আমার চেতনার রঙে রাঙানো এই খেলা ঘরে:

~0~0~! আপনাকে স্বাগতম !~0~0~

*******************************************************************************************************

Friday 28 June 2013

খেলেনা - ভাঙার খেলা দে আমারে বলি


( ফরমায়েশে লেখা কবিতালেখ্য, সম্প্রতি এটি প্রযোজনা করেছে, বর্ণালী শিশু কল্যাণ সংস্থা , তিনসুকিয়া )


বীন্দ্রনাথের ‘শিশুভোলানাথ’ আর বছর কয় আগে লেখা সুকুমার রায়ের ‘আবোলতাবোল’ যদি কেউ মন দিয়ে পড়েছেন দেখবেন দুটোকবিতাই  প্রায় একই স্বরে বাঁধা। রবীন্দ্রনাথ যে ভোলানাথ তুল্য শিশুদের ডেকে বলছেন,

ওরে শিশু ভোলানাথ , মোরে ভক্ত ব'লে
নে রে তোর তাণ্ডবের দলে ;
                     দে রে চিত্তে মোর
  সকল - ভোলার ওই ঘোর ,
খেলেনা - ভাঙার খেলা দে আমারে বলি ।


সুকুমার তাদেরই ডেকে বলছেন,
আয়রে ভোলা খেয়াল-খোলা
       স্বপনদোলা নাচিয়ে আয়,
    আয়রে পাগল আবোল তাবোল
      মত্ত মাদল বাজিয়ে আয়।
আয় যেখানে ক্ষ্যাপার গানে
          নাইকো মানে নাইকো সুর,
   আয়রে যেথায় উধাও হাওয়ায়
      মন ভেসে যায় কোন সুদূর।
তফাৎটা হলো সুকুমার এর পরে সত্যি এক বকচ্ছপের আজগুবীর জগতে পাড়ি দেবেন যেটি তাঁরই নির্মিত, সেইসব ভোলানাথের নয়। রবীন্দ্রনাথ সেই শিশুদের দলেই ভিড়ে যেতে চেয়েছেন, তিনি লিখছেন,
                    আপন সৃষ্টির বন্ধ আপনি ছিঁড়িয়া যদি চলি
                     তবে তোর মত্ত নর্তনের চালে
আমার সকল গান ছন্দে ছন্দে মিলে যাবে তালে । 
            যারা সব খেলাকে করে রক্ষা, ছিন্ন করে ‘খেলেনা শৃঙ্খল’ তাদের জগতে তিনি নিজেই ছুটি নিতে চাইছিলেন যখন একবার আমেরিকা গেছেন আর দেখেছেন, “লোভী মানুষ কোথা থেকে জঞ্জাল জড়ো করে সেইগুলোকে আগলে রাখবার জন্যে নিগড়বদ্ধ লক্ষ লক্ষ দাসকে দিয়ে প্রকাণ্ড সব ভাণ্ডার তৈরি করে তুলেছে।” মানুষকে লুণ্ঠন করে এই যে দেশটি ধনগর্বে মত্তমাতাল হয়েছে সে চিরটাকাল থাকবে না এই আশা তিনি করেছেন।  লিখছেন,  “আকাশের উপর দিয়ে যেমন ধুলানিবিড় আঁধি ক্ষণকালের জন্যে সূর্যকে পরাভূত করে দিয়ে তারপরে নিজের দৌরাত্ম্যের কোন চিহ্ন না রেখে চলে যায় , এ-সব তেমনি করেই শূন্যের মধ্যে বিলুপ্ত হয়ে যাবে।”  তাঁর সেই আশাই যেন প্রকাশ পেল  ‘তাল গাছ’ কবিতায়ঃ

তালগাছ        এক পায়ে দাঁড়িয়ে
                   সব গাছ ছাড়িয়ে
                             উঁকি মারে আকাশে ।
মনে সাধ ,        কালো মেঘ ফুঁড়ে যায়
                   একেবারে উড়ে যায় ;
                             কোথা পাবে পাখা সে ?

তাই তো সে     ঠিক তার মাথাতে
                   গোল গোল পাতাতে
                             ইচ্ছাটি মেলে তার ,
মনে মনে       ভাবে , বুঝি ডানা এই ,
                   উড়ে যেতে মানা নেই
                             বাসাখানি ফেলে তার ।
সারাদিন        ঝরঝর থত্থর
                    কাঁপে পাতা - পত্তর ,
                             ওড়ে যেন ভাবে ও ,
মনে মনে       আকাশেতে বেড়িয়ে
                   তারাদের এড়িয়ে
                             যেন কোথা যাবে ও ।

তার পরে        হাওয়া যেই নেমে যায় ,
                   পাতা - কাঁপা থেমে যায় ,
                              ফেরে তার মনটি —
যেই ভাবে ,       মা যে হয় মাটি তার ,
                   ভালো লাগে আরবার
                             পৃথিবীর কোণটি ।

          যদিও গেছিলেন বেড়াতে, তবু যা কিছু ঐশ্বর্যের মাদকতা দেখলেন তাঁতে যেন হাঁপিয়ে উঠলেন মার্কিন দেশে। তিনি আরো লিখছেন, “ কিছুকালের জন্যে আমি এই বস্তু উদ্গারের অন্ধযন্ত্রের মুখে এই বস্তু সঞ্চয়ের অন্ধভাণ্ডারে বদ্ধ হয়ে আতিথ্যহীন সন্দেহের বিষবাষ্পে শ্বাসরুদ্ধপ্রায় অবস্থায় কাটিয়েছিলুম। তখন আমি এই ঘন দেয়ালের বাইরের রাস্তা থেকে চিরপথিকের পায়ের শব্দ শুনতে পেতুম। সেই শব্দের ছন্দই আমার রক্তের মধ্যে বাজে, আমার ধ্যানের মধ্যে ধ্বনিত হয়। আমি সেদিন স্পষ্ট বুঝেছিলুম আমি ঐ পথিকের সহচর।” রবীন্দ্রনাথের চিরকালের  সেই পথিক এই বণিক দুনিয়ার কোন হিসেব মানেনা, তার নেই লেখা পড়া করে গাড়ি ঘোড়া করবার স্বপ্ন।  ‘সময় হারা’ কবিতাতে যেন সেই পথিকেরই কথাঃ

যত ঘণ্টা , যত মিনিট , সময় আছে যত
          শেষ যদি হয় চিরকালের মতো ,
তখন স্কুলে নেই বা গেলেম ; কেউ যদি কয় মন্দ ,
          আমি বলব , ' দশটা বাজাই বন্ধ । '
                   তাধিন তাধিন তাধিন ।

          শুই নে বলে রাগিস যদি , আমি বলব তোরে ,
                    ' রাত না হলে রাত হবে কী করে ।
নটা বাজাই থামল যখন , কেমন করে শুই ?
                    দেরি বলে নেই তো মা কিচ্ছুই । '
                   তাধিন তাধিন তাধিন ।

যত জানিস রূপকথা , মা , সব যদি যাস বলে
          রাত হবে না , রাত যাবে না চলে ;
সময় যদি ফুরোয় তবে ফুরোয় না তো খেলা ,
          ফুরোয় না তো গল্প বলার বেলা ।
                   তাধিন তাধিন তাধিন ।    

          না, এই সব মায়েছেলেতে দুষ্টুমির সঙ্গে মার্কিন দেশের ধন জঞ্জালের গপ্প মানাচ্ছে না ঠিক। কিন্তু শিশু ভোলানাথের এগুলোই প্রেক্ষাপট । তিনি লিখে রেখেছেন, তাঁর ‘পশ্চিম যাত্রীর ডায়েরীতে।’ তিনি লিখছেন, “আমেরিকার বস্তুগ্রাস থেকে বেরিয়ে এসেই ‘শিশু ভোলানাথ’ লিখতে বসেছিলুম। বন্দী যেমন ফাঁক পেলেই ছুটে আসে সমুদ্রের ধারে হাওয়া খেতে, তেমনি করে। দেয়ালের মধ্যে কিছুকাল সম্পূর্ণ আটকা পড়লে তবেই মানুষ স্পষ্ট করে আবিষ্কার করে, তার চিত্তের জন্যে এত বড়ো আকাশেরই ফাঁকাটা দরকার। প্রবীণের কেল্লার মধ্যে আটকা পড়ে সেদিন আমি তেমনি করেই আবিষ্কার করেছিলুম, অন্তরের মধ্যে যে-শিশু আছে তারই খেলার ক্ষেত্র লোকে-লোকান্তরে বিস্তৃত। এইজন্যে কল্পনায় সেই শিশুলীলার মধ্যে ডুব দিলুম, সেই শিশুলীলার তরঙ্গে সাঁতার কাটলুম, মনটাকে স্নিগ্ধ করবার জন্যে, নির্মল করবার জন্যে, মুক্ত করবার জন্যে।” তাতে আমরা প্রায় বৃদ্ধ রবীন্দ্রনাথের থেকে এতো সব সুন্দর শিশুর গল্পকথা পেলুম। দু’ভাবে পড়া যায় কবিতাগুলোকে।  একটি শিশু যার মায়ের সঙ্গে যত দুষ্টুমী। প্রায় সবগুলোই তাই। সে দূরে চলে যতে চায় কিন্তু মায়ের থেকে নয়। ‘লুকোচুরি’ কবিতাতে লিখছেনঃ

আমি যদি দুষ্টুমি করে
             চাঁপার গাছে চাঁপা হয়ে ফুটি,
ভোরের বেলা মা গো, ডালের ‘পরে
              কচি পাতায় করি লুটোপুটি,
তবে তুমি আমার কাছে হারো,
তখন কি মা চিনতে আমায় পারো।
       তুমি ডাক, ‘খোকা কোথায় ওরে। '
       আমি শুধু হাসি চুপটি করে।
 
যখন তুমি থাকবে যে কাজ নিয়ে
       সবই আমি দেখব নয়ন মেলে।
স্নানটি করে চাঁপার তলা দিয়ে
       আসবে তুমি পিঠেতে চুল ফেলে;
এখান দিয়ে পুজোর ঘরে যাবে,
দূরের থেকে ফুলের গন্ধ পাবে—
     তখন তুমি বুঝতে পারবে না সে
       তোমার খোকার গায়ের গন্ধ আসে।
 
দুপুর বেলা মহাভারত-হাতে
       বসবে তুমি সবার খাওয়া হলে,
গাছের ছায়া ঘরের জানালাতে
       পড়বে এসে তোমার পিঠে কোলে,
আমি আমার ছোট্ট ছায়াখানি
দোলাব তোর বইয়ের ‘পরে আনি—
     তখন তুমি বুঝতে পারবে না সে
       তোমার চোখে খোকার ছায়া ভাসে।
 
সন্ধেবেলায় প্রদীপখানি জ্বেলে
       যখন তুমি যাবে গোয়ালঘরে
তখন আমি ফুলের খেলা খেলে
টুপ্‌ করে মা , পড়ব ভুঁয়ে ঝরে।
আবার আমি তোমার খোকা হব,
‘গল্প বলো' তোমায় গিয়ে কব।
       তুমি বলবে, ‘দুষ্টু, ছিলি কোথা। '
          আমি বলব, ‘ বলব না সে কথা। '
--- তালগাছটিও দেখুন, ফিরে সেই মায়ের কাছেই আসে। ‘দূর’ কবিতাতে স্পষ্টই আছেঃ
হাওয়ায় হাওয়ায় যাওয়ার বাঁশি
          কেবল বাজে থাকি থাকি ।
আমায় এরা যেতে বলে ,
          যদি বা যাই , জানি তবে
দূরকে খুঁজে খুঁজে শেষে
          মায়ের কাছেই ফিরতে হবে ।
 আর অন্য ভাবে পড়লে, শিশুটি এ বিশ্বের যত জীব-মানব, আর মা এই ধরিত্রী প্রকৃতি স্বরূপা। চাঁদের বুড়িরও সেই তালগাছের মতো অসম্ভবের স্বপ্ন, জাল বুনে সে ধরতে চায় লক্ষ কোটি তারা। ‘বুড়ি’ কবিতায় লিখছেনঃ

এক যে ছিল চাঁদের কোণায়
চরকা - কাটা বুড়ি  
পুরাণে তার বয়স লেখে
                          সাতশো হাজার কুড়ি ।
সাদা সুতোয় জাল বোনে সে
                          হয় না বুনন সারা
পণ ছিল তার ধরবে জালে
                          লক্ষ কোটি তারা ।

হেনকালে কখন আঁখি
                          পড়ল ঘুমে ঢুলে ,
স্বপনে তার বয়সখানা
                          বেবাক গেল ভুলে ।
ঘুমের পথে পথ হারিয়ে ,
                          মায়ের কোলে এসে
পূর্ণ চাঁদের হাসিখানি
                          ছড়িয়ে দিল হেসে ।
 
সন্ধেবেলায় আকাশ চেয়ে
                          কী পড়ে তার মনে ।
চাঁদকে করে ডাকাডাকি ,
                          চাঁদ হাসে আর শোনে ।
যে - পথ দিয়ে এসেছিল
          স্বপন - সাগর - তীরে
দু - হাত তুলে সে - পথ দিয়ে
                          চায় সে যেতে ফিরে ।
     
হেনকালে মায়ের মুখে
                           যেমনি আঁখি তোলে
চাঁদে ফেরার পথখানি যে
      তক্‌খনি সে ভোলে ।
কেউ জানে না কোথায় বাসা ,
          এল কী পথ বেয়ে ,
কেউ জানে না , এই মেয়ে সেই
          আদ্যিকালের মেয়ে ।


বয়সখানার খ্যাতি তবু     
রইল জগৎ জুড়ি —
পাড়ার লোকে যে দেখে সেই
          ডাকে , ' বুড়ি বুড়ি ' ।
সব - চেয়ে যে পুরানো সে ,
          কোন্‌ মন্ত্রের বলে
সব - চেয়ে আজ নতুন হয়ে
         নামল ধরাতলে ।