আমার চেতনার রঙে রাঙানো এই খেলা ঘরে:

~0~0~! আপনাকে স্বাগতম !~0~0~

*******************************************************************************************************

Saturday 14 January 2012

বাঙালি উগ্রজাতীয়তাবাদ এবং উত্তর বঙ্গের জনগোষ্ঠীগত পাকচক্র



মুল অসমিয়াঃ ভাস্কর নন্দী 
বাংলা অনুবাদঃ সুশান্ত কর

বাঙালি উগ্রজাতীয়তাবাদের ‘মহাআখ্যান’
                  বাঙালি উগ্রজাতীয়তাবাদের ‘মহাআখ্যান’টি শুরু থেকেই তৈরি হয়েছিল বাংলার উচ্চবর্ণহিন্দু ভদ্রলোকের চাহিদামতো সমাজ এবং প্রতিষ্ঠানগুলোর সম্পর্কে মহাজাগতিক (cosmological) ধারণা দিয়ে  । যে জটিল দ্বন্দ্ব এই জাতীয়তাবাদকে সামনে নিয়ে যেতে চায় সেই আখ্যান এই প্রবন্ধে  বিবেচনার বিষয় নয়। উত্তর বাংলা এবং পশ্চিমাঞ্চলে ( যাকে আজকাল ‘জঙ্গলমহল’ বলা হচ্ছে)  এই জাতীয়তাবাদ যে বিভাজনমুখী প্রবণতার মধ্যে পড়েছে, সেই পটভূমিতে আমরা শুধু এই কথাটাই এখানে বলে রাখতে চাইছি যে অতীতেও বিভাজন রোধ করতে ভীষণভাবে ব্যর্থ হয়েছিল।  সেজন্যে অদূরেই যে  অন্ধকার ভবিষ্যত আমাদের জন্যে অপেক্ষা করছে আমরা  শুধু তার কারণগুলোই এখানে আলোচনা করতে চাইব।
       জাতীয়তাবাদ যেখানেই সফল হয়েছে সেখানেই সে সংশ্লিষ্ট ভূখন্ডে বসতরত নানা ধর্ম, ভাষা এবং জাতি বর্ণে বিভক্ত মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করেছে। কিন্তু বাঙালি উচ্চবর্গের অভিজাত শ্রেণিটি নিজের অর্ধ-সামন্তবাদী (চিরস্থায়ী বন্দোবস্তজনিত) পটভূমিকে অতিক্রম করতে পারেনি, আর তাই প্রয়োজনীয় অর্থনৈতিক এবং সামাজিক গতিশীলতাও সৃষ্টি করতে পারেনি। সেরকম গতিশীলতার অভাবের জন্যেই এই শ্রেণিটি নিজে মুখোমুখি হয়েছে যে জনগোষ্ঠীগত পার্থক্যগুলোর সামনে সেগুলোকেও অতিক্রম করতে পারেনি।
         ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের কর্মকর্তা হিসেবে বিকশিত বাঙালি প্রটোবোর্জুয়াদের সামন্তীয় বন্ধন স্পষ্ট হয়ে পড়ে আধুনিক মানভাষা হিসেবে বাংলার বিকাশের প্রক্রিয়াটিতে। সাধারণ মানুষের মুখের ভাষা থেকে যতটা পারে ততটাই সরে এলো ভাষাটি এবং সংস্কৃতের উপর বড় বেশি করে নির্ভর করতে শুরু করল। এই সংস্কৃত ছিল কেবল ব্রাহ্মণ্যবাদী অভিজাত শ্রেণিটিরই ভাষা। কিন্তু এই ভাষার নির্মাণেই নয়, অন্য সমস্ত সাংস্কৃতিক এবং সামাজিক ক্ষেত্রেও সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম এবং নিম্নবর্গ জাতির মানুষের জাতীয়তার প্রতীকচিহ্নগুলোকে প্রায় সম্পূর্ণই সরিয়ে ফেলা হলো।  এই বহির্ভূতকরণের   ফলে ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষকে প্রান্তিক অবস্থানে ঠেলে দেয়া হলো। তার ফলে অর্থনীতি বহির্ভূত বল প্রয়োগের মধ্যি দিয়ে উদ্বৃত্ত খাজনা সংগ্রহের রাস্তা খুলে গেল। যখন ঔপনিবেশিক শিক্ষা এবং প্রশাসনের ফুটো দিয়ে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের এই হিতাধিকারীদের মধ্যে ইউরোপীয় বোর্জুয়া আধুনিকতার প্রবেশ সুগম করে তুলল, তাকে নবজাগরণ বলে বলা হলো। কিন্তু তথাকথিত নবজাগরণও প্রকৃত সামাজিক উৎপাদন সম্পর্ককে অতিক্রম এবং গ্রাস করতে পারল না। আধুনিকতার এই স্পর্শ এবং তার সঙ্গে শক্তিশালী প্রশাসনিক এবং সামন্তীয় শক্তির মেলবন্ধন উচ্চবর্গীয় উগ্রজাতীয়তাবাদকে  এনে দিল প্রান্তিক মানুষের উপর প্রাধান্য বিস্তারের স্বাদ, যা কিনা এখন অব্দি চলছে।  ভারতের অন্যান্য বহু জায়গার মতো সে তার সামাজিক দূরত্ব ব্যক্তিগত বাহিনি বা বাহুবলে টিকিয়ে রাখেনি, রেখেছিল সামাজিক সাংস্কৃতিক বিদ্বেষ এবং গোঁয়ার্তুমী দিয়ে । বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য  সুদূর পরাহত হয়েই রইল।
       
           যারাই কোনোক্রমে গড়াগড়ি করতে করতে বহু কাঙ্খিত ভদ্রলোকের মর্যাদা পেয়েছিল , এই উগ্রজাতীয়তাবাদ তার ভেতর মহল থেকে উচ্চবর্গের বাইরে সেই সমস্ত বর্গকেও  সরিয়ে রাখল। সেটি না বুঝতে পারলে ভদ্রলোক-বামপন্থীদের শাসিত পশ্চিম বাংলাতে দলিত এবং মুসলমান সম্প্রদায়গুলোর চাকরি-বাকরি এবং তেমন অন্যান্য ক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকার শোকাবহ পরিস্থিতিকে ব্যাখ্যা করা যাবে না। সাধারণ ক্ষেত্রে যদি , সর্বহারা মূল্যবোধের জীবিকাগুলোকে গুরুত্বসহ নেয়া হতো তবে গ্রাম্য এবং নাগরিক সর্বহারার বৃহত্তম অংশ মুসলিমদের অবস্থা ভালো হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু প্রকৃতার্থে চিত্তরঞ্জন দাশের বিতর্কিত নাতিটি কংগ্রেস মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে দরিদ্র এবং সর্বস্বান্ত মুসলিমদের জন্যে যতটা করেছিলেন, সর্বহারার স্বয়ম্ভু অগ্রণী বাহিনীটি কিন্তু সেটুকুও করে নি। অবশ্য ঐ নাতি-মুখ্যমন্ত্রী যেটুকু করেছিলেন তাও তাঁর দাদু বঙ্গচুক্তির মধ্য দিয়ে মুসলমানদের যেটুকু দিতে চেয়েছিলেন তার’চে সামান্যও বেশি ছিল না।
     চিত্তরঞ্জন দাশের পদক্ষেপটিই ছিল মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠকে বাঙালি জাতির ভেতরে টেনে নেবার মহান পদক্ষেপ।  কিন্তু সুরেন্দ্রনাথ বেনার্জী, বিপিন চন্দ্র পালের মতো বিখ্যাত নেতাদের নেতৃত্বাধীন ভদ্রলোক-সমাজ এই চুক্তির বিরোধীতা করল, এবং শেষে গিয়ে জাতীয় কংগ্রেসকে দিয়ে সেই চুক্তির বিরোধীতা করালো। ধার ঋণ বা আধিয়ার রায়তের অধিকার ইত্যাদি যেসব বিষয় মুসলিম এবং অনুঃজাতির সঙ্গে অধিক ঐক্য সম্ভব করতে পারত, সেগুলোর ক্ষেত্রে ভদ্রলোক নেতৃত্ব দৃঢ়ভাবে স্থিতাবস্থার পক্ষে দাঁড়াল। সংহতি সাধক এমন দৃষ্টিভঙ্গীর অভাবই বঙ্গভঙ্গের আধারশিলা স্থাপন করে, যা হলোগে বাঙালি জাতির সবচে’ বড় ব্যর্থতা। পশ্চিম বঙ্গের সাম্প্রতিক সময়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদ আরেক ঐতিহাসিক পরাজয়ের সম্ভাবনাতে সগর্ভা। এবারে প্রধান যুদ্ধক্ষেত্র হলো উত্তর বঙ্গ।
           উত্তরবাংলার ছ’টি জেলার ভেতরে দার্জিলিংকে বাদ দিয়ে অন্য পাঁচটি  জেলাকে কেন্দ্রীয় সরকারই অতি পিছিয়ে পড়া জেলা হিসবে চিহ্নিত করেছে। দার্জিলিং বাদ পড়ে যাবার মূল কারণ হলো শিলিগুড়ি এবং দার্জিলিঙের নাগরিক বিস্তৃতি এবং সেগুলোর ব্যবসা বাণিজ্য, ছোট এবং মাঝারি উদ্যোগ, পরিবহন, পর্যটন, প্রশাসনীয় কার্যকলাপ, শিক্ষানুষ্ঠান, তুলনামূলক ভাবে ভালো আন্তর্কাঠামো এবং মানব বিকাশ। এই সমস্ত মিলে দার্জিলিং জেলাকে ‘পিছিয়ে পড়া’র সংজ্ঞার থেকে সরিয়ে রেখেছে যদিও, একই জেলার রাজস্ব এবং আরণ্যক গ্রামগুলোতে , চা-বাগানগুলোতে যদি আমরা আন্তর্কাঠামো এবং মানব বিকাশের দিকে চোখ ফেলি তবে তাদের অবস্থাও দেখব অন্য পাঁচটি পিছিয়ে পড়া জেলারই মতো, ভালো কিছু নয়। এই পিছিয়ে পড়া অবস্থার সঙ্গে এলাকাটির চা-মালিক এবং অন্যান্য পুঁজিপতি গোষ্ঠীকে দিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠের উপর প্রভুত্বকারী উচ্চবর্গের শাসক শ্রেণিটির স্বার্থের মধ্যে এক স্পষ্ট সম্পর্ক আছে।
            এই পিছিয়ে পড়া পরিস্থিতিটি উপর উপর শান্ত মনে হলেও জনগোষ্ঠী বা জাতিসত্তার রূপে  নিজেকে পরিচিত করতে চান তেমন এক বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ এখানে রয়েছেন। গেল শতকে আশির দশকের গোর্খা আন্দোলনকে বাদ দিলে অন্যদের বেলা তেমন হিংসাত্মক আন্দোলন হয় নিঅবশ্যি কামতাপুর লিবারেশন অর্গেনাইজেশনে’র মতো কিছু সংগঠনের নেতৃত্বে ক্ষণস্থায়ী হিংসাত্মক অভিযান যে একেবারে হয় নি, তাও নয়।  রাজ্য এবং দেশ যারা শাসন করেন তাদের জন্যে এগুলো নিশ্চয় ছিল গভীর বিপদের সংকেত। এই পরিস্থিতিকে কেউ কেউ আবার এক গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ এবং সমাজবাদী রাজনৈতিক ব্যবস্থার স্বার্থে শ্রেণি সংগ্রাম বিকাশের পথে এক বড় বাধা হিসেবেও ধারণা করে নিয়েছেন। এই প্রতিবাদ এবং আন্দোলনগুলো বাঙালি উচ্চবর্গের রাজনৈতিক  শ্রেণিটির দ্বারা জনসংখ্যার সুবিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের নিম্নবর্গের সম্প্রদায়গুলোর প্রতি সামাজিক শত্রুতা, উন্নয়নগত অবহেলা এবং সাংস্কৃতিক উন্নাসিকতার বিরুদ্ধে কেন্দ্রীভূত।
            বড় করে দেখলে উত্তরবাংলাতে তিনটা বড়বড় আন্দোলনকে চোখের সামনেই দেখা যায়ঃ তার একটি হচ্ছে পশ্চিম বাংলার থেকে পৃথক রাজ্যের জন্য গোর্খাদের আন্দোলন, চাবাগানের আদিবাসিদের আন্দোলন এবং কামতাপুরি আন্দোলন অথবা এরই অন্য এক রূপ বৃহত্তর কোচবিহার আন্দোলন।

গোর্খাদের আন্দোলন
            বাংলার দুই স্থানীয় শাসক দলই বাংলা ভাগ হতে দেবে না বলে নিজেদের অনুগামীদের সান্ত্বনা দিতে পারে, কিন্ত প্রকৃত পক্ষে এই দুই দলই গোর্খাদের জন্যে এই আলাদা ভূমিখন্ডের সীমা এঁকে ফেলেছে। সে হলো, আগেরকার গোর্খা ভূ-খন্ডগত কর্তৃত্ব (Gorkha Territorial Authority. GTA) এবং এখনকার গোর্খা পার্বত্য পরিষদ (Gorkha Hill Council) কেউই সাহসের সঙ্গে স্বীকার না করলেও এটি আসলে এক ফেডারেল ব্যবস্থা।
            গোর্খালেণ্ড নামের নতুন রাজ্যটির গঠন এখন শুধু সময়ের ব্যাপার। আমরা শুধু এই আশাই করতে পারি যে বিষয়টি নিষ্পত্তি করতে গিয়ে আমাদের যেন কোনো উচ্চ সামাজিক মূল্য দিতে না হয়।
দার্জিলিং জেলার তিনটা পাহাড়ি মহকুমাতে একটি আলাদা গোর্খা রাজ্য গঠনের জন্যে গোর্খাদের দাবি অনেক আগেই মেনে নেয়া উচিত ছিল। ভারতবর্ষের জন্যে রাজ্যগুলোর পুনর্গঠন নতুন কথা কিছু নয়। ভারত বিভাজনের দিন থেকে ভারতের মানচিত্রে ক্রমাগত পরিবর্তন হয়েই এসছে। পুরোনো রাজাশাসিত রাজ্যগুলোকে নিয়ে ভারত গণরাজ্যের গঠনের সময়েও কেরালা, তামিলনাড়ু, অন্ধ্র, কর্ণাটক, মহারাষ্ট্র, গুজরাট, পাঞ্জাব, হরিয়ানা, হিমাচল, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড়, উত্তরাখন্ড, ঝারখন্ড, অরুণাচল, মেঘালয়, নাগালেণ্ড ইত্যাদি রাজ্য ছিল না। তথাকথিত মূলস্রোতের বামপন্থীদের এক কথা মনে করিয়ে দেয়া দরকার যে একসময়ের বম্বে ভেঙ্গে মহারাষ্ট্র এবং গুজরাট গঠন করবার সময় বা সেরকম অন্য পরিস্থিতিতে তারাতো দেখি সে রকম রাজ্য গঠনের পক্ষেই দাঁড়িয়েছিল। অবশ্য, তারা হয়তো সেগুলোকে অতীতের ভুল বলে বলবে, এবং তার জন্যে কখনো বা আত্মসমালোচনাও করবে। কিন্তু সেরকম ভুলতো তারা তার পরেও করেছে। তার মধ্যে সবচে’ মারাত্মকটি হচ্ছে গোর্খা আন্দোলনের সময় সিপি আই-র কথা ‘ভুল’টি। দলটির তখনো কিছু বিপ্লবী রক্ত ছিল বলেই বোধ হয়, সে সময়ে ওরা গোর্খা জনগণের সমর্থণে তিনটি সূত্রের কথা বলেছিলেনঃ ১) ভারতের থেকে বিচ্ছিন্ন এক স্বাধীন দার্জিলিং রাষ্ট্র, ২) বিচ্ছিন্নতার পরে নেপালের সঙ্গে সংযুক্তি, ৩) ভারতের ভেতরে এক আলাদা রাজ্য । ‘ক্রেমলিনের বৃদ্ধপিতামহ’ (মাও একবার স্তালিন সম্পর্কে এরকম বলেছিলেন) সিপি আই-র সেই স্থিতিকে নিশ্চয়ই অনুমোদন জানিয়েছিলেন, কেননা বিচ্ছিন্নতার পর্যায় অব্দি জাতিসত্বাগুলোর আত্মনিয়ন্ত্রণেরপ্রসঙ্গে তাঁর স্থিতির কথা সবাই জানেন।
           কিন্তু সেই ‘বৃদ্ধ পিতামহ’ এখন পার্টি অফিসের নিথর মূর্তির বাইরে আর কিছুই নন। এখন ‘ঐক্য এবং সংহতি’র স্লোগানের দিন। কাশ্মীরের কথা উঠলেই ভারতের সঙ্গে ঐক্য এবং সংহতির কথা বলা হয়। তাহলে ভারতের ভেতরে যা গঠিত হবে সেই গোর্খালেন্ডই বা কী করে ঐক্য এবং সংহতিকে বিপন্ন করল? সেইটেই আসল কথা। কারণ বাংলার দুই শাসক দলের জন্যেই এ হচ্ছে বাংলার ঐক্য এবং অবিচ্ছিন্নতার প্রশ্ন। ‘বাংলাকে ভাগ হতে দেব না!” আমরা এভাবেই মার্ক্সবাদের উঁচু জমির থেকে এমনকি বৃহৎ ভারতীয় জাতীয়তাবাদের থেকেও নিচে নেমে আসি আর বাঙালি উগ্রজাতীয়তাবাদের ডোবাতে মাথা ডুবাই!
          দার্জিলিঙের তিনটা পার্বতীয় মহকুমা (এবং সেই সঙ্গে দার্জিলিঙের তরাই অঞ্চলও) ব্রিটিশ যুদ্ধ এবং ষড়যন্ত্রের মধ্যি দিয়ে জয় না করা অব্দি ঐতিহাসিক বাংলার অংশ হয় নি। ব্রিটিশ সিকিমের চোগিয়াল এবং ভূটানের রাজার থেকে দার্জিলিং এবং কালিম্পং কেড়ে নিয়েছিল। এই অঞ্চল  বাংলার অংশ বলে বলাটা যেমন, বিহার, ঝাড়খণ্ড, উড়িষ্যা এবং অসমের পুরোনো গোয়ালপাড়া জেলা বাংলার অংশ বলে বলাটাও তেমনি কথা। বৃটিশের প্রশাসনিক নির্দেশ এবং সুবিধা ছাড়া এগুলো কখনোই বাংলার অংশ হতে পারত না। বিহার, ঝাড়খন্ড, উড়িষ্যা, গোয়ালপাড়ার মতো জায়গাতেও বিশ শতকের শুরুতেই ব্যাপক বাঙালি থাকার বিপরীতে দার্জিলিং পাহাড়ে আজ অব্দি সাবেক বাঙালি বসতি নেই বললেই চলে। এই পাহাড়গুলো কী করে বাংলা হলো সে আমাদের বোধশক্তির বাইরে, কিন্তু প্রমাণ বহন করে এক ঔপনিবেশিক-উগ্রজাতীয়তাবাদী মানসিকতার। 

             ডুয়ার্স এবং তরাই শিলিগুড়িকে নিয়ে একটি গোর্খা রাজ্যের মূল দাবিটা ছিল সম্প্রসারণবাদী এবং উগ্র-জাতীয়তাবাদী। কারণ এই অঞ্চলগুলোতে গোর্খারা  এক ছোট সংখ্যালঘু অংশ এবং কখনোই তার ভূমিপুত্র ছিল না। গোর্খা ভূ-খন্ডগত কর্তৃপক্ষের (GTA)র সাম্প্রতিক আলোচনাগুলো এই দাবিকে মাত্র কয়েকশ মৌজার দাবিতে পর্যবসিত করেছে। এই মৌজাগুলোতে গোর্খা সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকা না থাকাটা নিশ্চিত করতে একটি সমিতি গড়ে দেয়া হয়েছে। রাজ্য সরকার গোর্খা সংখ্যাগরিষ্ঠতা এবং সংলগ্নতা আছে এমন মৌজাগুলোকে (GTA) তে অন্তর্ভূক্ত করবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এই প্রতিশ্রুতিতে আপত্তিকর কিছুই নেই। এমন মীমাংশার পূর্ব নজিরও আছে। পাঞ্জাব এবং হরিয়ানার বিভাজনের সময় আবোহর এবং ফাজিলকাকে নিয়ে পাঞ্জাবী এবং হিন্দিভাষীদের মধ্যে এমন বিবাদ হয়েছিল । তার মীমাংশা হয়েছিল এই নীতির ভিত্তিতে যে ‘গ্রামকে একক এবং সংলগ্নতা’র ভিত্তিতে নেয়া হবে।
চাবাগানের আদিবাসিদের আন্দোলন
             বাঙালি উগ্রজাতীয়তাবাদের উস্কানি এবং ক্রমাগত বর্বরতাপূর্ণ গোর্খা প্ররোচনার ফলে GTAতে ভূখন্ড সম্পর্কে এক অতি শক্তিশালী  প্রতিরোধ গড়ে উঠেছে। এই প্রতিরোধের পেছনে প্রধান শক্তি হচ্ছে আদিবাসি বিকাশ পরিষদ (AVP) নামে চা-বাগানের আদিবাসিদের এক সংগঠন। এই AVP হচ্ছে এক শক্ত পুঁজির পুরোনো বেসরকারী সংগঠন, যার মূখ্য কার্যালয় পশ্চিম বাংলার বাইরে। ডুয়ার্স এবং তরাইকে গোর্খাল্যাণ্ডের অন্তর্ভূক্ত করার দাবিতে সাম্প্রতিক আন্দোলনের আগে অব্দি এই AVP উত্তরবাংলাতে প্রায় অপরিচিত ছিল। দূয়ার্স এবং তরাইর জন্যে সংবিধানের ষষ্ট  অনুসূচীর অধীনে স্বায়ত্বশাসনের দাবি জানিয়ে এবং সে এলাকাতে গোর্খা স্বায়ত্ত শাসনের  বিরোধীতা  করেই এভিপি বিখ্যাত হয়েছিল। এই সংগঠনটি গুরুতর সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ছড়িয়ে দিয়েছিল এবং এর স্থানীয় নেতারা গোর্খাদের ভয়-ভীতি প্রদর্শন করে গুরুতর সাম্প্রদায়িক হিংসাতে জড়িয়ে পড়েছিল।
            
     এখন একটি সমিতি ডুয়ার্স  আর তরাইর এক বড় অংশের মৌজা ( ১৭০টার থেকেও বেশি) জিটিএ-তে ঢোকাবার জন্যে গোর্খাদের দাবিটি পরীক্ষা করছে। এভিপি এই নিয়ে যেকোনো জরিপের পথে শারীরিক বাধা গড়ে তুলেছে। এভিপিকে প্রকাশ্যে সমর্থণ দিচ্ছে এমন কিছু উগ্রজাতীয়তাবাদী  সংগঠন যারা গোর্খালেণ্ড দাবির যেকোনো প্রকাশের বিরোধীতা করে আসছে। এই বাঙালি সংগঠনগুলোর সদস্যদের মধ্যে সমস্ত ধরণের রাজনৈতিক দলের লোকজনকে দেখা যাচ্ছে।
           জনপ্রিয় সাংবাদিক-পরিভাষাতে উত্তর বাংলার রাজনীতিতে এভিপির এই হঠাৎ উত্থানকে নানারকম ব্যাখ্যা করা হচ্ছে। যেমন , গোর্খা প্রভুত্ব এবং উগ্রজাতীয়তাবাদের বিরোধীতা, এই বিশেষ মূলস্রোতের রাজনৈতিক দলের চক্রান্ত এবং  সেই দলের একজন শক্তিশালী নেতা এভিপিকে টাকা এবং কর্মী যোগান দিয়ে গোর্খা আন্দোলনকে স্তব্ধ করে দিতে চাইছেন, মধ্যভারতের পাহাড় –জঙ্গল এলাকার থেকে জঙ্গলমহল অব্দি আদিবাসি চেতনার বিস্তার ...ইত্যাদি ইত্যাদি। যদিও এই জল্পনা কল্পনাগুলোর পেছনে কিছু সত্য আছে, তবু  সেগুলো চা-বাগানের আদিবাসী শ্রমিকের এই আকস্মিক বিস্ফোরক উত্থানের ব্যাখ্যা করতে পারে না। কারণ তেমন এই ব্যাখ্যার জন্যে আমাদের কিছু সময়ের জন্যে হলেও ডুয়ার্স এবং তরাইর চা শ্রমিকের সাম্প্রতিক ইতিহাসে প্রবেশ করতে হবে। এক্ষেত্রে প্রথম উল্লেখযোগ্য কথাটা হলো, এই যে  ঐ এলাকার বাগানগুলোতে ২০০৩-০৭ সনের ভেতরে ১২০০এর থেকেও বেশি শ্রমিক আর তাদের পরিবারের সদস্যের খাদ্যাভাব জনিত তীব্র অপুষ্টিতে মৃত্যু হয়। সরকার, শাসক দলগুলো এবং মালিক সংস্থাগুলো অবশ্য মৃতের এই সংখ্যা সব সময়েই বিরোধীতা করে এসছে। কারণ এটি তাদের বিফলতার সূচক। তার উপর রয়েছে, আরেকটি অতিরিক্ত সমস্যা। সে হলো, ডাক্তারেরা সাধারণত এমন মৃত্যুকে’ হৃদযন্ত্র-শাসযন্ত্র’জনিত মৃত্যু বলে বলে দেয়। তার মানে ‘মৃত্যুর কারণ মৃত্যু’ বলে বলবার মতো।  একজন ডাক্তার অবশ্য ‘ তীব্র অপুষ্টিজনিত কারণে হৃদযন্ত্র শ্বাসযন্ত্র বিকল হয়েছে’ বলে মৃত্যুর কারণ নথিবদ্ধ করেছিলেন । কিন্তু তেহেলকার একজন সাংবাদিক তাঁর সেই নথি সম্পর্কে সাক্ষাৎ করতে যেতেই ট্রেড ইউনিয়নের গুণ্ডারা সেই ডাক্তারকে বাগান থেকেই তাড়িয়ে দিয়েছিল।
         সরকারি পক্ষ অস্বীকার করলেও এই নিয়ে এক গণ ন্যায়াধীকরণ গঠিত হয়। মুম্বাই ন্যায়ালয়ের একজন অবসর প্রাপ্ত ন্যায়াধীশকে অধ্যক্ষ এবং একজন অবসরপ্রাপ্ত চা-বাগান পরিচালক, বম্বে উচ্চন্যায়ালয়ের একজন জ্যেষ্ঠ পরামর্শদাতা, একজন অবসরপ্রাপ্ত মুখ্যসচিব, উত্তর বাংলার অর্থনীতি এবং চা-বাগান সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ একজন এমেরিটাস প্রফেসর , একজন নেতৃস্থানীয় অধিবক্তা এবং বেশ ক’জন বিশিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপককে সদস্য হিসেবে নিয়ে গঠিত এই ন্যায়াধীকরণ ছ’টি বন্ধ বাগান পরিদর্শন করে। সেগুলোতে বড় বড় প্রকাশ্য শুনানী হয়। যেখানে ট্রেড ইউনিয়ন কর্মী, চা-মালিক কর্তৃপক্ষ, বিধায়ক, এন জি ও, এবং সাক্ষ্য দিতে ইচ্ছুক জনতা সাক্ষ্য দেন। এমনকি জলপাইগুড়ি জেলা প্রশাসনের উপর মহলও রুদ্ধদ্বার কক্ষে সাক্ষ্য দেয় ন্যায়াধীকরণ এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে ২০০৮ সনের ভেতরে ৮০০রো বেশি মানুষ অপুষ্টির ফলে মারা যায়।
           সর্বোচ্চ আদালতের ‘খাদ্যের অধিকার’ পীঠের নিযুক্ত একজন আধিকারিকের তৈরি একটি প্রতিবেদনের ভিত্তিতে আদালত পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে অত্যন্ত কম মূল্যে খাদ্যশস্য যোগান, মাসের অন্তত ১৫ দিনের সার্বজনীন কাজ এবং বাগানে বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা, বেকার শ্রমিকদের জন্যে ভাতা ইত্যাদির ব্যবস্থা করবার নির্দেশ দেয়। রাজ্যসরকার মাসের পর মাস জুড়ে এই নির্দেশ পালন না করে রেখে দেয়।পুরোতো দূরেই থাক মোটামোটি ভালো করে এই নির্দেশের  প্রয়োগ শুরু করতেই বছরের পর বছর পেরিয়ে যায়। আমার নিজের হিসেব মতে এই নির্দেশের পরেও ৪০০ মানুষের মৃত্যু হয় খিদের জ্বালায়। গণ ন্যায়াধীকরণের ৮০০র সঙ্গে একে যোগ করলে নাহার মৃত্যুর বলির সংখ্যা দাঁড়ায় ১২০০।
একটি রাজ্য সরকার যে আদালত নির্দেশ না দেয়া অব্দি কিছুই করলনা, যাও কিছু করল, ২০০৭ অব্দি ছাড়াভাঙ্গা করে করল, তার থেকেই রাজ্যসরকারের উগ্রজাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক চরিত্র বড় করে ধরা পড়ে। এই নিয়ে আমরা আবার আসব পরে।
            এই দায়সারা সাহায্যের থেকেও বাজে কথাটি হচ্ছে এই যে রাজ্য এবং কেন্দ্রের সরকার এই দুর্ভিক্ষের মতো পরিস্থিতির জন্যে দায়ীদের প্রতি যা ব্যবহার করল সেটি। বন্ধ করে দেয়া ৩২টি বাগানকে অবৈধভাবে পরিত্যাগ করা হয়েছে।বাগানগুলোর মালিক পক্ষ শ্রমিক মজুরির বিশাল বকেয়া, নগদ এবং বস্তুর রূপে ( রেশন বলে ঢাকঢোল বাজিয়ে যে খাদ্যাদি দিয়ে থাকে সেগুলোতো আর সত্যি সত্যিই দান খয়রাত নয়, মজুরিরই অংশ) প্রাপ্য গ্র্যাচুইটি , ভবিষ্যনিধি ইত্যাদি হজম করে ফেলেছিল। তাঁরা সরকার এবং বেংকের থেকে নেয়া ঋণও হজম করে ফেলেছিল। কারণ তারা তাদের চা নিলাম বাজারে বিক্রি না করে সরাসরি বিক্রি করেছিল যাতে এরকম হিসাব বহির্ভূত বিক্রির মধ্যি দিয়ে নিজেকে দেউলিয়া এবং বাগানকে রুগ্ন বলে দাবি করতে পারে।
          চা আইন কেন্দ্রীয় সরকারকে চা মালিকদের এমন  অপরাধের জন্যে সাজা দেবার কর্তৃত্ব     দিয়েছে । সেরকম সর্বোচ্চ শাস্তি হতে পারে ক্ষতিপূরণ না দিয়ে  তাদের বাগান বাজেয়াপ্ত করা। কিন্তু সেরকম কার্যব্যবস্থা সম্পর্কে কাউকে কোনো ভাবনা চিন্তা করতেও দেখা গেল না। রাজ্য সরকারও পারত এই বাগান মালিকগুলোকে বিশ্বাসভঙ্গ এবং অপব্যবহারের অভিযোগে শাস্তি দিতে। কারণ তারা শ্রমিকের মজুরির থেকে তাদের ভবিষ্যবনিধির জন্যে কেটে রাখা ধন যথাস্থানে জমা না দিয়ে আত্মসাৎ করেছে। কিন্তু সরকার নাড়াচাড়া করলই না। বকেয়া ধন আদায় দেবার প্রতিশ্রুতি মাত্র দেয়া হলো—পূরণ কিন্তু কখনোই করা হলো না। শ্রমিকেরাও এই পরিস্থিতিকেই মেনে নিয়ে চুপ থাকতে হলো, কারণ প্রতিবাদ করলেই যদি মালিক পক্ষ বাগান ছেড়ে চলে যায়। আর তেমন হলে রাজ্য বা কেন্দ্রের কোনো সরকারইতো তাদের দিকে ফিরেও তাকাবে না।
         এই জনজাতীয় শ্রমিকদের প্রতি যে ব্যবহার করা হয়েছিল সে এক কলঙ্কিত কাহিনি। আবাসন, চিকিৎসা, অনাময়, খাবার জল ইত্যাদি যেসব কল্যাণমূলক বিধির কথা ১৯৫১ সনের বাগিচা-শ্রম আইনে উল্লেখ করা ছিল সেসব মালিক পক্ষ অনেক আগেই ত্যাগ করেছিল। কিন্তু রাজ্য সরকার ভ্রুক্ষেপ মাত্রও করেনি। কিন্তু বৃহত্তম কেলেঙ্কারি হয়েছিল মজুরকে নিয়ে।
          এখনকার মজুরি হচ্ছে সমতলে ৮৫ টাকা এবং পাহাড়ে ৯০টাকা। আমরা প্রথমে তাকাই চলুন এই সংখ্যাগুলো কিসের ইঙ্গিত দেয় সেদিকে। কারণ মজুরির একটা অংশ নগদ একটা অংশ বস্তুতে দেয়া হয়। গোটা এক বছরের জন্যে বিস্তর লাকড়ি বাগান কর্তৃপক্ষ কিনে নেয় সরকারি বন বিভাগ থেকে একেবারেই জলের দামে, ৩০০ থেকে ৫০০টাকার মধ্যে। প্রত্যেক শ্রমিক মাসে ৪০০ গ্রাম চাপাতা পেয়ে থাকে। তারপর আছে ‘রেশন’। মহিলা শ্রমিকের সংখ্যা মোট শ্রমিকের অর্দ্ধেকের থেকেও বেশি। অথচ তারা তাদের স্বামীর জন্যে রেশন পান না, স্বামী কাজ করলে কিন্তু স্ত্রীর জন্যে পেয়ে থাকেন। এটি দেখা দেখি ‘সমান কাজের জন্যে সমান পারিশ্রমিক’ নীতির বিরোধী। কিন্তু আমাদের নারী আন্দোলনের বাঙালি উগ্রজাতীয়তাবাদী চরিত্র লাখ লাখ শ্রমিক নারীর প্রতি এমন বৈষম্যের বিরুদ্ধে কথা বলতেই দেয় না। বিবাহিত হলে পুরুষ বা মহিলা শ্রমিক তাদের প্রাপ্যের মাত্র চারভাগের একভাগই পায়। আর যদি একজন শ্রমিক বিবাহিত হয়, তবে তাদের সন্তান দুটো হওয়া দরকার যাতে রেশন আরেকভাগ বেশি পায়। কিন্তু আমরা যদি রেশনের হিসেব করি, তখন দেখব যে সেই রেশনের জিনিসগুলো মালিক পক্ষ গণ বণ্টণ ব্যবস্থার থেকেই অতি কম দামে সংগ্রহ করে শ্রমিককে দেবার বেলা সেই মূল্য বাড়িয়ে দেখায়। বাগান মেনেজার এবং রেশন দোকানীর মধ্যে এই নিয়ে এক দারুণ বোঝাপড়া থাকে। সেজন্যেই রেশনের নামে শ্রমিকদের দেয়া এই জিনিসগুলো দাম দৈনিক ২০টাকার থেকেও কম। তার অর্থ হলো পাহাড়ে ২০+৯০=১১০ টাকা, সমতলে ২০+৮৫=১০৫টাকা। এই দুটো মূল্যই কৃষিমজুরের ন্যূনতম মজুরি ১৩০টাকার থেকে কম।কেন্দ্র সরকারের দ্বারা যে কোনো কাজের জন্যে নির্ধারিত ন্যূনতম মজুরির (flour wage) থেকেও এর পরিমাণ কম।
           এই অন্ধকার ছবির পটভূমিতে নিম্নতম মজুরির প্রশ্নটি বিচার করুন। ১৯৪৮সনে ন্যূনতম মজুরি আইনের তালিকাতে চা উদ্যোগ ছিল । এটি সবার জানা কথা যে ১৯৫৬ সনের পঞ্চদশ সর্বভারতীয় শ্রম সম্মেলন অব্দি এই আইনটি প্রয়োগের জন্যে কিছুই করা হয় নি। পুঁজিবাদী শিবিরের হর্তাকর্তারা, একটি ইউনিয়ন এবং সরকারের প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে ঐ সম্মেলনে মজুরি নির্ধারণের সুনির্দিষ্ট পদ্ধতিগুলো ঠিক করেছিল। ঠিক তার পর থেকেই সমস্ত তালিকাভুক্ত উদ্যোগের মজুরি নির্ধারণ সময়ে সময়ে হয়ে এসছে। তামিল নাড়ু, কেরালা এবং কর্ণাটকের মতো রাজ্য যেখানে বড় বড় চা-বাগান রয়েছে সেই সব রাজ্যও  বিধিবদ্ধভাবেই সময়ে সময়ে চা-শ্রমিকের ন্যূনতম মজুরি ঘোষণা করে এসছে। কিন্তু পশ্চিম বাংলা গেল পঞ্চাশ বছরে একবারো এই ঘোষণা করেনি। কারণটি বেশ আমোদজনক! ১৯৭৪ সনে ব্যবসায়িক স্বার্থজড়িত গোষ্ঠীগুলোর প্রভাবাধীন পশ্চিম বাংলার চা-শ্রমিকদের ট্রেডইউনিয়নগুলো (প্রধানত কংগ্রেস) এবং বামপন্থী ইউনিয়নগুলোর বাঙালি নেতৃবৃন্দ একটা ত্রিপাক্ষিক চুক্তিতে আবদ্ধ হয় যে সরকার চায়ের ন্যূনতম মজুরি ঘোষণা করতে আইনত দায়বদ্ধ নয়। সময়ে  সময়ে যেসব মজুরি সংক্রান্ত আলোচনাগুলো হয় তাকেই ন্যূনতম মজুরি বলে ধরা হয়। তাই এখানে অবাক হবার কিছু নেই যে পশ্চিম বাংলার ডুয়ার্স এবং তরাইর শ্রমিকেদের থেকে আর সমস্ত বড় বাগানের রাজ্যগুলোর শ্রমিকেরা (অবশ্যি অসমের কথা এখানে বলছি না) বেশি মজুরি পেয়ে থাকেন। এভিপির বিস্ফোরণ এবং ন্যূনতম মজুরির জন্যে সংগঠনটির দাবি জানাবার পরেই রাজ্য সরকার এবং ইউনিয়নের নেতারা এর গুরুত্ব বুঝে উঠেছেন।
           চা-বাগানের জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট হচ্ছে এর সমাজ এবং অর্থনীতির বিচ্ছিন্ন (enclave) চরিত্র। চা শ্রমিকদের এখানে নিয়ে আসা হয়েছিল উনিশ শতকের মাঝামাঝি এক দাসব্যবস্থার মতো ব্যবস্থার মধ্যি দিয়ে। একসময় তাদের ঔপনিবেশিক আইনের জোরে স্থানীয় মানুষ থেকে সরিয়ে রাখা হতো। সশস্ত্র বাহিনীর হাতে চাবুক পিটিয়ে ফাটকে বন্দি করে রাখা হতো। সেই সশস্ত্র বাহিনীটি চলাতো বাগানের মালিক পক্ষ এবং তাদের ব্রিটিশ অনুচরেরা।  বিগত কিছু সময় থেকে সেরকম আইন আর সশস্ত্র বাহিনী নেই যদিও চাবাগানের বিচ্ছিন্ন চরিত্র এখনো বহাল রয়েছে। শ্রমিকদের এই চারপাশের পরিবেশ থেকে সরিয়ে রাখার পেছনে বাঙালি উগ্রজাতীয়তাবাদী বিদ্বেষ আর শত্রুতাতো রয়েইছে, আর রয়েছে তাদের নিজেদের শিক্ষার অভাব।
            চাবাগানে যে স্কুল নেই , তেমন নয়, আছে। যে স্কুলগুলোতে  দুপুরের খাবার দেয়া হয়, সেগুলোতে উপস্থিতিও ভালো। কিন্তু সেই স্কুলগুলোতে বাগানের ছেলেমেয়েরা কি কিছু শেখে আদৌ?  মেট্রিক পরীক্ষার আগেই তাদের বেশির ভাগ স্কুল ছেড়ে দেয়। অতি অল্পই  মেট্রিকও পাশ করে। কেন? কারণ, এই প্রাথমিক স্কুলগুলোতে চাবাগানের ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের কাছে দুর্বোধ্য ভাষা বাংলা নতুবা হিন্দিতে পড়ানো হয়। এই সব ভাষা ওদের জগতে গিয়ে ঢুকতেই পারে না। পৃথিবীর অন্য সমস্ত শিশুর মতো ওদের জগতেটাকেও ছোঁয়া নিশ্চয় যেত, কিন্তু সে যেত ওদের নিজেদের ভাষা সাদ্রিতে বহু শিক্ষাবিদ এই নিয়ে পরামর্শ দিয়েছেন এবং বহু শ্রমিক এই নিয়ে লড়াইও করেছেন, মাতৃভাষাতে শিক্ষা দেবার জন্যে। এ মূলত কোঠারি আয়োগের পরামর্শ। এই পরামর্শ অনুযায়ী প্রথম তিন বছর মাতৃভাষাতে শেখার পর চতুর্থ বছর থেকেই রাজ্যের প্রশাসনিক ভাষা শিখে শিক্ষার অনুশাসন আয়ত্ব্ব করা উচিত। এমন শিক্ষার অভাবে অভাবে দক্ষ জীবিকা বা প্রশানের কাজে ওদের লাগাবার মতো যথেষ্ট সামাজিক মূলধন গড়ে উঠে না। চা মজদুরের ঘরে জন্ম নিয়ে তারা চিরদিন চাশ্রমিক হয়েই থেকে যায়। বিচ্ছিন্নতা চলতেই থাকে। উত্তর বাংলার কামতাপুরিরাও (যাদের নিয়ে আমরা এখন আলোচনা করব) সেই একই ভাষার প্রবঞ্চনার বলি। তাদের মধ্যেও একই রকম সামাজিক মূলধনের অভাব। ঠিক তাই এটা বুঝতে অসুবিধে হয় না যে আদিবাসিদের বিস্ফোরণ আড় অনেক আগেই দেখা দেয়া উচিত ছিল।

এবং কামতাপুরি আন্দোলন 
      
       উত্তর বাংলার জনগোষ্ঠীগত উত্তেজনার তৃতীয় প্রধান বিন্দুটি হলো কামতাপুরি প্রসঙ্গ। বাঙালি প্রশাসন এই সমস্ত মানুষ এবং তাদের ভাষাকে বোঝাতে ‘কামতাপুরি’ শব্দটি ব্যবহারে প্রবল আপত্তি করে। ‘মূলস্রোতে’র প্রচারমাধ্যম পৃথকতাবাদী আন্দোলন আর রাজনীতি বোঝাতেই শব্দটি ব্যবহার করে।
       উত্তরবাংলার এই সম্প্রদায়টি বোধহয় নিরংকুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ। তা নাহলেও তারা যে বৃহত্তম জনগোষ্ঠী সেটি নিশ্চিত। ওরা হচ্ছেন ঐতিহাসিকভাবে গঠিত এক সম্প্রদায়। এর ভেতরে হিন্দু মুসলমান দুইই রয়েছেন। মালহার মুসলমানেদের বাদ দিলে স্থানীয় মুসলমানেরা নস্য বলে পরিচিত। তাদের ভাষা আর সংস্কৃতিও তাদের হিন্দু প্রতিবেশিদের সঙ্গে এক। রাজবংশী আর পালিয়ারা মিলে এই সম্প্রদায়ের বৃহত্তম হিন্দু জাতি ( caste) গঠন করেছে। এই সম্প্রদায়ের ভেতরে ব্রাহ্মণদের নিয়ে একাধিক পেশাদার জাতিও রয়েছে।
এদের ভাষার স্বরূপ নিয়ে নানা অদরকারি তথ্যবিকৃত ( ill-informed) বিতর্ক শুরু হয়েছে। বাঙালি স্থিতাবস্থা, বিশেষ করে বামপন্থী স্থিতাবস্থা এই বলে নিরন্তর প্রচার করে যাচ্ছে যে এই ভাষাটি বাংলার এক উপভাষার বাইরে আর কিছুই নয়। কিন্তু সমস্যা এখানেই যে সম্প্রদায়টির ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ এই উপভাষার মর্যাদা নিয়ে সন্তুষ্ট নয়। এই বিবাদের ফলে উদ্ভূত বিতর্কের কোনো দরকারই পড়ত না যদি মানুষের সমাজ-ভাষাতত্ব নিয়ে ন্যূনতম ধারণাটিও থাকত। সমস্ত মাতৃভাষাই সমান ভাষা। যেগুলো মাতৃভাষা রাষ্ট্র এবং ভৌগলিক কারণে প্রশাসনের ভাষা হয়ে পড়ে সেগুলোই আধুনিক মান ভাষা হয়ে পড়ে। কলকাতা এবং তার আসেপাশের ভাটি গঙ্গার ভাষাটিই যে আধুনিক মানভাষা হয়ে পড়ল তার কারণ এই যে এই মহানগর ব্রিটিশের রাজধানী ছিল। বাংলারা আর যেসব মাতৃভাষার কলকাতার ভাষার সঙ্গে পরস্পরবোধ্যতা ছিল, সেগুলো সার্বজনীন ক্ষেত্রে এই মান ভাষাকে গ্রহণ করেছিল। তখন সেই মান ভাষা গ্রহণকারী মাতৃভাষাগুলোর ব্যক্তিগত পরিসরেও প্রবেশ করতে শুরু করে। এই গ্রহণের ফলেই এই মাতৃভাষাগুলো ধীরে ধীরে মানভাষাটির উপভাষাতে পরিণত হয়েছিল।
            ঐতিহাসিক ভাবে জটিল কতকগুলো কারণে ( যা নিয়ে আমরা এখন আলোচনা করব না) আমরা ইতিমধ্যে যে মানুষদের কথা বলছি তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশই সেরকম ‘গ্রহণে’র মধ্যি দিয়ে নিজের মাতৃভাষাকে বাংলার উপভাষাতে পরিণত হতে দিতে রাজি নয়। তারা প্রশাসনের ভাষা হিসেবেও বাংলাকে চাপিয়ে দেবার বিরোধীতা করেন এবং নিজের স্বায়ত্বশাসিত রাজনৈতিক স্থান চাইছেন, যেখানে তাদের নিজেদের ভাষা এক আধুনিক মানভাষাতে পরিণত হবে, যেভাবে একদিন ব্রিটিশের চাপিয়ে দেয়া বাংলাকে অতিক্রম করে এক আধুনিক মান ভাষা হিসেবে  অসমিয়া ভাষা গড়ে উঠেছিল অসমের মতোই এক স্বায়ত্ত্বশাসিত স্থানের দাবি আবশ্যিকভাবেই রাজনৈতিক। কামতাপুরি ভাষা এবং বাংলার মধ্যে শব্দগত এবং বাক্যের গঠনগত ( syntactical) মিল এই ক্ষেত্রে কোনো সবল যুক্তি নয়, ঠিক যেমন বাংলার সঙ্গে অসমিয়ার      মিলও কোনো সবল যুক্তি নয়।
            আধুনিক মান ভাষার জন্যে সংগ্রাম এবং তার বিকাশের প্রক্রিয়াতে অসমিয়া এক শক্তিশালী আধুনিক জাতিরূপে গড়ে উঠল। উত্তরবাংলাতে ভাষার জন্যে যারা লড়াই করছেন এই প্রাথমিক           ( nascent) জাতীয় প্রশ্নটিকে মনেপ্রাণে (implicitly) গ্রহণ করলেও প্রকাশ্যে (explicitly ) গ্রহণ করেন নি। ফলে ভাষাটির নাম নিয়েও বিতর্ক আছে। যেসব বাঙালি উগ্রজাতীয়তাবাদী ভাষাটির  এই জাতীয় দিকটিকে ঘৃণা করেন, তাদের সঙ্গে এই ভাষাটির একাংশও একে ‘রাজবংশি ভাষা’ বলে নাম দিতে চান। এই দ্বিতীয় অংশটি নিরাপত্তাজনিত কারণে এটা করতে চায়, কারণ তাতে দাবিটার জাতীয় মাত্রাও নেই হয়ে যায়, আর (বাঙালি উগ্রজাতীয়তাবাদীদের সঙ্গে) শত্রুতাও কমে। কেউ কেউ অবশ্য এটাও বলেন যে এর পেছনে রাজবংশি সাম্প্রদায়িকতাও লুকিয়ে আছে। সে নিয়ে আমাদের কিন্তু সন্দেহ আছে। এই নিয়ে সত্য অবস্থান এই যে এই ভাষিক সম্প্রদায়ের ভেতরে রাজবংশিরা বৃহত্তর গোষ্ঠী হলেও বাকিরা মিলেও একটা বড় অংশ তৈরি করেন।
            ভাষাটির বিকল্প নাম হচ্ছে ‘কামতাপুরি’। কোচবিহার জেলার দিনহাটার কাছে খনন করে এক বিশাল প্রাচীন রাজধানী প্রাঙ্গন পাওয়া গেছে। কামতাপুর নামের  সেই মধ্যযুগের  রাজ্যের থেকে ভাষাটির এই নাম হয়েছে। লক্ষ্য করবার মতো বিষয় যে কামতা রাজারা রাজবংশি ছিলেন না, ছিলেন খেন বংশীয়। এই খেনরা হলেন সংস্কৃতায়নে প্রভাবিত সমতলের  এক বড়ো জাতি। পূব ভূটানের খেনরা এখনো তাদের পুরোনো বড়ো-জনজাতীয় জীবন যাপন করেন এবং এক তীব্বত বর্মী ভাষাতে কথা বলেন। আগেকার গৃহভূমির নাম ব্যবহার করে ভাষার নাম দেয়ার মধ্যে যে রাজনৈতিক প্রক্রিয়াটি নিহিত রয়েছে সেটি গুরুত্বপূর্ণ।
              কামতাপুর নামটি সবাইকে নিজের ভেতরে গ্রহণ করে । শুধু রাজবংশিই নয়, মুসলমানদের ধরে এই ভাষাভাষী সবার থেকে ব্যাপক সমর্থণ পায়। অনেক পন্ডিতও এই নামটি ব্যবহার করতে শুরু করেছেন, কিন্তু তার থেকেও গুরুত্বপূর্ণ হলো এই যে লাখ লাখ মানুষ পায়ে পায়ে মাটি কাঁপিয়ে শত শত জনসভাতে নামটির প্রতি তাদের সমর্থণ জানিয়েছেন। তারা দাবি করছেন কামতাপুরি ভাষার স্বীকৃতি। ভাষাটির প্রতি রাষ্ট্রের স্বীকৃতি একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। কিন্ত আমাদের রাজনৈতিক শ্রেণিটির বাঙালি জাতীয়তাবাদী পারিপার্শিকতার এই স্বীকৃতিতে নারাজ। কামতাপুরি এবং আদিবাসিদের এই ঘরের ভাষার জন্যে দীর্ঘদিন ধরে নিরন্তর জানিয়ে আসা  দাবি কোঠারী আয়োগের পরামর্শের সঙ্গে মিলে গেলেও বাঙালি উগ্রজাতীয়তাবাদের স্থিতি দেখাচ্ছে যে ভাষার প্রশ্নে তারা এই ইঞ্চি জমিও ছেড়ে দিতে প্রস্তুত নয়।

অবদমিত জাতিসত্তাগুলোর সংগ্রাম  শ্রেণি সংগ্রামের  এক আবশ্যক রূপ।

        “বাংলা ভাগ হতে দেব না।” এই বাক্য এক সত্যিকার ভয়কেই প্রকাশ করে। কিন্তু রাষ্ট্র পরিচালনার কাজে ভয়ের প্রয়োগ কোনো কাজেরই নয়। বাঙালি উচ্চবর্ণ মানসিকতার জন্যে যতই অপ্রিয় লাগুক, বিক্ষুব্ধ জনতাকে হিংসাত্মক মীমাংসার দিকে ঠেলে না দিতে হলে গোর্খা, আদিবাসি এবং কামতাপুরীদের জাতিরূপে স্বীকৃতি দেয়াটা জরুরি হয়ে পড়েছে। এই সব মানুষ এবং সেই সঙ্গে পশ্চিম মেদিনীপুর, বাকুড়া আর পুরুলিয়া (পশ্চিমাঞ্চল)এর মানুষকে এক ফেডারেল রাজ্য কাঠামোতে স্থান দেয়াটাই হবে হিংসাত্মক সংঘাত এবং বাংলার প্রকৃত বিভাজন রোধ করবার একমাত্র উপায়। বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক প্রাণশক্তির প্রশংসা করবার সময় আমাদের এই কথা মনে রাখতেই হবে যে ১৯৪৭এ বাংলাকে যারা বিভাজনের দিকে ঠেলে দিয়েছিল তাদের উচ্চবর্গীয় মানসিকতা আজও বিরাজ করে এবং তারা তার ঐতিহাসিক পরিণতি সম্পর্কে আগের মতোই এখনো সম্পূর্ণ অজ্ঞ।
          কিছু মার্ক্সবাদী ভাবেন যে এমন জনগোষ্ঠীগত বা জাতীয় সংগ্রামগুলো হচ্ছে শ্রেণিসংগ্রাম থেকে একধরণের বিচ্যুতি। উত্তরবাংলার চা-বাগিচা এবং জঙ্গল মজদুর, গোর্খা এবং অন্যান্য আদিবাসিদের দিকে তাকানএখানে একটা চিন্তার সম্পরীক্ষাও করা যাক, চলুন। ধরুন, এই শ্রমিকরা সংখ্যালঘু জাতিসত্তার নাহয়ে নিজের সমাজের ভেতরের বাঙালি জাতিসত্তারই লোক। তখন কি তাদের বেলা এখনকার মতো আইন কানুনের এমন নগ্ন উল্লঙ্ঘন হতো? তারা যদি উপোসে মারা যেতেন রাষ্ট্র কি ঠিক এতোটাই উদাসীন হতে পারত? না, তখন আর উত্তরবাংলাতে একাবারেই প্রান্তিক অবস্থানের কামতাপুরি কৃষকদের এতোটা নিম্নমূল্যে মরাপাট বিক্রি করতে বাধ্য করা যেত না। পুঁজিবাদী হয়েও আমেরিকার দক্ষিণের কৃষ্ণাঙ্গদের মধ্যে যেমন দাসব্যবস্থার মতো অবস্থা বহাল রয়েছে, আমাদের এখানেও নিম্নবর্গ এবং সংখ্যালঘুর মতো অবদমিত জাতিসত্তাগুলো সবসময় আরো বেশি বেশি মুনাফা এনে দেয়।বৈষম্য আর প্রভুত্বের  অর্থনীতি বহির্ভূত বলপ্রয়োগের এক ব্যবস্থার মধ্যি দিয়ে এমন অতি মুনাফা সম্ভব করে তোলা হয়। এই অবদমিত জাতিসত্তাগুলোর সংগ্রাম তাই শ্রেণি সংগ্রামের আংশিক ভাবে হলেও এক আবশ্যক রূপ।
          বিগত জমানার ক্ষমতার কেন্দ্র থেকেই উত্তর বাংলার উন্নয়ন বিষয়ে উচ্চবাচ্য  শুনা গেছিল। এখনকার জমানাতেও উন্নয়নের আরো অতিরঞ্জিত প্রতিশ্রুতি শোনা যাচ্ছে, তা আজকের উদারবাদী পরিস্থিতিতে  তেমন ‘উন্নয়নে’র অর্থ যাই হোক না কেন। কিন্তু গণতান্ত্রিক এবং সবাইকে সামিল করে ফেলবার মতো কোনো সমাধানের বাইরে উন্নয়ন  হবেই না, আর হলেও তা শেষে গিয়ে আরো ভয়াবহ সংঘাত ডেকে নিয়ে আসবেই। আর সেই সংঘাত বাঙালি জাতিসত্তার জন্যেও অনিবার্যভাবেই বিপর্যয়ের সংবাদ সঙ্গে করে আনবে।

No comments: