( মে,১৯৩১--২৪নভেম্বর,২০০৯)
( এলেখা আজ ০৪-১২-০৯ তারিখে শিলচরের দৈনিক জনকন্ঠে প্রকাশিত হয়েছে। এখানে দেখুন।
এখানে দেখুন আরো তিনটি পৃষ্ঠা [১] [২] [৩] )
তা যেটি লিখছিলাম, কবিতার নেশাতে আরো কিছু শিক্ষকের আঁচে তপ্ত হতাম। তাঁদের মধ্যে শহরের ভেতরে অনুরূপা বিশ্বাস, তপোধীর ভট্টাচার্য এবং শহরের বাইরে উপত্যকার অন্যত্র আরো অনেকে ছিলেন। কিন্তু সত্যি বলতে কি, বহু বহু দিন ভক্তিমাধব চট্টপাধ্যায়কে চিনতাম না। যখন কোনো কাছাড় কলেজের বন্ধু এসে তাঁর কথা শোনাতো, ভাবতাম, সে বন্ধুর শিক্ষক কেমন হতে হয় সে নিয়ে কোনো ধারণাই নেই! আমার মনে আছে, একবার এক বন্ধু এসে বলেছিল, জি সি কলেজে জগন্নাথ রায় চৌধুরী আর কাছাড় কলেজে ভক্তিমাধব একই জিনিস। শুধু একজনের গলা উঁচু বলে লোকে শুনতে পায়, অন্যজনের স্বর মিহি । আসলে গলা নিয়ে নয় ততটা, সে বলতে চেয়েছিল স্থৈর্যের কথা। একজন যত বেগবান অন্যে তত ধীর স্থির। আমার মনে হয়েছিল, ওসব পশ্চিম বাংলা প্রেম। নইলে, ঐ কলেজে একসময় তপোধীর ভট্টাচার্য থাকতে আবার অন্য কারো নাম নেয় কী করে কেউ?
পরে জেনেছি, ঐ ধীর লোকটাইতো থেকে গেলেন। আমাদের উজ্জ্বল আলোতো ধুমকেতুর মতো চলে গেলেন কিছুটা অভিমানে , কিছু তাঁর দেশের টানে। তাতে কোনো অপরাধ নেই । দেশের টান থাকতেই পারে। পর দেশকে আপন করাবার মধ্যেও বাহাদুরি কিছু নেই! লোকেতো আজকাল কতই করছে। প্রায়ই শুনি, ছেলে মেয়েরা বরাক উপত্যকা তথা অসম ছেড়ে যেতে পারলে বাঁচে। কেউ কেউ দেশ ছেড়ে বিদেশে! এখানে বুঝি ঘোর অন্ধকার!
তিনি এখানে শখের বশে আসেন নি এ ঠিক। এসছেন চাকরি করতে। কিন্তু সেরকমতো কতই আসে। সরকারি আফিসের মতো মহাবিদ্যালয়কেও টাকা রোজগারের কল বানিয়ে রাখে। এর বাইরে যে দুনিয়া আছে তার খবরই রাখে না। আজ যখন নিজেও অধ্যাপনার কাজে আছি, তখন এই নির্লজ্জ সত্যতো ভেতর থেকে দেখছি!
কিন্তু তিনি যেন একটা নতুন দেশ আবিষ্কার করেছিলেন। যে ভূখণ্ডের খবর তেমন তাঁর নিজের পশ্চিম বাংলার লোকেরাও তেমন রাখে না, তিনি সেই দেশ আবিষ্কারের আনন্দে মেতেছিলেন। নইলে তিনি কেন শিলং থেকে ভাষা আন্দোলনের দিনগুলোতে এখানে ছুটে আসবেন? কেন ‘কাছাড়ের জনবিন্যাস’ নিয়ে, এখানকার ভাষা , এখানকার ছড়া এখানকার লোক ঐতিহ্য নিয়ে মাথা ঘামাবেন? রবীন্দ্রনাথ তাঁর আগ্রহের বিষয় ছিল । কিন্তু যা সামান্য লেখালেখি করেছেন তা ঐ এখানকার ভাষা ও সমাজকে ভালোবেসে। তাঁকে বৃহৎ বাংলায় পৌঁছে দেবার তাগিদ থেকে। ভাবখানা এই যেন, এদিকেও আছে! এদিকেও তাকাও! না তাকালে অসম্পূর্ণ থেকে যাবে!
তিনি জগন্নাথ রায় চৌধুরীর মতো ততো ব্যস্ত সামাজিক ছিলেন না। আশির দশকে আমি ছাত্র আন্দোলনে সক্রিয় ছিলাম। সুতরাং আগে যেমন লিখেছি, তাঁর সম্পর্কে জানার জন্যে পরের মুখে স্বাদ নেবার দরকার ছিল না। কিন্তু তাঁকে তেমন জনতার কলরবে দেখিনি। প্রচারের মধ্যমণি তিনি তেমন কোনোদিনই ছিলেন না। হয়তো এখানে ওখানে কোনো সংগঠনে জড়িয়ে ছিলেন, তার সবগুলোই ছিল ‘রূপমে’র মতো সাংস্কৃতিক সংগঠন। কিন্তু ১৯৯৩তে অবসর নেবার পরেই তাঁকে এখানে ওখানে দেখা যেতে শুরু হয়। আমরা তখন সাংস্কৃতিক ঐক্য মঞ্চ নামে এক সংগঠন করেছিলাম। সেখানেও কখনো কখনো তাঁকে অতিথি হিসেবে পেয়েছি। পেয়েছি তখনকার সাম্প্রদায়িক দুষ্ট সময়ের মুখোমুখী দাঁড়াবার বেলা। এ ছাড়াও প্রেমেন্দ্র মোহন গোস্বামী , দেবব্রত দত্তের মতো শিক্ষা ও সংস্কৃতির উজ্জ্বল নক্ষত্রেরা চলে যাবার পর যে ক’জন সে জায়গাকে দ্রুত ভরাট করেছিলেন মনে হচ্ছিল তিনি তাঁদের অগ্রপথিক।
আমার সৌভাগ্য যে সেই মানুষটিকে শেষ পর্যন্ত কিছুদিন সহকর্মী হিসেবে পেয়েছিলাম! যে বছরটিতে তিনি অবসর নেন সে বছর থেকে পরের ক’বছর আমি কালাইনের নতুন প্রতিষ্ঠিত সত্যরঞ্জন কলেজে বাংলা পড়াবার কাজ করতাম। তখন কিছু দিন তিনি ওখানকার ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব সামলেছিলেন। এখন কালাইন যাওয়া অনেক সহজ হয়েছে। শিলচর থেকে তখন কালাইন যাওয়া চাট্টিখানি কথা ছিল না । পাঁচবার বাস-রিক্সা পালটে, ভীড় ঠেলে বসে বা দাঁড়িয়ে আড়াই ঘণ্টা পর গিয়ে পৌঁছনো যেত। আজকালকার অধ্যাপকদের মতো তাঁর কোনো গাড়ি ছিল না। তবু তিনি যেতেন। রোজ নয় সপ্তাহে দু’সপ্তাহে একদিন গেলেই কাজ চলত। কিন্তু যেদিন যেতেন, সেদিন কলেজের কাছে সে ছিল এক ঘটনা। কার্যালয়ের কাজ সেরে নিয়ে শুরু হতো আড্ডা। সে আড্ডার বিষয় বৈচিত্র আমাকে অন্তত জানিয়ে দিত নিজের অজ্ঞতার বিস্তার ঠিক কতটা বিশাল। আমার মনে হয়, বাংলার আর যারা শিক্ষক ছিল তাদেরো ওই একই অভিজ্ঞতা হয়েছিল। প্রায়ই সে আড্ডা ফেরার বাস অব্দি এগুতো। আমরা এক সঙ্গেই শহরে ফিরতাম ।
তখনকার আমাদের রোজকার জীবন আড্ডা দেবার পক্ষে খুব অনুকুল ছিল না। অনিশ্চিত ভবিষ্যত, অনিয়মিত মাইনে, নতুন প্রতিষ্ঠিত মহাবিদ্যালয়ের আভ্যন্তরীণ জটিলতার যন্ত্রণা প্রতিনিয়ত আমাদের গায়ে জ্বালা ধরাতো । তার মাঝে তিনি ছিলেন হেমন্তের হাওয়া!
১৯৯৮র শুরুর দিন গুলোতে পরিচালন সমিতির সম্পাদকের কিছু পদক্ষেপ আমাদের শিক্ষকদের মধ্যে অসন্তুষ্টি এতো বাড়িয়ে দেয় যে সমস্যার সমাধান না হলে আমরা প্রায় সমবেত পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়ে পরিচালনা সমিতির অন্য সদস্যদের জানিয়ে দিই। ফেব্রুয়ারি মাসের শেষের দিকে এক সভায় পরিচালন সমিতি সম্পাদক বদল করে সে বিবাদের নিষ্পত্তি করে। আমি তার পরেই সেখান থেকে চলে আসি। পরে শুনেছি, ভক্তিমাধবও আর ওখানে থাকেন নি। আমরা যখন তাঁকে গিয়ে ব্যাথার কথা বলতাম, বুঝতাম তিনি অস্বস্তি বোধ করতেন। যেহেতু তিনি রোজকার ইতিবৃত্ত জানতেন না, তাঁর পক্ষে সিদ্ধান্ত নেয়া কঠিন হতো। এ বিবাদে তিনি কোনো পক্ষ নিয়েছিলেন বলে জানিনা। কিন্তু তাঁকে যে বেশ বিব্রত করেছিল এটি সত্যি। ঐ দ্বন্দ্বমুখর দিনগুলোতেই তাঁর সাথে আমার শেষ দেখা।
পরে পরে, যেমন আর সব খবর কাগজে দেখি, তাঁর সম্পর্কেও দেখতাম। খুবই কম লেখেন বলে দু’একটার বেশি কোথাও পড়েছি বলে মনে হয় নি। কিন্তু যে খবরটি আমি বেশ আগ্রহের সঙ্গে নিয়েছিলাম এবং মনেও রেখেছিলাম, তা এই যে পশ্চিম বাংলার নন্দীগ্রাম হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে যখন কোরাস ও বেশ কিছু সংগঠন প্রতিবাদী সমাবেশ ও আন্দোলন সংগঠিত করেছিলেন তিনি সেখানে সবার সঙ্গে সবার সামনে ছিলেন। কেউ কেউ একে ‘কলকাতাতে বৃষ্টি হলে শিলচরে ছাতা ধরা’র সঙ্গে তুলনা করে হেসেছেন! কলকাতার সরকারি দলের লোকেরা আজকাল এমন হাসির বিদ্যেই বেশ পারদর্শীও হয়েছেন! কিন্তু এতো তা ছিল না। নন্দীগ্রাম নিয়ে দেশে-বিদেশেও প্রতিবাদের ধ্বনি উঠেছে। কারণ ওখানে এক ‘বাম’ সরকার বিশ্বায়নের ধ্বজা দিয়ে কৃষক পেটাচ্ছিল। এ নেহাতৎই ‘বাম’ আর তৃণমূলের সংঘাত নয়। সাম্রাজ্যবাদ বনাম কৃষকের লড়াই! সারা ভারত এতে উদবুদ্ধ বোধ করেছে। সুতরাং নন্দীগ্রামের হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর অর্থ সাম্রাজ্যবাদ তথা বিশ্বায়নের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো। নিজের কিছু ‘সরকারি’ বাম বন্ধুদের রুষ্ঠ করেও ভক্তিমাধব এই যে মিছিলে পা মিলিয়েছিলেন তাতে আমার মনে তাঁর যে প্রতিমূর্তি আঁকা ছিল সেটি আরো একবার বের করে ঘসে মেজে উজ্জ্বল করে রাখতে হয়েছে। এ মূর্তি আর ম্লান হবে না। যিনি সেই ১৯৬১র ভাষা আন্দোলনের দিনগুলোতে প্রতিবাদের আগুন হাতে নেবেন বলে এদেশে ছুটে এসছিলেন শিলং থেকে, তাঁর জীবনের শেষ বেলাতে এ ছিল এক উজ্জ্বল উত্তরণ! আমাদেরতো এই মিছিলেই লোক বাড়াতে হবে! নন্দীগ্রামের বিরুদ্ধে যে মিছিল, সেতো থামে নি। এখনো পথ হাঁটছে। ভারতের কথা বাদই দিলাম, সারা অসমের গাঁয়ে গাঁয়ে কান পাতলেই এখন সে পদযাত্রার ধ্বনি শোনা যায়! শেষ অব্দি এই লড়াইটাই আমাদের জিততে হবে, যদি সমাজের- সংস্কৃতির আর সব রোগ সারাতে হয়! বাকি সব বৃথা! সব কোলাহল !