আমার চেতনার রঙে রাঙানো এই খেলা ঘরে:

~0~0~! আপনাকে স্বাগতম !~0~0~

*******************************************************************************************************

Tuesday 23 February 2021

হাড়

 

 মূল অসমিয়া : অরূপা পটঙ্গীয়া কলিতা


বাংলা অনুবাদ: সুশান্ত কর

 (মূল গল্পটির নাম ‘অস্থি’। ষোড়শ সংখ্যা ‘উজান’ পত্রিকাতে এই অনুবাদ ‘অস্থি’ নামেই প্রকাশিত হয়। মনে হলো নামটা খানিক পালটানো যেতে পারে। তাই করা হল। এখানে 'উজান' কেনা যাবে।)

 

 

 

রূপহী গ্রামে বৈশাখ মাসের নিঝুম রাত শেয়ালের ডাক, নতুন কোমল কুঁড়িপাতার মধ্য দিয়ে বাতাসের শব্দকে চাপা দিয়ে ভেসে উঠল না বাঁশ কাটার শব্দ, বুক ভাঙা কান্নার হাহাকার

 


           কেউ ধড়মড় করে পাটিতে বসে পড়ল না, কেউ বুকের কান্না আটকে বলে উঠল না,“ এই মাঝ রাতে কাকে বা কালে টেনে নিয়ে গেল গো!”

রাতভোরে কেউ বুক ভেঙে ক্রন্দনরত মৃতের আত্মীয়কে সান্ত্বনা দিতে গেল না বৈশাখের ফুলের গন্ধের সঙ্গে মিলে গেল না চিতার আগুনের গন্ধ কারো হা-হুতাশে পরিবেশ হলো না  ভার অথচ রূপহী গ্রামের  সবারই আদরের সম্মানের টোকারী গায়ক বগীরাম গায়নের মৃতদেহ খোলা আকাশের নিচে পড়ে রইল ভারি কিছুতে মেরে মাথা ফাটিয়ে দেওয়া হয়েছে ঘিলুসঙ্গে বেরিয়ে এসেছে রক্ত আরো কত কী তরল  পূর্ণিমার জ্যোৎস্না  সেই তরলে ঝিলিক দিয়ে যাচ্ছে রক্তের নদীতে মুখ উলটে পড়ে রইল বগীরাম গায়নের মৃতদেহ কুপিয়ে টুকরো করা হাতের উপরে পড়ে আছে বগীরামের চির সঙ্গী দোতারা বেরিয়ে এসেছে জিহ্বা

এই রক্তাক্ত জিহ্বার থেকেই, এই থ্যাতলানো হাতের থেকেই একদিন যে সুরের মায়াজাল তৈরি হয়েছিল, “বারীরে কাষরে জাতিবাঁহ এজুপি...” কিন্তু গায়নের সঙ্গে আজ সেই জাতিবাঁশের ঝাড়খানাও গেল না

মাঝরাতে কেউ বগীরাম গায়নকে হত্যা করে এই বড় মাঠের মধ্যে ফেলে রেখে গেছে স্বজন বিহীন বগীরাম গায়নকে গ্রামের লোকে অত্যন্ত ভালোবাসত প্রথমত, তাঁর হৃদয়স্পর্শী গানের জন্যে, দ্বিতীয়ত তাঁর স্পষ্টবাদিতার জন্যে মুগা রঙের পাঞ্জাবি আর রক্তাভ চেহারার বগীরাম গায়ন এই রূপহী গ্রামের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ বগীরাম গায়ন বিনা রূপহী গাঁও আর সূর্য বিনা আকাশ একই জিনিস

এতদিন রূপহী গ্রামের  আকাশ যেন ঢেকে রেখেছিল কালো মেঘেমেঘে ঢাকা আকাশের মতোই গুমগুমে পরিবেশ থমথমে আলোর  লেশ মাত্রও নেই চারদিকে কেবলই ফিসফিসানিকামরূপে তিনশ মানুষ মরেছে! ও হো!তিনশ নয়, হাজারও হতে পারে শিবসাগরের বাঙালি বস্তি জ্বলছে, তেজপুরে অসমিয়া মরছে, দুলিয়াজানে রক্তের নদী বইছে কথা অনেক কিছু তার সত্য,কিছু মিথ্যে কিন্তু কালো আকাশে লটকে আছে আশঙ্কা-আতঙ্ক

গায়নের হত্যা রূপহী গ্রামের কালো আকাশ আরো কালো করে গেল রূপহী গ্রামের আকাশে এখন রোদের  উত্তাপ নেই মাঝরাতে হত্যা করে ফেলে রেখে গেছে বগীরাম গায়নকে, ভোর রাতে হাঁটতে বেরিয়ে প্রথম দেখেছেন গুণরাম পণ্ডিত বাতাসের থেকে দ্রুত এই মৃত্যুর সংবাদ ছড়িয়ে পড়ল মৃত্যু রূপহী গ্রামের একটি স্বাভাবিক সত্য রূপহী গ্রামের লোকে অনেক মৃত্যু দেখেছে বৃদ্ধ মৌজাদারের আড়ম্বরপূর্ণ মৃত্যু, দিন হাজিরা করা রমার কর্কট রোগে ডেকে আনা তিল তিল মৃত্যু, হরিচরণের সঙ্গে বিয়ে হল না বলে গাছে দড়িতে ঝুলে রাণুর সেই করুণ মৃত্যু এই মৃত্যুগুলো দিন দুই চেলা মাছে যেমন জলে বুদবুদ তৈরি করে সেরকম রূপহী গ্রামের জীবনেও কালো দাগ একটা রেখে যায়

পরদিন থেকে মৃতদেহ পচতে শুরু করল অল্প অল্প গন্ধ বেরুতেও শুরু করল রূপহী গ্রামের শান্ত বাতাসে যেমন মিলে গেল বগীরাম গায়নের পচা মাংসের গন্ধ বাতাস হয়ে পড়দুর্গন্ধময় কেউ বলল, বগীরাম গায়নকে আসলেবাংলাদেশীকেউ মেরেছে রূপহী গ্রামের মানুষে দেখেছে বাংলাদেশের থেকে আসা লোক দেখেছে বসন্ত গোয়ালাকে রিফিউজি ক্যাম্পে মা বাবা ঠাকুরদা সবাইকে হারিয়ে তালপাতার ঘর একটা বানিয়েছিল একটা মাত্র গরু নিয়ে এখন দশটি গরুর দুধের ব্যবসা করে পেটে ভাতে করে খাচ্ছে বসন্ত গোয়ালার গায় গরুর গন্ধ আছে একই ঘরে গরুতে মানুষে থাকে দেখেছে রাম রতনকে এক টুকরোও মাটি না পেয়ে সে জলাজমি পরিষ্কার করে চাষাবাদ করে এখন পেটের ভাত জোগাড় করছে দেখেছে সরস্বতীর মাকে ডিমাকুছির ক্যাম্পেই স্বামীকে হারিয়ে দুই কাঁখে দুই সন্তান নিয়ে সে এসে উঠেছিল এই রূপহী গ্রামে বাকি মানুষের সঙ্গে রূপহী গ্রামের রিজার্ভে গিয়ে সেও সমান শ্রম দিয়েছিল জঙ্গল কাটতে

সমস্ত মানুষ একই সঙ্গে সম্মুখীন হয়েছে নিপীড়নের একই সঙ্গে সরকারি উচ্ছেদের মুখে পড়ে হাবুডুবু খেয়েছে সরকারি হাতিতে ঘর ভাঙলে সবাই মিলে আবার সেই ঘর দাঁড় করিয়েছে বেঁচে থাকবার সংগ্রাম করেছে এই মানুষেরা কেন বগীরাম  গায়নকে হত্যা করতে যাবে? ওরাও শুনেছিল বগীরাম গায়নের দোতারার সুরে সুরে বেজে বেজে উঠা করুণ ভাটিয়ালী গান, “ ও মাঝি রে...!”

গায়নের মৃতদেহের গন্ধ আরো খানিক বেড়েছে

একদিন মাঝরাতে লোকে দেখতে পেল রিজার্ভের দিকের বস্তিতে আগুন লেগেছে বসন্ত গোয়ালার গরুর হাম্বারব, সরস্বতীর মায়ের বাচ্চার কান্না, রামরতনের চীৎকার আগুনের ধোঁয়ার সঙ্গে বাতাসে মিশে গেছে মানুষের মৃত্যুর গোঙানি কেউ যেন বাতাসে বলে গেল গায়নের মৃত্যুর প্রতিশোধ নেওয়া হয়েছে

গায়নের মৃতদেহ পচছে নীল রঙের পচা মাংসপিণ্ডের মধ্যে সুন্দর সুঠাম বগীরাম গায়নকে খুঁজে পাওয়া যায় না রূপহী গ্রামের আকাশের নীলের সঙ্গে যেন গায়নের দেহের নীলগুলো মিশে গেছে রক্তহীন নীল পচা শিরাগুলোর বিষ রূপহী গ্রামের মাটিতে ছড়িয়ে পড়ছে বিষ মাখানো মাটিতে ছ্যাঁচড়ে আসছে এক নতুন তথ্য---বগীরাম গায়নকে মুসলমানে মেরেছে

সবাই যে পুকুরের পানি পান করেন তার পাড়ে পাওয়া গেল গরুর হাড় মসজিদে পাওয়া গেল মরা কচ্ছপ লোকগুলোর মাথাতে মাঠের থেকে ফেরা ক্ষুধাতুর, ক্লান্ত হালুয়া চাষার নির্দোষ ক্রোধ 

বাড়িঘর জ্বলছে নিতাই পণ্ডিতের কুয়োতে পাঁচটি মৃতদেহ আবদুল্লার পাঁচ বছরের ছেলেটি কাটা মাথা নিয়ে মাঠে পড়ে আছে

অথচ বগীরাম দোতারা বাজিয়ে সুর দিয়ে গাইতেন, “ যদি আল্লাহ রহমত...”  বগীরাম গায়নকে ঘিরে থাকা মানুষ তালে তালে মাথা নাড়া দিয়ে বলতেন, ‘ হ্যাঁ, সাহেব, হ্যাঁ

আবার নতুন তথ্যনা, বগীরাম গায়নকে বাঙালিরা মেরেছে বগীরাম গায়ন বুঝি অসমিয়া বরগীত গাইছিলেন তখন একদল বাঙালি ধরল বাউল গাইতে হবে না গাওয়াতে লাগল গণ্ডগোল সেই রাতেই অজ্ঞাত আততায়ী বগীরাম গায়নকে খুন করে বড় মাঠটাতে ফেলে চলে গেছে কেউ বুঝি বগীরাম গায়নকে খুন করতে ব্যবহৃত লোহার খুন্তি সুধীর মিত্রের বাড়িতে দেখতে পেয়েছে

 

            সুধীর মিত্রের বাড়ি জ্বলল সঙ্গে পাশের রমেন হাজরিকার খড়ের ঘরটাতেও আগুন লাগল মিত্র আর হাজরিকার ছেলেমেয়েরা সেই রাতে আতঙ্কে বিহ্বল হয়ে পথের পাশে জড়ো হয়ে চিৎকার করে করে কেঁদেছিল সেই কান্নার সুর যেন ভেঙে ছিঁড়ে রূপহী গ্রামের বাতাসে মিশে গেছিল যেভাবে গভীর রাতে গায়নের দোতারার সুরের ঝর্ণা গ্রামের জ্যোৎস্নার বুক বেয়ে ভেসে যেত, “ মাঝিরে...”, “বারীরে কাষরে...”

            নরম নরম পোকায় ঘিরে ধরেছে গায়নের দেহ, খসে পড়ছে পচা মাংস  গলা পচা মাংস ঘিরে হাজার হাজার মাছির ভন ভন মাটিতে কিলবিল করছে সাদা সাদা পোকা আকাশে শকুনের ঝাঁক, ওদের বাঁকা ঠোঁটে লোভ আকাশ শকুনের পাখাতে অন্ধকার হয়ে পড়েছে সেই আঁধারই থোকা থোকা ঝরে পড়ছে রূপহী গ্রামের সবুজ মাঠের মাঝখানে রূপহী গ্রামে এখন মানুষ নেই, আছে বাঙালি অসমিয়া, হিন্দু মুসলমান দাউ দাউ করে জ্বলছে রক্তের নালা বইছে বাতাসে শুধুই শকুনের পাখার ধপধপানো

             যে পূর্ণিমাতে ভরা জ্যোৎস্নাকে সাক্ষী করে গায়নের সুর চিরদিনের জন্যে স্তব্ধ হয়েছিল, সেই ভরা জ্যোৎস্নাকে সাক্ষী করে অন্য এক পূর্ণিমাতে রূপহী গ্রামে শান্তি ঘুরিয়ে আনবার জন্যে ট্রাক ভরে এসে নামল পুলিশ মিলিটারি

            শুরু হল রূপহী গ্রামে অত্যাচারের তাণ্ডব লীলা মিলিটারির লাঠির সামনে হিন্দু- মুসলমান, বাঙালিঅসমিয়ার রক্ত এক হয়ে গেল সবারই চোখের জলের রং এক হয়ে গেল, একই সঙ্গে ভেসে উঠল কান্নার রোল

            এখন রূপহী গ্রামে বাঙালি-অসমিয়া, হিন্দু-মুসলমান নেই, আছে শুধু এক দল নির্যাতিত মানুষ,এক ঝাঁক দরিদ্র মানুষ রূপহী গ্রামের মৌজাদার, ঠিকাদার, মণ্ডল, আগরওয়ালা থেকে শুরু করে পাকা বাড়ির বাসিন্দা কয়েক ঘরের লোকজন কবেই সরে গেছে রূপহী গ্রামের শকুনের পাখার অন্ধকার থেকে এদের ঢেকে রেখেছে টাকার পর্দা

            বগীরাম গায়নের মৃতদেহে এখন আর পচা মাংস নেই আছে শুধু শুকনো হাড় পচা গন্ধে আর মাছি কাছে চেপে আসছে না শকুনও চলে গেছে পোকাগুলোও মিশে গেছে মাটিতে বগীরামের শরীরের পাশ থেকে চলে গেছে পুলিশ মিলিটারি বিশাল মাঠে এখন পড়ে আছে বগীরাম গায়নের হাড় কতকগুলো খোলা মাঠের বাতাস বগীরামের বুকের হাড়ের মধ্যে পাক খেয়ে শিসের শব্দ তুলে আকাশে ছড়িয়ে পড়েছে --- এ যেন গায়নের বুকের সুর

            রূপহী গ্রামে শ্মশানের স্তব্ধতা গাছে পাতায় এক মূক বেদনা লোকে যেন গভীর রাতে শুনতে পায় বগীরামের বুকের হাড় থেকে বেরুনো এক দীর্ঘ শিস নিথর হয়ে শুনে লোকে সেই শিস সবার মগজে পাক খেয়ে  বুকে গিয়ে থামে

            একদিন লোকে দেখল---গাড়ি নিয়ে এসে অনেক ছেলে-মেয়ে এসে রূপহী গ্রামের বড় মাঠটাতে নামল এরা গ্রামের লোকের জন্যে নিয়ে আসা চিঁড়া, তেল, নুন, কেরোসিন, পুরোনো কাপড়ের পোটলা মৌজাদারের হাতে দিল মৌজাদার ইতিমধ্যে শহর থেকে ফিরে এসেছেন

            বগীরাম গায়নের শুকনো হাড়গুলোর ছবি নেবার জন্যে কাঁধে ক্যামেরা ঝুলিয়ে সাংবাদিক এলেন রূপহী গ্রামের পোড়া বাড়িগুলো দেখতে আসেন এ এল এমন্ত্রী গাঁয়ের মানুষকে দেবে বলে এলো ছাত্র-ছাত্রী, এলেন মহিলার দল সবাই বগীরামের কঙ্কালে ফুল দিলেন ধূপ- ধুনা, সতেজ ফুলে জায়গাটি ভরে উঠল

            ইতিমধ্যে রূপহী গ্রামের লোকজন বাড়িঘর মেরামতি শুরু করেছেন কে জানে, এর ওর থেকে চেরা চিকন বাঁশ, দা খোঁজ নেবার ছলে ভাঙা হৃদয়গুলো জুড়বার চেষ্টা করছে হয়তো

            বগীরামের কঙ্কালটিকে কেন্দ্র করে যেন একটা উৎসব শুরু হয়ে গেল ফুল, ফুল আর ফুলে বগীরামের হাড়গুলো একেবারে পুঁতে ফেলল শহরের লোকের পদভারে দুলতে থাকল গাঁয়ের এত বড় মাঠটি গ্রামের লোকে দূর থেকে এই মেলা দেখছে, কিন্তু কাছে চেপে আসছে না কী এক সন্দেহ গ্রামের মানুষকে বাধা দিচ্ছে এই সব শহুরে লোকজনের কাছে চেপে যেতে ফুলে পোঁতা বগীরামের বুকের থেকে রাতের বেলা লোকের কানে ভেসে আছে এক অদ্ভুত কোঁকানি কেউ যেন বগীরামের বুক চেপে ধরেছে ছটফট করে মানুষগুলো

            ফুলের দমের উপরে পড়ছে আরো ফুল ক্রমে সেই ফুলগুলোও পচতে শুরু করল দুই একটা মাছিও ভনভন করতে শুরু করল গ্রামের মানুষ উঠল কেঁপে এ হতে পারে না মাছি, পোকা, শকুন লোকের বুকের ধুক-পুক, ধুক-পুক শব্দ যেন রূপহী গ্রামের মেঘের গর্জনের সঙ্গে মিলে গেল রূপহী গ্রামের আকাশে এখন বৈশাখের মেঘ দুই এক ফোঁটা বৃষ্টি পড়ছে আর কিছু দিন পরেই মাঠে থেকে বেরুবে কাদার কাঁচা গন্ধ

            একদিন লোকে দেখল একদল শহুরে মানুষ  এসে বগীরামের কঙ্কালটিকে ফুলের থেকে উদ্ধার করে ট্রাকে তুলে গেয়ে বাজিয়ে শহরে নিয়ে যেতে চাইছে মৌজাদারের থেকে জানা গেল বগীরাম গায়ন বুঝি কীসেরশহিদহলেন শহরে বগীরামকে সম্মানে শ্মশানে তোলা হবেশ্মশানেউপর বগীরামের এক মূর্তি তৈরি হবে বগীরাম গায়ন বুঝি অমর হবেন কোনো এক ব্যবসায়ী সংস্থা বুঝি বগীরামের স্মৃতি রক্ষার্থে কুড়ি হাজার টাকা দেবে বগীরামের নামে এক পথ তৈরি হবে আরো অনেক কথা লোকে কেবল শুনে গেল

 পরদিন বগীরামকে শহরে নিয়ে যাওয়া হবে রাতে খোলা মাঠে ফুলের দম থেকে মুক্তি পেয়ে বগীরামের কঙ্কালটাই শুধু পড়ে আছে বৈশাখের উত্তাল বাতাস কালবৈশাখী  বাড়ি ফিরে এসেছে রূপহী গ্রামের সব ঘরের বাঁশের খুঁটাগুলো যেন পাগলি কালবৈশাখীর মেলা চুলের পাকে লেগে মেড় মেড় করে উঠেছে  ঘুমোতে পারেন নি মানুষজন বগীরামের বুকের ফাঁকা জায়গাতে ঢুকে যেন কালবৈশাখী তাণ্ডব নৃত্য করছে চারদিকে সেই ছন্দে সব কিছু ভেঙে ভেঙে ভেসে চলে যাচ্ছে এই ছন্দে শুধু বগীরামের বুকের স্পন্দনই নেই, আছে পাগলি কালবৈশাখীর নৃত্যরতা পায়েরও ধ্বনি

লোকের চোখ বন্ধ হয় নি ভোরে জয় ধ্বনি দিয়ে বগীরামের কঙ্কালটিকে ফুলে সাজিয়ে ট্রাকে তুলতে যাচ্ছে লোকে চুপচাপ দাঁড়িয়ে দেখছে সবার বুকে বগীরাম গায়নের সুরের ঝঙ্কার, “মাঝিরে...”, “বারীর কাষরে...”, “ যদি কর দরিয়ার পার...”, “মাহুত বন্ধুরে...”

যেন হারিয়ে যাবে এই সুর মানুষের বুক নিংড়ে যেন এই সুর নিয়ে যাবে শহরে লোকের চোখের সামনে ভেসে উঠছে বগীরামকে যেন কেউ মানুষের বুক খালি করে কেড়ে নিয়ে যাবে একটি লম্বা চুলের ছেলে আর পাঞ্জাবি পরা এক পেটোয়া ছেলে কঙ্কালটিকে কাঁধে তুলে ধরেছে ওদের মুখে শোক কিন্তু সেই শোক একটি ভান অল্প পরেই যেন এরা হা হা করে হেসে উঠবে

বগীরামের কঙ্কালটি যেন মানুষে একদল নাটুকের হাতে ছেড়ে দিয়েছে কঙ্কালের মাথাতে চোখের গহ্বরে লোকে দেখতে পেল এক মিনতি

            কালবৈশাখীর মেলা চুলের ঢেউয়ে ঢেউয়ে মানুষের বুকের ধুকপুকুনি উঠছে নামছে

            কাছাড়ি ছেলে বলরাম একটু বোকা বলে সবাই জানে বলো উঠল ওর টান টান শরীরের পেশিগুলো যেন ফেটে পড়বে কিছু একটা বলতে গিয়ে সে উত্তেজনাতে থেমে গেল

            সুধীর মিত্র উঠলেন কিন্তু কিছুই বলতে পারলেন না হাউ হাউ করে কেঁদে ফেললেন

            রহিম মিঞা উঠলেন শুকনো আঙুল কটি মেলে বলে উঠলেন, “দিমুনা!” রহিম মিঞার আঙুলগুলো আর বগীরামের কঙ্কালের হাতের হাড়গুলোর মধ্যে যেন কোনো তফাৎই নেই

            নবীন কোমল কুঁড়িপাতার পাতার মধ্য থেকে কোথাও কোনোভাবে থেকে যাওয়া শুকনো পাতাগুলোকে কালবৈশাখীতে ঝরিয়ে ফেলে দেবার মতো নিথর মানুষগুলোর মুখের থেকে কেউ যেন জোরে বের করে আনল একগুচ্ছ প্রতিবাদী কণ্ঠ,... “ নিদিওঁ, দিমু না, দেব না

            এক সময় শহরের মানুষগুলো চলে গেছিল কঙ্কালটি কাঁধে তুলে লোকে সর্বজনীন শ্মশানের দিকে এগিয়ে গেল সেই শ্মশানে শুয়ে আছে রূপহী গ্রামের জনতা, রূপহী গ্রামের মানুষ

--- --- ----

১।টোকারী: দোতারার মতো দেখতে কিন্তু আকারে সামান্য বড় ভাটি অসমে প্রচলিত লোকবাদ্য। আঙুলের টোকাতে বাজানো হয় বলে এরকম নাম।

২। বগীরাম যেহেতু সব ভাষার গান করতেন,তাই গানের কলির ভাষা মূলে রেখে দেওয়া গেল। এই কলির বাংলা রূপান্তর হবে--- বাগানের কাছের জাতিবাঁশের ঝাড়খানা...

               

Saturday 20 February 2021

একটি অসম্পূর্ণ রচনার ভূমিকা





 

 



 ঈশ্বর কি চাইলেই ষোড়শ শতকে রবীন্দ্রনাথকে পাঠাতে পারতেন? কিছু কিছু লেখক শিল্পী আছেন, বড়ই আত্মকেন্দ্রিকভাবেন, তাঁদের প্রতিভা জন্মসূত্রে প্রাপ্ত। ঈশ্বর প্রদত্ত। যারা ঈশ্বরে আস্থা রাখেন না, তাঁরাও ভাবেন, নিজেরা শ্রম করে যে প্রতিভা তৈরি করেন, তার কৃতিত্ব চারপাশের প্রকৃতি পরিবেশকে দেবেনই কেন? হিমালয়ে সাধনা করে সিদ্ধি লাভের প্রাচীন বিশ্বাসে আস্থা না রাখলেও তাঁদের বিশ্বাস অনেকটা এরকমই। ভাবেন, আড্ডা বিহীন , বন্ধু বিহীন---দিন রাত ঘরে বসে লিখলে পড়লেই তাঁরা ভাষার নিবেদিত প্রাণ সেবক হয়ে উঠতে পারেন। সম্ভবত জীবনানন্দের মতো প্রতিভার থেকে তাঁরা কিছু প্রেরণা নিয়েও থাকেন। কিন্তু কখনোই সম্ভবত প্রশ্ন করেন না, জীবনানন্দের যে প্রত্যয় ছিল 'আবার আসিব ফিরে' তার কী হলো? তিনি কি এলেন? তিনি কি সতেরো শতকে আসতে পারতেন? রাধা কিম্বা শ্যামার গান না গেয়ে বনলতা সেনের বাড়ি পৌছুতে পারতেন? সেই স্থান-কালকে মর্যাদা না দিতে শেখা দম্ভ মাত্র।

 সেই স্থানের কালের কিছু পরিচর্যাও চাই। সেই দম্ভ থেকে তাঁরা আওড়ান শঙ্খ ঘোষের সেই বিখ্যাত কবিতা পঙক্তি "এক দশকে সঙ্ঘ ভেঙে যায়'" এরা তাই সঙ্ঘের থেকে দূরেই থাকেন। যে সঙ্ঘগুলো তৈরি হয় তাঁদের মেধাকে সারপানি যোগাবার স্থান-কালের পরিচর্যা করবার জন্যে। বাংলাতে একটি কথা আছে , উলটো বুঝলি রাম। এরা সেই গোত্রের। নইলে শঙ্খ ঘোষ কি আর সঙ্ঘ করেন না? এই মুহূর্তে তিনিই বাংলা সাহিত্যের সব চাইতে বড় সঙ্ঘীআচ্ছা, কেমন হত যদি রবীন্দ্রনাথ বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের নেতৃত্ব না গ্রহণ করতেন? চর্যাপদটা কি আপনি এসে আকাশ থেকে দেখা দিত? সুনীতি চট্টোপাধ্যায়ের ওডিবিএল---কি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাগার থেকে আপনি প্রসবিত হত? ঈশ্বর বর দিলেন, তথাস্তু ! আর সব হয়ে যেত? সোজা পরিসংখ্যাতে যান, যেখানে সঙ্ঘ বেশি---সেখানেই মেধাও বেশি। আগাছাও বেশি। কিন্তু সেই একই কথা। আগাছা দেখে যে বটগাছের মাটিতে ঝুরি নামে না, সে তার আয়ুর হিসেবটাও ভালো জানে না... পশ্চিম বাংলা বাংলাদেশে অসংখ্য সেরকম সঙ্ঘ আছে। বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের উত্তর সুরী বাংলা আকাদেমির প্রাতিষ্ঠানিকতাও আছে। সেই তালিকা দীর্ঘ করি না। ত্রিপুরাতে প্রচুর বাংলা ছোট কাগজ আছে, ব্যক্তি বা গোষ্ঠী সম্পাদিত। আছে দৈনিক কাগজ। টিভি, রেডিও আছে। কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যাও কম না যেখানে বাংলা পঠন পাঠন হয় পূর্বোত্তরের বাকি রাজ্য থেকে তুলনাতে অনেক বেশি। বই মেলাও বসে একাধিক শহরে, যেখানে বাংলা বই পত্রের ভিড়টাই থাকে বেশি। এরই সব কিছুকেই নানা প্রকৃতির সঙ্ঘ বলেই নাম দিতে পারি। বাকি রাজ্যগুলোর কথা ভাবুন তো। সেখানে দুই চারজন লেখক- লেখিকা পত্র-পত্রিকা পেতে পারেন। সেই দেখে কেবল, ঈশ্বরের সেবাদাসেরা তুষ্ট থাকতে পারেন বৃহত্তর সাহিত্য সমাজের তাতে কী? প্রতিজন লেখককে প্রশ্ন করলেই জবাব মিলবে, তাঁরা সুখে নেই।

অসমে অসমিয়া মেধাজীবীদের মান ও পরিমাণ দেখুন, আর দেখুন তাঁদের অসম সাহিত্য সভা থেকে শুরু করে কত কী আছে? গুয়াহাটি শহরে দুটি বই মেলা হয়। বাংলা বই কম হলেও থাকে। কিন্তু সেগুলো কেনেন পড়েন, বাঙালিরা কম, অসমিয়ারা বেশি। কিছু বাংলা প্রকাশনাও থাকে, বাংলার থেকে। ত্রিপুরা থেকে অক্ষর কখনো থাকে। থাকে ব্যতিক্রম আর বাংলা সাহিত্য সংস্কৃতি সমাজ, গুয়াহাটি। এই মাত্র। স্বাভাবিকভাবেই এইবারে ৭ জানুয়ারি বাংলা কাগজ বার্তালিপি সংবাদ শিরোনামে জানিয়েছিল "প্রথম সপ্তাহেই সাড়ে চার কোটির ব্যবসা গুয়াহাটি বই মেলায়--- বাংলা বইয়ের বিক্রি নেই, ঠাই নেই মঞ্চেও।' ঈশ্বর প্রদত্ত মেধাবীদের মনে কি কোনো প্রশ্ন আছে, না আছে লজ্জা? তাঁরা কাদের জন্যে লেখেন? লজ্জা তো নেইই। এক অধ্যাপক, এখন দৈনিকের উত্তর-সম্পাদকীয় লিখে বিখ্যাত, এককালে একটি খ্যাতনামা বাংলা ছোট-কাগজ করতেন, রীতিমত কুৎসা ছড়ালেন-- সেই তাদের বিরুদ্ধে যারা এই অবজ্ঞা উপেক্ষার মধ্যেও বই মেলাতে অসম তথা পূর্বোত্তরের বই পত্রের আসর ধরে রাখলেন। যে প্রকাশক ও সংগঠনগুলোর নাম করলাম---দেড় দশকের বেশি সময় ধরে এরা  উত্তর-পূর্ব বাংলা লিটিল ম্যাগাজিন সম্মেলনের আয়োজনেও জড়িয়ে আছেন বিশেষ করে এই   বাংলা সাহিত্য সংস্কৃতি সমাজ, গুয়াহাটি গুয়াহাটি কেন্দ্রিক আরো বেশ কিছু সংগঠন রয়েছে কারো কারো নামের আগেবিশ্বশব্দটিও আছে কিন্তু ব্যাপ্তি কারোরই গুয়াহাটির বাইরে নেই না প্রত্যক্ষ না পরোক্ষ কাজকর্মও নেই বরাক উপত্যকাতে আছে বরাক উপত্যকা বঙ্গ সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্মেলন একে অসম সাহিত্য সভার বরাকের বাংলার প্রতিকল্প ভাবা যেতে পারে এমন তো প্রায় সব ভাষাগোষ্ঠীরই রয়েছে অসমে আছেবরাক নন্দিনী সাহিত্য পাঠচক্র’—যেটি একটি বাংলাদেশি সংগঠনের ভাবাদর্শগত বিস্তার যদিও , একে  সারা অসম লেখিকা সমারোহের বরাকের বাঙালির মধ্যেকার প্রতিকল্প ভাবা যেতে পারে আছে গণতান্ত্রিক লেখক সংস্থা ইত্যাদি আরো বহু সংগঠন ও পত্রিকা কিন্তু গোটা অসম তথা পূর্বোত্তরকে এক মঞ্চে নিয়ে আসা তো বাস্তবে যাচ্ছে না সেই চেষ্টাটাই হয় এই পূর্বোত্তরীয় লিটিল ম্যাগাজিন সম্মেলনে


কোনো স্থায়ী সংগঠন নেই বহুবার প্রস্তাব উঠেছে সম্ভব হয় নি নিয়মিত হয়ও না সম্মেলন সম্ভব হয় না একটা অনুরোধ থাকে আগেকার সম্মেলন সেই অনুরোধ জানায় কোনো না কোনো সংগঠন বা পত্রিকাকে তাঁরা গ্রহণ করেও কখনো করে উঠতে পারেন না করলেও সংগঠিত করতে নানা জনের দক্ষতার মাত্রাভেদও ঘটে তখন এই সংগঠনবিহীন সংগঠকের ভূমিকাটি পালন করেন গুয়াহাটির এই বাংলা সাহিত্য সংস্কৃতি সমাজের কর্মকর্তারাএই যেমন তিনসুকিয়া সম্মেলনে কথা ছিল, ঠিক পরের বছরে সম্মেলন আয়োজিত হবে আগরতলাতেমূল দায়িত্ব নেবেমুখাবয়বপারলেন নাপরের বছরেই ২০১৮তে ২২, ২৩ ২৪ ডিসেম্বরে আয়োজ়ন করে ফেললেন গুয়াহাটির সাউথ পয়েন্ট স্কুলেসেই সম্মেলনে ঠিক হল, পরের সম্মেলন হবে শিলচরেসবাইকে নিয়ে উদ্যোগটা নেবেমানবী’, ‘বরাকনন্দিনীপারলেন নাকা বিরোধী আন্দোলন এলকোভিড এলএইবারে এগিয়ে এল ত্রিপুরাপ্রাথমিক সিদ্ধান্তটা হলো কীভাবে? কারা সে সম্ভব করলেন?  বাপরে ! ঠিক এরই জন্যে এদের বিরুদ্ধে গোষ্ঠীবাজির অভিযোগ তুলাটা কেউ কেউ পবিত্র কর্ম বলে মনে করেন যেন বড় অন্যায় করে ফেলছেন, তাঁরা তাঁদেরই জন্যে অসম তথা পূর্বোত্তরের বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির বারোটা না বেজে আর যায় না

সম্প্রতি সেই প্রাক্তন ছোটকাগজের সম্পাদক লিখলেন, সম্মেলনগুলোতে বুঝি মদ মাংস আর আড্ডা  ছাড়া আর কিছু হয় না লেখকেরা জুটবে আর মদ মাংস হবে না---শুনলে যে ঘোড়ায়ও হাসব---এই কথা তাঁর জানা না থাকবার কথা নয় শুরুর দিকে তিনিও এই সম্মেলনের আয়োজনে সক্রিয় রইতেন ২০১২র গুয়াহাটি সম্মেলন অব্দি তো অবশ্যই কিন্তু তাঁর তো জেদটাই হচ্ছে তিনি মাইকেলকে মদ্যপ সাজিয়ে ছাড়বেন অথচ, হয় বহু কিছুই একমাত্র সম্মেলন যেখানে বছর দুই তিন পরে হলেও পূর্বোত্তরের সব পাঠকেরা না হলেও লেখকেরা পরস্পরের বই পত্রপত্রিকার হাতে নিয়ে দেখতে পারেন কিনতে পারেন ব্যাগ ভরে নিতে পারেনবিনিময় করতে পারেন ভাব

 পূর্বোত্তরে এমন কোনো বই মেলা নেই, যেখানে তা সম্ভব হয়ে উঠে অসম প্রকাশন পরিষদও তা সম্ভব করে না, যার গুণগানে কেউ কেউ ব্যস্ত থাকেন এমন কোনো বই পত্রিকার বাজার নেই---যেখানে তা সম্ভব হয়ে উঠে আর হয়ে উঠতে পারেন পরস্পরের বন্ধুনা, আমাদের কোনো পাতিরাম নেইধ্যানবিন্দু নেইনেই কলেজ স্ট্রিট  না, আমাদের অক্ষর, আমাদের জ্ঞান বিচিত্রা, আমাদের আবাহন, আমাদের বাতায়ন, আমাদের ব্যতিক্রম তা চেয়েও সম্ভব করতে পারে নি বহু আগে সঞ্জয় চক্রবর্তী লিখেছিলেন,...গঙ্গাপারের পথিক, বলতে পারো সঠিক/কোথায় আমার সাকিন!/চিত্ত কোথায় ভয়শূন্য, উচ্চ কোথায় শির,/কোন ভুবনে থাকব বলো হয়ে সুস্থির।/যদি এরকম হতো, আমার নিজের মতো/গুছিয়ে নেয়া  যেত রাজ্যপাট/তাহলে দুয়ারে দুয়ারে আর মাথাকোটা কেন,/বালাই ষাট.../ তারও আগে লিখেছিলেন কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ --..ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,/স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---/তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শস্য,/ নাভিমূলে মহাবোধি অরণ্যের বীজ.../তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যস্ত শাসন!—/সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; /হেমশস্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল  ফুলের মশাল!”,


 

এই সব কবিতা পঙক্তি পড়ে পাঠক তো বটেই বহু কবিও বাহ বাহ!’ ধ্বনিতে বলে উঠেন, আমাদের গৌরব এই কবিরা কিন্তু এর মর্ম অনুভব করেন না বহু  কবি লেখক সম্পাদকও যারা করেন,  তারাই আয়োজন করেন এহেন সভার,সম্মেলনের তাঁরা অনেকেই লেখক- সম্পাদক বটে, কিন্তু সবাই নন কিন্তু খুব কি জরুরি যিনি সৃজনে মননে দক্ষ, তিনি সংগঠনেও দক্ষ হবেন? স্বাভাবিকভাবেই যারাই ভাষাকে ভালোবাসেন, সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে ভালোবাসেন, সংগঠনটা বোঝেন, অনুদান গোটাতে পারেন, তাঁদের সবাই এগিয়ে এলেই শুধু সম্ভব হয় এহেন কর্ম আয়োজন কিন্তু আমাদের ঈশ্বর প্রদত্ত মেধাবীদের সেখানেও হাজারটা অভিযোগ প্রমাণ করে, তাঁরা নিজেদেরই বোঝেন কেবল, বৃহত্তর সমাজ বোঝেন না বোঝেন না, ঊর্ধ্বেন্দু দাশের এই আহ্বানের মর্ম কী?--- “তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যস্ত শাসন!--”

 

 

 তর্ক বহু কিছুই উঠতে পারে ভাব বিনিময় হয়টা কীসে? কাউকে তো বলতেই দেওয়া হয় না শুনতে তো আর কম লোক থাকে, বাইরে আড্ডা বসায় ডাকে কতজন লোককে? সবই তোগোষ্ঠীর লোক এমন বহু কিছু সব প্রশ্নের জবাব দেবারও প্রবৃত্তি জন্মায় না আমার এমন অভিজ্ঞতাও আছে, তিনসুকিয়া সম্মেলনের আগেই সংবাদে কেন তাঁর আসবার খবর নেই বলে গুয়াহাটিরগোষ্ঠীর ষড়যন্ত্র বোঝাচ্ছিলেন, তাঁরাই যখন পরে গুয়াহাটিতে এক অনুষ্ঠানে তাঁর বই প্রকাশের সভা করলেন, তখন তিনি আহ্লাদে গদগদ সব লেখকদের নিয়ে বেশি বলতে নেই কেউ কেউ শালীনতার মাত্রাও ছাড়ান চাই কি, আপনাকে ফোনেও ধমকি দিতে পারেন কারণ সেই---ঈশ্বর প্রদত্ত মেধা নিয়ে জন্মেছেন বলে এই বিশ্বাসও প্রবল যাকে তাকে যখন তখন অভিশাপও দিতে পারেন যদিও ব্যাস-বাল্মিকী কাউকে অভিশাপ কিছু দিয়েছেন বলে আমাদের কাছে খবর নেই

 


খবর এও তো নেই, যে কেউ যদি বলেছেন তাঁর শহরে বাংলা ছোট কাগজের সম্মেলন করবেন--- এই সম্মেলনের কেউ আটকেছেন খবর এও নেই, যে কেউ যদি ভুলে বাদ পড়ে গিয়ে ডাক না পেয়ে রবাহূত গিয়ে সম্মেলনে ভিড়েছেন, তবে তাঁকে একটি আসন , মঞ্চে একটা মাইক আর শোবার বিছানা জোটানো হয় নিতিনি পূর্বোত্তরের বাইরের হলে তো খানিক বেশিই পেয়েছেন তাঁদের অনেকেই কিন্তু রবাহূত হয়েই আসেন বিশেষ করে উত্তর বাংলার সম্পাদকেরা প্রাতিষ্ঠানিক বই মেলাগুলোর ঠিক বিপরীত অভিজ্ঞতা তাঁদের এখানে হয় খবর এও নেই যে সভা মঞ্চের বাইরে  কোনো লেখক সম্পাদকে আড্ডাতে বসে আনকোরা নতুন কোনো কাগজের স্বপ্ন দেখা শুরু করলে--- তাকে সামাজিক বয়কট করা হয়েছে খবর এও নেই যে কোনো তরুণ তরুণী সম্পাদিকা আর লেখক প্রেমে পড়ে গেলে  তা নিষিদ্ধ করে কোনো বিধান দেওয়া হয়েছে... এই সবই তো দুই সম্মেলনের মাঝের সময়ে বহু ফসল ফলায় না যদি ফলাবে, খামোখা কি লোকে নিজের গাঁটের পয়সা খরচা করে এক গাদা বই পত্র পত্রিকা কাঁধে পীঠে করে দিন দুই বা তিনের রেলপথের যাত্রা শীতের রাতে মাঝের কোনো স্টেশনে বিরতি দিয়ে এমনি করে? অধিকাংশই তার যেমন এসেছিল, সেরকমই ফিরেও যায় বিক্রিবাটা হয়ও না তুমি আমার, আর আমি তোমার-- করে আর কতটা কেনাকাটা করা যায়, দান দক্ষিণাই হয়ে উঠে কতটা? তবু যে লোকে যায়, ছুটে যায়---শিলিগুড়ি থেকে শিলচরে, আগরতলা থেকে তিনসুকিয়া--- প্রাণে প্রাণ মেলাবার টানে যায় মনে মন দেবার টানে যায় যে না যায় তাঁকে প্রশ্ন করে, মন, তুই এতো ছোট কেনে?

ছোট, কেননা তাঁর কাগজ ছোট-- ছোট কাগজের এও এক সমস্যা এর প্রতিশ্রুতি হচ্ছে, কাগজে ছোট হবে, কথাতে বড় হবে হয় তাঁর উলটো ঘাসের মতো মাথা উঁচু করতে ভয় পায় যদি বটের মতো ডাল ভেঙে পড়ে! কিন্তু কী আর করা যাবে, যেখানে বট জন্মায়, সেখানে ঘাস আগে থেকেই জন্মায় একে তুচ্ছ করা যাবে না, এর ফাঁক দিয়েই আকাশে বেরিয়ে যেতে হবে আর গিয়ে সেই তৃণভূমিকে ছায়াও দিতে হবে সেখানে কোনো জাত-বিচার চাইলেও কেউ করতে পারে না