আমার চেতনার রঙে রাঙানো এই খেলা ঘরে:

~0~0~! আপনাকে স্বাগতম !~0~0~

*******************************************************************************************************

Sunday 20 May 2012

আমাদের অন্য সমস্ত স্বপ্ন ভাষার সঙ্গে বিদেয় নিয়েছে-- তারা সবাই শহীদ হয়েছে

                 (ত্রিপুরার কাগজ সাতকাহনের জন্যে এটি চটজলদি এক তৈরি লেখা,
           বেরুলো ১৯শে মে, ২০১২। সামান্য সংশোধন সংযোজন করে ব্লগে তুললাম)

           শুকিয়ে গেছে রক্তের দাগ
                   বাতাসেও নেই আর কার্তুজের ঝাঁঝ
                   বহুদূর চলে গেছে একা রেলপথ
                   বেদীগুলো আজ শুধু নিস্তব্ধ স্মারক
                   দু’একটা চিল কি এখনো নীল রোদে
                   ডানা মেলে?

                  তবুও তোমার কাছে প্রতিরাতে বসে থাকে
                  স্তব্ধ, বোবা, ভাষাহীন একটি মানুষ।
                                                           ।। সৌমিত্র বৈশ্য ।।
       শিলচরে বড় হবার সুবাদে ছেলেবেলা থেকে দেখতাম রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তীর দিন কতক পরেই পাড়ায় পাড়ায় আরেকটি দিন উদযাপনের ধুম পড়ে যেত, সেটি ১৯শে মে। ১১ শহীদের ছবি একটা চেয়ার বা অস্থায়ীভাবে তৈরি বেদীর উপর রেখে ফুলে ধূপে সাজিয়ে রাখা হতো, কেউ কেউ পাশে বাংলা দেশাত্মবোধক গান মাইকে বাজিয়ে দিত, কেউ নয়। এই রীতিতে দিবস উদযাপনের রীতিটি বোধ করি শিলচরীয়, বা কাছাড়ি ব্যাপার। কেননা, ব্রহ্মপুত্র উপত্যকাতে ওমন দেখা যায় না। রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তীতে বা নেতাজী জয়ন্তীতে কেন্দ্রীয়ভাবে প্রভাত ফেরি হতো, স্কুল থেকেই যোগ দিতে বলা হতো। কিন্তু ১৯শের কোনো পথ চলাতে গেছি বলে মনে পড়ে না। কলেজে গিয়ে জেনেছি যে ১৯শের দিনে খুব সকালে শিলচর শ্মশানে জড়ো হওয়া আর বিকেলে গান্ধিবাগ শহীদ বেদীতে একটি নিয়মিত প্রথা। পথ চলা টলা ইত্যাদি সাম্প্রতিক। সেই ১৯৮৬তে যখন ১৯শের ২৫ বছর উদযাপিত হয়েছিল , ওদিকে আবার সেবা সার্কুলারের বিরুদ্ধে উপত্যকা তথা গোটা অসম উত্তাল ছিল তখন হয়েছিল বটে এক বিশাল শোভাযাত্রা, এর পর বোধহয় কেন্দ্রীয়ভাবে ওমন শোভাযাত্রা সন্মিলিত সাংস্কৃতিক মঞ্চ এবং ভাষা শহীদ স্টেশন দাবি সমিতির প্রচলন।
পাড়ায় পাড়ায় স্থায়ী শহীদ বেদি নির্মাণের ব্যাপারটি জনপ্রিয় হতে শুরু করে ওই ১৯৮৬র পর, বিশেষ করে বাংলা পঞ্চদশ শতককে ( ১৪০০ সাল) যখন বরণ করা হচ্ছিল তখন থেকে। তার আগে শহরেও এতো শহীদ বেদী ছিল না, আর গাঁয়েগঞ্জেতো মোটেও না। এখনো উধারবন্ধ, পাথারকান্দির মতো ছোট শহরগুলো বাদ দিলে উনিশ উপত্যকার কোনো প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে পালিত হয় কিনা আমার সন্দেহ আছে। বাংলাদেশে , পশ্চিম বাংলাতে, ত্রিপুরাতে বা অন্যত্র উনিশ পালনের ব্যাপারগুলোও অতি সাম্প্রতিক। এগুলো সম্ভবত প্রচার মাধ্যমের অবদান, অবশ্যি সংগঠিত উদ্যোগও রয়েছে। ১৯৮৬র আগে কবি লেখকেরাও ১৯ নিয়ে খুব যে লিখেছেন বলা যাবে না। শক্তিপদ ব্রহ্মচারীর সেই বিখ্যাত পংক্তি "দশটি ভাই চম্পা আর একটি পারুল বোন কলজে ছিঁড়ে লিখেছিল, এই যে ঈশান কোণ" আশির দশকের আগে লেখা নয়। এই নিয়ে তাঁকে এবং তাঁর সময়ের অনেক কবি লেখককে আশির দশকে প্রচুর কথা শুনতে হয়েছে। কিন্তু ১৯৮৬র ২১ জুলাইর পর এটি প্রায় অলিখিত নিয়মে পরিণত হয়েছে যে যিনিই দুলাইন গদ্য বা পদ্য লিখবেন বরাক উপত্যকাতে তিনিই ১৯ কিম্বা ২১ নিয়েও অবশ্যই লিখবেন, পারলে বই করবেন শুধু এই একটি বিষয় নিয়ে। কার বই কত বেশি, কে আগে কে পরে, কে কত ইতিহাস জানেন কিম্বা জানাতে পারেন এই নিয়ে রীতিমত প্রতিযোগিতাও দেখা গেছে। এতে অবশ্য কোনো লাভ হয় নি তা নয়, অঞ্চলটির ভাষা, ইতিহাস, সংস্কৃতি, ভূগোল, অর্থনীত , রাজনীতি ইত্যাদি নিয়ে গভীর অধ্যয়নের আগ্রহও বেড়েছে প্রচুর। সুজিৎ চোধুরী, অমলেন্দু ভট্টাচার্য, সঞ্জীব দেব লস্কর, কামালুদ্দীন আহমেদ, আবুল হোসেন মজুমদার , ইমাদউদ্দীন বুলবুল প্রমুখের মতো বেশ কিছু পণ্ডিত গবেষকের আন্তরিক কাজের প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে ১৯ শে মে, ২১ জুলাই বললে ভুল বলা হবে না। অনেকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাও ১৯শেরই দান। এটা পরোক্ষ সত্য। আসলে সত্তরের শেষ এবং আশির শুরুতে ছবছরের অসম আন্দোলনের দিনগুলোতে গুয়াহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের যে সব তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছিল সেটিই বিশ্ববিদ্যালয় আন্দোলনকে জোর দিয়েছিল। তবে কিনা, ষাটের ভাষা আইন নিয়ে বিবাদ এবং অসম আন্দোলন দুটোরই প্রেরণা ছিল অসমিয়া উগ্রজাতীয়তাবাদসেই সুবাদে বিশ্ববিদ্যালয়কে ১৯শের সঙ্গে জুড়া যায় বইকি।
এহেন যে ১৯ , ২১ সেই নিয়ে আমি নিজে কোনোদিনই লিখতে বিশেষ আগ্রহ বোধ করিনি। কেন, ব্যাপারটা খুলে বলি। ছেলে বেলার ১৯ উদযাপনের মানে বুঝতে বুঝতে যখন বড় হচ্ছি , ঠিক তখনইতো ১৯৮৬র ধাক্কা। নিজেও সেই লড়াইয়ের সামনের সারিতে ছিলাম। অগপ সরকার এসে অষ্টম শ্রেণি থেকে অসমিয়া পড়াটা বাধ্যতামূলক করে নির্দেশ দেবার পরে লড়াইতে যোগ দিইনি। বস্তুত, অসম আন্দোলনের বিভৎস দিনগুলোর উত্তাপের আঁচ পেতে পেতেই তো বড় হওয়া, তাই কলেজে যেতেই জড়িয়ে গেছিলাম ছাত্র আন্দোলনে। লড়াইর নামে তখন রক্ত গরম হয়ে পড়ত। অনেক দিনের খাটাখাটুনির পর, প্রথমে ১৯৮৫র অসম চুক্তি, এবং পরে ঐ সেবা সার্কুলারের পর এক বড় লড়াইয়ের পরিবেশ তৈরি হতে শুরু করল। ভেবেছিলাম এবারে একটা হেস্তনেস্ত হবে। শিলচর পাবলিক উচ্চতর মাধ্যমিক স্কুলের প্রথম দলটির ছাত্র হিসেবে নরসিং উচ্চতর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে চূড়ান্ত পরীক্ষাতে বসেছি আর দুটো পরীক্ষার মাঝের বিরতিতে  জেলা উপায়ুক্তের কার্যালয়ের সামনে এসে সহকর্মীদের সঙ্গে যোগ দিয়ে স্লোগান দিচ্ছি ---এই স্মৃতি এখনো ভুলিনি আমি। লেখাপড়া লাটে উঠেছিল। রাতে বাড়ি থাকতে মানা করছিল, সহকর্মীরা নইলে পুলিশ তুলে নেবে।
দেখলাম ২১ জুলাই, ১৯৮৬ করিমগঞ্জে পুলিশের বেপরোয়া গুলি চালনা এবং অত্যাচারের পর আন্দোলনটা দ্বিগুণ তেজে জ্বলে উঠবে কই, উলটে নেতিয়ে গেল। সভা ডাকলে সংগঠনের সভাতেই লোক কম আসতে শুরু করল। এবং ১৫ আগষ্ট যখন সার্কুলারটি স্তগিত করল সরকার তখন সত্যি লড়াইটা মরেই গেল। তার পরেও, আমরা বহুদিন বহুভাবে সড়ক, বিশ্ববিদ্যালয়, বন্যা, বিদ্যুৎ, কৃষিঋণ ইত্যাদি নিয়ে লড়াই চালিয়ে গেছি, বরাক উপত্যকাতে সেদিনকার সংগঠনগুলো নানা ভাবে এখনো সেই লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন ঠিকই, কিন্তু সংগ্রাম সমন্বয় সমিতি নামে যে মহা ঐক্যজোট সেবা সার্কুলারকে ঘিরে গড়ে উঠেছিল সেটি আর অক্ষত ছিল না বেশি দিন। তখন জেনেছি, ১৯৬১র ১৯ মের পরেও ঘটনা তাই ঘটেছিল। একমাস পরে হাইলাকান্দিতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাতে সে লড়াই কলঙ্কিত হয়েছিল। ঠিক যেমন স্বাধীনতা কলঙ্কিত হয়েছিল দেশভাগে। আর পশ্চিম বাংলার বঙ্গবন্ধুরাও রাজ্যের শাসন হাতে পেয়ে আনন্দে মেতেছিল, তেমনি ঐ বরাক উপত্যকার সরকারি ভাষা বাংলা, গুয়াহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তরে বাংলা, বাংলা মাধ্যমের স্কুল এমন কিছু ছুটকো দাবি আদায় করেই বরাক উপত্যকার লড়াই চুপ মেরে গেছিল। ব্রহ্মপুত্র তখন দিন গুনছিল ১৯৮৩র ১৮ ফেব্রুয়ারীর । যেদিন নরখাদকদের হাতে এক রাতে দু'হাজারের বেশি নরনারী শিশু প্রাণ বলি দিয়ে দেবে। তার আগে পরে, বিচ্ছিন্ন নরহত্যার হিসেব নিলে সংখ্যাটা তিন হাজারের উপরে যাবে। তখন আর কেবল ১১ কিম্বা ৮৬র ২জনকে আলাদা করে মনে থাকে কী করে!
আমার এখনো মনে হয়, বরাক উপত্যকার বুদ্ধিজীবিরা যখন সেই পঞ্চাশ বছরের আগেকার ১১ শহীদের আর সেই বীরত্বপূর্ণ লড়াইএর বার্তা বরাক উপত্যকার বাইরে নিয়ে যান তখন আসলে নিজেদের তাঁরা বড় নয় , ছোটই করেন। কারণ নীরব স্রোতারা কী একবারের জন্যেও নিজের মনকে বা পাশের বন্ধুটিকেও জিজ্ঞেস করেন না, এর পরের পঞ্চাশ বছর আপনারা করলেনটা কী? আপনাদের প্রতিবেশী দেশ এবং রাজ্যের ইতিহাসেতো এরপর এর চেয়েও বহু বেশি রক্ত ঝরেছে, পালটে গেছে ভূগোল কিম্বা ইতিহাস! সম্প্রতি শিলচর রেল স্টেশনকে ভাষা শহীদ স্টেশন নামে নামাঙ্কিত করবার দাবিতে একটি লড়াই দানা বেঁধেছে। তাতে ভাষা ধর্ম নির্বিশেষে মানুষের সমর্থণ দেখা গেছে। শ্রেণি নির্বিশেষে বলা যাবে না। সন্মিলিত সাংস্কৃতিক মঞ্চ এবং ভাষা শহীদ স্টেশন দাবি সমিতি রয়েছে এই আন্দোলনের পুরোভাগে। এর জন্যে আইনত দরকার রাজ সরকারের অনুমোদনও আদায় করা গেছিল। কিন্তু গেল বছর এটি আটকে দিল কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক। এই বলে যে, দাবিটি বুঝি আঞ্চলিক দেশপ্রেমের চিহ্নায়ক। গেল পঞ্চাশ বছরে যত দোষ দিসপুর ঘোসের ঘাড়ে চাপিয়ে অভ্যস্ত বরাক উপত্যকার মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবির কাছে এটি বোধকরি অবিশ্বাস্য আঘাত। তাঁরা জ্বলে উঠবেন কৈ, মিইয়ে গেছেন। সংগঠন দুটো এখন প্রাণপণ করছে লড়াইকে জিইয়ে রাখতে। তাই, আপাতত, তাঁরা স্টেশনে খ্যাতনামা ভাস্কর স্বপন পাল নির্মিত শহীদ বেদী বসাবার পরিকল্পনা নিয়েছেন। এরকম কাজে মধ্যবিত্ত বেশ স্বচ্ছন্দ বোধ করে, তাদের জাগিয়ে চাগিয়ে রাখতে বেশ সুবিধে হয়। এই বলে আমি সংগঠনদুটোকে খাটো করছি না, মোটেও তাদের বেচারি উপায় নেই অন্য।
আমি কি খুব হতাশার গল্প শোনাচ্ছি? মোটেও না। ১৯৬১ ভাষা আন্দোলন অসমের বাঙালির একার লড়াই ছিল না। এটা বরাক উপত্যকার থেকে যেসব ইতিহাস গ্রন্থ লেখা হয় তার প্রায় সবকটিতেই রয়েছে। মিজো, খাসি, বড়ো, মণিপুরি সব্বাই ছিলেন। তার পরে এদের অনেকেই স্বতন্ত্র রাজ্য নিয়ে বেরিয়ে গেলেন, নিজেদের ভাষাকেও সরকারী ভাষার মর্যাদাতে প্রতিষ্ঠা দিলেন। প্রতিবেশি বাংলাদেশের কথা না হয় আনলামই না। আমাদের তাত্বিক তখন প্রবন্ধ লিখলেন, আমার মধ্যে ঠিক আঞ্চলিক বোর্জুয়া গড়ে উঠেনি। স্বশাসন কিম্বা স্বতন্ত্র রাজ্যের দাবিতে এখনো লড়ছেন ডিমাছা, বডো, কার্বিরা। আমরা যেখানে ছিলাম, সেখানেই আছি।  বড়জোড় কাছাড়ে ছিলাম , এখন বরাক উপত্যকার মানুষ হয়েছি। এমন কি ১৯৭২এ মাধ্যম আন্দোলনে আমাদেরই লোকের হাতে করিমগঞ্জে শহীদ হয়েছিলেন বাচ্চু চক্রবর্তী, তাঁকে আমরা এখনো শহীদের মর্যাদা দেব কি দেব না এই নিয়ে গধুর তর্কে মাতি। ঘটনা হলো, অসমিয়ার সঙ্গে সেদিন যে ইংরেজিটাও উচ্চশিক্ষার মাধ্যম হিসেবে থেকে যেতে পেরেছিল তার পেছনে মূল অবদানটি আসলে ছিল আহোমদের। ২১ জুলাইর করিমগঞ্জের গুলিচালনার পর সরকার আন্দোলনটিকে দমিয়েই দিয়েছিল। নতুন করে প্রস্তুতি নিচ্ছিল অসমের তাবৎ জনজাতীয় সংগঠনগুলো আটসুর নেতৃত্বে। তারা হুমকি দিয়েছিল ১৫ আগষ্ট , ১৯৮৬র আগে যদি সেবা সার্কুলার স্তগিত না হয় তবে তাঁরা ব্যাপক লড়াইয়ে নামছেন। ঠিক সেই দিনটিতেই স্তগিত হয়েছিল। জনপ্রিয় প্রচারে এগুলোর উল্লেখ মেলে না। জনপ্রিয় প্রচারটি হচ্ছে যে, লড়াইগুলো বাঙালির লড়াই, বাঙালি লড়েছে, রক্তও বাঙালি দিয়েছে।
এমন কি ভাগ্যিস, এতো দিনে ছোটখাটো এক মুসলমান মধ্যবিত্ত জগৎ গড়ে উঠেছে। অন্যথা, নব্বুইর দশকের শুরুতে ইমাদ উদ্দীন বুলবুলের ভাষা সংগ্রামের ইতিহাস নিয়ে লেখা বইটির আগে নির্লজ্জের মতো, বহু কবি লেখকদের মুখেই এই প্রশ্ন শোনা যেত, ১১ শহীদের মধ্যে একজনও মুসলমান নেই কেন? এই প্রশ্নটি যে কেবল সাম্প্রদায়িক নয়, আত্মঘাতি---এই প্রশ্ন যে কৌতুহলকে উত্তর সন্ধানে প্ররোচিত করবার বদলে প্রস্তুত উত্তরকে দিয়ে প্রাচীর গড়ে তোলে এটি বুঝবার বোধটুকুও নেই এই সব বুদ্ধিজীবিদের।
শিলচর বিশ্ববিদ্যালয়ে জনসংখ্যানুপাতে যথেষ্ট মুসলমান নেই কেন?---- এই প্রশ্ন তুলে এখন যখন ছাত্র আন্দোলন হচ্ছে, এর মধ্যে বরং অনেকেই সাম্প্রদায়িকতার গন্ধ পাচ্ছেন সহজে। বস্তুত, এতেই আছে সেই প্রশ্নের উত্তর ----১১ শহিদের মধ্যে একজনও মুসলমান নেই কেন? এ কেবল দুটো সম্প্রদায়ের প্রশ্ন নয়, তলিয়ে দেখলে দেখা যাবে এ অনেকটাই শ্রেণিরও প্রশ্ন বটে।
              এবং আরো একটি ভেদ রয়েছে যেটি তাবৎ বৌদ্ধিক আলোচনাতে চাপা পড়ে থাকে। ভাষা নিয়ে আবেগটি মূলত মধ্যবিত্ত বিষয়। বরাক উপত্যকার শিলচর কেন্দ্রিক যে মধ্যবিত্ত সে মূলত দেশভাগের আগে পরে এই মাটিতে আসা লোকেদের নিয়ে গড়ে তোলা, যাদের শেকড় এখানকার মাটিতে খুব বেশি গভীরে গাঁথা হয়নি এখনো । আমি নিজেই যদি ছাত্র আন্দোলনের জড়িয়ে না থাকতাম এখানকার গ্রামাঞ্চল আর তার মানুষজনকে জানবার বুঝবার কোনো সুযোগই পেতাম না। আমাদের মুসলমান কিম্বা তপশিলি জাতি জনজাতি সহকর্মীরা যত সহজে এ গাঁয়ে ওগাঁয়ে সংগঠন গড়বার জন্যে আত্মীয় বন্ধুদের নাম করতে পারতেন, আমরা সিলেটি কায়স্থ, বামুন বন্ধুরা কিছুতেই তা করতে পারতাম না। আত্মগোপন করে আমাদের যদি গাঁয়ে যেতেও হতো, তবে যে পরিবেশ পেতাম সে আমাদের কাছে শুধু যে প্রাকৃতিক ভাবেই ভিন্ন তা নয় সাংস্কৃতিক ভাবেও অনেকটাই ভিন্ন হতো। অন্যথা, পুলশের গ্রেপ্তারি এড়িয়ে করিমগঞ্জ থেকে যারা পালিয়েছিলেন ২১ জুলাই বা তার পরে, তারা শিলচর হাইলাকান্দি ছড়িয়ে না গিয়ে গ্রামে ছড়াতে পারতেন এবং সেখান থেকে লড়াইকে নতুন উদ্যমে সংগঠিত করে পুনরুজ্জীবিত করতে পারতেন।
আমাদের এক কবির, ( দিলীপ কান্তি লস্কর) বহু পঠিত কবিতা আছে, “আমি কোত্থেকে এসছি তার জবাবে যখন বললাম, করিমগঞ্জ আসাম ... বাংলা ভাষার পঞ্চদশ শহিদের ভূমিতে আমার বাস/তিনি তখন এক্কেবারে আক্ষরিক অর্থই ভিরমি/ খাইয়ে দিয়ে আমাকে বললেন, ও! বাংলাদেশ ? তাই বলুন।এই আক্ষেপটি সত্য। এবং সঙ্গত। কিন্তু আক্ষেপটির একটি মধ্যবিত্ত চরিত্রও আছে। প্রশ্নকর্তা কোনো বড় ভারতীয় শহরের প্রবাসী বাঙালি হবেন। উত্তরদাতাও তাই। আমার প্রশ্ন, এমন কবিতা অসমিয়া, নাগা, মণিপুরি ভাষাতেও যে লেখা যায়, লেখা যেত--- এই তথ্য আমরা জানিতো, জানলেও মানিতো? কারণ, বাঙালি ছাড়া আর যে কাউকে ভারতের যে কোনো প্রান্তে গেলে কখনো কখনো সত্যি সত্যি ভিসা পাসপোর্টও চেয়ে বসা হয়। কিন্তু সেগুলোও মধ্যবিত্ত সমস্যা। সেই মধ্যবিত্ত বাঙালি হিন্দু যে আকছার, “ও! মুসলমান! তাই বলুন! বলে ভিরমি খাইয়ে দেয়, এবং বরাকের বিপন্ন বাঙালি হিন্দুও তাতে এককদম পেছনে যায় না, আমরা তাই নিয়ে কবিতা খুব লিখেছি কি? লিখেছি, 'সাহিত্য ১১২' তে অরিজিৎ চৌধুরীর লেখা অদেখা তুলির আঁচড়গল্প পড়ে দেখুন। গল্পের কথক কলকাতাতে ছশ স্কোয়ার ফুটের ফ্ল্যাট দরকষাকষি করাটা খুব দরকারী বোধ করছে। কেননা, আসামের যে বাংলাভাষি অঞ্চলে তার বাস সেখানে একদিকে ডি-ভোটার হবার ভয়তো অন্য দিকে মৌলবাদীদের দাপটে দেশভাগের আগের পূর্বপাকিস্তান হয়ে উঠেছে।
              এখন, যারা কলকাতাতে ফ্ল্যাট কিনতে যেতে পারেন, তাদের কাছে ভাষা শহীদ স্টেশনের নামাকরণটা যত জরুরি, ব্রডগেজ লাইন ততোটা নয়। কারণ, রেলে চড়ে মজুর কিষাণ, বাবুরা সব প্লেনে যা! নামাকরণের লড়াইটা যাদের নেতৃত্বে হচ্ছে, তাদের তদবির দেখলেই বোঝা যায় ব্রডগেজের কথাটা সঙ্গে থাকলেও লোক আসছেন ঐ নামাকরণেরই মোহে, কেননা এ তাদের আত্মমর্যাদার লড়াই। কিন্তু ব্রডগেজ কেন হবে না বলে যারা রেল অবরোধ, পথ অবরোধ আর টি আই ইত্যাদি করছে তারা অন্য। কিছু ছাত্র সংগঠন , যাদের সঙ্গে মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবি নেই! যাদের সমাবেশে গান গাইতে পাঞ্জাবী পরে কেউ যাবেন না তেমন। সামাজিক ভেদ রেখা এখনও বিলীন হয় নি, তাই পঞ্চাশ বছরে ১৯শের অর্জন নেই তেমন বিশেষ। ঢাকা দিল্লী কলকাতা কিছু দৌড়ঝাঁপ   ছাড়া ।
বছর দুই আগে গোটা বিশ্বের কাগজগুলোতে শিরোনামে এসছিলেন বৃদ্ধা বোয়া। আন্দামানের বোভাষার শেষ ব্যক্তি মারা গেলেন। এখন শুনছি, প্রতিবেশি নেপালেও কুসুন্দা ভাষার শেষ মহিলা জ্ঞানী মাইয়া সেন জীবিত আছেন। তাঁর পরে এই ভাষা বলবার মতো আর কেউ বেঁচে রইবেন না। তো সমস্যাটি যে শুধু অসমীয়া ভাষার থেকেই নয় আমরা কি জানি না? জানি, আজকাল শোনা যাচ্ছে ইংরেজি ভাষার দাপটে আর সব ভাষা যেতে বসেছে! বো কিম্বা কুসুন্দা ভাষা ইংরেজি ভাষার দাপটে যেতে বসেছে এই কথা বর্তমান লেখক বিশ্বাস করি না। আর যতদিন কেবল নিজের ভাষাকে নিয়েই ব্যস্ত থাকব আমরা ততদিন ইংরেজির দাপটকে যে হটানো যাবে তাও করি না বিশ্বাস । এই যেমন হিন্দিকে রাষ্টভাষা করে ভাবা হয়েছিল, দেশকে এক রাখা যাবে, তাতে প্রচুর বাঙালি বিদ্বানও দোহার দিচ্ছিলেন। আমরাতো পাকিস্তান পূর্বপাকিস্তানের সঙ্গে কী করল সেই কথা মনে রাখি। নিজের পাপ ভুলিয়ে দিই। দেশ এক করতে পারত না, যদি ইংরেজিকে পাশে না রেখে আপোস করত ভারত সরকার আর গদীতে আসীন হিন্দী উগ্রজাতীয়তাবাদিরা। ১৯৬৫র  ২৫ জানুরায়ী পাঁচজন তামিল তরুণ অবিভক্ত মাদ্রাজ রাজ্যে প্রাণ দিয়েছিলেন, তার পর আজকের কেরালাতে ছাত্ররা নিজের রক্তদিয়ে প্রতিবাদ পত্রে সই করবার মতো লড়াইতে নেমেছিলেন। ভাষা দাঙ্গা হয়েছিল, যাতে ষাটজন (৬০) প্রাণ হারিয়েছিলেন। এখন তাদের অনেকে ২১ ফেব্রুয়ারির বদলে ২৫ জানুয়ারীকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করবার জন্যে ইউনেস্কোরকাছে দাবি জানাচ্ছেন। ইংরেজি কেমন ভারতীয় ভাষাগুলোর উগ্রজাতীয়তাবাদের জটিল জালে টিকে আছে    এই ছবিটাও স্পষ্ট হবে যদি শুধু বরাক উপত্যকার নজির দিই। ভারতের যেকোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক স্তরে ইংরেজির বাইরেও দুই একটা ভাষা মাধ্যম হিসেবে স্বীকৃত। অসমেও যেমন অসমিয়া। কিন্তু যে শিলচর বিশ্ববিদ্যালয় ১৯শের অবদান বলে গৌরব করা হয়, তার প্রতিষ্ঠার প্রায় দুটো দশক অতিক্রান্ত হবার পরেও কোত্থাও স্নাতক স্তরে বাংলা মাধ্যম হিসেবে চালু হয় নি। স্নাতকোত্তরে সবচেবড় বিভাগটি বাংলা এই নিয়ে গৌরব করা যেতে পারে, কিন্তু অন্য সমস্ত বিদ্যাচর্চাতে বাংলাকে অস্পৃশ্য করে রাখা হয়েছে। অথচ, ভারতের প্রচুর বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে যেখানে স্নাতকোত্তর স্তরেও মাধ্যম কেবল ইংরেজি নয়। কেন? এই প্রশ্ন কাউকে তেমন করতে শোনা যায় না। ১৯শের উপত্যকার থেকে এই নিয়ে কোনো দাবিও উঠলনা আজ অব্দি! আশ্চর্য নয়? কানাঘোষা শোনা যায়বাংলা চালু করলেই মণিপুরিরাও দাবি করবে! তার মানে ইংরেজি কোথাও ব্যবহৃত হচ্ছে বড় ভারতীয় ভাষার নিম্নচাপকে প্রতিহত করতে, কোত্থাও ছোট ভারতীয়ভাষাগুলোর উর্দ্ধচাপকে দমিয়ে দিতে। ভাষা বিপন্ন হবে নাতো কি, ফলে ফুলে বিকশিত হবে!   আচ্ছা,  বরাক উপত্যকা, বা অসমে বা পূর্বোত্তরে ওমন বিপন্ন ভাষাতো প্রচুর আছে। আমরা সেগুলোর সব কটাকে অন্তত প্রাথমিক স্তরে লেখা পড়ার ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেবার দাবিতে সরব হচ্ছি না কেন? পণ্ডিতজনে বলবেন, ওদের লিপি নেই, সাহিত্য নেই। আহা! যদি বৃদ্ধা বোয়া কিম্বা মাইয়া সেনের লিপি থাকত, কবিত্ব করতে জানতেন তাঁরা আমাদের বুদ্ধির গোড়ায় তবে বেশ করে সার পড়তে পেত! ভোজপুরি কিম্বা সাদ্রি ভাষার স্বীকৃতি নিয়ে নীরব কেন ১৯শের কবিকুল!
বরাক উপত্যকার বৌদ্ধিক জগতে একটি বিশ্বাস প্রায় প্রবাদে পরিণত হয়েছে, “ধর্ম যে জাতীয়তার আধার হতে পারে না , পারে ভাষা৭১এর বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ তা প্রমাণ করেছে। না হয়, আমরা ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের ভয়াল রূপ সেদেশে দেখেছি, আমরা কি ভাষা জাতীয়তাবাদের রূপ দেখিনি ১৯শে মে, ২১ জুলাই, ১৮ ফেব্রুয়ারির অসমে? দেখেছি দেখেও আমাদের চোখ ফিরিয়ে রেখেছি বাংলাদেশের দিকে। তাও সেদেশের পাহাড়ে তাকালে আমাদের ফোকলা স্বরূপ বেরিয়ে পড়ে। অসমিয়া উগ্র জাতীয়তাবাদ থেকে কিছুতেই কম ভয়ঙ্কর নয় ওদেশের বাঙালি জাতীয়তাবাদ। তারপরেও আমরা বাংলাদেশে তাকাই, কেন? কারণ ও ভাবেই আমরা, এখনো স্বপ্ন দেখি আমাদের ভেতরকার ধর্মীয় ভেদকে ভুলিয়ে দেব, ঠিক যেমন ১৯০৫এর বঙ্গভঙ্গের বিরোধী নেতৃত্ব এক ব্যর্থ স্বপ্ন দেখেছিলেন। সেই একই নেতৃত্ব যেমন ১৯৪৭এ দেশভাগের পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন আমাদেরও তেমনি ভেতরের স্বরূপ বেরিয়ে পড়ে সামান্য সুযোগ পেলেই। অদেখা তুলির আঁচড়ের গল্পটিতো বললামই। সম্প্রতি দেখলাম শিলচর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের পক্ষে কজন লেখক, বুদ্ধিজীবি, শিক্ষাবিদ কাগজে চিঠি লিখেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে প্রবল ছাত্র-শিক্ষক আন্দোলন হচ্ছে কমাস ধরে। তার মধ্যে আলাদা করে কিছু দলিত , সংখ্যালঘু সংগঠনও যোগ দিয়েছে। কিছু কিছু সংবাদ মাধ্যমও হয়েছে সরব। দুপক্ষই দাবি করছে বিশ্ববিদ্যালয় ১৯শের অর্জন । এর সম্মান ধুলিস্যাৎ করা হচ্ছে। যারা লড়াই করছে তারা উপাচার্যের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ আনছেন। যারা উপাচার্যের পক্ষে তারা আন্দোলন করিয়েদের বিরুদ্ধে। এমনটাই দেখা যায় যখন ডিব্রুগড় বা গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ে লড়াই হলে। পক্ষ প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে জাতিধ্বংসের অভিযোগ এনে স্বপক্ষ সবল করবার চেষ্টা করে। কিন্তু সেই আন্দোলন বিরোধী বুদ্ধিজীবিরা যখন লেখেন,“ ...দেখেছি কীভাবে সংবাদমাধ্যমের একটি আমাদের সর্বনাশের ডঙ্কা বাজাচ্ছে। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে নানাভাবে প্রলোভিত করে সাম্প্রদায়িকতার পঙ্কিল পথে হেঁটে তাঁরাআমাদের বিপর্যস্ত করতে চাইছেন... তখন বুঝি আমাদের সর্বনাশের ডঙ্কা বাজবার অপেক্ষা আছে কি আর? আছে শুধু কলকাতাতে দশ ফুট বাই দশ ফুট ঘরের ফ্ল্যাট কেনার স্বপ্ন... আমাদের অন্য সমস্ত স্বপ্ন ভাষার সঙ্গে বিদেয় নিয়েছে। তারা সবাই শহীদ হয়েছে।