আমার চেতনার রঙে রাঙানো এই খেলা ঘরে:

~0~0~! আপনাকে স্বাগতম !~0~0~

*******************************************************************************************************

Sunday, 19 February 2012

সুরমা নদীর গাংচিল হেমাঙ্গ বিশ্বাসের আকাশী গঙ্গা


(নিখিল ভারত বঙ্গ সাহিত্য সংস্কৃতি সম্মেলনের তিনসুকিয়া শাখার মুখপত্র 'প্রতীতি'র জন্যে হেমাঙ্গ বিশ্বাস নিয়ে এক প্রাথমিক পাঠ)
                 
দেখিতে গিয়াছি সিন্ধু।
দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া
ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া
একটি ধানের শিষের উপরে
একটি শিশিরবিন্দু।
    বীন্দ্রনাথের এটি জনপ্রিয় অনুকবিতা। মাঝে মাঝে মনে হয় আমাদের পূর্বোত্তরের বাঙালিদের কথা ভেবে লেখেন নি তো? গেল বছর আমরা রবীন্দ্রসার্ধশতবর্ষ নিয়ে মাতলাম। অথচ কই, কেউ কবি অশোক বিজয় রাহার কথা বিশেষ মনে রাখলেন না তো! এবারে আমরা স্বামী বিবেকানন্দকে নিয়ে মেতেছি, সব্বাই। প্রায় সমস্ত ছোট বড় শহরে তাঁকে নিয়ে উৎসব অনুষ্ঠান হচ্ছে আর হবে, কিন্তু কই, আমাদের ঘরের কাছের মানুষ যিনি আমাদের জন্যেই আজীবন পণ করেছেন, জীবনের ঝুঁকি নিয়েছেন, জেলে গেছেন সেই হেমাঙ্গ বিশ্বাসকে স্মরণ করবার দায় আমরা গুটি কয় ‘বুদ্ধিজীবি’র কাঁধে চাপিয়ে দিব্বি সুখে আছি! এবছর তাঁর শতবর্ষ! তাঁকে সেভাবে স্মরণ না করবার কারণটুকু কি? তিনি আমাদেরই লোক, ‘গাঁয়ের যোগী’ বলে! কলকাতাতে দীর্ঘদিন থাকলেও ঠিক সেখানকার মূলস্রোতের সিলমোহর তাঁর গায়ে পড়েনি বলে? এভাবে যে আমরা কোনদিনই স্বনির্ভর হয়ে, স্বমর্যাদাতে নিজের পায়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারব না, সে যতই রবীন্দ্রনাথ, বিবেকানন্দ, নেতাজী সুভাষের উত্তরাধিকার আমাদের উপর বর্তাক -- এই সত্যটুকু নিয়ে কি খানিক অবসরেও ভাবব না?
soruo-white swan

         ‘হেমাঙ্গ বিশ্বাসঃ সাংস্কৃতিক চেতনাৰ অমল সুবাস’ নামে ফটিক বরার এক চটি বই রয়েছে। সেখানে তিনি এক জায়গাতে আক্ষেপ করে লিখেছেন, “আধুনিক অসমৰ আকাশৰ তিনিটা উজ্জ্বল তাৰকাই সংস্কৃতিৰ পোহৰেৰে জনজীৱন পোহৰাই আছে। ডিব্রুগড়ৰ তামোলবাৰী বাগিচাত ওপজা জ্যোতিপ্রসাদ, সুদূর সাগৰ পাৰৰ ঢাকাত ওপজা বিষ্ণুপ্রসাদ আৰু সুৰমা উপত্যকাৰ শ্রীহট্ট জিলাৰ মিৰাশী গাঁওত ওপজা হেমাঙ্গ বিশ্বাস---তিনিও আঢ্যবন্ত, আটন্তিয়াৰ পৰিয়ালত , সোণৰ নহলেও, ৰূপৰ চামুচ মুখত লৈ জনম লৈছিল। উত্তৰাধিকাৰ ৰূপে পোৱা সুখ স্বাচ্ছন্দ্য আৰু প্রাচুর্য্য নেওচি বোকা-পাণী, ধুলি-বালি , জেং জোং ভৰা গাঁৱলীয়া বাটেৰে , বাহনি-ঝাৰণিৰ মাজেৰে অনাহাৰে অর্দ্ধ্বাহাৰে  পৰৰ কাৰণে কন্দা জীৱন কটাই গ’ল।...তিনিও দুখীয়া হালোৱা, হজুৱা, বণূৱা, তলমজলীয়াৰ ঘৰে ঘৰে গানৰ  অগণী সিঁচি সিঁচি গ’ল। তিনিও গাঁৱলীয়া বাটেৰে , ভৰা নৈৰ ঘাটেৰে বাট বুলি লোককৃষ্টি, কলা, লোকসঙ্গীতৰ সেণ চেকুঁৰা বুটলি, বুকুৰ মৌৰ তিওৱা প্রেমৰ অমিয়া মাধুৰী ঢালি সেণসেৰীয়া সংস্কৃতি সৃষ্টি কৰি গ’ল। জ্যোতিপ্রসাদ আৰু বিষ্ণু ৰাভাক অলপ হ’লেও মানুহে চিনি পায়। পিচে তৃতীয় জনক আজিৰ অসমৰ মানুহে, বিশেষকৈ আজিৰ পুৰুষে, চিনি নাপায় বা পোৱা সকলেও পাহৰি পেলাইছে।”  ফটিক বরাকে এক বন্ধু জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘হেমাঙ্গ বিশ্বাস কোন?’ তার উত্তরে তিনি বইটির ভূমিকাতেই লিখেছেন, “...হেমাঙ্গ বিশ্বাস এনে এজন মানুহ যিজনে চিলেটৰ (শ্রীহট্ট) বঙালী হৈও অসমীয়া ভাষা, কৃষ্টি আৰু সংস্কৃতিৰ লোকায়ত ৰূপটো সংৰক্ষিত কৰিবলৈ আন বহুতৰ লগে ভাগে আৰু অকলেও প্রাণে পণে চেষ্টা কৰি গ’ল; যিজনে জ্যোতিপ্রসাদ, বিষ্ণু ৰাভা, ভূপেন হাজৰিকা, নৰহৰি বুঢ়াভকত, মঘাই ওঝা, ব্রজেন বৰুৱা, ৰমেন বৰুৱা, আব্দুল মালিক, দিলীপ শর্মা, কুলধৰ চলিহা, প্রফুল্ল চন্দ্র বৰুৱাকে আদি কৰি আন বহুতো প্রতিভাশালী আৰু একনিষ্ঠ লিখক –শিল্পীক গোটপিত খুৱাই একেলগে অসমৰ জনসংস্কৃতিৰ প্রচাৰ কৰি উন্নতি সাধনৰ বাবে কাম কৰিবলৈ এখন মঞ্চলৈ উলিয়াই আনিছিল...।” তথ্যগুলো দিলাম, এই ইঙ্গিত দিতে যে এতো বিশাল ব্যক্তিত্বের পুরো একটা পরিচয় তুলে দিতে আরেকটা বই লিখতেই হয়। আবার কোনো একটা দিক তুলে ধরাও সমস্যা, কেননা আমাদের এই শহরে অধিকাংশের  কাছে ব্যক্তি হেমাঙ্গের প্রাথমিক পরিচয়টুকু তুলে ধরাটাই এখনো এক গুরুত্বপূর্ণ কাজ। আমরা তাই , সেই কাজটাই করব ভাবছি।
হেমাঙ্গ জীবনীঃ   খোয়াই তাঁর ভালোবাসা
            হেমাঙ্গ বিশ্বাসের রাজনৈতিক প্রেরণার স্থল নিশ্চয়ই সাম্যবাদী আন্তর্জাতিকতাবাদ, কিন্তু যেহেতু সারা জীবন বাংলা এবং অসমিয়াতেই কাজ করেছেন তাই যে মাটিতে তাঁর শেকড়কে পুষ্ট করেছে তার প্রতি মুগ্ধতা প্রকাশ পেয়েছিল ‘সীমান্ত প্রহরী’ কাব্যগ্রন্থের’ খোয়াই’ ( ১৯৫৩) কবিতার এই ক’টি পংক্তিতে, “‘তোমার কূলকে ভালবেসেই তো/কূল ছাড়া আমি/...ব্রহ্মপুত্র আমার বিস্ময়/পদ্মা আমার শ্রদ্ধা/গঙ্গা আমার ভক্তি/তুমি আমার ভালবাসা... খোয়াই।”।
          এই খোয়াই নদীর পাড়েই তখনকার অসমের , এখনকার বাংলাদেশের সিলেটের হবিগঞ্জের মিরাশি গ্রামে ১৯১২র ১৪ জানুয়ারি তারিখে হেমাঙ্গ বিশ্বাসের জন্ম। তাঁর বাবা হরকুমার বিশ্বাস ছোটখাটো হলেও জমিদার ছিলেন। তখনকার দিনের মেট্রিক পাশ হলেও বাংলা ইংরেজি সংস্কৃতে তাঁর বেশ চর্চা এবং জ্ঞান ছিল। ফলে পাঁচ গাঁয়ের ব্রাহ্মণ পন্ডিতদের মধ্যেও তাঁর বেশ সম্মান ছিল। মা সরোজিনী বিশ্বাসের পরিবারটিও  সঙ্গীত কাব্য চর্চাতে সমৃদ্ধ ছিল। একদিকে সামন্তীয় শাসন শোষণ এবং অন্যদিকে গীতা বেদান্ত সঙ্গীতের সুর এবং স্বর যুগপৎ দেখেছেন ও শুনেছেন বাড়িতে। একদিকে হিন্দুত্বের বড়াই অন্যদিকে ঢুলি মালি নমশূদ্র মুসলমান প্রজাদের মুখের ভাত কেড়ে নিয়ে দূর-দূর-ছাই-ছাই তাঁকে ছেলেবেলা থেকেই বিরক্ত করে তুলেছিল। ফলে তিনি বাড়ি ছেড়ে ঘুরে বেড়াতে ভালোবাসতেন খোয়াই নদীর পাড়ে পাড়ে। প্রজাদের পাড়ায় পাড়ায়। বাড়িতেই পদাবলী কির্তন , ওঝাপালা লেগেই থাকত ।সেগুলোতো আয়ত্বে এসছিলই, প্রজাদের মধ্যে ভিড়ে গিয়ে লোকগীত, লোক নৃত্য, যাত্রা।  বাউল গানেও মজে গেলেন। শুধু বাংলা নয় মণিপুরি নৃত্যগীতের সঙ্গেও তার পরিচয় ঘটেছিল গ্রামের বাড়িতে থাকতেই।  মিরাশি গ্রামের স্কুলেই নিয়েছিলেন প্রাথমিক স্কুলের পাঠ। সেদিনগুলোতেই স্কুলে যাবার আসবার পথে পথেই হয়েছিল তার এই লোকসংস্কৃতির আদি পাঠ। স্কুলের প্রধান শিক্ষক শিখিয়েছিলেন রবীন্দ্র সঙ্গীত। পরে অবশ্যি মা তাঁকে শেখাতে শুরু করেন । মা শিখিয়েছেন প্রচুর মেয়েলি ব্রতকথার গান, শ্যামাসঙ্গীত এমন কি রজনীকান্তের গানও।
           ক্লাস সেভেনে পড়বার সময়ে বাবার হঠাৎ খেয়ালে তিনি চলে এলেন উজান অসমের ডিব্রুগড়ে। জর্জ হাইস্কুলে ভর্তি হলেন, থাকার ব্যবস্থা হলো বিখ্যাত ওম বাবার আশ্রম বা বিরাজ আশ্রমে। এখানে অসমিয়া গান কবিতা সাহিত্যের প্রতি তাঁর সমান আগ্রহে পেয়ে বসল। বন্ধু লোহিত কাকতি তাঁকে শেখালেন, প্রথম অসমিয়া গান,” কিয়োনো পাহৰা অসমীয়া হেৰা/ চিৰদিন তুমি আছিলা স্বাধীন/ ভাৰতৰ মাজে তোমাৰ জননী/ বীৰ প্রসৱিনী আছিল এদিন...।”  কিন্তু এখানে স্থায়ী হলেন না। ধর্মমতি বাবারই মনে হলো, এই আশ্রমে অধর্ম বেশ ঘাটি গেড়েছে। নিয়ে গিয়ে আবার ভর্তি করে দিলেন হবিগঞ্জের সরকারী হাইস্কুলে। সেখানেই ১৯৩০শে তিনি মেট্রিক পাশ করেন।
             হবিগঞ্জে তিনি যখন ছাত্র তখনি সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে গোটা ভারত চঞ্চল হতে শুরু করেছে। হবিগঞ্জও তখন নীরব ছিল না। ভগৎ সিঙের মামলা, যতিন দাসের অনশনে মৃত্যু, চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন ইত্যাদি হেমাঙ্গের মনে প্রবল ছাপ ফেলে। নিজেও একটা দুটো করে মিছিলে পা মেলাতে শুরু করেন। ‘অনুশীলন সমিতি’তে যোগ দিয়ে কিছুদিন অনুশীলন করলেও, গান্ধির অসহযোগ আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। সেই ১৯৩০এই ১৪৪ ধারা ভাঙার অপরাধে হেমাঙ্গের হাজতবাস হলো। বয়স তাঁর তখন মাত্র সতের। হবিগঞ্জ, সিলেট হয়ে পরে তাঁকে নগাওঁ জেলে নিয়ে আসা হয়। এখানে তাঁর জেল সঙ্গী হিসেবে পেলেন পরে যিনি অসমের মুখ্যমন্ত্রী হবেন সেই বিমলাপ্রসাদ চালিহা এবং আরো অনেককে। বিমলাপ্রসাদের কাছেই জেলেই তিনি পার্বতী প্রসাদের ‘বনগীত’ এ পাঠ নিলেন। অসমীয়া ভাষা সাহিত্য সংস্কৃতির প্রতি তাঁর আকর্ষণ আরো খানিকটা বাড়ল। ক’মাস পরে জেল থেকে ছাড়া পেলেন। হেমাঙ্গ গিয়ে সিলেট মুরারি চাঁদ কলেজে বিজ্ঞানে নাম লেখালেন। কিন্তু আইন অমান্য আন্দোলনে সময় গান্ধির আহ্বানে প্রকাশ্য জনসভাতে নিজে আবার কলেজ ছাড়ার কথাও ঘোষণা করলেন। ইতি পড়ল তাঁর প্রথাগত শিক্ষাতে। ইতিমধ্যে কংগ্রেসে নেতাজি সুভাষের প্রভাব বাড়ছে। নেতাজি সিলেটে এলে সেই সভা সংগঠনে হেমাঙ্গ অগ্রণী ভূমিকা নিলেন। সুভাষের প্রভাবেই হোক, আর বাড়ির কাছে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন মামলার মতো ঘটনার জন্যেই হোক, কিম্বা রবীন্দ্রনাথের ‘রাশিয়ার চিঠি’ , গোর্কির ‘মাদার’এর বাংলা অনুবাদ কিম্বা বিভূতিভূষণের ‘পথের পাঁচালী’ পড়ে ফেলবার জন্যেই হোক-- ধীরে ধীরে গান্ধির প্রতি তাঁর আকর্ষণ কমছিল। কংগ্রেসের হিন্দুত্ববাদী ঝোঁককেও তিনি ভালো চোখে নিতে পারছিলেন না, কেননা বাড়িতে এই ঝোঁকের প্রতি তাঁর ছিল আবাল্য লড়াই। সুতরাং নিজে থেকেও কিছু সঙ্গীকে নিয়ে এক সময় তিনি কংগ্রেসের স্বীকৃত পথের বাইরে গিয়ে কিছু রাজনৈতিক প্রচারে মন দিলেন। ফলে আবার গ্রেপ্তার। এবারে আড়াই বছর। আবারো একই জেল বদলের অনুক্রমে নগাওঁ এলেন, পরে গুয়াহাটিও গেলেন। এই যাত্রাতেই তিনি হেলে বসে শুনলেন এবং শিখলেন জ্যোতিপ্রসাদের ‘গছে গছে পাতি দিলে ফুলৰে শৰাই।’
এদিকে জেলেই তাঁর শরীরে যক্ষা বাসা বাঁধে। তখন যক্ষা মানে মারণ রোগ! উপায়ুক্ত মোলান সাহেব রাজনীতি করবেন না বলে দাসখত লিখে দেবার শর্তে মুক্তি দিতে রাজি হলেন। হেমাঙ্গ থুড়িই দেবেন! সরকার নিজেই পরে উপায় না দেখে মুক্তি দিল। শিলঙে তখন ডাঃ বিধান রায় চিকিৎসা করতেন। তাঁর কাছে গেলেন। তিনি তাঁকে যাদব পুরে নিজের প্রতিষ্ঠিত হাসপাতালে পাঠালেন। সেখানেই কমিউনিষ্ট নেতা অনিলেন্দ্র রায়ের কাছে তাঁর মার্ক্সবাদে দীক্ষা। সেখানেই সিলেটের দুই কমিউনিষ্ট নেতা দিগিন দাসগুপ্ত এবং চঞ্চল শর্মার সঙ্গে চেনাপরিচয় হয়। সুতরাং সেই হাসপাতাল থেকেই তিনি সিলেট পার্টির প্রতি সহমর্মীতা প্রকাশ করেন। এবং সুস্থ হয়ে সিলেট যখন ফেরেন ততদিনে তিনি পুরো দস্তুর কমিউনিষ্ট।
           তখনই তাঁর গ্রামে একটি ঘটনা ঘটে যাতে কেবল মানচিত্রের স্বাধীনতা নয় খোলনলচে পালটানো নিয়ে তাঁর প্রত্যয়দৃঢ়তার পরিচয় মেলে।  তাঁদের গ্রামে ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘের উদ্যোগে একটি হিন্দু মন্দির গড়ে তোলা হবে। তাতে কোনো অসুবিধে ছিল না। কিন্তু সেখানে অনেকেই এলেন যারা হিন্দু ঐক্য নিয়ে প্রবল ভাষণ দিচ্ছিলেন। সেই সভার সভাপতি ছিলেন হেমাঙ্গের  বাবা হরকুমার বিশ্বাস। বাবার উপস্থিতিতেই হেমাঙ্গ সেখানে দাঁড়িয়ে বললেন,” হিন্দু ঐক্য নয়, চাই শোষিত মানুষের ঐক্য...মানুসের সেবা, বিশেষতঃ, শোষিত জনগণের সেবা আমার ধর্ম।” এরকম কিছু লড়াই পরিবারের ভেতরেই করার পরিণাম যা হবার ছিল তাই হয়েছিল। ছেলে বলে রেয়াত করেন নি বাবা। ১৯৪২এ বাড়ি থেকে বিতাড়িত হন হেমাঙ্গ।
         সে সময় একবার হবিগঞ্জ জেলার বানিয়াচঙে  ম্যালেরিয়া রোগ মহামারীর আকারে ছড়িয়ে পড়ে। এতে হাজার হাজার লোকের মৃত্যু ঘটে। এ সময় বানিয়াচঙে মানুষের সেবাতে  ছুটে গিয়েছিলেন হেমাঙ্গ বিশ্বাস। সে সময়ই গান লিখেছিলেন, 'বাইন্যাচঙে প্রাণ বিদরী ম্যালেরিয়া মহামারী/হাজার হাজার নর-নারী মরছে অসহায়,/শান্তি ভরা সুখের দেহ/শূন্য আজি নাইরে কেহ/মৃত সন্তান বুকে লইয়া কান্দে বাপ-মায়...'
ইতিমধ্যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামা বাজতে শুরু করেছে, ফ্যাসীবাদের বিপদ ঘণ্টাও আতঙ্কিত করে তুলেছে বিশ্বের স্বাধীনতাকামী মানুষকে। স্পেনের গৃহযুদ্ধে কডওয়েল , লোরকার মতো কবি বুদ্ধিজীবিদের মৃত্যুও লেখক শিল্পীদের আতঙ্কিত করতে শুরু করে।  রম্যাঁ রল্যাঁ, গোর্কি, আইনষ্টাইন, আদ্রেঁ জিদ প্রমুখদের উদ্যোগে আন্তর্জাতিক স্তরে গড়ে উঠে ‘ফ্যাসীবাদ বিরোধী লেখক শিল্পী সঙ্ঘ’। এর সঙ্গে বিশ্ব জুড়েই কমিউনিষ্টরা ছিলেন বটে, কিন্তু কমিউনিষ্টরা ছাড়াও অনেকে এর সঙ্গে জুড়েছিলেন,  ফ্যাসীবাদ এবং সাম্রাজ্যবাদের দ্বারা যারাই আক্রান্ত বোধ করছিলেন সেই সমস্ত লেখক শিল্পীরা। যেমন ভারতে এর সঙ্গে জুড়েছিলেন জহরলাল নেহরু, রবীন্দ্রনাথের, পণ্ডিত রবি শঙ্কর, পৃথ্বিরাজ কাপুর , বুদ্ধদেব বসুদের মতো ব্যক্তিত্বও । ১৯৩৬এ লক্ষ্ণৌতে  এঁদের সবার উদ্যোগে এবং মুন্সি প্রেমচান্দের পৌরহিত্যে আয়োজিত হয় এর প্রথম অধিবেশন। ভারতে এর নাম হয় ‘সারা ভারত প্রগতিশীল লেখক শিল্পী সংঘ’ । এই সংগঠন দীর্ঘস্থায়ী না হলেও  শিল্প সাহিত্যের অঙ্গনে ‘প্রগতিশীল’ শব্দটি এই সংঠনের নামের থেকেই জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করে। পরের বছর রবীন্দ্রনাথের নেতৃত্বে এর কলকাতা বা বঙ্গীয় শাখা গড়ে উঠে। ১৩৩৮এ কলকাতাতে সর্বভারতীয় সংগঠনটির দ্বিতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।
          যুদ্ধের তীব্রতা বৃদ্ধি, জাপানের ভারতের দোরগড়াতে এসে ব্রহ্মদেশ আক্রমণ, ৪২এর ভারত ছাড়ো আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে এই সংগঠনে কিছু মতভেদ এবং বিশৃঙ্খলাও দেখা দেয়। কমিউনিষ্ট পার্টি তখন সাংস্কৃতিক কাজে কর্মে সরাসরি হস্তক্ষেপ করবার সিদ্ধান্ত নেয়। ১৯৪৩এ পার্টির মুম্বাই কংগ্রেসের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী গড়ে উঠে ভারতীয় গণ নাট্য সংঘ , যেটি পরে আই পি টি এ নামে বিখ্যাত হয়। কায়ফি আজমী,  বলরাজ সাহনী, শংকর, শৈলেন্দ্র, পৃথ্বিরাজ কাপুরেরা উদ্যোগ নিয়ে সংগঠনটি গড়তে তোলেন।  বাংলার প্রাদেশিক কমিটিতে মনোনীত হন সুনীল চ্যাটার্জী, দিলীপ রায়, সুধী প্রধান, বিজন ভট্টাচার্য,দেবব্রত বিশ্বাস , শম্ভু মিত্র, সুজাতা মুখার্জী, মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য, স্নেহাংশু আচার্য, বিষ্ণু দে’র মতো ব্যক্তিত্ব।  হেমাঙ্গ বিশ্বাস এর আগেই ১৯৪২এ তাঁর শিল্পীদল নিয়ে এসে কলকাতাতে অনুষ্ঠান করে গেছিলেন। সুতরাং তিনিও রইলেন প্রাদেশিক সংগঠনে। পূর্বোত্তরের আর যে খ্যাতনামা ব্যক্তিটি সংগঠনের শুরু থেকেই এর সঙ্গে ছিলেন তিনি ত্রিপুরার সচীন দেব বর্মণ।
হেমাঙ্গ জীবনীঃ   .ব্রহ্মপুত্র তাঁর  বিস্ময়
            আমরা গণনাট্যের নাটক ‘নবান্ন’ কিম্বা বিজন ভট্টাচার্য, শম্ভু মিত্র, তৃপ্তি মিত্রদের নিয়ে কিছু লিখছি না এই ভেবে যে এগুলো সবাই এক আধটু জানেন এবং এখানে এগুলো হবে অপ্রাসঙ্গিক। পার্টি এবং কৃষক সভার কাজ করতে করতেই পার্টির সাংস্কৃতিক কাজে কর্মের নেতৃত্বে চলে এসছিলেন হেমাঙ্গ বিশ্বাস।  যেমন ১৯৮৮ এ এখনকার কাছাড়ের কাটাখালে    বসেছিল কৃষক সভার জেলা সম্মেলন। প্রকাশ্য অধিবশনের সভাপতি আরেক শিল্পী প্রতিভা ইরাবৎ সিং । সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিচালনার দায় হেমাঙ্গের কাঁধে। ১৯৪৫এ নেত্রকোনাতে অনুষ্ঠিত কৃষক সভার সর্বভারতীয় সম্মেলনে সেই ইরাবত সিং হেমাঙ্গের ‘কাস্তেটারে দিও জোরে শান’কে মনিপুরি নৃতিনাট্যে রূপান্তরিত এবং অনুবাদ করে পরিবেশন করেন। তেভাগা আন্দোলনের সময়ের বার্মা সীমান্তে শহীদের মৃত্যু বরণ করেন ইরাবৎ সিং।  এই ইরাবৎ সিংকে হেমাঙ্গ উৎসর্গ করে লিখেছিলেন ‘সীমান্ত প্রহরী’ নামে বিখ্যাত কবিতা এবং একই নামের পুরো একখানা বই। প্রকাশ পেয়েছিল ১৯৬১তে।   এই গণনাট্যের আদর্শে গড়ে ১৯৪৫এ তুলেছিলেন ‘সুরমা ভ্যালি কালচারাল স্কোয়াড’। সেটি নিয়ে তিনি শিলচর, শিলং , গুয়াহাটি হয়ে অসমের প্রধান প্রধান সমস্ত শহরে ভ্রমণ করেন। অভিনব ছিল সে পরিকল্পনা। “মণিপুরি বীর টিকেন্দ্রজিৎ, খাসিয়া জাতীয় বীর তিরোৎ সিং, জয়ন্তীয়া বীর কিয়াং নাবা, অসমের মণীরাম দেওয়ান, কুশল কোঁয়র, কনকলতাকে নিয়ে ব্যালে, কার্টুন, ছায়ানৃত্য, গণসংগীতে প্রস্তুত করেছিলেন  অনবদ্য আলেখ্যে। যার আবেদন সহজেই তখন পৌঁছুতে পেরেছিল মানুষের মনে।   সর্বত্র বিপুল সাড়া এবং সমর্থণ পেয়ে এরই শাখা খুলে খুলে  এগুতে থাকেন। সে যাত্রাতেও তিনি দ্বিতীয়বারের জন্যে ডিব্রুগড়ে আসেন এবং সেখানে গোবিন্দ শর্মাকে সভাপতি ও নগেন কাকতিকে সম্পাদক করে ডিব্রুগড় শাখাও গঠন করেন। ১৯৪৬এর শুরুতে তেজপুরে তাঁদের অনুষ্ঠানের কথা শুনে  অভিভূত হলেন জ্যোতিপ্রসাদ আগরওয়ালা। অসুস্থতার জন্যে হাজির হতে পারেন নি। ডাক্তারে নির্দেশ উপেক্ষা করে ডেকে পাঠান হেমাঙ্গ বিশ্বাসকে । দু’জনার দীর্ঘ আলাপ হলো জ্যোতিপ্রসাদের বাড়িতে । জ্যোতিপ্রসাদ যেন বহুদিন ধরে  সন্ধান করে ফেরা বন্ধুকে কাছে পেলেন। তেজপুরে তাঁরা সাদ্রিভাষাতেও চা বাগানের শ্রমিকদের সংগ্রামের উপর ভিত্তি করে একখানা নাটক করেছিলেন, ‘বদলা লেনা’। জ্যোতিপ্রসাদের সঙ্গে সেই শুরু হওয়া বন্ধুত্বকে আমৃত্যু সম্মান জানিয়েছিলেন হেমাঙ্গ। নিজের দ্বিতীয় কাব্য গ্রন্থ ‘ কুল খুড়ার চোতাল’ তিনি উৎসর্গ করেছিলেন তাঁকে।
              তাঁর এই ভ্রমণের সফলতার উপর ভিত্তি করেই ১৯৪৭এ শিলচরে বসে ভারতীয় গণ নাট্য সংঘের প্রথম প্রাদেশিক সম্মেলন। জ্যোতিপ্রসাদ শারীরিক অসুস্থতার জন্যে সেই সম্মেলন উপস্থিত থাকতে পারেন নি , কিন্তু শুভেচ্ছা পাঠিয়েছিলেন। তাঁর অনুপস্থিতিতেই তাঁকে সভাপতি করে সঙ্ঘের প্রাদেশিক সমিতি গঠন করা হয়। হেমাঙ্গ বিশ্বাস হলেন সম্পাদক আর ডিব্রুগড়ের নগেন কাকতি সহ –সম্পাদক। এই সম্মেলন অবিভক্ত অসমের সমস্ত জাতি-জনজাতির সাংস্কৃতিক সমানাধিকারের আর সমমর্যাদার আকাঙ্খাকে সামনে তুলে ধরে। বড় জাতিগুলোর আধিপত্যকামী এবং জনজাতিদের বিচ্ছিন্নতার মানসিকতা –দুইএরই বিরোধীতা করা হয় এই সম্মেলনে। শিলচর সম্মেলনেই বডো শিল্পীদলের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন নীলেশ্বর ব্রহ্ম, রবীন বসুমাতারি। যোরহাট থেকে যাওয়া মিশিং শিল্পীদলের নেতৃত্বে ছিলেন লক্ষ্মীনাথ দলে। মণিপুরি দলের নেতৃত্বে ছিলেন কামিনী সিংহ প্রমুখ। জ্যোতিপ্রসাদ এবং হেমাঙ্গ বিশ্বাসের নেতৃত্বে সমগ্র অসমে গণনাট্য শক্তিশালী সংগঠন রূপে আত্মপ্রকাশ করে। সে এতোটাই যে শাসক শ্রেণি আতঙ্কিত হয়ে ১৯৪৯এর জুলাই মাসে ডিব্রুগড়ের নালিয়াপুলে যে দ্বিতীয় প্রাদেশিক সম্মেলন হয়েছিল তার শেষ দিনের শান্তি সমাবেশে এসে পুলিশ বিনা প্ররোচনাতে গুলি চালায়। সে পুলিশ কিন্তু স্বাধীন দেশের স্বাধীন পুলিশ! সাংস্কৃতিক সম্মেলনে ভয়ার্ত প্রশাসন। গুলিতে বীনা বরা এবং ষোড়শী নাগ নামে দুজন মহিলা সাংস্কৃতিক কর্মী শহীদ হন। স্বাভাবিক ভাবেই জ্যোতিপ্রসাদ এই প্রতিবাদে সংবাদপত্রে যে বিবৃতি দিলেন কোনো কাগজ সেটি ছাপবার সৌজন্যও দেখায় নি।পরে তিনি ‘নালিয়াপুলের বিপদ সংকেত’ নাম দিয়ে প্রচার পত্র হিসেবে বিলি করেন। অসমের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ইতিহাসে এই প্রচার পত্রের শক্তি এতোটাই যে জ্যোতিপ্রসাদের রচনাবলীর প্রথম সংস্করণেও প্রকাশক/সম্পাদকেরা এটিকে ঠাই দিতে সাহস করেন নি। হেমাঙ্গ বিশ্বাসের নজরে পড়তে তিনি এর বিরোধিতা করেন। পরে আরো অনেকে তাঁর সঙ্গে যোগ দেন। চাপে পড়ে দ্বিতীয় সংস্করণে একে ঠাই দেয়া হয়।
            ইতিমধ্যে বিষ্ণু রাভাও এসে গণনাট্যে এসে যোগ দিলেন। ১৯৪৮এ খোয়াঙে অনুষ্ঠিত জনজাতি ছাত্র সম্মেলনে হাজির হয়ে গণনাট্য  সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করে  জ্যোতিপ্রসাদের পরামর্শে। বিষ্ণু রাভা ছিলেন সেই সম্মেলনের সাংস্কৃতিক শাখার সম্পাদক। ১৯৫৫তে গুয়াহাটির জাজেস ময়দানে অসম গননাট্য সঙ্ঘের তৃতীয় অধিবেশনের আয়োজনে বিষ্ণু রাভা, ভূপেন হাজারিকা মূল উদ্যোগ নিয়েছিলেন।  ঔপন্যাসিক হাওয়ার্ড ফাস্ট, এরেন বুর্গ, টিখনভের মতো ব্যক্তিত্বরা সেই সম্মেলনে শুভেচ্ছাবাণী পাঠিয়েছিলেন। বলরাজ সাহানী, সলিল চৌধুরী, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, সুমিত্রা মিত্র, দেবব্রত বিশ্বাস প্রমুখ এসছিলেন সর্বভারতীয় সংগঠনের পর্যবেক্ষক হয়ে। মেঘালয়, মণিপুর, কাছাড়, গোয়াল পাড়ার মতো প্রত্যন্ত জেলাগুলো থেকে এসছিলেন প্রতিনিধিরা।  মঘাই ওঝা সেই সম্মেলনের ঢোল বাজিয়ে প্রথম বারের জন্যে গোট সবাইকে মুগ্ধ করেন। এর পরে তিনি বহুবার ভারতের বহু জায়গাতে গিয়ে ঢোলবাদনের জন্যে ডাক পেয়েছিলেন, গিয়েও ছিলেন। গোটা দেশ মোহিত হয়েছিল অসমের ঢোলের তানে।
         গণনাট্যেরে স্বর্ণযুগে ১৯৫৫র গুয়াহাটি সম্মেলনই ছিল শেষ। ১৯৫১তে জ্যোতিপ্রসাদের অকাল প্রয়াণ হলো, হেমাঙ্গও সুস্থ রইলেন না তেমন ১৯৫৫র সম্মেলনের পর। তাছাড়া  পার্টির ভেতরে বাইরেও নানা রাজনৈতিক বিতর্কে তখন  পুরোনো বন্ধুরা অনেকেই আলাদা হতে শুরু করেন গোটা দেশেই। সে প্রসঙ্গে বিস্তৃত আমরা এখানে যাব না। কিন্তু তাই বলে গণনাট্যরে প্রয়াস ব্যর্থ হবার ছিল না, হয় নি। সে এক দিশা নির্দেশের কাজ করেছিল। সেই দিশাতে পরেও অজস্র শিল্পী মাঝে মধ্যেই গণনাট্যের পতাকা তলায় বা তার বাইরে নিজেদের মতো সংগঠন করে কাজ করে গেছেন এবং যাচ্ছেন । বাংলা অসমিয়া বডো নানান ভাষা সম্প্রদায়ের মধ্যে।
           হেমাঙ্গ বিশ্বাসের শরীরের সেই পুরোনো অসুখ মাঝে মধ্যেই চাগিয়ে উঠত। চিকিৎসার জন্যে তাঁকে চিনে পাঠানো হলো ১৯৫৮তে। চিনে গিয়েও অবসরে কাল কাটাবার মানুষতো আর তিনি নন, বিপ্লবোত্তর চিনকে দেখে নেবার বুঝে নেবার সুযোগ ছাড়বেন কেন? সেই অভিজ্ঞতাগুলো লিখে পাঠালেন ‘নতুন অসমীয়া’ কাগজে অসমিয়াতে। সম্পাদক তিলক হাজারিকা সেগুলো ধারাবাহিক ভাবে ছেপে গেলেন। পরে সেগুলোই সংকলিত করে প্রকাশ পায় ‘চীন চাই আহিলোঁ।’ পরে এর বাংলা সংস্করণও প্রকাশিত হয়। অসমিয়া এবং বাংলা সাহিত্যে এই ভ্রমণ কাহিনির সামাজিক, রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক গুরুত্ব অপরিসীম!  বিপ্লবোত্তর চিন সম্পর্কে এটি কেবল অসমিয়াতে নয়, যেকোনো ভারতীয় ভাষাতে প্রথম বই।
   
        চিন থেকে ফিরে আসার ক’দিন পরেই ১৯৬০ এর ভাষা আন্দোলন এবং পাশাপাশি ভাষা সংঘর্ষ শুরু হয়। সেই সময় তিনি ভূপেন হাজারিকাকে সঙ্গে নিয়ে নানা ভাষা সম্প্রদায় থেকে শিল্পী নিয়ে শিলং থেকে যাত্রা শুরু করেন। সেই সুরমা ভ্যালী কালচারাল স্কোয়াডের দিনগুলোতে যেন ফিরে গেলেন। কৌশলগত অবস্থান থেকে সেবারে গণনাট্যের নাম ব্যবহৃত হলো না। ‘Let us meet cultural troupe’ ছিল নতুন স্কোয়াডের নাম।  কিন্তু ইতিমধ্যে ব্রহ্মপুত্রের জল অনেক দূর বয়ে গেছে , বিদেশি সাম্রায্যবাদীদের জায়গাতে ভাতৃঘাতি রক্তপাতে উষ্ণ এবং লাল হচ্ছে জল এবং উপত্যকা। সুতরাং এবারের অভিযান ছিল অনেক বেশি সাহসী এবং ঝুঁকি পূর্ণ। কিন্তু বিখ্যাত ‘হারাধন –রংমনে’র গীতি আলেখ্য সহ আরো প্রচুর গান, কবিতা, নাটক নিয়ে দু’ই তাঁরা যেন সংগ্রামী ঐক্যের যুদ্ধ জয় করলেন। বাংলা অসমিয়াতে  ভূপেন হাজারিকার সাগর সঙ্গমে গানটিও ছিল সেই অভিযানের অন্যতম জনপ্রিয় গান।  যে দিকে গেলেন, গানের সুরেই দাঙ্গাবাজদের প্রতিহত করতে করতেই এগুলেন তাঁরা।
হেমাঙ্গ জীবনীঃ   গঙ্গা তাঁর ভক্তি
          হেমাঙ্গ চিনে যাবার আগে থেকেই স্তালিনের মৃত্যুর পর থেকে চিন-সোভিয়েত লাইনের বিতর্কে আন্তর্জাতিক সাম্যবাদী আন্দোলন দু’ভাগে বিভাজিত হতে শুরু করে। ক্রুশ্চেভের নেতৃত্বে সোভিয়েতের বিরুদ্ধে পুঁজিবাদের পথে ফিরে যাবার অভিযোগ উঠছিল। এমন কি চেকোশ্লাভাকিয়া আক্রমণের মধ্যি দিয়ে সোভিয়েতের সাম্রায্যবাদী চরিত্র স্পষ্ট হয়ে বেরুচ্ছিল বলে সাম্যবাদীদের থেকেই অভিযোগ উঠতে শুরু করেছিল। ভারতেও তার অভিঘাত এসে পড়তে শুরু করেছিল, যদিও স্পষ্ট হতে সময় নিয়েছিল। আমরা জানি চিন –সোভিয়েত লাইনের বিতর্কে কমিউনিষ্ট পার্টি প্রথমে ১৯৬৪তে এবং পরে ১৯৬৭তে ত্রিধা বিভক্ত হয়ে যায়। ১৯৬৮তে গড়ে উঠা সিপিএম আসলে মধ্যপন্থা একটা নিয়েছিল, তাই তাকেও ভাঙ্গনের মুখে পড়তে হয় ১৯৬৭তে। আপাত দৃষ্টিতে মনে হতে পারে দুটো বিদেশী দেশের তর্কে ভারতের দলগুলোর এতো উৎসাহ কেন? আর তাতে হেমাঙ্গ বিশ্বাসের মতো অসমের এই ব্যক্তিটির কী সম্পর্ক? সংক্ষেপে বলতে পারি, পুঁজিবাদ একটি আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা । পুঁজির স্বার্থে শ্রমকে শোষনের ব্যবস্থা। সুতরাং তার বিরুদ্ধে লড়াইটাও শ্রমিকদের নেতৃত্বে একটি আন্তর্জাতিক উদ্যোগ। সোভিয়েতের সমর্থণে দাঁড়াবার মানে ছিল পুঁজিবাদের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান , আর চিনের সমর্থণে দাঁড়াবার মানে ছিল বিপ্লবের পতাকাকে তুলে ধরা। তাছাড়া চিন ভারতের মতোই ছিল এক সামন্তীয় কৃষি নির্ভর দেশ। সে দেশে বিপ্লব হয়ে গেছে ক’বছর আগে, এটি ভারতের মতো যেকোনো আধা সামন্তবাদী দেশের কাছে আলাদা এক প্রেরণা এবং শিক্ষার স্থল। পুঁজিবাদের শিক্ষা যদি বিলেতি মার্কিনিদের থেকে নেয়া যেতে পারে তবে তার বিরুদ্ধে লড়াইর দীক্ষা সোভিয়েত-চিনের মতো বিদেশের থেকে নেয়াটা দোষের হয় কেবল কুযুক্তির জোরে।
             সে যাই হোক, হেমাঙ্গের জীবিকার একটা দরকার ছিল। ১৯৫৯তে তিনি পার্টি কর্মী রুনু দত্তকে বিয়ে করেন। পরের বছর তাঁর পুত্র মৈনাকের জন্ম। ১৯৬১তে তিনি কলকাতার রুশ দূতাবাসের বার্তা বিভাগে অসম শাখার দায়িত্বের   চাকরি পেয়ে চলে যান। তাই বলে, ১৯৬৪তে তিনি সিপি আই-র সোভিয়েত লাইনে রইলেন না। এমন কি ১৯৬৭তে সিপিএমের সুবিধেবাদেও না, সিপিএম যখন গণ আন্দোলনের পথ ছেড়ে পশ্চিম বাংলাতে  রাইটার্স দখলের পথ করছে হেমাঙ্গের তখন সগর্ব উচ্চারণ, “মাথা নিচু করে রাইটার্সে যাব না!” তিনি একাই রইলেন।  নকশাল বাড়ির বিদ্রোহকেও তিনি স্বাগত জানিয়েছিলেন। ফলে  সোভিয়েত কর্তৃপক্ষ যখন তাঁকে চিন সমর্থণ ত্যাগ করবার চাপ দিল, তিনি চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে  ‘ডাঃ দ্বারকানাথ কোটনিস স্মৃতিরক্ষা সমিতি’র হয়ে দ্বিতীয়বারের জন্যে চিনে যান। ডাঃ কোটনিস হচ্ছেন সেই মহান ভারতীয় যাকে জাপান চিন আক্রমণ করলে চিনা কম্যুনিষ্ট পার্টির অনুরোধে চিনা বিপ্লবীদের চিকিৎসার জন্যে পাঠান ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি সুভাষ চন্দ্র বসু। ১৯৩৮এ তিনি সদলবলে সেখানে যান, এবং বিপ্লবীদের সঙ্গে মহান চিনা লং মার্চে যোগ দিয়ে নিজের দায়িত্ব পালন করেন। মাত্র ৩২ বছর বয়সে দারুণ অসুখে পড়ে ১৯৪২এর ৯ ডিসেম্বরে তিনি চিনেই মারা যান। নানকান গ্রামে বিপ্লবী শ্রদ্ধার সঙ্গে তাঁকে সমাধিস্থ করা হয়। শুনা গেছে যে বিপ্লবীদের সেবাতে এই মহান ডাক্তার কখনোবা টানা বাহাত্তর ঘন্টা কাজ করে গেছেন। সেই পরিশ্রমই পরে তাঁর প্রাণ নেয়। সেই মহান বিপ্লবী ডাক্তারকে চিন কোনদিন ভুলেনি। সেই স্মরণীয় ব্যক্তিত্বকে সম্মান জানাতেই আরো অনেকের সঙ্গে হেমাঙ্গ বিশ্বাসের এই দ্বিতীয়বার চিন যাত্রা। এবারেও তাঁর ভ্রমণ কাহিনি লিখে বের করেন, ‘আকৌ চিন চাই আহিলো’। বইটি ১৯৭৭এ ছেপে বেরোয়। এবারের বইতে ষাটের              দশকের সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সময়কার মতাদর্শগত বিতর্কের  আভাস তুলে ধরবার প্রয়াস নেন। এই নিয়েও ভারতীয় কোনো ভাষাতে এটিই প্রথম বই। অসমিয়াতেও , বাংলাতেও।  ১৯৮০তেও তৃতীয়বারের জন্যে তিনি চিন গেছিলেন। সেবারে চিন সরকারের আমন্ত্রণে।
হেমাঙ্গ জীবনীঃ   পদ্মা তাঁর  শ্রদ্ধা
           ১৯৮১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তাঁর ‘মাস সিঙ্গার্সে’র সঙ্গী রত্না সরকার, প্রীতি চৌধুরী, মিঠুন মুখার্জি, টুঙ্কু সরকার ও দীপক পাত্রকে সঙ্গে  নিয়ে তিনি গেছিলেন বাংলাদেশে । পুরোনো সংগ্রামী সাথি নজরুল ইসলাম খানের গোপীবাগের বাড়িতে উঠেছিলেন। তাঁর সে ভ্রমণের উদ্যোক্তাদের মধ্যে সেদেশের প্রখ্যাত মার্ক্সবাদী তাত্বিক  বদরুদ্দীন উমরও ছিলেন । ছিলেন ফকির আলমগীরের মতো শিল্পীরাও। সেবারে ঢাকাতে একুশে ফেব্রুয়ারির প্রভাতফেরিতে গান গেয়ে গেয়ে যোগ দিয়েছিলেন হেমাঙ্গ বিশ্বাস। ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র মিলনায়তনে   ঢাকার ২৭টি সাংস্কৃতিক সংগঠনের জোট  'গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি ফ্রন্ট' হেমাঙ্গ বিশ্বাসকে সংবর্ধনা দিয়েছিল । দেশ ছেড়ে আসার পর এই প্রথম এবং শেষবারের জন্যে তিনি দেখতে গিয়েছিলেন তার পৈতৃক ভিটে হবিগঞ্জের মিরাশি গ্রাম।  জয়দেবপুরে  গিয়েছিলেন কবি গোবিন্দ দাস ও কবিয়ালগুরু হরি আচার্যের ভিটে দেখতে। তিনি সেদিন গোবিন্দ দাসের একটি গান সংগ্রহ করে দিয়েছিলেন ফকির আলমগীরকে , "স্বদেশ স্বদেশ করছ যারে, এদেশ তোমার নয়।”  সত্যিতো যে দেশকে বাল্যে নিজের বলে জেনেছিলেন, সেই দেশই তাঁর রইল না! তাঁর একখানা গান রয়েছে,” হবিগঞ্জের জালালি কইতর, সুনাম গঞ্জের কুড়া, সুরমানদীর গাংচিল আমি শূণ্যে দিলাম উড়া/শূণ্যে দিলাম উড়ারে ভাই যাইতে চান্দের চর/ডানা ভাইঙ্গা পড়লাম আমি কইলকাতার উপর/তোমরা আমায় চিননি/তোমরা আমায় চিননি।” তাঁকে চেনাতো সত্যি আমাদের এখনো অনেক বাকি। কলকাতা প্রবাস তাঁকে যে সুখি করতে পারেনি এওতো এই গানে বোঝাই যায়। কলকাতা সত্যি তাঁকে আজও তেমন চেনেও নি, জীবনের শেষ দিকে বোধহয় দুটো মাত্র কেসেট বেরিয়েছিল এই মহান শিল্পীর। নিজে তিনি কখনোই সেরকম প্রকাশক খোঁজে ফেরেনও নি। হবিগঞ্জের মিরাশি গ্রাম, সুরমা নদী নিশ্চয় তাঁর স্মৃতিকে ভারাতুর করে তুলত।  কিন্তু ভুলে থাকতে পারতেন না ব্রহ্মপুত্র উপত্যকাতে তাঁর জীবনের সবচে’ উজ্জ্বল দিনগুলোকেও । সেতো তাঁর কলকাতার বাড়ির নামেই প্রকাশ-- ‘জিরণি’। আর একমাত্র কন্যার নাম রেখেছিলেন –‘রঙিলী’।
             অসমের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ আমৃত্যু কখনোই বিচ্ছিন্ন হয় নি। প্রায়ই তিনি এসছেন এটা ওটা অনুষ্ঠানের বা ব্যক্তিগত উপলক্ষে। শেষ দিকে তিনি দলের বাইরে গিয়ে ‘মাস সিঙ্গার্স’ নামে একটি সংগঠন গড়ে তুলেছিলেন। সেই সংগঠন নিয়ে দেশে বিদেশে গেছেন, এসছেন অসমেও বহুবার।  মঘাই ওঝার সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক দাঁড়িয়েছিল নিতান্তই ব্যক্তিগত এবং পারিবারিক। আজীবন তাঁর এবং তাঁর পরিবারের পাশে দাঁড়িয়েছে বিপদে সম্পদে।  মঘাই ওঝার মৃত্যুর পরেও নিজের বহু অর্থ কষ্ট সত্বেও নিয়মিত অর্থ সাহায্য পাঠাতেন। ‘অসম আৰু বঙ্গৰ লোক সঙ্গীত সমীক্ষা’ বইটি তাঁকে উৎসর্গ করেছিলেন। লিখেছিলেন, মঘাই তাঁর শিল্পী জীবনের শ্রেষ্ঠ আবিষ্কার।  আশির অসম আন্দোলনের দিনগুলোতেও তিনি ছুটে এসছিলেন ষাটের দিনগুলোর মতো সাংস্কৃতিক বাহিনী নিয়ে বেরুবেন বলে। কিন্তু ভূপেন হাজারিকা সেবারে সঙ্গ দিলেন না। গুয়াহাটিতে এক ট্যুরিষ্ট লজে এসে উঠেছিলেন। সেখানে যে গুটিকয় গুনমুগ্ধ এবং পুরোনো বন্ধু দেখা করতে গেছিলেন তাদের তিনি বলেছিলেন, “ যি দেখিছো অসমত যেন এখনো নিরপেক্ষ ঘৰ নাই।...ইয়ালৈ আহি দেখিছো অস্তিত্বৰ চেতনা বৰ দলৈ সোমাইছে। পৰিস্থিতি কেতিয়াও এনে হোৱা নাই। ই ভাষিক সমস্যা নহয়...মিলনৰ প্রক্রিয়া কিন্তু থানবান হৈ গৈছে। সাংস্কৃতিক ভেটি কঁপি উঠিছে, সংহতির মূলতে ভাবুকিয়ে দেখা দিছে।” ( তিলক হাজারিকা সম্পাদিত ‘বিপ্লবী গণ শিল্পী হেমাঙ্গ বিশ্বাস’ বই থেকে ফটিক বরার পূর্বোক্ত গ্রন্থে ব্যবহৃত উদ্ধৃতি)
             ১৯৮২তে ‘দিশারি’ সাংস্কৃতিক সংস্থার আমন্ত্রণে তিনি গেছিলেন শিলচরে। দিশারি তখন ‘মৈত্রী উৎসব’ নামে তিনদিনের এক বার্ষিক অনুষ্ঠান নিয়মিত করত। এই ‘দিশারি’র প্রতিষ্ঠাতা অনন্ত দেবও ছিলেন আসলে পুরোনো গণনাট্য আন্দোলনের কর্মী। সেই অনুষ্ঠানে হেমাঙ্গ ছাড়াও আমন্ত্রিত হয়ে গুয়াহাটি থেকে গেছিলেন রবীন্দ্র সঙ্গীত শিল্পী দিলীপ শর্মা, গোয়াল পাড়া থেকে লোক সঙ্গীত শিল্পী প্রতিমা পাণ্ডে বরুয়া। আলোচনা চক্রে যোগ দিতে গেছিলেন অমলেন্দু গুহ। বহুদিন পরে পুরোনো বন্ধুরা সমবেত হয়েছিলেন আবারো। স্বাভাবিক ভাবেই এক আলাদা আবেশময় পরিবেশ তৈরি হয়েছিল গোটা শহরের সাংস্কৃতিক মহলে। সেকালের ‘দিশারি’র কর্মী রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী শুভপ্রসাদ নন্দীমজুমদার ঠিকই লিখেছেন,  এর পরে যেন আবারো নতুন করে তাঁর ‘মাস সিঙ্গার্সে’র আদলে গণ সঙ্গীতের দল করবার ধুম উঠে গেল শহরে।   বর্তমান লেখকেও তখন জড়িয়েছিলেন ‘শান্তসেনা’ নামে একটি সাংস্কৃতিক সংগঠনে। যাদের গণসঙ্গীতের নিজস্ব দল ছিল। সেই সংগঠনের বার্ষিক অনুষ্ঠানে একক হেমাঙ্গ বিশ্বাসের গান ‘জন হেনরি’র তালে তালে একক নৃত্য অনুশীলন এবং পরিবেশনের দুর্বল হলেও একটা অভিজ্ঞতা হয়েছিল। সে ১৯৮৩র কথা।
            ‘মাটি আৰু মানুহ’ নামে অসমের অন্য এক সাংস্কৃতিক  কিংবদন্তি লোকনাথ গোস্বামীর নেয়া হেমাঙ্গের এক সাক্ষাৎকার রয়েছে। লোকনাথ তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গেছিলেন ১৯৮৬র নভেম্বরে । তখনো তিনি জানিয়েছিলেন শীত পেরুলেই তিনি অসমে আসবেন আবার। কিন্তু শরীরের  অসুস্থতা ক্রমে বেড়েই গেল। ঠিক পরের বছর ১৯৮৭র ২২ নভেম্বর হেমাঙ্গ থেমে গেলেন।  কিন্তু অসমের বাঙালি কিম্বা অসমিয়া হয়ে উঠার অর্থ যে অন্তর থেকে অর্জিত প্রতিবেশি চেতনা এই যে দীক্ষা এবং শিক্ষা তিনি তাঁর গোটা জীবন দিয়ে  গেছেন তা এতো সহজে হারিয়ে যাবার নয়।
          সিলেট থেকে  যাত্রা শুরু করে জীবনের এক উজ্জ্বল অধ্যায় অসমে যাপন করলেও বাংলা এবং অসমীয়াতে ‘গণ সঙ্গীতে’র ধারাটি প্রতিষ্ঠা পায় হেমাঙ্গ বিশ্বাসের দৃঢ় সাংগঠনিক এবং তাত্বিক অবস্থানের জন্যেই। গণসঙ্গীতের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে তিনি লিখেছিলেন, “স্বাদেশিকতার ধারা যেখানে সর্বহারার আন্তর্জাতিকতার মহাসাগরে গিয়ে মিলেছে, সেই মোহনায় গণসঙ্গীতের জন্ম।” শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের যেমন ‘ঘরানা’, তার বিপরীতে লোক সঙ্গীতের ‘বাহিরানা’ নিয়েও তাঁর চিন্তা পরের চিন্তকদের ভাবনার দিশা দিয়েছে। সুরমা ভ্যালি কালচারাল স্কোয়াডের এবং গণনাট্যের শুরুর দিনগুলোতে তৈরি হয় তাঁর বিখ্যাত  গান ‘তোমার কাস্তেটারে দিও জোরে শান’। তখন এবং পরের জীবনে তাঁর লেখা এবং গাওয়া   বিখ্যাত গানগুলো হলোঃশঙ্খচিলের গান,   জন হেনরীর গান,   মাউন্টব্যাটেন মঙ্গলকাব্য,   বাঁচব বাঁচব রে আমরা,   মশাল জ্বালো,    সেলাম চাচা,    আমি যে দেখেছি সেই দেশ,‘হবিগঞ্জের জালালী কইতর সুনামগঞ্জের কুড়া’, ‘ও সোনা বন্ধুরে’, ‘আমার মন কান্দে পদ্মার চরের লাইগ্যা’ । ‘পদ্মানদীর মাঝি’, ‘কোমল গান্ধার’, ‘লালন ফকির’ ইত্যাদি ছায়াছবিতে, যাত্রাপালা ‘লেনিন’এ এবং  কল্লোল, তীর, লাললণ্ঠন ইত্যাদি নাটকে সঙ্গীত পরিচালনা করেছিলেন । ‘লাললন্ঠন’ নাটকে তিনি বিভিন্ন চিনা সুর ব্যবহার   করেছিলেন । তিনবার চিনে গিয়ে চিনা ভাষাটাও তিনি অনেক রপ্ত করেছিলেন। ফলে বেশ কিছু চিনা গান কবিতা বাংলাতে অনুবাদও করেছিলেন। এছাড়াও দেশ বিদেশের প্রচুর বিখ্যাত গানকে তিনি ওমন ভাবে বাংলাতে অনুবাদ করে জনপ্রিয় করেছিলেন যে সাধারণ শ্রোতাদের অনেকেই এগুলোকে  হেমাঙ্গের বিশুদ্ধ বাংলা বলেই জানেন এখনো। যেমন পিট সিগার কলকাতার ময়দানে এসে গেয়েছিলেন ‘উই শ্যাল অভার কাম।’ হেমাঙ্গকে তিনিই ডেকে তুললেন মঞ্চে । তিনি গাইলেন ‘আমরা করব জয়।’ এটি এর পর  নানা ভাষাতে অনুদিত হয়ে এতো জনপ্রিয় হয় যে গোটা ভারত জয় করে বসেছিল বটে, যদিও ‘মা তুমি শিগগির এসো’ কবিতার ‘ইবনদি’ এখনো ফিরে আসে নি।
            ‘সীমান্ত প্রহরী’ কবিতার বইএর এক দুর্দান্ত দীর্ঘ কবিতা এটি। শেষ হয়েছে, “ইবনদির সাথে/এই আমার শেষ সাক্ষাৎ।/মাঝরাতে হ্যাপিভ্যালির চূড়ায়/ভয়ে ভয়ে চাঁদ উঠেছিল/কুয়াশার ঘোমটা পরে।/সারারাত জেগেছিলাম আমি।/আর জেগেছিল/সুদূর খাসিয়া পুঞ্জিতে/ফুলকুমারী কাসান্থিউ।/থেকে থেকে কেঁদে উঠেছিল—/ইম্মেই ওয়ান ক্লোয়/মা, তুমি শিগগির ফিরে এসো।” অসমের এক গুরুত্বপূর্ণ কবি তপন মহন্ত লিখেছেন, “ ‘ইবনদি’ ... কি সাম্রাজ্যবাদীর নিগড়ে পিষ্ট ভারত বর্ষের প্রতীক নয়?...কবিতাটিও  এলিজি কবিতা হিসেবে বিশ্বসাহিত্যে স্থান পাওয়ার যোগ্যতা রাখে। কবিতাটি শুধু বাংলায় লেখা বলেই কি প্রচারের অভাবে তলিয়ে গেল বিস্মৃতির অন্তরালে?”আমরা কথাটার একটাই মানে করতে পারি, কবিতাটি হারাবে না, হারাবেন না কবিও, শুধু দিন কাল এখনো পাল্টায় নি বিশেষ ফুরোয় নি সেই ফুলকুমারী কাসান্থিউর মায়ের পথ চেয়ে থাকা। কোথাও কি ভুল হয়েছিল? পার্টির ভুল  নাহয় হয়েইছিল,  কিন্তু হেমাঙ্গ নিজেই বা কেন ফিরে এলেন না! কেনই বা কলকাতাতে তাঁকে ‘জিরণি’ নিতে হয়েছিল? চল্লিশের দশকে সুরমাভ্যালী স্কোয়াডের যিনি মহানায়ক, ষাটের দশকে “‘Let us meet cultural troupe’ এর যিনি দুর্নিবার সংগ্রামী, আশির দশকে তিনি ‘মাস সিঙ্গার্সে’র অতিথি গায়ক কেন? ‘ভাঙা বুকের পাঁজর দিয়া নয়া বাংলা গড়বার’ কিম্বা “ সমতলে লুইতের বুকে/ উদ্দাম ঝরনা হয়ে নেমে আসুক; ঝুমুর মাদল আর বিহু পেঁপায়/ পারে পারে ঐকতান তুলুকঃ /জীবনের/ সৃজনের/ স্বপ্নের/ শান্তির।” ( সীমান্তপ্রহরী) এই পংক্তিগুলোতো তাঁর নিজের ছিল, শুধু পার্টির নয়।  সেখানে, “...মিলনৰ প্রক্রিয়া কিন্তু থানবান হৈ গৈছে। সাংস্কৃতিক ভেটি কঁপি উঠিছে, সংহতির মূলতে ভাবুকিয়ে দেখা দিছে।” বলে আত্মতুষ্টি লাভের সুযোগ রয়েছে কি? যে ডানা ভেঙ্গে তিনি কলকাতার উপর গিয়ে পড়েছিলেন সেতো আমাদের সব্বার  এক স্বপ্নেরও ডানা। আর কোথাও কি কোনো ভুলচুক ছিলনা, সত্যি? বাবা ‘হরকুমার বিশ্বাস’এর  যে শ্রেণি বিশ্বাস এবং প্রতাপ তাঁকে হবিগঞ্জের বাড়ি থেকে তাড়িয়েছিল সেই ক্ষমতাই তো  তাঁকে এবং আমাদের তাড়িয়ে বেড়িয়েছিল! তার কোনো সুরাহা  করতে হবে না? প্রশ্নটা আমাদের নিজেদের  করতে হবে। হেমাঙ্গকে জেনে তাঁকে ছেড়ে এগিয়ে যেতে হবে। কেননা, আমাদের  ‘জিরণি’ এখানেই এই মাটিতেই যে গড়তে হবে, সে কথা ভুললে চলবে কেন?
তথ্যসূত্রঃ
 ১) হেমাঙ্গ বিশ্বাসঃ সাংস্কৃতিক চেতনার অমল সুবাস; ফটিক বরা; সুভাষ সুরভি প্রকাশন;ডিব্রুগড়-০৩; ২০০২।  
 ২) উজান গাঙের নাইয়াঃ হেমাঙ্গ বিশ্বাস; তপন মহন্ত; নাইন্থ কলাম’—অসমের কৃতী বাঙালি সংখ্যা; গুয়াহাটি; মে , ২০১১)
৬) হেমাঙ্গ বিশ্বাসৰ গান আৰু কবিতা; অমিয় ভূষণ চক্রবর্তী; ‘অনীক’ ফেব্রুয়ারী মার্চ, ১৯৮৮ হেমাঙ্গ বিশ্বাস স্মরণ সংখ্যাতে প্রকাশিত ‘অগ্নিখেলার সাথী’ প্রবন্ধের হরেন্র্র নাথ বরঠাকুরের করা অসমিয়া অনুবাদ; নতুন পদাতিক ; গুয়াহাটি ১ আগষ্ট, ২০০৩।