আমার চেতনার রঙে রাঙানো এই খেলা ঘরে:

~0~0~! আপনাকে স্বাগতম !~0~0~

*******************************************************************************************************

Saturday 16 April 2011

অসমিয়া ভাষা, সিলেটি উপভাষা এবং অসমে ভাষাচর্চার রূপরেখা 0২


                  ( বাঙাল নামার জন্যে লেখা ধারাবাহিক। আগের লেখাটি এখানে পড়ুন)
                     ৯১৩ তে প্রকাশিত বেণুধর রাজখোয়ার ' Notes on the Sylhetee Dialect' এর উপর নির্ভর করেই প্রায় সমস্ত অসমিয়া ভাষাবিদ সিলেটিকে অসমিয়ার উপভাষা বলে দাবি করে থাকেন। প্রখ্যাত অসমিয়া ভাষাবিদ কটন কলেজের প্রাক্তন অধ্যাপক ড রমেশ পাঠকও এক্কেবারে সন তারিখ দিয়ে দাবি করেছেন , “ চিলেটর ভাষার সৈতে অসমীয়া ভাষার সম্পর্ক বর্তমান অবস্থাত বিচারিবলৈ যোয়াটো পর্বতত কাছকণী বিচারিবলৈ যোৱাৰ দরে হ', কারণ বাংলা ভাষাই চিলেটী ভাষার রূপ এনেদরে সলাই পেলাইছে যে চিলেটী এতিয়া বাংলা ভাষারে আঞ্চলিক রূপ মাথোন। অথচ, ১৯১৩ চনলৈকে চিলেটী ভাষা অসমীয়া ভাষার সৈতে অদ্ভূৎ ধরণে মিলিছিল। ... ১৯১৩ চনত ওলোয়া বেণুধর রাজখোয়াৰ Notes on Sylhetee Dialect বোলা গ্রন্থখনৰ পরা তথ্যবোর দিয়া হৈছে। ...” ( পৃঃ ১৫৯; উপভাষা বিজ্ঞানের ভূমিকা ।) তার মানে ১৯১৩তে যেহেতু বেনুধর রাজখোয়ার বইটি বেরিয়েছিল সুতরাং ওই পর্যন্ত ভাষাটি অসমিয়া ছিল। তার পর থেকে একে বাংলা গ্রাস করেছে । এরকম ভাষাগ্রাস করা সম্ভব কিনা, সিলেটির মধ্যে আদৌ তেমন অস্বাভাবিক কিছু পরিবর্তন হয়েছে কিনা এই সব ভাষাতাত্বিক প্রশ্ন এক পাশে সরিয়ে রেখেও যে বিপজ্জনক আশঙ্কাটি তাঁর লেখাতেও স্পষ্ট যে এমন ভাষা তত্ব অহেতুক সাধারণ অসমীয়াদের মনে বাংলা সম্পর্কে এক আতঙ্ককে লালন করতে সাহায্য করে। ড রমেশ পাঠকেরও মন্তব্যেরই মাঝের অংশে রয়েছে, “ চিলেটত যি ঘটিছিল বা ঘটিল তেনে ঘটনার প্রক্রিয়া কাছারতো আরম্ভ হৈছে...।” আমরা কিন্তু এখনো ড রমেশ পাঠকের মতো এতোটা হতাশ হয়ে মনে করিনা যে সিলেটির সঙ্গে অসমিয়ার সম্পর্ক সন্ধান করতে যাওয়াটা পর্বতে কচ্ছপের ডিম সন্ধানের মতো ব্যাপার।এতোটা মৌলিক পরিবর্তন দুই ভাষার কোনোটিরই ঘটেনি । যে বেনুধর রাজখোয়ার Notes -এর উপর তাঁদের এতো আস্থা তিনি ওই গ্রন্থটি রচনার তের বছর পরেই অসম সাহিত্য সভার নবম ধুবড়ি অধিবেশনের সভাপতির দায়িত্বে ছিলেন। ওখানে যা ঘটেছিল তা খুব গৌরব জনক ছিল না । তখনো অসমে অসমিয়া বাঙালি বিভাজন ততটা স্পষ্ট ছিল না । অসমিয়াদের অনেকেই যেমন সানন্দে বাংলা ভাষা সাহিত্য চর্চা করতেন , বাঙালিদের অনেকেও তেমনি অসমিয়াদের যেকোনো সাংস্কৃতিক উদ্যোগে সহায় সম্বল জোটাতেন। সেই সম্পর্কে যারা ভাঙ্গন আনতে চাইছিলেন তাঁদের অন্যতম গোয়ালপাড়াতে অনুষ্ঠিত ধুবড়ি অধিবেশনের সভাপতি বেনুধর রাজখোয়া । ডদেবব্রত শর্মা লিখছেন , “রাজখোয়াই বঙালি লিখকর কিবা যুক্তির দোষ দেখুয়াই এটা কথা লিখিছিল। এই কথাত উপস্থিত বঙালী লোক সকলে অতি বেয়া পালে । ইয়ার প্রতিবাদত বাঙালী ভদ্রলোক এজনে কথা ক'বলোই উঠিলৎ সভাপতি রাজখোয়াই ক'বলৈ নিদি বহুয়াই থ'লে” ( পৃঃ ২৫০, অসমীয়া জাতি গঠন প্রক্রিয়া আরু জাতীয় জনগোষ্ঠীগত অনুষ্ঠান সমূহ।) তাতে বেশির ভাগ মানুষ সভা ছেড়ে বেরিয়ে গেছিলেন। সভা নেতৃত্ব এতে বিব্রত বোধ করলেন এবং পরদিন যাতে বেনুধর রাজখোয়া নিজের মন্তব্যের জন্যে দুঃখ প্রকাশ করে বিবৃতি দেন তার ব্যবস্থা করেন। খসড়া বিবৃতিটি সেখানে উপস্থিত বাঙালি নেতৃত্বকে দেখিয়েও অনুমোদন নেয়া হয়েছিল। কিন্তু সেই বিবৃতি পাঠ করতে গিয়ে বেনুধর রাজখোয়া যা বললেন নিজের ভাষ্যতে দেবব্রত শর্মা লিখছেন, “ বাঙালি সকলে নিজকে জাপানীসকলর লগত তুলনা করার সম্পর্কে ইতিকিং করি রাজখোয়াই ক'লে জাপানী আরু বাঙালি দুয়ো জাতিয়ে মাছ খায় বুলিয়েই বাঙালি জাপানী হ'ব নোয়ারে; কারণ তেনেহ'লে মেকুরী আরু বাঙালী দুয়ো মাছ খায় বাবে বাঙালী মেকুরী হ'ব লাগিব।” এর পরের ঘটনাবলী থামাতে রীতিমতো পুলিশ ডাকতে হয়েছিল। শরৎচন্দ্র গোস্বামী আক্ষেপ করে লিখেছেন , “ তার ফল থাকিল বহুদিন প্রকৃততে আজিলৈ। ...সাহিত্য সন্মিলনর পাছত অসমীয়ার বিপক্ষে এটা ডাঙর দল হ'ল।” ( পৃঃ ২৫১; ) । সুতরাং Notes on Sylhetee Dialect এর লেখক যে অন্যকে অসমিয়ার কাছে টেনে আনবার কলা খুব ভালো জানতেন না তথ্য তা প্রমাণ করে। যে যুক্তিতে একটু কটু ভাষাতে বললেও তিনি 'বাঙালী''মেকুরী' হবার সম্ভাবনা নাকচ করছেন সেইসব যুক্তি কিন্তু তিনি নিজেই ঐ Note লিখবার বেলা ভুলে বসেছিলেন। বস্তুত, রমেশ পাঠক যেভাবে লিখেছেন, সিলেটিকে বাংলা ভাষা গ্রাস করেনি। যদিও বা সিলেটির অসমীয়ার ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠার কোনো সম্ভাবনা ছিল সেই সম্ভাবনার চারা গাছকে মেরে ফেলার রাজনৈতিক আয়োজনও কিন্তু শুরু হয়েছিল ১৯২৬ থেকেই। সে বছরের অসম বিধান পরিষদের নির্বাচনেই অন্যতম দাবি ছিল শ্রীহট্টকে অসম থেকে বাদ দেয়া । ত্রিশের দশকে গোপীনাথ বরদলৈ যখন আসাম এসোসিয়েসন নতুন করে গড়ে তোলেন তখন থেকেই তাঁর অন্যতম প্রয়াস ছিল সিলেটকে অসম থেকে বের করে দেয়া । এরকম দাবির জন্যেই দেশ ভাগের সময় একমাত্র অসমেই সিলেটে গণভোট হয়েছিল। আর তাতে সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী গোপীনাথ বরদলৈ ।ঐ ঘটনা অসমে থেকে যাওয়া অংশের সিলেটিদের মনেও যে গভীর বিয়োগান্তক দাগ বসিয়ে দিয়েছে সেই তথ্যকে গোপন করে সিলেটি কেন বাংলা হয়ে গেল তার দায় বাংলা ভাষার উপর চাপিয়ে দেয়া এক্কেবারেই ঐতিহাসিক সত্যও নয়, শুভফলদায়কও নয়।

  সিলেটিকে কিছু ভাষাতাত্বিকেরা অসমিয়া বলে দাবি করলেও রাজনীতির মধ্যবিত্ত লোকেরা বাংলা বলেই জেনে এবং মেনে এসছিলেন। এবং তাদের ভয় ছিল সিলেট অসমে থাকলে অসমীয়া মধ্যবিত্তকে বাঙালির অধীনস্থ হয়ে থাকতে হবে । আজ আমরা কল্পনা করতে পারি, সিলেট ভারতে থেকে গেলে এতোদিনে কম করেও এক কোটি মানুষের আলাদা প্রদেশ হয়ে যেতে পারত। কিন্তু তখন সেটি কল্পনা করা মুস্কিল ছিল। বরং ব্রিটিশ প্রশাসনে সিলেটিদের আধিপত্য যেরকম ছিল তাতে অসমিয়া মধ্যবিত্তের সেই আশঙ্কা একেবারেই অমূলক ছিল না ।
অসমিয়াদের সম্পর্কে এরকম উক্তি কোনো বাঙালি লেখক বুদ্ধিজীবি করেছেন কিনা আমরা বহু সন্ধান করেও এ অব্দি পাই নি। সেরকম কিছু থাকলে অন্তত দেবব্রত শর্মার ঐ বহু অধিত গ্রন্থ কিম্বা ডপ্রফুল্ল মহন্তের 'অসমীয়া মধ্যবিত্ত শ্রেণির ইতিহাস গ্রন্থে' পাওয়া যেত। ডপ্রফুল্ল মহন্ত বরং গৌরবের সঙ্গেই লিখেছেন, “ অসমত বাঙালী সকলেই আছিল আধুনিকতার অগ্রদূত আরু বৃটিশর পিছতে তেওঁলোকেও এক সামাজিক মর্যাদা লাভ করিছিল। সেইকালত নিশ্চয় (অসমিয়া) অভিজাত সকলে বাংলা ভাষার জ্ঞান আয়ত্ব্ব করাটো আরু বাঙ্গালিক অনুকরণ করাটোক আধুনিক আভিজাত্য বা সামাজিক মর্যাদার প্রতীক হিচাপে গণ্য করিছিল।” ( পৃঃ ১৯২, অসমীয়া মধ্যবিত্ত শ্রেণির ইতিহাস ।) কিন্তু বিশ শতকের শুরু থেকেই উদীয়মান অসমিয়া মধ্যবিত্ত বাঙালি উন্নাসিকতার আঁচও পেতে শুরু করেছিলেন। এও তেমনি সত্য । স্বাধীনতার পরবর্তী কালে গুয়াহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষার পঠনপাঠনের অধিকার লড়াই করে আদায় করতে হয়েছিল, শিলচরের অসম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাও বহু লড়াইয়ের ফলেই সম্ভব হয়েছে। এ নিয়ে অসমের সিলেটিদের ক্ষোভ ব্যাপক। কিন্তু এই বিরোধের উত্তরাধিকার কিন্তু বাঙালিদের থেকেই পাওয়া । কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অসমিয়া ভাষা সাহিত্য অধ্যয়নের বিরোধীদের অন্যতম ছিলেন একজন ঢাকাইয়া দীনেশ চন্দ্র সেন। কলকাতার মধ্যবিত্ত বাঙালির এক বড় অংশ যেমন ঢাকা , তেমনি গুয়াহাটিতেও বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের বিরোধী ছিল। গুয়াহাটিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রসঙ্গ উঠলে সিলেটিদের একাংশ দাবি তুলেছিল সেটি স্থাপিত হওয়া উচিত সিলেটে । আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের বদান্যতাতেই অসমিয়া ভাষা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে যেমন অন্তর্ভূক্ত হয়েছিল, তেমনি গুয়াহাটিতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হতে পেরেছিল।
                সেইকালত নিশ্চয় (অসমিয়া) অভিজাত সকলে বাংলা ভাষার জ্ঞান আয়ত্ব্ব করাটো আরু বাঙ্গালিক অনুকরণ করাটোক আধুনিক আভিজাত্য বা সামাজিক মর্যাদার প্রতীক হিচাপে গণ্য করিছিল” ডপ্রফুল্ল মহন্তের এই উক্তি কিন্তু ড রমেশ পাঠকের এই উক্তিকে ঐতিহাসিকভাবেই নাকচ করে --- “বাংলা ভাষাই চিলেটী ভাষার রূপ এনেদরে সলাই পেলাইছে যে চিলেটী এতিয়া বাংলা ভাষারে আঞ্চলিক রূপ মাথোন।” বস্তুত বেনুধর রাজখোয়ার নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত অসম সাহিত্য সভার ধুবড়ি অধিবেশন অব্দি আজকের অনেক ভাটি অসমের অসমিয়ারাও বাঙালি হতে চাইছিলেন। শরৎচন্দ্র গোস্বামী লিখেছেন, “ অসমীয়া ভাষার সঙ্কীর্ণতা ইমান বাঢ়িছিল যে শিবসাগরত নোকোয়া শব্দ এটা ব্যবহার করিলেই ভাষা চুয়া হ'ল বুলি কিছুমান উজনীয়া লোকে আটাহ পারি ফুরিছিল। কামরূপীয়া বা গোয়ালপরীয়া মাত কথাতো বঙলুয়াই। যি বিশিষ্ট ভাষার বহির্ভূত। এনে সংকীর্ণতার ফলত নামনি অসমর অনেকেই অসমীয়া লিখিবলৈ ভয় করিছিল। … এনে অবস্থাত কাকামরূপত তেতিয়াওও কেইজনমান ক্ষমতাসম্পন্ন লোক আছিল, যে ভাবিছিল যে কামরূপীয়া মানুহে উজনীয়ার ইমানবিলাক অত্যাচার আরু অবিচার ( ভাষা বিষয়ত) সহ্য করাত করি তেওঁলোকে বঙালী ভাষাকে গ্রহণ করা ভাল।” ( পৃঃ ১৫০-৫১; 'সাহিত্য সভার কথা'; শরৎ চন্দ্র গোস্বামী রচনাবলী; পৃঃ ২৪৮, অসমীয়া জাতি গঠন প্রক্রিয়া আরু জাতীয় জনগোষ্ঠীগত অনুষ্ঠান সমূহ-তে উদ্ধৃত।) আর বেনুধর রাজখোয়ার মতো ব্যক্তির যে মানসিতার পরিচয় আমরা তুলে দিলাম তাতে রাজবংশি, বডোদের মতো বহু জনগোষ্ঠীই আজ অসমিয়ার থেকে হয় বেরিয়ে গেছেন কিম্বা বেরিয়ে যাবার প্রক্রিয়াতে রয়েছেন। সেখানে সিলেটি উপভাষার বাংলা হয়ে যাবার দায় বাঙালিদের কাঁধে চাপিয়ে দেয়ার প্রয়াসটি মোটেও সঠিক নয়।
               তার জন্যে কিন্তু সিলেটি উপভাষার সঙ্গে অসমিয়া ভাষার ঘনিষ্ঠতার সত্যটি কিছুতেই নাকচ হয়ে যায় না। এ মোটেও পর্বতে কচ্ছপের ডিম খোঁজার মতো ব্যাপার নয়। এবারে আমরা সেটিই করে দেখাব। আমরা আগেই উল্লেখ করেছি অন্যান্য উৎসের সঙ্গে ড উপেন রাভা হাকাচামের অন্যতম তথ্য সূত্র ছিল গ্রীয়ার্সনের ভারতের ভাষা সমীক্ষা । সেখানে বাবা এবং তাঁর দুই ছেলের যে বাইবেলীয় গল্পের বিভিন্ন ঔপভাষিক রূপ রয়েছে, এখন অব্দি যে কোনো বাঙালি ভাষাবিদেরও উপভাষা চর্চার মূল আশ্রয় সেই গল্পটি। কিন্তু সেটিযে খুব নির্ভর যোগ্য নয়, সেই কথা আমরা এর আগের অধ্যায়ে উল্লেখ করেছিলাম। ইচ্ছে ছিল, এবারে আমরা সেটির সিলেটি রূপ পুরোটা উল্লেখ করে আমাদের আলোচনা এগিয়ে নিয়ে যাব। কিন্তু জাপানের ভূকম্পনের পর সমীক্ষার সেই সাইট খুলছে না । সুতরাং আপাতত সেটি ছাড়াই কাজ চালাতে হবে । 'Notes on Sylhetee Dialect' বইটিও এখন দুর্লভ। আমরা বহু সন্ধান করেও এখন অব্দি পাইনি। আমাদের মূল নির্ভর ডউপেন রাভা হাকাচাম। তিনি অসমীয়া বাংলার সঙ্গে সিলেটি উপভাষার তুলনা করেছেন। কিন্তু আমরা আগেই লিখেছি, অসমিয়া ভাষা তাত্বিকেরা বৃটিশ কিম্বা বর্তমান অসমের মানচিত্রের বাইরে বেরোন নি। যখন কিনা তাদের উচিৎ ছিল প্রাচীন কামরূপের মানচিত্র, তথা ব্রহ্মপুত্র নদীর সমগ্র দক্ষিণ পূর্ব তীর অনুসরণ করা। আপাতত ততটা সুযোগ আমাদেরও নেই। আমরা তাই সিলেটির প্রতিবেশি ঢাকাইয়া উপভাষার আশ্রয় নেব।
             সিলেটি উপভাষা এবং বাংলা - অসমীয়া ভাষার ধ্বনিতত্বঃ
     ) শ ষ স ধ্বনিঃ উপেন রাভা হাকাচাম লিখেছেন “বাংলা শ ষ স ধ্বনি চিলেটীয়াত হ হয় । এই ধ্বনি কেইটা নিম্ন শ্রেণির অসমীয়ার মুখত হ আরু আঢ্যবন্ত অসমীয়ার মুখত কোমল হ উচ্চারিত হয়। উদাহরণ—বাংলা সাপ , শশুর, সকল, সার শালি, মানুষ, পিশী, সে > চিলেটীয়া ঃ হাপ, হউর , হকল, হার, হালি, মানুহ, পিহী হে। সেই দরে শুনা, বসা, শিখা, আসা আদি ধাতুরো উচ্চারণ প্রায় অসমীয়ার দরে হয়।” (পৃঃ২৭৭; অসমীয়া আরু অসমর ভাষা উপভাষা )
সুনীতি চট্টপাধ্যায় লিখেছেন, “In earlier Assamese, inter-vocal [Ś] became [ ɦ ], and in recent Assamese single [Ś] initial or intervocal is pronounced as guttural spirant [x], although written , , « ś,ş,s » . East Bengali partly agrees with Assamese in turning [Ś] to [ ɦ ]” ( পৃঃ ৫৪৬, OBDL, Rupa & Co, 1993) । উৎসাহের মাত্রাটা একটু কম হলেই এই 'partly agrees' কথাটার মানে ডহাকাচাম নিজের উদাহরণেই খোঁজে পেতেন। তাঁর উদাহরণের প্রায় সমস্ত শব্দে ', ' ধ্বনিগুলো শব্দের শুরুতে রয়েছে। 'মানুহ', 'পিহী' র মতো নাম শব্দ কিম্বা 'বস' ক্রিয়াপদ সিলেটিতে নেই। সুনীতি চট্টপাধ্যায় লিখেছেন , “ [ ɦ ] cannot occure in Bengali as a final sound in a syllable: it must either have a vowel to prop itself up , or it must be dropped: and occasionally, it is changed to a semivowel [ ĕ], or to [ì ]” ( পৃঃ ৫৫৭,) সিলেটিতে অসমিয়াকে অনুসরণ করে অক্ষরান্ত [, ] [] -তে পরিণত হয় ঠিকই কিন্তু তার পরেই সে বাংলার ধর্ম অনুসরণ করে লোপ পেয়ে যায়। তাই সিলেটি শব্দগুলো হলোঃ মানু, পি', বা' ( বাঁশ) ইত্যাদি) সঞ্জীব দেব লস্কর নজিরদিয়েছেন,গোরুয়ে ঘা খাইন না।অর্থাৎ,গরু ঘাস খাচ্ছে না। পুলিশে লাগাল পাইলে বা হারাইব। অর্থাৎ, পুলিশে ধরলে বাঁশ দেবে।” 
        জগন্নাথ চক্রবর্তী লিখেছেন, “...'' আদ্য নিজস্ব প্রচুর শব্দ ছাড়াও আদর্শ বাংলার অনেক আদ্য শিশধ্বনি [, ,] বরাকে '' ধ্বনিতে পরিণত হয়েছে।” ( পৃঃ ৩৮৫; বরাক উপত্যকার আঞ্চলিক বাংলা ভাষার অভিধান ও ভাষা তত্ব, বাংলাঃ ১৪১২) অর্থাৎ পদমধ্য কিম্বা পদান্ত '[, ,] এর কোনো রূপান্তরের কথা তিনি বলেন নি। পদান্ত [, ,] এর ''তে রূপান্তর এবং শেষে বিলোপের প্রবণতা প্রাকৃতেই ছিল । এবং মান্য বাংলাতেও তার রেশ একেবারেই অপরিচিত নয়। যেমন ঃ স্নেহ< প্রাঃ ণেই বা নেই < নাই< একেবারে আধুনিক বাংলা--লাই । তেমনি ঃ রাধিকা< প্রাঃ রাহিআ< প্রা-বাঃ রাহী < মধ্য ও আধুনিক বাংলা রাই । সংঃ নাসিৎ< প্রাঃ ণাহি < বাঃ নাই। সংস্কৃত পঞ্চদশ থেকে বাংলা পনের হবার কাহিনিও একই।
সিলেটির মতোই ঢাকার বাংলাতেও ঘটনাক্রম প্রায় একই রকম ঘটে । মুহম্মদ আব্দুল হাই লিখছেন, “...//ধ্বনিটি প্রায়ই // হয়ে যায়, যেমন/হাগ/='শাক' অর্থে, /হউন/='শকুন' অর্থে...” ( পৃঃ ৩০০, ঢাকাই উপভাষা, বাঙলা ভাষা ২য় খন্ড, সঃ হুমায়ুন আজাদ; আগামী প্রকাশনী, ২০০৯) তিনি আরো লিখছেন, “শব্দের মূলধ্বনি // প্রায়ই লুপ্ত হয়। যেমন /আত/+হাত অর্থে। /অয়/ ='হয়' অর্থে” ( পৃঃ৩০০;) শব্দের মূলেই যদি আদিতে // থাকে তবে সিলেটিতেও ঘটনাক্রম একই পথে এগোয়। 'হাত' হয়ে যায় ''', 'হয়' হয়ে যায় ''', 'হাইলাকান্দি' ''ইলাকান্দি' ইত্যাদি' । এই কথাগুলো অবশ্যি উপেন রাভা হাকাচামও বেনুধর রাজখোয়ার সূত্র থেকে উল্লেখ করেছেন। ( পৃঃ২৭৭; ) , কিন্তু বেনুধর রাজখোয়া ভোট-বর্মীমূলীয় মিশিং জনজাতিদের উচ্চারণ প্রবণতার সঙ্গে এর সাদৃশ্যের সন্ধান করেছেন। যখন কিনা ঢাকার মতো পূব বাংলার যেকোনো বাংলা উপভাষারই এ এক সাধারণ প্রবণতা । মিশিংদের একাংশের মধ্যে প্রচলিত অসমিয়াকে উপেন রাভা হাকাচাম বলেন মিশিংমিজ। সেখানে তিনি যা বলছেন তার অর্থ অবস্থান নির্বিশেষে মিশিংমিজে '' লোপ পায়, সিলেটির মটো কেবল আদ্য অবস্থানে নয়। (পৃঃ১৭০;) [] লোপ পেয়ে দ্বিস্বরে পরিণত হবার যে কথাটি সুনীতি চট্টপাধ্যায় বলছেন সেটি সিলেটিতেও সত্য। আর ঢাকাইয়া সম্পর্কে আব্দুল হাই লিখছেন, “ ঐতিহাসিক ভাষাতত্ব অনুসারে // এর // য়ে পরিবর্তন এবং তারপরে // লোপের ফলে দ্বিধ্বনিপরিবর্তনের ( Double sound change) দৃষ্টান্তও এ উপভাষায় বিরল নয়,--/বসা/>/বহা/>/বওয়া/” বস ধাতু জাত অসমিয়া 'বহ, বহক' শব্দগুলো সিলেটিতে দাঁড়ায় 'বও, বইন, বউক্কা'√আস ধাতু জাত অসমিয়া ' আহ, আহক' শব্দগুলো সিলেটিতে দাঁড়ায় 'আও, আইন, আউক্কা' । অন্যদিকে আবার আদ্য ''এর স্বরূপ অবস্থানের ফলে চট্টগ্রাম কিম্বা নোয়াখালির কিছু শব্দ বরং অদ্ভূৎ ভাবে অসমিয়ার সঙ্গে মিলে যায়। যেমন অসমিয়া 'সিহঁত/ সিহঁতি'-( মান্য বাংলা ওরা, সিলেটি তারা) সাদৃশ্যে চাঁটগেয়ে 'হিতি' , নোয়াখালিতে 'হেতি'। দাঁড়ালো এই যে চাঁটগেয়ে বা নোয়াখালির উপভাষা অধ্যয়ন না করলে অসমিয়া ভাষার অধ্যয়নই সম্পূর্ণ হতে পারে না । 'সিহঁত-হিতি-হেতি' শব্দগুলো ঐতিহাসিকভাবেই পরস্পর সম্পর্কসূত্রে বাঁধা। যেমন সম্পর্ক সূত্রে বাঁধা সিলেটি সহ পূব বাংলার আরো কিছু উপভাষা এবং অসমিয়া প্রথম পুরুষ একবচনে স্ত্রী-লিঙ্গ শব্দ 'তাই'। বাংলা গদ্যের আদি গ্রন্থগুলোর অন্যতম বলে স্বীকৃত পাদ্রি মানোএল দা আস্‌সুম্পসাঁউ-র লেখা 'কৃপার শাস্ত্রের অর্থ ভেদ ' বইটিতে ঢাকার অদূরে ভাওয়ালের উপভাষা ব্যবহৃত হয়েছিল। সুনীতি কুমার এর উচ্চারণ অনুযায়ী রোমান হরফে নাম লিখছেন, 'Crepar Xaxtrer Orthobhed' (পৃঃ ৩৮৪,)। বইটি বাংলাতে লেখা হলেও হরফ রোমান ব্যবহৃত হয়েছিল। সম্ভবত মূলেই বইটির নাম এরকম লেখা হয়েছিল। সম্ভবত '' ধ্বনির '' উচ্চারণ বোঝাবার জন্যে 'x' রোমান অক্ষরের ব্যবহার যেকোনো অসমীয়া লেখকের বহু আগে এই বইতেই প্রথম হয়েছিল । যে বইটির ভাষা ছিল বাংলার ঢাকাইয়া উপভাষা ।
              ২) , , , ধ্বনিঃ উপেন রাভা হাকাচাম লিখছেন, “ চিলেটীয়াত অসমীয়ার দরে চ আরু ছ র পার্থক্য সিমান তীব্র নহয়। সংস্কৃত তৎসম শব্দর স অসমীয়ার দরে চ বা ছ হয় ( অবশ্যে তদ্ভবর ক্ষেত্রত অসমীয়াত কোমল হ হয়)। অসমীয়ার দরে চিলেটীয়াতো বাংলা ঝ, -র দরে উচ্চারিত হয়। যেনে মাঝে ঃ মাজে, ওঝা ঃ ওজা।” (পৃঃ ২৭৭, ) । সংস্কৃতে এগুলোকে তালব্য ধ্বনি বলত। অসমীয়া বাংলা দুইয়েতেই এরা তালব্য হয়ে নেই। গোলক চন্দ্র গোস্বামী লিখেছেন, “ ইহঁতর উচ্চারণত জিভাখনে ক'তো নোছোয়েঃ মাথোন দাঁতর আলুর কাষত জিভাখন গৈ রয়। ফলত, ভিতরর পরা ওলাই অহা বায়ুর সোঁতটো ঘঁহনি খাই বাহির হয়।” ( পৃঃ২৯, অসমীয়া ব্যাকরণ প্রকাশ) ইনি তাই এদের ঘৃষ্টধ্বনি বলছেন। কিন্তু উত্তর দন্তমূলীয় কিনা ,স্পষ্ট করে বলেন নি । যদিও তাঁর ইঙ্গিত সেদিকেই। বাংলাতে এগুলো উত্তর দন্তমূলীয়ই ।
                     উপেন রাভা যে বৈশিষ্টের জন্যে অসমীয়া সিলেটিতে মিল দেখেছেন সুনীতি চট্টপাধ্যায় কিন্তু উত্তর পূর্ব বাংলার সব উপভাষাতেই সেগুলোর অস্তিত্বের কথা লিখছেন। অর্থাৎ এখানে এসে ধ্বনিগুলো দন্ত্য-উষ্ম ধ্বনি ( -এর মতো) হয়ে যাচ্ছে। তিনি লিখছেন, “The OIA palatal stops [c, ch, ɟ, ɟɦ] became palatal affricated in Eastern India as early as the first MIA .period. This value is preserved in west Bengal; but in North and East Bengali , they have been further modified to the dental affricates and sibilants [ʦ,s,ʣ,z] (পৃঃ ৪৬৪, ) তিনি আরো লিখছেন, “ ...the dental affricates ( i.e. , toungue-tip alveolar or dental, instead of tongue-middle supra-alveolar sounds) probably originated in North Eastern Bengal and Kāma-rūpa , whence the advanced south and west, and affected the east Bengali (Vanga) dialects to a considerable extent.” ধ্বনিগুলোর কামরূপী উৎসের পেছনে তিনি ভোটবর্মী ভাষাগুলোর অবদান অনুমান করেছেন। সপ্তম শতকের মধ্যেই কামরূপ এবং আশেপাশের আর্যভাষাতে এই উষ্মায়নের পাকা স্থান লাভের সম্ভাবনার কথা তিনি উল্লেখ করেছেন।
                   জগন্নাথ চক্রবর্তী চ আর ছ এর পার্থক্যকে উপেন রাভার মতো অস্বীকার করছেন না। লিখছেন ছ উচ্চারণে, “ মহাপ্রাণতার জন্যে দন্তমূলে জিহ্বাগ্র আরো জোরে আঘাত করে। ফলে '' থেকে তালু প্রবণতা খানিক বাড়ে। '' এর সঙ্গে ''এর পার্থক্য সামান্য বললেও , লিখছেন '' এর সঙ্গে '' এর পার্থক্য সুস্পষ্ট। '' ধ্বনির উচ্চারণ 'z' এর মতো [ Jʒ]বললেও তিনি '' [ Jʒɦ] এর স্বতন্ত্র অস্তিত্বের কথা লিখছেন।( পৃঃ ৩৮৩, ) জুরি এবং ঝেংড়া শব্দদুটো তাঁর মতে ভিন্ন। তবে শব্দের শেষে ব্যবহৃত '' এর উপর শ্বাসাঘাত কম বলে উপেন রাভার দেয়া উদাহরণের বেলা ( মাঝে ঃ মাজে, ওঝা ঃ ওজা।) ধ্বনিটি ''ই উচ্চারিত হয়। কিন্তু 'জলে' আর 'ঝড়ে' কিন্তু ধ্বনিদুটো তাদের স্বাতন্ত্র্য ঠিকই বজায় রাখে, যদিও দুটোই খানিকটা দন্ত্য ধর্ম অর্জন করে ফেলে।
ঢাকার উপভাষাতে বরং '' আর '' এর পার্থক্য অস্বীকার করছেন মুহাম্মদ আব্দুল হাই। তাই যদি হয় , তবে ঢাকার উপভাষা বরং এক্ষেত্রে অসমীয়া ভাষার ঘনিষ্ট হয়ে যাচ্ছে। আব্দুল হাই লিখছেন, এই দুটোই ঢাকাই উপভাষাতে // = /z/ হয়ে যায়। “...দ্বিত্ব লাভ করলে সাধারণতঃ /জ্জ/ রূপে উচ্চারিত হয়, তবে // রূপেও উচ্চারিত হতে শোনা যায়।” ( পৃঃ৩০০, ) যেমনঃ বুঝেছেন = বুজ্জেন, জাজ্জ্বল্যমান= যাজ্জ্বলিমান।
                  ৩) , তথা অন্তস্থ -ব ধ্বনিঃ উপেন রাভা হাকাচাম লিখছেন, “ সিলেটীয়াত অসমীয়ার দরে ( /) ধ্বনির উচ্চারণ আছে। অর্থাৎ সিলেটীয়াত বাংলার দরে ৱ -র ঠাইত ব উচ্চারণ নকরে। যেনে--নৱাব (নবাব নহয়), দেৱর (দেবর) নহয়, হাৱর/ হাওর ( =বিশাল পথার ) বরঞ্চ বানানত য় লিখিলেও ৱ বুলি উচ্চারণ করে। যেনে সোয়াদঃ হোয়াদ, গুয়া, পোয়াঃ পোৱা ইত্যাদি।” ( পৃঃ২৭৮,) বাংলা থেকে স্বাতন্ত্র্য বোঝাবার জন্যে অসমীয়াতে দুটো ধ্বনি রয়েছে। ৰ এবং ৱ । বাংলা র সম্ভবত এককালের বাংলা-অসমিয়া ' ' এর উত্তরসুরীই। আগেকার বেশ কিছু প্রাচীন বাংলা লিপিতেই ওই অসমীয়া ৰ দেখা গেছে । কিন্তু অন্তস্থ- -বাংলা ব্যবহার আমাদের জানা নেই। বাণীকান্ত কাকতি লিখেছেন, “প্রা ভা আ. -,ব বুজাবলৈ ব- আখরটো ব্যবহার করা হয় আরু সিহঁত দুয়োটাকে ব উচ্চারণ করা হয় করা হয়। ৱ-শ্রুতি বুজাবলৈ আরু তৎ. শব্দত প্রা.ভা.. স্বরমধ্য – ৱ-বুজাবলৈও অসমীয়াই ৱ আখর এটা তৈয়ার করি লৈছে।” ( পৃঃ ২০০,অসমীয়া ভাষার গঠন আরু বিকাশ; মূল ইংরাজীঃ Assamese , Its Formation and Development-এর বিশ্বেশ্বর হাজরিকার করা অনুবাদ) এই 'অসমীয়াই ৱ আখর এটা তৈয়ার করি লৈছে” কথাটার একটা অর্থ স্পষ্ট যে এগুলো প্রা.ভা.. কিম্বা বাংলাতে নেই।
                  উপেন্দ্রনাথ গোস্বামী তাঁর 'অসমীয়া লিপি' গ্রন্থে প্রাচীন বাংলা পুঁথি বা লিপিতে অসমীয়া ৰ এর অস্তিত্বের কথা লিখলেও ৱ-এর সম্পর্কে কিন্তু নীরবতা অবলম্বন করেছেন। লিপিটি যে প্রাচীন অসমীয়া পুঁথি কিম্বা তাম্রলিপি গুলোতে ছিল সে তিনি নজির টেনেই দেখাচ্ছেন। আধুনিক কালে হেমচন্দ্র বরুয়া একে জনপ্রিয় করতে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। কিন্তু বাণীকান্ত কাকতির 'অসমীয়াই ...তৈয়ার করি লৈছে' কথাটার অন্য আরেক অর্থও রয়েছে। অসমিয়াতে লিপিটির স্বতন্ত্র অস্তিত্ব রয়েছে বলেই প্রাচীন ভারতীয় আর্যের মর্যাদাতে ধ্বনিটি অসমিয়াতেও নেই। বাণিকান্ত কাকতি লিখেছেন, “ তদ্ভ.আরু তৎ.দুয়োবিধ শব্দতে আদ্য য়-() আরু ৱ-() উচ্চারণত জ-আরু ব-র ধ্বনিমূল্য আহরণ করিছে।” (পৃঃ ১৯৯, ) বাংলাতেও প্রায় সব অবস্থানেই এরকম ব্যাপার ঘটেছে বটে। কিন্তু একেবারেই লুপ্ত হয় নি যে সিলেটিতে অন্তস্থ--এর কোনো রকম ব্যবহার দেখলেই বাংলার সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ করতে হবে। “পদাদিস্থিত অন্তস্থ [-] সর্বদা বর্গীয় [-] হইয়াছে”, লিখছেন সুকুমার সেন। ( পৃঃ১৮১, ভাষার ইতিবৃত্ত) যেকথাটি বাণীকান্ত কাকতি লিখছেন অসমীয়ার সম্পর্কে। জগন্নাথ চক্রবর্তী বরাক বাংলা ( কাছাড়ি ?, সিলেটির বিভাষা?) 'বয়ার' শব্দকে ওষ্ঠ্য স্পৃষ্টধ্বনি বলেছেন। লিখেছেন , “ -ধ্বনি এখানে মূলানুগ বলতে পারি। বরাক বাংলায় এর কোনো উচ্চারণ বৈলক্ষণ্য ঘটেনি।” (পৃঃ ৩৮৪,) তিনি আরো জানাচ্ছেন, স্বরমধ্যবর্তী অন্তস্থ [-] সাধারণত লোপ পেয়েছে, কখনো কখনো সেটি শ্রুতিধ্বনি রূপে [] হয়ে গেছে। এখানে এসে উপেন রাভা হাকাচামের ' দেৱর (দেবর) নহয়, হাৱর/ হাওর' শব্দদুটোর ব্যাখ্যা পাওয়া যাচ্ছে। শব্দগুলো দেওর, হাওর ( বিশাল জলাজমি, পথার বা ধানের মাঠ নয়) এভাবে লেখা হয়। এই শব্দগুলো শুধু সিলেটিতেই নেই। ঢাকাই সহ পুব বাংলার আরো বিভিন্ন উপভাষাতে পাওয়া যাবে । 'দেওরা' যেমন। আব্দুল হাই লিখছেন / ?আওর/ ।সিলেটিতেও উচ্চারণটা তাই। প্রাকৃতে উৎপন্ন ব-শ্রুতি প্রায়ই বাংলাতে লোপ পেয়েছে বলেও সুকুমার সেন যেগুলোর উদাহরণ দিয়েছেন সেগুলো আসলে অন্ত অবস্থানের ব-ধ্বনি। যেমন তাপ-তাব-তা। কিন্তু তিনি কিছু ব্যতিক্রমও দিয়েছেন ---নাও, নায়্‌ গাঁও, দাও। সিলেটিতে তাপ—থেকে 'তাও' রয়েছে। সে কি খুব একটা দূরের কিছু? সুকুমার সেন কোনো কোনো বাংলা শব্দে লঘু ব-শ্রুতি কথা লিখে বেশ জনপ্রিয় কিছু শব্দের নজির টেনেছেন—খাওয়া, হাওয়া। শব্দগুলো সিলেটিতেও প্রচলিত শব্দ । সেখানে '' ধ্বনির উচ্চারণ স্বাতন্ত্র্য থাকলেও 'ওয়া'র নেই বিশেষ। 'গাওয়া ঘি' সিলেটিতে চেনা শব্দজোড়। 'সোয়াদঃ হোয়াদ, গুয়া, পোয়াঃ পোৱা' শব্দগুলো অসমিয়ার মতোই বটে, কিন্তু বাংলার থেকে মোটেও বশি দূরের নয়। 'গুয়া'র বদলে মান্য বাংলাতে 'সুপারি' বেশি প্রচলিত হলেও 'গুয়া' একেবারেই অচেনা শব্দ নয়। সাধু বাংলাতেই পাওয়া যাবে এমন বাক্য, “তাহার পর, ফুটফুটে' চাঁদের আলোয় আগুন-পুরুতে সম্মুখে, গুয়াপান, রাজ-রাজত্ব যৌতুক দিয়া, রাজা পঞ্চরত্ন মুকুট পরাইয়া রাজপুত্রের সঙ্গে রাজকন্যার বিবাহ দিলেন। চারিদিকে জয়ধ্বনি উঠিল।” ( ঘুমন্ত পুরী, ঠাকুরমার ঝুলি)। এই শব্দগুলো মতো শুয়া (শোয়াবসা; সিলেটি শওয়া বওয়া), মোয়া-- মান্য বাংলার বহুচেনা আর প্রচলিত শব্দ। শব্দ শেষে 'য়া' না 'ওয়া' হবে সেটি নির্ভর করে পূর্ববর্তী স্বরের উপর। এগুলো আসলে প্রতিস্থাপনযোগ্য অর্ধস্বরধ্বনি । এই শব্দগুলতেও য়-শ্রুতি শব্দের শুরুতে নেই।
                 বাণীকান্ত কাকতি যেকথাগুলো অসমিয়ার ক্ষেত্রে লিখেছেন, একই কথা সুকুমার সেন বাংলার ক্ষেত্রেও লিখেছেন। মধ্য অবস্থানের সম্পর্কে সুকুমার সেন লিখছেন, '[-] লুপ্ত হইয়াছে যেমনঃছায়া> ছা। সিলেটিতে এই শব্দটিও রয়েছে । অসমীয়াতেও অনেক সময় ঘটনা সেরকম ঘটেছে । যেমনঃছাঁ । কিন্তু সিলেটিতে 'ছেওয়া/ ছাওয়া'ও রয়েছে। তেমনি রয়েছে 'বাওয়া' (বাবা অর্থে) । জগন্নাথ চক্রবর্তীকে মানতে হলে অবশ্যি উপেন রাভা হাকাচাম একেবারেই অস্বীকৃত হয়ে পড়েন। সেক্ষেত্রে মান বাংলাকেই অসমীয়ার কাছাকাছি ভাষা বলতে হয়। তিনি লিখেছেন, “ বরাক উপত্যকার আঞ্চলিক বাংলায় 'শ্রুতিধ্বনি-' বা '-শ্রুতি'র তাৎপর্যই আলাদা। মান্যবাংলার ব-শ্রুতি আসলে 'অন্তঃস্থ ব-শ্রুতি''ওয়' বা ''-কারের সাহায্যে এই ধ্বনিকে নির্দেশ করা হয়। যেমন, পা+> পাওয়া...কিন্তু বরাক উপত্যকার আঞ্চলিক বাংলায় মান্যবাংলার 'অন্তঃস্থ ব-শ্রুতি' খাঁটি ব-শ্রুতিতে রূপান্তরিত হয়েছে। অর্থাৎ 'ওয়' বা '' এখানে পুরোপুরি '' ধ্বনিতে পর্যবসিত হয়েছে। যেমন, খা+> খাবা (=খাওয়া), দে+> দেবা (= দেওয়া), বা+> বাবা (=বাওয়া), ছা+> ছেবা (= ছায়া)।” ( পৃঃ ৩৯৪, ) কাছাড়ি বিভাষাতে এগুলো সত্য হলেও বিকল্প মান্য বাংলার শব্দগুলো সিলেটিতে প্রচলিত শব্দ। উচ্চারণ বৈচিত্র বরং আদ্য বর্ণগুলোতে চোখে পড়ে । এই অর্ধস্বর বা যৌগিক স্বরধ্বনিগুলোর সাদৃশ্য দেখিয়ে যদি সিলেটিকে অসমিয়ার দিকে টেনে নিতে হয়, তবে কিন্তু কেউ কেউ অসমিয়াকে বাংলার দিকেও টেনে নিয়ে যাবার সম্ভাবনা পূর্ণমাত্রাতে সম্ভব হয়ে উঠবে। বিশ শতকের শুরু অব্দি যা কিছুদিন হয়েও ছিল। কিন্তু এগুলো ভাষাতত্বের যুক্তি নয়। সে যুক্তির কথাতে আমরা পরে আবার আসব।
           ) -কারের উ-কারে পরিবর্তনঃ উপেন রাভা হাকাচাম লিখেছেন 'অসমর গ্রামাঞ্চলর লোকে করার দরে সিলেটর গ্রামাঞ্চলর লোকেও ও ধ্বনিক উ র দরে উচ্চারণ করে। যেনে--চোরঃ চুর, তোমার ঃ তুমার, টোকাঃ টুকা ।( পৃঃ ২৭৮, ) মোটের উপর তিনি ঠিকই লিখেছেন। কিন্তু সর্বত্র ও উ-তে পরিণত হয় না, কাছাকাছি চলে আসে মাত্র। তাঁর 'গ্রামাঞ্চলে'র কথাটা বড় বিভ্রান্তিজনক। উপভাষার নাম নিলে সুবিধে হতো । কারণ, সমস্ত গ্রামাঞ্চলের উচ্চারণ প্রবণতা এক নয়। তাছাড়া স্বরধ্বনিগুলোর আচরণের সাধারণ প্রবণতার থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখলে কিছুই স্পষ্ট হয় না । অসমীয়াতে উ-কারের ও-কার প্রবণতা ব্যাপক ( যেমন তাম্বুল=তামোল), স্বরসঙ্গতির জন্যে কখনো বা উল্টটা হয় ( যেমন কোষ=কুঁহি) । মান্য বাঙলাতেও স্বরসঙ্গতি এমন উদাহরণ ব্যাপক। বস্তুত সমগ্র ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগুলোরই এ এক সাধারণ প্রবণতা। নাম বা ক্রিয়াপদের গুণ ধর্ম পাল্টালেই এই ব্যাপারগুলো ঘটে । সুনীতি কুমার নজির টেনেছেন, “...the root দুল [dul] to swing has [u], but the verbal noun by «guņa» in OIA. Has [o] –দোল [do:l] a swing,--also the casuative দোলাই [ dolai] I cause to swing...” ( পৃঃ ৪১৪, ) লিখেছেন , “ Alternances of [I] and [u] with [e] and [o] through Vowel-Harmony is a most important thing in New Bengali....” ( পৃঃ ৪১৫, ) .এর কারণ নির্দেশ করতে গিয়ে তিনি লিখেছেন, “ This is duw to partly to the low position of the Bengali [I] and [u] vowels.” অন্যদিকে জগন্নাথ লিখছেন “মান্যবাংলা থেকে এখানে এই ধ্বনির ( , o-লেখক) অবস্থান সামান্য উচ্চে। ( পৃঃ ৩৮২, ) তাই তিনি স্বীকার করছেন “ বরাক উপত্যকার আঞ্চলিক বাংলায় এই স্বরধ্বনি ( , o-লেখক) অনেকটা '' ধ্বনির কাছাকাছি উচ্চারিত হয়।” () ধ্বনিগুলোর এমন ঊর্ধ্বায়নের ফলেই মান্য বাংলা, ছায়া এখানে হয় ছেবা/ ছেওয়া, বাঁকা হয় বেঁকা, টাকা হয় টেকা ইত্যাদি। ( পৃঃ ৩৯৩, জগন্নাথ) টাকা থেকে অসমিয়াতে 'টকা'ও এই উর্ধ্বায়নের পরিণাম।
              ) র এবং ড় ধ্বনি ঃ মোটের উপর সঠিক ভাবেই উপেন রাভা হাকাচাম লিখেছেন, “চিলেটীয়াতো অসমীয়ার দরে র আরু ড়-র মাজত উচ্চারণ পার্থক্য নাই। যেনে বড় ঃ বর, বাড়ী ঃ বারি।” কিন্তু বাংলার ভাষাতাত্বিকেরা জানেন যে শুধু সিলেটি নয় পূব বাংলার প্রায় কোন উপভাষাতেই অসমিয়ার মতো '' এর উচ্চারণ নেই, রয়েছে ''। কিন্তু জগন্নাথ চক্রবর্তী বলেন অন্য কথা, “ '' আগে '' এর ধ্বনিভেদ মাত্র ছিল। অন্ত্য '' ''-তে পরিণত হত। বিদ্যাসাগর মহাশয় প্রথম রূপ ও উচ্চারণ বিচার করে করে ''-কে পৃথক ব্যঞ্জন ধ্বনির মর্যাদা দেন। বরাক উপত্যকার (?) এর যথাযথ উচ্চারণ লক্ষ্য করা যায়। বাংলাদেশে কিন্তু এই তাড়িত '' প্রায়ই উচ্চারিত হয় না। ( পৃঃ ৩১, ) প্রখ্যাত বাংলার ভাষাবিদ পবিত্র সরকার জগন্নাথের অভিধান এবং ব্যাকরণের ভূমিকা লিখতে গিয়ে লিখেছেন, “ আমার ধারণা ছিল, অসমিয়াতে যেমন '' ধ্বনিটি নেই এবং নেই পূর্ববঙ্গের কোনো উপভাষায় সেহেতু বরাকের বাংলাতেও '' থাকার কথা নয়। কিন্তু শ্রী চক্রবর্তী একাধিক শব্দে ''-এর ব্যবহার দেখিয়েছেন দেখে একটু অবাকই হলাম। কিন্তু, এটি তারই 'মাতৃভাষা', ফলে তাঁর নির্দেশ মানতে আমি বাধ্য।” শব্দের আদিতে ''এর ব্যবহার নেই । তাই ''তে শুরু হওয়া কোনো শব্দ তাঁর অভিধানে নেই। কিন্তু মাঝে বা শেষে রয়েছে । সেখানে তিনি স্পষ্ট ড় এবং র এর ব্যবধান দেখাচ্ছেন। যেমন থুর ( কলার মোচা), থুড়থুড়া ( জরাভাব সূচক ), থুড়থুড়ি ( বুড়ি দুদু থুড়থুড়ি /হাড়ি পিনদে নকুড়ি-- বরাক প্রবাদ) (পৃঃ ২০১, ) । কিন্তু আগ্রহ ব্যঞ্জক শব্দ 'থুড়া' (সামান্য) এর সমর্থণে তিনি বরাক বাংলা বাক্য লিখছেন, 'মোরে থুড়া নুন দিও।' এর পরেই তাঁর বরাক বাংলা যে সিলেটি থেকে ভিন্ন তার প্রমাণ স্বরূপ উল্লেখ করছেন শ্রীহট্টে শব্দটি 'থুরা'। এই প্রবাদের 'মোরে' সিলেটিতে অপরিচত শব্দ, অসমিয়াতে পরিচিত। কিন্তু 'থুড়া''' অসমিয়ার ঘনিষ্ট হবার সর্ত ভাঙ্গছে।
                     উপেন রাভার উল্লেখিত দুটি শব্দের মধ্যে আশ্চর্য রকম ভাবে বাসা অর্থে 'বাড়ি' শব্দটি জগন্নাথে নেই। সেখানে আছে আঘাত অর্থে । 'বারি' শব্দটির অর্থ কার্যার্থে নির্ণীত সময় পরম্পরা। পালা, পর্যায় ( এলকু কার বারি?) (পৃঃ ২৭০, ) তেমনি আশ্চর্য রকম ভাবে জেষ্ঠ অর্থে 'বড়' বা 'বর' কোনো শব্দই নেই। 'বর' শব্দের অর্থ পানের খেত। শব্দটি অস্ট্রিক 'বরোজ' উৎসজাত এই তথ্যের উল্লেখ তিনি করছেন, অর্থাৎ সংস্কৃত 'বর' উৎসজাত নয়। 'বড়' আলাদাভাবে অভিধানটিতে না থাকলেও 'বড়ন' আছে। অর্থ বড়ঠান, বড় ঠাকরুণ, বাবার মা। তেমনি আছে 'বড়া' , ( বরা নয়) পিষ্ট খাদ্যদ্রব্যের ভাজা ছোট ছোট পিণ্ড বিশেষ। 'শাড়ি, গাড়ি, কাপড়'-এর মতো বহু চেনা শব্দগুলো এই অভিধানে নেই কেন, সে এক প্রশ্ন থেকেই যায়। কিন্তু মধ্য বা অন্ত্য অবস্থানে '' নিয়ে প্রচুর শব্দ রয়েছে এটি সত্য। যেমন 'সাধুগিরি'জাত শব্দ 'শাউকাড়ি' স্পষ্টতই সিলেটিতে '' অন্ত শব্দ। 'বাঙ্গালনামা'তে সঞ্জীব দেব লস্কর ডিমাছা রাজাদের চিঠিপত্র থেকে পুরোনো বাংলা গদ্যের যে নমুনা দিয়েছেন, তাতে আছে, “আর বড়খলার চান্দলস্করর বেটা” 'বরখলা' নয় কিন্তু। সঞ্জীব তেমনি আরো বেশ কিছু '' অন্ত শব্দের উল্লেখ করেছেন, যেমনঃ চিনেনা ভুবির গুড়ি বিয়া করতে চায় মৌলবির পুড়ি । কিন্তু জগন্নাথে বাঁশের নাম 'বরুয়া' আছে , আছে বেষ্টন অর্থে 'বেরা', বেড়া নয়। তার মানে কি কিছু ব্যতিক্রম কাছাড়ি বিভাষাতে রয়েই গেছে ?
             ঢাকার উপভাষা সম্পর্কে আব্দুল হাই কিন্তু স্পষ্টতই লিখছেন, “ দন্তমূলীয় প্রতিবেষ্টিত ঘোষ স্বল্পপ্রাণ ও মহাপ্রাণ তাড়ন জাত // // ধ্বনি ঢাকাই উপভাষায় নেই। এ ধ্বনি দুটির জায়গায় '' ব্যবহৃত হয়। শিক্ষিত লোকের মুখে মাঝে মাঝে // // দুটিই শোনা যায়। ( পৃঃ ২৯৭, ) ঢাকার উপভাষার নজির যেমন, বিয়ার কয়দিন বাদে হ্যার হউর বারিত হ্যার নিমন্তন অইলো।
) স্বরধ্বনির ক্ষতিপূরণ দৈর্ঘীকরণ /,/ -//তে রূপান্তর ঃ উপেন রাভা হাকাচাম লিখছেন, “ অসমীয়ার দরে ক্ষতিপূরণ দৈর্ঘীকরণ হিচাপে রৈ যোয়া অন্ত্য আ-র প্রয়োগ আছে, যিটো বাংলাত এ বা ও হয়। যেনে মিঠা ( বাংলা মিঠে), তিতা ( বাংলা তিতো), বিয়া (বাংলা বিয়ে) , কন্যা (বাংলা ক'নে)।”
               এই মাত্র আমরা দেখালাম ঢাকার উপভাষাতেও অসমিয়ার মতো 'বিয়া' হয় , বিয়ে নয়। আব্দুল হাই দেখিয়েছেন, কর্তৃকারকে এক বচনে দুএকটি শব্দ ছাড়া ঢাকাইয়াতে শব্দের শেষে '' ধ্বনির ব্যবহার নেই, -কারের একেবারেই ব্যবহার নেই। সুতরাং মিঠে, বিয়ে, কনে ঢাকার উপভাষাতেও থাকবার কোনো সম্ভাবনাই নেই। সিলেটি 'কন্যা' একটি কষ্টকল্পিত শব্দ। ভারতীয় জ্যোতিষ শাস্ত্রের অন্যতম রাশিনাম কন্যা । সত্যজিৎ রায়ের এক বিখ্যাত ছায়াছবির নাম 'তিনকন্যা' 'কন্যা' অর্থে এখন যদিও বিয়ের কনেও বোঝায় এর আসল অর্থ বারো বছরের অবিবাহিত কুমারী। অপিনিহিতের ফলে সিলেটিতে শব্দটি দাঁড়ায় 'কইন্না' ( বাইক্ক, যইজ্ঞ-যেমন) । কখনো বা ''এর দ্বিত্বও হয় না, অসমিয়ার মতোই 'কইনা' শব্দ সিলেটিতেও ব্যবহৃত হয়, ঢাকাইয়াতেও। তফাৎ থাকে কেবল শ্বাসাঘাত আর সুরের ব্যবহারে । সুনীতি কুমার লিখছেন , “the 'Crepar Xaxtrer Orthobhed' being in the Dacca dialect, indicates epenthesis quite regularly: e.g., «coina» = কন্যা ( kanyā)” (পৃঃ ৩৮৪,) এধরণের অপিনিহিতি অসমীয়াতেও অপরিচিত নয়। লক্ষ থেকে লইকখ; অজ্ঞান থেকে অইগগান, রাজ্য থেকে রাইজ, বাক্য থেকে বাইক, অবাক্য থেকে অবাইক হয়ে 'অবাইচ' এগুলো বহু চেনা অপিনিহিতির নজির। কিন্তু কইরা, রাইকখা-র মতো ঢাকার উপভাষাতে সুলভ , সিলেটিতে নয়। সিলেটিতে শব্দগুলো সাধু বাংলার মতো--করিয়া , রাখিয়া।
               বিবাহ থেকে জাত পূর্ব বাংলা ভাষাগুলোর এবং অসমীয়ার 'বিয়া' শব্দে যে ব্যঞ্জনের ক্ষয় থাকলেও দৈর্ঘীকরণ নেই এতো একেবারে দিনের আলোর মতো স্পষ্ট । একমাত্র মিষ্ট থেকে মিঠা, তিক্ত থেকে তিতা-তে ব্যাপারটা সত্য হতে পারে। কিন্তু সাধারণত দৈর্ঘীকরণ হয় লুপ্ত ব্যঞ্জনের আগের হ্রস্বস্বরের। ভক্ত থেকে যেমন ভাত, সপ্ত থেকে সাত, কর্ম থেকে কাম, কিম্বা ধর্ম থেকে ধাম। মিঠা, তিতা-তে সেরকম ঘটনা ঘটেছে কি? আমাদের মতে এগুলো অন্ত্য স্বরাগমের পরিণাম। সংস্কৃত 'দিশ' থেকে সিলেটি ( এবং মান্য বাংলাতেও) 'দিশা' যেমন ( তার পরে আবার স্বরসঙ্গতির ফলে 'দিশে') । মান্য বাংলাতে উপেন রাভা যেমন লিখেছেন শব্দটি 'তিতো' নয়, 'তেতো' । স্পষ্টই এটি 'তিতা'র পরবর্তী রূপান্তর এবং অন্যোন্য সরসঙ্গতির নজির। অর্থাৎ যেখানে স্বরধ্বনিগুলো পরস্পরের প্রভাবে দুটোই পালটে গেছে । দুটো ধ্বনিরই অবস্থান অর্ধ সংবৃত উচ্চ-মধ্য । আমাদের বক্তব্য হচ্ছে বাকি শব্দগুলোও স্বরসঙ্গতির ফলে মান্য বাংলাতে পরিবর্তিত হয়েছে । 'কইনা'র ক্ষেত্রে অভিশ্রুতি হয়েছে। দেখা গেলো, অত্যুৎসাহে সাদৃশ্য দেখাতে গিয়ে উপেন রাভা হাকাচাম কিছু ভুল শব্দের উল্লেখ করেছেন, এবং ধ্বনি পরিবর্তনের এক ভুল সূত্রের উল্লেখ করেছেন। এরকম অত্যুৎসাহ এক পক্ষকে তুষ্ট করলেও অন্য পক্ষমাত্রেই বিব্রত বোধ করে । এবং সব পক্ষেরই ভাষাতাত্বিকেরা বিব্রত বোধ করেন।
              ) পদান্ত স্বরলোপ উপেন রাভা হাকাচাম লিখেছেন, “ব্যঞ্জনান্ত রূপর প্রতি দুর্বলতা বেছি ( বাংলার অ-কারান্ত দুই-এক শব্দ বা রূপ চিলেটিয়াত ব্যঞ্জনান্ত হয়) । যেনে-- আছিল, খাইছিল, দিছিল। কিন্তু বাংলাত ছিল (-) , খাইছিল (-), দিছিল (-)।”
                  প্রথম কথা হলো, 'দিছিল(+) , খাইছিল(+) মান্য বাংলা শব্দ নয়। যেকোনো বাংলা গদ্যে তিনি সঠিক শব্দগুলো পেয়ে যেতেন। এই ভুল উল্লেখ একটু অবাকই করে । মান্য বাংলাতে শব্দগুলো দিয়েছিল (+), খেয়েছিল(+)। দ্বিতীয়ত, তাঁর 'দুর্বলতা বেছি' এবং ' দুই-এক শব্দ বা রূপ' স্ববিরোধী হয়ে গেছে। এভাবে কোনো ভাষাতত্বের সূত্র তৈরি হতে পারে না । ভাষাতত্বের সাধারণ ছাত্ররাও জানেন যে পদান্ত স্বরলোপ আধুনিক বাংলা -অসমিয়াতে ব্যাপক। সুনীতি কুমার ( পৃঃ ৩০১, ) এবং বাণীকান্ত কাকতি (পৃঃ ৭৬) দু'জনেই এই কথা লিখেছেন। 'টালত মোর ঘর নাহি পড়িবেশি' চর্যার এই চরণের প্রত্যেকটি শব্দ স্বরান্ত ছিল, না বলে দিলে সম্ভবত এখন কোনো বাঙালি অসমিয়া চরণটি শুদ্ধভাবে পড়তেই পারবেন না, ওড়িয়ারা পারবেন। তৃতীয়ত, উপেন রাভা হাকাচাম যে নজিরগুলো টেনেছেন সেগুলো সব ক'টাই ক্রিয়াপদ। 'ছিল' একটি ক্রিয়া বিভক্তি। এর বাকি আলোচনা রূপতত্বেই হতে পারে । চর্যার 'টালত' শব্দটি মান্য বাংলাতে স্বরহীন করে কেউ পড়বেন কিনা আমাদের সন্দেহ। কেননা , এর আধুনিক রূপ যদি হয় 'টিলাত্' সিলেটি অসমিয়াতে কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু মান্য বাংলাতে হবে 'টিলাতে' । তেমনি 'বাড়িত্, ঘরত্' অথচ মান্য বাংলাতে 'বাড়িতে, ঘরে'। কিন্তু এখানেও এই 'ত্' কিম্বা '' হচ্ছে কারক বিভক্তি সুতরাং রূপতত্বের আলোচনার বিষয়।
            কিন্তু উপেন রাভা হাকাচামের স্বরান্ত 'খাইছিল (-), দিছিল (-)' শব্দগুলো, এমন কি 'আছিল' একেবারেই উৎস বিহীন শব্দ নয়। অসমিয়াতেও শব্দগুলোর বানান একই রকম, এবং পূর্ব বাংলার ঢাকা, নোয়াখালি, কুমিল্লার উপভাষাতে শব্দগুলো স্বর-সহ কিম্বা স্বরহীন দুই রূপেই পাওয়া যাবে। এমন কি ঢাকার উপভাষাতে 'বারিত্' শব্দটির নজির আমরা পঞ্চম সূত্র ব্যাখ্যার সময় দিয়েই রেখেছি।
) -কার এবং উ-কারের আগম তথা অপিনিহিতিঃ উপেন রাভা লিখেছেন, “ কামরূপীর দরে চিলেটিয়াতো আপিনিহিতির প্রয়োগ সর্বাধিক; যিটো বাংলার লগত নিমিলে । যেনে-বেইল ( অসমীয়াঃ বেলি, বাংলা ঃ বেলা ) রাইত (অসমীয়া রাতি, বাংলাঃ রাত ), সইত্ত ( অসঃ সইত), দেইখ্যা < দেখ+ ইয়া তু কামরূপীঃ দেইখছা < দেখ+ ইছা, ইত্যাদি।”
            অপিনিহিতি অসমীয়াতেও অপরিচিত নয় এই কথাটা আমরা আগেই লিখেছি, তেমনি লিখেছি কেবল সিলেটি নয়, সমস্ত পূর্ব বাংলার উপভাষাতেই অপিনিহিতি ব্যাপক। বস্তুত উপেন রাভা হাকাচামের 'দেইখ্যা' শব্দটি ঢাকা, কুমিল্লার উপভাষাতে ব্যবহৃত শব্দ, সিলেটি নয়। প্রাক বৃটিশযুগের বাংলা সাহিত্যেও শব্দটি অচেনা ছিল না, “'দেইখ্যা আইলাম তারে সই , দেইখ্যা আইলাম তারেএকই অঙ্গে এতো রূপ নয়ানে না ধরে..." (জ্ঞানদাস) সিলেটিতে শব্দটি 'দেখিয়া'--এতে কোনো অপিনিহিতি নেই।
             'সইত্ত' সিলেটিতে ব্যবহৃত হয় বটে, কিন্তু ঢাকার উপভাষাতেই শব্দটির ব্যবহার ব্যাপক, সিলেটিতে সাধারণ প্রচলিত শব্দটি অসমিয়ার ঘনিষ্ট 'হাচা' ( অসমিয়া-সঁচা)। কেবল কামরূপী নয়, বাণীকান্ত কাকতির মতে, “... পশ্চিম অসমর কথ্যর ই এটা বিশেষত্বপূর্ণ লক্ষণ। ই ইমান বেছিকৈ প্রচলিত যে শব্দ একোটাক দ্বিস্বরীকরণ করি চিনিব নোয়ারা করি পেলায়।” ( পৃঃ ১২৬,) সুনীতি কুমার লিখছেন, “ So far as Bengali is concerned, we see a weakeneing of «-i,-u» after «å,ā» in the 14th century; and the beginnings of epenthesis certainly go back to that century. In the 15th century, in the works of Kŗttibasa , Vijaya-Gupta, and the reast, works which are preserved in rather late MSS, epenthesis is a noticeable thing” (পৃঃ ৩৭৯,) তিনি আরো লিখেছেন, “ Among the NB. Dialects, epenthesis still retains its force in the Vanga or east Bengal speeches. In standard, Colloquial Bengali, and in west Bengali generally, there has been contraction of epenthetic vowels, as well as Umlaut, which was a direct result of epenthesis in these forms of NB.... the 'Crepar Xaxtrer Orthobhed' being in the Dacca dialect, indicates epenthesis quite regularly: e.g., «coina» = কন্যা ( kanyā)” (পৃঃ ৩৮৪,)
             কামরূপের কিম্বা পশ্চিম অসমের অসমীয়ার সঙ্গে বাংলার ঘনিষ্ঠতা সম্পর্কে শরৎ চন্দ্র গোস্বামীর বক্তব্য আমরা আগে উল্লেখ করেছি। তিনি লিখছিলেন, “কামরূপীয়া বা গোয়ালপরীয়া মাত কথাতো বঙলুয়াই। যি বিশিষ্ট ভাষার বহির্ভূত।” 'বঙলুয়া' কথাটার অর্থ কিন্তু 'বাংলা' নয়, বাংলা গন্ধী। বাংলার নিকট সম্পর্কিত। এবারে দেখা যাক স্বয়ং উপেন রাভা হাকাচাম এ নিয়ে কী লিখছেন। তিনি প্রায়ই সত্যের খুব কাছাকাছি গিয়ে চমকে দিচ্ছেন, “ নামনি অসমর অর্থাৎ পশ্চিম অঞ্চলর অসমীয়ার অন্যতম দুটা উপভাষা হৈছে অবিভক্ত কামরূপ জিলাত প্রচলিত কামরূপী উপভাষা আরু অবিভক্ত গোয়ালপারা জিলাত প্রচলিত গোয়ালপরীয়া বা রাজবংশী (ডেশী) উপভাষা...উজনি অসমর অর্থাৎ পূব অঞ্চলর উপভাষা (মান্য অসমীয়া)র সৈতে নামনি অসমর উপভাষাসমূহর বিস্তর পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়।...পশ্চিম গোয়ালপারা অঞ্চলত প্রচলিত রাজবংশীসকলর কথিত অসমীয়ার সৈতে উত্তর বঙ্গ অঞ্চলত প্রচলিত কথিত বাংলার পার্থক্য নাই বুলিবই পারি।” ( পৃঃ ৩৩৪,) রাজবংশী অসমীয়া না বাংলা না স্বতন্ত্র ভাষা--এই প্রশ্ন কামতাপুর আন্দোলনের ফলে আগামী দিনগুলোতে আরো বেশি বেশি করে উঠছে আর উঠবে। গোয়াল পাড়ার লোকগীত যারা গান করেন, তাদের প্রায়ই দেখা যায় অসম সীমান্ত অতিক্রম করলেই বাংলা লোকগান বলে চালিয়ে দেন। অতিনৈকট্যের ফলে বরং এই সমস্যাগুলোও বড় করে দেখা দেয়। কিন্তু যে প্রশ্নটি গুরুত্বপূর্ণ --- ' উত্তর বঙ্গ অঞ্চলত প্রচলিত কথিত বাংলার পার্থক্য নাই' বলে যে উপেন রাভা লিখছেন সিলেটির সঙ্গে পার্থক্যটা কি তার চেয়েও কম? তা যদি না হবে, তবে সিলেটিকেই শুধু 'প্রায় অসমিয়া' করে দেখাবার এতো তোড়জোড় কেন।
              উপেন রাভা হাকাচাম উপরের কথাগুলোর পরেই লিখছেন, “ এই পরিপ্রেক্ষিতত ভাষার রাজনৈতিক বা ভৌগলিক বিভাজনতকৈ সাংস্কৃতিক বা নৃতাত্বিক বিভাজনর গুরুত্ব অপরিসীম বুলি সমাজ ভাষা বিজ্ঞানীসকলে মত প্রকাশ করিছে।” এইটেই গুরুত্বপূর্ণ কথা । আসলে অসমের বর্তমান রাজনৈতিক আকারের সঙ্গে উত্তর বাংলা হয়ে, কোচবিহার, দিনাজপুর, রংপুর, ময়মনসিংহ পার করলেই শুধু সিলেটির সঙ্গে অসমীয়ার যা কিছু আত্মীয়তা তার উৎস সন্ধান করা যেতে পারে। তার আগে দেখা যাবে সমগ্র উত্তর বাংলার জেলাগুলোর ভাষার সঙ্গে অসমীয়ার “পার্থক্য নাই বুলিবই পারি।” ঢাকার ভাষার সঙ্গে বরং অসমীয়ার ঘনিষ্ঠতা অনেক বেশি এ আমরা কিছুটা দেখালাম। এগিয়ে আরো নিচে চলে গেলে নোয়াখালি ,চট্টগ্রামের ভাষাতেও অসমীয়ার আত্মীয়তার সন্ধান পাওয়া যাবে। এর প্রাকৃতিক কারণ নদী ব্রহ্মপুত্র । ঐতিহাসিক কাল জুড়ে এই নদী পথে অসম বাকি বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করেছে । এমন কি রেল স্থাপনের আগে অব্দি উনিশ শতকের অসমিয়া নবজাগরণের অগ্রদূতেরাও বৌদ্ধিক, বৈষয়িক, প্রশাসনিক সমস্ত কাজেই ঐ পথেই জাহাজে কলকাতা থেকে যাতায়াত করতেন। ঢাকার সঙ্গেও তাদের যোগাযোগ ছিল । রেল এসেই প্রথম সেই যোগ ছিন্ন করতে শুরু করে । বৃটিশ বিরোধীতার প্রথম বলি শহীদ মণিরাম দেওয়ান ঢাকাতে গিয়ে ইতিহাসে কুখ্যাত জগৎ শেঠের কোনো এক বংশধরের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করে কলকাতার ব্যবসার গতিপ্রকৃতি অধ্যয়ন করেন। এরা অসমেও ব্যবসা চালাতেন। মণিরামকে কলকাতা নিয়ে গিয়ে বিখ্যাত লাতুবাবুর সঙ্গে 'অসমের রাজা' বলে পরিচয় করিয়েও দেন এরাই। ( পৃঃ ১৫১, অসমীয়া মধ্যবিত্ত শ্রেণীর ইতিহাস, প্রফুল্ল মহন্ত।) প্রবাদপ্রতিম কলাগুরু বিষ্ণু প্রসাদ রাভার জন্ম হয়েছিল ১৯০৯ সনে ঢাকাতে। নদী ব্রহ্মপুত্র অসমিয়া আধুনিকতার প্রথম পুরুষদের মনে দাগ ফেলেছিল এভাবে, “ হিমালয় গর্ভত উৎপত্তি হই ব্রহ্মপুত্র নদ যেনে রূপে আমার দেশেরে বই গই পদ্মা   নদীরে লগালগি সুবিস্তার মেঘনা নাম ধরি মহাসমুদ্রত পরিছে, সেইরূপে আমি সংকীর্ণভাব এড়ি বেদেশী বঙালীরে মিহলি হই উন্নতি সমুদ্রত পড়ো এই কথা সরোগত করিব পারিলে দেশর মঙ্গল হয়।” ( পৃঃ১৮৯, অসমীয়া মধ্যবিত্ত শ্রেণীর ইতিহাস, প্রফুল্ল মহন্ত; নগেন শইকীয়া সম্পাদিত 'আসাম বন্ধু' সংকলনের পৃঃ ৯৫,১০০ থেকে ব্যবহৃত উদ্ধৃতি। সম্ভবত এটি গুণাভিরাম বরুয়ার উক্তি । ) 'বঙালীরে মিহলী (মিশ্রণ) ' হয়ে যেতে এখন কেউ চাইবে না, পরামর্শটি সৎও হ'বে না। কিন্তু 'মিলন' ছিল, আগামিতেও তা দীর্ঘস্থায়ী হবে--সেই মিলনসূত্রটি ব্রহ্মপুত্র-- আমাদের ইঙ্গিত সেদিকে।
               দ্বিতীয় কারণটি এর সঙ্গেই সম্পর্কিত-- কিছুটা নৃতাত্বিক, কিছু ঐতিহাসিক । এখনো বডো, রাভা, রাজবংশী, খাসি, গারো, হাজং ইত্যাদি জনজাতি এই সমগ্র এলাকার সাধারণ অধিবাসি। এই সম্পর্কগুলোর অধ্যয়ন না করে এনিয়ে যেকোনো সিদ্ধান্তই বিচ্ছিন্ন কিম্বা অসম্পূর্ণ হতে বাধ্য । আপাতত আমরা ধ্বনিতত্বের দিক থেকে যেটুকু আলোচনা করলাম সেও খুব একটা ভাষাতত্বের শৃঙ্খলা মেনে নয়। আমাদের আলোচনাও সেই পূর্ণাঙ্গ আলোচনার পথে এক্কেবারেই প্রাথমিক খসড়া মাত্র । বলা ভালো প্রস্তাবনা মাত্র । আপাতত ধ্বনিতত্বের দিকটা সামাল দেয়া গেল। আগামীতে আমরা ভাষার রূপের সাগরে ডুব দেবার চেষ্টা নেব।

7 comments:

Imran molla said...

অনেক কিছুই নতুন জানলাম। একজন বাংলাদেশি বাংগালি হিসেবে অসমীয়া সম্পর্কে বেশি কিছু জানতাম না। তবে সিলেটি ভাষাটা ঠিক অসমীয়ার সাথে যায় বলে মনে হয় না। নোয়াখালি চট্টগ্রামের ভাষার সাথে অসমীয়ার মিল থাকলেও সেটি অসমীয়া তা কেউ কিসের জোরে বলবে তা আমার বোধগম্য নয়। প্রত্যেক ভাষার কিছু শব্দ থাকে যেগুলোর সাথে অন্য ভাষার শব্দের মিল থাকে অথবা কাছাকাছি ধরণের।

Imran molla said...

অনেক কিছুই নতুন জানলাম। একজন বাংলাদেশি বাংগালি হিসেবে অসমীয়া সম্পর্কে বেশি কিছু জানতাম না। তবে সিলেটি ভাষাটা ঠিক অসমীয়ার সাথে যায় বলে মনে হয় না। নোয়াখালি চট্টগ্রামের ভাষার সাথে অসমীয়ার মিল থাকলেও সেটি অসমীয়া তা কেউ কিসের জোরে বলবে তা আমার বোধগম্য নয়। প্রত্যেক ভাষার কিছু শব্দ থাকে যেগুলোর সাথে অন্য ভাষার শব্দের মিল থাকে অথবা কাছাকাছি ধরণের।

Imran molla said...

অনেক কিছুই নতুন জানলাম। একজন বাংলাদেশি বাংগালি হিসেবে অসমীয়া সম্পর্কে বেশি কিছু জানতাম না। তবে সিলেটি ভাষাটা ঠিক অসমীয়ার সাথে যায় বলে মনে হয় না। নোয়াখালি চট্টগ্রামের ভাষার সাথে অসমীয়ার মিল থাকলেও সেটি অসমীয়া তা কেউ কিসের জোরে বলবে তা আমার বোধগম্য নয়। প্রত্যেক ভাষার কিছু শব্দ থাকে যেগুলোর সাথে অন্য ভাষার শব্দের মিল থাকে অথবা কাছাকাছি ধরণের।

Sushanta Kar said...

লেখাটা পড়বার জন্যে ধন্যবাদ। আপনার যা প্রশ্ন আমারও তাই। :)

নাম প্রকাশে অনইচ্ছুক said...

বই গুলা কই পাওয়া যাবে? বিশেষ করে অসামীয়া ভাষার ইতিকথা।
এই ভাষার সাথে কি কোন না কোন ভাবে বাংলা ভাষার সম্পৃক্ত ছিলো।
মানে এই ভাষার উৎপত্তি কি বাংলা ভাষা থেকে?

নাম প্রকাশে অনইচ্ছুক said...

বই গুলা কই পাওয়া যাবে? বিশেষ করে অসামীয়া ভাষার ইতিকথা।
এই ভাষার সাথে কি কোন না কোন ভাবে বাংলা ভাষার সম্পৃক্ত ছিলো।
মানে এই ভাষার উৎপত্তি কি বাংলা ভাষা থেকে?

সুশান্ত কর said...

অসমে আসতে হবে। গুয়াহাটি পান বাজারে। অথবা নাম দেখে নেটে সার্চ করে দেখুন, আন্তর্জালে কেউ বিক্রি করছে কি না।