মূল অসমিয়া লেখাটি বেরিয়েছে সাহিত্য ডট অর্গের নভেম্বর ,১২ সংখ্যাতে |
স্নেহাংকর নবীন অসমিয়া কবি । ‘উশাহ’ তাঁর দ্বিতীয় কাব্য গ্রন্থ। প্রথমটির নাম ছিল, ‘মোৰ
শূন্যতাখিনিক চুই চাবলৈ চেষ্টা কৰিবা...চুলোঁ বুলি নক’বা।’ ২০১০এ তিনসুকিয়া শহরে
অনুষ্ঠিত জ্ঞানমেলাতে কিনে রেখেছিলাম। পড়ব বলে টেবিলে রেখেছিলাম । এমনি করি,
যেগুলো পরে কাজে এলে পড়া যাবে বলে ভাবি সেগুলো আলমারিতে ভরিয়ে
রাখি। কিন্তু টেবিলে ‘উশাহ’ পড়ে রইল। প্রায় এক বছর পড়া হয়ে উঠল না । তবু রইল । কেন
না পড়ব । স্নেহাংকর যদিও লিখেছেন, “পোহৰৰ সিপাৰে শুই থাকে সময়/
অসময়ৰ কঁপনিত দৃষ্টি বৰ উকা/ তাতে কাৰ কি”( আলোর ওপারে শুয়ে থাকে সময়/ অসময়ের কাঁপনে দৃষ্টি বড়
ফাঁকা/ তাতে কার কী)।
আমার বেলা বোধ করি, ‘তাতে কাৰ কি’ কথাটা খাটে না । হয়তো সময়ের জেগে উঠার জন্যে দিন গুনছিলাম। পড়লাম একদিন। নিজে শুয়ে শুয়ে। কিন্তু শুতে পারিনি। পড়ে শেষ
করেই স্নেহাংকরকে ফোন করলাম। আমি দুঃখিত। আমার দেরি হয়ে গেল। আরো আগে পড়া উচিত ছিল। এ
বইয়ের কয়েকটি কবিতা আমি সময় পেলে অনুবাদ করব।
তথ্যগুলো বাহুল্য বলে ভাবতে পারেন কেউ কেউ । কিন্তু আমার ভালোলাগাটুকু
এভাবেই বোধ করি সবচে’ ভালো বুঝাতে পারলাম। সেই ভালোলাগাটুকু বাংলা কবিতার পাঠকদের
সঙ্গে ভাগ করে নেবার কারণ হলো, আমরা যারা অসমিয়া কবিতা পড়ি তাদের আগ্রহ যদি কবি
স্নেহাংকর এবং সাধারণ ভাবে অসমিয়া কবিতার সম্পর্কে আরো একটু নাড়িয়ে দেয়া যায়। । সেদিনই অনুবাদ করেছিলাম শেষ কবিতা, ‘কবিতা আপোনাৰ বাবে
নহয়।’ দীর্ঘ কবিতা, ক’লাইন উল্লেখ করলেই আপনারা ধরতে পারবেন , স্নেহাংকরের সময়ের
কবিদের উপলব্ধি কী? “ আমেৰিকা- শব্দটো এটা ভিলেইনৰ নাম/ হিৰ’ই ভিলেইনক গালি
পাৰিলে/ বলীউড মার্কা আৱেগেৰে উথলি উঠা শ্রোতা –দর্শকৰ/ চেতনাৰ (?) জোৱাৰ
উঠে...ফেন (fan)-এৰে ফুলি উঠে/ আপোনাৰ সৃষ্টি ঔদ্ধত্য/ বুজি পোৱাৰ
অধিকাৰ অবাধ বুলি/ অৰণ্যৰোদন কৰোঁতে আপুনি পাহৰিলে /কবিতা কিমান স্বাধীন/ তাতেই
আপোনাৰ/ আপোনালোকৰ বিপদ...”(আমেরিকা—শব্দটি এক ভিলেনের নাম/হিরো যদি ভিলেনকে গালি
পাড়ে/বলিউড মার্কা আবেগে উথলে উঠা স্রোতা দর্শকের/চেতনার (?) জোয়ার উঠে...ফেন (fan)-এতে
ফুলে উঠে/আপনার সৃষ্টি ঔদ্ধত্য/বুঝে নেবার অধিকার অবাধ বলে/অরণ্য রোদন করতে গিয়ে
আপনি ভুলেই গেলেন/কবিতা কতটা স্বাধীন/সেখানেই আপনার/ আপনাদের বিপদ...) । এখন পড়ে দেখুন, কবি তোষপ্রভা কলিতার ‘কবিতা’ নামের কবিতার ক’টি লাইন, “
এমুঠি বোদ্ধাৰ বাবে/ এনেকৈয়ে হেনো তাই হ’ব চিৰন্তন।/ এতিয়া কবিতা হ’ল/ দু’ৰূহ
দুর্বোধ্য এক/ কঠোৰ হৃদয়হীন নির্দয়া ৰমণী/ নাজানো হঠাতে তাইক কোনে দিলে আনি/ কোনো
এক মিছনেৰী ‘মাদাৰ’ৰ অনন্য হৃদয়;/ যাক পাই কবিতাৰ পুনর্জন্ম হ’ল,/ ধন্য হ’ল পূর্ণ
হ’ল।/ ঋজু অকপট হ’ল/ কবিতা সর্বত্রগামী হ’ল/ এতিয়া কবিতা হ’ল/ শীত আৰু বসন্তৰ/ দুখ
আৰু আনন্দৰ/ অস্ত্র আৰু ফুল;/ কবিতা নহয় আৰু বতৰৰ ফুল।/ কবিতাৰ নাই দিন নাই
ৰাতি/সময় অসময়, কবিতা নহয় আৰু সুখী মানুহৰ ক্রীতদাস/ কবিতা নহয় আৰু পন্ডিতৰ অলস
বিলাস...”(গুটিকয় বোদ্ধার জন্যে/ এমনি করেই বুঝি সে হবে চিরন্তন/
এখন কবিতা হলো/ দুরূহ দুর্বোধ্য এক/ কঠোর হৃদয়হীন নির্দয়া রমণী/ জানিনে হঠাৎ কে
তাকে এনে দিলে/ কোন এক মিশনারী ‘মাদার’এর অনন্য হৃদয়;/ যাকে পেয়ে কবিতার পুনর্জন্ম
হলো/ ঋজু অকপট হলো/ কবিতা সর্বত্রগামী হলো/ এখন কবিতা হলো/ শীত আর বসন্তের/ দুঃখ
আর আনন্দের/ অস্ত্র আর ফুল;/ কবিতা নয় আর ঋতুর কুসুম।/ কবিতার নেই দিন আর রাত/ সময়
অসময়, কবিতা নয় আর সুখী মানুষের ক্রীতদাস/ কবিতা নয় পণ্ডিতের অলস বিলাস...) । সবই বুঝা গেলো । কিন্তু হঠাৎ এই ‘মিছনেৰী মাদাৰ’টি
কোত্থেকে এলেন?আর এলেনই যদি, তাঁর সঙ্গে ‘অস্ত্র’-এর কী সম্বন্ধ? আমার মনে পড়ছে
অতি সম্প্রতি পড়া পূর্বোত্তর ভারতের এক শক্তিশালী বাঙালি কবি-গল্পকাৰ পল্লব ভট্টাচার্যের ‘কমলিনী উপাখ্যান’ উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র বিপ্রের মনে দেখা দেয়া
কেয়েকটি প্রশ্ন , “নিজের জীবন কি সত্যই রচনা করিতে পারিতেছে? পারা যায়?! পূর্বে
রচিত না হইলেও, পারিপার্শ্বিক দ্বারা রচিত হইবার নানা সম্ভাবনা লইয়া, জীবন রচিত
হইয়া চলিতেছে। ইহাতে হয় স্রোতে ভাসিতে হইবে, নয় প্রতিস্রোতে। প্রায় সকলেই বলে, সে
প্রতিস্রোতে ভাসিতেছে, কিন্তু ইহা যে আদতে স্রোত নয়, একথাই বা কে নিশ্চিত বলিবে?”
আমার মনে হলো, একই জিজ্ঞাসা স্নেহাংকরেরো, প্রতিস্রোতই যে স্রোত নয় কে বলবে? নইলে
কি আর তিনি লিখবেন, “ অহংবোধক চূর্ণ-বিচূর্ণ কৰি কবিতাই / আপোনাকো শিকাব পাৰে
আঙুলিত ধৰি / বাটৰ বুকুতে শুই থকা বাটৰ দিশ...” (অহংবোধকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে কবিতা/ আঙুলে ধরে আপনাকেও
শেখাতে পারে/ পথের বুকে শুয়ে থাকা পথের দিক...)।
শেষে গিয়ে স্নেহাংকরের অমোঘ উচ্চারণ,
কবিতা “ অহৰহ বিচাৰে আপোনাৰ সমর্পিত সাধনা।” (অহরহ চায় আপনার সমর্পিত সাধনা)
স্নেহাংকরের কবিতার সম্পর্কে নির্দিষ্ট করে কিছু আমি যে লিখব, সে কাজটি
অত্যন্ত কঠিন করে রেখেছে সমূদ্র কাজল শইকীয়ার লেখা
এক অনন্য ভূমিকা। ‘ভূমিকা’ বলে শিরোনামটিই নেই । ‘যেতিয়া কবিয়ে কয়ঃ তুমি নজনাকৈ
নাইকিয়া হৈ যাম।’ (যখন কবি বলেন, তুমি টেরটি পাবেনা, আমি হারিয়ে যাবো)এর পর কিছু লেখা আসলে এক বাহুল্য মাত্র। এ এক ভূমিকামাত্র নয়, কবিতা বইটির
সঙ্গে এক অতিরিক্ত প্রাপ্তি। কবি, কবিতা, পাঠক সম্পর্কিত এক স্বতন্ত্র গভীর তত্বচিন্তার প্রবন্ধ এটি। কিন্তু
জটিল নতুবা কঠিন –কোনটাই নয় । বরং এ এক সাহিত্যিক গদ্য। আমি একটি ছোট উদাহরণ দিই,
“ কবিতা কাৰ বাবে লিখোঁ, কোনে পঢ়ে, কোনে পড়াটো আমি আচলতে বিচাৰিছোঁ? কাৰ সন্মুখত
নো আমি নাটক কৰি আছোঁ বা কৰিবলৈ বিচাৰোঁ, আমাৰ নাটকখননো কোনে চাই আছে? দর্শকজনৰ
পৰা আমাৰ মানসিক তথা স্থানিক দূৰত্বই বা কিমান--- এনেধৰণৰ প্রশ্নই সদায় আমাক
বিচলিত কৰি ৰাখে। স্নেহাংকৰ এজন নতুন কবি। সকলো কবিয়েই নতুন আৰু সদায়েই নতুন
সেয়েহে অলপ শুধৰাই ক’লে এনেকৈ ক’ব লাগিব--- স্নেহাঙ্কৰ এজন নতুন প্রজন্মৰ কবি।
এইজন কবিয়ে এদিন লিখিলেঃ তুমি নজনাকৈয়ে নাইকিয়া হৈ যাম...” (কবিতা কার জন্যে লিখি, কে পড়ে, কার পড়াটা আমরা আসলে
চাই? কার সামনে নাটক করছি, বা করতে চাই, আমদের নাটক দেখে কে? দর্শকের থেকে আমাদের
মানসিক বা স্থানিক দূরত্বই বা কদ্দূর? –এমন প্রশ্ন আমাদের সবসময় বিচলিত করে রাখে।
স্নেহাংকর একজন নতুন প্রজন্মের কবি। এই কবিটি একদিন লিখলেন, তুমি টেরটি পাবেনা,
আমি হারিয়ে যাবো...)। এই ‘হারিয়ে যাবো’ কথাটির সূত্র ধরে শেষে গিয়ে
তিনি জিজ্ঞেস করছেন, “ স্নেহাংকৰে কি বিচাৰিছে? নাম , যশ নে ধন? যিহককেই নিবিচাৰক
কিয় সেয়া তেওঁৰ অধিকাৰ আৰু সেয়া তেওঁ কৰা উচিত। আমাৰ পৰম্পৰাগত প্রথাই কিন্তু সদায়
ইয়াক বিৰোধিতা কৰি আহিছে –সেয়া আমাৰ বিচাৰত হাস্যস্পদ। কবিয়ে নাম-যশ নিবিচাৰিব
কিয়? নাম –যশৰ জরিয়তেই দেখোন এজন সৃষ্টিশীল ব্যক্তিয়ে তেওঁৰ আকাংক্ষিত পাঠক বা
দর্শকৰ সৈতে যোগাযোগ সাব্যস্ত কৰে, সঁহাৰি বিচাৰি পায়, ভালো পোৱা বিচাৰিয়েইতো
লেখকে লিখে। আৰু ধন? কবিয়ে অর্থৰ প্রত্যাশা কৰাত আপত্তি কিয়?” ( স্নেহাংকর কী চাইছেন? নাম , যশ না
ধন? যাই চান না কেন এ তাঁর অধিকার এবং এ তার দাবি করা উচিত। আমাদের পরম্পরাগত
প্রথা কিন্তু সবসময় একে বিরোধিতা করে এসছে –এ আমাদের বিচারে হাস্যাস্পদ। কবি
নাম-যশ চাইবেন না কেন? নাম –যশের মধ্যি দিয়েই দেখি একজন সৃষ্টিশীল ব্যক্তি তাঁর
আকাংক্ষিত পাঠক বা দর্শকের সঙ্গে যোগাযোগ সাব্যস্ত করেন, প্রেরণা খুঁজে পান,
ভালোবাসার সন্ধানেইতো লেখক লেখেন। আর অর্থ? কবি অর্থের প্রত্যাশা করলে আপত্তিটা
কিসের ? ) এই যে প্রশ্ন
উত্থাপন করলেন তিনি এটি চিন্তা করবার মতো বিষয় । আমরা মনে করি, সস্তা যশ এবং ধনের
লোভ যে বহু প্রতিভাকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যায় সেই কথা মনে রেখেই সমুদ্র কাজল এগুলো
লিখেছেন । এর এই কথাগুলো একা কবি স্নেহাংকর নয় সমস্ত লেখক এবং পাঠক জনতাকে
উদ্দেশ্য করে লিখেছেন। অসমে অর্থ সাহিত্যের সত্যিকার কতটা কী ভালো মন্দ করতে পারে
এ কথাও ভাববার মতো। এখানে নেই আনন্দ পাব্লিশার্স, নেই পেঙ্গুইন অথবা অক্সফোর্ড
প্রেস।
সে যাই হোক , সমূদ্র কাজল ‘তুমি নেদেখাকৈয়ে এদিন নাইকিয়া হৈ যাম’ কবিতাটিকে
নিয়ে এভাবে ভেবেছেন, আর করার কারণটাও কবি দিয়ে রেখেছেন । শুরুতেই তিনি পঞ্চদশ
শতিকার জাপানি কবি মাৎশো বাশো (Matsuo Bashō)র একটি
হাইকুর উদ্ধৃতি দিয়ে রেখেছেন ‘Come see real flowers of this painful world’ বাশো মৃতপ্রায় হাউকু ধারাটিকে পুনরুজ্জীবিত করেছিলেন। জাপানি এবং চিনা ধ্রূপদী
সাহিত্যিকদের সারিতে তাঁকে গণ্য করা হয়। কিন্তু তাঁর জীবন ছিল দারিদ্র্য, অস্থিরতা আর অনিশ্চয়তাতে ভরা। তাঁর বাবা ছিলেন এক
সাধারণ সামুরাই। আশা করেছিলেন ছেলেকে সেনাবাহিনীতে ঢুকিয়ে এক সম্মানজনক জীবন
দেয়াতে পারবেন । পারেননি । দীর্ঘদিন বাশো কবি টাডো যোশিটাডার বাড়িতে রাঁধুনীর কাজ
করতে থাকলেন । কিন্তু সেখানেই তিনি কাব্যের যে পরিবেশ পেলেন, সেই তাঁর জীবন পালটে
দিল। শেষে গিয়ে জাপানের সবচে’ সম্মানিত কবিদের একজন করে তুলল। বন্ধু হয়ে ওঠা
যোশিটাডার আকস্মিক মৃত্যুর পর বহুদিন বাড়ি ছেড়ে বাশো কই যে গেছিলেন এ এক রহস্য হয়ে
রইল । পরের জীবনে বাশোর নিজে দেয়া বিবরণ এবং গবেষকদের এখনকার আবিষ্কৃত
উপকরণগুলোও পরস্পর বিরোধিতাপূর্ণ। মনে হয় বাশোর জীবনের এইসমস্ত সত্যই স্নেহাংকরকে
অনুপ্রাণিত করেছে এই কবিতা লেখার জন্যে । লিখেছেন কী সুন্দর করে দেখুন , “শীতল
এন্ধাৰত নিতাল মাৰিলে তেজৰ সোঁত/পোষাক সলোৱা সুৰে/অগা- দেৱা কৰিছে দিনে
নিশাই/অথচ/গমকে নেপাবা/কেতিয়া তোমাৰ পোহৰতে হেৰাম” (শীতল আঁধারে চুপ মেরে গেছে শোণিত স্রোত/ জামা পাল্টাবার
সুরে/ সামনা দিয়ে পথ কেটে যাচ্ছে দিন রাত/অথচ/টেরটি পাবে না/ কখন হারিয়ে যাবো
তোমার আলোয়...)।
নতুবা “চকু পিৰপিৰাই থাকিবা/ক’তো
নেদখা পোহৰ/ভাল পোৱা/তোমাৰ যে এন্ধাৰ ময়েই (চোখ পিরপির করতে থাকবে/ কোথাও না দেখা আলো/ আমিই যে
তোমার অন্ধকার…)।
কিন্তু বাশো সম্পর্কে এই কথাগুলো যদি আমরা না জানি? কবি রবীন্দ্রনাথের ‘সোনার তরী’ কবিতা কি কারো মনে পড়বে না?আমার কিন্তু মনে পড়ল,“যত চাও তত লও তরণী-পরে।/আর আছে?— আর নাই, দিয়েছি ভরে॥/ এতকাল নদীকূলে/ যাহা লয়ে ছিনু ভুলে/ সকলি দিলাম তুলে/থরে বিথরে—/এখন আমারে লহো করুণা ক’রে॥/ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই, ছোটো সে তরী/আমারি সোনার ধানে গিয়েছে ভরি।/ শ্রাবণগগন ঘিরে/ ঘন মেঘ ঘুরে ফিরে,/ শূন্য নদীর তীরে/রহিনু পড়ি—/যাহা ছিল নিয়ে গেল সোনার তরী।” কবির সৃষ্টি কবিতা থেকে যাবে , কবি হারিয়ে যাবেন ; নতুবা কবিতাগুলো স্থানান্তরের -কালান্তরের পাঠক সমাজে যেতে থাকবে , কবি থাকবেন দাঁড়িয়ে এক নির্জন স্থির স্থান-কালেই। আমরা কি ভাবতে পারি না? না পারলেও কিছু যায় আসে না। পাঠক নিজের মনের স্থিতি অনুযায়ীই কবিতা পড়েন।
কিন্তু বাশো সম্পর্কে এই কথাগুলো যদি আমরা না জানি? কবি রবীন্দ্রনাথের ‘সোনার তরী’ কবিতা কি কারো মনে পড়বে না?আমার কিন্তু মনে পড়ল,“যত চাও তত লও তরণী-পরে।/আর আছে?— আর নাই, দিয়েছি ভরে॥/ এতকাল নদীকূলে/ যাহা লয়ে ছিনু ভুলে/ সকলি দিলাম তুলে/থরে বিথরে—/এখন আমারে লহো করুণা ক’রে॥/ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই, ছোটো সে তরী/আমারি সোনার ধানে গিয়েছে ভরি।/ শ্রাবণগগন ঘিরে/ ঘন মেঘ ঘুরে ফিরে,/ শূন্য নদীর তীরে/রহিনু পড়ি—/যাহা ছিল নিয়ে গেল সোনার তরী।” কবির সৃষ্টি কবিতা থেকে যাবে , কবি হারিয়ে যাবেন ; নতুবা কবিতাগুলো স্থানান্তরের -কালান্তরের পাঠক সমাজে যেতে থাকবে , কবি থাকবেন দাঁড়িয়ে এক নির্জন স্থির স্থান-কালেই। আমরা কি ভাবতে পারি না? না পারলেও কিছু যায় আসে না। পাঠক নিজের মনের স্থিতি অনুযায়ীই কবিতা পড়েন।
বাশোর একটা কবিতা আছে, “if I took it
in hand,/it would melt in my hot tears— /heavy autumn frost” স্নেহাংকর লিখছেন দেখুন , “ বৰ নিমখ, নিমখ হ’ল অ’ আই
/চকু মোৰ/ চাই থাকিলে মঙহৰ মানুহো গেলি যায়/ নুসধিবি একোকে” (বড় নোনা , নোনা হলোগো মা/আমার চোখ / তাকিয়ে রইলে মাংসের
মানুষও গলে পচে যায়/ আর জিজ্ঞেস করো না কিছু .../কবিতার নামঃআই
জানো)। না, স্নেহাংকর হাইকু লেখেন নি । তাঁর কবিতা সাধারণ অসমিয়া কবিতার মতোই
প্রয়োজন অনুযায়ী দীর্ঘ অথবা ছোট। কিন্তু আমরা ভারতীয়দের সাধারণত ইংরাজি বা ফরাসি
কবিতা পড়বারই অভ্যাস থাকে। সম্ভবত আমাদের
এক ঔপবেশিক মন আছে বলেই ইউরোপের সাহিত্যধারারা অনুগামী হতে পারলে বা তার থেকে
অনুপ্রেরণা পেলেই আমরা শ্লাঘাবোধ করি।সেদিক থেকে স্নেহাংকর কিন্তু ব্যতিক্রম। তাঁর
আছে এক আন্তর্জাতিক কবিতা পাঠকের মন। আর যেখানেই যে কথাটি তাঁকে চিন্তা করতে
সুবিধা দিয়েছে তিনি সেভাবেই লিখেছেন। কবিতাক’টির শুরুতে কথাগুলোর উল্লেখ করে
আমাদের বুঝে উঠতেও সুবিধা করে দিয়েছেন। যেমন ‘টেলিফ’নিক’ কবিতার শুরুতেই আবার আছে
বাশো, “Now cat’s done/mewing,
bedroom’s/touched by moonlight.” কিন্ত
এটি আবার প্রেমের কবিতা । এই বিড়ালটিকে পাওয়া যাবে ‘ম্যা...য়া...ওঁ’ কবিতাতে।
“হোটেল নৰকৰ দুৱাৰডলিত /চে’লফ’ন লৈ এজনী তপস্বী মেকুৰী / তাইৰ চকুত মোৰ চকুৰে অলেখ
চকুৰ প্রতিবিম্ব...” (হোটেল নরকের দোয়ারে /সেলফোন নিয়ে একজন তপস্বী বেড়ালি /
তার চোখে আমার চোখেতে অনেক চোখের প্রতিবিম্ব...)অবশ্যে এই বেড়ালি বাংলা বাগ্বিধির ‘বেড়াল তপস্বী’ হতে অসুবিধে নেই। দীর্ঘ
কবিতাটি শেষ হয়েছে এই কথাতে, “ সাৰ পায়েই জানিলোঁ/ মেকুৰী ভাল পাব নোৱাৰী।” (জেগে
উঠেই জানলাম/ বেড়ালিকে বাসতে নারি ভালো)আশা
করছি এর বেশি বলতে হবে না। ‘আপোনাৰ জলছবি’র শুরুতেই আছে লালন ফকিরে গানের ক’টি
লাইন, “ খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কেমনে আসে যায়।/ ধরতে পারলে মন- বেড়ি দিতাম পাখির
পায়/ আট কুঠুরি নয় দরজা আঁটা মধ্যে মধ্যে ঝলকা কাটা/ তার উপরে সদর কোঠা আয়না মহল
তায়।” সম্পূর্ণ গানের আরো দুটো স্তবক হলো, “কপালের ফের নইলে কি আর পাখিটির এমন
ব্যবহার।/খাঁচা ছেড়ে পাখি আমার কোনখানে পলায় ।।/ মন, তুই রৈলি খাঁচার আশে খাঁচা যে
তোর তৈরি কাঁচা বাঁশে।/কোন দিন খাঁচা পড়বে খসে ফকির লালন কেঁদে কয়” একই কবিতার
পুনসৃজন করেছেন কেমন স্নেহাংকর দেখুন । আমরা সম্পূর্ণটা তুলে দেবার লোভ সামলাতে
পারলাম না।
আইনাৰ
সন্মুখত থিয় হৈ চালোঁ
নিৰাভৰণ
ঘৰখনৰ দুৱাৰ খিৰকী
অনাদিৰ পৰা
অনন্তলৈ জুই লগা
চৌকাটোলৈ চকু
গ’ল
থাউনিচোন
পোৱাই না যায়
এসাগৰ
এন্ধাৰৰ মাজত
হঠাৎ
দেখিলোঁ
এচমকা ভাসমান
গভীৰ
...উজ্জ্বল জুই
ঘৰৰ চৌকা আৰু
গৰাকী...
ভিতৰ কোঠাত
জ্বলি থকা চাকি
আৰু মূল
দুৱাৰৰে আয়াসতে
অহা-যোৱা
কৰিলেহে
আইনাত ভাহি
উঠে
আপোনাৰ জলছবি
ছবিৰ ভিতৰতো
ছবি
পানীতেই
আপোনাৰ
ভিতৰতো আপুনি
(আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দেখি /নিরাভরণ ঘরখানার দোয়ার
খিড়কি/অনাদির থেকে অনন্তঅব্দি লেগেছে আগুন /চুলোটার দিকে চোখ গেল/তলানিতো দেখি
ঠেকেই না পায়ে /এক সমূদ্র অন্ধকারের মধ্যে /হঠাৎ/দেখি একবিঘৎ ভাসমান/গভীর ...উজ্জ্বল
আগুন/ঘরের চুলো আর গৃহস্থ .../ভেতর ঘরে জ্বলন্ত বাতি /আর মূল দোয়ার দিয়ে আয়াসে/আসা যাওয়া করলেই/আয়নাতে ভেসে উঠে/আপনার জলছবি/ছবির ভেতরেও ছবি /পানিতেই/আপোনার ভিতরেও আপনি)
৯ ডিসেম্বর, ২০১২ সাময়িক প্রসঙ্গে |
তিনি যেটুকু লেখা বাহুল্য বলে ভেবেছেন, সেইটুকু আমরা খানিক অনুসন্ধান
করলাম। তাতে আমাদের স্নেহাংকরের কবিতা চিন্তার সূত্র খুঁজে পেতে সুবিধে হলো ।
এটুকু দরকার। ‘দ্য জ়াহির’ নামে একটি বিখ্যাত স্পেনীয় ছোট গল্প আছে। লেখক জর্জ লুই
বোর্জ । জন্মসূত্রে তিনি একজন আর্জেন্টাইন। তাঁর গল্পের থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে একই
নামে আরো একখানা বিখ্যাত উপন্যাস লিখেছিলেন ব্রাজিলের পোর্তুগীজ ঔপন্যাসিক পাওলো
কোয়েলো । কোয়েলোর উপন্যাস ‘দ্য এলকেমিস্ট’ আমরা অনেকেই পড়েছি বা নাম শুনেছি। দুই দশকে বইটি ৭১টি ভাষাতে অনুদিত হয়ে গিনিজ বুকে তালিকাবদ্ধ হয়েছে ইতিমধ্যে। অনেকে তাঁদের উত্তরাধুনিক
লেখক বলে চিহ্নিত করতে চান। আমরা জানিনা , তাঁরা নিজেরা কী ভাবেন। লুই বোর্জ প্রথম
জীবনে কমিউনিষ্ট পার্টির সদস্য ছিলেন। পরে
নিজেকে স্বৈরতন্ত্রের বিরোধী বলে পার্টির থেকে বেরিয়ে এলেন । কিন্তু দেখা গেল
আমেরিকা সমর্থিত সেনা সরকারকে একটা সময়ে তিনি
সমর্থন দিলেন। যাই হোক, আমরা এগুলোর
ভেতরে যাবো না। এগুলোকে সাহিত্য বিচারের অনিবার্য উপকরণ ভেবে নিতে আমাদের আপত্তি
আছে। ‘জ়াহির’ গল্পটি আমরা পড়েছি।
যিনিই পড়ুন এক নতুন ধরণের গল্পের স্বাদ
পাবেন। কিন্তু আমরা বুঝলাম যে কোথাও না কোথাও
কবি স্নেহাংকর নতুন জনপ্রিয় সাহিত্য চিন্তা ‘উত্তরাধুনিকতাবাদ’দিয়ে অনুপ্রাণিত
হয়েছেন। অন্তত সাহিত্যের ‘আধুনিকতাবাদ’ বলে জিনিসটিকে যে তিনি নিজেও
ভালোচোখে দেখেন নি, প্রতিটি কবিতাতেই এটি স্পষ্ট।
পূর্বোক্ত, ‘কবিতা আপোনাৰ বাবে নহয়’ কবিতার মূল কথা এটাই। সমূদ্র কাজল শইকিয়ার
ভূমিকাতেও দেখলাম, ‘আধুনিকতাবাদে’র কথা উল্লেখ করে সংক্ষিপ্ত কিন্তু তীক্ষ্ণ
সমালোচনা । এমন তাত্বিক অবস্থান আমাদের আবার এক নতুন ধরণের ইউরোকেন্দ্রিকতার দিকে
নিয়ে যাবে না তো? ‘আধুনিকতার’ বিরুদ্ধে কিন্তু এমন অভিযোগ অনেক পুরোনো হলো। আমাদের মতো এককালের ঔপনিবেশিক দেশের মানুষের মনে
ইংরেজি ভাষা এবং ইউরোপীয় সভ্যতার সবই ভালো- এমন এক ধারণা কাজ করে। এখানকার বাজারে নতুন
যে জিনিসই বেরোক , কাল আমাদের লাগবেই। তা সে নতুন মোবাইল সেট বা কবিতা লেখাৰ শৈলী যাই হোক। এমন বিপদ আমাদের থাকেই। আমরা কখনোবা আমাদের নিজের সংস্কৃতির পরম্পরাকেই ভুলে যাই। তাই, ‘মিছনেৰী মাদাৰ’কে নইলে আমাদের ‘প্রগতিবাদী’ কবিতাও লিখা হয় নি । তাই আমি নিজে
এমন সাহিত্য তত্বের সম্পর্কে সতর্ক। সমালোচনা করতে গিয়ে নিশ্চয় এর কোনো মূল্য থাকে, লেখকের ব্যক্তিজীবনেরো একটা কিছু দর্শন
থাকবে যদিও, লেখার সময়ে সেই দর্শনকে নিয়ন্তার দায়িত্ব দিতেই নেই। আর দিলেও লাভ কিছু নেই। সাহিত্যক যতই শিবির একটা গড়ুন
না কেন , সাহিত্য শিবিরে থাকে না। শেষে গিয়ে সমস্ত সাহিত্য এক একটা সমগ্র
ভাষাগোষ্ঠীর এবং কোনো ভাষাতে যদি অনুদিত হয় তবে
সেই ভাষার পরম্পরার নিজের সম্পদ হয়ে যায়
গিয়ে। নিজের তাত্বিক অবস্থানের সঙ্গে সাহিত্যিকজনো কেউ ‘নজনাকৈ নাইকিয়া হৈ’ যান।
লেখকও মনে মনে সেইটাই চান। মনে হয় কবি স্নেহাংকএ এই কথা জানেন এবং মেনে চলেন ।
নইলে কেনই বা লিখবেন, “মোৰ এখন চিলা আছে/চিলাত আছে মোৰ দুচকু”
(আমার একটি ঘুড়ি আছে/ ঘুড়িতে আছে আমার দুটি চোখ…/কবিতার নামঃচিলা উৰে আকাশত)।
অবশ্য ‘উত্তরাধুনিক’ চিন্তার অনেক এলোমেলো ব্যাপারের মধ্যেও , কিছু চিন্তা
আছে আমাদের কাজে আসবার মতো। আমরা যে দু’জন লেখকের
নাম উল্লেখ করলাম তাঁদের দুজনেই ছিলেন বহু ভাষিক এবং এঁদের গল্প উপন্যাসের একটা
লক্ষণ চোখে না পড়ে থাকে না যে তাঁরা নিজের সংস্কৃতির সঙ্গে
বিশ্ব ইতিহাসের, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে এক সকম মানস ভ্রমণ করে নিজের মতো সত্যের সন্ধান
করেন। ‘দ্য এলকেমিষ্টে’র কেন্দ্রীয় চরিত্র মেষপালক ছেলে সান্তিয়াগো যেমন গোপন
ঐশ্বর্যের সন্ধানে মিশরের পিরামিডে যায়। আমরা আশা করছি, পাঠক ইতিমধ্যে স্নেহাংকরের মাৎশো বাশো,
নতুবা লালন ফকিরের প্রতি আগ্রহের কারণ খুঁজে পেলেন।সোজা কথাতে বলতে গেলে বিশ্বায়নের
যুগে যখন আমাদের একাংশ
সংবেদনশীল মধ্যবিত্ত মন পুঁজিবাদী আধুনিকতার চাকচিক্যে ক্লান্ত, অথচ চোভিয়েত পতনের পর সেদিকে কোনো নতুন
আন্তর্জাতিক বিকল্প পথের সন্ধানও দেখা দেয় নি তখন এ এক বিশ্বপ্রবণতা হয়েছে যে
লেখকরা নিজ উদ্যমে পুরোনো মত এবং পথ পরিত্যাগ করেছেন। বিশেষকরে
ইউরোকেন্দ্রিক সমস্ত চিন্তা চর্চাকে ছেড়ে ,
বর্তমানকে ছেড়ে এক নতুন ভবিষ্যত নির্মাণের আশাতে ইউরোপের বাইরে এবং অতীতের দিকে যাত্রা করছেন । স্থান-কাল সম্পর্কীয় এক স্বতন্ত্র চিন্তাচর্চার মধ্যে এঁরা ঢুকে পড়েছেন।
ইউরোকেন্দ্রিকতার মধ্যে, আমি যেভাবে বুঝেছি, উপনিবেশের যুগে গড়ে ওঠা আমাদের ধর্ম নতুবা জাতি চিন্তাও ঢোকে থাকে।তাই দেখব, স্নেহাংকর কবিতা লেখার সময় মান্য অসমীয়া ভাষার সীমা
অতিক্রম করে যান । বাংলাভাষাতে এমন অতিক্রম
আজকাল প্রায় সাধারণ কথা হয়ে গেছে । যেমন প্রবীন কবি গৌতম চৌধুরীর কবিতার ক’টি লাইন
দেখুন, “কিতারে সত্য কই হে গজবিড়ালি/ মুখ থিকা মৎস নামাও, আর কইয়া দাও প্রকৃত সত্য
কিতা?/ দূর ? না নিকট? কিতা সত্য ?/ আলো আঁধারির মিল ক্ষণিকের? না কি চিরধাবমান
বিপরীতগামীতা?/ কারে আমি আমি কই, কে আমার তুমি?/ রুদ্ধকমলদল কার বুকে আন্ধার ঘনায়?
কারবুক আলো করে কমলা সুন্দরী?” ( বিরহ মিলন লইয়া এক পরস্তাব)। ‘কমলাসুন্দরী’কে চিনলেনতো? কবি যেই কলকাতার মান বাংলার থেকে সরে এলেন গোয়াপাড়ার লোকগীতের ‘কমলাসুন্দরী’কে এসে ছুঁয়ে ফেললেন । মান
বাংলাতে লিখলে এমন হতো না বলে বলব না, কিন্তু
সম্ভাবনা অনেক কম থাকত। স্নেহাংকরও অসমিয়া সামাজিক উপভাষা(?) সাদ্রিতে লিখেছেন, “ তদেৰ নাই জানিহি/ হামদেৰ ছানাগিলাকেৰ চকুমে/
আজিকালি হৰিয়ালি জাগামে ছবটা লালে –লাল আহে” ( হামদেৰ ত’ কন রং নেইখে) । কবি যখন লেখেন, ‘‘জ়াহিৰ’ হ’বা/ ভাল পোৱা” আমরা যেন
সুফি কবিতাগুলো নতুন করে অসমিয়া ভাষাতে পড়ে ফেললাম । অথবা, লালনগীতি সম্পর্কিত যে
কবিতার উল্লেখ করলাম ,এ কেবল প্রতিবেশী বাংলাদেশের বা বাংলা ভাষাজগতের কথা নয়, ‘কেবলীয়া নাম’ বা
‘টোকারী গীত’ পরম্পরাকে মনে করুন যেখানে কবি লেখেন, “মাঝ সাগৰতে এডাল বিৰিখ। তাতে
নানা পখীৰ কায়া/ ৰজনী পুৱালে পক্ষী উৰি গলে/এৰিলে বিৰিখৰ মায়া।”
(মাঝ সাগরে একটা বিরিকখো । তাতে নানা পাখির কায়া/ রজনী
পোহালে পক্ষী উড়ে গেলো/ছেড়ে দিল বিরিকখের মায়া।/ টোকাৰী গীত, সংগ্রাহক প্রতাপ হাজৰিকা। সৌজন্যঃঅসমীয়া লোকসংগীত আৰু অন্যান্যগীত-মাত –ফেচবুক গ্রুপ,অভিজিৎ কলিতা) ‘অসুখ’ নামের কবিতাতে এই প্রজন্মের
কবি কি লেখেন দেখুন, “ ‘এয়া লোৱা’—বুলি ঈশ্বৰে তোমাৰ হাতত অগাধ সম্পদ তুলি দিলে/
আপোন পাহৰা হ’লা ছাঁটোলৈকে লাজ-লাজ/ দেহী ঐ লাজুকি লতা/ কুঁৱাৰ বেৰত কুমজেলেকুৱা
বগালে/ ঈশ্বৰৰ খেয়াল খুচিৰ কিবা ঠিকনা আছেনে/ টিলিকতে দিনবোৰ
নিশা হয়/ ৰাতিৰ আকাশত তৰাই চাই থাকোঁতেই/ তেওঁ সোণৰ জখলাৰে নামি আহে......ঈশ্বৰৰ
প্রলম্বিত বৰষুণৰ টোপালবোৰ স্ফটিক যেন উজ্জ্বল/ তীখাৰ দৰে তেজাল পাৰাৰ নিচিনা গধুৰ/ নদীত পানীৰ টোপাল পৰে/ঢৌত
উটি যোৱা তুমি/দুচকুৰ এন্ধাৰত/ দুলি থাকে ভাল পোৱাৰ সুখ/ অসুখ”।
(‘এই নাও’—বলে ঈশ্বর তোমার হাতে অগাধ সম্পদ তুলে দিলেন/
আত্মভোলা হলে ছায়াটি দেখেও লাজ-লাজ/ দেহধারী ঐ লাজুকি লতা/কুয়োর বেড়াতে কেঞ্জুলিকা
বেয়ে উঠল/ ঈশ্বরের খেয়াল খুশির কি আর কোনো ঠিকানা আছে/ টিক করে দিনগুলো রাত হয়/ রাতের আকাশে তারাগুলো তাকিয়ে থাকতেই/
তিনি সোনার সিঁড়িতে নেমে আসেন......ঈশ্বরের প্রলম্বিত বৃষ্টিফোটাগুলো স্ফটিকের মতো
উজ্জ্বল/ ইস্পাতের মতো ধারালো পারদের মতো ভারী / নদীতে পানির বিন্দু পড়ে /ঢেউতে
ভেসে যাওয়া তুমি/দুচোখের
আঁধারে / দুলতে থাকে ভালো বাসার সুখ/ অসুখ)আধুনিক অসমিয়া কবিতাতে আমরা বৈষ্ণব ঐতিহ্যের থেকে
ঈশ্বরের কথা পাইনি নয়।পেয়েছি এরকমঃ
বৈকুণ্ঠৰে পৰা হৰিয়ে সুধিলে—/“কোন কোন আহিবৰ হ’ল”/ নাম-লোৱা ভকতে সাদি
বুলিলে—/“নামতে গৈ আছো তল।” (বৈকুণ্ঠ থেকে হরি সুধোলেন—/“ কার আসার হলো বেলা ”/ নামে মত্ত- ভক্ত জানালো—/“ভাসিয়েছি যে তোমার
নামের ভেলা।/ ঈশ্বৰ আৰু ভকত; লক্ষ্মীনাথ বেজবৰুৱা) কিন্তু তিনি আবার ভক্তের ঈশ্বর। কিন্তু কবি স্নেহাংকর ভক্ত নন, তাঁর ঈশ্বর
ঈশ্বর নইলেও সমস্যা নেই। এ যেন জীবনের নশ্বরতাকে স্মরণ করিয়ে আধুনিক জীবনের
ভোগবাদের সুখ এবং বিষন্নতার সমালোচনাহে। “ তেওঁৰ আঙুলিত ঠাঁৰত হিল্লোলিত হয়/
ৰত্নভাণ্ডাৰত তোমাৰ / পোহৰ বৰষুণ বতাহ আৰু জুইৰ মৃণ্ময় গীত।” (তাঁর আঙুলের দোলায় হিল্লোলিত হয়/ রত্নভাণ্ডারে তোমার / আলো বৃষ্টি বাতাস
আর আগুনের
মৃণ্ময় গীত।)
‘নামকীর্তন’ নয়, কবির আগ্রহ ‘মৃণ্ময় গীতে’ই শুধু ! আমার মতে এটি অসমিয়া কবিতার
নতুন উচ্চারণ। এবং নতুন চিত্র। এক ধরণের বর্তুলাকার
অগ্রপদক্ষেপ।
১৬ ডিসেম্বর, ২০১২ সাময়িক প্রসঙ্গে |
**************************