আমার চেতনার রঙে রাঙানো এই খেলা ঘরে:

~0~0~! আপনাকে স্বাগতম !~0~0~

*******************************************************************************************************

Friday 12 November 2010

বাঙালি ও বাংলা ভাষার ভোটবর্মী আত্মীয়তার সন্ধানে

( গারোদের জাতীয় উৎসব ‘ওয়ান গালা Wangala২০১০ ‘ উপলক্ষে বাংলাদেশের একটি স্মরণিকার জন্যে লেখা)

             ক সময় ভাষার ভিত্তিতে মনে করা হতো বাঙালি মাত্রেই আর্য নৃগোষ্ঠীরই একটি প্রধান শাখা। এর পেছনে নিজেদের বিলেতিদের সঙ্গে একপাত্রে ঠাঁই নেবার মোহটাই ছিল প্রবল। বাঙালিরা যে আর্য এমন ধারণা উনিশ শতকের হিন্দু ভারতীয়/ বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রবর্তকদের মধ্যে প্রবল ছিল। তাঁদের চিন্তার সমর্থনের বেশির ভাগটাই তাঁরা গুটিয়েছিলেন জার্মান পন্ডিত মেক্সমূলরের রচনাবলীর থেকে। ঋষি অরবিন্দতো তামিল আর সংস্কৃতের মতো দুটো সম্পূর্ণ পৃথক ভাষাগোষ্ঠীকেও একই উৎস জাত বলে ‘আবিষ্কার’ করবার ধারে কাছে গিয়ে পৌঁছেছিলেন। মেক্সমুলর কখনো ভারতে আসেন নি, কিন্তু তিনিই সেকালের  এক প্রধান ভারততত্ববিদ বলে স্বীকৃতি পেয়ে বসে আছেন। এদেশে ও দেশে তাঁর বহু ভক্ত তখনো ছিলেন, এখনো রয়েছেন।  তিনি লন্ডনের ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সংগ্রহশালাতে পাওয়া ভারতীয় নথিপত্রের উপরেই নির্ভর করেছিলেন।  অনেকে এও বলেন ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর অর্থ সাহায্যেই তিনি তাঁর কাজগুলো করেছিলেন। উদ্দেশ্য কী ছিল তা নিয়ে নানা মুনির নানা মত আছে, অনেক পশ্চিমী লোক তাঁর বিরুদ্ধে  খৃষ্ট ধর্মের স্বার্থ বিরোধী কাজ করবার দায়েও অভিযোগ এনেছিলেন । তাতে আপাত দৃষ্টিতে মনে হয় না যে বিলেতি শাসকদের প্রত্যক্ষ কোনো সুবিধে হবার ছিল। কিন্তু, বিলেতিরাও আর্য, ভারতীয়রাও আর্য এমন এক তত্বে যদি খুব হাওয়া পানি দেয়া যায় তবে বিলেতি শাসনকে ঝাড়েমূলে উপড়ে ফেলবার দরকারটা উবে যায় না কী? তাই দেখব পরবর্তী কালে যারা হিন্দুত্বের ধ্বজা তুলে ভারতীয় রাজনীতিতে নেমেছিল তাদের কাছে প্রধান শত্রুপক্ষ হয়ে পড়েছিল বিলেতিরা নয়, এ দেশেরই মুসলমানেরা। ধরে নেয়া হয়েছিল এদেশে ইসলাম একটি নব্যআগন্তুক ধর্ম এবং এই ধর্মের প্রায় সবাই অনার্য সিমেটিক সভ্যতার উত্তরসূরী। এমনটি ধরে নিতে গিয়ে এও ভুলে যাওয়া হয়েছিল যে আধুনিক বিশ্বে যে দেশের নামের সঙ্গে ‘আর্য’ শব্দটি জুড়ে আছে সেই ‘ইরান’ মূলত একটি মুসলমান প্রধান দেশ । অবশ্যি এটি সত্য যে ১৯৩৫এর আগে সরকারি ভাবে ‘ইরান’ নামটি চালু ছিল না, কিন্তু পণ্ডিতি বিস্মৃতির পক্ষে এটি কোনো যুক্তি হতে পারে না। বিশেষ করে যখন সেদেশের আর্য ভাষা ‘পার্শি’ বৃটিশ ভারতেও দীর্ঘদিন রাজভাষা হিসেবে বহাল ছিল ।
              যে উনিশ শতক শুরু হয়েছিল  হিন্দু ধর্মেরই ভেতরে নানা সংস্কার আন্দোলনের মধ্যি দিয়ে সেই শতকের  শেষে এসে দেখলাম সেই সংস্কার আন্দোলনগুলোর লক্ষ্য মুখ ঘুরে গেল অন্য ধর্মাবলম্বীদের বিরুদ্ধে আর একই সঙ্গে ভারতীয়তা আর হিন্দুত্বকে সমার্থক করে শুরু হলো তার গৌরবোদ্ধত আস্ফালন।  রবীন্দ্রনাথ তাঁর বেশ কিছু লেখাতেই সে প্রসঙ্গ ছুঁয়ে গেছেন। তেমনি এক কবিতাতে মজা করে লিখেছেনঃ মোক্ষমুলর বলেছে ‘আর্য’,/সেই শুনে সব ছেড়েছি কার্য,/মোরা বড়ো বলে করেছি ধার্য,...”(বঙ্গবীর)  বিপরীতে  মূলত উত্তর ভারতের অবক্ষয়ী সামন্তীয় সমাজ থেকে গড়ে উঠা মুসলমান মধ্যবিত্তদের  মধ্যে দেখা গেল প্রাচীন আরবি  আর ইসলামি ঐতিহ্যের সঙ্গে নিজেদের যুক্ত করে গৌরবোদ্ধারের প্রয়াস। বাংলাদেশেও যে সামান্য মুসলমান মধ্যবিত্ত সমাজ গড়ে উঠছিলেন তাদেরও একাংশ সেই আবেগে গা ভাসিয়ে ‘আর্য দম্ভে’র জবাব দিতে শুরু করলেন। আসরাফ আতরাফের দ্বন্দ্বে বাংলার মুসলমান সমাজকে ক্ষত বিক্ষত করতে শুরু করলেন।  আরবি জাতীয়তাবাদের সঙ্গে নিজেদের সংযুক্ত করতে গিয়ে আসরাফেরা ‘আরবি’ ভাষাটিকেতো নিজেদের বলে দাবি করতে পারলেন না।  কিন্তু বাংলাকে যথা সম্ভব ‘আরবি’ করে তুলবার চেষ্টা চালালেন। আর ইতিমধ্যে যে উত্তর ভারতীয় ভাষাটি এক স্বাভাবিক ঐতিহাসিক প্রক্রিয়াতে ‘আরবি-ফার্সি’ প্রভাববহুল ভাষাতে পরিণত হয়েছিল কিম্বা সেভাবে গড়ে উঠেছিল সেই উর্দুকে নিজেদের মাতৃভাষা বলে চালাবার চেষ্টা করে গেলেন।

                           সেই উর্দুটাও যে ভারতীয় আর্য শাখারই এক অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাষা সে যেন দুটো পক্ষই ভুলে থাকতে ভালোবাসলেন। একমাত্র ৫২র ভাষা আন্দোলন আর ৭১এর স্বাধীন বাংলাদেশ গঠনের মধ্যি দিয়েও এই বিভ্রান্তির  ইতিহাসের থেকে বাঙালি মুসলমান বেরিয়ে এলেন ।  কিন্তু ‘মোক্ষমুলরের’ পাঠশালা থেকে বহু হিন্দু বাঙালি এখনো যে বেরিয়ে এসছেন তা মনেতো হয়ই না, বরং বহু মুসলমানও আজকাল সেই পাঠশালার আশেপাশে ঘুরাঘুরি করেন এমনটি চোখে পড়ে। মেক্সমূলরের পাঠশালা বলে আমরা সেই জার্মান জাতীয়তাবাদের ইতিহাসের দিকে চোখ ফেরাতে চাইছি যা পরে জার্মানিতে নাৎসিবাদের রূপে চরম আকার ধারণ করেছিল। সেরকম  মেক্সমুলর শিষ্যরাই  ভারতে যেমন কামতাপুরি ভাষাকে বাংলা বলে চালিয়ে দেবার চেষ্টাতে ক্ষান্তি দেন না, তাদেরই সগোত্রীয়রা বাংলাদেশে চাকমা, হাজংদের বাংলা বলে চালিয়ে দিতে পারলেই হাঁফ ছেড়ে বাঁচেন যেন। এর জন্যে তারা যে সহজ বুদ্ধিটি কাজে লাগান, তা এই যে--- কোথায় কোন ধ্বনিতে, শব্দরূপে, বাক্যতত্বে বাংলার সঙ্গে এদের মিল রয়েছে তাই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে  তাঁরা সতত উদ্গ্রীব ।  এই সহজ বুদ্ধিতে এককালে অসমীয়ার মতো পূর্বভারতের উন্নত ভাষাকে বাংলা বলে চালিয়ে দেবার ফাঁদে রবীন্দ্রনাথও পড়েছিলেন। এবং এখন প্রায় সমস্ত অসমীয়া পণ্ডিত সিলেটির মতো বাংলার এক সমৃদ্ধ উপভাষাকেও অসমীয়া বলে চালিয়ে দেবার ভাষারাজনীতি করে থাকেন। 
                     মজা হলো, রবীন্দ্রনাথ যখন অসমীয়াকে বাংলা বলে ভুল করছিলেন তখন অসম বৃহৎ বাংলারই এক প্রান্তীয় অঞ্চল ছিল।  আজ যখন অসমীয়া পণ্ডিতেরা ওই একই পথ ধরে সিলেটিকে অসমীয়া বলে প্রচার করে থাকেন তখন  সিলেটিদের  বাস্তবতা হলো তাদের এক বড় ভাগ অসমের প্রান্তীয় তিনজেলা কাছাড়-করিমগঞ্জ-হাইলাকান্দির  সংখ্যালঘু বাসিন্দা। কামতাপুরিরা অসম, পশ্চিম বাংলা দুই প্রদেশেরই সংখ্যালঘু বাসিন্দা। তাই তাদের ধরে দু’পক্ষই দড়ি টানা টানির খেলা খেলে থাকেন। বাংলাদেশেও রয়েছেন তারা, কিন্তু সংখ্যাতে এতো অল্প যে ওদের কথা কেউ ভুলেও মুখে আনেন না।  সেখানে চাকমা হাজংদের কবে বাঙালি বলে মানানো যাবে তার জন্যে কিছু বাংলা ভাষাপ্রেমীদের রাতের ঘুম হয় না ভালো করে। সম্ভবত ২১ ফেব্রুয়ারীর সকালে শহীদ বেদির তলায় গিয়েও তারা তাদের প্রার্থনা জানাতে ভুল করেন না।  যে দেশের উদ্যোগে ২১এর দিনটি  আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি পায় সে দেশে এখনো বাংলার বাইরে কোনো ভাষার রাষ্ট্রীয় কোনো স্বীকৃতি নেই এর চে’ লজ্জার কথা আর কীই বা হতে পারে! অথচ এক দুটি নয় সে দেশে প্রায় পয়তাল্লিশটি ছোট বড় অবাঙালি নৃগোষ্ঠীর মধ্যে প্রচলিত পঁচিশটিরও বেশি ভাষা রয়েছে।
                   বাংলা আর্য ভাষা বটে---কিন্তু বাঙালি আর্য নয় , বহু নৃগোষ্ঠীর মিশ্রণ সম্ভূত জাতি-- এই সত্য নীহার  রায় , সুনীতি চট্টপাধ্যায়দের কল্যাণে আমরা অনেক আগেই জেনেছি। এই দুজনের মধ্যেই ‘হিন্দুত্ব’ নিয়ে এক গৌরব বোধ ছিল বটে, কিন্তু তারাই এই সত্যগুলোকে প্রথম প্রকাশ্যে নিয়ে আসেন। ‘সংস্কৃত বাংলার জননী ভাষা’ এমন মিথকেও প্রথম জোর ধাক্কা দিয়ে ভাঙ্গেন সুনীতি চট্টপাধ্যায়। অতুল সুর বলে এক সুপরিচিত নৃতাত্বিক গবেষক রয়েছেন---যার হিন্দুত্ব ভাবটাও বেশ সরেস---তিনি অতটা অনার্য হওয়াটাকে মেনে না নিতে পেরে এক ‘আলপাইন আর্য তত্বে’র বেশ প্রচার করেছিলেন, সুনীতি চট্টপাধ্যায় সেই তত্বকেও তাঁর আগেই নাকচ করা সত্বেও। সেই আলপাইনরা বুঝি বৈদিক আর্যদের অনেক আগে এসেই বাংলার সভ্যতাকে নির্মাণ করেছিলেন। দেখা যাবে, এই সব গবেষক-বুদ্ধির লোকেরা বৈজ্ঞানিক নৈরাসক্তিকে দূরে ঠেলে, পায়ে দলে যে মতটিকে দাঁড় করালে নিজেদের আভিজাত্যের, বলা ভালো ভাষিক ও ধর্মীয় আধিপত্যকে প্রতিষ্ঠা দেয়া যাবে সেই মতের পক্ষে অবরোহী পদ্ধতিতে নানা তথ্যের সমাবেশ ঘটাতেই বেশ সহজ বোধ করেন। তাই না দেখে, বর্তমান লেখকও নিজের গায়ের কালো রঙ, শরীরের নাতিদীর্ঘ উচ্চতা দেখিয়ে বাংলা ভাষার ছাত্রদের এই বলতে বেশ ভালোবাসেন যে তার পুর্বপুরুষ ছিল মহিষাসুরের রাজ্যের  কোনো সাঁওতাল আদিবাসি গাঁয়ের ‘গাওঁবুড়া’।
                     চাটগাঁয়ের বন্দরের পথ ধরে আরব-ইরানি ব্যবসায়ী আর সুফি সন্তেরা মোটামুটি খৃষ্টীয় আটের নয়ের শতক থেকে  বাংলাতে প্রবেশ করতে শুরু করেছেন --এই সত্য আমরা জানি। আর্যরা বড় জোর তার এক সহস্রাব্দ আগে থেকে মৌর্য যুগের শেষের দিকে বাংলা দেশে ঢুকতে শুরু করেছিলেন। পুব বাংলাতে তারা রাজা শশাংক, কুমার ভাস্কর বর্মাদের আগে জাঁকিয়ে বসতেই পারেন নি।   এই সব ঐতিহাসিক তথ্য আজকাল এক আধটু অনুসন্ধান  যারা করেন তাদের প্রায় সবার জানা। আমরা শুধু  কথাটা মনে করিয়ে দিলাম, এই সত্যের দিকে চোখ ফেরাতে যে বাংলার প্রাচীন জমানা নিয়ে যদি গৌরব করবার কারো কিছু থাকে, প্রাচীনতার দাবিতে যদি বাংলার মাটির উপর কোনো অধিকার দাবি করবার কারো কিছু থাকে তবে সে বাংলার অনার্য মানুষের।  অন্তত যারা সেই অনার্যত্বকে অক্ষত রাখতে পেরেছেন সেইসব---চাকমা, ত্রিপুরী, মগ, গারো, হাজং, খাসিয়া, রাজবংশি, সাঁওতাল, মুণ্ডা, বডো, রাভা মানুষদের বাদ দিয়ে বাংলার মাটির কোনো কথা শুরুই হতে পারে না।   সেই অর্থে তারাই বাংলার ‘আদিবাসি’ বটে। কিন্তু বাঙালিরা নয় কি? 
                                বাঙালিরা কি আদিবাসি নয়?  আর্যত্বের দাবি দাঁড় করালেই কি বাঙালির আদিবাসিত্ব প্রতিষ্ঠা পায়? অথবা বাঙালি যেহেতু ‘আর্য’ তাই কি তারা শশাংক-ভাস্কর বর্মাদের কালে নিয়ে আসা উত্তর ভারতীয় বামুন কিম্বা চাঁটগাঁয়ের বন্দর দিয়ে  প্রবেশ করে পার্শি বণিকদের সঙ্গে করে আসা আগন্তুক প্রবাসী? রাষ্ট্রসঙ্ঘের ব্যবহৃত শব্দ ‘indigenous’ এর আক্ষরিক অর্থে  ভারতীয় উপমহাদেশে ব্যবহার করাটা বড় গোলমেলে। আফ্রিকা, আমেরিকা, কানাডা, অস্ট্রেলিয়ার মত দেশে গেল দুই তিন শতকে ইউরোপ থেকে গিয়ে  সাদা চামড়ার  সাহেবেরা ওখানকার মুল অধিবাসিদের মেরে কেটে হয় সাফ করে দিয়েছে, নতুবা তাদের প্রান্তিক অবস্থানে ঠেলে দিয়ে নিজেরাই রাজা হয়ে বসেছে। কিন্তু ভারতীয় উপমহাদেশেতো তারা সেটি করতে  পারে নি। প্রাচীন আর্য , পার্শি কিম্বা আরবি কেউ সেটি পারেনি।  ‘শক হূন দল পাঠান মোঘল ‘ এখানে এক দেহে সবাই ‘লীন’ হয়ে গেছে। এই সত্যটি কেন যে আমরা সবাই ভুলে থাকি। কী মুস্কিল! যে সাদা চামড়ার লোকেরা নৃগোষ্ঠী গত সাফাই অভিযানের জন্যে জগৎ বিখ্যাত আমরা তাদের থেকেই নিরাপদে ‘শব্দ’, ‘বাক্য’, ‘পরিভাষা’ এবং ‘তত্ব’ সবই ধার করতে ভালোবাসি।
                 বাংলাভাষাতে ‘উপজাতি’ বলে একটি অপমান জনক শব্দ চালু আছে। তার মানে, যারা এখনো পুরো জাতি হয়ে ঊঠেনি, অন্য জাতির শাখা হয়ে রয়েছে। উপভাষার মতো আরকি। ‘উপজাতি’দের ভাষাকে অনেকেই তাই ‘উপভাষা’ বলে চালিয়ে দেবার ফাজলামোও করে থাকেন। এমনকি বাঙলা দেশে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি ভাষাকেও কেউ কেউ বাংলা বলে চালিয়ে দেন একথা জানতে পেলে শহিদ সুদেষ্ণা সিনহার জন্মভিটে অসমের  করিমগঞ্জে জেলার বহু বাঙালিও আৎকে উঠবেন। পশ্চিম বাংলা –ত্রিপুরাতেও ‘উপজাতি’ শব্দটি চালু রয়েছে। রয়েছে ‘জাতি-উপজাতি’র সংঘাত এবং ‘ভাই ভাই ঠাই ঠাই’ করবার বিপরীত রাজনীতিও। অসমেও শব্দটি ছিল। কিন্তু এখানেই সম্ভবত শক্তিশালী জনজাতীয় রাজনীতির দৌলতে এক সম্মানজনক সমাধান বের করে এনে ব্যবহৃত হচ্ছে ‘জনজাতি’।   ‘Indigenous’ শব্দটি  অসমেরর রাজনীতিতেও এক জনপ্রিয় শব্দ। কিন্তু তার অসমীয়া প্রতিশব্দ একটি আরবি মূলীয় শব্দ ‘খিলঞ্জিয়া’ । ‘খিলঞ্জিয়া’ বললে কেবল Tribal’ দেরকে বোঝায় না। অসমীয়া ‘ভট্টাচার্য-চক্রবর্তী’ বামুনরাও নিজেদের খিলঞ্জিয়া বলে দাবি করতে সদা ব্যস্ত। আটশ বছর আগে অসমে আসা ‘আহোমে’রাও খিলঞ্জিয়া, কিন্তু হাজার কয় বছরের প্রাচীন করিমগঞ্জের সিলেটিরা নয়।  ধরেই নেয়া হয় যে, অসমের বাঙালিরা এই সেদিন বৃটিশ আমলের নব্য আগন্তুক বিদেশি। বহু বাঙালি সেটি বিশ্বাসও  করে ।  যখন ‘খিলঞ্জিয়া’দের জন্যে সাংবিধানিক অধিকারাদি দাবি করা হয় ,তখন সে দাবির থেকে অন্য ‘আগন্তুক’ ভারতীয়রা বাদ পড়েন। ময়মনসিংহ মুলের মুসলমান বাঙালিদের অসম সাহিত্য সভার মতো প্রভাবশালী  সংগঠন ‘ন’অসমীয়া’  বলে স্বীকৃতি দিলেও তারা ‘খিলঞ্জিয়া’তো ননই, আমজনতা তাদের ‘বাংলাদেশি’ বলেই ভেবে থাকে এবং সেরকম ব্যবহারও করে থাকে তাদের প্রতি।
                   ভয় হয়, বাংলাদেশে যদি বাঙালিরা ‘আদিবাসি’  না হন তবে তাদেরকেও     একদিন  ‘ নব্যআগন্তুক’ বলে ভেবে নেয়া হবে নাতো?  প্রশ্নটি ‘আদিবাসি’দের  পরিচিতি আন্দোলনের কৌশলগত অবস্থান থেকেও উঠা উচিত।  বহু বাঙালি মনে এই প্রশ্নটি কাজ করবে। শাসক শ্রেণির  জাত্যাভিমানী অবস্থানের বাইরেও বহু সাধারণ বাঙালি নিজেদের বিপন্নতাবোধ থেকেও এর বিরোধীতা করছেন আর করবেন। তাই দেখা যাবে  যেসব দল সংগঠনগুলো সেদেশে ‘নীতিগত’ভাবে ‘আদিবাসি’ পরিচিতির দাবিকে মেনে নেন, তারাও কৌশলগত অবস্থানে অন্যত্র গিয়ে ‘উপজাতি’ শব্দটিই দেদার ব্যবহার করে থাকেন।
                    অবিভক্ত বাংলাদেশে বাংলা ভাষাটি মূলত আগন্তুক ভারতীয় আর্য ভাষার সন্তান, এর গড়ে উঠার বয়স হাজার বছরের বেশি নয়। ব্রাহ্মণ্য হিন্দু ধর্মও এখানে নব্য আগন্তুক ধর্ম, ইসলামতো বটেই। কিন্তু, তাই বলে বাঙালি আগন্তুক নয়। এখানে যে প্রাগআর্য ‘কিরাত-নিষাদ’ নৃগোষ্ঠীগুলো ছিল তারাইতো কালক্রমে ব্রাহ্মণ্য প্রভাবে সামন্তীয় স্থায়ী কৃষি অর্থনীতিতে প্রবেশ করল আর আর্য ভাষা, ধর্ম এবং সংস্কৃতিকে বরণ করে নিল। সেই ষোড়শ শতকে বডোমূলীয় রাজা কুমার ভাস্কর বর্মার কামরূপের আমল থেকেই সেই প্রক্রিয়া চলছে। পুব বাংলার এক বড় ভাগ সেই কামরূপের অঙ্গ ছিল সে কথা যেন আমরা ভুলে না যাই। আর শুধু ব্রাহ্মণ্য প্রভাবেই বলি কেন? শাহজালাল থেকে শুরু করে যে সুফী সন্তরা এদেশে এসছিলেন তাদের ধর্ম প্রচারের ভাষা কী ছিল স্মরণ করুন। আরাকানে, কাছাড়ে, ত্রিপুরাতে, কামতাপুরের রাজসভাতে  কেন বাংলা সাহিত্য চর্চা হচ্ছে ভাবতে বসুন। গেল হাজার বছরে এদেশে ধর্মান্তরণের কথাগুলো ইতিহাসের বইতে খুব বড় বড় করে লেখা হয়েছে তাতে ধর্মীয় জাতিয়তাবাদী রাজনীতির বেশ সুবিধেও হয়েছে।  ভাষান্তরের কথাটাওতো লেখা হয়েছিল। কিন্তু সেগুলো বাংলা ভাষার ইতিহাসের ভূমিকা হিসেবে থেকে গেল। এ নিয়ে কেউ   কেউ হৈ চৈ করবার তেমন দরকার বোধ করলেন না।  যেটুকু হয়েছে , তা ঐ বাঙালির একাংশকে উর্দুতে ভাষান্তরিত করবার প্রয়াস নিয়ে। তার সঙ্গে জড়িয়ে ছিল হিন্দু-মুসলমান ধর্মীয় পরিচিতির বিরোধও। এই ভাষা বিরোধ নিয়ে বাঙালি এতো ব্যস্ত রইল যে তার নিজেরই আদিম ভাষাগুলো , পরে যেগুলো তার প্রতিবেশি ভাষা হয়ে গেল সেদিকে তাকাবার দরকারও সে বোধ করল না  আর করলেও  ফুরসত যেন সে কোনোদিনই  পেল না। এটি আমরা প্রায় নিশ্চিত হয়েই বলতে পারি। কেননা রামেশ্বর শ’ গেল শতকের আশির দশকের মাঝামাঝি ( বাংলা ১৩৯০) তাঁর ‘সাধারণ ভাষা বিজ্ঞান ও বাংলা ভাষা’ বইতে ভারত বাংলাদেশে বাঙালির ভাষাতত্ব চর্চার এক খতিয়ান তুলে ধরেছিলেন। সেখানে দেখা যাবে দু’একজন সাঁওতালি বা নেপালি ভাষা নিয়ে এক আধটু অধ্যয়ন করলেও বাঙালি ভাষাতাত্বিকদের প্রায় কেউই প্রতিবেশি অন্য ভাষা নিয়ে বিশেষ চর্চা করেন নি। সেই সুনীতি চট্টপাধ্যায় যা তাঁর ওবিডিএল লিখবার দরকারে এবং পরেও ‘কিরাত জনকৃতি’র মতো  গ্রন্থে কিছু কিছু কাজ করেছিলেন। নীহার রঞ্জন রায়,  মুহাম্মদ সহীদুল্লাহদের ধারণা ছিল দ্রাবিড় বিশেষ করে অস্ট্রিক সাঁওতাল মুণ্ডারিদের প্রভাব যদিও বাংলাতে ব্যাপক, ভোট বর্মীদের প্রভাব প্রায় নগণ্য বললেই চলে।
                      অতি অল্প বাঙালিই তারপরে প্রশ্ন করেছেন,”তা কী করে হবে?” সুনীতি চট্টপাধ্যায় ‘কামরূপী’কে বাংলার একটি উপভাষা বলে চিহ্নিত করে যাবার পর ভারতে অন্তত প্রায় সমস্ত বাঙালি  ভাষাতাত্বিক তাঁর এই উপভাষা বিভাজনকে নিয়ে প্রশ্ন তুলেন নি। এই ‘কামরূপী’রাই এখন ‘কামতাপুরি’নামে বাংলার থেকে ( এবং অসমিয়ার থেকেও)  আলাদা হয়ে যেতে চাইছেন। তারা যে নৃগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করেন সেই কোচ-রাজবংশীরা যে স্পষ্টতই বডোদের থেকে বেরিয়ে যাওয়া ভোট-বর্মী নৃগোষ্ঠির লোক সেই সত্য কিন্তু কেউ অস্বীকার করেন না। তারা কি আর্যায়নের প্রক্রিয়াতে চলে এলেন তাদের নিজেদের কোনো নৃতাত্বিক প্রভাব ছাড়াই? এই সত্য কে কবে প্রমাণ করলেন? যে মণিপুরিরা বিষ্ণুপ্রিয়া নাম নিয়ে আর্যভাষা বরণ করে নিলেন তাদের ভাষাতে কি মণিপুরি প্রভাব বলতে কিছুই নেই? তর্কের খাতিরে না হয় মেনে নেয়াই গেল তারাতো আর বাঙালি নন, কিন্তু একটি ভোটবর্মী জনগোষ্ঠি কেমন আর্য ভাষার অধিকারী হয়ে পড়তে পারেন বিষ্ণুপ্রিয়ারা কিন্তু এই সময়ে তার প্রত্যক্ষ নিদর্শন। তাদের নিয়ে বাঙালিরা ভারতে টানাটানি না করলেও অসমিয়ারা করে থাকেন। হাজং, চাকমারাও শুধু প্রমাণ করেন যে  কী রকম এক একটি জনগোষ্ঠী তাদের   নিজস্ব গতিতে আর্যায়নের প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ হবার আগেই বাঙালিকরণের চাপের মুখে অবরুদ্ধ পথে দাঁড়িয়ে গেছে। চাকমা -হাজংদের  বাঙালি বলব আর তাদের ভাষার মধ্যে  ভোটবর্মী প্রভাব নিয়ে মাথা ঘামাবো না, বরং তারা কতটা বিশুদ্ধ আর্য-বাংলার অধিকারী তাই প্রমাণ করতে মাথার ঘাম পায়ে ফেলব এমন দ্বিচারিতা কি না করলেই নয়? 
                 এই চাকমা-হাজং-কামতাপুরি-বিষ্ণুপ্রিয়া ভাষার লোকেরা হচ্ছেন পুথির বাইরে আমাদের চোখের সামনে থাকা সেই সব জনগোষ্ঠি যারা প্রমাণ করেন যে নৃগোষ্ঠীগুলোর ধর্মান্তরণ শুধু নয়, ভাষান্তরণও একটি অবশ্য সম্ভব ঐতিহাসিক প্রক্রিয়া। তারা যদি, তাদের প্রাচীন অনার্য ভাষাগুলো ছেড়ে আর্য ভাষাকে বরণ করেছেন তবে সেটি হয়েছে এক স্বাভাবিক ঐতিহাসিক সামাজিক প্রক্রিয়াতে। ইতিহাসের নানা সময়ে এ রকম বিচিত্র  প্রক্রিয়াতে, বিশেষ করে স্থায়ী কৃষি ব্যবস্থাতে এবং সেই সঙ্গে আর্যায়নের প্রক্রিয়াতে প্রবেশ করে যে অনার্য নৃগোষ্ঠিগুলো  সে প্রক্রিয়াকে সম্পূর্ণ করেছেন বাংলাদেশে তারাই গেল এক হাজার বছরের নবাবী আমলে নিজেদের ‘বাঙালি’ বলে পরিচয় গড়ে তুলেছেন। সেই অনার্যদের মধ্যে অস্ট্রিকরা অবশ্যই আছেন। কিন্তু, পূব বাংলাতে আর্যদের আসার আগেই যে ভোটবর্মীরা ছেয়ে গেছিলেন সে কথা সুনীতি চট্টপাধ্যায় লিখে গেছেন। তারা সব গেলেন কোথায়? তারাই বাঙালি হলেন, গড়ে তুললেন বাংলাদেশ।  
                  বাংলা চর্চা করবার জন্যে  তাদের কেউ বাধ্য করেনি। মণিপুরে শতিনেক বছর আগে প্রাচীন মণিপুরি লিপিতে লেখা সমস্ত বইপত্র পুড়িয়ে ফেলে বাংলা লিপি চালু করা হয়েছিল। কিন্তু সেটি বাঙালিরা গিয়ে করেন নি। মণিপুর রাজ পামহেইবা বৈষ্ণব গুরু শান্তিদাসকে ডেকে নিয়ে গেছেন। নিজে বৈষ্ণব ধর্ম বরণ করেছেন এবং বৈষ্ণব ধর্মের প্রচারের স্বার্থে তিনিই প্রাচীন মণিপুরি লিপি বর্জন করিয়েছিলেন।
                      এখন সে  রাজতন্ত্র গেছে বটে , কিন্তু জনতন্ত্র কায়েম হয়নি। ‘গণতন্ত্রে’র নামে কায়েম হয়েছে  সংখাগুরুতন্ত্রের ভন্ডামী। ধর্ম-আর ভাষার নামে চলে সেই সংখ্যাগুরুতন্ত্র। ভোটের জন্যে ‘সংখ্যালঘু তোষণে’র অভিযোগ যতই উঠে থাকুক না কেন, সংখ্যাগুরুকে তরল আবেগে খুশ করে রাখাটাই এই সংখ্যাগুরুতান্ত্রিক রাজনীতির প্রধান ধারা। বাংলাভাষা নিজেই সেই সংখ্যাগুরুতন্ত্রের স্বীকার ছিল বাংলাদেশে, এখনো আছে ভারতের অসমে। দু’দেশেই ভাষার জন্যে বাঙালি প্রাণ দিয়েছে।  এখন সেই বাঙালি নিজেই যেখানে স্বাধীনতা আর স্বাতন্ত্র্য অর্জন করতে পেরেছে সেখানে চালাচ্ছে সেই বাংলাভাষার ‘গনতন্ত্র’। সেটি হোক বাংলাদেশে, কিম্বা ত্রিপুরাতে কিম্বা পশ্চিম বাংলাতে। ধর্ম আর ভাষার নামে জাতীয়তার আবেগকে প্রবল না করলে পুঁজিবাদ নিজের লুন্ঠনকে আড়াল করবার পথ খুঁজে পায় না। এই জাতীয়তার বাইরের লোকেরাতো শাসক শ্রেণির  ঘোষিত শত্রু বটে, জাতীয়তার ভেতরে থেকে যারা বর্তমান লেখকের মতো সেই গণতন্ত্রের মুখোস উন্মোচন করেন  তারা চিহ্নিত হয়ে পড়েন ‘জাতির শত্রু –জাতি বহির্ভূত  শত্রু পক্ষের  দালাল’ বলে। এভাবে জাতীয়তাবাদ তার বাইরে ভেতরে সাঁড়াশির আক্রমণ হানে নিজের দেশেরই দুর্বল জাত-বর্ণ-শ্রেণি-লিঙ্গগুলোর এবং যারা আরো ব্যাপকতর গণতন্ত্রের আওয়াজ তুলেন তাদের  বিরুদ্ধে। নিরাপদে থাকে বিদেশি সাম্রাজ্যবাদ।  
                  আমরা এটা দেখাবার চেষ্টা করলাম বটে যে বাঙালিরাও বাংলাদেশে, পশ্চিম বাংলাতে, ত্রিপুরাতে, কাছাড়ে, করিমগঞ্জে ‘আদিবাসি’, ‘খিলঞ্জিয়া’, ‘Indigenous’; কিন্তু ‘Tribal’ অথবা অসমের অর্থে ‘জনজাতি’ নয়। কানাডা, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, লাতিন আমেরিকার মতো বাঙালিরা আগন্তুক বিদেশি দখলদারও নয়। কিন্তু, বাঙালি জাতীয়তাবাদটি এক বিলেতি আমদানি। সেই জাতীয়তাবাদের ভূমিকা বিলেতি ‘Nationalism’ থেকে তথা ‘Nation State ’ গড়বার প্রয়াস থেকে ভিন্ন নয়। যে ন্যাশনেলিজম তার আভ্যন্তরীণ জাতি-বর্ণ-ধর্মগত বৈচিত্রকে ভয় করে , এবং প্রায়শঃই নানা ছুতোয় তাকে ধ্বংস করবার চেষ্টা করে। একেই তারা নাম দেয় ‘জাতীয় সংহতি’ । সেই ‘সংহতি’ নিজেকে প্রকাশ করে সাম্প্রদায়িকতার চেহারাতে। রাবীন্দ্রিক ভাষাতে ‘অজগর সাপের ঐক্যনীতি’। পাকিস্তানের শাসকেরা যার জন্যে খোদ বাঙালিদের মধ্যেই কুখ্যাত।   যে সাম্প্রদায়িকতার স্বীকার বাংলাদেশের চাকমা, গারো, ত্রিপুরা, মগ, হাজং, মণিপুরি ইত্যাদি ভাষিক সংখ্যালঘু মানুষেরা। ঘটনা চক্রে তাদের ধর্মও সংখ্যাগুরুর ধর্ম থেকে ভিন্ন। ধর্মটি এক হলেও যে তারা সেরকম সাম্প্রদায়িকতার স্বীকার হতেন তার প্রমাণ সেদেশের বিহারি মুসলমান সম্প্রদায়। ভারতবর্ষের বাংলা কাগজগুলো মূলত সেদেশে হিন্দু বাঙালির বিরুদ্ধে  সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে সরব। কেননা, তারাও এক ভাষিক জাতীয়তাবাদের ধ্বজা তুলে রেখেছে যার রঙটি শুধু হিন্দু। বাংলাদেশের ভাষিক সংখ্যালঘুদের প্রতি তাদের  দরদ কেমন তা বুঝতে হলে এদেশে স্মরণার্থী হয়ে আসা বাংলাদেশের ‘চাকমা’দের দিকে তাকালেই  স্বরূপ স্পষ্ট হয়ে যাবে। সারাক্ষণ ভিটেচ্যুত হবার ভয় তাদের তাড়া করে বেড়ায় মিজোরামে , অরুণাচলে। 
            জাতীয়তাবাদ চেষ্টা করে সবাইকে বাঙালি করতে, চেষ্টা করে  এটি প্রমাণ করতে যে সংখ্যালঘুদের কারা কী পরিমাণে বাঙালি হয়েই আছেন। কিন্তু যদি গণতন্ত্রকে সত্যি শক্তিশালী করতেই হয়, তবে কে বাঙালি আর কে নয় সেটি প্রমাণ কিম্বা অপ্রমাণ করবার অধিকার দিতে হবে সেই নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীকে। যারা বাঙালি বলে নিজেদের স্বীকার করবেন না, তাদের ভাষা সংস্কৃতি যত ক্ষুদ্রই হোক তাকে সম্মান জানানো স্বীকৃতি জানানো এক সুস্থ আর স্বাস্থ্যবান ভবিষ্যতের জন্যেই এক অবশ্য প্রয়োজনীয় বিষয়। তা নইলে আজ হোক কাল হোক আন্তর্জাতিকভাবে ২১শে ফেব্রুয়ারির ইতিহাস লজ্জিত হবে এটি প্রায় নিশ্চিত। চাকমা হাজংদের ভাষা কতটা বাঙালি , সেই সত্য প্রমাণ করবার পন্ডশ্রম না করে, বাংলা কতটা ভোটবর্মী ,  কিম্বা অস্ট্রিক সেই গবেষণাতে  বাঙালি শ্রম নিয়োগ করুক। তাতে লাভ দুটো। প্রথমতঃ এই সব ছোট ছোট জনগোষ্ঠির স্বমর্যাদা আর স্বাধিকার বোধ প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়াতে বাঙালি দ্রুতি এনে তাদের আপন  করে নিতে পারবে। তারা বিশ্বাস করতে পারবেন যে জোর যার মুলুক শুধু তারই নয়। ‘প্রথম আলো’ কাগজে পড়লাম ২০০৯ সালের চট্টগ্রামে অনুষ্ঠিত  আদিবাসি মেলাতে বাংলাদেশের শিল্পমন্ত্রী দিলীপ বড়ুয়া বললেন, “বাঙালি জাতিসত্তার সঙ্গে মিশে আছে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ৩৫টি আদিবাসী গোষ্ঠী। তারা বাংলাদেশের সৃজনশীল চেতনাকে সমৃদ্ধ করছে। তারা আমাদের গর্বিত নাগরিক। তাদের ঐহিত্য ও সংস্কৃতিকে লালন এবং বিকশিত করে অসাম্প্রদায়িক চেতনার বাংলাদেশ গড়তে হবে।“ এমন উক্তি মোটেও অসাম্প্রদায়িক নয়। এ হলো বাংলাভাষার ভেতরে সবাইকে বিলীন করে ফেলবার  সাম্প্রদায়িকতা।  এমন উক্তির সামনে সংখ্যালঘু ভাষা সম্প্রদায়ের মানুষ শুধু ভয়ে নীরবে থাকতে  পারেন। মনে মনে তারাও তাদের নিজেদের ভাষা সংস্কৃতির জন্যে  নতুন করে সেই  ‘১৯৫২’র আগুন ধিকি ধিকি করে হলেও জ্বালবেন আর জ্বালচ্ছেন। এই করে সমৃদ্ধ আর ঐক্যবদ্ধ বাংলাদেশ গড়া যাবে না। এই করে তাদের মধ্যে শিক্ষাদীক্ষাও ছড়ানো যাবে না। কেন না এই সত্যতো বাঙালিই বড় গলাতে বলে থাকে যে ‘মাতৃভাষা মাতৃদুগ্ধ সমান।’ চাকমা-হাজং –গারো-বিষ্ণুপ্রিয়াদের মাতৃভাষার হবেটা কী?  দ্বিতীয়তঃ বাংলা কতটা ভোটবর্মী ,  কিম্বা অস্ট্রিক সেরকম  গবেষণাতে  বাংলা ভাষা আর বাঙালির ইতিহাসেরও  অনেক নতুন দিক উন্মোদিত হবে এটি নিশ্চিত।
                  আমরা সেরকম দুএকটি ভাষাতাত্বিক ইঙ্গিত দিয়ে আমাদের এই লেখা শেষ করব।
                                        “আশীর্বাদম ন গৃহ্নিয়াত পূর্ব দেশ নিবাসিনাম ।
                                         'শতায়ুর' ইতি বক্তব্যে, 'হতায়ুর' ইতি ভাষিনাম ।।
           --এই শাস্ত্র বাক্যটির উল্লেখ করেছেন সুনীতি চট্টপাধ্যায় তাঁর বিখ্যাত বই ODBL-এ । আমরা পূর্বদেশবাসীদের থেকে আশীর্বাদ নিতে মানা করা হচ্ছে। কেন না আমরা 'শতায়ু' হবার আশীর্বাদ দিতে গিয়ে 'হতায়ু' হবার শাপ দিয়ে বসি। আমরা মানে প্রায় সমস্ত পূব বাংলার বাঙালিরা আর অসমিয়ারা । এই শাস্ত্রবাক্য প্রমাণ করে আমরা বহু আগে থেকেই এই 'হ' উচ্চারণ করি । যাদের থেকে আশীর্বাদ নিতে মানা করা হচ্ছে তারা হয় আর্য নন, নতুবা ইতিমধ্যে ভেজালে পরিণত হয়েছেন। তারা ‘হতায়ু’ বলেন কেন ?   ---এই প্রশ্নের উত্তরই খুব কম লোক সন্ধান করেছেন । সুনীতি চট্টপাধ্যায়ও তাঁর গ্রন্থে খুব নিশ্চিত হয়ে কিছু উত্তর দেন নি। কিন্তু  লিখেছেন , “. . . The presence of a large Tibeto-Burman element in the population of Assam and East and North Bengal may have something to do with this....”  এই ‘হ’ উৎস সন্ধানে অনেকে আলপাইন আর্যদের ভাষা অব্ধিও গিয়ে পৌঁছোন। অনেক আর্যভাষাতে এই ‘হ’কারীভবন  দুর্লভও নয়। কিন্তু তার আগে ‘আলপাইন’ তত্বেতো নিশ্চিত হতে হবে। তার চে’ বরং সুনীতি চট্টপাধ্যায়ের অনুমানের পক্ষে তথ্যাদি আমাদের হাতের কাছেই রয়েছে।
                             এই /স-শ-ষ/এর ‘হ’ হবার তথা মহাপ্রাণতার প্রবণতা পুব বাংলার উপভাষাগুলোতে ব্যাপক। তা এমনই যে শুধু ‘হে‘,হকালি বেলা’, ‘হাইঞ্জা বেলা’, ‘হক্কলডি’র মতো শব্দগুলোতেই নয় ,শব্দের শুরুতে অ/আ স্বরান্ত ব্যঞ্জন পেলেই , এমনকি শুধু ‘অ’কে পেলেও হয় মহাপ্রাণ হয়ে যাবে অথবা শেষের দিকে হবার প্রবণতা দেখাবে। তাই পূব বাংলার লোকেরা ‘কাপ’, পাপড়, চল, চাল, জল , জাল, ‌পরান,কপাল  উচ্চারণ করতে পারেন না। করেন কা’প,পা’পড়, চ’ল,জ’ল, জা’ল, প’রান, ক’পাল  অনেকটাই /খা,ফা,ছ,ঝ,ফ,খ/-এর কাছাকাছি কিন্তু পুরোটা নয়। অকারণ হয়ে উঠে অহকারণ, অনাচার হয়ে যায় অহনাচার। এরকম ‘হ’ –এর টানে অ অনেক সময় ‘আ’ হয়ে যায় যেমন আঞ্চল, আষ্ট। আবার উল্টোটাও হয় । সাধারণত সঘোষ মহাপ্রাণ অল্পপ্রাণে পরিণত হয়। ‘হ’ থাকলেতো কথাই নেই ‘হলদি’ হয় ‘অ’লদি’; ভাত হয়ে যায় বা’ত ; ভাই হয়ে যায় ‘বা’ই’ ; ‘ঘাই’ হয়ে যায় ‘গা’ই’। বডো ভাষার স্বরধ্বনিতে ‘অ’ নেই, ‘আ’ রয়েছে। ক,ত,চ,ট,প,ঘ,ধ,ঝ, স,ষ,শ এরকম কোনো ব্যঞ্জন ধ্বনিই নেই। কিন্তু ‘হ’ রয়েছে। বস্তুত এই ‘হ’ ধ্বনিটিই খুব মোটা দাগে পূর্ব আর পশ্চিম বাংলার বাংলাকে আলাদা করে চিনিয়ে দেয়। সাধারণত বাংলাভাষাতে /স, ষ/এর কোনো স্বনিমীয় তাৎপর্য নেই। বাঙালি সবেতেই উচ্চারণ করে ‘শ’। তবু পশ্চিম বাংলার কিছু বাঙালি যে ‘স’ উচ্চারণ করে তাঁর উৎসের খোঁজে সাঁওতালি ভাষা অব্দি গিয়ে পৌঁছুনো যেতে পারে। তারাও যে খুব বিশুদ্ধ আর্য নয় তার প্রমাণ তাদের ভাষাতে প্রথম পুরুষে ‘সে (হে) –তাই’ এমনটি সংস্কৃতের ( কিম্বা পুব বাঙালিদের) মতো লিঙ্গভেদ নেই। এমন  লিঙ্গভেদ নেই বডোতেও, সাঁওতালিতেও। এখন, এই দুই ভাষাগোষ্ঠীর কারা তাদের প্রভাবিত করছে সেটিও অনুসন্ধানের বিষয় হতে পারে। 
                 এই ‘হ’ ধ্বনিই অসমিয়াকে বাংলার সঙ্গে আলাদা করে। অসমিয়াতেতো স্বতন্ত্র অবস্থাতে থাকা /শ,স, ষ/ তিনটিই ‘হ’ উচ্চারিত হয় তাও স্পষ্ট উষ্ম নয়, একটু ঘৃষ্ট। তাই তারা  ইংরেজিতে ধ্বনিটি প্রকাশ করেন ‘h’ লিখে নয়, লেখেন ‘x’-- Mexico  (‘মেহিকো’)-তে যেরকম । তাঁরা অসম লেখেন Asom নয় Oxom ।অসমিয়াদের মধ্যে এই ‘হ’ ধ্বনিটি নিয়ে বেশ একটা গৌরব বোধ রয়েছে। পুব বাংলার বাঙালিদের সেনিয়ে গৌরব  না করবার কোনো কারণ আছে কি? আমরা আরো টেনে গেলে দেখাতাম এই একটি ধ্বনি পুব বাংলার উপভাষাগুলোর  উপর কত বিচিত্র রঙ চড়িয়েছে। 
                   কিন্তু , সে হবেখন অন্য সময়, অন্য কোনোখানে। আমরা যদি  আপাতত তাই নিয়ে ‘বাঙ্গালদের’ গৌরব বোধ একটু বাড়াতে অনুপ্রাণিত করতে পারি, (সিলেটি হিসেবে বর্তমান লেখকের সেই গৌরব বোধ প্রবল), যদি আমাদের আত্মার আত্মীয় বলে প্রতিবেশি সংখ্যালঘু ভাষার মানুষকেও—তাদের ‘আদিবাসি’ কিম্বা ‘জনজাতি’ যে নামেই চিহ্নিত করুন--- সেই ঐতিহ্যের প্রতি গৌরববোধের শরিক করতে পারি, সেই ঐতিহ্যের ঘনিষ্ঠ আর প্রত্যক্ষ বাহক বলে তাদের ভাষা সংস্কৃতির সমান স্বীকৃতি, মর্যাদা আর বিকাশের লড়াইতে তাদের পাশে দাঁড়াবার জন্যে আরো কিছু বন্ধু বাড়াতে   পারি তাতেই আমার এ লেখার শ্রম সার্থক। তাতে বাংলা ভাষা বিপন্ন হবে না, সমৃদ্ধ হবে। তার নিজেরই আরো আরো নতুন সম্ভাবনার দোয়ার খুলে যাবে—এটি নিশ্চিত।
তথ্যসূত্রঃ ১) The Origin and Development of Bengali Language, Suniti Kumar Chatterji;২) বাঙালির ইতিহাস, নীহার
    রঞ্জন রায়;
৩) বাঙালা ও বাঙালীর বিবর্তন , অতুল সুর; ৪) ভাষার ইতিবৃত্ত, সুকুমার সেন;৫)সাধারণ ভাষা বিজ্ঞান ও বাংলা ভাষা;
৬)ভাষাপ্রেম ভাষাবিরোধ, পবিত্র সরকার;৭) উত্তর বঙ্গের ভাষা, সম্পাদনা রতন বিশ্বাস;৮) অসমীয়া আরু অসম্র ভাষা উপভাষা,
 উপেন রাভা হাকাচাম;৯) অসমীয়া আরু অসমর তিব্বতি-বর্মীয় ভাষা, ঐ; এবং এরকম কিছু ওয়েবসাইটঃ অ)
http://w4study.com/?p=22, আ)http://www.prothom-alo.com/detail/news/42105,
ই)http://swabhimanngo.blogspot.com/2010/08/protibadi-  aandolon-o-bamponthider.html, ঈ)
   http://www.facebook.com/note.php?note_id=138982706139600

Tuesday 19 October 2010

সেবারের সেই পুজো এবং পনঙ্কু


From My Google Blog
From My Google Blog
                                                            (১)
                     সেবার বাবা এলেন একা। হঠাৎই। দিন কতক আগে চিঠি এলো তিনি আসছেন। এক ঝাঁপে ছ’ছটাকে  পেছনে ফেলে হি ই ই ই ----ই করে একেবারে সপ্তম স্বর্গে  গিয়ে আমি দাঁড়ালাম ।
কতদিন... কত কত দিন ধরে স্বপ্ন দেখে গেছি, আমার সেই শৈশবের রাজপাটে আবারো গিয়ে পা রাখব। যে রাজপাটে  আমি রাজা , পনঙ্কু মন্ত্রী। আমি যা বলতাম সেই নির্দেশ মানাই ছিল পনঙ্কুর কাজ । তার উপর আর কোনো কথা ছিল না। মাঝে মধ্যে তার পরামর্শ আমাকে মানতে হতো। তাই বলে মায়ের হাতের মার আর  বাবার চোখের লালকে  ভয় পাওয়াটা কোনো কাজের কাজ ছিল না। সে আমাদের আইনে ছিল না। আমাদের রাজত্ব চলছিল নিরঙ্কুশ । দিনের পর দিন।
                   পনঙ্কু আমার ছেলেবেলার প্রথম বন্ধু। আমার বাবার অফিসের বেয়ারা। অফিসটা যে কোয়ার্টারে থাকতাম তার উলটো দিকের পাহাড়ে। পাহাড় বললে ভয় পাবার কিছু নেই। এখানেই আসলে পাহাড়টা মোড় ফিরেছে।   মাঝের খাদটা ওখানে শুরু হয়েছে মাত্র।  সেখানে আরেক বেয়ারার বাড়ি ছিল। যে আমাকে বিশেষ পাত্তা দিত না বলে নাম ভুলে গেছি।
                      অফিসে কাজ থাকতো না বোধ হয় বিশেষ। কারন পনঙ্কু প্রায়ই এসে জানালার ফাঁক দিয়ে উঁকি দিত। আমি আর আমি পাখি হয়ে যেতাম। কে জানত  আমরা গেছি কোন পাহাড়ে, কোন অরণ্যে।   বাবাদের অফিসের ঠিক উপর দিয়ে চলে গেছে যে পথ সেটি তখন জানতাম তুয়েনসাং  গিয়ে থেমেছে। ওই পথ দিয়ে বাবা প্রায়ই জীপে করে চলে যেতেন। সেই পথের ওপারে এক বিশাল মাঠ ছিল, যেখানে প্রায় বিকেলে সামাতুরের নাগা ছেলেরা ফুটবল খেলত। তাতে আমার কোনো নিমন্ত্রণ থাকবার কথাও ছিল না, ছিলও না।  বাড়ি থেকে কখনো তাকাতাম ওদিকে ।   সে ওই খেলা দেখব বলে নয়। যেদিন সেখানে কোনো খেলা হত না সেদিন প্রচুর ঘোড়া দৌড়ে বেড়াত । কখনো সন্ধ্যে হয়ে চাঁদ উঠে আসত। ঘোড়াগুলো তখনো চরে বেড়াতো। রাত বাড়লে ওরা চাঁদের দেশে  বাড়ি চলে যেত । কিন্তু কোন পথে, তার কোনো চিহ্ন রেখে যেত না। গেলে আমি আর পনঙ্কু নিশ্চিত ওখানে হানা দিতাম পরদিনই।
                    সেই মাঠের বাঁয়েই ছিল এক পুলিশ ফাঁড়ি। তার উপরে এক বিশাল বাঁশের তোরণের ভেতরে সেনা বাহিনীর আড্ডা। ওই তোরণ পার করে একদিন নিয়ে গেছিল পনঙ্কু। সেখানে পথের দু’ধারে সারি সারি কাটা বাঁশের ফলা মাটিতে গাঁথা ছিল। পনঙ্কুকে জিজ্ঞেস করলে সে বলেছিল, বড়রা যখন কোনো দুষ্টুমি করে তখন এখানে এনে শুইয়ে দেয়া হয়। সেই থেকে এই শরশয্যা আমার কাছে এক আতঙ্ক। ঠিক করেছিলাম, এমন কোনো দুষ্টুমি নিশ্চয়ই বড় হয়ে করব না যাতে এখানে এসে শুয়ে পড়তে হয়।
From My Google Blog
                 সেই থানার গেটেই এক অচেনা গাছে সবুজ সবুজ বেশ টক দেখতে ফল ফলত। পনঙ্কু করত কি, আমাকে কাঁধে তুলে নিয়ে  বলত , পাড় । একদিন, মনে আছে, ঠিক ধরা পড়ে গেছিলাম। পুলিশ এসে বেশ গোঁফ ফুলিয়ে কোমরে হাত রেখে দাঁড়িয়ে ছিল। ব্যাটা আমাদের রাজত্বকে প্রত্যাহ্বান জানাচ্ছিল। পনঙ্কু  ভয় পেত না, নির্বিকার আমাকে বলে যাচ্ছিল, তুই পাড়তে থাক। আর নিজে কী সব কথা বলে বলে  সেই পুলিশকে বশ করত।  আমি তার মাথা মুণ্ডু ছাই কিছু বুঝতেই পারতাম না। সে বলত ওদের মাতৃভাষায়। বোধহয় বশ করত মন্ত্র পড়ে। 
               ও নির্ঘাৎ প্রেম করত। বিয়ে থা করে নি। নইলে একদিন ...সেই যে  বাবার অফিসের পশ্চিমে পুলিশ ফাঁড়ির পাশ দিয়ে এক চিলতে পথটা চড়াই উৎরাই পার করে চলে গেছে এঁকে বেঁকে তেপান্তরের মাঠ পেরিয়ে কাজলা দীঘির ঘাট ছাড়িয়ে সেই লুকোনো আরণ্যক ঝরণাতে  একদিন আমাকে নিয়ে গেল কেন? ওখানে  দল বেঁধে মেয়েরা ঝরণার নিচে কেলি করছিল।  আমি ততক্ষণে ওর কাঁধে। ও বেরসিক ওভাবেই ওদের সঙ্গে আলাপ জমাচ্ছিল আর  আমি হাঁ করে দেখছিলাম ! ওভাবেও লোকে স্নান করে বুঝি ! স্নান লোকে করে  ঐ এক চিলতে  কালো অন্ধকার ঘরে , যেমনটি  আমরা  করে থাকি ।   ওদের দু’একজন আমাকে নিয়েও টানা টানি করেনি যে তা নয়, কিন্তু আমাদের তখন কড়া নিয়ম ছিল যেখানেই যাই তার দাগ রাখা যাবে না। জলে নামলেও নামতে পারি, কিন্তু চুল ভেজানো না ।
                সেই রাজপাট ছেড়ে আমি চলে এসছিলাম ৭২এর শরতে। শারদীয় দুর্গাপুজোর দিনকতক আগে। এসছিলাম করিমগঞ্জে মামার বাড়ি। সেবারেই আমার প্রথম পুজো দেখা। শিউলি ফুলে... থুড়ি...কচুরিপানার ফুলে ফুলে দোলে বেড়ানো। ভেসে কাটানো।   কিন্তু আমি কি জানতাম যে সে রাজ আর রাজত্ব, সেই বৃন্দাবন আর নিশ্চিন্দিপুর আমি পেছনে ফেলে এসছি চিরদিনের মতো? পনঙ্কু , প্রায়ই দেখতাম, মাকে মেঘের দিকে হাত তুলে দেখাতো আর বলত কোন মেঘে ওর কার বাড়ি।  মাও আমার হার মানতেন না।  তিনিও রোজ একটা দক্ষিণের মেঘের দিকে তাকিয়ে দেখাতেন সেই পাহাড়ের ওদিকটাতেই তাঁর মায়ের বাড়ি । সে দেশের নাম পাকিস্তান । পরে জেনেছি, মায়েদের বাড়ি ছিল বটে পাকিস্তানে।  কিন্তু তখনকার নতুন বাড়িটি আর  সে পাকিস্তান নেই। পাকিস্তানের সীমান্ত পেরিয়ে সে তখন ভারত বর্ষের এপ্রান্ত।  সম্ভবত তাই তিনি তখনো তার দেশবাড়ির নাম বললেই বলতেন পাকিস্তান। আমি জানতাম সামাতুরের বাইরে আছে আরেক  রূপ কথার দেশ। সে দেশের নাম পাকিস্তান। আর ওখানে একজনই মহিলা থাকেন । তিনি আমাদের মায়ের  মা, দিদিমা। আমি চলে এসছিলাম সেই আশ্চর্য ভদ্রমহিলাকে দেখে যাব বলে।
From My Google Blog
                   কে জানত সেই ভদ্রমহিলা মন্ত্র জানেন? না ঠিক , তিনি ধরে রাখেন নি। কিন্তু রাখলেও রাখতে পারতেন। হয়েছিল এই, আমাকে স্কুলে ভিড়িয়ে দেবেন বলে বাবা সবাইকে নিয়ে এসে আমাদের শিলচরে ভাড়া করা বাড়িতে কাকাদের সঙ্গে রেখে নিজে ফিরে গেছিলেন একা। দু’বছর পর আমার বড় কাকার বিয়ে হলো, বাবা এসে মা আর ছোট ভাইবোনদের নিয়ে গেলেন। আমাকে রেখে গেলেন একা, নির্বাসনে।  লেখাপড়ার শাস্তি বরাদ্দ করে।
                   তারপর ওরা আসতেন প্রতি দুবছরে একবার মাসখানিকের জন্যে। সেদিনগুলোতে ছিল আমার মুক্তির দিন, ছুটির দিন, দিন উৎসবের। কিন্তু সেবার হঠাৎই বাবা একা এলেন।  প্রথমমানের ( এখনকার তৃতীয় শ্রেণি) পাঠশালাতে যে ছেলেকে নাম লিখিয়ে দিয়েছিলেন ঢুকিয়ে   সেই আমি তখন সবে ক্লাস এইটের ষান্মাসিক দিয়েছি। বাবা এলেন আমাকে নিয়ে যেতে। এক মাস পুজোর ছুটি। সেই ছুটিতে আমি যাব সেই নিশ্চিন্দিপুরে। আমি কি পারি স্বর্গে পা না বাড়িয়ে?
From My Google Blog
সেই স্বর্গে পনঙ্কু ছিল না। বাবা ততদিনে বদলি হয়ে গেছেন কিফ্রিতে। এখন নাগাল্যান্ডের মায়ান্মার সীমান্তে এক স্বতন্ত্র  জেলা শহর । সামাতুর থেকে বড়, দীর্ঘ আরো অপূর্ব এক  শৈল শহর। কিন্তু , তখন তুয়েনসাঙের,  মনে হয় ছিল, এক  মহকুমা শহর। ওই তুয়েনসাং নামটা জুড়ে ছিল বলে মনের কোনে একটা আশা জেগেই ছিল পনঙ্কু কি আসবে না ,আমি এসছি জেনে? সে কি সত্যি ভুলে গেছে আমাকে ?  কৈ, আমিতো তাঁকে ভুলিনি একটি দিনের জন্যেও। আমার চোখতো এখনো শরতের তুলো তুলে মেঘে খুঁজে  বেড়ায় আমার সেই প্রথম প্রেম, প্রথম বন্ধু পনঙ্কুকে। আমিতো আর ছিলাম না ‘কাবুলিওয়ালা’ মিনি । আমি সুশান্ত।
From My Google Blog
                   অনেক অনেক দিন পর আবার চড়লাম পাহাড় লাইনের রেলে। মামার বাড়ি যেতে আসতে মাঝে বদরপুর ঘাটে বরাকনদীর উপর যে রেল সেতুটা পেরিয়ে যেত মাথার উপর দিয়ে সেই সেতু পার করে রেল চলে যায় পাহাড়ে। কত কত দিন এ পথ দিয়ে যেতে আসতে দিন গুনেছি কবে আসবে সেই দিন আবারো যেদিন আমি ওই সেতুর নিচে দিয়ে নয়, যাব উপর দিয়ে । নদী পেরিয়ে। আজ সেই দিন আবার এলো। সে আজ বহু বহু দিন আগের কথা। তেত্রিশটি শরৎ আগের কথা। সন   ১৯৭৮এর গল্প।
From My Google Blog
                                                                    (২)
                  লামডিঙে ট্রেন পালটে পরদিন ভোরের অল্প আগে ডিমাপুরে পৌঁছুলাম। এলাম, আর একটা গাড়ি চেপে কিফ্রি রওয়ানা দিলাম ---ব্যাপারটা ওরকম ছিল না মোটেও। সেখানে একটা  হোটেলে উঠতে হলো। ভেতরে যাবার ইনার লাইন পারমিট এই শহরেই মেলে। সেটি আগে যোগাড় যন্ত্র করতে হয়। মনে হয় না, বাবার সে সমস্যা ছিল। তাঁর স্থায়ী অনুমতিপত্র ছিল। কিন্তু কথা হলো পরের গাড়ি পেলে তবেতো? এখানে বসে থাকতে হবে, বাজারের জিনিসপত্র নিয়ে যদি কোনো ট্রাক কিফ্রি যায় আর সামনের ওই তিনচারটে আসন খালি থাকে তবে তাতে চড়া যাবে। নাগাপাহাড়ের পথে পথে তখন আজকের মতো না বাস ছিল, না টেক্সি। তাই কিফ্রি থেকে সাধারণত লোক তখনই বাইরে যেত যখন ওরকম গাড়িঘোড়ার সংখ্যা বেড়ে যেত। পুজোর সময় সেরকম গাড়ির সংখ্যা সঙ্গত কারণেই বেড়ে যেত। প্রথমদিন বাবা গোটা দিন ঘুরে কোনো ব্যবস্থা করতে পারেন নি। বিকেলে আমরা এমনি এমনি এখানে ওখানে ঘুরে বেড়ালাম। প্রথমবারের মতো ডিমাপুর শহরটা ঘুরে দেখলাম। শিলচরের মতোই বড়ো শহর,  লোকে বলে নাগাল্যান্ডের অর্থনৈতিক রাজধানী। সে রাজ্যের  একমাত্র সমতল শহর। আমাকে একা রেখেই সকালে বাবা বেরুতেন গাড়ির খোঁজে, পরদিন দুপুরে এসে জানালেন তার পরদিন বিকেলে একটা গাড়ি যাবে বাজারের কিছু জিনিসপত্র নিয়ে।  সঙ্গে যাবে কিফ্রির একমাত্র পুজোর প্রতিমা।
From My Google Blog
                       প্রতিমা আমাদের সঙ্গে যাবে শুনে আমার এখনো মনে আছে, প্রতিক্রিয়া হয়েছিল দু’রকম। মনে হচ্ছিল আমাদের উপরেই বোধহয় দায়িত্ব পড়ল সেই প্রতিমা নিয়ে যাবার। এভাবে সেই পুজোর সঙ্গে আমি জড়িয়ে গেলাম। আবারো মন খারাপ হয়ে গেল। কেননা শিলচরে আমাদের পাশের বাড়িতে ঘটা করে পুজো হতো। বাড়ির  পুজো, কিন্তু তাতে পাড়ার সবার অবারিত দ্বার ছিল। সে পুজোতে মুর্তি আমাদের চোখের সামনে তৈরি হতো। শ্রাবণ মাসে শিল্পী এসে কাঠামো তৈরি করে মাটির প্রথম পোঁচটা দিয়ে চলে যেতেন করিমগঞ্জে। যেখানে তাঁর বাড়ি। শিলচরের আগে করিমগঞ্জের পুজো আর শিল্পীদের কদর ছিল বেশি। দিন কতক পর সম্ভবত পুরো ভাদ্র পার করে এসে তিনি সেই কাঠামোতে আরেকপোচ মাটি চড়াতেন, সাদা কাপড়ে মোড়তেন, তার উপর আবারো মাটি।সেই মাটি শুকোলে সাদা রঙ। এমনি করে আমরা আমাদের চোখের সামনে দুর্গার হয়ে উঠা দেখতাম। ফলে সেই প্রতিমা যখন বিসর্জনের জন্যে নিয়ে যাওয়া হতো, আমার মনে হতো সত্যি সত্যি দুর্গা না যাবার বায়না ধরেছেন। আর লোকগুলো জোর করে তাকে তুলে নিয়ে গিয়ে ট্রাকে তুলে দিচ্ছে।
From My Google Blog
                      কিফ্রির মূর্তি যখন আমাদের ট্রাকের পেছনে তোলা হলো, তখন মনে হলো ইনি একেবারেই ফেলনা। তাঁর কোনো কদর নেই। মূর্তি নিয়ে যেতে এসছিলেন রঞ্জিৎ কাকু। ট্রাকেই আলাপ। পরে পরে জেনেছিলাম ইনি হচ্ছেন সেখানকার সেই লোক যাকে নইলে কারো চলে না। মূর্তি আনো ...রঞ্জিৎ, পেন্ডেল সাজাও ...রঞ্জিৎ, হ্যাজাক জ্বালাও ... রঞ্জিৎ, কারো বাড়িতে জল আসছে না রঞ্জিৎ, কারো ঘরের চালে ফুটো রঞ্জিৎ, কারো বাড়ি বদল করা চাই রঞ্জিৎ... । ইনি সর্ব ঘটের কাঠালি কলা, ডাক পেলেই হলো, বৌদি...ই... বলে হাঁক পেড়ে গিয়ে হাজির। আগে এ বাড়ি ওবাড়ির সুখ দুঃখের খবর  জানাবেন, এক আধটু হাসির হুলোড় জমাবেন , দু’এককাপ চা চেয়ে খেয়ে নেবেন। তারপর জিজ্ঞেস করবেন, ডেকেছিলে কেন, বল?
                          গোটা পথে দেখছিলাম ট্রাক চালাচ্ছিল ড্রাইভার, কিন্তু সেই ড্রাইভারকে চালাচ্ছিলেন রঞ্জিৎ কাকু। আমাকে নিয়ে যখন বাবা পেছনে সিটে বসেছিলেন, রঞ্জিৎ কাকু টেনে নিয়েছিলেন সামনের একটিমাত্র সিটে যাতে আমি সেখান থেকে গোটা পথ দেখে দেখে যেতে পারি। পাহাড়ি পথে আমি পরে অজস্র বার  ঘুরে বেড়িয়েছি। পাহাড় অতিক্রম না করে আমরা শিলচরের লোকেরা  পৃথিবীর কোত্থাও যেতে পারি না। জোয়াই শিলঙের মতো সুন্দর পথ আমি পূর্বভারতে আর কোথাও দেখিনি, গ্যাংটক দার্জিলিঙেও না। কারণ শিলং রয়েছে মেঘালয়ের মালভূমির উপর। বাংলা ছায়াছবিগুলো এই পথের পাশে এসে সুটিং করলে সুইজারল্যান্ড যাবার ব্যয় বাঁচাতে পারত। এরা শিলং অব্দি এসছে অনেকবার কিন্তু তার দক্ষিণে যাবার সুবুদ্ধি আজো হয়েছে বলে দেখিনি। দেখলে দার্জিলিঙ নিয়ে বাঙালির অহঙ্কার সেই কবেই ফুরিয়ে যেত। রবীন্দ্রনাথ চিনেছিলেন এই শহরকে ।তাই তাঁর সবচে’ রোমান্টিক উপন্যাস ‘শেষের কবিতা’ লিখেছিলেন এই শহরকেই সম্মান জানাতে।
From My Google Blog
                              নাগাল্যাণ্ডের পথে পথে পাইন বন ছড়ানো থাকলেও সৌন্দর্যে সে   শিলঙের ধারে কাছেও যায় না। কিন্তু বিশাল উঁচু... যার সামনে আমার মেঘালয় কিম্বা উত্তরকাছাড়ের পাহাড়গুলোকে মনে হয় নিতান্তই ‘বাওনা’ । দূর দূর পাহাড়ের অন্ধকার  গায়ে গায়ে যেন এখানে ওখানে নক্ষত্রের মেলা বসেছে। রঞ্জিৎ কাকু , বলে যাচ্ছিল কোনটা কোন শহর। কোনটা দিয়ে আমরা যাব আর কোনটাকে আমরা এড়িয়ে যাব। ওই কাছ থেকে যে শহরটিকে দেখা যাচ্ছিল সেখানে আসতে যখন ট্রাকের কয়েক ঘন্টা লেগে যাচ্ছিল, আমার বিস্ময়ের সীমা ছিল না। দু’চোখের পাতা এক করা কষ্টকর হচ্ছিল।
From My Google Blog
                           মাঝরাতে ওরা ঠিক করলেন একজায়গাতে গাড়ি দাঁড় করিয়ে ঘুমোবেন। ঘুমোবেন মানে, ড্রাইভার আর ওর সঙ্গী চলে গেল ট্রাকের পেছনে। পথের উপরেই শুবে বলে। আমরা ভেতরে শুলাম  আয়েস করে তা কিন্তু নয়। হাত পা মেলে শোবার কোনো উপায় ছিলই না।  ব্যাপারটা আমার  মোটেও পোষালো না। এই আকস্মিক রসভঙ্গের জন্যে আমি মোটেও তৈরি ছিলাম না। আরেকটা কথাতো বলাই হয় নি, এই আরণ্যক পথের মাঝে শুয়ে পড়ে হাওয়া খাবার ঋতু সেটি মোটেও ছিল না। হাড়ে ততক্ষণে  একটু একটু করে ঘাস গজাতে শুরু করেছিল।
                        আমার এখনো মনে আছে, গাড়িটা আসছিল গদাই লস্করি চালে। সেটি ফেরার পথে নিজের অভিজ্ঞতার থেকেই বুঝতে পেরেছি। কিন্তু তখন আঁচ করছিলাম বাবা আর রঞ্জিৎ কাকুর উদ্বেগ দেখে। সেদিনি সন্ধ্যেতে মহাষষ্ঠী, আর আমরা দাঁড়িয়ে তখনো বহু বহু দূর। বাবা বলছিলেন, আর গাড়ি পেলে না? রঞ্জিৎ কাকু বলছিলেন পুজোর সময় এর চে’ ভালো উপায় ছিল না। আমার তাতে কিছু যাচ্ছিল না, আসছিল না। রাতের অন্ধকারেই যে পথের বেশিটা পার করিনি সেই আমার সৌভাগ্য। এই পথ আমি আগে দেখিও নি, আর দেখলেই বা কী? এই পথ আমার জন্মভূমির পথ। তাকে দেখবার মোহটাই যে আলাদা !   সকাল বেলা এক ছোট্ট শহরে এসে অনেক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল। যতদূর মনে পড়ছে সে শহরের নাম ফেক, এখন এক জেলা শহর। আমরা সেখানে হাত মুখ ধুয়ে চা খেয়ে রোদ পোহায়ে হাড়ের গজানো ঘাসগুলোকে ঘুম পাড়ালাম। বাঁদিকে যে পথটা উপরের দিকে উঠে গেছিল সে পথে কিচ্ছুটি দেখার উপায় ছিল না। বাবা বলছিলেন একেই বুঝি মেঘ বলে! আর কী আশ্চর্য ডানদিকে যে পথটা নিচে নেমে গেছিল সেই পথে আলো ঝলমল সূর্য নেমে এসছে। লাল নীল পরি, গন্ধর্বরা খেলে বেড়াচ্ছে। কেউ উঠে আসছে, কেউ মেনে গিয়ে পথের বাঁকে মিলিয়ে যাচ্ছে। আমি নিশ্চিৎ আজকাল ইন্টার নেটের ছবি ট্যাগ করবার যুগে সেই দৃশ্য  খুবই সাধারণ মনে হলেও আমাদের ছেলেবেলা সেই ছবি দেখিয়ে কাউকে উন্মনা করে দেবার জন্যে   যথেষ্ট ছিল ।
From My Google Blog
                  এক সময় মেঘের বুক চিরে আমাদের গাড়ি এগুতে শুরু করেছিল। এমন মেঘের বুক চিরে এগুবার উত্তেজনার রঙই আলাদা। আমার মনে আছে, এই মাত্র ক’বছর আগে সস্ত্রীক আরো কিছু আত্মীয় আত্মীয়ার সঙ্গে  সঙ্গে যখন চেরাপুঞ্জির পথে যাচ্ছিলাম আমরা একটা খেলা শুরু করেছিলাম। কেউ বলল, এই ই...ই...ই...ই...ই গেল! অন্য জন বলল, এই...ই...ই...ই এলো! যদি মেঘ মিলিয়ে না গেল, কিম্বা রোদ চলে  না এলো তবে যে কথাটা বলল সে গেল ...হেরে ।  এমন রৌদ্রমেঘের খেলা আমি তখন একাই উপভোগ করছিলাম। আমার সেই আনন্দে রঞ্জিৎ কাকু অল্প অল্প গা ভাসাচ্ছিলেন। বাবা আমার চাপা মানুষ, চুপ করে হাসছিলেন।
From My Google Blog
                  কিন্তু বেশিক্ষণ চলল না সে   খেলা। খানিক পরেই ঝলমলে রোদ আর পথের উৎকন্ঠা সবার ঘাম বের করে এনেছিল। মাঝে মাঝে একেকটা ঝরণা চোখে পড়লেই ইচ্ছে হচ্ছিল ঝাঁপিয়ে পড়ে শরীর শীতল করি। সেই সৌভাগ্যও যে হতেই পারে অতোটা আমি ভাবিই নি। দুপুরে গাড়ি এক ঝরনার কাছে দাঁড়িয়ে পড়লে দেখি সবাই কনডাক্টার গাড়ির ইঞ্জিনে জল দিল। ড্রাইভার আর রঞ্জিত কাকু প্রায় জন্মদিনের পোষাকে সেই ঝরনাতে জল হয়ে গেল। আমারও ইচ্ছে করছিল বটে, কিন্তু বাবা সেটা কিছুতেই হতে দেবেন না। যদি নতুন জলে এই পুজোর দিনগুলোতে জ্বর চড়ে তবে মায়ের কাছে বাবার নিস্তার ছিল না। কিন্তু, আমিও একটু চেপে ধরতেই হাঁটু অব্দি পা ভেজাবার অনুমতি পাওয়া গেছিল। একটু পরে দেখি বাবাও সে জলে পা ভেজাতে শুরু করেছেন।
                   সন্ধ্যে হতেই আমারো মনে হচ্ছিল, পথটা সত্যি বড় দীর্ঘ হয়ে গেছে। রাত প্রায় নটায় দ্বিতল বাড়ির নিচের তলার খোলা দরজা দিয়ে লণ্ঠনের যে আলোর রেখা পথ দেখাচ্ছিল এখনো মনে পড়লে সে রেখাগুলো  আমার চোখ এলোমেলো করে দেয়। মা! বলে ডাকতে আমার লজ্জা করছিল।  মিতু...উ...উ...উ...,আমার বোনের নাম ধরে জোরে ডাক দিতেই রাতের পাখিরা ডানা ঝাপটে এসে আমার গায়ে  পড়ল। ছোঁ মেরে নিয়ে ভেতরে চলে গেল। বাবা কোথায় পড়ে রইলেন আমি ফিরেও তাকাই নি।  
                                                              (৩)
                          পরদিন সেই ভোর  থেকেই দেখি আমাদের বাড়িতে দৌড় ঝাঁপের শেষ নেই। এক জন আসছেন তো আরজন যাচ্ছেন। তাদের কেউ কেউ আবার, “কৈ গো আপনার  বড় পোলা? আইছে বুলে?” জিজ্ঞেস করতে করতে বিছানা ঘরেও উঁকি দিচ্ছিলেন। না না, এমনটি ভাবার কোনো কারণ নেই আমি এক কেউ কেটা গেছি বলে  তারা সবাই আমাকে দেখতে আসছেন। আসলে আমাদের কোয়ার্টার বাড়িটা ছিল শহরের অনেকটা মাঝামাঝি।
From My Google Blog
                        এই রে, মাঝমাঝি বললে কী বোঝা যাবে? তার মানে এই নয় যে এখানেই সব বাজার হাট, অফিস আদালত, হাসপাতাল , পোস্ট আপিস। পুরো শহরটি প্রায় মাইল তিনেক লম্বা। যেপথে আমরা এসে শহরে ঢুকেছিলাম সেটি উপরে উঠে সোজা চলে গেছে তুয়েনসাং। সেখানেই এক জায়গায় ডানদিকে একটু উপরের দিকে  মোড় নিয়ে আবার পেছন দিকে সমান্তরালে আরেকটা পথ চলে এসছে শহরের প্রবেশ পথের সমান্তরালে উপরে। সেই পথ মাইল দু-এক গিয়ে মিলেছে কিফ্রির লয়লা স্কুলের মাঠে। সেই স্কুলে আমার ভাই বোনেরা পড়ত। ঐ উপরের পথের মাঝামাঝি আমাদের বাড়ি। সেই অর্থে আমাদের বাড়িটা শহরের মাঝামাঝি। সুতরাং স্কুলের দিকথেকে যারাই পুজোমন্ডপের দিকে এগুচ্ছিলেন তারা অতটা পথ একা এগুবার পথে সঙ্গী জোটাতে এসে আমাদের বাড়িতে হানা দিচ্ছিলেন।
From My Google Blog
                        নিচের সেই তুয়েনসাং পথের মোড়ের কাছেই পুজোর মন্ডপ। ওখানেই শহরের ছোট্ট বাজার হাট। এর থেকে উপরে চড়লে শহরটা আর বেশি দূর এগোয় নি। লোকজনের বসতবাড়ি মূলত আমাদের দিকটাতেই। অফিস আদালত সব গোটা শহরে পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে  এখানে ছড়ানো ছিটোনো। সব ক’টা পথের কাছে কাছেও নয়।
                       কিফ্রির বাজার হাট বললেও বিশেষ কিছু বোঝা যাবে না। সামাতুরে আমরা দেখতাম মাঝে মধ্যে হেলিকপটার এসে বাবাদের অফিসের উপরের মাঠের এক প্রান্তে ‘ড্রপিং’ করে যেত। সেগুলোই যে দু’একটা দোকান পাট ছিল ওদের পসারের জিনিস পত্তর । সে ‘ড্রপিং’ থেকেই আমাদের ঘরে চাল ডাল পাওয়া যেত। মানে দোকানির থেকে কেনা যেত।  শাক সবজি প্রায় সবাই বাড়িতে ফলাতো।  আমাদের বাড়ির সামনে এক বড় ফুলের বাগান যেমন ছিল, পেছনটার তেমনি ছিল সবজি খেত। নিজেদের গরু ছিল বেশ কিছু, ছাগলও ছিল। আর ছিল প্রচুর মুরগি।  পরে যখন শিলচরে এসে বাবা বাড়ি করেন, সেখানেও গরু ছাগল পোষতে না পারলেও আমরা বেশ কিছুদিন মুরগি পোষার চেষ্টা করেছিলাম। মাছ পাওয়া যেত না। একবার মনে আছে, বাবা তুয়েনসাং থেকে এক বড় তেলের টিনে প্যাক করা জ্যান্ত মাগুর মাছ কিনে নিয়ে গেছিলেন। সেই মাছ আমরা অনেকদিন ধরে খেয়েছিলাম। সে  এক  আশ্চর্য অভিজ্ঞতা ছিল। নইলে আমরাতো শুধু জানতাম ছোট টিনের কৌটার মাছ। যেগুলো ‘ড্রপিঙে’ আসত। এখনো, এই তিনসুকিয়াতে সার্ডিন’ মাছের  কৌটা পাওয়া যায় বলে আমি মাসের বাজারের এক কৌটো অবশ্যই নিয়ে আসি।
                   কিফ্রিতে সামাতুরের থেকে অবস্থা খানিকটা ভালো ছিল। এখানে ‘ড্রপিং’ নেই। সপ্তাহে দু’একটা গাড়ি আসত সব্জি মাছ ইত্যাদি নিয়ে। থামত আমাদের বাড়ির কাছেই উপরের রাস্তাতে। হয়তো অন্যত্রও অন্য গাড়ি থামত। আমি তত নিশ্চিত নই। লোকের জানাই থাকত কবে গাড়ি আসবে। কারণ, ওটাইতো নিত্যদিনের ব্রেকিং নিউজ ---থুড়ি বিশেষ বিশেষ খবর ছিল। ব্যস , মুহূর্তে ওইখানেই সব ছু! মন্তর!
তবু স্কোয়াস, লঙ্কা, গাজর,  ফুল কপি, বাঁধা কপির গাছ লাগাবার স্বভাবটা কেউ ছাড়েনি। বিপদতো লেগেই থাকত। ফুলের গাছে বাড়ির চারপাশটা  অবশ্যই সাজাতো সবাই। শখে নয় ততটা। যতটা বাড়ির ঠাকুর দেবার  দরকারে । শখের গাছ ছিল ডালিয়া। আরো দু’একটা পাহাড়ি ফুল ছিল। সেগুলোর নাম আজ আর আমি মনে করতে পারি না।  ডালিয়া পারি, এর থেকে সহজে চোখ ফেরানো মুস্কিল।  কত বিচিত্র রঙ আর কত বিচিত্র বাহার।    
                                 যেভাবে লোক আসছিল, আমাদের সঙ্গে নিয়ে পুজো দেখতে যাবে বলে তাতে এ ক’দিনের টানা যাত্রার ধকলের পরেও বেশিক্ষণ শুয়ে থাকা মুস্কিল ছিল । বুঝতে পারছিলাম এ শুধু পুজো দেখতে যাওয়া নয়, পুজো করতে যাওয়া। সবাই গেলে তবেই না ওখানকার কাজগুলো সব হয়ে উঠবে সময় মতো। ওদের কথা থেকেই বুঝতে পারছিলাম, এ আমার শিলচরের পাশের বাড়ির পুজো নয়। এ হলোগে এক্কেবারে নিজেদের বাড়ির  পুজো। এই যে পরের বাড়ির  থেকে নিজেদের পুজোতে অবস্থানের পাল্টে যাওয়া তার অনুভূতিটাই ছিল অন্যরকম। পাশের বাড়ির পুজোর প্রতিটি দিনের সঙ্গী থেকেও সেই ছেলেবেলাই আঁচ করাতাম কোথায় যেন কিসের একটা অভাব রয়েছে। দেবী আমাদের বন্ধুবান্ধবদের চোখের সামনেই হয়ে উঠতেন মানেতো তাঁকে আমরাই গড়ে তুলতাম। তারপরেও যেন তিনি আমাদের হয়ে উঠতেন না। পুজোর মূল আয়োজনে আমাদের ইচ্ছে অনিচ্ছের কোনো মূল্যই ছিল না। আর পুজোর দিন কয়টিতে সে বাড়ির আত্মীয়রা অন্য শহর বা গ্রাম থেকে এসে যেভাবে হম্বি-তম্বি শুরু করতেন সেটি ছিল একেবারেই অসহ্য আর অপমানকর। বোধকরি জমিদারবাড়িগুলোতে সেরকম  অপমানের জবাব দিতেই একসময় দুর্গা পুজোর গণতান্ত্রিকীকরণ হয়ে গেছিল। পুজো হয়ে গেছিল বারোয়ারি। ছোট্ট করে আর পরোক্ষে  হলেও আমি সেই সাংস্কৃতিক ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে গেছিলাম যেন। সুতরাং আমিতো সে পুজোতে যাবই । আরো আগেই যাব। ভাবখানা এই যেন... আমায়  নইলে... তোমার প্রেম হতো যে মিছে।
বোন ভাইয়েরাও বলে রেখেছে, সাত সকালে উঠতে হবে। পুজো মন্ডপে যেতে হবে। কিন্তু আমার  আরো কিছু কাজ ছিল। দেখবার ছিল যদি শহরটা সামাতুর হয়, যদি বেরিয়েই দেখি পনঙ্কু আমার জন্যে দাঁড়িয়ে আছে। আমিতো আর পুজো দেখতে আসিনি। সে কি আর কম দেখেছি! এসছি সামাতুরের জন্যে, পনঙ্কুর জন্যে। বাবাকে পথে পথে বলেও এসছি, আমাকে সামাতুর নিয়ে যেতে হবে। বাবা  বলেছিলেন, ‘হবে। যদি গাড়ি পাওয়া যায়।‘ কিন্তু তাঁর মুখ থেকেই শুনেছি সামাতুরের অনেকেই এখন এখানে এই কিফ্রিতে আছেন। আর পনঙ্কু, সাকিবারাও মাঝে মাঝেই এখানে এসে থাকে। সে তথ্য বাবা কিছু না ভেবেই দিয়েছিলেন। আমি জিজ্ঞেস করিনি। কিন্তু দিয়ে আমার উৎসাহ বাড়িয়ে দিয়েছিলেন।
                            যেমন নতুন প্রেমিকেরা সব মেয়েতে তার প্রেমিকার মুখ খুঁজে ফেরে পথে নেমেই আমি নাগা পুরুষ দেখলেই তার চেহারাটাকে মেলাবার চেষ্টা করতে শুরু করলাম পনঙ্কুর সাথে। স্নান সকালের দুধ রুটি মুখে দিতেই মা নতুন জামা বের করে দিলেন। সার্টটা তিনিই নিজেই বহু বহুদিন পর আমার গায়ে চাপিয়ে দিলেন। সেটি গায়ে মানিয়েছে কি না অনেক ক্ষন ধরে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখলেন। না জানি, কত দিন ধরে এই মুহূর্তটির জন্যে তিনি সময় গুনছিলেন। বাড়িতে আসা একদল নারী পুরুষ আর আমাদেরই বয়সের তাদের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে আমি আর বোন মিতু সেই সকালে মন্ডপের পথে পা বাড়ালাম। মা-বাবা ছোট ভাইটিকে নিয়ে আসবেন পরে। মূল পথটা ছেড়ে একটা ফাঁড়ি পথে চড়াই উৎরাই ভেঙ্গে   আমাদের দলটি মন্ডপের দিকে এগুচ্ছিল আর বোন আমার গাইডের কাজ সামাল দিচ্ছিল। সে শুধু পথ দেখাচ্ছিল না। আমাকে পথের পরে প্রতিটা ঘর, অফিস, গাছ, পাখি, পারলে পতঙ্গের সঙ্গেও আলাপ করিয়ে করিয়ে নিয়ে তবে পথ হাঁটছিল। এমনকি কোথায় পা ফেলতে হবে কোথায় নয় সেই নির্দেশও দিতে দিতে এগুচ্ছিল। পাছে, তার সমতলের অনভিজ্ঞ ভাইটি পা পিছলে খাদে পড়ে যায়!    
                                 একটাই পুজো পুরো শহরে।  করেন মুলত বাঙালিরা হিন্দুরা। কিন্তু এ  ছাড়াও ছিলেন কিছু অসমিয়া, বিহারি, নেপালি মানুষ। তারা সব্বাই নাগাল্যান্ডের বাইরের লোক, বাঙালিদের বেশিরভাগই অসমের অবিভক্ত কাছাড় জেলার লোক। তারা ওখানে আছেন আমাদের পরিবারটিরই মতো সরকারি চাকরি করেন বলে, ছোটখাটো ব্যবসা করেন বলে কিম্বা করেন হাতের কাজ ।  বছরের ঐ একটা সময় ওরা বাড়ি না যেতে পারার দুঃখ ভুলেন ঐ পুজোতে। সেই সকালে সবাই গিয়ে জড়ো হবে। নিজেরাই হাত লাগিয়ে এটা ওটা সম্পন্ন করবে। হাসবে, মস্করা করবে, পরনিন্দা পরচর্চা করবে। আবার সময় হলে, ‘বাদলটা প্রসাদ না নিয়ে কোথায় চলে গেল, বলতো!’, ‘নবীন এটা কী করল , ওর বৌকে না নিয়ে চলে এলো!’, ‘ এই দাস বৌদিকে দিয়ে যদি একটা কাজও ভালো করে হয়!’ বলে কিফ্রিতুতো দিদি, বৌদিরা অনুযোগের ঝড়ও ছোটাবেন। ভট্টাচার্য জেঠু হয়তো, ততক্ষণে গর্জন করে গোটা মণ্ডপ মাথায় তুলে বলবেন, “রায়কে আমি বললাম ওর অফিস থেকে এক দশটা টিন জোগাড় করে দিতে, না বাবু পারবেন না! বাবুর মান খসে যাবে অফিসারকে বলতে! বেটা আসবিতো দুপুর বেলা । তোর ঠ্যাঙ ভেঙ্গে দেব। ” আর বেশিদূর যাব কেন, আমার মাকেই দেখলাম কতমানুষকে তেমন শাসন করছেন। উনি শাসন করতে চিরদিনই ভালো বাসেন। তাঁকে নইলে কারো চলছিল না, কিন্তু তাঁর নিন্দুকের সংখ্যাও কম ছিল না। সে নিন্দুকের দলে যে মাঝে মধ্যে আমিও ভিড়ে যাই নি তাও সত্য নয়। দিনের দুবেলা সবার খাবার পাত পড়ত মণ্ডপে। যদিও অনেকেই বাড়িতে খেয়ে দেয়েও আসত। দুপুর গড়ালে কেউ কেউ খানিকক্ষণের জন্যে বাড়ি গেলেও সন্ধ্যে হবার আগেই আবার ভিড় বেড়ে উঠত। চারদিকে গোল করে চেয়ারে বসে আড্ড জমাতো যে যার মতো। এক কোনে হয়ত দেখা গেল কেউ গেয়ে উঠছেন আগমনির গান, কেউ শ্যামা সঙ্গীত, কেউ বাউল গান তো, কেউ সরাসরি হেমন্ত মান্না দে কিম্বা কিশোর কুমার । কারো গলা বাঁকা তো কারো বা ভাঙ্গা। কিন্তু তাতে কারো রসগ্রহণে কোনো অসুবিধে হচ্ছিল না। অন্য কোনে তখন কেউ কৌতুক শুনিয়ে আড্ডা জমিয়ে রেখেছেন।  আমি তখন খুব ভালো বাথরুম সিঙ্গার ছিলাম। রেডিওতে যে গান শুনতাম তাই পথে ঘাটে গুনগুনিয়ে গায়ক হবার স্বপ্নে দিন কাটাতাম। সে গানগুলোর বেশির ভাগই ছিল শিলচর কিম্বা ঢাকা সিলেটের রেডিও স্টেশনের সম্প্রচারিত বাঙলা আধুনিক কিম্বা ছায়াছবির গান। হিন্দি গান যে শুনতামনা তা নয়, কিন্তু সেকালে আমার এক ভ্রান্ত বোধ গড়ে উঠেছিল যে হিন্দি গান করে বাজে ছেলেরা। রকে বসে আড্ডা দেয়াই যাদের জীবনের লক্ষ্য। আমার কাকিমা রোজ সকালে শ্যামা সঙ্গীত গেয়ে গেয়ে পুজো দিতেন আর আমাদের ঘুম ভাঙাতেন। আমি সেগুলোর অনেকটাই শিখে ফেলেছিলাম।  সেগুলো গেয়ে আমিও আসর জমিয়ে দিয়েছিলাম, বললে আমার আজকালকার অনেক বন্ধু বিশ্বাসই করবে না।  আজো আমি প্রাণ ভরে গান শুনি , সেকালের গানগুলো আমার এখনো এতো প্রিয় যে তার প্রায় সবকিছুই আমার সংগ্রহে রয়েছে। কিন্তু যেগুলো সম্ভবত ভারতে খুব কম লোকের সংগ্রহে রয়েছে সে হলো, বাংলাদেশের সাবিনা ইয়াসমিন, সুবীর নন্দী, এন্ড্রো কিশোর, ফিরদৌসী রহমানদের গান। আজ সিডি ইন্টারনেটের যুগে আমার সেই পুরোনো প্রেমকে যে আবারো এভাবে এতো করে কাছে পেয়ে যাব বহুদিন তা স্বপ্নেও ভাবিনি। সাবিনা আমার সবচে’ প্রিয় শিল্পীদের একজন । লতা মুঙ্গেসকরও আমাকে ততো মুগ্ধ করতে পারে না। কিন্তু কলেজ জীবনে যখন স্পষ্ট হয়ে গেল যে আমার দ্বারা  গায়ক হবার কোনো সম্ভাবনা নেই আমি যে গুনগুন করা ছেড়েছি, তাই নয়, এখন আর আমি কোনো গানের একটি কলিও মনে রাখতে পারি না। এ এক অদ্ভূত মানসিক অবস্থান। শুধুই মনে হয় কী হবে মনে রেখে? অথচ এই লেখা যখন তৈরি করছি তখনো আমার কম্প্যুটারে বাজছেন সুবীর নন্দী। গান না শুনে আমি কোন দিন কোনো লেখা পড়ার কাজ করতেই পারিনি।
                             দশমীর বিকেলে দুর্গা আবারো ট্রাকে চড়লেন। পেছনে গোটা শহরের যত জীপ রয়েছে, সংখ্যাটা আমার মনে আছে আঠারোটা, সেগুলোর এক দীর্ঘ লাইন। গোটা শহর তাতে চড়ে বসেছে। বিকেলের  আকাশ লাল হয়ে আসতেই সূর্যের সঙ্গে করে সমতলের কোলাহল থেকে বহু বহু দূরে একা এক কিফ্রি শহরের দুর্গার  শুরু হলো  দীর্ঘ বিদায় যাত্রা। কাছে পিঠে কোনো নদী ছিল না। অথবা কাছেই ছিল, কিন্তু এতো বিশাল উঁচু পাহাড়ের নিচে নামাটাইতো ঘন্টা কয়েকের যাত্রা। শরতের শুক্লা পক্ষ। এখানে ওখানে তুলো তুলো মেঘে সাজানো স্পষ্ট আকাশ । গোটা পাহাড় একসময়  জ্যোৎস্নাতে ঝলমল করে উঠল। সে রাতের জ্যোৎস্নার রঙ সম্ভবত কোনদিনই ভোলা যাবে না। কারণ ওমন বিসর্জনের যাত্রার অভিজ্ঞতাও আর কোনো দিন হয়ে উঠবে না।
                              ঝিঁঝিঁ পোকার সাম্রাজ্যে সেদিন হানা দিয়েছিল সেই গান , “ মারে ভাসাইয়া জলে কী ধন লইয়া যাইমু ঘরে...।” পরে জেনেছি, সে আমাদের সিলেট-কাছাড় অঞ্চলের এক জনপ্রিয় লোক গান। কিন্তু শিলরেতো সেটি শুনিনি কখনো। ওখানেতো চলে বিসর্জনের মহামিছিলে চলে ‘দম মারো দম... হরে কৃষ্ণ হরে রাম...” এখন সম্ভবত বাংলাব্যান্ড ‘দোহারে’র শিল্পীরা বিশ্বময় ঐ গানটিকে ছড়িয়ে দিয়েছে। বছর কয় আগে যখন কালিকারা  তখনো তেমন নাম করেনি, টিভিতে দেখছিলাম ওরা ঐ গানটি কলকাতার কোনো বিসর্জনের ঘাটে বসে গাইছিল।  কিফ্রির মানুষগুলো যখন গাইছিল , “ মারে ভাসাইয়া জলে...।”  তখন কি আর ওরা শুধু দুর্গার কথা মনে রেখেই গাইছিল? দেশের বাড়িতে পড়ে থাকা বৃদ্ধা মায়েদের কথা, বাবাদের কথা --- সেই ভাইয়েদের কথা , বোনেদের কথা ভেবে কি তাদের চোখ থেকে দু’এক ফোটা জল গড়িয়ে পড়েনি যাদের তারা মুখ দেখেন নি বহু বহু দিন। যাদের জন্য হয়তো এবারেও পুজোতে দুটো জামা কেনবার পয়সা পাঠাতে পারে নি, আর পারলেও তারা যে সময় মতো সেটি হাতে পেয়েছেন তার কোনো নিশ্চিতি নেই। আমি জানি, এরা সব্বাই বাড়িতে খাম, পোস্ট কার্ড কিনে এনে রেখেছেন। আর বিসর্জনের ঘাট থেকে ফিরেই রাতে নতুবা পরদিন সকালে সব্বাই বসে যাবেন আলাদা আলাদা করে বাড়িতে চিঠি লিখতে।  সেদিন দুপুরে পোস্টাপিসে সব্বাই আবার মুখোমুখী হবেন, বাড়িতে চিঠি পাঠাতে। “কত চিঠি লেখে লোকে-কত সুখে, প্রেমে, আবেগে, স্মৃতিতে, কত দুঃখে ও শোকে।” প্রতিবার পুজোর পর আমি নিজেও যে নিজের চিঠিটা পোস্ট করবার পর থেকেই দিন গুনে থাকি  কবে আসবে এক গুচ্ছ চিঠি।  শুধু আমারই জন্যে। এবারেই শুধু তার ব্যতিক্রম হবে।
                 আঠারোটা গাড়ি যখন এক সঙ্গে পথ চলে তখন একটানা চলে না কখনো, এখানে ওখানে থামতে থামতে হৈহোল্লোড় করতে করতে দু’ঘন্টার পথ পাঁচ ঘন্টায় পার করে  দশমীর চাঁদ যখন ওনেকটাই মাথার উপরে উঠে এসছে তখন গাড়ি এসে থামল এক পাহাড়ি সেতুর পার করে।  গাড়ি থেকে যখন নেমে সবাই জড়ো হলাম তখনকারমতো কোনো অভিজ্ঞাতকে মনে রেখেই কি রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, “আজ জ্যোৎস্নারাতে সবাই গেছে বনে
                               বসন্তের এই মাতাল সমীরণে” যে ভদ্রমহিলাটি , “আমার এ ঘর বহু যতন করে /ধুতে হবে মুছতে হবে মোরে/আমারে যে জাগতে হবে/কি জানি সে আসবে কবে...” এই বলে বনে গেল না তার মাথায় ছিট ছিল। বনে যারা গেছিল তারা  মাতাল ছিল বটে, কিন্তু ততোটা নয় যতটা হলে মেয়েদের আর বাচ্চাদেরো পাহাড়ের খাদ বেয়ে নিচে জলের কাছে নামতে দিতে পারে। সুতরাং আমরা রইলাম উপরে । বড়দের কেউ কেউ আমাদের সঙ্গ দিলেন। বাকিরা একচালা মূর্তি নিয়ে মুহূর্তে পাহাড়ের গায়ে মিলিয়ে গেলেন। আমরা শুধু শুনতে পারছিলাম দূর থেকে ‘দুর্গা মাইকি জয়!”  কোথায় গেলেন , কী করলেন কিচ্ছু দেখা যাচ্ছিল না। আমরা তখন শরতের এই জ্যোৎস্না মাখা সমীরণে মাতাল ছিলাম। যদিও নাচছিলাম সেই গানের তালে  , মাকে ভাসাইয়া জলে কী ধন লইয়া যাইমু ঘরে...।
                                                            (৪)
                                  পুজোর ক’দিনে আর দশমীর পর এবাড়ি ওবাড়ি যেতে আসতে কিফ্রি শহরের অনেকটাই আমার জানা হয়ে গেছিল। চেনা হয়ে গেছিল যাদের চেনা যেতে পারত। যারা আমাদের পরিবারের সঙ্গে কোনো না কোনো সম্পর্কে বাঁধা। দিনে দুপুরে কখনো একা কখনো ভাই বোনদের নিয়ে এবাড়ি ওবাড়ি যেতে আসতে কোনো বাধা ছিল না , তা যত দূরেই হোক। একেতো পথে গাড়িঘোড়া বিশেষ নেই, তার উপর পাহাড়ে এক আধটু শীত পড়লে যা হয় রোদের সস্নেহ ছোঁয়াতে গোটা দিন ঘুরে বেড়ানো যেতে পারে। লক্ষ্মী পুজোর দুপুরে মা আমাকে পাঠালেন ধরকাকুদের বাড়িতে। সম্ভবত পুজোর জন্যে দরকারি কিছু জিনিস দিয়ে আসতে এবং বিনিময়ে অন্য কিছু নিয়েও আসতে।  কী, সেটি মনে নেই। লক্ষ্মীপুজো যদিও যার যার বাড়িতে হবে তবু যেমন তখন দেশের বাড়িতে হতো এখানেও হৈ হোল্লোড়ের কোনো খামতি দেখিনি। বরং যারা  অবিবাহিত ছিলেন তাদের কারো বা কারো বাড়িতে ছিল বিশেষ নিমন্ত্রণ। যেমন রঞ্জিত কাকু। দিনে একবার এমনিতেই আসেন। লক্ষ্মীপুজোর সকালে দেখলাম তিনিই এসে এটি নিশ্চিত করে গেলেন যে আমাদের বাড়িতেই রাতে খিচুড়ি তৈরি হবে আর অর্ধেক কিফ্রি সেটি খেতে আসবে। কে কে আসবে, সে তালিকাও তিনি তৈরি করে গেলেন বাড়ি বাড়ি খবর দিতে। বিকেলে তিনিই এসে কোমরে গামছা বাঁধবেন, কথা রইল। এতে মানা করবার সাধ্যি কারো নেই, ইচ্ছেও নেই। কেননা তাতেই তো এই ঘরে দুটো লোক জোটাবার বাহানা পাওয়া যাবে। আর সেবারে  আমার উপস্থিতি ছিল এক বাড়তি বাহানা।  
                                     বাবা এখানে যে কোয়ার্টারে ছিলেন, সেটি ছিল দ্বিতল। এখানে স্টেট বেঙ্কের কর্মীরা বাবাকে নিয়ে তিনজনের পরিবার থাকতো। বাড়ির মালিক নাগা মানুষ। নাগাদের কোন শাখার মনে নেই, সুমি, সাংতাম কিম্বা ইয়েমচুঙের কোনো একটা হবেন। কেননা কিফ্রিতে ওদের উপস্থিতিই বেশি ছিল।  যদিও অনেকেই তখন পাকা ‘আসাম টাইপ’ ঘরে বাস করছিলেন ওরা উঠোনের শেষ প্রান্তে নাগা কায়দায় তৈরি কাঠ-বাঁশের মাচার মতো ঘরে বাস করতেই ভালো বাসতেন । সেটি ওদের জীবনধারার সঙ্গে সঙ্গতি পূর্ণ ছিল।  বাইরে থেকে দেখলে বোঝবার উপায়ই ছিল না যে ওরাই বাড়ির মালিক। সামাতুরে আমাদের বাড়িতে  নাগা মানুষের নিত্য আনাগোনা ছিল।  বাবা সেখানে খণ্ড উন্নয়ন অফিসে ( ভিডিও)  প্রথমে কাজ করতেন। বোধহয় তাই। এখানে সেরকম বালাই নেই। যা কিছু কাজ তা অফিসেই হতো। বাড়িতে অকাজের ভ্রমণ না হলে কেউ বিশেষ আসত না। এই বাড়ির মালিক ভদ্রলোককেও কখনো আমাদের ঘরে এসে দু’দন্ড বসে আড্ডা দিয়ে যেতে  দেখিনি। তারা নিজেদের নিয়েই ব্যস্ত থাকতেন। পুজো চলে গেলেই শুধু ওদের সঙ্গে আমার আলাপ করিয়ে দেবার সুযোগ পেয়েছিলেন মা।
                                      ওদিকে পাশের ঘরে তখন কেউ ছিলনা। গোটা উপর তলাটা জুড়ে থাকতেন বেঙ্কের ম্যানেজার। একা এক মারাঠি ভদ্রলোক । আর বাড়ি থাকলেই কীসব পুজো পাঠ নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন। কিন্তু তার, এক ভৃত্য ছিল বিহারি মুসলমান। সে একাই বাড়িটার তাপ বাড়িয়ে   রাখত। নিচের তলাতে আমাদের দু’ঘরের রান্নাঘর ছিল পাশাপাশি। সুতরাং সেই ভৃত্যের সঙ্গে আমাদের দেখা দেখি হতো  রান্নাঘরের দাওয়াতেই বেশি। লক্ষ্মীপুজোর দিন তারও মনিবের ঘরে ছুটি। সে যোগ দিল আমাদের ঘরেরই কিছু খুচরো কাজে। সে খুব জোরে রেডিও বাজাতো। সেই রেডিও শুনলেই মনে হতো, আমরা এখনো পৃথিবী ছেড়ে অন্য কোনো গ্রহে পা দিইনি। তা নইলে, কাক পক্ষীর ডাক শুনবার জন্যেও কখনো হৃদয় কাঁদতে শুরু করত। শোনা যেত শুধু দূর পাহাড় থেকে ছুটে আসা বাতাসের ডাক। 
মা আমাকে একাই পাঠালেন ধরকাকুদের বাড়ি। ওরা আমার পূর্ব পরিচিতও ছিলেন।
From My Google Blog
              একবার সামাতুর গেছিলেন ওরা স্বামী স্ত্রী।  দু’রাত্তির থেকেছিলেন আমাদের বাড়ি ।তখন ওদের নতুন বিয়ে, এখন তিন সন্তানের মা-বাবা। বাবা কিফ্রি থেকে চলে আসবার অনেক দিন পরে অব্দি ওরা ওখানে ছিলেন। দীর্ঘদিন চিঠিপত্রে যোগাযোগ ছিল। লিখতেন মূলত কাকু, আমাদের মাকে।  ওরা কলকাতার কাছে বাড়ি করছেন জানতাম, বড় ছেলেটিকে সেখানে কোথাও পড়তে পাঠিয়েছিলেন। তার পর আজ বহুদিন আর কোনো যোগাযোগ নেই। 
                                একা পথ হাঁটতে একটু ভয় যে করছিল না তা নয়, কিন্তু সাবালক হবার এমন স্বীকৃতি উপভোগ করতে কারই বা ইচ্ছে না জাগে। একা একা উপরের পথে চড়তে শুরু করলাম। সারামাটি পাহাড়টা দেখতে দেখতে হিসেব করছিলাম ওখানে যেতে কোন পথে কতদূরই বা যেতে হবে। বোন সঙ্গে নেই, সুতরাং শাসন করবার কেউ ছিল না। আমি তারিয়ে তারিয়ে পথের প্রতিটি ছবি চেখে চেখে এগুচ্ছিলাম। তখন একটু আধটু মেয়ে দেখার অভ্যেসও গড়ে উঠছিল না বললে, ডাহা মিথ্যে বলা হবে। পথে যেতে যেতে লাল নীল চাদর গায়ে  ওমন কিছু নাগা মেয়েরাও আমার দিকে এক আধটু  দৃষ্টি ছুঁড়ে দেবার করুণা         করছিল । বুঝিবা, ভাবছিল এ কোন দেশের রাজকুমার !আমিও হাঁটছিলাম, যেন রাজত্বটা একটু দেখে নিতে এসছি। কখনো ডাইনে, কখনো বাঁয়ে।  কখনো হাঁটছি তো কখনো দাঁড়িয়ে আছি। কখনো সামনে তো কখনো পেছনে চোখ আমার ঘুরছে ফিরছে। কোন তাড়া নেই। ওবাড়িতে যাবার কীই বা আনন্দ, যতটা রয়েছে পথের পরে।
From My Google Blog
                             কিফ্রি সাগরপার থেকে প্রায় ২,৯৪০ ফুট উপরে। তার থেকেও প্রায় ৮,০০০ ফুট উপরে সারামাটি পর্বতমালা। সারামটির কাছে কিফ্রিকে দেখলে মনে হয় যেন মায়ের কোলে শিশু শুয়ে রয়েছে।   শীতে সারামাটিতে বরফ জমে, কিন্তু আমার সে দেখবার সৌভাগ্য হয় নি। পরে একদিন এক বৃষ্টির ভোরে বোন তুলে দিয়েছিল ঘুম থেকে। ওর ধারণা ঠান্ডা যখন পড়েছে, পাহাড়ে তবে বরফ দেখা দেবে। প্রবল উত্তেজনায় , কেউ টেরটি পায়নি, আমরা দুই ভাইবোন নাগা-চাদর গায়ে ছাতা হাতে  বেরিয়ে পথের উপর। এ বাড়ি ওবাড়ির মুরগিরাতো সেই মাঝ রাতেই জেগে হাঁক পাড়ে, আর যে পাখিরা ছিল তাদের তখন ঘুম ভেঙেছে মাত্র ।  আর সব্বাই ঘুমিয়ে আছে।  স্বয়ং পথও এতো ভোরে ওর বুকের উপর আমাদের এই উপদ্রব আশা করেনি। কিন্তু বোন বেচারি দাদাকে দেখাবার উল্লাসে এটি মোটেও ভাবে নি যে মেঘলা ভোরে সামনের পথটাও ওখানে স্পষ্ট চোখে পড়ে না, দূরের সারামাটিতো কল্পনারও বাইরে। তবে বৃথা যায়নি সে জাগরণ। আমরা দুটিতে সেই ঝিরেঝিরে বৃষ্টিতে এক ছাতার নিচে হেঁটে হেঁটে চলে গেলাম বাবাদের বেঙ্কে। মেঘলা ভোরে পূব আকাশে অল্প অল্প রোদের আভাসের রূপ কেমন তা বলে দেখানো আমার সাধ্যি নেই। তার মধ্যে যদি এমন হয় যে আমরা দাঁড়িয়ে আছি লাল, হলদে,সাদা ডালিয়া ফুলের বাগিচায়। এক একটা গাছ সেখানে আমাদের দুটি কিশোর কিশোরীর মাথার থেকেও উঁচু । আশ মিটিয়ে দু’জনের হাতে যতটা ধরে ডালিয়া পেড়ে আমরা হাতে নিয়ে ফিরে এলাম, ঘর সাজাবো বলে।  সারামাটি তখনো মেঘের চাদর গায়ে শুয়ে ছিল।
                                  এই সারামাটি পর্বতমালার কোনো এক ঝরণা থেকে নেমে গেছে নদী বরাক। সোজা দক্ষিণে গিয়ে মণিপুরে ঢুকে গেছে। মণিপুর থেকে কাছাড় হয়ে অসমে। করিমগঞ্জে গিয়ে সুরমা কুশিয়ারা হয়ে বাংলাদেশে দেশে ঢুকে সেই নদী মেঘনাতে গিয়ে মিশেছে। ঐ নদীর উপর মণিপুরের  টিপাইমুখে বাঁধ হচ্ছে বলে এখন প্রতিবাদে ধরণিতল কাঁপিয়ে রেখেছে গোটা বাংলাদেশ ।  ওতো কথা তখন জানতাম না। আমরা এতো আত্মবিস্মৃত আর আত্মঘাতি মানুষ যে এখনো আমাদের পাঠ্য বইতে লেখে বরাক মনিপুর থেকে নেমে এসছে। ওদিকে আমরা ছেলে বেলা পড়েছি বরাক বুঝি নেমেছে পাটকাই পর্বতমালা থেকে। পাটকাই তিনসুকিয়ার একেবারেই কাছে অরুণাচল প্রদেশে এসে ছুঁয়েছে।  সেই বা কী করে হয়! বছর খানিক আগে ‘এবিওজিনেসিস’ (Abiogenesis ) নামে ডিমাপুরের একটি ব্যান্ড এই পাহাড়কে নিয়ে দুর্দান্ত গান বেঁধেছে ‘সারামাটি টিয়ারস’ । আমার সম্পাদিত পত্রিকা ‘প্রজ্ঞানে’ এ নিয়ে এক প্রতিবেদন তৈরি করবার বেলা ওদের সঙ্গে সারামাটির কথা আমি নিজেও এতো ভালো করে জানতে শুরু করি। যে সে ব্যান্ড নয়।  পূর্বোত্তর ভারতের সঙ্গীতের ঐতিহ্য নিয়ে বাকি ভারতের এখনো কোনো ধারণাই নেই। বিশেষ করে পাহাড়ি রাজ্যগুলোর । অভিমানে ওরাও বাকি ভারতের সঙ্গে তেমন যোগাযোগ গড়েন বলে মনে হয় না। অথচ সিঙ্গাপুর থেকে সিকাগো ওদের খ্যাতি রয়েছে। অরুণাচলের এক লামা তাসি গ্র্যামী পুরস্কারের জন্যে মনোনীত হবার আগে কেই বা জানত, আর তার পরেই বা ক’জন তাঁকে মনে রেখেছে !                     
                  ‘এবিওজিনেসিসে’র দুটো এলবাম ইতিমধ্যে দু’দুবার , ৫১ এবং ৫২ সংখ্যক গ্র্যামী পুরস্কারের জন্যে মনোনীত হয়েছিল।  নিজেদের কিছু বাদ্য যন্ত্রও ওরা নিজেরা তৈরি করেছেন। তার মধ্যে একটি বাঁশে তৈরি বাঁশির মতো দেখতে। দলের প্রধান দুই সদস্য আর সদস্যা মোয়া এবং আরেনলা মিলে নাগা পরম্পরাগত বাঁশিতে সামান্য পরিবর্তন করে নাম দিয়েছেন ‘হাওয়ে’।  কিন্তু সেতো একালের  কথা । সত্য হলো তখন সেই পাহাড়ের নামটা  কিফ্রিতে তখনো কেউ বেশেষ  জানত বলে মনে হয় না। তারা শুধু জানতেন ওই পাহাড়টাই সবচে উঁচু, ওতে বরফ জমে। ঐ সারামাটির কোলেই কি সামাতুর? আমি জানি না। কিন্তু ‘সামাতুরে’র পর এই রহস্য ভরা ‘সারামাটি’র পর্বত আমার স্মৃতিতে এতোটাই  জায়গা করে নিল যে আজ এই আধা বুড়ো বয়সেও আমি কখনো এই আনন্দে ঘুম ছেড়ে জেগে উঠি যে সেই ভীষণ সুন্দর  পাহাড়ে আমি চলে এসছি। পা ফেলে রীতিমতো এর কোলে ঘুরে বেড়াচ্ছি। হয়তো আজ রাতেও ওদের দুটির সঙ্গে আমি আবার মুখোমুখি হ’ব। মুখোমুখি হতে চাই দিনে দুপুরে, কিন্তু হতে পারি কৈ। যেতে পারি কৈ? আমার সঙ্গে যাদের নিতে ইচ্ছে হবে তাদের সব্বাই এখন পাহাড় চড়তে ভয়ে পায়।    মাঝে মাঝে এও মনে হয়, গেলে কি আর কখনো আমার রাতগুলো  অমন দারুণ সব সুন্দর স্বপ্নময় হয়ে থাকবে  ? 
                        ধরকাকুদের বাড়ির পথে হঠাৎ দেখি  বাঁদিকের এক ছোট্ট শাখা পথ থেকে ( গলি বলা যাবে না)  দু’ট বাচ্চা নাগা ছেলে ট্রাইসাইকেলে পথে নেমে এসছে। ওপথে ট্রাইসাইকেল চালাবার বিপদ জানি। একবার পনঙ্কু আমাকে এরকম তুলে ছেড়ে দিয়েছিল। শুরুতে যদিও বা ভালই লাগল গতি বেড়ে যেতেই আমিতো থামেতেই পারি না। ভাগ্যিস নিচের মোড়টাতে গিয়ে পথ খানিকটা সমতল আর চওড়া হয়ে গেছিল। ওখানে গিয়ে সাইকেল আপনি থেমে গেছিল। কিন্তু ওরা বেশ সেই ঢালি পথে সাইকেল চালাচ্ছিল, আর থেকে থেকে পা নামিয়ে সেটি বেশ দাঁড় করিয়ে নিজেদের পালা বদল করছিল।  তাদের সেই খেলাতে আমার চোখ আটকে গেছিল বলে আমি দেখিনি উলটো দিক থেকে তখন তিনটি নাগা পুরুষ আমার দিকেই তাকাতে তাকাতে আমার সম্ভবত আমাকে নিয়েই কথা বলতে বলতে চড়াই উঠছিল। তার থেকে একজন এসে আমার পথ আটকে দাঁড়ালো। শুরুতে আমি একটু ভয় পেয়ে গেলাম।   কিন্তু ওর মুখে নীরব হাসি দেখে সে ভয় চলে গেল, সে জায়গা নিল ক্রোধ। এ কেমন ঠাট্টা, আমাকে কি বাচ্চা ছেলে পেয়েছে ? ঠিক কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলাম না। এক সময় ক্রোধের জায়গা নিল লজ্জা। সে লজ্জা আমার মুখেও হাসি আনতেই সে সঙ্গীদের নাগাতে কিছু বলল। কিন্তু আমাকে  কিছু বলে না । আমি ডানে যেতে চাইলে সে ডানে পথ আটকায়, বায়ে যেতে চাইলে সে বায়ে।  আমি বলতেও পারি না, যেতে দাও। ততদিনে আমি নাগামিজ ভাষা ভুলে গেছি। দু’দিনের অতিথি হয়ে ভুল ভাষা বলে লোক হাসিয়ে হবে টা কী, তাই আর নতুন করে শিখবার চেষ্টাও করি নি। এক সময় আমার কান্না পাবার জোগাড় হলো, এতো আচ্ছা মুস্কিল হলো দেখি। কে বা কারা ওদের উদ্দেশ্যটাই বা কী, কিছুই বুঝতে পারছি না। ওভাবে কেউ কাউকে পথে আটকায় জানলেতো আর আমাকে একা আসতে দেয়াই হতো না। কী মনে করে যেন, ওরা একসময় নিজেদের মধ্যে হা হা করে হাসতে হাসতে আমার পথ ছেড়ে দিল। আমি দ্রুত পায়ে ধরকাকুদের বাড়ি চলে এলাম।
                     ওদের বাড়ির ছেলে মেয়েরা খুব সরল ছিল। আর ছিল মিশুকে। এই ক’দিনে আমি ওদেরও দাদা হয়ে গেছি। ওরা আমাকে বাড়ির বাইরেই পাকড়াও করে ভেতরে খবর দিল। ধরকাকু ওখানে এক সরকারী স্কুলের শিক্ষক ছিলেন। সম্ভবত তাই তাঁর সেদিন বন্ধ ছিল। কাকু জিজ্ঞেস করলেন, কী রে পনঙ্কু তোদের বাড়ি যায় নি? ওতো তোকে দেখতেই যাচ্ছে! “প...ন...ঙ্কু!” আমি যেভাবে চিৎকার দিয়ে উঠলাম। আমি যাই। বলে পা বাড়াতেই, কাকিমা ভেতর থেকে এসে বললেন, “আরে, যাবি। ও কিফ্রিতে থাকবেতো। তোর সঙ্গে দেখা না করে যাবে না।“ কে শোনে কার কথা! আমি যে কাজে মা পাঠিয়ে ছিলেন, সে কাজ চট জলদি সেরে জোরে পা চালালাম। এখনো আমাকে হাঁটতে হবে অ...নে...ক  পথ! ডিঙোতে হবে অনেক চড়াই ।
                   কেন ও বলল না, ও পনঙ্কু! কেন শুধু  কতকগুলো শুকনো ঠাট্টা করে চলে গেল? ওই  কী?  ও জানল কী করে আমি এসছি? যদি দেখাই করবে তবে আমাকে  অমন আসতে দিল কেন? ওরতো কথা ছিল আমাকে কাঁধে তুলে নেবে! ছোঁ মেরে সেই পুরোনো দিনগুলোর মতো আবার হারিয়ে যাবে পাইন বনে!  ছিল কী? পনঙ্কু কি এতো বুড়িয়ে গেছে? ও কি এতো মুটিয়ে গেছে? যে লোকটা আমার পথ আটকালো সেতো তেমনি ছিল দেখতে। ওর গায়ে ফুলহাতা কাজ করা কালো ডোরা কাটা সাদা সার্ট ছিল। পায়ে বুট জুতো। পনঙ্কুকে আমি দেখেছি সারাক্ষণ গায়ে একটা সাদা গেঞ্জি বা গেঞ্জি সার্ট পরে থাকতে। খাকি কিম্বা কালো পেন্ট ।   পায়ে চপ্পল কখনো থাকতো, কখনো না। শক্ত সমর্থ ছিল ,কিন্তু তেমন স্বাস্থ্য ছিল না।
                           সে ঐ খালি পায়ে , খালি গায়ে কিফ্রি চলে আসবে—অতোটা ভাবার মতো বুদ্ধু আমি ছিলাম না। কিন্তু মোটা হতে হবে আর চুলেও দু’একটা পাক ধরাতে হবে ----এমন কোনো শর্ত থাকবারওতো কথা ছিল না।
                          বাড়ি যেতে যেতে হাঁপিয়ে পড়েছি। কিছুটা ঘেমেও গেছি । কিন্তু এরই মধ্যে গোটা ঘর খুঁজে দেখি কোত্থাও কেউ নেই। মাকে জিজ্ঞস করলাম, ‘কেউ এসছিল?’  ‘কে আসবে?’ মায়ের পাল্টা প্রশ্ন,  “এসছিস যদি তাড়াতাড়ি স্নান করে আয়।” আমার কি আর তখন স্নানে মন? মায়ের প্রশ্নের উত্তরও দিতে পারিনি , লজ্জায়। কী বলব?  সত্যটা কী ?  ও গেল কোথায়? আমার এই দৌড়ে আসাটাই যে বৃথা গেল।
তবু আসেই নি যখন, আমি স্নান সারতে গেলাম বাথরুমে । দু-এক মগ জল ঢালতেই শুনি উপরের সেই বাড়িতে নেমে আসার পথের থেকে ডাক, “ ও বাবুনি! কী করি আছা?” আমার হাত থেমে গেল, হৃদকম্পন বেড়ে গেল। “ কে এলো এই ব্যস্ত দিনে?” মায়ের   গলায় বিরক্তি। তার পরের ডাক একেবারে ঘরের ভেতর, “ তোমাখানর খবর লব আহিলোঁ।” ‘ ও! পনঙ্কু! আহা আহা।”  আমি কি খুব দ্রুত হাত চালিয়ে ছিলাম? মনে পড়ে না। এমনিতে একচোট হেসে ফেলেছিলাম ঐ স্নানের ঘরে বসে। ও ওই পথের উপর ঠাট্টাটা করে আমাকে মুস্কিলেই ফেলে দিয়েছিল। আমার ‘প্রেসটিজ’ বলে কিছু রইল না। ও আফটার  অল আমার মন্ত্রি ছিল। আমার নির্দেশ পালন ওর আজ ছিল। আজ  অমন আচরণ করল যেন, আমি এক বাচ্চা ছেলে আর ও জ্যাঠা মশাই।   এখন আমি ওর সামনে যাই কী করে?  কথাই বা কী বলব? আমিতো আর ওর ভাষা বলতে পারি না। ও বললে কিছুটা বুঝব, কিন্তু জবাবে রা করা প্রায় অসম্ভব ছিল। এই সত্য আমি এ ক’দিনে কিফ্রি থেকে বুঝেছি। নাগা কারো সঙ্গে আমি একটিও কথা বলতে পারি নি। পুজোর সময়ও অনেকে গেছিল পুজো দেখতে। কারো সঙ্গে আমার আলাপ করিয়েও দেয়া হয়েছিল। আমি শুধু মুখে এক চিলতে হাসি এনে মাথা নাড়িয়ে গেছি। এই ক’বছরে এতোটা দূরত্ব তৈরি হবে সে আমার কল্পনা করবারও দরকার পড়েনি কক্ষনো। দু’একটা শব্দ যে উচ্চারণ করতে পারব না তা নয়, কিন্তু যদি ভুল বলি--  সে লজ্জায় তাও বলিনি।
                             বাড়ির পেছন থেকেও বসবার ঘরে ঢুকে তবেই বিছানা ঘরে যাওয়া যেত। আমি চুপচাপ এক কোন দিয়ে বিছানা ঘরে ঢুকবার সময় ও ওর স্বভাব সুলভ গলা উঁচু করে আওয়াজ দেয়, “ হেইইই... কিমান টাইমতে আহিলে? “  কোনো জবাব না দিয়ে আমি দৌড়ে ঘরে। এই কথার অর্থ দুটো হতে পারে, ভাবছিলাম। “ কবে কিফ্রি এলে?”,  “ এখন যে কোথাও যাচ্ছিলে, কখন ফিরলে?” কী বিড়ম্বনা। এখন কোন উত্তর দিই? ছোট ভাইটি তখন পনঙ্কুকে ওর পুজোর নতুন খেলনা দেখাতে ব্যস্ত। বোন দৌড়ে এসে জানালো , “চিনিস? পনঙ্কুদা! সামাতুর থেকে এসছে!”  জ্যাঠাইমা!আমি চিনব না তো ও চিনবে? আমরা যখন সামাতুর শাসন করতাম ও তখন বিছানাতে বসে দুধ খেত।  জিজ্ঞেস করলাম, সঙ্গে দু’জন কে ?  ‘ওরা ওর এখানকার বন্ধু। ওর এখানে অনেকে আছে।” সঙ্গীরা সামাতুরের হলে কোনো কথা ছিল না। এখানকার বন্ধুতে আমার কী?   পনঙ্কু তখন বলে যাচ্ছিল মাকে, “ছেলে বড় হয়ে গেছে! ... আগের বার যখন আসি বাবু বলছিলেন পুজোর পরে এবারে ওকে নিয়ে আসবেন। চলে এলাম। ওকে কোলে পিঠে করে মানুষ করেছি। দেখতে ইচ্ছেতো  হয়ই।”
                         এমনটাও হয় তবে? ও শুধু আমার জন্যেই এসছে! জোরে চুলে চিরুনি চালাতে গিয়ে শুনি ও বলছে, এসছিল পাশের গাঁয়ে ওর আত্মীয় কারো খবর নিতে । ধরবাবুদের বাড়ির কাছ দিয়ে আসবার সময় উনি জানালেন, করবাবুর ছেলে এসছে। তাই চলে এলো। সমস্ত উৎসাহ, সমস্ত উচ্ছ্বাস আমার চুল থেকে গড়িয়ে পড়া জলের সঙ্গে গলা  বেয়ে কাঁধ দিয়ে নেমে গেল। নেহাতই কৌতুহল বশে আমি ধীর পায়ে ওর কাছে গেলাম। ও আমাকে দু’হাতে জড়িয়ে কাছে  টেনে নিল। সসবই ঠিক ছিল।  কিন্তু এ সেই পনঙ্কু নয়।
                         যতক্ষণ ছিল ও আমাকে ছাড়েনি। কত কি জিজ্ঞেস করল , আমি দু’একবার ঘাড় নাড়ানোর বেশি কথাই বলতে পারলাম না। ও একা আসত, আমাকে ডেকে কাছে কিম্বা  দূরে নিয়ে যেত।  আমি ওকে বলতাম আমি ওর ভাষা ভুলে গেছি। ও নিশ্চয় আমাকে দু’একটা শিখিয়ে দিত। এখন এই এতোগুলো ওর পেয়ারের বন্ধুদের সামনে আমি বলি কী করে? আমি শুধু মাথা নেড়ে গেলাম, আর কথার জবাবে হাসবার অভিনয়টা করে ওর মান বাঁচালাম। কিন্তু ভেতরে এক তীব্র অপমান আমার সমস্ত শরীর জ্বালিয়ে যাচ্ছিল। এতো এতো দিনের অপেক্ষার পর, সেদিনগুলো ফিরে আসতে আসতেও যে ওমন রঙ পালটে ফেলবে কে ভেবেছিল? আমার যে মা ওকে রীতিমত শাসন করতেন, ওর মুখের উপর দরজা বন্ধ করে শাঁসিয়ে বলে দিতেন, “আর কোনো দিন ভর দুপুরে  ওকে নিয়ে তুই ঐ  পাব্লিক ফিল্ড পার করে যাবি তোর হাড় ভেঙে দেব!” সেই মায়ের হাতে করে দেয়া  চা আর নারকেলের নাড়ু  খেয়ে ও দিব্বি রসের আলাপ জুড়েছে। আর আমি ওর কোলে বসে আছি যেন বাচ্চা ছেলে! ও কি জানে না আর দু’বছর পর আমি কলেজে যাব? ও কি আমার কাকা?  মামা?  জ্যেঠামশাই? ঘন্টা খানিক পরে ‘উঠি’ বলে বন্ধুদের নিয়ে যে বেরিয়ে চলে গেল সে তাই ছিল। তাকে নাম ধরে ডাকতে আমার লজ্জা করছিল। এ কথা বলার অর্থ ছিল না কোনো, কোনো ভাবেই, “ আবার কবে আসবে?” নীরবে বাড়ির বারান্দাতে দাঁড়িয়ে ওর চলে যাওয়া দেখলাম। 
                         আমার বন্ধু পনঙ্কু তখনো একা একা সামাতুরের ঘন জঙ্গলের পথে কোনো এক ঝরণা তলার দিকে এগুচ্ছে। ওখানে ওর বান্ধবী কেউ স্নান করতে গেছে। ওর কাঁধে    আমাদের ফেলে আসা বাড়িতে যে নতুন পরিবারটি এসছে তার বড় ছেলে। সে এখনো পাহাড়ে আছে। তার এখনো এই পাহাড় ছেড়ে নেমে যেতে অনেক দেরি...।

Tuesday 5 October 2010

পুজো

( খন ১৯৯৫। পুজোর কদিন আগে মামার বাড়ি গেছি দিন দুয়ের জন্যে। ছেলেবেলা কখনো কখনো পুজোতে মামার বাড়ি যাওয়া, কুশিয়ারা নদির কূলে বিসর্জন দেখার এক আলাদা আমেজ ছিল। কেন জানেন, ওপারেই যে বাংলাদেশ। জকিগঞ্জের হাজারো লোক ওপারে ভিড় জমায় করিমগঞ্জে দেবীর বিসর্জন দেখতে। তখনও আমি বাড়ি ছাড়া হইনি। কিন্তু আঁচ করছিলাম, আমাকে  মাথুর যাত্রা করতে হবে। মন বিষন্ন ছিল। তেমনি একরাতে কোনো এক কাগজে শালিমার তেলের এক বিজ্ঞাপনে দেখলাম, পুজো মানে...। ধুর এ আবার কবিতা বুঝি। আমি ওদের কবিতাটা শুদ্ধ করে দিলাম এরকম । এতে অবশ্যি করিমগঞ্জ নেই। আছে শিলচর।  লেখা হয়েছিল ১১ থেকে ১৪ অক্টোবর, ৯৫)

শিশির ভেজা শিউলি তলে
রোদের লুটোপুটি;
পুজো মানেই ভিড়ের ট্রেনে
জানালা তোলা ছুটি

পুজো মানেই ঘরের টানে
বাঁধন যত ছেঁড়া;
কাশের বনে পথ হারিয়ে
ছেলে বেলায় ফেরা।

পুজো মানেই সে কবেকার
প্রেমতলার মোড়;
তনুদীপুর সাথে সেবার
মিশন রোডে ভোর

ছোট বৌদি চায়ের কাপে
কত দিনের পর;
পুজো মানেই, কোথায় থাকে
তরুণিমার বর?

এবং তারপর...

বিসর্জনে ঢাকের কাঠি
বেলুন সাদা লালে;
স্টেশন জুড়ে ধোঁয়া এবং
টোল পড়ে না গালে।