(লেখাটি শিলচরের মাসিক দিগন্তিকা কাগজের শারদ সংখ্যা, ২০১৩তে প্রকাশিত)
সাহেব সংস্পর্শ ছাড়াই উপভাষা দিয়ে যাত্রা শুরুঃ এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ তথ্য যে বাংলা এবং অসমিয়া ভারতীয় উপমহাদেশের দুই গুরুত্বপূর্ণ আর্যভাষার প্রথম অভিধান লেখা হয়েছিল একই শতাব্দীতে কয়েক দশকের তফাতে মাত্র। আর দুটোই ছিল দ্বিভাষিক। পোর্তুগিজ পাদ্রি মনোএল দ্য আসসুম্পসাউ ১৭৩৪ থেকে ১৭৪২এর মধ্যে লিখেন একটি ব্যাকরণ এবং অভিধান - ‘ভোকাবুলারিও এম ইদিওমা বেনগল্লা, ই পোর্তুগিজঃ দিভিদিদো এম দুয়াস পার্তেস’ । ১৭৩৫এ তিনি লিখেছিলেন ‘কৃপার শাস্ত্রের অর্থ ভেদ’ -যেটি আধুনিক বাংলা ভাষার প্রথম গদ্য গ্রন্থ। দুটো বইই ১৭৪৩এ পোর্তুগালের রাজধানী থেকে ছেপে বেরোয়। বাংলা ভাষাতে এ দুটিই প্রথম ছাপা বই। বাংলাভাষাটিকে নিয়ে আমরা নিজেরা এর আগে বৌদ্ধিক প্রয়াসের চিহ্নই রাখিনি ।
অন্যদিকে ১৭৯৫ খ্রিস্টাব্দে আহোম পুরোহিত শ্রেণির প্রখ্যাত মহন পরিবারের টেঙাই পণ্ডিত ‘বরঅম্র, লতিঅম্র’ নামে একটি আহোম-অসমিয়া দ্বিভাষিক অভিধান লিখেছিলেন, মতান্তরে সংগ্রহ করেছিলেন। আহোম রাজদরবারে অ-আহোম রাজকর্মচারীদের যেমন স্থানীয় আহোম ভাষা শেখার দরকার পড়ছিল এরকম এক পরিস্থিতিতে অথবা বিলুপ্তির মুখে পড়া আহোম ভাষাকে অসমিয়ার ধাঁচে ধরে রাখবার দরকার থেকে হয়তো এটি লেখা হয়েছিল। এখনো স্পষ্ট নয় কারণটি কী? দুটো মতই রয়েছে।
সাধারণত আমাদের আধুনিক ভাষার চিন্তার ইতিহাস নিয়ে যে বোধ তা শুরু হয় কলকাতার শ্রীরামপুরের আর শিবসাগরের মার্কিন বাপটিষ্ট মিশনারীদের নিয়ে। আমাদের চিন্তাতে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ একদিকে, অন্যদিকে ‘অরুণোদয়’ কাগজ বড় জায়গা নিয়ে বসে আছে। তাতে কোনো সমস্যা ছিল না। মনে হয় যেন তারাই বাংলা আর অসমিয়া ভাষাকে নতুন করে উদ্ধার করলেন, গড়ে তুললেন। তা করলেন বটে। সে যে ভাষা ইতিহাসের এক রাজনৈতিক বাঁক-- সেটি চাপা পড়ে যায় এবং আরো কিছু গুরুত্বপূর্ণ সত্য চাপা পড়ে যায় যদি তার আগের ইতিহাসে আমরা চোখ না ফেলি। বাংলাতে অবশ্য হেলহেডের ব্যাকরণের কথাটাও আমরা ভুলিনা , সম্ভবত তাঁর নামের সঙ্গে মূদ্রণযন্ত্র এবং পঞ্চানন কর্মকারের হাতে লিপি খোদাইর ইতিবৃত্ত জড়িয়ে আছে বলে। অন্যথা মনোএল দ্য আসসুম্পসাউ-এর নাম আমরা তাঁর প্রথম ছাপা বাংলা গদ্য গ্রন্থের প্রসঙ্গে মনে রাখি তাও সেই ‘কৃপার শাস্ত্রের অর্থভেদ’ প্রসঙ্গে ।
মনোয়েলের ব্যাকরণ এবং অভিধানটি কিন্তু লেখা হয়েছিল আজকের মান বাংলাতে নয়, এমন কি যে সাধু বাংলাকে শ্রীরামপুর মিশনের দিন থেকে সংস্কৃতপ্রায় কৃত্রিম করে তুলবার চেষ্টা হবে এবং যেটি বাংলাসাহিত্যের সাধারণ ভাষা হিসেবে প্রাক-ব্রিটিশ যুগেই গড়ে উঠেছিল-- সেই ভাষাতেও নয়। লেখা হয়েছিল ঢাকার অদূরে বর্তমানে গাজীপুর জেলার অন্তর্ভুক্ত, তৎকালীন ভাওয়াল পরগণার বাংলা ভাষার উপর ভিত্তি করেই। অর্থাৎ উপভাষাচর্চা যা পরে দীর্ঘদিন চাপা পড়ে যাবে তাই দিয়েই শুরু হয়েছিল আধুনিক বাংলা ভাষাতত্ত্বের চর্চার ইতিহাস। অন্যদিকে ‘বরঅম্র, লতিঅম্রে’র যুগে আধুনিক মান অসমিয়া গড়ে উঠেনি। সেটির শুরু শিবসাগরে মার্কিন বাপটিস্ট মিশনে ‘অরুণোদয়’ প্রকাশের মধ্য দিয়ে । অথবা তাকে যদি আত্মারামের অনুদিত ‘বাইবেলে’র কাল ১৮১৩ অব্দি টেনে নিয়ে যাই তবে শ্রীরামপুর মিশন এবং উইলিয়াম কেরির ভাষা-কর্মযজ্ঞের সঙ্গে জুড়ে দিতেও পারি। কারণ কেরির প্রেরণাতেই এটি অনুদিত এবং প্রকাশিত হয়েছিল। কিন্তু তার আগেই ‘অম্র’ গ্রন্থটি লেখা হয়ে গেছে। বইটি সম্ভবত গোটা ভারতের ভাষাচিন্তার ইতিহাসেই এর জন্যেও গুরুত্বপূর্ণ যে সাহেবি কোনো সংসর্গ ছাড়াই এক বা একাধিক ভারতীয় এটি লিখছেন। যে অসমিয়া ব্যবহার করেছেন সেটি শিবসাগর অঞ্চলের উপভাষা হওয়াই সম্ভব। কিন্তু সেই সঙ্গে তাঁরা ‘তাই-আহোমে’র মতো এমন একটি ভাষাও লিপিবদ্ধ করছেন যেটি তখন বিলোপোন্মুখ। আহোমেরা ততদিনে অসমিয়া ভাষা গড়ে তুলতে এবং আয়ত্ব্ব করতে বহুদূর এগিয়ে গেছেন।
অসমিয়া ভাষাচিন্তার গৌরবের কাহিনিটি এখানেই শেষ নয়। ১৮১০এ রুচিনাথ কামরূপী (বা বরগোঁহাই)র অভিধান ত্রিভাষিক । সংস্কৃতের সঙ্গে সেখানে আলাদা করে জায়গা করেছিল কামরূপী এবং উজানের অসমিয়া। তৃতীয় আরেকখানা অভিধানের সংবাদ মেলে নাথান ব্রাউনের Grammatical Notices of the Assamese Language –এর ভূমিকাতে । যাদুরাম ডেকাবরুয়ার লেখা এবং ১৮৩৯এ প্রকাশিত A Manuscript Bengali Dictionary with Assamese Definitions। জানিনা কোনো বাঙালি ভাষাচিন্তক এই অমূল্য বইখানার কোনো খবর কোনদিনই নিলেন না কেন? কোনো বাংলা বইতে এর উল্লেখ মেলে না ।১ বইটি এখন মেলেনা, জাতীয় অভিধান দলটি এর সন্ধানে আছেন। আমরাও করতে পারি। দুই ভাষার তুলনামূলক ইতিহাসে বইটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আলো ফেলতেই পারে। বস্তুত বইটি সেই যুগে বসে লেখা যখন অসমিয়া বৌদ্ধিক সমাজ সানন্দে বাংলা চর্চা করতেন। ড০ প্রফুল্ল মহন্ত যে যুগটি সম্পর্কে তাঁর 'অসমীয়া মধ্যবিত্ত শ্রেণির ইতিহাস গ্রন্থে' লিখেছেন, “ অসমত বাঙালী সকলেই আছিল আধুনিকতার অগ্রদূত আরু বৃটিশর পিছতে তেওঁলোকেও এক সামাজিক মর্যাদা লাভ করিছিল। সেইকালত নিশ্চয় (অসমিয়া) অভিজাত সকলে বাংলা ভাষার জ্ঞান আয়ত্ব্ব করাটো আরু বাঙ্গালিক অনুকরণ করাটোক আধুনিক আভিজাত্য বা সামাজিক মর্যাদার প্রতীক হিচাপে গণ্য করিছিল।” ২ এবং সেই যুগেও বটে যখন প্রথমবারের মতো ব্রিটিশের ভাষানীতি গোটা ভারত বিশেষ করে পূর্ব ভারতে সংঘাতের বীজও বপন করে। যার সুদূরপ্রসারী প্রভাব সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত কিন্তু তাৎপর্যপূর্ণ মন্তব্য পাওয়া যায় ‘অসমীয়া জাতীয় অভিধানে’র ভূমিকা অংশে। সম্পাদক লিখছেন, “নিজ মাতৃভাষার নির্বাসনর বাবে দায়ী বৃতিচ সাম্রায্যবাদক চিনাক্ত করিব নোয়ারি ই অসমীয়ার ঠাইত বাংলা জাপি দিয়া বাবে কেবল বাঙালি কেরাণী মহরীক দায়ী কৰিছিল। ফলস্বরূপে অসমিয়া ভাষার অস্তিত্বর বাবে ভাবুকি স্বরূপ বৃতিচ সাম্রায্যবাদ নেপথ্যতে থাকি গৈছিল আরু পরবর্তী প্রায় দের শতিকা কাল অসমীয়া-বঙালী সংঘর্ষই অসমর এক প্রধান জনসংঘাতর রূপ ধারণ করিছিল। বৃতিচ সাম্রাজ্যবাদ যে প্রকৃততে বাংলা ভাষার প্রতি দরদি নাছিল, সেই কথার প্রমাণ হৈছিল এই কথার পরা যে যি সময়ত বৃতিচে অসম আরু উরিষ্যাত বাংলা ভাষা জাপি দিছিল, ঠিক সেই সময়ত খোদ বংগত কিন্তু ফার্চী ভাষাহে জাপি দিছিল। তাৰ কারণ আছিল এই যে জনসংখ্যার প্রায় আধা আধা হিন্দু মুছলমান জনবসতি থকা তেতিয়ার অভিবক্ত বংগত মুছলমান সকলর ভাষা বুলি অভিহিত বা জনাজাত ফার্চী ভাষা বলবৎ কৰিলে হিন্দু সকল জাঙুর খাই উঠিব আরু তার ফল হ'ব দীর্ঘস্থায়ী হিন্দু-মুছলমান সংঘর্ষ। বৃতিচর সেই ষড়যন্ত্র যে বহুদূর ফলিয়ালে তার প্রমাণ পরবর্তী কালত হিন্দু মুছলমান সংঘাতক কেন্দ্র করি বাংলা ভাষা, বাঙ্গালী জাতি আনকি বংগদেশতে উলম্ব বিভাজন।”৩ শুধু একটি তথ্যগত ভুল রয়েছে এই গোটা বক্তব্যে। ফার্সিকে বাংলার সরকারী ভাষা হিসেবে ব্রিটিশ তখন বলবৎ করেনি। এটি ছিলই সরকারি ভাষা ১৮৩৭ অব্দি। অর্থাৎ অসমে এবং উড়িষ্যাতে বাংলা ভাষা বলবৎ করবার পরের বছরেই শুধু বাংলাদেশে বাংলা বলবৎ হয়। এর পরেই ভাষাগুলো নিয়ে বিভ্রান্তি যেমন বাড়তে থাকে সেই বিভ্রান্তি দূর করতে গিয়ে ভাষা এবং ভাষাচিন্তার বিকাশও কিন্তু হতে থাকে দ্রুত গতিতে। অসমিয়া বাংলার উপভাষা কিনা, কিম্বা সিলেটি অসমিয়ার উপভাষা কিনা এই তর্কের গোড়ার কথাটিও কিন্তু এই ইতিহাস এবং ভাষারাজনীতি। এক দশকের ব্যবধানে প্রকাশিত রবিনসন এবং নাথান ব্রাউনের ব্যাকরণেই আমরা এই ভাষারাজনীতির প্রকট চেহারাটি দেখতে পাব। প্রথমজন ছিলেন কেরির অনুগত ব্রিটিশ মিশনারী। সুতরাং তাঁর বক্তব্য ছিল অসমিয়া হচ্ছে বাঙালি বামুনদের প্রচলিত বাংলারই ভিন্ন রূপ। দ্বিতীয়জন ব্রহ্মদেশ হয়ে অসমে আসা মার্কিন মিশনারী। প্রথমজন অসমের স্কুলে অসমিয়া ভাষা প্রচলনেরও তীব্রবিরোধী ছিলেন, দ্বিতীয়জন অসমিয়াকে প্রতিষ্ঠা দেবার লড়াই লড়েছিলেন। ৪ রবীন্দ্রনাথ নাথান ব্রাউনের ব্যাকরণের সঙ্গে পরিচিত থাকা সত্বেও প্রথম জীবনে অসমিয়ার স্বাতন্ত্র্য সম্পর্কে রবিনসনেরই অনুসারী ছিলেন।৫ এই ভাষারাজনীতির দৌড়ে যাদুরামকে ইচ্ছে করেই প্রায় লুকিয়ে ফেলা হলো। যার কিছু বিবরণ মেলে ‘অসমীয়া জাতীয় অভিধানে’র প্রথম খণ্ডে। আপাতত সেই বিষয় এক পাশে সরিয়ে রেখে আমরা এ পর্যন্ত ভাষাদুটোতে ভাষা নিয়ে যা কিছু চিন্তন এবং মনন হয়েছে তার এক সংক্ষিপ্ত ইতিবৃত্ত তুলে ধরবার চেষ্টা নেব।
সাহেব সংস্পর্শ ছাড়াই উপভাষা দিয়ে যাত্রা শুরুঃ এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ তথ্য যে বাংলা এবং অসমিয়া ভারতীয় উপমহাদেশের দুই গুরুত্বপূর্ণ আর্যভাষার প্রথম অভিধান লেখা হয়েছিল একই শতাব্দীতে কয়েক দশকের তফাতে মাত্র। আর দুটোই ছিল দ্বিভাষিক। পোর্তুগিজ পাদ্রি মনোএল দ্য আসসুম্পসাউ ১৭৩৪ থেকে ১৭৪২এর মধ্যে লিখেন একটি ব্যাকরণ এবং অভিধান - ‘ভোকাবুলারিও এম ইদিওমা বেনগল্লা, ই পোর্তুগিজঃ দিভিদিদো এম দুয়াস পার্তেস’ । ১৭৩৫এ তিনি লিখেছিলেন ‘কৃপার শাস্ত্রের অর্থ ভেদ’ -যেটি আধুনিক বাংলা ভাষার প্রথম গদ্য গ্রন্থ। দুটো বইই ১৭৪৩এ পোর্তুগালের রাজধানী থেকে ছেপে বেরোয়। বাংলা ভাষাতে এ দুটিই প্রথম ছাপা বই। বাংলাভাষাটিকে নিয়ে আমরা নিজেরা এর আগে বৌদ্ধিক প্রয়াসের চিহ্নই রাখিনি ।
অন্যদিকে ১৭৯৫ খ্রিস্টাব্দে আহোম পুরোহিত শ্রেণির প্রখ্যাত মহন পরিবারের টেঙাই পণ্ডিত ‘বরঅম্র, লতিঅম্র’ নামে একটি আহোম-অসমিয়া দ্বিভাষিক অভিধান লিখেছিলেন, মতান্তরে সংগ্রহ করেছিলেন। আহোম রাজদরবারে অ-আহোম রাজকর্মচারীদের যেমন স্থানীয় আহোম ভাষা শেখার দরকার পড়ছিল এরকম এক পরিস্থিতিতে অথবা বিলুপ্তির মুখে পড়া আহোম ভাষাকে অসমিয়ার ধাঁচে ধরে রাখবার দরকার থেকে হয়তো এটি লেখা হয়েছিল। এখনো স্পষ্ট নয় কারণটি কী? দুটো মতই রয়েছে।
সাধারণত আমাদের আধুনিক ভাষার চিন্তার ইতিহাস নিয়ে যে বোধ তা শুরু হয় কলকাতার শ্রীরামপুরের আর শিবসাগরের মার্কিন বাপটিষ্ট মিশনারীদের নিয়ে। আমাদের চিন্তাতে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ একদিকে, অন্যদিকে ‘অরুণোদয়’ কাগজ বড় জায়গা নিয়ে বসে আছে। তাতে কোনো সমস্যা ছিল না। মনে হয় যেন তারাই বাংলা আর অসমিয়া ভাষাকে নতুন করে উদ্ধার করলেন, গড়ে তুললেন। তা করলেন বটে। সে যে ভাষা ইতিহাসের এক রাজনৈতিক বাঁক-- সেটি চাপা পড়ে যায় এবং আরো কিছু গুরুত্বপূর্ণ সত্য চাপা পড়ে যায় যদি তার আগের ইতিহাসে আমরা চোখ না ফেলি। বাংলাতে অবশ্য হেলহেডের ব্যাকরণের কথাটাও আমরা ভুলিনা , সম্ভবত তাঁর নামের সঙ্গে মূদ্রণযন্ত্র এবং পঞ্চানন কর্মকারের হাতে লিপি খোদাইর ইতিবৃত্ত জড়িয়ে আছে বলে। অন্যথা মনোএল দ্য আসসুম্পসাউ-এর নাম আমরা তাঁর প্রথম ছাপা বাংলা গদ্য গ্রন্থের প্রসঙ্গে মনে রাখি তাও সেই ‘কৃপার শাস্ত্রের অর্থভেদ’ প্রসঙ্গে ।
মনোয়েলের ব্যাকরণ এবং অভিধানটি কিন্তু লেখা হয়েছিল আজকের মান বাংলাতে নয়, এমন কি যে সাধু বাংলাকে শ্রীরামপুর মিশনের দিন থেকে সংস্কৃতপ্রায় কৃত্রিম করে তুলবার চেষ্টা হবে এবং যেটি বাংলাসাহিত্যের সাধারণ ভাষা হিসেবে প্রাক-ব্রিটিশ যুগেই গড়ে উঠেছিল-- সেই ভাষাতেও নয়। লেখা হয়েছিল ঢাকার অদূরে বর্তমানে গাজীপুর জেলার অন্তর্ভুক্ত, তৎকালীন ভাওয়াল পরগণার বাংলা ভাষার উপর ভিত্তি করেই। অর্থাৎ উপভাষাচর্চা যা পরে দীর্ঘদিন চাপা পড়ে যাবে তাই দিয়েই শুরু হয়েছিল আধুনিক বাংলা ভাষাতত্ত্বের চর্চার ইতিহাস। অন্যদিকে ‘বরঅম্র, লতিঅম্রে’র যুগে আধুনিক মান অসমিয়া গড়ে উঠেনি। সেটির শুরু শিবসাগরে মার্কিন বাপটিস্ট মিশনে ‘অরুণোদয়’ প্রকাশের মধ্য দিয়ে । অথবা তাকে যদি আত্মারামের অনুদিত ‘বাইবেলে’র কাল ১৮১৩ অব্দি টেনে নিয়ে যাই তবে শ্রীরামপুর মিশন এবং উইলিয়াম কেরির ভাষা-কর্মযজ্ঞের সঙ্গে জুড়ে দিতেও পারি। কারণ কেরির প্রেরণাতেই এটি অনুদিত এবং প্রকাশিত হয়েছিল। কিন্তু তার আগেই ‘অম্র’ গ্রন্থটি লেখা হয়ে গেছে। বইটি সম্ভবত গোটা ভারতের ভাষাচিন্তার ইতিহাসেই এর জন্যেও গুরুত্বপূর্ণ যে সাহেবি কোনো সংসর্গ ছাড়াই এক বা একাধিক ভারতীয় এটি লিখছেন। যে অসমিয়া ব্যবহার করেছেন সেটি শিবসাগর অঞ্চলের উপভাষা হওয়াই সম্ভব। কিন্তু সেই সঙ্গে তাঁরা ‘তাই-আহোমে’র মতো এমন একটি ভাষাও লিপিবদ্ধ করছেন যেটি তখন বিলোপোন্মুখ। আহোমেরা ততদিনে অসমিয়া ভাষা গড়ে তুলতে এবং আয়ত্ব্ব করতে বহুদূর এগিয়ে গেছেন।
অসমিয়া ভাষাচিন্তার গৌরবের কাহিনিটি এখানেই শেষ নয়। ১৮১০এ রুচিনাথ কামরূপী (বা বরগোঁহাই)র অভিধান ত্রিভাষিক । সংস্কৃতের সঙ্গে সেখানে আলাদা করে জায়গা করেছিল কামরূপী এবং উজানের অসমিয়া। তৃতীয় আরেকখানা অভিধানের সংবাদ মেলে নাথান ব্রাউনের Grammatical Notices of the Assamese Language –এর ভূমিকাতে । যাদুরাম ডেকাবরুয়ার লেখা এবং ১৮৩৯এ প্রকাশিত A Manuscript Bengali Dictionary with Assamese Definitions। জানিনা কোনো বাঙালি ভাষাচিন্তক এই অমূল্য বইখানার কোনো খবর কোনদিনই নিলেন না কেন? কোনো বাংলা বইতে এর উল্লেখ মেলে না ।১ বইটি এখন মেলেনা, জাতীয় অভিধান দলটি এর সন্ধানে আছেন। আমরাও করতে পারি। দুই ভাষার তুলনামূলক ইতিহাসে বইটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আলো ফেলতেই পারে। বস্তুত বইটি সেই যুগে বসে লেখা যখন অসমিয়া বৌদ্ধিক সমাজ সানন্দে বাংলা চর্চা করতেন। ড০ প্রফুল্ল মহন্ত যে যুগটি সম্পর্কে তাঁর 'অসমীয়া মধ্যবিত্ত শ্রেণির ইতিহাস গ্রন্থে' লিখেছেন, “ অসমত বাঙালী সকলেই আছিল আধুনিকতার অগ্রদূত আরু বৃটিশর পিছতে তেওঁলোকেও এক সামাজিক মর্যাদা লাভ করিছিল। সেইকালত নিশ্চয় (অসমিয়া) অভিজাত সকলে বাংলা ভাষার জ্ঞান আয়ত্ব্ব করাটো আরু বাঙ্গালিক অনুকরণ করাটোক আধুনিক আভিজাত্য বা সামাজিক মর্যাদার প্রতীক হিচাপে গণ্য করিছিল।” ২ এবং সেই যুগেও বটে যখন প্রথমবারের মতো ব্রিটিশের ভাষানীতি গোটা ভারত বিশেষ করে পূর্ব ভারতে সংঘাতের বীজও বপন করে। যার সুদূরপ্রসারী প্রভাব সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত কিন্তু তাৎপর্যপূর্ণ মন্তব্য পাওয়া যায় ‘অসমীয়া জাতীয় অভিধানে’র ভূমিকা অংশে। সম্পাদক লিখছেন, “নিজ মাতৃভাষার নির্বাসনর বাবে দায়ী বৃতিচ সাম্রায্যবাদক চিনাক্ত করিব নোয়ারি ই অসমীয়ার ঠাইত বাংলা জাপি দিয়া বাবে কেবল বাঙালি কেরাণী মহরীক দায়ী কৰিছিল। ফলস্বরূপে অসমিয়া ভাষার অস্তিত্বর বাবে ভাবুকি স্বরূপ বৃতিচ সাম্রায্যবাদ নেপথ্যতে থাকি গৈছিল আরু পরবর্তী প্রায় দের শতিকা কাল অসমীয়া-বঙালী সংঘর্ষই অসমর এক প্রধান জনসংঘাতর রূপ ধারণ করিছিল। বৃতিচ সাম্রাজ্যবাদ যে প্রকৃততে বাংলা ভাষার প্রতি দরদি নাছিল, সেই কথার প্রমাণ হৈছিল এই কথার পরা যে যি সময়ত বৃতিচে অসম আরু উরিষ্যাত বাংলা ভাষা জাপি দিছিল, ঠিক সেই সময়ত খোদ বংগত কিন্তু ফার্চী ভাষাহে জাপি দিছিল। তাৰ কারণ আছিল এই যে জনসংখ্যার প্রায় আধা আধা হিন্দু মুছলমান জনবসতি থকা তেতিয়ার অভিবক্ত বংগত মুছলমান সকলর ভাষা বুলি অভিহিত বা জনাজাত ফার্চী ভাষা বলবৎ কৰিলে হিন্দু সকল জাঙুর খাই উঠিব আরু তার ফল হ'ব দীর্ঘস্থায়ী হিন্দু-মুছলমান সংঘর্ষ। বৃতিচর সেই ষড়যন্ত্র যে বহুদূর ফলিয়ালে তার প্রমাণ পরবর্তী কালত হিন্দু মুছলমান সংঘাতক কেন্দ্র করি বাংলা ভাষা, বাঙ্গালী জাতি আনকি বংগদেশতে উলম্ব বিভাজন।”৩ শুধু একটি তথ্যগত ভুল রয়েছে এই গোটা বক্তব্যে। ফার্সিকে বাংলার সরকারী ভাষা হিসেবে ব্রিটিশ তখন বলবৎ করেনি। এটি ছিলই সরকারি ভাষা ১৮৩৭ অব্দি। অর্থাৎ অসমে এবং উড়িষ্যাতে বাংলা ভাষা বলবৎ করবার পরের বছরেই শুধু বাংলাদেশে বাংলা বলবৎ হয়। এর পরেই ভাষাগুলো নিয়ে বিভ্রান্তি যেমন বাড়তে থাকে সেই বিভ্রান্তি দূর করতে গিয়ে ভাষা এবং ভাষাচিন্তার বিকাশও কিন্তু হতে থাকে দ্রুত গতিতে। অসমিয়া বাংলার উপভাষা কিনা, কিম্বা সিলেটি অসমিয়ার উপভাষা কিনা এই তর্কের গোড়ার কথাটিও কিন্তু এই ইতিহাস এবং ভাষারাজনীতি। এক দশকের ব্যবধানে প্রকাশিত রবিনসন এবং নাথান ব্রাউনের ব্যাকরণেই আমরা এই ভাষারাজনীতির প্রকট চেহারাটি দেখতে পাব। প্রথমজন ছিলেন কেরির অনুগত ব্রিটিশ মিশনারী। সুতরাং তাঁর বক্তব্য ছিল অসমিয়া হচ্ছে বাঙালি বামুনদের প্রচলিত বাংলারই ভিন্ন রূপ। দ্বিতীয়জন ব্রহ্মদেশ হয়ে অসমে আসা মার্কিন মিশনারী। প্রথমজন অসমের স্কুলে অসমিয়া ভাষা প্রচলনেরও তীব্রবিরোধী ছিলেন, দ্বিতীয়জন অসমিয়াকে প্রতিষ্ঠা দেবার লড়াই লড়েছিলেন। ৪ রবীন্দ্রনাথ নাথান ব্রাউনের ব্যাকরণের সঙ্গে পরিচিত থাকা সত্বেও প্রথম জীবনে অসমিয়ার স্বাতন্ত্র্য সম্পর্কে রবিনসনেরই অনুসারী ছিলেন।৫ এই ভাষারাজনীতির দৌড়ে যাদুরামকে ইচ্ছে করেই প্রায় লুকিয়ে ফেলা হলো। যার কিছু বিবরণ মেলে ‘অসমীয়া জাতীয় অভিধানে’র প্রথম খণ্ডে। আপাতত সেই বিষয় এক পাশে সরিয়ে রেখে আমরা এ পর্যন্ত ভাষাদুটোতে ভাষা নিয়ে যা কিছু চিন্তন এবং মনন হয়েছে তার এক সংক্ষিপ্ত ইতিবৃত্ত তুলে ধরবার চেষ্টা নেব।
রবিনসন নাথান ব্রাউনের অভিধান , ব্যাকরণ হয়ে ভাষাতত্ত্বে প্রবেশিকাঃ ভাষাচর্চার ধারাবাহিক ইতিহাস অসমিয়াতে একত্রে এখনো সুলভ নয়। বিভিন্ন বইয়ের ভূমিকা ইত্যাদিতে বিচ্ছিন্নভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। ড০ মৃণাল কুমার গগৈর মতো কেউ কেউ কোথাও কোথাও বিচ্ছিন্ন ভাবে সেই ইতিবৃত্ত নিয়ে অধ্যয়ন করেছেন।৬ শ্রীগগৈ আলোচনার সুবিধার্থে গোটা সময়টাকে তিন ভাগে ভাগ করে নিয়েছেন। ১)অসমত ভাষা অধ্যয়ন ( ১৮৩৬-১৮৭৩ খৃঃ), ২) ভাষাতত্ত্বমূলক অধ্যয়ন ( ১৮৭৪-১৯৪০), ৩) ভাষাবৈজ্ঞানিক অধ্যয়ন ( ১৯৪১—অদ্যাপি)
১৮৩৬টা তিনি শুরুর কাল ধরে নিয়েছেন কেন স্পষ্ট নয়। অসমে সরকারি ভাষা হিসেবে বাংলা চালু করবার হিসেব ধরলে হওয়া উচিত ছিল ১৮৩৩। এর পরে সংগঠিত ভাবে অসমিয়ার স্বাতন্ত্র্যবোধ জাগতে শুরু করে। কিন্তু আমরা ইতিমধ্যে দেখালাম বোধটা ছিল না নয়, আর অভিধান রচনার কালটা আসলে ১৭৯৫ থেকে শুরু। এই সময়ের মধ্যে তিনটি অভিধান অসমিয়া ভাষা নিয়ে লেখা হয়ে গেছে। ‘বর অম্র, লতি অম্রে’র কথা জানা সত্বেও তিনি হিসেব থেকে বাদ যে দিলেন তার কারণটি বুঝবার অপেক্ষা রাখে। যাদুরাম ডেকাবরুয়ার অভিধানের কথা আমরা লিখলামই। আর তাই আসলে ১৮৩৬ও নয়, ১৮৩৯এর উইলিয়াম রবিনসনের লেখা A Grammar of the Assamese Language বইটির কথাই আমাদের মনে আসে বেশি। প্রথম অসমিয়া ব্যাকরণ বলে এটিই এখন অব্দি খ্যাত। এটিও কিন্তু ছাপা হয়েছিল সেই শ্রীরামপুর মিশন কলকাতা থেকে। একদিকে যখন প্রশাসন বলে যাচ্ছিল অসমের ভাষা বাংলা, রবিনসন তাকেই সবল ভিত্তির উপর দাঁড় করাতে গেছিলেন। তাঁর সামনে আর কোনো আদর্শ ছিল না বলে তিনি প্রচলিত লাতিন ব্যাকরণ এবং কেরির বাংলা ব্যাকরণের আদর্শে বইটি রচনা করেন।
১৮৪৬এ শিবসাগর মিশন থেকে ‘অরুনোদয়’ কাগজ বের করে ব্রহ্মদেশ হয়ে অসমে আসা মার্কিন মিশনারীরা আন্তরিকতার সঙ্গে অসমিয়া ভাষার প্রচারে প্রসারে মন দিলেন। তাদের কাজগুলো কলকাতার শ্রীরামপুরের মিশনের মতোই আন্তরিক হলেও গুণগতভাবে স্বতন্ত্র ছিল। শ্রীরামপুরীদের মতো এরা সংস্কৃতকরণের দিকেও ঝোঁকেননি। এই কাগজটি করতে গিয়ে যেমন যেমন তাদের ভাষা চিন্তা দেখা দিচ্ছিল তেমন তেমন সেগুলো লিখিয়ে নিচ্ছিলেন নানাজনকে দিয়ে, আর নিজেরাও নেমে পড়েছিলেন ব্যাকরণ অভিধানের কাজে। নাথান ব্রাউন ১৮৪৮এ লিখলেন দ্বিতীয় ব্যাকরণ Grammatical Notices of the Assamese Language। এই বইটি Grammatical Notes on the Assamese Language নামেও মেলে। ১৮৯৩তে যখন পি এইচ মুর এর তৃতীয় সংশোধন করেন তখন এই নাম সহ অহেতুক অনেক বিষয় ছেটে ফেলেন, যার মধ্যে যাদুরাম ডেকাবরুয়া প্রসঙ্গও ছিল। যা পরবর্তী গবেষকদের কাছে এখনো বেশ সংগত ঊষ্মার কারণ হয়ে আছে। ব্রাউন যেভাবে শিবসাগর অঞ্চলের উপভাষাকে ভিত্তি করেছিলেন তাকে অনেকটাই শুধরে ফেলেছিলেন মুর। এ অনেকটাই বাংলার সাধুভাষা নির্মাণের মতো ব্যাপার। অকৃত্রিম বানান টানানও পালটে ফেলা হয়। তাতে অসমিয়াকে অনেকটাই অহেতুক বাংলার কাছাকাছি নিয়ে আসা হয় বলে অনেকেই সংগত অভিযোগ উত্থাপন করে থাকেন। ৭ অথচ, ব্যাকরণটির ভূমিকাতে ব্রাউন অসমিয়া ভাষাতত্ত্ব বিশেষ করে ধ্বনিতত্ত্ব নিয়ে বেশ গভীরে গিয়ে আলোচনা করে এক জায়গাতে বেশ গর্বের সঙ্গেই লিখেছিলেন, “ For beauty and softness the Assamese language is much superior to the Bengali”। গোলক চন্দ্র গোস্বামী এই বইটির সম্পর্কে লিখছিলেন, “...পরবর্তীকালর কুরি শতিকাৰ শেষার্দ্ধত খাচ অসমীয়া লোকে , পণ্ডিত সকলে লিখা বৈজ্ঞানিক বুলি দাবী করিবলৈ যোয়া কোনো এখন ব্যাকরনে তাক আজিলৈকে চের পেলাব পরা নাই।” ৮ আনন্দরাম ঢেকিয়াল ফুকন যিনি বাংলা, সংস্কৃত ভাষাতেও বেশ সুলেখক ছিলেন ১৮৫৫তে একটি ছোট্ট বই লেখেন A Native ছদ্মনামে। বইটির নাম, A Few Remarks on the Assamese Language and Vernacular Education in Assam. তার আগে ১৮৪৯তে আরো দুটি বই ছেপে বেরোয় । F. O. Poviottiর An Assamese Grammar with Vocabulary and Exercise. অন্যটি দেবেশ্বর চালিহার Origin and Growth of The Assamese Language. এগুলোর উদ্দেশ্য ছিল, সেই যাদুরাম ডেকাবরুয়ার মতোই অনসমীয়াদের অসমিয়া ভাষার সঙ্গে পরিচয় ঘটিয়ে দেয়া। কিন্তু সেযুগেই অসমিয়া ভাষার ইতিহাস লেখার প্রয়াস হচ্ছে এটি চালিহার বইটির নামেই স্পষ্ট।
কিন্তু যে ব্যাকরণ সেসময়ে লেখা হয়ে এখনো অসমিয়া ব্যাকরণ চিন্তাকে প্রবলভাবে প্রভাবিত করে যাচ্ছে সেটি হেমচন্দ্র বরুয়ার লেখা এবং ১৮৫৯তে প্রকাশিত ‘অসমীয়া ভাষার ব্যাকরণ’। এর দ্বিতীয় সংশোধিত সংস্করণ বেরোয় ১৮৭৩এ। এবং এখনো এটি অনেকের কাছেই অবশ্যপাঠ্য গ্রন্থ। ভাষাচার্য গোলক চন্দ্র গোস্বামী লিখেছেন এক জায়গাতে, “ হেমচন্দ্র বরুয়ার ব্যাকরণখনেই আছিল অসমীয়া ব্যাকরণর সুদৃঢ় আরু সুনির্মিত বুনিয়াদ...তেখেতর ব্যাকরণখনেই আছিল অসমীয়া ভাষার লিখা অসমীয়া ব্যাকরণর এটা প্রথম প্রধান আরু উল্লেখনীয় মাইলর খুঁটি।” ৯ । কিন্তু তিনি প্রচলিত ভাষাটির বিশ্লেষণের পরিবর্তে লিখিত অসমিয়ার রূপকে পরিশীলিত এবং মার্জিত করবার উপর গুরুত্ব দিয়েছিলেন। যে কাজগুলো তখন কিন্তু বাংলাতেও হচ্ছিল। তাঁর বিরুদ্ধেও আজকাল ভাষাটিকে সংস্কৃত এবং বাংলাগন্ধী করে ফেলবার অভিযোগও শোনা যায়।১০ ১৯০০তে প্রকাশিত তাঁর রচিত অভিধান ‘হেমকোষ’ যেটি গেল প্রায় এক শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে অসমিয়া লেখক, শিক্ষক, ছাত্র সমাজে প্রায় ‘বেদে’র মর্যাদা পেয়ে আসছে, যেটি এই এক শতাব্দী লিখিত ভাষাটিকে প্রায় শাসন করে গড়ে তুলেছে বললে অত্যুক্তি করা হয় না, সেটি সম্পর্কেই এই অভিযোগগুলো শোনা যাচ্ছে সম্প্রতি।
১৮৭৩এ অসমে প্রশাসনিক ভাষা হিসেবে অসমিয়া স্বীকৃতি পাবার সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যালয়গুলোতে এবং অফিস-কাছাড়িতে ব্যাকরণের চাহিদা হঠাৎ বেড়ে যায়। হেমচন্দ্রের ব্যাকরণটির সংশোধিত সংস্করণ বেরিয়েছিল সেই প্রেক্ষাপটে। ওই সময়ে আরো বেশ ক’টি ব্যাকরণও বেরিয়েছিল। যেমন ১৮৭৪এ দীনবন্ধু তর্কালঙ্কারের ‘অসমীয়া ল’রার ব্যাকরণ’, ১৮৮৭তে নারায়ণ শর্মা বিদ্যাভূষণের ‘আশুবোধ ব্যাকরণ’ ইত্যাদি আরো বেশ ক’টি । কিন্তু এগুলোর প্রায় সবক’টিই হেমচন্দ্রের ব্যাকরণকে অনুসরণ করে। মৌলিকতা বিশেষ আছে বলে পরবর্তী কেউ মনে করেন না। কিন্তু ঐ সময়ে আরো একটি বই অসমিয়া বাংলার তুলনামূলক আলোচনার জন্যে গুরুত্বপূর্ণ। ১৮৯৪তে সেটি লেখেন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জি এফ নিকল। বইটির নাম Manual of the Bengali Language Compromising a Bengali Grammar and Lessness with Various Appendix including Assamese Grammar . এই বইটির সন্ধান পাওয়া জরুরি। নামে মনে হয় এটিতে দুটো ভাষার তুলনামুলক অধ্যয়ন কিছু হয়েছিল। আমাদের মনে পড়বে এই বছরেই শুরু হয়ে গ্রিয়ার্সনের ভারতীয় ভাষা সমীক্ষার কাজ, শেষ হয়েছিল তিন দশক পরে ১৯২৮এ। এটির কথা সবাই জানেন বলে বিস্তৃত লিখছি না আর। ব্যাকরণের এর পরের দুটি গুরুত্বপূর্ণ রচনা হচ্ছে ১৯২৫এর সত্যেন্দ্রনাথ বরার ‘বহল ব্যাকরণ’। এই দুটিতে ব্যাকরণ রচনা ভাষাবিজ্ঞানকে স্পর্শ করছে গিয়ে। ভূমিকাতে সত্যেন্দ্রনাথ লিখেছেন, ব্যাকরণ ভাষা শেখায় না, ভাষাটিকে ছিঁড়ে ফুড়ে ভেতরের স্বরূপ চেনায়। ১১অন্য আরো দু’টি ১৯৩৩এ প্রকাশির শৰৎ চন্দ্রগোস্বামীৰ ‘সৰল ব্যাকৰণ’। রেফ চিহ্নের পর অসমিয়া বানানে ব্যঞ্জনের দ্বিত্ব পরিহার করবার ভাবনা তাঁর থেকেই প্রচলিত হতে শুরু করে। অন্যটি, ১৯৩৬এ প্রকাশিত কালীরাম মেধির Assamese Grammar and Origin of the Assamese Language.এর একটি অসমিয়া সংস্করণও রয়েছে ‘অসমীয়া ব্যাকরণ আৰু ভাষাতত্ত্ব।’ তিনিও সত্যেন্দ্রনাথের পথে হেঁটেছেন সেই সঙ্গে ঐতিহাসিক ভাষাবিজ্ঞান অধ্যনের দিকেও পা ফেলেছেন, অনেকটাই। অবশ্য বাণীকান্ত কাকতির বেশ আগেই গ্রীয়ার্সন এবং অধ্যাপক নিকলকে বাদ দিলে কোনো অসমিয়া বিজ্ঞানীর হাতে ঐতিহাসিক ভাষাবিজ্ঞানের সূচনা হয়েছিল দেবানন্দ ভঁরালীর ‘অসমীয়া ভাষার মৌলিক বিচার আরু সাহিত্যর চিনাকি’ (১৯১২) বইটি দিয়ে। কুড়ি বছর পরে এর এক সমৃদ্ধ দ্বিতীয় সংস্করণও বেরিয়েছিল। তিনিই প্রথম অসমিয়া ভাষার উৎপত্তি, ব্যাকরণের উপকরণের উৎপত্তি এসব নিয়ে ভাবেন এবং আধুনিক ব্যাকরণ কেমন হবে তার ধারণা দেবার প্রয়াস করেন। এর পরেই সত্যেন্দ্রনাথের ব্যাকরণটিও লেখা সম্ভব হয়ে উঠে। এঁরা তখনই গ্রীয়ার্সনের বইটি দেখেছিলেন বলে মনে হয় না। কারণ বইটি ছাপা যদিও শুরু হয়েছিল ১৯০৩এ সব ক’টা খণ্ডের কাজ শেষ হয়েছিল ১৯২৮এ।
১৮৩৬টা তিনি শুরুর কাল ধরে নিয়েছেন কেন স্পষ্ট নয়। অসমে সরকারি ভাষা হিসেবে বাংলা চালু করবার হিসেব ধরলে হওয়া উচিত ছিল ১৮৩৩। এর পরে সংগঠিত ভাবে অসমিয়ার স্বাতন্ত্র্যবোধ জাগতে শুরু করে। কিন্তু আমরা ইতিমধ্যে দেখালাম বোধটা ছিল না নয়, আর অভিধান রচনার কালটা আসলে ১৭৯৫ থেকে শুরু। এই সময়ের মধ্যে তিনটি অভিধান অসমিয়া ভাষা নিয়ে লেখা হয়ে গেছে। ‘বর অম্র, লতি অম্রে’র কথা জানা সত্বেও তিনি হিসেব থেকে বাদ যে দিলেন তার কারণটি বুঝবার অপেক্ষা রাখে। যাদুরাম ডেকাবরুয়ার অভিধানের কথা আমরা লিখলামই। আর তাই আসলে ১৮৩৬ও নয়, ১৮৩৯এর উইলিয়াম রবিনসনের লেখা A Grammar of the Assamese Language বইটির কথাই আমাদের মনে আসে বেশি। প্রথম অসমিয়া ব্যাকরণ বলে এটিই এখন অব্দি খ্যাত। এটিও কিন্তু ছাপা হয়েছিল সেই শ্রীরামপুর মিশন কলকাতা থেকে। একদিকে যখন প্রশাসন বলে যাচ্ছিল অসমের ভাষা বাংলা, রবিনসন তাকেই সবল ভিত্তির উপর দাঁড় করাতে গেছিলেন। তাঁর সামনে আর কোনো আদর্শ ছিল না বলে তিনি প্রচলিত লাতিন ব্যাকরণ এবং কেরির বাংলা ব্যাকরণের আদর্শে বইটি রচনা করেন।
১৮৪৬এ শিবসাগর মিশন থেকে ‘অরুনোদয়’ কাগজ বের করে ব্রহ্মদেশ হয়ে অসমে আসা মার্কিন মিশনারীরা আন্তরিকতার সঙ্গে অসমিয়া ভাষার প্রচারে প্রসারে মন দিলেন। তাদের কাজগুলো কলকাতার শ্রীরামপুরের মিশনের মতোই আন্তরিক হলেও গুণগতভাবে স্বতন্ত্র ছিল। শ্রীরামপুরীদের মতো এরা সংস্কৃতকরণের দিকেও ঝোঁকেননি। এই কাগজটি করতে গিয়ে যেমন যেমন তাদের ভাষা চিন্তা দেখা দিচ্ছিল তেমন তেমন সেগুলো লিখিয়ে নিচ্ছিলেন নানাজনকে দিয়ে, আর নিজেরাও নেমে পড়েছিলেন ব্যাকরণ অভিধানের কাজে। নাথান ব্রাউন ১৮৪৮এ লিখলেন দ্বিতীয় ব্যাকরণ Grammatical Notices of the Assamese Language। এই বইটি Grammatical Notes on the Assamese Language নামেও মেলে। ১৮৯৩তে যখন পি এইচ মুর এর তৃতীয় সংশোধন করেন তখন এই নাম সহ অহেতুক অনেক বিষয় ছেটে ফেলেন, যার মধ্যে যাদুরাম ডেকাবরুয়া প্রসঙ্গও ছিল। যা পরবর্তী গবেষকদের কাছে এখনো বেশ সংগত ঊষ্মার কারণ হয়ে আছে। ব্রাউন যেভাবে শিবসাগর অঞ্চলের উপভাষাকে ভিত্তি করেছিলেন তাকে অনেকটাই শুধরে ফেলেছিলেন মুর। এ অনেকটাই বাংলার সাধুভাষা নির্মাণের মতো ব্যাপার। অকৃত্রিম বানান টানানও পালটে ফেলা হয়। তাতে অসমিয়াকে অনেকটাই অহেতুক বাংলার কাছাকাছি নিয়ে আসা হয় বলে অনেকেই সংগত অভিযোগ উত্থাপন করে থাকেন। ৭ অথচ, ব্যাকরণটির ভূমিকাতে ব্রাউন অসমিয়া ভাষাতত্ত্ব বিশেষ করে ধ্বনিতত্ত্ব নিয়ে বেশ গভীরে গিয়ে আলোচনা করে এক জায়গাতে বেশ গর্বের সঙ্গেই লিখেছিলেন, “ For beauty and softness the Assamese language is much superior to the Bengali”। গোলক চন্দ্র গোস্বামী এই বইটির সম্পর্কে লিখছিলেন, “...পরবর্তীকালর কুরি শতিকাৰ শেষার্দ্ধত খাচ অসমীয়া লোকে , পণ্ডিত সকলে লিখা বৈজ্ঞানিক বুলি দাবী করিবলৈ যোয়া কোনো এখন ব্যাকরনে তাক আজিলৈকে চের পেলাব পরা নাই।” ৮ আনন্দরাম ঢেকিয়াল ফুকন যিনি বাংলা, সংস্কৃত ভাষাতেও বেশ সুলেখক ছিলেন ১৮৫৫তে একটি ছোট্ট বই লেখেন A Native ছদ্মনামে। বইটির নাম, A Few Remarks on the Assamese Language and Vernacular Education in Assam. তার আগে ১৮৪৯তে আরো দুটি বই ছেপে বেরোয় । F. O. Poviottiর An Assamese Grammar with Vocabulary and Exercise. অন্যটি দেবেশ্বর চালিহার Origin and Growth of The Assamese Language. এগুলোর উদ্দেশ্য ছিল, সেই যাদুরাম ডেকাবরুয়ার মতোই অনসমীয়াদের অসমিয়া ভাষার সঙ্গে পরিচয় ঘটিয়ে দেয়া। কিন্তু সেযুগেই অসমিয়া ভাষার ইতিহাস লেখার প্রয়াস হচ্ছে এটি চালিহার বইটির নামেই স্পষ্ট।
কিন্তু যে ব্যাকরণ সেসময়ে লেখা হয়ে এখনো অসমিয়া ব্যাকরণ চিন্তাকে প্রবলভাবে প্রভাবিত করে যাচ্ছে সেটি হেমচন্দ্র বরুয়ার লেখা এবং ১৮৫৯তে প্রকাশিত ‘অসমীয়া ভাষার ব্যাকরণ’। এর দ্বিতীয় সংশোধিত সংস্করণ বেরোয় ১৮৭৩এ। এবং এখনো এটি অনেকের কাছেই অবশ্যপাঠ্য গ্রন্থ। ভাষাচার্য গোলক চন্দ্র গোস্বামী লিখেছেন এক জায়গাতে, “ হেমচন্দ্র বরুয়ার ব্যাকরণখনেই আছিল অসমীয়া ব্যাকরণর সুদৃঢ় আরু সুনির্মিত বুনিয়াদ...তেখেতর ব্যাকরণখনেই আছিল অসমীয়া ভাষার লিখা অসমীয়া ব্যাকরণর এটা প্রথম প্রধান আরু উল্লেখনীয় মাইলর খুঁটি।” ৯ । কিন্তু তিনি প্রচলিত ভাষাটির বিশ্লেষণের পরিবর্তে লিখিত অসমিয়ার রূপকে পরিশীলিত এবং মার্জিত করবার উপর গুরুত্ব দিয়েছিলেন। যে কাজগুলো তখন কিন্তু বাংলাতেও হচ্ছিল। তাঁর বিরুদ্ধেও আজকাল ভাষাটিকে সংস্কৃত এবং বাংলাগন্ধী করে ফেলবার অভিযোগও শোনা যায়।১০ ১৯০০তে প্রকাশিত তাঁর রচিত অভিধান ‘হেমকোষ’ যেটি গেল প্রায় এক শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে অসমিয়া লেখক, শিক্ষক, ছাত্র সমাজে প্রায় ‘বেদে’র মর্যাদা পেয়ে আসছে, যেটি এই এক শতাব্দী লিখিত ভাষাটিকে প্রায় শাসন করে গড়ে তুলেছে বললে অত্যুক্তি করা হয় না, সেটি সম্পর্কেই এই অভিযোগগুলো শোনা যাচ্ছে সম্প্রতি।
১৮৭৩এ অসমে প্রশাসনিক ভাষা হিসেবে অসমিয়া স্বীকৃতি পাবার সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যালয়গুলোতে এবং অফিস-কাছাড়িতে ব্যাকরণের চাহিদা হঠাৎ বেড়ে যায়। হেমচন্দ্রের ব্যাকরণটির সংশোধিত সংস্করণ বেরিয়েছিল সেই প্রেক্ষাপটে। ওই সময়ে আরো বেশ ক’টি ব্যাকরণও বেরিয়েছিল। যেমন ১৮৭৪এ দীনবন্ধু তর্কালঙ্কারের ‘অসমীয়া ল’রার ব্যাকরণ’, ১৮৮৭তে নারায়ণ শর্মা বিদ্যাভূষণের ‘আশুবোধ ব্যাকরণ’ ইত্যাদি আরো বেশ ক’টি । কিন্তু এগুলোর প্রায় সবক’টিই হেমচন্দ্রের ব্যাকরণকে অনুসরণ করে। মৌলিকতা বিশেষ আছে বলে পরবর্তী কেউ মনে করেন না। কিন্তু ঐ সময়ে আরো একটি বই অসমিয়া বাংলার তুলনামূলক আলোচনার জন্যে গুরুত্বপূর্ণ। ১৮৯৪তে সেটি লেখেন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জি এফ নিকল। বইটির নাম Manual of the Bengali Language Compromising a Bengali Grammar and Lessness with Various Appendix including Assamese Grammar . এই বইটির সন্ধান পাওয়া জরুরি। নামে মনে হয় এটিতে দুটো ভাষার তুলনামুলক অধ্যয়ন কিছু হয়েছিল। আমাদের মনে পড়বে এই বছরেই শুরু হয়ে গ্রিয়ার্সনের ভারতীয় ভাষা সমীক্ষার কাজ, শেষ হয়েছিল তিন দশক পরে ১৯২৮এ। এটির কথা সবাই জানেন বলে বিস্তৃত লিখছি না আর। ব্যাকরণের এর পরের দুটি গুরুত্বপূর্ণ রচনা হচ্ছে ১৯২৫এর সত্যেন্দ্রনাথ বরার ‘বহল ব্যাকরণ’। এই দুটিতে ব্যাকরণ রচনা ভাষাবিজ্ঞানকে স্পর্শ করছে গিয়ে। ভূমিকাতে সত্যেন্দ্রনাথ লিখেছেন, ব্যাকরণ ভাষা শেখায় না, ভাষাটিকে ছিঁড়ে ফুড়ে ভেতরের স্বরূপ চেনায়। ১১অন্য আরো দু’টি ১৯৩৩এ প্রকাশির শৰৎ চন্দ্রগোস্বামীৰ ‘সৰল ব্যাকৰণ’। রেফ চিহ্নের পর অসমিয়া বানানে ব্যঞ্জনের দ্বিত্ব পরিহার করবার ভাবনা তাঁর থেকেই প্রচলিত হতে শুরু করে। অন্যটি, ১৯৩৬এ প্রকাশিত কালীরাম মেধির Assamese Grammar and Origin of the Assamese Language.এর একটি অসমিয়া সংস্করণও রয়েছে ‘অসমীয়া ব্যাকরণ আৰু ভাষাতত্ত্ব।’ তিনিও সত্যেন্দ্রনাথের পথে হেঁটেছেন সেই সঙ্গে ঐতিহাসিক ভাষাবিজ্ঞান অধ্যনের দিকেও পা ফেলেছেন, অনেকটাই। অবশ্য বাণীকান্ত কাকতির বেশ আগেই গ্রীয়ার্সন এবং অধ্যাপক নিকলকে বাদ দিলে কোনো অসমিয়া বিজ্ঞানীর হাতে ঐতিহাসিক ভাষাবিজ্ঞানের সূচনা হয়েছিল দেবানন্দ ভঁরালীর ‘অসমীয়া ভাষার মৌলিক বিচার আরু সাহিত্যর চিনাকি’ (১৯১২) বইটি দিয়ে। কুড়ি বছর পরে এর এক সমৃদ্ধ দ্বিতীয় সংস্করণও বেরিয়েছিল। তিনিই প্রথম অসমিয়া ভাষার উৎপত্তি, ব্যাকরণের উপকরণের উৎপত্তি এসব নিয়ে ভাবেন এবং আধুনিক ব্যাকরণ কেমন হবে তার ধারণা দেবার প্রয়াস করেন। এর পরেই সত্যেন্দ্রনাথের ব্যাকরণটিও লেখা সম্ভব হয়ে উঠে। এঁরা তখনই গ্রীয়ার্সনের বইটি দেখেছিলেন বলে মনে হয় না। কারণ বইটি ছাপা যদিও শুরু হয়েছিল ১৯০৩এ সব ক’টা খণ্ডের কাজ শেষ হয়েছিল ১৯২৮এ।
ঐতিহাসিক ভাষাবিজ্ঞানের পথে পাঃ এই অব্দি সময়টাকে আমরা মোটা দাগে ব্যাকরণ, অভিধান চর্চার সময় বলে আলাদা করতে পারি। ১৯৪১এ বাণীকান্ত কাকতির বহুখ্যাত Assamese : its formation and Development বইটি বেরুবার সঙ্গে সঙ্গে চিত্রটি একেবারেই পালটে যায়। যেমন পালটে যায় সুনীতি চট্টোপাধ্যায়ের বিখাত ODBL বেরুবার সঙ্গে সঙ্গে বাংলা ভাষাবিজ্ঞান চর্চার ইতিহাস। কিন্তু মাঝখানে আমাদের বাংলাতে যেমন ‘বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ’ এবং সেই সূত্রে রবীন্দ্রনাথ, রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী, হরপ্রসাদ শাস্ত্রীদের ভাষাবিজ্ঞান চর্চার কথা ভুললে চলবে না। তেমনি অসমে সেই বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের শাখা গড়বার প্রয়াস এবং পরে কামরূপ অনুসন্ধান সমিতি তথা অসম সাহিত্য সভা গড়ে ওঠা, এবং সেই সঙ্গে ভাষার সমাজবিজ্ঞান বা সামাজিক ভাষাতত্ত্ব নিয়ে যেসব আন্দোলন এবং লেখালেখি হচ্ছিল সেগুলোর কথাও আসলে মনে রাখতে হবে। মনে রাখতে হবে লক্ষ্মীনাথ বেজবরুয়া, পদ্মনাথ ভট্টাচার্য বিদ্যাবিনোদ, পদ্মনাথ গোহাঞি বৰুৱাদের বিভিন্ন আন্দোলন, গবেষণা এবং অনুসন্ধানের কথা। যেগুলো ছাড়া আসলে বাণীকান্ত কাকতির আবির্ভাব রহস্য এবং গুরুত্ব অনুধাবন করা মুস্কিল হবে। উদাহরণ স্বরূপ আমরা, অসম সাহিত্য সভার প্রাক্তন সভাপতি বেণুধর রাজখোয়ার Notes on the Sylhetee Dialect বইটির কথাই উল্লেখ করতে পারি। যেটিতে তিনি সিলেটিকে অসমিয়া ভাষা বলে প্রথম দাবী করেন এবং এক দীর্ঘ ঔপভাষিক বা ভাষারাজনৈতিক বিতর্কের সূচনা করেন। সম্ভবত উপভাষাতত্ত্ব নিয়ে এইটিই প্রথম কোনো গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ। এর আগে আমরা কয়েকটি অভিধানে উপভাষাকে গুরুত্বদেবার কথা উত্থাপন করেছি। কিন্তু সেগুলো ছিল অভিধান বা ব্যাকরণ মাত্র । বেনুধর রাজখোয়ার বইটি এখন আলাদাভাবে দুষ্প্রাপ্য। কিন্তু নানান ভাষাবিদের রচনাতে তার প্রচুর উল্লেখ থাকাতে অনেকটাই পুনরুদ্ধার সম্ভব। এবং যথাসময়ে আমাদের তা করতে হবে।
বাণীকান্ত কাকতির পথ অনুসরণ করে কিন্তু তাঁকে অতিক্রম করে পরের দশকে বিরিঞ্চি কুমার বরুয়া লেখেন ‘ভাষা আরু সংস্কৃতি’ । ১৯৫৭তে বইটি প্রকাশ পায়। একই বছরে বেরোয় ডিম্বেশ্বর নেওগের New Light on the history of Growth of Assamese Language বইটি। এর অনেক বছর পর আমরা ঐতিহাসিক ভাষাবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে লেখা আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ বই পাচ্ছি ১৮৮৫তে লেখা বিশ্বেশ্বর হাজারিকার Assamese language: Origin and Development । দাবি করা হয়, এই তিনটি বেশ তথ্য এবং তত্ত্ব সমৃদ্ধ অসমিয়া ভাষার ইতিহাসের গ্রন্থ।
বাণীকান্ত কাকতির পথ অনুসরণ করে কিন্তু তাঁকে অতিক্রম করে পরের দশকে বিরিঞ্চি কুমার বরুয়া লেখেন ‘ভাষা আরু সংস্কৃতি’ । ১৯৫৭তে বইটি প্রকাশ পায়। একই বছরে বেরোয় ডিম্বেশ্বর নেওগের New Light on the history of Growth of Assamese Language বইটি। এর অনেক বছর পর আমরা ঐতিহাসিক ভাষাবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে লেখা আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ বই পাচ্ছি ১৮৮৫তে লেখা বিশ্বেশ্বর হাজারিকার Assamese language: Origin and Development । দাবি করা হয়, এই তিনটি বেশ তথ্য এবং তত্ত্ব সমৃদ্ধ অসমিয়া ভাষার ইতিহাসের গ্রন্থ।
ভাষাতত্ত্ব থেকে ভাষাবিজ্ঞানে উত্তরণঃ ব্যাকরণ , অভিধান রচনার নতুন ধারাঃ এই সময়ের মধ্যেও ব্যাকরণ রচনার ধারা অব্যাহত ছিল। প্রায় সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ ভাষাতাত্ত্বিক এক একখানা ব্যাকরণ লিখলেও কে সঠিক ব্যাকরণ লিখতে পারলেন এই নিয়ে তর্কও বাংলার মতোই তীব্র ছিল। ডিম্বেশ্বর নেওগ, উপেন্দ্রনাথ গোস্বামী, ভগবান মরল, বাপচন্দ্র মহন্তের মতো খ্যাতনামা ভাষাবিজ্ঞানীরাও ব্যাকরণ রচনাতে হাত দিয়েছিলেন। কিন্তু ১৯৭২এ লেখা গোলক চন্দ্র গোস্বামীর ‘অসমীয়া গোলক ব্যাকরণ- সুবোধ এবং প্রবোধ ভাগ’ খুব ধীরে হলেও অসমিয়া ভাষা চিন্তার জগৎখানাই পালটে দেয়। ১৯৮৭তে প্রকাশিত তাঁর আরো একখানা গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ ‘অসমীয়া ব্যাকরণর মৌলিক বিচার।( প্রথম ভাগ)’ । ২০০০এ তৃতীয় আরেকখানা লেখেন ‘অসমীয়া ব্যাকরণ প্রবেশ’। ব্যাকরণ রচনাতে গতানুগতিক পথে যারা হাঁটছিলেন তাদের প্রায় প্রত্যককেই এক প্রত্যাহ্বানের মুখে ঠেলে দেয় তাঁর এই বইগুলো এবং অন্যান্য ভাষাবৈজ্ঞানিক রচনা। ১৯৫৬তে প্রকাশিত দেবানন্দ ভঁরালির A study of Phonology and Vocabulary the Assamese Language বইটিতে আধুনিক ভাষাবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে অসমিয়া ধ্বনিতত্ত্ব এবং শব্দভাণ্ডার নিয়ে অধ্যয়নের সূচনা হয়েছিল যদিও সিদ্ধি জুটেছিল ভাষাচার্য গোলক চন্দ্র গোস্বামীর ১৯৬৬তে লেখা An Introduction of Assamese Phonology বইটিতেই। অসমিয়া ভাষা চিন্তাতে তাঁর প্রভাব এতোটাই সুদূর প্রসারী হলো যে দেবব্রত শর্মার মুখ্য সম্পাদনাতে ২০১০এর ১ জানুয়ারী থেকে পরের তিন বছরে কয়েক হাজার পৃষ্ঠার চারটি সুবৃহৎ খণ্ডে বেরিয়ে ‘অসমীয়া জাতীয় অভিধান’ রীতিমত এক জাতীয় ভাষা আন্দোলনের জন্ম দিয়ে দিয়েছে সমগ্র অসমে। এর শুধু শেষ খন্ডটিরই পৃষ্ঠা সংখ্যা ১৭০০! যার প্রায় দ্বিতীয় কোনো তুলনা সমগ্র ভারতে আমাদের মনে পড়ে না। রবীন্দ্রনাথ যে সামগ্রিক বাংলা অভিধানের স্বপ্ন দেখেছিলেন সেরকমতো ভারতে হয়েছে বলে শুনিনি, কিম্বা মহম্মদ শহীদুল্লাহ যেভাবে বাংলা দেশের আঞ্চলিক ভাষার অভিধান রচনা করেছিলেন বা করিয়েছিলেন সেটিও রাষ্ট্রীয় বাধ্যবাধকতার জন্যে সামগ্রিক বাংলার অভিধান হয়ে উঠতে পারল না। অসমিয়াতে সেটিই সম্ভব করে তুললেন দুই অধ্যাপক মদন শর্মা এবং দেবব্রত শর্মার নেতৃত্বে ‘অসমীয়া জাতীয় প্রকাশনে’র এক বিশাল ভাষাকর্মী বৃন্দ। এঁদের মূল ভাষাচিন্তার গুরু কিন্তু ভাষাচার্য গোলক চন্দ্র গোস্বামী। যিনি গুয়াহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম যুগে বাংলাও পড়িয়েছেন এবং পারিবারিক সূত্রে ধর্মবিপ্লবী শ্রীচৈতন্যের পরিবারের উত্তর পুরুষ। অর্থাৎ কোথাও স্রোতের বিরুদ্ধে হাঁটার প্রেরণা তিনি পরিবার থেকে পেলেও পেতে পারেন। ভাষাচার্যের পরে থেকেই মূলত অসমিয়া ভাষা তথা ব্যাকরণ চর্চাতে আধুনিক ভাষাবৈজ্ঞানিক চিন্তা গুরুত্ব পেতে শুরু করে। নামে ব্যাকরণ হলেও অনেক গুলো বই আসলে ভাষাবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে অসমিয়া ভাষার স্বরূপ বিশ্লেষণ। যেমন ১৯৯১তে প্রকাশিত দীপ্তিফুকন পাটগিরির ‘আধুনিক অসমীয়া ব্যাকরণ’, কিম্বা ঐ একই বছরে নরনারায়ণ শর্মার ‘অসমীয়া ভাষার রূপতত্ত্ব আরু ব্যাকরণ’, কিম্বা ১৯৯৫তে প্রকাশিত রুণিমা চৌধুরীর Assamese Verbs: A study in the Structural Paradigm. এই সারিতে সবচে গুরুত্বপূর্ণ এবং সম্মানিত গ্রন্থ বোধকরি ভীমকান্ত বরুয়ার ১৯৯৬তে প্রকাশিত ‘অসমীয়া ভাষা’ বইটি।
ভাষাতত্ত্ব থেকে ভাষাবিজ্ঞানে উত্তরণঃ তাত্ত্বিক অনুসন্ধানঃ বস্তুত এই সময়েই অসমিয়া ভাষাতে ভাষাবিজ্ঞান চর্চারও জোয়ার আসে ।আধুনিক বর্ণনামূলক ভাষাবিজ্ঞানের চর্চা ভারতীয় বাংলাতেও সত্তর আশির দশকের আগে খুব বেশি হয় নি। সস্যুরকে না জেনেই আগেই রবীন্দ্রনাথের হাতে বর্ণনামূলক ভাষাবিজ্ঞানের সূচনা হলেও পরবর্তী প্রায় সবাই হাঁটছিলেন সুনীতি কুমার, সুকুমার সেনের পথ ধরে। বোধ করি ১৯৮৪ নাগাদ প্রকাশিত রামেশ্বর শ’-এর ‘সাধারণ ভাষাবিজ্ঞান ও বাংলা ভাষা’ বইতেই প্রথম ভাষাবিজ্ঞানের তাত্ত্বিক দিকগুলোর সঙ্গে আমাদের পরিচয় ঘটিয়ে দেন। ১২ বরং বাংলাদেশ এই নিয়ে যে এগিয়েছিল এই কথা তিনি নিজেও যেমন লিখেছেন তেমনি সমর্থণ করেছেন হুমায়ুন আজাদ তাঁর দু’খন্ডের ‘বাংলা ভাষা’ সংকলনের ভূমিকাতে ।১৩ অসমিয়াতে এই তাত্ত্বিক চর্চাটি আগেই শুরু হয়েছিল। উপেন্দ্র নাথ গোস্বামীর ‘ভাষাবিজ্ঞান’ ( ১৯৭৬) বইটি দিয়ে। এই পথে পরে লিখেছেন ফণীন্দ্র নারায়ণ দত্তবরুয়া ‘আধুনিক ভাষাবিজ্ঞান পরিচয়’( ১৯৯০); ভাগবান মরলের ভাষার্থ বিজ্ঞান (১৯৮৮); রমেশ পাঠকের ‘ভাষা বিজ্ঞান ভূমিকা’( ১৯৮৫), ব্যাকরণ আরু প্রাকৃতি বিজ্ঞান’ ( প্রকৃতি নয় –লেখক) ( ১৯৮৮), দীপ্তি ফুকন পাটগিরির ‘ভাষাতত্ত্ব’ ( ১৯৯১) এবং ভাষাতত্ত্বর বিচিত্র কথা’( ১৯৯৬); দীপঙ্কর মরলের ‘উপভাষা বিজ্ঞান’( ১৯৯১) । এছাড়াও কটন কলেজের শতবার্ষিকীতে প্রকাশিত ‘চিন্তন আরু মনন (২০০০) এবং নাহেন্দ্র পাদুন সম্পাদিত দু’খানা প্রবন্ধ সংকলনের একটি ‘ভাষার তত্ত্বকথা’ ( ১৯৯৩) এবং ‘চিন্তা-প্রবাহ’ ( ১৯৯৬-৯৭) সাক্ষ্য দেয় যে ভাষা বিজ্ঞানের একেবারে শেষচিন্তা চমস্কি এবং চমস্কি উত্তর বিকাশের ধারা নিয়েও অসমিয়া ভাষাকর্মীরা রীতিমত চিন্তিত , মানে ওয়াকিবহাল।
ভাষাতত্ত্ব থেকে ভাষাবিজ্ঞানে উত্তরণঃ উপভাষাবিজ্ঞান এবং তুলনামূলক অধ্যয়নে মনোনিবেশঃ : উপভাষা চর্চাদিয়েই অসমিয়া অভিধানের যাত্রা শুরু হয়েছিল সেই ১৭৯৫তে। বা বেণুধর রাজখোয়ার Notes on the Sylhetee Dialect বইটির কথা আমরা আগেই উল্লেখ করেছি। এমন দু’চারটি বই খবর করলে এদিকে ওদিকে আরো পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু যথার্থ ভাষাবৈজ্ঞানিক উপভাষাচর্চারও সূচনা করেন উপেন্দ্রনাথ গোস্বামী ১৯৭০এ তাঁর A Study on Kamrupi: A Dialect of Assamese বইটির মধ্যি দিয়ে। এই ধারাতে পরের গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন হলো দীপঙ্কর মরলের Phonology of Assamese Dialect: contemporary Standard and Mayong ( 1992); ধীরেন্দ্র নাথ দাসের The Dialect of Goalpara and Kamrupi: A comparative Analysis (1999), বিভা ভঁরালীর ‘কামরূপী উপভাষাঃএটি অধ্যয়ন’( ২০০৪) এবং জীবন চন্দ্র পাঠকের ‘দরঙী উপভাষা অধ্যয়ন’ (২০০৫)। বোঝাই যাচ্ছে এখনো উপভাষাগুলোর এক বিশাল ক্ষেত্র অনধিত থেকে গেছে। যদিও ২০০৯তে প্রকাশিত উপেন রাভা হাকাচামের ‘অসমীয়া আরু অসমর ভাষা-উপভাষা’ বইটি এই বিষয়টি নিয়ে এক উল্লম্ফন বলে বিবেচিত হতে পারে। বইটিতে তিনি অসমিয়ার সমস্ত স্বীকৃত উপভাষার আলোচনা করেছেন। এমন কি স্বীকৃত/ অস্বীকৃত উপভাষার তালিকাতে হাজং, বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি (মায়াং)এর আলোচনাও যেমন সেরে নিয়েছেন অসমিয়ার জাতিগত/সামাজিক শ্রেণিগত উপভাষার তালিকা ধরে ঝাড়খণ্ডি আদিবাসীদের, ময়মন সিংহ মূলীয়দের সঙ্গে সিলেটির আলোচনাও করেছেন। সেদিক থেকে এই বইটির বিষয় বৈচিত্র এবং এবং অধ্যয়ন ক্ষেত্র অনেক ব্যাপক।
উপভাষা অধ্যয়নের পাশাপাশি উপেন রাভা হাকাচামের এই বইটি অবশ্য ১৯৭৭এ প্রমোদ চন্দ্র ভট্টাচার্য প্রতিবেশি ভাষাগুলো, বিশেষ করে ভোটবর্মী ভাষাগুলো অধ্যয়নের যে ধারার সূচনা করেছিলেন সেই ধারাতেও এক গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন। তিনি অসমিয়ার সঙ্গে প্রতিবেশি ভোটবর্মী ভাষাগুলোরও এক বিস্তৃত আলোচনা করেছেন। এই বিষয়ে তাঁর আরেকটি স্বতন্ত্র বইএর নাম ‘অসমীয়া আরু অসমর তিব্বত-বর্মীয় ভাষা ’(২০০০) । ১৯৯৭তে গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে করা তাঁর গবেষণা সন্দর্ভের নামই ছিল “Rabha and Assamese Language: A Comparative Study” সুতরাং আমাদের পরবর্তী অসমিয়া বাংলা ভাষা এবং উপভাষাগুলোর যে কোনো অধ্যয়নেও এই নবীন ভাষাবিজ্ঞানীকে বারে বারে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে মনে রাখতে হবে। এটি এর জন্যেও যে বাংলাতে সেই ১৯৫১তে ‘কিরাত জনকৃতি’ দিয়ে সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় যে মহান কাজটির সূচনা করেছিলেন তাও অসমের মাটিতে যোরহাট জগন্নাথ বরুয়া কলেজের এক সম্মেলন বসে, বিচ্ছিন্ন কিছু কাজবাদ দিলে তাঁর আর প্রায় কোনো গুরুত্বপুর্ণ উত্তরাধিকার নেই। অথচ, অসম তথা পূর্ববাংলাতে প্রচলিত বাংলা ভাষার অধ্যয়নে এই দিকটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি অধ্যয়নের বিষয় বলে বিবেচিত হওয়াই উচিত।
অসমিয়াতে ১৯৮৮র সত্যেন্দ্রনারায়ণ গোস্বামীর Studies in Sino-Tibetan Language , ভীমকান্ত বরুয়ার ‘অসমর ভাষা’( ১৯৯০), একই লেখকের Nagamese : The Language of Nagaland ( ১৯৯৩), উপেন্দ্রনাথ গোস্বামীর An introduction to the Deuri Language ( 1994), এম আর বড়োর The Bodo Structure (1991), টাবু টাইডের A Dictionary of the Missing Language (1995), অপর্ণা কোঁওরের Karbi People and Their Language: A Critical Study (1991) ইত্যাদি বইগুলোর প্রত্যেকটিই এই ভোট-বর্মী ভাষাগুলো বা তাদের মধ্যে প্রচলিত নাগামীজের মতো আর্যভাষাগুলোর অধ্যয়ন করেছে ব্যাপক গভীরে গিয়ে।
সেই যাদুরাম ডেকাবরুয়ার অভিধানেই অসমিয়া-বাংলার তুলনামূলক অধ্যয়নের সূচনা হয়েছিল। এর পরে প্রায় কোনো অসমিয়া ভাষা বিজ্ঞানের বই নেই যেখানে কোনো না কোনো ভাবে বাংলা ভাষার প্রসঙ্গ আসেনি। বাণীকান্ত কাকতির বিখ্যাত গবেষণা গ্রন্থটিতেতো বটেই। সে অবশ্যি বাংলা ভাষাতত্ত্বের বই সম্পর্কেও সত্য। বাংলাতে সম্ভবত অসমিয়া ভাষাতত্ত্ব চর্চার শুরু করেন রবীন্দ্রনাথ । তাঁর ‘শব্দতত্ত্ব’ বইতে ‘ভাষাবিচ্ছেদ’ ছাড়াও ‘বাংলা বহুবচন’ প্রবন্ধে তার স্বাক্ষ্য রয়েছে। সুনীতি চট্টোপাধ্যায় তাঁর বিখ্যাত গবেষণা গ্রন্থটিতে সেই কাজ করেছেন বেশ গভীরে প্রবেশ করেই। তাঁর ছাত্রই ছিলেন বাণীকান্ত। সাহিত্যের ইতিহাসও লেখা সম্ভব হয় নি বাংলা অসমিয়া ওড়িয়া ইত্যাদি মাগধি অপভ্রংশজাত ভাষাগুলোর তুলনামূলক আলোচনা ছাড়া। বিশেষ করে চর্যাপদ এবং শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের মতো গ্রন্থগুলো আলোচনাতেতো বটেই। অসমিয়া জাতীয়তা নিয়ে যেকোন আলোচনাতেও বাংলা প্রসঙ্গ এসেই থাকে। যেগুলো বাংলা সম্পর্কে অসমিয়া ভাষাবিজ্ঞানী বা তাত্ত্বিকদের দৃষ্টিভঙ্গীগুলোকে বুঝতে সাহায্য করবে। আমরা তা করব পরে যথাসময়ে। কিন্তু ১৯৭৮এ ফণীন্দ্র কুমার দত্তবরুয়ার গবেষণাগ্রন্থ A Comparative Analysis of the Morphological Aspects of Assamese and Oriya –তে যেন বিশেষ জোর দিয়েই আলাদা করে প্রতিবেশী আর্যভাষাগুলো নিয়ে ভাষাবৈজ্ঞানিক অধ্যয়ন শুরু হলো। তেমনি আরেকটি সুপরিচিত বই দীপ্তি ফুকন পাটগিরির ‘অসমীয়া বাংলা আরু উরিয়া ভাষা’ (২০০৪)।ভারতীয় আর্যভাষাগুলোর স্তরগুলো নিয়ে তুলনামূলক আলোচনার জন্যে দু’টো গুরুত্বপূর্ণগ্রন্থ নগেন ঠাকুরের ‘পালি প্রাকৃত অপভ্রংশ ভাষা আরু সাহিত্য’ ( ১৯৯২) এবং সুবাসনা মহন্তর ‘ভারতীয় আর্যভাষার পরম্পরাত উদ্ভবকালীন অসমীয়া ভাষার গঠন। (২০০০) এ ছাড়াও, বিশ্বজিৎ দাস এবং ফুকন চন্দ্র বসুমতারীর সম্পাদনাতে ২০১০এ প্রকাশিত ‘অসমিয়া এবং অসমর ভাষা’ নামের সংকলন গ্রন্থটিও এই সারিতে এক নতুন সংযোজন।
ভাষাতত্ত্ব থেকে ভাষাবিজ্ঞানে উত্তরণঃ তাত্ত্বিক অনুসন্ধানঃ বস্তুত এই সময়েই অসমিয়া ভাষাতে ভাষাবিজ্ঞান চর্চারও জোয়ার আসে ।আধুনিক বর্ণনামূলক ভাষাবিজ্ঞানের চর্চা ভারতীয় বাংলাতেও সত্তর আশির দশকের আগে খুব বেশি হয় নি। সস্যুরকে না জেনেই আগেই রবীন্দ্রনাথের হাতে বর্ণনামূলক ভাষাবিজ্ঞানের সূচনা হলেও পরবর্তী প্রায় সবাই হাঁটছিলেন সুনীতি কুমার, সুকুমার সেনের পথ ধরে। বোধ করি ১৯৮৪ নাগাদ প্রকাশিত রামেশ্বর শ’-এর ‘সাধারণ ভাষাবিজ্ঞান ও বাংলা ভাষা’ বইতেই প্রথম ভাষাবিজ্ঞানের তাত্ত্বিক দিকগুলোর সঙ্গে আমাদের পরিচয় ঘটিয়ে দেন। ১২ বরং বাংলাদেশ এই নিয়ে যে এগিয়েছিল এই কথা তিনি নিজেও যেমন লিখেছেন তেমনি সমর্থণ করেছেন হুমায়ুন আজাদ তাঁর দু’খন্ডের ‘বাংলা ভাষা’ সংকলনের ভূমিকাতে ।১৩ অসমিয়াতে এই তাত্ত্বিক চর্চাটি আগেই শুরু হয়েছিল। উপেন্দ্র নাথ গোস্বামীর ‘ভাষাবিজ্ঞান’ ( ১৯৭৬) বইটি দিয়ে। এই পথে পরে লিখেছেন ফণীন্দ্র নারায়ণ দত্তবরুয়া ‘আধুনিক ভাষাবিজ্ঞান পরিচয়’( ১৯৯০); ভাগবান মরলের ভাষার্থ বিজ্ঞান (১৯৮৮); রমেশ পাঠকের ‘ভাষা বিজ্ঞান ভূমিকা’( ১৯৮৫), ব্যাকরণ আরু প্রাকৃতি বিজ্ঞান’ ( প্রকৃতি নয় –লেখক) ( ১৯৮৮), দীপ্তি ফুকন পাটগিরির ‘ভাষাতত্ত্ব’ ( ১৯৯১) এবং ভাষাতত্ত্বর বিচিত্র কথা’( ১৯৯৬); দীপঙ্কর মরলের ‘উপভাষা বিজ্ঞান’( ১৯৯১) । এছাড়াও কটন কলেজের শতবার্ষিকীতে প্রকাশিত ‘চিন্তন আরু মনন (২০০০) এবং নাহেন্দ্র পাদুন সম্পাদিত দু’খানা প্রবন্ধ সংকলনের একটি ‘ভাষার তত্ত্বকথা’ ( ১৯৯৩) এবং ‘চিন্তা-প্রবাহ’ ( ১৯৯৬-৯৭) সাক্ষ্য দেয় যে ভাষা বিজ্ঞানের একেবারে শেষচিন্তা চমস্কি এবং চমস্কি উত্তর বিকাশের ধারা নিয়েও অসমিয়া ভাষাকর্মীরা রীতিমত চিন্তিত , মানে ওয়াকিবহাল।
ভাষাতত্ত্ব থেকে ভাষাবিজ্ঞানে উত্তরণঃ উপভাষাবিজ্ঞান এবং তুলনামূলক অধ্যয়নে মনোনিবেশঃ : উপভাষা চর্চাদিয়েই অসমিয়া অভিধানের যাত্রা শুরু হয়েছিল সেই ১৭৯৫তে। বা বেণুধর রাজখোয়ার Notes on the Sylhetee Dialect বইটির কথা আমরা আগেই উল্লেখ করেছি। এমন দু’চারটি বই খবর করলে এদিকে ওদিকে আরো পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু যথার্থ ভাষাবৈজ্ঞানিক উপভাষাচর্চারও সূচনা করেন উপেন্দ্রনাথ গোস্বামী ১৯৭০এ তাঁর A Study on Kamrupi: A Dialect of Assamese বইটির মধ্যি দিয়ে। এই ধারাতে পরের গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন হলো দীপঙ্কর মরলের Phonology of Assamese Dialect: contemporary Standard and Mayong ( 1992); ধীরেন্দ্র নাথ দাসের The Dialect of Goalpara and Kamrupi: A comparative Analysis (1999), বিভা ভঁরালীর ‘কামরূপী উপভাষাঃএটি অধ্যয়ন’( ২০০৪) এবং জীবন চন্দ্র পাঠকের ‘দরঙী উপভাষা অধ্যয়ন’ (২০০৫)। বোঝাই যাচ্ছে এখনো উপভাষাগুলোর এক বিশাল ক্ষেত্র অনধিত থেকে গেছে। যদিও ২০০৯তে প্রকাশিত উপেন রাভা হাকাচামের ‘অসমীয়া আরু অসমর ভাষা-উপভাষা’ বইটি এই বিষয়টি নিয়ে এক উল্লম্ফন বলে বিবেচিত হতে পারে। বইটিতে তিনি অসমিয়ার সমস্ত স্বীকৃত উপভাষার আলোচনা করেছেন। এমন কি স্বীকৃত/ অস্বীকৃত উপভাষার তালিকাতে হাজং, বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি (মায়াং)এর আলোচনাও যেমন সেরে নিয়েছেন অসমিয়ার জাতিগত/সামাজিক শ্রেণিগত উপভাষার তালিকা ধরে ঝাড়খণ্ডি আদিবাসীদের, ময়মন সিংহ মূলীয়দের সঙ্গে সিলেটির আলোচনাও করেছেন। সেদিক থেকে এই বইটির বিষয় বৈচিত্র এবং এবং অধ্যয়ন ক্ষেত্র অনেক ব্যাপক।
উপভাষা অধ্যয়নের পাশাপাশি উপেন রাভা হাকাচামের এই বইটি অবশ্য ১৯৭৭এ প্রমোদ চন্দ্র ভট্টাচার্য প্রতিবেশি ভাষাগুলো, বিশেষ করে ভোটবর্মী ভাষাগুলো অধ্যয়নের যে ধারার সূচনা করেছিলেন সেই ধারাতেও এক গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন। তিনি অসমিয়ার সঙ্গে প্রতিবেশি ভোটবর্মী ভাষাগুলোরও এক বিস্তৃত আলোচনা করেছেন। এই বিষয়ে তাঁর আরেকটি স্বতন্ত্র বইএর নাম ‘অসমীয়া আরু অসমর তিব্বত-বর্মীয় ভাষা ’(২০০০) । ১৯৯৭তে গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে করা তাঁর গবেষণা সন্দর্ভের নামই ছিল “Rabha and Assamese Language: A Comparative Study” সুতরাং আমাদের পরবর্তী অসমিয়া বাংলা ভাষা এবং উপভাষাগুলোর যে কোনো অধ্যয়নেও এই নবীন ভাষাবিজ্ঞানীকে বারে বারে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে মনে রাখতে হবে। এটি এর জন্যেও যে বাংলাতে সেই ১৯৫১তে ‘কিরাত জনকৃতি’ দিয়ে সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় যে মহান কাজটির সূচনা করেছিলেন তাও অসমের মাটিতে যোরহাট জগন্নাথ বরুয়া কলেজের এক সম্মেলন বসে, বিচ্ছিন্ন কিছু কাজবাদ দিলে তাঁর আর প্রায় কোনো গুরুত্বপুর্ণ উত্তরাধিকার নেই। অথচ, অসম তথা পূর্ববাংলাতে প্রচলিত বাংলা ভাষার অধ্যয়নে এই দিকটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি অধ্যয়নের বিষয় বলে বিবেচিত হওয়াই উচিত।
অসমিয়াতে ১৯৮৮র সত্যেন্দ্রনারায়ণ গোস্বামীর Studies in Sino-Tibetan Language , ভীমকান্ত বরুয়ার ‘অসমর ভাষা’( ১৯৯০), একই লেখকের Nagamese : The Language of Nagaland ( ১৯৯৩), উপেন্দ্রনাথ গোস্বামীর An introduction to the Deuri Language ( 1994), এম আর বড়োর The Bodo Structure (1991), টাবু টাইডের A Dictionary of the Missing Language (1995), অপর্ণা কোঁওরের Karbi People and Their Language: A Critical Study (1991) ইত্যাদি বইগুলোর প্রত্যেকটিই এই ভোট-বর্মী ভাষাগুলো বা তাদের মধ্যে প্রচলিত নাগামীজের মতো আর্যভাষাগুলোর অধ্যয়ন করেছে ব্যাপক গভীরে গিয়ে।
সেই যাদুরাম ডেকাবরুয়ার অভিধানেই অসমিয়া-বাংলার তুলনামূলক অধ্যয়নের সূচনা হয়েছিল। এর পরে প্রায় কোনো অসমিয়া ভাষা বিজ্ঞানের বই নেই যেখানে কোনো না কোনো ভাবে বাংলা ভাষার প্রসঙ্গ আসেনি। বাণীকান্ত কাকতির বিখ্যাত গবেষণা গ্রন্থটিতেতো বটেই। সে অবশ্যি বাংলা ভাষাতত্ত্বের বই সম্পর্কেও সত্য। বাংলাতে সম্ভবত অসমিয়া ভাষাতত্ত্ব চর্চার শুরু করেন রবীন্দ্রনাথ । তাঁর ‘শব্দতত্ত্ব’ বইতে ‘ভাষাবিচ্ছেদ’ ছাড়াও ‘বাংলা বহুবচন’ প্রবন্ধে তার স্বাক্ষ্য রয়েছে। সুনীতি চট্টোপাধ্যায় তাঁর বিখ্যাত গবেষণা গ্রন্থটিতে সেই কাজ করেছেন বেশ গভীরে প্রবেশ করেই। তাঁর ছাত্রই ছিলেন বাণীকান্ত। সাহিত্যের ইতিহাসও লেখা সম্ভব হয় নি বাংলা অসমিয়া ওড়িয়া ইত্যাদি মাগধি অপভ্রংশজাত ভাষাগুলোর তুলনামূলক আলোচনা ছাড়া। বিশেষ করে চর্যাপদ এবং শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের মতো গ্রন্থগুলো আলোচনাতেতো বটেই। অসমিয়া জাতীয়তা নিয়ে যেকোন আলোচনাতেও বাংলা প্রসঙ্গ এসেই থাকে। যেগুলো বাংলা সম্পর্কে অসমিয়া ভাষাবিজ্ঞানী বা তাত্ত্বিকদের দৃষ্টিভঙ্গীগুলোকে বুঝতে সাহায্য করবে। আমরা তা করব পরে যথাসময়ে। কিন্তু ১৯৭৮এ ফণীন্দ্র কুমার দত্তবরুয়ার গবেষণাগ্রন্থ A Comparative Analysis of the Morphological Aspects of Assamese and Oriya –তে যেন বিশেষ জোর দিয়েই আলাদা করে প্রতিবেশী আর্যভাষাগুলো নিয়ে ভাষাবৈজ্ঞানিক অধ্যয়ন শুরু হলো। তেমনি আরেকটি সুপরিচিত বই দীপ্তি ফুকন পাটগিরির ‘অসমীয়া বাংলা আরু উরিয়া ভাষা’ (২০০৪)।ভারতীয় আর্যভাষাগুলোর স্তরগুলো নিয়ে তুলনামূলক আলোচনার জন্যে দু’টো গুরুত্বপূর্ণগ্রন্থ নগেন ঠাকুরের ‘পালি প্রাকৃত অপভ্রংশ ভাষা আরু সাহিত্য’ ( ১৯৯২) এবং সুবাসনা মহন্তর ‘ভারতীয় আর্যভাষার পরম্পরাত উদ্ভবকালীন অসমীয়া ভাষার গঠন। (২০০০) এ ছাড়াও, বিশ্বজিৎ দাস এবং ফুকন চন্দ্র বসুমতারীর সম্পাদনাতে ২০১০এ প্রকাশিত ‘অসমিয়া এবং অসমর ভাষা’ নামের সংকলন গ্রন্থটিও এই সারিতে এক নতুন সংযোজন।
এখনো বাকি বহু পথ হাঁটাঃ পুরো আলোচনাকে গুটিয়ে আনলে আমরা দেখব অসমিয়া ভাষা চর্চার শুরুটা অসমিয়াদের হাতেই। উপভাষার চর্চা দিয়েই। রবিনসনের ব্যাকরণ যে ভাষাকে বাংলা করে তুলতে চাইছিল নাথান ব্রাউনের ব্যাকরণ তাকে আবার স্রোতে দাঁড় করালো। কিন্তু ব্রাউনের ব্যাকরণে মূরের হস্তক্ষেপ থেকে বোঝা যায় রবিনসনের ধারাটিও সমানে সজীব ছিল। পরবর্তীতে হেমচন্দ্র বরুয়া নিজের লেখা ব্যাকরণ এবং অভিধানে অসমিয়ার স্বাতন্ত্র্যকে আরো প্রতিষ্ঠা দিলেন। অসমিয়ার প্রচারেও তিনি ছিলেন আন্তরিক। তাঁর আদর্শ এতোটাই প্রতিষ্ঠা পায় যে পরবর্তী প্রায় এক শতাব্দী তা অসমিয়া লিখিত ভাষাকে রীতিমত শাসন করে। অতি সম্প্রতিই শুধু ভাষাবিজ্ঞানী গোলকচন্দ্র গোস্বামী, উপেন্দ্রনাথ গোস্বামী, ভীম কান্ত বরুয়া, রমেশ পাঠক, অপর্ণা কোয়রদের যুগেই তাঁর বিরুদ্ধে সংস্কৃত এবং বাংলাকে অনুসরণ করবার অভিযোগ উঠছে। হেমচন্দ্র বরুয়ার ১৯০০তে মৃত্যুর তিনবছরের মধ্যেই বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের আন্দোলন শুরু হয়েছিল। যার ঢেউ অভিবক্ত অসমেও পৌঁছেছিল। এখানেও এর শাখা গড়ে তুলবার আয়োজন চলছিল। যার পরিণতি একদিকে ছিল কামরূপ অনুসন্ধান সমিতি অন্যদিকে অসম সাহিত্য সভার সূচনা। তাই সত্যেন্দ্রনাথের ‘বহল ব্যাকরণে’র মতো গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থও লেখা হয়েছিল যা ছিল নির্দেশ দেবার বিপরীতে ভাষার নিয়ম অনুসন্ধানের প্রথম প্রয়াস। দেবানন্দ ভঁরালীর ‘অসমীয়া ভাষার মৌলিক বিচার আরু সাহিত্যর চিনাকি’ (১৯১২) বইটি দিয়ে ঐতিহাসিক ভাষাবিজ্ঞানের সূচনাও এই পরিবেশেই সম্ভব হয়েছিল।
অন্যদিকে ভাষাতত্ত্বের চর্চাতে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নে অসমিয়া ভাষাবিজ্ঞানীরা কিন্তু বাঙালি বিশেষ করে ভারতীয় বাঙালিদের থেকে এগিয়ে পা ফেলেছেন। টেঙাই পণ্ডিত বা রুচিনাথ কামরূপীর সময় কোনো বাঙালি অভিধান রচনাতে হাত দেন নি, আর কোনো সাহেবও অসমে পা ফেলেন নি। গোলক চন্দ্রগোস্বামী, উপেন্দ্রনাথ গোস্বামীরা যখন আধুনিক বর্ণনামূলক ভাষাবিজ্ঞান চর্চা করছেন ভারতীয় বাঙালিরা তখন সুনীতি চট্টোপাধ্যায়, সুকুমার সেনের শাসনে ‘পরাধীন’, স্বাধীন পদক্ষেপ নেবার কথা ভাবছেনই না। ভোট-বর্মী ভাষাগুলোতে ‘কিরাত জনকৃতি’র পথে বাঙালিরা বিশেষ পা বাড়াননি। অতি সম্প্রতি উত্তর বাংলা বা ত্রিপুরাতে কিছু অধ্যয়নের সংবাদ পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু অসমিয়াতে এই শাখার অধ্যয়ন বহুদূর এগিয়ে গেছে।
তারপরেও এটি ঠিক যে ব্যাকরণ এবং অভিধান বাক্যতত্ত্ব নিয়ে, উপভাষাগুলো নিয়ে, অনসমীয়া আর্য, অনার্য ভাষাগুলো নিয়ে সুগভীর কাজকর্ম এখনো অনেক করার আছে। ঐ সেদিন ২০১০এ গ্রেগরি এণ্ডার্সন, ডেভিড হ্যারিসন এবং গণেশ মুর্মুর নেতৃত্বাধীন এক গবেষক দল অরুণাচল প্রদেশে ‘কোরো’ বলে এক নতুন ভাষা খুঁজে বের করলেন। এমন প্রচুর কাজ এখানে অসমিয়া, বাংলা , হিন্দি যেকোনো ভাষাতেই করবার বাকি আছে। উজান অসমের বিভিন্ন জেলার অসমিয়া ভাষাবৈচিত্রগুলো নিয়ে অধ্যয়ন প্রায় নেইই। বাংলার সঙ্গে অসমিয়ার তুলনামূলক অধ্যয়ন এখনো গভীরে গিয়ে প্রবেশ করে নি। সাধুবাংলা বা কলকাতার মান বাংলার সঙ্গে অসমিয়ার সম্পর্ক তুলনা করতে গিয়ে প্রতিবেশি বাংলা উপভাষা নিয়ে অনেক সত্যই আড়ালে থেকে যায়, যেগুলোর অনুসন্ধান হয়তো দুটো ভাষার সম্পর্কেই অনেক নতুন তথ্য এবং সত্যের মুখোমুখি করতে পারত। উপেন রাভা হাকাচাম ‘অসমীয়া আরু অসমর ভাষা-উপভাষা’ বইয়ের মুখবন্ধে অসমের বেশ কিছু সামাজিক শ্রেণি উপভাষার নাম করেছেন , “নেপালী সকলর নেপালী- অসমীয়া, অভিবাসী সম্প্রদায়র উজানী (দেশী) আরু ভাটিয়া (ময়মন সিঙীয়া) অসমীয়া, কাছারর বাঙালীসকলর চিলেটীয়া (কাছারীয়) অসমীয়া, অভিজাত আরু শিক্ষিত বাঙালী পরিয়ালর ঔপনিবেশিক অসমীয়া (ব্রিটিছর দিনত মফচলীয় আমোলাপট্টিত আরু সম্প্রতি রেলোয়ে কলনিত এনে ভাষার নমুনা পোয়া যায়) ,নগর-মহানগর কেন্দ্রিক মাড়োয়ারী সম্প্রদায়র হিন্দী মিশ্রিত বজরুয়া অসমীয়া (broken Assamese), কুলি-নাপিত-ধোবা-রিক্সাওয়ালা আদি বৃত্তিজীবি লোকর দেশোয়ালী অসমীয়া ইত্যাদি এই শ্রেণীর অসমীয়ারূপে অতি সম্প্রতি বহুভাষিক অসমীয়া মাতৃভাষী চাকরিজীবি ,ব্যবসায়, গৃহীণী আরু ছাত্র-ছাত্রীকো প্রভাবান্বিত করি 'চলতি অসমীয়া' বা 'জনপ্রিয় অসমীয়া ভাষা'র প্রচলনত ইন্ধন যোগাইছে।”১৪ এর থেকে স্পষ্ট তিনি ‘চিলেটীয়া অসমীয়া’দের ‘অসমীয়া মাতৃভাষী’দের সঙ্গে একাকার করছেন না। বরং সিলেটিকে অসমের ভাষা অর্থেই অসমিয়া বলছেন। তাহলে এই ভাষাগুলোকে তিনি উপভাষা কেন বলছেন এই প্রশ্ন উঠতেই পারে । এই প্রশ্নও অনুসন্ধানের বিষয় হতে পারে যে মূল অধ্যায়ে তিনি মারোয়াড়ি বা ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার রেলওয়ে কলোনির বাংলাকে নিয়ে আলোচনা করতে উৎসাহ দেখালেন না কেন? শুধু তিনিই নন, প্রায় কোনো অসমিয়া ভাষাবিদকেই এদের নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা করতে দেখা যাবে না। এগুলো না করবার ফলে বিভ্রান্তি কেমন বাড়ে তার আরেকটি নজির প্রখ্যাত অসমিয়া ভাষাবিদ অধ্যাপক ড০ রমেশ পাঠকের এই মন্তব্য। তিনি এক্কেবারে সন তারিখ দিয়ে দাবি করেছেন , “ চিলেটর ভাষার সৈতে অসমীয়া ভাষার সম্পর্ক বর্তমান অবস্থাত বিচারিবলৈ যোয়াটো পর্বতত কাছকণী বিচারিবলৈ যোৱাৰ দরে হ’ব, কারণ বাংলা ভাষাই চিলেটী ভাষার রূপ এনেদরে সলাই পেলাইছে যে চিলেটী এতিয়া বাংলা ভাষারে আঞ্চলিক রূপ মাথোন। অথচ, ১৯১৩ চনলৈকে চিলেটী ভাষা অসমীয়া ভাষার সৈতে অদ্ভূৎ ধরণে মিলিছিল। ... ১৯১৩ চনত ওলোয়া বেণুধর রাজখোয়ার Notes on Sylhetee Dialect বোলা গ্রন্থখনর পরা তথ্যবোর দিয়া হৈছে। ...”১৫তার মানে ১৯১৩তে যেহেতু বেনুধর রাজখোয়ার বইটি বেরিয়েছিল সুতরাং ওই পর্যন্ত ভাষাটি প্রায় অসমিয়াই ছিল। তার পর থেকে একে বাংলা গ্রাস করেছে । এরকম ভাষাগ্রাস করা সম্ভব কিনা, সিলেটির মধ্যে আদৌ তেমন অস্বাভাবিক কিছু পরিবর্তন হয়েছে কিনা এই সব ভাষাতাত্ত্বিক প্রশ্ন এক পাশে সরিয়ে রেখেও যে বিপজ্জনক আশঙ্কাটি তাঁর লেখাতেও স্পষ্ট যে এমন ভাষাতত্ত্ব অহেতুক সাধারণ অসমিয়াদের মনে বাংলা সম্পর্কে এক আতঙ্ককে লালন করতে সাহায্য করে। ড০ রমেশ পাঠকেরও মন্তব্যেরই মাঝের অংশে রয়েছে, “ চিলেটত যি ঘটিছিল বা ঘটিল তেনে ঘটনার প্রক্রিয়া কাছারতো আরম্ভ হৈছে...।” আমরা কিন্তু এখনো ড০ রমেশ পাঠকের মতো এতোটা হতাশ হয়ে মনে করিনা যে সিলেটির সঙ্গে অসমিয়ার সম্পর্ক সন্ধান করতে যাওয়াটা পর্বতে কচ্ছপের ডিম সন্ধানের মতো ব্যাপার।এতোটা মৌলিক পরিবর্তন দুই ভাষার কোনোটিরই ঘটেনি। তার সঠিক স্বরূপ তুলে ধরতে আমাদের ব্রিটিশ কিম্বা বর্তমান অসমের মানচিত্রের বাইরে বেরুতে হবে । প্রাচীন কামরূপের মানচিত্র, তথা ব্রহ্মপুত্র নদীর সমগ্র দক্ষিণ পূর্ব তীর অনুসরণ করতে হবে।
ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার বাংলা নিয়ে এখনো প্রায় কোনো কাজ নেই অসমিয়াতে। বাংলাতেও নেই। সাদ্রি ভাষার সম্পর্কে কিছু অনুসন্ধান হয়ে থাকলেও সাওঁতালি,মুণ্ডারি কিম্বা খাসিয়ার মতো পূর্বোত্তরীয় জীবন্ত অষ্ট্রমূলীয় ভাষা সম্পর্কে অধ্যয়নও অনেক নতুন আলোর সন্ধান দিতে পারত। ভীমকান্ত বরুয়ার ‘অসমর ভাষা’তে পূর্বোত্তরের সমস্ত ভাষা নিয়েও আলোচনা আছে।১৬ মণিপুরি থেকে ককবরক। নাগামিজ এবং নেফামিজ নিয়ে ইনি অন্যতম বিশেষজ্ঞ পূর্বোত্তরে। কিন্তু মেঘালয়ের ভাষা প্রসঙ্গেও তিনি খাসি ভাষা নিয়ে আমরা সুনীতি চট্টপাধ্যায় বা বাণীকান্ত কাকতির দিন থেকে যা জেনে এসছি তার থেকে একটিও বেশি বাক্য ব্যয় করেন নি । অথচ ক্ষুদ্র হলেও খাসিয়া কিন্তু বর্তমান অসমেরও একটি গুরুত্বপূর্ণ ভাষা। রাষ্ট্রীয় এবং ভৌগোলিক বিচ্ছিন্নতার প্রাকৃতিক পরিবেশ যেমন এগুলোর পথে বাঁধা, তেমনি ভাষারাজনৈতিক পরিবেশও জটিলতা বাড়িয়ে রেখেছে। সেই পরিবেশ কাটিয়ে উঠতেও ভাষার অধ্যয়ন এক অন্যতম উপায় বলে বিবেচিত হতেই পারে। বিজ্ঞানবোধের সঙ্গে জাতীয়তাবাদী ধ্যানধারণার সংঘাত বেঁধে যাবার ভয়েও অনেকে অধ্যয়নে বিরত থাকেন। এই কথা অসমিয়ার সম্পর্কেতোও বটেই , বাংলার সম্পর্কেও সমান সত্য।
--- --- ---- ---
১১-০৯-২০১২; শিলচরে শেষ।
--- --- ---- ---
উল্লেখপঞ্জিঃ
১) সম্পাদকীয় আগকথা; অসমীয়া জাতীয় অভিধান, ১ম খন্ড, অসমীয়া জাতীয় অভিধানঃ বৃহত্তর আরু মহত্তর অসমীয়া জাতি গঠনর অভিজ্ঞান; সম্পাদনা ড০ দেবব্রত শর্মা; অসম জাতীয় প্রকাশ; যোরহাট; ২০১০; পৃঃ২৪
২) ড০ প্রফুল্ল মহন্ত; অসমীয়া মধ্যবিত্ত শ্রেণির ইতিহাস; পৃঃ ১৯২ ।
৩) সম্পাদকীয় আগকথা;অসমীয়া জাতীয় অভিধান, ১ম খন্ড, অসমীয়া জাতীয় অভিধানঃ বৃহত্তর আরু মহত্তর অসমীয়া জাতি গঠনর অভিজ্ঞান; সম্পাদনা ড০ দেবব্রত শর্মা; অসম জাতীয় প্রকাশ; যোরহাট; ২০১০; পৃঃ ৮।
৪) অসমীয়া ভাষাত রবিন্সন আরু ব্রাউনর ব্যাকরণঃ লক্ষ্য আরু উদ্দেশ্য; অসমীয়া ভাষা; ড০ ভীমকান্ত বরুয়া;বনলতা, ডিব্রুগড়; পৃঃ১৫৭ ।
৫) ভাষাবিচ্ছেদ; শব্দতত্ত্ব; রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর; রবীন্দ্ররচনাবলী; ১২৫তম জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে প্রকাশিত সুলভ সংস্করণ, বিশ্বভারতী; ১৯৮৫।
৬) অসমত ভাষা অধ্যয়নর ইতিহাসঃ এটি আভাস;ভাষা বিজ্ঞান আরু অসমীয়া ভাষার পরিচয়;শরাই ঘাট প্রিন্টার্স প্রকাশন, গুয়াহাটি;২০০৭; পৃঃ৯২।
৭)সম্পাদকীয় আগকথা;অসমীয়া জাতীয় অভিধান, ১ম খন্ড, অসমীয়া জাতীয় অভিধানঃ বৃহত্তর আরু মহত্তর অসমীয়া জাতি গঠনর অভিজ্ঞান; সম্পাদনা ড০ দেবব্রত শর্মা; অসম জাতীয় প্রকাশ, যোরহাট, ২০১০; পৃঃ২৫ ।
৮ ) গোলক চন্দ্র গোস্বামী;অসমীয়া ব্যাকৰণৰ মৌলিক বিচাৰ ; ১৯৮৭, পৃঃ ১০ ।
৯) ঐ; অসমীয়া ব্যাকরণর মৌলিক বিচার, পৃঃ ২৫৪।
১০) ড০ ভগবান মৰল, অসমীয়া জাতীয় অভিধান আৰু বিকল্প বানান, আমাৰ অসম, ৯ মার্চ, ২০১০; অ জা অ-২য় খণ্ডে পুনঃমূদ্রিত; পৃঃ৩৫ ।
১১) সত্যেন্দ্রনাথ বরা, বহল ব্যাকরণ, পৃঃ ০।
১২) ভাষাবিজ্ঞানে সাম্প্রতিক গবেষণার গতিপ্রকৃতি ; ‘সাধারণ ভাষাবিজ্ঞান ও বাংলা ভাষা; রামেশ্বর শ’; পুস্তক বিপণি; কলকাতা০৯; ১৩৯০ বাংলা; পৃঃ ৭১০ ।
১৩) হুমায়ুন আজাদ; অবতরণিকাঃ বাঙলা ভাষাতত্ত্ব [ ১৭৪৩-১৯৮৩];বাঙলা ভাষা, ১ম খন্ড; সম্পাদক, হুমায়ুন আজাদ;আগামী প্রকাশনী ঢাকা;সংশোধিত দ্বিতীয় সংস্করণ, আগষ্ট ২০০২; পৃঃ১০১ ।
১৪) উপেন রাভা হাকাচাম; উত্তর-পূর্বাঞ্চলর ভাষাগত ক্ষেত্রত অসমর ভাষাসমূহর সহ-অবস্থান আরু অসমীয়া ভাষার সমৃদ্ধি সাধনত ইবিলাকর ভূমিকা; ১ম অধ্যায়; অসমীয়া আরু অসমর ভাষা-উপভাষা;জ্যোতিপ্রকাশন; গুয়াহাটি-০১;জুলাই ২০০৯; পৃঃ ৩।
১৫) ড০ রমেশ পাঠক; উপভাষা বিজ্ঞানের ভূমিকা; পৃঃ ১৫৯ ।
১৬) ভীমকান্ত বরুয়া; অসমর ভাষা;৫ম পরিবর্ধিত সংস্করণ;জানুয়ারি ২০১০; বনলতা, ডিব্রুগড়।
গ্রন্থপঞ্জিঃ
১) ড০ উপেন রাভা হাকাচাম, অসমীয়া আরু অসমর তিব্বত-বর্মীয় ভাষা; প্রকাশিকা, মঞ্জুলা রাভা হাকাচামজাক; ধূপধরা, গোয়ালপাড়া; ৩য় সংশোধিত সংস্করণ, এপ্রিল ২০০৭।
২) ড০ উপেন রাভা হাকাচাম, অসমীয়া আরু অসমর ভাষা উপভাষা; জ্যোতি প্রকাশন, গুয়াহাটি; জুলাই ২০০৯।
৩) সুকুমার সেন; ভাষার ইতিবৃত্ত; আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, তৃতীয় আনন্দ সংস্করণ,নভেম্বর, ১৯৯৪।
৪) জগন্নাথ চক্রবর্তী; বরাক উপত্যকার আঞ্চলিক বাংলা ভাষার অভিধান ও ভাষাতত্ত্ব; ভাষা সংস্কৃতি আকাদেমি, হাফলং,অসম; বৈশাখ ১৪১২।
৫) পবিত্র সরকার; ভাষাপ্রেম ভাষাবিরোধ; দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা; জানুয়ারি ২০০৩।
৬) রামেশ্বর শ'; সাধারণ ভাষাবিজ্ঞান ও বাংলাভাষা; পুস্তক বিপণি, কলকাতা; অখণ্ড দ্বিতীয় সংস্করণ, শ্রাবণ ১৩৯৯।
৭ ) অতীন্দ্র মজুমদার; ভাষাতত্ত্ব; নয়া প্রকাশ, কলকাতা; দ্বিতীয় সংস্করণ, ১৯৮৭।
৮) নীহার রঞ্জন রায়; বাঙালির ইতিহাস-আদি পর্ব; দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা; বৈশাখ ১৪০০।
৯) উপেন্দ্র চন্দ্র গুহ; কাছাড়ের ইতিবৃত্ত; অসম প্রকাশন পরিষদ, গুয়াহাটি; দ্বিতীয় সংস্করণ অক্টোবর ২০০৪।
১০) ড০ সুজিত চৌধুরী; শ্রীহট্ট কাছাড়ের প্রাচীন ইতিহাস ; দিনকাল প্রেস লিমিটেড, শিলচর; ২০০৬
১১) Suniti Kumar Chatterji; The Origin and Development of the Bengali Language; Rupa & Co, Kolkata;1993.
১২) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর; রবীন্দ্ররচনাবলী; ১২৫তম জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে প্রকাশিত সুলভ সংস্করণ, বিশ্বভারতী; ১৯৮৫।
১৩ ) ড০ দেবব্রত শর্মা; অসমীয়া জাতি গঠন প্রক্রিয়া আরু জাতীয় জনগোষ্ঠীগত অনুষ্ঠান সমূহ; একলব্য প্রকশন, যোরহাট; ফেব্রুয়ারি, ২০০৭
১৪) ড০ প্রফুল্ল মহন্ত; অসমীয়া মধ্যবিত্ত শ্রেণির ইতিহাস; লয়ার্স বুক ষ্টল, গুয়াহাটি; ২০০৯।
১৫) ড০ বাণীকান্ত কাকতি; অসমিয়া ভাষার গঠন আরু বিকাশ; ড০ বাণীকান্ত কাকতি জন্ম শতবার্ষিকী উদযাপন সমিতি, বরপেটা; অক্টোবর ১৯৯৬।
১৬) ড০ সুজিত চৌধুরী; প্রবন্ধ একাদশ, সম্পাদনাঃ জয়দীপ বিশ্বাস; অক্ষর পাবলিকেশনস, আগরতলা/ কলকাতা; ২০১০।
১৭) সঞ্জীব দেবলস্কর ; প্রসঙ্গ সিলেটি ভাষা; বাঙালনামা ঃ দ্বিতীয় বর্ষ, দ্বিতীয় সংখ্যা ;http://bangalnama.wordpress.com/2010/09/13/prasango-sylheti-bhasha/
১৮) G. A. Grierson; Linguistic Survey of India; http://www.joao-roiz.jp/LSI/
অন্যদিকে ভাষাতত্ত্বের চর্চাতে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নে অসমিয়া ভাষাবিজ্ঞানীরা কিন্তু বাঙালি বিশেষ করে ভারতীয় বাঙালিদের থেকে এগিয়ে পা ফেলেছেন। টেঙাই পণ্ডিত বা রুচিনাথ কামরূপীর সময় কোনো বাঙালি অভিধান রচনাতে হাত দেন নি, আর কোনো সাহেবও অসমে পা ফেলেন নি। গোলক চন্দ্রগোস্বামী, উপেন্দ্রনাথ গোস্বামীরা যখন আধুনিক বর্ণনামূলক ভাষাবিজ্ঞান চর্চা করছেন ভারতীয় বাঙালিরা তখন সুনীতি চট্টোপাধ্যায়, সুকুমার সেনের শাসনে ‘পরাধীন’, স্বাধীন পদক্ষেপ নেবার কথা ভাবছেনই না। ভোট-বর্মী ভাষাগুলোতে ‘কিরাত জনকৃতি’র পথে বাঙালিরা বিশেষ পা বাড়াননি। অতি সম্প্রতি উত্তর বাংলা বা ত্রিপুরাতে কিছু অধ্যয়নের সংবাদ পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু অসমিয়াতে এই শাখার অধ্যয়ন বহুদূর এগিয়ে গেছে।
তারপরেও এটি ঠিক যে ব্যাকরণ এবং অভিধান বাক্যতত্ত্ব নিয়ে, উপভাষাগুলো নিয়ে, অনসমীয়া আর্য, অনার্য ভাষাগুলো নিয়ে সুগভীর কাজকর্ম এখনো অনেক করার আছে। ঐ সেদিন ২০১০এ গ্রেগরি এণ্ডার্সন, ডেভিড হ্যারিসন এবং গণেশ মুর্মুর নেতৃত্বাধীন এক গবেষক দল অরুণাচল প্রদেশে ‘কোরো’ বলে এক নতুন ভাষা খুঁজে বের করলেন। এমন প্রচুর কাজ এখানে অসমিয়া, বাংলা , হিন্দি যেকোনো ভাষাতেই করবার বাকি আছে। উজান অসমের বিভিন্ন জেলার অসমিয়া ভাষাবৈচিত্রগুলো নিয়ে অধ্যয়ন প্রায় নেইই। বাংলার সঙ্গে অসমিয়ার তুলনামূলক অধ্যয়ন এখনো গভীরে গিয়ে প্রবেশ করে নি। সাধুবাংলা বা কলকাতার মান বাংলার সঙ্গে অসমিয়ার সম্পর্ক তুলনা করতে গিয়ে প্রতিবেশি বাংলা উপভাষা নিয়ে অনেক সত্যই আড়ালে থেকে যায়, যেগুলোর অনুসন্ধান হয়তো দুটো ভাষার সম্পর্কেই অনেক নতুন তথ্য এবং সত্যের মুখোমুখি করতে পারত। উপেন রাভা হাকাচাম ‘অসমীয়া আরু অসমর ভাষা-উপভাষা’ বইয়ের মুখবন্ধে অসমের বেশ কিছু সামাজিক শ্রেণি উপভাষার নাম করেছেন , “নেপালী সকলর নেপালী- অসমীয়া, অভিবাসী সম্প্রদায়র উজানী (দেশী) আরু ভাটিয়া (ময়মন সিঙীয়া) অসমীয়া, কাছারর বাঙালীসকলর চিলেটীয়া (কাছারীয়) অসমীয়া, অভিজাত আরু শিক্ষিত বাঙালী পরিয়ালর ঔপনিবেশিক অসমীয়া (ব্রিটিছর দিনত মফচলীয় আমোলাপট্টিত আরু সম্প্রতি রেলোয়ে কলনিত এনে ভাষার নমুনা পোয়া যায়) ,নগর-মহানগর কেন্দ্রিক মাড়োয়ারী সম্প্রদায়র হিন্দী মিশ্রিত বজরুয়া অসমীয়া (broken Assamese), কুলি-নাপিত-ধোবা-রিক্সাওয়ালা আদি বৃত্তিজীবি লোকর দেশোয়ালী অসমীয়া ইত্যাদি এই শ্রেণীর অসমীয়ারূপে অতি সম্প্রতি বহুভাষিক অসমীয়া মাতৃভাষী চাকরিজীবি ,ব্যবসায়, গৃহীণী আরু ছাত্র-ছাত্রীকো প্রভাবান্বিত করি 'চলতি অসমীয়া' বা 'জনপ্রিয় অসমীয়া ভাষা'র প্রচলনত ইন্ধন যোগাইছে।”১৪ এর থেকে স্পষ্ট তিনি ‘চিলেটীয়া অসমীয়া’দের ‘অসমীয়া মাতৃভাষী’দের সঙ্গে একাকার করছেন না। বরং সিলেটিকে অসমের ভাষা অর্থেই অসমিয়া বলছেন। তাহলে এই ভাষাগুলোকে তিনি উপভাষা কেন বলছেন এই প্রশ্ন উঠতেই পারে । এই প্রশ্নও অনুসন্ধানের বিষয় হতে পারে যে মূল অধ্যায়ে তিনি মারোয়াড়ি বা ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার রেলওয়ে কলোনির বাংলাকে নিয়ে আলোচনা করতে উৎসাহ দেখালেন না কেন? শুধু তিনিই নন, প্রায় কোনো অসমিয়া ভাষাবিদকেই এদের নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা করতে দেখা যাবে না। এগুলো না করবার ফলে বিভ্রান্তি কেমন বাড়ে তার আরেকটি নজির প্রখ্যাত অসমিয়া ভাষাবিদ অধ্যাপক ড০ রমেশ পাঠকের এই মন্তব্য। তিনি এক্কেবারে সন তারিখ দিয়ে দাবি করেছেন , “ চিলেটর ভাষার সৈতে অসমীয়া ভাষার সম্পর্ক বর্তমান অবস্থাত বিচারিবলৈ যোয়াটো পর্বতত কাছকণী বিচারিবলৈ যোৱাৰ দরে হ’ব, কারণ বাংলা ভাষাই চিলেটী ভাষার রূপ এনেদরে সলাই পেলাইছে যে চিলেটী এতিয়া বাংলা ভাষারে আঞ্চলিক রূপ মাথোন। অথচ, ১৯১৩ চনলৈকে চিলেটী ভাষা অসমীয়া ভাষার সৈতে অদ্ভূৎ ধরণে মিলিছিল। ... ১৯১৩ চনত ওলোয়া বেণুধর রাজখোয়ার Notes on Sylhetee Dialect বোলা গ্রন্থখনর পরা তথ্যবোর দিয়া হৈছে। ...”১৫তার মানে ১৯১৩তে যেহেতু বেনুধর রাজখোয়ার বইটি বেরিয়েছিল সুতরাং ওই পর্যন্ত ভাষাটি প্রায় অসমিয়াই ছিল। তার পর থেকে একে বাংলা গ্রাস করেছে । এরকম ভাষাগ্রাস করা সম্ভব কিনা, সিলেটির মধ্যে আদৌ তেমন অস্বাভাবিক কিছু পরিবর্তন হয়েছে কিনা এই সব ভাষাতাত্ত্বিক প্রশ্ন এক পাশে সরিয়ে রেখেও যে বিপজ্জনক আশঙ্কাটি তাঁর লেখাতেও স্পষ্ট যে এমন ভাষাতত্ত্ব অহেতুক সাধারণ অসমিয়াদের মনে বাংলা সম্পর্কে এক আতঙ্ককে লালন করতে সাহায্য করে। ড০ রমেশ পাঠকেরও মন্তব্যেরই মাঝের অংশে রয়েছে, “ চিলেটত যি ঘটিছিল বা ঘটিল তেনে ঘটনার প্রক্রিয়া কাছারতো আরম্ভ হৈছে...।” আমরা কিন্তু এখনো ড০ রমেশ পাঠকের মতো এতোটা হতাশ হয়ে মনে করিনা যে সিলেটির সঙ্গে অসমিয়ার সম্পর্ক সন্ধান করতে যাওয়াটা পর্বতে কচ্ছপের ডিম সন্ধানের মতো ব্যাপার।এতোটা মৌলিক পরিবর্তন দুই ভাষার কোনোটিরই ঘটেনি। তার সঠিক স্বরূপ তুলে ধরতে আমাদের ব্রিটিশ কিম্বা বর্তমান অসমের মানচিত্রের বাইরে বেরুতে হবে । প্রাচীন কামরূপের মানচিত্র, তথা ব্রহ্মপুত্র নদীর সমগ্র দক্ষিণ পূর্ব তীর অনুসরণ করতে হবে।
ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার বাংলা নিয়ে এখনো প্রায় কোনো কাজ নেই অসমিয়াতে। বাংলাতেও নেই। সাদ্রি ভাষার সম্পর্কে কিছু অনুসন্ধান হয়ে থাকলেও সাওঁতালি,মুণ্ডারি কিম্বা খাসিয়ার মতো পূর্বোত্তরীয় জীবন্ত অষ্ট্রমূলীয় ভাষা সম্পর্কে অধ্যয়নও অনেক নতুন আলোর সন্ধান দিতে পারত। ভীমকান্ত বরুয়ার ‘অসমর ভাষা’তে পূর্বোত্তরের সমস্ত ভাষা নিয়েও আলোচনা আছে।১৬ মণিপুরি থেকে ককবরক। নাগামিজ এবং নেফামিজ নিয়ে ইনি অন্যতম বিশেষজ্ঞ পূর্বোত্তরে। কিন্তু মেঘালয়ের ভাষা প্রসঙ্গেও তিনি খাসি ভাষা নিয়ে আমরা সুনীতি চট্টপাধ্যায় বা বাণীকান্ত কাকতির দিন থেকে যা জেনে এসছি তার থেকে একটিও বেশি বাক্য ব্যয় করেন নি । অথচ ক্ষুদ্র হলেও খাসিয়া কিন্তু বর্তমান অসমেরও একটি গুরুত্বপূর্ণ ভাষা। রাষ্ট্রীয় এবং ভৌগোলিক বিচ্ছিন্নতার প্রাকৃতিক পরিবেশ যেমন এগুলোর পথে বাঁধা, তেমনি ভাষারাজনৈতিক পরিবেশও জটিলতা বাড়িয়ে রেখেছে। সেই পরিবেশ কাটিয়ে উঠতেও ভাষার অধ্যয়ন এক অন্যতম উপায় বলে বিবেচিত হতেই পারে। বিজ্ঞানবোধের সঙ্গে জাতীয়তাবাদী ধ্যানধারণার সংঘাত বেঁধে যাবার ভয়েও অনেকে অধ্যয়নে বিরত থাকেন। এই কথা অসমিয়ার সম্পর্কেতোও বটেই , বাংলার সম্পর্কেও সমান সত্য।
--- --- ---- ---
১১-০৯-২০১২; শিলচরে শেষ।
--- --- ---- ---
উল্লেখপঞ্জিঃ
১) সম্পাদকীয় আগকথা; অসমীয়া জাতীয় অভিধান, ১ম খন্ড, অসমীয়া জাতীয় অভিধানঃ বৃহত্তর আরু মহত্তর অসমীয়া জাতি গঠনর অভিজ্ঞান; সম্পাদনা ড০ দেবব্রত শর্মা; অসম জাতীয় প্রকাশ; যোরহাট; ২০১০; পৃঃ২৪
২) ড০ প্রফুল্ল মহন্ত; অসমীয়া মধ্যবিত্ত শ্রেণির ইতিহাস; পৃঃ ১৯২ ।
৩) সম্পাদকীয় আগকথা;অসমীয়া জাতীয় অভিধান, ১ম খন্ড, অসমীয়া জাতীয় অভিধানঃ বৃহত্তর আরু মহত্তর অসমীয়া জাতি গঠনর অভিজ্ঞান; সম্পাদনা ড০ দেবব্রত শর্মা; অসম জাতীয় প্রকাশ; যোরহাট; ২০১০; পৃঃ ৮।
৪) অসমীয়া ভাষাত রবিন্সন আরু ব্রাউনর ব্যাকরণঃ লক্ষ্য আরু উদ্দেশ্য; অসমীয়া ভাষা; ড০ ভীমকান্ত বরুয়া;বনলতা, ডিব্রুগড়; পৃঃ১৫৭ ।
৫) ভাষাবিচ্ছেদ; শব্দতত্ত্ব; রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর; রবীন্দ্ররচনাবলী; ১২৫তম জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে প্রকাশিত সুলভ সংস্করণ, বিশ্বভারতী; ১৯৮৫।
৬) অসমত ভাষা অধ্যয়নর ইতিহাসঃ এটি আভাস;ভাষা বিজ্ঞান আরু অসমীয়া ভাষার পরিচয়;শরাই ঘাট প্রিন্টার্স প্রকাশন, গুয়াহাটি;২০০৭; পৃঃ৯২।
৭)সম্পাদকীয় আগকথা;অসমীয়া জাতীয় অভিধান, ১ম খন্ড, অসমীয়া জাতীয় অভিধানঃ বৃহত্তর আরু মহত্তর অসমীয়া জাতি গঠনর অভিজ্ঞান; সম্পাদনা ড০ দেবব্রত শর্মা; অসম জাতীয় প্রকাশ, যোরহাট, ২০১০; পৃঃ২৫ ।
৮ ) গোলক চন্দ্র গোস্বামী;অসমীয়া ব্যাকৰণৰ মৌলিক বিচাৰ ; ১৯৮৭, পৃঃ ১০ ।
৯) ঐ; অসমীয়া ব্যাকরণর মৌলিক বিচার, পৃঃ ২৫৪।
১০) ড০ ভগবান মৰল, অসমীয়া জাতীয় অভিধান আৰু বিকল্প বানান, আমাৰ অসম, ৯ মার্চ, ২০১০; অ জা অ-২য় খণ্ডে পুনঃমূদ্রিত; পৃঃ৩৫ ।
১১) সত্যেন্দ্রনাথ বরা, বহল ব্যাকরণ, পৃঃ ০।
১২) ভাষাবিজ্ঞানে সাম্প্রতিক গবেষণার গতিপ্রকৃতি ; ‘সাধারণ ভাষাবিজ্ঞান ও বাংলা ভাষা; রামেশ্বর শ’; পুস্তক বিপণি; কলকাতা০৯; ১৩৯০ বাংলা; পৃঃ ৭১০ ।
১৩) হুমায়ুন আজাদ; অবতরণিকাঃ বাঙলা ভাষাতত্ত্ব [ ১৭৪৩-১৯৮৩];বাঙলা ভাষা, ১ম খন্ড; সম্পাদক, হুমায়ুন আজাদ;আগামী প্রকাশনী ঢাকা;সংশোধিত দ্বিতীয় সংস্করণ, আগষ্ট ২০০২; পৃঃ১০১ ।
১৪) উপেন রাভা হাকাচাম; উত্তর-পূর্বাঞ্চলর ভাষাগত ক্ষেত্রত অসমর ভাষাসমূহর সহ-অবস্থান আরু অসমীয়া ভাষার সমৃদ্ধি সাধনত ইবিলাকর ভূমিকা; ১ম অধ্যায়; অসমীয়া আরু অসমর ভাষা-উপভাষা;জ্যোতিপ্রকাশন; গুয়াহাটি-০১;জুলাই ২০০৯; পৃঃ ৩।
১৫) ড০ রমেশ পাঠক; উপভাষা বিজ্ঞানের ভূমিকা; পৃঃ ১৫৯ ।
১৬) ভীমকান্ত বরুয়া; অসমর ভাষা;৫ম পরিবর্ধিত সংস্করণ;জানুয়ারি ২০১০; বনলতা, ডিব্রুগড়।
গ্রন্থপঞ্জিঃ
১) ড০ উপেন রাভা হাকাচাম, অসমীয়া আরু অসমর তিব্বত-বর্মীয় ভাষা; প্রকাশিকা, মঞ্জুলা রাভা হাকাচামজাক; ধূপধরা, গোয়ালপাড়া; ৩য় সংশোধিত সংস্করণ, এপ্রিল ২০০৭।
২) ড০ উপেন রাভা হাকাচাম, অসমীয়া আরু অসমর ভাষা উপভাষা; জ্যোতি প্রকাশন, গুয়াহাটি; জুলাই ২০০৯।
৩) সুকুমার সেন; ভাষার ইতিবৃত্ত; আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, তৃতীয় আনন্দ সংস্করণ,নভেম্বর, ১৯৯৪।
৪) জগন্নাথ চক্রবর্তী; বরাক উপত্যকার আঞ্চলিক বাংলা ভাষার অভিধান ও ভাষাতত্ত্ব; ভাষা সংস্কৃতি আকাদেমি, হাফলং,অসম; বৈশাখ ১৪১২।
৫) পবিত্র সরকার; ভাষাপ্রেম ভাষাবিরোধ; দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা; জানুয়ারি ২০০৩।
৬) রামেশ্বর শ'; সাধারণ ভাষাবিজ্ঞান ও বাংলাভাষা; পুস্তক বিপণি, কলকাতা; অখণ্ড দ্বিতীয় সংস্করণ, শ্রাবণ ১৩৯৯।
৭ ) অতীন্দ্র মজুমদার; ভাষাতত্ত্ব; নয়া প্রকাশ, কলকাতা; দ্বিতীয় সংস্করণ, ১৯৮৭।
৮) নীহার রঞ্জন রায়; বাঙালির ইতিহাস-আদি পর্ব; দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা; বৈশাখ ১৪০০।
৯) উপেন্দ্র চন্দ্র গুহ; কাছাড়ের ইতিবৃত্ত; অসম প্রকাশন পরিষদ, গুয়াহাটি; দ্বিতীয় সংস্করণ অক্টোবর ২০০৪।
১০) ড০ সুজিত চৌধুরী; শ্রীহট্ট কাছাড়ের প্রাচীন ইতিহাস ; দিনকাল প্রেস লিমিটেড, শিলচর; ২০০৬
১১) Suniti Kumar Chatterji; The Origin and Development of the Bengali Language; Rupa & Co, Kolkata;1993.
১২) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর; রবীন্দ্ররচনাবলী; ১২৫তম জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে প্রকাশিত সুলভ সংস্করণ, বিশ্বভারতী; ১৯৮৫।
১৩ ) ড০ দেবব্রত শর্মা; অসমীয়া জাতি গঠন প্রক্রিয়া আরু জাতীয় জনগোষ্ঠীগত অনুষ্ঠান সমূহ; একলব্য প্রকশন, যোরহাট; ফেব্রুয়ারি, ২০০৭
১৪) ড০ প্রফুল্ল মহন্ত; অসমীয়া মধ্যবিত্ত শ্রেণির ইতিহাস; লয়ার্স বুক ষ্টল, গুয়াহাটি; ২০০৯।
১৫) ড০ বাণীকান্ত কাকতি; অসমিয়া ভাষার গঠন আরু বিকাশ; ড০ বাণীকান্ত কাকতি জন্ম শতবার্ষিকী উদযাপন সমিতি, বরপেটা; অক্টোবর ১৯৯৬।
১৬) ড০ সুজিত চৌধুরী; প্রবন্ধ একাদশ, সম্পাদনাঃ জয়দীপ বিশ্বাস; অক্ষর পাবলিকেশনস, আগরতলা/ কলকাতা; ২০১০।
১৭) সঞ্জীব দেবলস্কর ; প্রসঙ্গ সিলেটি ভাষা; বাঙালনামা ঃ দ্বিতীয় বর্ষ, দ্বিতীয় সংখ্যা ;http://bangalnama.wordpress.com/2010/09/13/prasango-sylheti-bhasha/
১৮) G. A. Grierson; Linguistic Survey of India; http://www.joao-roiz.jp/LSI/