আমার চেতনার রঙে রাঙানো এই খেলা ঘরে:

~0~0~! আপনাকে স্বাগতম !~0~0~

*******************************************************************************************************

Tuesday 24 November 2015

বেত্রাঘাত




(মূল অসমিয়া কবিতাটি লিখেছেন  অজয় লাল দত্ত  ।   এই সময়ে কথাপ্রধান এই কবিতাটির গুরুত্ব অনুধাবন করে অনুবাদ করে ফেললাম। ---সুশান্ত কর)
(C)Image:ছবি




















খোলা মঞ্চে দাঁড়িয়ে উদাত্ত কণ্ঠে
যখন মানুষকে ঘৃণা করবার জন্যে ভাষণ দিতে পারে
তখন আর বেত্রাঘাতের প্রয়োজন নেই!

বেত্রাঘাতের দরকার সেই ওদের পিঠে
যারা খিদের কথা বলে,
পেটের দায়ের কথা বলে,
জীবনের জ্বালার কথা বলে,
যে জ্বলন্ত মানুষগুলোকে হাতে হাত ধরে এক হতে বলে!
কারণ ভয় এদের থেকেই, যার পেটে আগুন আছে
হাতে এসে পৌঁছুতে আর কতই বা দূর?
হয়ে উঠতে পারে ভয়ঙ্কর...

যার অভাবের কোনো ইতিহাস নেই
যে বর্ণের গালিচাতে কাটিয়েছে শৈশব
যে বাতানুকূল ঘরে ‘ ঘামে স্নাত শরীরে’র কবিতা লিখে জুটিয়েছে বৈভব
লেহন অথবা ভক্তি, ক্ষয় সমস্ত শক্তি
নজির হিসেবে নিন, দুই এক উক্তি!

আসলে বেত্রাঘাত সেই ওদের জন্যেই
যারা হয়তো ভুল করেছে
হয়তো পরের ভুল ধরেছে
হুঁশিয়ার করতে করেছে দুঃসাহস
ভয় এই এদের থেকেই...
যার পেটে ইঁদুর আছে
শাসনের দড়ি কেটে যদি ফেলে পাছে?

বিভেদকামীকে শক্তি যোগানো
প্রেমের বদলে ঘৃণা বিলোনো,
এরাতো কুটুম্ব, খেলোয়াড়ের, পাশা খেলার
আছে পুরস্কার-টুরস্কার, মুক্তোর মালা,
তাঁরাইতো মুখ্য অতিথি, খেলা শেষের ভোজসভার......


000~~~~~~~~~~~~~~~000

মুল অসমিয়া কবিতাও এখানে রইল।

000~~~~~~~~~~~~~~000

বেত্ৰাঘাত
--------
মুকলি মঞ্চত থিয় হৈ উদাত্ত কণ্ঠৰে
যেতিয়া মানুহক ঘৃণা কৰাৰ ভাষণ দিব পাৰে
তেতিয়া আৰু বেত্ৰাঘাতৰ প্ৰয়োজন নাই!
বেত্ৰাঘাতৰ প্ৰয়োজন সেই সকলৰ পিঠিত
যিয়ে ভোকৰ কথা কয়,
পেটৰ দায়ৰ কথা কয়,
জীৱনৰ জ্বালাৰ কথা কয়,
যিয়ে জ্বলি থকা মানুহবোৰক এক হোৱাৰ কথা কয়!
কাৰণ ভয় এই সকলৰ পৰা, যাৰ পেটত অগনি আছে
হাত পাবলৈনো কেত পৰ?
হৈ পৰিব পাৰে ভয়ংকৰ...
যাৰ অভাৱৰ ইতিহাস নাই
যিয়ে বৰ্ণৰ দলিচাত কটাইছে শৈশৱ
যিয়ে বাতানুকুল ৰূমত 'ঘামে ধোৱা গা'ৰ কবিতা লিখি গোটাইছে বৈভৱ
লেহন অথবা ভক্তি, ক্ষয় সকলো শক্তি
উদাহৰণ হিচাবে লওক, দুই এটা উক্তি!
আচলতে বেত্ৰাঘাত সেই সকলৰ বাবেহে
যি সকলে হয়তো ভুল কৰিছে
হয়তো আনৰ ভুল ধৰিছে
সঁকিয়াই দিবলৈ দুঃসাহস কৰিছে
ভয় এইসকলৰ পৰা...
যাৰ পেটত নিগনি আছে
শাসনৰ জৰী কুটি দিয়ে যদি পাছে?
বিভেদকামীক শক্তি যোগোৱা
প্ৰেমৰ সলনি ঘৃণা বিলোৱা,
এইসকলটো কুটুম, খেলুৱৈৰ, পাশা খেলৰ
আছে বঁটা-বাহন, মুকুতাৰ ধাৰ,
তেওঁলোকেইতো মুখ্য অতিথি, খেলৰ শেষৰ ভোজমেলৰ.....


Tuesday 27 October 2015

১৯৮৩র অসম: নিপীড়িত বাঙালি হিন্দু-০২


দিগন্ত শর্মা
(দিগন্ত শর্মা, সাদিন কাগজের সাংবাদিক এবং অনুসন্ধানী লেখক। এর আগে তিনি  ‘ নেলি ১৯৮৩নামে একটি অনুসন্ধানমূলক প্রতিবেদন লিখেছিলেন তিনি। বর্তমান অনুবাদক  সেটি বাংলাতে অনুবাদ করেছিলাম। দু’টিই আগে পরে বই হিসেবে বেরোয়। সেই বইতে মূলত ধরা হয়েছিল ধর্মীয় সংখ্যালঘু তথা মুসলমানদের  উপরে নেমে আসা আক্রমণের  ছবি। এবারে বাঙালি হিন্দুর উপরে কেমন অত্যাচার নেমে এসেছিল, সেই প্রশ্নের উত্তর সন্ধানে তিনি ঘুরেছেন ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার  পূব থেকে পশ্চিমে। আর লিখছেন এই নিবন্ধ। ধারাবাহিক ভাবে এটি এই ব্লগ ছাড়াও প্রকাশিত হবে, আরো দুই একটি ব্লগে এবং ছাপার অক্ষরে বেরুচ্ছে শিলচর থেকে প্রকাশিত চন্দন সেনগুপ্ত সম্পাদিত মাসিক ‘অরুণোদয়ে’।  এবারে দ্বিতীয় পর্ব। লেখকের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে যোগাযোগ করুন, এই নম্বরে: ৯৮৫৪৬-৩১৯২৮। )


মূল অসমিয়াঃ দিগন্ত শর্মা

বাংলা অনুবাদঃ সুশান্ত কর





  
         হাত জোড় করছি – জমি বাড়ি সব ছেড়ে যাবো, আমাদের মেরো না:  মহিলার নাম সোনামতি৮৩র ফেব্রুয়ারির হিংসাত্মক ঘটনার কথা বলতে গিয়ে মুখ খুলেই হু হু করে কাঁদতে শুরু করলেন। শাড়ির আঁচলে দুই গাল বেয়ে নেমে আসা চোখের জল মোছবার চেষ্টা করলেন যদিও, স্রোত থামবার নামই করল না। মুহূর্ত কয় আমরাও বেশ অস্বস্তি অনুভব করলাম। “মহিলাকে সেই সব দুঃখের দিনের কথাগুলো জিজ্ঞেস করে কি ভুল করলাম কিছু?”—এমন একটা ভাবনা নাড়িয়ে গেলো। ঠিক সেই সময় আর্নে রামনগরের কিছু মানুষ বলতে শুরু করলেন---না কেঁদে থাকবে কী করে? চোখের সামনে পরিবারে সমস্ত মানুষকে মেরে ফেলল।
            ধীরে ধীরে সোনামতি বলতে শুরু করলেন, “ ওই উত্তর দিক থেকে লাঠি-বল্লম-তিরধনুক-তলোয়ার নিয়ে প্রচুর মানুষে যখন আমাদের বাড়িটি ঘিরে ফেলল, পালাতে চাইলাম। কিন্তু পারলাম না। আক্রমণকারী দলটি আমাদের পরিবারটিকে  ধরে ফেলল। আমি ওদের পায়ে ধরে কাকুতি মিনতি করলাম, “হাত জোড় করছি, পায়ে পড়ছি। এই জমিবাড়ি ছেড়ে আমরা চলে যাবো।আমাদের মেরো না।” খানিক থেমে জল চোখে তিনি আরো বললেন, “ কিন্তু ওরা আমার অনুরোধে কান দিল না। আমার চোখের সামনে আমার মানুষটিকে (স্বামী), আমার মা আর চার বছরের মেলে চামেলিকে ঘা মারতে শুরু করল। আমি দু’বছরের ছেলে কাজলকে নিয়ে যে দিকে চোখ যায় দৌড়োলাম। কিন্তু পেছন থেকে কেউ একজন আমাকে লাঠির ঘা মারতেই আমি গড়িয়ে পড়লাম। তারপর আর কিছুই বলতে পারি না। পরদিন দু’জন মানুষ আমাকে ধরে দাঁড় করিয়ে দিলেই দেখলাম, আমি বাড়ির কাছেই পড়েছিলাম। আমার পাশেই শুয়ে শুয়ে কাঁদছে ছেলে কাজল। ঐ দু’জনের একজন আমাকে ধরে দাঁড় করিয়ে গ্রামের অন্য মাথায় শিবিরে নিয়ে এলেন। অন্যজন কাজলকে কোলে করে নিয়ে এলেন। গ্রামের লোকেরাই জানালো সেদিনের আক্রমণে আমার বর রাজকুমার নমশূদ্র, মা কুমুদিনী নমশূদ্র , আমার মেয়ে চামেলি মারা গেছে...।
            ওদিকে সেই সময়, আমি চারমাসের গর্ভবতী ছিলাম। সব হারিয়ে আমি উপায়হীন হয়ে পড়লাম।  আহত শরীর , পেটে বাচ্চা। সেই সঙ্গে আহত দুবছর বয়সী কাজল। শিবিরে যে ডাক্তারেরা এসেছিলেন, তারা তার চিকিৎসা করেছিলেন বটে কিন্তু মাস কয় পরে সেও মারা গেল। ভালো চিকিৎসা করাতে পারলাম না।  গর্ভের সন্তানটিই জীবনের ভবিষ্যৎ ভেবে  আশাতে বেঁচে রইলাম। সেই সন্তানেরই আমি মা এখন। সেই অন্যায়ের বিচার আমি পেলাম না। হয়তো ন্যায়, কোনোদিনই পাবো না। ...”
          
ঈশ্বর নমশূদ্রের সারা গায়ে এখন আঘাতের চিহ্ন
  সোনামতি, পক্ষ, মিছিলা...অজস্র মহিলার জীবনে অন্ধকার নামিয়ে এনেছিল বিদেশী বহিষ্কার আন্দোলনের ফ্যাসিস্ট কার্যকলাপ। সারা আসাম ছাত্র সংস্থা, সারা আসাম গণসংগ্রাম পরিষদ এবং এদের সমর্থক (অসম সাহিত্য সভা) সংগঠনের নেতৃত্বে একাংশ উগ্র-অসমিয়াদের দ্বারা  সংগঠিত বাংলাভাষী গণনিধন কাণ্ডের পরিণতিতে  ধেমাজির শিলাপাথারের নিকটবর্তী আর্নে রামনগর  গ্রামের বহু পরিবার নিঃশেষ হয়ে গেছিল। কিন্তু শুধু ঐ আর্নে রামনগরই নয়। এই গ্রামের পাশের ‘আর্নে তিরাশি’ গ্রামেও শতাধিক মানুষকে এরা হত্যা করেছিল। ‘অসমের অস্তিত্বরক্ষা’র আন্দোলনের ঘাতক বাহিনীর লোকেরা। শিলাপাথারের কাছের বৃহত্তর আর্নে চর অঞ্চলের অন্তর্গত ‘আর্নে তিরাশি’ নামের গ্রামেই ১৯৮৩র ফেব্রুয়ারি মাসে সব চাইতে বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছিল।  গ্রামের নাম এমন হবার কারণ ছিল, মাত্র তিরাশিটি পরিবার শুরুতে এই গ্রাম বসিয়েছিল। সেই তিরাশি  পরিবারের গ্রামে মৃতের সংখ্যা ছিল শতাধিক। গ্রামের কোনো এক পরিবারের একটি কুঁড়েঘরও যদি দাঁড়িয়ে থাকতো। আক্রমণকারীরা পুরো গ্রাম জ্বালিয়ে নিঃশেষ করেছিল। সেই গ্রামের এক ব্যক্তি ঈশ্বর নমশূদ্র। প্রায় ৭০ বছর বয়সের এই বৃদ্ধের বিদেশী বিতাড়ন আন্দোলনের সময় বয়স ছিল দুই কুড়ি।  ঈশ্বর নমশূদ্রের সারা গায়ে এখন আঘাতের চিহ্ন।  মাথাতে যদি দায়ের ঘায়ের চিহ্ন, পিঠে বল্লমের, পায়ে বন্দুকের গুলির চিহ্ন , তো হাতে তলোয়ারের ঘা। বুকে ধনুক থেকে ছোঁড়া তির বেঁধার চিহ্ন স্পষ্ট।
          
মাথাতে যদি দায়ের ঘায়ের চিহ্ন
  ঈশ্বর নমশূদ্র বলছিলেন, “আমাদের গ্রামের চারদিকে উঁচু উঁচু খাগের জঙ্গল ছিল। তাই আক্রমণ করতে ওরা ঠিক কোনদিক থেকে আসছিল ধরা যায় নি। কিন্তু ওরা যে হা রে রে রে !---- করে আসছিল সেটা টের পাওয়া যাচ্ছিল।  কী করা ঠিক হবে ভাবতে ভাবতেই ভোরের দিকে অসমিয়া, মিশিং জনগোষ্ঠীর একাংশ মানুষ গ্রাম ঘিরে ফেললো। হাতে তাদের অগুণতি অস্ত্র-শস্ত্র। আমাদের বাড়ি ছেড়ে পালাবার বাইরে উপায় ছিল না। তাই সবাই দক্ষিণের ব্রহ্মপুত্র নদীর দিকে দৌড় দিল। কিন্তু ওরা যে আমাদের সবাইকে ঘিরে ফেলেছে, বুঝতে পারি নি। অন্যদের মতো আমিও ন’মাসের ছেলে অজিতকে কোলে করে প্রাণ বাঁচাতে দৌড় দিলাম। কিন্তু সামনের থেকে একদল লোক আমাকে আটকে দিল। ওদের কেউ আমাকে লম্বা লাঠি দিয়ে মারলো  । আমি গড়িয়ে পড়ে গেলাম।    আমার হাত থেকে ছিটকে পড়ে গেল ন’মাসের শিশুটি। কই পড়ল ---দেখবার জন্যে ফিরে তাকাতেই দেখি মাটিতে পড়ে কাঁদছে শিশুটি, ওকেই ঘা মেরে দুই টুকরো করে ফেলল। দেখে আমি চীৎকার করে উঠেছি কি, ওদের কেউ আমাকে দা দিয়ে ঘা দিল, কেউ বল্লমে খোঁচালো,কেউ তির দিয়ে  বুকে পিঠে বিঁধলওরা গেল কিন্তু পরে ঘরে আগুন দিতে এলো আরো একদল, তারা গুলি ছুঁড়লে আমার পায়ে গুলি লাগলো।আমি অজ্ঞান হয়ে পড়ে রইলাম। সেদিন সন্ধ্যাতে কেউ আমাকে তুলে নিয়ে গেলো। পরদিন আশ্রয় শিবিরে ডাক্তার এলো।চিকিৎসা করল। প্রায় এক মাস পরে লখিমপুর গিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলাম। আমার পুরো শরীরে আঘাতেচিহ্নগুলোর চিকিৎসা করাতে গিয়ে বহু টাকা ব্যয় হলো। আজও  কখনো শরীরের  প্রচণ্ড ব্যথাতে আমি ছটফটাতে থাকি।  সেই নৃশংস আক্রমণে মরে গেলে ভালোই ছিল। কিন্তু মরলাম না। মানুষের হিংস্রতার সাক্ষী হয়ে বেঁচে আছি। কিন্তু শরীরে আঘাতের ব্যথা-বেদনার  থেকেও   মনে যে ঘায়ের দাগ থেকে গেলো ---তার যন্ত্রণা যে কী বিষম বোঝাতে পারবো না। সেই যন্ত্রণার চিকিৎসা হাসপাতালে হবে কী করে?

পিঠে বল্লমের

            
পায়ে বন্দুকের গুলির চিহ্ন

তো হাতে তলোয়ারের ঘা

বুকে ধনুক থেকে ছোঁড়া তির বেঁধার চিহ্ন স্পষ্ট
          আর্নে তিরাশি গ্রামের ঈশ্বর নমশূদ্রের সারা শরীরের আঘাতের দাগগুলো শুধু ঐ বল্লম-দা-তলোয়ার-তিরধনুকের আঘাতের দাগ নয় তাঁর শরীরের প্রতিটি ক্ষতচিহ্নই ‘অসম –অসমিয়ার অস্তিত্বে’র নামে একাংশ ‘খিলঞ্জিয়া’ অসমিয়ার সুপরিকল্পিত ভাবে প্রদর্শন করা নির্লজ্জ হিটলারি চরিত্রের স্বাক্ষর। ‘অসম আন্দোলনে’র নেতৃত্ব তথা সমর্থক লোকজনের সৃষ্ট ফ্যাসিবাদী কার্যকলাপের জ্বলন্ত প্রমাণ।
            ঈশ্বর নমশূদ্র যখন কথাগুলো বলছিলেন আর্নে তিরাশি গ্রামের মানুষজন ভিড় করেছিলেন। তারই মধ্যে এক বৃদ্ধা মাথায় গালে হাত দিয়ে কথাগুলো শুনছিলেন। ঈশ্বরের দিকে পলক না ফেলে তাকিয়ে ছিলেন। তাঁর সঙ্গে যখন কথা বলতে চাইলাম, গ্রামের লোকেরা বললেন, তিনি ভালো করে কথা বলতে পারেন না। আগে গ্রামের একজন সক্রিয় মহিলা ছিলেন তিনি। তাঁর নাম দিবাসী নমশূদ্র।  শরীরে তাঁর তির বিঁধেছিল। যখন দৌড়ে পালাচ্ছিলেন তিরের ঘায়ে গড়িয়ে পড়েছিলেন।  পড়ে পড়েই দেখছিলেন তাঁর বাবা-স্বামী-পুত্রকে কোপিয়ে কোপিয়ে কাটছিল। সেই থেকে দিবাসী আগের মতো আর কথা বলতে পারেন না। এমনকি স্বামী-পুত্র এবং বাবার নামগুলোও ভুলে গেছেন। কারো বুঝতে বাকি থাকে না যে ১৯৮৩র ফেব্রুয়ারি মাসে ‘আসু’, ‘সারা আসাম গণসংগ্রাম পরিষদে’র নেতৃত্বে চলা আন্দোলনের অস্ত্রধারীরা যখন বাঙালিদের উপরে আক্রমণ নামিয়ে এনেছিল এমন বহুজনের জীবনে অন্ধকার নামিয়ে এনেছিল।  দিবাসী নমশূদ্রের মতো মহিলার জীবনেও নামিয়ে এনেছিল অকাল অন্ধকার---যার জন্যে তিনি হারালেন স্মৃতিশক্তি।

অসমের অস্তিত্বরক্ষার নামে আন্দোলনকারীর হিংস্রতাতে
নিস্তব্ধ কিশোর, নিঃশেষিত পরিবার:


             “আমাদের আর্নে তিরাশি গ্রামে আন্দোলনকারীরা  যখন আক্রমণ করে কে কোনদিকে পালিয়েছিল কোন ঠিক-ঠিকানা ছিল না। সবাই শুধু প্রাণটাই বাঁচাতে চাইছিল। পরদিনই শুধু আমরা জানতে পারছিলাম কার পরিবারের কতজন মরেছে, বা কার ঘরে কতজন বেঁচে আছে।  গ্রামের একটাও ঘর দাঁড়ানো ছিল না। সব কটিতে এই আক্রমণকারীরা আগুন দিয়েছিল। ঘটনার পর দিনে পুরো আর্নে তিরাশি গ্রামে হিসেব করে বের করতে হয়েছিল, কে আহত, কে নিহত আর কারাই বা অক্ষত বেঁচে আছেন। আমাদের গ্রামের লোকজনের খবর করে, খোঁজে বের করে , নদীর পারেও গিয়ে মানুষজনকে জিজ্ঞেস করে দেখি পনেরো ষোল বছর বয়সের কিশোর মাখনদের বাড়ির লোকজন কাউকে পাওয়া যাচ্ছে না।” ---আর্নে তিরাশি গ্রামের এক বৃদ্ধ আমাদের সামনে ‘সংঘাতকালে’র বর্ণনা দিচ্ছিলেন এই ভাবে। তিনি যখন কথাগুলো বলছিলেন, এক যুবক তাঁর মুখের দিকে তাকিয়েছিল নিষ্পলক। তাকে দেখিয়ে বৃদ্ধ বললেন, এই সেই মাখন নমশূদ্র। আন্দোলনকারীদের নিপীড়নের শিকার। ঘটনার পরদিন ওকে নদীর পার থেকেই উদ্ধার করা হয়েছিল। ওর বাবা সার্থক নমশূদ্র, মা ময়নাবালা  এবং তিন বোনের মৃতদেহ পাওয়া গেছিল গ্রামের মাঝ বরাবর বেরিয়ে যাওয়া পথের পাশে।” জিজ্ঞেস করলাম, ওর তিন বোনের নাম কী ছিল? মাখন সামান্য অপেক্ষা করে কী যেন মনে করল। আর আটকানো স্বরে বলল, বীণামতি নমশূদ্র, রশুমতি নমশূদ্র, খকিলা নমশূদ্র।
            বলেই মাখন ওখানে বসেই হু হু করে কেঁদে ফেলল। কিছুক্ষণের জন্যে আর্নে তিরাশি গ্রামে আমাদের মাঝখানে মৌনতা ছেয়ে ধরল। সেই মৌনতা আবার ভাঙল, “ ওকে আমরা এর পরে গ্রামের মানুষই বড় করলাম। ঘর সাজিয়ে দিলাম নিরাশ্রয় ছেলেটির। ওকে সান্ত্বনা দেবার আরো কোনো ভাষা আমাদের জানা ছিল না।” সেই বৃদ্ধ আবার বললেন, “ মাখনের পরিবারের তবু একজন বেঁচে রইল। কিন্তু আরান মণ্ডলের পরিবারের সব্বাইকে হত্যা করেছিল আন্দোলনকারীরা। মোট কথা শতাধিক মানুষকে এরা সেদিন খুন করেছিল। আহতেরতো কোনো হিসেবই নেই। গেল তিনটা দশক ধরে আমরা অপেক্ষা করে রইলাম, এই গণহত্যার, এই নির্মম কাণ্ডের  বিচার হবে। ন্যায় পাবো আমরা---দোষীরা শাস্তি পাবে। কিন্তু দেখলাম এই দেশে আমাদের মতো নির্যাতিতেরা বিচার পায় না। এই গণতন্ত্র, এই প্রশাসন ব্যবস্থার প্রতি আমাদের আস্থা হারিয়ে গেছে। আমাদের আর্নে চরাঞ্চলের গ্রামগুলোতে আক্রমণ করে গ্রামের মানুষজন তাড়িয়ে অসমিয়াদের দখলে নেবার চেষ্টা করেছিল আক্রমণকারীরা।  আক্রমণ করবার সময় আমাদের বাঙালিদের বিদেশী বলে প্রচার করেছিল। সেসব কথা আমরা সেই ঘটনার পরে জানতে পাই। কিন্তু সত্যিই কি আমরা বিদেশী?” ---তাঁর মুখ থেকে নিরবচ্ছিন্নভাবে বেরুচ্ছিল কথাগুলো। তাঁর কথাতে  ক্ষোভ আর হতাশার ছবি স্পষ্ট।
            উগ্রজাতীয়তাবাদী অসমিয়াদের একাংশ মানুষ আর্নে চরাঞ্চলের হাজার হাজার জনতার উপরে আক্রমণ চালাবার জন্যে যে পূর্বপরিকল্পনা করেছিল, গোপনে সংগঠিত হয়েছিল---লখিমপুর জেলার (তখনকার) বিভিন্ন জায়গার মানুষ সেই সব কথাও এই বাঙালি মানুষজনে পরে জেনেছিলেন। কিন্তু যে দুই গ্রামের কথা লিখলাম, তারও আগে এই পুরো চরাঞ্চলে প্রথম আক্রমণ এরা নামিয়েছিল নলবাড়ি গ্রামে।

প্রথম আক্রমণ হয়েছিল নলবাড়িতে।
যেখানে ঘরের ভেতরেই জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছিল সোনাই মণ্ডলকে।

           
     আর্নে রামনগর, আর্নে তিরাশি, পানবাড়ি, কাকবাড়ি , মুক্তিয়ার, বর্মণ বস্তি, কেম্পবস্তি, দিঘলীয়া বস্তি ইত্যাদি গ্রামে প্রায় একই সময়ে আন্দোলনকারীরা আক্রমণ চালিয়েছিল। কিন্তু এগুলোর ভেতরে প্রথম আক্রমণ করেছিল কই?
                ভুক্তভোগী লোকজন আমাদের জানালেন, প্রথমে আক্রমণ হয়েছিল টেঙানি নলবাড়ি গ্রামে। আর্নে চরাঞ্চলের অন্তর্গত নলবাড়ি গ্রামের একাংশ মানুষ জানিয়েছিলেন সেই ভয়াবহ দিনের কথা।  সেই গাঁয়ের সঞ্জয় রায়ের বাড়িতে বসে গ্রামের বয়োজ্যেষ্ঠ কিছু মানুষ আমাদের সামনে বর্ণনা করেন, ১৯৮৩র ফেব্রুয়ারিতে বিদেশী বহিষ্কার আন্দোলনের সময় তাদের উপরে আক্রমণ নামার দিনের কথা। সে গ্রামের সুনীল রায় বলছিলেন, “আমাদের গ্রামের চারপাশে নলবন ছিল। লম্বা লম্বা নলবনে ভরা ছিল বলেই এই গ্রামের নাম পড়েছিল নলবাড়ি।” এমনিতে এর আসল নাম টেঙানি নলবাড়ি।
          একাজান গ্রামপঞ্চায়েতের অন্তর্গত আমাদের টেঙানি নলবাড়ি গ্রামেই প্রথম আক্রমণ করেছিল, আক্রমণকারীরা। হাজার হাজার অসমিয়া, আর জনজাতি মানুষ এসে  ভোরে আমাদের গ্রামে আক্রমণ করে, আর অতি নৃশংসভাবে  সোনাই মণ্ডলকে হত্যা করে।” এইটুকু বলে  কিছু সুনীল রায় কিছুক্ষণ থামলেন।  তাঁর পাশেই বসেছিলেন সেই গ্রামের আরো কিছু মানুষ। তাদের দিকে তাকিয়ে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, “ সোনাই মণ্ডলের বৌয়ের নাম কী ছিল যেন?” কেউ একজন জবাব দিলেন, “শ্যামলা।” “হ্যা, শ্যামলা।”আবার বলতে শুরু করলেন সুনীল রায়, “ ওরা যে আমাদের গ্রামে আক্রমণ করবে সে আমরা আগেই খবর পেয়েছিলাম।  অসমিয়াদের একাংশ যদিও আমাদের আক্রমণ করতে এসেছিল, তাদেরই একাংশ আমাদের আগেই জানিয়ে দিয়েছিলেন যে ছাত্র সংস্থার নেতৃত্বে আন্দোলনের সমর্থকেরা যেকোনো সময় গ্রামগুলোতে আক্রমণ নামাতে পারে।   খারাপ মানুষের মতো ভালো মানুষওতো আছে।  খবরটি পেয়ে আমরা গাঁয়ের লোকে রাতে রাতে পাহারা দেবার গ্রামরক্ষী বাহিনী তৈরি করেছিলাম।  আমাদের গ্রামে যখন আক্রমণ করে তার সামান্য আগেই গ্রামরক্ষীরা সারা রাত পাহারা দিয়ে গিয়ে শুয়েছিল মাত্র। গ্রামের একদিকে তাদের জন্যে একটা বাঁশখড়ের ঘরও তৈরি করা হয়েছিল। পাহারা শেষে সোনাই মণ্ডল সেখানেই শুয়ে পড়েছিল। ও গভীর ঘুমে শুয়ে থাকতেই আমাদের গ্রাম আক্রান্ত হলো।  লোকে পালাতে শুরু করল। হুলস্থূল চারদিকে।সবাই আর্তনাদ, চিৎকার চেঁচামেচি করে  দৌড়াদৌড়ি শুরু করল। কিন্তু সোনাই মণ্ডল সেই ঘরে শুয়ে ছিল। ওকে সেখানেই আক্রমণকারীরা পেল, আর দা দিয়ে কোপালো। ঘরে আগুন দিয়ে সেই আগুনেই ওকে ছুঁড়ে ফেলল। পরে শুনতে পাই, আগুনে ছুঁড়ে ফেলবার আগে অব্দি সোনাই বেঁচে ছিল। ওদিকে সোনাইর বৌ শ্যামলা দৌড়ে প্রাণ বাঁচালো যদিও স্বামীর মৃত্যুর পরে  এ রাজ্যে থাকবে না বলে পশ্চিমবাংলার ক্রান্তিহাটে চলে যায়। এখানকার জমি বাড়ি সব ত্যাগ করে চলে যায় শ্যামলা।” সুনীল রায় যখন কথাগুলো বলছিলেন তখন সঞ্জয়ের মতো একালকার তরুণরা নীরবে কথাগুলো শুনছিল। সেখানে আরো কিছু যুবতী, বৌমানুষেরাও ছিল যারা সেই নৃশংস ঘটনাগুলো দেখে নি। কিন্তু গ্রামের বড়োদের মুখে তিন দশক আগেকার সেই নির্মম ঘটনা শুনে নতুন প্রজন্মের কী ধারণা হবে সেটাই প্রশ্ন।
            সুনীল রায় আরো বললেন, “ গ্রামেরই জগদীশ সরকারের কন্যা শেফালি সরকারকে (১৫) ওরা কোপিয়ে খুন করে। কী দোষ ছিল ঐ কিশোরীর? সেভাবেই নিরুদ্দেশ হয়ে গেল হরিপদ রায়। সেরকম আরো বহু পুরুষ-মহিলার আজঅব্দি কোনো খবর বেরোয় নি। বহুদিন পরে নলবনের মাঝখানে কিছু নরকঙ্কাল পাওয়া গেছিল।  কিন্তু সেই নরকঙ্কালগুলো ছিল কাদের শনাক্ত করবে কে?  আমাদের গ্রামের অনেকেই দৌড়ে দৌড়ে প্রাণ বাঁচালেন যদিও পরে শুনেছি এই গ্রামে হামলা করবার পরে ওরা শিলাপাথার থেকে ব্রহ্মপুত্রের পাড় অব্দি পুরো অঞ্চলটিতেই বিদেশী খেদার নামে আক্রমণ নামিয়েছিল।”
            অসমিয়া উগ্রজাতীয়তাবাদী তথা বিদেশী খেদার জন্যে মারণাস্ত্র যারা এসেছিল, বা বিদেশী বলে ভেবে ‘মানুষে’র বাড়ি ঘরে আগুন দিয়ে ‘অগ্নিশিখা’ নিয়ে অসমিয়া জাতির ‘অস্তিত্ব’ রক্ষা করতে যারা এসেছিল তারা শিলাপাথারের বৃহত্তর অঞ্চলে চালিয়েছিল গণনিধন পর্ব। অসমিয়া জাতির নামে চালানো এই বর্বর গণহত্যা অভিযানের প্রথম শিকার ছিল সোনাই মণ্ডল।
           
(ক্রমশ:)
লেখকের দূরভাষ: ৯৮৫৪৬-৩১৯২৮। লেখক ‘সাদিন’ কাগজের স্টাফ রিপোর্টার।      
           


Thursday 28 May 2015

১৯৮৩র অসমঃ নিপীড়িত বাঙালি হিন্দু


দিগন্ত শর্মা
(দিগন্ত শর্মা, সাদিন কাগজের সাংবাদিক এবং অনুসন্ধানী লেখক। এর আগে তিনি  ‘ নেলি ১৯৮৩নামে একটি অনুসন্ধানমূলক প্রতিবেদন লিখেছিলেন তিনি। বর্তমান অনুবাদক  সেটি বাংলাতে অনুবাদ করেছিলাম। দু’টিই আগে পরে বই হিসেবে বেরোয়। সেই বইতে মূলত ধরা হয়েছিল ধর্মীয় সংখ্যালঘু তথা মুসলমানদের  উপরে নেমে আসা আক্রমণের  ছবি। এবারে বাঙালি হিন্দুর উপরে কেমন অত্যাচার নেমে এসেছিল, সেই প্রশ্নের উত্তর সন্ধানে তিনি ঘুরেছেন ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার  পূব থেকে পশ্চিমে। আর লিখছেন এই নিবন্ধ। ধারাবাহিক ভাবে এটি এই ব্লগ ছাড়াও প্রকাশিত হবে, আরো দুই একটি ব্লগে এবং ছাপার অক্ষরে বেরুবে শিলচর থেকে প্রকাশিত চন্দন সেনগুপ্ত সম্পাদিত মাসিক ‘অরুণোদয়ে’। লেখকের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে যোগাযোগ করুন, এই নম্বরে: ৯৮৫৪৬-৩১৯২৮। )

( মিছিলা নমশূদ্র)

মূল অসমিয়াঃ দিগন্ত শর্মা
বাংলা অনুবাদঃ সুশান্ত কর

             ৯৭৯এর প্রথম ভাগে অসমের মঙ্গলদৈ লোকসভা সমষ্টির সাংসদ হীরালাল পাটোয়ারির আকস্মিক মৃত্যু হয়। সে বছরের শেষের দিকে আসনে উপনির্বাচনের সিদ্ধান্ত নেয় নির্বাচন আয়োগ। একই সঙ্গে ঐ বছরের এপ্রিল মাস থেকে ভোটার তালিকাতে নাম ভুক্তির কাজ আরম্ভ করে। মেমাস অব্দি এই ভোটার তালিকা সংশোধনের কাজ অব্যাহত ছিল। কিন্তু মেমাসের প্রথম সপ্তাহে ভোটার তালিকাতে প্রচুর অবৈধ বিদেশীর নাম ঢোকে গেছে বলে এক অভিযোগ উত্থাপিত হয়  বলা হয়, কংগ্রেস (আই) দল নিজের ভোট ব্যাঙ্ক শক্তিশালী করতে কৌশলে  সন্দেহজনক নাগরিকের নাম ভোটার তালিকাতে ঢুকিয়েছে।  এই অভিযোগ উত্থাপন করে পুরো আসাম কাঁপিয়ে তোলে সারা আসাম ছাত্র সংস্থা  এর আগে অসমে বিদেশী অনুপ্রবেশ থেকে শুরু করে বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের দাবিতে সারা আসাম ছাত্র সংস্থা, সংক্ষেপে ‘আসু’ বিভিন্ন প্রতিবাদী কর্মসূচী রূপায়ণ করে আসছিল। অন্যদিকে সংসদে তখন ভারতীয় জনতা পার্টির নেতা অটল বিহারি বাজপেয়ী ১৯৭৯র আগেই অসম সহ সমগ্র পূর্বোত্তরে বাংলাদেশীদের অবাধ অনুপ্রবেশ হচ্ছে বলে বক্তব্য রেখেছিলেন। সেই বক্তব্য অসমের একাংশ সচেতন ব্যক্তি, রাজনৈতিক নেতা এবং ছাত্র সংগঠনের নেতৃত্বকে আন্দোলনমুখী করে তোলে। এর আগে ‘আসু’ মুখ্যমন্ত্রী গোলাপ বরবরাকে কয়েক দফা দাবি সম্বলিত স্মারকপত্র প্রদান করেছিল। এমনকি তারা প্রধানমন্ত্রীকেও সত্তর দশকের মধ্য ভাগ থেকেই নানা দাবিতে স্মারকপত্র দিয়ে আসছিল। কিন্তু কেন্দ্রের সরকার সেই সব সমস্যা সমাধানের জন্যে বিশেষ কোনো পদক্ষেপ নেয় নি। ১৯৭৭এ জরুরি অবস্থার পরে কেন্দ্রের সরকার বদল হলো।  অসমেও সরকার বদল হলো। একই সময়ে অত্যন্ত শক্তিশালী ছাত্র সংগঠন সারা আসাম ছাত্র সংস্থারও নেতৃত্ব বদল হলো। আসুর নেতৃত্বে এলেন প্রফুল্ল কুমার মহন্ত এবং ভৃগু কুমার ফুকন।  মঙ্গলদৈ লোকসভা আসনের উপনির্বাচনকে কেন্দ্র করে উত্থাপিত বিদেশী নাগরিকের প্রশ্নটিকে আসুনেতৃত্ব বড় করে তোলে ধরলেন। মঙ্গলদৈ লোকসভা চক্রে ভোটার তালিকাতে বিদেশী নাগরিকের নাম অন্তর্ভুক্ত হয়েছে বলে নির্বাচনী আয়োগের কার্যালয়ে হাজার হাজার অভিযোগ পত্র প্রেরণ করে। নির্বাচনী আয়োগ সেগুলো পরীক্ষা নিরীক্ষাও করেন। গুরুত্বপূর্ণ কথা এই যে নির্বাচন আয়োগও এই সব অভিযোগ-পত্রের ৬৪.২৮% সত্য বলে ঘোষণাও করে। অর্থাৎ আয়োগ স্বীকার করে নেয় যে প্রায় ৪৫,০০০ ভোটার এই চক্রে       সন্দেহজনক নাগরিক।
          
              
           
মিছিলা নমশূদ্র
এই ঘটনা পুরো আসামকে উত্তেজিত করে তোলে। মঙ্গলদৈর ঘটনাকে আধার করে
আসু দাবি তোলে সারা রাজ্যের ১৩টি লোকসভা আসনের ভোটার তালিকাই প্রকাশ করতে হবে এবং বিদেশী নাগরিকের নাম সেগুলোর থেকে বাদ দিতে হবে।  মঙ্গলদৈর ঘটনা রাজ্যের ভূমিপুত্র এবং মধ্যবিত্তদের একাংশকে উত্তেজিত এবং আবেগিক করে তোলে। তাদের বিদেশী বহিষ্কারের দাবিকে আসামের আরো কিছু জাতীয় সংগঠনও সমর্থন জানায়।  বিশেষ করে পূর্ববঙ্গ থেকে অসমে প্রব্রজন অব্যাহত আছে বলে ব্যাপক প্রচার চালানো হয়।  ১৯৭৯তে ‘আসু’র নেতৃত্বে বিভিন্ন দল-সংগঠনের এক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সেই সর্বদলীয় সভাতে সারা আসাম গণ-সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোলা হয়। ‘আসু’র নেতারাই এর নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। অসম সাহিত্য সভাও এই সংগঠনে সামিল হয়।আসুর সভাপতি প্রফুল্ল কুমার মহন্ত ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে এক স্মারক পত্র প্রেরণ করেন, যেখানে অসমে অস্বাভাবিক জনসংখ্যা বৃদ্ধির পরিসংখ্যা তুলে ধরা হয়। এর পরেই আরম্ভ হয় আন্দোলনের কর্মসূচী---প্রতিবাদী মিছিল, বন্ধ, গণ-সত্যাগ্রহ ইত্যাদি ইত্যাদি...।
         
             
দিগন্ত শর্মার আগেকার বইএর বাংলানুবাদের প্রচ্ছদ
     দিল্লিতে সরকার বদল হয়। ইন্দিরা গান্ধি আবার রাজপাট দখল করেন। দিসপুরে বারবার সরকার গঠন এবং পতনের ঘটনা ঘটে। ‘আসু’র বিদেশী কেন্দ্রিক আন্দোলন সারা রাজ্যকে উত্তাল করে তোলে। সংগঠিত হয় নানা হিংসাত্মক ঘটনা। এরই মধ্যে কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে আন্দোলনকারী নেতৃত্বের কয়েক দফা বৈঠক হয়ে যায় কিন্তু এই সব আলোচনা-বৈঠক সমস্যার কোনো সমাধান করতে পারল না। আন্দোলনকারী নেতৃত্ব কেন্দ্রীয় সরকারের প্রস্তাব মেনে নিতে রাজি হলো না। ফল-স্বরূপে অসম থেকে এই বিদেশী বিতাড়ন বা বহিষ্কার এক জ্বলন্ত সমস্যা রূপে মাথা তোলে। আসু, গণ-সংগ্রাম পরিষদ তথা আন্দোলনকারী নেতা, কর্মী, সমর্থকেরা বিদেশীর বিরুদ্ধে নিজেরাই ব্যবস্থা নিতে গোপনে শলা-পরামর্শ করতে শুরু করে। ‘বিদেশীরা আছে কই?’ ‘বিদেশী কারা?’ ‘ বিদেশী প্রধান অঞ্চল কোনগুলো...?’ এসব কথার ব্যাপক গুঞ্জন ওঠে।  একাংশ লোক ব্রহ্মপুত্র উপত্যকাতে  বাঙালি হিন্দু এবং মুসলমান বসতি-প্রধান এলাকাগুলোই বিদেশীর বাসস্থান  বলে চিহ্নিত করে।  সেই প্রব্রজনকারী বা আভ্যন্তরীনভাবে স্থানান্তরিত (internally displaced) মানুষ যে এলাকাগুলো দখল করে বসতি স্থাপন করেছিলেন সেই এলাকাগুলো দখলমুক্ত করবার জন্যে একাংশ নেতা-কর্মীদের গোপন আহ্বান  ছড়িয়ে দেয়া হয়।  আন্দোলনের সমর্থক হাজার হাজার মানুষ এই সব ‘বিদেশী’দের তাড়িতে দেবার জন্যে নানা পদক্ষেপ নিতে শুরু করেন, কোথাও বা তা হিংসাত্মক আকারও নেয়। একই সঙ্গে ‘আসু’, গণ-সংগ্রাম পরিষদ নেতৃত্ব প্রশাসনযন্ত্রকেও অচল করে দেবার জন্যে বহু গোপন বেআইনি কর্মসূচী শুরু করে। এরই মধ্যে ইন্দিরা গান্ধি নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকার ১৯৮৩র ফেব্রুয়ারি মাসে অসম বিধান সভার সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত করবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ১৯৭৯র থেকে বেশ কবার অসম রাষ্ট্রপতি শাসনাধীনও ছিল। সেখানে কেন্দ্রের কংগ্রেস (ই) সরকার নির্বাচন করবার সিদ্ধান্ত নিলে তাকে প্রত্যাহ্বান জানিয়ে উচ্চতম ন্যায়ালয়ে আবেদন করা হয়। ন্যায়ালয় সেই আবেদন ১ ফেব্রুয়ারি তারিখে প্রত্যাখ্যান করে। ইন্দিরা গান্ধি সঙ্গে সঙ্গে যে সব কর্মচারী নির্বাচনের কাজে  অংশ নেবেন তাদের জন্যে গ্রুপ ইন্সিওরেন্সের সুবিধে দেবার কথা ঘোষণা করেন। আর ঐ ১ ফেব্রুয়ারির থেকেই অসম পরিণত হয় এক জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডে। জাতীয় সংগঠনগুলোর বিরোধিতাকে অবজ্ঞা করে ইন্দিরা গান্ধি নির্বাচনী প্রচারও করেন। অসমের ভূমিপুত্রের (খিলঞ্জিয়া) একাংশ এই নির্বাচনকে অবৈধ আখ্যা দেন। আন্দোলনকারীরা নির্বাচন বয়কটের আহ্বান জানান। ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার অধিকাংশ মানুষ এই আহ্বানকে সমর্থন জানান। পুলিশ ফাঁড়ি ঘেরাও, রাস্তা-ঘাট বন্ধ, সেতু জ্বালিয়ে দেয়া ইত্যাদি আরম্ভ হয়। পুলিশের গুলিতে বেশ কিছু ছাত্রনেতার মৃত্যুও হয়। রাজ্যের পরিস্থিতি হয়ে পড়ে অগ্নিগর্ভ। ওদিকে বাঙালি অধ্যুষিত বিভিন্ন       অঞ্চলে আক্রমণ নামাবার গোপন পরিকল্পনা প্রস্তুত করা হয়। অসমিয়ার অস্তিত্ব রাখতে অসমকে বিদেশী মুক্ত করতেই হবেতারজন্যে বিদেশী তাড়াতে হবে। ‘আহ আহ ওলাই আহ! খেদ ঐ খেদ , বিদেশীক খেদ!’ স্লোগানে মুখরিত হয় আকাশ। কিন্তু কোথাকার বিদেশী তাড়াবে?  কিছু নেতারা বিভিন্ন জেলার চরঅঞ্চল, বনাঞ্চল, গ্রেজিং এলাকা, পতিত ভূমি, সরকারি খাস জমিতে বসবাস করা বাঙালি হিন্দু –মুসলমানকে বিদেশি বলে শনাক্ত করে  সেই এলাকাগুলোতে পরিকল্পিত ভাবে আক্রমণ নামাতে শুরু করেনমঙ্গলদৈ চাউলখোয়া চরঅঞ্চল, নগাঁও (এখনকার মরিগাঁও) জেলার নেলি অঞ্চল, মৈরাবাড়ি, কামপুর, চামগুড়ি, কামরূপ জেলার গোরেশ্বর, চমরিয়া, নলবাড়ির মোকালমোয়া, দরং জেলার খৈরাবাড়ি-কলাই গাঁও ইত্যাদি জায়গাতে আন্দোলনকারীরা নৃশংস আক্রমণ নামায়।  সেরকম এখনকার ধেমাজি জেলার  (তখনকার লখিমপুর জেলা)  বিষ্ণুপুর, শান্তিপুর  ইত্যাদির বাসিন্দা হিন্দু বাঙালিদের উপরে ফেব্রুয়ারির ১৪ তারিখ থেকে ধারাবাহিকভাবে ভয়াবহ  আক্রমণ  নেমে আসে। অসমিয়া এবং জনজাতীয় হাজার হাজার মানুষ একত্রিত হয়ে অত্যন্ত নির্মম এবং জঘন্য আক্রমণ নামায় শিলাপাথারের কাছে ‘আর্নে’ বলে এক বিশাল চরঅঞ্চলে। সেই নিরীহ বাঙালিরা বিদেশী বহিষ্কার আন্দোলনে  সৃষ্ট সংঘাতময় পরিবেশের কেমন বলি হয়েছিলেন, সেই সংঘাতের আগেকার এবং পরবর্তী প্রব্রজন  (Migration) বা স্থানান্তরণ (Displacement)  পরিস্থিতি, সংঘাত পরবর্তী ন্যায় ব্যবস্থার এই সব মানুষের জীবনে কী রকম প্রভাব ফেলেছে, পরবর্তী কালে শান্তি স্থাপনের ক্ষেত্রে এই সব নির্যাতিত মানুষের ভূমিকা কী ছিল... অগ্নিগর্ভ ১৯৮৩ সনের ফেব্রুয়ারি মাসে সারা আসামেই বাঙ্গালিরা কী রকম নির্যাতিত হয়েছিলেন---ক্ষেত্র-ভিত্তিক অধ্যয়ন করে এই লেখাটি তৈরি করা হয়েছে।
                                                                       

(এক)

সবুজ আর্নে চরের রক্তাক্ত অধ্যায়
           
         
  ছেঁড়া পা ছুঁয়ে মিছিলা নমশূদ্র নীরবে কাঁদছিলেন
       ‘সেদিন সকালে উঠে বাড়িতে এটা ওটা করছিলাম। ছেলেমেয়েরা উঠোনে ছিল। ওদের বাবা একবার ঘরে যান, আরেকবার আসেন। গ্রামের বুঝদার মানুষেরা দিন দুই আগেই ধেমাজির দিকে অনেক বড় গণ্ডগোলের কথা শুনেছিলেন।  সেদিনও আমাদের গ্রামের উত্তর দিকে অনেক হৈ হট্টগোল কানে আসছিল। কোথায় কী হচ্ছে---কিছুই ধরতে পারছিলাম না। কিন্তু হঠাৎই সকালে সকালে আমাদের গ্রামেও চিৎকার চেঁচামেচি, হুলস্থূল, কান্নাকাটি, মার ধর আরম্ভ হয়ে গেলো। হাজার হাজার লোকে ঘিরে ফেলল আমাদের গ্রাম। ওদের হাতে দা, বর্শা, বল্লম, বন্ধুক, তির-ধনুক, লাঠি আর জ্বালানো মশাল...। গ্রামের লোকেরা পালাতে শুরু করলে যাকে যেখানে পেলো কোপাতে শুরু করল। আক্রমণকারীদের কেউ বা লাঠি দিয়ে মারল, কেই তির ধনুকে, কেউ বা বন্দুক দিয়ে গুলি করল। আমি বাড়ির উঠোন থেকে ছেলেমেয়ে দুটোর হাতে ধরে প্রাণ বাঁচাতে দৌড় দিলাম। আমার স্বামী আর বড় মেয়ে রীণাও দৌড় দিল। কিন্তু সেরকম দৌড়োচ্ছি যখন তখনি অস্ত্র হাতে লোকগুলো আমাদের ঘিরে ফেলল। ওদের কেউ একজন আমাকে লম্বা একটা ডেগার দিয়ে ঘা বসালো। ঘাটা আমার পায়ে লেগে পা একটা দুই টুকরো হয়ে গেলো। হাঁটুর নিচের টুকরোটি ছিটকে দূরে পড়ে গেলো আর আমি অজ্ঞান হয়ে গেলাম।” কথাগুলো বলে মিছিলা নমশূদ্র নামের পঁয়ষট্টি বছরের মহিলা থামলেন কিছুক্ষণ। শাড়ির আঁচলে দুই গাল বেয়ে নামা চোখের জল মুছলেন। খানিকক্ষণ তিনি মাথা নত করে রইলেন। একটি পিড়িতে বসে কথা বলছিলেন তিনি। এইবারে তিনি দুই হাতে শাড়ি কুঁচকে বাঁ পা দেখালেন ---‘এই দেখুন...’
           মিছিলা নমশূদ্র যখন আমাদের কথাগুলো বলছিলেন কচি কাঁচা ছেলে মেয়ে, যুবক যুবতী, বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা পাশে দাঁড়িয়ে বসে সব কথাই শুনছিলেন। কিছুক্ষণ সবাই নির্বাক হয়ে পড়লেন। নীরবতা ভেঙ্গে আমরাই মহিলাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তার পরে কী হলো?’
 ‘তারপরে আমি সেখানেই পড়ে রইলাম। পরে গ্রামের অন্য মানুষকে সঙ্গে নিয়ে আমাকে তুলে নিয়ে এলেন স্বামী। জ্ঞান যখন ফিরে এলো, আমার অবশিষ্ট পাটুকু কাপড়ে বাঁধা ছিল। অসহ্য ব্যথায় আমি ছটফট করছিলাম। এরই মধ্যে আমি স্বামীকে জিজ্ঞেস করলাম ছেলেমেয়ের কথা। তখনই তিনি হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করলেন। বললেন, আমাদের বারো বছরের ছেলে বিজয় আর ছয় বছরের মেয়ে শ্রীমতীকে ঘাতকেরা কেটে মেরে ফেলেছে। আমি যেখানে পড়ে ছিলাম, সেখানেই বুঝি বিজয় আর শ্রীমতীরও মৃতদেহ পড়ে ছিল।  স্বামীকে জিজ্ঞেস করলাম, বড় মেয়ে রীণা কই? তিনি বললেন, রীণার (১৬) হাতে দায়ের ঘা পড়েছে, পিঠে একটা তির বিঁধেছে। ওকে মাটিতে পড়ে থাকতে দেখে হয়তো ওরা মৃত বলে ভেবেছিল, ছেড়ে চলে গেছে। আমার পা কাটার যন্ত্রণা দ্বিগুণ বাড়িয়ে দিল এই সন্তান হারাবার দুঃখ, এরপরে স্বামী আমাকে  ভৈরবপুর আশ্রয় শিবিরে নিয়ে এলেন...।’ 
        
         
নাম তাঁর পক্ষ নমশূদ্র।
    
‘শিবিরে কদিন থাকলেন?’
            ‘ঠিক মনে নেই। কিন্তু এটা মনে আছে---আমার এই পা আর সন্তানকে কেড়ে নিয়ে গেছে অসমিয়াদের যে আক্রমণ সেটি ঘটেছিল ১৯৮৩র ফেব্রুয়ারি মাসে। মানে ফাল্গুন মাসের প্রথম সপ্তাহে। সেদিনটির পরে আর আমি স্বামী ছাড়া নড়াচড়া করতেই অক্ষম হয়ে গেলাম।  এদিকে আমাদের বাড়িঘরও আক্রমণকারীরা জ্বালিয়ে ফেলেছিল। আশ্রয় শিবির থেকে প্রথমে লখিমপুর হাসপাতালে, পরে ডিব্রুগড় হাসপাতালে থেকে মাস ছয়েক চিকিৎসা করালাম।   এর পরে গ্রামে যদিও বা ঘুরে এলাম বছর না ঘুরতেই হঠাৎই একদিন আমার স্বামী  নরেশ নমশূদ্রের মৃত্যু হলো। বাড়িতে পড়ে রইলাম সেই দাঙ্গাতে পঙ্গু আমি আর আমার কন্যা। আমার পা নেই, আর কন্যা রীণার আহত হাত। উঃ কী যে যন্ত্রণা...!’
            ছেঁড়া পা ছুঁয়ে মিছিলা নমশূদ্র নীরবে কাঁদছিলেন। তাঁর বয়স এখন ষাট পার করেছে। ৩২ বছর আগে বিদেশী বিতাড়নের নামে  অসমিয়া জাতির অস্তিত্ব রক্ষার নাম নিয়ে হাতে কর্মে একাংশ বাঙালির উপরে যে হিংস্র আক্রমণ সংঘটিত হয়েছিল, তারই সাক্ষী হিসাবে আজও ধেমাজি জেলার শিলাপাথার থানার অন্তর্গত আর্নে রামনগর গ্রামে আছেন মিছিলা নমশূদ্র। স্বামীর মৃত্যুর পরে সম্পূর্ণ অসহায় হয়ে পড়েছিলেন মিছিলা। কিন্তু আন্দোলনকারী দায়ের ঘায়ে আহত কন্যা রীণাকে স্থানীয় এক তরুণ বিয়ে করে, মিছিলার দৈনন্দিন জীবনের চালিকা শক্তি এখন সেই মেয়ে জামাইই।   দুখানি ক্র্যাচ দু’দিকে ধরে কোনোক্রমে চলাফেরা করেন মিছিলা। প্রতিমুহূর্তে তাঁর ছেঁড়া পা তাঁকে মনে করিয়ে দেয় অসমিয়া জাতির সংগঠিত সেই নৃশংসতা আর বর্বরতার কথা। শুধু যে এই মিছিলা নামের মহিলাটির বেলা, তাই নয়। বৃহত্তর আর্নে চর অঞ্চলে মিছিলা নমশূদ্রের সেই ছিন্ন পাখানি এখন অসমিয়া উগ্রজাতীয়তাবাদের নির্মম ঘৃণনীয় তথা নারকীয় অধ্যায়ের জ্বলন্ত সাক্ষ্য। মিছিলা যখন ক্র্যাচ দু’খানাতে ভর করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এদিকে ওদিকে ঘুরে বেড়ান, তখনই যেন গ্রামবাসীর (সে সময়ের ভুক্তভোগী) চোখে ভেসে উঠে নৃশংস সেই সব আক্রমণের ছবি।
        
            
পক্ষের শূন্য কপাল
   আর্নে রামনগর গ্রামে মিছিলা যখন আবেগ বিহ্বল হয়ে অসমিয়া ভাষী স্থানীয় জনজাতি মানুষের সেই আক্রমণের কথা বর্ণনা করছিলেন তখন কাছেই বসে ছিলেন আরেক মহিলা। মিছিলার কথা শেষ হবে হচ্ছে করতেই সেই মহিলা বলে উঠলেন, ‘ সেই আক্রমণের দিনটিতে আমার বিয়ের মাত্র সাতদিন হয়েছিল। আগের রবিবারে আমাদের বিয়ে হয়েছিল। পরের রবিবারে আমরা আক্রান্ত হলাম। আমাকে আর্নে রামনগরে বিয়ে দিয়েছিলেন। দুদিন আগেই গেছি স্বামীর ঘরে। কিন্তু স্বামীর সঙ্গে একদিন কাটাতে না কাটাতেই সেই আক্রমণ নেমে এলো...’
              মহিলাটি কথা থামালেন। খানিক সবাই নিস্তব্ধ হয়ে রইলেন। তারপরে বড় কষ্টে আটকানো গলাতে মহিলাটি বলে গেলেন, ‘ সেদিন আমার সামনেই স্বামীকে হত্যা করল ওরা। আমাকেও আক্রমণকারীরা মারতে আসছিল। স্বামী আমাকে দৌড়ে পালাতে বলে নিজে ওদের বাধা দিতে দৌড়ে গেলেন। দুই পা দৌড়ে গেছি কি পেছনে ফিরে দেখি, আমার স্বামীকে কোপাচ্ছে ওরা। উনি গড়িয়ে পড়ে গেছেন, সেই শরীরে লাঠি দিয়ে ঘা দিচ্ছে।  তারপরে কিছু লোকে আমাদের বাড়িতে আগুন দিল।  আমি দৌড়ালাম। ইতিমধ্যে গ্রামের মানুষজনও দৌড়োচ্ছে প্রাণ বাঁচাতে। আমি দৌড়ে দৌড়ে প্রাণ বাঁচালাম। কিন্তু আমার সিঁথির সিঁদুর হারালাম। বিয়ের মাত্র সাতদিন পরেই।' আমাদের সামনেই মহিলাটি হুহু করে কেঁদে ফেললেন। আমরা দেখে গেলাম শুধু---তাঁর দুই গাল বেয়ে নামছে চোখের জল। দেখে গেলাম, তাঁর শূন্য কপাল। গেল তিনটা দশক তিনি পার করেছেন এই দুঃখের বোঝা বয়ে বয়ে।  বিয়ের সময় তাঁর বয়স ছিল মাত্র ষোল। নাম তাঁর পক্ষ নমশূদ্র। আর্নে রামনগরের উপেন্দ্র নমশূদ্রের বাইশ বছরের ছেলে মাণিক নমশূদ্রের সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল পক্ষের। মিছিলার ছিন্ন পা, পক্ষের শূন্য কপাল---অসমিয়া উগ্রজাতীয়তাবাদী , অসমের অস্তিত্ব রক্ষার নামে সংগঠিত ঘাতক বাহিনী এই সমাজকে দেয়া ‘নির্মম উপহার’ ।
(ক্রমশ:)
             
~~~~০০০~~~
লেখাটি আর যেখানে পড়া যাবেঃ
১) http://swabhimanngo.blogspot.in/2015/05/blog-post_28.html
২) http://ishanerpunjomegh.blogspot.in/2015/05/blog-post_28.html