আমার চেতনার রঙে রাঙানো এই খেলা ঘরে:

~0~0~! আপনাকে স্বাগতম !~0~0~

*******************************************************************************************************

Friday, 12 November 2010

বাঙালি ও বাংলা ভাষার ভোটবর্মী আত্মীয়তার সন্ধানে

( গারোদের জাতীয় উৎসব ‘ওয়ান গালা Wangala২০১০ ‘ উপলক্ষে বাংলাদেশের একটি স্মরণিকার জন্যে লেখা)

             ক সময় ভাষার ভিত্তিতে মনে করা হতো বাঙালি মাত্রেই আর্য নৃগোষ্ঠীরই একটি প্রধান শাখা। এর পেছনে নিজেদের বিলেতিদের সঙ্গে একপাত্রে ঠাঁই নেবার মোহটাই ছিল প্রবল। বাঙালিরা যে আর্য এমন ধারণা উনিশ শতকের হিন্দু ভারতীয়/ বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রবর্তকদের মধ্যে প্রবল ছিল। তাঁদের চিন্তার সমর্থনের বেশির ভাগটাই তাঁরা গুটিয়েছিলেন জার্মান পন্ডিত মেক্সমূলরের রচনাবলীর থেকে। ঋষি অরবিন্দতো তামিল আর সংস্কৃতের মতো দুটো সম্পূর্ণ পৃথক ভাষাগোষ্ঠীকেও একই উৎস জাত বলে ‘আবিষ্কার’ করবার ধারে কাছে গিয়ে পৌঁছেছিলেন। মেক্সমুলর কখনো ভারতে আসেন নি, কিন্তু তিনিই সেকালের  এক প্রধান ভারততত্ববিদ বলে স্বীকৃতি পেয়ে বসে আছেন। এদেশে ও দেশে তাঁর বহু ভক্ত তখনো ছিলেন, এখনো রয়েছেন।  তিনি লন্ডনের ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সংগ্রহশালাতে পাওয়া ভারতীয় নথিপত্রের উপরেই নির্ভর করেছিলেন।  অনেকে এও বলেন ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর অর্থ সাহায্যেই তিনি তাঁর কাজগুলো করেছিলেন। উদ্দেশ্য কী ছিল তা নিয়ে নানা মুনির নানা মত আছে, অনেক পশ্চিমী লোক তাঁর বিরুদ্ধে  খৃষ্ট ধর্মের স্বার্থ বিরোধী কাজ করবার দায়েও অভিযোগ এনেছিলেন । তাতে আপাত দৃষ্টিতে মনে হয় না যে বিলেতি শাসকদের প্রত্যক্ষ কোনো সুবিধে হবার ছিল। কিন্তু, বিলেতিরাও আর্য, ভারতীয়রাও আর্য এমন এক তত্বে যদি খুব হাওয়া পানি দেয়া যায় তবে বিলেতি শাসনকে ঝাড়েমূলে উপড়ে ফেলবার দরকারটা উবে যায় না কী? তাই দেখব পরবর্তী কালে যারা হিন্দুত্বের ধ্বজা তুলে ভারতীয় রাজনীতিতে নেমেছিল তাদের কাছে প্রধান শত্রুপক্ষ হয়ে পড়েছিল বিলেতিরা নয়, এ দেশেরই মুসলমানেরা। ধরে নেয়া হয়েছিল এদেশে ইসলাম একটি নব্যআগন্তুক ধর্ম এবং এই ধর্মের প্রায় সবাই অনার্য সিমেটিক সভ্যতার উত্তরসূরী। এমনটি ধরে নিতে গিয়ে এও ভুলে যাওয়া হয়েছিল যে আধুনিক বিশ্বে যে দেশের নামের সঙ্গে ‘আর্য’ শব্দটি জুড়ে আছে সেই ‘ইরান’ মূলত একটি মুসলমান প্রধান দেশ । অবশ্যি এটি সত্য যে ১৯৩৫এর আগে সরকারি ভাবে ‘ইরান’ নামটি চালু ছিল না, কিন্তু পণ্ডিতি বিস্মৃতির পক্ষে এটি কোনো যুক্তি হতে পারে না। বিশেষ করে যখন সেদেশের আর্য ভাষা ‘পার্শি’ বৃটিশ ভারতেও দীর্ঘদিন রাজভাষা হিসেবে বহাল ছিল ।
              যে উনিশ শতক শুরু হয়েছিল  হিন্দু ধর্মেরই ভেতরে নানা সংস্কার আন্দোলনের মধ্যি দিয়ে সেই শতকের  শেষে এসে দেখলাম সেই সংস্কার আন্দোলনগুলোর লক্ষ্য মুখ ঘুরে গেল অন্য ধর্মাবলম্বীদের বিরুদ্ধে আর একই সঙ্গে ভারতীয়তা আর হিন্দুত্বকে সমার্থক করে শুরু হলো তার গৌরবোদ্ধত আস্ফালন।  রবীন্দ্রনাথ তাঁর বেশ কিছু লেখাতেই সে প্রসঙ্গ ছুঁয়ে গেছেন। তেমনি এক কবিতাতে মজা করে লিখেছেনঃ মোক্ষমুলর বলেছে ‘আর্য’,/সেই শুনে সব ছেড়েছি কার্য,/মোরা বড়ো বলে করেছি ধার্য,...”(বঙ্গবীর)  বিপরীতে  মূলত উত্তর ভারতের অবক্ষয়ী সামন্তীয় সমাজ থেকে গড়ে উঠা মুসলমান মধ্যবিত্তদের  মধ্যে দেখা গেল প্রাচীন আরবি  আর ইসলামি ঐতিহ্যের সঙ্গে নিজেদের যুক্ত করে গৌরবোদ্ধারের প্রয়াস। বাংলাদেশেও যে সামান্য মুসলমান মধ্যবিত্ত সমাজ গড়ে উঠছিলেন তাদেরও একাংশ সেই আবেগে গা ভাসিয়ে ‘আর্য দম্ভে’র জবাব দিতে শুরু করলেন। আসরাফ আতরাফের দ্বন্দ্বে বাংলার মুসলমান সমাজকে ক্ষত বিক্ষত করতে শুরু করলেন।  আরবি জাতীয়তাবাদের সঙ্গে নিজেদের সংযুক্ত করতে গিয়ে আসরাফেরা ‘আরবি’ ভাষাটিকেতো নিজেদের বলে দাবি করতে পারলেন না।  কিন্তু বাংলাকে যথা সম্ভব ‘আরবি’ করে তুলবার চেষ্টা চালালেন। আর ইতিমধ্যে যে উত্তর ভারতীয় ভাষাটি এক স্বাভাবিক ঐতিহাসিক প্রক্রিয়াতে ‘আরবি-ফার্সি’ প্রভাববহুল ভাষাতে পরিণত হয়েছিল কিম্বা সেভাবে গড়ে উঠেছিল সেই উর্দুকে নিজেদের মাতৃভাষা বলে চালাবার চেষ্টা করে গেলেন।

                           সেই উর্দুটাও যে ভারতীয় আর্য শাখারই এক অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাষা সে যেন দুটো পক্ষই ভুলে থাকতে ভালোবাসলেন। একমাত্র ৫২র ভাষা আন্দোলন আর ৭১এর স্বাধীন বাংলাদেশ গঠনের মধ্যি দিয়েও এই বিভ্রান্তির  ইতিহাসের থেকে বাঙালি মুসলমান বেরিয়ে এলেন ।  কিন্তু ‘মোক্ষমুলরের’ পাঠশালা থেকে বহু হিন্দু বাঙালি এখনো যে বেরিয়ে এসছেন তা মনেতো হয়ই না, বরং বহু মুসলমানও আজকাল সেই পাঠশালার আশেপাশে ঘুরাঘুরি করেন এমনটি চোখে পড়ে। মেক্সমূলরের পাঠশালা বলে আমরা সেই জার্মান জাতীয়তাবাদের ইতিহাসের দিকে চোখ ফেরাতে চাইছি যা পরে জার্মানিতে নাৎসিবাদের রূপে চরম আকার ধারণ করেছিল। সেরকম  মেক্সমুলর শিষ্যরাই  ভারতে যেমন কামতাপুরি ভাষাকে বাংলা বলে চালিয়ে দেবার চেষ্টাতে ক্ষান্তি দেন না, তাদেরই সগোত্রীয়রা বাংলাদেশে চাকমা, হাজংদের বাংলা বলে চালিয়ে দিতে পারলেই হাঁফ ছেড়ে বাঁচেন যেন। এর জন্যে তারা যে সহজ বুদ্ধিটি কাজে লাগান, তা এই যে--- কোথায় কোন ধ্বনিতে, শব্দরূপে, বাক্যতত্বে বাংলার সঙ্গে এদের মিল রয়েছে তাই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে  তাঁরা সতত উদ্গ্রীব ।  এই সহজ বুদ্ধিতে এককালে অসমীয়ার মতো পূর্বভারতের উন্নত ভাষাকে বাংলা বলে চালিয়ে দেবার ফাঁদে রবীন্দ্রনাথও পড়েছিলেন। এবং এখন প্রায় সমস্ত অসমীয়া পণ্ডিত সিলেটির মতো বাংলার এক সমৃদ্ধ উপভাষাকেও অসমীয়া বলে চালিয়ে দেবার ভাষারাজনীতি করে থাকেন। 
                     মজা হলো, রবীন্দ্রনাথ যখন অসমীয়াকে বাংলা বলে ভুল করছিলেন তখন অসম বৃহৎ বাংলারই এক প্রান্তীয় অঞ্চল ছিল।  আজ যখন অসমীয়া পণ্ডিতেরা ওই একই পথ ধরে সিলেটিকে অসমীয়া বলে প্রচার করে থাকেন তখন  সিলেটিদের  বাস্তবতা হলো তাদের এক বড় ভাগ অসমের প্রান্তীয় তিনজেলা কাছাড়-করিমগঞ্জ-হাইলাকান্দির  সংখ্যালঘু বাসিন্দা। কামতাপুরিরা অসম, পশ্চিম বাংলা দুই প্রদেশেরই সংখ্যালঘু বাসিন্দা। তাই তাদের ধরে দু’পক্ষই দড়ি টানা টানির খেলা খেলে থাকেন। বাংলাদেশেও রয়েছেন তারা, কিন্তু সংখ্যাতে এতো অল্প যে ওদের কথা কেউ ভুলেও মুখে আনেন না।  সেখানে চাকমা হাজংদের কবে বাঙালি বলে মানানো যাবে তার জন্যে কিছু বাংলা ভাষাপ্রেমীদের রাতের ঘুম হয় না ভালো করে। সম্ভবত ২১ ফেব্রুয়ারীর সকালে শহীদ বেদির তলায় গিয়েও তারা তাদের প্রার্থনা জানাতে ভুল করেন না।  যে দেশের উদ্যোগে ২১এর দিনটি  আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি পায় সে দেশে এখনো বাংলার বাইরে কোনো ভাষার রাষ্ট্রীয় কোনো স্বীকৃতি নেই এর চে’ লজ্জার কথা আর কীই বা হতে পারে! অথচ এক দুটি নয় সে দেশে প্রায় পয়তাল্লিশটি ছোট বড় অবাঙালি নৃগোষ্ঠীর মধ্যে প্রচলিত পঁচিশটিরও বেশি ভাষা রয়েছে।
                   বাংলা আর্য ভাষা বটে---কিন্তু বাঙালি আর্য নয় , বহু নৃগোষ্ঠীর মিশ্রণ সম্ভূত জাতি-- এই সত্য নীহার  রায় , সুনীতি চট্টপাধ্যায়দের কল্যাণে আমরা অনেক আগেই জেনেছি। এই দুজনের মধ্যেই ‘হিন্দুত্ব’ নিয়ে এক গৌরব বোধ ছিল বটে, কিন্তু তারাই এই সত্যগুলোকে প্রথম প্রকাশ্যে নিয়ে আসেন। ‘সংস্কৃত বাংলার জননী ভাষা’ এমন মিথকেও প্রথম জোর ধাক্কা দিয়ে ভাঙ্গেন সুনীতি চট্টপাধ্যায়। অতুল সুর বলে এক সুপরিচিত নৃতাত্বিক গবেষক রয়েছেন---যার হিন্দুত্ব ভাবটাও বেশ সরেস---তিনি অতটা অনার্য হওয়াটাকে মেনে না নিতে পেরে এক ‘আলপাইন আর্য তত্বে’র বেশ প্রচার করেছিলেন, সুনীতি চট্টপাধ্যায় সেই তত্বকেও তাঁর আগেই নাকচ করা সত্বেও। সেই আলপাইনরা বুঝি বৈদিক আর্যদের অনেক আগে এসেই বাংলার সভ্যতাকে নির্মাণ করেছিলেন। দেখা যাবে, এই সব গবেষক-বুদ্ধির লোকেরা বৈজ্ঞানিক নৈরাসক্তিকে দূরে ঠেলে, পায়ে দলে যে মতটিকে দাঁড় করালে নিজেদের আভিজাত্যের, বলা ভালো ভাষিক ও ধর্মীয় আধিপত্যকে প্রতিষ্ঠা দেয়া যাবে সেই মতের পক্ষে অবরোহী পদ্ধতিতে নানা তথ্যের সমাবেশ ঘটাতেই বেশ সহজ বোধ করেন। তাই না দেখে, বর্তমান লেখকও নিজের গায়ের কালো রঙ, শরীরের নাতিদীর্ঘ উচ্চতা দেখিয়ে বাংলা ভাষার ছাত্রদের এই বলতে বেশ ভালোবাসেন যে তার পুর্বপুরুষ ছিল মহিষাসুরের রাজ্যের  কোনো সাঁওতাল আদিবাসি গাঁয়ের ‘গাওঁবুড়া’।
                     চাটগাঁয়ের বন্দরের পথ ধরে আরব-ইরানি ব্যবসায়ী আর সুফি সন্তেরা মোটামুটি খৃষ্টীয় আটের নয়ের শতক থেকে  বাংলাতে প্রবেশ করতে শুরু করেছেন --এই সত্য আমরা জানি। আর্যরা বড় জোর তার এক সহস্রাব্দ আগে থেকে মৌর্য যুগের শেষের দিকে বাংলা দেশে ঢুকতে শুরু করেছিলেন। পুব বাংলাতে তারা রাজা শশাংক, কুমার ভাস্কর বর্মাদের আগে জাঁকিয়ে বসতেই পারেন নি।   এই সব ঐতিহাসিক তথ্য আজকাল এক আধটু অনুসন্ধান  যারা করেন তাদের প্রায় সবার জানা। আমরা শুধু  কথাটা মনে করিয়ে দিলাম, এই সত্যের দিকে চোখ ফেরাতে যে বাংলার প্রাচীন জমানা নিয়ে যদি গৌরব করবার কারো কিছু থাকে, প্রাচীনতার দাবিতে যদি বাংলার মাটির উপর কোনো অধিকার দাবি করবার কারো কিছু থাকে তবে সে বাংলার অনার্য মানুষের।  অন্তত যারা সেই অনার্যত্বকে অক্ষত রাখতে পেরেছেন সেইসব---চাকমা, ত্রিপুরী, মগ, গারো, হাজং, খাসিয়া, রাজবংশি, সাঁওতাল, মুণ্ডা, বডো, রাভা মানুষদের বাদ দিয়ে বাংলার মাটির কোনো কথা শুরুই হতে পারে না।   সেই অর্থে তারাই বাংলার ‘আদিবাসি’ বটে। কিন্তু বাঙালিরা নয় কি? 
                                বাঙালিরা কি আদিবাসি নয়?  আর্যত্বের দাবি দাঁড় করালেই কি বাঙালির আদিবাসিত্ব প্রতিষ্ঠা পায়? অথবা বাঙালি যেহেতু ‘আর্য’ তাই কি তারা শশাংক-ভাস্কর বর্মাদের কালে নিয়ে আসা উত্তর ভারতীয় বামুন কিম্বা চাঁটগাঁয়ের বন্দর দিয়ে  প্রবেশ করে পার্শি বণিকদের সঙ্গে করে আসা আগন্তুক প্রবাসী? রাষ্ট্রসঙ্ঘের ব্যবহৃত শব্দ ‘indigenous’ এর আক্ষরিক অর্থে  ভারতীয় উপমহাদেশে ব্যবহার করাটা বড় গোলমেলে। আফ্রিকা, আমেরিকা, কানাডা, অস্ট্রেলিয়ার মত দেশে গেল দুই তিন শতকে ইউরোপ থেকে গিয়ে  সাদা চামড়ার  সাহেবেরা ওখানকার মুল অধিবাসিদের মেরে কেটে হয় সাফ করে দিয়েছে, নতুবা তাদের প্রান্তিক অবস্থানে ঠেলে দিয়ে নিজেরাই রাজা হয়ে বসেছে। কিন্তু ভারতীয় উপমহাদেশেতো তারা সেটি করতে  পারে নি। প্রাচীন আর্য , পার্শি কিম্বা আরবি কেউ সেটি পারেনি।  ‘শক হূন দল পাঠান মোঘল ‘ এখানে এক দেহে সবাই ‘লীন’ হয়ে গেছে। এই সত্যটি কেন যে আমরা সবাই ভুলে থাকি। কী মুস্কিল! যে সাদা চামড়ার লোকেরা নৃগোষ্ঠী গত সাফাই অভিযানের জন্যে জগৎ বিখ্যাত আমরা তাদের থেকেই নিরাপদে ‘শব্দ’, ‘বাক্য’, ‘পরিভাষা’ এবং ‘তত্ব’ সবই ধার করতে ভালোবাসি।
                 বাংলাভাষাতে ‘উপজাতি’ বলে একটি অপমান জনক শব্দ চালু আছে। তার মানে, যারা এখনো পুরো জাতি হয়ে ঊঠেনি, অন্য জাতির শাখা হয়ে রয়েছে। উপভাষার মতো আরকি। ‘উপজাতি’দের ভাষাকে অনেকেই তাই ‘উপভাষা’ বলে চালিয়ে দেবার ফাজলামোও করে থাকেন। এমনকি বাঙলা দেশে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি ভাষাকেও কেউ কেউ বাংলা বলে চালিয়ে দেন একথা জানতে পেলে শহিদ সুদেষ্ণা সিনহার জন্মভিটে অসমের  করিমগঞ্জে জেলার বহু বাঙালিও আৎকে উঠবেন। পশ্চিম বাংলা –ত্রিপুরাতেও ‘উপজাতি’ শব্দটি চালু রয়েছে। রয়েছে ‘জাতি-উপজাতি’র সংঘাত এবং ‘ভাই ভাই ঠাই ঠাই’ করবার বিপরীত রাজনীতিও। অসমেও শব্দটি ছিল। কিন্তু এখানেই সম্ভবত শক্তিশালী জনজাতীয় রাজনীতির দৌলতে এক সম্মানজনক সমাধান বের করে এনে ব্যবহৃত হচ্ছে ‘জনজাতি’।   ‘Indigenous’ শব্দটি  অসমেরর রাজনীতিতেও এক জনপ্রিয় শব্দ। কিন্তু তার অসমীয়া প্রতিশব্দ একটি আরবি মূলীয় শব্দ ‘খিলঞ্জিয়া’ । ‘খিলঞ্জিয়া’ বললে কেবল Tribal’ দেরকে বোঝায় না। অসমীয়া ‘ভট্টাচার্য-চক্রবর্তী’ বামুনরাও নিজেদের খিলঞ্জিয়া বলে দাবি করতে সদা ব্যস্ত। আটশ বছর আগে অসমে আসা ‘আহোমে’রাও খিলঞ্জিয়া, কিন্তু হাজার কয় বছরের প্রাচীন করিমগঞ্জের সিলেটিরা নয়।  ধরেই নেয়া হয় যে, অসমের বাঙালিরা এই সেদিন বৃটিশ আমলের নব্য আগন্তুক বিদেশি। বহু বাঙালি সেটি বিশ্বাসও  করে ।  যখন ‘খিলঞ্জিয়া’দের জন্যে সাংবিধানিক অধিকারাদি দাবি করা হয় ,তখন সে দাবির থেকে অন্য ‘আগন্তুক’ ভারতীয়রা বাদ পড়েন। ময়মনসিংহ মুলের মুসলমান বাঙালিদের অসম সাহিত্য সভার মতো প্রভাবশালী  সংগঠন ‘ন’অসমীয়া’  বলে স্বীকৃতি দিলেও তারা ‘খিলঞ্জিয়া’তো ননই, আমজনতা তাদের ‘বাংলাদেশি’ বলেই ভেবে থাকে এবং সেরকম ব্যবহারও করে থাকে তাদের প্রতি।
                   ভয় হয়, বাংলাদেশে যদি বাঙালিরা ‘আদিবাসি’  না হন তবে তাদেরকেও     একদিন  ‘ নব্যআগন্তুক’ বলে ভেবে নেয়া হবে নাতো?  প্রশ্নটি ‘আদিবাসি’দের  পরিচিতি আন্দোলনের কৌশলগত অবস্থান থেকেও উঠা উচিত।  বহু বাঙালি মনে এই প্রশ্নটি কাজ করবে। শাসক শ্রেণির  জাত্যাভিমানী অবস্থানের বাইরেও বহু সাধারণ বাঙালি নিজেদের বিপন্নতাবোধ থেকেও এর বিরোধীতা করছেন আর করবেন। তাই দেখা যাবে  যেসব দল সংগঠনগুলো সেদেশে ‘নীতিগত’ভাবে ‘আদিবাসি’ পরিচিতির দাবিকে মেনে নেন, তারাও কৌশলগত অবস্থানে অন্যত্র গিয়ে ‘উপজাতি’ শব্দটিই দেদার ব্যবহার করে থাকেন।
                    অবিভক্ত বাংলাদেশে বাংলা ভাষাটি মূলত আগন্তুক ভারতীয় আর্য ভাষার সন্তান, এর গড়ে উঠার বয়স হাজার বছরের বেশি নয়। ব্রাহ্মণ্য হিন্দু ধর্মও এখানে নব্য আগন্তুক ধর্ম, ইসলামতো বটেই। কিন্তু, তাই বলে বাঙালি আগন্তুক নয়। এখানে যে প্রাগআর্য ‘কিরাত-নিষাদ’ নৃগোষ্ঠীগুলো ছিল তারাইতো কালক্রমে ব্রাহ্মণ্য প্রভাবে সামন্তীয় স্থায়ী কৃষি অর্থনীতিতে প্রবেশ করল আর আর্য ভাষা, ধর্ম এবং সংস্কৃতিকে বরণ করে নিল। সেই ষোড়শ শতকে বডোমূলীয় রাজা কুমার ভাস্কর বর্মার কামরূপের আমল থেকেই সেই প্রক্রিয়া চলছে। পুব বাংলার এক বড় ভাগ সেই কামরূপের অঙ্গ ছিল সে কথা যেন আমরা ভুলে না যাই। আর শুধু ব্রাহ্মণ্য প্রভাবেই বলি কেন? শাহজালাল থেকে শুরু করে যে সুফী সন্তরা এদেশে এসছিলেন তাদের ধর্ম প্রচারের ভাষা কী ছিল স্মরণ করুন। আরাকানে, কাছাড়ে, ত্রিপুরাতে, কামতাপুরের রাজসভাতে  কেন বাংলা সাহিত্য চর্চা হচ্ছে ভাবতে বসুন। গেল হাজার বছরে এদেশে ধর্মান্তরণের কথাগুলো ইতিহাসের বইতে খুব বড় বড় করে লেখা হয়েছে তাতে ধর্মীয় জাতিয়তাবাদী রাজনীতির বেশ সুবিধেও হয়েছে।  ভাষান্তরের কথাটাওতো লেখা হয়েছিল। কিন্তু সেগুলো বাংলা ভাষার ইতিহাসের ভূমিকা হিসেবে থেকে গেল। এ নিয়ে কেউ   কেউ হৈ চৈ করবার তেমন দরকার বোধ করলেন না।  যেটুকু হয়েছে , তা ঐ বাঙালির একাংশকে উর্দুতে ভাষান্তরিত করবার প্রয়াস নিয়ে। তার সঙ্গে জড়িয়ে ছিল হিন্দু-মুসলমান ধর্মীয় পরিচিতির বিরোধও। এই ভাষা বিরোধ নিয়ে বাঙালি এতো ব্যস্ত রইল যে তার নিজেরই আদিম ভাষাগুলো , পরে যেগুলো তার প্রতিবেশি ভাষা হয়ে গেল সেদিকে তাকাবার দরকারও সে বোধ করল না  আর করলেও  ফুরসত যেন সে কোনোদিনই  পেল না। এটি আমরা প্রায় নিশ্চিত হয়েই বলতে পারি। কেননা রামেশ্বর শ’ গেল শতকের আশির দশকের মাঝামাঝি ( বাংলা ১৩৯০) তাঁর ‘সাধারণ ভাষা বিজ্ঞান ও বাংলা ভাষা’ বইতে ভারত বাংলাদেশে বাঙালির ভাষাতত্ব চর্চার এক খতিয়ান তুলে ধরেছিলেন। সেখানে দেখা যাবে দু’একজন সাঁওতালি বা নেপালি ভাষা নিয়ে এক আধটু অধ্যয়ন করলেও বাঙালি ভাষাতাত্বিকদের প্রায় কেউই প্রতিবেশি অন্য ভাষা নিয়ে বিশেষ চর্চা করেন নি। সেই সুনীতি চট্টপাধ্যায় যা তাঁর ওবিডিএল লিখবার দরকারে এবং পরেও ‘কিরাত জনকৃতি’র মতো  গ্রন্থে কিছু কিছু কাজ করেছিলেন। নীহার রঞ্জন রায়,  মুহাম্মদ সহীদুল্লাহদের ধারণা ছিল দ্রাবিড় বিশেষ করে অস্ট্রিক সাঁওতাল মুণ্ডারিদের প্রভাব যদিও বাংলাতে ব্যাপক, ভোট বর্মীদের প্রভাব প্রায় নগণ্য বললেই চলে।
                      অতি অল্প বাঙালিই তারপরে প্রশ্ন করেছেন,”তা কী করে হবে?” সুনীতি চট্টপাধ্যায় ‘কামরূপী’কে বাংলার একটি উপভাষা বলে চিহ্নিত করে যাবার পর ভারতে অন্তত প্রায় সমস্ত বাঙালি  ভাষাতাত্বিক তাঁর এই উপভাষা বিভাজনকে নিয়ে প্রশ্ন তুলেন নি। এই ‘কামরূপী’রাই এখন ‘কামতাপুরি’নামে বাংলার থেকে ( এবং অসমিয়ার থেকেও)  আলাদা হয়ে যেতে চাইছেন। তারা যে নৃগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করেন সেই কোচ-রাজবংশীরা যে স্পষ্টতই বডোদের থেকে বেরিয়ে যাওয়া ভোট-বর্মী নৃগোষ্ঠির লোক সেই সত্য কিন্তু কেউ অস্বীকার করেন না। তারা কি আর্যায়নের প্রক্রিয়াতে চলে এলেন তাদের নিজেদের কোনো নৃতাত্বিক প্রভাব ছাড়াই? এই সত্য কে কবে প্রমাণ করলেন? যে মণিপুরিরা বিষ্ণুপ্রিয়া নাম নিয়ে আর্যভাষা বরণ করে নিলেন তাদের ভাষাতে কি মণিপুরি প্রভাব বলতে কিছুই নেই? তর্কের খাতিরে না হয় মেনে নেয়াই গেল তারাতো আর বাঙালি নন, কিন্তু একটি ভোটবর্মী জনগোষ্ঠি কেমন আর্য ভাষার অধিকারী হয়ে পড়তে পারেন বিষ্ণুপ্রিয়ারা কিন্তু এই সময়ে তার প্রত্যক্ষ নিদর্শন। তাদের নিয়ে বাঙালিরা ভারতে টানাটানি না করলেও অসমিয়ারা করে থাকেন। হাজং, চাকমারাও শুধু প্রমাণ করেন যে  কী রকম এক একটি জনগোষ্ঠী তাদের   নিজস্ব গতিতে আর্যায়নের প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ হবার আগেই বাঙালিকরণের চাপের মুখে অবরুদ্ধ পথে দাঁড়িয়ে গেছে। চাকমা -হাজংদের  বাঙালি বলব আর তাদের ভাষার মধ্যে  ভোটবর্মী প্রভাব নিয়ে মাথা ঘামাবো না, বরং তারা কতটা বিশুদ্ধ আর্য-বাংলার অধিকারী তাই প্রমাণ করতে মাথার ঘাম পায়ে ফেলব এমন দ্বিচারিতা কি না করলেই নয়? 
                 এই চাকমা-হাজং-কামতাপুরি-বিষ্ণুপ্রিয়া ভাষার লোকেরা হচ্ছেন পুথির বাইরে আমাদের চোখের সামনে থাকা সেই সব জনগোষ্ঠি যারা প্রমাণ করেন যে নৃগোষ্ঠীগুলোর ধর্মান্তরণ শুধু নয়, ভাষান্তরণও একটি অবশ্য সম্ভব ঐতিহাসিক প্রক্রিয়া। তারা যদি, তাদের প্রাচীন অনার্য ভাষাগুলো ছেড়ে আর্য ভাষাকে বরণ করেছেন তবে সেটি হয়েছে এক স্বাভাবিক ঐতিহাসিক সামাজিক প্রক্রিয়াতে। ইতিহাসের নানা সময়ে এ রকম বিচিত্র  প্রক্রিয়াতে, বিশেষ করে স্থায়ী কৃষি ব্যবস্থাতে এবং সেই সঙ্গে আর্যায়নের প্রক্রিয়াতে প্রবেশ করে যে অনার্য নৃগোষ্ঠিগুলো  সে প্রক্রিয়াকে সম্পূর্ণ করেছেন বাংলাদেশে তারাই গেল এক হাজার বছরের নবাবী আমলে নিজেদের ‘বাঙালি’ বলে পরিচয় গড়ে তুলেছেন। সেই অনার্যদের মধ্যে অস্ট্রিকরা অবশ্যই আছেন। কিন্তু, পূব বাংলাতে আর্যদের আসার আগেই যে ভোটবর্মীরা ছেয়ে গেছিলেন সে কথা সুনীতি চট্টপাধ্যায় লিখে গেছেন। তারা সব গেলেন কোথায়? তারাই বাঙালি হলেন, গড়ে তুললেন বাংলাদেশ।  
                  বাংলা চর্চা করবার জন্যে  তাদের কেউ বাধ্য করেনি। মণিপুরে শতিনেক বছর আগে প্রাচীন মণিপুরি লিপিতে লেখা সমস্ত বইপত্র পুড়িয়ে ফেলে বাংলা লিপি চালু করা হয়েছিল। কিন্তু সেটি বাঙালিরা গিয়ে করেন নি। মণিপুর রাজ পামহেইবা বৈষ্ণব গুরু শান্তিদাসকে ডেকে নিয়ে গেছেন। নিজে বৈষ্ণব ধর্ম বরণ করেছেন এবং বৈষ্ণব ধর্মের প্রচারের স্বার্থে তিনিই প্রাচীন মণিপুরি লিপি বর্জন করিয়েছিলেন।
                      এখন সে  রাজতন্ত্র গেছে বটে , কিন্তু জনতন্ত্র কায়েম হয়নি। ‘গণতন্ত্রে’র নামে কায়েম হয়েছে  সংখাগুরুতন্ত্রের ভন্ডামী। ধর্ম-আর ভাষার নামে চলে সেই সংখ্যাগুরুতন্ত্র। ভোটের জন্যে ‘সংখ্যালঘু তোষণে’র অভিযোগ যতই উঠে থাকুক না কেন, সংখ্যাগুরুকে তরল আবেগে খুশ করে রাখাটাই এই সংখ্যাগুরুতান্ত্রিক রাজনীতির প্রধান ধারা। বাংলাভাষা নিজেই সেই সংখ্যাগুরুতন্ত্রের স্বীকার ছিল বাংলাদেশে, এখনো আছে ভারতের অসমে। দু’দেশেই ভাষার জন্যে বাঙালি প্রাণ দিয়েছে।  এখন সেই বাঙালি নিজেই যেখানে স্বাধীনতা আর স্বাতন্ত্র্য অর্জন করতে পেরেছে সেখানে চালাচ্ছে সেই বাংলাভাষার ‘গনতন্ত্র’। সেটি হোক বাংলাদেশে, কিম্বা ত্রিপুরাতে কিম্বা পশ্চিম বাংলাতে। ধর্ম আর ভাষার নামে জাতীয়তার আবেগকে প্রবল না করলে পুঁজিবাদ নিজের লুন্ঠনকে আড়াল করবার পথ খুঁজে পায় না। এই জাতীয়তার বাইরের লোকেরাতো শাসক শ্রেণির  ঘোষিত শত্রু বটে, জাতীয়তার ভেতরে থেকে যারা বর্তমান লেখকের মতো সেই গণতন্ত্রের মুখোস উন্মোচন করেন  তারা চিহ্নিত হয়ে পড়েন ‘জাতির শত্রু –জাতি বহির্ভূত  শত্রু পক্ষের  দালাল’ বলে। এভাবে জাতীয়তাবাদ তার বাইরে ভেতরে সাঁড়াশির আক্রমণ হানে নিজের দেশেরই দুর্বল জাত-বর্ণ-শ্রেণি-লিঙ্গগুলোর এবং যারা আরো ব্যাপকতর গণতন্ত্রের আওয়াজ তুলেন তাদের  বিরুদ্ধে। নিরাপদে থাকে বিদেশি সাম্রাজ্যবাদ।  
                  আমরা এটা দেখাবার চেষ্টা করলাম বটে যে বাঙালিরাও বাংলাদেশে, পশ্চিম বাংলাতে, ত্রিপুরাতে, কাছাড়ে, করিমগঞ্জে ‘আদিবাসি’, ‘খিলঞ্জিয়া’, ‘Indigenous’; কিন্তু ‘Tribal’ অথবা অসমের অর্থে ‘জনজাতি’ নয়। কানাডা, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, লাতিন আমেরিকার মতো বাঙালিরা আগন্তুক বিদেশি দখলদারও নয়। কিন্তু, বাঙালি জাতীয়তাবাদটি এক বিলেতি আমদানি। সেই জাতীয়তাবাদের ভূমিকা বিলেতি ‘Nationalism’ থেকে তথা ‘Nation State ’ গড়বার প্রয়াস থেকে ভিন্ন নয়। যে ন্যাশনেলিজম তার আভ্যন্তরীণ জাতি-বর্ণ-ধর্মগত বৈচিত্রকে ভয় করে , এবং প্রায়শঃই নানা ছুতোয় তাকে ধ্বংস করবার চেষ্টা করে। একেই তারা নাম দেয় ‘জাতীয় সংহতি’ । সেই ‘সংহতি’ নিজেকে প্রকাশ করে সাম্প্রদায়িকতার চেহারাতে। রাবীন্দ্রিক ভাষাতে ‘অজগর সাপের ঐক্যনীতি’। পাকিস্তানের শাসকেরা যার জন্যে খোদ বাঙালিদের মধ্যেই কুখ্যাত।   যে সাম্প্রদায়িকতার স্বীকার বাংলাদেশের চাকমা, গারো, ত্রিপুরা, মগ, হাজং, মণিপুরি ইত্যাদি ভাষিক সংখ্যালঘু মানুষেরা। ঘটনা চক্রে তাদের ধর্মও সংখ্যাগুরুর ধর্ম থেকে ভিন্ন। ধর্মটি এক হলেও যে তারা সেরকম সাম্প্রদায়িকতার স্বীকার হতেন তার প্রমাণ সেদেশের বিহারি মুসলমান সম্প্রদায়। ভারতবর্ষের বাংলা কাগজগুলো মূলত সেদেশে হিন্দু বাঙালির বিরুদ্ধে  সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে সরব। কেননা, তারাও এক ভাষিক জাতীয়তাবাদের ধ্বজা তুলে রেখেছে যার রঙটি শুধু হিন্দু। বাংলাদেশের ভাষিক সংখ্যালঘুদের প্রতি তাদের  দরদ কেমন তা বুঝতে হলে এদেশে স্মরণার্থী হয়ে আসা বাংলাদেশের ‘চাকমা’দের দিকে তাকালেই  স্বরূপ স্পষ্ট হয়ে যাবে। সারাক্ষণ ভিটেচ্যুত হবার ভয় তাদের তাড়া করে বেড়ায় মিজোরামে , অরুণাচলে। 
            জাতীয়তাবাদ চেষ্টা করে সবাইকে বাঙালি করতে, চেষ্টা করে  এটি প্রমাণ করতে যে সংখ্যালঘুদের কারা কী পরিমাণে বাঙালি হয়েই আছেন। কিন্তু যদি গণতন্ত্রকে সত্যি শক্তিশালী করতেই হয়, তবে কে বাঙালি আর কে নয় সেটি প্রমাণ কিম্বা অপ্রমাণ করবার অধিকার দিতে হবে সেই নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীকে। যারা বাঙালি বলে নিজেদের স্বীকার করবেন না, তাদের ভাষা সংস্কৃতি যত ক্ষুদ্রই হোক তাকে সম্মান জানানো স্বীকৃতি জানানো এক সুস্থ আর স্বাস্থ্যবান ভবিষ্যতের জন্যেই এক অবশ্য প্রয়োজনীয় বিষয়। তা নইলে আজ হোক কাল হোক আন্তর্জাতিকভাবে ২১শে ফেব্রুয়ারির ইতিহাস লজ্জিত হবে এটি প্রায় নিশ্চিত। চাকমা হাজংদের ভাষা কতটা বাঙালি , সেই সত্য প্রমাণ করবার পন্ডশ্রম না করে, বাংলা কতটা ভোটবর্মী ,  কিম্বা অস্ট্রিক সেই গবেষণাতে  বাঙালি শ্রম নিয়োগ করুক। তাতে লাভ দুটো। প্রথমতঃ এই সব ছোট ছোট জনগোষ্ঠির স্বমর্যাদা আর স্বাধিকার বোধ প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়াতে বাঙালি দ্রুতি এনে তাদের আপন  করে নিতে পারবে। তারা বিশ্বাস করতে পারবেন যে জোর যার মুলুক শুধু তারই নয়। ‘প্রথম আলো’ কাগজে পড়লাম ২০০৯ সালের চট্টগ্রামে অনুষ্ঠিত  আদিবাসি মেলাতে বাংলাদেশের শিল্পমন্ত্রী দিলীপ বড়ুয়া বললেন, “বাঙালি জাতিসত্তার সঙ্গে মিশে আছে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ৩৫টি আদিবাসী গোষ্ঠী। তারা বাংলাদেশের সৃজনশীল চেতনাকে সমৃদ্ধ করছে। তারা আমাদের গর্বিত নাগরিক। তাদের ঐহিত্য ও সংস্কৃতিকে লালন এবং বিকশিত করে অসাম্প্রদায়িক চেতনার বাংলাদেশ গড়তে হবে।“ এমন উক্তি মোটেও অসাম্প্রদায়িক নয়। এ হলো বাংলাভাষার ভেতরে সবাইকে বিলীন করে ফেলবার  সাম্প্রদায়িকতা।  এমন উক্তির সামনে সংখ্যালঘু ভাষা সম্প্রদায়ের মানুষ শুধু ভয়ে নীরবে থাকতে  পারেন। মনে মনে তারাও তাদের নিজেদের ভাষা সংস্কৃতির জন্যে  নতুন করে সেই  ‘১৯৫২’র আগুন ধিকি ধিকি করে হলেও জ্বালবেন আর জ্বালচ্ছেন। এই করে সমৃদ্ধ আর ঐক্যবদ্ধ বাংলাদেশ গড়া যাবে না। এই করে তাদের মধ্যে শিক্ষাদীক্ষাও ছড়ানো যাবে না। কেন না এই সত্যতো বাঙালিই বড় গলাতে বলে থাকে যে ‘মাতৃভাষা মাতৃদুগ্ধ সমান।’ চাকমা-হাজং –গারো-বিষ্ণুপ্রিয়াদের মাতৃভাষার হবেটা কী?  দ্বিতীয়তঃ বাংলা কতটা ভোটবর্মী ,  কিম্বা অস্ট্রিক সেরকম  গবেষণাতে  বাংলা ভাষা আর বাঙালির ইতিহাসেরও  অনেক নতুন দিক উন্মোদিত হবে এটি নিশ্চিত।
                  আমরা সেরকম দুএকটি ভাষাতাত্বিক ইঙ্গিত দিয়ে আমাদের এই লেখা শেষ করব।
                                        “আশীর্বাদম ন গৃহ্নিয়াত পূর্ব দেশ নিবাসিনাম ।
                                         'শতায়ুর' ইতি বক্তব্যে, 'হতায়ুর' ইতি ভাষিনাম ।।
           --এই শাস্ত্র বাক্যটির উল্লেখ করেছেন সুনীতি চট্টপাধ্যায় তাঁর বিখ্যাত বই ODBL-এ । আমরা পূর্বদেশবাসীদের থেকে আশীর্বাদ নিতে মানা করা হচ্ছে। কেন না আমরা 'শতায়ু' হবার আশীর্বাদ দিতে গিয়ে 'হতায়ু' হবার শাপ দিয়ে বসি। আমরা মানে প্রায় সমস্ত পূব বাংলার বাঙালিরা আর অসমিয়ারা । এই শাস্ত্রবাক্য প্রমাণ করে আমরা বহু আগে থেকেই এই 'হ' উচ্চারণ করি । যাদের থেকে আশীর্বাদ নিতে মানা করা হচ্ছে তারা হয় আর্য নন, নতুবা ইতিমধ্যে ভেজালে পরিণত হয়েছেন। তারা ‘হতায়ু’ বলেন কেন ?   ---এই প্রশ্নের উত্তরই খুব কম লোক সন্ধান করেছেন । সুনীতি চট্টপাধ্যায়ও তাঁর গ্রন্থে খুব নিশ্চিত হয়ে কিছু উত্তর দেন নি। কিন্তু  লিখেছেন , “. . . The presence of a large Tibeto-Burman element in the population of Assam and East and North Bengal may have something to do with this....”  এই ‘হ’ উৎস সন্ধানে অনেকে আলপাইন আর্যদের ভাষা অব্ধিও গিয়ে পৌঁছোন। অনেক আর্যভাষাতে এই ‘হ’কারীভবন  দুর্লভও নয়। কিন্তু তার আগে ‘আলপাইন’ তত্বেতো নিশ্চিত হতে হবে। তার চে’ বরং সুনীতি চট্টপাধ্যায়ের অনুমানের পক্ষে তথ্যাদি আমাদের হাতের কাছেই রয়েছে।
                             এই /স-শ-ষ/এর ‘হ’ হবার তথা মহাপ্রাণতার প্রবণতা পুব বাংলার উপভাষাগুলোতে ব্যাপক। তা এমনই যে শুধু ‘হে‘,হকালি বেলা’, ‘হাইঞ্জা বেলা’, ‘হক্কলডি’র মতো শব্দগুলোতেই নয় ,শব্দের শুরুতে অ/আ স্বরান্ত ব্যঞ্জন পেলেই , এমনকি শুধু ‘অ’কে পেলেও হয় মহাপ্রাণ হয়ে যাবে অথবা শেষের দিকে হবার প্রবণতা দেখাবে। তাই পূব বাংলার লোকেরা ‘কাপ’, পাপড়, চল, চাল, জল , জাল, ‌পরান,কপাল  উচ্চারণ করতে পারেন না। করেন কা’প,পা’পড়, চ’ল,জ’ল, জা’ল, প’রান, ক’পাল  অনেকটাই /খা,ফা,ছ,ঝ,ফ,খ/-এর কাছাকাছি কিন্তু পুরোটা নয়। অকারণ হয়ে উঠে অহকারণ, অনাচার হয়ে যায় অহনাচার। এরকম ‘হ’ –এর টানে অ অনেক সময় ‘আ’ হয়ে যায় যেমন আঞ্চল, আষ্ট। আবার উল্টোটাও হয় । সাধারণত সঘোষ মহাপ্রাণ অল্পপ্রাণে পরিণত হয়। ‘হ’ থাকলেতো কথাই নেই ‘হলদি’ হয় ‘অ’লদি’; ভাত হয়ে যায় বা’ত ; ভাই হয়ে যায় ‘বা’ই’ ; ‘ঘাই’ হয়ে যায় ‘গা’ই’। বডো ভাষার স্বরধ্বনিতে ‘অ’ নেই, ‘আ’ রয়েছে। ক,ত,চ,ট,প,ঘ,ধ,ঝ, স,ষ,শ এরকম কোনো ব্যঞ্জন ধ্বনিই নেই। কিন্তু ‘হ’ রয়েছে। বস্তুত এই ‘হ’ ধ্বনিটিই খুব মোটা দাগে পূর্ব আর পশ্চিম বাংলার বাংলাকে আলাদা করে চিনিয়ে দেয়। সাধারণত বাংলাভাষাতে /স, ষ/এর কোনো স্বনিমীয় তাৎপর্য নেই। বাঙালি সবেতেই উচ্চারণ করে ‘শ’। তবু পশ্চিম বাংলার কিছু বাঙালি যে ‘স’ উচ্চারণ করে তাঁর উৎসের খোঁজে সাঁওতালি ভাষা অব্দি গিয়ে পৌঁছুনো যেতে পারে। তারাও যে খুব বিশুদ্ধ আর্য নয় তার প্রমাণ তাদের ভাষাতে প্রথম পুরুষে ‘সে (হে) –তাই’ এমনটি সংস্কৃতের ( কিম্বা পুব বাঙালিদের) মতো লিঙ্গভেদ নেই। এমন  লিঙ্গভেদ নেই বডোতেও, সাঁওতালিতেও। এখন, এই দুই ভাষাগোষ্ঠীর কারা তাদের প্রভাবিত করছে সেটিও অনুসন্ধানের বিষয় হতে পারে। 
                 এই ‘হ’ ধ্বনিই অসমিয়াকে বাংলার সঙ্গে আলাদা করে। অসমিয়াতেতো স্বতন্ত্র অবস্থাতে থাকা /শ,স, ষ/ তিনটিই ‘হ’ উচ্চারিত হয় তাও স্পষ্ট উষ্ম নয়, একটু ঘৃষ্ট। তাই তারা  ইংরেজিতে ধ্বনিটি প্রকাশ করেন ‘h’ লিখে নয়, লেখেন ‘x’-- Mexico  (‘মেহিকো’)-তে যেরকম । তাঁরা অসম লেখেন Asom নয় Oxom ।অসমিয়াদের মধ্যে এই ‘হ’ ধ্বনিটি নিয়ে বেশ একটা গৌরব বোধ রয়েছে। পুব বাংলার বাঙালিদের সেনিয়ে গৌরব  না করবার কোনো কারণ আছে কি? আমরা আরো টেনে গেলে দেখাতাম এই একটি ধ্বনি পুব বাংলার উপভাষাগুলোর  উপর কত বিচিত্র রঙ চড়িয়েছে। 
                   কিন্তু , সে হবেখন অন্য সময়, অন্য কোনোখানে। আমরা যদি  আপাতত তাই নিয়ে ‘বাঙ্গালদের’ গৌরব বোধ একটু বাড়াতে অনুপ্রাণিত করতে পারি, (সিলেটি হিসেবে বর্তমান লেখকের সেই গৌরব বোধ প্রবল), যদি আমাদের আত্মার আত্মীয় বলে প্রতিবেশি সংখ্যালঘু ভাষার মানুষকেও—তাদের ‘আদিবাসি’ কিম্বা ‘জনজাতি’ যে নামেই চিহ্নিত করুন--- সেই ঐতিহ্যের প্রতি গৌরববোধের শরিক করতে পারি, সেই ঐতিহ্যের ঘনিষ্ঠ আর প্রত্যক্ষ বাহক বলে তাদের ভাষা সংস্কৃতির সমান স্বীকৃতি, মর্যাদা আর বিকাশের লড়াইতে তাদের পাশে দাঁড়াবার জন্যে আরো কিছু বন্ধু বাড়াতে   পারি তাতেই আমার এ লেখার শ্রম সার্থক। তাতে বাংলা ভাষা বিপন্ন হবে না, সমৃদ্ধ হবে। তার নিজেরই আরো আরো নতুন সম্ভাবনার দোয়ার খুলে যাবে—এটি নিশ্চিত।
তথ্যসূত্রঃ ১) The Origin and Development of Bengali Language, Suniti Kumar Chatterji;২) বাঙালির ইতিহাস, নীহার
    রঞ্জন রায়;
৩) বাঙালা ও বাঙালীর বিবর্তন , অতুল সুর; ৪) ভাষার ইতিবৃত্ত, সুকুমার সেন;৫)সাধারণ ভাষা বিজ্ঞান ও বাংলা ভাষা;
৬)ভাষাপ্রেম ভাষাবিরোধ, পবিত্র সরকার;৭) উত্তর বঙ্গের ভাষা, সম্পাদনা রতন বিশ্বাস;৮) অসমীয়া আরু অসম্র ভাষা উপভাষা,
 উপেন রাভা হাকাচাম;৯) অসমীয়া আরু অসমর তিব্বতি-বর্মীয় ভাষা, ঐ; এবং এরকম কিছু ওয়েবসাইটঃ অ)
http://w4study.com/?p=22, আ)http://www.prothom-alo.com/detail/news/42105,
ই)http://swabhimanngo.blogspot.com/2010/08/protibadi-  aandolon-o-bamponthider.html, ঈ)
   http://www.facebook.com/note.php?note_id=138982706139600