Swajatyer Ohomikar Theke Mukti Daner Shikkhai Ajaker Diner Prodhan Shikkha: Rabindranath Thakur
একটি নোটঃ দু'টো সমালোচনা ও বাংলা নাটকের মূল্যায়নপদ্ধতি
২ নভেম্বর,২০০৮এর 'দেশ' কাগজে বিখ্যাত নাট্যকার ব্রাত্য বসু'নাট্যমঞ্চ নাট্যরূপ' বইটির দ্বিতীয় সংস্করণের এক সমালোচনালিখেছেন। বইটির লেখক পবিত্র সরকার । ছেপেছেন দে'জ পাবলিশিং, কলকাতা । ব্রাত্যের সমালোচনার নাম 'নতুন সমন্বয় বোধের আকাঙ্খা' । ব্রাত্য লিখেছেন এই বইয়ের প্রথম সংস্করণ অনেক বছর আগে তাঁকে 'পোয়েটিক্স' বুখতে বেশ সাহায্য করেছিল। সেই প্রথমসংস্করণ পড়েই তাঁর মনে হয়েছিল, “. . . বাংলা নাটকের স্বাধীনতা উত্তর ইতিহাসচর্চার পাঠ্যের যদি কিছু মান্য নিদর্শন আমরা হাতেপেয়েও থাকি, নাট্যের ধারাবাহিক ও দেশি-বিদেশি নাট্যমানচিত্রের সার্বিক চেহেরা অনুধাবন ও তৎসংক্রান্ত কিছু খসড়া অন্তত বা টিপ্পনি,ইতিহাস সংক্রান্ত উত্তেজনার খোরাকের নথি কোথায় ? . . . . .ভবিষ্যতে যদি এবম্বিধ কোনও ইতিহাসচর্চার অবকাশ তৈরি করে আমাদের নাটমঞ্চ বা আমাদের নাট্যরূপ তাহলে পবিত্র সরকারের এ বইটি নিঃসন্দেহে তার অগ্রগণ্য গ্রন্থপঞ্জিতে অনিবার্য ।”
ব্রাত্যের মতে এই বইটির মূল সুর সমন্বয়ের । নতুন সংস্করণে ছত্রিশটি প্রবন্ধ রয়েছে । ধনঞ্জয় থেকে ব্রেশট ,রবীন্দ্রনাথ থেকে বাদল সরকার এবং হালের বাংলা থিয়েটার পর্যন্ত বইটি অবগাহন করেছে।
২ মার্চ ,২০০৯-র 'দেশ' কাগজে রুদ্র প্রসাদ সেনগুপ্ত'বিজন ভট্টাচার্য রচনা সংগ্রহ-১'এর এক সমালোচনা লিখেছেন । 'অযত্নে রুক্ষ প্রতিভাবৃক্ষ ' নামে । বইটি সম্পাদনা করেছেন বিজনের ছেলে বিখ্যাত কবি নবারুণভট্টাচার্য এবং আরো এক বিখ্যাত নাট্য-আলোচক ও ঐতিহাসিক শমীক বন্দোপাধ্যায় । ছেপেছেন দে'জপাবলিশিং , কলকাতা । রুদ্রের সমালোচনার থেকেবিজন যে নাট্য দর্শনে এককালে বিশ্বাস করতেন তার গতি প্রকৃতি বেশ ভালো বোঝা যায় । এর জন্যে এই নোটটা আমার করে রাখা জরুরি ।
লেখাটার শুরুতেই রুদ্র বেশ হতাশার সঙ্গে উল্লেখ করেছেন , আজ যখন আমরা নিজের দাদুর নামতাই ভুলে যাই কারণ কোনো ফর্মে তাঁর নামলিখতে হয় না সেখানে বিজন ভট্টাচার্যের মতো নাট্যকারদের ভুলে যাওয়াতো চাট্টিখানি কথা । সাহিত্যই আজকাল ব্রাত্য হতে বসেছে, তার উপর নাটকতো চিরদিনই ,'নশ্বর' ।
বিজন ভট্টাচার্যের খান দশ নাটক, নাটকের স্থির চিত্র আর তাঁর নাটকের গানের স্বরলিপি দিয়ে এই প্রথম খণ্ডটি সাজানো । রুদ্র লিখেছেন, বিজন ভট্টাচার্য “দেবতার মতো প্রতিভাবান আর হয়তো শিশুর মতো অগোছালো' ছিলেন ।. . . যাঁর প্রতিভা আর শক্তির সম্যক আদল তিনি নিজেপেয়েছিলেন কিনা সন্দেহের অবকাশ আছে ।” বিজন ভট্টাচার্য, শম্ভু মিত্র আর উৎপল দত্তকে তিনি তুলনা করেছেন ব্রহ্মা -বিষ্ণু- মহেশ্বরের সঙ্গে। অবশ্যই বিজন ভট্টাচার্য মহেশ্বর । তিনি লিখেছেন, “ . . . 'রাজা অয়দিপাউস' এর শম্ভু মিত্রের করা অনুবাদ যখন আমরা পড়ি তখন বিভিন্ননাট্যমুহূর্তের বহুচর্চিত স্মৃতির আভাসটাও ফুটে ওঠে । উৎপল দত্তের 'টিনের তলোয়ার' পড়তে পড়তে শেষ দৃশ্যে তিতুমীর হয়ে ওঠার সেই গায়ে কাঁটা দেওয়া চমকের অন্তত শোনা কথাও একটা ছবি দেখতে সাহায্য করে বর্তমানের অতি স্বল্প নাট্যপ্রেমীদের । কিন্তু বিজন বাবুর ক্ষেত্রে এই কিংবদন্তির অভাব । কারণ কত শতবার মুক্তাঙ্গনে একা একা বয়ে গেছে 'দেবীগর্জন'-এ জোতদারের সেই ধর্ষণ দৃশ্যের ভয়ঙ্কর রূপ। তাল গাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে সব গাছ ছাড়িয়ে আর যাই হোক অরণ্যেরতো সৃষ্টি হয় না ! বিজন বাবুর সেই অমোঘ অভিনয় আর চাঁচাছোলা কলমের ধারকে এক সূত্রে গাঁথার মন্ত্রণাদাতা কই ? আলোচনা করতে পেরেছেন কাদের সঙ্গে ? না তাপস সেন না খালেদ চৌধুরী ।” তিনি আরো লিখেছেন, “...শ্রদ্ধেয় নট, নির্দেশক শেখর চট্টপাধ্যায় লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথের নাটকগুলি নতুন করে লিখে নিতে পারলে মঞ্চায়ন সম্ভব । সে হেন বিদ্রুপবাণেবিদ্ধ নাটকের অহল্যা উদ্ধার হল শম্ভু মিত্রের স্পর্শে । কিন্তু সেই স্পর্শ দিতে গিয়ে শম্ভুদা'কে পাশে পেতে হয়েছে সেই খালেদ চৌধুরী , সেইতাপস সেন এবং সেই তৃপ্তি মিত্রকে ...।” তার উপর রুদ্রপ্রসাদের আক্ষেপ বিজন ভট্টাচার্য নিজেও ভালো সংগঠক ছিলেন না, তিনি তা পানও নি।শম্ভু মিত্র বুঝেছিলেন—বাণিজ্যিক থিয়েটারে কিছু হবে না। 'গণনাট্য যতটা গণের ততটা বোধহয় নাট্যের নয় ।' এর জন্যে তাঁর নতুন পথ–বহুরূপী । তাতে তিনি সরকারী উপেক্ষারও শিকার হন । তাতেও শম্ভু মিত্রকে আটকানও যায় নি । কারণ , “ শম্বু মিত্র নিজের প্রতি যত্ন নেওয়াটা বৃহত্তর কারণেই কর্তব্য মনে করলেন । বিজনবাবু হয়তো কর্তব্য মনে করলেন, যত্ন না নেওয়াটাকেই ।” নাটকের গুণমানের থেকেও অতিরিক্ত কিছু যে নাট্যকারের প্রতিষ্ঠাতে প্রভাব ফেলে এ কথা বোঝা যায় যখন রুদ্র লেখেন। জীবনের শেষভাগে শম্ভু মিত্র 'আ্যান্টিলেফট' ।তাই গোটা বামপন্থা তাঁর বিরুদ্ধে। “তিনি সম্ভ্রমের সজারু কাঁটা বিস্তার করে নিজের অবস্থানকে সেই কাঠিন্যেই প্রতিষ্ঠা দিয়েছেন।” উৎপল দত্ত প্রথম যুগে বামপন্থী হবার জন্যেই শাসককুলের বিরোধী, কিন্তু পরেরে জীবনে ঐ এক কারণেই শাসকদের বদান্যতা পেয়ে এসেছেন । বামপ্নথার প্রতি বিজন ভট্টাচার্যের অনুরাগ কম ছিলনা কিছুতেই , কিন্তু শাসক দলের অনুরাগঈ না হওয়াতে যে সমর্থন উৎপল দত্ত পেয়ে এসছেন তা তাঁর ভাগ্যে জোটেনি একেবারেই ।
বিজন ভট্টাচার্য নিজেও নিজের কাজের আদর তেমন করেন নি । রুদ্র লিখেছেন, “ এঁরা নিজেদের নয়, নিজেদের কাজের আদর করেছেন ।নিজেদের সোনার ধানে তরী ভরিয়ে দিয়েছেন, সে তরীতে নিজেদের ঠাঁইয়ের কথা ভাবেন নি। প্রায় অন্ধ শম্ভু মিত্র শুধু প্রখর অভিজ্ঞতা আর অনুমানে মঞ্চ মেপে শরীরের ঝুঁকি নিয়েই অভিনয় করেছেন। উৎপল দত্ত শেষ পর্বে ডায়ালিসিস নিতে নিতে পাঠ করে গেছেন । কিন্তু বিজনবাবুর মতো মৃত্যুর ক'ঘণ্টা আগে দলের উদাসীন কর্মীর নজর এড়িয়ে যাওয়া পেরেকের ক্ষত শরীরে নেননি।” তাঁর 'নবান্ন' থেকে 'দেবীগর্জন'সময়ের দাবি মিটিয়ে গেছে। “ কিন্তু 'মেঘে ঢাকা তারা'-র মাস্টারমাশাইকে দেখলে মনে হয় শুধু সময়ের দাবি মেটানোর নাটক নয়, কালোত্তীর্ণহয়ে ওঠার রসদ তাঁর কলমে ছিল।” রাজ্য সরকার উৎপল দত্তকে নিয়ে ঢালাও উৎসব করবার ব্যবস্থা করে । বিজন ভট্টাচার্যকে নিয়েবেসরকারই উদ্যোগেও এমন কিছু করা যায় না কি, সে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছেন লেখক । একটু বিদ্রুপ করেই লিখছেন, “ মানলাম, উৎপল দত্ত না হয় বামপন্থার 'অফিসিয়াল মদতদাতা ' হয়ে উঠতে পেরেছিলেন । কিন্তু বিজনবাবুর বাম অনুরাগের ক্ষেত্রে বলা যাবে--'নাথিং অফিসিয়াল আ্যাবাউট ইট' ।
দুই প্রজন্মের এই দুই বিখ্যাত নাট্যকারের সমালোচনা দেখায় বাস্তবে নাটক তথা শিল্পের মূল্যায়ন হয় কিসে । প্রতিষ্ঠান তথা শিল্প অতিরিক্ত উপাদানগুলো শিল্পের স্বীকৃতি তথা প্রতিষ্ঠাতে ব্যাপক প্রভাব ফেলে ।
----
লিখে শেষ ঃ ২৩-০৭-০৯, বৃহষ্পতিবার ।