আমার চেতনার রঙে রাঙানো এই খেলা ঘরে:

~0~0~! আপনাকে স্বাগতম !~0~0~

*******************************************************************************************************

Monday 19 August 2013

সম্পর্কঃ পথ বেছে নেবার দায়টাও আমাদেরই ...

('সম্পর্ক' এই মূল বিষয়কে নিয়ে দৈনিক যুগশঙ্খ  (পৃঃ ৭ থেকে ১০) 'রবিবারের বৈঠকের বিশেষ সংখ্যা করে ১৮ আগস্ট, ২০১৩। অন্য সাতজনের সঙ্গে আমার এই লেখাটি প্রকাশ পায়। আমার ইউনিকোডে লেখাটির সঙ্গে ছবিতে এখানে রইল বাকি সব ক'টা। ছবিতে ক্লিক করে নামিয়ে বড় করে ইচ্ছে করলে সেগুলোও পড়তে পারেন।)

  “একমাসে অপহৃত ১৬ জনঃ বাঙালিদের নিরাপত্তার দাবিতে উত্তাল চিরাং” এই শিরোনামে একটি সংবাদ বেরিয়েছে দৈনিক যুগশঙ্খে ১৪ আগষ্ট। পাশেই একটি ছবি চিরাং জেলাশাসকের কার্যালয়ের সামনে একটি বাঙালি ছাত্রযুব সংগঠন ধর্ণা দিচ্ছে।  সংগঠনটি গেল মাস খানিক ধরে ভাটি অসম তথা বডোল্যাণ্ডে এক নাগাড়ে একই প্রশ্নে বিভিন্ন আন্দোলন কর্মসূচি নিয়ে চলেছে। সমাজ রাজনীতি সম্পর্কে উৎসাহী যে কোন ব্যক্তির কাছে এই তথ্য কৌতুহল জাগানো উচিত । তার উপর যে ছবির কথা বললাম, সেটিতে এদের দাবী দাওয়া লেখা দেখলাম, বিশুদ্ধ বাংলা ভাষাতে। একই সংগঠন যখন উজান অসমে ব্যানার লেখে , তখন লেখে অসমিয়াতে। বাংলা লিখলে যে মহাভারত অশুদ্ধ হবে, তা নয়; অনেকেই লেখে। কিন্তু এরা লেখেন না। ভাটি অসমে তারাও লেখেন।  বিশেষ করে গোটা অসমেই যেখানে বাঙালি, বিশেষ করে হিন্দু বাঙালি প্রতিবাদী-রাজনীতির বন্ধ্যাত্ব চলছে---তখন এমন সংবাদ পেলে, আজকাল অন্য অনেকে যেমন করে, আমিও এগুলো আন্তর্জালে ছড়াই, বিশুদ্ধ বাংলাভাষাতে , বাংলা হরফে সংলাপ বিনিময় করে এর সামাজিক অর্থ বোঝার চেষ্টা করি। আমি  আন্তর্জালে যুগশঙ্খের ডিব্রুগড় সংস্করণ  খুলে  দেখলাম, ওখানে ছবিটি রঙিন এবং অনেক বেশি বাঙ্ময়। কেন জানি, মনে হলো এই সংবাদ গোটা অসমের মানুষ জানলে উৎসাহী হবেন। দেখিতো, অন্য সংস্করণগুলোতে আছে কিনা। শিলচর সংস্করণে পেলাম না। তাতে দোষের কিছু নেই। যেকোন কাগজ তার স্থান বাঁচাবার জন্যে এটা করে। পাঠকের আগ্রহের কথা বিবেচনা করে। সব সংবাদ বা লেখালেখি সব সংস্করণে দেয় না। যেমন বডো ছাত্র সংস্থার আসাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখা পৃথক বডোল্যাণ্ডের দাবিতে শিলচরে মিছিল করেছে আগের দিন, সেই সংবাদও ডিব্রুগড় সংস্করণে আছে, কিন্তু শিলচর সংস্করণে নেই। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে একটা প্রশ্ন মনে জাগল, বিটিএডিতে এই যে লাগাতার অপহরণ হচ্ছে এর বিরুদ্ধে  কি শিলচরে বা করিমগঞ্জে  একটি ‘পথচলা’ আশা করতে পারি? বডোল্যাণ্ডের দাবীতে যদি হতে পারে, তবে সেই আন্দোলনের শিকার যারা হচ্ছেন তাদের হয়ে হবে না কেন!
    
       
                  হবে কি করে! জানলে তবে তো! সে থাক! গোটা রাজ্যে এখানে ওখানে পৃথক রাজ্যের দাবি উঠলেও বরাক উপত্যকাতে তেমন তীব্র নয়, কিন্তু ব্রডগ্যাজের দাবিতে একটি সংগ্রাম সম্প্রতি বেশ বেগ পেতে শুরু করেছে।  সেই সংগ্রামে অংশভাগীরা এসে দিসপুর লাস্ট গেটে ধর্ণা দিচ্ছেন, এমনটা কল্পনা করতে পারি?  বা তাদের সমর্থনে সমাবেশ হচ্ছে তিনসুকিয়াতে! খুব কষ্ট করেও পারি না। দায় কার! কে আটকেছে? বঞ্চনা আছে, প্রতারণাও আছে—কিন্তু প্রতিবাদের ভাষাকেও নিজ ভূমির বাইরে ছড়িয়ে দিতে বাঙালিকে আটকেছে কে? এই দেশ যে গণতান্ত্রিক একখানা দেশ এই নিয়ে তো বাঙালিই গর্ব করে সবার চাইতে বেশি! যখন অন্য বহু জনগোষ্ঠিগত সংগঠন স্বাধীনতা দিবস বা প্রজাতান্ত্রিক দিবস বর্জনের আওয়াজ তোলে, তখন বাঙালিইতো ব্যস্ত হয় সবার চাইতে বেশি দিনটি পালন করবে বলে। তবে এ কোন স্বৈরাচার, বাঙালির প্রতিবাদের ভাষাকেও রুদ্ধ করে! প্রশ্নগুলোতো ভাববারই বিষয় বটে।            
                       আবাল্য বড় হয়েছি বরাক উপত্যকাতে। আবাল্য শুনেছি সে উপত্যকা বঞ্চিত বড়। বড় হয়ে কাজের সূত্রে ব্রহ্মপুত্রে নিবাস। তাও উজান অসমে। শিল্প সমৃদ্ধ জেলাশহর গুলোর একটিতে। এসে থেকেই শুনেছি এখানকার লোকেরা বুঝি সবচে’ বেশি রাজস্ব দেন সরকারকে। দেবেন হয়তো, চা আছে, তেল-কয়লা আছে। কিন্তু একটিও তো শহর পাইনি শিলচরের মতো! যখন ফিরে গিয়ে বলেছি, বহু বন্ধুকে যে গুয়াহাটি রাজধানীকে বাদ দিলে,  তুলনায় শিলচরের মতো আর একটি উন্নত শহর নেই  গোটা অসমে—দেখেছি কেউ বিশ্বাস করেন না। কিম্বা যখন কাউকে বলেছি, ব্রডগ্যাজ রেলওয়ের মতো গেল এগারো বছর ধরে ধেমাজি ডিব্রুগড় জেলাকে সংযুক্ত করবার জন্যে দীর্ঘতম সেতুটি এখনো হচ্ছে না। সুতরাং খুব জরুরি নয় যে ব্রডগ্যাজ হচ্ছে না শুধুই দিসপুরের অবজ্ঞার জন্যে, আরো কারক থাকতে পারে, যেগুলো বগীবিলকেও বিলম্বিত করে-- দেখি রসিকতা করে বন্ধুরা বলেন, “তবে তুই অসমিয়া হয়েই গেছিস!” তারা কি আর  বিশ্বাস করবেন যদি বলি, যে ধেমাজি বলে উজান অসমে একটি জেলা রয়েছে যার সঙ্গে শুধু শিলচরের অদূরে দুধপাতিল বা বড়খলারই তুলনা চলে। এতো কাছে, কিন্তু বহু দূর। ইলশে গুড়ি বৃষ্টিতেও ওখানে বন্যা নামে! সেখানকার লোকজনকেই মন্ত্রীরা পরামর্শ দেন কলাগাছের ভেলায় জীবন যাপন রপ্ত করুন!  সে জেলায় কিন্তু বাঙালিও বাস করেন। তারা অসমিয়া হয়ে যান নি! গলায় ফুলাম গামছা বেঁধেও তারা কণ্ঠ ছেড়ে গান করেন বাংলা ভাষায় –হোক সে গান মনসা ভাসান!
   
                তো আমাকে অসমিয়ারা অসমিয়া করুন না করুন, পুরোনো বন্ধুরা তাই করেছেন! অসমিয়া হয়ে যাওয়া ছাড়া আমার গত্যন্তর নেই! আবাল্য যে আখ্যান এই উপত্যকার সম্পর্কে শুনে শুনে বড় হয়েছি, তার অনেকগুলোই আমাকে ঝাড়াই বাছাই করতে হয়েছে, আর নিত্যদিন হচ্ছে। বলব না সুখে আছি, কিন্তু অসুখটা তা নয় ---যা সেই বন্ধুরা বলেন!
                   
           আমি সাহিত্যের ছাত্র। সামান্য লেখালেখিও করি। জেনে উৎসাহিত বোধ করি যে সেই পদ্মনাথ ভট্টাচার্য বিদ্যাবিনোদের দিন থেকে হেমাঙ্গ বিশ্বাসের দিন অব্দি এই উপত্যকার বাংলা সাহিত্য এবং সংস্কৃতি চর্চাতে এক উজ্জ্বল পূর্বাধিকার ছিল। মাঝে অসম আন্দোলন ইত্যাদি কারণে কিছু ভাটা পড়েছিল বটে, কিন্তু এখনতো গেল এক দশকে আবার জোয়ার বইছে—ধুবড়ি থেকে সদিয়া অজস্র ছোট কাগজ বেরুচ্ছে। একাধিক দৈনিক কাগজ বেরুচ্ছে, রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তীর বাইরেও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও হচ্ছে। এমন কি গুয়াহাটি শহরকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে একাধিক বাংলা প্রকাশনা সংস্থা। সেগুলোর মধ্যে ভিকি প্রকাশনীর তো গোটা অসমেই কোন বিকল্প নেই! আর এই কাজগুলো যারা করছেন তাদের সিংহভাগ নিশ্চয়ই এই উপত্যকারই মূল নিবাসীরা করছেন। কিন্তু একটা ভালো অংশ কিন্তু, সেই সব লোক যারা বরাক উপত্যকার থেকে এখানে প্রব্রজিত। আমারই মতো। কিম্বা পদ্মনাথ থেকে, রাজমোহন নাথ, হেমাঙ্গ বিশ্বাসের মতো। এদের প্রত্যেকেরই কিন্তু আজকাল  এক ব্যথা— এই উপত্যকা তাদের বরণ করে নিলেও মূলভূমি যে বরাক উপত্যকা সে কিন্তু দেখতে শুরু করে সন্দেহের চোখে। সে সন্দেহ ‘অসমিয়া উগ্রজাতীয়তাবাদে’র শরিক হবার!
     
    
সেদিন ‘দলছুট’ বলে শিলচরের গানের দল গুয়াহাটির জেলা গ্রন্থাগারে গান গেয়ে গেলেন। আয়োজন করেছিল ‘ব্যাতিক্রম মাসডো’। অনুষ্ঠানের নাম ছিল, ‘সম্পর্ক’! গান ছাড়াও ছোট্ট এক আলোচনা চক্র হয়ে গেছিল। তাতে অনেকের সঙ্গে এসছিলেন শিলচরের ভাষা শহীদ স্টেশন দাবী সমিতির সম্পাদক রাজীব কর। রাজীব আমার পুরোনো বন্ধু। অনেক দিন ধরেই আশা করছিলাম সে তাদের লড়াইকে এই উপত্যকাতেও ছড়িয়ে দেবে। লড়াই না হোক, অন্তত একটা জনমত গড়ে তোলবার কাজতো হতেই পারে। কে বাধা দিয়েছে! এই নিয়ে দু’জনে প্রায়ই কথাও হয়েছে। ফোনে কিম্বা শিলচর গেলে। দেখলাম , সম্প্রতি সে সেটি শুরু করেছে। সঙ্গ দিচ্ছে ‘ব্যতিক্রম মাসডো’।  এই প্রক্রিয়ারই এক অগ্রপদক্ষেপ এই ‘সম্পর্ক’ অনুষ্ঠান। পরদিন একই গানের দল নিয়ে একই আয়োজকেরা গেলেন লামডিঙে। এবং দুই জায়গাতেই শোনালেন তাদের নিজেদের গান। অসমের একটি গানের দল নিজেদের বাঁধা গান গাইছে এটা নিজেওতো একটা বড় সংবাদ। এই উপত্যকার মানুষ সেটি জানতেন না! শুধু জানলেনই না, লামডিঙে তারা শাখা স্থাপন করে গেলেন শিলচরের জনপ্রিয় সংগঠন ‘সন্মিলিত সাংস্কৃতিক মঞ্চে’র। শাখা কিনা জানি না। কিন্তু যদি আলাদা  সংগঠনও হয়, কিন্তু নামটিতো নিজেই কিছু বার্তা বহন করে! আর করে বলেই একই নামে সম্প্রতি আরেকটি সংগঠন গড়ে উঠেছিল বরাক উপত্যকারই অন্য প্রধান শহর করিমগঞ্জে। সেই দলছুটের অনুষ্ঠানের সংবাদ কিন্তু বেরুলো এই উপত্যকার বাংলা অসমিয়া সমস্ত কাগজে বেশ গুরুত্ব দিয়ে!  অনেকগুলো ছবি দেখলাম আন্তর্জালেও। তার মধ্যে একটি এই যে তাঁরা মঞ্চে দাঁড়িয়ে আছেন, তাঁদের গলায় অসমিয়া গামছা। অভিজ্ঞতা বলে, এই ছবি বরাক উপত্যকাতে পৌঁছুলে আর ভাবুকজনে দেখলে-- গামছাতে গলা বাঁধা দেবার দায়ে তাদেরকেও ভর্ৎসনা করবেন, কিন্তু তারা যে কী গান শুনিয়ে হল ভর্তি মানুষজনকে মুগ্ধ করে গেলেন , সে কথা  কানেও তুলবেন না।
   
         কেন ! এই পথে সম্পর্ক হতে পারে না? সিলেটের পদ্মনাথ ভট্টাচার্য বিদ্যাবিনোদ কিম্বা হেমাঙ্গ বিশ্বাস কি এই পথে ব্রহ্মপুত্র বিজয় করেন নি! গেছিলেন বটে তারা অভিমানে কাশি কিম্বা কলকাতা চলে। কিন্তু ভালোবাসাবাসিতো ছাড়েন নি। প্রথমজন কলকাতা যানই নি, দ্বিতীয় জন সেখানে গিয়েই গাইলেন, “ডানা ভাইঙা পরলাম আমি কইলকাতার’ উপর।    
             
           ব্রহ্মপুত্রের পথ যাতে না ফুরোয় কাশি কিম্বা কলকাতায় সে পথ নিশ্চয় সন্ধান করতে হবে। সংঘাতও অনিবার্য হবে কখনো কখনো। কিন্তু সেই সংঘাতও কি হবে না অপরিবর্তনীয় প্রতিবেশীর সঙ্গে বৃহত্তর প্রেমের জন্যে? সেই প্রেমের সন্ধান করতেই আমাদের কোন  কবি এখন লিখে ফেলেনঃ “মিলিদি, গঙ্গাপারের ছেলে, শোন/গাঢ় সিঁদুরের ভিতর গভীর বাতাসের ধ্বনি/চিরকাল বাজাবে তার অমোঘ খঞ্জনি/একা নির্জন ঘরে বিষণ্ণ একা থাকা ভালো।” ( আমি একা নির্জন ঘরে; সঞ্জয় চক্রবর্তী) মিলিদির কথা কী ছিল? “মিলিদি প্রায়ই বলে ফোনে,/বল, ঠিক কোন কারণে, তুই পড়ে আছিস ওখানে।/গড়িমসি ছাড়, এক্ষুণি উড়ে চলে আয়/আমাদের কোলকাতায়।/হাসবি, নাচবি, গাইবি, কাঁদবি,/এমন কি মরবিও বাংলায়” এই মিলিদিরা কি হতে পারেন  কোনভাবেই আমাদের কোন ‘মুক্তিদূত?” অথচ এখনো অসমের বহু মধ্যবিত্ত স্বপ্ন দেখেন তাঁরা খোলা আকাশের নিচে উড়বার জন্যে সেই ‘কইলকাতা’ মহানগরেই পাড়ি দেবেন। তাকে ‘মুক্তদুনিয়া’ বলে  গল্প লেখেন করিমগঞ্জের কোন গল্প লেখক। এই ভাবনাইতো এক বড় কারণ যে এই দেশ নিয়ে স্বপ্ন দেখেনা, আশা জাগায় না মধ্যবিত্ত বাঙালি। শিলচরে মিছিল হয় “বডোল্যাণ্ড” নিয়ে, কিন্তু দিসপুর কাঁপে না ব্রডগ্যাজের দাবীতেও!   পথ হাঁটেনা কেউ এসে ভাষা শহীদ স্টেশনের দাবীতে!

 
               না হয় আমরা গলায় গামছা বাঁধি, আপনারা বাঁধেন না—কিন্তু গানতো করি একই ভাষায়? না হয় আপনারা আসাম বলেন, ‘অসম’ বললে বিরক্ত হন---আমরা দুটোই বলি, কিন্তু যখন বলি ‘অসম’ তখন উচ্চারণেতো থাকিই বিশুদ্ধ বাঙালি। না হয় আমরা ভুলে গেছি ধানের মাঠ, চিনেছি ‘পথার’ কিন্তু খাইতো এখনো সেই একই চালের পিঠে! আমাদের কি থাকতে নেই কোনো সম্পর্ক? হতে নেই, কোন বার্তালাপ? সে আমরা বুঝি বরাক উপত্যকাতে অসমীয়া মানে কিন্তু মূলত প্রশাসক। যেমন বৃটিশ ভারতের গোটা পূর্বোত্তরে বাঙালির ছিল পরিচয়। এখনো তাঁরা অনেকে যখন দিল্লীর বিরুদ্ধে উষ্মা প্রকাশ করেন, সেই উষ্মার তাপে পুড়ে বাঙালি শরীর।  কিন্তু আপনারাওতো বুঝবেন আমাদের এই বাস্তবতা যে ----আমাদের যখন  নিষিদ্ধ বাঙালি সংগঠনগুলো কখনোবা শ্মশানে পাঠায়,  তখন কাঁধ দিতে এসে চোখের জল ফেলে আবাল্য বন্ধুটি। হাসপাতালে যাবার বেলা খবর না দিলে যে বন্ধুটি  নৌকো করে ছুটে এসে  বলে, ‘মোক কিয় মাতি নে পঠালি ও!” আমরা সেই বন্ধুদের  দূরে  ঠেলি  কি করে!  কী করে ভাঙি ‘হারাধন-রঙমনে’র পুরোনো সখ্য!
      
            সেই বার্তালাপে খুলে যাবে না জানি কোন স্বর্গদ্বার।   আমাদের খুঁজে নিতে হবে আরো বহু বহু প্রশ্নের উত্তর। আমাদের যেমন আছে প্রাচীন কামরূপের , কামতাপুরের, কাছাড়ি রাজ্যের ইতিহাস , তেমনি আছে দেশভাগ আর সিলেট ভাগের, ভাষা আন্দোলনের  উত্তরাধিকার---এখনো বাঙালি বললে আমরা এই উপত্যকাতে বুঝি শুধুই বাঙালি হিন্দু। এখনো আমাদের যারা ছোটখাটো দোকান চালান ভূষিমালের কিম্বা ওষুধপাতির, হাল ঠেলেন, কাপড় বুনেন, ইটের পরে ইট সাজিয়ে পরের জন্যে বাড়ি করেন কিন্তু কলকাতা যাওয়া তো দূর-- ডিটেনশন কেম্পে  যাবার দুস্বপ্নে রাতের পরে রাত কাটান, উগ্রপন্থীর হাতে অপহৃত না হবার স্বপ্ন দেখেন-- সেই সব সঞ্জিৎ মণ্ডল , সুবল দেবনাথদের সমাজকে ভালো করে চেনাই হয় নি আমাদের। বিশেষ করে মধ্যবিত্ত বৌদ্ধিক সমাজের!  চিনব কী করে! ভালোবেসে দেশটাকে নিজের বলে স্বীকার করলে তবে তো! একের পাশে অন্যে দাঁড়াবার সাহস গোটালে তবে তো! আমরা কি দাঁড়াবো, না এক নতুন অস্পৃশ্যতার সূত্র ধরে সরে যাবো পরস্পর থেকে দূর! আমাদের কি দিন আসবে না,  যখন সঞ্জয় চক্রবর্তীরই মতো  সবাই উচ্চারণ করতে পারবঃ
 ভয় নেই আর,বালক
দুরু দুরু বক্ষে আর
দাঁড়ানো নেই কোন বৃক্ষের আড়ালে
যাও তোমারই দেশ
যেখানে খুশি। (কুয়াশালিপি)

না, যদি পারি তবে নিশ্চিত আমাদের পরিচয় হবে এক হতাশ বিপন্ন প্রজাতি! পথ বেছে নেবার দায়টাও আমাদেরই !

                                    
 

  

Thursday 15 August 2013

স্বাধীনতা দিবস


















১৫ আগস্ট , ১৯৯২
লাল কেল্লার প্রাকার থেকে ভাষণ দিলেন
প্রধানমন্ত্রী পি বি নরসিমা রাও।
তিনি বিয়াল্লিশের শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানালেন
প্রথমেই।
তারপরেই পাড়লেন
পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার কথা।
নয়া অর্থনীতির কথা
তিনি আরো একবার বোঝালেন খুব সাবলীল ভাষায়।
সিকিউরিটি স্ক্যামের প্রতি
তিনি যে কী চরম
তা স্মরণ করিয়ে দিতে ভুল করেন নি।
তারপরেই তিনি অসমের কথা পাড়লেন,
জানালেন যে
স্রোতের বিরুদ্ধে রয়েছে এখন
মাত্র গুটি কয়।
কাশ্মীরের কথা
যখন তিনি বলতে যাবেন
পাকিস্তানকে গালাগাল করতে গিয়ে
তিনি খুব ক্লান্ত বোধ করছিলেন।
তবু তাঁর গণতন্ত্রপ্রিয়তার কথা,
সময় হলেই নির্বাচন করিয়ে নেবার কথা
আমাদের জানালেন।
পাঞ্জাবের কথা বলতে গিয়ে,
অনেক্ষণ ধরে হাততালি পাচ্ছিলেন না—
একটুই জোরের সাথেই মনে করিয়ে দিলেন,
কত বছর পর
তার সরকার সেখানে নির্বাচন করিয়েছে।
সন্ত্রাস বলতে গেলে
এখন সেখানে নেই।
যে গুটি কয় মানুষ
সেখানে রোজ মরে
সফলতার তুলনায়
সে সংখ্যা খুব কম—
এই কথাটা তিনি যখন বোঝাতে যাবেন,
তার চোখ তখন
সামনে বসা শ্রোতাদের দিকে।
শ্রোতাদের হাতের দিকে।
হন্যি হয়ে খুঁজে ফিরছিল—
কোন্ হাতে তালি বাজছে না।
সে  হাতগুলোর সংখ্যা
খুব কম।
কিন্তু ঐ কম হাতগুলোকে
যে তার কী ভীষণ ভয়
তাই আমরা আঁচ করছিলাম,
যখন দেখছিলাম
স্বাধীনতা দিবসে
তিনি নিজেকে বন্দি করে রেখেছেন
এক কাঁচের ঘরে।
তাঁর সামনে পেছনে
ডানে-বায়ে,
উপরে নিচে
প্রহরী অগুনতি।
গোটা মাঠ ঘিরে অন্ততঃ
হাজার কয়েক।
এমন কি আকাশেও ফিরছে স্টেনগান হাতে।

আমাদের খুব কষ্ট হলো—
গুটি কয় মানুষ,
এখনো এই দেশ আর তার নেতাকে
বুঝতেই পারলো না!