আমার চেতনার রঙে রাঙানো এই খেলা ঘরে:

~0~0~! আপনাকে স্বাগতম !~0~0~

*******************************************************************************************************

Sunday 18 January 2015

আকাদেমি পত্রিকার লোকসংস্কৃতি সংখ্যাঃ মাটির মর্মকথা বুঝবার একটি সমবেত আন্তরিক প্রয়াস।



                                                                                  ম্প্রতি কোলকাতা থেকে নতুন প্রকাশিত একটি কাগজ ‘সুভম সাময়িকী’র শারদীয় সংখ্যাতে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় সাহিত্য সংগঠনগুলো নিয়ে লিখেছেন, “ ...এই ধরণের সংগঠনগুলো সাহিত্যের গন্ধ গায়ে মাখে, কিন্তু সাহিত্যের চর্চা সেভাবে তাদের পক্ষে করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। সংগঠন হয়তো বিশাল বড় ক্ষমতাও অনেক, কিন্তু সাহিত্য একক ব্যক্তির সৃষ্টি। তাঁর নিঃসঙ্গতা, তাঁর গভীর চিন্তা , এগুলোর সঙ্গে সংগঠনের কোনো সম্পর্ক থাকে না। তেমনি পুস্তক প্রকাশনা তার একটা বাণিজ্যিক দিক আছে, চরিত্র আছে। সাহিত্যের সঙ্গে তার আড়াআড়ি নেই, তাকে অবলম্বন  করেই সাহিত্যের প্রকাশ ঘটে।” ‘সাহিত্য একক ব্যক্তির সৃষ্টি।’ ইত্যাদি ইত্যাদি কথার সঙ্গে আমাদের কোনো বিরোধ নেই। প্রশ্ন শেষ বাক্য দুটি নিয়ে।   কথাটা তিনি লিখেছেন গুয়াহাটিতে এমন এক সাহিত্য সংগঠনে আমন্ত্রিত হয়ে এসে হওয়া অভিজ্ঞতার উপরে। কিন্তু বাজারের প্রশংসাতে তিনি এর পরে এতো বেশি উচ্ছ্বসিত যে পশ্চিমে যখন সম্পাদক ঠিক করে দেন, লেখক কোন জায়গা রাখবেন আর কোন জায়গা কাটবেন এহেন যৌথ-শিল্প আমাদের দেশে নেই বলে বেশ আক্ষেপ করছেন। এমনকি বাংলাদেশে গিয়ে দেখলেন, তাঁর আধা লেখা ধারাবাহিক উপন্যাসের পাইরেটেড প্রতিলিপি বেরিয়ে গেছে। এতেও তিনি এই ভেবে উচ্ছ্বসিত যে ‘ডিমান্ড’টাতো আছে। পাঠক কি সাহিত্যের পশ্চিমবঙ্গীয় রাজনীতিটা ধরতে পারলেন? অনুভব করলেন কেন, আমাদের সাহিত্যের পূর্বোত্তরীয় রাজনীতিটা আলাদা হবে? ওদের ওখানে বাজারকে ‘অবলম্বন  করেই সাহিত্যের প্রকাশ ঘটে’। আমাদেরতো প্রকাশনা শিল্প গড়ে উঠছে মাত্র। আর যেটুকু আছে, এমন কি অসমিয়া সাহিত্যেরও  বাজারটা নেই সেরকম।  আমাদের এখানে কিসেকে অবলম্বন করবে সাহিত্য? এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়াটা জরুরি।
      
           কলকাতা শহরকে কেন্দ্র করেই এক কালে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ গড়ে উঠেছিল পশ্চিম বাংলাতে। তারই দেখাদেখি বা প্রেরণাতে এককালে কামরূপ অনুসন্ধান সমিতি হয়ে অসম সাহিত্য সভা গড়ে উঠেছিল অসমে। অবিভক্ত বাংলাদেশের প্রবাসীদের নিয়ে গড়ে উঠেছিল নিখিল ভারত বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলন।  বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ বা তার রূপান্তর পশ্চিম বঙ্গ বাংলা আকাদেমির এখন আর সেই গণমুখী  প্রাণ নেই যদিও সংগঠনটি আছে। তেমনি দেশের মানচিত্র পাল্টালেও নিখিল ভারত বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলনের ভাবনা এখনো ১৯৪৭ পার করে নি। বাংলা ভাষা সাহিত্য নিয়ে সে ঐ বাৎসরিক একটি সম্মেলন করবার বাইরে কিছু করে বলে মনে হয় না। এর অসম শাখাও যে অসমের ভাষা সাহিত্য নিয়ে কোনো খবর রাখে আমাদের নজরে আসেনি।
                    কিন্তু অসম সাহিত্য সভা এবং তার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ প্রেরণাতে অসমে যেসব বিভিন্ন ভাষা সাহিত্য সংগঠন গড়ে উঠেছে সেগুলোর একটি গণমুখী চরিত্র আছে। ভালো কিম্বা মন্দ সংগঠনগুলোর কাজে কর্মে প্রাণ আছে। অসমে বাজারের বিকল্প এরাই। বরাক উপত্যকা বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলন তারই একটি। দৃশ্যত অসম সাহিত্য সভার উগ্রজাতীয়তাবাদী অবস্থানের বিরোধিতা করতে গিয়েই এর জন্ম বটে---তাই ‘পরোক্ষ’ শব্দটিও লিখছিলাম। অসমের  মণিপুরি সাহিত্য পরিষদ কিম্বা দেউরি সাহিত্য সভার একই কাহিনি। আধুনিক নাগরিক শিল্প বা সাহিত্য ব্যক্তির একক সৃষ্টি যে থাকছে না সে শীর্ষেন্দু নিজেই লিখছেন। তবু আমরা যদি মেনেও নিই এসব একক ব্যক্তির নিভৃতে নিরালায় সৃষ্টি , ‘লোক’ সংস্কৃতি বা সাহিত্য নিয়েতো এই কথা বলা যাবে না। আর গেলেও এই কথা মানতেই হবে যে এই সব সংগঠনকে অবলম্বন করেই এখানকার সব সাহিত্য ‘প্রকাশে’র মুখ দেখে। প্রকাশ বলতে আমরা ছাপার কথা বলছি না। সেতো পরে। আগেতো এই কথা জরুরি জানানো যে এখানেও ভাষা আছে, আর এই ভাষাতে সাহিত্য হয়। শিল্প হয়। গান হয়। ছবি হয়।  দুঃখের হলেও সত্য যে এখানকার বহু শহুরে বাঙালিও এই সত্য জানেন না। সাহিত্যের বহু স্নাতকোত্তর ছাত্রও জানেন না। তারা তাই মেদিনীপুরের নিম্নবর্গকে নিয়ে করা সাহিত্য নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। আমাদের চাতলা, শনবিল কিম্বা বকরি হাওরেও  যে কিছু দুর্ভাগা নিম্নবর্গ আছেন এই কথা বহু ‘প্রগতিশীল’ প্রতিষ্ঠান বিরোধী ছোট কাগজও মনে রাখেন না। আর যারা মনে রাখেন তাদের কোনো দায় নেই সেই ‘নিম্নবর্গ’কে হেমাঙ্গ বিশ্বাস যেমন মঘাই ওঝাকে নিয়ে মুম্বাই অব্দি পৌঁছে গেছিলেন তেমনি ডেকে শিলচর বা গুয়াহাটি অব্দি নিয়ে আসবার।   এই কাজটা করেন বঙ্গ সাহিত্য ও সম্মেলনের মতো সংগঠন। দীর্ঘ তিন দশক ধরে করে আসছেন। 
                 সীমাবদ্ধতা আছে। অনেকেই বলেন, এরাও বাৎসরিক পিকনিক করেন। সাংগঠনিক নির্বাচনের নামে বিচ্ছিরিভাবে চেয়ার টানি করেন। এবং শাসক দল বা শ্রেণি বিক্ষুব্ধ হবেন এমন কোনো কাজই করেন না বা করবেন না। সবই সত্য। মতাদর্শ নির্বিশেষে মধ্যবিত্তের নেতৃত্বে যখন এমন এক সংগঠন গড়ে উঠে তখন সেও সযত্নে দূরে সরিয়ে রাখে বহু ‘প্রত্যাখ্যাত অপর’কে। সব কণ্ঠ আদৌ সমস্বরে গান গাইবার স্বাধীনতা পায় না। কিন্তু বহু স্বর পায়, যেটুকু পাবার জন্যেও এখনো এর থেকে ভালো বিকল্প গড়ে উঠলে ভালো, কিন্তু গড়ে উঠে নি এটা বাস্তবতা। চাইকি, আমাদের একটা নিজস্ব কলেজ স্ট্রিট গড়ে উঠলেও তো বেশ ভালো ছিল, তখনই শুধু বাজারকে কষে গালি দিয়ে লিখে নিজেদের কাগজ ছড়াবার জন্যে ‘পাতিরাম’কে পেতাম। এই দ্বান্দ্বিক বাস্তবতার কথা নাইবা  ভুলে রইলাম। এই সংগঠনগুলো সাহিত্য করেন না বটে, করাটা তাদের কাজও নয়।  কিন্তু করবার পরিবেশটি গড়ে তোলেন। যেমন কলেজ স্ট্রিট করে পশ্চিমবঙ্গীয় সাহিত্যের জন্যে।  জমিতে চাষ হবে বলে বৃষ্টিপাতের ব্যবস্থাটা করে দেন। তৃণ গুল্মলতাকেও মাথা তোলবার সাহস যোগান।  এবারে সেই জলে কে মানব জমিন চাষ করে সোনা ফলাবেন, সে নিশ্চয় ব্যক্তি মানুষের নিজের কথা।  সেই ব্যক্তিকে ভোর সকালে ঠেলে ঘুম থেকে তোলবার ব্যবস্থাটাও করে দেয় এমন সংগঠন। কিছু কিছু অতিদাম্ভিক শিল্পী সাহিত্যিক আছেন, যারা এই জমিতে তৃণ কিম্বা আগাছা সহ্য করেন না। কিন্তু বটবৃক্ষওতো সেখানেই জন্মায় যেখানে তার আগে তৃণ জন্মাতে পারে, তাই না? মরুভূমিতে নয়।  তাই এই কথাতো নির্বিঘ্নে বলাই যেতে পারে, যে বরাক উপত্যকা বঙ্গ সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্মেলনের মতো সংগঠনগুলো আসলে তৃণমূলে সার-পানি যোগাবার সংগঠন।
                 প্রকাশনা শিল্পে খুব বেশি কাজ এরা এখনো করতে পারেন নি। ২০১৩র বইমেলা উপলক্ষে প্রকাশিত ‘স্মারক পত্রিকা’ খুলে দেখলাম সব মিলিয়ে বারোখানা বইয়ের খবর আছে, আর ‘আদাদেমি পত্রিকা’র , পূর্বনাম যার গবেষণা পর্ষদ পত্রিকা, চারটি সংখ্যার কথা আছে। কিন্তু প্রথম প্রকাশনাটিরই নামই ‘ বরাক উপত্যকার বারোমাসী গান’ । অধ্যাপক অমলেন্দু ভট্টাচার্যের সম্পাদিত এই বইটি কি শুরুতেই জানিয়ে দিল না, যে কলেজ পাঠ্য ‘ফুল্লরার বারোমাসী’তেই আমাদের ঐতিহ্য থেকে যায় নি। কিম্বা কবি অধ্যাপক শক্তিপদ ব্রহ্মচারী এবং অধ্যাপক বিশ্বতোষ চৌধুরী সম্পাদিত  ‘ঈশানের পুঞ্জমেঘ’ নামের কাব্য সংকলনতো বেশ ঘটা করেই জানিয়ে দিয়েছিল, আমাদের নাগরিক কবিতার শুরুটাও হয়নি মাত্র ঐ ষাটের ‘অতন্দ্রে’র হাত ধরে। স্থানে এবং কালে আমাদের শেকড় ছড়ানো বহু দূর। কেউ আমরা বনসাই নই। বাকি নামগুলো নিচ্ছিনা, সেগুলো  সবাই জানেন।
                   আমরা বনসাই নই। এই কথাটা বড় করে বলবার, ভাববার এবং ভাববার দরকার আছে। এখানকার শহুরে মধ্যবিত্তের একটা বড় অংশ হয় ব্রিটিশ ভারতে প্রব্রজিত, নতুবা দেশভাগের পরে আসা উদ্বাস্তু। এদের অধিকাংশই বাস করেন স্মৃতির বাংলাদেশে কিম্বা স্বপ্নের ‘কোলকাতায়’। এ মাটি যেন এখনো তাদের বহুর কাছে ব্রাত্য। অজ্ঞাত এবং উপেক্ষিত।  সেই তারাই যখন বৌদ্ধিক নেতৃত্বটা গ্রহণ করেন, তখন মফস্বল থেকে উঠে আসা বহু প্রতিভাও বিশ্বাস করতে শুরু করেন যে তাঁর ‘সত্তা’ বলে আসলে বেশি কিছু নেই। তিনি ঠিক ‘খিলঞ্জিয়া’ নন। বাংলায় বললে, ‘তৃণমূলীয়’ বা ‘ভূমিপুত্র’ নন।  পরের জমিন, পরের জায়গা ; ঘর বানিয়ে থাকেন তিনি। ছিন্নমূল, শৈবাল, কিম্বা পরগাছা জাতীয়। এই ভাবেই ভারতীয় বাঙালির চার প্রকার ভেদের কথা জানিয়েছিলেন, সেদিন তিনসুকিয়াতে এক অনুষ্ঠানে ঝাড়খণ্ডের অধ্যাপক বিনোদ মাহাতো। আমাদের ‘শৈবাল’ প্রকৃতিকে আরো সবল করে তুলছে বিশ্বায়ন।  গেল দুই দশকে বিশ্বায়নের ঠেলাতে দেশের ভেতরে ব্যাপক আভ্যন্তরীণ প্রব্রজনেরতো আবার সবাই ‘শিকার’।  ‘প্রবাসী’ কিম্বা ‘বহির্বঙ্গ’ কথাটা তাই নির্দ্বিধাতে এখানে উচ্চারিত হয়। তাও বাংলাভাষাতে। ঠিক তাই ১৯৪৭এর পরে অসম কিম্বা বাংলাদেশের রাজনীতি-সাহিত্য সংস্কৃতি  বহু পাল্টালেও তাতে  অসম কিম্বা বরাক উপত্যকার  বাঙালির  বিশেষ হেলদোল নেই কিন্তু। বিশেষ  কোনো ভূমিকা সে রাখতে পারে নি ।  এই নিয়ে সম্ভবত অধিকাংশের কোনো জিজ্ঞাসাও নেই। যা হচ্ছে তাই মেনে নেয়াতো আছেই, ভাবগতিক দেখে মনে হয় ‘মনে নেয়া’ও রয়েছে পূর্ণোদ্যমে। প্রথম  ভাষা আন্দোলনের পাঁচটি  দশক পেরিয়ে গেলো। সেই আন্দোলনের ইতিবৃত্ত লিখবার প্রতিযোগিতাও খুব হলো। কিন্তু কারো চিন্তাতে এই কথা এলো না যে এখানে ভাষার স্বরূপটা নিয়েই তো কোনো কাজ হলো না বিশেষ এদ্দিনে। অথচ অখনিত বিশাল খনি পড়ে আছে! এই কাজটা শুনেছি বরাক বঙ্গ করবেন ‘আকাদেমি পত্রিকা’র আগামী সংখ্যাতে। এটি এক সুসংবাদ। যেমন সুসংবাদ , তাঁরা গেল  ২০১১ - ১২ সংখ্যাটি করেছিলেন ‘লোকসংস্কৃতি’ নিয়ে। সম্প্রতি সংখ্যাটি আমাদের হাতে এলো।

         
রবিবারের প্রসঙ্গ
‘লোক সংস্কৃতি’ আমাদের শেকড় চেনায়। শুধুই সাংস্কৃতিক নয়, আমাদের আর্থ সামাজিক ইতিহাসের সমস্ত তথ্যকে সে নিজের মধ্যে ধারণ     করে বর্তমান অব্দি নিয়ে আসে। এবং ‘অতীত’ যেহেতু কোনোদিনই মানব ইতিহাস থেকে বিদেয় নেবার কোনো সম্ভাবনা নেই, তাই এমন কোনো দিনও আসবে না যখন ‘লোকসংস্কৃতি’ বলে মানুষের আর কিছু থাকবে না। হেমাঙ্গ বিশ্বাস তাই লিখেছেন, তাঁর ‘অসম বঙ্গ লোক সঙ্গীত সমীক্ষা’ বইতে  ‘লোকসঙ্গীত’ আমাদের বর্তমান এবং ভবিষ্যতও। কিন্তু মানবসমাজের কিছু কিছু খেচর  ‘মগডাল’ আছে যারা ‘শেকড়’ থেকে বিচ্ছিন্ন হতে পারলেই বাঁচে। আর তাই নাগরিক কিম্বা উচ্চবর্গীয় সমাজ চিরদিনই নিজের কৃতিত্ব জাহির করতে সেই শেকড়ের সঙ্গে সংঘাতে গেছে এবং গিয়ে থাকে। তারাই এমন তত্ত্ব জনপ্রিয় করেন যে  শিবের থেকে শিখে মুনি ভরতই তো সঙ্গীতের প্রচার করলেন এই দুনিয়াতে। এই সত্য স্বীকার করতে তাদের লজ্জা হয় যে আদিম মানবেরা যেদিন প্রথম পাথর ঘসে হাতিয়ার তৈরি করে ফেলল সেদিন থেকেই তার শিকারের আনন্দকে সে ব্যক্ত করতে শুরু করেছে নাচে,  গানে কিম্বা ছবি এঁকে।  ‘ নদীর নাম সই কচুয়া, মাছ মারে মাছুয়া’ এই ছিল কোচবিহারের ভাইয়াইয়া গানটির মূল কথা। বিশ শতকের ত্রিশের দশকে গানটি রেকর্ড করতে গেছিলেন আব্বাস উদ্দীন। কিন্তু এই ‘ইতর’ভাষাতে গানটি রেকর্ড করা যাবে না বলে কোম্পানির কর্মকর্তারা ফিরিয়ে দিলেন। পরে সেই গানটিরই সুর তুলে নিয়ে কথাকে কলকাতার মহানাগরিক মানে কাজি নজরুলকে দিয়ে ‘ভদ্রজনোচিত’ ভাষাতে রূপান্তরিত করিয়ে নিল কোম্পানি। সেই গানটি এতো জনপ্রিয় হলো যে এর  প্রথম কলিটি --‘নদীর নাম সই অঞ্জনা, নাচে তীরে খঞ্জনা’ --বহু স্রোতা এবং কবির মুখে কলমে ফিরতে ফিরে প্রায় বাংলা প্রবাদ বাক্যের জায়গা করে নিল। চাপা পড়ে গেল বাংলা ভাষা-সাংস্কৃতিক বৈচিত্রকে মহানাগরিক প্রতিষ্ঠানের দ্বারা প্রত্যাখানের , অস্বীকারের, অবজ্ঞা আর উপেক্ষার ‘ইতরোচিত’ প্রয়াসের ইতিবৃত্ত। এমন প্রয়াসের বিরুদ্ধে লড়াই গড়ে তোলবার বাসনা নিয়েই হেমাঙ্গ তাঁর বইটি লিখেছিলেন। কিন্তু ‘বামপন্থী’দের মধ্যেই এই পথে  তাঁর খুব অনুরাগী জন্মায় নি। অন্তত অসম কিম্বা বরাক উপত্যকাতেতো নয়ই। ‘লোকসংস্কৃতি’কে ভালোবাসার কাজটা তাই এদ্দিন করে আসছিলেন ‘জাতিঙ্গা’ বা ‘প্রবাহে’র মতো গুটি কয় কাগজই। ‘শ্রমিক-কৃষকে’র জন্যে সাহিত্য করবার  ‘প্রগতিশীল’ কোনো কাগজ এসব নিয়ে মাথা ঘামায় নি বিশেষ।  ইদানিং যে আই এস এস এন নম্বর জোটানো কিছু কাগজে ছবিটা অন্যরকম দেখা যাচ্ছে তারও মূল প্রেরণা কিন্তু অধ্যাপক অমলেন্দু ভট্টাচার্য,  তুষার কান্তি নাথ প্রমুখের মতো হৃদয়ের ভালোবাসার থেকে নয়, বিশ্ববিদ্যালয় অনুদান আয়োগের ফরমায়েশ মেনে নম্বর গোটানোর তাগিদ থেকে। সম্ভবত তাই এই দু’ই বছরেও ‘আকাদেমি পত্রিকা’র এই সংখ্যাটি নিয়ে কোথাও কোনো আলোচনাও নজরে আসেনি                                                                   
             ‘বনসাই’ মানসিকতার থেকে বেরিয়ে আসা খুবই কঠিন।  আমরা তাই কলম ধরলাম, নিজেদের সমস্ত অজ্ঞতা, অক্ষমতা এই বিষয়টি নিয়ে থাকা সত্ত্বেও। আমরা তাত্ত্বিক  ভালো মন্দ নিয়ে বিশেষ কিছুই লিখব না। শুধু পরিচয় করিয়ে দেবো সংখ্যাটির। সম্পাদনা করেছেন,  আবুল হুসেন মজুমদার, জন্মজিৎ রায়, অমলেন্দু ভট্টাচার্য, সঞ্জীব দেবলস্কর, সুব্রত পুরকায়স্থ। এবং মূল সম্পাদক তুষার কান্তি নাথ।   সতেরো খানা পূর্ণাঙ্গ প্রবন্ধ দিয়ে সাজিয়েছেন সংখ্যাটি। তিনটি গুরুত্ব পূর্ণ প্রবন্ধ  ‘পরিশিষ্ট’ বলে শেষে আলাদা বিভাগে যুক্ত হয়েছে।  সেই তিনটি যোগ করলে সংখ্যাটা দাঁড়ায়, কম নয়, বিশে। 
             ‘লোকসংস্কৃতি ও নাগরিক সংস্কৃতি : সংঘাত , সমন্বয় ও উত্তরণ’ প্রবন্ধে জন্মজিৎ রায় মূলত এই কথাকেই প্রতিষ্ঠা দিয়েছেন আমরা যেটি বলে এলাম, লোক সংস্কৃতি পাল্টাবে কিন্তু বিলীন হবে না কোনোদিন। লোক সংস্কৃতি যদি থিসিস হয় , তবে নাগরিক বা ‘ধ্রুপদী’ সংস্কৃতি অ্যান্টি-থিসিস। দুইয়ের সংঘাত সমন্বয়ে উত্তরিত হয় লোক সংস্কৃতি।  তিনি রবার্ট রেডফিল্ড অনুসরণ করে লিখেছেন, সভ্যতা হচ্ছে ‘ a complex structure of great and little tradition.’ এখন  নাগরিক সংস্কৃতিকে ‘বড়’ এবং লোক সংস্কৃতিকে ‘ছোট’ ঐতিহ্য বলা যাবে কিনা, এই প্রশ্ন আমাদের মনে জেগেছে কিন্তু। রবীন্দ্রনাথও যখন ‘উচ্চ এবং নিম্ন’ সংস্কৃতি বলে প্রকার ভেদ করেছিলেন, হেমাঙ্গ তাকে ব্যঞ্জনার্থে নিতে বলেও সতর্কবাণী শুনিয়েছেন, ‘লোক সংস্কৃতি’কে যেন নিম্ন সংস্কৃতি বলে ভেবে বসবার দাম্ভিকতাতে আমাদের না পেয়ে বসে। তবে কিনা, এই দুই সংস্কৃতির কারোরই যে একক বিচ্ছিন্ন কোনো অস্তিত্ব হতে পারে না, জন্মজিৎ রায়ের মতো সেই কথা হেমাঙ্গও শুনিয়েছিলেন।
             দ্বিতীয়টি লিখেছেন আরেক বিদগ্ধ পণ্ডিত আবুল হুসেন মজুমদার। তাঁর প্রবন্ধটির নাম ‘বরাক উপত্যকার লোকসংগীতে অধ্যাত্মবাদঃ সম্প্রীতি  চেতনার প্রেক্ষাপট’ । প্রবন্ধটির শুরু এই কথাতে , “ ধর্মবিশ্বাস মানুষের স্বভাবজাত, নাস্তিকতা একটি কৃত্রিম অভ্যেস’’ তিনি তাঁর মতো ব্যাখ্যা দিয়েছেন। মোটা মোটি ‘বোধ-বুদ্ধির’ শুরু থেকেই সুখ-দুঃখ, আশা-নিরাশা, মৃত্যু-প্রাণ নিয়ে প্রশ্ন করে এসেছে মানুষ । ‘উত্তর গড়ে তুলেছে, গড়ে তুলেছে তত্ত্ব’ তাও ‘বোধ-বুদ্ধি’ দেখা দেবার পরে। তার আগেকার স্বভাবটি তবে কী? মানবাতিরিক্ত প্রাণীদের ঈশ্বর কল্পনা শূন্যতার তবে ব্যাখ্যাটা কী? তার মানে প্রাণী মাত্রেরই ‘নাস্তিক’ স্বভাবটাই আসলে ‘প্রাকৃতিক’। বাকিটা মানুষের গড়ে তোলা।  তিনি নিজেও লিখছেন , ‘এসব থেকেই পুজো অর্চনা আর উপাস্য, দেবী-দেবতা, ভগবান ঈশ্বর লাভ করেছেন অস্তিত্ব।” খুবই স্পষ্ট যে তিনি লিখছেন, ঈশ্বরকে গড়ে তোলেছে মানুষ।
              সে যাক,  শিরোনাম দেখে এটা মনে করবার কারণ নেই যে লোকসংস্কৃতির সবটাই ধর্ম সম্পৃক্ত। এমনটা তিনি দাবিও করেন নি।  তবে কি না আমাদেরতো আরেকটা অন্ধ ‘নাস্তিক’ ধারণাও আছে এমন যে প্রাক-ব্রিটিশ যুগটাই আসলে অন্ধবিশ্বাসের ‘মধ্যযুগ’ আর ধর্মীয় সংঘাতের যুগ। তার বিরুদ্ধে গিয়ে দীনেশ সেন মনে হয় প্রথম ব্যক্তি যিনি দেখিয়েছিলেন আমাদের লোক সাহিত্যের প্রধান ধারাটিই আসলে হয় ধর্মসম্পর্করহিত কিম্বা ধর্ম নিরপেক্ষ।  হেমাঙ্গ বিশ্বাস হলেতো বরাক উপত্যকার কবির এই পদেও নদী পথগামী যাত্রীর প্রবঞ্চিত হবার আশঙ্কার অভিব্যক্তিই দেখতে পেতেনঃ অধীন এক্রামে বলে,/ মমরাজা ওরে : / খেওয়া ঘাট চিনিয়া করিয়ো পার –আমার ঠাকুর জগন্নাথ।” আবুল হুসেন ধর্মীয় সমন্বয় দেখেছেন। এই দেখাও মিথ্যে নয়। এমনকি ইসলাম নিয়ে বহু  বিশ্বাসী-নাস্তিক নাগরিক ‘শিক্ষিতজনে’র ধারণাকেও ধ্বসিয়ে দিয়ে তিনি প্রশ্ন তুলেছেন, “ ইসলামকে ধর্মতাত্ত্বিকেরা বলেন সংগঠিত (organised) ধর্ম—তার সবকিছু সুবিন্যস্ত, সুনির্দিষ্ট, অপরিবর্তনীয় ইত্যাদি। সত্যিই কি তাই?” মোদ্দা কথাটা খুব সোজা। এক্রাম আলীর ‘জগন্নাথে’র নাম নেয়াটা তাঁর বিশ্বাসেরই অঙ্গ, এখনকার মতো রাজনৈতিক প্রেরণা নয়। এই ‘যৌথচেতনার প্রকাশমূলক সমৃদ্ধ সংস্কৃতি, লোকসংস্কৃতি’কে লালন করাবার  আমাদের  কর্তব্যের কথা স্মরণ করিয়ে ফুরিয়েছে প্রবন্ধটি।
              সুবীর করের প্রবন্ধ ‘অথ বাঘ-মানব প্রসঙ্গ ও উত্তর পূর্ব ভারতের লোককথা’ একটি নৃতাত্ত্বিক রচনাও। বেশ জটিল এবং তত্ত্বগধুর। কিন্তু বরাক উপত্যকার বাঙালির একাংশের মধ্যে বাঘ-পূজার উৎস সন্ধানে তিনি শুধু প্রতিবেশী মিজো, লাখের ,পাবি জনজাতীয় সমাজ এবং সংস্কৃতির ইতিহাসেই নয় ভ্রমণ করেছেন এবং করিয়েছেন চীন থেকে শুরু করে লাতিন আমেরিকা অব্দি। আর দেখিয়েছেন কী করে একটি আঞ্চলিক বিশেষ জনসমাজের শেকড় ছড়িয়ে থাকে বিশ্বভূবন জুড়ে। ‘তাদের মধ্যে এক অন্তর্লীন যোগসূত্র রয়েছে।’ তখনই প্রশ্ন করতে মন চায় লোকসংস্কৃতিকে ‘ছোট ঐতিহ্য’ বলে পরিভাষিত করা কতটা সংগত। মাঘমাসের ১৩ তারিখ থেকে সংক্রান্তির আগের দিন অব্দি বরাক সিলেটে প্রচলিত বাঘপুজোর আচার অনুষ্ঠানের পরিচিতি দেবার সঙ্গে বেশ কিছু ‘আই’র সংকলন প্রবন্ধটির একটি বাড়তি প্রাপ্তি। এই কাজ অনেকটা সুজিৎ চৌধুরীর ‘স্বর্ণগোধিকার সন্ধানে’র মতো ‘অভিনব’ কাজ। যার কথা লিখেছেন সঞ্জীব দেব লস্কর সুজিৎ চৌধুরী নিয়ে লিখতে গিয়ে পরিশিষ্ট অংশে।
                
আবুল হুসেন মজুমদারের সিদ্ধান্তকে আরও দৃঢ় ভিতের উপরে দাঁড় করায় কামালুদ্দীন আহমেদের চতুর্থ প্রবন্ধ ‘গাজিনৃত্য : বরাক উপত্যকার এক অনুপম লোকশিল্পকলা’ নিবন্ধ।  মূলত মাহিমাল সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রচলিত কিন্তু সম্প্রদায় নির্বিশেষে জনপ্রিয় এই নৃত্য পরম্পরা সম্পর্কে লেখক লিখেছেন, “ সপ্তদশ শতাব্দীতে রাঢ়, সুন্দরবন এবং বরাক উপত্যকাতে একই সঙ্গে গাজি লোকবিশ্বাসের উৎপত্তি হয়েছিল। প্রকৃতপক্ষে গাজিনৃত্য পদ্মপুরাণ বা মনসামঙ্গল বর্ণিত লোকদেবী মনসা বা বিষহরীর সন্তুষ্টি বিধানের জন্য পরিবেশিত ওঝানৃত্যের একটা মুসলমানি সংস্করণ বলেই মনে হয়। ”এই ‘গাজি’ পরম্পরার থেকে বিচ্ছিন্ন নাগরিক সমাজই এমন তত্ত্ব গঠন করেন যে ইসলামে সংস্কার বলে কিছু নেই। এমন তত্ত্ব আসলে ঘুরিয়ে ধর্মের সর্বশক্তিমানতাকেই প্রতিষ্ঠা দেন। আসল ঘটনা সেরকম ঘটে না, উৎপাদন ব্যবস্থা পাল্টাবার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে বিশ্বাসেও সংস্কার আসে , আসে পরম্পরাতে। আধুনিক ভারতীয় ইসলামকে অনেকটা পৌত্তলিকতা বিরোধী ‘ব্রাহ্মধর্ম আন্দোলনে’র সঙ্গেই মেলানো যায়। যার কিনা প্রেরণা ছিল এই দেশে ব্রিটিশ প্রবর্তিত পুঁজিবাদ।  আর তাই, লেখককে সত্যটাই লিখতে হয়েছে, “ ধর্মীয় পুনর্জাগরণের প্রভাবে গাজিনৃত্যের পৃষ্ঠপোষক, রসভোক্তা এবং পরিবেশকদের মধ্যে একটা দ্বন্দ্বের লক্ষণ খুবই স্পষ্টরূপে দেখা দিয়েছে। এই জাতীয় দ্বন্দ্বের বশবর্তী হয়ে অনেক পৃষ্ঠপোষক আর গাজি নৃত্যানুষ্ঠানে সহায়তা করেন না, অনেক রসগ্রাহী আর গাজিনৃত্যের অনুষ্ঠানে উপস্থিত হন না এবং অনেক শিল্পী তাঁদের বংশপরম্পরাগত পেশাটির প্রতি আগ্রহ বোধ করেন না।” যে জমিদার বা মিরাসদারেরা এক কালে পৃষ্ঠপোষকতা করতেন সেই শ্রেণিটিরই আর কোনো অস্তিত্ব নেই। সুতরাং অস্তিত্ব বিপন্ন হচ্ছে গাজি পির বা  দেবতারও।
         
           পঞ্চম প্রবন্ধটি পুনর্মুদ্রণ। নৃত্যশিক্ষক এবং গবেষক মুকুন্দদাস ভট্টাচার্যের ১৯৯৫তে প্রকাশিত বই ‘বরাক উপত্যকার লোকনৃত্য : গ্রামীণ নৃত্য কলা’র থেকে নেয়া ‘ বৌ নাচ বা বধূবরণ নৃত্য।’ ‘যৌথশ্রম প্রক্রিয়া থেকেই ছন্দও সুরের উৎপত্তি। গণজীবনের নিত্যনৈমিত্তিক কর্মলীলা বা শ্রমপ্রক্রিয়া সেই ছন্দ ও সুরে আশ্রিত হয়ে লোকনৃত্য, লোক সঙ্গীতের সৃষ্টি করে। লোক-সংস্কৃতির এই উপাদানগুলি এক জায়গায় স্থির থাকে না। এগুলো পরিবর্তনশীলতো বটেই, তবে সে পরিবর্তন ঘটে অতি ধীরে, পরোক্ষে, সাধারণ অভিজ্ঞতার বাইরে। পরিবর্তনের একটা নিজস্ব স্বতঃস্ফূর্ত ধারা আছে, বাইরে থেকে তা আরোপ করতে গেলেই তা বিচ্যুত ও বিকৃত হয়ে পড়ে।” সেই বিকৃতির থেকে রক্ষা পাক সিলেট –বরাক উপত্যকাতে প্রচলিত ‘বৌ নাচ’ এমন একটা আকাঙ্ক্ষার থেকেই তাঁর নিবন্ধটি। নামে ‘বৌনাচ’ হলেও কথায় গানে বাদ্যে এই আনন্দ অনুষ্ঠানে নারী পুরুষ কী ভাবে অংশ নেন , এর উৎসটা কী? সিলেটেই বা এ জনপ্রিয় হলো কেন, এবং মূল যে নব বঁধুর নাচ তার ব্যাকরণ ছবি সহ ব্যাখ্যা করেছেন।  তাঁর অভিমত “...কাছাড় শ্রীহট্ট অঞ্চলে দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় এতো গান, এতো নাচ। বাংলা ভাষাভাষী অন্য কোনো অঞ্চলে বা সমাজে এতো ভিন্ন নাচ নেই...” বৌ নাচের সবচাইতে জনপ্রিয় গান ‘সুয়াগ চান্দ বদনি ধনি’ এর সিলেটি বয়ানে কথাভাগ পুরো তুলে দিয়েছেন। ভণিতা নেই। সুতরাং আগে যে পড়লাম, ‘গীতটি ভণিতাযুক্ত’ –এ ছাপার ভুল বলেই মনে হচ্ছে। ‘যুক্ত’ নয়, হবে মুক্ত। 

২৫  জানুয়ারি, ২০১৪ বেরুলো ২য়  ভাগ।

            ‘বরাক উপত্যকার লোক সংস্কৃতি বলয়ে ওঝানাচ’ লিখেছেন শিবতপন বসু সাঁওতালদের মধ্যে ভূত তাড়ানোর জন্যে  ,মুণ্ডা জনজাতিদের মধ্যে ডাইনি তাড়ানোর তাড়ানোর থেকে জন্মনিয়েছে  ‘ওঝা সম্প্রদায়’ বলে যে লেখার শুরু সেখানে সংস্কৃত উপাধ্যায়> উবজঝাঅ> ওঝা শব্দের উৎপত্তির ব্যাখ্যা কতটা সন্তোষজনক এই প্রশ্ন মনে দেখা দেয়ই। যদিও ভাষা বিজ্ঞানের যে কোনো বইতে শব্দটির ব্যুৎপত্তি এভাবেই লেখা আছে। তাই যদি হবে তবে নিশ্চয় প্রাক-আর্য সমাজে অন্য কোনো শব্দ দিয়ে ওঝাকে বোঝানো হয়ে থাকবে। সেটি কী? এমনিতেও ‘উপাধ্যায়’ ব্রাহ্মণের উপাধি। ‘ওঝা’ কথার বহু মানে। চিকিৎসক থেকে নৃত্যশিল্পী।  যাই হোক, সেখান থেকেই বৌদ্ধ-তান্ত্রিক  ঐতিহ্য হয়ে বরাক সিলেটের ‘ওঝা’ পরম্পরা এসেছে এটা লেখকেরও অভিমত। তবে মনসা পুজো আর ওঝা নাচ শুরু থেকেই পরস্পর সম্পৃক্ত ছিল না। দুই ভিন্ন উৎস থেকে এসে জুড়েছে। তিনি লিখছেন, “ ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ ও দেবী ভাগবতের মতো দুখানি অর্বাচীন পুরাণে যখন প্রথম মনসার স্থান হয় তখন থেকেই এই পুজোর সঙ্গে গীত বাদ্য যুক্ত হয়েছিল বলে মনে হয়।” এই নাচকে শুধু লোকনৃত্য আখ্যা দিয়েই , “...আমরা তৃপ্ত হতে চাই না। এ নৃত্য ভারতীয় শাস্ত্রসম্মত নৃত্যেরই সগোত্রীয়।” এই দাবিটি নিয়ে বিশেষজ্ঞদের তর্কে মাতা উচিত। অন্যথা, কথার কথা হয়ে থেকে যাবে।
              একই বিষয়কে সামান্য অন্যদিক থেকে দেখেছেন দীপেন্দু দাস তাঁর ----‘গুরমার গান’ বা ‘ওঝানাচ’ : লিঙ্গাতিযায়ী লোককলা---নিবন্ধে। প্রবন্ধটি পড়তে পড়তে মনে হচ্ছিল অন্য কথা। সাম্প্রতিক ভারতে ‘তৃতীয় লিঙ্গ’ যখন সামাজিক মর্যাদা এবং স্বীকৃতির দাবিতে সরব তখন অনেকে একে পশ্চিমা সাংস্কৃতিক আগ্রাসন বলছেন কেন?  ধর্মের মোড়কে ভারতে তো এ শুরু থেকেই ছিল। দীপেন্দু লিখছেন, বাইবেলের মতো বহু ধর্মগ্রন্থে সৃষ্টির শুরু থেকেই নারী পুরুষ আলাদা। কিন্তু “ হিন্দু দর্শন লিঙ্গ পার্থক্য নিয়ে সৃষ্টির এই মিথ-এ বিশ্বাস করে না। নারী পুরুষ একই দেহে সহাবস্থান পরিলক্ষিত হয় অর্ধনারীশ্বর কনসেপ্টের-এর মধ্যে”    ওঝা নৃত্যের শিল্পীকে লিঙ্গনিরপেক্ষ মানুষ হতে হয় কিনা এই কথা স্পষ্ট করেন নি, কিন্তু লিখেছেন এই শিল্পীকেতো একই সঙ্গে মনসা মঙ্গলের নারী পুরুষ চরিত্রগুলোর ভূমিকাতে অভিনয় করতে হয়, তাই নারী বা পুরুষ যেই হোন শিল্পী তাঁকে নিরপেক্ষ পোশাক অবশ্যই পরতে হয়। অনেকে অসমিয়া ‘ওজাপালি’র সঙ্গে সিলেট কাছাড়ের  ‘ওঝানাচ’কে এক করে দেখেন, তিনি স্পষ্ট করেছেন, বাংলার মতো অসমিয়া ‘ওজাপালি’ কেবল মনসা গানের সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়।
             প্রিয়ব্রত নাথের প্রবন্ধ ‘বরাক উপত্যকার তিনটি মেয়েলি ব্রত : একটি সমাজতাত্ত্বিক আলোচনা’। সাবিত্রী , কার্তিক এবং  সূর্য এই তিনটি ব্রত নিয়ে লিখেছেন। একটা কথাতো স্পষ্ট যে এগুলো প্রাক ব্রাহ্মণ্য পরম্পরা। সবগুলোই কৃষি কর্মের শুরু থেকেই  উর্বরতার আকাঙ্খা থেকে জন্ম নিয়েছে। কথাগুলো স্পষ্ট করলেই পারতেন যদিও লিখেছেন কার্তিক ব্রতে এখন, “পুরোহিত অংশ নিলেও তার ভূমিকা সীমিত” । চাষাবাদের শুরু থেকেই মাতৃতান্ত্রিক সমাজের অবক্ষয়েরও শুরু সুতরাং স্বাভাবিক ভাবেই  ব্রাহ্মণ্য এবং সামন্ত সমাজে এই ব্রতগুলো মেয়েরা করে থাকলেও এতে” সামাজিক , পারিবারিক , অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে মেয়েদের অবমূল্যায়নে চিত্রটি ধরা পড়ে সহজে।” সূর্যব্রতে কৃষ্ণগীতের জনপ্রিয়তার কথা লিখতে গিয়ে কারণ হিসেবে তিনি ব্যাখ্যা করেছেন “ ‘মার্কণ্ডেয় পুরাণ’, ‘পদ্মাপুরাণ’ এমন কি ‘ঋগ্বেদে’ও সূর্য কৃষ্ণের অভিন্ন রূপ দেখানো হয়েছে।” বাকিগুলো নিয়ে আমাদের কোনো কথা নেই, কিন্তু ঋগ্বেদে কৃষ্ণ কল্পনা খানিকটা আরোপিতই মনে হয়েছে আমাদের। তিনি প্রাসঙ্গিক শ্লোক উল্লেখ করে দিলে ভালো করতেন।
               ‘বরাক উপত্যকার লোকছড়ায় প্রতিফলিত সমাজচিত্র’ প্রভাসচন্দ্র নাথের প্রবন্ধ। ছড়া এমন এক পদ্যরূপ যেখানে পুরো বাঙালি সমাজ নিজের সমষ্টি প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছে, তার পরেও একে ‘শিষ্ট’ সাহিত্যের অন্তর্ভূক্ত করবার কথা রবীন্দ্রনাথের আগে কেউ ভেবেছেন বলে কোনো তথ্য নেই। সুকুমার সেন তাঁর পরে এসেছেন। এ এমনই এক ‘জাতের বার’ সাহিত্য শাখা যে ভারতীয় অলংকার শাস্ত্রের নবরসের একটিও এর মধ্যে অনুভব করা কঠিন।  রবীন্দ্রনাথ সঠিক ভাবেই লিখেছিলেন, “আমাদের অলংকারশাস্ত্রে নয় রসের উল্লেখ আছে, কিন্তু ছেলেভুলানো ছড়ার মধ্যে যে রসটি পাওয়া যায়, তাহা শাস্ত্রোক্ত কোনো রসের অন্তর্গত নহে।” তিনি ছেলেভোলানো ছড়ার সংগ্রহে মেতেছিলেন, কিন্তু সেগুলোতো শিশুরাই রচনা করে নি , করেছেন বড়রা। সুতরাং বহু ছড়াতে রবীন্দ্রনাথ নিজেই বাংলার  সামূহিক শোক সন্ধান পেয়েছিলেন।   ।   ব্যক্তিরচিত ছড়া এখন কোন পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে তা বোঝা যাবে সিলেটের কবি দিলোয়ারের এই উচ্চারণে, “‘ছড়া নয় পানি পড়া/ নয় কোন মাদুলী,/ সে তো নয় ভিখারীর/ আনা সিকি আধুলি।/ ছড়া বয় রক্তের কণাতে/ অপমানে ফুঁসে ওঠে ফণাতে।/ অনলস সংগ্রামী আশাতে/ এক জোট মানুষের ভাষাতে,/ ছড়া তাই ঘরে ঘরে বিপ্লব/ অগ্রণী জনতার উৎসব’।  কিন্তু ছড়া যখন ব্যক্তি রচনা করতেন না, মুখে মুখে সে ঔপভাষিক এলাকা অতিক্রম করে অথবা না করে ভাষা বয়ানও পালটে ফেলত তখনো শুধু শিশুদের কথা ভেবেই এগুলো রচিত হতো না। ঘুমপাড়ানি ছাড়াও তার ছিল কিম্বা আছে নানা উপলক্ষ। সেগুলোই বুঝবার চেষ্টা করেছেন প্রভাস চন্দ্র।  তিনিও শুরু করেছেন , শিশুতোষ ছড়া দিয়েই। কিন্তু শুরুতেই যে ছড়াটি তুলে দিলেন, ‘ ডুপিরে ডুপি আইলে আইলে যাইচ’—সেখানে জয়ন্তিয়া রাজার ইতিবৃত্তেরও সন্ধান দিলেন এই ভাবে, “ ...তেলেনীএ দিব তেল, মালিনীএ দিব ফুল/ জইন্তা রাজার বিয়া অইত (অ) পিপরায় মারে ঢুল।”   পণ প্রথা ধরা দিয়েছে অধ্যাপক অমলেন্দু ভট্টাচার্যের সংগৃহীত একটি  ছড়া এরকম, “ খাইলাম দাইলাম বেওয়াই তত্ত্ব কথা কও/ আর কালিআনা পুড়ি তোমার তিশ টাকা লও।” লেখক এখানে পণ প্রথার সন্ধান পেয়েছেন সঠিক ভাবেই, কিন্তু এ যে  সিলেট কাছাড়ের সমাজে কন্যাপণ প্রচলিত থাকবার সন্দেশও দিচ্ছে, সে কেন লেখকের দৃষ্টি এড়িয়ে গেল, এই আমাদের জিজ্ঞাসা। ‘কবাডি’ বা ‘হাডুডু’ খেলার ছড়া কিন্তু কিশোরেরাই রচনা করে থাকে। সেখানেও ধরা আছে সিপাহী বিদ্রোহ, “ চলবড্ডি হারা সিপিয়াকে মারা/ সিপাইকে লেটো বেটো বাঙ্গালকে ধরা”  লেখক ‘বাঙ্গাল’ শব্দে ‘বাঙালি’ জাতিই বুঝেছেন। আমাদের ইতিহাস ধারণা বলে এটা নাও হতে পারে।  সেই ভুসুকুর কাল পূব বাংলার লোককেই ‘বাঙ্গাল’ বলা হয়ে থাকে, এখনও এই পরম্পরা অটুট আছে। সেসব সিদ্ধান্ত নেবার দায় অবশ্যি ঐতিহাসিকদের। তিনি নিজেও সেরকম কিছু ইতিহাসের তথ্য যুগিয়েছেন অধ্যাপক অমলেন্দু ভট্টাচার্যের লেখা ‘বরাক উপত্যকার বাংলা সাহিত্য চর্চার ধারাবাহিক ইতিহাস’ বই থেকে।  সে দায় থেকে লেখককে ছাড় দিলে তার নিবন্ধটি কাছাড় সিলেটের বিচিত্র ছড়ার অনবদ্য সংকলন বলেই মনে হবে পাঠকের। ইতিহাসের প্রচুর জিজ্ঞাসারও জন্ম দেয় এই ছড়া এবং তাতে প্রতিফলিত সমাজচিত্র।       
               সর্বজিৎ দাস তাঁর নিবন্ধ ‘বরাক উপত্যকার প্রবাদে সমাজ মনস্কতা’তে সুনির্দিষ্ট একটা দৃষ্টি কোন বেছে নিয়েছেন। প্রবাদগুলো নির্বিচার তুলে নিয়ে নির্ভেজাল নিরপেক্ষ ‘প্রবাদ’ সন্ধান করে বেড়ান নি। যেমন বর্ণভেদ সিলেট কাছাড়ের সমাজে বর্ণভেদ চিত্রিত এই প্রবাদে,  ‘ অগ্নির ব্রাহ্মণ জাতি/ মুখ তাকি উৎপত্তি/ সাউ আইলা উরাত তাকি/ শুদ্র আইলা চরণ তাকি’ ঋগ্বেদের এই শ্লোকের এটি সিলেটি রূপান্তর “ব্রাহ্মণোহস্য মুখমাসীদ্বাহূ রাজন্যঃ কৃতঃ।/উরু তদস্য যদ্বৈস্যঃ পদ্ভ্যাং শূদ্রো অজায়ত।।”  সাউ বা সাহাদের বৈশ্য বর্ণে ধরে নিচ্ছে এই প্রবাদ। আশ্চর্যরকম ভাবে এই প্রবাদে ‘রাজন্য’ বা ‘ক্ষত্রিয়’ নেই! ঘটনা হলো বাঙালি সমাজে রাজা থাকলেও ‘ক্ষত্রিয়’ বর্ণটি বাস্তবেই ছিল না কোনোদিন। সেই সব ইতিহাসের বিষয় নিয়ে কথা বলেন নি সর্বজিৎ, হয়তো পরিসর অনুমোদন করত না বলে।  এই বর্ণবাদ নিয়ে রসিকতা কিম্বা ক্রোধের প্রকাশও কেমন ঘটেছে প্রবাদে তিনি তার নজির দিয়েছেন, “ মুরর উপরে ব্রহ্মলুক/ নিচে আমরা সাউলুক/ মাইজে যত উল্লুক আর ভল্লুক” কিম্বা “জাতর ঘর মার লাথি/ ভাতর ঘর ধর ছাতি” । এর সঙ্গেইতো সম্পৃক্ত  পুরুষতন্ত্র। তাকে  বৈধতা দিচ্ছে এমন প্রবাদ “ পুড়ির বিয়া ভাত দেখি/ পুয়ার বিয়া জাত দেখি”। সেরকম বকধার্মিকদের চারিত্রিক অসংগতি , শ্রেণিবৈষম্য তথা বিরোধকে উন্মোচিত করে এমন বেশ কিছু প্রবাদের সঙ্গে পরিচিত  করলেন, সর্বজিৎ। তাঁর অনুসন্ধান বেশ সুচিন্তিত এবং আন্তরিক বলেই মনে হলো। শুরুতেই তিনি অধ্যাপক আবিদ রাজা মজুমদারের ‘বরাক উপত্যকার প্রবাদ প্রবচন’ থেকে প্রবাদের একটি সুন্দর এবং সুচিন্তিত  সংজ্ঞা তুলে দিয়েছেন, “ মানুষের প্রাত্যহিক বিচিত্র অভিজ্ঞতা ও উপলব্ধির মর্ম নির্যাস সঞ্চিত হয় যেসব সুসংগঠিত সরল অথচ বৈদগ্ধ ভরা ঐতিহ্যবাহী উক্তিগুলির মধ্যে, তারাই হলো প্রবাদ।”
              আশিস রঞ্জন নাথের প্রবন্ধ ‘বরাক উপত্যকার লোকজীবনের লুপ্ত প্রায় কিছু লোক-উপাদান’ একটি দীর্ঘ এবং সুচিন্তিত রচনা। পাঠককে শুধু জ্ঞান তাত্ত্বিক ভাবেই সমৃদ্ধ করবে না, স্মৃতিকাতরও করে তুলবে তাঁর রচনার গুণে। ‘পিঁড়ি’ বা ‘খাট’, ‘ঢেঁকি’,  ‘উদূখল’ বা ‘গাইল-ছিয়া এবং ‘নকশি কাঁথা’ই তাঁর আলোচ্য ‘লোক-উপাদান’ যেগুলোর ব্যবহার দ্রুত বিলীন হচ্ছে আমাদের সমাজ থেকে। সেগুলোর পৌরাণিক, সামাজিক উৎস সন্ধান করেছেন। সামাজিক আচারে, ব্যবহারে, রীতি নীতি , অনুষ্ঠানে তো বটেই  অবশ্যই গীতে , ছড়ায়,  প্রবাদে, প্রবচনে এবং অতি অবশ্যই  ভাষাতে শব্দগুলোর ব্যবহারের মানে এবং বৈচিত্র্য  অনুসন্ধান করবার চেষ্টা করেছেন।  এগুলো যে শুধু ব্যবহারের জন্যে নির্মিতই হতো না, আমাদের সামাজিক সৃজনশীলতারও প্রেরণারও আধার ছিল তার বহু নজির দিতে গিয়ে তিনি জসিমউদ্দীনের সুবিখ্যাত ‘নকশী কাঁথার মাঠ’ অব্দি পৌঁছেছেন।  পশ্চিম বাংলা সরকারের উদ্যোগের ফলে  অন্তত নকশি কাঁথাকে মেধাসত্বের তালিকাতে আনতে পেরেছে ভারত সরকার । এই সংবাদ দিয়েও লেখক নিজের বেদনা জানিয়ে সঠিক ভাবেই লিখেছেন, “ …আমাদের আধুনিকতা মনস্ক মানসিকতার অবহেলাতে যদি তার অস্তিত্ব সঙ্কটাপন্ন হয়ে পড়ে তবে এ দায়তো আমাদেরই।” প্রসঙ্গক্রমে লিখেই ফেলি সংখ্যাটির প্রচ্ছদ পরিকল্পনা করেছেন পুণ্যপ্রিয় চৌধুরী সেরকমই এক নকশি কাঁথা দিয়ে।
             সেরকমই আরেক বেদনা গাথা পড়িয়েছেন অনামিকা চক্রবর্তী তাঁর ‘বিবাহের লোকাচার ও লোকগান : শিল্পীর নকশি কাঁথায় নিপুণ গাথা’ প্রবন্ধে। সিলেট কাছাড়ের হিন্দু বিবাহ আচার  এবং সম্পর্কিত গানের একটা বিস্তৃত পরিচয় তুলে ধরেছেন যার অনেকগুলোই এখন ‘বিবাহভবনে’র যুগে লুপ্ত হতে চলেছে। তাঁর প্রবন্ধের একটি দৃষ্টি আকর্ষণী দিক হচ্ছে তিনি ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার অসমীয়া বিয়ের আচার এবং গানের সঙ্গে সিলেটি আচার এবং গানের সাদৃশ্যের দিকগুলোর সঙ্গেও পাঠকের পরিচয় ঘটিয়ে দিয়েছেন।  এই নিয়ে বহু আগে হেমাঙ্গ বিশ্বাসও প্রায় একই কথা লিখেছিলেন তাঁর ‘লোক সঙ্গীত সমীক্ষা’তে , “ বাংলার প্রায় প্রত্যেক জেলাতেই বিয়ে উপলক্ষে গান আছে। কিন্তু শ্রীহট্টের মেয়ে দেখা, মঙ্গলাচরণ, পানখিলি, পানি তোলা, অধিবাস, সোহাগ মাগা, দধিমঙ্গল, বিবাহ, কন্যাযাত্রা প্রতিটির জন্যে আলাদা আলাদা এমন গানের লহরি বাংলাদেশের আর কোথাও আছে বলে জানিনে। গায়ে লেগে থাকা প্রদেশ ‘অসমের বিয়ানামে’ই শুধু এমন ঐশ্বর্যশালী বৈচিত্রের সন্ধান পাই। শ্রীহট্ট জেলাতে বিয়েতে ধামাইল অপরিহার্য হলেও শুধু বিবাহ অনুষ্ঠান অনুসারে যে বিশেষ গীতের ধারা তাতে সুরের দিক থেকে কোনো কোনো গানে সম্পূর্ণ নতুন ধারার সন্ধান মেলে। আর সে হচ্ছে অসমিয়া বিয়ানামের সুস্পষ্ট ছাপ।” (অসমিয়ার থেকে অনুবাদ লেখকের)  অনামিকা আরো নতুন কিছু দিকে আলো ফেলেছেন। পানখিলিতে নারদকে ডেকে এনে দেবতাদেরা আশীর্বাদ চেয়ে স্বর্গে পান পাঠাবার প্রথা ভাটি অসমেও প্রচলিত থাকার কথা জানিয়েছেন। তেমনি  অসমিয়াদের মধ্যে যা ‘জোরন’ অনুষ্ঠান সিলেটিদের মধ্যে সেটিই ‘জুড়নী’। গানও প্রায় দুই সমাজে একই রকম।
             এরই পরিপূরক প্রবন্ধটি লিখেছেন মহবুবুল বারি। ‘বরাক উপত্যকার বাঙালি মুসলমান সমাজে প্রচলিত বিয়ের গান।’ আচারের ঘনঘটা হিন্দুদের তুলনাতে কম। কিন্তু স্নানাদি রয়েছে। গায়ে হলুদের বদলে আছে মেহেদি পরানোর অনুষ্ঠান এবং আনুষঙ্গিক গান। মহবুবুল বারি অনুষ্ঠানগুলো ক্রম মেনে লিখে গেছেন এবং সেই সঙ্গে প্রাসঙ্গিক গানের উল্লেখ এমন ভাবে করে গেছেন যে পূর্বরাগ দিয়ে শুরু হয়ে  পরিজনের সঙ্গে বিচ্ছেদের গানে শেষ হয়েছে । গানের কথাগুলোর মধ্যে সাদৃশ্য যেমন নজরে পড়ে, তেমনি ভাষাবৈচিত্রও। এই যেমন হাতে পায়ে মেহেদি পরাতে গিয়ে মেয়েরা যে  শুরুর গানটি করেন এমনতর : উজান গাংগে মন্দিয়ে খুশবয় খুশবয় করে/ ভাটিয়ল গাংগেতে আইজ সাউদে হিনান করে। / কইবায় মন্দি কইবায়রে আমার /অউজেন মাইজীর খবরও নারে... । বিয়ের পুরো অনুষ্ঠান শেষে যখন মেয়ে বিদেয় নেয়, পরিজন মহিলারা তখন গেয়ে উঠেনঃ পালের টানে নৌকা যায়/ ঘুরলো নৌকা বাঁকের মাথায়।/ ছইয়ার ভিতর বিয়া কন্যায়/ কান্দিয়া কুল ভাসায় রে... 

     
১লা ফেব্রুয়ারি, ১৪ বেরুলো ৩য় ভাগ
    শুরুর দিকগুলোর প্রবন্ধ কয়েকটি পড়ে যদি আমরা জানলামই যে বাঙালি কোনো অবিমিশ্র জনগোষ্ঠী নয়, তার লোকসংস্কৃতির উৎসও নয় কোনো একক নৃগোষ্ঠী সুতরাং এখকার প্রতিবেশী সমাজই বা বাদ যায় কেন? এই কথা সম্পাদকেরা মনে রেখেছেন দেখে ভালো লাগল। ‘মণিপুরি লোক সংস্কৃতি’ লিখেছেন মণিধন সিংহ এবং  সুদীপ্তা খেরসা লিখেছেন, ‘ডিমাছাদের পূজা-পার্বণ: ঐতিহ্যের মূল্যায়ন’
মণিধন সিংহের প্রবন্ধে যেসব গান, ছড়া প্রবাদ প্রবচনের নজির দিয়েছেন সেগুলোর বাংলার অনুবাদও লেখকই যুগিয়েছেন। ফলে বাংলা ভাষা জানা পাঠকের বুঝতে সমস্যা হয় না।  একটা সামগ্রিক কিন্তু সংক্ষিপ্ত পরিচয় তিনি তুলে ধরেছেন মণিপুরি লোকসংস্কৃতির। তাঁর থেকেই জানা গেল মণিপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকসংস্কৃতির বিভাগের উদ্যোগে এই নিয়ে গবেষণা উৎসাহের সঞ্চার করেছে। অসম ত্রিপুরার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভূমিকা এই ক্ষেত্রে কী জানলে ভালো হতো। মণিপুরি লোকসঙ্গীতকে বলে ‘খুনং ঈশৈ’। গাইবার বিচিত্র প্রণালীর নাম এরকম, জাত, লমইন, শিকপলোন, শুইকপলোন, নহৈরোল, হিরিপাবোৎ, হিরিথাংগৈ ইত্যাদি। ছেলেভোলানো ছড়াকে বলে ‘নাউথেম ঈশৈ’।  পালাগান বা লোকগীতিকাকে মণিপুরিতে বলে ‘ঈশৈয়ারী’। বেশ কিছু লোকমহাকাব্যও রয়েছে মণিপুরিতে। সম্ভবত এগুলো বাংলা সুফী প্রণয়কাব্যগুলোর মতো। মঙ্গলকাব্য বা ধর্মসংশ্লিষ্ট হলে লেখক উল্লেখ করতেন। সেরকম কিছু কাব্যের নামোল্লেখ করেছেন তিনি, ‘ফৌওইবী অকোংজাম্বা’, ‘তনুলাইজীংনেম্বী’, ‘খম্বা-থোইবী’। এর মধ্যে শেষেরটি আশ্রয় করে হিজম অঙাংহল আধুনিক কালে  একটি সাহিত্য কর্ম করেছেন। কাব্য না কথা সাহিত্য স্পষ্ট করেন নি লেখক।  রূপকথা –উপকথাতেও সমৃদ্ধ মণিপুরি ঐতিহ্য। একত্রে এগুলোকে ‘লোককাহিনি’ বলেছেন লেখক। লোকগীতিকা, লোকমহাকাব্যকে এই ‘লোকসাহিত্যে’এর থেকে আলাদা করে দেখানো কেন, আমাদের কাছে স্পষ্ট হলো না। লোকসাহিত্যের তিনটি ভাগের কথা বলেছেন, পুরা কাহিনি বা Myths মণিপুরিতে বলে ’লাইতীনগী ৱারী’ , কিম্বদন্তী –মণিপুরিতে বলে ‘থাজৱারী’ এবং রূপকথা –মণিপুরিতে ‘ফুংগাৱাৰী’ বোঝা গেল এই  ‘ৱারী’ শব্দটির একটি আলাদা অর্থ আছে, সম্ভবত ‘কথা বা কাহিনি’। 
            প্রবাদ প্রবচনকে মণিপুরিতে বলে ‘পাউরৌ’ আর ধাঁধাকে বলে ‘পাউখোং’। এগুলো ছাড়াও প্রবন্ধটিতে লেখক বিভিন্ন আচারে অনুষ্ঠানে , খেলাধুলাতে কিছু পরিবেশ্য কলার সম্পর্কেও আভাস দিয়েছেন। বিশেষ করে ‘লাইহারাওবা’ উৎসবের সঙ্গে প্রতিবেশি অমণিপুরিরাও সবিশেষ পরিচিত। সম্ভবত মণিপুরি শাস্ত্রীয় নৃত্যেরও উৎস এই উৎসবই, যদিও লেখক সেরকম কিছু লেখেন নি। উৎসবটির সঙ্গে পরিচয়টিকে গাঢ় করবার একটা সুযোগ করে দিলেন মাত্র। 
              সুদীপ্তা খেরসা তাঁর প্রবন্ধে ডিমাছা সমাজে প্রচলিত অব্রাহ্মণ্য পুজো পার্বণের নৃতাত্ত্বিক উৎস নিয়ে ভেবেছেন এবং হিন্দুব্রাহ্মণ্য পুজো দেব-দেবীতে প্রাক-পৌরাণিক এমন কি প্রাগার্য পরম্পরার চিহ্নের বিপরীতে ডিমাছা ধর্মীয় সংস্কারে ব্রাহ্মণ্য প্রভাবের চিহ্নগুলোর কথা লিখেছেন। তুষার কান্তি নাথের উদ্ধৃতি দিয়ে তিনিও অনুমান করেছেন ইন্দোমোঙ্গলীয় হরপ্পার সংস্কৃতিরও অংশীদার থেকে থাকবেন। এমন অনুমান আমরা অন্যত্র দেখেছি বলে মনে পড়ে না। তবে গঙ্গারিডি রাষ্ট্র এবং সভ্যতার অংশীদার ইন্দোমোঙ্গলীয়রা ছিলেন বললে মানা যায়। সেখানে আবিষ্কৃত একটি ট্যাবলেটে একজোড়া মানব-মানবীর মুখে পাখির ঠোঁট সেদিকে ইঙ্গিত করে বলে লেখিকার দাবি। আর ডিমাছা কিংবদন্তি অনুযায়ী এই নৃগোষ্ঠীর জন্ম পাখির থেকে।  কিন্তু ডিমাছারাই ছিলেন--- লিখলে কিছু বিভ্রান্তি বাড়ে বলে মনে হয়, মনে প্রশ্ন দেখা দেয় বডো বা ত্রিপুরিই বা নয় কেন? এমন বেশকিছু নৃগোষ্ঠীতো একই বডো বৃহৎ পরিবার থেকে এসেছেন বলে আমরা জানি। সেই প্রসঙ্গ স্পষ্ট করে এলে বুঝতে সুবিধে হতো। বা ধরুন, এই বাক্যটি আমাদের বেশ কৌতূহল বাড়িয়েছে, “ পুরাণ কাহিনি মতে সৃষ্টির পুণ্যলগ্নে ‘ডিলাওব্রা-সাঙ্গীব্রাতে’ পিতা বাংলারাজার (ভূমিকম্পের দেবতা) ওরসে মাতা আরিখিডিমা (বিরাটকায় এক পাখি/Golden eagle) সাতটি ডিম প্রসব করেন। সেই ডিম থেকেই ডিমাছাদের পূর্বপুরুষের জন্ম হয়।” পড়লে মনে হবে যেন ‘বাংলারাজা’ই আদি দেবতার নাম। আর ডিমের ছাওয়াল বলেই নৃগোষ্ঠীর নাম ‘ডিমাছা’। আমরাতো জানি, লেখিকাও নিশ্চিত জানেন, ঘটনা এরকম নয়। ডিমাছা শব্দের ‘ডি’ মানে জল। তো কথাগুলো স্পষ্ট হলে ভালো ছিল। বিশেষ করে এই ‘বাংলারাজা’ কথাটির মানে কী?  লৌকিক না জনপ্রিয় বিশ্বাস যেমনই হোক, গবেষকের বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতো তার থেকে আলাদা হবে। তিনি নিশ্চিত ব্যাখ্যা করবেন, যে ডিমাছা দেবতা আর হিন্দু পৌরাণিক ‘শিব’ এক নন। যারা মনে করেন এক, তারা এমনও বিশ্বাস করেন যে শিব থেকেই এসেছে শিব্রাই, আদিতে সবাই আর্য ছিলেন। বর্তমান লেখিকাও যখন লেখেন ‘দেবাদিদেব শিব্রাই’ তখন আমাদের মনে প্রশ্ন জাগে ঐ আখিরিডিমার সন্তানের পিতা তবে কে? এমনিতেও পৌরাণিক বিশ্বাসমতেই শিব দেবাদিদেব। বৈদিক বিশ্বাস মতেও নন।  শিলচরেই এমন গবেষক-অধ্যাপককেও আমরা দেখেছিলাম, যিনি রীতিমত অনৈতিহাসিক দাবি করেছিলেন, বাঙালিদেরই একটি অংশ ক্রমে ডিমাছা হয়েছিলেন। বাস্তবে উল্টোটাই হওয়া সম্ভব এবং হয়েছে।  লৌকিক সংস্কৃতির সত্য সন্ধান করতে হলে এমন ‘ব্রাহ্মণ্য-লৌকিক’ বিশ্বাসের থেকে পাঠককেও বের করে আনবার প্রয়াস আমাদের জরুরি।
                 এই কাজটি তুষার কান্তি নাথ করেছেন, তাঁর “বরাক উপত্যকার দুর্গাপুজায় ‘নৌকাটানা’ অনুষ্ঠান” প্রবন্ধে। এই সংখ্যার শেষ প্রবন্ধে। শুরুতেই জানিয়েছেন, “মার্কণ্ডেয় পুরাণে চণ্ডিকা দেবীর বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে। সেখানে চন্ডী ও দুর্গাকে এক করে দেখা হলেও এই দেবী যে মূলত প্রাক-আর্যভাষী দ্রাবিড়, কিরাত-মোঙ্গলীয় এবং মাতৃতান্ত্রিক চরিত্রের অস্ট্রিকভাষীদের আরাধ্যা দেবী তা একালে সমাজবিজ্ঞানী ও সাংস্কৃতিক নৃতত্ত্বের পণ্ডিত মহলে স্বীকৃত। ‘চণ্ডী’ শব্দটিই অন-আর্য ভাষা সঞ্জাত। ...তাঁর উৎস পুরাণে নয়, লৌকিক সংস্কৃতিতে।” অরণ্যদেবীর থেকে শস্যদায়িনী হয়ে বাণিজ্য নৌকার রক্ষয়িত্রী দেবীতে রূপান্তরের এবং একই সঙ্গে শাকম্ভরী, দুর্গা , লক্ষ্মীর সঙ্গে চণ্ডী এক হয়ে যাবার প্রক্রিয়া বুঝবার চেষ্টা করেছেন তিনি। সেই সঙ্গে এই ইতিহাসের সূত্র সন্ধানও দিয়েছেন, যে এককালে বাকি বাংলার সঙ্গে বরাক উপত্যকাও নৌবাণিজ্যে বেশ সমৃদ্ধ প্রদেশ ছিল।
            এর পরের তিনখানা প্রবন্ধ কেন ‘পরিশিষ্ট’ বলে যুক্ত হলো সেই কথাটিই বুঝে উঠলাম না। প্রতিটি প্রবন্ধইতো গুরুত্বপূর্ণ। এগুলো ছাড়া এই সংখ্যা অসম্পূর্ণ থেকে যেতো। তাঁর মধ্যে প্রথমটি  অমলেন্দু ভট্টাচার্যের লেখা ‘লোকসংস্কৃতির চর্চার ধারায় রাজমোহন নাথ’ । আমাদের ইতিহাস এবং লোকসংস্কৃতির আদি গবেষকদের অন্যতম শ্রেষ্ঠজন, রাজমোহনের জীবন এবং কাজের এক সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিয়েছেন। সঞ্জীব দেবলস্করও সেরকমই লিখেছেন সুজিৎ চৌধুরীকে নিয়ে। প্রবন্ধের নাম ‘লোকসংস্কৃতি এবং ইতিহাস : প্রসঙ্গ সুজিৎ চৌধুরী’ এই  প্রবন্ধে সুজিৎ চৌধুরীর একটি মন্তব্য উদ্ধার করেছেন তিনি। লোকসংস্কৃতির অধ্যয়ন এবং গবেষণার প্রধান প্রয়োজনটি এখানে স্পষ্ট হয়ে যায়, “ কোসাম্বী বলেছেন যে ইতিহাসের অন্য ধরণের প্রমাণ যেখানে অনুপস্থিত, সেক্ষেত্রে ধর্মাচার ও লৌকিক তীর্থস্থানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন জনশ্রুতি দিয়ে বিদ্যমান এবং আমাদের ধারণা এগুলোর যথাযথ বিশ্লেষণের মাধ্যমে এই অঞ্চলের ইতিহাসের একেবারে অন্ধকারাচ্ছন্ন যুগটির উপর কিয়ৎ পরিমাণে আলোকপাত করা সম্ভব।” সাহিত্য সমালোচক সুজিৎ চৌধুরীর প্রসঙ্গ আলোচনা করতে গিয়েও লেখক দেখিয়েছেন, সেখানেও উপস্থিত লোকসাংস্কৃতিক উপাদান তাঁর নজর এড়িয়ে যায় নি। তৃতীয়টি ‘লোকসংস্কৃতি বিদ্যা ও পাণ্ডুলিপিবিদ্যা---বিনিময়’। লিখেছেন অর্জুনদেব সেনশর্মা।  লোকসংস্কৃতিকে মাঠে ফেলে শুকিয়ে মেরে ফেলবার যে সমস্ত নাগরিক আয়োজনের কথা শুরুতে লিখলাম সেগুলো আমাকে তা ভাবিয়েছে বহুদিন। ‘লোকসাহিত্য’, ‘লোকসংস্কৃতি’ শব্দগুলোও এই আয়োজনের অংশ কিনা এই প্রশ্নও ভাবিয়েছে। হেমাঙ্গ সম্মানের সঙ্গে শব্দগুলো ব্যবহার করেছেন, তার পরেও। আমাদের অবচেতনে ‘প্রত্যাখ্যানে’র সূত্রগুলো নানা ভাবে বাসা বেঁধে থাকে কি না।  অর্জুন সেন শর্মা  দেখলাম তাঁর নিবন্ধে  সেই প্রশ্ন তুলেছেন। উত্তর তিনিও স্পষ্ট করতে পারেন নি, আমারও এখনো পাওয়া হয় নি। তবু ভয়ে ভয়ে এদ্দূর লিখে ফেললাম পাঠপ্রতিক্রিয়া।   তবে যেটি আমাদের অবাক করল, তা এই যে সিলেট কাছাড় তথা অসমের এক অনন্য ব্যক্তিত্ব হেমাঙ্গ বিশ্বাসের জন্মশতবর্ষেই প্রকাশিত হয়েছে এই কাগজটি।হেমাঙ্গের সামান্য উপস্থিতি পর্যন্ত নেই! অথচ, লোকসঙ্গীতের ‘বাহিরানা’ তত্ত্বের জন্যে তাঁর ‘অসম বঙ্গ লোক সমীক্ষা’ একটি দিক দর্শক গ্রন্থ। তাঁর আলোতেই পথ দেখে দেখে আমাদেরও এই লেখাতে সাহসে ভর করে এগুনো।
            কিন্তু একটি প্রবন্ধের সম্পর্কে কথা বলব বলে আমরা শেষ অব্দি অপেক্ষা করেছিলাম। সেটি সঞ্জীব দেবলস্করের ‘ভূমি চারণা (Landlore) : বরাক উপত্যকার মাটির ইতিবৃত্ত’  । প্রবন্ধটি এই সংখ্যাতে একেবারে ‘জাতের বার’। একটি কাব্যিক গদ্য। এর রসটুকু বাদ দিয়ে সার বোঝানো কঠিন। আর রসের রচনা না পড়িয়ে মরমে পশানো কঠিন।   যে ‘বনসাই’ বা পরগাছা মনের কথা লিখে আসছিলাম, সেই মনের কাছে যেন ‘মাটি'র বার্তা পৌঁছে দেবার সাধনা। সেই কবেকার সাগর তলার  মাটি উঠে এসে আজকের ‘বরাক উপত্যকার’ চেহারা নিয়েছে তার ইতিহাসটাতো আর সাড়ে পাঁচ পৃষ্ঠাতে লেখা সম্ভব ছিল না, তিনি তাই আশ্রয় নিয়েছেন ব্যঞ্জনাময় কাব্যভাষার।  প্রবন্ধটি শুরু হয়েছে এই ভাবে, “মাটির প্রতি ভালোবাসা নিছক জড় পদার্থের প্রতি ভালোবাসা নয়,  এ ভালোবাসার শিকড় অনেক গভীরে। এ ভালোবাসাকে ঘিরে আছে মানুষের ঐতিহ্য, পরম্পরা এবং সংস্কৃতি। মাটি কেবল নিষ্প্রাণ ভূত্বকের একটি স্তরমাত্র নয়, মাটি আমাদের সত্তারই একটি অংশ মাত্র।”। সেই মাটির মানুষ সুজিৎ চৌধুরি ‘...পাথর পড়তে পারতেন’, লিখেছিলেন  এক প্রবন্ধে কবি অমিতাভ দেবচৌধুরী। সঞ্জীব সেই পাথর –মাটিকেই পড়বার চেষ্টা করেছেন। আর তার নাম দিয়েছেন, Landlore ! শব্দটিই আনকোরা নতুন। তাঁর সৃষ্টি। তিনি লিখেছেন, ‘মাটির অভিমান, মাটির অভিমান, মাটির প্রতিশোধ স্পৃহার’ কথা। “আমরা যে মাটির মর্মকথা বুঝতে চাইনি।” লেখাটি শেষ হয়েছে, শক্তিপদের একটি কবিতা দিয়ে, “মাটির রঙের বাহানা থাকলেও মাটি/ বেণী আসহকলা জানে না।/ মাটির রঙের সংখ্যা তাই সাত নয়—সাতশো সাত/ হাজার সাত নক্ষত্র/ হতে পারে...।” অতশতো  রঙ দেখতে আমাদের যাত্রা এখনো বহু পথ করতে বাকি...   বরাক উপত্যকা বঙ্গ সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্মেলন এই সংখ্যা দিয়ে মাটির মর্মকথা বুঝবার   এক সমবেত আন্তরিক প্রয়াসের জন্যে, পা চালিয়ে হাঁটবার জন্যে এক বড় সড় তাড়া দিলেন মাত্র  ।