এবার ফিরাও মোরেঃ
তিনি বুঝি বলেছিলেন তাঁর গানেই তিনি বেঁচে থাকবেন। কথাটা মিথ্যে নয়। পৃথিবীতে যত শিল্প রূপ আছে তার মধ্যে সবচে’ বেশি জনপ্রিয়তা রয়েছে গানেরই । গান না থাকলে গাঁয়ে-ভূয়ে রবীন্দ্রজয়ন্তী কতটা উৎসাহে উদযাপিত হতো সন্দেহ আছে। বঙ্কিমের মতোই হিসেব নিলে কিন্তু দেখা যাবে রবীন্দ্রনাথের গদ্যরচনাই সংখ্যাতে বেশি। কিন্তু তার থেকেও বেশি তাঁর শিল্প বহির্ভূত কাজ । তাঁর গদ্য বা পদ্য শিল্পতে যে ভাবনাগুলো ধরা আছে তার প্রায় সবটাকেই তিনি অনুবাদ করেছেন কাজে। সমাজ নির্মাণের কাজে । আলো-হাওয়া-মাটি ও মানুষ নিয়ে লেখা কাব্যে। সে কাজগুলো তিনি করছিলেন করবেন বলেই নয়। তাঁর আশা ছিল , তিনি নিদর্শন রেখে যাবেন। দেশের মানুষ তাই দেখে পুরো দেশকে রচনা করবে, করবে পুনর্নির্মাণ । তাঁর বিশ্বাস ছিল, “যারা আমাদের চারদিকে রয়েছে তাদের মধ্যে যদি সত্যকার আগুন জ্বালতে পারি, তবে সে আগুন আপনি আপনার শিখার পতাকাকে বহন করে চলবে।. . . দেশের সর্বত্র প্রসারিত হবে—শাখা থেকে প্রশাখায় বিস্তৃত হবে, বৃহৎ বনস্পতি হয়ে ছায়াদান করতে পারবে, ফলদান করতে পারবে।” ( শ্রীনিকেতন; পল্লীপকৃতি)
এটা হয়নি। তাঁর জন্যে আমরা তাঁর চিন্তার সীমাবদ্ধতাকে দায়ী করব, না আমাদের দায়িত্বজ্ঞানহীনতাকে সে নিয়ে পরে আসব। কিন্তু এটা সত্য যে আমরা সে কাজগুলোকে বিশেষ কোনো মর্যাদাই কখনো দিলাম না। যদিও আমরা ঘটা করে যখন রবীন্দ্রজয়ন্তী পালন করি তখন মিথ্যাচারের চূড়ান্ত নজির রেখে বড়াই করে বলি যে তিনি আছেন আমাদের শয়নে-স্বপনে-অশনে-ব্যসনে .......ইত্যাদি ইত্যাদি !
বাংলা চতুর্দশ শতকের শুরুর বছরের ফাল্গুনে রবীন্দ্রনাথ এক তরতাজা তরুণের মতোই ডাক দিয়েছিলেনঃ
কবি, তবে উঠে এসো---যদি থাকে প্রাণ
তবে তাই লহো সাথে, তবে তাই করো আজি দান ।
বড়ো দুঃখ, বড়ো ব্যথা---সম্মুখতে কষ্টের সংসার
বড়োই দরিদ্র, শূন্য, বড়ো ক্ষুদ্র, বন্ধ, অন্ধকার ।
অন্ন চাই, প্রাণ চাই, আলো চাই, চাই মুক্ত বায়ু,
চাই বল, চাই স্বাস্থ্য, আনন্দ-উজ্জ্বল পরমায়ু,
সাহসবিস্তৃত বক্ষপট । এ দৈন্য মাঝারে, কবি,
একবার নিয়ে এসো স্বর্গ হতে বিশ্বাসের ছবি ।”
তাঁর সে কবিতা আমরা আবৃত্তি করেছি । কিন্তু “অন্ন চাই, প্রাণ চাই, আলো চাই, চাই মুক্ত বায়ু” এই আহ্বানে সাড়া দিয়ে “স্বর্গ হতে বিশ্বাসের ছবি” নিয়ে আসতে কেউ তেমন উদ্যোগী হই নি। বরং জীবনের শেষে তাঁর সততার থেকে উঠে আসা বিনয়োক্তি, “ আমার কবিতা, জানি আমি, গেলেও বিচিত্র পথে হয় নাই সর্বত্রগামী” কে নিয়ে আমরা বৌদ্ধিক বিলাশিতায় মেতেছি । সন্ধান করেছি--- তিনিতো দরিদ্র জীবনের কথা বিশেষ ভাবেন নি, তিনি তা নিজেই স্বীকার করেছেন---তবে তাঁর পরে সে কাজ করলেন কে ? নজরুল, সুকান্ত না সুভাষ ? শরৎ , মানিক না তারাশংকর ?
আমাদের এই ভণ্ডামীর সঙ্গে তাঁর পরিচয় ছিল। তিনি লিখেছেন, “ ....কিন্তু যখন দেখলাম আমার কথাগুলি শ্রুতি মধুর কবিত্ব হিসেবেই সকলে নিলেন । এবং যাঁরা কথাটাকে মানলেন তাঁরা এটা কাজে খাটাবার কোনো উদ্যোগ করলেন না , তখন আমার ভাবকে কর্মের মধ্যে আকার দান করবার আমি নিজেই কৃতসংকল্প হলাম।. . . ” ( আশ্রমের রূপ ও বিকাশ) এই আবেগ ও ব্যথা থেকেই তাঁর অন্তরাত্মা গেয়ে উঠেছিল, “ যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চলোরে. . .।” এ শুধু আমাদের হতাশ মনের প্রতি করা কবির দয়া নয়, এ হলো নিজের প্রতি করা নিজের প্রতিজ্ঞা । তিনিতো শুধু লেখার টেবিলের কবি নন, খর রৌদ্রে মাঠে ময়দানে গ্রামের জলে কাদায় পা মাড়ানো অবিলাসি কবি। সে কবিতা আবৃত্তি করতে গেলে আমাদেরো ইস্ত্রি করা শান্তিনিকেতনী ফ্যাসনের কুর্তা-পাঞ্জাবির হাতায় কাদা মাখিয়েই করতে হবে। তাই কেউ করে না। ওতোটা ঝুঁকি কেঊ নেয় না। তিনি নিজেই লিখেছেন, “দেশের জন্যে আমার যতকিছু ভাবনা, সুদূর বাল্য কাল থেকে যা আমার মনকে অবিরত আচ্ছন্ন করেছিল, ছন্দোবদ্ধ রূপেই শুধু তা প্রকাশ পায় নি। আমি বরাবরই সেই ভাবনাকে রূপ দিতে চেয়েছি কাজে।” [সজনীকান্ত দাসের ব্যবহৃত উদ্ধৃতি, রবীন্দ্র নাথঃ জীবন ও সাহিত্য’ ( ১৩৬৭), কর্মী রবীন্দ্রনাথ , পৃঃ২৮] । আমরা রবীন্দ্রোত্তর সময়ে কাজ ও চিন্তার দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক নিয়ে বহু আড্ডা দিলাম। রবীন্দ্রনাথের এই আহ্বান আমাদের কানে পৌঁছুলোও না, “ আজ আপনারা কবি রবীন্দ্রনাথকে নয়, তার কর্মের অনুষ্ঠানকে প্রত্যক্ষ করুন, দেখে লিখুন, সকলকে জানিয়ে দিন কত বড় দুঃসাধ্য কাজের ভিতর আমাকে জড়িয়ে ফেলতে হয়েছে। আমি পল্লী প্রকৃতির সৌন্দর্যের যে চিত্র এঁকেছি তা শুধু পল্লীপ্রকৃতির বাহিরেরে সৌন্দর্য; তার ভিতরকার সত্যরূপ যে কী শোচনীয়, কী দুর্দশাগ্রস্ত তা আপনারা প্রত্যক্ষ করুন । আমাকে আপনার বিচার করবেন কবি রূপে নয়, কর্মীরূপে ; এবং সে কর্মের পরিচয় আপনারা এখনই দেখতে পাবেন। এই যে কর্মের ধারা আমি এখানে প্রবর্তন করেছি, এই কার্যের, এই প্রতিষ্ঠানের ভার দেশের লোকের কি গ্রহণ করা উচিত নয় । . . . আজ আপনাদের আমি আমার এই কর্মক্ষেত্রে নিমন্ত্রণ করে এনেছি, কবিতা শোনাবার জন্যে বা কাব্য আলোচনার জন্যে নয়। ” বোঝাই যাচ্ছে কথাগুলো তিনি সাহিত্যের সেবকদের বলছেন। ‘রবিবাসর’ বলে এক সাহিত্য প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত কিছু কবি লেখকদের তিনি শান্তিনিকেতনে আমন্ত্রণ করে এনেছিলেন ১৩৪৩এর শেষ ফাল্গুনে। সাহিত্য আলোচনার জন্যে নয়, “তাই এখানে আজ আপনারা বার বার একই কথা বলেছি। আপনারা যদি আমার এই কর্মানুষ্ঠাকে প্রকৃতভাবে উপলব্ধি করতে পারেন-----তবেই হবে তার প্রকৃত সার্থকতা।” (সম্ভাষণ, পল্লীপ্রকৃতি) তাঁর সেই কর্মানুষ্ঠানের সঙ্গে পরিচিত হবার চেষ্টা নিয়েই আমাদের এই লেখা তৈরি হবে।
দরিদ্রের একমাত্র শক্তি ছিল মনোরথঃ
তাঁর কৈশোরে ‘হিন্দুমেলা’ ও ‘সঞ্জীবনী সভা’র কথা আমরা জানি। হিন্দু মেলা প্রায় একদশক জমিয়ে চললেও দ্বিতীয়টির আয়ু বেশি ছিল না। এ নিয়ে পরে তিনি রসিয়ে রসিয়ে লিখেছেন , “ সেই সভায় আমরা এমন একটি খ্যাপামির তপ্ত হাওয়ার মধ্যে ছিলাম যে, অহরহ উৎসাহে যে আমরা উড়িয়া চলিতাম। লজ্জা ভয় সংকোচ আমাদের কিছুই ছিল না। এই সভায় আমাদের কাজ উত্তেজনার আগুন পোহানো।” ( স্বাদেশিকতা) কিন্তু সেই সভাতে রবীন্দ্রনাথও আক্ষরিক অর্থেই বুকের রক্ত দিয়ে দেশের সেবা করাবার পণ করেছিলেন। উদ্যোগটি ছিল জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের। এর উদ্দেশ্য ছিল শিল্প-সাহিত্য-বাণিজ্য সবদিক দিয়েই ভারতকে স্বনির্ভর করে তুলতে দেশের লোককে উদ্বুদ্ধ করে তোলা। তাই করতে গিয়ে জ্যোতিরিন্দ্রনাথকে বড় সড় ক্ষতির মুখেও পড়তে হয়েছে । তাঁরা কাপড়ের কল তৈরির চেষ্টা নিয়েছিলেন । তাতে এক টুকর মাত্র গামছা তৈরি করে উঠতে পেরেছিলেন। যে দেশলাই তৈরি হয়েছিল, জীবনস্মৃতিতে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, “আমাদের একবাক্সে যে খরচ পড়িতে লাগিল তাহাতে একটা পল্লীর সম্বৎসরেরে চুলা-ধরানো চলিত। আরো একটু অসুবিধা এই হইয়াছিল যে , নিকটে অগ্নিশিখা না থাকিলে তাহাদিগকে জ্বালাইয়া তোলা সহজ ছিলনা।” এক দেশীয় জাহাজ তৈরি করবেন বলে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ একখানা জাহাজের খোল কিনেছিলেন, “ সে খোল একদা ভর্তি হইয়া উঠিল কেবল এঞ্জিনে এবং কামরায় নহে—ঋণে এবং সর্বনাশে।” ( জাহাজের খোল, জীবনস্মৃতি) কিন্তু সেই সভার সব চেষ্টা অন্তত রবীন্দ্রনাথের জীবনে ব্যর্থ যায় নি। তিনি যে প্রতিজ্ঞা রক্ত দিয়ে করেছিলেন তা কখনোই ভুলেন নি। বিশেষ করে দ্বিতীয়বার বিলেত ভ্রমণ করে আসার পর আঠারো শতকের শেষ দশকের শুরুতে জমিদারির কাজে শিলাইদহ ভ্রমণের কথা বহুবার বহুভাবে আলোচিত হয়েছে। এই ভ্রমণে গ্রাম বাংলার সঙ্গে তাঁর যে পরিচয় ঘটেছিল তা তাঁর জীবনের মোড় ফিরিয়ে দিয়েছিল। এই সময়েই তিনি জীবনের স্পষ্ট দিশে নির্দেশ ঠিক করতে পারছেন। তাঁর যে দ্বান্দ্বিক জীবন দর্শন,যাকে তিনি ‘জীবন দেবতা’ বলে চিহ্নিত করছেন তা তখনই তাঁর চিন্তায় স্পষ্ট রূপ নেয় । এর পর আর কোনো সংশয় নেই । তখনই তাঁর জীবনের কর্তব্য স্থির হয়ে যায়। ‘এবার ফিরাও মোরে’র পূর্বোক্ত প্রতিজ্ঞাটিও তখনকারই । মানুষ ও প্রকৃতি, নগর ও গ্রাম , ধনী ও দরিদ্র, ব্রাহ্মণ ও শূদ্র ইত্যাদি দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক নিয়ে এক বিশিষ্ট চিন্তা প্রস্থানই তখন তাঁর গড়ে উঠছে। এবং তিনি অবশ্যই দুর্বল পক্ষে অবস্থান করছেন।
তাঁর প্রতিকার চেষ্টাতে প্রথম প্রথম তিনি দলীয় রাজনীতিতেও যোগ দিয়ে কাজ করবার চেষ্টা করছিলেন। রাজনীতি মানে তখন ছিল জাতীয় কংগ্রেস। তাঁর মনে হচ্ছিল এই কংগ্রেসের দেশের লোকের চাইতে শাসক বিদেশীদের সঙ্গে সম্পর্ক ঘনিষ্ট করতেই বেশি আগ্রহী। তাঁরা নিজেদের জন্যে আবেদন নিবেদনে নিজেদের সীমাবদ্ধ রেখেছিল। এ নিয়ে তাঁরও ঘোর আপত্তি ছিল। কিন্তু সে আপত্তি শুধু ঐ তথাকথিত চরম পন্থীদের মতো নয়। তাঁর আপত্তি ছিল দেশের সত্যকার মানুষ যেখানে থাকে সেই পল্লী নিয়ে এদের কোনো ভাবনা বা কর্মসূচীই নেই। দেশের মানুষের সঙ্গে নেতাদের বিচ্ছিন্নতা ঘোচাতে তাঁর প্রথম প্রয়াস ছিল ১৮৯৭তে নাটোরে অনুষ্ঠিত কংগ্রেসের অধিবেশনে অবনীন্দ্রনাথকে সঙ্গে নিয়ে বাংলাতে অনুষ্ঠান পরিচালনার চেষ্টা করে সফল হওয়া। এর জন্যে প্রতিষ্ঠাতা উমেশ চন্দ্র বন্দোপাধ্যায়ের বিদ্রুপের মুখে পড়ে যে কবিতাটি লিখেছিলেন সেখানেও দেখা যাবে পল্লী তাঁর চিন্তার কেন্দ্রে আছে,“যারা তোমারে দূরে রাখি নিত্য ঘৃণা করে/হে মোর স্বদেশ,/মোরা তারি কাছে ফিরি সম্মানের তরে/পরি তারি বেশ।/.......তোমার যা দৈন্য মাতঃ তাই ভূষা মোর/কেন তাহা ভুলি!/পরধনে ধিক গর্ব ! করি করজোড় /ভরি ভিক্ষার ঝুলি! /পুণ্য হস্ত শাক-অন্ন তুলে দাও পাতে/তাই যেন রুচে;/মোটা বস্ত্র বুনে দাও যদি নিজ হাতে/তাহে লজ্জা ঘুচে।” ( কল্পনা, ভিক্ষায়াং নৈব নৈব চ’) । তার ন’ বছর পর পাবনাতে অনুষ্ঠিত কংগ্রেসের সম্মেলনে রবীন্দ্রনাথকে সভাপতি করা হয়েছিল এই আশাতে যে তাঁর মধ্যস্থতাতে নরম ও চরম পন্থীদের মধ্যে একটা বোঝা পড়া হবে। এর দু’মাস আগে ( ডিসেম্বর,১৯০৭) কংগ্রেসের সুরাট অধিবেশনে দুপক্ষের জুতো ছোঁড়াছুঁড়িও হয়ে গিয়ে ছিল। তখন দেশজুড়ে বঙ্গভঙ্গ নিয়ে আবহাওয়া উত্তাল। দেশের নেতারাই প্রকট করছিলেন দেশের সঙ্গে তাদের বিচ্ছিন্নতা, আর তাঁদের হাতে হিন্দুতে মুসলমানে ঐক্যতো দূর স্বপ্ন। পাবনা অধিবেশন রবীন্দ্রনাথ বাংলাতে পরিচালনা করেন। সেখানে তিনি তখনই হিন্দু –মুসলমানের ভেদ মেটাতে দূরগামী রাজনৈতিক পরিপক্কতার পরিচয় দিয়েছিলেন। তাঁর সেখানে বক্তব্য ছিল, “সমস্ত বিরোধ ও বৈচিত্রের মধ্যে যদি ঐক্যমূলক গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা গড়ে তুলা যায় তবেই দেশের যথার্থ প্রাণশক্তি সঞ্জীবিত হবে। হিন্দু মুসলিম ঐক্য সাধনের জন্য হিন্দুদের ভেদবুদ্ধি দূরীকরণ এবং মুসলমানদের যোগ্যতানুসারে হিন্দুদের মতো সমানভাবে সরকারী চাকুরী ও সম্মান দেওয়া অবশ্য কর্তব্য।” ( রবীন্দ্রনাথের স্বদেশ চিন্তাঃ ড০ শ্রীমন্তকুমার জানা; পৃঃ ১৭২) সে প্রসঙ্গে আমরা আপাততঃ যাচ্ছিনা, যদিও এই চিন্তাও তাঁর দেশকে খুব কাছে থেকে দেখারই পরিণাম। সে অধিবেশনে তিনি সভাপতির ভাষণে বলেছিলেন, “. . . বর্তমান কালের প্রকৃতির সহিত আমাদের দেশের অবস্থার সামঞ্জস্য করিতে না পারিলে আমাদিগকে বিলুপ্ত হইতে হইবে। বর্তমানের সেই প্রকৃতিটি—জোটবাঁধা, ব্যুহবদ্ধতা, অর্গানিজেশন। .....অতএব গ্রামে গ্রামে আমাদের মধ্যে যে বিশ্লিষ্টতা, যে মৃত্যুলক্ষণ দেখা দিয়াছে, গ্রামগুলিকে সত্বর ব্যবস্থাবদ্ধ করিয়া তাহা ঠেকাইতে হইবে। শিক্ষিত সমাজ গণসমাজের মধ্যে তাহাদের কর্মপ্রচেষ্টাকে প্রসারিত করিলে তবেই আমাদের যোগ আপনি সর্বত্র সঞ্চারিত হইতে পারিবে।” কিন্তু নরম-চরম কোনো পক্ষই তাঁর সে আহ্বানে সাড়া দেন নি। এই ছিল তাঁর শেষ প্রত্যক্ষ দলীয় কাজ। এর অনেক পরে শ্রীনিকেতন শিল্পভাণ্ডার উদ্বোধন করতে গিয়ে সেদিনের কথা উল্লেখ করে আক্ষেপ করে তিনি বলেছেন , “ একদা আমাদের রাষ্ট্রযজ্ঞ ভঙ্গ করবার মতো একটা আত্মবিপ্লবের দুর্যোগ দেখা দিয়েছিল। তখন আমার মতো অনধিকারীকেও অগত্যা পাবনা প্রাদেশিক রাষ্ট্রসংসদের সভাপতিপদে বরণ করা হয়েছিল। সেই উপলক্ষে তখনকার অনেক রাষ্ট্রনায়কদের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ ঘটেছে। তাঁদের মধ্যে কোনো কোনো প্রধানদের মধ্যে বলেছিলেম , দেশের বিরাট জনসাধারণকে অন্ধকার নেপথ্যে রেখে রাষ্ট্ররঙ্গভূমিতে যথার্থ আত্মপ্রকাশ চলবে না। দেখলুম সে কথা স্পষ্টভাষাতে উপেক্ষিত হল। সেইদিনই আমি মনে মনে স্থির করলুম কবিকল্পনার পাশেই এই কর্তব্য স্থাপন করতে হবে, অন্যত্র এর স্থান নেই। . . . আমার সেদিনকার মনের আক্ষেপ কেবল যে কোনো কোনো কবিতাতেই প্রকাশ করেছিলুম তা নয়, এই লেখনীবাহন বাহন কবিকে অকস্মাৎ টেনে এনেছিল দুর্গম কাজের ক্ষেত্রে। দরিদ্রের একমাত্র শক্তি ছিল মনোরথ। ”
স্বাজাত্যের অহমিকার থেকে মুক্তি দানের শিক্ষাই আজকের দিনের প্রধান শিক্ষাঃ
পাবনা অধিবেশনের বছর কয় আগেই অবশ্যি তিনি ‘ শিক্ষা ও পল্লীসংস্কারের সংকল্প মনে নিয়ে পদ্মাতীর থেকে শান্তিনিকেতন আশ্রমে’ তাঁর ‘আসন’ বদল করেছেন সে আমরা জানি সবাই। কিন্তু ঐ অধিবেশন তাঁর সে সংকল্পকে দৃঢ় হতে সাহায্য করেছিল, এই মাত্র। শান্তি নিকেতনে তাঁর শিক্ষা সংস্কারেরে প্রয়াসের কথা আমরা মধ্যবিত্তদের কমবেশি সবাই জানি। আজ বিশ্বায়নের ঢেউতে সব্বাই হায়দ্রাবাদ-বাঙালুরুতে ছিটকে পড়লেও , এই বছর কয় আগেও সন্তানকে শান্তিনিকেতনে পাঠিয়ে পড়াতে পারাটা কেবল বাঙালি নয় সারা ভারতের বহু পিতামাতার আভিজাত্যের পক্ষে শ্লাঘার বিষয় ছিল। সুতরাং শান্তিনিকেতন সম্পর্কে কমবেশি সব্বাই জানেন বলে দাবি করলেও তার পেছনের দর্শনটাকে প্রায়ই ভ্রান্ত ব্যাখ্যা করা হয়। বলা হয়ে থাকে যে ওখানে তিনি বৈদিক ভারতের তপোবনের আদর্শে ছাত্র পড়াতে চেয়েছিলেন । বিলেতি শিক্ষা ব্যবস্থার বিরুদ্ধে এক ভারতীয় আদর্শ দাঁড় করাতে চেয়েছিলেন। কিম্বা, ওখানে তিনি প্রাচ্য ও পাশ্চত্যের মিলন ঘটাতে চেয়েছিলেন। ইত্যাদি ইত্যাদি। এগুলো সত্য , কিন্তু অর্ধ সত্য। অর্থাৎ যে ভারতীয় উগ্রজাতীয়তাবাদের তিনি বিরোধীতা করে এসছিলেন, মধ্যবিত্তের প্রিয় সেই দর্শনে তাঁর কর্ম প্রয়াসের যেটুকূ নজরে পড়ে সেটুকু সত্যই বলা হয়ে থাকে । বিলেতি শিক্ষাব্যবস্থাকে তিনি কখনোই বিরোধীতা করেন নি। বরং কোথাও কোথাও তার প্রবল প্রশংসাই আছে। যেমন ‘ভারতবর্ষের ইতিহাসে’, “ইংরেজের নিজের ছেলেদের শিক্ষাপ্রণালী এরূপ নহে---অক্সফোর্ড-কেমব্রিজে তাঁহাদের ছেলে কেবল যে গিলিয়া থাকে তাহা নহে , তাহারা আলোক আলোচনা ও খেলা হইতে বঞ্চিত হয় না। অধ্যাপকদের সঙ্গে তাদের সুদূর কালের সম্বন্ধ নহে। একে তো তাহাদের চতুর্দিগ্বর্তী স্বদেশী শিক্ষাকে সম্পূর্ণরূপে আপন করিয়া লইবার জন্য শিশুকাল হতে সর্বতোভাবে আনুকূল্য করিয়া থাকে, তাহার পরে শিক্ষাপ্রণালী ও অধ্যাপকগণও অনুকূল। আমাদের আদ্যোপান্ত সমস্তই প্রতিকূল, যাহা শিখি তাহা প্রতিকূল, যে উপায়ে শিখি তাহা প্রতিকূল, যে শেখায় সেও প্রতিকূল। ” এই প্রতিকূল শিক্ষাব্যবস্থাটি অবশ্যি ভারতে ব্রিটিশের প্রবর্তিত। এবং আমাদের অতি বিলেত ভক্তির দয়াতে সেটি এই স্বাধীন দেশে এখনো চলছে, রাবীন্দ্রিক শিক্ষাকে দূরে ঠেলে বিলেতি ব্যবস্থাকে দিনে দিনে আরো জোরালো করা হচ্ছে। ভারতে ব্রিটিশ যে শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করেছিল , আমরা জানি এর পেছনে কেবল কিছু অনুগত কেরানি তৈরির রাজনীতি ছিল। এখন যেমন বিশ্বায়নের যুগের রাজনীতি হলো---- বিপিও (BPO) কোম্পানীর সেবাদাস তৈরি করার জন্যে শিক্ষাকে কাজে লাগানো। এই শিক্ষিতরা সবসময়েই মার্কিনি-বিলেতিদের ভক্ত হবে, নিজের দেশ সম্পর্কেও উগ্রজাতীয়তাবাদী হবে। কিন্তু দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ হতদরিদ্রদের পায়ে ঠেলে ‘পিলসুজের’ অন্ধকারে ঠেসে দিয়ে নিজের লজ্জা ঢাকার চেষ্টা নেবে। যেন এরা নেই, কোনো দিন ছিলই না!
রবীন্দ্রনাথ ঠিক এর উল্টোটি করতে চেয়েছিলেন। এমন এক শিক্ষাব্যবস্থা যেখানে কেবল কেরানি নয়, দেশ গড়ার কারিগর তৈরি করা হবে যারা দেশের স্বাধীনতাকে ধরে রাখবে এবং তাকে বিকশিত করবে। তারা সমস্ত সাম্রাজ্যবাদের তথা উগ্রজাতীয়তাবাদের বিরোধী হবে। ‘স্বাজাত্যের অহমিকার থেকে মুক্তি দানের শিক্ষাই আজকের দিনের প্রধান শিক্ষা।’ সুতরাং তাঁর এই ‘প্রধান শিক্ষা’তে সবার সমান নিমন্ত্রণ। তাই শান্তিনিকেতনের সম্প্রসারণ ঘটে শ্রীনিকেতনে ও তাঁর পল্লী সংস্কারের কাজে। অর্থাৎ তাঁর শিক্ষা ও পল্লী সংস্কার দুটো আলাদা কাজ ছিল না মোটেও। তাঁর পল্লী সেবা কেবল লোক দেখানো কাজ ছিল না। এ ছিল রীতিমত স্বাধীনতার রাজনৈতিক আন্দোলনের পরিপূরক। মধ্যবিত্তদের দরিদ্রদের সান্নিধ্যে নিয়ে গিয়ে দেশকে সত্যিকারেরে জানার চেনার , দেশকে অধিকার করাবার পথ চিনিয়ে দেয়া । “ স্বদেশকে লঘুচিত্তে অবজ্ঞা, উপহাস, ঘৃণা---এমন কি অন্যান্য দেশের তুলনায় ছাত্ররা যাহাতে খর্ব করিতে না শেখে সে দিকে বিশেষ দৃষ্টি রাখিতে চাই।”। ( শিক্ষা; তপোবন) উল্টোদিকে, দেশ গড়ার কাজে হত দরিদ্রদেরো সামিল করা ও নেতৃত্বে নিয়ে আসার আন্তরিক প্রয়াস। “ . . আমাদের দেশে সকলের চেয়ে দরকার, হাতে ভিক্ষা তুলিয়া দেওয়া নয়, মনে ভরসা দেওয়া।” ( সমবায় ১; সমবায়নীতি ) এর জন্যেই তাদের মধ্যেও তাঁর শিক্ষা ছড়াবার চেষ্টা। এমন চেষ্টা ‘সর্ব শিক্ষা’র নামে স্বাধীন দেশের সরকার স্বাধীনতার এতো বছর পরে হাতে নিয়েছে, তাও রাস্ট্রসংঘ সহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার চাপে ; আর সেখানে আমরা দেখছি মধ্যবিত্ত আমলা ও শিক্ষকেরা দয়া-দাক্ষিণ্যের কি হাস্যকর নাটকই না করে যাচ্ছেন।
শিলাইদহে জমিদারির কাজ করাবার দিনগুলোতেই তিনি জমিদার কম, শিক্ষা ও গ্রামসংস্কারক বেশি হয়ে উঠবার চেষ্টা নিয়েছিলেন। নিজের ছেলে রথীন্দ্রনাথের এবং সেই সঙ্গে গ্রামের আরো কিছু ছেলেদের পড়াবার জন্যে সেখানেই গৃহ বিদ্যালয় তৈরি করে তাঁর পরীক্ষা নিরীক্ষা শুরু হয়। প্রায় একদশক পরে ১৯০১এ শান্তিনিকেতনে তার সে পরীক্ষার বিস্তার ঘটে। মাস্টারের বেতের ভয়ে বদ্ধ পাকা ঘরে ছাত্রদের বন্দী করা আর প্রকৃতির কোল থেকে এনে ‘তোতাপাখি’কে রাধানাম শেখানো একই কথা। তাই তাঁর বিদ্যালয় ছিল নগর থেকে দূরে গ্রাম্য-প্রাকৃতিক পরিবেশে। সোজা কথাটি এই যে--- মানুষ ও প্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নয়, তার মধ্যে থেকে নিজেকে তার অংশ হিসেবে জেনে বিশ্বকে সত্যকার জানার চেষ্টা । “ ঈশ্বর জলে-স্থলে অগ্নিতে ওষধি বনস্পতিতে সর্বত্র আছেন, এই কথা মনে করিয়া তাঁহাকে প্রণাম করা শান্তিনিকেতনের দিগন্ত প্রাসারিত মাঠের মধ্যে অত্যন্ত সহজ।” ( শিক্ষা; তপোবন) এই সহজ পদ্ধতিটির জন্যে অবশ্যি তাঁকে অনেক হাসি-ঠাট্টা-বিদ্রুপের মুখে পড়তে হয়েছে। প্রাচীন পন্থী বলে নিন্দেও শুনতে হয়েছে। ভারতের বিলেতি শিক্ষাতে শিক্ষিতদের থেকে অন্য কিছু আশা করাই দায় ছিল। কিন্তু শাসকেরা তাঁর উদ্দেশ্যটি ঠিকই ঠিকই ধরতে পেরেছিল। ১৯১২ তে পূর্ববঙ্গ-আসাম সরকার এক গোপন ইস্তাহারে তার কর্মচারীদের জানিয়েছিল শান্তিনিকেতনের শিক্ষাব্যবস্থা তাদের সন্তানদের জন্যে একেবারেই উপযুক্ত নয় ( রবীন্দ্রনাথের স্বদেশ চিন্তা; ড০ শ্রীমন্তকুমার জানা; পৃঃ ৪০০) । অথচ এই কথাতো তাঁর অতি বড় শত্রুতেও বোধহয় বলবে না যে রবীন্দ্রনাথ আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার কোনো ব্যবস্থাই ওখানে করেন নি, বরং সে কাজটাই আরো ভালো করে করবেন বলেই দশক দুই পরে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে পরেই তিনি শান্তিনিকেতনকে বিশ্বভারতিতে উন্নীত করতে উঠে পড়ে লেগে যান। যেখানে শুধু দেশ বিদেশের শিক্ষাই নয়, শিক্ষকও আমন্ত্রিত হচ্ছেন আর তাঁরা একে একে এসে যোগও দিচ্ছেন। আমরা সে ইতিবৃত্ত নিয়ে বেশি লিখব না। কারণ এ নিয়ে প্রচুর লেখা লেখি হয়েই থাকে। আমরা শুধু লিখব ‘বিশ্বভারতীর’ পেছনের দর্শনের কথা। ১৯১৬তে , যখন তিনি যুদ্ধ, সাম্রাজ্যবাদ আর উগ্রজাতীয়তাবাদের থেকে মুক্তির সন্ধানে মত বিনিময় করতে গোটা বিশ্ব চষে বেড়াচ্ছেন আর শান্তিনিকেতনের বিস্তার ঘটিয়ে বিশ্বভারতী গড়বার কথা ভাবছেন, চিকাগো থেকে রথীন্দ্রনাথকে এক চিঠিতে লিখছেন, “শান্তিনিকেতন বিদ্যালয়কে বিশ্বের সঙ্গে ভারতের যোগের সূত্র করে তুলতে হবে----ঐ সার্বজাতিক মনুষ্যত্ব চর্চার কেন্দ্র স্থাপন করতে হবে---স্বাজাতিক সংকীর্ণতার যুগ শেষ হয়ে আসছে----ভবিষ্যতের জন্যে যে বিশ্বজাগতিক মহামিলন যজ্ঞের প্রতিষ্ঠা হচ্ছে তার প্রথম আয়োজন ঐ বোলপুরের প্রান্তরেই হবে।। . . . পৃথিবী থেকে স্বাদেশিক অভিমানের নাগপাশ বন্ধন ছিন্ন করাই আমার শেষ বয়সের কাজ।” অন্যত্র তিনি আরো বলছেন, “ ভারত বর্ষ তার আপন মনকে জানুক এবং আধুনিক সকল লাঞ্ছনা থেকে উদ্ধার লাভ করুক। . . . ভারতবর্ষে কেবল হিন্দু চিত্তকে স্বীকার করলে চলবে না । ভারতবর্ষের সাহিত্যে, শিল্পকলা স্মৃতিবিজ্ঞান প্রভৃতিতেও হিন্দু মুসলমানের সংমিশ্রণে বিচিত্র সৃষ্টি জেগে উঠেছে। তারই পরিচয়ে ভারতবর্ষীয় পূর্ণ পরিচয় । সেই পরিচয় পাবার উপযুক্ত কোনো শিক্ষাস্থানের প্রতিষ্ঠা হয়নি বলেই তো আমাদের শিক্ষা অসম্পূর্ণ ও দুর্বল। . . . মানুষের জ্ঞানচর্চার বৃহৎ ক্ষেত্রের সঙ্গে যোগ হলেই তবে আমাদের বিদ্যার সার্থকতা হবে। বিশ্বভারতীর এই লক্ষ্য সার্থক হোক ।” ( বিশ্বভারতী) এবং সর্বোপরী , “ আমাদের দেশে কেবলমাত্র কেরানীগিরি ওকালতি ডাক্তারি ডেপুটিগিরি দারগাগিরি মুনসফি প্রভৃতি ভদ্র সমাজে প্রচলিত কয়েকটি ব্যবসায়ের সঙ্গেই আমাদের আধুনিক শিক্ষার প্রত্যক্ষ যোগ। . . . ভারতবর্ষে যদি সত্য বিদ্যালয় স্থাপিত হয় তবে গোড়া হইতেই সে বিদ্যালয় তাহার অর্থশাস্ত্র তাহার কৃষিতত্ব তাহার স্বাস্থ্যবিদ্যা তাহার সমস্ত ব্যবহারিক বিজ্ঞানকে আপন প্রতিষ্ঠানের চতুর্দিকবর্তী পল্লীর মধ্যে প্রয়োগ করিয়া দেশের জীবনযাত্রার কেন্দ্রে স্থান অধিকার করিবে। এইরূপ আদর্শ বিদ্যালয়কে আমি ‘বিশ্বভারতী’ নাম দিবার প্রস্তাব করিয়াছি ।” ( বিশ্বভারতী) বিদ্যালয়-বিশ্ববিদ্যালয়কে যারা ব্রিটিশের শেখানো পথে ‘পাশ করে চাকরি পাবার জন্যে জরুরি মার্কসীট’ পাবার কল বলে গণ্য করেন তাঁরা অবশ্যি এ কথাগুলোর মানে বুঝে উঠতে পারবেন না । এ পর্যন্ত এসে এটাতো স্পষ্ট যে রবীন্দ্রনাথ সেভাবে ভাবতেনই না। তাঁর চিন্তাতে , “ . . . শিক্ষার প্রকৃত ক্ষেত্র সেখানেই যেখানে বিদ্যার উদ্ভাবনা চলিতেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের মুখ্য কাজ বিদ্যার উৎপাদন, তার গৌণ কাজ সেই বিদ্যাকে দান করা।” ( বিশ্বভারতী)
এই সব শ্রান্ত শুষ্ক ভগ্ন বুকে ধ্বনিয়া তুলিতে হবে আশাঃ
এই যে বিদ্যালয়ের শিক্ষাকে পাশের পল্লীতে প্রয়োগের কথা বললেন সেই চিন্তার থেকেই প্রায় সমকালে শ্রীনিকেতনের প্রতিষ্ঠা। মধ্যবিত্ত চিন্তায় শ্রীনিকেতনের কথা যদিও খুব একটা শুনতে পাওয়া যায় না, তবু আসলে এটি বিশ্বভারতীরই বিকশিত রূপ। একে ছাড়া রবীন্দ্রনাথের বিশ্বভারতী অসম্পূর্ণ হতো। শ্রীমন্ত কুমার জানা লিখেছেন, “ ‘বিশ্বভারতী’ ও ‘শ্রীনিকেতন’ মুক্ত বিহঙ্গের দুই পক্ষ ।” ( রবীন্দ্রনাথের স্বদেশচিন্তা; পৃঃ ৪২৪) । একে নিয়ে আমরা একটু বিস্তৃত লিখব । কিন্তু তার আগে এই কথাটি স্পষ্ট করা ভালো যে যদিও তাঁর শিক্ষা ও পল্লী চিন্তাকে কখনোই বিশ্লিষ্ট করা সম্ভব নয়, তবু শ্রীনিকেতন শুধু বিশ্বভারতীর উন্নীত রূপ নয়। বা বিশ্বভারতী করতে গিয়ে তাঁর মাথায় এই চিন্তা এসছে তাও নয়। আসলে সেই শিলাইদহের দিনগুলো থেকে পল্লী ও তার মানুষকে নিয়ে তাঁর যা কিছু কাজ, যার অনেকটাই আপাত দৃষ্টিতে শিক্ষার থেকে স্বতন্ত্র ও সমান্তরাল শ্রীনিকেতনে সেই সমান্তরাল ধারাটি এসে এক বিন্দুতে মিলেছে।
শিলাইদহে জমিদারির কাজে প্রথম যাবার দিনগুলোতেই তিনি প্রজাদের মধ্যে বৈজ্ঞানিক জ্ঞানবুদ্ধি ছড়াবার চেষ্টা, পল্লীমঙ্গলের কাজ, কুটির শিল্প ও উন্নত প্রযুক্তি প্রচলনের চেষ্টা হাতে নিয়েছিলেন। কুষ্ঠিয়াতে তিনি তখন গণেন্দ্রনাথ ও সুরেন্দ্রনাথকে সঙ্গে নিয়ে এক বয়ন শিল্প শেখাবার বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তাতে তাঁকে অনেক ক্ষতি স্বীকার করতে হয়েছিল। সজনীকান্ত দাসকে বলেছেন, “... ওই তাঁতের সুতো ধরে আমি সর্বনাশের দরজা পর্যন্ত পৌছতেও ইতস্তত করিনি। সুতো সরবরাহ করে যাঁরা আমাকে ঠকিয়েছিলেন, তাঁরা আমার দেশের লোক।” ( কর্মী রবীন্দ্রনাথ ; সজনী কান্ত দাস ) তাঁর জমিদারির আমলাতন্ত্রেও সংস্কার এনেছিলেন। আমলারা প্রথমে তার বিরোধীতা করেছিল। বিরোধীতার আসল কারণ ছিল এতে তাদের অভ্যস্ত কাজের চাল বিগড়ে যাচ্ছিল , কিন্তু বাইরে বলছিল আদালতে কোনো মামলা গড়ালে বা ব্রিটিশ প্রশাসনের সঙ্গে কোনো কাজ করতে হলে তারা রবীন্দ্রনাথের নতুন ধরণ বুঝি বুঝে উঠতে পারবে না । তাতে সমস্যা বাড়বে বই কমবে না। রবীন্দ্রনাথ এতে কান দেন নি। কারণ তিনি প্রথা মেনে চলবার লোক ছিলেন না। আর কোনো উপরওয়ালাদের সন্তুষ্ট করবার লোকতো একেবারেই নন। সাধারণ মামলা মোকদ্দমাতে যাতে আদালতের দোয়ারে দোয়ারে গাঁয়ের লোককে ঘুরে বেড়াতে না হয় তিনি তাই তাদের মধ্যে সালিসীবিচারের ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন। বিরাহিমপুর ও কালিগ্রাম পরগণাতে ক’টি গ্রাম নিয়ে এক একটি বিচার সভা স্থাপন করেন। সমস্ত পরগণার জন্যে পাঁচজন সভ্য নিয়ে এক একটি বিচার সভা স্থাপন করেন। সেখানে নিয়ম হয় যে ফৌজদারি ছাড়া অন্য কোনো মামলা আদালতে নিয়ে যাওয়া হবে না। এতে করে প্রজাদের অনেক অর্থ ও শ্রমের সাশ্রয় হয়েছিল।
বিচার ব্যবস্থার সঙ্গে গ্রাম সংস্কার ওতোপ্রোত জড়িয়েছিল । এই আপিল সভা থেকেই রবীন্দ্রনাথের মনে গ্রাম সংস্কারেরে জন্যে বৃহৎ সাংগঠনিক ব্যবস্থার চিন্তা দেখা দেয়। বিরাহিমপুর পরগণাকে পাঁচটি মণ্ডলে ভাগ করে প্রত্যেক মণ্ডলের এক এক জন অধ্যক্ষের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। এই অধ্যক্ষদের তিনি তাঁর জমিদারির কর্মচারীদের থেকে মনোনীত করেছিলেন। সালিশি বিচারেরে দিকটি ছাড়াও তাদের কাজ ছিল পথঘাট সংস্কার করা, জলকষ্টের সমাধান করা, বিদ্যালয় স্থাপন করা, জঙ্গল পরিষ্কার করা, দুর্ভিক্ষের জন্যে ধর্মগোলা বসানো । কর্মচারিদের দিয়ে কাজ তেমন না এগুনোতে, শ্রীমন্তকুমার জানা জানাচ্ছেন, বাইরে থেকে তাঁর বিশস্ত ব্যক্তি তথা শান্তিনিকেতনের কিছু শিক্ষকদের উপর কাজ দেখার ভার দেন। কিন্তু এমন কাজও পুলিশের কুনজরে পড়াতে বেশিদূর এগোয় নি। কালিগ্রাম পরগণাতেও এমন হিতৈষী সভা স্থাপিত হয়েছিল। এবং সেখানকার কাজ বেশ ভালোই এগিয়েছিল । ( রবীন্দ্রনাথের স্বদেশচিন্তা )
রবীন্দ্রনাথ নোবেল পাওয়াতে দেশে বিদেশে তাঁর প্রতিষ্ঠা বেড়েছিল। এখনো যে জেনে না জেনে তাঁকে নিয়ে বাঙালি তথা ভারতীয়ের গর্বের শেষ নেই তার অন্যতম কারণতো এই নোবেল পুরস্কার । কিন্তু সেই নোবেল পুরস্কারেরে টাকাগুলো কোথায় গিয়েছিল সে নিয়ে আমাদের হয় কৌতুহল নেই অথবা জানা নেই। তা এর জন্যে যে এগুলো যে কাজে লেগেছিল সে কাজটি সম্পর্কে আমাদের কোনো আগ্রহ নেই। সে টাকাতা গেছিল সেখানে যেখানে তাঁর প্রাণটি ছিল। ১৯০৫এ পতিসরে তিনি এক কৃষি ব্যাঙ্ক খুলে রেখেছিলেন। সে টাকাগুলো সেই ব্যাঙ্কে রাখেন পুঁজি বাড়াবার জন্যে। এটি তাঁর কোনো নিজের জন্যে করা ব্যবসায়িক বুদ্ধি ছিল না। বরং মহাজনদের ভারী সুদের বোঝা থেকে গরিব চাষিদের মুক্ত করতে , তাদের মধ্যে সঞ্চয় অভ্যাস গড়ে তুলতে, সাংগঠনিক ক্ষমতার বিকাশ ঘটাতে তিনি এই ব্যাঙ্ক প্রতিষ্ঠা করেন। সেখানে সুদের হার ছিল নাম মাত্র।
আমরা অনেকেই এমন দেশের কাজ করে গায়ে পড়ে লোকের উপকার করি যশ বাড়াবার জন্যে। এর জন্যে নিজের সর্বস্ব দিতে মোটেও প্রস্তুত থাকিনা । রবীন্দ্রনাথের কাছে এই ছিল দেশের যথার্থ সাধনা। তাঁর বিশ্বাস ছিল এই পথেই দেশের যথার্থ মুক্তি আসবে এবং তাকে রক্ষা করা যাবে। তাই তিনি যে শুধু এই গ্রামের বিদ্যালয়ে নিজের সন্তানদের শিক্ষাতে হাতে খড়ি করিয়েছিলেন তাই নয়, একমাত্র পুত্র রথীন্দ্রনাথে যাতে উত্তরাধীকার সূত্রে একেই জীবনের কাজ হিসেবে গ্রহণ করেন তারো ব্যবস্থা করতে সন্তোষ চন্দ্র মজুমদারের সঙ্গে তাঁকে ১৯০৬এ আমেরিকার ইলিওনিস বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠান কৃষিবিজ্ঞানে শিক্ষা নিতে। এ নিয়ে বাবার কোনো পরিকল্পনার কথা রথীন্দ্রনাথ শুরুতে জানতেন না। ‘পিতৃস্মৃতি’তে রথীন্দ্রনাথ লিখেছেন, “ আমেরিকায় যে তিন-চার বছর কলেজে পড়েছিলাম সেই সময় বাবা জমিদারিতে প্রজাদের মধ্যে যে কত রকমের কাজে হাত দিয়েছেন তা কিছুই জানতুম না। বাবা যখন গল্পচ্ছলে এই সব কথা আমাকে বলতেন আমি মুগ্ধ হয়ে শুনে যেতুম। সবশেষে বললেন----আমি যেসব কাজ করতে চেয়েছিলুম কিন্তু এখনো হাত দিতে পারিনি, তোকে সেগুলি করতে হবে---বিশেষতঃ কৃষির উন্নতির চেষ্টা করতে হবে।” বোধহয় চাষাভূষাদের মধ্যে কাজ করেছিলেন বলেই রবীন্দ্রনাথের এই ছেলেটির সম্পর্কে আমরা অতি অল্পই খবর জানি। মাঝে মাঝে রবীন্দ্রজীবন প্রসঙ্গে তাঁর নাম আসে। কিন্তু প্রায় বাবার সমান জীবনকাল নিয়ে তিনিই যে বাবার দেশসাধনার যথার্থ উত্তরসূরীর দায়িত্ব নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করেছিলেন, এই তথ্যের উল্লেখও আমাদের কাছে অপ্রয়োজনীয় বলে মনে হয়। বরং আমরা অনেক বেশি আগ্রহী কাব্যসাহিত্যে রবীন্দ্রনাথের উত্তরসূরীদের নিয়ে। আমেরিকার থেকে ফিরে এসে রথীন্দ্রনাথ শ্রীনিকেতনের কাজে যোগ দেবেন ও জীবনের শেষে স্বাধীন ভারতের সরকার বিশ্বভারতীকে কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদা দিলে তিনি তার প্রথম উপাচার্যের দায়িত্ব বহন করবেন । কিন্তু সে অনেক পরেরে কথা। রথীন্দ্রনাথ ফিরে এসে প্রথমে শান্তিনিকেতনে ও সমান্তরালে পুববাংলার জমিদারীতে পল্লী সংস্কারেরে কাজে বাবার সহায়ক হন। তাঁর হাতে সে কাজগুলোর দায়িত্ব দিয়ে রবীন্দ্রনাথ নিশ্চিন্তে বিদেশ ভ্রমণে যেতে পারছেন তখন। ১৯১২তে এক চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ লিখছেন, “ বোলপুরে একটা ধানভানা কল চলছে—সেই রকম একটা কল এখানে ( পতিসরে) আনাতে পারলে বিশেষ কাজে লাগবে। এ দেশ ধানেরই দেশ—বোলপুরের চেয়ে অনেক বেশি ধান এখানে জন্মায় । . . . এই কলের সন্ধান দেখিস। তারপর এখানকার চাষাদের কোন industry শেখানো যেতে পারে সেই কথা ভাবছিলুম। এখানে ধান ছাড়া আর কিছুই জন্মায় না। এদের থাকবার মধ্যে কেবল শক্ত এঁটেল মাটি আছে। আমি জানতা চাই pottery জিনিসটকে cottage industry রূপে গণ্য করা চলে কিনা। একবার খবার নিয়ে দেখিস---অর্থাৎ ছোটোখাটো furnace আনিয়ে এক গ্রামের, লোক মিশে এ কাজ চালানো সম্ভবপর কিনা। . . .আর একটা জিনিস আছে ছাতা তৈরি করতে শেখানো। সেরকম শেখাবার লোক যদি পাওয়া যায় তাহলে শিলাইদহ অঞ্চলে এই কাজটা চালানো যেতে পারে। নগেন্দ্র বলছিল খোলা তৈরী করতে পারে এমন কুমোর এখানে আসতে পারলে বিস্তর উপকার হয়। যাই হোক, ধানভানা কল,potteryর চাক ও ছাতা তৈরির শিক্ষকের খবর নিস ভুলিসনে।” ( চিঠিপত্র থেকে ড০ শ্রীমন্তকুমার জানার উদ্ধৃতি; রবীন্দ্রনাথের স্বদেশ চিন্তা)
কিন্তু জমিদারি এলাকাতে কাজ ভালো রকম এগুচ্ছিল না। তা ছাড়া পল্লীকে নিয়ে তাঁর কাজগুলোকে ক্রমেই তিনি শান্তিনিকেতনের সঙ্গে যুক্ত করতে আগ্রহী হয়ে উঠছিলেন। লণ্ডনে থাকতেই ১৯১২তে তিনি আট হাজার টাকা দিয়ে সুরুলে একটি ভাঙ্গা বাড়ি কেনেন। এটি কেনা তাঁর পক্ষে খুব সহজ কাজ ছিল না। সন্তোষ মজুমদারকে লিখছেন, “ রথীর জন্যে জমি সংগ্রহ করে বাড়ী ও laboratory তৈরি করতে বিস্তর খরচ পড়বে এবং সে খুব সম্ভব আমার সাধ্যাতীত হবে; এর জন্যে আমার আর্থিক দুর্গতি সত্বেও এই বাড়ি কিনতে হল।” মনে হবে যেন ছেলের ভবিষ্যৎ জীবন ও জীবিকা সুরক্ষিত করবার জন্যে এ আর দশজন দ্বায়িত্বশীল পিতার মতোই উদ্বেগের মধ্যে পড়েছেন রবীন্দ্রনাথ। কিন্তু ইতিমধ্যে আমাদের কাছে এটি স্পষ্ট হওয়া উচিত যে এই ‘রথীর জন্যে’ কথাটার মানে সেরকম কিছু নয়। তার থেকে বহু বৃহৎ, বহু মহৎ। পরের বছর বহু অর্থ ব্যয়ে সে বাড়ির সংস্কার করে ঐ বাড়িকে কেন্দ্র করে সুরুলে কাজ শুরু হয় । কিন্তু ওখানেও কাজ তেমন ভালো হয় নি। ওখানে শ্রীনিকেতন প্রতিষ্ঠার আগে রবীন্দ্রনাথকে আরো কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষার মধ্যে দিয়ে যেতে হবে। বিশেষ করে এর পর কিছু দিন তাঁর জমিদারিতে করা কাজ ছিল ব্যাপক ও বিশাল। একমাত্র রাজরোষে পড়েই সে কাজ বন্ধ হয়ে যেতে পেরেছিল।
১৯১৫তে রবীন্দ্রনাথের প্রেরণাতে ড০ দ্বিজেন্দ্রনাথ মৈত্রের প্রচেষ্টায় ‘বঙ্গীয় হিতসাধন মণ্ডলী’ নামে এক প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। এই প্রতিষ্ঠানের হয়ে কাজ করাবার জন্যে তখন অতুল সেন নামের এক অসামান্য ব্যক্তিত্ব এসে যোগ দেন। তাঁর নেতৃত্বে জমিদারী এলাকাতেই বেশ কিছু কাজ ভালো রকম এগোবার সুযোগ পায়। মূলত পাঁচটি ভাগে কাজ সামাল দিতেন অতুল সেন—সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করা , প্রাথমিক শিক্ষার ব্যবস্থা করা, ঋণদায় থেকে চাষিদের মুক্ত করা, ও সালিশীবিচারে গ্রাম্য কলহের নিষ্পত্তি। পতিসর, কামতা ও রাতোয়ালে কাজ শুরু হয়। তিনটি হাসপাতাল স্থাপিত হয়। চিকিৎসার সঙ্গে ওখানকার ঔষধালয় থেকে বিনামূল্যে ঔষধ দেবার ব্যবস্থাও করা হয়। এক দুটো নয়, শিশু বৃদ্ধের জন্যে প্রায় শ’ দু-এক নিম্নপ্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। সেগুলো ছিল পুরো অবৈতনিক এবং পড়ানো হতো সকালে ও রাতে দু’বেলা। বিদ্যালয়গুলোর জন্যে পাঠ্যসূচী রবীন্দ্রনাথ নিজেই তৈরি করে দিয়েছিলেন। অক্ষর জ্ঞানের পর শেখানো হতো সাধারণ লেখাপড়া ও গণিত। তার পর একে একে শিক্ষার্থীদের শেখানো হতো ভূগোল, ইতিহাস, সাধারণ বিজ্ঞান এবং অতি অবশ্যই জনস্বাস্থ্য । অতুল সেনের নেতৃত্বে চাষিরা নিজেরাই বিনা পরিশ্রমে গায়ে গতরে খেটে ওখানে পুকুর ও কুয়ো খনন করেছিল, রাস্তা তৈরি ও মেরামত করেছিল এবং প্রয়োজনে জঙ্গল পরিষ্কার করেছিল । এক দুটো নয় ছ’শ গ্রাম নিয়ে রবীন্দ্রনাথ ও অতুল সেন এই বিশাল কর্ম যজ্ঞ ফেঁদেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ নিজেও এ কাজে টাকা ঢালতেন , প্রজারাও সংগ্রহ করত কিছু। এতো এতো কাজ হচ্ছিল তার পরেও রবীন্দ্রনাথ লিখছেন এক চিঠিতে, “বৎসরে ১১০০০ টাকার আয় দাঁড়াইয়াছে।” শুধু কি কাজ ? ‘বিশ্রাম কাজের অঙ্গ’ ---সে বিশ্রামও যাতে বিনোদনে ভরে উঠে সেদিকেও তাঁর চোখ ছিল। নির্দেশ ছিল বৎসরে একদিন বৃক্ষরোপন উৎসব করবার। সে উৎসবে , সে কাজেও যাতে তাল ছন্দ লয়ের ছোঁয়া লাগে সেদিকেও কবি মনের খেয়ালের ত্রুটি ছিল না । প্রতিটি কুড়ে ঘর যাতে দু’চারটি বেল, গোলাপ, যুঁই ফুলের গাছে সেজে উঠে সেদিকেও নজর ছিল তাদের। কিন্তু অচিরেই সেই নিরীহ কাজ ব্রিটিশের কুনজরে পড়ে। ১৯১৬তে অতুল সেন ও তাঁর কিছু সঙ্গী উগ্রপন্থী হবার মিথ্যে মামলাতে জড়িয়ে প্রথমে বন্দী ও পরে নজর বন্দী হয়ে পড়েন । এমন কাণ্ড আমরা স্বাধীন ভারতেও আখছার দেখে অভ্যস্ত। এই সেদিন পর্যন্ত ছত্রিশ গড়ের চিকৎসক বিনায়ক সেন বছর দুই ‘উগ্রপন্থী’ সন্দেহে বিনা বিচারে জেল খেটে বেরুলেন। অসমে সঞ্জয় ঘোষ কিম্বা বিহারে সরিতা-মহেশের মতো নিরপরাধ কর্মঠ তরুণ তরুণী খুন হলেন। অতুল সেনের অবর্তমানে ওখানকার কাজ দেখার জন্যে তেমন যোগ্য কেঊ ছিল না। ওখানে কাজ তেমন আর ভালো এগোয় নি তার পরে । একটা পাকা ভিত তৈরি হবার জন্যে যেটুকু সময়ের দরকার ছিল তততা তাঁরা সেখানে পান নি।
রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর কজের উপর প্রত্যক্ষ শাসকীয় দমন কার্য নিয়ে আমাদের পণ্ডিতেরা আশ্চর্যরকম নীরব। বোধকরি রবীন্দ্রনাথের এই শাসকীয় শ্রেণিবিরোধী কাজগুলো আজও তঁদের খুব একটা পছন্দ নয় বলেই । অথচ সাম্রাজ্যবাদ ও উগ্রজাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধাচরণ করবার জন্যে বিদেশের মাটিতে একবার তাঁকে হত্যা করবার ষঢ়যন্ত্রও হয়েছিল ! সে প্রসঙ্গে আমরা আপাততঃ যাচ্ছি না। কিন্তু আমাদের রবীন্দ্রপ্রীতিও যে শ্রেণিদৃষ্টিতে নির্ণীত তা দেখাবার জন্যে এই তথ্যের উল্লেখ জরুরি বলে মনে হয়। পণ্ডিতদের এই উপেক্ষার এক করুণ কিন্তু সরল কারণ ব্যাখ্যা অবশ্য রবীন্দ্রনাথে নিজেও করেছেন। তাঁর সেদিনগুলোর অভিজ্ঞতার শরিক করতে সজনী কান্ত দাসকে বলেছেন, “ ভিক্ষাপাত্র হাতে খালি পায়ে পাগলের মতো ঘুরে বেড়িয়েছি পথে পথে, দেশের লোকের প্রাণে সাড়া জাগাবার জন্যে দিনের পর দিন কত অখ্যাত অজ্ঞাত জায়গায় সভা করে বক্তৃতা দিয়ে ফিরেছি। এক মুহূর্ত নিশ্বাস ফেলবার সময় ছিল না। শুধু সভা আর পরামর্শ----পরামর্শ আর কাজ। দুর্ভাগ্যের বিষয় সে ইতিহাস কেউ লিখে রাখে নি। আজ চেষ্টা করেও তোমরা সে নষ্ট ইতিহাস উদ্ধার করতে পারবে না; টুকরো টুকরো খবর পাবে, কিন্তু আমাদের সেই নিরলস সাধনার সম্পূর্ণ ইতিহাস কোনোদিনই আর লোকচক্ষুর গোচরে আসবে না। আসবে না কারণ এই যে, আমারই স্বহস্তে রচিত সেই বিপুল উদ্যমের খসড়া যাদের হাতে ছিল, রাজার প্রহরীর ভয়ে তারা একদিন তা নিঃশেষে অগ্নিসাৎ করে নিশ্চিত হয়েছিলেন। আমার অনেকদিনের অনেক ভাবনা সেই সঙ্গে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।” ( রবীন্দ্রনাথঃ জীবন ও সাহিত্য )
সেদিনকার নথিপত্র অনেক কিছুই পুড়ে শেষ হয়ে গেছে; অনেক সঙ্গীরা বিশ্বাসঘাতকতাও করেছে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ তাতে দমে যান নি। এবারে তিনি পরিকল্পনা নিলেন আরো ব্যাপক এবং বিশাল । তাঁর এই পুনরুদ্যমের পরিণাম শ্রীনিকেতন। কিন্তু তার আগে তিনি মোঘল যুগের বৈষ্ণব-সুফী গুরুদের মতো ভারতভ্রমণে বেরুলেন। নেপালচন্দ্র রায় প্রমুখ ক’জন শান্তিনিকেতনের শিক্ষককে সঙ্গে নিয়ে দেশের কৃষি তীর্থ ঘুরে দেখতে বেরুলেন। ইতিমধ্যে একবার আমেরিকা ভ্রমণের সময় তাঁর সাক্ষাৎ ঘটে কৃষি বিজ্ঞানের নতুন স্নাতক লিওনার্ড এলমহার্ষ্টের সঙ্গে । এক আশ্চর্য পুরুষ ছিলেন এই এলমহার্স্ট। রবীন্দ্র জীবনে আরো বহু বিদেশী বুদ্ধিজীবিদের কথা শোনা যায়। কিন্তু যথারীতি চাষাভুষাদের জন্যে জীবনপাত করা এই ভদ্রলোকের কথা ভ্রমক্রমেও কোথাও উল্লেখ হয় না! অথচ ইনি যে সে লোক ছিলেন না । ইচ্ছে করলেই এক রাজকীয় জীবন যাপন করতে পারতেন। প্রথমে টিনিটি কলেজে, পরে কেম্ব্রিজে পড়াশোনার পাট চুকিয়ে তিনি আমেরিকা গিয়ে কমেল বিশ্ববিদ্যালয়ে কৃষি বিজ্ঞান অধ্যয়ন করেন। সেখানে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর দেখা হয় । তিনি কোনো অর্থবহ কাজের সন্ধানে ভারতে আসতে চাইছিলেন। রবীন্দ্রনাথ তাঁকে তাঁর সঙ্গে এসে গ্রামের কাজে যোগ দিতে বললে এলমহার্স্ট সানন্দে তা স্বীকার করেন। তাঁর নেতৃত্বে সেই সুরুলের বাড়িতে ১৯২২এর ৬ ফেব্রুয়ারী বিশ্বভারতীর পল্লী উন্নয়ন কেন্দ্র তথা শ্রীনিকেতন যাত্রা শুরু করে। শ্রীনিকেতনের নেতৃত্বে তিনি তিন বছর ছিলেন । ১৯২৫ তে দেশে ফিরে যান। সেখানে ডেভনসায়ারে ওই শ্রীনিকেতনের আদর্শে বিখ্যাত ডার্টিংটন হলের (http://en.wikipedia.org/wiki/Dartington_Hall) প্রতিষ্ঠা করেন। দেশে ফিরে সেই নব যুবক ডরথি স্ট্রেইট বলে এক মহিলাকে বিয়েও করেন। এর পর এই দু’জনে নিজেদের কাজ সামাল দেবার পরেও পরের পঁচিশ বছর শ্রীনিকেতনের কাজের জন্যও টাকা পাঠিয়ে গেছেন।। এই এলমহর্স্টের চেষ্টাতে এবারে আর শুধু দেশ নয় , বিদেশ থেকেও প্রচুর অর্থ, প্রযুক্তি ও সহায়ক লোক পেতে শুরু করলেন রবীন্দ্রনাথ। অতুল সেনেদের ব্যর্থতার পর এ ছিল তাঁর এক অবিশ্বাস্য পুনরুত্থান । প্রভাত কুমার লিখেছেন, “ অর্থ এল আমেরিকা থেকে, শক্তি ও বিজ্ঞান এল ইংলণ্ড থেকে, কর্মকেন্দ্র হ’ল বোলপুরের নিকটবর্তী এক গ্রাম।” ( রবীন্দ্রজীবন কথা)
এলমহার্স্ট প্রথমেই গ্রামে গ্রামে শিক্ষা বিস্তারের কাজে মন দিলেন। স্থানীয় পাঠাশালার ছাত্র ও শিক্ষকদেরই বাড়ি বাড়ি গিয়ে ছাত্র পড়াবার কাজে লাগানো হলো। দ্বিতীয় বছরে বিনা বেতনে গরিব ও অনাথ ছাত্রদের পড়াবার জন্যে শান্তিনিকেতনের কাছে শিক্ষাসত্র খোলা হলো। এ ছিল শ্রীনিকেতনেরই গ্রামোন্নয়ন পরিকল্পনার অঙ্গ। উদ্দেশ্য ছিল এরাই পাঠ শেষে স্বাবলম্বী শিক্ষিত হয়ে যখন তারুণ্যে পৌঁছুবে গ্রাম সংস্কার ও উন্নত সমাজ গঠনের কাজ হাতে নিয়ে এরাই গ্রামে গ্রামে কাজ করবে। গ্রামীণ জনতার মাঝখান থেকে নেতৃত্ব গড়ে না তুলতে পারাটা কালিগ্রামের অতুল সেনকে নিয়ে করা পরীক্ষার এক ব্যর্থতার দিক ছিল। এখানে এলমহার্স্টের নেতৃত্বে সেই খামতির দিকটা শোধরাবার আয়োজন হতে থাকল। এদের কারু শিল্পের সঙ্গে গৃহ শিল্পে ( home science) শিক্ষা দেবার ব্যবস্থা হয়েছিল। এদের মধ্যেকার চারু ও কারু বৃত্তিকে উসকে দেয়াটা উদ্দেশ্য ছিল। দৈনন্দিন নিজেদের প্রয়োজনীয় কাজ তাদের নিজেদেরই করতে হতো। যেমন জলতোলা, বাগান করা , বাজার করা, রান্না করা। যাতে শুরু থেকেই এরা স্বাবলম্বী হয়ে উঠে। আজ যাকে আমরা ITI বললে সহজে বুঝি ----এ ছিল তারই এক প্রাথমিক ধরণের রূপ। তিন বছর পর ১৯২৭এ শিক্ষা সত্র শ্রীনিকেতনে স্থানান্তরিত হয়। কারণ শান্তিনিকেতনের অপেক্ষাকৃত ধনী ও উচ্চবিত্তদের পরিবেশে এটি চালানো যাচ্ছিল না। এখানেও চিকিৎসা কেন্দ্র, ম্যালেরিয়া নিবারণ, রাস্তা তৈরি , ক্ষুদ্র ঋণদান ইত্যাদির কাজ তাঁর জমিদারির থেকে আর ব্যাপক আকারে শুরু হলো।
শিক্ষাসত্রের ভেতরে ও বাইরে যাদের মধ্যে শিক্ষা ছড়াবার কাজ হচ্ছিল তারা যাতে অর্থনীতি, দর্শন, ইতিহাস, কৃষি , শিল্প ও বিজ্ঞান ইত্যাদি সব বিষয়ে মোটামোটি কাজ চালাবার ধরণে শিক্ষা লাভ করতে পারে তার জন্যে সহজ সরল ভাষায় লোকশিক্ষা গ্রন্থমালা ছেপে বের করা হয়েছিল। এর অনেক বই স্বয়ং রবীন্দ্রনাথই রচনা করে প্রকাশ করেন, অন্য আরো অনেকে অবশ্য যে কাজ সাহায্য করেছিলেন। ঐ সময় থেকে কিছু কিছু আধুনিক উন্নত কারিগরী প্রযুক্তিরও আমদানি হলো শ্রীনিকেতনে। দরিদ্র কৃষকদের কাজ বলেই যাতে তা শ্রী ও আনন্দহীন না হয়ে পড়ে সেদিকে রবীন্দ্রনাথের সূক্ষ্ম দৃষ্টি ছিল। জমিদারিতে যখন অতুল সেনের নেতৃত্ব কাজ চলছিল তখনো তিনি বনমহোৎসবের প্রচলন করাবার পরামর্শ দিচ্ছেন। শ্রীনিকেতনে ১৯২৮এর ১৫ জুলাই হলকর্ষণ উৎসব পালিত হয়। দু’মাস পরে ১৭ ভাদ্র,সম্ভবত ২ সেপ্টেম্বরে বনমহোৎসবেরও শুরু হয়। এসব উৎসবে শ্রেণি নির্বিশেষে সবাই যাতে যোগ দেয় তার ব্যবস্থা হয়েছিল । উচ্চবিত্তদের মধ্যে হলকর্ষণের প্রতি থাকা বিকর্ষণ দূর করাও রবীন্দ্রনাথে উদ্দেশ্য ছিল। এ ছিল গান্ধির চরখার বিকল্পও বটে। গান্ধির চরখা কাটার প্রস্তাব তাঁর চিন্তাতে সমর্থণ পায় নি এ আমরা প্রায় সবাই জানি। চরখা রবীন্দ্রনাথের কাছে ছিল যান্ত্রিকতার প্রতীক। এটি মানুষকে যন্ত্র করে তুলে, স্রষ্টা করে না। এক জন একা বিচ্ছিন্ন বসেও চরখা কাটতে পারে, কিন্তু হলকর্ষণে একজন মানুষ যুক্ত হয় প্রকৃতি এবং সেই সঙ্গে আরো দশটি মানুষের সঙ্গে। তাছাড়া যদি এ ভাবাও যায় যে চরখা স্বনির্ভর কুটির শিল্প গড়ে বিদেশী শিল্পের উপর নির্ভরতা কমায়, তবুও রবীন্দ্রনাথের কাছে কৃষি অনেক গুরুত্বপূর্ণ। ওখানেই আমাদের দেশের আসল অর্থনীতি তথা প্রাণ লুকিয়ে আছে। তাছাড়া কেবল এক দার্শনিক-তাত্বিক দৃষ্টিতেই তিনি চরকার বিরোধীতা করেন নি। চরখার ধারণার উদ্ভবের পেছনে ‘বিদেশি বয়কট’ আন্দোলনের প্রভাব আছে। আর সেই আন্দোলন মূলত পরিচালিত হয়েছিল বোম্বের বস্ত্রমিলমালিকদের স্বার্থে। এই আন্দোলনের থেকে সেই মিলমালিকেরা বহু মুনাফা অর্জন করেছিল সে আমরা জানি। রবীন্দ্রনাথ জানতেন তার থেকেও বেশি কিছু। তিনি লিখেছেন, “ বোম্বাইয়ের যে সমস্ত কারখানা দক্ষিণ-আফ্রিকার কয়লার কয়লায় কল চালিয়ে কাপড় বিক্রি করছে, তাদের কাপড় কেনায় যদি আমাদের দেশাত্মবোধে বাধা না লাগে তবে আমাদের বাংলাদেশের তাঁতিদের কেন নির্মম হয়ে মারি। বাঙালি দক্ষিণ আফ্রিকার কোনো উপকরণ ব্যবহার করে না , করে বিলিতি সুতো। তারা বিলাতের আমদানি কোনো কল চালিয়ে কাপড় বোনে না, নিজেদের হাতের শ্রম ও কৌশল তাদের প্রধান অবলম্বন, আর যে তাঁতে বোনে সেও দিশি তাঁত । এখন যদি তুলনায় হিসেব করে দেখা যায়, আমাদের তাঁতের কাপড়ের ও বোম্বাই মিলের কাপড়ের কতটা অংশ বিদেশী, তাহলে কী প্রমাণ হবে। তা ছাড়া কেবলই কি পণ্যের হিসাবটাই বড় হবে, শিল্পের দাম তার তুলনায় তুচ্ছ ? সেটাকে আমরা মূঢ়ের মতো বধ করতে বসেছি। অথচ যে যন্ত্রের বাড়ি তাকে মারলুম সেটা কি আমাদেরই যন্ত্র। সেই যন্ত্রের চেয়ে বাংলাদেশের বহু যুগের শিক্ষাপ্রাপ্ত গরিবের হাত দুখানা কি অকিঞ্চিৎকর । আমি জোর করেই বলব, পুজোর বাজারে আমাকে যদি কিনতে হয় তবে আমি নিশ্চয়ই বোম্বাইয়ের বিলিতি যন্ত্রের কাপড়া ছেড়ে ঢাকার দিশি তাঁতের কাপড় অসংকোচে এবং গৌরবের সঙ্গেই কিনব। সেই কাপড়ের সুতোয় বাংলাদেশের বহু যুগের প্রেম এবং আপন কৃতিত্ব গাঁথা আছে। . . . একদিন ইংরেজ বণিক বাংলাদেশের তাঁতকে মেরেছিল, তাঁতীর হাতের নৈপুণ্যকে আড়ষ্ট করে দিয়েছিল। আজ আমাদের নিজের দেশের লোক তার চেয়ে বড় বজ্র হানলে। ” ( বাঙালির কাপড়ের কারখানা ও হাতের তাঁত; পল্লী প্রকৃতি ) বোঝাই যায় বোম্বাই মিলের স্বার্থে পরিচালিত বিদেশী বয়কটের আন্দোলন সেই বজ্র। চরখা একটু ঘোরানো পথে সেই মিলের প্রতীক হয়ে দঁড়িয়েছিল। তিনি আরো লিখেছেন, “ . . বাংলা তাঁতে স্বদেশী মিলের বা চরখার সুতো ব্যবহার করেও তাকে বাজারে চলন-যোগ্য দামে বিক্রি করা যদি সম্ভবপর হয়, তবে তার চেয়ে ভালো আর কিছুই হতে পারে না। স্বদেশী চরখার উৎপাদনশক্তি যখন সেই অবস্থায় পৌঁছবে তখন তাঁতিকে অনুনয়-বিনয় করতেই হবে না; কিন্তু যদি না পৌঁছয়, তবে বাঙালি তাঁতিকে ও বাংলার শিল্পকে বিলিতি লৌহযন্ত্র ও বিদেশী কয়লার বেদীতে বলিদান করতে পারব না। (ঐ) এবারে ,যারা বিদেশী বয়কট পন্থী সন্ত্রাসীদের যথার্থ দেশপ্রেমী বলে এখনো গৌরব বোধ করেন এবং এদের বিরোধীতা করাবার জন্যে রবীন্দ্রনাথের দেশপ্রেম ও শ্রেণিচরিত্র নিয়ে তাত্বিকতার জটাজাল মেলে ধরেন তাঁরা নিজেদের বিচারবোধের পুনর্বিবেচনা করতে পারেন। রবীন্দ্রনাথের কুটির শিল্পের বিকাশের ধারণা এরকমই কৃষির বিকাশের সঙ্গে জড়িয়ে ছিল । যেমন, সুতা উৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত তাঁত, ধান চাষের সঙ্গে যুক্ত ধান মাড়াবার কল , গোপালন ও দুধ উৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত ঘি মাখন উৎপাদনের কল ইত্যাদি। কুটির শিল্পের শিক্ষা, সম্প্রসারণ ও উন্নতির কথা মাথায় রেখে শ্রীনিকেতনে ‘শিল্পভবন’ গড়ে তোলা হয়েছিল। তার জন্যে প্রয়োজনীয় ভাঁড়ার ঘরটির দ্বারোদ্ঘাটন করেন সুভাষ বসু ১৯৩৮এর ৮ ডিসেম্বরে। বনমহোৎসব প্রমাণ করে পরিবেশ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ কত যুগাগ্রগামী ধারণার প্রবক্তা ছিলেন। প্রকৃতির থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে মানুষের সভ্যতা সংস্কৃতি এবং অস্তিত্ব কিছুই সুরক্ষিত থাকে না এ চিন্তা তাঁর সেই শিলাইদহের পদার্পণের দিন এবং কৃষ্ণকমল ভট্টাচার্য সম্পাদিত কাগজ ‘হিতবাদি’র সঙ্গে যুক্ত হবার দিন থেকেই প্রধান চিন্তাতে দাঁড়িয়ে ছিল। দেশের প্রকৃতিকে বাদ দিয়ে দেশকে আয়ত্ব করা যায় এ তিনি কল্পনাও করতে পারেন নি। বস্তুত তাঁর পল্লীপ্রীতি এই প্রকৃতি প্রীতির অংশ মাত্র ।
সবচাইতে বড় উদ্যোগ যেটি শ্রীনিকেতনে নেয়া হলো তা হলো কৃষকদের মধ্যে সমাবায় গড়বার প্রয়াস। এ ছিল ভারতে সমবায় ধরণার প্রথম প্রয়োগ প্রয়াস! ১৯২৯ এর ৯ ও ১০ ফেব্রুয়ারী শ্রীনিকেতনের বার্ষিক উৎসবে সমবায় নীতি নিয়ে ভাষণ দিতে গিয়ে তিনি বলেন, “ মানুষ খাটো হয় কোথায় । যেখানে সে দশজনের সঙ্গে ভালো করিয়া মিলিতে পারে না। পরস্পরের মিলিয়া যে মানুষ সেই মানুষই পুরা, একলা মানুষ টুকরা মাত্র।” এই কথাটি তত প্রচার পায়নি যত প্রচার পেয়েছে তার “... একলা চলো রে ।” গানটি । এ যে এক দ্বান্দ্বিক দ্রষ্টার দেখা, একই সত্যের দ্বান্দ্বিক স্বরূপ -----এই সহজ কথাটা বুঝতে পারলে আর কোনো অস্পষ্টতা থাকে না। তিনি আরো বলছেন, “ যাহাদের মনে ভরাসা নাই . . . . তাহাদিগকে ভিক্ষা দিয়া, সেবাশুশ্রুষা করিয়া, কেহ বাঁচাইতে পারে না। ইহাদিগকে বুঝাইয়া দিতে হইবে , যাহা একজনে না পারে তাহা পঞ্চাশ জনে জোট বাঁধিলেই হইতে পারে। তোমরা যে পঞ্চাশজনে চিরকাল পাশাপাশি পৃথক পৃথক চাষ করিয়া আসিতেছ, তোমরা তোমাদের সমস্ত জমি হাল লাঙ্গল গোলাঘর পরিশ্রম একত্র করিতে পারিলেই গরিব হইয়াও বড়ো মূলধনের সুযোগ আপনি পাইবে। ” তবে কিনা এখানেও তাঁর সমাবায় পরীক্ষা অনেকদূর এগোলেও শেষরক্ষা করা যায় নি। কেন, সে প্রশ্নটাই লাখটাকার প্রশ্ন।
কিন্তু সে আগুন আপনি আপনার শিখার পতাকাকে বহন করে ফিরল নাঃ
যেমন লাখটাকার প্রশ্ন, রবীন্দ্রনাথের জ্বালানো ‘সত্যিকারের আগুন’ তার আপনার শিখাকে দশের সর্বত্র বহন করতে পারে নি কেন? কেনই বা রবীন্দ্রভক্তির প্রচারকেরা তাঁর এদিকটাকে একেবারেই হিসেব থেকে বাদ দিয়ে রেখেছেন। কেনইবা যে বুদ্ধিজীবিরা শান্তিনিকেতনে বাড়ি করাটাকে আভিজাত্য ও ফ্যাসনের প্রতীক করে তুললেন তাঁরাও রবীন্দ্রনাথের বাণীকে নিয়ে বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাষণ দেবার পাশাপাশি গ্রাম ভারতের কোনায় কানাচে নিয়ে যাবার কথা ভাবলেন না। নিদেন পক্ষে গান্ধির খাদির মতো প্রচারও , যদিও তাতেও ফাঁকির ভাগ প্রচুর, রবীন্দ্রনাথের কোনো উদ্যোগ পায় নি ।
অনেকে অবশ্যি আত্মপক্ষ সমর্থণ করে বলবেন, আজ যে ভারতের চারদিকে সমবায় আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছে সেতো রবীন্দ্রনাথের মতো ব্যক্তিদেরই ভাবনার ফসল। এই ফাঁকিবাজেরা ‘পারমানবিক’ পরীক্ষা চালিয়েও নির্বিকার লজ্জাতে বলতে পারেন ‘বুদ্ধ হাসছেন!’ গান্ধির নেতৃত্বে ‘স্বাধীন’দেশের জাতীয় দিবসে সেনাবাহিনির কুচকাওয়াজ করেও গান্ধির নামে মালা জপতে পারেন। কিন্তু ‘সভ্যতার পিলসুজে’রা যে এখনো মাথায় প্রদীপ নিয়ে এদেশে খাড়া দাঁড়িয়ে আছে, উপরের সবাই আলো পাচ্ছে আর তাদের গা দিয়ে তেল গড়িয়ে পড়াছে ---তার কী হবে? তার কী হলো ? রবীন্দ্রনাথতো আর NGO চালান নি। এ ছিল তাঁর দেশমুক্তির পথ। দারিদ্র্য আর বৈষম্য মুক্তির পথ! তারতো কিছুই হয় নি । বরং বিশ্বভারতীর থেকেও রবীন্দ্রমুক্তির আয়োজন ক্রমশঃ প্রবল হচ্ছে। শুধু নোবেল পুরস্কার চুরিই নয় এখন বিশ্বভারতী সংবাদ শীর্ষে আসছে একের পর এক উপাচার্যদের নানা কেলেঙ্কারি , খুন, রাহাজানি ও ড্রাগ মাফিয়াদের জন্যে। বিশ্ববিদ্যালয়টির বর্তমান অবস্থাকে সেদিন দেখলাম ইন্টারনেটে এক শুভানুধ্যায়ী শান্তিনিকেতনের বাসিন্দা সৌমিক বন্দ্যোপাধ্যায় ব্যক্ত করেছেন এভাবে, ( তাঁর কাজ চালানো গোছের ইংরেজি রেখে উল্লেখ করা গেল।–লেখক) “.... Now Rabindranath is no more here. . . . What Rabindranath wanted to make a relationship between this university and the adjacent rural areas, especially through direct involvement or participation in this university ... The rural reconstruction program is not carrying on now by this university which was set up by Tagore in Sriniketan. All the developmental works are self-centric in the university. The research scholars just study the villages for their own degree. And what is required to own a degree, the scholars study up to that portion. No in-depth study has been taken place in this university for quite some time. But some other senior professors (retired and ongoing) tried hard to achieve the goal what Tagore had an ideology. Some intensive studies were carried out by Prof. Sunil Sengupta in Agro Economic Research Centre, Visva-Bharati and Palli Charcha Kendra, Visva-Bharati, Sriniketan (with collaboration with Prof. Amartya Sen) but after that there was no intensive study nor there do any program to uplift the rural poor in the field of education, social justice, etc. The adjacent rural areas are automatically grown up with the society that has been changed by the time and technological growth. Where political disturbance is the main problem in the institutional area such as Visva-Bharati, there no developmental work can be done. Some officers are involved with the scams for last 5 years. There are competitions to enjoy the power and money within the high ranking officials and union leaders for the last 6-7 years. Prof. Amlan Dutta, was an ideal Vice Chancellor of this university. But after him, the darkness has been spread over throughout the university, be it in education, administration, health system, or anything else.” ( February 19,2002 http://www.mouthshut.com/user/saumikm.html . এ প্রসঙ্গে আরো দেখুন এখানে)
১৮৯০তে শিলাইদহে পা দেবার পর থেকে আশি বছরের জীবনের পঞ্চাশ বছরের কঠোর শ্রম আর পরীক্ষা নিরীক্ষার পর বিশ্বভারতী-শ্রীনিকেতনে যে বিশাল কর্মযজ্ঞ রবীন্দ্রনাথ গড়ে তোলেন এটি এ দেশে তাঁর প্রধান পরিচয় হলো না—এ শুধু তাঁর নয় আমাদের জাতীয় জীবনের এক মর্মান্তিক বিয়োগান্তক ঘটনা। এই ব্যর্থতার কারণটি এক বাক্যে কিন্তু প্রাঞ্জল ভাষাতে ব্যাখ্যা করেছেন বাংলাদেশের এক বুদ্ধিজীবি, মহম্মদ আনিসুর রহমান , এভাবেঃ গান্ধির মতো কৃষকদের সঙ্গে একাত্ম হবার জন্যে রবীন্দ্রনাথকে কখনোই প্রকাশ্যে তাঁর গায়ের জামা খুলতে দেখা যায় নি। (unlike Gandhi, Tagore is not known to have ever taken off his shirt in public to integrate with the peasants!; Roots of participation and self-reliance thinking and action research in Rabindranath Tagore; Paper presented at the ALARPM 6th & PAR 10th World Congress, September 21-24, 2003, at the University of Pretoria, South Africa. ) . এই গায়ের জামা খোলার তত্বটি তিনিও জানতেন। ‘ওরা চালিত হবে, আমরা চালনা করব দূর থেকে, উপর থেকে’ এতে যে কাজ হবার নয় তিনি জানতেন। আর জামা না খুললেও শিলাইদহের দিনগুলোতে তিনি তা অনুশীলনও করতেন। তবে কিনা শান্তিনিকেতনের দিনগুলোতে ‘জামা খুলে’ নেমে পড়াটা ক্রমেই তাঁর কাছে কঠিন হয়ে দাঁডিয়েছিল। এরই স্বীকারোক্তিতে তিনি তাঁর ‘পল্লীপ্রকৃতি’র শেষ রচনা, যেটি আসলে বাঁকুড়াতে এক জনসভাতে ১৩৪৬এর ১৮ ফাল্গুনে দেয়া ভাষণ, সেই ভাষণ শেষ করছেন এই বলে, “আমি পল্লীর পরিচয় হারিয়েছি নিজে পরিচিত হয়ে। বাইরে বেরোনো আমার পক্ষে দায়, শরীরেও কুলোয় না । আমার পল্লীর ভালোবাসা বিস্তৃত করতে পারতুম, আরো অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতে পারতুম, কিন্তু সম্মানের দ্বারা আমি পরিবেষ্টিত , সে পরিবেষ্টন আর ভেদ করতে পারব না । আমার সেই শিলাইদহের জীবন হরিয়ে গেছে।” এই উক্তির সঙ্গে আমরা তুলনা করতে পারি টলস্টয়ের শেষদিন গুলোর কথা। নিজের জমিদারি প্রজাদের মধ্যে বিলিয়ে দেবার প্রস্তাবে স্ত্রীর সম্মতি না পেয়ে অভিমানে সেই ৮২ বছর বয়সে ছোটমেয়ের হাত ধরে ভরা শীতের বরফপাতের দিনে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যান। বেশিদূর যেতে পারেন নি। নিউমোনিয়াতে আক্রান্ত হয়ে আস্তাপোভো স্টেশনে অজ্ঞান ও অসুস্থ হয়ে পড়ে যান। সেখান থেকে তাঁকে তুলে আনা হয় বটে, কিন্তু বাঁচানো যায় নি। রবীন্দ্রনাথেরও মনে হয়েছিল , নিজের জমিদারি প্রজাদের মধ্যে বিলিয়ে দেবেন। কিন্তু দেননি কারণ, ভয় পরমুহূর্তেই অন্য জমিদার চাষির থেকে সে জমি কেড়ে নেবে।
এই উক্তিকে অবশ্যি অনেকে রবীন্দ্রনাথের ভূমিসংস্কারের বিরোধীতা করাবার প্রমাণ হিসেবে দেখেন। আর আমাদের এই শেষ কথাগুলোতে সেই সব পণ্ডিতেরা অবশ্যই উৎফুল্লিত হবেন যারা রবীন্দ্রনাথকে ধনিক শ্রেণির প্রতিনিধি, বুর্জোয়া, এক সামান্য সংস্কারক, বিলাসি বুদ্ধিজীবি হিসেবে ভাবতে অভ্যস্ত। এহেন বৌদ্ধিক বিলাসিতাও রবীন্দ্রনাথকে ও তাঁর কাজকে অবহেলা করাবার এক অন্যতম কারণ। আমরা অতোটা সরলীকরণের পক্ষে নই। জেনেশুনেই নই। কারণ এইসব ‘বুর্জোয়া’ বিরোধী বুদ্ধিজীবিদেরও সফলতার ঘরে আজ, সেই ‘এবার ফিরাও মোরে’ কবিতার এক শতাব্দিরো বেশি দিন পরেও শূন্য বই, ডান দিকে খুব বেশি পূর্ণ সংখ্যা নেই!
রাস্তাটাকে ভক্তিরসে দিয়ো না কাদা করেঃ
‘ধনগৌরবের ইতরতা’র বিরুদ্ধে রবীন্দ্রনাথের ঘৃণা নিয়ে কোনো সৎ লোকের সংশয় প্রকাশের অবকাশ নেই। ‘ধনের ধর্মই অসাম্য।‘ কিম্বা ‘ ধনকামী নিজের গরজে দারিদ্র্য সৃষ্টি করিয়া থাকে’ এই কথাগুলো তিনি জানতেন এবং ঘৃণা করতেন। এব্যাপারে তাঁর ধ্যনধারণা এবং স্বপ্ন সাধ প্রায় সাম্যবাদীদের কাছাকাছি গিয়ে পৌঁছেছিল। রাশিয়ার বিপ্লব তাঁকে ভীষণ উৎসাহিত ও উৎফুল্লিত করেছিল বলেই তিনি ‘এ জন্মের তীর্থ দর্শন’ করতে রাশিয়া ভ্রমণ করেছিলেন। আর রুশ বিপ্লবই যে তাঁকে সমাজবাদের দিকে আকৃষ্ট করেছিল তা নয়। সেই শিলাইদহবাস ও ‘সাধনা’ পত্রিকার যুগ থেকেই তিনি এই রাজনৈতিক দর্শনের সঙ্গে পরিচিত হতে শুরু করেছিলেন। সাধনাতে লিখেছেন,’কর্মের উমেদার’, স্ত্রী মজুর’ এবং ‘ক্যাথলিক সোশ্যালিজম’। এর আগে দ্বিতীয়বারে বিলেত যাত্রাতেই ওখানে শুনে এসছেন, “কার শঙ্খ উঠিয়াছে বাজি জাগাতে জগৎজনে ?” ওখানেও দেখে এসছেন , “ অক্ষমের বক্ষ হতে রক্ত শুষি করিতেছে পান লক্ষ মুখ দিয়া; বেদনারে করিতেছে পরিহাস স্বার্থোদ্ধত অবিচার . . .” সমাজবাদ সম্পর্কে তাঁর বিশ্বাস ও ধ্যান ধারণা এ পর্যন্ত পৌঁছেছিল, “ সোসিয়েলিষ্টরা যে পৃথিবীময় ধন বিভাগ করে দেয় সেটা সম্ভব কি অসম্ভব ঠিক জানিনে----যদি একেবারেই অসম্ভব হয় তা হলে বিধির বিধান বড়ো নিষ্ঠুর; মানুষ ভারী হতভাগ্য।”( ছিন্ন পত্রাবলী) তিনি শুধু নিশ্চিত ছিলেন না ‘সম্ভব কি অসম্ভব’, তার কারণ তাঁর জীবনের একটিমাত্র লক্ষ্য তিনি স্থির করে নিয়েছিলেন, বিশেষ করে ‘স্বদেশী আন্দোলন’ ও পাবনা সম্মেলনের তিক্ত অভিজ্ঞতার পর, “... শিক্ষার আলোক বিস্তার । আমি পোলিটিশিয়ান নই।” তাই রাশিয়া গিয়েও তিনি তাই দেখেছেন যা তিনি দেখতে চেয়েছেন, যে কাজগুলো তিনি শ্রীনিকেতনে করছিলেন । বলছিলেন, তাই বুঝি ওরা দেশ জুড়ে করছিল। উল্টোবুদ্ধির লোকেরা উল্টো বলেন, ওখানে তিনি তাই দেখেছিলেন যা তাঁকে দেখানো হয়েছিল। তাই যদি হতো তবে তাঁকেতো এও দেখানো ও বোঝানো হয়েছিল যে শ্রীনিকেতনের মতো এক দুটি আদর্শ বিদ্যালয় করে সারা দেশে তা ছড়ানো যায় না। পরে সাম্য প্রতিষ্ঠা করা যায় না। তা করতে গেলে ক্ষমতার থেকে অবশ্যই ধনগর্বী ‘ইতর’দের হটাবার কাজ একই সময়ে করতে হয়। অথচ তিনি কিনা সিদ্ধান্ত নিলেন, আমাদের দেশের লোক ম্যালেরিয়াতে ভোগে দুর্বল বলেই কাজগুলো করতে পারছেনা । এই সিদ্ধান্ত এক ‘অপোলিটিশিয়ানে’র একেবারেই সরল সিদ্ধান্ত। তাই বলে গূঢ় সত্যের কিছুই বোঝেন নি তাও নয়। ‘পোলিটিশিয়ান’ না হলেও সেখানে সমাজবাদের পরীক্ষা নিয়ে এই সত্য উপলব্ধি তাঁর হয়েছিল যে , “ প্রয়োগের দ্বারাই মতের বিচার হতে পারে, এখনো পরীক্ষা শেষ হয় নি । . . .তত্বটাকে সম্পূর্ণ গ্রহণ করবার পূর্বে অপেক্ষা করতে হবে। কিন্তু তবু সে সম্মন্ধে আলোচনা করা চলে, কেবল মাত্র লজিক নিয়ে বা অঙ্ক কষে নয়----মানব প্রকৃতিকে সামনে রেখে।” ( রচনাবলীর থেকে ব্যবহৃত উদ্ধৃতি; অমরেশ দাশ, রবীন্দ্রনাথের চিন্তায় সমাজ তন্ত্র; পৃঃ ১৪৯)
টলস্টয়ের বা গান্ধির মতো রবীন্দ্রনাথ নিজের গায়ের জামা না খুলতে পারেন , কিন্তু টলস্টয়ের মত তিনিও ভেবেছিলেন নিজের জমি প্রজাদের মধ্যে ভাগবাটয়ারা করে দিতে। ১৯২৬শে প্রমথ চৌধুরীর ‘রায়তের কথা’র আলোচনা করতে গিয়ে লিখেছেন, “আমার জন্মগত পেশা জমিদারি, কিন্তু আমার স্বভাবগত পেশা আসমান-দারি। এই কারণেই জমিদারির জমি আকঁড়ে থাকতে আমার অন্তরের প্রবৃত্তি নেই। এই জিনিসটার ’পরে আমার শ্রদ্ধার একান্ত অভাব । আমি জানি জমিদার জমির জোঁক, সে প্যারাসাইট, পরাশ্রিত জীব। ” কিন্তু একেতো টলস্টয়ের পরিণামের কথা তাঁর জানা ছিল, তার উপর তিনি ভেবেছিলেন আরো গভীরে গিয়ে । তাঁর বিশ্বাস ছিল ‘. . . আমাদের দেশের মূঢ় রায়তদের জমি অবাধে হস্তান্তর করবার অধিকার দেওয়া আত্মহত্যার অধিকার দেওয়া।” তিনি ভূমি সংস্কারের বিরোধী ছিলেন না , “ এক সময় সেই অধিকার তাদের দিতেই হবে,...” তাঁর সংশয় ছিল, “. . . কিন্তু এখন দিলেই কি সেই অধিকারের কিছু বাকি থাকবে?” সেই লক্ষ্যে তাঁর পথ ছিল , আমাদের পছন্দ হোক বা না হোক, “ আসল কথা, যে মানুষ নিজেকে বাঁচাতে জানে না কোনো আইন তাকে বাচাঁতে পারে না। নিজেকে এই যে বাঁচাবার শক্তি তা জীবনযাত্রার সমগ্রতার মধ্যে, কোনো একটা খাপছাড়া প্রণালীতে নয় । . . .পল্লীর মধ্যে সমগ্রভাবে প্রাণ সঞ্চার হলে তবেই সেই প্রাণের সম্পূর্ণতা নিজেকে প্রতিনিয়ত রক্ষা করবার শক্তি নিজের ভিতর থেকেই উদ্ভাবন করতে পারবে।” অর্থাৎ, তাঁর লক্ষ্যটিও ছিল, শেষ অব্দি, ‘লাঙ্গল যার জমি তার। ’ শুধু পথ ভিন্ন ছিল। মার্ক্সবাদী বিকল্প পথটি সম্পর্কে যথেষ্ট অধ্যয়ন ও অভিজ্ঞতা থাকলেও এ নিয়ে পুরোপুরি নিঃসংশয় হবার কোনো সুযোগও তিনি পান নি। যে পরীক্ষাটি সোভিয়েতে কয়েক দশক পরে ব্যর্থ হয়েছে তা দেখে আর যেই সন্তুষ্ট হন, তিনি একে ‘বিধির বিধান বড়ো নিষ্ঠুর’ বলেই ভাবতেন । এবং লক্ষ্যে পৌঁছুবার নিজের পথে সম্ভবত আরো আস্থা বাড়ত। তাছাড়া নিজের দেশে স্বদেশী সন্ত্রাসীদের যে ফাঁকি তিনি দেখেছেন এবং সোভিয়েতের যে বিচ্যুতিগুলো তিনি দেখছিলেন সেগুলোও তাঁর চিন্তা পাল্টাবার পক্ষে সহায়ক ছিল না। তিনি যে রাশিয়াতে গেছিলেন সেখানে স্টালিন নেতৃত্ব দিচ্ছেন। সর্বহারার একনায়কত্ব ক্রমেই পার্টির একনায়কত্বে পরিণত হচ্ছিল। পরে যা ব্যক্তির ও সেই সঙ্গে ‘পার্টির ছিদ্র দিয়ে ক্ষমতায় ফেরা ধনীদের’ একনায়কত্বে পরিণত হয়ে পড়বে । তার উপর তিনি যখন ১৯২৪শে চিনে গেছিলেন, সেখানকার কম্যুনিষ্ট যুব লীগ হ্যাংকাওতে তাঁর বিরুদ্ধে শ্লোগান দিয়েছিল, “ ফিরে যাও, পরাভূত দেশের ক্রীতদাস! ” বস্তুবাদের এমন অবস্তুবাদী দৃষ্টি তাঁর চিন্তাকে কী করে পাল্টাতে পারত ! তিনি তাই সে সময় লিখেছিলেন, “ আমি নিজে জমিদার, এই জন্যে হঠাৎ মনে হতে পারে আমি বুঝি নিজের আসন বাঁচাতে চাই। যদি চাই তা হলে দোষ দেওয়া যায় না---ওটা মানবস্বভাব। যারা সেই অধিকার কাড়তে চায় তাদের যে বুদ্ধি , যারা সেই অধিকার রাখতে চায় তাদেরও সেই বুদ্ধি; অর্থাৎ কোনটাই ঠিক ধর্মবুদ্ধি নয় , ওকে বিষয় বুদ্ধি বলা যেতে পারে। আর যারা কাড়তে চায় যদি তাদের চেষ্টা সফল হয় তবে কাল তারাই বনবিড়াল হয়ে উঠবে । হয়ত শিকারের বিষয় পরিবর্তন হবে, কিন্তু দাঁত নখের ব্যবহারটা কিছুমাত্র বৈষ্ণব ধরণের হবে না।” চিন-রাশিয়ার এই ‘বনবিড়াল’রাই আজকের বিশ্বে মার্ক্সবাদ ও সাম্যবাদের সবচে’ বড় শত্রু সে কি আর বলতে? তাঁর এই চিন্তাই ‘কালের যাত্রা’ নাটকে প্রকাশ করেছে ‘কবি’ চরিত্রটি। বলছে, “. . .তখন এঁরাই হবেন বলরামের চেলা---হলধরের মাতলামিতে জগৎটা উঠবে টলমলিয়ে। . . . .তার পরে কোন-এক যুগে কোন-একদিন আসবে উল্টোরথের পালা। তখন আবার নতুন যুগের উঁচুতে নিচুতে হবে বোঝাপড়া । এই বেলা থেকে বাঁধনটাতে দাও মন--- রথের দড়িটাকে নাও বুকে তুলে , ধুলোয় ফেলো না; রাস্তাটাকে ভক্তিরসে দিয়ো না কাদা করে।” কথাটা রবীন্দ্রনাথের ‘রাস্তা’টা সম্পর্কেও সত্য। ভক্তি রসে কাদা করা চলবে না ।
রাশিয়াতে অধ্যাপক পেত্রভের সঙ্গে আলোচনাতে রবীন্দ্রনাথের প্রশ্ন ছিলঃ আপনি কি মনে করেন লোকশিক্ষার এই প্রসার কেবল আর্থনীতিক পরিবর্তনের ফলেই ঘটেছে? পেত্রভের উত্তর ছিলঃ তা বৈকি । তা না হলে আমাদের এই লক্ষ লক্ষ দেশবাসীকে কী ভাবে শিক্ষা দেওয়া যেত জানি না। রবীন্দ্রনাথ বলছেনঃ আপনাদের অবস্থায় সাধারণের মধ্যে শিক্ষাপ্রসারের আগে যে ( অর্থনীতির) প্রচলিত রূপকে ভেঙ্গে দেওয়া দরকার ছিল, তা সহজেই বোঝা যায়। কিন্তু জারের রাশিয়ায় জনশিক্ষা থেকে জনসাধারণ যত দূরে ছিলেন অন্য দেশে তেমন হয় নি। ইংলণ্ড আর জার্মানীতে জনসাধারণ জনশিক্ষার ফল পেয়েছেন । কিন্তু শোষণ, আর ধনতন্ত্রী উৎপাদনের প্রধান প্রধান ঘাঁটিতে বড় বড় শিল্পকেন্দ্রগুলিতে সম্পদের স্বাভাবিক সংহতি বরবাদ করা হয় নি। সেখানেও সংস্কৃতি ও শিক্ষার প্রসার সম্ভব, সম্ভব শিক্ষার ভিত্তিতে ব্যক্তির অন্তরের মুক্তিসাধন । আমার মতে জনসাধারণের মধ্যে শিক্ষা প্রসারের আমাদের যে সমস্যা ---সেটা আভ্যন্তরিক । জনসাধারণ যখন শিক্ষিত হবেন, আত্মশক্তি লাভ করবেন, তখন জনশিক্ষা আর শাসন পদ্ধতির আমূল সংশোধন ঘটাতে পারবেন। . . .
আমরা এখন তিন শিকি শতাব্দি দূরে বসে নির্বিকার চিত্তে বলতে পারি পেত্রভ ও রবীন্দ্রনাথ কারোরই বিশ্বাস সম্পূর্ণ ছিল না। ‘ মধ্যএশিয়ার অর্ধসভ্য জাতের মধ্যেও বন্যার মতো বেগে শিক্ষা বিস্তার করেও’ রাশিয়া তার পরিবর্তিত সমাজ ধরে রাখতে পারে নি। আর রবীন্দ্রনাথের শিক্ষা চিন্তা কোঠারি কমিশনের প্রতিবেদনের মতো , ( প্রতিবেদনের ‘শিক্ষাদান-গবেষণা ও সম্প্রসারণের’ ধারণা। যেটি আজো কার্যকরী করা হয় নি) কারো কারো শিক্ষা সংস্কারের চিন্তাকে প্রভাবিত করলেও তা দেশের সর্বত্র ছড়ায় নি, না সেই শিক্ষা ‘শাসন পদ্ধতির আমূল সংশোধন’ ঘটাতে পেরেছে। এখনো ভারতে টাকার জোরে “লোকমত তৈরি হয়, টাকার দৌরাত্ম্যে . . .ধনীর স্বার্থের সর্বপ্রকার প্রতিকূলতা ( স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের নিজের ‘বামপন্থী’ রাজ্যেও --লেখক) দলিত হয়। একে জনসাধারণের স্বায়ত্বশাসন বলা চলে না। ” এখনো আমাদের গণতন্ত্র নিয়ে আমাদের উল্লসিত হবার কোনো কারণ নেই, কেননা, “ যেখানে মূলধন ও মজুরির মধ্যে অত্যন্ত ভেদ আছে সেখানে ডিমক্রাসি পদে পদে প্রতিহত হতে বাধ্য।” ( সমবায় ২; সমবায় নীতি)
একঝোঁকা হলেই তাল কাটেঃ
তা হলে পথ কোথায় ? ‘রথযাত্রা’তে নাটকের চরিত্র ‘কবি’কে যখন প্রশ্নটি করা হয়েছিল , তখন সে উত্তর দিয়েছিল, “ . . .আমরা মানি ছন্দ, আমরা জানি একঝোঁকা হলেই তাল কাটে।” সৈনিক যখন জিজ্ঞেস করেছিল, “আমরা কী করব।”—পুরোহিত যখন জিজ্ঞেস করেছিল, “আমি কী করব।” কবি উত্তর দিয়েছিল, “ তাড়াতাড়ি কিছু করতেই হবে এমন কথা নেই । দেখো, ভাবো। ভিতরে ভিতরে নতুন হয়ে ওঠো। তার পরে ডাক পড়বার জন্যে তৈরি থাকো।” এখন এই ‘নতুন’ হয়ে ঊঠার দিন এসছে। রবীন্দ্রপথ এবং সাম্যবাদী পথ—দু’পক্ষকেই। এখন ‘ডাক’ পড়েছে।
আমরা মনে করি শ্রেণি বিভাজিত দেশে রবীন্দ্রনাথের ‘জ্বালানো সত্যিকারের আগুন’ এমনিতেই এক আদর্শ সামনে নিয়ে ছড়িয়ে পড়া সম্ভব ছিল না। তা হয়ও নি। রবীন্দ্রনাথের ভাবনাও ‘একঝোঁকা’ ছিল, সুতরাং তার ‘তাল’ কেটেছে। এটি এক রাজনৈতিক প্রশ্ন তাকে সেভাবেই দেখা উচিত। অতুল সেনের অভিজ্ঞতা সেদিকেই ইঙ্গিত করে । রাষ্ট্রের বলপ্রয়োগের বিরুদ্ধে বলপ্রয়োগের দরকার পড়তেই পারে। সশস্ত্র বা নিরস্ত্র। তার জন্যে দেশজোড়া এক সাংগঠনিক উদ্যোগ দরকার ছিল। আর কোনো রাজনৈতিক প্রত্যয় ছাড়া সে উদ্যোগ কারো পক্ষে নেয়া সম্ভবও ছিল না, এখনো নেই। দ্বিতীয়ত; দেশ পাল্টাবে , দেশ গড়ার উদ্যোগ তার পরে নেয়া হবে---এমন তত্ব যারই হোক গান্ধির, পেত্রভের মতো রুশিওদের কিম্বা ভারতের কম্যুনিষ্টদের সে বুদ্ধিও খুব কাজের নয় । তাও আর পরীক্ষা করে দেখবার দিন ফুরিয়েছে। দেশ বদলের কাজে নামলেই যে দেশকে পুরোটা জানা হয় না , তা এই ভারতে বহুবার বহুভাবে দেখা হয়ে গেছে। ‘পাশেই প্রত্যক্ষ মরছে দেশের লোক রোগে ভোগে উপবাসে’ আর তাই দেখে কেউ মঞ্চের উপর চড়ে পরেরে উপর সমস্ত দোষ চাপিয়ে ‘দেশাত্মবোধের বাগবিস্তার’ করছে, রবীন্দ্রনাথ ঠিকই বলেছেন, ‘এতো বড় অবাস্তব অপদার্থতা আর কিছু হতেই পারে না।’ যারা কেবল পুরোনোর নিন্দে করে , তাকে ধ্বংসের কথা বলে বলে কালাতিপাত করেন তাঁরা শেষ অব্দি নিজেকেও ধ্বংশের কিনারায় নিয়ে গিয়ে দাঁড় করান। নেতির কথাতেই যার অনুশীলন সে ইতির সত্যে পৌঁছুবে কিসে । তাই আমরা আজো দেশের দিকে দিকে ‘সন্দীপে’দের ভূতের তাণ্ডব লীলা দেখি। হাফলং, থেকে ডিফু থেকে, গুয়াহাটি থেকে মুম্বাই হয়ে লালগড় অব্দি সর্বত্র দেশের নামে সন্ত্রাসী ভাড়াটে গুণ্ডাদের তাণ্ডব লীলা। দেশের সাথে, দেশের মানুষের সাথে তাদের হৃদয়ের কোনো যোগ কেউ খোঁজে পায় না। লালগড়ের আদিবাসি-কৃষক মানুষের প্রতিরোধ কী করে মাওবাদীদের হটকারিতায় ব্যর্থ হলো , গুড়িয়ে গেল সেতো আমরা ঐ সেদিন দেখলাম ।
মনে হচ্ছে , এই একুশ শতকে অবস্থাটি পাল্টাচ্ছে। বহু তথাকথিত সমাজসেবী সংগঠনগুলোকে দেখা যাচ্ছে পালা বদলের রাজনৈতিক প্রশ্নে সরব হতে। আবার কম্যুনিষ্টদের বহু গোষ্ঠীকেও দেখা যাচ্ছে সেবাকর্মের প্রতি আগেকার ‘অস্পৃশ্যতা’ ত্যাগ করতে। ভারতীয় কম্যুনিষ্টদের একবারই শুধু দেখা গেছিল গ্রামে গ্রামে সেবার হাত বাড়িয়ে দিতে, সে ঐ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার ‘জনযুদ্ধে’র দিনগুলোতে দুর্ভিক্ষের কালে। তাও বৃটিশ-সোভিয়েত মৈত্রীর রাজনীতির চাপে। অন্যথা এরা একে , নেহাৎই সংস্কার কর্ম বলে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করতেই অভ্যস্ত ছিলেন। বিহারের সরিতা –মহেশকেও তাদের নিজেদের দলে ঘৃণিত ও পরিত্যাজ্য হতে হয়েছিল। একমাত্র এই তরুণজুটীর মৃত্যুর পরেই দলটী বন্ধডাকার মতো রাজনৈতিক কর্মসূচী হাতে নিয়েছিল। এ যে দেশ গড়বার কারিগরদের কতবড় মানসিক স্বাস্থ্যের যোগান দেয়, দেশের উপর অধিকার বোধ জন্মিয়ে তাকে আপনার করে জানতে সাহায্য করে এ তাদের কল্পনারও বাইরে ছিল। আজ অবস্থাটা মনে হচ্ছে গোটা বিশ্বেই পাল্টাচ্ছে। বিশ্বায়ন বিরোধী লড়াইর মঞ্চগুলোতে দু’দলকেই দেখা যাচ্ছে একত্রে। বিশেষ করে ‘ওয়ার্লড সোস্যাল ফোরামে’তো বটেই। এই দুই পথের মিলনেই যে শুধু এক ‘অন্য বিশ্ব সম্ভব’ ( Another World is Possible: World Social Forumএর শ্লোগান) হয়ে উঠবে তা এখন বিশ্বাস করা যায়। যদি ভারতে তেভাগা-তেলেঙ্গানা-নকশালবাড়ি-শ্রীকাকুলামের কৃষক বিদ্রোহ বিফলে যায় নি, তবে এও দৃঢ়তার সঙ্গে এখনো উচ্চারণ করা যায়ই যে শ্রীনিকেতনের রাবীন্দ্রিক পরীক্ষাও অথলে যাবার নয়। রাবীন্দ্রিক অধ্যাপকেরা কী বলবেন জানি না, আমরাও রবীন্দ্রনাথের মতো দৃঢ় প্রত্যয়ে বিশ্বাস করি যে , “আজ যদি আমরা অল্প কিছুও করতে পারি, একটি ছোটো ক্ষেত্রে ( শ্রীনিকেতনে –লেখক ) যদি আমাদের প্রচেষ্টা সংহত হয়, আমার দৃঢ় বিশ্বাস সেই স্ফুলিঙ্গ ভবিষ্যতে সোশিয়ালিজমে বিকাশ পাবে” ( রাশিয়াতে অধ্যাপক পেত্রভের সঙ্গে আলোচনা; তীর্থদর্শনের পঞ্চাশ বছর---সংকলন। ) আগামীর নতুন ভারতের নতুন সমাজবাদী গ্রামীণ সমাজ গড়তে গেলে বা সেখানে সার্বজনীন শিক্ষা ছড়াতে গেলে রবীন্দ্রনাথের শ্রীনিকেতনের দিকে আমাদের ফিরে ফিরে তাকাতেই হবে। সেখান থেকে শুরু করে আরো দূর বহু দূর অব্দি পথ এগিয়ে যেতে হবে। এ নিয়ে আমাদেরো কোনো সংশয় নেই!
------------------------------------------------------------
(22শে আগষ্ট লেখা শেষ।)