আমার চেতনার রঙে রাঙানো এই খেলা ঘরে:

~0~0~! আপনাকে স্বাগতম !~0~0~

*******************************************************************************************************

Tuesday 26 September 2017

হরেন্দ্রনাথ বরঠাকুর এবং তাঁর শিশু নাটক

।। সুশান্ত কর।।

(গত ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৭তে তিনসুকিয়ার 'উজান সাহিতো গোষ্ঠী' এক সভাতে হরেন্দ্রনাথ বরঠাকুরকে সংবর্ধনা জানায়। সেখানে এই শিশু সাহিত্যিক তথা নাট্যকারের জীবন এবং কর্মের পরিচয় দিতে গিয়ে এই বক্তৃতাটি তৈরি হয়ে যায়। মূল অনুষ্ঠানে এর একটি সংক্ষিপ্ত বয়ানই পরিবেশিত হয়েছিল। এখানে রয়েছে সম্পূর্ণ এবং বিস্তৃত )



“আমার নাটকগুলো সত্যি নাটক হয়েছে কি হয় নি, সে নিয়ে আমার নিজেরই সন্দেহ আছে। প্রত্যেকটি নাটকই তাগাদাতে লেখা। অভাব আর চাহিদা পুরাতে লেখা। লেখে উঠে, বা মঞ্চায়ন দেখে আমি সবসময় ভীষণ একটা অসন্তুষ্টিতে ভুগী। জানি না কিসের তাড়নাতে নাট্যপীঠ বা প্রশান্ত শর্মা আমার নাটকগুলো এতো যত্ন করে রেখেছেন---যে কাজগুলো কিনা আমি নিজেও করবার দরকার মনে করি নি। কেনই বা তিনি এই সংকলন এতো কষ্টে আর শ্রমে প্রকাশ করতে গেলেন, সে আমার কাছে একটি উত্তর বিহীন প্রশ্ন হয়েই আছে। আমার ভয় হচ্ছে, এই সমস্ত শ্রম এবং আন্তরিকতা সুধী সমাজের বিচারে শেষঅব্দি একমুঠো নষ্ট ফসলে না পরিণত হয়। সেরকম হলেও আমার দিক থেকে খেদ করবার কিছু থাকবে না। সে আমার অজ্ঞতা, বৌদ্ধিক সীমাবদ্ধতা এবং অপরিপক্বতা বলে দ্বিধাহীনভাবে মেনে নেব।” কথাগুলো আমরা অনুবাদ করে নিয়েছি। লিখেছিলেন   হরেন্দ্রনাথ বরঠাকুর তিন বছর আগে তাঁর ‘শিশুনাট সমগ্রে’।  তিনি আরো লিখেছিলেন, “নাট্যকার হবার ধৃষ্টতা আমার কোনোদিনই ছিল না, এখনো নেই। ছাত্রবেলা এবং যৌবনবেলাতে লেখা বহু নাটক আমি নিজেই নষ্ট করে ফেলেছি...” ---এই সব উচ্চারণ যার তিনি এবারে ২০১৭তে অসমীয়া শিশু সাহিত্যে, তথা নাটকে জীবনজোড়া অবদানের জন্যে সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছেন। আর কথা গুলো লিখেছিলেন তিনবছর আগে প্রকাশিত তাঁর নাট্য সমগ্রে। শিবসাগরের ‘নাট্যপীঠে’র হয়ে বইটি সম্পাদনা করেছিলেন নাট্যপরিচালক, প্রশিক্ষক, অভিনেতা প্রশান্ত শর্মা।  আপনাদের মনে হতে পারে আকাদেমি পুরস্কার বুঝিবা নিজের সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে তাঁর ধারণাকে প্রথমবারের জন্যে ভ্রান্ত প্রমাণ করে দিল। এমন ভ্রান্তি আমাদের অনেকরই হয়ে থাকে। বুঝিবা স্বীকৃতি একটি প্রতিষ্ঠান দিলেই দেয়া হলো। আসলে ততদিনে তাঁর নাটক সারা অসমেই বহুবার অভিনীত হয়ে গেছেই। অধিকাংশেরই উদ্যোক্তা এই নাট্যপীঠ এবং পরিচালক প্রশান্ত শর্মা। কিছু নাটক করেছিল উত্তরলখিমপুরের ‘নাবিক’ নাট্যগোষ্ঠী। তাদের দরকারে তাঁরা নাটক চেয়ে গেছেন, আর হরেন্দ্রনাথ বরঠাকুর লিখে গেছেন। ১৯৯৬র ১লা জানুয়ারিতে আরেক প্রখ্যাত নাট্যকার সফদর হাসমির মৃত্যুদিনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল নাট্যপীঠ। সেই থেকে তাঁদের অধিকাংশ নাটকই লিখেছেন হরেন্দ্রনাথ বরঠাকুর। কেবল ‘রজার দেউল’ এই একটি নাটকই বিশের বেশিবার অভিনীত হয়েছে। বাকিগুলো মিলিয়ে কবার অভিনীত হয়েছিল আমরা একটা অনুমান করে নিতে পারি। দর্শক সমালোচকেরা যদি ইতিমধ্যে নাটকগুলোর সমাদর না করতেন, তবে তাঁর লেখা নাটকগুলোর থেকে দশখানা নাটক এখান ওখান থেকে সংগ্রহ করে নিজে উদ্যোগী হয়ে প্রকাশ করতে উৎসাহী হতেন না প্রশান্ত শর্মা। তিনি ভেতরে কী কষ্ট করেছিলেন আমরা শুনেছি, দেখিনি। কিন্তু বাইরে আমরা দেখেছি কত শুভানুধ্যায়ীর থেকে পাই পাই করে অর্থ সংগ্রহ করে ব্যয়ভার সংগ্রহ করেছেন। এবং প্রকাশ করেছিলেন ২০১৪র ফেব্রুয়ারির এক বিকেলে তিনসুকিয়া মহাবিদ্যালয়ে এক গুণীজন সমাবেশে। তাঁর পরেও যখন নিজের এই সব অসন্তুষ্টির কথা তিনি ‘নাট্যকার’ আমাদের জানান, তাকে নিছক ‘বিনয়’ বললে তাঁর অসম্মান করা হয়। তিনি অন্তর থেকে জানেন, শিল্পীকে যখন নিজের কাজে সন্তুষ্টি আর দম্ভে পেয়ে বসে তখনই তাঁর ‘যবনিকা পতন’ হয়। নিজের ‘সীমাবদ্ধতাটি’ জেনে একটি অসন্তুষ্টি তাঁর মনে কাজ করে বলেই তিনি মহৎ নাট্যকার, মহৎ শিল্পী। এটা যে কোনো নবীন শিল্পীর কাছে শেখার জিনিস।
            তবে এখানে জানিয়ে নিই, যে বইটির কথা আমরা উল্লেখ করলাম এটিই তাঁর নাটক নিয়ে জীবন জোড়া কাজ নয়। জনপ্রিয় প্রকাশনা সংস্থাগুলো আজঅব্দি তাঁর দিকে যে খুব একটি নজর দিয়েছে, সেরকম আমরা দেখিনি। কিন্তু নিতান্তই আত্মীয় বন্ধু বা নিজের প্রয়াসে প্রকাশিত  তাঁর রচনার সংখ্যা নিতান্ত কম নয়।আটটি পথ নাটক, বেশ কিছু একাঙ্কিকা, দুটি পূর্ণাঙ্গ নাটক লেখা ছাড়াও শিশুনাটক নিয়ে তাঁর সুগভীর তাত্ত্বিক অধ্যয়নের খতিয়ান রয়েছে ‘প্রসঙ্গ অসমীয়া শিশু-নাট্য’ নামে একটি প্রবন্ধ সংকলনে, যেটি অসম সাহিত্য সভার তিনসুকিয়া শাখা প্রকাশ করেছিল ২০০৫এ। ‘খরিয়ে মেলিলে বাট’,‘কণ পরুয়ার বিলৈ’ সহ বেশ কিছু শিশু উপন্যাস, বেশ কিছু কবিতাও তিনি লিখেছেন--- যদিও সেগুলো বই আকারে বেরিয়েছে বলে কোনো সংবাদ আমাদের কাছে নেই।তাঁর লেখা বহু প্রবন্ধপাতি অসমিয়া –বাংলা ছোটকাগজে,স্মরণিকাতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। বহু অনুবাদও তিনি করেছেন।ভগৎ সিংহের সুবিখ্যাত বই তাঁর অনুবাদে ‘মই কিয় নাস্তিক হলো’ নামে দশকখানিক আগে প্রকাশিত হয়েছিল। এখন তিনি ব্যস্ত রয়েছেন সুকান্ত ভট্টাচার্যের শিশুরচনাগুলোর অনুবাদে। এই সব কাজের জন্যে ইতিমধ্যে বেশকিছু পুরস্কারেও সম্মানিত হয়েছেন। তবে শেষ প্রকাশনা অবশ্যই ‘হরেন্দ্রনাথ বরঠাকুর শিশু-নাট সমগ্র’। এবং এই বইটি থেকেই তাঁর দিকে আকাদেমির নজর পড়ে। তাই আমরা সেটি নিয়ে কিছু কথা বলতে চাই, যাতে তাঁর কাজের সম্পর্কে কিছু ধারণা মেলে।
           দশখানা নাটক। তার প্রথমটি ‘প্লেটফর্ম’ এবং ‘একলব্যর বিচার’ ছাড়া বাকি প্রত্যেকটিই বলতে পারি স্পষ্টতই রূপক নাটক। কারণ সেগুলোতে জীব-জন্তু গাছপালা সবাই চরিত্র এবং তারা নিজেদের মধ্যে এবং শিশুদের সঙ্গে কথাও বলে, কাজও করে। এমন কি একটি নাটকে ‘পলরীয়া প্রতিধ্বনী’তে  ‘প্রতিধ্বনী’ও কথা বলে। প্রতীকের রূপকথা উপকথার আদল রয়েছে প্রায় সবকটিতে।  কিন্তু এর একটিও অবাস্তবও নয়, নয় পৌরাণিকও।
     
    ‘প্লেটফর্ম’ নাটকটিকে আপাতদৃষ্টিতে একটি ‘বাস্তববাদী’ নাটক বলা যেতে পারে। নয়টি দৃশ্যে রেলস্টেশনের প্লেটফর্মের ভবঘুরে দরিদ্র শিশুদের গল্প। তাদের কেউ স্টেশনেই গান করে হাত পেতে পয়সা রোজগার করে, কেউ বুট পালিশ করে, কেউ সামান্য টাকার বিনিময়ে সিনেমার পোস্টার সাঁটে শহরের দেয়ালে দেয়ালে। এদের রোজগার যত্রতত্র, কিন্তু মাথা গুঁজবার ঠাই এই স্টেশন প্লেটফর্ম। তাদের জাতধর্মের কোনো ঠিকানা নেই। ‘রানি’ বলে মেয়েটিকে দলনেত্রী বানিয়েছে। রোজগারের টাকা সবাই এসে ওকে দেয়, সে হিসেব করে ওদের ‘সংসার’ সামাল দেয়। আর পি এফ, স্টেশন মাস্টার, বাইরের দুনিয়ার বাবুদের উপেক্ষা, অবজ্ঞা, অত্যাচারে জীবন কাটে।সন্ত্রাসী আক্রমণে রেলবন্ধ হলে এরা বিপন্ন হয়, যাত্রী নেই। ফলে রোজগার জোটে না। জোটে না খাবার। বাইরের শহরে সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামা হলেও যেমন জীবন যাপন করা কঠিন হয়, তার উপরে প্রশ্ন উঠে এদের কার ধর্ম বা কী? সাংবাদিক যতীন এদের বন্ধু হয়, দলের সদস্য হয়। তাদের লিখতে পড়তে শেখায়, গাইতে শেখায় নতুন গান। এবং শেষে প্রতিবাদ করতে। এবং নাটকের শেষে এদের টিকিট কেটে রেলে চড়িয়ে পাঠায় অন্যান্য প্লেটফর্মে গিয়ে তাদের মতো যেখানে যত পথশিশু রয়েছে তদের সংগঠিত করতে। এমন করে পথশিশুদের সংগঠিত করা সম্ভব কি না, যখন কি না স্টেশন কর্তৃপক্ষই এদের স্টেশন থেকে তাড়াতে চাইছে, তখন মধ্যবিত্ত যতীন মামার এই পদক্ষেপ অসচেতনভাবে হলেও কর্তৃপক্ষের কাজটিই সহজ করে দিল কি না  খুব কট্টর বাস্তববাদী তথা যৌক্তিক অবস্থান থেকে এই প্রশ্ন উঠতেই পারে। কিন্তু যদি প্রশ্ন করি, একটি সুন্দর জীবনের স্বপ্ন দেখা এবং দেখানোর এই ভিন্ন নাট্যকারের সামনে কী পথই বা খোলা ছিল, তখন এইটুকুন খামতি বাস্তবতার দিক থেকে আমাদের মেনে নিতে বেগ পেতে হয় না।
                  বাকি নাটকগুলোতে সেই সমস্যা নেই। প্রতীকী নাটক দুরকমের হয়ে থাকে। এই যেমন রবীন্দ্রনাথের ‘রক্তকরবী’ আদি হচ্ছে সাঙ্কেতিক নাটক। সেখানে  রাজা-নন্দিনী-রঞ্জন ইত্যাদি চরিত্রগুলোর মর্ম দর্শকের বোঝা কঠিন হয়ে পড়ে নাট্যকারের ভাবনার সঙ্গে আলাপ না থাকলে। যদিও নাট্যকার ক্রমেই কিছু স্পষ্ট করেও থাকেন, কিছুটা দর্শকের বোধের উপরে ছেড়ে দেন। হরেন্দ্রনাথ বরঠাকুরের নাটকগুলো সেই অর্থে সাঙ্কেতিক নাটক নয়। এগুলোতে মানবেতর প্রাণী, জড় পদার্থ এমন কি প্রাকৃতিক ঘটনাতেও মানবিক চরিত্র আরোপ করেছেন তিনি। সেই অর্থে এই সব উপস্থাপনাকে অবাস্তব বলে মনে হতে পারে,কিন্তু নিজেদের অন্তর্বস্তু নিয়ে চরিত্রগুলো এমন কি কল্পিত কাহিনিও অনেক বেশি বাস্তব হয়ে উঠে। এই ব্যক্তি-বস্তু বা ভাবের বিশেষ কোনো মর্ম এমনিতে স্বাভাবিক অবস্থাতে আমাদের কাছে স্পষ্ট ধরা নাও দিতে পারে, নাট্যকার তাই স্পষ্ট –রূপময় এবং বাস্তব করে তুলেন।  হরেন্দ্রনাথ বরঠাকুরের বাকি সব নাটক এই গোত্রের,অর্থাৎ যাকে বলে রূপক নাটক। অবশ্য শিশুনাটকে এই রূপক আশ্রয়ের একটি অন্যতর ব্যাখ্যা হরেন্দ্রনাথ বরঠাকুরের রয়েছে, যার সঙ্গে আমাদের বিদ্যায়তনিক পরিচয় সাধারণত কম হয়। সেসব তিনি লিখেছেন ঐ ‘প্রসঙ্গ অসমীয়া শিশু-নাট্য’ বইতে। সেখানে তিনি ১৮ বছর অব্দি শিশুদের বয়স ভেদে মানসিক অবস্থা নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা করেছেন। এবং লিখেছেন,  তিন থেকে পাঁচ বা ছয় বছর বয়স অব্দি শিশুরা বিমূর্ত ধারণা করতে পারে না। অর্থাৎ মানুষে পশু পাখিতে তফাৎ সেরকম করতে পারে না। পশুপাখির কথা বলা তার কাছে খুবই স্বাভাবিক বলে মনে হয়।মানুষের পিঠে পাখা জুড়ে দিয়ে পরি বানিয়ে ফেললে শিশু তাকে অবাস্তব বলে মনে করে না। ফলে শিশুর দিকথেকে নাটকগুলো রূপক নাহয়ে হয়ে পড়ে বাস্তব। এই বয়সের শিশুর মধ্যে ‘অনুকরণপ্রিয়তা’ প্রবল থাকে। ফলে সে বড়দের আচরণ অনুকরণ করে। পুতুল নিয়ে রান্নাবাটি খেলে, পুতুলকে খাইয়ে দেয় ঘুম পাড়িয়ে দেয় ইত্যাদি। হরেন্দ্রনাথ বড়ঠাকুরের নাটকে সেভাবে পুতুল খেলা দেখব না। কিন্তু এই অনুকরণপ্রিয়তার কথাই মনে হয় তিনি ভেবেছেন যখন বেশ কিছু নাটকে আমরা দেখব শিশুরা আদালত বসিয়ে দিয়েছে, প্রতিবাদী বা শোক সভা করছে। সাত থেকে চৌদ্দ-পনেরো বছরের শিশুদের প্রবণতা হচ্ছে সমবয়সীদের মধ্যে দল গঠন, দলের প্রতি আনুগত্য। ফলে বহু নাটকেই দেখব শিশুরা দল বেঁধে করছে যা করবার, প্লেটফর্মে সবাই দলনেত্রী রানির আনুগত্য মেনে নিয়েছে।যাই হোক, আমরা তাঁর নাটকে চলে যাই।  
             দ্বিতীয় নাটক ‘বালিমাহীর কথা’ নাটকটি তৈরি হয়েছে গল্পের ভেতরে রয়েছে গল্প দিয়ে। মূল গল্পটির শুরু একটি বাস্তব গল্প দিয়ে যেখানে পপী-পিঙ্কুমণি-মাইনারা একটা খোলা জায়গাতে খেলছিল। কিন্তু কী খেলা হবে সেই নিয়ে ওদের মধ্যে তর্ক বাঁধল, জায়গাটি খেলার জন্যে উপযুক্তি বিবেচিত হলো না। ফলে তারা শিশুসুলভ ঠাট্টা তামাসা করে নিজেরাই রেল হয়ে ‘ঝক-ঝক রেলগাড়ি চলে রেলগাড়ি’ গান গেয়ে ‘কণখুড়ার’ বাগিচাতে গিয়ে উপস্থিত হয়। সেখানে গিয়ে বাগিচার বিপর্যস্ত অবস্থা দেখে এরা বড় মর্মাহত হয়। গাছগাছালি কেটে ফেলা হয়েছে। ভাঙ্গা পাখির বাসা ইত্যাদি দেখে এরা বেশ মর্মাহত হয়। ফলে তারা কি কিছুই খেলল না? অবশ্যই খেলল। মৃতগাছগাছালির জন্যে একটি শোকসভা বসালো, সেই সভা পরিণত হল প্রতিবাদী সভাতে। এবং সিদ্ধান্ত হল বাগিচাটিকে জনতার বাগিচা ঘোষণা করে এখানে আবারও বাগিচা সাজিয়ে তুলতে হবে। তারা বাগিচা সাজাচ্ছে, দিন যাচ্ছে। পপীর কিন্তু ভাবনা যে পাখিটির বাসা ভেঙ্গেছিল, সে আবার ফিরে আসবে কি না। একরাতে সে স্বপ্নে দেখতে পেল সেই পাখিটি একটি  ‘বালিমাহী’ অর্থাৎ খঞ্জনা। সবাই জানতে চাইল স্বপ্নে সে কী দেখেছে? সর্বত্র বাসা বাঁধবার জায়গা খুঁজে পাখিটি হয়রান, পাচ্ছে না কোথাও। এবারে সেই স্বপ্নের কথাটিকে নিয়ে পপী এবং বন্ধুরা তৈরি করে একটি নাটকের ভেতরে নাটক, যেটি বিশুদ্ধ এক রূপকাংশ। খঞ্জনা গাছের কাছে যায়, ঘরের কাছে যায়, ঝর্ণার কাছে যায়, পর্বতের কাছে যায়। তার ডিম পাড়বার সময় হয়েছে, বাসা বাঁধবার জায়গা চাই। অথচ, সর্বত্র দূষণে সবাই বিপন্ন , কেউ তাকে নিরাপদ ঠাই দেবার প্রতিশ্রুতি দিতে পারল না। স্বপ্নের কথা ওখানেই শেষ। কিন্তু স্বপ্নে-বাস্তবে এক হয়ে যায়, যখন শেষে ক্লান্ত খঞ্জনাটি সত্যি এসে পপী-পিঙ্কুদের সামনে অচেতন হয়ে পড়ে যায়। তারা তাকে সেই নির্মীয়মাণ বাগিচাতে আশ্রয় দেয়, শুশ্রূষা করে সুস্থ করে তুলে এবং শপথ নেয় এক দূষণমুক্ত পৃথিবীর গড়বার।
            তৃতীয় নাটক ‘জোনমণির স্বর্গযাত্রা’তেও সেরকম নাটকের ভেতরে নাটক রয়েছে। গল্পটি তিনি নিয়েছেন পোল্যান্ডের লেখক আইজাক বাসেভিচ সিঙ্গারের একটি গল্প ‘মূর্খের স্বর্গ’ থেকে। জোনমণি অলকা ভাইবোন। প্রাতিষ্ঠানিক স্কুলশিক্ষাতে জোনমণির কোনো আগ্রহ নেই। তার বোন অলকা ঠিক বিপরীত। জোনমণি ছবি এঁকে প্রজাপতি ধরে, খেলাধুলো করে ভালো পায়। পড়াশোনা করে নয়। ওদিকে বাড়িতে খুব চাপ। তার মন খারাপ হতে থাকে এই বন্দি দশাতে। সে গল্পচ্ছলে ঠাকমার থেকে জানতে পায় যে স্বর্গেই একমাত্র সুখ, কিন্তু সেখানে লোকে না মরে যেতে পারে না। সুতরাং সে মরবে বলে স্থির করে ফেলল, খাওয়া দাওয়া ছেড়ে দিল। কেউ এই অসুখের কোনো কারণ জানে না। প্রতিবেশী এক দাদু রহস্যটি ভেদ করলেন। তিনি স্বর্গ নিয়ে একটি নাটক তৈরি করেন। জোনমণির ঘরটিকে স্বর্গের মতো সাজিয়ে তুলেন। অলকার জনাকয় বান্ধবীদের সাজানো হলো পরি। সেই নাটকে তার এই বোধ হলো যে যত সুখ এই মাটির পৃথিবীতেই। সরাসরি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বিরুদ্ধে কোনো কথা নেই, বটে। কিন্তু প্রতিবেশী দাদুটি যেভাবে নেচে গেয়ে নাটক করে তাঁকে জীবনে শিক্ষাটি দিলেন---তাতে বিকল্প শিক্ষার একটি ভাবনার বীজ তো বপন করেই এই নাটক।
             চতুর্থ নাটক ‘বেলি ওলোয়া সাধু’ সেরকম কেশব মহন্তের একই নামে একটি গল্পের নাট্যরূপ। এর একটি প্রস্তাবনা দৃশ্য রয়েছে, যেখানে ঘোষক বা সূত্রধার কেশব মহন্তের ভূমিকাতে অবতীর্ণ হন, এবং একদল ছেলে মেয়েকে ঘুমিয়ে পড়া সূর্যের ঘুম ভাঙাবার গল্প বলতে শুরু করেন। এই গল্পই ক্রমে নাটকে পরিণত হয়।  সেই নাটকে অলঙ্কৃতা আফ্রিদি ইত্যাদি কচিকাঁচারা বড় চিন্তিত হয়ে পড়ে কী করে সূর্যের ঘুম ভাঙানো যায়, এতো দূর সূর্যের কাছে যায়ই বা কে আর কীভাবে? চিলকে ডাকা হলো।  চিল গিয়ে বাকি পাখিদের কাছে সমস্যাটি তুলে ধরল। তারপরে পাখিদের মধ্যে নানান তর্ক বিতর্ক দ্বিধাদ্বন্দ্বের ছবি যেভাবে নাটকে উপস্থাপিত হয়---সে আমাদের সংগঠন করবার, মহৎ উদ্দেশ্যে ত্যাগ করবার না করবার, ঈর্ষা-বিদ্বেষ, মিথ্যাচারের শিকার হবার অভিজ্ঞতার গল্প। দুঃসাহসিক অভিযানে টিয়া যেমন ফাঁকি দেয়, কোকিল তেমনি প্রাণ দেয়। ময়ূর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। প্রতি যাত্রাতেই জোনাকি ওদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যায়। শেষে গিয়ে মোরগ সফল হয়। এটি রূপকথারই গল্প। কিন্তু হরেন্দ্রনাথ বড়ঠাকুরের কলমে যেন অন্ধকার থেকে আলোর বিশ্বে যাত্রার মানুষের সংগ্রামের গল্পে পরিণত হয়েছে।

             
পঞ্চম নাটক ‘পলরীয়ার প্রতিধ্বনি’র গল্প অনেকটা সেই ‘বালিমাহীর কথা’র মতোই । সেখানে যদি দূষণে তবে এখানে নগরায়ণে শিশুদের খেলবার ঠাই নেই হয়ে যাবার সংকটের গল্প। গল্পটি জার্মান লেখক ফ্রেডরিখ ফ্লেডের শিশু উপন্যাসের ডব্ল্যু কে হোমসের কথা ইংরেজি  অনুবাদ "রানওয়ে ইকো’র অসমীয়া নাট্যরূপান্তর। ত্রিকূট পর্বতের আকর্ষণ হল সেখানে গিয়ে কিছু বললেই সে কথার তিনবার প্রতিধ্বনি হয়। ফলে সারা দুনিয়ার বহু লোক সেই পর্বতে ভ্রমণ করতে যায়। কমলা ললিতা পপী পিঙ্কিরা সনিয়ারাও পরিবারের সঙ্গে একদিন সেখানে গিয়ে হাজির হল, সঙ্গে গাইড মিঃ হক। কিন্তু আশ্চর্য! সেদিন কোনো প্রতিধ্বনি শোনা গেল না। ক্লান্ত প্রতিধ্বনি ঠিক করেছে সে আর মানুষের বিনোদন করবে না। তার চেয়ে মানুষের দুনিয়াতে নিজেই কিছুদিন ঘুরে আসবে। এর পরে যা সব কীর্তি সে করে তা হাস্যরসের ঝর্ণা বইয়ে দেয় নাটকে। সে সনিয়াদের স্কুলে গিয়ে প্রধান শিক্ষিকার ভূগোল ক্লাসে প্রশ্নের জবাব দেয় , তাও ভুল জবাব। ছাত্ররা বিদ্রূপ করছে ভেবে প্রথমে যদিও তিনি চটেন, পরে রহস্য না ধরতে পেরে খানিক আতঙ্কিত হন।   সনিয়াদের খেলবার জায়গা নেই, রাজপথের পাশে খেলে। সেখানেও সে গিয়ে সনিয়ার মায়ের ভূমিকাতে নামে, মায়ের ডাক ভেবে পথ পেরোতে গিয়ে সনিয়া দুর্ঘটনাতে পড়ে। একটি ট্রাকের নিচে পড়তে পড়তে সে বেঁচে যায়। ড্রাইভার আর সনিয়ার মায়ের সংলাপে প্রতিধ্বনি জানতে পায় পাশেই নিঃসন্তান প্রতাপশালী মানুষ অরবিন্দ চৌধুরীর দেয়াল ঘেরা একটি বাগিচা এমনি পড়ে আছে, যেটি সে খুলে দিলেই শিশুরা বেশ খেলতে পারে। এইবারে সে অরবিন্দ চৌধুরীর পেছনে পড়ে যাতে বাগিচাটি খুলে দেয়। অরবিন্দ চৌধুরী রহস্য ভেদ করতে পুলিশ পৌরসভা সবার শরণাপন্ন হয়। কিন্তু কিছুতেই বাগিচা খুলে দেবে না। এদিকে অদেখা প্রতিধ্বনির জ্বালায় তার আহার নিদ্রা সবই বিপন্ন । শেষে সে বাগিচা খুলে দিতে রাজি হলে প্রতিধ্বনি সনিয়ার থেকে বিদায় নিয়ে আবার সেই পর্বতে ফিরে যায়। মানুষের নগর তার কাছে মোটেও আমোদজনক মনে হলো না, বরং মিঃ হকের মতো মানুষ বেকার হয়ে যাওয়ার বেদনা সে অনুভব করে। হক হঠাৎ আবিষ্কার করেন প্রতিধ্বনি ফিরে এসেছে।  কচিকাঁচারা আবার সেই পাহাড়ে যায়, প্রতিধ্বনি জানায় সে তাদের ভালোবাসে, গান ভালোবাসে। নাটক এখানেই শেষ হয় শিশুদের একটি গানে। সেই গানের আহ্বানটি এরকম: আমাদের মনের কথা পৃথিবীকে শোনাতে তুমি পথ দেখাও প্রতিধ্বনি, মেঘে মেঘে ঢেউ তুলে প্রতিধ্বনিত হোক সেই কথা।
            ‘একলব্যের বিচার’ নাটকটি নামে মনে হয় একালেও কোনো গুরু বুঝিবা  শিষ্যের বুড়ো আঙুল না হলেও সেরকম কোনো দক্ষিণা দাবি করবেন। না শেষ অব্দি সেরকম কিছু হয় না। এই নাটকের গুরু দ্রোণাচার্যের বিপরীত, সুবিবেচক এবং সুবিচারকও। কিন্তু ঘটনা সেই একই, দরিদ্র ছেলে মোহনের ইচ্ছে সে ছবি আঁকা শেখে। কিন্তু উপায় নেই। তাকে এই বয়সেই রোজগার করে খেতে হয়। সুতরাং সে কাজ নিল এক চারুকলা বিদ্যালয়ে। আঁকিয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের ব্রাশটা, তুলিটা, ক্যানভাসটা গুছিয়ে রেখে, চা এনে দেয়, বাসনপত্র ধুয়ে দেয়, বিদ্যালয় সাফাই করে। সে বিদ্যালয় থেকে প্রায়ই রং তুলি হারিয়ে যেতে শুরু করলে কৈফিয়ত দেবার দায়টাও ওর উপরেই পড়ে। যদিও কেউ সেরকম অত্যাচার বা গালিগালাজ তাকে করে নি। একদিকে নাটকের রহস্য আর দিকে দারিদ্র্য এবং সততাকে ঘনীভূত করতে তার মতো আরো দু’চারজন বস্তির ছেলেকেও মাঝে মধ্যে নাটকে নিয়ে আসেন নাট্যকার। তারা মাটিকে আঁকিবুঁকি করে, রং নেই ব্রাশ নেই। স্টুডিওর এটা ওটা কৌতূহল বশে ধরলে মোহন তাদের ধরতে মানাও করে। আর ছাত্রী গায়ত্রী এসে ওদের কিছু চাইলে চুরি না  করে  বলে নিয়ে যাবার মধ্যবিত্তসুলভ উপদেশ দিয়ে কিছু রং তুলি দিতে চাইলে, ওদের আত্মমর্যাদাতে বাধে। ওরা না নিয়ে চলে যায়। তা হলে, হারাচ্ছে কী করে?  সুতরাং শিক্ষক রবিন চৌধুরী এক অভিনব অনুসন্ধান প্রক্রিয়া শুরু করলেন,সবাইকে নিয়ে। সেই সবার মধ্যে মোহনও রয়েছে। তার উপরে দায়িত্ব পড়ল, রাতেও সে স্টুডিওতে থাকবে আর নজর রাখবে কে রং তুলি সরাচ্ছে।  দেবজিৎ বলে একটি ছাত্রের আধো আঁকা একটি ক্যানভাস এক সকালে আবিষ্কৃত হল সম্পূর্ণ হয়ে গেছে, এবং ছবি দেখে সবাই মুগ্ধ হয়ে গেল। ছাত্রেরা মনে করে এই কাজ শিক্ষক ছাড়া আর কারো নয়, কিন্তু তিনি দাবি করেন এমন ভালো ছবি তিনিও আঁকতে পারবেন না। সুতরাং সন্দেহ সেই বস্তির ছেলেদের কিংবা মোহনের উপরে ঘনীভূত হল। বস্তির ছেলেরাও ঘটনাচক্রে  সন্দেহের বাইরে চলে গেলে, এক রাতে রবিন চৌধুরী এসে মোহনকে হাতে নাতে ধরে ফেলেন। সে তখন ছবি আঁকছিল। তার ভয় হলো , এবারে তার চাকরিখানা যাবে। কিন্তু সেরকম কিছু হলো না। পুলিশেও দেয়া হলো না। বিদ্যালয়েই একটি নকল আদালত বসল, এবং জানা গেল যে মোহন প্রখ্যাত শিল্পী চন্দ্রকান্ত দাসের ছেলে। যাকে সমাজ তথা বর্তমান শিল্পীরাও স্মরণে রাখে নি।  সুতরাং বিচারের রায়ে স্থির হলো, মোহন এবং তাঁর মায়ের দায়িত্ব এখন থেকে বিদ্যালয় নেবে, সে স্বাধীন ভাবে এই বিদ্যালয়ে থেকেই শিল্প চর্চা করবে। এভাবে প্রতিভার প্রতি সামাজিক দায়বদ্ধতার নাটক হয়ে উঠে ‘একলব্যর বিচার’ । এই সংকলনে এটি দ্বিতীয় বাস্তববাদী নাটক। এইখানে একটি কথা উল্লেখ করা ভালো, তিনি মনে করেন শিশু যেহেতু সমাজের উৎপাদন ব্যবস্থার সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত নয় বা নীতিগতভাবে যুক্ত থাকার কথা নয় ফলে তাদের কোনো শ্রেণি চরিত্র থাকবার কথা ছিল না। কিন্তু শিশু যে পরিবারে বড় হয়ে উঠে সেই পরিবারের শ্রেণিচরিত্র তাকে শৈশব থেকেই পেয়ে বসে। কথাগুলো তাঁর সেই ২০০৫এর প্রবন্ধ বইতে তিনি লিখেছেন। এবং এই নাটকে শিশুদের মধ্যেকার সেই শ্রেণি-দ্বন্দ্বকেও তিনি সুকৌশলে চিত্রিত করেছেন।
            একটি জনপ্রিয় ছড়াগান-- অসমিয়াতে যাকে বলে ওমলা-গীত-- ‘অ’ ফুল , অ’ ফুল নুফুলো কিয়’র নাট্যরূপান্তর ‘নুফুলা ফুলর মালিতা’ । ছড়াটি সরাসরি নাটকে নেই। মাঝে মাঝে বিভিন্ন চরিত্রের সংলাপে ছড়িয়ে আছে। ছোট্ট ছড়া । আমরা অন্য সূত্র থেকে তুলে দিচ্ছি, তাতে ধারণা একটি করে নেয়া সহজ হবে। একই ছড়া লক্ষ্মীনাথ বেজবরুয়ার ‘এজনী মালিনী আৰু এজোপা ফুল’ রচনাতে খানিক অন্যরকমও রয়েছে   ...
' ফুল অ' ফুল ! নুফুল কিয় ?
-- গৰু‌ৱে যে আগ খাই মইনো ফুলিম কিয় !
' গৰু অ' গৰু ! আগ খ‌া‌ৱ কিয় ?
-- গৰখীয়াই যে মোক নৰখে মইনো নাখাম কিয় !
' গৰখীয়া অ' গৰখীয়া ! গৰু নৰখ কিয় ?
-- ৰান্ধনিয়ে যে ভাত নিদিয়ে মইনো ৰখিম কিয় !
' ৰান্ধনি অ' ৰান্ধনি ! ভাত নিদিয় / নাৰান্ধ কিয় ?
-- খৰিকটীয়াই যে খৰি নিদিয়ে মইনো ৰান্ধিম কিয় !
' খৰিকটীয়া অ' খৰিকটীয়া ! খৰি নিদিয় কিয় ?
-- বৰগছ যে কাতি থৈছো নুশুকাইনো কিয় !
' বৰগছ অ' বৰগছ !  নুশুকা‌ৱ কিয় ?
-- মেঘে যে বৰষুণ দিয়ে মইনো শুকাম কিয় !
' মেঘ অ' মেঘ !  বৰষুণ দিয় কিয় ?
-- ভেকুলীয়ে যে টোৰটোৰাই মইনো নিদিম কিয় !
' ভেকুলী অ' ভেকুলী !  টোৰটোৰা‌ৱ কিয় ?
-- মই কৰো টোৰ টোৰ
   মেঘে কৰে গুৰ গুৰ
   বৰষুণ দিয়ে হুৰ হুৰ

   বোপা-ককাৰ সহজতো মইনো এৰিম কিয় !
             জোনমণি সেউতী শেওয়ালিরা এক সকালে আবিষ্কার করে তাদের প্রিয় সুন্দর বাগিচার ফুলগুলো কেউ খেয়ে গেছে। এরা তদন্ত শুরু করে ফুলকে জিজ্ঞেস করে জানে গরুতে খেয়ে গেছে। কাজলি রাঙলি গরুদের জিজ্ঞেস করে জানে রাখাল কর্তব্যে অবহেলা করাতে খাবার না পেয়ে এরা যা পেয়েছে তাই খেয়েছে... এই ভাবে নাটকের গল্প এগোয়। শেষে একটি বিচার সভা বসে। এবারে এতোগুলো চরিত্রের কাকে আসামী করা যাবে আর কাকে নয় তার বিচারও বেশ চিত্তাকর্ষক ভাবে করিয়েছেন নাট্যকার। দেখা গেল কাউকেই শাস্তি দেয়া যাচ্ছে না, দিলে দিতে হয় ‘অন্যের উপরে দায় চাপিয়ে দেবার মানবিক স্বভাবটিকে’। আর ‘ভেকুলি’ তথা বেঙ যে বলছে, ‘বোপা-ককাৰ’ রীতি সে ছাড়বে কেন একেই বলে ‘কূপমণ্ডুকতা’। হাজার বছরের অভ্যাসকে সে কোনো প্রশ্ন না করে পালন করে আসছে। তার শাস্তি হলো না, কারণ সরাসরি সে কোনো অন্যায় করে নি। কিন্তু শিক্ষার ব্যবস্থা হলো। স্থির হলো ওকে কুয়ো থেকে বের করে সাগরে ছেড়ে দেয়া আসবে, যাতে দুনিয়াটাকে ভালো জানতে চিনতে পায়। শুনেই বেঙ দিল লাফ, ছেলেমেয়েরা পিছু নিল ওকে ধরবে বলে---এমন এক হাস্যরসের দৃশ্যে নাট্যকার নাটকটিকে শেষ করে কেবল যে নাটকটিকে রসসিক্ত করলেন তাই নয়, আমাদের হাজারো কুসংস্কার এবং পারম্পরিক অভ্যাসকে নিয়ে নিজেও যেন খানিকটা হেসে নিলেন। সম্পাদক জানিয়েছেন নাটকটি ইতিমধ্যে জয়ারানি রায় গোয়ালপাড়িয়া ভাষাতে অনুবাদ করেছেন, আর সেখানকার ‘মাটিয়া’ সংস্থা ২০১৩র অক্টোবরে সেটির অভিনয় করে।
            ‘জোন-তরার সাধু’ অষ্টম নাটক। না চাঁদ বা তারার গল্প নয়। জোন , তরা নামে দুই খরগোশের গল্প। নাটকের শেষের দিকে কাকের সংলাপে যদিও রয়েছে ‘জাকেই পরম বল’ অর্থাৎ ‘একতাই বল’---আমাদের মনে হয়েছে ---এটি সত্য। কিন্তু তারও থেকে সত্য সেই বাংলা প্রবাদ ‘সৎ সঙ্গে স্বর্গবাস, অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ’। হরিণার সংলাপেও সেই আভাস স্পষ্ট।  ‘বেলি ওলোয়া সাধু’র মতোই এই নাটকেও ঠাকুরদার গল্প বলার আদল দেয়া হয়েছে। জোন তরা ভালুক জাম্ববন্তের আশ্রয়ে ছিল ভালোই। ধূর্ত শেয়ালে সন্ধানে ছিল কবে এদের ধরে খায়। একদিন ভালুক গেল ভাগ্নের বিয়ে খেতে । একহাড়ি মধু রেখে গেল  জোন তরার দায়িত্বে । সেই সুযোগে শেয়াল এসে ওদের আস্থাভাজন হলো কৌশলে । এবং মধুগুলো খেয়ে নিল। ভালুক ফিরে এলে সব দায় চাপিয়ে দিল জোন তরার উপরে। দু’জনে মিলে এদের আক্রমণ করল। কাকের দল ওদের বাঁচিয়ে দিল। কাক এসে নিয়ে গেল ওদের কাছের এক বনে নিয়ে গেল। সেখানে ঝর্ণা আছে, হরিণের মতো তৃণভোজী প্রাণী আছে। আছে ফুল ফল।  সবচাইতে বড় কথা ‘জাকত থাকি হারিলেও/ পাওঁ আমি সুখ, / আটায়ে ভগাই লওঁ/ হাৰি যোৱাৰ দুখ/ মৰিলেও জাকেই হঁও মৰণৰ ভাগী।’
          ‘রজার দেউল’ সেই ‘বালিমাহীর কথা’ বা ‘নুফুলা ফুলর মালিতা’ র মতোই অনেকটা। সেই বিপন্ন প্রকৃতি, বিপন্ন শৈশবের গল্প।  নাটকগুলো ক্রমান্বয়ে পড়ে গেলে একটি ধারণা গড়ে উঠতে থাকে যে শিশুদের তিনি সামাজিক কম, বেশি প্রাকৃতিক জীব হিসেবে উপস্থিত করেছেন। অথবা শৈশবের আড়ালে আসলে প্রকৃতি বিচ্ছিন্ন আমাদের সামাজিকতার প্রতি নাট্যকারের বিক্ষোভ যেন প্রায় প্রতিটি নাটকে ছড়িয়ে আছে।  এই নাটকে সেটি বিদ্রোহের রূপ ধরে। নাটকের নামটি নিয়েছেন, তিনি একটি বিখ্যাত শিশুখেলার ছড়া থেকে। সেই ছড়ার খানিকটা আমরা দিচ্ছি এরকম:  এইটো কাৰ দৌল?/ৰজাৰ দৌল/ভাঙিম নে নেভাঙিম?/নাভাঙিবা/ক’লী-ব’গীক মাতিম নে নেমাতিম?/নামাতিবা।...”
       
   জোন সোন মালতিদের কাছে রোদ আসে দেশবিদেশের রং নিয়ে বিক্রি করবে বলে। বিক্রি আর করে কই? বিলিয়ে দিয়ে যায়। সে যেতেই ওদের হাতের রংও চলে যায়। এবারে , রং পায় কই। অনেক ভেবে এরা নগরের সবচাইতে বড় বাগিচাতে গেল ফুলের থেকে রং নেবে বলে। গিয়ে দেখে সব ফুল অযত্নে নুইয়ে পড়েছে। এরা সেই বাগিচাকে যত্ন করে আবার সজীব করে তুলে। তখনই শুরু হয় রাজ-পুরোহিতের উপদ্রব। রাজার গড়া মন্দিরের জন্যে সব ফুল নিয়ে যাবে। নিয়ে যাওয়া মানে একরকম বাগিচা ধ্বংস করাই। প্রতিবাদ করতে মালিকে বন্দি করে নিয়ে যায়। আবার ‘বেলি’ তথা রোদ আসে। কচিকাঁচারা আবার আশার আলো দেখে। রোদ ওদের প্ররোচিত করে এই রাজার মন্দির ভাঙতে হবে। সে তাদের সেই দেউল ভাঙার মন্ত্র শেখায়। সেই মন্ত্র সেভাবেই এরা উচ্চারণ করে যেভাবে আবহমান কাল থেকে শিশু সমাজে খেলাটি প্রচলিত। কিন্তু শেষে নাট্যকারের সংযোজন...একটি গানে, “ ভাঙো নে নাভাঙো লাগে কিয় সুধিব/ রজার দ’ল ভাঙিবর হ’ল...” তাদের গানের শেষে দেউল ভেঙেই পড়ে। এই নাটকটি নিয়ে সদ্যপ্রয়াত নন্দকিশোর মহেশ্বরী একটি ছায়াছবি করবার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। কিন্তু শেষমেষ হয়ে উঠেনি। হরেন্দ্রনাথ বরঠাকুরের সঙ্গে ব্যক্তিগত আলাপে জানলাম সেন্সরবোর্ড রাজার দেউল ভাঙবার দৃশ্যে ছাড়পত্র দেয় নি বলে হয় নি। পরিচালক নাট্যকারকে জিজ্ঞেস করলে তিনিও সেই অংশ বাদ দিয়ে এগোতে রাজি হন নি। অসমের বিশেষ করে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার বাংলানাটকে কিন্তু এরকম সাহসী নাটক এখনো দুর্লভ। 
         শেষ নাটক ‘অমাতর মাত’ । ‘ জোন-তরার সাধু’র মতো এও হিংস্র জন্তুর বিরুদ্ধে অহিংস্র প্রাণীদের বিদ্রোহের নাটক। কিন্তু সেখানে আধুনিক রাষ্ট্রের ‘অভয়ারণ্য’ ঘোষণার রাজনীতির প্রসঙ্গটিও নিয়ে এসেছেন। অভয়ারণ্যে জীবজন্তু হত্যা আইনত নিষিদ্ধ হল তো বটে। কিন্তু আইনের ফাঁকে না হিংস প্রাণীর প্রাণী হত্যা বন্ধ হল, না হলো মানুষের হাতে নিরীহ জন্তুর বিপন্নতার কোনো শেষ। বাধ্য হয়ে তৃণভোজী প্রাণীগুলো জোটবদ্ধ হল। সেই বিদ্রোহে মৌমাছি, বোলতা ইত্যাদি সব চাইতে ক্ষুদ্র প্রাণীগুলোর ঐক্য সাহস এবং কর্মদক্ষতা খুব কাজে এলো। ক্ষুদ্র বলে এদের উপেক্ষা না করবার ফলে তৃণভোজী প্রাণীদের সাহস এবং দক্ষতা এতোটাই বৃদ্ধি পেল যে বনরাজা বাঘ তাদের আক্রমণে মৃতপ্রায় হয়ে গেল। কিন্তু বাঘকে মারেন নি নাট্যকার। চরিত্রটি যদিও প্রতীকী , বাস্তব জগতে বিপন্ন প্রকৃতির শিকার বাঘও। তাকেও বাঁচিয়ে রাখার দায় মানুষের। সুতরাং কোনো ভুল বার্তা না যায়, তাই পরিচালককে নির্দেশ দিয়ে রেখেছেন শেষ দৃশ্যে হয় বাঘকে অচেতন দেখাবার জন্যে কিছু করুন, অথবা বাঁধন ছিঁড়ে পালিয়ে যাওয়া দেখান যেমন তিনি।
         প্রতিটি নাটক একাঙ্কিকা। সবচাইতে বেশি এগার দৃশ্যের নাটক ‘পলরীয়া প্রতিধ্বনি’, আর সবচাইতে ছোট  পাঁচ অঙ্কের নাটক ‘জোন-তরার সাধু’। ‘রজার দেউলে’ কেন কোনো দৃশ্য বিভাজন নেই, সে আমাদের স্পষ্ট হলো না। নাট্যকার বা সম্পাদকের ভুলেও হয়ে থাকতে পারে। হরেন্দ্রনাথ বরঠাকুর একজন কবিও। নাটকগুলোতে অনেক প্রচলিত এবং পরিচিত শিশু পাঠ্য ছড়া, গান, লোককাহিনি, উপকাহিনির আংশিক বা সম্পূর্ণ ব্যবহার আছে, যদিও বেশ কিছু গান কবিতার কথা তাঁর নিজেরই লেখা। নিছক গল্পে বা ভাববস্তুতেই নয়, নাটকগুলোকে রসসিক্ত করে তুলবার যাবতীয় আয়োজন তিনি করেছেন এই সব ছড়ায়, গানে এবং অভিনয় কালে নাচবার সুযোগ করে দিয়েও। এইখানে বলে রাখা ভালো, অসমিয়া আধুনিক শিশু সাহিত্য যদিও মূলত লক্ষ্মীনাথ বেজবরুয়ার হাতে শুরু, নাটকের শুরু জ্যোতিপ্রসাদে। তাঁর ‘নিমাতী কইনা’ প্রথম শিশুদের জন্যে লেখা কাব্যনাটক।প্রচলিত লোককাহিনি,কিন্তু তিনি নিয়েছেন লক্ষ্মীনাথ বেজবরুয়ারই রচনার থেকে। জ্যোতিপ্রসাদের সম্পর্কে হরেন্দ্রনাথ লিখেছেন,“জ্যোতিপ্রসাদের উল্লেখযোগ্য কৃতিত্বটি হল---তিনি অসমিয়া শিশুনাটকের পরম্পরাগত ধারাটিকে চিহ্নিত করে স্থানীয় উপকরণেই উন্নততর আধুনিক মানের শিশুনাটক সৃষ্টির চেষ্টা করেছিলেন। অসমীয়া আধুনিক শিশুনাট্য সাহিত্যের এটিই ইতিবাচক তথা প্রগতিশীল ধারা। এই ধারাটিকে বিকশিত করে নেবার উপরেই অসমিয়া শিশু সাহিত্যের ভবিষ্যৎ আজও নির্ভরশীল।” (অসমীয়া শিশু নাট্যধারার গতি-প্রকৃতি; প্রসঙ্গ অসমীয়া শিশু নাট্য; পৃ:৩৫ থেকে বাংলাতে অনূদিত।) ফলে তিনি নিজে যে সেই ধারারই অনুবর্তী হয়ে কাজ করবেন, সে লেখাই বাহুল্য। শিশু নাটক খুব বড় হওয়া উচিত নয়, মিনিট বিশেকে শেষ হতে পারলে ভালো -- সেসব তাঁর সুগভীর অধ্যয়ন এবং অভিজ্ঞতার থেকে নেয়া সিদ্ধান্ত। সেই সঙ্গে তিনি শিশুনাটক পরিবেশনার সময় মঞ্চ, আলো, শব্দ সংযোজন, দর্শকাসনের ব্যবস্থা ইত্যাদি নিয়েও সুগভীর অধ্যয়ন করেছেন। যেমন তিনি লিখেছেন, শিশুনাটক পরিবেশনের সময় হল পুরো অন্ধকার করা উচিত নয়। অভিনেতা-অভিনেত্রীকে দর্শকের প্রতিক্রিয়া দেখতে দেয়া উচিত। সেই সব প্রসঙ্গ আমরা নাটকের পাঠ আলোচনাতে বাদ দিতে পারি। কিন্তু তথ্য হিসেবে একটি কথার উল্লেখ মনে হয় থাকা ভালো যে তিনি মনে করেন প্রসেনিয়াম পদ্ধতিতে আদর্শ শিশুনাটক পরিবেশিত হতে তথা বিকশিত হতে পারে না,তার জন্যে পরম্পরাগত লোকনাট্যের অভিনয় পদ্ধতি না হলেও, পথ নাটক পদ্ধতিই ভালো। যদিও তিনি যখন নাটকগুলো লিখেছেন, বর্তমান বাস্তবতার সঙ্গে সমঝোতা করেই লিখেছেন,এবং সেগুলোতে মঞ্চনির্দেশনাও ভালোরকমই দেয়া রয়েছে। 

Thursday 21 September 2017

দুঃখের অধিকার


মূল হিন্দি: যশপাল
বাংলা অনুবাদ: সুশান্ত কর


[১৯০৩এর ৩ ডিসেম্বর পাঞ্জাবের ফিরোজপুরের জন্ম আধুনিক হিন্দি কথা সাহিত্যের অন্যতম কৃতীপুরুষ যশপালের। স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগ দিয়ে জেলও খেটেছেন কংগ্রেসে যোগ দিয়ে অচিরেই গান্ধিবাদে আগ্রহ হারালে ভগৎ সিঙের ‘নজোয়ান ভারত সভা’তে যোগ দেন এবং মার্ক্সবাদে আগ্রহী হয়ে পড়েন। বহু গল্প এবং উপন্যাসের জনক যশপাল কিছু কবিতা এবং নাটকও লিখেছেন। ‘বিপ্লব’ নামে একটি   কাগজও সম্পাদনা করেছেন। তাঁর ‘ঝুটা সচ’ উপন্যাসের জন্যে সাহিত্য আকাদেমি পেয়েছিলেন। এছাড়াও ভারত সরকার তাঁকে   পদ্মভূষণ সম্মানে সম্মানিত করেছিলেন, পেয়েছিলেন সোভিয়েত দেশ নেহরু পুরস্কার২৬ ডিসেম্বর, ১৯৭৬এ ৭৩ বছর বয়সে এই মহান লেখকের প্রয়াণ ঘটে। ‘দুখ কা অধিকার’ তাঁর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ছোটগল্পের একটি। আমার করা অনুবাদ 'উজান' ত্রয়োদশ সংখ্যাতে এটি প্রকাশিত হল  ]


মানুষের পোশাক সবাইকে বিভিন্ন শ্রেণিতে ভাগ করে দেয়। প্রায়ই দেখা যায় পোশাক মানুষের অধিকার এবং অবস্থান নিশ্চিত করে দেয়। এ আমাদের জন্যে অনেক বন্ধ দরজা খুলে দেয়। কিন্তু কখনো এমন পরিস্থিতিও আসে যখন আমরা খানিক নিচে নেমে সমাজের তলার শ্রেণির অনুভূতিগুলো অনুভব করতে চাই। তখন এই পোশাকই বাধা হয়ে দাঁড়ায়। কাটা ঘুড়িকে যেমন হাওয়া সহসা মাটিতে পড়ে যেতে দেয় না, ঠিক সেরকম কোনো কোনো পরিস্থিতিতে পোশাক আমাদের নিচে ঝুঁকতে বাধা দিয়ে বসে।
বাজারে,ফুটপাতে কিছু চিনার ডালায় আর কিছু মাটিতে বিক্রির জন্যে রাখা ছিল। এগুলোর পাশে এক মাঝবয়সী মহিলা বসে ছিল। চিনার তো বিক্রির জন্যেই ছিল। কিন্তু সেগুলো কেনার জন্যে কেউ সামনে যায় কী করে? বিক্রি করবার জন্যে যে মহিলাটি বসেছিল, সে তো সারাক্ষণ দুই হাঁটুতে মুখ লুকিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিল।
পাশের দোকানের বেঞ্চে বসা লোকজন, বাজারে দাঁড়ানো লোকজন মহিলাটির সম্পর্কে ঘৃণার সঙ্গে কী সব কথাবার্তা বলছিল। মহিলাটির কান্না দেখে মনে খুব কষ্ট হচ্ছিল, কিন্তু কারণটি জিজ্ঞেস কী করে করি? ফুটপাতে ওর কাছে গিয়ে যে বসব, আমার পোশাক বড় বাঁধা হয়ে দাঁড়াল।
একটি লোক প্রবল ঘৃণাতে এক পাশে থু থু ফেলে বলল,“কী দিন কাল এলো রে বাবা! জোয়ান ছেলে মরেছে একটা দিন পার হলো না, এই বেহায়া মেয়ে মানুষ দোকান লাগিয়ে বসে গেছে।”
'উজান' ত্রয়োদশ সংখ্যাতে প্রকাশিত
দ্বিতীয় সাহেব নিজের দাড়ি খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে বলল,“আরে যার যেমন কর্ম,আল্লাহও সেরকমই ফল ভোগ করতে দেন।”
সামনের ফুটপাথের একটি লোক দিয়াশলাইর কাঠিতে কান চুলকাতে চুলকাতে বলল,“ আরে এই সব লোকের কী? এই হারামি মানুষগুলো ছোট্ট একটা রুটির টুকরোর জন্যে জান দিয়ে দিতে পারে।এদের জন্যে ছেলে-মেয়ে,স্বামী-স্ত্রী,ইমান–ধর্ম সব রুটির টুকরোই।”
মুদির দোকানে বসে থাকা লালাজী বললেন,“আরে ভাই,এদের জন্যে বাঁচা-মরার কোনো অর্থ নেই। কিন্তু অন্যের ধর্ম-কর্মের খেয়াল রাখা চাই তো? জোয়ান ছেলে মারা গেলে তেরো দিনে অশৌচ হয়। আর এ এখানে বাজারে এসে চিনার বেচতে বসে গেছে। হাজার মানুষ যায় আসে। কেউ কি জানে এর ঘরে অশৌচ চলছে? কেউ যদি এর চিনার কিনে খেয়ে ফলে তবে লোকের ধর্ম-কর্ম থাকে কী করে? কী কাল এলো রে বাবা!”
আশপাশের দোকানে জিজ্ঞেস করে  জানা গেল এর তেইশ বছর বয়সী ছেলে ছিল। ঘরে ওর বৌ আর নাতি আছে। ছেলে শহরের পাশের দেড় বিঘার জমিতে কাজ করে পরিবার চালাত। চিনারর ডালা বাজারে পৌঁছে দিয়ে কখনো ছেলে বসে যেত বেচতে, কখনো মা বসত।
ছেলে খুব ভোরে উঠে পাকা চিনার পাড়তে গেছিল। ভেজা মাটিতে বসে বিশ্রাম করবার সময় এক সাপের উপর ওর পা পড়ে গেল। সাপ ছেলেকে ছোবল দিয়ে বসল।
ছেলের বুড়ি মা পাগলিনী প্রায় ওঝা ডেকে নিয়ে এল। ঝাড়-ফুঁক হল। মা-মনসার পুজো হল। পুজোর জন্যে দান-দক্ষিণা চাই। ঘরে কিছু আটা আর আনাজ ছিল,দান দক্ষিণাতেই ফুরিয়ে গেল। মা, বৌ- বাচ্চারা ‘ভগবানা’র গায়ে পড়ে অনেক কান্নাকাটি করল। কিন্তু ভগবানা সেই যে চুপ করেছিল আর টু শব্দটি করে নি। সাপের বিষে ওর পুরো শরীর কালো হয়ে গেছিল।
জীবিত মানুষ ন্যাংটোও থাকতে পারে, কিন্তু মৃতকে কী করে ন্যাংটো বিদেয় করা যায়? এর জন্যে তো বাজাজের দোকান থেকে নতুন কাপড় আনতেই হবে। চাই কি তার জন্যে মায়ের হাতের বাসন বর্তনই না কেন বিক্রি করে দিতে হয়।
ভগবানা পরলোকে চলে গেল। ঘরে যা টুক টাক এটা ওটা ছিল ওকে বিদেয় জানাতে গিয়ে চলে গেল। বাপ নেই তো কী হল? ছেলে সকালে উঠেই খিদেয় কাঁইকুই শুরু করল। দিদিমা ওকে খাবার জন্যে চিনার দিয়ে দিল, কিন্তু বৌকে কী দেয়? বৌয়ের শরীর জ্বরে রুটি শেকার তাওয়ার মতো গরম  হয়ে গেছিল। এখন ছেলে নেই, বুড়িকে দু’আনা চারআনা ধারই বা দেয় কে?
         বুড়ি কাঁদতে কাঁদতে কাঁদতে  আর চোখ মুছতে মুছতে ছেলের গোটানো চিনারর ডালা নিয়ে বাজারের দিকে পা বাড়াল---আর কীই বা সে করতে পারত?
বুড়ি তো চিনার বিক্রি করবে বলে সাহস করে বাজারে এল, কিন্তু চাদরে মাথা ঢেকে হাঁটুতে মাথা লুকিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিল।
কাল যার ছেলে চলে গেছে, আজ সে বাজারে সওদা করতে করতে বসে গেছে, হায় রে পাষাণ হৃদয়!
এই ছেলে হারানো মায়ের দুঃখের পরিমাণ  আন্দাজ করবার জন্যে আমি গেল বছরে আমাদের পাড়াতে আরেক ছেলে হারানো মায়ের কথা ভাবতে শুরু করলাম। ঐ সম্ভ্রান্ত মহিলা ছেলের মৃত্যুর পরে আড়াই মাস পালঙ্ক থেকে উঠতে পারেন নি। উনি মিনিট পনেরো পরে পরে পুত্র শোকে মূর্ছা যাচ্ছিলেন। আর যখন মূর্ছা যাচ্ছিলেন না তখন চোখের জল বাধ মানত না। দু’দুজন ডাক্তার সারাক্ষণ তাঁকে দেখার জন্যে বসে থাকতেন। সারাক্ষণ মাথাতে বরফ রাখতে হতো। পুরো শহরের মানুষের মন এঁর ছেলে হারাবার শোকে গলে পড়ছিল।
যখন মন কিছু ভেবে পায় না তখন অস্বস্তিতে পায়ের গতি বেড়ে যায়। এ অবস্থাতেই আমি নাক উপরে তুলে পথের মানুষের সঙ্গে ঠোকাঠুকি করে পা চালিয়ে দিলাম। ভাবছিলাম---দুঃখ করবার জন্যে, শোক পালনের জন্যেও অবসর চাই , সুবিধে চাই আর দুঃখী হওয়াটাও একটা অধিকার বটে, যা সবার থাকে না!