মূল হিন্দি: যশপাল
বাংলা অনুবাদ: সুশান্ত কর
[১৯০৩এর ৩ ডিসেম্বর
পাঞ্জাবের ফিরোজপুরের জন্ম আধুনিক হিন্দি কথা সাহিত্যের অন্যতম কৃতীপুরুষ যশপালের।
স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগ দিয়ে জেলও খেটেছেন। কংগ্রেসে যোগ দিয়ে অচিরেই গান্ধিবাদে আগ্রহ হারালে ভগৎ
সিঙের ‘নজোয়ান ভারত সভা’তে যোগ দেন এবং মার্ক্সবাদে আগ্রহী হয়ে পড়েন। বহু গল্প এবং
উপন্যাসের জনক যশপাল কিছু কবিতা এবং নাটকও লিখেছেন। ‘বিপ্লব’ নামে একটি কাগজও সম্পাদনা করেছেন। তাঁর ‘ঝুটা সচ’
উপন্যাসের জন্যে সাহিত্য আকাদেমি পেয়েছিলেন। এছাড়াও ভারত সরকার তাঁকে পদ্মভূষণ সম্মানে সম্মানিত করেছিলেন,
পেয়েছিলেন সোভিয়েত দেশ নেহরু পুরস্কার। ২৬ ডিসেম্বর,
১৯৭৬এ ৭৩ বছর বয়সে এই মহান লেখকের প্রয়াণ ঘটে। ‘দুখ কা অধিকার’ তাঁর অন্যতম
শ্রেষ্ঠ ছোটগল্পের একটি। আমার করা অনুবাদ 'উজান' ত্রয়োদশ সংখ্যাতে এটি প্রকাশিত হল ]
মানুষের পোশাক সবাইকে বিভিন্ন শ্রেণিতে ভাগ করে দেয়। প্রায়ই
দেখা যায় পোশাক মানুষের অধিকার এবং অবস্থান নিশ্চিত করে দেয়। এ আমাদের জন্যে অনেক
বন্ধ দরজা খুলে দেয়। কিন্তু কখনো এমন পরিস্থিতিও আসে যখন আমরা খানিক নিচে নেমে
সমাজের তলার শ্রেণির অনুভূতিগুলো অনুভব করতে চাই। তখন এই পোশাকই বাধা হয়ে দাঁড়ায়। কাটা
ঘুড়িকে যেমন হাওয়া সহসা মাটিতে পড়ে যেতে দেয় না, ঠিক সেরকম কোনো কোনো পরিস্থিতিতে পোশাক
আমাদের নিচে ঝুঁকতে বাধা দিয়ে বসে।
বাজারে,ফুটপাতে কিছু চিনার
ডালায় আর কিছু মাটিতে বিক্রির জন্যে রাখা ছিল। এগুলোর পাশে এক মাঝবয়সী মহিলা বসে
ছিল। চিনার তো বিক্রির জন্যেই ছিল। কিন্তু সেগুলো কেনার জন্যে কেউ সামনে যায় কী
করে? বিক্রি করবার জন্যে যে মহিলাটি বসেছিল, সে তো সারাক্ষণ দুই হাঁটুতে মুখ
লুকিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিল।
পাশের দোকানের বেঞ্চে বসা
লোকজন, বাজারে দাঁড়ানো লোকজন মহিলাটির সম্পর্কে ঘৃণার সঙ্গে কী সব কথাবার্তা
বলছিল। মহিলাটির কান্না দেখে মনে খুব কষ্ট হচ্ছিল, কিন্তু কারণটি জিজ্ঞেস কী করে
করি? ফুটপাতে ওর কাছে গিয়ে যে বসব, আমার পোশাক বড় বাঁধা হয়ে দাঁড়াল।
একটি লোক প্রবল ঘৃণাতে এক
পাশে থু থু ফেলে বলল,“কী দিন কাল এলো রে বাবা! জোয়ান ছেলে মরেছে একটা দিন পার হলো
না, এই বেহায়া মেয়ে মানুষ দোকান লাগিয়ে বসে গেছে।”
'উজান' ত্রয়োদশ সংখ্যাতে প্রকাশিত |
দ্বিতীয় সাহেব নিজের দাড়ি
খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে বলল,“আরে যার যেমন কর্ম,আল্লাহও সেরকমই ফল ভোগ করতে দেন।”
সামনের ফুটপাথের একটি লোক দিয়াশলাইর কাঠিতে কান
চুলকাতে চুলকাতে বলল,“ আরে এই সব লোকের কী? এই হারামি মানুষগুলো ছোট্ট একটা রুটির
টুকরোর জন্যে জান দিয়ে দিতে পারে।এদের জন্যে ছেলে-মেয়ে,স্বামী-স্ত্রী,ইমান–ধর্ম সব
রুটির টুকরোই।”
মুদির দোকানে বসে থাকা লালাজী
বললেন,“আরে ভাই,এদের জন্যে বাঁচা-মরার কোনো অর্থ নেই। কিন্তু অন্যের ধর্ম-কর্মের
খেয়াল রাখা চাই তো? জোয়ান ছেলে মারা গেলে তেরো দিনে অশৌচ হয়। আর এ এখানে বাজারে
এসে চিনার বেচতে বসে গেছে। হাজার মানুষ যায় আসে। কেউ কি জানে এর ঘরে অশৌচ চলছে?
কেউ যদি এর চিনার কিনে খেয়ে ফলে তবে লোকের ধর্ম-কর্ম থাকে কী করে? কী কাল এলো রে
বাবা!”
আশপাশের দোকানে জিজ্ঞেস
করে জানা গেল এর তেইশ বছর বয়সী ছেলে ছিল।
ঘরে ওর বৌ আর নাতি আছে। ছেলে শহরের পাশের দেড় বিঘার জমিতে কাজ করে পরিবার চালাত। চিনারর
ডালা বাজারে পৌঁছে দিয়ে কখনো ছেলে বসে যেত বেচতে, কখনো মা বসত।
ছেলে খুব ভোরে উঠে পাকা চিনার
পাড়তে গেছিল। ভেজা মাটিতে বসে বিশ্রাম করবার সময় এক সাপের উপর ওর পা পড়ে গেল। সাপ
ছেলেকে ছোবল দিয়ে বসল।
ছেলের বুড়ি মা পাগলিনী
প্রায় ওঝা ডেকে নিয়ে এল। ঝাড়-ফুঁক হল। মা-মনসার পুজো হল। পুজোর জন্যে দান-দক্ষিণা
চাই। ঘরে কিছু আটা আর আনাজ ছিল,দান দক্ষিণাতেই ফুরিয়ে গেল। মা, বৌ- বাচ্চারা ‘ভগবানা’র
গায়ে পড়ে অনেক কান্নাকাটি করল। কিন্তু ভগবানা সেই যে চুপ করেছিল আর টু শব্দটি করে
নি। সাপের বিষে ওর পুরো শরীর কালো হয়ে গেছিল।
জীবিত মানুষ ন্যাংটোও থাকতে পারে, কিন্তু মৃতকে
কী করে ন্যাংটো বিদেয় করা যায়? এর জন্যে তো বাজাজের দোকান থেকে নতুন কাপড় আনতেই
হবে। চাই কি তার জন্যে মায়ের হাতের বাসন বর্তনই না কেন বিক্রি করে দিতে হয়।
ভগবানা পরলোকে চলে গেল। ঘরে
যা টুক টাক এটা ওটা ছিল ওকে বিদেয় জানাতে গিয়ে চলে গেল। বাপ নেই তো কী হল? ছেলে
সকালে উঠেই খিদেয় কাঁইকুই শুরু করল। দিদিমা ওকে খাবার জন্যে চিনার দিয়ে দিল,
কিন্তু বৌকে কী দেয়? বৌয়ের শরীর জ্বরে রুটি শেকার তাওয়ার মতো গরম হয়ে গেছিল। এখন ছেলে নেই, বুড়িকে দু’আনা চারআনা
ধারই বা দেয় কে?
বুড়ি কাঁদতে কাঁদতে কাঁদতে আর চোখ
মুছতে মুছতে ছেলের গোটানো চিনারর ডালা নিয়ে বাজারের দিকে পা বাড়াল---আর কীই বা সে
করতে পারত?
বুড়ি তো চিনার বিক্রি করবে
বলে সাহস করে বাজারে এল, কিন্তু চাদরে মাথা ঢেকে হাঁটুতে মাথা লুকিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিল।
কাল যার ছেলে চলে গেছে, আজ
সে বাজারে সওদা করতে করতে বসে গেছে, হায় রে পাষাণ হৃদয়!
এই ছেলে হারানো মায়ের
দুঃখের পরিমাণ আন্দাজ করবার জন্যে আমি গেল
বছরে আমাদের পাড়াতে আরেক ছেলে হারানো মায়ের কথা ভাবতে শুরু করলাম। ঐ সম্ভ্রান্ত
মহিলা ছেলের মৃত্যুর পরে আড়াই মাস পালঙ্ক থেকে উঠতে পারেন নি। উনি মিনিট পনেরো পরে
পরে পুত্র শোকে মূর্ছা যাচ্ছিলেন। আর যখন মূর্ছা যাচ্ছিলেন না তখন চোখের জল বাধ
মানত না। দু’দুজন ডাক্তার সারাক্ষণ তাঁকে দেখার জন্যে বসে থাকতেন। সারাক্ষণ মাথাতে
বরফ রাখতে হতো। পুরো শহরের মানুষের মন এঁর ছেলে হারাবার শোকে গলে পড়ছিল।
যখন মন কিছু ভেবে পায় না
তখন অস্বস্তিতে পায়ের গতি বেড়ে যায়। এ অবস্থাতেই আমি নাক উপরে তুলে পথের মানুষের
সঙ্গে ঠোকাঠুকি করে পা চালিয়ে দিলাম। ভাবছিলাম---দুঃখ করবার জন্যে, শোক পালনের
জন্যেও অবসর চাই , সুবিধে চাই। আর
দুঃখী হওয়াটাও একটা অধিকার বটে, যা সবার থাকে না!
No comments:
Post a Comment