আমার চেতনার রঙে রাঙানো এই খেলা ঘরে:

~0~0~! আপনাকে স্বাগতম !~0~0~

*******************************************************************************************************

Thursday 14 July 2011

রবীন্দ্রনাথ এখনো লড়ছেন নির্জাতিকরণের বিশ্বায়নের সংস্কৃতির বিরুদ্ধে।

                    তকাল ( ১২/০৭) দুলিয়াজানের কাছে নাওহলিয়াতে গেছিলাম রবীন্দ্রজন্মজয়ন্তী অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত হয়ে। এখানে এমন অনুষ্ঠানে ‘নির্দিষ্ট বক্তা’ বলে একটা পদ থাকে। অনির্দিষ্ট যে কে থাকে আমি বুঝি না। যাই হোক গেলাম। আয়োজকদের সম্বন্ধে আমার কোনো পূর্ব ধারণা ছিল না। কাউকে চিনতামও না। ওদের সাংস্কৃতিক সম্পাদিকা আমাকে মাসখানিক আগে ফোনে যোগাযোগ করে নিমন্ত্রণ জানিয়ে রেখেছিলেন। সপ্তাহ দুই আগে বাড়ি এসেও বলে যান। এবং কাল রাত সাতটাতে গাড়ি করে নিয়ে যেতে আসেন। ফিরিয়ে দিয়ে যাবেন এই প্রতিশ্রিতিতে এতো রাতে যেতে রাজি হয়ে যাই।
             ওখানে পৌঁছোবার মাইল তিনেক আগে থেকেই দেখি সার বেঁধে ছেলে মেয়ে, বাচ্চা কাঁখে বাড়ির বৌ যাচ্ছে। যারা নিয়ে যাচ্ছিলেন, জানালেন ওদের অনুষ্ঠানেই লোক যাচ্ছে। একটু অবাক হলাম। ওরা জানালেন, ওদের অনুষ্ঠানে হাজার হাজার লোক হয়। আরেকটু অবাক হলাম। রবীন্দ্রজয়ন্তীতে হাজার হাজার লোক, তাও সেই উজান অসমের প্রত্যন্ত গাঁয়ে! কারা হবেন কেমন হবেন একটু বুঝে নেয়া চাই। সম্পাদিকা জয়া দত্ত সঙ্গে ছিলেন। জিজ্ঞেস করলাম, ওখানে কি বাংলাতে বললে লোকে বুঝবে, না অসমিয়াতে বলতে হবে? উনি জিজ্ঞেস করলেন, আপনি লোক সংখ্যা শুনে ঘাবড়ে যান নি তো? প্রশ্নটা বিব্রত করল। কী বোকার মতো প্রশ্ন। বললাম, স্থান কাল পাত্রটা বুঝে নিতে হবে না? তাই।
            রবীন্দ্রজন্মজয়ন্তীতে হাজারখানিক লোক হতে কোনো নিষেধ নেই। কিন্তু, ওখানে একটু অবাক হবার কথাই বটে। শুনলাম ওদের ওখানে রবীন্দ্রস্মৃতি বিদ্যালয় প্রাঙ্গনে এই জন্ম জয়ন্তী অনুষ্ঠানের বয়স আঠাশ বছর। এতো বড় অনুষ্ঠান গোটা উজান অসমে আর কোথাও হয় না। ওখানকার সমস্ত ভাষা ধর্মের মানুষ তাতে যোগ দেন। ওই ভাষা ধর্মের মিলনের কথাটা অবশ্যি তাদের আমন্ত্রণ পত্রেই জেনেছিলাম। কিন্তু তিনসুকিয়ার থেকে মাইল বিশেক দূরে সবচে’ বড় রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তী হয় আর আমি জানিনা জেনে নিজেই লজ্জিত হলাম। চুপ রইলাম।
              পথের কাছে , গাড়ি থেকে নেমে দেখি বিশাল তোরণের সামনে  এক বিশাল জনতার জটলা। প্রবেশ পথে পুলিশের প্রহরা। দুরু দুরু বুকে কিছু দূর হেঁটে অনুষ্ঠান মঞ্চের কাছে গিয়ে তো আমার চোখ চড়ক গাছ। ওখানে সলমন খানের এক্কেবারে নতুন হিন্দি সিনেমার গানের তালে নাচছে দুই কচি ছেলেমেয়ে, ছেলেটি মেয়েটির নিতম্বে তালি বাজাচ্ছে! তখনো ওদের প্রতিযোগিতাগুলো চলছে ওটা শেষ প্রতিযোগিতা। গুরু গম্ভীর নাম আছে এর ‘classical & semi classical’ তাতে আরো কয়েকটি নাচ গান শুনবার সৌভাগ্য হলো, একটি ঝাড়খন্ডি গানের সঙ্গে আদিবাসি ছেলেমেয়েদের নাচ আমাকে বেশ আমোদ দিল। ভাবলাম এরা যে এই মঞ্চ পেয়েছেন এই বড় সৌভাগ্য। মেধা প্রকাশের জন্যে ওদের কত লড়াই করতে হয় সে তো জানি। কিন্তু বাকি নাচগুলো যাই হোক, গানগুলোতো মনে হলো না এই ছেলেমেয়েরাই বছরখানিক পর আর শুনতে চাইবে বলে! তার নাম ক্লাসিক্যাল!! এসে ঠকে যাইনি তো!
                সামনের সারিতে সম্মানিত অতিথির আসনে বসে আছি। একে একে কর্মকর্তারা ফাঁক পেয়ে এসে আলাপ করছেন, পরিচিত হচ্ছেন। সংস্থার সভাপতি, অতি বৃদ্ধ কনক গগৈ মহাশয় জানালেন এই অনুষ্ঠানে সমস্ত জনগোষ্ঠীর মানুষ যোগ দেন , সবার মন রেখে অনুষ্ঠান সাজাতে হয়। বিশালতার রহস্য বোঝা গেল। আমার শহুরে সংস্কৃত মন কুঁচকে ছিল। রেগে যাচ্চিল। ঠোঁট কাটা বলে বদনাম একটা আছে। ভাবলাম, বলে দেব কি, এই অনুষ্ঠান না করলেই কি নয়! বলা যেত, যদি লোক কম হতো, এই ভিড়ে মৌনং বুদ্ধিমান লক্ষণঃ , নইলে আর বাড়ি ফিরতে হবে না। কিন্তু সময় যত এগুলো, আরো জানা গেল, আগের দিন পুরো অনুষ্ঠান হয়ে গেছে রবীন্দ্রনাথকে কেন্দ্র করেই। দ্বিতীয় দিনেই একে করে তোলা হয়েছে বিচিত্রানুষ্ঠান। তাতে অসমিয়া বাঙালি ছেলে মেয়ের দল যেমন তেমন নেপালি, ঝারখণ্ডি আদিবাসি ছেলেমেয়ের দল যে কখনো সলমন খান, কখনো মাইকেল জেক্সনের নাচের অনুকরণটা দেখাচ্ছিল ওরা তেমন মঞ্চ পেত কই আর কোথায়! তাই বলে ওই সব বিজাতীয় গান? আমার মনের সঙ্গে তর্ক করছিলাম!    
             ওদের গানের তালে নাচলে শুনতটা কে! দেখতে ভিড় করতটা কে! করত ! যুক্তির জোরে নাহয় নিজেকে বোঝালাম ঠিক মতো নাচলে লোক আসত দেখত ভিড় করত। কিন্তু ওদের বোঝাবে কে, আর ওরা বুঝবেই কেন? বছর কয় আগে, ঘটা করে একটা ঝাড়খন্ডী গান সমগ্র অসম তথা পূর্বোত্তর ভারতে জনপ্রিয় হয়েছিল ‘চল গোরি…’ । ঝাড়খণ্ড অব্দি গেছিল সেই গানের ঢেউ।কিন্তু, গেয়েছিলেন অসমিয়া শিল্পী কৃষ্ণমণি চুতিয়া। খুব ভালো কথা। কিন্তু তিনিও যখন সেই গানের ভিডিও এলবাম করেন কালো চামড়ার আদিবাসি ছেলেমেয়েদের নিতে ভয় পেয়েছিলেন। অভিনয় করেছিল সাদা চামড়ার সমস্ত অসমিয়া ছেলেমেয়েরা। তাই কালকের স্টেজে কালো চামড়ার আদিবাসি ছেলেমেয়েরা বেছে নিয়েছিল মাইকেল জ্যাকসনের গান। আমার মধ্যবিত্ত মন নাক কুঁচকে যেতেই পারে, এরা রবীন্দ্রনাথকে জানে না, চেনে না, বোঝেনা ভেবে। কিন্তু ওদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে আসবার কোনো শ্রম করেছে কি মধ্যবিত্ত মন। হঠাৎই মন প্রশ্ন করল, আচ্ছা এরা কি রবীন্দ্রনাথকে অপমান করছেন নিজেদের অজ্ঞতা আর উপেক্ষা দিয়ে? না রবীন্দ্রনাথ এখনো সমানে লড়ছেন এদের উপর চেপে বসা নির্জাতিকরণের বিশ্বায়নের সংস্কৃতির বিরুদ্ধে। গোটা ব্যাপারটা আমার কাছে স্পষ্ট হয়ে গেল। আর কোনো দ্বিধা রইল না, রইলনা সংস্কারের বাঁধা। লড়ছেনই তো! আমাকেও লড়তেই হবে।
                  যারা এখানে সমবেত হয়েছেন, যারা এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছেন তাদের সমস্ত সম্মান জানিয়েই ওদের লড়াইয়ের সেই স্পৃহাকে জেনে নিতে হবে, চিনে নিতে হবে। আর তাদের কাছে পৌঁছে দিতে হবে রবীন্দ্রনাথকে! মধ্যবিত্ত তো নিজের অহংকার নিয়ে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে অতোটা আম-জনতার ভিড়ে মিশে যায় না। সেখানে সহজেই পৌঁছে যায় বাজার। সে সাধারণ বাঙালি, অসমিয়া ছেলেমেয়েদের কাছেও সত্যি। বাজারটাকেই জগৎ ভাববার ভ্রমে সে পড়তেই পারে। তার ভেতরেই সে তৈরি করে তার এক নিজস্ব লৌকিক জগৎ। কারণ, ওরা যেভাবে নাচছিল গাইছিল বাজার ঠিক সেরকম করে গায় না। । বাজারকে আয়ত্ব করে ওরা কেমন ভেতর থেকে বাজার কে অন্তর্ঘাত করেন সেতো এই ক’বছরে দেখেছি। আমাদের শিল্পীদের চিনতই না গোটা উগ্রজাতীয়তাবাদী ভারত বর্ষ। আজ প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চল থেকে যে ছেলেমেয়েরা প্রত্যহ্বান জানাচ্ছে তার রহস্য আঁচ করলাম। ওদের অনেকেকেই বাজার গিলে ফেলে। সে জানি, কিন্তু অনেকে ওখান থেকেই এক উল্টরথের রশি ধরে টান মারে তাতেই উঠে আসে জুবিন গার্গ, দেবজিৎ সাহা,…। এ ছাড়া আপাতত নান্যপন্থা… আছে কি! আমি জানিনা।
                 আমি তাই সোজা, বলতে উঠে আয়োজকেরা যে দক্ষতার সঙ্গে কেবল গুটিকয় অহংকারি বাঙালি নয়,রবীন্দ্রনাথের বৈচিত্র ময় ভারতবর্ষকে সংগঠিত করেছেন তার জন্যে অকুন্ঠ ধন্যবাদ জানালাম। তাদের উগ্রজাতীয়তাবাদ বিরোধী রবীন্দ্রনাথ, ফ্যাসিবাদ বিরোধী রবীন্দ্রনাথ, গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ, শিলাইদহের রবীন্দ্রনাথ, শ্রীনিকেতনের রবীন্দ্র নাথ, বাউল গানের রবীন্দ্রনাথ, মণিপুরি নাচের রবীন্দ্রনাথ, পৌষমেলার রবীন্দ্রনাথ, রথীন্দ্রনাথের পিতা রবীন্দ্রনাথ, রামকিঙ্করের রবীন্দ্রনাথের গল্প শোনালাম।রাত ১১ টাতে বক্তৃতা এবং পুরষ্কার বিতরণের অনুষ্ঠান শেষে দেখলাম সঞ্চয়িতা, গীতবিতান আর গীতাঞ্জলীর বাইরেও রবীন্দ্রনাথ রয়েছেন জেনে বেশ ক’জন মধ্যবিত্ত সম্মানিত অতিথিও বেশ অবাক হলেন। আয়োজকদের অন্যতম ছিলনে দীপক মিত্র, রবীন্দ্র স্মৃতি বিদ্যালয়ের শিক্ষক। কঠোর পরিশ্রম করছিলেন দেখলাম। আসবার সময় বললেন, আপনার কাছে আমি আসব স্যার! আপনাকে আবারো আমাদের মধ্যে আসতে হবে। মনে মনে বললাম, আসতে পেলে আমি স্বয়ং ধন্য হব। এমন রাবীন্দ্রিক পরিবেশ আমি আর পাবই বা কোথায়! রাত ১২টায় যখন ফিরে আসছিলাম তখনো ‘আর্টিষ্ট’ মঞ্চে ঊঠেন নি। কখন উঠবেন তাই চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করছিল পেছনের কিছু ছেলেরা। শুনলাম ‘আর্টিষ্ট’ যখনি উঠুন, রাত ভোরের আগে নামবেন না!
                  সত্যের খাতিরে বলে রাখিঃমাঝে মাঝে কিছু ছেলেমেয়ারা অসমিয়া আধুনিক গান, ঝুমুর গানের সঙ্গেও নাচছিল সেই সত্য না উল্লেখ করলে সত্যের অপলাপ হবে। তিনটি ছেলে রবীন্দ্রনাথের গানের তালে পা মিলিয়ে দারুণ নাচ দেখালো যে শিলচরের বাইরে এমনটি দেখার অভিজ্ঞাতা আমার তিনসুকিয়াতে অন্তত কখনো হয় নি।

Saturday 9 July 2011

শ্রীহট্টের প্রাকৃতিক শোভা



প্যারীচরণ দাস (১৮৪৬-১৮৮৭)


( মাইকেল মধুসূদনোত্তর যুগের শ্রীহট্টের প্রথম এবং শ্রীহট্ট কাছাড়ের  দ্বিতীয় আধুনিক কবি প্যারীচরণের ‘পদ্যপুস্তক’ ৩য় ভাগে রয়েছে এই কবিতা। উৎসঃ প্যারীচরণ দাসঃ জীবন ও কাব্যকৃতি; জন্মজিৎ রায়; নাইন্থ কলাম, একাদশ বর্ষ, মে ২০১১)

শ্রীহট্ট লক্ষীর হাট, আনন্দের ধাম,
স্বর্গাপেক্ষা প্রিয়তর এ ভূমির নাম।
জন্মভূমি, তেঁই ইহা আমার নিকটে
জিনিয়া ত্রিদশালয় গৌরব প্রকটে।।
বিদেশের বর্ণনায় মুগ্ধ তনু মন,
মোহবশে দেশপানে চাইনে কখন ।
ভ্রান্তিমদে মাতি আমি যথা তথা যাই,
স্বদেশের পানে হায়! ফিরিয়া না চাই।।
কি ছার নন্দনবন কল্পনা কল্পিত,
হয় কি প্রকৃত তাহে প্রসূন কলিত?
মিছে শুনে কবি তথা অলির গুঞ্জন,
কবির কল্পনা মাত্র মন্দারের বন।।
প্রকৃতির ভাণ্ডারেতে শ্রীহট্টের মাঝে
কতশোভা মন লোভা সর্বত্র বিরাজে।
প্রতিভা প্রসূত নয় প্রকৃতির বিষয়,
দেখ না পথিক গিয়ে মনে যদি লয়?
ধবল তুষার শৈল, মরু ভয়ানক,
আগ্নেয় পর্বত, হ্রদ, ঘূর্ণিত উদক,
ঘন ঘোর নাদি পাত জলের কল্লোল ,
নীরনিধি সাগরের উত্থলি হিল্লোল
উত্তুঙ্গ সুমেরু শৃঙ্গ ভীষণ দর্শন,
দর্শকের হয় যাতে ভয় উদ্দীপন,
ছাড়িয়া বারেক ভাই করি আগমন
শ্রীহট্টের চারুশোভা কর দরশন।।
যেদেশেতে শরমার বালিময় চরে
হেমন্তে সারস বক সুখে কেলি করে
স্রোতহীন তটিনীর নিরমল জলে
সাঁতারে মরালকুল অতি কুতূহলে
কলনাদে রাজঁহাস জলে করে খেলা
কুন্দশ্বেত বলাকার মিলে মঞ্জুমেলা।
আর কত জলচর বিহঙ্গের কুল
নয়নের তৃপ্তিকর নাহি যার তুল।।
যে দেশের বনশোভা অতুলন ভবে,
প্রকাণ্ড দীর্ঘল দ্রুম আপন গৌরবে
উচ্চশিরঃ; ঝোপঝাড়ে সুষমার সীমা
বিভূষণা বনমধু লতার মহিমা।।
কতশত বনফল কাননে ফলিত,
কত শত পুষ্পকলি কন্দরে কলিত।
বিপিনের কলকণ্ঠ সুগায়কগণ
নিত্যপ্রাতে বিভুগণ করে সংকীর্তন।।
অদূরে পাহাড় শোভে নীলনভঃ তলে,
কত নদী নির্ঝরিণী-উপবীত গলে,
অপূর্ব গম্ভীর মূর্তি প্রশান্ত দর্শন
দেখ দূরে, যেন যোগী যোগে নিমগন।।
কমনীয় দুর্বাদলে কষায়িতমুখ
তরুতলে মৃগনাভ ভুঞ্জে শান্তিসুখ ।
সুলোচনা কুরঙ্গিণী চঞ্চল চরণে
দ্রুত আসি তোষে তার অঙ্গ কণ্ডুয়নে।।
যে দেশেতে কমলার শোভা চমৎকার
ললিত ললাম লাল বর্ণের বাহার।
কি কোমল অঙ্গ! তায় সুবাস সঞ্চার,
কি মধুর রস! পানে তৃপ্তি সবাকার ।।
কমলা কুসুম আহা কিবা মনোহর,
মধুলোভে মধুকর পাশে নিরন্তর।
অদূরে বিপিন মাঝে নয়নরঞ্জন
মধুচক্রে পথিকের কেড়ে লয় মন।।
ভারতে কোথাও আর খুঁজে মিলা ভার
কমলা মধুর সম দ্রব্য মিষ্ট তার।
হায় বৃথা পুরাকালে নয়নের নীরে
তিতিলা দানব কুল জলধীর তীরে।।
না পাইয়া সুধা ( যবে ঈষৎ হাসিয়া
ভুবন মোহিনী মুখে, দিলেন বাটিয়া,
মোহিনীমোহন কান্তি দেবে দেবসীধু)
ছিল না কি এ সংসারে কমলার মধু?
যে দেশে জনমে অতি মিষ্ট আনারস
সিন্ধুমথা সুধাসম মিষ্ট যার রস।
কাঁঠাল রসাল পেঁপে আদি ফল নানা
প্রভূত সম্ভূত কালে কে করে গণনা।।
শ্যামল ক্ষেত্রে শোভে শস্য নানা জাতি,
কেদারে কেদারে শুন কৃষকের গীতি।
ইক্ষু ক্ষেত্রে ইক্ষু যথা বীরের বিশিখ,
পাতাগুলি সমুন্নত ঊর্ধদিগে শিখ।।
পাহাড়ে অগরু আছে আতরের মূল,
যার গন্ধে বিলাসীর পরাণ আকুল!
চাহার পাতার আর রবরের গাছে
ইতিপূর্বে কে জানিত এতগুণ আছে?
গবয় মহিষ হাতি বৎসরে বৎসরে
শত শত ধরা পড়ে বিলাসের তরে।
তথাপি বিলাস বাঞ্ছা পূর্ণ নাহি হয়,
নিষ্ঠুর মানব মন কভু তুষ্ট নয়।।
শৈলপুত্রী শৈবালিনী প্রবাহে মিশিয়া
আকর কাঞ্চনকণা নাচিয়া নাচিয়া
আসে চলি; গড়ি গড়ি গজমুক্তা মালা,
পায় সদা পিতৃস্থানে এ যৌতুক বালা।।
তড়াসেতে নলিনীর শোভা চমৎকার
মৃদুমন্দ সমিরণে দোলে বারে বার।
মকরন্দ লোভে অলি গুঞ্জে চারিধারে
বায়ুভরে দোলে দল বসিতে না পারে।।
হাস্যমুখী কুমুদিনী উৎপনিনী সনে,
মধুলোভা মধুপের আনন্দ গুঞ্জনে,
হইত তুলনা তারা উদিত কখনে
নীলাভ নীরদ মালা সঙ্কুল গগনে।।
শততঃ শ্রীহট্ট শ্রীর অচল আবাস,
প্রকৃতির প্রীতিনেত্রে তাহাই প্রকাশ।
জঘন্য মানব , যেই করে আচরণ
পরদ্বারে ভিক্ষাবৃত্তি থাকিতে আপন।।
সুবোধ সন্তান তারে বলে জ্ঞানীজনে,
ভুঞ্জে যেই ঘরে যাহা আনন্দিত মনে,
অতএব স্বদেশের স্বভাবদর্শন
কর জ্ঞানী ত্যজি নিন্দামাদক সেবন।।

মেলিয়া নয়ন হের মন-প্রাণলোভা
স্বর্গীয় সৌন্দর্য সার স্বদেশের শোভা।
হায় রে সৌভাগ্য সদা হবে কি এমন
দেখিয়া ওরূপ রুচি জুড়াইব মন।।