আমার চেতনার রঙে রাঙানো এই খেলা ঘরে:

~0~0~! আপনাকে স্বাগতম !~0~0~

*******************************************************************************************************

Wednesday 2 September 2020

ফেসবুক লাইভে নানা প্রসঙ্গ

তরঙ্গবার্তা

 ম্প্রতি অতিমারির দিনে ফেসবুক লাইভে বলাবলি বেশ জনপ্রিয় হয়েছে। আমাকেও এখানে ওখানে থাকতে হয়েছে। কখনো সরাসরি বক্তৃতাতে। কখনো আলোচনাতে। সেগুলো এখানে রাখছি।

১) প্রথম আলোচনা ‘তরঙ্গবার্তা’র উদ্যোগে। বিষয় ছিল 👉 আসাম চুক্তি, নাগরিকত্ব ও সাম্প্রদায়িকতা: প্রেক্ষাপট, বর্তমান এবং ভবিষ্যত’। 

এখানে রইল। 👇

 

 

২) দ্বিতীয় আলোচনারও আয়োজ়ক তরঙ্গবার্তাই ছিল। রবীন্দ্রনাথের জন্মদিনে।  বিষয় ছিলরবীন্দ্রনাথের গান কানে শুনে প্রাণে ভরেছিলেন বিজয়া চৌধুরী: এক অসম কন্যার জীবন এবং কর্ম কাহিনি । সেটি রইল এখানে 👇



 

 


১৯শে মে ‘ভাষা শহিদ দিবসে’র আগের দিনে ১৮ মে সন্ধ্যাতে একটি আন্তর্জাতিক আলোচনা চক্র হয় ।
আকাশ জুড়ে লেখা আমার আত্মপরিচয় :: দুয়োরে খিল। টান দিয়ে তাই খুলে দিলাম জানলা’ --এই শিরোনামে আলোচনা সভায় আয়োজক ছিলেন, শিল্পী শুভপ্রসাদ নন্দী মজুমদার। তাঁর সঙ্গে সঞ্চালনাতে সহযোগ করেন লেখক- সাংবাদিক অরিজিৎ আদিত্য। অসম বাংলা বাংলাদেশ, ভারতের বাকি প্রদেশ এবং পশ্চিমা বিশ্বের জনা পনেরো প্রবাসী এই আলোচনাতে যোগ দেন। এবং নানা দিক থেকে দিনটির তাৎপর্য, ভাষার সমস্যা, ভাষার অধিকার নিয়ে কথা বলেন। গুরুত্ব বোঝে আলোচনাটি এখানে তুলে রাখা গেল।

 

 

 

 

 

 

আরেকটি আলোচনা সভা বসে ঠিক তার পরের দিন, অর্থাৎ ১৯শে মে রাতে। আয়োজন করে বাংলাদেশের 'ঐহিক'। ছবির ক্যাপশনে ‘স্মরণ ও শ্রদ্ধায় ১৯মে’ লেখাটিতে ক্লিক করলেই ভিডিওতে পৌঁছানো যাবে।

স্মরণ ও শ্রদ্ধায় ১৯মে

 
 
 ২৭ মে,২০২০ তারিখে জটিল রোগে ভোগে অকালে চলে যায় আমাদের বন্ধু, সমাজকর্মী, পরিবেশ কর্মী এবং সাংবাদিক পীষুষ কান্তি দাশ। তাঁর স্মরণে ধারাবাহিক আলোচনা সভার আয়োজন করেছিল  ‘ওপিনিয়ন মুভার্স’ ‘স্মৃতিতে পীযূষ’  শিরোনামে। এর দ্বিতীয় পর্বে ৩১ মে তারিখে আমি ছিলাম। সাংবাদিক প্রণবানন্দ দাসের সঙ্গে। সেটিও ছবির নিচের ক্যাপশনে ক্লিক করে শুনতে পারেন। 
স্মৃতিতে পীযূষ’-২য় পর্ব
এই দুই ভিডিও-তেই আমার দিক থেকে নেট সমস্যা ছিল।  ওপিনিয়ন মুভার্সেরই পরের আলোচনা যেটিতে আমি ছিলাম সেটি অনুষ্ঠিত হয় ২১ জুলাই, ২০২০-এ। আমার সঙ্গে ছিলেন অরুণাংশু ভট্টাচার্য। এটিও সরাসরি শুনা যাবে নিচের ক্যাপশনে ক্লিক করে। অথবা ইউট্যুব রইল তার নিচে। 
 


 

 

আপাতত শেষ আলোচনা সভা যেটিতে ছিলাম, এর আয়োজ়ক ‘জয় ভীম ইন্ডিয়া নেটওয়ার্কঅনুষ্ঠিত হয় ৩১শে আগস্ট, ২০২০, সোমবার, রাত ৮টায়বিষয় ছিল অসমের ভয়াবহ অভিজ্ঞতার আলোকে CAA, NPR, NRCআমি ছাড়াও ছিলেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক সুশীল মান্ডি এবং জননেতা সুনীল সরেন। কিন্তু তাঁরা দু’জনেই নেট সমস্যাতে যোগ দিতে পারেন নি। সঞ্চালনা করেন শরদিন্দু উদ্দীপন। ছবির ক্যাপশনে ক্লিক করে এতেও পৌঁছানো যাবে। 

অসমের ভয়াবহ অভিজ্ঞতার আলোকে CAA, NPR, NRC   


 

Sunday 26 July 2020

রবীন্দ্রনাথের গান কানে শুনে প্রাণে ভরেছিলেন বিজয়া চৌধুরী : এক অসম কন্যার জীবন এবং কর্ম কাহিনি




দারুহরিদ্রা, ২য় সংখ্যাতে প্রকাশিত
ম্প্রতি রবীন্দ্রনাথের গান নিয়ে একটি লেখা তৈরি করতে গিয়ে বেশ কিছু পড়া নাপড়া বই পত্রিকার পাতা ওলটাতে ওলটাতে এক জায়গাতে চোখ খানিকক্ষণ আটকে গেছিল। “মার্চ ২০১২য় গানের জগতে বিরল, বিরল কেন, অলৌকিক এক কাণ্ড ঘটল। সেটি ঘটল আবার কলকাতা শহরে। ওইদিন, ‘বিহান মিউজিক’ প্রকাশ করে রবীন্দ্রসঙ্গীতের একটি সিডি—এবং, দশখানি গানের সে সংকলনের প্রতিকটি পঁচাশি বছর পার এক শিল্পীর গাওয়া”১ ---লেখাটির শুরুতেই চমক আছে। যে কোনো পাঠকই কৌতূহল ধরে রাখবেন। এই অব্দি এসে হয়তো ভাববেন,পঁচাশি বছর পার করাতেই বুঝিবা ঘটনাটি ‘অলৌকিক’ হয়ে উঠল।না, সেরকম নয়। সিডির গান নিয়ে লিখতে গিয়ে লিখছেন এভাবে,“গায়ন তাঁর কেবল সুরেলা  স্নিগ্ধতায় সীমিত নয়; তাঁর চেহারাও তা-ই—শান্ত, শীলিত প্রজ্ঞার ছাপ স্পষ্ট বিজয়ার চলনে-বয়নে। বোধহয়,ঐ আত্মপ্রতিষ্ঠার সামর্থ্যগুণেই ‘(তোমার) ভুবনজোড়া আসনখানি’  গানটি বিজয়া চৌধুরীর গলায় এতো খুলেছে –যে গান….”২ আরো খানিক বাদে লিখছেন,“বিজয়া চৌধুরী-র ‘এসো নীপবনে ছায়াবীথিতলে’ আমাকে আপাদমস্তক ভিজিয়ে পুরো ভাসিয়ে ছাড়ে—নিদেন দু-দিন সকালে সাঁঝে ফিরে ফিরে বারে বারে বাজাই সেটি।”৩ তাঁর আগে তিনি নিজের কয়েক দশকের টানা গান শুনার ইতিবৃত্ত জানাচ্ছেন,সঙ্গে জানাচ্ছেন রবীন্দ্রসঙ্গীতের জনপ্রিয় হবার এবং শিল্পীদের উঠে আসবার কাহিনি। লেখক শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায়। ফলে যে কেউ এই ‘অলৌকিক কাণ্ডে’র নায়িকার সম্পর্কে আগ্রহ ধরে রেখে এগুবেন। আমরাও এগিয়েছি।  আহামরি ‘অলৌকিক’ কিছু মনে হলো না যতক্ষণ এসে না জানলাম যে তাঁর কৈশোর কেটেছে শিলঙে,যৌবন সিলেটে এবং অনুষ্টুপের প্রকাশিত একখানা আত্মজীবনী রয়েছে ‘সিলেট কন্যার আত্মকথা’। তখন বিশ্বাস হলো---কাণ্ডখানা সেরকমই বটে। বিচিত্র গানের সঙ্গে রবীন্দ্রসঙ্গীতের যিনি অলিগলির সংবাদ রাখেন সেই লেখক কিনা লিখলেন,“তবু,ঘনিষ্ঠ জানাজানি সত্ত্বেও,২০১২র আগে, বিজয়া চৌধুরীর রবীন্দ্রসঙ্গীত আমার কানে পৌঁছোয় নি। না, গ্রামোফোন রেকর্ড নয়,সামনাসামনি শ্রবণ নয়,পৌঁছাল তা,হালের প্রযুক্তি, সারা আকাশ পাতা, আপাত বিশ্বের আন্তর্জাল, ইন্টারনেট-এর সৌজন্যে। কথায় কথায় জেনেছিলাম, আন্তর্জাল-সংসারে বঙ্গ সঙ্গীতের নানান যা ঘাঁটি আছে তাদের অনেক ক’টিতে নোঙর বাঁধলে বিজয়া চৌধুরী নামক জনৈক গায়িকার ঘাটে পৌঁছানো যায়। বিশুদ্ধ কৌতূহলবশে,এ-মুলুক সে-মুলুক ঢুঁড়ে,পেলাম অবশেষে আমার অন্বিষ্ট পারানির খোঁজ।”৪ আমরাও অগত্যা সেরকম সন্ধান করে দুই চারটি পেলাম গিয়ে ইউ-ট্যুবে। বিজয়ার পুত্র অমিত চৌধুরীর একাউন্টে সেই ‘এসো নীপবনে’ গানটিরই ভিডিও রূপ দেখলাম।  নিজের সংগ্রহের সব সিডি ঘেঁটে কিছু পাওয়া গেল না।  কিন্তু মনে প্রশ্ন জন্ম নিল-- উষা রঞ্জন ভট্টাচার্যের যে দুটি বই আমার কাছে রয়েছে সেখানে তো নামটি আছে বলে মনে হচ্ছে না। কতশত নাম আমারই কি মনে আছে?অগত্যা,তাক থেকে নামালাম আবার।পড়েও ফেললাম ‘কবি ও কুইনী এবং অন্যান্য’।বইটি আমাকে তাঁর স্নেহের সঙ্গে দেওয়া উপহার ছিল। ২০০৩ সনে। এইবারে স্নেহ ফসল ফলাবে। না,বিজয়ার সন্ধান কোথাও পেলাম না। তারপরে আবার খুলে বসলাম,২০১১তে প্রকাশিত ‘উত্তর-পূর্বভারতে রবীন্দ্রচর্চা’।না তাতেও নেই। অথচ শিলং, সিলেটের কত মানুষেরই না কত কথা রয়েছে। এর মধ্যে তাঁর সম্পর্কিত দুই চারজনের কথাও রয়েছে, সেটি আমরা তৃতীয় পাঠে আবিষ্কার করলাম।পরে লিখছি,কিন্তু বিজয়ার কথা নেই। সুতরাং সন্ধানের নেশা একটা চেপেই বসল। বই দুটি পড়তে পড়তেই গোগোলে ঢুঁ মারলাম। মারতেই বহু সাইটে বেরুলো তাঁর একটি নয়,দুটি বইয়ের খবর। অন্যটি ‘রান্নার সাতকাহন’। বইয়ের সংগ্রহ  ‘রকমারি ডট কম’-এর ভেতরে গিয়ে পুরো না হলেও বইটির পৃষ্ঠা দুয়েক নজরে এলো। সাইটে বইটির সম্পর্কে লেখা, “শাক থেকে শোলমুলো, শুক্তো থেকে শুটকি---প্রাণমাতানো পেটভরানো হরেক রান্নার সন্ধান আছে এই বইতে। থরে থরে সাজানো নিরামিষ রান্নার ভাজা, ডাল, তরকারি, পুর। ডালেরই বা কতরকম...রান্না নিয়ে লেখকের নানা মজাদার অভিজ্ঞতার গল্পগুলো তেমনি স্বাদের।”৫বইটি বের করেছিল আহনন্দ পাব্লিশার্স।তৃতীয় মুদ্রণ ২০১৩তে। তার মানে -- এর কাটতি আছে।আছেও বেশকিছু সাইটে। কিন্তু লেখক পরিচিতিতে অপেক্ষা করছিল আরো বিস্ময়। বিজয়ার জন্ম শিবসাগরে। বড় হয়েছেন সিলেটে। শিবাজী তাঁর আত্মকাহিনি পড়েছেন। কেনবা শিবসাগরের কথাটি উল্লেখ করেন নি! হয়তো সেখানে গান করেন নি বলে। কিন্তু আমাদের কাছে তো এটিই ‘সেন্টহুডে’র বড় প্রমাণ।শিবাজী যে লিখলেন,‘অলৌকিক এক কাণ্ড ঘটল।’ আমাদের বিশ্বাস গেল বেড়ে। শিবসাগর থেকে শিলং সিলেট হয়ে যিনি ১৯৬৫তে কলকাতাতে গানের রেকর্ড করতে পারেন তিনি নির্ঘাৎ আরো বহু কাণ্ড ঘটিয়েছেন। নইলে পঁচাশি বছর বয়সে অধ্যাপক  শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো দ্বিভাষিক লেখক গবেষক তাঁকে নতুন করে ‘আবিষ্কার’ করতে যাবেন কেন? ‘আবিষ্কার’ কথাটি অমিত চৌধুরীর থেকেই নেয়া।ইউ-ট্যুবে নিজের চ্যানেলে ধরেই নিতে পারি যে ভিডিওটি অমিত নিজে বানিয়েছেন সেখানে মায়ের সংক্ষিপ্ত জীবনপঞ্জিও তুলে দিয়েছেন।সেখানে তিনি ‘rediscovered’ শব্দটি শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায় ও মৌসুমী ভৌমিকের উল্লেখ সহই লিখেছেন। তিনিও শুরুতেই উল্লেখ করেছেন বিজয়া জন্মেছেন শিবসাগরে।৬ শিবাজীর কুড়ি পৃষ্ঠার প্রবন্ধে বিজয়ার কথা কমই আছে। তিনি আসলে তাঁকে বসিয়েছেন রবীন্দ্রসঙ্গীতের জনমানসে বিস্তারের ইতিহাসের খোপে খোপে। সুতরাং সেদিকটিতেই জোর পড়েছে বেশি। যুক্তিতে তথ্যে দেখিয়েছেন শান্তিনিকেতনীদের বাইরে রবীন্দ্রসঙ্গীতের জনপ্রিয়তার জোয়ারটি আসে রবীন্দ্রশতবর্ষের পরেই।আর এমন সময়েই গ্রামোফোন রেকর্ডে বিজয়ার আবির্ভাব।


                  সুতরাং দুই চারটি হোয়াটস এপ,ফেসবুক গ্রুপেও তাঁর সম্পর্কে দুই চারটি কথা লিখে, ছবি দিয়ে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলাম। নিশ্চয়ই অসমের অনেকে জেনে থাকবেন। একটি গ্রুপে আমাদের শিক্ষক রবীন্দ্র গবেষক উষারঞ্জনও রয়েছেন।তিনি কম কথা বলেন,এখানেও বলেন নি। আমরাও চাইলেই ফোন করতে পারতাম। কিন্তু তাতে মুস্কিল আসান হয়ে যেত। নিজে পথ করে নেবার আনন্দই মাঠে মারা যেত। শিবাজী লিখেছিলেন বটে,বিয়ের আগে বিজয়া ছিলেন নন্দী মজুমদার। খুব একটা গুরুত্ব দিই নি।এতে আর এমন কি কথা! পৃথিবীতে কি আর শুভপ্রসাদই কেবল নন্দী মজুমদার? আমাদের অগ্রজ বন্ধু। রবীন্দ্রসঙ্গীতে, গণসঙ্গীতে যাঁর খ্যাতি আছে। জন্ম হয়েছিল শিলঙে। বড় হয়েছেন শিলচরে। এখন কলকাতা বর্ধমান মিলিয়ে থাকেন। আমাদের অজ্ঞানতার খিড়কিতে ধাক্কা দিয়ে শিলচরের কবি সাংবাদিক তমোজিৎ সাহা এবং বাচিক শিল্পী অমিত শিকিদার জানালেন তিনি শুভপ্রসাদের পিসি হন। শিলচর বেতারে একবার এসে সাক্ষাৎকার একটি দিয়েছিলেন, আর্কাইভে থাকবে।শুভপ্রসাদের কন্যা শবনম সুরিতা ডানা এসে কথা বলল,ওর মা জয়িতা যোগ দিল। ফোনে শুভদার সঙ্গেও কথা হলো। বাকিখানা ইতিহাস।আমরা যা লিখব। দেখলাম, আন্তর্জালে ‘ধানসিড়ি’র সংগ্রহে ‘সিলেটি কন্যার আত্মকথা’ বইটি রয়েছে। কিন্তু করোনার জন্যে লকডাউন চলছে। এরা পুরোনো বই সংগ্রহ করে বিক্রি করে থাকেন। কথা হলো। লকডাউনে কিছু হবার ছিল না। ওদের থেকে পুরোনো বইয়ের প্রচ্ছদের ছবি দিতেই দুই চারজনে জানালেন,তাঁদের কাছে বইটি রয়েছে। কেউ কেউ সংগ্রহের বইটির প্রচ্ছদও দেখিয়ে দিলেন। এর মধ্যে অনুজ অধ্যাপক রত্নদ্বীপ পুরকায়স্থও ছিল। সে কষ্ট করে প্রতিটি পৃষ্ঠা মোবাইলে স্ক্যান করে পাঠিয়ে দিল দিন দুই পরে। আমরা নামিয়ে সেখানাও পড়ে নিলাম এই ঘরবন্দির দিনগুলোতেই। ইচ্ছে থাকলে কী না সম্ভব হয়ে উঠে। আর অসম্ভবকে সম্ভব করবার গল্পই তো বিজয়া চৌধুরীর গল্প। আমরা সেই গল্পের আপাতত দরকারিটুকু পড়ে দিচ্ছি তাঁরই ‘আত্মকাহিনি’ থেকে।

                 খুব ছোটবেলা বাবাকে হারিয়েছিলেন বিজয়া। তারপরে জীবনের গল্প যত এগিয়েছে বহু উঠানামার পরেও দেখেছি সাত ভাইবোনের এবং তাঁদের সন্তানদের অধিকাংশই দেশে বিদেশে ছড়িয়ে যাচ্ছেন। বিজয়ার নিজের বিয়েও হয়েছে বিলেত প্রবাসী ‘দাদা’র বন্ধু নগেশ চৌধুরীর সঙ্গে বিলেতে গিয়েই। কিন্তু নিজের আত্মকাহিনির প্রতিটি পৃষ্ঠাতেই যে ভাইবোনদের সঙ্গীত চর্চার  ফিরিস্তি দিচ্ছেন,তাতে মনে হতে অসুবিধে নেই যে শৈশবে বাবাকে না হারালে সম্ভবত সেই কাজটি করা হয়ে উঠত না। ছেলেবেলা তাঁর এবং ছোটভাই দুখু তথা আশিসপ্রসাদের গান শেখা শুরু বাড়িতেই সেজদা অরুণ প্রসাদের কাছে কাছে। সেই সেজদা গান শিখতেন বাবাকে লুকিয়ে। কারণ গানবাজনা শিখলে ছেলের লেখাপড়া হবে না, ছেলে ইঞ্জিনিয়ার হবে না এই ধারণা বাবার বদ্ধমূল ছিল।৭ এই পড়ে পড়ে যখন এগুচ্ছি, তখন এক জায়গাতে পাওয়া গেল হেমাঙ্গ বিশ্বাসের কথা। হেমাঙ্গ বিশ্বাসের সঙ্গে তাঁদের সামাজিক যোগযোগ ছিল। এবং যখনই কথা হতো তিনি বেজোড়াতে তাঁর নিজের মামার বাড়ির আর সেই সঙ্গে নন্দীমজুমদার বাড়ির গল্প করতেন। এবং তাঁর থেকেই তিনি তাঁদের আদিবাড়ির লোকজনের গানের খ্যাতি সম্পর্কে জানতে পারেন। সেই প্রসঙ্গে বিজয়া শিলচরের উনিশ শতকীয় প্রতিভা রামকুমার নন্দীমজুমদারেরও নাম করেন।৮ হেমাঙ্গ বিশ্বাসের জীবন কথাতে যারাই সামান্য নাড়াচাড়া করেছি, আমরা জানি তাঁর পৈত্রিক পরিবার নিয়ে তিনি খুব সপ্রশংস ছিলেন না। এটি অত্যন্ত জাতপাতমানা আচারনিষ্ঠ জাঁদরেল জমিদারের পরিবার ছিল। উদার পরিবার ছিল তাঁর বেজোড়ার মামার বাড়ি। চৌধুরী পরিবার বলে সেটি খ্যাত ছিল। তাঁর গানের প্রেরণাও সেই সুবাদে হয়ে উঠেছিলেন মা। বাবা নন।আর অবশ্যই জমিদারির প্রজারা। কিন্তু যে বাবা ‘সেজদা’কে গানে প্রশ্রয় দিতেন না, তাঁর আদি পরিবারের লোক রামকুমার নন্দীমজুমদার –যিনি মাইকেলের বীরাঙ্গনা পত্রকাব্য বেরুলে তাঁর একখানা উত্তরকাব্য লিখে সেকালেই খ্যাতি কুড়িয়েছিলেন –এই সংবাদটি আমাদের আরো একখানা মহাগ্রন্থে নজর দিতে উৎসাহী করে তুলে। সেই বইটি অবশ্যই অচ্যুতচরণ চৌধুরী তত্ত্বনিধির ‘শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত’।যারা বইটি পড়েছেন,জানেন যে জেলা পরগণা ধরে ধরে অচ্যুতচরণ সিলেটের বহু পরিবারের পরিচিতি তুলে দিয়েছেন। বস্তুত ইতিহাসে প্রবেশের এটি তাঁর একটি পদ্ধতি ছিল। পূর্বাংশে তিনি সিলেটের ভৌগোলিক-সামাজিক- রাজনৈতিক ইতিহাসে ভ্রমণ সেরে ‘উত্তরাংশে’ সেরকম বহু বংশ পরিচয় লিখে রেখেছেন যতটা পেয়েছেন। বইটি প্রকাশিত হয় ১৯১৭তে। তখন তিনি লিখছেন,সাড়ে তিনশত বছর আগে বেজোড়াতে এই পরিবার এসে বসতি করেন। ময়মন সিংহের হাজারদি বনগ্রামে ছিল এদের আদিনিবাস। সেখানকার ভুবনেশ্বর নন্দীর তিন সন্তান লবণেশ্বর,শুক্লাম্বর ও মহেশ্বর। শুক্লাম্বরের সন্তান পীতাম্বর,তাঁর ছেলে লম্বোদর,লম্বোদরের ছেলে ত্রিলোচন বুড়িশ্বরে এসে বসতি করেন। তাঁর সন্তান রামদাস বেজোড়াতে এসে বসতি করেন। তাঁর মধ্যম সন্তান বিশ্বনাথ বেজোড়াতে থেকে যান। দুইভাইর এক দুর্গাদাস আন্ধিউড়াতে আরেক ভাই গোপাল চলে যান ইটাখোলাতে। অচ্যুতচরণ বেশ বিস্তৃত একখানা বংশপরিচয় দিয়েছেন।৯বিশ্বনাথের পরবর্তী তৃতীয় প্রজন্মে এসে তিনভাই রঘুনাথ কৃষ্ণপ্রসাদ ও রামনাথের কথা পাচ্ছি। ঠিক কোন সুতোতে যে বিজয়া চৌধুরীর বাবা যোগেশ চন্দ্রের সংযোগ শুভপ্রসাদকে প্রশ্ন করে নিশ্চিত হওয়া গেল না। তিনি বললেন,শুনেছেন ‘মাইজম ঘরে’র সন্তান তাঁর ঠাকুরদাদা। অর্থাৎ কৃষ্ণপ্রসাদের উত্তরপুরুষ হলেও হতে পারেন।নামের ‘প্রসাদ’ অংশটিও আমাদের অনুমানকে দৃঢ়ভিত্তির উপরে দাঁড় করায়।যা শুভপ্রসাদ অব্দি বহমান। অচ্যুৎচরণ উল্লেখ করেছেন, ত্রিলোচন মহাভারতের আদিপর্ব ও শান্তিপর্ব রচনা করেছিলেন। তাঁর দুটি পর্বেরই পুঁথি পাওয়া গেছে। সেই সঙ্গে মহাভারতের আদিপর্বের আরো এক রচয়িতা রামেশ্বর নন্দীকেও তিনি এই পরিবারের লোক বলেই অনুমান করেছেন। যদিও রামেশ্বর বা পরবর্তীকালের রামকুমার নন্দীমজুমদার-- যিনি পূর্বোক্ত বইটি ছাড়াও লিখেছিলেন ‘মালতি উপাখ্যান’ সহ সব মিলিয়ে একুশখানা বই—তাঁদের দুজনের এই পরিবারের সঙ্গে সংযোগটি স্পষ্ট করেন নি।রামেশ্বর নন্দীর আদিপর্বের কথা কিন্তু সুকুমার সেন তাঁর ‘বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস’-এর দ্বিতীয়খণ্ডে উল্লেখ করেছেন।১০তিনি ‘ক্রিয়া-যোগসার’ নামে আরো একখানা গ্রন্থের কথাও  লিখেছেন। আরো লিখেছেন,“রামেশ্বর দাস ভনিতায় যে দণ্ডীপর্ব পাওয়া যায় তাহা ইঁহার রচনা হইতে পারে।”১১ ভূমির অধিকার সূত্রে নন্দীপরিবারটি মজুমদার উপাধি পেয়ে থাকবেন এ ইতিহাসের ছাত্র মাত্রেই অনুমান করতে পারেন।‘বীরাঙ্গনা পত্রোত্তর কাব্যে’র নবীন সংস্করণের সম্পাদক অধ্যাপক অমলেন্দু ভট্টাচার্য এবং অধ্যাপক জহর সেন তাঁদের ভূমিকাতে লিখেছেন,“রামকুমারের পিতৃ-পিতৃব্য নন্দীমজুমদার বংশের অধস্তন দশম পুরুষ”১২  রামকুমারের বাবা রামসন্তোষ বিষয়বুদ্ধির অভাবে মাটিবাড়ি রক্ষা করতে পারেন নি। চলে আসেন বেজোড়ার পাটলি গ্রামে। সেইখানেই ১৮৩১শে রামকুমারের জন্ম। জয়নাথ নন্দী মজুমদার এই পরিবারের মানুষ, সম্ভবত রঘুনাথ বা রামনাথের উত্তরসূরি হবেন। তাঁর ‘শ্রীহট্টগৌরব’ নামে ১৩৪৩ বাংলাতে পদ্যে লেখা দুই খণ্ডে একটি বই রয়েছে। ১৩ তাঁর দুইচারটি পদ্যনমুনা আন্তর্জাল ঘেঁটে পাওয়া গেল এরকম,“বিষয়েতে মত্ত পাপী স্ত্রী পুত্র ধনের তরে/দিনান্তেও জগদীশে ভাবে না অন্তরে ॥” কিংবা  “সনাতন সত্যধর্ম্ম হইলে মলিন/পাপ পূর্ণ হয় ধরা কুকর্ম্মেতে লীন ॥/পাপিষ্ঠের অত্যাচারে শিষ্টে কষ্ট পায়/সতীর সতীত্ব যায় করে হায়! হায় ॥/ঈশ্বরের সিংহাসনে বসে শয়তান/তারে পূজে নরনারী যাহারা অজ্ঞান ॥” লেখক গ্রন্থসূত্র স্পষ্ট করেন নি। লিখেছেন ‘হজরত মোহাম্মদ (গান)’।১৪ শুভপ্রসাদ লিখে জানালেন,“তিনি আলু চাষের উন্নত পদ্ধতি উদ্ভাবনের জন্য রায়সাহেব উপাধি পেয়েছিলেন। তিনি বাবাদের সম্পর্কিত কাকা। লোকে ঠাট্টা করে তাঁকে পটেটো রায়সাহেব বা আলু রায়সাহেব বলত। তিনি স্বভাবকবি ছিলেন। নিজের ছেলে মাখন যিনি স্বাধীনতা আন্দোলনে জেল খেটেছেন, তাঁকে নিয়ে লিখেছিলেন,‘আমার পুত্র মাখন,জেল খাটিছে এখন,বেঁচে থাকলে যশোলাভ করবে বাছাধন’। আমার পিসি বিএ পাশ করার পর লিখেছিলেন,‘ঊষা নন্দী মজুমদার, বিএ পাশ করল এবার’…।” মাখন সম্ভবত সুকুমার নন্দী,যার কথা বিজয়া লিখেছেন। তিনি তাঁদের সিলেটের বাড়ির কাছেই আত্মগোপনে ছিলেন।১৫ অধ্যাপক উষারঞ্জন এই পরিবারের সম্পর্কে যে দুই চারকথা লিখেছেন,তাঁর ভাষাতেই রাখি,“মথুরা নাথ নন্দী ছিলেন শিলংবাসী সর্বজন শ্রদ্ধেয় ব্রাহ্ম আচার্য। জন্ম ১৮৬২তে, শ্রীহট্টের বেজুড়া পরগণার বিখ্যাত নন্দী মজুমদার বংশের প্রথম গ্র্যাজুয়েট তিনি। ১৮৮৯তে পঞ্চাশ টাকা মাইনেতে অসম সেক্রেটারিয়েটে যোগ দিতে শিলং চলে আসেন। তাঁর পুত্রদের একজন হিতেন্দ্রনাথ নন্দী (১৮৯১-১৯১৭) শান্তিনিকেতনে ব্রহ্মচর্যাশ্রমে প্রথম পর্বের ছাত্র এবং প্রথম ভারতে প্রস্তুত ফাউণ্টেন পেনের (ঝরনা কলমের) কালি ‘কাজল কালি’র উদ্ভাবক ও প্রচলন কর্তা। হিতেন্দ্রের ভাই নরেন্দ্রও ছিলেন শান্তিনিকেতনের ছাত্র। মথুরাবাবুর কন্যা শোভনা নন্দী (পরে শোভনা গুপ্তা, শিলঙে সুপরিচিত ব্যক্তিত্ব)। হিতেন্দ্রনাথকে কবি বিশেষ স্নেহের চোখে দেখতেন। কাজল কালি-র প্রচার-বিজ্ঞাপনে রবীন্দ্রনাথের ‘উপস্থিতি’র আড়ালে কালির গুণের সঙ্গে যে কিঞ্চিৎ স্নেহগুণও মিশে থাকতে পারে, কোনও কোনও বঙ্গবাসী এমন ধারণা পোষণ ও প্রচার করতেন।”১৬  বিজনবিহারি রায়ের ‘ভক্ত-সাধক মথুরানাথ নন্দী’ নামে ১৯৫১তে একটি লেখার কথাও উল্লেখ করেছেন। বিজনবিহারির বাবা বিনোদবিহারি খাসিয়া ভাষাতে দ্বিশতাধিক ব্রহ্মসঙ্গীত ও রবীন্দ্রসঙ্গীতের অনুবাদ করেছিলেন।ফলে বিদ্যা ও কলা চর্চাতে যে পরিবারটির একটি প্রাচীন ঐতিহ্য ছিল যে গল্প হেমাঙ্গ বিশ্বাস বিজয়াদের কাছে করতেন তা খানিক বেশিই সত্য।

       
           সেই পরিবারের মেয়ে বিজয়ার গানের ১৯৬৫ থেকে ৮০ অব্দি আটটি রেকর্ডের একটি তালিকা শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায় দিয়েছেন।১৭ এগুলোর থেকে ষোলটি গানের সংকলন সিডি হয়ে প্রকাশিত হয় ২০১১তে ‘ভুবন জোড়া আসনখানি’ নামে। ২০১২তে প্রকাশিত সিডির তিনি নামোল্লেখ করেন নি। অর্থাৎ দুটি সিডির সংবাদ তাঁর থেকে পাচ্ছি।এর সবগুলোর উল্লেখ বিজয়া নিজের আত্মকাহিনিতে করেন নি। কিন্তু এর বাইরে আরো কিছু করেছেন, আমরা পরে লিখব।

       
                  ১৯২৫এর দশমীর দিনে জন্ম হয়েছিল বলে নাম বিজয়া। তাঁর বাবা যোগেশ চন্দ্র তখন শিবসাগরে কর্মরত ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন।মায়ের পৈত্রিক পরিবার হিন্দু হলেও ছিলেন ব্রাহ্মধর্মভাবাপন্ন। ফলে মেয়ে শৈলবালাকে লেখাপড়াতে উৎসাহ দিয়েছিলেন। এবং মধ্য ইংরেজি পরীক্ষাতে মা সারা অসমে প্রথম হয়ে স্বর্ণপদক পেয়েছিলেন। তাতেই বিয়ের প্রস্তাব পেতে শুরু করলেন। আর যোগেশচন্দ্রের সঙ্গে যখন তাঁর বিয়ে হয়ে গেল। তখন তাঁর বয়স ছিল পনেরো। বরের বয়স ছিল একত্রিশ। তিনি  ছিলেন দ্বিতীয়পক্ষ। মেয়ের পড়াশুনা আটকে যাবে বলে মিশনারি স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা বাধা দিলেও কাজ হয় নি। বিয়েটা হয়ে গেছিল। এবং অচিরেই প্রথম পক্ষের সন্তানেদের আপন করে নিতে পেরেছিলেন বা তাঁরা হয়ে পড়েছিলেন। সেই ছেলেবেলাতেই শিবসাগরে নাটকের অভিনয়ের সংবাদ দিচ্ছেন বিজয়া--যেখানে দাদা দিদিরা সবাই যোগ দিতেন। চন্দ্রগুপ্ত, হরিশচন্দ্র, কর্ণার্জুন ইত্যাদি নাটক হতো। সগৌরবে লিখছেন,গান ছিল তাঁদের ভাইবোনদের জন্মজাত।১৮ কিন্তু বাবার এসবে আগ্রহের সংবাদ নেই। তিনি চাইতেন ছেলেমেয়েরা লেখাপড়াতে এগিয়ে যাবে।ফলে তখনই ‘সেজদি' তথা ঊষা নন্দী মজুমদারকে (পরে পুরকায়স্থ) ময়মনসিংহের একটি নামকরা বোর্ডিং স্কুলে পাঠিয়ে দেন। সেই পাঠানো বৃথা যায় নি।তিনি স্বাধীনতা উত্তরকালে বরাকউপত্যকার এক কৃতী শিক্ষাবিদ হয়ে উঠেছিলেন।আর "ছোড়দা’ তথা পরমেশ প্রসাদের মেধা পরিবারের সবার নজর কাড়াতে বাবার সাধ জাগল ছেলে পড়ে আই সি এস হবে। কিন্তু সেসব সাধ রইল সাধের জায়গাতে। ৫১ বছর বয়সে বাবা দাদাদের সঙ্গে নিয়ে শিবসাগর থেকে নাজিরা যাবার পথে পোষা ঘোড়ায় টানা ফিটন গাড়ি দুর্ঘটনাতে আহত হন,পরে তারই ভুল চিকিৎসা করতে কলকাতা গিয়ে অকালে মারা যান।এরই মধ্যে তিনি তুরাতে বদলির আদেশ পেয়েছিলেন। পরিবারকে নিয়ে গিয়ে শিলঙে রেখে নিজে গেছিলেন কলকাতাতে। তখন তাঁর ছোট ছেলের জন্ম হবে। বাবার মৃত্যুর পরে জন্মালেন বলে ছোট সেই ভাইয়ের নাম পড়ে গেল ‘দুখু’।১৯ তিনি আশিস প্রসাদ। শিলঙে শৈলবালার বোন ও বোনের বর থাকতেন। সেই সুবাদে কাছেই পুলিশ বাজার ও  জেলরোডে মাঝামাঝি  পথের ধারে কুঞ্জলতা কুটিরে তাঁরা ভাড়া থাকতেন। বাড়িটি বড় ছিল। বাবার মৃত্যুর পরে শুধু পেনশনের টাকাতে মায়ের চালানো কঠিন হয়ে পড়েছিল এতো বড় পরিবার। একে একে গাড়ি,ঘোড়া এবং আসবাব পত্রের সঙ্গে সাধের গ্রামোফোনটিও বিক্রি হয়ে যায়। যেটিতে গান শুনে শুনে ভাইবোনেরা অনুশীলন করতেন। শিলঙের বাসাটিও সামাল দেওয়া মায়ের পক্ষে কঠিন হচ্ছিল। যদিও শিলং ছাড়বার আরেকটি কারণ  বিজয়া বেশ রসিয়ে উল্লেখ করেছেন-- পাছে ভাইয়েদের কেউ কোনো খাসিয়া কিশোরীর আকর্ষণে বাঁধা পড়ে।২০ সিলেটে পুরোনো লেন পাড়া, তাঁতিপাড়া এমন সব এলাকাতে ভাড়া বাসাতে কাটিয়ে বছর কয় পরে মা লামাবাজারে একটি বাড়ি করেন। ইতিমধ্যে একেবারে বড় দাদা দেবীপ্রসাদ চাকরি নিয়ে চলে যান বিলেত। পুরোনো লেনের কাছেই ছিল সিলেট গার্লস গভর্নমেন্ট হাইস্কুল,তার ভেতরে ছিল একটি শিশু বিদ্যালয়। সেখানেই  ছোট ভাই দুখুর সঙ্গে বিজয়ার পাঠশালা জীবনের শুরু।বড়ো দাদা দিদিরা ততদিনে হাইস্কুল ডিঙিতে কলেজেও চলে গেছেন। সেজদাকে শিবসাগরে বাবা থাকতে লুকিয়ে গাইতে হতো। সিলেটে সেটি হয়ে গেল প্রকাশ্যে। ফলে প্রায় রোজ বাড়িতে গানের আসর বসতে শুরু করল। সেই দাদাও অকালে মাত্র ত্রিশ বছর বয়সে চলে যান। কিন্তু তাঁর আদরে আশ্রয়ে গানের যে অভ্যাস হচ্ছিল তাতে স্কুলে অচিরেই আদর বেড়ে গেছিল বিজয়ার।২১শিবসাগরে,শিলঙে থিয়েটারের গল্প শুনেছেন বা দুই চারটা দেখেওছেন,কিন্তু সিলেটে যাত্রার সঙ্গেও পরিচয় হলো।২২ বাড়িতে ভাইবোনেরা মাঝেমধ্যেই বসিয়ে দিতেন গান আর কবিতার আসর। অধিকাংশ গানই শুনে শেখা,তাও পাশের কোনো বাড়ির রেডিওতে। গানে যেমন সেজদা,কবিতা পড়াতে নেতৃত্ব দিতেন ‘সেজদি’। সেরকম আসরে ধারে জুটে গেছিল একটি গ্রামোফোন আর কিছু বিখ্যাত শিল্পীর গানের রেকর্ড। সেই গ্রামোফোনের গল্পটি বেশ রসালো। তাঁতিপাড়া বাড়ির কাছেই একটি স্কুলে পড়তেন দাদা রাধেশ। সেখানে একটি নতুন ছেলে এসে ভর্তি হয়। গ্রাম থেকে এসেছে জ্যাঠামশাইর বাড়িতে থাকে। নিজের বলতে এরাই। এসেই দাদাকে পেছনে ফেলে ক্লাসের পরীক্ষাতে প্রথম। তবু দাদার মুখ থেকে ওর প্রশংসাতে বাড়িতে খই ফুটতে থাকে। সেই বয়সে একদিন ছেলেটি বাড়ির সামনে এসে ডাকছে,‘রাধেশ! রাধেশ!’ শিশু বিজয়া খেলা ছেড়ে জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করলেন,“এই তোর নাম বুঝি নগেশ,তুই তো দাদাদের ক্লাশে ফার্স্ট হয়েছিস,তাই না?” ইনিই পরে বিজয়ার স্বামী নগেশ চৌধুরী। ধীরে ধীরে দুই বাড়িতে যাতায়াত বাড়ে। বনেদী বাড়ি। গ্রামোফোন ছিল। সেগুলোই নিয়ে আসা হতো কখনো বা।বহুদিন থাকত।ভাইবোনে শুনা হতো। সেভাবেই বিজয়ার শুনা হয়েছিল কানাকেষ্ট,শচীন দেববর্মণ,ফৈঁয়াজ খাঁদের গান। হয়তো কাননবালার গানও শুনেছিলেন। তিনি উল্লেখ করেছেন কাননবালা ও দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের কণ্ঠে ‘কর্ণকুন্তি সংবাদ’ শুনার অভিজ্ঞতার কথা।২৩ ‘কর্ণকুন্তি সংবাদ’ পরে তাঁরা নিজেরাও অভিনয় করেছেন সিলেটের বিখ্যাত সারদা মেমোরিয়াল হলেও। সেখানে কৃষ্ণের ভূমিকাতে নগেশও অভিনয় করেছিলেন।২৪ সে অবশ্য বেশ পরের কথা। এর আগেই  তাঁর এবং দুখুর গানের খ্যাতি ছড়াতে থাকে।এখানে ওখানে শহরের বাইরেও গানের ডাক পেতে থাকেন, সেই শৈশবেই। তিনি বলছেন, সেই খ্যাতি শিলঙেও ছড়িয়েছিল। সম্ভবত সেটি শিলঙে থাকতে নয়। ফেরার পরে সিলেট থেকে গিয়ে ওখানে গান করবার কথা পরে জানিয়েছেন।২৫ “লোকের মুখে মুখে আমাদের নাম হয়ে গেল দুখু-খুকুর গান।”২৬ দুখু তথা আশিস প্রসাদ একবার ‘চৌবাস্টেটে’ অনুষ্ঠিত নজরুল গানের প্রতিযোগিতাতে সারা অসমে প্রথম হয়ে রূপোর পদক লাভ করেন। সেজদা মানা করাতে বিজয়া সেই প্রতিযোগিতাতে যোগ দেন নি। চৌবাস্টেটের মহারানি তাঁকে মাস্টার দুখু অবিধা দিয়েও সম্মানিত করেন। সেজদি উষা নন্দী মজুমদার ততদিনে মৌলবীবাজার স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা। স্কুল কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নেন যে দুখুকে একটি হারমোনিয়াম দিয়ে সম্মানিত করা হবে। সেই হারমোনিয়াম দুখু কম নাড়াচাড়া করতেন, বিজয়া সেটি নিয়ে রীতিমত পড়ে থাকতেন। এবং কার গান,কী গান -- জানার দরকার নেই, ভালো লাগলেই হারমোনিয়ামে তুলে নেওয়া হয়ে পড়ে তাঁর নেশা।সেজদার সঙ্গে মায়ের উৎসাহও ছিল নিরন্তর।বাড়িতে গুণী লোকের যাতায়াত যেমন বাড়তে লাগল।তেমনি সিলেট শহর বলেও কথা—যেখানেই সুর তাল ---সেখানেই ভাইবোনদের তো যেতেই হবে। সিলেটে একবার খ্যাতিমান শিল্পী মণি বর্ধন এলেন তাঁর নাচের দল নিয়ে। ভাইবোনেরা সেই নাচ দেখলেন। দেখে সেজদির মনে হলো---তারাও বন্ধুদের নিয়ে গরমের ছুটিতে ‘নটীর পূজা’ অভিনয় করবেন।এবং করেও ফেললেন গিরিশ ইঞ্জিনিয়ারদের বাড়িতে মঞ্চ তৈরি করে।সেই বাড়িতে এককালে এরা ভাড়া থাকতেন।২৭ সিলেটের লামাবাজারে যেখানে এঁরা বাড়ি করেছিলেন,সেখানকার অধিকাংশ বাসিন্দা মণিপুরি।বাড়ির অলঙ্করণও সম্ভব করেছিলেন লৈপন সিং নামে এক মণিপুরি ভদ্রলোক।খোদ রবীন্দ্রনাথ সিলেট ভ্রমণে এসে মণিপুরি নাচের সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলেন।বাকিটুকু ইতিহাস।বিজয়ারাও মণিপুরি নাচ গান দেখে শুনে বড় হতে থাকেন। বিজয়া লিখেছেন,“আমাদের বাড়ির পেছনেই ছিল মণিপুরি মণ্ডপ। প্রায়ই সন্ধ্যায় ওখানে খোল করতালের আওয়াজ আর ছেলেমেয়েদের সম্মিলিত গানের মূর্ছনায় লামাপাড়া সঙ্গীত রসে প্লাবিত হোত।”২৮ পাড়ার রাসপূর্ণিমা,ঝুলনে বড় উৎসব হতো আর বিজয়াদের পরিবারের লোকজনের নিমন্ত্রণ বাঁধা থাকত। অবশ্য সিলেট শহরের যত্রতত্র বাঙালিদের আখড়ারও অভাব ছিল না। লামাবাজারের বাড়ির কাছেই ছিল গোপাল আখড়া।ওখানকার কীর্তনও নিয়মিত শুনা হতো,আবার পাড়ার মোদির দোকানেরও যে বিনোদনের উপায় ছিল কীর্তন তাঁর বর্ণনাও দিচ্ছেন। 

            ক্রমে বিজয়া কুমুদ রঞ্জন গোস্বামীর কাছে প্রথাগতভাবে গান শেখা শুরু হলো। শাস্ত্রীয় সঙ্গীত,ভজন এবং রবীন্দ্রসঙ্গীত শেখাচ্ছিলেন তিনি।সেই সঙ্গে চলছিল রেকর্ডে শুনে সায়গল,কনক দাস,পঙ্কজ মল্লিকদের গান গলাতে প্রথম,পরে হারমোনিয়ামে তুলা।যে সন্তোষ সেনগুপ্তের সৌজন্যে বহু পরে তিনি প্রথম গানের নিজের গান রেকর্ড করবেন তাঁর গানও সেভাবেই শুনা। গান গাইবার ডাক দুই ভাইবোনে এমন পেতে থাকলেন যে একসময় মা আমন্ত্রকদের কাছে যাতায়াতদের ভার বহনের দাবিটুকু জানাতে শুরু করলেন।২৯ যে সারদা ম্যামোরিয়েল হলের কথা বলছিলাম,সেখানে মানবেন্দ্র রায়,রামানন্দ চ্যাটার্জির মতো মানুষ বক্তৃতা করতে এলে উদ্বোধনী গানের ভার খুখু-দুখু দুই ভাইবোনের উপরেই পড়ত। বিজয়ার এই খ্যাতির পেছনে সিলেট গভর্ণমেন্ট স্কুলেরও ভূমিকা আছে। সেখানে প্রতিবছরই গানের প্রতিযোগিতাতে তিনি প্রথম হতেন। স্কুলে একবার অসমের গভর্নর পরিদর্শনে এলেও গান গেয়ে তাঁকে অভ্যর্থনার দায়িত্ব পড়েছিল বিজয়ার উপর।৩০ফলে সেই খ্যাতি বাকি শহরে ছড়িয়ে যেতে সময় নিচ্ছিল না। খানিক বড় হলে একবার ডাঃ বৈকুণ্ঠ নন্দীর বাড়িতে পালাকীর্তনে কৃষ্ণের ভূমিকাতে গান গাইবার আমন্ত্রণ পেয়েছিলেন। লোকে লোকারণ্য। কীর্তন শেষে কিছু মানুষ তাঁকে আর রাধার ভূমিকার অভিনেত্রী রেখাকে প্রণামও করে গেলেন। সিলেটে বড় বড় সঙ্গীত আসর, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হতো। আর সেগুলোতে তাঁদের উপস্থিতি ছিল প্রায় অনিবার্য,শুনতে দেখতে অথবা গাইতে। সেই সুবাদে সেকালের সাহিত্য ও সঙ্গীত জগতের সেরা গুণীদের খুব কাছে থেকে দেখার অভিজ্ঞতা তাঁদের হয়েছিল। সেভাবেই শুনা হয়েছিল রাধারানি ও নৃপেন্দ্র কৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায়ের কীর্তন, তারাপদ চক্রবর্তীর শাস্ত্রীয় সঙ্গীত, কেরামৎউল্লা খাঁয়ের তবলার লহরা।৩১        

                কিন্তু কেবল গানেই নয়। ‘সেজদা’একবার বাড়িতে একটি লাইব্রেরি তৈরির ব্যাপক কিন্তু ব্যর্থ চেষ্টা করেন। নামও দিয়েছিলেন ‘The Young Library’। সেখানে বহু বই পত্রের সঙ্গে সুন্দরীমোহন দাসের নাতি রনজিৎ দাসের ‘টুংটাং’ নামে একটি দুর্লভ বইও সংগৃহীত হয়েছিল। দাদাদের এই সব কীর্তিকলাপের বেশ রসালো বর্ণনা আত্মকাহিনির পাতায় পাতায়। দাদা একবার সাহিত্যিক হবারও চেষ্টা করেছিল। ছোড়দা,অর্থাৎ পরমেশ প্রসাদ শিলং নিয়ে একটি ছোট্ট ছড়াও লিখেছিলেন সাত বছর বয়সেই। বহু পরে ‘প্রতিচ্ছবি’ নামে একটি কবিতা ‘দেশ’ পত্রিকাতে ছাপাও হয়েছিল।৩২  কিন্তু সেই পথে আর এগুনো হয় নি। ছেলেবেলাতেই বাবাকে হারিয়ে সবাই চাকরি করাকেই জীবনের ব্রত করে নিয়েছিলেন। বিজয়া নিজেও একবার একটি গল্প লিখে ফেলেছিলেন,পোষা বেড়ালের জীবনে অনুপ্রাণিত হয়ে। নাম ছিল ‘মুনিনাঞ্চ মতিভ্রমঃ’।সেটি আবার ঘটা করে লেখিকার ছবি তুলে ‘মাসপয়লা’ নামে একটি মাসিক পত্রিকাতে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন কংগ্রেসি স্বদেশী স্বজন বীরেন মামা। কিছুদিন পরে যখন লেখাটি অমনোনীত হয়ে ফিরে এলো,লেখিকা গল্প লেখার ইচ্ছে একেবারেই বাদ দিলেন।৩৩  কিন্তু কথাগুলো যখন আমরা আত্মকাহিনিতে পড়ছি তখন মনে হচ্ছে, আরেকটু আয়াস স্বীকার করলেই তিনি আত্মজৈবনিক উপন্যাস একখানা দাঁড় করিয়ে দিতেই পারতেন। বস্তুত তাঁর তাবৎ ইচ্ছের উত্তরাধিকার গিয়ে বর্তেছে একমাত্র ছেলে অমিত চৌধুরীতে। যার কথাতে আমরা পরে আসব।আপাতত যেটি লিখতে চাই, সে হলো—সেরকম সক্রিয়তার সংবাদ না মিললেও পরিবারটি স্বদেশীভাবাপন্ন ছিল। আমরা সুকুমার নন্দীর কথা আগেই লিখেছি। তবে ব্রিটিশের অনুগামীও ছিলেন বটে আত্মীয়দের মধ্যে। সেরকম কারো সৌজন্যে পরিবারের সবার নাম লেখানো ছিল পুলিশের খাতাতে। সেই জন্যে ভাইদের চাকরি পাওয়া কঠিন হলে  সেজদা অরুণপ্রসাদ ও মেজদা জ্যোতিপ্রসাদ দুজনেই ‘দেশবন্ধু পল্লি সংস্কার ব্যাঙ্কে’ চাকরি নিলেন। সেই চাকরি জুটিয়ে দিয়েছিলেন এই ‘বীরেন মামা’।৩৪১৯৪২এর ‘ভারত ছাড়ো আন্দোলনে’ ‘দুখু-খুকু’ দুই ভাইবোন সক্রিয়ভাবে নেমে পড়লেন। এখানে ওখানে পিকেটিং করা,সংগ্রামী গান করা নিয়মিত ব্যাপার হয়ে গেল।আই-এন-এ স্বেচ্ছাসেবী দলেও নাম লেখালেন। আর সভাসমিতি করে বেড়ালেন।৩৫‘ভারত ছাড়ো’ তখনই সফল হলো না। কিন্তু এলো পঞ্চাশের মন্বন্তর। শুরু হলো একদিকে নিরন্ন মানুষের সেবা আর দিকে মুনাফাখোরদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম। সেই সুবাদে আই পি টি এ-র কাছাকাছি ভিড়ে গেলেন। সরাসরি সদস্য হলেন কি না উল্লেখ নেই। হেমাঙ্গ বিশ্বাসের সঙ্গে আগেও সম্পর্ক ছিলই। এই পর্যায়ে এসে ঘনিষ্ঠতা হলো। পানু পাল,সন্ধ্যা দাস, দেবব্রত দত্তদের অভিনীত ‘ভুখানৃত্যে’র বিস্তৃত উল্লেখ করেছেন বিজয়া। পানু পালের সম্প্রতি শতবর্ষ পেরিয়ে গেছে নীরবে,এই কথাটি এখানে উল্লেখ থাকা ভালো। ২০ জানুয়ারি,১৯১৯শে জন্মেছিলেন এই বিরল প্রতিভা।৩৬‘সিলেট রেফারেণ্ডামে’ও সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছিলেন। সিলেট বিভাজনের বিরোধীপক্ষ যাতে জেতে তার জন্যে প্রাণপাত করলেন। এবং অতিঘনিষ্ঠ বান্ধবীদের বিপরীত পক্ষে দেখেও ক্ষুণ্ণ হলেন।সৈয়দ মুজতবা আলির ভাগ্নি জাহানারাও তাঁর সহপাঠীদের মধ্যে অন্যতমা ছিলেন। এর পেছনের রাজনীতি বা সামাজিক সমস্যা নিয়ে তিনি বেশি শব্দব্যয় করেন নি।সম্ভবত দেশভাগ এবং দেশান্তর তাঁকে রাজনীতিতে বেশি আগ্রহ ধরে রাখতে দেয়ও নি। ঠিক কবে এরা আবার সিলেট ছেড়ে শিলঙে চলে এলেন সেই কথাও স্পষ্ট নেই। সম্ভবত ১৪ আগস্ট, ১৯৪৭এর আগেই। বাড়ি দখল হলো, না বিক্রি করে এলেন সেই তথ্যও নেই। সিলেটে থেকে গেল ‘সেজদা’র স্মৃতি। অরুণপ্রসাদ ছিলেনই হৃদরোগী। ১৯৪৫এ তিনি সিলেটেই মারা যান।৩৭

            রাজনীতিতে মায়ের থেকেও সেই সব ব্যাপারে খুব একটা উৎসাহ ছিল না। তাঁর একমাত্র ধ্যানজ্ঞান হলো গান করা।  কিন্তু তবু গণনাট্যের বন্ধুত্বই তাঁকে কম্যুনিস্ট নারী আন্দোলনের নেত্রীদেরও কাছে নিয়ে যায়। ততদিনে তাঁরা আবার শিলঙে দেশান্তরী। তাঁর খুব কাছের বান্ধবী হয়ে উঠেছিলেন সুরমা ঘটক। কীভাবে কতটা বিস্তৃত নেই। কেবল লিখেছেন,‘প্রিয়বান্ধবী’। তিনি বিজয়াকে আত্মগোপনে থাকা নারী নেত্রীদের মধ্যে বার্তা বাহকের কাজে লাগান।সেই সুবাদে আলাপ  অঞ্জলি লাহিড়ির সঙ্গে। অঞ্জলি লাহিড়ির প্রস্তাবে  সুরমা ঘটক,কল্যাণী মিশ্র আরো কয়েকজনের সঙ্গে গুয়াহাটি হয়ে শিলচরে গিয়ে মণিপুরি গ্রামে পৌঁছান। মিছিলে যোগ দিয়ে পুলিশের তাড়াও খান।৩৮

             দেশভাগের পরে শিলঙে এসে পরিবারটি ছড়িয়ে যেতে শুরু করে। ‘সেজদি’র শিক্ষিকা হিসেবেও বেশ প্রতিষ্ঠা ছিল। সিলেটের পরে করিমগঞ্জে,শিলঙেও তিনি শিক্ষকতা করেছেন। সেসব দেশভাগের আগেই। তখনই তাঁর বিয়ে হয়ে যায় হিমাংশু শেখর পুরকায়স্থের সঙ্গে। ততদিনে বর সিলেট থেকে ব্যবসাসূত্রে নগাঁও প্রবাসী। সেই নগাঁও বাড়িতে এসে থাকতে শুরু করেন বিজয়া ও মা শৈলবালা।সঙ্গে দুই ভাইপো। সেই বাড়িতে যে ‘শনিবারের চিঠি’ আসতো সেই সংবাদ পাওয়া যাচ্ছে। যদিও বিজয়া লিখছেন,সিলেটে শেখা গানগুলো অভ্যাস করেই তাঁর দিন কাটছিল।৩৯ এখানে গান করা তাঁর হয়ে উঠেনি। অচিরেই দাদা রাধেশপ্রসাদ নগাঁও এলে তিনি শিলং যাবার বায়না ধরলেন এবং চলে এলেন।

             শিলঙে আসবার পরে যথার্থই ‘মুক্তির আনন্দ’ পেলেন।৪০ শিলঙে  বেতার কেন্দ্র স্থাপিত হলো। ১৯৪৮এর মাঝামাঝি তারা সেন,দীপা দত্ত,লিলি দত্তদের সঙ্গে বিজয়াও অডিশন দিয়ে শিল্পীতালিকাবদ্ধ হয়ে গেলেন। প্রতি পনেরো মিনিটের অনুষ্ঠানের জন্যে সম্মানমূল্য পেতেন কুড়ি টাকা। বেতারে প্রথম দুটি গানই ছিল রবীন্দ্র সঙ্গীত ‘হিমের রাতে ঐ গগনের দীপগুলিরে’ ও ‘সেদিন আমায় বলেছিলে আমার সময় হয় নাই’।গান গাইবার পরিবেশও ছিল, উৎসাহও বেড়ে গেল। সিলেটের সঙ্গীতশিক্ষক কুমুদ রঞ্জন গোস্বামীও দেশভাগের পরে শিলং চলে আসেন।বিজয়ার আবার তাঁর ওখানে যাতায়াত শুরু হলো। প্রায় কাছাকাছি সময়ে দাদার বন্ধু নগেশ চৌধুরীর সঙ্গে তাঁর বিয়ে ঠিক হয়ে গেল।কিন্তু বিয়ে হয় নি। নগেশ তখন চ্যাটার্ড একাউণ্টেন্সি পড়তে বিলেত প্রবাসী। তখন একবার দিলীপ রায় এলেন শিলঙে মূলত অরবিন্দ আশ্রমের জন্যে তহবিল সংগ্রহে। তাঁর সঙ্গে তাঁর আয়োজিত অনুষ্ঠানে গান গাইবার সুযোগ পেয়ে বেশ ধর্ম সংকটে পড়ে গেছিলেন বিজয়া। একদিকে তখন নগাঁও গিয়ে নগেশের সঙ্গে দেখা করতে হয়। আর দিকে কুমুদ গোস্বামী বেঁকে বসলেন,দিলীপ রায়ের সঙ্গে গান গাওয়া যাবে না।কুমুদ গোস্বামীকে উপায় করে রাজি করানো গেল। দিলীপ রায়ের অনুষ্ঠানে তাঁর সঙ্গে দ্বৈত ছাড়াও সমবেত এবং একক গান করলেন।গ্যারিসন থিয়েটারে অনুষ্ঠান হয়। অসমের গভর্নরও উপস্থিত ছিলেন। দিলীপ রায় তাঁর গানের প্রশংসা করে বললেন,‘প্রথম শ্রেণীর গলা।’৪১ ইচ্ছে জানালেন, বিজয়া যদি কলকাতা যান তবে একসঙ্গে দুজনে রেকর্ড করতে চাইবেন। স্বাভাবিকভাবেই এই আহ্বান বাড়িতে ঝড় তুলবার কথা। তুললও। বাড়ির লোকে ভাবনাচিন্তাও শুরু করে দিলেন। তখন পরমেশ প্রসাদ কলকাতাতে কাজ করতেন। কিন্তু অচিরেই শিলচরে বদলি হওয়াতে সেই ভাবনাতে ছেদ পড়ল। কিন্তু এই সব করতে গিয়ে নগেশের সঙ্গে নগাঁও গিয়ে দেখা করা হয়ে উঠল না। তিনি  ততদিনে ব্রহ্মপুত্র পার করে তেজপুরের কাছে ‘লোকরা’তে চলে গেছিলেন। সেজদি, মেজদা সহ বিজয়া সেই বাড়িতে গিয়ে দেখা করেছিলেন।

            নগেশ বনেদী বাড়ির সন্তান ছিলেন,কিন্তু শৈশবে মা হারিয়েছেন,ভাই বোন কেউ ছিল না। পড়তে লন্ডনে গেলেন। সেখান থেকে চট করে আসাও সমস্যা ছিল। অগত্যা বিজয়াকেই লন্ডনে নিয়ে যাবার ইচ্ছে জানালেন। সেখানে গিয়ে বিয়ে হবে। তখন দুখু তথা আশিস প্রসাদও থাকছেন শিলচর।বড়দা দেবীপ্রসাদ আছেন ছুটিতে কলকাতা। শিলচর থেকে মেয়েকে আশীর্বাদ করে পাঠানো হলো কলকাতা। সেখান থেকে দুখুর সঙ্গে লন্ডনে। সেই যাত্রার এবং বিয়ের ব্যয় সংগ্রহ হয়েছিল যেভাবে এরও একটি চিত্তাকর্ষক গল্প আছে। সেই গল্প লিখে জানিয়েছেন শুভপ্রসাদ,এর থেকে সামাজিক ইতিহাসেরও অনেকটা আঁচ করা যাবে। আমরা তাই পুরোটাই রেখে দিচ্ছি,“ বাবাদের সিলেটের বাড়িটা বিক্রি হয়েছে পরে। পিসিমনিকে লন্ডন পাঠানোর সময় যাতায়াত খরচ তোলার জন্য আমার বাবা সব ভাইবোনদের কাছ থেকে পাওয়ার অব অ্যাটর্নি নিয়ে সিলেট গিয়ে বাড়িটা বিক্রি করেন।যিনি কিনেছিলেন তিনি আমার রাঙাকাকা রাধেশের বন্ধু (শিলচরের অধ্যাপক যতীন্দ্র রঞ্জন দে'র খুড়তুতো ভাই) তপেশ রঞ্জন দে (হরি)। দেশভাগের সময় রাঙাকাকা ও তাঁর বন্ধু হরির তত্ত্বাবধানে বাড়িটা রেখে আসা হয়। পরে রাঙাকাকা চলে এলে ওখানে হরিবাবুই থাকতেন। আসার সময় বাবারা বাড়ি বিক্রি করে না। সেই সময়কার অনেক উদ্বাস্তুদের মত বাবাদের ধারণা ছিল দেশভাগটা একটা সাময়িক ভ্রম। উত্তেজনা কমলে আবার দুটো দেশ এক হয়ে যাবে। তখন বাবারা আবার ফিরে যাবে সিলেট।১৯৭২ সালে বাবার সাথে সিলেট গিয়েছিলাম। বাবার সরকারি ডিউটি ছিল। আমাদের লামাবাজারের বাড়ি তখনই প্রথম দেখা। হরিবাবু আমাদের গোটা বাড়ি ঘুরে ঘুরে দেখিয়েছেন। বাড়িতে যা যা আসবাবপত্র ছিল সবই আমার ঠাকুমার কেনা। পরে ১৯৯৯ সাল থেকে সিলেট যাওয়া শুরু হলে আমি প্রতিবার লামাবাজারের বাড়িতে হরিবাবুর সাথে দেখা করতাম। উনি প্রতিবার অনুযোগ করতেন, নিজের বাড়ি রেখে হোটেলে ওঠো কেন? হরিবাবু আমাকে গল্পচ্ছলে বলেছেন, বাবারা মাত্র পাঁচ হাজার টাকায় বাড়িটা বিক্রি করেছে ওনাকে। হরিবাবুকে বিক্রি করার অন্য একটা আবেগও ছিল। হরিবাবুর কাকা (যতীনবাবুরও কাকা,আমার রাঙাকাকা আসলে যতীনবাবুরই সহপাঠী বন্ধু) গগন চন্দ্র দে'কে আমার ঠাকুমা ধর্মের ভাই মেনেছিলেন। আমার বিধবা ঠাকুমা একক চেষ্টায় আমার ঠাকুর্দার প্রাপ্য টাকা সরকার থেকে আদায় করে এই বাড়ি করেছিলেন।নিজে দাঁড়িয়ে এই কাজে তদারকি করেছিলেন গগন চন্দ্র। ফলে হরিবাবুকে বেচাটা নিজেদের কাছে থাকাই ভেবেছিলেন হয়ত। আমি একবার মণিকাকা (আশিসপ্রসাদ)কে নিয়ে সিলেট গিয়েছিলাম একদিনের জন্য। হরিবাবু ও আমার মণিকাকার দেখা হওয়াটা সেটা একটা আলাদা গল্পের বিষয়। একদিনের মধ্যে কাকার বাল্য কৈশোর ও যৌবনের সব স্মৃতি মাখা স্থানগুলো ঘুরিয়েছি। কাকু থেকে চীৎকার করে বলে গেছে আমার মরতে আর কোনো বাধা নেই। আমি আবার সিলেট দেখে ফেলেছি। কাকার বয়স এখন ৯৩/৯৪।দেখা হলেই বলে,আরেকবার সিলেট নিয়ে যাবি? হরিবাবু ইজিচেয়ারে আধশোয়া হয়ে গল্প করতে করতে আমাকে বলেছেন,এই ইজিচেয়ার তোমার ঠাকুমার।এই যে খাটে আমি শুই সেটা তোমার জেঠুর বিয়ের খাট। শেষ করি এই মজার কথা বলে, আমার সিলেটের পরিচিতরা নিজেদের মধ্যে কথা বলার সময় কখনো কখনো ওই বাড়িটাকে ‘শুভদা তারার বাড়ি’ বলে।”

                 ৮ আগস্ট,১৯৫৫ লন্ডনে ছোট্ট অনুষ্ঠানে বিজয়া নগেশের বিয়ে হলো। তাঁকে কনে সাজাতে এসেছিলেন তখন লন্ডন প্রবাসী মঞ্জুলা রায় ও সুরভি মেহতা। মঞ্জুলা সম্পর্কে সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায়ের ছোট বোন ছিলেন।চিত্তরঞ্জন দাসের নাতনি। লন্ডনেও ছড়িয়েছিল গানের খ্যাতি। বিয়ের দিনেই দুই ভাইবোনে গান করেছিলেন। ক্রমেই এখানে ওখানেও মজলিশে যোগ দেবার সুযোগ ঘটেছিল।কিন্তু সে ততোটাও না,যে সময় কেটে যায়।সারাদিন বিজয়াকে একা বাড়ি থাকতে হয়।ফলে নগেশ তাঁকে  নানান ভাষা শেখা, হাতের কাজ শেখার ক্লাসে ঢুকিয়ে দিলেন।৪২ লেখাপড়ার পাশাপাশি ভারতীয় হাইকমিশনের একাউন্টস বিভাগে একটি ছোট্ট চাকরিও করতেন নগেশ। সেখানেই বিজয়ার জন্যেও একটি চাকরি জোটানো গেল। সেই চাকরির সুবাদে মাঝে নগেশকে ছুটি নিয়ে টানা পড়বার ব্যবস্থাও করা গেছিল।

               ঐ চাকরি করবার সময়েই একদিন নীলিমা সান্যাল খবর করে বিজয়ার অফিসে এসে হাজির। সেই নীলিমা সান্যাল যিনি আকাশবাণীতে খবর পড়ে ইতিমধ্যে খ্যাতি কুড়িয়েছেন।প্যাডিংটন হলে সরস্বতী পুজোতে গান গাইতে হবে।সেখানে গাওয়া গানের একটি ‘ওহে গৃহবাসী, খোল দ্বার খোল’ এতো জনপ্রিয় হয়েছিল যে বিবিসি থেকেও সেটি সম্প্রচারিত হয়েছিল। এরপরে বেশ কিছু সরকারি অনুষ্ঠানেও গান গাইবার নিয়মিত ডাক পড়তে শুরু করে। এরকমই গান্ধিজয়ন্তীর এক অনুষ্ঠানে হেমন্ত মুখার্জির সঙ্গে সমবেত কণ্ঠের গানে তো গলা মেলালেনই। একা ভজনও গাইলেন।৪৩ সেই অনুষ্ঠানে ভারতের রাষ্ট্রদূত বিজয়লক্ষ্মী পণ্ডিতেরও প্রশংসা কুড়িয়েছিলেন বিজয়া। মজা হচ্ছে সামান্য গায়িকা বিজয়া ও রাষ্ট্রদূত বিজয়লক্ষ্মীর বিলেতে প্রবাসকাল একই ছিল—১৯৫৫ থেকে ৬১। ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের কিংস কলেজেও বিজয়া গান করেছেন। গানের সুবাদে নিজের কার্যালয়ে কিছু সুবিধেও হচ্ছিল,ঈর্ষার পরিবেশও তৈরি হয়েছিল। তাঁর ঊর্ধ্বতন অধ্যাপক সুন্দরম যতদিন ছিলেন সুরক্ষিত ছিলেন বিজয়া। তাঁর অকাল মৃত্যুতে বিজয়ার বিভাগ বদল তথা স্থানান্তরণ  ঘটে। স্বামী-স্ত্রীতে এক জায়গাতে কাজ করাও আর হয়ে উঠেনি।

              ১৯৫৭তে নগাঁওর জামাইবাবু হিমাংশু শেখর পুরকায়স্থের মাত্র ৫১ বৎসর বয়সে অকাল মৃত্যুর সংবাদও গিয়ে তাঁর কাছে পৌঁছায়। বাবার পরে দ্বিতীয়বার যেন অভিভাবক হারালেন তাঁরা। বিজয়া নগেশ তখন জার্মানিতে আশিস প্রসাদের ওখানে ছুটি কাটাচ্ছিলেন। জামাইবাবুর মৃত্যুর  পরে সেজদি উষা পুরকায়স্থ নগাঁওর পাট তুলে হাইলাকান্দিতে চলে যান নতুন চাকরি নিয়ে।হাইলাকান্দি মহকুমা,পরে জেলার এক খ্যাতিমান শিক্ষিকা হিসেবে তিনি সেখানেই অবসর নিয়েছিলেন। ১৯৬১র আগস্টে বিবাহ বার্ষিকীর দুদিন আগে নগেশের পরীক্ষার রেজাল্ট বেরুলো। তার পরেই এরা স্বামী স্ত্রীতে জাহাজে করে দেশে ফেরেন। বিজয়াকে দূতাবাস স্থায়ী চাকরির প্রস্তাব দিয়েছিল। সেসব উপেক্ষা করেই তিনি স্বামীর সহযাত্রী হন। স্বামী মুম্বাইতে লোভনীয় চাকরি নিয়ে ফিরলেন।বিজয়া লিখেছেন,জুন মাসের কোনো এক তারিখে লিভারপুলে জাহাজঘাটিতে এসেছেন। তারিখটি সম্ভবত ভুল।৪৪  সেপ্টেম্বর নভেম্বর হওয়াই সম্ভব। দাদা রাধেশ প্রসাদ তখন লন্ডনে তাঁদের সঙ্গেই থেকে ছিলেন। তাঁকে রেখেই তাঁদের ফিরতে হয়। যে দুখুর সঙ্গে করে ছবছর আগে বিলেত গেছিলেন, সেই দুখুই মুম্বাইতে তাঁদের নিতে আসেন। তাঁর সঙ্গে পরে কলকাতা হয়ে শিলঙের লাবানের বাড়িতে যান। শিলচরের বাড়ি থেকে কনে বিদায় হয়েছিল,ছবছর পরে শিলঙের বাড়িতে বরবরণ হয় মাঙ্গলিক অনুষ্ঠান করে। এ এক আশ্চর্য যাযাবরী জীবন বটে। অসমে তখন ভাষা আন্দোলনের উত্তেজনা। এই কথাটি মনে রাখতে হবে। ব্রহ্মপুত্র উপত্যকাতে রক্তক্ষয়ী হত্যালীলা হয়ে গেছে। অসমিয়া বাঙালি দুই তরফেই লোকের করুণ মৃত্যু হয়েছে। শিলচরে ১৯শে মে-র রক্তাক্ত দাগ পড়ে গেছে। বইটির কোথাও এর উল্লেখ নেই দেখে সামান্য অস্বস্তি তো হয়ই।

                পরের বছরের মে মাসের ১৫ তারিখে কলকাতাতে একমাত্র পুত্রের জন্ম দেন বিজয়া।৪৫  অমিত চৌধুরী। যিনি কেবল প্রতিভাবান ছাত্রই হবেন না কবি,ঔপন্যাসিক এবং সঙ্গীতশিল্পী ও বিশেষজ্ঞ হয়ে আন্তর্জাতিক স্তরে খ্যাতি কুড়োবেন। তাঁর ঝুলিতে ইতিমধ্যে ২০০২ সালে সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার এসেছে। এসেছে এক দশক পরে রবীন্দ্র পুরস্কার। বাকি পুরস্কারের তালিকা অনেকটা এরকম...  ১৯৯১ সালে বেস্টি ট্রস্ক অ্যাওয়ার্ড এবং কমনওয়েলথ রাইটার্স প্রাইজ, ১৯৯৪ সালে ইনকোর পুরস্কার এবং দক্ষিণ শিল্প সাহিত্য পুরস্কার,১৯৯৯ সালে লস এঞ্জেলস টাইমস বই পুরস্কার, ২০১২ সালে সাহিত্য গবেষণায় মানবিকতার জন্য ইনফোসিস পুরস্কার।৪৬এইখানে মনে করিয়ে দেওয়া ঠিক হবে অমিতের জন্মের বছর ছিল তাঁরই আত্মীয় পূর্বপুরুষ ব্রাহ্ম আচার্য মথুরানাথ নন্দীর জন্মশতবর্ষ।

                দুবছর পরে চাকরি বদল করে ব্রিটানিয়া কোম্পানিতে চাকরি নিলেন নগেশ।চাকরি হলো কলকাতাতে। সেই কোম্পানিতে পরে প্রথম ভারতীয় ম্যানেজিং ডিরেক্টর হয়েছিলেন নগেশ চৌধুরী।৪৭ কলকাতাতে এসে এবারে সেই দেড় দশক আগে দিলীপ রায়ের দেখানো স্বপ্ন চাগিয়ে উঠল। খুবই স্বাভাবিক। দেবব্রত বিশ্বাসের ছাত্রী হলেন বিজয়া।৪৮ মাসখানিক পরে দেবব্রত বিশ্বাসের শেখাবার পদ্ধতিতে ক্ষুণ্ণ হয়ে একবার যাওয়া ছেড়ে দিয়েছিলেন। পরে দেবব্রত নিজে এসে আবার শেখানো পাকা করে গেলেন।৪৯তখনই একদিন গান রেকর্ড করাবার ইচ্ছে জানালেন। দেবব্রত সন্তোষ সেনগুপ্তের কাছে যাবার প্রস্তাব দিলেন।তিনি তখন এইচ এম ভিতে যুক্ত ছিলেন। ক্রমে সন্তোষ সেনগুপ্তেরও ছাত্রী হলেন বিজয়া। তিনি বাড়িতে এসেও শেখাতে শুরু করলেন। কিন্তু রেকর্ড করবার সুযোগ সহজে আসে নি। তার জন্যে সেইদিন অব্দি অপেক্ষা করতে হলো যতদিনে তিনি রেকর্ড কোম্পানির শিল্পী নির্বাচনের দায়িত্বে এলেন এবং বিজয়াকে দিয়ে ‘বউনি’ করলেন।৫০দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়ের পরিচালনাতে দুটি রবীন্দ্র সঙ্গীত শেষে রেকর্ড হলো।গান দুটি ছিল ‘সন্ধ্যা হোল গো’ এবং ‘দুখের বেশে এসেছো বলে, তোমায় নাহি ডরিব হে’। সন ১৯৬৫। তখন তাঁর বয়স চল্লিশ।গানের রিহার্সালে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়,চিন্ময় চট্টোপাধ্যায়ও উপস্থিত ছিলেন। প্রত্যেকেই প্রশংসা করলেন। পরে কাগজে সপ্রশংস আলোচনাও বেরুলো। কিন্তু যে জন্যে বাংলা গানের জগতে বহু নিষ্ঠা ও সাধনার পরেও তাঁর নামটি বহুচেনা হয়ে উঠতে পারল না—তার বড় কারণ এই যাযাবরী জীবন। রেকর্ডটি বাজারে বেরুবার আগেই নগেশের চাকরি বদল হয় মুম্বাইতে, আর তিনিও সঙ্গে চলে গেলেন।

                বিজয়ার জায়গাতে অন্য যে কেউ হলে এতে গান ছেড়েই দিতেন। এভাবে কিছু হয়? কিন্তু তিনি মুম্বাই গিয়ে শুরু করলেন ইউনুস মালিকের কাছে হিন্দি ভজন শেখা। ইচ্ছে হলো ‘বোম্বে’ বেতারে গান করবেন। অডিশনের সর্ত ছিল ১৮টি গান শুদ্ধ উচ্চারণে গাইতে হবে। তিনি সেই অসাধ্য সাধন করলেন। বছর কয় নিয়মিত মুম্বাইর বেতারে তাঁর হিন্দি ভজন সম্প্রচারিত হলো। মাঝে মধ্যে কলকাতা গেলে দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে দেখা হলেই কলকাতা না থাকবার জন্যে আক্ষেপ করতেন।৫১  মুম্বাইতে ছিলেন । নিয়মিত বেতারে গাইছেন। কখানা গানের রেকর্ডও হয়েছে।অথচ চলচ্চিত্রে গান গাইবার চেষ্টা করেছেন---এমন কোনো সংবাদ নেই। সামান্য উল্লেখও নেই।এই ঔদাসীন্য যে কোনো আমাদের মতো পাঠককে ভাবায় বটে। অথচ তিনটি দশক তিনি মুম্বাইতে ছিলেন।তাঁর সঙ্গে সঙ্গে গানে সাহিত্যে হাত পাকাচ্ছিল শিশু অমিত। আদর করে বাবা যার নাম রেখেছিলেন টুপলু। কলকাতা বাড়িতেই নিজের ইচ্ছে মতো বাজিয়ে সে গ্রামোফোনের বারোটা বাজিয়েছে। মুম্বাইতে মা আবিষ্কার করলেন,ছেলে সেই বয়সেই মুখে মুখে ছড়া তৈরি করছে। সেগুলো বিজয়া টুকে নিতে শুরু করলেন। বড় হতে গিটার হাতে ইংরেজি গান করতে শুরু করে,চেষ্টা করেও মা বাংলা গাওয়াতে পারেন নি।এক সময় বেতারে যুববাণীতেও নির্বাচিত হয়ে গাইতে শুরু করে। ও পি নাইয়ারের মতো সঙ্গীতজ্ঞ তাঁর গান শুনে প্রশংসা করে বলেছিলেন,একদিন পাশ্চাত্য সঙ্গীতে বিশ্বজুড়া নাম হবে।৫২ বহু সময় মায়ে ছেলেতেও একত্র অনুষ্ঠান করেছেন।কবিতাও লেখেনঅমিত।‘ইলাস্ট্রেটেড উইকলি’র মতো কাগজে কবিতা বেরোতেও শুরু করে। সেই বয়সেও বিজয়া গান শেখা ছাড়েন নি। মাঝে বহুদিন ইউনুস মালিকের কাছে শেখা ছেড়ে দিয়েছিলেন। কে মহাবীর বলেও একজনের কাছে কিছু দিন শিখেছিলেন,তিনিও স্বাস্থ্যের জন্যে আসেন না। বিজয়ার শিক্ষক সন্ধান তাতে থামে নি। দূরদর্শনে একদিন গোবিন্দ প্রসাদ জয়পুরওয়ালার গজল শুনে চমৎকৃত হয়ে তাঁকেই শিক্ষক রাখবেন ঠিক করেন।তখন বিজয়াকে হিন্দি শেখাচ্ছিলেন রাজেশ জোহরি।তিনি গোবিন্দ প্রসাদকে জানতেন,নিয়ে আসেন বাড়িতে। সন্তোষ সেনগুপ্তের সঙ্গেও বিজয়ার যোগাযোগ ছিল। মাঝে মধ্যে মুম্বাইর বাড়িতে গিয়ে হাজির হতেন।তখন যতটা পারতেন রবীন্দ্র সঙ্গীত শেখাতেনও। একদিকে গোবিন্দজীর শাস্ত্রীয় সঙ্গীত আর দিকে সন্তোষ সেনগুপ্তের রবীন্দ্র সঙ্গীত শুনে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের প্রতি ঝোঁক বেড়ে যায় অমিতের।সেই ঝোঁক তাঁর আজ অব্দি অক্ষত।এখন তিনিও ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে একটি আলোচিত নাম।অমিতের বয়স তখন আঠেরো। বছর তিনেক পরে অমিত বিলেতে যান ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতক শ্রেণিতে পড়তে। কথা ছিল তাঁকে ওখানে রেখে বাবা-মা দুজনেই ফিরতে আসবেন। কিন্তু সেটি আর হয়ে উঠে নি। বিজয়াকে দ্বিতীয়বার বিলেত প্রবাসী হয়ে ছেলের সঙ্গে থেকে যেতে হয়।আগের বারের চাইতে কষ্টকঠিন ছিল এই দ্বিতীয়বারের প্রবাস জীবন।সেই সব কষ্টের মধ্যেও অমিতের শাস্ত্রীয় সঙ্গীত অনুশীলনে একটি দিনের জন্যেও ভাটা পড়ে নি। পরীক্ষার দিনেও অনুশীলন করে যেতে ভুলেন নি।সেবারে লন্ডনে থাকতেই ‘ভবনীতা’ বলে এক গানের রেকর্ডের দোকানে তিনি আবিষ্কার করেন নিজের দু’খানা হিন্দি গানের রেকর্ড—‘ভক্তিধারা’ ও ‘ভক্তিনিবেদন’।দুটিতেই সুরসংযোজন করেছিলেন গোবিন্দ প্রসাদ। নির্দেশনাও এবং ব্যবস্থাপনাও তাঁরই ছিল।৫৩ কিন্তু রেকর্ড বের করবার প্রথম তাড়াটি ছিল ছেলে অমিতের। এর মধ্যে দ্বিতীয়টি যখন বেরোয়, সেই প্রথম রবীন্দ্র সঙ্গীতের রেকর্ডের মতো তিনি মুম্বাইতে নেই। সেই দোকানেই রেকর্ডটি প্রথম চোখে দেখা।৫৪তৃতীয় আরেকখানা বেরিয়েছিল ‘ভক্তিগুঞ্জন। কিন্তু সেটি আর লং প্লেয়িং রেকর্ড নয়,ততদিনে প্রযুক্তি পালটে গেছে।ক্যাসেট এসে গেছে। ক্যাসেটটি উন্মোচিত হয়েছিল তাজমহল হোটেলে।অনুষ্ঠানে পৌরোহিত্য করেছিলেন পণ্ডিত যশরাজ।এর পরে গোবিন্দপ্রসাদকেও অকালে হারাতে হয়। মাত্র ছেচল্লিশ বছর বয়সে এই শিল্পী মারা যান।৫৫  মা-ছেলে দুজনের কাছেই সে ছিল আত্মীয়বিয়োগের মতো বেদনাদায়ক ঘটনা।

               স্নাতক অমিত অক্সফোর্ডে ডি ফিল করবার সুযোগ পান। সেই গবেষণার কাজ করতে করতেই উপন্যাস লেখার সাধ জাগল। লিখলেন এবং ১৯৯০র মে মাসে ছাত্রাবস্থাতেই তাঁর ‘A Strange and Sumlime Address’ নামে আত্মজৈবনিক উপন্যাসটির জন্যে বেস্টি ট্রস্ক পুরস্কারে সম্মানিত হলেন।পুরস্কার মূল্য ছিল ১০ হাজার পাউন্ড। সেই পুরস্কার গ্রহণ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন নগেশ ও বিজয়া। কিন্তু ইতিমধ্যে নগেশ অবসর নেন।তাঁদের আড়াই দশকের বেশি মুম্বাই প্রবাস কাটিয়ে কলকাতা চলে এসেছেন। তখন ১৯৮৯। ১৯৯১র ডিসেম্বরে অমিত সহপাঠী রিঙ্কা তথা  রসিঙ্কা চৌধুরীকে বিয়ে করেন। যিনি নিজেও সাহিত্য সমালোচক এবং ঐতিহাসিক হিসেবে সুপরিচিত নাম।

               মুম্বাইতে থাকতে থাকতেই পরিকল্পনা করছিলেন,এবারে কলকাতা থেকে রবীন্দ্র সঙ্গীতের রেকর্ড করবেন। এসে করলেন। নজরুল গীতিরও একখানা রেকর্ড বের করেন। সেই সঙ্গে কলকাতা বেতারে এবং দিল্লি বেতারের ‘বিবিধ ভারতী’তে, ততদিনে দেখা দেওয়া বিভিন্ন এম এম চ্যানেলেও তাঁর গান নিয়মিত শুনা যেতে শুরু করল। তিনি গোটা দেশে পরিচিত নাম হয়ে উঠলেন। জীবনের সপ্তম দশকে তিনি পৌঁছে গেছেন ততদিনে।

                 অবসরের পরে স্বামী স্ত্রীতে একটি ভুল সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছিলেন।পন্ডিচেরি অরবিন্দ আশ্রমে গিয়ে বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেবার। ভুল এর জন্যে যে তবে তো আর নতুন সহস্রাব্দের দ্বিতীয় দশকে তাঁকে শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায়রা বা মৌসুমী ভৌমিকেরা নতুন করে আবিষ্কার করতে পারতেন না। সেই যাওয়া হলো না, অমিতের একমাত্র কন্যা রাধার টানে। যার পোশাকি নাম অরুণা। অমিত রিঙ্কার বিয়ের বেশ কিছু বছর পরে সে জন্মায় ১৯৯৮তে৫৬  এবং সেও উত্তরাধিকারের সম্মানে ভালো গান করে। সেই কথা মেয়ের ঠাকুমা লেখেন নি। তিনি যখন ‘আত্মকথা’ লিখছেন অরুণা তখন নিতান্তই শিশু।

       
      বইটির একটি ছোট্ট ভূমিকা লিখেছেন অমিত। আমরা দ্বিমত প্রকাশের কোনো কারণ দেখিনি যখন তিনি লেখেন, “Life has given my mother a great deal, but not, I think, the wider recognition that a women of her great gifts in music and of her moral courage and intelligence deserves, and which,I believe, might have been hers if she'd spent the first quarter of her life in more fortunate circumstances. But hers is not a story of neglect, but of a flowering: not just of a women, but of a human being, and of other human beings around her. This book, for me, is not only about the life of a woman,but is an extraordinary record of human interrelationships over time.” জীবনে তিনি বহু শিক্ষকের কাছে গান শিখেছেন বটে,কিন্তু তাঁর শেখা তো শুরু হয়েছিল পরিবার পরিজনের থেকে। সেই পরিজন তাঁকে উড়বার এক বিস্তৃত আকাশ দিয়েছেন যেমন,তেমনি দিয়েছে বিশ্রামের নীড়। সেই পরিজনকে ছেড়ে তিনি কোনো ভিন্ন নীড়ের সন্ধান করেন নি,যা হতে পারত ‘more fortunate circumstances’।কিন্তু কোনো ‘circumstances’-এই তিনি লক্ষ্যচ্যুত হন নি। গান শেখা,অভ্যাস করা ছাড়েন নি। এমন কি একসময় তো রেওয়াজ করছেন কি না এর তদারকি তরুণ সন্তান করছে। যে কোনো শিক্ষানবিশের কাছে শুধু সেজন্যেই তিনি হতে পারেন আদর্শস্বরূপা।

               ‘নীড়’ শব্দটি আমরা লিখলাম,কেননা পাখিরই মতো বিজয়ার কোনো স্থায়ী বাসা ছিল না।জীবনে কত বাসা পালটেছেন সেও মনোযোগ দিয়ে অধ্যয়ন করলে,সংখ্যাটি দুই অঙ্কেও বেশ বড় হবে। আর তাই জীবনের আটটি দশক যিনি বিশ্বজুড়ে গান করে কাটিয়েছেন তাঁকে আমাদের মতো সাধারণ বাংলা গানের তথা রবীন্দ্রসঙ্গীতের শ্রোতারা শুনেছেন কম, চিনেছেন তার চাইতেও কম।ছেলেবেলাতে রেনুকা দাসগুপ্তের গলাতে তিনি বহু গানের সঙ্গে এই রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনেছিলেন,“তোমার  সুরের ধারা ঝরে যেথায় তারি পারে/দেবে কি গো বাসা আমায় একটি ধারে?।/আমি শুনব ধ্বনি কানে,/আমি ভরব ধ্বনি প্রাণে,/সেই ধ্বনিতে চিত্তবীণায় তার বাঁধিব বারে বারে ॥/আমার নীরব বেলা সেই তোমারি সুরে সুরে/ ফুলের ভিতর মধুর মতো উঠবে পুরে।/আমার দিন ফুরাবে যবে,/যখন রাত্রি আঁধার হবে,/হৃদয়ে মোর গানের তারা উঠবে ফুটে সারে সারে।”মা শৈলবালা তাঁকে বলেছিলেন,গানটি তিনি ঠিক রেণুকার মতোই গাইতে পারেন কিনা চেষ্টা করে দেখতে। দেখেছিলেন বিজয়া।৫৭ মা প্রশংসাও করেছিলেন। কিন্তু গানে গানে রবীন্দ্রভাবকেও কি প্রাণে ভরেছিলেন বিজয়া? এই গানটিতে তাঁর ‘আত্মকথা’র সারাৎসার ধরা রয়েছে। বিজয়া সেটি খেয়াল করেন নি,করলে লিখতেন।রবীন্দ্রনাথের গান কানে শুনে প্রাণে ভরেছিলেন বিজয়া চৌধুরী।

              এমন বহু কথাই বিজয়া লিখতে পারতেন। লেখেন নি। চিঠিপত্রের বেশি তিনি কিছু লেখেন নি। নিতান্ত ছেলে অমিত এবং ছেলের স্ত্রী রিঙ্কার অনুরোধে স্মৃতি কথা লিখতে বসেছিলেন। আর পাঠক হিসেবে মনের ভেতরে ছিলেন কেবল তাঁরা এবং নাতিনাতনিরা।৫৮  ফলে বাবা-মায়ের নামই উল্লেখ করতে ভুলে গেছেন। ভাই বোনেদের নামেরও সর্বত্র উল্লেখ নেই। আমাদের সেই সব ভাইপো শুভপ্রসাদ  এবং তাঁর কন্যা শবনম সুরিতা ডানাকে জিজ্ঞেস করে জানতে হয়েছে। এমন কি নিজের গানের সংকলনের কথাও সবটা উল্লেখ করেন নি,অনুষ্ঠানাদি তো নিশ্চয়ই বাদ পড়েছে। তাঁর আত্মকাহিনি পড়ে আমাদের মনে হয়েছিল রবীন্দ্র গানের রেকর্ড তো তিনি সেই ১৯৬৫তেই একখানা করেছেন, তারপরে তো হিন্দি ভজনেরই সংকলন তিনখানা। শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায় উল্লেখ করেছেন ২০১২র ‘বিহান মিউজিক’ প্রকাশিত সংকলনটির আগের বছরেও একটি সিডি বেরিয়েছিল যেটি কিনা আসলে আটখানা গ্রামোফোন রেকর্ডের সিডি রূপান্তর।সেই রেকর্ডগুলো প্রকাশিত হয় যথাক্রমে ১৯৬৫,১৯৬৭,১৯৭২, ১৯৭৭,১৯৭৮,১৯৮০। এর মধ্যে ১৯৮০তেই তিনখানা।রবীন্দ্র সংগীতের এতোগুলো রেকর্ড করেছেন। বিশ্বভারতীর সঙ্গে নিশ্চয় যোগাযোগ হয়েছিল। না হলে কেন নেই,সেই সব সংবাদও নেই।বইটি প্রকাশ করেছেন ‘অনুষ্টুপ’ ২০০৪ সালে।অনুষ্টুপ পত্রিকাতেই ‘স্মৃতিগুচ্ছ’ শিরোনামে লেখাগুলো প্রকাশিত হচ্ছিল। এঁদের গবেষণা নিবন্ধ প্রকাশ করবার খ্যাতি আছে। শুভপ্রসাদ জানিয়েছেন, তাঁর বাল্যবান্ধবী সুরমা ঘটকের প্রেরণাতেই লেখাগুলো বই আকারে প্রকাশিত হয়। সুরমা ঘটকের অন্তত তিনখানা আত্মজৈবনিক রচনার কথা আমরা জানি--- ‘সুরমা নদীর দেশে’,‘শিলং জেলের ডায়েরি’ ও ‘ঋত্বিক,পদ্মা থেকে তিতাস।’ তিনি বা অনুষ্টুপ সম্পাদক কিছু টীকাভাষ্যও বইটিতে জুড়ে দেবার কথা ভাবতে পারতেন। আশা করছি, পরবর্তী কোনো সংস্করণে সেটি হবে।আমাদের বইখানার নাম নিয়েও কিছু বলবার আছে।তাঁর জন্মকালে তো  সিলেট অসমেরই অংশ ছিল। জন্মও অসমেই হয়েছে। জীবনের একটি বড় অংশ কেটেছেও এখানে। তবে কি বইটির নাম হতে পারত না ‘অসম কন্যার আত্মকথা’? এটি একটি দ্বিমুখী প্রত্যাখ্যানের আখ্যান। অসমিয়া না হলে অসমিয়া জাতীয়তাবাদী মনও কাউকে অসমের সন্তান বলে সহজে স্বীকার করে না। তেমনি বাঙালি মধ্যবিত্তেরও একটি প্রবণতা আছে, নিজেদের অসমে ‘প্রবাসী’ ভাবার। আর সিলেটিদের তো অবশ্যই একটি অভিমানও আছে। হিন্দিতে ‘অভিমান’ অর্থ কখনো ‘গৌরব’ কিংবা ‘দম্ভ’ও হয়। সিলেটিদের মনে এই দুই অর্থই ক্রিয়াশীল থাকে। তার ঐতিহাসিক কারণও রয়েছে নিশ্চয়। প্রথমত ব্রিটিশ ভারতে জোর করে সিলেটকে অসমে নিয়ে আসা, এবং দেশভাগের কালে অসমিয়া জাতীয়তাবাদী শাসকশ্রেণির  একে জোর করে অসমের বাইরে ঠেলে দেবার চেষ্টা করা।ফলে অবচেতনে নির্বাসিতা ‘সিলেট’কে ধরে রাখবার বিপরীতে অসমকে প্রত্যাখ্যানের একটি মনস্তত্ত্ব সিলেটি মনেও কাজ করে। বৌদ্ধিক জগতেও দেখা যাবে  সিলেট কিংবা এরই সম্প্রসারিত অঞ্চল  কাছাড় তথা এখনকার বরাকউপত্যকা নিয়ে যত অধ্যয়ন হয়ে থাকে বাকি অসম এমন কি বাঙালি জীবন নিয়েও কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে অধ্যয়ন অনুসন্ধিৎসা সময় যত এগুচ্ছে আর সেরকম সমানুপাতিক নয়,কমে আসছে।এর নানা সমস্যাও আছে নিশ্চয়।সব বৌদ্ধিক অনুশীলনকেই ‘অসমিয়া জাতীয়তাবাদের’ অনুমোদন লাভের একটি অলিখিত সামাজিক নিয়ম রয়েছে।কিন্তু এ বাঙালির বৌদ্ধিক নিম্নগামীতারও দ্যোতক বটে। শিবসাগরের জাতিকা বিজয়া তাই উজান অসমেও একটি অচেনা নাম। আমরা যাদের থেকে তাঁর সম্পর্কিত তথ্যগুলো সংগ্রহ করলাম---এদের সবারই কিন্তু কোনো না কোনো ভাবে সিলেটি এবং বিভাগ পরবর্তী বরাক উপত্যকাতে শেকড় ছড়ানো।

             সেরকমই এক  অধ্যাপক রত্নদীপ পুরকায়স্থ, যিনি ডিগবয় কলেজে বাংলা পড়ান,আমাদের আরো দুটি সংকলনের প্রচ্ছদ পাঠিয়েছেন যেগুলো রবীন্দ্র জন্মের একশত পঁচিশ বছরে ১৯৮৫তে বেরিয়েছিল।এর একটি প্রকাশ করে‘মিউজিক ইণ্ডিয়া’। দুই পৃষ্ঠাতে মোট বারোটি গান রয়েছে।সঙ্গীত নির্দেশক ছিলেন সুবিনয় রায়। অন্যটি প্রকাশ করে ‘মালটি সাউন্ড’। সঙ্গীত নির্দেশক ছিলেন অর্ঘ্য সেন।এই দ্বিতীয় সংকলনে ছোট্ট দুটি ভূমিকা লিখেছেন আরেক অসম তথা সিলেট সন্তান অমিতাভ চৌধুরী এবং দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়।সন্তোষ সেনগুপ্তের বিশিষ্ট ছাত্রী বলে পরিচয় দিয়ে অমিতাভ লিখছেন,“রবীন্দ্রনাথ বলতেন,তোমরা আমার গানে একটু ভাব দিও,একটু দরদ দিও। সেই দরদ শ্রীমতী চৌধুরীর গলায় ও গাওয়ার ধরণে স্পষ্ট। তিনি রবীন্দ্র সঙ্গীত গেয়ে আসছেন বেশ কিছু কাল।এই রেকর্ডে একসঙ্গে যুক্ত হল এমন কিছু গান, যা নানা মেজাজের, নানা ভাবনার। সব মিলিয়ে আছে একটি সুর।গায়িকার কণ্ঠে সেই সুর ধ্বনিত হয়েছে রসের ব্যঞ্জনা দিয়ে।গানগুলিতে তিনি নিজেকে জাহির করেন নি,রবীন্দ্রনাথকে তুলে ধরেছেন নিষ্ঠায় যত্নে ও মাধুর্যে...।” দ্বিজেন মুখোপাধ্যায় লিখেছেন,“রবীন্দ্রসঙ্গীতের ক্ষেত্রে যেসব গুণ থাকার দরুন শিল্পী তার পূর্ণতার বিকাশ লাভ করে, শ্রীমতী বিজয়া চৌধুরী সেই জাতের একজন শিল্পী। উদাত্ত কণ্ঠ, স্পষ্ট উচ্চারণ এবং চমৎকার গায়ন পদ্ধতি,শ্রীমতী চৌধুরীকে পৌঁছে দেবে পূর্ণতার শেষ ধাপে। গায়ন রীতি ও কণ্ঠের মাধুর্য্যে যেমন তিনি নিজস্বতার সাক্ষ্য বহন করেন, তেমনি রবীন্দ্র সংগীতের পূর্ব্বসূরীদের কণ্ঠ ও গায়ন রীতির কিছু কিছু সাদৃশ্য ও তাঁর গানে লক্ষ্যণীয়।...”

        
  শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায় ‘বিহান’ প্রকাশিত সিডির নামের উল্লেখ করেন নি। সেটি আমরা পেলাম প্রথমে আনন্দবাজার পত্রিকার ২৮শে বৈশাখ, ১৪১৯, ১১ মে ২০১২তে সংবাদে। সেখানে লেখা আছে, “উইভার্সঃ ৬-৩০। বিজয়া চৌধুরীর সিডি ‘দি ইনকম্প্যারেব্ল বিজয়া চৌধুরী: সংস অফ টেগোর' প্রকাশ। থাকবেন উৎপলকুমার বসু, শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ।”৫৯ পরের মাসে ৪ জুন,২০১২ তে একই পত্রিকা সংবাদ দিচ্ছে,“প্রায় আশি বছর বয়স হল সেই সিলেট-কন্যার। গানের ভুবনে কিঞ্চিৎ আড়ালেই থাকা সেই কন্যা বিজয়া চৗধুরী খবরে এলেন আবার। সম্প্রতি উইভার্স স্টুডিয়োয় প্রকাশিত হল তাঁর রবীন্দ্রসঙ্গীতের সিডি ‘দি ইনকম্পেয়ারেবল বিজয়া চৌধুরী: সংস অব টেগোর’-এর (বিহান মিউজিক)। সুচিত্রা মিত্র ও কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সমকালীন এই শিল্পী নজরুলগীত।অতুলপ্রসাদের গান এবং হিন্দি ভজনেও স্মরণীয়। ...তাঁর পুত্র লেখক অমিত চৗধুরী বলেছেন,‘আমার মা আর সুবিনয় রায় নির্লিপ্ত এক ভঙ্গিতে, ব্যক্তিগত আবেগ দিয়ে ভরিয়ে না তুলে রবীন্দ্র সঙ্গীত গাইতেন। সেই ধারা ব্যতিক্রমী, সন্দেহ নেই।”৬০ তাঁর অতুল প্রসাদের গানের রেকর্ড বা সিডি কবে প্রকাশ পেয়েছে আমরা কোনো সূত্রেই বের করতে পারিনি। হয়তো বেতারে বা অনুষ্ঠানগুলোতেই তা সীমাবদ্ধ ছিল। নজরুলগীতির সংবাদ পাচ্ছি আনন্দবাজারেরই ১১ জুলাই, ২০১৬ সংখ্যাতে।সেখানে লেখা হচ্ছে,“উৎপলকুমার বসু অমিত চৌধুরীকে বলেছিলেন,‘এত দিন রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী তিন জন আছে জানতাম— কণিকা সুচিত্রা নীলিমা। তোমার মা-র গান শোনার পর বুঝলাম তিন জন নয়, চার জন!’ ... দিলীপ রায়ের সঙ্গেও তিনি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গেয়েছেন। ১৯৫৫-’৬১ ছিলেন লন্ডনে। ১৯৬৪ থেকে মুম্বাইয়ে। লিখেছেন আত্মজীবনী সিলেট কন্যার আত্মকথা।এখন কলকাতায়।সন্তোষ সেনগুপ্ত-র কাছে রবীন্দ্রসংগীতের তালিম।তাঁরই সহায়তায় ১৯৬৫-তে এইচ এম ভি থেকে প্রথম রেকর্ড। সম্প্রতি, নবতিপর শিল্পীর ১৯৮০-’৯০-এ রেকর্ড করা ‘রবীন্দ্রনাথ ও কাজী নজরুলের গান’ শীর্ষক দুটো সিডি প্রকাশিত হল বিহান মিউজিক থেকে।”৬১ ২০১৬তে প্রকাশিত সেই সিডির গানগুলো আমাদের শুনবার সৌভাগ্য হয়ে গেল Music India Online(MIO) ওয়েবসাইটে। সাঁইত্রিশটি গানের সংকলন। এর তেরোটি নজরুল গীতি, বাকিগুলো রবীন্দ্রসঙ্গীত।৬২ তিনি কোথাও কোনো পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছেন বলে সংবাদ নেই। কিন্তু জীবনের শেষ বেলাতে এসে বাংলার এক প্রধান কবি উৎপল কুমার বসু তাঁকে রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রধান তিন শিল্পীর পাশে চতুর্থ বলে সম্মানিত করেন তখন জীবনের প্রাপ্তির পাত্র আর অপূর্ণ থাকে না বটে।অন্তত কলকাতা মহানগরের সঙ্গীতমহল তাঁকে স্মরণে রেখেছে। তাই দেখছি প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতেও গুণীজনে সমবেত হচ্ছেন তাঁর স্মরণে। আনন্দবাজারের সংবাদে ১৬ জুলাই, ২০১৭তে জানাচ্ছে, “...সুচিত্রা মিত্র ও কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়দের সমকালীন তিনি নজরুলগীতি, অতুলপ্রসাদের গান এবং হিন্দি ভজনেও স্মরণীয়। ... এ বার তাঁর প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে ২০ জুলাই সন্ধে সাড়ে ৬টায় উইভার্স স্টুডিয়োয় তাঁকে নিয়ে আলোচনা ও এক সংগীতানুষ্ঠানের আয়োজন হয়েছ।থাকবেন মৌসুমী ভৌমিক, শঙ্করলাল ভট্টাচার্য, শুভপ্রসাদ নন্দী মজুমদার, মীনা বন্দ্যোপাধ্যায়, অমিত চৌধুরী ও অরুণা চৌধুরী।”৬৩  ইতিমধ্যে শিলং শিলচর হয়ে রবীন্দ্রসঙ্গীতে ‘মহানাগরিক’ শুভপ্রসাদ নন্দীমজুমদার তাঁরই ভাইপো--- পরমেশপ্রসাদের সন্তান আমরা আগেই লিখেছি।

 

তথ্যসূত্র :

১) শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায়;রবীন্দ্রনাথের গান : একটি ব্যক্তিগত প্রতিবেদন;অনুষ্টুপ, শারদীয় ২০১৪ সংখ্যা,সম্পাদক অনিল

    ;পৃ:৩৬২।

২) প্রাগুক্ত; পৃ:৩৬২।

৩) প্রাগুক্ত; পৃ:৩৬৭।

৪) প্রাগুক্ত; পৃ:৩৬৬।

৫) রকমারি ডট অর্গ;https://www.rokomari.com/book/44247/rannagharer-satkahan .

৬) Bijoya Chaudhuri - Eso Nipabane (Tagore); Album:Bhuban- Jora Asankhani;Amit

    Choudhury Yoy Tube Channel; https://www.youtube.com/watch?v=cqxwLr_p3vo .

৭); সিলেট কন্যার আত্মকাহিনি; অনুষ্টুপ; কলকাতা-০৯; জানুয়ারি, ২০০৮; পৃ:২০।

৮ ) প্রাগুক্ত; পৃ:৭৩।

৯), উত্তরাংশ;অচ্যুতচরণ চৌধুরী তত্ত্বনিধি;কথা; কলকাতা,৪৭;২০১০; পৃ:৩১৭।

১০) সুকুমার সেন; বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস; আনন্দ পাবলিশার্স লিমিটেড; কলকাতা ৯;আনন্দসংস্করণ, দ্বিতীয় মুদ্রণ,

      ;পৃ:১০৩।

১১) প্রাগুক্ত; পৃ: ৩৬৯)

১২) অমলেন্দু ভট্টাচার্য, জহরকান্তি সেন; ভূমিকা;বীরাঙ্গনা পত্রোত্তর কাব্য; রাম কুমার নন্দী মজুমদার; North Eastern Centre for Advanced Studies; Silchar; ১৪০২;পৃ:১।

১৩) অমলেন্দু ভট্টাচার্য; সুরমা-বরাক উপত্যকা বিষয়ক গ্রন্থ; শ্রীহট্ট কাছাড়ের প্রাচীন ইতিহাস ও সংস্কৃতির রূপরেখা; সম্পাদনা

     , সুনির্মল দত্ত চৌধুরী, অমলেন্দু ভট্টাচার্য, মানবেন্দ্র ভট্টাচার্য; রবীন্দ্র স্মৃতি গ্রন্থাগার, শিলং ও বঙ্গীয়

     ,শিলং শাখা;শিলং; ১৯৯৬; পৃ:৩৮১।

১৪) আবদুল মুকীত চৌধুরী;বাংলা কাব্য-সাহিত্যে মানবাধিকার ও সাম্য- ৩য় পর্ব;

      http://alhassanain.org/bengali/?com=content&id=385

১৫) বিজয়া চৌধুরী; সিলেট কন্যার আত্মকাহিনি;প্রাগুক্ত;পৃ:৪১।

১৬) উষারঞ্জন ভট্টাচার্য; উত্তর-পূর্বভারতে রবীন্দ্রচর্চা; আনন্দ পাবলিশার্স; কলকাতা; ডিসেম্বর,২০১১; পৃঃ২০১।

১৭) শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায়;প্রাগুক্ত;পৃ:৩৬৭ ।

১৮) বিজয়া চৌধুরী;প্রাগুক্ত;পৃ:১৮।

১৯) প্রাগুক্ত;পৃ:২৫।

২০) প্রাগুক্ত;পৃ:২৬।

২১) প্রাগুক্ত;পৃ: ৩৬।

২২) প্রাগুক্ত;পৃ: ৪৯।

২৩) প্রাগুক্ত;পৃ:৫১।

২৪);পৃ:৬৬।

২৫) প্রাগুক্ত;পৃ:৬৮।

২৬) প্রাগুক্ত;পৃ:৫১।

২৭) প্রাগুক্ত;পৃ:৫৩।

২৮) প্রাগুক্ত;পৃ:৫৫।

২৯) প্রাগুক্ত;পৃ:৬৮।

৩০) প্রাগুক্ত;পৃ:৭৯।

৩১) প্রাগুক্ত;পৃ:৭১-৭২।

৩২) প্রাগুক্ত;পৃ:৮২।

৩৩)প্রাগুক্ত;পৃ:৬৩।

৩৪)প্রাগুক্ত;পৃ:৬৩।

৩৫) প্রাগুক্ত;পৃ:৭৫।

৩৬) শতবর্ষেও উপেক্ষিত পথ নাটকের জনক; ১৯৯৩তে ডঃ সঞ্জয় গাঙুলির নেয়া সাক্ষাৎকার; নাট্যমেব জয়তে পত্রিকা;

      , ২০১৯; https://natyamebo.blogspot.com/2019/09/blog-post_3.html

৩৭) বিজয়া চৌধুরী;প্রাগুক্ত;৭৯।

৩৮) প্রাগুক্ত;পৃ:৭৪।

৩৯) প্রাগুক্ত;পৃ: ৮৮।

৪০) প্রাগুক্ত;পৃ:৯১।

৪১) প্রাগুক্ত;পৃ: ৯৬।

৪২) প্রাগুক্ত;পৃ:১০৭।

৪৩) প্রাগুক্ত;পৃ:১১৮।

৪৪) প্রাগুক্ত;পৃ:১২৪।

৪৫) প্রাগুক্ত;পৃ:১২৮।

৪৬) অমিত চৌধুরী; উইকিপিডিয়া;https://bn.wikipedia.org/wiki/অমিত_চৌধুরী।

৪৭) বিজয়া চৌধুরী;প্রাগুক্ত;১৫১।

৪৮) প্রাগুক্ত;পৃ:১৩১।

৪৯) প্রাগুক্ত;পৃ:১৩২।

৫০) প্রাগুক্ত;পৃ:১৩৪।

৫১) প্রাগুক্ত;পৃ:১৩৬।

৫২) প্রাগুক্ত;পৃ:১৫৯।

৫৩) প্রাগুক্ত;পৃ:১৭৬।

৫৪) প্রাগুক্ত;পৃ:১৬৬।

৫৫);পৃ:১৭৬।

৫৬) প্রাগুক্ত;পৃ: ১৯১-৯২।

৫৭) প্রাগুক্ত;পৃ:৫২।

৫৮) প্রাগুক্ত;পৃ: ১৭।

৫৯) কলকাতা-কোথায় কী;আনন্দবাজার পত্রিকা;২৮ বৈশাখ ১৪১৯ শুক্রবার ১১ মে

      ২০১২;http://archives.anandabazar.com/archive/1120511/kothae.html

৬০);আনন্দবাজার পত্রিকা;২১ জ্যৈষ্ঠ ১৪১৯ সোমবার ৪ জুন

       ২০১২;http://archives.anandabazar.com/archive/1120604/4karcha.html

৬১) কলকাতার কড়চা;আনন্দবাজার পত্রিকা;১১ জুলাই,২০১৬;

      https://www.anandabazar.com/supplementary/kolkatakorcha/kolkata-korcha-1.431766

৬২) রবীন্দ্রনাথ ও কাজী নজরুলের গান; বিজয়া চৌধুরী; Music India Online(MIO);

https://mio.to/album/Bijoya+Chaudhuri/Rabindranath+O+Kaji+Nazruler+Gaan+%282016%29

৬৩) কলকাতার কড়চা;আনন্দবাজার পত্রিকা;১৭ জুলাই, ২০১৭;https://www.anandabazar.com/calcutta/kolkatar-korcha-1.643415

                                                  *            *            *

 লেখাটি নিয়ে একটি চিঠি হাতে লিখে পাঠিয়েছেন অধ্যাপক উষারঞ্জন ভট্টাচার্য। তিনি আক্ষেপ করেছেন, লিখবার সময় আমি কেন ফোন করিনি তাঁকে । কারণটি লেখার ভেতরেই আছে। তিনি আমার শিক্ষক। আমার প্রতিক্রিয়া এখানেও কিছু লিখে রাখি :: বিজয়া চৌধুরীকে নিয়ে লিখতে গিয়ে আমি ইচ্ছে করেই ঊষা স্যরকে ফোন করি নি৷ করলে তিনি পুরো 'নোট ' দিয়ে দিতেন৷ তো আমার আবিষ্কারের মজা কী থাকত? আর আজ কি এমন কলমে কালিতে চিঠি আসত হোয়াটস এপে? এর মধ্যে খানিক ছাত্রমনের 'দুষ্টুমী ' তো আছেই!

চিঠির গুরুত্ব বোঝে এখানে তুলে রাখলাম...


 


 

 শবনম সুরিতা ডানার ফেসবুক ভিডিও থেকে... বিজয়ার ভিডিও