চিন দেশের একটা কিস্যা বলি। সে অনেক কাল আগে সে দেশে এক জলের ভারী ছিল। তার দুই মাটির ঘড়া
ছিল জল আনবার জন্যে। যেমন আর সমস্ত ভারী আমাদের দেশেও করে,
একটা বাঁশের লাঠির দু’দিকে ঘড়া দুটো
ঝুলিয়ে কাঁধে করে জল নিয়ে আসত দূর পাহাড়ের ঝরণা থেকে। দুটোই পুরোনো ঘড়া। তার মধ্যে
একটা ঘড়া খানিক ফুটো হয়ে গেছিল। সে বেচারা সবটা জল নিয়ে বাড়ি পৌঁছুতে পারত না।
দিনের পর দিন তাই হচ্ছে। ওদিকে অন্য ঘড়ার দেমাকও সহ্যের বাইরে চলে যাচ্ছিল। একই
কাঁধে ভর করে , একই কাজের জন্যে দু’জনের রোজকার ভ্রমণ, কিন্তু ফুটো কলসির দিকে সে
ফিরেও তাকায় না। নিজের সামর্থ্যে মশগুল সে। কিন্তু জলের ভারী ব্যাটার সেদিকে নজরই
নেই। দিন যায়, মাস যায়, বছরও ঘুরে গেল। ফুটো কলসিকে কাঁধ থেকে নামিয়ে ছুটি দেয় না
বলে বছর দুই পরে একদিন কলসি নিজেই বলল, “ মালিক, কিছু মনে করবেন না, আমার খুব
লজ্জা করছে। এবারে আমাকে ছুটি দিন। আমাকে ক্ষমা করবেন।” ভারী জিজ্ঞেস করল, “কেন
বলোতো?” “ না, ওই আপনি রোজ কত দূর থেকে কত কষ্ট করে জল ভরে নিয়ে আসতে যান। কিন্তু
আমি কিছুতেই আপনার কোনো কাজে লাগি না, আমার আদ্ধেক জল সেই পথেই পড়ে পড়ে নষ্ট হয়ে
যায়। এবারে আমাকে সরিয়ে নতুন ঘড়া নেবার সময় হলো আপনার।” ভারী বলল, “তাই! কাল তবে
শেষবার যাব।” লজ্জার থেকে মুক্তি , কিন্তু দীর্ঘদিনের প্রভুর থেকে বিদেয় নেবার সময়
এলো ভেবে ঘড়ার যেন মন কেমন হয়ে গেল। ঠিক
খুশিও না , আবার খুশি।
পরদিন যথারীতি জল আনতে সেই দূর পাহাড়ের পথে চলল ভারী। যাবার
পথে ফুটোকে বলল, “ আজ শেষবার ভালো করে
পথটাকে দেখে নে, আরতো দেখতে পাবি না।” ঝরণাতে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, “কিছু দেখলি পথে?”
ফুটো বলল, “ নতুন কী আর দেখব? আমিতো যাবার পথেই দেখি রোজ কত জল ঝরাই!” ভারী
কিচ্ছুটি না বলে, যথারীতি জল ভরল, এবং ফিরতি পথে রওয়ানা দিল। মাঝপথে বলল, “নিচে
তাকিয়ে দেখ।” ফুটো বলল, “কী আর দেখব? সেইতো নিজের অপদার্থতা! জল পড়ে পড়ে যাচ্ছে।
” “ ফুল গাছ দেখছিস না?”
ফুটো বলল, “হ্যা, সেগুলোর উপরেইতো জল পড়ছে।” এবারে ভারী বলল, “এটা আমি আগেই
দেখেছি। তুই জল ফেলে ফেলে বেশ একটা সুন্দর
রেখা এঁকে এঁকে যাস, দেখে আমার বেশ ভালোই লাগছিল। আমি দিলাম ফুলের বীজ রুইয়ে। গাছও
হয়ে গেল , সে অনেকদিন। এখন দেখ ফুলে ফুলে ছয়লাপ। তুই আসলে কি কাজটা করছিলি দেখলি? সেই ফুল যখন
আমার মালিকের বাড়ি নিয়ে গিয়ে দিই, ওরা কি খুশি হয় বল! শুধু শুধু লজ্জা পাচ্ছিলি।” শুনে ফুটোর মন ভালো
হয়ে গেল। ভারী তবে জেনেশুনেই তাকে ধরে রেখেছে। এই কাজ করাবে বলে!
কিন্তু যে কাজের
জন্যে সে দায়িত্বপ্রাপ্ত তার কী হবে? বন্ধ ঘড়াটার দেমাক কি তাতে কমবে এত্তোটুকু?
ভারী কি তবে তাকে ধরে রাখবার বাহানা খুঁজছে? এই ভেবে তার মন আবারও খারাপ হয়ে গেল।
বলল,” সে হোক! কিন্তু আমার কাজ জল নিয়ে তোমার মালিকের বাড়ি পৌঁছে দেয়া, সেটি আমি
পারিনা। আমাকে ছুটি দাও। আজ কিন্তু শেষ।”
ভারী তখন বলল, “তোর মন কোনদিকে সেও আমি জানি। পথের অন্য পাশে ফুলের গাছ দেখছিস?”
“সে কি করে দেখব, ওতো আর আমার মতো ফুটো নয়, এক বিন্দু জলও সে নষ্ট করে না।” “
সুতরাং ফুল জন্মায় না, তোর জলে ফুল জন্মায়! এই ভেবে আনন্দ কর। তোর এটাই কাজ!” যে
ফুটো কলসি পরিত্যক্ত হয়ে এককোনে পড়ে থাকবার কথা ছিল, ভারীর এই কথাতে যেন তার নতুন
জন্ম হলো। সত্যি, নতুন কাজ পাবার আনন্দে সে এতোই উতলা হলো যে সেদিনকার মতো সব জল
পথের মাঝেই ফুরিয়ে গেল।