচ্ছেন। ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার  প্রায় প্রতিটি সঙ্গীত বিদ্যালয়ে রবীন্দ্রসঙ্গীতের পাঠ দেয়া হয়ে থাকে।  তিনি  যে প্রতিটি অসমিয়া মনে জ্যোতি প্রসাদ বিষ্ণুরাভার থেকে মোটেও কম শ্রদ্ধার আসনে বসে নেই তার কারণ ঘটনাক্রম সেই ১৩০৫ সনে রবীন্দ্রনাথের আশা করা মতো ঘটেনি,  রবীন্দ্রনাথও তাঁর তখনকার অভিমত আঁকড়ে ধরে থাকেন নি। ঐ প্রবন্ধটি লেখার সময় অব্দি এমন কি ১৯০৫এর বাংলা ভাগ বিরোধী আন্দোলনের সময় অব্দি তিনি সমকালীন উগ্র ভারতীয় তথা বাঙালি  জাতীয়তাবাদের সঙ্গে ছিলেন। এমনকি ইউরোপীয় জাতি-রাষ্ট্রের ধারণার প্রতিও তাঁর অগাধ শ্রদ্ধা ছিল। ওই প্রবন্ধেই তিনি লিখছেন, “ বৃটিশ দ্বীপে স্কটল্যান্ড, আয়র্ল্যান্ড ও ওয়েলসের স্থানীয় ভাষা ইংরেজি সাধুভাষা হইতে একেবারেই স্বতন্ত্র। তাহাদিগকে ইংরেজির উপভাষাও বলা যায়  না। উক্ত ভাষাসকলের প্রাচীন সাহিত্যও স্বল্পবিস্তৃত নহে। কিন্তু ইংরেজের বল জয়ী হওয়ায় প্রবল ইংরেজিভাষাই বৃটিশ দ্বীপের সাধুভাষারূপে গণ্য হইয়াছে। এই ভাষার ঐক্যে বৃটিশ যে উন্নতি ও বললাভ করিয়াছে, ভাষা পৃথক থাকিলে তাহা কদাচ সম্ভব হইত না।” এটি এক উজ্জ্বল প্রমাণ যে ভারতে ‘জাতি গঠনে’র ধারণাটি একটি ইউরোপীয় আমদানি। রবীন্দ্রনাথের নিজেরই পরের রচনাগুলোতে তার স্বীকৃতি ও উল্লেখ অজস্র আছে। জাতি রাষ্ট্রের ধারণা এক ইউরোপীয় এবং বর্বর ধারণা। যেখানেই সে ধারণা গেছে সঙ্গে করে মৃত্যু আর ধ্বংস ছাড়া আর কিছুই নিয়ে যায় নি। আমরা সবাই জানি এখানে যে  ‘ইংরেজের বলে’র তিনি ভূয়সী প্রশংসা করছেন তাকেই তিনি ‘অজগর সাপের ঐক্য নীতি’ বলে পরের জীবনে ক্ষোভ প্রকাশ করছেন। জীবনের শেষে ‘সভ্যতার সংকট’ অব্দি আসতে আসতে সেই ক্ষোভ অভিশাপে পরিণত হয়েছে। কেবল অসমীয়ারা ক্ষুন্ন হয়ে আছে বলেই তিনি অসমীয়াকে স্বতন্ত্র ভাষা বলে মেনে নিয়েছেন তা নয়। তিনিই প্রথম আবিষ্কার করেছেন ‘বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য’ই আমাদের দেশের মূল সুর।পরের স্বাতন্ত্র্য স্বীকার করে নিয়ে তাকে আপন করবার প্রতিভাটা ভারতের নিজস্ব প্রতিভা।  আমরা যে রচনার থেকে তাঁর উদ্ধৃতিগুলো দিলাম সে লেখাটিও তাই পরে পরিত্যক্ত হয়েছিল। শুধু ঐতিহাসিক সত্যতার দায়ে ১২৫তম জন্মজয়ন্তীর  সময় প্রকাশিত সুলভ সংস্করণের সম্পাদকেরা একে পরিশিষ্টে ঠাই দিয়েছেন।
          অসমীয়া ভাষাতে গ্রন্থ প্রকাশের বিষয়ে লক্ষীনাথ বেজবরুয়ার সঙ্গে কথা প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ কিছু বিরূপ মন্তব্য করেছিলেন। তাঁর আশঙ্কা ছিল এমন করে সবাই যদি বাংলা ছাড়তে শুরু করে তবে আর বাংলা সাহিত্য বলে কিছু টিকে থাকবে না। এই কথাগুলো অসমিয়া পন্ডিতদের মধ্যে বহুবার বহুভাবে আলোচিত হয়েছে। লোক সংস্কৃতির প্রখ্যাত গবেষক, অসম সাহিত্য সভার প্রাক্তন সভাপতি অধ্যাপক বীরেন্দ্রনাথ দত্তের কথাতে রবীন্দ্রনাথের এই সব মন্তব্য “ কিছুদূৰ বৈষয়িক ধৰণৰহে আছিল। আৰু সেয়া আছিল কবিৰ আগ বয়সৰ কথা । ৰবীন্দ্রনাথেৰ পৰিণত চিন্তাত আন এখন ছবিহে ফুটি উঠে । প্রত্যেক আঞ্চলিক ভাষাই সমৃদ্ধি লাভ কৰক আৰু তাৰ মাজতেই সাংস্কৃতিক-ভাষিক বিস্তৃতি লাভ কৰক-কবিয়ে মনে প্রাণে তাকেই কামনা কৰিছিল” ( অসমীয়া আৰু বাঙালীৰ সম্পর্কঃ এক ঐতিহাসিক বিহঙ্গম দৃষ্টি; সাতসৰী, ১৬-৩১ ডিসেম্বর সংখ্যা,২০০৭, পৃঃ২০)
           যারা ভাবেন যে কোনো এক ভাষাতে বেঁধে ফেলতে পারলেই এক সর্বভারতীয় ঐক্য দাঁড়িয়ে যাবে তাদের সে  উগ্রজাতিয়তাবাদি ধারণার বিরুদ্ধে যে রবীন্দ্রনাথ যে কেমন সোচ্চার ছিলেন তার কথা বলতে গিয়ে ওই একই লেখাতে বীরেন্দ্রনাথ প্রভাত কুমারের ‘রবীন্দ্র জীবনকথা’ থেকে এক উদ্ধৃতি দিয়েছেন, “ কবি বলেন, ভারত ব্যাপী মিলনের একটা ভারতীয় ভাষা করবার কথা হচ্ছে। তাঁর মতে এতে করে যথার্থ সমন্বয় হতে পারে না, হয়তো একাকারত্ব ( uniformity ) হতে পারে, কিন্তু একত্ব (unity) হতে পারে না। দড়ি দিয়ে বাঁধা , মিলনের প্রয়াস মাত্র। সে মিলন শৃঙ্খলের মিলন অথবা বাহ্য শৃঙ্খলার মিলন মাত্র। তবে প্রবাসী বাঙালিদের উদ্দেশে কবি বললেন, তাঁরা যেন যে দেশে বাস করেন সে দেশ সম্বন্ধে উদাসীন না থাকেন। তিনি বললেন, প্রায়ই দেখা যায় বাংলার বাইরে যেখানে বাঙালিরা থাকেন তার ভাষা সাহিত্য তথ্যাদি সম্বন্ধে তাঁদের একটা ঔদাসীন্য আছে; এই উদাসীনতা বা অবজ্ঞা অজ্ঞতারই নামান্তর। বাঙালির প্রধান রিপু এই আত্মাভিমান।”
              ঔদাসীন্যের কথা যখন এলোই তবে উল্লেখ করে রাখা মন্দ হবে না যে রবীন্দ্রনাথের  ভাষাবিজ্ঞানেরও ভালোই অধ্যয়ন ছিল। প্রখ্যাত ভাষাবিজ্ঞানী সুকুমার সেনের কথায়, ঐ অধ্যয়নগুলোর কথা মনে রাখলে, “রবীন্দ্রনাথকে বাঙ্গালী ভাষাবিজ্ঞানীদের মধ্যে প্রথম বলিতেই হয়।” ( বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস; চতুর্থ খন্ড; পৃঃ৪১৫) তাঁর সেই অধ্যয়নের মধ্যে অসমিয়া ভাষাও রয়েছে। ‘বিলাক-বোৰ’ ইত্যাদি অসমিয়া বহুবচন প্রত্যয়ের উৎস সন্ধানে তিনি বেশ নিবিড় অনুসন্ধান চালিয়েছিলেন। অসমিয়া ভাষা নিয়ে নাথান ব্রাউনের ব্যাকরণ তাঁর আয়ত্বে ছিল।
এখন কথা হলো, উপেন রাভা হাকাচামের মতো অসমিয়া কিম্বা সুধীর বিষ্ণুর মতো বাঙালি ভাষাবিদেরা কি তাদের ‘শৃঙ্খলের মিলন’ তত্ব ছাড়তে রাজি রয়েছেন? রাজি আছেন কি, ‘একাকারত্বে’র ( uniformity ) তত্বকে ধুলোয় মিলিয়ে  একত্ব (unity) প্রতিষ্ঠার পথে পা বাড়াতে?  উনিশে মে’র পঞ্চাশ বছরকে সামনে রেখে এক দল সাংস্কৃতিক কর্মী সারা বরাকের শহরগুলোতে বিশেষ করে শিলচরে একটি স্লোগান দিচ্ছেন দেখা যাচ্ছে, ‘হৃদয়ে রবীন্দ্রনাথ চেতনায় উনিশ’।  ভালো কথা। কিন্তু এমন চিহ্নায়নের নানান  অর্থ হতে পারে। আমজনতার কাছে যে সোজা অর্থটা সোজাসুজি পৌঁছুবে তা এই যে রবীন্দ্রনাথ বাংলা ভাষার কবি, উনিশ সেই ভাষার অধিকার রক্ষার জন্যে রক্ত দেবার দিন। সুতরাং যে কোনো মূল্যেই বাংলার জন্যে লড়াইটা চালিয়ে যেতেই হবে। তাতেও মন্দ কিছু নেই।
              কিন্তু হৃদয়ে রবীন্দ্রনাথ কথাটার অর্থতো অনেক ব্যাপক। কেবল বাংলা ভাষার অধিকারের কথা বলা হলো গে রবীন্দ্রনাথকে হত্যা করা। মনে কি পড়ে রবীন্দ্রনাথের সেই আক্ষেপ, ‘সাত কোটি সন্তানেরে হে মুগ্ধ জননী, রেখেছো বাঙালি করে ,মানুষ করোনি।” সেদিকে খেয়াল আছে তো? ‘বাঙালির প্রধান রিপু এই আত্মাভিমান’ –এর বিরুদ্ধেও লড়াইটা সমানে হয়ে উঠবে কি? উঠছে কি?  মণিপুরি, ডিমাসাদের হৃদয়ের কথাতে কান পাতা হচ্ছে কি? রবীন্দ্রনাথের কথাগুলো অসমিয়া হৃদয়েও পৌঁছে দেবার কাজটা হয়ে উঠবে তো? বাঙালিদের মনে অসমিয়া জাতীয়তাবাদের আগ্রাসনের আতঙ্ক রয়েছে। কিন্তু অসমিয়া মনেও যে বাঙ্গালির আত্মাভিমানের আতঙ্ক রয়েছে তার প্রতি কোনো সম্মান আর সহানুভূতি রয়েছেতো?  অষ্টাদশ শতকের তিন দশক প্রাদেশিক ভাষা হিসেবে বাংলার স্বীকৃতি থাকবার পর যখন তাকে তুলে দেয়া হয়েছিল তখন বহু বাঙালি এর বিরোধীতা করেছিলেন এই যুক্তিতে যে  অসমীয়ার স্বতন্ত্র ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পাবার কোনো যোগ্যতাই নেই। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অসমিয়া চালু করতে গিয়ে আশুতোষ বন্দোপাধ্যায়কেও দিনেশ সেনের মতো পন্ডিত মানুষের  বিরোধীতার অনেক কাঠখড় পোহাতে হয়েছে সেই ইতিহাস  আমরা জানি তো? আমরা কি সত্য তার কোনো সমাধান বের করেছি, না বের করতে আগ্রহী? মুসলমানেরা আদমসুমারিতে নিজের মাতৃভাষা বাংলা লেখালে অসমিয়ারা আর  অসমিয়া লেখালে বাঙালিরা কি  ‘বিশ্বাসঘাতক’ বলে গাল দিয়েই যাব,  না এর উর্ধে গিয়েও কিছু ভাবব?
          বছর কয় আগে ভাষার দাবিতে কামতাপুরিদের ডাকা এক বন্ধের সময় আমার এক বামপন্থী অসমিয়া সহকর্মীর সঙ্গে ওদের মাতৃভাষা কী, তাই  নিয়ে তর্ক হচ্ছিল। তিনি বলছিলেন, ওদের ডাকা বন্ধের কোনো বৈধতা নেই। ওরা অসমিয়া ভাষাকে ভাঙ্গবার ষড়যন্ত্র করছে। আমি বলছিলাম, “ওদিকে আপনাদের পশ্চিম বাংলার কমরেডরা বলবেন ওরা ‘বাঙালি’, এদিকে আপনারা অসমের কমরেডরা বলবেন ওরা ‘অসমিয়া’। ওদিকে বুদ্ধদেব সরকার বলবে ওরা ‘বাঙালি’, এদিকে তরুণ গগৈ সরকার বলবে ওরা ‘অসমিয়া’। ওরা বেচারা যাবে কোনদিকে ?   ভালো হয় না কি ওরা কি সেটা ওদেরই ঠিক করতে দেয়া?” তিনি খুব চটে গেছিলেন। যুক্তিতে না পেরে বলছিলেন , “আপনি আসলে অসমিয়া স্বার্থ বোঝেন না। বোঝবেন কী করে? নিজেই তো বাঙালি উগ্রজাতিয়তাবাদ ছাড়তে পারেন নি।“ আমি বললাম, “সেটি কীরকম?”             উনি বললেন, “আপনি এখনো ‘অহমিয়া’ বলে যাচ্ছেন! বলুন অসমিয়া ,যেমন বলেন ‘অস’মিয়া’ ( oxomia)।” আমি যতই বল্‌ আমি এখনো অসমিয়া ‘স’ উচ্চারণ করতে শিখিনি,; উনি বলে গেলেন , “আপনি ইচ্ছে করেই বলছেন না! বলুন ‘অসমিয়া!’”
          ভাবছি আমার এই লেখা পড়বার পর আমার অসমিয়া কিম্বা বাঙালি বন্ধু, যারা ভাষার প্রশ্নে খুবই স্পর্শকাতর, জোর গলায় ধমকে দিয়ে বলবেন নাতো, ‘থামুন মশাই! চুপ করুন। একদম বাজে কথা বলবেন না! এক্কেবাৰে কথা নক’ব!” রবীন্দ্রনাথ যেভাবে অসমিয়া হৃদয় জয় করে নিলেন আমরা কি তার থেকে শিক্ষা নিয়ে  পরস্পরের হৃদয় জয় করতে  এক্কেবারেই অপারগ? অক্ষম?! 
(লিখে শেষ ঃ ১৪-০৫-১০)