আমার চেতনার রঙে রাঙানো এই খেলা ঘরে:

~0~0~! আপনাকে স্বাগতম !~0~0~

*******************************************************************************************************

Sunday, 22 April 2012

রবীন্দ্রনাথ এবং দুই-চার পাত কলে ছাঁটা বিদ্যা

মাকে রবীন্দ্রনাথ নিয়ে ছাত্রবোধ্য একটা কিছু লিখতে বলা হয়েছিল অনেকদিন আগেই। একেবারে আমিতো লিখি, তায় ছাত্র পড়াই। এই নিয়ে  যদি এক ঘণ্টাতে কিছু না নামাতেই পারলাম, তবে আর আমার মান থাকে বা কিসে! এবারে এই মান রাখাটাই আমার ভাবনা হয়ে দাঁড়ালো, লেখাটা গৌণ। আমার মাথাতে ঘুরছিল রবিঠাকুরেরই একটি ছড়ার ক’টি লাইন, “সহজ কথায় লিখতে আমায় কহ যে,/সহজ কথা যায় না লেখা সহজে।/লেখার কথা মাথায় যদি জোটে/তখন আমি লিখতে পারি হয়তো।/কঠিন লেখা নয়কো কঠিন মোটে,/যা-তা লেখা তেমন সহজ নয় তো।’(উৎসর্গ;খাপছাড়া)সুতরাং যা হয় কিছু , লেখার কথা জুটছিল না মাথায় মোটে!             তারপর না হয় কিছু একটা দাঁড় করানোও গেল, ভাবতে বসলাম, পড়বেটা কে! ছাত্ররা পড়ে আজকাল? কাগজে পত্রে কিম্বা আড্ডাতে যে শুনি বক্তৃতা ভীষণ--- ‘যুবপ্রজন্মের অবক্ষয়!’ ঐ ‘কিশোর প্রজন্ম’ নিয়েও একই কথা। আচ্ছা, না হয় পড়লই বা! কী হবে! মনে থাকবে! জ্ঞান বাড়বে! পড়লে কি জ্ঞান বাড়ে? পড়ে এবং একমাত্র বই/ পত্রিকা  পড়েই যে জ্ঞান বাড়ে এইটেইতো আমাদের সব কুসংস্কারের বাড়া! ফলে আমরা কেমন কাব্যি করি, ‘লেখাপড়া করে যে গাড়িঘোড়া চড়ে সে।” সত্যজিত রায়ের চলচ্ছবিতে একেই খানিক বিদ্রূপ করে বলা হয়েছিল, “লেখাপড়া করে যে গাড়িচাপা পড়ে সে।” ভাবখানা ঐ একই , উল্টোদিক থেকে। যার ছিল গাড়ি চড়ার কথা সে কিনা  পড়ে তলায় চাপা---বেকারদের নিয়ে আক্ষেপ! এই সাকার হওয়া, লিখে পড়ে ভালো বর এবং ঘর পাওয়া একেই যে আমরা বলি ‘মানুষ হওয়া’ এইটেইতো আমাদের সব সংস্কারের বড় সংস্কার। সত্যি কি আর ‘মানুষ’ হই !
            আচ্ছা, এই যে লিখলাম, বই পড়েই যে জ্ঞান বাড়ে এ আমাদের কুসংস্কার মাত্র!—কথাটা খুবই সহজ কিনা। কিন্তু কত সহজেই পাঠক আৎকে উঠবেন। এতো একেবারেই ছেলে মেয়েদের গোল্লায় যাবার পরামর্শ দেয়া! যে ছাত্র বই পত্তরের ধার ঘেঁসে না, নকল করে পাশ দেবার ধান্দাতে থাকে মশগুল-- তার পক্ষে কিনা ওকালতি! কিন্তু ভেবে দেখুন, পরীক্ষাতে নকল করে সেও কিন্তু এই সংস্কারে আচ্ছন্ন একেবারে। বইএর কথা সংগত কারণেই ওর মাথাতে ঢোকে না, অথচ  টোকাটুকিটা সে করে কিন্তু বইএর থেকেই। বাজারে চালু সহজ বই, নোট বই থেকে হলেও সেটি বইইতো!  তাঁর কিন্তু উচিৎ ছিল নকলটি না করে, সোজা আমাদের মতো মাষ্টার মশাইদের সামনে দাঁড়িয়ে বলে ফেলা , যে বই আপনারা পড়ান, বাংলা কিম্বা ইংরেজিতে, তাতে আমার জীবনের কথা কিছু নেইতো! নেইতো নদী লঙ্গাই কিম্বা ডিহিঙের কথা। নেইতো, আমার গ্রামে গেল বর্ষার ঝড়ের কিম্বা বানের কথা! নেইতো, পাশের গায়ের চড়ক মেলার শিবদুর্গার নাচের কথা! আছিমগঞ্জের গেল উরুসের কথা! পাথারকান্দির রাশের কথা! নেইতো, ফুটো নৌকা আর ভাঙা লাঙল সারাইর কথা!  বলে যে না, কারণ বই নিয়ে যে সংস্কার তার প্রতি ভয়টা আমাদের ভূতের চেয়ে  কিছু কম না।
         আমরা কি রবীন্দ্রনাথ থেকে সরে এসছি? মোটেও না। কথাগুলোতো রবীন্দ্রনাথই লিখে গেছেন! সেই যে,     “... বইপড়াটা  যে শিক্ষার একটা সুবিধাজনক সহায়মাত্র, তাহা আর আমাদের মনে হয় না; আমরা বইপড়াটাকেই শিক্ষার একমাত্র উপায় বলিয়া ঠিক করিয়া বসিয়া আছি। এ সম্বন্ধে আমাদের সংস্কারকে নড়ানো বড়োই কঠিন হইয়া উঠিয়াছে। মাস্টার বই হাতে করিয়া শিশুকাল হইতেই আমাদিগকে বই মুখস্থ করাইতে থাকেন। কিন্তু বইয়ের ভিতর হইতে জ্ঞানসঞ্চয় করা আমাদের মনের স্বাভাবিক ধর্ম নহে।” (আবরণ/ শিক্ষা) তবে স্বাভাবিক ধর্ম তথা সুসংস্কারটি কী?  আমরা লিখব একেবারে শেষে । আপতত এইটুকুন লেখা যাক যে ছেলেমেয়েরা তার পরিবার, চারপাশের সমাজ প্রকৃতির সঙ্গে খেলায়, লীলায় এবং ছোঁয়ায় যা কিছু শিখে আসে বইএর পাতা সেগুলো তাকে ভুলতে বলে। তাকে জানায় আর সবই অবিদ্যা, বইতেই শুধু জমানো আছে বিদ্যা!   এই সংঘাতের জ্বালা সয়ে সয়েই তার  মনের ধর্মের বিরুদ্ধে যেতে হয় বলেই   শুধু ছাত্র স্কুল পালায় না। বেচারারা দুর্বল বলেই দোষ চাপানো সহজ। স্কুল-কলেজ পালান শিক্ষক, অভিভাবক, সরকার প্রশাসন সব্বাই।  প্রত্যেকের শুধু পালাবার ধরণ আলাদা! এও পালাবারই একটি ধরণই বটে,  “কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে আমাদের মাস্টাররা বই পড়াইবার একটা উপলক্ষমাত্র; আমরাও বই পড়িবার একটা উপসর্গ। ইহাতে ফল হইয়াছে এই, আমাদের শরীর যেমন কৃত্রিম জিনিসের আড়ালে পড়িয়া পৃথিবীর সঙ্গে গায়ে-গায়ে যোগটা হারাইয়াছে এবং হারাইয়া এমন অভ্যস্ত হইয়াছে যে, সে-যোগটাকে আজ ক্লেশকর লজ্জাকর বলিয়া মনে করে-- তেমনি আমাদের মন এবং বাহিরের মাঝখানে বই আসিয়া পড়াতে আমাদের মন জগতের সঙ্গে প্রত্যক্ষ যোগের স্বাদ-শক্তি অনেকটা হারাইয়া ফেলিয়াছে। সব জিনিসকে বইয়ের ভিতর দিয়া জানিবার একটা অস্বাভাবিক অভ্যাস আমাদের মধ্যে বদ্ধমূল হইয়া গেছে। পাশেই যে-জিনিসটা আছে, সেইটেকেই জানিবার জন্য বইয়ের মুখ তাকাইয়া থাকিতে হয়। নবাবের গল্প শুনিয়াছি, জুতাটা ফিরাইয়া দিবার জন্য চাকরের অপেক্ষা করিয়া শত্রুহস্তে বন্দী হইয়াছিল। বইপড়া বিদ্যার গতিকে আমাদেরও মানসিক নবাবি তেমনি অত্যন্ত বাড়িয়া উঠিয়াছে। তুচ্ছ বিষয়টুকুর জন্যও বই নহিলে মন আশ্রয় পায় না। বিকৃত সংস্কারের দোষে এইরূপ নবাবিয়ানা আমাদের কাছে লজ্জাকর না হইয়া গৌরবজনক হইয়া উঠে, এবং বইয়ের ভিতর দিয়া জানাকেই আমরা পাণ্ডিত্য বলিয়া গর্ব করি। জগৎকে আমরা মন দিয়া ছুঁই না, বই দিয়া ছুঁই।” (ঐ)
          ভাবছিলাম এই বইপত্তর, লেখা পড়া এইসব নিয়ে রবীন্দ্রনাথ কী লিখে গেছেন, তাই নিয়েই দুটো কথার জাল ফাঁদব। কিন্তু সেওতো হবে বই দিয়ে রবীন্দ্রনাথকে ছোঁয়া এবং ছোঁয়াবার প্রয়াসমাত্র। নাহয় আমার রবীন্দ্রনাথ পড়াই আছে, কিন্তু যাদের জন্যে লিখছি-- সেইসব ‘সর্বশিক্ষার’ যুগের ছাত্র-শিক্ষকদের নিয়েতো নেই কোনো অধ্যয়ণ কিম্বা অনুশীলন। ফলে আমার লেখাগুলো চোখের ভেতর দিয়ে মর্মে গিয়ে না যদি পৌঁছোয় তবে লজ্জাটা আমার শুধু, আর কারো না। এই কথাটা শুরুতেই বলে রাখলুম। এবারে “কে হায় হৃদয় খুঁড়ে ‘লজ্জার’ বেদনা জাগাতে ভালোবাসে?” আমার কাছে তাই কাজটা সহজ ছিল না কেন কিছুতেই, আশা করছি এবারে বোঝানো গেল।
            বই দিয়ে জগৎ ছুঁয়ে ছুঁয়েই আমরা ‘গাড়িঘোড়া’ চড়বার স্বপ্ন যখন দেখি, ‘মানুষ’ হবার প্রকল্পটা সজ্ঞানেই মুলতুবি করে রাখি যখন  তখন ঐ ‘অবক্ষয়’ ব্যাপারটা যে একেবারেই ছেয়ে যাবে, ‘আজকালকার ছেলেমেয়ে’দের নিয়ে বিপন্ন বোধ করবেন সেকালের লোকজন সে আর ওমন অবাক করা কথা কী? তাঁরা তখন আমাদের নীতিশিক্ষা দেবার জন্যে ব্যস্ত হয়ে পড়েন, লেটেষ্ট ফ্যাসন হলো, স্কুলে কলেজে ‘ভ্যালু -এডুকেশন!’ ওখানেও রবীন্দ্রনাথ আমাদের,  মানে  সেকালের লোকজনদের,  হতাশ করেছেন। তিনি সত্যি ‘গুরুদেব’!  ‘আজকালকার ছেলেমেয়েরা জেনে আনন্দে হুল্লোড় করতে পারেন যে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, “ব্রহ্মচর্যপালনের পরিবর্তে আজকাল নীতিপাঠের প্রাদুর্ভাব হইয়াছে। যে-কোনো উপলক্ষে ছাত্রদিগকে নাতি-উপদেশ দিতে হইবে, দেশের অভিভাবকদের এইরূপ অভিপ্রায়।ইহাও ঐ কলের ব্যাপার। নিয়মিত প্রত্যহ খানিকটা করিয়া সালসা খাওয়ানোর মতো খানিকটা নীতি-উপদেশ-- ইহা একটা বরাদ্দ; শিশুকে ভালো করিয়া তুলিবার এই একটা বাঁধা উপায়।নীতি-উপদেশ জিনিসটা একটা বিরোধ। ইহা কোনোমতেই মনোরম হইতে পারে না। যাহাকে উপদেশ দেওয়া হয় তাহাকে আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়। উপদেশ হয় তাহার মাথা ডিঙাইয়া চলিয়া যায়, নয় তাহাকে আঘাত করে। ইহাতে যে কেবল চেষ্টা ব্যর্থ হয় তাহা নয়, অনেক সময় অনিষ্ট করে। সৎকথাকে বিরস ও বিফল করিয়া তোলা মনুষ্যসমাজের যেমন ক্ষতিকর এমন আর কিছুই নয়-- অথচ অনেক ভালো লোক এই কাজে উঠিয়া-পড়িয়া লাগিয়াছেন, ইহা দেখিয়া মনে আশঙ্কা হয়।সংসারে কৃত্রিম জীবনযাত্রায় হাজার রকমের অসত্য ও বিকৃতি যেখানে প্রতিমুহূর্তে রুচি নষ্ট করিয়া দিতেছে সেখানে ইস্কুলে দশটা-চারটের মধ্যে গোটাকতক পুঁথির বচনে সমস্ত সংশোধন করিয়া দিবে ইহা আশাই করা যায় না। ইহাতে কেবল ভুরি ভুরি ভানের সৃষ্টি হয়, এবং নৈতিক জ্যাঠামি যাহা সকল জ্যাঠামির অধম, তাহা সুবুদ্ধির স্বাভাবিকতা ও সৌকুমার্য নষ্ট করিয়া দেয়।” (শিক্ষাসমস্যা/ শিক্ষা) তাই বলে কি, ছেলেমেয়েদের জাহান্নমে পাঠাবার ব্যবস্থা বাৎলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ? মোটেও না, শুধু জাগাতে চাইছিলেন কর্তব্যবোধ। সে ঐ ‘গুরুজনের আদেশ অমান্য করতে নেই’ জাতীয় কর্তব্যবোধও নয়। এই জীবন নিয়ে সে করবেটা কী, সেই কাজের বোধ। আমরা শুধু জাগিয়ে চলি পড়ার বোধ! নীতিকথাটাও পড়ার জিনিস!নীতিকথার বই বাজারে বিক্রির জিনিস!
            মূল্যবোধটা সেই কাজের বোধ  থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে দেখা যে দেয় না, এই বোধই আমরা হারিয়ে বসে আছি।  যে ছেলে কবি হবে বলে ঠিক করেছে সে হয়তো  নদীর টানে পাড়ে গিয়ে একান্তে বসে থাকতে  ভালোবাসবে, থাকবে অন্যমনস্ক। কিন্তু যে ছেলে সমাজসেবা করবে বলে ঠিক করেছে তাকেতো জানতেই হবে কী করে বন্ধু বাড়াতে হয়, জয় করতে হয় শত্রুর মন। তিনি লিখছেন, “মানবহৃদয়ে সুখস্পৃহাই একমাত্র চালক-শক্তি। ইচ্ছা করিয়া কেহ কখনো দুঃখ সহ্য করে না। কথাটা শুনিবামাত্রই অনেকে তাড়াতাড়ি প্রতিবাদ করিতে উঠিবেন, কিন্তু একটু বুঝাইয়া বলি। কর্তব্যপালনের জন্য অনেক সময় কষ্ট সহ্য করিতে হয় বটে, কিন্তু কর্তব্যপালনেই আমার যে আন্তরিক সুখ হয়, সেই সুখ ওই কষ্ট অপেক্ষা বলবান বলিয়া, কিংবা পরকালে অধিক পরিমাণে সুখ পাইবার অথবা ততোধিক দুঃখ এড়াইবার আশায় আমরা কর্তব্যের অনুরোধে কষ্ট সহ্য করিয়া থাকি। এ স্থলে আমি ফিলজফির নিগূঢ় তর্ক তুলিতে চাহি না; কিন্তু সকলেই বোধ হয় নিদানপক্ষে এ কথাটা স্বীকার করিবেন যে, লোকে সুখের প্রলোভনেই অন্যায় পথ অবলম্বন করে, এবং কর্তব্যের প্রতি আন্তরিক টানই এই প্রলোভন অতিক্রম করিবার একমাত্র উপায়।” (ছাত্রদের নীতিশিক্ষা / শিক্ষা)
     
     আমি আশা করছি, স্কুল পালানো ছেলেমেয়েরা যদি বা পড়ছে এই লেখা, এইবারে একটু নড়েচড়ে বসেছে। স্কুল না ভালো লাগাটা এক্কেবারেও অপরাধ কিছু নয়! স্কুল নিয়ে ইনি যা লিখেছেন তা হচ্ছেগে সব লেখার বাড়া, “ইস্কুল  বলিতে আমরা যাহা বুঝি সে একটা শিক্ষা দিবার কল। মাস্টার এই কারখানার একটা অংশ। সাড়ে দশটার সময় ঘণ্টা বাজাইয়া কারখানা  খোলে। কল চলিতে আরম্ভ হয়, মাস্টারেরও মুখ চলিতে থাকে। চারটের সময় কারখানা বন্ধ হয়, মাস্টার-কলও তখন মুখ বন্ধ করেন, ছাত্ররা দুই-চার পাত কলে ছাঁটা বিদ্যা লইয়া বাড়ি ফেরে। তার পর পরীক্ষার সময় এই বিদ্যার যাচাই হইয়া তাহার উপরে মার্কা পড়িয়া যায়।কলের একটা সুবিধা, ঠিক মাপে ঠিক ফরমাশ-দেওয়া জিনিসটা পাওয়া যায়-- এক কলের সঙ্গে আর-এক কলের উৎপন্ন সামগ্রীর বড়ো-একটা তফাত থাকে না, মার্কা দিবার সুবিধা হয়।কিন্তু এক মানুষের সঙ্গে আর-এক মানুষের অনেক তফাত। এমন-কি, একই মানুষের একদিনের সঙ্গে আর-একদিনের ইতর-বিশেষ ঘটে।তবু মানুষের কাছ হইতে মানুষ যাহা পায় কলের কাছ হইতে তাহা পাইতে পারে না। কল সম্মুখে উপস্থিত করে কিন্তু দান করে না। তাহা তেল দিতে পারে কিন্তু আলো জ্বালাইবার সাধ্য তাহার নাই।”(শিক্ষাসমস্যা/ শিক্ষা) এইবারে, জীবনে যারা আলো জ্বালাতে চায়, তারাতো স্কুল পালাবেই, রবীন্দ্রনাথও পালাতেন। এবং নিজের ছেলেমেয়েদের কাউকেই লেখাপড়া করবার জন্যে কোনো প্রতিষ্ঠিত স্কুলে পাঠান নি। সেই শিলাইদহের গাঁয়ে প্রজাদের পড়াবার ব্যবস্থা করতে নিজের মতো একটা পাঠশালা করেছিলেন, সেখানেই ওদের হাতে খড়ি। তাঁর সেইসব প্রয়াসই পরে শান্তিনিকেতন, শ্রীনিকেতন, বিশ্বভারতীতে ডানা ডালপালা মেলে, যেগুলোকে আমরা ছেঁটেছি প্রচুর পরে , যতই তাঁর নামে দোহার দিইনা কেন, ছড়াইনি কিন্তু তেমন! কারণ তাতে বৃটিশও বিপদ দেখত প্রচুর, এক্কেবারে নির্দেশিকা জারি করে আদেশ দিয়েছিল কোনো সরকারি কর্মচারী যেন শান্তিনিকেতনে ছেলে না পাঠান। আমরাও এখনো বৃটিশ থেকে কম কিছু না। বিলেতি নেশার ছাড়িনিতো কিছুই। গেল দুই দশকে নতুন করে মাতাল হয়েছি বরং। শুধু কি বই পড়লেই হলো! পড়তে হবে ইংরেজিতে! তবেই বুঝি, কার কত জ্ঞান! আপনাকে যদি অচেনা কেউ কখনো মুখ্যু সুখ্যু কিছু ভেবে উপেক্ষা করে, মুখের উপর দুটো ইংরেজি ঝেড়ে দিন, টুক করে সেলাম ঠুকে দেবে, চায়ের আড্ডাতে ডাক দেবে। যে শুধু উচ্চারণ করতে জানে, “চিত্ত যেথা ভয়শূন্য, উচ্চ যেথা শির,/জ্ঞান যেথা মুক্ত, যেথা গৃহের প্রাচীর/আপন প্রাঙ্গণতলে দিবসশর্বরী/বসুধারে রাখে নাই খন্ড ক্ষুদ্র করি,/যেথা বাক্য হৃদয়ের উৎসমুখ হতে/উচ্ছ্বসিয়া উঠে …”ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি  সে তেমন জানে না কিছুই। কিন্তু যে জানে গুরুগম্ভীর স্বরে আবৃত্তি করতে, “Where the mind is without fear and the head is held high/Where knowledge is free/Where the world has not been broken up into fragments/By narrow domestic walls/Where words come out from the depth of truth “ ...etc. etc. etc… তার সত্যি সত্যি কদর ভীষণ ‘the head is held high’! আজকাল ইংরেজি স্কুলেও ঘটা করে রবীন্দ্রজন্মজয়ন্তী পালিত হয়ে থাকে। একমাত্র রবীন্দ্রনাথ কেটে ছেঁটেই সেটি করা সম্ভব। অনুবাদ করেও তাঁর সত্য কথাগুলোর সবটা যে উচ্চারিত  হবে সেখানে সে প্রায় অসম্ভব! জন্ম জয়ন্তী তাই আড়ম্বড় যতটা, আন্তরিকতা নয় ততটা মোটেও। 
          সে যে কী ভীষণ মেকি, কী ভীষণ নকল ‘শিরে’র আস্ফালন আমরা আঁচ করেও যেন অসহায়! যারা ইংরেজি মাধ্যমের বেসরকারি স্কুলগুলোতে পড়ছেন না তাদের মধ্যেই যেন এই নিয়ে লজ্জাকে সংক্রমিত করে দেয়া হয়েছে ভীষণ রকম। সেই সব ছাত্রদের সঙ্গে আমাদের দেখা হয় কলেজে , তাই চিনি তাদের লজ্জার চেহারাটা।  কোনো বিদ্বেষ ছিল না, রবীন্দ্রনাথের ইংরেজি ভাষাটির প্রতি, তাঁর        ‘  ইংরেজি সহজ শিক্ষা’ নামে একাধিক পাঠ্য বইও আছে। ওমন ইংরেজি শেখার সহজ বই সত্যি, আমাদের চোখে পড়ে নি আজো। পড়ে দেখবেন, সেই বইগুলোতে ছাত্রদের পড়ে মুখস্থ করবার একটিও লাইন নেই। কিন্তু শিক্ষকের করবার আর করাবার নির্দেশ রয়েছে শুরু থেকে শেষ। কিন্তু বাংলা তথা মাতৃভাষার প্রতি যে বিদ্বেষ এবং উপেক্ষা তার বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন নিরলস সংগ্রামী আজীবন! এক জায়গাতে লিখছেন, “এক তো, ইংরেজি ভাষাটা অতিমাত্রায় বিজাতীয় ভাষা। শব্দবিন্যাস পদবিন্যাস সম্বন্ধে আমাদের ভাষার সহিত তাহার কোনোপ্রকার মিল নাই। তাহার পরে আবার ভাববিন্যাস এবং বিষয়-প্রসঙ্গও বিদেশী। আগাগোড়া কিছুই পরিচিত নহে, সুতরাং ধারণা জন্মিবার পূর্বেই মুখস্থ আরম্ভ করিতে হয়। তাহাতে না চিবাইয়া গিলিয়া খাইবার ফল হয়। হয়তো কোনো-একটা শিশুপাঠ্য রীডারে hay makingসম্বন্ধে একটা আখ্যান আছে, ইংরেজ ছেলের নিকট সে-ব্যাপারটা অত্যন্ত পরিচিত, এইজন্য বিশেষ আনন্দদায়ক; অথবা snowball খেলায় Charlieএবং Katielমধ্যে যে কিরূপ বিবাদ ঘটিয়াছিল তাহার ইতিহাস ইংরেজ-সন্তানের নিকট অতিশয় কৌতুকজনক, কিন্তু আমাদের ছেলেরা যখন বিদেশী ভাষায় সেগুলা পড়িয়া যায় তখন তাহাদের মনে কোনোরূপ স্মৃতির উদ্রেক হয় না, মনের সম্মুখে ছবির মতো কিছু দেখিতে পায় না, আগাগোড়া অন্ধভাবে হাতড়াইয়া চলিতে হয়।আবার নীচের ক্লাসে সে-সকল মাস্টার পড়ায় তাহারা কেহ এন্ট্রেন্স পাস, কেহ বা এন্ট্রেন্স ফেল, ইংরেজি ভাষা ভাব আচার ব্যবহার এবং সাহিত্য তাহাদের নিকট কখনোই সুপরিচিত নহে। তাহারাই ইংরেজির সহিত আমাদের প্রথম পরিচয় সংঘটন করাইয়া থাকে। তাহারা না জানে ভালো বাংলা, না জানে ভালো ইংরেজি; কেবল তাহাদের একটা সুবিধা এই যে, শিশুদিগকে শিখানো অপেক্ষা ভুলানো ঢের সহজ কাজ, এবং তাহাতে তাহারা সম্পূর্ণ কৃতকার্যতা লাভ করে।বেচারাদের দোষ দেওয়া যায় না। Horse is a noble animal--বাংলায়  তর্জমা করিতে গেলে বাংলারও ঠিক থাকে না, ইংরেজিও ঘোলাইয়া যায়। কথাটা কেমন করিয়া প্রকাশ করা যায়। ঘোড়া একটি মহৎ জন্তু, ঘোড়া অতি উঁচুদরের জানোয়ার, ঘোড়া জন্তুটা খুব ভালো-- কথাটা কিছুতেই তেমন মনঃপূতরকম হয় না, এমন স্থলে গোঁজামিলন দেওয়াই সুবিধা। আমাদের প্রথম ইংরেজি শিক্ষায় এইরূপ কত গোঁজামিলন চলে তাহার আর  সীমা নাই। ফলত অল্পবয়সে আমরা যে ইংরেজিটুকু শিখি তাহা এত যৎসামান্য এবং এত ভুল যে, তাহার ভিতর হইতে কোনোপ্রকারের রস আকর্ষণ করিয়া লওয়া বালকদের পক্ষে অসম্ভব হয়-- কেহ তাহা প্রত্যাশাও করে না। মাস্টারও বলে ছাত্রও বলে, আমার রসে কাজ নাই, টানিয়া-বুনিয়া কোনোমতে একটা অর্থ বাহির করিতে পারিলে এ যাত্রা বাঁচিয়া যাই, পরীক্ষায় পাস হই; আপিসে চাকরি জোটে। সচরাচর যে-অর্থটা বাহির হয় তৎ-সম্বন্ধে শঙ্করাচার্যের এই বচনটি খাটে :অর্থমনর্থং ভাবর নিত্যং/নাস্তি ততঃ সুখলেশঃ সত্যম্।অর্থকে অনর্থ বলিয়া জানিয়া, তাহাতে সুখও নাই এবং সত্যও নাই।” (শিক্ষার হেরফের/ শিক্ষা)
             সেই কবে, এক শতাব্দি আগে পরাধীন ভারতে শিক্ষাকে আমরা চাকরি জোটাবার অস্ত্র হিসেবে পেয়েছি এবং সেভাবেই নিয়েছি। ইংরেজকে বিদেয় দিলেও চাকরির বাজারে তার ভাষাটিকে বিদেয় করিনি তো বটেই, বরং তাকেই আরো ঘসে মেজে সাফসুতরো করে করে মরচে না পরে সেদিকে লক্ষ্য রেখেছি। এবারে সেটি ঠিক না বেঠিক কাজ যে আরেক বিশাল তর্ক। ইংরেজি নইলে আজকের দিনে ঠিক আন্তর্জাতিক মানুষ হয়ে ওঠা যাবে না, এই বিশ্বাসও যে মূলত বিলেতিদের দিয়ে যাওয়া  এবং তোতাপাখির মতো মুখস্ত করতে করতেই পাওয়া সে আমাদের ভুলেও মনে হয় না। হতো যদি , আমাদের প্রতিবেশি দেশগুলোও এককালের বিলেতি উপনিবেশ না হতো, তাদের থেকেও শেখা যেত। আছে বটে চিন, যারা চিনা ভাষাতেই বিশ্বজয় করেছে। কিন্তু হিমালয়ের প্রকৃতি এবং রাজনীতি আমাদের চোখ আড়াল করে রেখেছে। সে আড়ালও ভেদ করা যেত হয়তো, যদি চিন্তা করতে পেতাম, পেতাম কল্পনা করতে। মুখস্থ করবার ফাঁকে ফাঁকে পেতাম কিছু অবসর। যত দিন যাচ্ছে, বাজারের ইংরেজির দাপটে সেইসব অবসরগুলোও আমাদের জীবন থেকে ছিনিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
                    সেই একশতাব্দী আগে রবীন্দ্রনাথের আক্ষেপ এখনো আরো ভয়াবহ সত্য বই কম কিছু করিনি আমরা, “আমরা বাল্য হইতে কৈশোর এবং কৈশোর হইতে যৌবনে প্রবেশ করি কেবল কতকগুলা কথার বোঝা টানিয়া। সরস্বতীর সাম্রাজ্যে কেবলমাত্র মজুরি করিয়া মরি, পৃষ্ঠের মেরুদণ্ড বাঁকিয়া যায় এবং মনুষ্যত্বের সর্বাঙ্গীণ বিকাশ হয় না। যখন ইংরেজি ভাবরাজ্যের মধ্যে প্রবেশ করি তখন আর  সেখানে তেমন যথার্থ অন্তরঙ্গের মতো বিহার করিতে পারি না। যদি বা ভাবগুলা একরূপ বুঝিতে পারি কিন্তু সেগুলাকে মর্মস্থলে আকর্ষণ করিয়া লইতে পারি না; বক্তৃতায় এবং লেখায় ব্যবহার করি, কিন্তু জীবনের কার্যে পরিণত করিতে পারি না।...... অসভ্য রাজারা যেমন কতকগুলা সস্তা বিলাতি কাচখণ্ড পুঁতি প্রভৃতি লইয়া শরীরের যেখানে সেখানে ঝুলাইয়া রাখে এবং বিলাতি সাজসজ্জা অযথাস্থানে বিন্যাস করে, বুঝিতেও পারে না কাজটা কিরূপ অদ্ভুত এবং হাস্যজনক হইতেছে, আমরাও সেইরূপ কতকগুলা সস্তা চকচকে বিলাতি কথা লইয়া ঝলমল করিয়া বেড়াই এবং বিলাতি বড়ো বড়ো ভাবগুলি লইয়া হয়তো সম্পূর্ণ অযথাস্থানে অসংগত প্রয়োগ করি, আমরা নিজেও বুঝিতে পারি না অজ্ঞাতসারে কী একটা অপূর্ব প্রহসন অভিনয় করিতেছি এবং কাহাকেও হাসিতে দেখিলে তৎক্ষণাৎ য়ুরোপীয় ইতিহাস হইতে বড়ো বড়ো নজির প্রয়োগ করিয়া থাকি।” ( শিক্ষার হেরফের/শিক্ষা)
            এই আমাদের মানুষ হওয়া। এই কাজ যে ভালো করতে পারে আমরা তাকেই বলি শিক্ষিত এবং সমীহ করি। এমন শিক্ষিতের দেখা যে কেবল  আজকালকার ইংরেজি মাধ্যমের স্কুল গুলোতেই মেলে তাতো নয়, বাংলা তথা ভারতীয় ভাষামাধ্যমের স্কুলগুলো এই ব্যামো থেকে কোনোকালেই মুক্ত ছিলনা বলেই সুযোগ পেতেই সেই সব স্কুল থেকে পাশ করা ছাত্ররাই গেল দুই দশকে ইংরেজি মাধ্যমের বাজার খুলে বসেছেন দেশজুড়ে। আমাদের শিক্ষার মাধ্যম বাংলা, মণিপুরি, সাদ্রি   হবেটা কি, তার ভেতরকার ভাবখানাতো সেই বিলেতি ভিক্ষের দানে পাওয়া। তাই ‘বাংলা ভাষা’ কথাটা উচ্চারণ করলেই আমাদের মনে পড়ে বাংলা সাহিত্যের কথা, কিন্তু ‘ইংরেজি’ বললেই জ্ঞান-বিজ্ঞান, অর্থনীতি আরো কত কী? বাংলা ভাষার বই বললে বুঝি সাহিত্যের বই, পত্রিকা বললে বুঝি সাহিত্যের পত্রিকা। সেই পত্রিকাতে যে  হাডু-ডু-ডু, কবাডি খেলা থেকে শুরু করে গ্রহান্তরের জীবের ইতিহাস চর্চা করা যেতে পারে সে  আমাদের দূর দূর অব্দিও কল্পনাতেই আসে না। তাই স্কুলের মারের ভয় কেটে যাবার পর আর ঐ সব বই পত্রিকার দিকে কেউ ফিরেও তাকায় না। তখন আবার সেই সব লিখিয়েদের মুখেই শোনা যায়  ভাষার বিপন্নতা নিয়ে হাহাকার! সে হাহাকার করতে হয় বলেই করা। হাহাকারের ভেতরকার রহস্য নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না, কারণ আমাদের মাথা ঘামাতে শেখানো হয় নি,  আমরা কল্পনার মানুষই নই, মানুষ মুখস্থবিদ্যার।
             সেই যে পাঠশালাতে ‘মিথ্যেবাদী রাখাল বালকে’র গল্প মুখস্থ দিয়ে আমাদের সাহিত্যের এবং নীতিকথার পাঠ শুরু হয়, শেষ হয় ‘তোতা-কাহিনী’র সপ্রসঙ্গ ব্যাখা  উগরে দিয়ে। মাঝের দিনগুলোতে কেউ আমাদের  রাখাল বালকের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেয়া তো দূর, ‘তোতাকাহিনী’র নাট্যরূপান্তর করে অভিনয় করতেও পরামর্শ দেবেন না। দেনও যদি, সেই ঐ গ্রীষ্মের কিম্বা পুজোর ছুটির  আগের দিনে কিম্বা রবীন্দ্রজন্মজয়ন্তীতে। রুটিনের বাইরে। তার জন্যে পরীক্ষাতে মার্ক্স দুটো কমলেও কমতে পারে, বাড়বার কোনো সম্ভাবনা নেই। তাই ছেলে স্কুলে নাটক করবে জানলে বহু বাবা ছেলেকে বাড়ি আটকে রাখতে এখনো ভালোবাসেন!  আমাদের মনের  সৃজনী সম্ভাবনাও  যেটুকু ছিল তাও উবে যায়, থাকে শুধু অনুকরণ আর  অনুরণন।
              আমরা একটি প্রশ্নের উত্তর মুলতুবি রেখে এগিয়েছিলাম,  মনের স্বাভাবিক ধর্ম তথা সুসংস্কারটি কী? রবীন্দ্রনাথ লিখছেন,  “প্রত্যক্ষ জিনিসকে দেখিয়া-শুনিয়া নাড়িয়া-চাড়িয়া সঙ্গে সঙ্গেই অতি সহজেই আমাদের মননশক্তির চর্চা হওয়া স্বভাবের বিধান ছিল। অন্যের অভিজ্ঞাত ও পরীক্ষিত জ্ঞান, তাও লোকের মুখ হইতে শুনিলে তবে আমাদের সমস্ত মন সহজে সাড়া দেয়। কারণ, মুখের কথা তো শুধু কথা নহে, তাহা মুখের কথা। তাহার সঙ্গে প্রাণ আছে; চোখমুখের ভঙ্গি, কণ্ঠের স্বরলীলা, হাতের ঈঙ্গিত-- ইহার দ্বারা কানে শুনিবার ভাষা, সংগীত ও আকার লাভ করিয়া চোখ কান দুয়েরই সামগ্রী হইয়া উঠে। শুধু তাই নয়, আমরা যদি জানি, মানুষ তাহার মনের সামগ্রী সদ্য মন হইতে আমাদিগকে দিতেছে, সে একটা বই পড়িয়া মাত্র যাইতেছে না, তাহা হইলে মনের সঙ্গে মনের প্রত্যক্ষ সম্মিলনে জ্ঞানের মধ্যে রসের সঞ্চার হয়।” (আবরণ/ শিক্ষা) সোজা কথাটা হলো বইএর সঙ্গে নয়, জীবনের সঙ্গে চারপাশের সমাজ এবং প্রকৃতির সঙ্গে সহজ যোগের   সাধনাটাই হলো শিক্ষা। বাল্মিকি মুনি লব-কুশকে রামায়ণ পড়িয়েছিলেন বটে, কিন্তু সে মুখস্থ করতে দিয়ে নয়---গাইতে দিয়ে।   শুনেছি, আজকাল সর্বশিক্ষা অভিযানে তেমন ভাবনা কিছু কিছু ভাবা হচ্ছে। জানি না, আমাদের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা তেমন নেই। কিন্তু মহাবিদ্যালয়ে যে ছাত্রদের সঙ্গে আমাদের দেখা হয় তাতে এই বিশ্বাস বাড়ে যে পাশের হার বেড়েছে হয়তো, ‘মানুষে’র হার এখনো বাড়েনি বিশেষ। এখনো ছেলেমেয়েরা জানেনা, এই জীবন নিয়ে করবেটা কী! দুই একজন চটপটে জবাব দেয় , সে হবে ডাক্তার কিম্বা ইঞ্জিনিয়ার! ওরকম জবাব কানে পড়লেই বুঝি সে ঐ পুতুলের অনুরণন মাত্র। মানবিক  স্বাতন্ত্র্যে ভর করে তাতে  অনুযোজন নেই কোনো। আর  সে ব্যর্থতা ছোটদের নয়, আমরা যারা বড় বলে বড়াই করি –সেই তাদের । আমাদের হাঁটতে হবে আরো দূর বহু দূর। রবীন্দ্রনাথ আমাদের পথ দেখাতে পারেন। সেই বিশ্বাস উস্কে দিতেই এ ক’লাইন লেখার প্রয়াস নিলাম। এই মানুষটিকে আমরা স্মরণ করেছি প্রচুর, কিন্তু কাজকে করেছি ‘বিস্মরণ’।




।। ছোট কাগজের পূর্বোত্তর এবং দুটো মাটির ঘড়ার গল্প ।।

(লেখাটা ১ এবং ৭ জুলাই, ২০১২ দৈনিক সাময়িক প্রসঙ্গ, শিলচরে ধারাবাহিক বেরুলো)

“...ড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো/স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি/ হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ.../তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—/সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে /তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়;/হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল/ ফুলের মশাল!”~~ কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ
             চিন দেশের একটা কিস্যা বলে শুরু করা যাকসে অনেক কাল আগে সে দেশে এক জলের ভারী ছিল। তার দুই মাটির ঘড়া ছিল জল আনবার জন্যে । যেমন আর সমস্ত ভারী আমাদের দেশেও করে, একটা বাঁশের লাঠির দু’দিকে ঘড়া দুটো ঝুলিয়ে কাঁধে করে জল নিয়ে আসত দূর পাহাড়ের ঝরণা থেকে। দুটোই পুরোনো ঘড়া । তার মধ্যে একটা ঘড়া খানিক ফুটো হয়ে গেছিল। সে বেচারা সবটা জল নিয়ে বাড়ি পৌঁছুতে পারত না । দিনের পর দিন তাই হচ্ছে । ওদিকে অন্য ঘড়ার দেমাকও সহ্যের বাইরে চলে যাচ্ছিল। একই কাঁধে ভর করে , একই কাজের জন্যে দু’জনের রোজকার ভ্রমণ, কিন্তু ফুটো কলসির দিকে সে ফিরেও তাকায় না। নিজের সামর্থ্যে মশগুল সে । কিন্তু জলের ভারী ব্যাটার সেদিকে নজরই নেই। দিন যায়, মাস যায়, বছরও ঘুরে গেল। ফুটো কলসিকে কাঁধ থেকে নামিয়ে ছুটি দেয় না বলে বছর দুই পরে একদিন কলসি নিজেই বলল, “ মালিক, কিছু মনে করবেন না, আমার খুব লজ্জা করছে। এবারে আমাকে ছুটি দিন। আমাকে ক্ষমা করবেন।” ভারী জিজ্ঞেস করল , “কেন বলোতো?” “ না, ই আপনি রোজ কত দূর থেকে কত কষ্ট করে জল ভরে নিয়ে আসতে যান। কিন্তু আমি কিছুতেই আপনার কোনো কাজে লাগি না, আমার আদ্ধেক জল সেই পথেই পড়ে পড়ে নষ্ট হয়ে যায়। এবারে আমাকে সরিয়ে নতুন ঘড়া নেবার সময় হলো আপনার।” ভারী বলল, “তাই! কাল তবে শেষবার যাব।” লজ্জার থেকে মুক্তি , কিন্তু দীর্ঘদিনের প্রভুর থেকে বিদেয় নেবার সময় এলো ভেবে ঘড়ার যেন মন কেমন হয়ে গেল। ঠিক খুশিও না , আবার খুশি।
        পরদিন যথারীতি জল আনতে সেই দূর পাহাড়ের পথে চলল ভারী । যাবার পথে ফুটোকে বলল, “ আজ শেষবার ভালো করে পথটাকে দেখে নে, আরতো দেখতে পাবি না।” ঝরণাতে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, “কিছু দেখলি পথে?” ফুটো বলল, “ নতুন কী আর দেখব? আমিতো যাবার পথেই দেখি রোজ কত জল ঝরাই!” ভারী কিচ্ছুটি না বলে যথারীতি জল ভরল, এবং ফিরতি পথে রওয়ানা দিল। মাঝপথে বলল, “নিচে তাকিয়ে দেখ।” ফুটো বলল, “কী আর দেখব? সেইতো নিজের অপদার্থতা! জল পড়ে পড়ে যাচ্ছে” “ ফুল গাছ দেখছিস না?” ফুটো বলল, “হ্যা, সেগুলোর উপরেইতো জল পড়ছে।” এবারে ভারী বলল, “এটা আমি আগেই দেখেছি। তুই জল ফেলে ফেলে বেশ একটা সুন্দর রেখা এঁকে এঁকে যাস, দেখে আমার বেশ ভালোই লাগছিল। আমি দিলাম ফুলের বীজ রুইয়ে । গাছও হয়ে গেল , সে অনেকদিন। এখন দেখ ফুলে ফুলে ছয়লাপ। তুই আসলে কি কাজটা করছিলি দেখলি? সেই ফুল যখন আমার মালিকের বাড়ি নিয়ে গিয়ে দিই, ওরা কি খুশি হয় বল! শুধু শুধু লজ্জা পাচ্ছিলি।” শুনে ফুটোর মন ভালো হয়ে গেল। ভারী তবে জেনেশুনেই তাকে ধরে রেখেছে । এই কাজ করাবে বলে! কিন্তু যে কাজের জন্যে সে দায়িত্বপ্রাপ্ত তার কী হবে? বন্ধ ঘড়াটার দেমাক কি তাতে কমবে এত্তোটুকু? ভারী কি তবে তাকে ধরে রাখবার বাহানা খুঁজছে? এই ভেবে তার মন আবারও খারাপ হয়ে গেল। বলল,” সে হোক! কিন্তু আমার কাজ জল নিয়ে তোমার মালিকের বাড়ি পৌঁছে দেয়া, সেটি আমি পারিনা। আমাকে ছুটি দাও। আজ কিন্তু শেষ।” ভারী তখন বলল, “তোর মন কোনদিকে সেও আমি জানি। পথের অন্য পাশে ফুলের গাছ দেখছিস?” “সে কি করে দেখব, ওতো আর আমার মতো ফুটো নয়, এক বিন্দু জলও সে নষ্ট করে না।” “ সুতরাং ফুল জন্মায় না, তোর জলে ফুল জন্মায়! এই ভেবে আনন্দ কর। তোর এটাই কাজ!” যে ফুটো কলসি পরিত্যক্ত হয়ে এককোনে পড়ে থাকবার কথা ছিল, ভারীর এই কথাতে যেন তার নতুন জন্ম হলো। সত্যি, নতুন কাজ পাবার আনন্দে সে এতোই উতলা হলো যে সেদিনকার মতো সব জল পথের মাঝেই ফুরিয়ে গেল।
         লিটিল ম্যাগাজিন নিয়ে শুরুতেই এই গল্পটি বলবার কারণ ধীরে ধীরে স্পষ্ট হবে। আপাতত এইটুকুন বলা যাক যে, গেল প্রায় এক শতাব্দীর সময় ধরে , সেই ‘কল্লোল’ ‘কালিকলমে’র দিনগুলো থেকে সাহিত্যকে অই দুটো ঘড়ার চোখ থেকে দেখবার প্রয়াস ভুরি ভুরি দেখা যাবে ফুটো কলসির নিজে থেকে সরে যাওয়া, কিম্বা তাকে সরিয়ে দেবার প্রয়াস। কিন্তু ফুল ফোটাবার উর্বর মাটির দিকে চোখ গেছে যে জলের ভারীর তাঁর সন্ধান মেলে কদাচিৎ কোথাও কোথাও।

বহু বাজারে চলতি লেখক , বড়ো বাজারের ছাপ- মারা
        ‘লিটিল ম্যাগাজিনে’র যুগের একেবারে প্রথম ফুটো কলসিটি হচ্ছেন কিন্তু রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং। সুতরাং আমাদের মতো চুনোপুটিরতো সেখানে ‘ত্রাহি মাম’ দশা! মনে পড়ে রবি ঠাকুরকে অবসরে পাঠাবার অমিত রায়ের সেই বিখ্যাত প্রস্তাব, “রবি ঠাকুরের বিরুদ্ধে সব চেয়ে বড়ো নালিশ এই যে, বুড়ো ওয়ার্ডসওর্থের নকল করে ভদ্রলোক অতি অন্যায়রকম বেঁচে আছেসেই অমিত রায় কিন্তু বহু চেনা ইংরেজ লেখদেরও তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিত, কেননা এরা সবাই , “বহুবাজারে চলতি লেখক, বড়োবাজারের ছাপ-মারাপেছনের ইতিবৃত্তগুলো বহু চেনা বহু চর্চিত, আমরা তাই অমিত রায়ের বয়ানেই তুলে দিলাম
          লিটিল ম্যাগাজিন আর বাংলা সাহিত্যে ‘আধুনিকতা’ বলে একটি বস্তুর বয়স কিন্তু একই। বস্তুত বাংলা সাহিত্যে লিটিল ম্যাগাজিনের যাত্রা শুরু সেই আধুনিক দর্শনেরই মুখপত্র হয়ে । নইলে ভাবুনতো হঠাৎ করে সেই আদ্যিকালের সমাচার দর্পন, সংবাদ কৌমুদি, সংবাদ প্রভাকর, তত্ত্ববোধিনি, বিবিধার্থ সংগ্রহ, বঙ্গদর্শন, সাধনা, ভারতী, বালক, প্রবাসী, হিতবাদী, কিম্বা সবুজপত্রের মতো কাগজ যেগুলোর অনেকগুলোই সংবাদ পত্রের রূপ নিলেও, অধিকাংশই কিন্তু আকারে ওই লিটিল ম্যগাজিনের মতোই। এমন কি কখনো বা অনুষ্টুপ, অমৃতলোক, উজ্জ্বল পাণ্ডুলিপির থেকে বেশ খাটোই। আমরা এদের ‘সাময়িক পত্র’ বা পত্রিকা বলেই চিনতাম। গাঁটের পয়সা খরচ করেই বেরুতো এদের অনেক গুলো । এবং সম্পাদকের পকেটে টান পড়লে বা মতিগতি পাল্টালে বন্ধও হয়ে যেত । এরা সবাই কোন ঝড়ে যে কবে বাংলা ভাষা সাহিত্যের ইতিহাস থেকে বেমালুম উবে গেল আমরা কোনোদিন প্রশ্নটুকুও করবার সাহস জুটিয়ে উঠতে পারলাম না । অথচ ওই সব কাগজের পরতে পরতেই লেখা ছিল আমাদের ‘নবজাগরণে’র ইতিহাস! এমন কি আমাদের অসমেও তৎকালীন রাজধানী শিলঙের ‘শিলং সাহিত্য সভা’র ( যেটি পরে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের শিলং শাখাতে পরিণত হয়) মুখপত্র ছিল ‘সাহিত্যসেবক’১৮৯৩তে বেরিয়ে দু’বছরের বেশি সময় টিকে ছিল কাগজটি আর এর সম্পাদনা সমিতিতে ছিলেন প্রবাদ প্রতিম প্রতিভা পদ্মনাথ ভট্টাচার্য বিদ্যাবিনোদ। বা শিলচরে এই পদ্মনাথ ভট্টাচার্যের পৃষ্ঠপোষকতাতেই এক দল সম্পাদক মণ্ডলীর প্রয়াসে ১৯২৪ থেকে বেরিয়ে দীর্ঘ সতের বছর আমাদের বৌদ্ধিক নেতৃত্ব দেবার এক কঠিন কিন্তু, আজ অব্দি অপ্রতিদ্বন্দ্বী প্রয়াস করেছিল ‘শিক্ষাসেবক’ নামে একটি বাংলা কাগজ। কিন্তু যখন আধুনিকতা আমাদের ইতিহাসের পাঠ শেখালো আমরা জানলাম, আমাদের যাত্রা হলো শুরু ‘অতন্দ্র’ দিয়ে, ঐ মাত্র ১৯৬৩তে! তাও কাগজটি ছিল শুরুতে মাত্র কবিতার কাগজ! তার আগে অবশ্য করুণা সিন্ধু দে, ত্রিদিব মালাকারদের সম্পাদিত কাগজ ‘স্বপ্নিলে’র কথা আসে। কিন্তু সেই কাগজতো আর দীর্ঘজীবি হলো না তাই, ‘করুণার পত্রিকায় যার বীজ বপন করা হলো তাই দেখা দিল ‘অতন্দ্রে’ এবং অতন্দ্রের গৌরবটা কী? “এই তরুণরাই প্রথম নিজেদের সমসাময়িক—সেই 
অর্থে আধুনিক। এদের দ্বারাই তখন যে পত্রিকা প্রকাশিত হলো ‘অতন্দ্র’...আর আগের যাঁরা, তাঁরা কিন্তু তাদের সমসাময়িক না।”এই প্রশ্নটি কিন্তু উঠছে, “ ‘বর্তমান আধুনিক সাহিত্যের ট্রেণ্ড’-অর্থাৎ সেই সময়ের আধুনিক সাহিত্যের ট্রেণ্ডটা বোঝার উপায় কেমন ছিল?...বাংলা সাহিত্য কি পাওয়া যেত?” উত্তর আসছে, “ না, নিশ্চয় না ।”তার মানে জীবন বাস্তবতা স্থান-কালের অবিচ্ছিন্নতার প্রশ্নটিকে তুলতে বাধ্য করছিল। কিন্তু, কোনো দার্শনিক উত্তর সন্ধানের দিকে আদৌ নিয়ে যাছিল না। সেই জিজ্ঞাসা ছাড়াই দাঁড়াচ্ছিল ‘আধুনিকতা’সময় মানে যে ঠিক ঘড়ির সময় নয় , সে তাঁরাও বুঝতে পারছিলেন। কিন্তু সেই সময়কে যে স্থান থেকে বিচ্ছিন্ন করে ছোঁয়া যায় না , সেই বোধের তাঁরা বাইরে ছিলেন। আধুনিকতার আত্মপরিচয়, “এখন কলকাতা+ইউরোপ+ দুই আমেরিকা। কলকাতা এবং ইউরোপের মাঝখানে আর কিছু নেই, একটি বন্দরও নেই ।” নেইই যে, আর না থাকলে কেন নেই-- সেই জটিল জিজ্ঞাসারতো জায়গাই নয় অধিকাংশ লিটিল ম্যাগাজিন। অতন্দ্র আর এমন কী!

ওদের যদি বিলেত আছে , আমাদের আছে সোভি য়েতঃ 
                              সেই কল্লোল , স্বপ্নিলের সময় থেকে একেবারে উত্তরাধুনিকদের নিয়ে কেউ অধ্যয়ন করলেই দেখবেন, এই ঊর্ধ্বমুখী সরলরৈখিক সময়ের পেছনে ছুটতে গিয়ে আধুনিকতা তার পুরো বয়স জুড়ে কেবল যে তার পূর্বগামীদের অস্বীকার করেছে তাই নয়, সমকালীনদেরকেও অস্বীকার করে গেছে। এবং এটা তাদের নিয়তি লেখন যে প্রায় সব্বাই তাদের পরবর্তীদের দ্বারা প্রত্যাখ্যাত হয়েছেন। এটা হবার কারণ কেবল সময়কে ধরবার যাত্রা নয়। ‘প্রতিষ্ঠান’ বলে আরেকটি বিমূর্ত ধারণারও চিরদিন বিরোধিতা করে গেছে আধুনিকতা বাদ। বিমূর্ত বলছি এই কারণে যে এটি কারো কাছে নিতান্তই কিছু ‘সামন্তীয় ধ্যান ধারণা’, কারো কাছে ‘বাজার’ বা পুঁজিবাদ—-অমিট রে উচ্চারিত’ ‘বহুবাজারে চলতি লেখক, বড়োবাজারের ছাপ-মারা, কারো কাছে রাষ্ট্র, কারো কাছে কেবলই ‘দেশ- আনন্দবাজার’ সেখানেও নানামুনির নানা মত। যাদের প্রত্যাখান করছেন কেউ তাঁরা সেই প্রতিষ্ঠানে জুড়ে গেছেন বলেই আর গৃহীত হচ্ছেন না । কী যে সমকালীন, কী যে আধুনিকতা, কী যে নতুন—এই প্রশ্নের অধিকাংশই সঠিক উত্তর দিতে পারেননি, আর কেউ একটা সত্য উচ্চারণ করলেও অন্য পক্ষ , কিম্বা একটা সময় পরে নিজেরাও মেনে নিতে পারেন নি। এই ফাঁদে পা দিয়েছিলেন, এবং দিয়ে রেখেছেন ‘মার্ক্সবাদী’রাও-- যারা সেই ‘প্রগতি লেখক সঙ্ঘে’র ব্যর্থতার থেকে শিক্ষা নিয়ে আদৌ নিজেদের কোনো পথ করে নিতে পারেন নি, বা করেন নি। ‘আধুনিকতা’র স্রোতে গা ভাসিয়েছেন। লেনিনের পার্টিসাহিত্য নিয়ে বা মাও-এর ইয়েনান ভাষণ যারা পড়েছেন তারা এটাও বোঝেন নি যে সেই ভাষণ সাধারণভাবে সমস্ত সাহিত্যিকদের জন্যে ছিল না, ছিল কেবল পার্টিকর্মীলেখকদের জন্যে। রীতিমত রাজনৈতিক রণকৌশল অবলম্বন না করে 
কেবল ‘মার্ক্সবাদী’ সেজে সেই নির্দেশিকা অনুসরণ করা অসম্ভব ছিলআর কেবল লিটিল ম্যাগাজিন দিয়ে সেই বিপ্লবী যুদ্ধ জয়ের স্বপ্ন দেখার মানে সেই দুটো নির্দেশিকার মর্মবস্তুকে অন্তর্ঘাত করা । অথচ তাদের অধিকাংশের কাছেও প্রতিষ্ঠান বিরোধীতার মানে দাঁড়ালো ‘লিটিল ম্যাগাজিন'। সত্তরের দশকে এই চিন্তার থেকে শৈবাল মিত্ররা এক আন্দোলনের জন্ম দিয়েছিলেন ‘ তৃতীয় ধারার সাহিত্য’অন্যত্র বাকিরা সেই নাম না নিলেও পথ প্রায় একই ধরেছিলেন। যেমন শিলচরের 'আমাদের সমকাল' বা 'প্রতিস্রোত'জীবনের শেষ দিকে শৈবাল মিত্র তাঁর সেই বিশ্বাসেও স্থিত ছিলেন না । এমনকি তপোধীর ভট্টাচার্যের ‘আধুনিকতা পর্ব থেকে পর্বান্তর’ বইটি যারা পড়েছেন, যে বইটিতে মনে করা হয় বাংলার উত্তরাধুনিকতা এক তাত্বিক ভিত্তি পেল, সেটিও আসলে মার্ক্সবাদেরই বিনির্মাণ। কেবল বাংলা সাহিত্যের জন্যে নির্মিত এক দর্শন। বইটিতে মার্ক্সবাদ বিরোধী একটিও উচ্চারণ নেই , বরং আছে প্রচুর ঋণ স্বীকার । অথচ দর্শনটির নাম ‘উত্তরাধুনিকতাবাদ’ দেশজ উপকরণের দিকে চোখ ফেরাতে গিয়ে কেউ যাতে ধর্ম বা মৌলবাদের ফাঁদে পা না দেন সেই নিয়ে বইটিতে প্রচুর সতর্কবাণী উচ্চারিত হলেও দেখা যাচ্ছে অনির্বাণ ধরিত্রীপুত্র উত্তরাধুনিকতার অন্য বহু প্রত্যয়কে স্বীকার করেও গীতা অনুবাদ করছেন ভক্তি নিয়ে, বাংলাদেশের নাস্তিক কবি ফারহাদ মাজহারনদীয়ার নিমাই আর কুষ্টিয়ার , ছেঁউড়িয়ার লালন সাঁইকে নিয়ে এমন এক ‘ভাবান্দোলনে’ নেতৃত্ব দিচ্ছেন যে প্রতিপক্ষ বলছেন তিনি জামাতের চর।
         উত্তরাধুনিকদের আগে লিটিল ম্যাগিজিনকে কেন্দ্র করে হাংরি, শ্রুতি, শাস্ত্র বিরোধী, তৃতীয় ধারা ইত্যাদি যা কিছু ‘পাঠক উত্তেজিত করা’ র উচ্চকিত আন্দোলন হয়েছিল তার প্রায় সব ক’টা মূলত কবিতাকে কেন্দ্র করে, কিছু কিছু ছোট গল্পকে নিয়ে। উপন্যাস নিয়ে প্রায় নেই, প্রবন্ধ নিয়ে নয়। বরং কোনো কোনো কবিতা-গল্পের আন্দোলনের ভাবনারই বিস্তার ঘটছিল সেখানে। এবং কোনো ব্যতিক্রম ছাড়াই এদের প্রত্যেকে নিজেদের প্রেরণা নিচ্ছেন ইউরোপ এবং আমেরিকার থেকে । কমিউনিষ্টদের মধ্যেও ভাব ছিল এই যে ওদের ('বোর্জুয়া') যদি বিলেত আছে, আমাদের আছে সোভিয়েত—--দুটোই কিন্তু আসছে সেই ইংরেজি ভাষার প্লেনে চড়েউদ্ধৃত, আলোচিত এবং বিতর্কিত হচ্ছে ইংরেজিতে। লেনিন, গোর্কি মাও কোট করতে গিয়েও কেউ মনে করেন নি যে, তাঁদের ইংরেজিটা কিন্তু আসল নয় নকল, অনুবাদ মাত্র। বাংলাতে যাকে সহজেই অনুবাদ করে আপন করে নেয়া যায়। শ্রদ্ধেয় শিবদাস ঘোষের রচনাবলী পড়লেই যে কেউ দেখবেন শতকরা ছাপ্পান্নটা ইংরেজি আর একুশটা তার অনুদিত শব্দ নিলে সেগুলোতে ঠিক 'বিপ্লবী' জোরটা আসে ! বৈচিত্রময় ভারতের জাত-বর্ণ-অঞ্চলে বিভাজিত শ্রমিক-কৃষক ইউরো-সোভিয়েত মায়াজালের এক হ্যাঁচকা টানে হয়ে গেলেন 'প্রলেতারিয়েৎ' । এমন যে কবি হেমাঙ্গ বিশ্বাস , যিনি ‘কইলকাত্তার বুকে ডানা ভাইঙা’ পড়েছেন বলে আর্তনাদ করছেন গানে তাঁর নিজের সমস্ত সংগঠনের নাম ছিল ইংরেজিতে। এমন কি হাংরিদের ইস্তাহার বেরিয়েছিল পুরোপুরি ইংরেজিতে! ওদের নামটাও তাই, যেনবা বাঙালিদের 'ক্ষুধার্ত' হতে বড্ড লজ্জা করে! পৃথিবীতে আর যেনবা কোনো দেশ নেই! আর যেন বা ভাষা নেই! আছেও যদি তবে ফুটো কলসি ! কোথাওতো বিলেতি ভারী কলসি আমাদের অবচেতনকে শাসন করছিল।

       ‘লিটিল ম্যাগাজিন’ এই শব্দটিকেই নেয়া যাক না কেন । এটি মূলত মুখে মুখে আর প্রবন্ধে প্রচলিত এক ইংরেজি শব্দ । ‘সাময়িক পত্রিকা’ সে কিছুতেই নয় কিন্তু । পত্রিকার নাম পৃষ্ঠাতেও লেখা হয় না শব্দ দুটো । কিন্তু আমাদের চেতনাকে শাসন করে । 'অসমিয়াতেও শব্দটি তত জনপ্রিয় নয়। ওদের 'সাহিত্য আলোচনী' --এ বোধ করি 'আলোচনী' শব্দেরই যাদুবিদ্যা যে অসমিয়াতে 'প্রান্তিকে'র মতো এক অন্যন্য জনতার 'আলোচনী' আছে, যার তুলনা গোটা ভারতবর্ষে নেই । কোনো বিজ্ঞাপন ছাড়া একটি কাগজ কেমন ন্যুইয়র্ক প্রবাসী গণিতের অধ্যাপক থেকে শুরু করে টিংরাই হাবির মতো প্রত্যন্ত গ্রামের কৃষি নিয়ে ব্যস্ত পাঠকেরও নিজের কাগজ হয়ে যেতে পারে 'প্রান্তিক' তা করে দেখিয়েছে। দেবাশিস তরফদার যেহেতু এই অসমেরই মাটিতে শেকড়ের সন্ধান করেন তাই তিনিও স্বপ্ন দেখতে পারেন , “আমার মনে হয়, একটা পূর্ণাঙ্গ সাময়িকপত্র আবার বেরোলে ভালো হয়. এবং সেই পত্র তার আলো আহরণ করবে বিভিন্ন প্রাণদায়ী উত্স থেকে. অধুনা মৃত বঙ্গীয় সভ্যতা থেকে তো বটেই, বৃহত্তর ভারতের অতীত সভ্যতাগুলি, ধ্রুপদী যুগে বা মধ্যযুগেরও, আসাম-এর সভ্যতা, ইউরোপে-এর সভ্যতা, চীনা জাপানি ইরানি ...যেখানেই উজ্জীবিত হবার মত প্রেরণা আছে, তকে আত্মসাত করে, এবং আমাদের নিজস্ব মনোভঙ্গীকে প্রশ্রয় দিয়ে , একটা বড় আদর্শ সামনে রেখে কাজ করলে, তবেই মাঝারিয়ানা, বা নিম্নরুচির বিপদ থেকে আমরা রক্ষা পাব. অবশ্য এটা আমার দিবাস্বপ্ন. কিন্তু যদি এমন কখনো হয়, তাহলে সভ্যতার ছোট একটি কেরসিন শিখা আমাদের দেশ থেকেও জ্বলে উঠতে পারে” (ব্যক্তিগত মেইলে আলাপ; বড় হরফ আমাদের।) এই 'আবার বেরোলে ভালো হয়' তিনি লিখেছেন 'তত্ববোধিনি' থেকে 'শিক্ষাসেবকে'র ঐতিহ্যকে মনে রেখে। তাঁকে লিখতে হচ্ছে 'দিবাস্বপ্ন' কেননা আমাদের মেধা বাঁধা রয়েছে 'লিটিল মেগাজিনে' । এই মুহূর্তে ভারতে এই নামে সম্ভবত একটিই ‘কাগজ’ আছে , এবংভাষা নিয়ে কোনো দ্বিচারিতাছাড়াই সেটি বেরোয় ইংরেজিতে কিন্তু মজা হলো সেটি কাগজে সীমাবদ্ধ নেই। তার ওয়েব সংস্করণও রয়েছে । সম্পাদনা করেন অন্তরা দেব সেন এবং প্রান্তিক কাঞ্জিলাল। এর উপদেষ্টা মন্ডলীতে রয়েছেন অন্তরার পিতা অমর্ত্য সেন, আশিষ নন্দি , গুলজার ইত্যাদি অনেকে। এবং এর লেখক তালিকাতে কে নেই! সন্তোষ রাণা থেকে শুরু করে জর্জ ফার্ণাণ্ডেজ, জয় গোস্বামী থেকে ভারভারা রাও। ব্যাপ্তি এবং বিস্তারে সে ‘লিটিল’ নয় মোটেও। মর্মবস্তুতেও সে আসলে 'সাধনা' 'বঙ্গদর্শনে'র এক দক্ষিণ এশিয় বিস্তার। কেবল সম্পাদকদের আয়ে বেরোয়, বিজ্ঞাপনী ব্যয়ে নয়। এই ‘লিটিল’ শব্দটি তবে এলো কোত্থেকে ? এই প্রশ্নের বহু অনুসন্ধান করেও আমরা উত্তর পাই নি কোনো । বিলেতে শব্দটি ছিল literarymagazine বা periodical এই পিরিওডিকেল’ থেকে আমাদের বাংলার ‘সাময়িক পত্র’এই ধারণার সময় বোধ নিয়ে কোনো জটিলতা নেই। একটা নির্দিষ্ট সময়ের পরে পরে বেরোয় বলে এই নাম। ১৮০২থেকে প্রকাশিত ‘এডিনবার্গ রিভিউ’ সম্ভবত ছিল সবচে’ প্রাচীন সাময়িক কাগজ। আমেরিকাতে তেমনি সবচে’ প্রাচীন কাগজ ‘নর্থ আমেরিকান রিভিউ’ , বেরুতো ১৮১৫ থেকে । কিন্তু এগুলো সবই ঐ ‘লিটারারি মেগাজিন’লিটিলশব্দটি সম্ভবত একটি মার্কিন প্রবণতার দান। শব্দকে ছোট করে নেয়া । ‘লিটারারি’ কে ‘লিট’ না করে এক অর্থপূর্ণ সংকোচন আমরা যে মার্কিন দেশ থেকে ধারণটি নিয়েছি সেটি ভাববার পক্ষে যথেষ্ট কারণ আছে । টি এস এলিয়টের, কবিতা ছেপে এলিয়টের সঙ্গে করেই বিখ্যাত হয়েছিল মার্কিন কাগজ ‘পোয়েট্রি’ তার থেকে বুদ্ধদেব বসুর সম্পাদিত পত্রিকার নাম কবিতা’ পরিচয়’ পত্রিকার অফিসে অন্নদা শঙ্কর রায়ের হাতে ‘পোয়েট্রি’র একখানা ছাপা সংস্করণ দেখে তিনি সেই নামে , সেই ভাবে কাগজ করবার প্রেরণা পান। এই ‘আধুনিকতাবাদ’ বলে যে তত্বটির সঙ্গে আমাদের আজকে পরিচয় ‘পোয়েট্রি’র তাতে অসামান্য যোগদান ছিল। এবারে, বুদ্ধদেব দেখেছিলেন এক ক্ষীণকায় সংস্করণ। এবং কাগজটিকে অনেকে বলেও থাকেন ‘লিটিল’কিন্তু ‘পোয়েট্রি'র বর্তমান ইতিবৃত্ত বহু লিটিল ম্যাগাজিন সম্পাদকের হৃৎকম্পন বাড়াবার পক্ষে যথেষ্ট। হ্যারিয়েট মনরো নামে এক চিত্রকলার সমালোচক শিকাগো থেকে ১৯১২তে কাগজটি বের করেছিলেন। এবছর তার শতবর্ষ! প্রথমে ‘পোয়েট্রি ফাউন্ডেশন’ বলে একটি সংগঠনও ছিল এর প্রকাশক । ১৮৪২থেকে প্রকাশনার দায়িত্ব নেয় ‘মডার্ণ পোয়েট্রি এসোসিয়েশন’২০০৩এ রুথ লিলি নামে এক ধনাঢ্য মার্কিন মহিলা কাগজটিকে ১০ কোটি ডলার অনুদান দেন, যে তহবিলের এখন পরিমাণ দাঁড়িয়েছে তার দ্বিগুণ। এখন আবার প্রকাশনার দায়িত্বে সেই 'পোয়েট্রি ফাউন্ডেশন'। গোটা বিশ্ব থেকে লক্ষাধিক কবিতার থেকে বাছাই করে বছরে ৩০০ কবিতাকে ঠাই দেয় পত্রিকাটি । এবং ৩০,০০০এর বেশি গ্রাহক এর ছড়িয়ে আছে গোটা বিশ্বে। কিন্তু এহ বাহ্যএটিও আর এখন কেবল কাগজে বেরোয় না, এররয়েছে ওয়েব সংস্করণ১০ সেখানে কবিতা আর পাঠ্য নয় কেবল, আপনি শুনতেও পাবেন। আবারও সেই ওঝাপালার যুগে পুনরাগমন, এবং আগের চে’য়ে বহু বেশি ব্যাপ্তি এবং বিস্তার নিয়ে। আমাদের ‘কবিতা’র পরিণাম কী ? ১৯৩৫এ প্রকাশিত পত্রিকা ধুঁকতে ধুঁকতে ১৯৬০এ মাত্র পঁচিশ বছরে বন্ধ! তার পরেও মার্ক্সবাদী ও উত্তরাধুনিকদের কাছে তাঁর প্রতিষ্ঠানের শরিক হবার বদনাম ঘুচে না কিছুতেই, জানি না কেন !সে অনেক তর্ক!

সাহিত্যে’র প্রতিষ্ঠান বিরোধী বিদ্রোহ এবং দু'ই নৌকার গল্প ঃ
             ইতিহাসের এই প্রেক্ষপটটিকে সামনে রেখে এবারে আমরা তাকাবো ‘সাহিত্য’ কাগজটির দিকে। আমাদের উদ্দেশ্য কাগজটির সাম্প্রতিক ( সাহিত্য ১১৪) সম্পাদকীয়কে খানিক ভালো করে পড়ে নেয়া । দেবাশিস তরফদারের মতো আমাদেরও প্রশ্ন “ উত্তর-পূর্বের বাঙালি কি একই ভুল করবে? আমাদের রস আহরণের একটি ক্ষেত্র—এই সাত বহিনীর মহাদেশের দিকে আরো মনোযোগ, আরো দরদ দিয়ে কি আমরা তাকাবো না?” চালশেতে পৌঁছোনো ‘সাহিত্য’ আমাদের গৌরব সে কথা শুরুতেই স্বীকার করে নেয়া ভালো। যে নিষ্ঠার সঙ্গে বহু ঝড় ঝঞ্ঝাট সামলে এক অধ্যাপক কবি নিতান্তই পারিবারিক শ্রম এবং ব্যয়ে একটি ছাপাখানা খুলে কাগজটি চালিয়ে যাচ্ছেন, আমাদের লেখকদের বই ছেপে যাচ্ছেন, সাহিত্যের ইতিহাস লিখে যাচ্ছেন এবং পাঠকের কাছে সেগুলো আবার পৌঁছেও দিচ্ছেন কোনো বিজ্ঞাপনী আশ্রয় ছাড়াই সেই নিষ্ঠা আর ত্যাগকে সম্মান জানাবার যোগ্যতা অর্জন করতে আমাদের অনেককেই আরো বহুদিন শ্রম করতে হবে। আরো বহুদিন, বলছি এর জন্যেই যে অধিকাংশ বাঙালি পাঠকের কাছেই পূর্বোত্তরের যেকোনো প্রকাশনা মাত্রেই হচ্ছে ফুটো কলসি। ভারী কলসিটি হচ্ছে ‘দেশ’ কিম্বা কলকাতার ‘অনুষ্টুপ’, 'অমৃতলোক'অনেকে এখানে নিজেরা কাগজ করেন, কিন্তু সাহিত্যের নাম জানেন না! তাঁর আরেকটি গৌরব যে তিনি ‘তৃতীয় ভূবনে’র একটি ধারণার সঙ্গেও বহু দিন ধরে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। ভূবনটি ‘সঙ্গ বিহীন বাঙালি’র যদিও তারও যে এক ‘তৃতীয়’ থাকতে পারে এই ভাবনাটাইতো ভুলিয়ে দেয়া হয়েছিল ‘স্বপ্নিল'-'অতন্দ্র’ যুগে। কিন্তু যে মাটি চাষ করেছিলেন পদ্মনাথ ভট্টাচার্য বিদ্যাবিনোদ, রাজমোহন নাথ, যতীন্দ্র মোহন ভট্টাচার্য, সুরেন চক্রবর্তী, হেমাঙ্গ বিশ্বাস, অমলেন্দু গুহ , ঊর্ধ্বেন্দু দাশ সে মাটিতে ফসল ফলালোর দায়িত্ব নেয় নি ‘তৃতীয় ভূবন’ তাই আমাদের অমিতাভ দেবচৌধুরীর ‘কবির বাড়ি’তে, দেবাশিস তরফদারের ‘কবির স্বদেশে’ উত্তরণ। যে স্বদেশের উচ্ছ্বলা ‘জাটিঙ্গা’র 'স্রোতে'অদূরে ‘নাইন্থ কলামে’ দাঁড়ানো বাঙালির রয়েছে ‘মহাবাহু’র বিস্তারএই আমাদের 'মুখাবয়ব'
          সম্পাদকীয়টি ‘সাহিত্য’ সম্পাদকের একেবারে নতুন চিন্তার থেকে লেখা তা নয়। বহুদিন ধরে তিনি এসব লিখে আসছেন। আমরা পড়ে আসছি । ‘সাহিত্যের মুক্তি ' ১২ এবং ‘সুরক্ষিত বন্দিশালা’ ১৩ রচনা দুটিকে পূর্বোত্তরে সাহিত্য চিন্তার দুটো মূল্যবান দলিলই বলতে হবে। পরিসরের কথা ভেবে আমরা সেগুলোকে এখানে না ছুঁয়ে এগুব। এই সম্পাদকীয়তে কবি বিজিৎ ভট্টাচার্য সেই ‘তৃতীয় ভূবনে’র লিটিল ম্যাগাজিন এবং সাহিত্যের জন্যে এক 'অশনিসংকেতে'বার্তা দিয়েছেন। ইতিহাসের এক সুসংকেত দিয়ে তিনি লিখেছেন, “আমাদের গৌরব ছিল লিটল ম্যাগাজিন। পূবের সাহিত্যিকেরা ছিলেন প্রতিষ্ঠানের শাসন মুক্ত ।” “কিন্তু গত কয়েক বছরে ছবি দ্রুত পালটে যাচ্ছে—পশ্চিমের হাওয়া এসে লাগছে পূবের পালে । অথচ এতদিন পূবের আলো আলোকিত রাখছিল পশ্চিমকে ।” ব্যাপারখানা কী? “ গত কয়েক বছরে আমাদের এ অঞ্চলে যত দৈনিক পত্রিকার জন্ম হয়েছে তাকে প্রায় বিস্ফোরণ বললে অত্যুক্তি হবে।” এর মানে দাঁড়ালো যে রাষ্ট্র বা শ্রেণিশাসনে আমরা বাস করি সে কোনো প্রতিষ্ঠান নয়, অন্যথা আমরা ‘প্রতিষ্ঠানের শাসনমুক্ত' ছিলাম কী করে? অথচ একই সম্পাদকীয়তে তিনি তাঁর মার্ক্সবাদী দীক্ষা মনে করিয়ে দিতে এই বাক্যও লিখেওছেন, “...তাকে পাল্টাতে গেলে সমস্ত ব্যবস্থাকেই পাল্টাতে হবে।” সেই ব্যবস্থাটি যে কী তা তিনি কোনোদিনই ব্যাখ্যা করেন নি, পাছে রাজনীতি ছোঁয়া লাগে! ! সে যাই হোক, লিটিল মেগাজিনে’র এ যাবৎ যে ইতিবৃত্ত আমরা দেখালাম তাতে এই বিশ্বাস করবার কোনো মানেই নেই যে “এতদিন পূবের আলো আলোকিত রাখছিল পশ্চিমকে।” বরং অতন্দ্র যুগেও পশ্চিমের ' কবিতা'- 'কৃত্তিবাসের আলোয় চোখ এতোটাই ঝলসে গেছিল যে যারা সে চশমা পরেন নি, তাদের সম্পর্কে আমাদের সদম্ভ উক্তি ছিল, “আগের যাঁরা, তাঁরা কিন্তু তাদের সমসাময়িক না অবশ্যি যদি এভাবে কল্পনা করে নিই যে পূবে এতোদিন ছিল কেবল ‘সাহিত্য’ আর পশ্চিমে ‘আনন্দবাজারে’র মোহজাল তবেই শুধু কথাটা সত্য হতে পারে । কিন্তু সে ‘তৃতীয় ভূবনে’র কল্পনা মাত্র , বাস্তব নয়। দৈনিক কাগজ আমাদের ছিল, এতো বিস্তার ছিল না মাত্র । আমাদের কাগজগুলো ছিল আনন্দ বাজার, যুগান্তর, আজকালের সাম্রায্য নিচে ‘বন্দোবস্তি’ রায় বাহাদূরদের মতো, এখন স্বনির্ভর হয়ে উঠছি। একে অস্বীকার করা মানে পশ্চিমী ‘প্রতিষ্ঠানে’র কাছে অবচেতনে আত্মসমর্পন করা । এটি আমাদের বৌদ্ধিক বিকাশের জন্যে এক সুসংবাদ! কেননা, আমরা আমাদের বিশাল জনতার বৌদ্ধিক তৃষ্ণার দায়িত্ব কেবল কিছু লিটিল ম্যাগাজিন আর পশ্চিমী কাগজের কাঁধে তুলে দিয়ে নিশ্চিত থাকতে পারছিলাম না। আমাদের জনতা ছিল সে কাগজগুলোর কাছে প্রত্যাখাত অপর মাত্র । নিজের আয়নাতে দাঁড়ালেও দেখা যেত অপরের মুখ! তিনি অবশ্যি জনতার বৌদ্ধিক পিপাসা নিয়ে খুব একটা ভাবেন নি, অতো দূর ভাবনা পৌঁছোয়ও নি। তাঁর ভাবনা কেবল 'সৎ সাহিত্য' নিয়ে । প্রচুর সৎ সাহিত্যিক সেই বাণিজ্যিক কাগজগুলোর মোহে বাঁধা পড়েছেন। যারা ছিলেন লিটিল ম্যাগাজিনে তাদের অনেককে দৈনিকগুলো টেনে নিয়ে বসিয়ে দিচ্ছে সম্পাদনার কাজে, অথবা সাহিত্যের পাতার দায়িত্ব দিয়ে। এরাও এই যে দু’ নৌকোতে পা দিয়ে চলছেন, “এতে শ্রেয় লাভ কতটা হচ্ছে জানি না, তবে বিপদ কি কোথাও হচ্ছে না?” নিশ্চয় হচ্ছে। কলসি ফুটো হলে জল পুরোটা বাড়ি অব্দি গিয়ে পৌঁছুবে না সেতো জানাই কথা, কিন্তু ফুলের চাষ কোথাও হচ্ছে কিনা সেদিকে তাকাবো না?
               তাঁর এই সিদ্ধান্তটি বেশ মজাদার, “ ...অনেকে পূর্বার্জিত লিটিল ম্যাগাজিনের খ্যাতিটুকু সম্বল করে দৈনিকের সম্পাদকও হয়ে বসেছেন এই যে দু-নৌকায় পা দিয়ে চলা এ অঞ্চলে আজ তা দিনের আলোর মতো স্বচ্ছ। আর এরই ফলে সমগ্র উত্তর পূর্বাঞ্চলে আজ লিটিল ম্যাগাজিনের, লিটিল ম্যাগাজিন আন্দোলনের নাভিশ্বাস উঠেছে। আর তাই নতুন ভাবনা চিন্তা নিয়ে উঠে আসা কোনো লেখক গোষ্ঠী আমরা পাচ্ছি না লিটিল ম্যাগাজিন নামধারী পত্রিকাগুলোকে আশ্রয় করে । হ্যাঁ, এখানে শিলচরের মানবী গোষ্ঠীকে আমার ব্যতিক্রমী মনে হচ্ছে--- এবং মনে হচ্ছে এই অবক্ষয়ের যুগে যদি এদের হাত ধরে কিছু একটা পরিবর্তন আবার আসে। এখন সম্ভবত ঐ একটি কাগজেই আমরা তরুণ প্রজন্মের একটা গোষ্ঠীবদ্ধ প্রয়াস দেখতে পাচ্ছি যাঁরা পা রেখেছেন কেবল লিটিল ম্যাগাজিনের তরণীতেই। এঁরা বিপথগামী না হন।” সাহিত্য সম্পাদক এখানে ওখানে নিজেকে মার্ক্সবাদী বলেও দাবি করেন, দাবি করেন বস্তুবাদী বলে। এই বয়ান শুধু ‘মানবী’র উল্লেখেই সমস্ত বাস্তব বোধ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এই বয়ানের অর্থ দাঁড়ালো, উত্তরপূর্বাঞ্চললিটিল ম্যাগাজিন সম্মেলনে যে শতাধিক কাগজ এসে জোটেন তাঁরা সবাই আত্মবিক্রিত প্রতিষ্ঠানের দাস! অমিট রে হয়তো বলত , রবীন্দ্রনাথের উত্তরসূরী! কিন্তু আমাদের সমস্যাতো 'মানবী'কে নিয়েই! কাগজটি ভালো, গেল এক দশকেরও বেশি সময় জুড়ে এর সম্পাদিকারা সত্যি এক নতুন সাহিত্যের পরিবেশ গড়ে তুলতে পেরেছেন শিলচর তথা বরাক উপত্যকাতে। বিশেষ করে লেখিকাদের নিয়ে এদের এক ব্যাপক সাংগঠনিক উদ্যোগ রয়েছে । কিন্তু এর সম্পাদক মণ্ডলীর সদস্য চন্দ্রিমা দত্ত, শর্মিলা দত্তরাতো সংবাদ পত্রের নিয়মিত লেখিকা। চন্দ্রিমা দত্ত দীর্ঘ দিন ধরে দৈনিক যুগশঙ্খের মেয়েদের পাতা ‘অনন্যা’ সম্পাদনা করেছেন। এবং অসমে তাঁরই প্রথম নিজের কবিতার ওয়েবসাইট ছিল। ১৪ যে ‘অতন্দ্রে’র বিস্তার বলে ‘সাহিত্য’ কখনো গৌরব করে সেই অতন্দ্রের যাত্রাইতো শুরু হয়েছিল সেই ১৯৬৩তে দৈনিকপ্রান্তজ্যোতির ক্রোড়পত্র হিসেবে । এক্কেবারে ‘টাইমস লিটারারি সাপ্লিমেন্টে’র স্টাইলে! দৈনিক কাগজ আর লিটিল ম্যাগাজিনের মিতালির এই পুরোনো ইতিহাস তিনি ভুলেন নি, আমাদের ভুলাতে চান ! সে নিয়ে আত্মসমালোচনা করতেও তো সাহিত্য সম্পাদককে দেখা যায় নি। এর পরেও এমন উক্তির অর্থ দাঁড়ায় শুধু এই যে ‘সাহিত্য’ লিটিল ম্যাগাজিনের সাম্রায্যে আর কারো অস্তিত্ব মেনে নিতে প্রস্তুত নয়। সে নিজেই হয়ে উঠতে চায় একক ‘প্রতিষ্ঠান’লিটিল ম্যাগাজিন নিয়ে তাঁর বহু উচ্চারিত উক্তিটি এই সম্পাদকীয়তেও এসছে, “ লিটিল ম্যাগাজিনগুলোর জন্ম কোনো একটা আদর্শগত প্রতিজ্ঞা নিয়ে, প্রতিবাদ, ভাঙচুর, বিদ্রোহ, আন্দোলন, মোট কথা সাহিত্যে একটা নতুন ভাবনা চিন্তা নিয়ে আসা একটা সর্বাঙ্গীন পরীক্ষা নিরীক্ষার জন্যে। এঁদের পাঠক নির্বাচিত এবং বয়স্ক ।” যে কথাটা যোগ দিলে এই উক্তি সম্পূর্ণতা পেত তা এই যে ‘এর সম্পাদক হবেন বনেদী ধনাঢ্য ।' ‘পোয়েট্রি’ কাগজের রুথ লিলির মতো পৃষ্ঠপোষক না পেলেও লিটিল ম্যাগাজিনের সম্পাদককে হতে হবে মোটা মাইনের অধ্যাপক, যিনি মাস মাইনের থেকে বাঁচিয়ে নিজের ছাপাখানা করতে পারেন, শুরুর কাগজ কিনতে পারেন, কর্মচারীর মাইনে দিতে পারেন। ‘মানবী’ সম্পাদিকারাও এটা স্বীকার করতে গৌরবই বোধ করবেন যে তাঁরা আসলে শিলচরের এক বনেদী শিল্পপতি পরিবারের কন্যা । ঠিক এর জন্যেই তিনি নিয়ম করে ছোট কাগজের বিজ্ঞাপন নেবার বিরুদ্ধেও লিখে থাকেন ।১৫ যে বেকার ছেলে বা মেয়েটি জানে না সাহিত্য আসলে কী, আদর্শ মানে কী , জানবার জন্যে দুটো বই, পত্রিকা কিনবার পয়সা যার হাতে নেই আর থাকলেও সে আমাদের পূর্বোত্তরের ছোট শহর বা গাঁয়ের মানুষ বলে পেয়ে উঠে না, সে নিজের মানবিক সৃজনী গুণের তাড়নাতে যদি দুটো লাইন লিখতে শুরু করেছে, নিজের একটা কাগজ করতে শুরু করেছে এবং পানের দোকানে গিয়ে বিজ্ঞাপন চেয়ে বসেছে , তার সামনেও শুরু হবে ‘সাহিত্যে’র প্রতিষ্ঠান বিরোধী বিদ্রোহ! “প্রতিবাদ, ভাঙচুর, বিদ্রোহ, আন্দোলন!” এ যেন বা কলেজ ষ্ট্রিটের কফি হাউসের প্রতিবাদ! এই আন্দোলনের কিন্তু কোনো সৃজনী প্রতিভা নেই। প্রতিষ্ঠানের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দেখে সে নিজেকে, প্রতিস্থাপক হিসেবে নয়। অথচ পূর্বোত্তরের মানুষ এবং প্রকৃতির নিবিড় পাঠ রয়েছে যার, সেই কবি দেবাশিস তরফদারে কী সস্নেহ উচ্চারণ, "আমার বিশ্বাস , আমরা কলকাতা বা তার উপগ্রহের বাঙালিদের চেয়ে স্বভাবত আলাদা। আমরা যেন আরেকটু খোলামেলা,আরেকটু সুখী, আরেকটু ইন্দ্রীয় প্রবণ। এর প্রকাশ কি কোথাও ঘটছে না? অনেক সময় নানা ছোট কাগজের অনামী লেখক লেখিকার ‘কাঁচা’ লেখাতে এই স্বভাবের প্রকাশ দেখেছি। দেখে, আক্ষেপ হয়েছ মনে, এই গুণগুলি হারিয়ে ফেলার জন্যে। কিন্তু সব কি হারায়? এই আলো –হাওয়া-রৌদ্রে কোথাও কি সূক্ষ্মভাবে মিশে নেই? কে জানে!” ১৬ এই ‘নানা ছোট কাগজের অনামী লেখক লেখিকা’রা সাহিত্য সম্পাদকের প্রশ্রয় পায় নি কোনোদিন। তাঁর শহরের কাছের 'অনুষঙ্গ', ‘চম্পাকলি’, ‘প্রবাহ’ কিম্বা ‘শিলচরে’র জাটিঙ্গার মতো কাগজ যারা, গ্রাম বরাকের সত্যকে সন্ধান করে ফেরেন পরম নিষ্ঠার সঙ্গে তাদেরতো সাহিত্য পাতেই তোলেনি। বিশেষ করে 'জাটিঙ্গা'র মতো লোক সংস্কৃতি আর ইতিহাস বিষয়ের উঁচু মানের কাগজ গোটা অসমেই আর দুটো নেই। এমনকি শিলচরের ‘আমাদের সমকাল’, ‘প্রতিস্রোতে’র মতো ‘আধুনিক’ কাগজও তাঁর কাছে থেকেছে ব্রাত্য। সম্ভবত এরা এ দোকানে ও দোকানে ঘুরে বিজ্ঞাপন নেয় বলে । আর ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার কাগজগুলোর কথাতো বলেই লাভ নেই, তারা অনেকে 'অসম' লেখেন--- এই এক মামলাতেই 'তৃতীয় ভূবনে'র ডি-ভোটার । ডিটেনশন ক্যাম্পের শিবির নিবাসি!
              একটি সূত্র অবশ্য তিনি এই সম্পাদকীয়তেই উল্লেখ করেছেন। ত্রিপুরার ধর্মনগরে এক লিটিল ম্যাগাজিন সম্মেলনে গিয়ে শুনেছেন, সম্পাদকেরা জানাচ্ছেন, “যথেষ্ট পরিমাণ ভালো লেখা সংগ্রহ করাই একটা বড় সমস্যা। লিটিল ম্যাগাজিনের মুখে প্রতিষ্ঠানের কথা শুনি কেন? আমরাতো জানতাম একটা লিটিল ম্যাগাজিন তখনই প্রকাশিত হয় যখন একদল লেখক মনে করেন তাঁদের অনেক কিছু নতুন বলার আছে—অনেক নতুন সৃষ্টি আছে, তাঁদের হাতে অনেক লেখা, আর তার জন্যে তাঁরা প্রকাশ করেন লিটিল ম্যগাজিন। লিটিল ম্যাগাজিন সম্পাদকতো ম্যানেজার নন, সংগ্রাহক নন।” ‘সাহিত্যে’র এই সমস্যা নেই। ‘পোয়েট্রি’ কাগজের মতো, কিম্বা কলকাতার ‘কৃত্তিবাস’,‘অনুষ্টুপ’, ‘অমৃতলোকে’র মতো কারণ লেখকেরা জানেন যে কাগজটির অর্থ চিন্তা নেই , তাই নিয়মিত বেরোতে পারে , তাই লেখা পাঠাতে থাকেন। এবারে, এই নিজ বাস্তবতা দিয়ে ‘তৃতীয় ভূবনে’র সাহিত্য তত্ব যদি নির্মিত হয় তবে সেই প্রয়াস বিষয়মুখ ( objective) হয়ে উঠে না। বিষয়ীমুখ ( subjective) অথবা ভাববাদী থেকে যায়। অর্থচিন্তার থেকে অনিয়মিততা, অনিয়মিততার থেকে ভালো লেখার সংকট—এতো স্পষ্টই অর্থনীতির বিচারে অপ্রাতিষ্ঠানিকতার সমস্যা! নিজেদের কাছে ভালো লেখা নেই, সেতো বিনয়। না কি ‘কাঁচা’ লেখা হলেও ছাপানো যাবে ? তবে আর কেন তাঁকে ভাবাচ্ছে, “ বাণিজ্য পত্রিকাগুলো আমাদের তরুণ সমাজকে যেখানে টেনে নামাচ্ছে সেই দৃশ্য দেখে। এদের প্রতি সপ্তাহে লেখা চাই, অনেক কাঁচা মাল চাই, সুতরাং দরাজ হাতে যা পাচ্ছে তাই ছাপছে—আর দলে দলে নিষ্ঠাহীন, সাধনাহীন, শিক্ষাহীন এক শ্রেণির লেখক সমাজ তৈরি হচ্ছে যারা ভবিষ্যতের সাহিত্য জগৎকে ধ্বংস করে দেবে!”
           এই উক্তির অন্য বয়ান হলো, অশিক্ষিত লেখকদের দায়িত্ব নেবেনা, ‘সাহিত্য’বাণিজ্য পত্রিকা সে দায় নিলেও হবে প্রতিবাদে সোচ্চার। এই তৃতীয় ভূবনে’র এই একলব্যেরা যাবে তো যাবে কোথায়! তবে কি এই বিশ্বাসও করে নিতে হবে যে এখনো ‘একলব্যের’ বুড়ো আঙুল কেটে নেবার দায় লিটিল ম্যাগাজিনের! এখনো ‘লিটিল ম্যাগাজিনে’র তাত্বিক গুরু ‘দ্রোণাচার্য’! বস্তুত তাই। ‘লিটিল ম্যাগাজিন’ যখন একটা আদর্শ নিয়ে বড়ো হয়ে উঠে , সে আদর্শ যতই মহান শোনাক, যতই সে মানুষের জয়গান করুক বস্তুত সে জনতার মুখপত্র কখনোই নয়। মার্ক্সবাদী হলেও নয়, উত্তরাধুনিক হলেও নয়। সামান্য কিছু মধ্যবিত্ত যাদের কিনে নেয়া প্রচুর অবসর আছে অধ্যয়নের এবং জিজ্ঞাসার উত্তর খোঁজে বেড়ানোর--- লিটিল ম্যাগাজিন শেষ পর্যন্ত সেই সব অভিজাতদের কাগজ হয়ে উঠে । এঁদের পাঠক এবং লেখক “ নির্বাচিত এবং বয়স্ক ।” এটা নিন্দা বা প্রশংসার্থে নয়, সীমাবদ্ধতাকে চিনিয়ে দেবার জন্যেই আমাদের সত্যোচ্চারণ। এরা যেকোনো প্রতিষ্ঠানের নিন্দা করতে পারেন। কিন্তু প্রতিস্থাপিত করতে পারেন না । সে কাজ আম জনতার! তাই নিজেদের বনেদীয়ানাকে নিয়ে যদি জনতার বিরুদ্ধেই যুদ্ধে নামেন তবে প্রতিরোধ অবশ্যম্ভাবী!

         স্বয়ং মার্ক্স একাধিক দৈনিক বাণিজ্যিক কাগজে নিয়মিত লিখতেন, পড়তেন। কেবল নিজের চিন্তা ছড়াবেন বলে নয়, কখনো বা স্রেফ দু’টো টাকা রোজগার করে সংসার চালাবেন বলে। লেনিন, ট্রটস্কিরা দৈনিক কাগজ সম্পাদনা করতেন। রুশ বিপ্লবের সবচে' বড় প্রতিবাদী কাগজটির নাম ছিল 'প্রাভদা' আর এটি ছিল লেনিনের প্রতিষ্ঠিত দৈনিক। পোষ্ট মডার্ণরা কী বলবেন জানি না, কিন্তু অন্য কেউ স্রেফ তার জন্যে তাদের প্রতিষ্ঠানের লোক বলবার সাহস গোটাতে পেরেছেন বলেতো জানি না। কল্পনা করা যাক যে, লেনিনের ‘পার্টি সংগঠন এবং পার্টি সাহিত্য’ বক্তৃতাতে লিটিল ম্যাগাজিন নিয়ে প্রচুর ভালো ভালো প্রশংসনীয় উক্তি আছে। তাঁর ঘোর শত্রুতেও হেসে পেটে খিল ধরিয়ে দেবে! ছোট কাগজের তিনি বিরোধিতা করেন নি। বস্তুত তিনি এই নিয়ে বেশি কথাও ব্যয় করেন নি, কিন্তু এক জায়গাতে বলেছেন, আমাদের দৈনিক কাগজ, ছোট কাগজ, প্রকাশনা সংস্থা সবই হতে হবে পার্টি সাহিত্যের জন্যে! ১৭

যে মাটিতে আগাছা জন্মায় , যে মাটিতে হয় অরণ্যের বিস্তার--- সে মাটি উর্বর বড়ো ঃ
                আমাদের বলতে ইচ্ছে করে, পূর্বোত্তরের বাংলা ভাষা এবং সাহিত্যের জন্যে, এক প্রবল বৌদ্ধিক উত্থানের জন্যে আমাদের ছোট কাগজের সম্মেলন চাই, কিন্তু ছোট কাগজ নিয়ে সমস্ত পশ্চিমী ( কলকাতা কিম্বা শিখাগো) চিন্তার থেকে আমাদের বেরিয়ে আসাও চাই। নতুবা বুদ্ধির দারিদ্র্য থেকে আমাদের মুক্তি নেই কোনো । কলকাতার স্বগোষ্ঠীর কিছু লেখকদের লেখা নিরন্তর ছাপিয়ে তিনভূবনের জমিনদারি টিকিয়ে রাখার পক্ষে আমাদের কোনো যুক্তি নেই! আনন্দবাজার কিম্বা নিউইয়র্ক টাইমসের আধিপত্যের থেকে, কলেজ ষ্ট্রিট কিম্বা ফ্রাঙ্কফুর্টের আধিপত্যের থেকে বেরিয়ে আসার স্বার্থেই আমাদের দৈনিক কাগজ কিম্বা বাণিজ্যিক প্রকাশনা সংস্থাগুলোর সঙ্গে সহযোগিতাও চাই । আমাদের তাই ভিকি এবং অক্ষরেরও পাশে থাকা চাই। আমাদের বইমেলা চাই, বাংলা একাদেমী চাই, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ বা সাহিত্য সভা চাই, এমন কি সম্ভব হলে, আমাদের নিজেদের জাতীয় বিদ্যালয়ও চাই। যে যতীন্দ্রমোহন সংগ্রহশালা আসলে আমাদেরই সম্পত্তি তার স্থানান্তরণ সম্ভব না হলে তার মতো প্রতিষ্ঠান চাই। আমাদেরই নির্মাণ ‘কামরূপ অনুসন্ধান সমিতি’র পুনরুত্থান চাই। সেগুলো হবে না কি বিশুদ্ধ বাঙালি উদ্যোগ? না হোক, হবেই বা কেন? আমাদের প্রতিবেশীদের সঙ্গে আত্মীয়তাও চাই। আমাদের এই চাইয়ের তালিকাটাকে ক্রমেই দীর্ঘ করে তোলা চাই।
           একটা কথা পরিষ্কার বোঝে নেয়া যাক, যে কলকাতা নিয়ে আমাদেরও এতো বড়াই—তাকে গড়ে তোলেনি ‘আধুনিকে’রা। আধুনিক সাহিত্য চিন্তা নয় পাঠক কেন্দ্রিক। সে বিশুদ্ধ স্রষ্টা কেন্দ্রিক সাহিত্যতত্ব । এমনকি যারা ‘জনগণের জন্যে সাহিত্য’ করবার প্রতিজ্ঞা করেছিলেন তারাও আস্থা জ্ঞাপন করেন নি জনতার চেতনায়। লিটিল ম্যাগ একনায়কত্ব হচ্ছে, অনেকটা পার্টি একনায়ত্বের মতো। দুই বিশ্বযুদ্ধের সময় নিজেদের সমাজ নিয়ে বিব্রত একদল লেখক নিতান্তই পালিয়ে বেড়াতে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন নিজেদের অতীতে বা প্রাচ্যের মতো পুঁজিবাদের দুর্বল ঘাটিগুলোর দর্শনে, সাহিত্যেতাঁরাই জন্ম দিয়েছিলেন আধুনিকতাবাদের । আমাদের তখন পালাবার জো নেই, আমরা তখন স্বপ্ন দেখছি স্বাধীনতার। তখন একদল সাহিত্যিক সাহেব সাজবার মোহে স্থানকালের মাপে একেবারেই বেখাপ্পার মতো এই দর্শনকে আশ্রয় করে বৃহত্তর সামাজিক উদ্যোগ গুলো থেকে সরে দাঁড়ালেন। তবু তাদের পৈত্রিক সম্পত্তি বিনষ্ট করে এই বিলাসিতা সাজছিল। কারণ, প্রাগাধুনিক সমস্ত লেখক সাহিত্যিকেরা তাদের জন্যে জমি চাষ করে প্রচুর ফসল ফলিয়ে গেছিলেন। কল্পনা করুন যে, রাজা রামমোহন থেকে রবীন্দ্রনাথ অব্দি সবাই কেবল গুটি কয় লিটিল ম্যগাজিন সম্পাদনা করে যাচ্ছেন, তাও কবিতা গল্প নিয়ে। বিজ্ঞান নেই, কৃষি নেই, রাজনীতি নেই, অর্থনীতি নেই, প্রত্নতত্ব নেই, ইতিহাস নেই, শিক্ষা নেই, খেলা নেই ! কল্পনা করুন যে, বর্ণপরিচয় বলে কোনো বই নেই, বিশ্বভারতী-শ্রীনিকেতন বলে কোনো বিদ্যালয় নেই –-অথচ ‘কল্লোল’, ‘কালি কলম’, ‘কবিতা’ ‘কৃত্তিবাস’ এসে গেছে! এমন কি কল্পনা করুন, যে ‘বটতলা সাহিত্যে’র বিরুদ্ধে বৃটিশ তার ব্যবসায়িক বুদ্ধিতে এক প্রত্যাখ্যানের রাজনীতি শুরু করেছিল, সেই বটতলা বলে কিছু ছিল না, অথচ ‘সাহিত্য’ সম্পাদক তাঁর কাগজ নিয়ে গিয়ে বসে আছেন কলকাতার বইমেলাতে। একেবারেই ‘আকাশকুসুম’যে পঞ্জিকা’র মতো একটি বইকে আমরা সাহিত্যের কোনো আলোচনাতে কোনো দিন ঠাইই দিলাম না সে দায়িত্ব নিয়েছিল আমাদের আমজনতাকে শিক্ষিত করবার। এমন কি সেই সব চাষিদেরকেও শিখিয়ে গেল কী করে, কখন, কী চাষ করা যায়। কোন রোগে কী ওষধি হাতের কাছে মেলে । আমরা গল্পে ‘ময়নার মা’কে নিয়ে মজা করলাম, কিন্তু ‘ভূবন মণ্ডলে’রা যেদিন চেহারা বদল করে বসবেন ক্ষমতার গদীতে তখন ময়নার মায়ের সংসার চালাবার বুদ্ধি দেবার দায়িত্ব কিন্তু নিল বটতলার ‘পাঁজি’বটতলার ফেরিওয়ালাই গ্রামে গ্রামে পৌঁছে দিল বর্ণপরিচয়। আমাদের কি সেই সব ফুটো কলসি চাই না? আমাদেরওতো ছিলেন ‘প্রাগআধুনিক’ বহু প্রাজ্ঞ পিতৃপুরুষ, যারা খেটে খুটে আমাদের করে খাবার ব্যবস্থা করে যেতে চাইছিলেন । আমরা অধঃপতিত ‘আধুনিক পুরুষ’ বাপের নাম ভুলিয়ে দিলাম ! কেননা, আমাদের সেই নির্দেশ দিয়েছেন কলকাতার ইয়ার দোস্তেরা তারা বলে গেলেন, সব আগাছা! সরে দাঁড়াও, ছেটে ফেলো। এই চোখটি ছাড়াই , যে মাটিতে আগাছা জন্মায়, যে মাটিতে হয় অরণ্যের বিস্তার--- সে মাটি উর্বর বড়ো। সে মাটিতে উদ্যান গড়ে তুলতে দরকার পড়ে না কোনো রক্তপাতের! কোনো দুর্দম সংগ্রামের। যে মাটিতে তৃণ গজাবার অবসর পায় না, সে মাটিতে অশ্বত্থ যদি স্বপ্ন দেখে মাথা তুলে দাঁড়াবার তবে সে রাতের স্বপ্ন মাত্র। সে আশা দুরাশা মাত্র ।

হেৰৌ , ফেচবুক কেনেকৈ ব্যৱহাৰ কৰে আমাৰ পৰা শিকা
            তার পরেও জানি আমি, ফুটো কলসির আত্মবিশ্বাস আসবে না। কারণ, এই সমস্ত উদ্যোগ নিতে গেলে যে পুঁজির সমর্থণ চাই তা আমাদের নেই। সবটার জন্যে পুঁজির সমর্থণ চাইও নে । চাই সেই জলের ভারীটির চোখ, যে দেখেছিল মাটিতে জলের রেখা। পঞ্চানন কর্মকার ছাপাখানার জন্যে হরফ করে এক সাঙ্ঘাতিক বিপ্লব করেছিলেন বাংলা তথা ভারত বর্ষে । আজ যে আমরা তেমনি আরেক বিপ্লবের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছি সেই সংবাদ দেখছি সাহিত্য সম্পাদকতো দূর 'উত্তরাধুনিকতা'র নায়ক তপোধীর ভট্টাচার্যেরও চোখে পড়েনি । তপোধীর ভট্টাচার্যের সেই অবশ্য পাঠ্য বইতে অজস্রবার বৈদ্যুতিন মাধ্যমের নিন্দে আছে । পড়লে আমার মনে পড়ে যায়, ছাপা বইয়ের সেইসব প্রথম যুগগুলোর কথা যখন, প্রচ্ছদে লিখে দিতে হতো, "আমাদের এই গ্রন্থের কালি গঙ্গা জলে শোধন করিয়া লওয়া হইয়াছে।”
              আমাদের পরাশ্রিত চেতনার কাজ হলো আমরা নতুন প্রযুক্তির হয় নিন্দে করব, অথবা ঠিক সেই কাজগুলোই করব যে গুলো সত্যি নিন্দার। টিভি ইণ্টারনেট আমাদের ঘরে ঘরে এক 'গ্ল্যামার ষ্টেটমেন্ট' হয়েই প্রবেশ করেছিল। টিভিকে আমরা ‘বোকাবাস্ক’ বলে খুব নিন্দে মন্দ করলাম। কিন্তু কখনো কি ভেবেছিলাম, সে আমাদের শিলং কিম্বা সদিয়ার বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দেবে বাংলা সহ ভারতীয় ভাষাগুলোর এতো বিস্তার। আমার খুব হাসি পায় যখন দেখি রোমান হরফে ইণ্টারনেটে ইংরেজিতে আর্তনাদ করা হয়, আমাদের মাতৃভাষাগুলো বিপন্ন হয়ে যাবে! আমাদের বরাক উপত্যকা বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলনের কাছাড় শাখার সম্পাদককে আমি বলে বলে হয়রান, যে ভাই, আপনি আপনার ব্যাথাগুলো বাংলাতে লিখুন। আমরাও জেনে শুনে তৃপ্ত হই! তিনি অসমীয়া উগ্রজাতীয়তাবাদের নিন্দে করেন, ইংরেজিতে! আমাদের ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার বড়সড় বাংলা ভাষা সাহিত্যের উদ্যোগ দেখলেই একটি 'কিন্তু' যোগ করে পরামর্শ দেন, But, don't lose your identity!” কী বিড়ম্বনা। অথচ, ইন্টারনেটে বাংলা মনিপুরি অসমিয়া লেখা আজ নিতান্তই ডালভাত। ছাপা যন্ত্রের থেকে অনেক সহজ এবং সুন্দর! বিজ্ঞানী পলাশ বরণ পাল থেকে বাংলাদেশের মেহেদী হাসানের মতো আত্মমর্যাদাতে ভরপুর কিছু মানুষ বিদেশি প্রযুক্তির দাসত্ব না করে তাকেই করেছেন দাস। একুশ শতকের এঁরাই পঞ্চানন কর্মকার । অথচ কোনো ভাষাদিবসে যে আমার তাদের সম্মান জানাব সে যোগ্যতা অর্জন করিনি আজো ।
সেদিন আমাদের এক অসমীয়া বন্ধু প্রতিম প্রতাপ বরুয়া, অসমীয়াতকথা বতরা’১৮ নামের ফেসবুক গ্রুপে একটা পোষ্ট দিলেন, আমরা পড়াবার লোভ সামলাতে পারছি না, “সিদিনা ৰাতি ১১ মান বজাত এজন লৰাৰ ফেচবুক বন্ধুত্বৰ অনুৰোধ গ্ৰহণ কৰিলো গ্ৰহণ কৰাৰ লগে লগে ৰোমান লিপিৰে লিখা বাৰ্ত্তা আহিল - "থেংচ দিউদ, কি কৰি আছা ?" উত্তৰ দিবলৈ পোৱাৰ আগতেই আহিল ভিডিও চাটৰ অনুৰোধ লৰাজনৰ প্ৰফাইলতো এবাৰ চাই লৈ উত্তৰ দিলো - "অচিনাকী ভাইটি, তুমি মোতকৈ ২১ বছৰ সৰু গতিকে প্ৰথমবাৰতে তুমি বুলি নামাতিবাচোন অলপ চিনাকী হৈ নিজৰ কথা আৰু কামেৰে মোক তুমি বুলি মাতিব পৰা অধিকাৰটো আদায় কৰি লোৱা " তাৰ পিছত আৰু বাৰ্ত্তা নাহিল লৰাজনৰ পৰা এনেকুৱা অভিজ্ঞতা মোৰ কেইবাবাৰো হৈছে এইসকলে ফেচবুক কিহৰ বাবে ব্যৱহাৰ কৰে নাজানো মই কিন্তু ফেচবুক অসমীয়া ভাষাত সুন্দৰ সুন্দৰ কথাবোৰ পঢ়াৰ বাবে ব্যৱহাৰ কৰো নিজৰ যোগ্যতা মতে ভুলে-শুদ্ধই কিবা কিবি লিখিছোও ফেচবুক নথকা হলে কম্পিউটাৰত নিজৰ ভাষাটো নিজৰ লিপিৰে কেতিয়াবা লিখিলোহেতেঁন বুলি মনে নধৰে একমাত্ৰ অসমীয়া লিপিৰে লিখা-পঢ়া কৰাৰ বাবেই কিমান ভাল ভাল অচিনাকী মানুহ চিনাকী হৈ ওচৰ চাপি আহিল ! তাৰ পিছত ইউনিকোডত কীৰ্ত্তন লিখা কামটোত অংশ লৈছো, এখন শ্ৰব্য নাটকো আহি আছে, নিজৰ ভাষাত এটা ব্লগো সৃষ্টি কৰিলো ইত্যাদি সেই লৰাজনৰ দৰে লৰাহঁতক মোৰ কবলৈ মন যায় - “হেৰৌ, ফেচবুক কেনেকৈ ব্যৱহাৰ কৰে আমাৰ পৰা শিকা আমাদের পূর্বোত্তের অধিকাংশ বাঙালি বন্ধুও নেটে তাই করেন, “ "থেংচ দিউদ, কি কৰি আছা ?" তাও আবার সাহেবি বর্ণে। তাই দেখে , আমাদের তাত্বিকেরা বিলাপ করেন, সর্বনাশ! এ যে ঘোর কলিকাল!
         কেবল ঐ ইংরেজি লিটিল ম্যাগাজিন বা পোয়েট্রির মতো কিছু ইংরেজি কাগজ নেটে এসে গেছে তাতো প্রাচীন বিশ্বাস। বাংলা, হিন্দি ,অসমিয়া, বিষ্ণুপ্রিয়া ওয়েব ম্যাগাজিনে, পত্রিকায় আর বইতে এখন ইন্টার নেট ছয়লাপ। এখনো যদি কেউ লিটিল ম্যাগাজিনে মুক্তির স্বপ্ন দেখেন, তবে আমরাতো বলবই, তাঁরা কিন্তু খুব “ তাদের সমসাময়িক না ।” ইণ্টার নেটে কী কী আছে তার হিসেব দেয়া কঠিন। খুবই কঠিন। কিন্তু কী কী নেই তার একটা হিসেব দিতে পারি । সেখানে আলাদা করে ফেয়ার কপি করা নেই, নিজের লেখা বা পড়া বই রাখবার আলিমিরার সমস্যা নেই, ইঁদুরে কাটা বা আগুনে পোড়ার সমস্যা নেই, সরকারি ভাষার চাপ নেই, ছাপাখানার খরচ নেই, বাঁধানো নেই, পোষ্ট করা নেই, গ্রাহক চাঁদা নেই, বিজ্ঞাপনের সন্ধানে ফেরা নেই, সম্পাদকের চোখ রাঙানি নেই, পাঠকের সমস্যা নেই, লেখকে পাঠকে যোগের সমস্যা নেই । বইমেলাতে দৌড়োনো নেই, উপর থেকে নিচে নেই, কেন্দ্র আর প্রান্ত নেই। পণ্ডিতে আর মুর্খে শাসনের বেড়াজাল নেই!
             ফলে যেটি পাল্টাতে যাচ্ছে খুব দ্রুত তা হলো সাহিত্য আর ভাষাত্ত্বের সমস্ত প্রাচীন কাঠামো আরো একবার, যেমন পালটে গেছিল ছাপাখানা আসবার পর। এক নতুন বৌদ্ধিক উত্থানের দোরগড়ায় দাঁড়িয়ে রয়েছি আমরা । যে দরজা পার করলেই আর স্থানকাল থাকছে না, সরলরৈখিক কিম্বা বৃত্তাকার। তার সর্পিল চেহারা এতো বেশি স্পষ্ট যে স্থানে-কালের আনুভূমিক কিম্বা উলম্বে চোখ ফেলতেই হচ্ছে আর দেখেও ফেলছি বহুদূর অব্দি। সামনে না পেছনে—এই প্রশ্নটাই নিরর্থক । যেমন নিরর্থক এই প্রশ্ন যে ছায়া পথে আমাদের পৃথিবী রয়েছে কোথায়, সামনে না পেছনে। কারণ কবিতা এখানে শুধু পড়া নয়, শোনাও যায় যে সেই বাল্মীকির যুগের মতো। এমন কি চাইলে তা দেখাও যায়! যেমন ছিল ওঝাপালার দিনে। বরং এই প্রশ্ন সেখানে অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক যে আমরা যেতে চাইছি কোথায় এবং কোন দিকে । সেদিকে আমাদের পথ খোলা---জাহান্নমে কিম্বা বেহেস্তে! কথাগুলো খানিক আবেগিক হয়ে গেল। কিন্তু আধুনিকতার 'যুক্তি''র মার খেয়ে আমরা এও ভুলে গেছি যে আমাদের সমস্ত কঠিন যাত্রাই আরম্ভ হয় এক প্রচণ্ড আবেগ থেকে! আর ঈশ্বর না হোক, প্রকৃতির উপর এক অগাধ আস্থা থেকে!
          আমরা বহু বাংলা ওয়েব কাগজের নাম করতে পারি। কিন্তু কৌরব, পরবাস থেকে শুরু করে গুরুচণ্ডালি হয়ে  সে তালিকা দীর্ঘ হবে। আপাতত শুধু এই ঠিকানা দুটোই দিয়ে যাই যে আপনারা যদি ‘কাঠের নৌকাতে’  ভ্রমণ করেন তবে পড়তে পাবেন পূর্বোত্তরের বাংলা বই, পত্রপত্রিকা। এটি এক সংগ্রহ শালা । আপনার সম্পাদিতটিও সেখানে তোলার ব্যবস্থা করতেই পারেন। আর যদি ‘ঈশানের পুঞ্জমেঘে’  বেড়াতে আসেন তবে লেখক হয়েই আসুন, আপনি স্বাগত। আপনি ভালো না মন্দ লেখেন সে বিচার সেখানে পাঠক করেন যারা ছড়িয়ে আছেন গোটা বিশ্বে । সেখানে আপনার সহায়ক আছেন, বন্ধু আছেন, সম্পাদক নেই কোনো,নেই প্রকাশক কিম্বা স্বাধীনতা কেড়ে নেবার মতো কোনো 'প্রতিষ্ঠান' । সে 'দেশ' হোক, কিম্বা হোক 'সাহিত্য'


তথ্য সূত্রঃ
) বিজিৎ কুমার ভট্টাচার্য; অতন্দ্র এবং বরাক উপত্যকায় বাংলা কাব্য চর্চা; সম্পাদনা, বিজিৎ কুমার ভট্টাচার্য; সাহিত্য প্রকাশনী, হাইলাকান্দি;দ্বিতীয় মূদ্রণ ১লা ডিসেম্বর,২০০০; পৃঃ ৩১ ( এটি মূলত অতন্দ্রের লেখক-সম্পাদকদের একটি আড্ডাকে লিখিত রূপে ধরে রাখবার প্রয়াস। প্রথমে প্রকাশ পেয়েছিল ‘সাহিত্যে’র নবপর্যায়ের চতুর্থ সংকলনে । এবং বই হিসেবে বেরোয় ১লা অক্টোবর , ১৯৮৮তে)
) ; পৃঃ ৩০
) বিজিৎ কুমার ভট্টাচার্য; ;পৃ ২০-২১
) বিমল চৌধুরী; ; পৃঃ২১
) দেবাশিস তরফদার; কবির স্বদেশ ; মহাবাহু , বর্ষা, ১৮১৭; গুয়াহাটি; পৃঃ৭০
) বাংলা কবিতায় আধুনিকতাবাদ এবং বিবাদ; সুশান্ত কর; '' -৫ম বর্ষ, ১০ম সংখ্যা; ফাল্গুন-বৈশাখ ১৪০১-০২; শিলচর পৃঃ১।
) শক্তিপদ ব্রহ্মচারী; অতন্দ্র এবং বরাক উপত্যকায় বাংলা কাব্য চর্চা; পৃঃ ৪০
) পবিত্র কুমার দাস;কবিতা পত্রিকা-সূচীগত ইতিহাস; প্যাপিরাস; কলকাতা; সেপ্টেম্বর ১৯৮৯; পৃঃ ১ ।
১১) দেবাশিস তরফদার; ঐ ।
১২) সাহিত্য ১০০; ১ শ্রাবণ ১৮১৪; বর্ষ ৪২ সংখ্যা ১; সম্পাদক বিজিৎ কুমার ভট্টাচার্য, হাইলাকান্দি, অসম, পৃঃ ৮৯ ।
১৩) সুরক্ষিত বন্দিশালা; বিজিৎ কুমার ভট্টাচার্য; সাহিত্য প্রকাশনী; হাইলাকান্দি, অসম; ২২শে শ্রাবণ ১৮০০; ৭ আগষ্ট ১৯৯৩।
১৫) সাহিত্যের মুক্তি, ঐ।
১৬) দেবাশিস তরফদার; ঐ ।
১৭)Party Organisation and Party Literature; V. I. Lenin;Lenin Collected Works, Progress Publishers, 1965, Moscow, Volume10, pages44-49. ;http://www.marxists.org/archive/lenin/works/1905/nov/13.htm)
১৮)অসমীয়াত কথা বতৰা ;http://www.facebook.com/groups/axomiyakothabotora
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
সম্পর্কিত আরো দুই একটি যোগাযোগঃ

২)The Dial 

৩)MODERNISM AND THE MAGAZINES – ESSAY – MALCOLM BRADBURY