আমার চেতনার রঙে রাঙানো এই খেলা ঘরে:

~0~0~! আপনাকে স্বাগতম !~0~0~

*******************************************************************************************************

Sunday, 12 October 2014

অসমের মাটি এবং মাটির মানুষ


( প্রায় বছর খানিক আগে এই লেখাটি তৈরি করেছিলাম ত্রিপুরার একটি কাগজের কথায়। কাগজটি যেকোনো কারণেই হোক বেরুলো না। অতএব যিনি লেখা নিয়ে গেছিলেন, তাঁর অনুমতি নিয়ে ব্লগেই প্রকাশ্যে নিয়ে এলাম। তবে লেখাটি সম্প্রতি শিলচরের 'আমাদের সমকালে'র ৩৬বর্ষ, ১ম সংখ্যাতে প্রকাশ পেলো।)

                                                           “আমার রক্তে কান্নাজলের আলতো গন্ধ
                  হেলে পড়েছে ধানের চারা..”
(ঢল ভেঙে আসছে,হীরেন ভট্টাচার্য)
মা-মাটি মানুষকথাটা পশ্চিম বাংলার রাজনীতিতে খুব শোনা গেছিল গেল বিধানসভা নির্বাচনের আগে। শব্দগুচ্ছকে এর আগে আমরা এক আবেগভরা জনপ্রিয় যাত্রার নাম বলেই জানতাম। সেই নাম দিয়ে যে কেউ রাজনীতিতে বাজিমাত করে দিতে পারেন এ আমাদের কল্পনার বাইরেও ছিল। তাও এমন একটা দল এবং সরকারের বিরুদ্ধে যাদের সম্পর্কে লোকে বলেন যে তারা তিন দশক রাজত্ব করেইছিলেন ভূমি সংস্কারের জোরে এবং গোটা দেশে তারা সেই কর্মসূচীকে এগিয়ে নিয়ে গিয়ে একটা জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবকরবেন বলে লোকে জেনে আসছিল। দেখা গেল, শাসনের শেষ দিকে তাদের বিরুদ্ধেই কৃষকের হাত থেকে জমি নিয়ে গিয়ে এবারে আর জমিদার নয়, শিল্পপতিদের সমঝে দেবার অভিযোগ উঠল। আর এই অভিযোগের তোড়েই এরা শাসন থেকে উড়ে গেলেন। জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবমুলতুবি হয়ে গেল। বাকি দেশের আর কোনও আশা রইল না।
              সত্যি কি তাই? দেখা গেল এর কিছু পরে ভারত সরকারের খাদ্য নিরাপত্তা আইন এবং ভূমি অধিগ্রহণ আইন নামে দুটো আইন নিয়ে এলো। আরেকটি আইন ইতিমধ্যে প্রক্রিয়ার মধ্যে আছে। সেটি ভূমি সংস্কার আইন। ২০১৩র জুলাই মাসে ভারত সরকার এর একটি খসড়া প্রকাশ করে জনমত সংগ্রহে নেমেছে। এইসব ঘটনা আমাদের অনেককে ভিরমি খাইয়ে দেবার মতো ঘটনাই বটে। এটি এমন একটা বিষয় যা আসলেই আমাদের চর্চার বাইরে থাকে। রাজনীতির যারা সক্রিয় কর্মী, তাদেরই বাইরে থাকে, বাকিদেরতো কথাই নেই। কেননা বিষয়টি বেশ জটিল। একেতো অর্থনীতির জটিল মারপ্যাঁচ না বুঝলে প্রায় কিছুই বোঝা যায় না, তার উপরে বেশ খেটেখুটে অনুসন্ধান করে তবে অধ্যয়ন করতে হয়। এই অধ্যয়ন অনীহাকে মনে হয় কেবল মধ্যবিত্তের শ্রেণি চরিত্র দিয়ে সবটা ব্যাখ্যা করা যায় না। এই মেধার উপরে, বিশেষ করে পূর্বোত্তরের বাঙালি, এমনকি বামপন্থীমেধার উপরেও ঔপনিবেশিক মননের প্রভাব এখনো অত্যন্ত গভীরে । হীরেন গোঁহাই ২০০৩এ জাতি সমস্যা, ভূমি সাম্রাজ্যবাদনামে একটি দীর্ঘ দিগদর্শী নিবন্ধ লিখেছিলেন। তিনি ১৯৮৭তে বি বি দত্ত এবং এম এন কান্সার সম্পাদিত ‘Land Relation in North East Indiaবইটির পুনর্নির্মাণ করে দাঁড় করিয়েছিলেন তাঁর লেখা। আমরা হীরেন গোঁহাইর লেখাটির উপরেই মূলত নির্ভর করে এগুবো। এছাড়াও কিছু উৎস থাকবে, যথাস্থানে সেগুলোর উল্লেখও থাকবে। শুধু অসমিয়া কথাগুলোকে আমরা বাংলাতে অনুবাদ করে নেব। হীরেন গোঁহাই অধ্যাপক এম এন কার্ণারের একটি লেখার থেকে একটি গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য উদ্ধার করেছেন, “ However, the studies undertaken by British officials were confined to the physical, ethnographic and historical conditions and rarely touched the basic problem of the people: Problem relating to the institutional structure evolved under British rule and its relation to economic backwardness were, by and large, excluded from the preview of all official enquiries while questions unrelated to the British created institutional structure were given exaggerated importance.” এর খানিক পরে অধ্যাপক কার্ণারই আরো লিখেছেন, “Such a biased analysis influenced even the native scholars who had almost fused into the colonial intellectual tradition.” বোঝাই যায় এই পরম্পরা অনুসরণ করেই অসমিয়া ভাষাতেতো বটেই, বাংলাভাষাতে অসম তথা পূর্বোত্তরের ভূমি-চর্চা খুবই কম। বাংলাতে যেটুকু আছে, তার প্রায় সবই পশ্চিম বাংলার। এখানে বাঙালি যারা কাজ করেছেন, তাদেরও ভাষা হয় অসমিয়া নতুবা ইংরেজি। বাংলা ভাষাতে যে অসমের ভূমি সমস্যা নিয়ে কেউ তেমন এর আগে অধ্যয়ন করেছেন বা করবার আগ্রহ দেখিয়েছেন এই তথ্যটাই বহু চেষ্টাতেও আমাদের হাতে এলো না। এ অবস্থাতে আমরা একটা জটিল পথে যাত্রা শুরু করছি মাত্র। লেখাটা সত্যিকারের দাঁড়াতো যদি ক্ষেত্র অনুসন্ধান করে কিছু দাঁড় করানো যেতো। যারা করেন, তাঁরা সেভাবেই করেন। সেদিক থেকে একটি সূচনা বিন্দু আঁকবার চেষ্টা মাত্র করা হয়েছে এই প্রবন্ধে।
  
            কাজটি করবার মতো জ্ঞানগম্মি এবং দক্ষতাও আমার নিতান্তই কম। অথচ বিষয়টি খুবই জরুরি। আপনি গান গাইবেন, কবিতা লিখবেন বিপ্লবের আর কিছু হচ্ছে না বলে কম্যুনিস্ট দলগুলোর আদর্শচ্যুতিকে দিনরাত শাপশাপান্ত করবেন, এই দ্বিচারিতা না ছাড়লেই নয়। কেননা সব আদর্শেরই শেকড় মাটিতে গজায়। সেই মাটির দিকে ভালো করে তাকালে দেখা যাবে ধ্রুপদীমার্ক্সবাদ সম্পর্কে টুকটাক জ্ঞানগম্মি নিয়ে আমাদের যেমন একদিন এই বিশ্বাস গড়ে উঠেছিল যে সংগঠিত শিল্প শ্রমিক একদিন নেতৃত্ব দেবে আর ভূমিহীন কৃষকেরা সঙ্গ দেবে, জমি এবং কারখানা মালিকানা নিজেদের হাতে নিয়ে আসবে বলে ---সেই শ্রেণি দুটোই আসলে ধ্রুপদীরূপে যদিও বা কিছু গড়ে উঠেছিল ভারতে প্রথমে সবুজ বিপ্লব এবং পরে বিশ্বায়নের দৌলতে আজ আর নেই। যদি থাকত, তবে হাজারটা সোভিয়েতের পতন সেদেশে হলেও এদেশে লাখো সোভিয়েত মাথা তুলে দাঁড়াতো। দাঁড়ায়যে নি, এগুলো নিছক দলগুলোর আদর্শচ্যুতি বা গোঁড়ামো নয়। জটিলতাগুলো অনেককে হতাশ করে দিচ্ছে বটে আর যারা হতাশ নন তাদেরও পুরোনো অধ্যয়নের অনেক রং-রূপ এতো দ্রুত পালটে দিচ্ছে যে বুঝে উঠলেও বোঝাতে গিয়েও হিমসিম খেতে হচ্ছে। অথচ, এমন নয় যে কৃষি আন্দোলনগুলো বিকশিত হবার জন্যে কম্যুনিস্টদের জন্যে অপেক্ষা করছে। কোনদিনই করে নি। এগুলো শুধু কম্যুনিস্টদেরই কর্মসূচী--- এই গোঁড়া বিশ্বাসটি আসলে সাহিত্য এবং সংবাদ চর্চাকরা শিক্ষিতজনের, তিনি হতে পারেন ডান কিম্বা বাম। কম্যুনিস্টরা আসলে স্বপ্ন দেখেন, লড়াইগুলোকে একটা জায়গাতে এনে শুধু কিছু আইনি সংস্কার নয়, ব্যবস্থাটাকেই এই শ্রেণিগুলোর অধীনে নিয়ে যাবার। বিকাশের পুরো পরিকল্পনাটা এবং প্রয়োগটাই যাতে এই উৎপাদক শ্রেণিগুলো নিজেদের কেন্দ্রে রেখে করতে পারেন, বণিক কিম্বা মহাজনের স্বার্থে নয়। এবং শেষ অব্দি এক শ্রেণি-রাষ্ট্রহীন সমাজের দিকে এগিয়ে যেতে পারেন। গোটা দেশেই কৃষকেরা লড়ছেন, রোজ সংবাদে আসছে। সোভিয়েতের পতন কিম্বা চীনের ভণ্ডামোর কথা তারা জানেনও না। জানবার দরকারও নেই। এ তাঁদের জীবনপাতের সমস্যা। ভূমি অধিগ্রহণের আইনটি যে হয়ে গেল, তার পেছনেতো শেষ হুমকিটি আসলে একতা পরিষদে, যাদের লড়াই জনলোকপালের লড়াই থেকে কম কিছু ছিল না। বরং অনেক বেশি ভয়ঙ্কর হতে পারত যদি তাদের দেশজোড়া পদযাত্রা দিল্লি অব্দি এসে পৌঁছে যেতে পারত। তার আগেই শাসক দল বিপদের আঁচ পেয়ে ২০১২র অক্টোবরে আগ্রার পথে গিয়ে আটকে দিয়ে আইন আনবার প্রতিশ্রুতি দেয় এবং কথা রাখে। যদিও তাতে এখনো আছে অনেক ফাঁকফোকর, কিন্তু পুরোনো বিলেতি আমলের আইন থেকে এটি অনেক ভালো , কৃষক বান্ধব।
   
ভূমি সংস্কার আইনের খসড়াতে ১৯৯২র গ্রামোন্নয়নের প্রতিবেদনের উল্লেখ আছে। সেটিতে জানা গেছিল, দেশের অর্ধেকের বেশি মানুষের আদৌ কোন জমিজমা নেই। ভূমিহীনের সংখ্যা দেশজুড়েই বেড়ে চলেছে তপশিলি জাতি-জনজাতিদের মধ্যেই। ২০০৩-০৪এর জাতীয় নমুনা সমীক্ষা সংগঠনের ( NSSO) একটি সমীক্ষা বলছে অবস্থা নতুন শতকেও পাল্টায়নি বিশেষ। ৪১.৬৩% মানুষের কোনক্রমে মাথা গোঁজবার ঠাই একটা থাকলেও জমিজমা বিশেষ নেই। আরো এক তৃতীয়াংশ মানুষ ভূমিহারা হচ্ছে হচ্ছে অবস্থাতে আছে। আরো ২০%এর জমি আছে এক হেক্টরেরও কম। অন্যভাবে বললে, দেশের ৬০% মানুষের হাতে আছে মাত্র ৫% জমি , অন্যদিকে দেশের সবচাইতে ধনী ১০%এর হাতে রয়েছে ৫৫%এর বেশি জমি। জমিই আমাদের খাবার-দাবার যোগায়, এই বৈষম্যের মধ্যেই আমরা বাকিরা সেগুলোর নিয়মিত সরবরাহ আশা করে বেশ সুখেই আছি!
         ভারতে কৃষিযোগ্য জমির পরিমাণ হবে প্রায় ৫৪ কোটি একর। তার মধ্যে ৭৩ লক্ষ একর সিলিং বহির্ভূত বলে ঘোষিত হয়েছে। মোট জমির এটা মাত্র ১.% তার মধ্যে ভূমিহীনদের মধ্যে বিলিবন্টন হয়েছে মাত্র ৫৪ লক্ষ একর, মোট কৃষি জমির মাত্র ১% গ্রামীণ পরিবারগুলোর এরা মাত্র ৪% এই বণ্টিত জমির ৪০%ই পেয়েছেন পশ্চিম বাংলার মানুষ। তালিকাতে লাভবানদের মধ্যে আরো আছে মাত্র তিনটি রাজ্যের কেরালা, জম্মু ও কাশ্মীর এবং অসম। আমরা এই তথ্যগুলো তুলে দিলাম সমস্যার গুরুত্বটা শুরুতেই অনুধাবন করা সহজ হবে বলে।
             আমরা একটি আনুভূমিক সংক্ষিপ্ত চিত্র তুলে ধরতে পারতাম। কিন্তু সেটি করা তার পক্ষে অসম্ভব যার উলম্ব তথা কালানুক্রমিক কোনও অধ্যয়ন নেই। আমরা তাই সেটিই করব মূলত ব্রিটিশ ভারত থেকে শুরু করে। কথায় কথায় আমরা জমিদার-জোতদারদের যেসব কথা বার্তা বলি, সেগুলো মূলত অবিভক্ত বাংলার ক্ষেত্রে মানায়, তাও উত্তর চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত যুগেই। নইলে ভারতে ভূমি ব্যবস্থার বৈচিত্র্য এতো বেশি যে এক রাজ্যের ভেতরেই পূবে-পশ্চিমের কাহিনি ভিন্ন, পাহাড় সমতল হলেতো কথাই নেই। ছোট্ট রাজ্য অসমের ভূমি ব্যবস্থাও গোটা ভারতের চাইতে কম বিচিত্র নয়। তাই অসমের তিন বৃহৎ কৃষি জনগোষ্ঠীকে কেন্দ্র করে  মোটা-দাগের আলোচনাতে তার একটা রূপরেখা আঁকবার চেষ্টা করব মাত্র।

ব্রহ্মপুত্রের পাড় ভাঙ্গা ধ্বস নয় , তার থেকে ও ভয়ঙ্কর ভূস্বামী । পাগলা হাতির সরকারি উচ্ছেদের নোটিশ :
 
           ভূমি নিয়ে যারাই সামান্য নাড়াচাড়া করেন তারাই আজকাল জানেন যে প্রাক-ব্রিটিশ জমানাতে ভারতে ভূমি মালিকানার বিশেষ কোন ধারণা ছিল না। কৃষক কিম্বা জমিদার, রাজা কিম্বা সম্রাট ভূমির মালিকানা কারোরই ছিল না, আর ছিল না নগদ টাকাতে রাজস্ব দেবার কোন ব্যাপার স্যাপার। শ্রেণিভেদ তখনো বহু জায়গাতেই প্রবল ছিল, কিন্তু ভূমিহীন বললে আজ যা বোঝায়, তার থেকে প্রাক-ব্রিটিশ আমলের চরিত্রটি ছিল ভিন্ন। আজ ভূমিহীন মানেই হয় কৃষিমজুর নতুবা পরিভ্রমী অসংগঠিত শ্রমিক। জমির মালিকানা এবং মুদ্রাতে রাজস্ব দেবার প্রথা ব্রিটিশ এই দেশে চালু করে। আর ব্রিটিশ চলে যাবার পরেও একটু আগে উল্লেখ করা ব্রিটিশের অধ্যয়ন পদ্ধতিই শুধু নয়, অধ্যয়নের বিষয়টিও তার অস্তিত্ব বজায় রাখে। অর্থাৎ কাঠামোটি সামান্য রদবদলের মধ্য দিয়ে গেলেও মৌলিক কোন পরিবর্তন তার মধ্যে ঘটেনি এখনো। পূর্বোত্তর ভারতে জনজাতিদের মধ্যে সামূহিক মালিকানা তথা চাষাবাদের পরম্পরা সম্পর্কে ভাসাভাসা ধারণা হলেও আমাদের অনেকর মধ্যেই আছে। তার জন্যে বিশেষ অধ্যয়ন করতে হয় না। Land Relation in North East India'বই থেকে তথ্য নিয়ে হীরেন গোঁহাই শুরুতেই দেখিয়েছেন এই সব জনজাতিরাও উপনিবেশোত্তর আমলেও আত্মরক্ষা করতে পারেন নি। ১৯৫১তে খাসিয়া জয়ন্তিয়া পাহাড়ে নিজে চাষাবাদ করেন না, এই অর্থে জমিদার ছিলেন ৯০৬জন, বিপরীতে ২৮,৯৯৪ জন কৃষি মজুর ছিলেন। ১৯৭৯ সনেও সেখানে একটি গ্রামে অনুসন্ধান করে জানা গেল যে ৪০ % মানুষই আসলে ভূমিহীন। ত্রিপুরাতে ১৯৫১ সনে কৃষিজীবী মানুষের ৬২.৯৪ % ছিলেন কৃষক এবং ৮.৯৩ % ভূমিহীন ১৯৮১তে এই সংখ্যাদুটো পালটে হচ্ছে ৪৩. ৫৭% এবং ২৩.৯১% তার মানে অবস্থার অবনতি হচ্ছে।
          ভাটি অসমের একাংশ মোঘল ভারতের অংশ ছিল । মোঘল শাসনের শেষের দিকে বাকি ভারতে কৃষি তথা কৃষি পণ্যের বিকাশ কিছু হয়েছিল। খাজনা আদায়ের বিষয়টিকে একটি কেন্দ্রীয় ব্যবস্থার অধীনে নিয়ে আসবার চেষ্টা করছিলেন মোঘল শাসকেরা। ব্যক্তি কৃষকের থেকে খাজনা আদায়ের উদ্যোগ কিছু কিছু হলেও সেগুলো সেভাবে সফল হয় নি । তার আগেই ব্রিটিশ চলে আসে। গ্রাম হিসেবেই খাজনা আদায় দেয়া হতো, এবং সে হতো ফসলে। মুদ্রাতে নয়। যদিও সম্পদের বৈষম্য নানা ভাবে মোঘল ভারতে বেড়েছিল, এবং সামূহিক খাজনা আদায় দিলেও গ্রাম সমাজের চুড়োয় ছিলেন যারা, মূলত উচ্চবর্ণ হিন্দুরা, বেশ সুবিধে করে নিতেন। এমন কিছু ব্যাপার স্যাপারে ক্ষুব্ধ ভাটি অসম বা উত্তর বাংলার কোচ-কৃষকদের একাংশ এক সময় মোঘলের খাজনা ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বিদ্রোহও করেছিলেন। বাকি অসমের ভূমি ব্যবস্থা মোঘল ব্যবস্থা থেকে খানিক ভিন্ন ছিল। জমি এখানে গ্রাম সমাজ তথা খেলের অধীনে থাকত। নিঃসন্তান অবস্থাতে যদি কোন কৃষকের মৃত্যু হতো তবে তার জমি সেই খেলের দখলে ফিরে যেতো বলে অমলেন্দু গুহ লক্ষ্য করেছিলেন। তাঁর Medieval and Early Colonial Assam বই থেকে এই তথ্যের উল্লেখ করেছেন শ্রী গোঁহাই। চাষের জমিটি ছাড়াও জঙ্গলের বাঁশ-কাঠ, গবাদি পশুর চরবার জায়গা ইত্যাদি কৃষক এমনিতেই ব্যবহারের অধিকার ভোগ করত। অমলেন্দু গুহ অনুমান করেছিলেন যে এগুলো অসমের কৃষকের পরম্পরাগত অধিকার ঔপনিবেশিক আমলে কেড়ে নেয়া হলেও আহোম শাসনে সুরক্ষিত ছিল। শ্রী গুহের ধারণা আহোম যুগের ভূমি ব্যবস্থা তাইসমাজের অবদান বা সৃষ্টি। এই ধারণা খণ্ডন করেছেন শ্রী গোহাঁই। এবং আমাদেরও মনে হয় খণ্ডনটি সংগত । কেননা, অসমে আসবার পরে আর তাই সমাজ কিম্বা শাসন নিজেও তার পুরোনো জনজাতীয় রূপটিকে অক্ষত রাখে নি। একটি সামন্তীয় সমাজ অসমে তাদের শাসনেই বিকশিত হতে শুরু করে। বিশেষ করে পঞ্চদশ-ষোড়শ শতকের চুহুংমুং বা দিহিঙীয়া রাজার সময় থেকে । যখন বহু ক্ষুদ্র জানজাতীয় রাজ্যকে আহোমরা কেন্দ্রীয় শাসনের অধীনে নিয়ে আসেন। এই গোটা প্রক্রিয়া অসম ইতিহাসে এবং জনশ্রুতিতে এখনো সাত রাজ মারি এক করারনীতি বলে সুপরিচিত। আহোম রাষ্ট্রের সেনাবাহিনীতে ক্রমে একটি পদ গড়ে উঠে পাইক। শব্দটি এসছে পদাতিকশব্দের থেকে , এই তথ্যের উল্লেখ করে তিনি লিখছেন, জনজাতীয় সমাজে আদিম সামন্ত-ব্যবস্থার উদ্ভব হচ্ছিল । যখন রাষ্ট্রের দাবিতে প্রত্যেক প্রজা কৃষিকর্ম কিম্বা যুদ্ধ সবেতেই যোগ দিতে বাধ্য। অর্থাৎ অন্য সময় যারা যৌথ জমিতে চাষাবাদ করছে, যুদ্ধের সময় তারা সবাই যুদ্ধে যাচ্ছে। আহোম রাষ্ট্রে গোটপাইকব্যবস্থাকে হীরেন গোঁহাই অনুমান করেছেন জনজাতীয় সমাজের সামন্তবাদী ব্যবহার। এবং প্রাচীন কামরূপেও এই ব্যবস্থা থাকা সম্ভব, যা কিনা আহোমেরাও ব্যবহার করেছেন। জমির যৌথ ভোগদখল এবং চাষাবাদের প্রথা কোচেদের মধ্যেও ছিল, ফলে মোগল শাসকেরা ব্যক্তিগত খাজনা আদায় ব্যবস্থার প্রচলন করতে গেলে, পুরোনো সম্পর্কের সঙ্গে সংঘাত বাঁধে এবং তারা বিদ্রোহের পথ নিয়েছিলেন।
          আহোম যুগে শ্রেণিভেদও ছিল, শোষণও ছিল । কিন্তু ঔপনিবেশিক আমল থেকে সেটি কম নিপীড়ক ছিল । এমন সিদ্ধান্ত মোটের উপরে গোটা ভারত সম্পর্কেই প্রায় সমস্ত তাত্ত্বিকেরাই নিয়ে থাকেন। পলাশীর যুদ্ধের পরে ব্রিটিশের প্রবর্তিত ভূমি ব্যবস্থাকে, এমনকি চিরস্থায়ী বন্দোবস্তকেও আগের ব্যবস্থার থেকে অনেক বেশি অমানবিক ব্যবস্থা বলে ব্রিটিশ এবং জমিদারদের স্তাবক বঙ্কিমও অস্বীকার করেন নি। বঙ্গদেশের কৃষকেলিখেছিলেন, “ ... কিন্তু লর্ড্ কর্ন্ওয়ালিস্ মহাভ্রমে পতিত হইয়া চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সৃজন করিলেন। রাজস্বের কণ্ট্রাক্টরদিগকে ভূস্বামী করিলেন। তাহাতে কি হইল? জমীদারেরা যে প্রজাপীড়ক রহিলেন। লাভের পক্ষে প্রজাদিগের চিরকালের স্বত্ব একেবারে লোপ হইল। প্রজারাই চিরকালের ভূস্বামী; জমীদারেরা কস্মিন্ কালে কেহ নহেনকেবল সরকারী তহশীলদার। কর্ণ্ওয়ালিস্ যথার্থ ভূস্বামীর নিকট হইতে ভূমি কাড়িয়া লইয়া তহশীলদারকে দিলেন। ইহা ভিন্ন প্রজাদিগের আর কোন লাভ হইল না। ইংরাজ-রাজ্যে বঙ্গদেশের কৃষকদিগের এই প্রথম কপাল ভাঙ্গিল। এই চিরস্থায়ী বন্দোবস্তবঙ্গদেশের অধঃপাতের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত মাত্রকস্মিন্ কালে ফিরিবে না। ইংরাজদিগের এ কলঙ্ক চিরস্থায়ী; কেন না, এই বন্দোবস্ত চিরস্থায়ী
           ব্রিটিশের এহেন ঔপনিবেশিক ভূমি ব্যবস্থাতে শুধু আবাদি জমিই নয়, বন, পাহাড়, জলাশয়, নদী সবেতেই ক্রমে সরকারের মালিকানা স্থাপন করে। যে নতুন ভূস্বামীরা জমির মালিকানা পেলেন তাদের সে মালিকানাও সরকারের ইচ্ছেমতো খাজনা আদায় দেয়া না দেয়ার উপর নির্ভরশীল হয়ে গেল। পূর্বোত্তরে পাহাড়ে যারা সঞ্চরণশীল ঝুম চাষ করতেন, সেই সব জনজাতিরাও ক্রমে বনের উপরে পরম্পরাগত অধিকার হারিয়ে দেউলিয়া হয়ে যেতে শুরু করলেন। বন-জলাশয় থেকে জীবন জীবিকার উপকরণ সংগ্রহের সহজাত অধিকার হারিয়ে পুরো সমাজ বিপর্যস্ত হতে শুরু করল। ১৮২২শে গোয়ালপাড়া,১৮২৬এ বাকি ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা এবং ১৮৩২এ কাছাড়ের সমতল ব্রিটিশের অধীনে আসে। ১৮৭৪এ সিলেটকেও অসমে নিয়ে আসা হয় রাজস্বের হিসেব করেই। সিলেট গোয়ালপাড়াতে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ছিল। বাকি অসমে উনিশ শতকের শেষ অব্দি বিচিত্র সব ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু মূল ব্যবস্থাটি রায়তারী ব্যবস্থাবলেই সুপরিচিত। তার আগে অব্দি বাংলাদেশের ভূমি রাজস্ব পরিষদই সরকারি সিদ্ধান্ত নিত। ৭৪এর পরে এই ক্ষমতা শিলঙের মুখ্য আয়ুক্তের অধীনে নিয়ে আসা হয়। ১৮৮৬তে The Assam Land Revenue Regulation জারি করা হয়। এটিও একটি ঢিলেঢালা কিছু গৃহীত নীতি নির্দেশিকা ছিল। কিন্তু এর পর থেকে এখন অব্দি একেই নানাভাবে সংস্কার করে করেই সরকারী ভূমি নীতি এগুচ্ছে। আইনটি এখনো বলবত এবং ১৮৮৬র ভূমি-রাজস্ব আইননামে সুপরিচিত। এরকম প্রথম উদ্যোগটিকে ঠিক সংস্কারও বলা যাবে না,শতাব্দের শেষে এর উপরে ভিত্তি করে ১৮৯৬তে The Assam Land Revenue Manual নামে একটি আইনি ব্যবস্থার সূত্রপাত করা হয়। ভূমি-রাজস্বের আইন তথা নীতিনিয়মকে একটি পদ্ধতিতন্ত্রের অধীনে নিয়ে আসা হয়। তবে কিনা এর উদ্দেশ্য মূলত ছিল সমতলের রাজস্ব প্রশাসন এবং পদ্ধতির একটি আইনগত ভিত্তি তৈরি করা।
           এই হাত-পুঁথি বা ম্যানুয়েলের মতে আগে বুঝি রাজা ছিলেন জমির নিষ্কণ্টক মালিক, আর প্রজারা ছিল ভূমিদাস মাত্র। আসলে এটা ছিল বর্তমান সম্পর্কে সত্য, অতীত সম্পর্কে ডাহা মিথ্যা কথন। রাজা আগে ছিলেন শুধুই রাজস্বের মালিক, জমির নয়। এখন ব্রিটিশ সরকার দুইয়েরই মালিক হলো।কৃষিজমি বা কৃষি বহির্ভূত জমি সে যাই হোক। ব্রিটিশ এভাবেই নয়া-সামন্তবাদের প্রবর্তন করেছিল অসমে। এর পরে এরা ইচ্ছে মতো খাজনা বাড়ানো কমানোর অধিকারী হলো।এই হাতপুঁথিতে পাট্টাদারব্যবস্থাটি পাকা করা হয়।কাদের খাজনা দিতে হবে না,কারা দশসালের জন্যে, কারা এক সালের জন্যে পাট্টা পাবেন সেটি নির্ধারণ করা হয়। বাংলাদেশে ব্রিটিশ নামে হলেও জমিদারদের মাটির উপরে স্থায়ী অধিকার মেনে নিয়েছিল।অসমে পাট্টার ব্যবস্থা করা হয়েছিল প্রায় সবার জন্যে। পাট্টাদারেরা জমি ভোগ করবার স্বত্ব অনেকটা মালিকের মতো কেনাবেচা করতে পারলেও পাট্টার কাল পেরোলে আবার নবীকরণ করতে হতো। কিন্তু একসালা পাট্টা যাদের মিলত জমির উপর তাদের বস্তুত কোন অধিকারই থাকত না। সেই জমি এরা দান, বিক্রি, বা সন্তানকে দিতে পারতেন না। সরকার যদি এদের জমি দখল করত, তবে এরা আসবাব পত্রের জন্যে সামান্য ক্ষতিপূরণ পেলেও জমির জন্যে কোনো মূল্যই পেতেন না। মজার কথা হলো, চা-বাগানের বিশাল পরিমাণের জমিকে ধরা হয়েছিল পতিত জমির সারিতে। ১৮৩৮ থেকেই চা চাষের জন্যে এক বিশেষ স্বত্ব মঞ্জুর করবার নিয়ম গড়ে তোলা হয়েছিল। ১০০ থেকে ১০,০০০ একর জমি এমনিই দিয়ে দেয়া হতো। শুধু এর এক চতুর্থাংশ জমিতে পাঁচ বছরের মধ্যে চা চাষ করে দেখাতে হতো। এভাবে পাওয়া জমির এক চতুর্থাংশ জমি চিরদিনের জন্যে করমুক্ত করে রেখে দেয়া হয়েছিল। বাকি তিন চতুর্থাংশে তৃণাঞ্চল হলে পাঁচ বছরের জন্যে, নল-খাগড়া থাকলে দশ বছরের জন্যে, আর বন-জঙ্গল হলে বিশ বছরের জন্যে করমুক্ত হতো। এর পরেও নামমাত্র খাজনা নির্ধারণ করা হতো এদের। অবশ্যি, বিশ বছর পার করে নি। ১৮৫৪তেই নিয়ম পালটে জমির ঊর্ধ্ব সীমা করা হয় ৫০০ একর। এর এক চতুর্থাংশ চিরদিনের জন্যে করমুক্ত করে দিয়ে বাকি তিন চতুর্থাংশ নাম মাত্র নিরিখে ৯৯ বছরের জন্যে লীজে দিয়ে দেয়া হয়েছিল। অথচ, একই পতিত জমিতে জনজাতিদের সঙ্গে কেমন বৈষম্য করে তাদের পরম্পরাগত চাষাবাদকে দুঃসাধ্য করে ফেলা হচ্ছে এবং মজুর বা ভূমিদাসে পরিণত হবার পথ করে দেয়া হচ্ছে তার ছবিটা দেখা যাক।
       সঞ্চরণশীল কৃষিতে নিয়োজিত লোকেদের জানিয়ে দেয়া হয়েছিল যে পতিতজমি অস্থায়ীভাবে দখল করে কোনও স্বত্ব দাবি করতে হলে তাদের নিয়মিত খাজনা দিতে হবে তথা পাট্টার জন্যে দাবি জানাতে হবে। জমাবন্দি এবং দাগের দলিলে পাট্টাদারদের নাম, স্বত্বের প্রকৃতি এবং শর্তগুলো লিখে রাখার ব্যবস্থা হলো। কিন্তু পাট্টাদারের জমিতে যদি কোন রায়ত বাস করতেন তার নাম নথিবদ্ধ হলেও তার কোন স্বত্ব বা ভোগ করবার কাল ইত্যাদি কিছুই নথি বদ্ধ হতো না। নিজের পাওনা খাজনার প্রতি অতি-মনোযোগই সরকারকে রায়তদের প্রতি অমনোযোগী করে রেখেছিল। এমন প্রজা বা রায়তের সংখ্যা কামরূপ জেলাতে ১৮% , অন্য জেলাগুলোতে ৬% এর বেশি ছিল না। ফলে বাংলাদেশে যেভাবে এর কিছু আগে ন্যূনতম প্রজা স্বার্থ রক্ষা করবার জন্যে Bengal Tenancy Act প্রণয়ন করা হয়েছিল, অসমে সেরকম কিছুও হলো না। সেরকম দাবি উঠবার পরিস্থিতিও তৈরি হয় নি।
           এবারে , এই পাট্টাদারেরা নিজে চাষাবাদ করতেন না তেমন। তারা অন্য চাকরি, ব্যবসা ইত্যাদি করতেন। তারা অন্যদের দিয়েই চাষ করাতেন এবং সেই সব চাষিরা মূলত জনজাতীয় ছিলেন। তাঁদের দাম দিয়ে পাট্টা কেনার বা নিয়মিত খাজনা দেবার সামর্থ্য ছিল না। এগুলো মুদ্রা দিয়ে হতো। আর হাতে ফসলের বদলে মুদ্রা পেতে গেলে বাজার ব্যবস্থাতে ঢোকতে হয়, উৎপাদনকে পণ্যে পরিণত করতে হয় এমন কি বাজারের উপরে নিজের নিয়ন্ত্রণও কায়েম করবার চেষ্টা নিতে হয়। নিতান্তই যুগের সঙ্গে তাল মেলাবার যুক্তি দিয়ে এগুলো হয়ে উঠা ছিল অধিকাংশের কাছে অসম্ভব। তাই তাদের কাছে ছিল এগুলো নতুন উপদ্রব। ফলে নিজের যৎসামান্য জমি যদি থাকে তবে সেখানে এবং চাকরিজীবী বা অন্যবৃত্তিধারী পাট্টাদারের জমিতে এরা চাষাবাদ করতেন পুরুষানুক্রমে। অনেকে বাঁধা শ্রমিকেও পরিণত হলেন। বিনিময়ে তাঁরা পাট্টাদারের থেকে কী পেতেন সেই তথ্য দেন নি হীরেন গোঁহাই। কিন্তু এটি উল্লেখ করেছেন যে এই সব জনজাতীয়রাই ১৯৪৮এ সাম্যবাদী দলের নেতৃত্বে লাঙল যার, জমি তাঁরস্লোগানে কৃষি বিদ্রোহে যোগ দিয়েছিলেন। তবে কিনা কৃষক বিদ্রোহ এখানে ওখানে উনিশ শতকের শেষ তিনদশকেও ব্যস্ত রেখেছিল ব্রিটিশ প্রশাসনকে। এর মধ্যে ১৮৯৪র জানুয়ারি মাসের বিখ্যাত পাথরুঘাটের রণ বা বিদ্রোহও আছে। আমরা যেসব রেগুলেশন বা হাতপুঁথির কথা লিখে এলাম সেগুলোর ব্যবস্থা হচ্ছিল এই পরিস্থিতিতেই। “ জমির আয়ের উপরে ভিত্তি করে খাজনা নিরূপণ হতো না। সাধারণ চাষিদের খাজনার পরিমাণ ছিল চা-চাষিদের খাজনার থেকে অনেক বেশি। চা-চাষিদের আয়কর দিতে হতো, তাও ছিল জমির যৎসামান্য খাজনা, শ্রমিকের মজুরি, মূলধনের সুদ ইত্যাদি বাদ দিয়ে যেটুকু লাভ থাকে তার উপরে ভিত্তি করে। এসব অন্যজমির বেলাতে বিবেচনাতে আনা হতো না। নিজে শ্রম করে একমাসেরও খোরাকি জোগাড় করতে পারতেন না যেসব কৃষক তাদেরও খাজনার থেকে রেহাই মিলত না। বাজারের লাভালাভ আগের সামন্তবাদী বা জনজাতি প্রথার উৎপাদন ব্যবস্থাতে ছিল না। ...কিন্তু, উৎপাদনী ব্যবস্থাতে বাজার সম্পর্ক প্রবল হলো না, অর্থাৎ অর্থনীতিতে পুঁজিবাদী চরিত্রের পূর্ণ বিকাশ ঘটে নি। বোঝাই যাচ্ছে, ‘আধা-সামন্তবাদের দিকে উৎপাদনী ব্যবস্থা এগুচ্ছে শাসন পদ্ধতি এবং আর্থ-ব্যবস্থার মধ্যি দিয়ে একটি নতুন মহাজনী বা মধ্যশ্রেণির উদ্ভব হলো। যে শ্রেণিটি নিজের হাতে জমা ধন ধীরে ধীরে জমি কিনে ভূ-সম্পত্তিতে নিয়োগ করে তার পরিমাণ বাড়ালেও উৎপাদনী ব্যবস্থা বা কৌশল উন্নত করাতে ব্যয় করে নি। উৎপাদনী প্রক্রিয়াতে পুঁজি বিনিয়োগ হলো না। যখন উৎপাদিত শস্যের দাম কম থাকত তখন এই মধ্যশ্রেণি সরকারি নিরিখের থেকেও বেশি খাজনা রায়তের উপরে চাপিয়ে দিতে মুনাফা বাড়াতো। আবার যখন শস্যের দাম বাড়ত উৎপাদিত শস্যের বিশাল পরিমাণ আধি বা ঠিকা বন্দোবস্তীতে কৃষকের থেকে আদায় করত। এমন আধি বা চুকানিকে নিয়েই এক সময় এমন জমি-মহাজনদের বিরুদ্ধে কৃষক আন্দোলন গড়ে উঠেছিল...” এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল যথেচ্ছ খাজনা বাড়িয়ে জনজাতি কৃষকদের হতাশ করে দিয়ে চা-বাগানে শ্রমিক হিসেবে কাজ করতে বাধ্য করাবার ষঢ়যন্ত্র।
প্রবীণ কম্যুনিস্ট নেতা নন্দেশ্বর তালুকদার একটি সাক্ষাৎকারে জানাচ্ছেন, তেভাগা আন্দোলন অসমে মূলত গড়ে উঠেছিল সিলেট কাছাড় আর গোয়ালপাড়াতে গোয়ালপাড়াতে চর অঞ্চলের মুসলমান কৃষকেরা সেভাবে সেই আন্দোলনে যোগ দেন নি মৌলানা ভাসানীর, যিনি পরে বাংলাদেশে গিয়ে সেখানে মুক্তি যুদ্ধের অন্যতম নায়ক হবেন, নেতৃত্বাধীন মুসলিম লীগের প্রভাব থাকার ফলে। এই দাবি কতটা যথার্থ স্বতন্ত্র অধ্যয়ন জরুরি। তবে আপাতত এইটুকু তথ্য রেখে এগুনো যাক যে, চর-অঞ্চলের পূর্ববঙ্গীয় মুলের কৃষকদের সমস্যা যে গোড়া থেকেই ভিন্ন ছিল এবং ভাসানী সেই কৃষকদের আন্দোলনেই নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন সেই ইঙ্গিত অনিল রায়চৌধুরী কিন্তু দিয়েছেন, এমনকি অসমে কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে উঠার পরে ১৯৪৪এ কোকড়াঝাড়ের গৌরাঙ তারাঙে কৃষক সম্মেলনে বিশ্বনাথ মুখার্জি, প্রাণেশ বিশ্বাস , আব্দুল কাদের ইত্যাদির সঙ্গে মৌলানা ভাসানীও মঞ্চ ভাগ করেছিলেন সেই তথ্যেরও তিনি উল্লেখ করেছেন। ভাসানীর কৃষক আন্দোলনের সঙ্গে তার মুসলিম লীগে যোগ দেয়াটা যে খাপ খায়না এই প্রশ্নে তাঁর অভিমত অনেক স্পষ্ট। কিন্তু এর বাইরে মূলত রাভা, হাজং, বডো, কোচ, রাজবংশীরা ছিলেন সেই লড়াইতে। সেসব তথ্যের সমর্থন অনিল রায়চৌধুরীও করছেন। নন্দেশ্বর তালুকদার সেই শুরুর যুগের অন্যতম কৃষক নেতা ছিলেন। তিনি লিখছেন, তেভাগার আগে কৃষকদের উৎপন্ন ফসল মালিকের বাড়িতে নিয়ে গিয়ে মাড়া দিতে হতো, তেভাগার ফলে তারা নিজের বাড়িতে মাড়া দিয়ে তিনভাগের একভাগ মালিককে পাঠাতে শুরু করেন। গোয়ালপাড়ার বগরিবাড়ি জমিদারদের অধীনে এক বিশাল বনাঞ্চল ছিল যেখানে বডো, রাভারা বাস করতেন । তাদের বলা হতো দফাদার। এরা বন রক্ষা করতেন, বিনিময়ে বাঁধ কাঠ খের ইত্যাদি ব্যবহার করতে পেতেন। কখনো বা শাল সেগুন ইত্যাদি গাছ কেটে বিক্রি করলেও লাভের ছয় ভাগের এক ভাগ জমিদারদের দিয়ে দিলেই হতো। কিন্তু ১৯৪৪ সাল নাগাদ বেশি মুনাফার লোভে জমিদার এই কাঠের নিলাম ডেকে ঠিকাদারদের সমঝে দিতে চাইলে কৃষকরা বিদ্রোহ করেন। এই আন্দোলন কুঠারি আন্দোলন বলে পরিচিত হয়। তিন বছর এই লড়াই চলেছিল। শেষে কৃষকেরাই বিজয়ী হলে আশেপাশের গ্রামাঞ্চলেও কৃষক সভার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। এর পরিণাম হয়েছিল গোটা অসমে জনজাতিদের মধ্যে আধিয়ার রক্ষা আইনের আন্দোলন। ১৯৪৮এ এই আইন প্রবর্তিত হয়। গুয়াহাটির কাছে বেলতলার কৃষক আন্দোলন তখনি বেশ খ্যাতি অর্জন করে । কিন্তু আন্দোলনে একা কম্যুনিস্ট পার্টি ছিল না। কলাগুরু বিষ্ণু রাভাদের বিপ্লবী কম্যুনিস্ট পার্টির প্রভাব তখন বাকি অসমে বেশ ছিল। তদুপরি ১৯৩৫এ প্রতিষ্ঠিত ট্রাইবেল লীগও কৃষক আন্দোলনের পাশে দাঁড়ায় । এদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল, সহযোগিতা গড়ে তোলবারও প্রয়াস ছিল। কৃষকের সর্তে ভূমিমালিককে ফসলের ভাগ দেয়া, জমিতে কৃষকের স্থায়ী পাট্টা, যে কোনও কারণে উচ্ছেদ বন্ধ করা ইত্যাদি। এ কথা সবাই জানেন যে কৃষি আন্দোলন তখন অসমে সশস্ত্র রূপ নিয়ে ছিল। ফলে যদিও বা আধিয়ার আইন প্রবর্তিত হলো, সরকারের পক্ষে কম্যুনিস্টদের বিচ্ছিন্ন করে দমন করাও বেশ সহজ হয়েছিল। বহু কৃষক নেতা সেই আন্দোলনে শহীদও হয়েছিলেন। এছাড়া ইতিমধ্যে বডোদের মধ্যেও সামান্য হলেও একদল ধনি কৃষক , মহাজন দেখা দিয়েছিলেন ব্রিটিশ আমলেই। দাদন প্রথার মতো কিছু সামন্তীয় প্রথা দেখা দিচ্ছিল বডোদের মধ্যে, যার দৌলতে ধনী বডো কৃষক বা মহাজনেরা কৃষিশ্রমিকদের শোষণ করে যাচ্ছিলেন, কিন্তু সমাজের ভেতর থেকে এগুলো বিরোধিতা করবার মতো সাহস বা নেতৃত্ব কোনটাই গড়ে উঠেনি। সম্ভবত জনজাতিদের মধ্যে শ্রেণি দৃষ্টিভঙ্গী নির্ধারণেও ভুল হয়েছিল কমিউনিস্ট নেতৃত্বের। জাতি সত্ত্বার প্রশ্নগুলোও সঠিক ভাবে তুলে ধরতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। ফলে যেটুকু সম্ভাবনা ছিল, তাও মার খায় ট্রাইবাল লীগ ইত্যাদি সংগঠনের সুবিধেবাদী উত্থানে। যেগুলো এখন প্রায় উগ্রজাতীয়তাবাদের চেহারা নিয়ে এক জনজাতিদেরকেই অন্য জনজাতির বিরুদ্ধে লড়িয়ে দিচ্ছে। এই প্রসঙ্গে নকশাল আন্দোলনের প্রভাবে গড়ে উঠা সত্তর আশির দশকে অত্যন্ত শক্তিশালী কৃষক আন্দোলনে নেতৃত্বদায়ী সারা অসম খেতিয়ক সংস্থার এক দলিলে ১৯৮২ সনে লেখা হচ্ছে এভাবে, “...এই তথাকথিত বামপন্থীরা শ্রাদ্ধের বামুনের মন্ত্রপাঠের মতো শ্রেণি ঐক্যের কথা আউড়ে গেছেন, কিন্তু এই শ্রেণিগত ঐক্য অর্জনের জন্যে সুনির্দিষ্টভাবে শ্রেণি বিশ্লেষণ করতে, শ্রেণিগত ঐক্য অর্জনের পথে বাধা হিসেবে থাকা জাতিগত বর্ণগত দ্বন্দ্ব বিরোধের মীমাংসার কথাটিকে কখনোই গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করে নি। ফল যা হবার তাই হয়েছে। উগ্রজাতীয়তাবাদের স্বরূপ এবং উৎস সন্ধান করে বের করাতো দূরেই থাক, এরা কার্যতঃ উগ্রজাতীয়তাবাদের কাছে আত্মসমর্পণ করেছেন; নতি স্বীকার করেছেন অত্যন্ত লজ্জাজনক ভাবে।
         ব্রিটিশ মুনাফাটা লুটছিল খাজনার মধ্যি দিয়ে। খাজনার জন্যেই সে পাট্টার ব্যবস্থা করেছিল। স্থায়ী চাষাবাদ তার খাজনাকেও নিয়মিত করে। পাট্টাদারেরা জমির খাজনা আদায় করে নিতে এবং নিজেরও আয় বাড়াতে লোক লাগিয়ে হলেও চাষাবাদ করতে এবং পরিমাণে বাড়াতে উৎসাহী হবে এটা ব্রিটিশ ভেবেছিল। সেটিই হয়, উৎপাদনও ব্যাপক বাড়ে আর রেগুলেশনের পরের বিশ বছরে শুধু ব্রহ্মপুত্র উপত্যকাতে জমির খাজনার পরিমাণ বেড়েছিল ৮৮% এই সময়ের মধ্যে খাজনার নিরিখও অবশ্য কিছু বেড়েছিল, কিন্তু এই পরিমাণ বৃদ্ধিতে মূল প্রেরণাটি ছিল পাট্টাদারের সংখ্যা এবং উৎপাদনের পরিমাণ বৃদ্ধি। উপর তলার লোকদের সুখ সম্ভোগ বাড়লেও জনতার যে অংশ থেকে কৃষি মজুররা আসতেন তাদের অবস্থা হয়েছিল দুর্বিসহ।
             স্বাধীন সামন্তবাদ যে সমাজকে সম্পূর্ণ বশীভূত করতে পারে নি ঔপনিবেশিক আমলের নতুন ব্যবস্থা তাদেরকেই অসমিয়া বর্ণহিন্দুর স্বত্বহীন রায়ত তথা ভূমিদাসে পরিণত করেছিল। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল হিন্দু জাতব্যবস্থা। হীরেন গোঁহাই এই তাৎপর্যপূর্ণ মন্তব্য করেছেন, “ ...দৃশ্যত যদিও অসমিয়া বা অন্যান্য বর্ণহিন্দুদের অন্যায়ই জনজাতীয়দের দুর্দশার কারণ, আসলে কিন্তু ঔপনিবেশিক ব্যবস্থাই ছিল তার মূল কারণ। হিন্দু জাতিভেদ প্রথা যদিও ভারতীয় সামন্তবাদের প্রধান বৈশিষ্ট্য, সেই বৈশিষ্ট্যও ঔপনিবেশিক ব্যবস্থার প্রভাবে কিছু পরিমাণে রূপান্তরিত হয়ে গেছিল। অনুষ্ঠানটি ঔপনিবেশিক ভূমিব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়েছিল এবং ঔপনিবেশিক মধ্যবিত্তের শোষণ বা সম্পদ আহরণের উপকরণে পরিণত হয়েছিল। নতুন ভূমি ব্যবস্থা জনজাতীয় সমাজকে নিচের স্তরে ঠেলে দিয়েছিল এবং হীন জাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে সেই অবনমনকে স্বাভাবিককরে ফেলা হয়েছিলযদিও পুঁজিবাদী শিল্প-মালিক বা বাংলাদেশের বৃহৎ জমিদারদের তুলনাতে অসমিয়া বর্ণহিন্দুর শোষণ পরিমাণে কিছুই ছিল না তবু এগুলোই তাদের অবস্থাপন্ন করে তুলছিল আর জনজাতীয়দের নিঃস্ব।
শ্রেণি এবং জাতিভেদের এই যুগলমিলনও নানাভাবে বর্তে থাকে স্বাধীনতার পরেও। শিক্ষা এবং সরকারি চাকরিকে ঔপনিবেশিক আমলেও জনজাতিরা সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধির উপায় বলে ভাবতে শুরু করেছিলেন। এটাতো বোঝাই যায়ই, নগদ টাকাতে খাজনা দিতে হয় বলে পাট্টাদার হবার সুবিধেটা নিতেন মূলত বর্ণহিন্দুরাই যারা আগে থেকেই সুবিধেজনক অবস্থাতে ছিলেন এবং উপনিবেশের চাকরি-ব্যবসা ইত্যাদিও সহজে বাগিয়েছিলেন। হাতে নগদ টাকা এলে জনজাতিরাও পাট্টাদার হয়ে খাজনা দেবার সামর্থ্য অর্জন করতে পারতেন এমন একটি আকাঙ্ক্ষা দেখা দেয়া স্বাভাবিক। তাই দেখা যাবে, কালী চরণ ব্রহ্ম যখন সাইমন কমিশনের কাছে সাক্ষ্যদান করতে গেছিলেন , তিনি বিধান সভাতে জনজাতিদের জন্যে আসন ছাড়াও প্রশাসনিক চাকরিতেও আসন সংরক্ষণ দাবি করেছিলেন। কালীচরণ ব্রহ্ম কৃষি পণ্যের বাণিজ্য কী ভাবে জনজাতিরা নিজেরাই করতে পারেন সেই নিয়েও ভেবেছিলেন এবং কাজ করেছিলেন। বডোদের মধ্যে তিনি এক নতুন ধর্মান্দোলন গড়ে তুলেছিলেন যার মূল প্রেরণাটি আসলে ছিল বডোদের রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন এবং অর্থনৈতিক উন্নতি। এখানে সেই ধর্মান্দোলন নিয়ে বিস্তৃত লেখার সুযোগ নেই। কিন্তু ঔপনিবেশিক ভারতের সামন্তবাদী কৃষি অর্থনীতি, এই ধর্মান্দোলন, শিক্ষা, চাকরির সম্প্রসারণ এবং জাতবর্ণ ব্যবস্থা যে মোটেও বিচ্ছিন্ন নয়, পরস্পর সম্পর্কিত বিষয় সেটি সামগ্রিক অধ্যয়নে চাপা থাকে না।
         মেদিনী চৌধুরী লিখেছেন, উনিশ শতকের শেষ থেকে অসমিয়া মধ্যবিত্তের উচ্চবংশগৌরব আলাদা মাত্রা পেতে শুরু করে। উচ্চবংশ (ভালোবংশ বলেও বলা হতো) মানে অসমিয়া ভাষী বা আর্যমূলীয় ভাষাভাষী উচ্চবর্ণহিন্দু এবং ইংরেজ প্রশাসনের সঙ্গে জড়িত নাহলেও কোনও কিছু উপায় করে আপনার জনের বংশ। ব্রহ্মপুত্র উপত্যকাতে ভালো বংশ মানে ব্রাহ্মণ, দৈবজ্ঞ, কায়স্থ, কলিতা কুলের মানুষ। ইতর, ‘প্রাকৃতএই শব্দগুলোর প্রয়োগ ইতিমধ্যে অসমের সাবেক কৃষিজীবী সমাজ এবং উচ্চবর্ণের ( নতুন যারা জাতে উঠেছিলেন তাদের সহ) মধ্যবিত্ত ভদ্রলোক সমাজের মধ্যে দূরত্বের সৃষ্টি করেছিল। কিন্তু ভালোবংশেরর ধারণাটির সাহায্যে ইংরেজ শাসনের সময়ে যা কিছু চাকরি-বাকরি বা অন্যান্য সুযোগ সুবিধে বেরিয়েছিল সবেতেই একচেটিয়া অধিকার হলো এই তথাকথিত ভালোবংশের লোকেদের। ইংরাজ প্রশাসন চাকরিতে নিয়োগ করতে গেলে, বাজারের বন্দোবস্তি দিতে গেলে, ঠিকা দিতে গেলে ঐ ভালোবংশের লোক খোঁজে বেড়াতো। এমনকি ইংরেজ দেশ ছেড়ে চলে যাবার পরেও একেবারে ১৯৪৮ অব্দি ভালো বংশের প্রার্থী চেয়ে বিজ্ঞাপন বেরুতো। এমন ব্যবস্থার ফলে আহোম, রাজবংশী (কোচ সহ) ইত্যাদি বৃত্তিগত জাতির ছেলেরা চাকরি বাকরির সুযোগ প্রায় পেতোই নাআর্যমূলীয় ভাষাভাষীবলতে যে বাঙালি , মাড়োয়াড়ি, বিহারি ইত্যাদি জনগোষ্ঠীই বোঝায়, অসম ইতিহাসে তার অজস্র নজির আছে। আজ অসমে জনজাতীয় এবং মুসলমান কৃষকদের লড়িয়ে দেবার স্বার্থে জনজাতীয়দের মধ্যে প্রবল মুসলমান বিদ্বেষ জাগিয়ে তোলা হচ্ছে, বা হয়েছে। কিন্তু যখন সাইমন কমিশনের সামনে প্রথম নিজেদের দাবি দাওয়া নিয়ে জনজাতি নেতৃত্ব হাজির হচ্ছিলেন চারদিক থেকে বিদ্রূপ বাণে তাদের বিদ্ধ করছিল সেই বর্ণহিন্দু ভূস্বামী এবং সহচরেরা। বডোদের যুব প্রতিনিধি একদল দেখা করবারই অনুমতি পান নি, হঠাৎ গিয়ে স্যর শাইদুল্লাহ , পরে যিনি ব্রিটিশ ভারতে অসমের প্রধানমন্ত্রী হবেন, উপস্থিত হলে তিনি তাদের প্রবেশের ব্যবস্থা করে দেন। যাদব চন্দ্র খাকলারির নেতৃত্বাধীন অসম কছারী যুবসংঘের প্রতিনিধি দলটির তাই সেদিন অন্যতম দাবিই ছিল বডোদের জন্যে পৃথক নির্বাচক মণ্ডলী এবং কিছুতেই যেন এই জনগোষ্ঠীকে হিন্দুবলে বিবেচনা করা না হয়। পরে যখন ১৯৩৩এ ট্রাইবাল লীগ গড়ে উঠে তারও মূল দাবিমালাতে ছিল এগুলো।
 
         ব্রিটিশ ভারতের এমন নব্যব্রাহ্মণ্যবাদী ব্যবস্থাতে বহু জনজাতি হিন্দু হয়ে উঠবার মোহতেও মেতেছিলেন ঠিকই । সেও আরেক লাভজনক ব্যবসা হয়ে উঠেছিল কারো কারো। কিন্তু পুরো দস্তুর হিন্দু হয়ে উঠাটাও বেশ কঠিন এবং ব্যয় সাপেক্ষ কম্ম ছিল। দীর্ঘদিনের শঙ্করী বৈষ্ণব ধর্মের প্রচার প্রসারেও অবস্থা বিশেষ পাল্টায় নি। ভাটি অসমে যেমন ধর্মান্তরিত হয়ে পুরো দস্তুর হিন্দু হতে চাইলে শুরুতে একটি জনগোষ্ঠী বা ব্যক্তিকে সমাজের একেবারে নিচের পানীকোঁচ বা কোঁচ সম্প্রদায়ে স্থান দেয়া হতো। কয়েকটি প্রজন্ম যদি নিষ্ঠা ভক্তিতে সত্রের দিশা পরামর্শ মেনে আচার অনুষ্ঠান পালন করেন তবেই শুধু হিন্দু হতে পারতেন। তার জন্যে যে অনুষ্ঠান হতো সে ছিল অকল্পনীয় ভাবে ব্যয় বহুল। জগৎ চন্দ্র মুশাহারি মৌজাদার ছিলেন। তাঁকে উনিশ শতকের শেষে হিন্দু হবার ধর্মীয় অনুষ্ঠানে ৬০০০ টাকা ব্যয় করতে হয়েছিল। বোঝাই যায় এই ধন কাদের হাতে গেছিল। পূর্বোত্তর ভারতে খৃষ্ট ধর্ম কেন এই সময়ে দ্রুত এবং সহজে ছড়িয়ে পড়েছিল তার একটা কারণ আমরা এর থেকে অনুমান করতে পারি। সেগুলোও যে কোনোদিনই বামুন কায়েত ভালো নজরে নেয় নি, তার কারণতো শুধুই ধর্মীয় নয়, শ্রেণি আধিপত্য হারাবারও ভয় বটে। হিন্দু ধর্মের দিকে যখন টেনে আনতে পারেনি, ভেতর থেকে বর্ণবিদ্বেষকে যখন নিরাকৃত করতে পারে নি তখন ১৯৪৭ উত্তর ভারতে আধিপত্য রক্ষার এই শাসক শ্রেণির অন্যতম উপায় হয়েছে বহিরাগতবিদ্বেষ, বাঙালি (হিন্দু) বিদ্বেষ এবং সর্বাধিক মাত্রাতে মুসলমান (বাঙালি) বিদ্বেষ। যে মুসলমান সমগ্র পূর্বোত্তর ভারতেরই কৃষি এবং অকৃষি শ্রমিকদের সবচে বড় অংশ।
           এমন পরিস্থিতিতেই ব্রহ্মআন্দোলনও ছড়িয়ে পড়েছিল। সে অন্য প্রসঙ্গ। আমরা বরং বুঝবার চেষ্টা করতে পারি কী ভাবে দৃশ্যত কৃষি অর্থনীতির বহির্ভূত উপায়েও ভূমি মালিকেরা তাদের জমিতে কৃষি মজুর কিম্বা ভূমিদাসের যোগান নিশ্চিত করেছিলেন। কিছু ব্যতিক্রমী স্বাধীনতা সংগ্রামীদের বাইরে প্রায় কোনও বর্ণহিন্দু সমাজ কিম্বা রাজনৈতিক নেতৃত্ব ব্রিটিশ আমলে জনজাতিদের মধ্যে শিক্ষা বিস্তারের কোনও উদ্যোগই নেন নি। ব্রিটিশোত্তর তথা নয়া উপনিবেশ আমলে ১৯৬১ জনগণনার থেকে জানা যায় শিবসাগর জেলাতে বিদ্যালয় বিহীন গ্রাম সংখ্যার অনুপাত ছিল ৩.৯৫%, কামরূপ জেলাতে ৫.৭৯% , কিন্তু জনজাতি বহুল পশ্চিম অসমের অবিভক্ত গোয়াল পাড়া জেলাতে সেই সংখ্যা ছিল ৪২.৪৬ % আর পূবের অবিভক্ত লক্ষীমপুর জেলাতে সেই অনুপাত ৪২.৪৬% এরা যে মূলত জনজাতি তা আরেকটি তথ্য থেকেও স্পষ্ট হয়। সে বছরে মেট্রিক উত্তীর্ণ জনজাতিদের অনুপাত ছিল সমস্ত উত্তীর্ণদের মধ্যে মাত্র ০.৩৩ শতাংশ। প্রায় তিনদশক পরে ১৯৮৯-৯০ এবং ৯১-৯২তে প্রাথমিক স্তরে ছাত্র-ছাত্রী সংখ্যা ছিল ১,২৫,৬৪০জন এবং ১,২৪, ২০৫ জন। একই সময়ে ১৯৮৯ এবং ১৯৯১তে স্নাতক সংখ্যা ছিল মাত্র ৭,৭০৫ এবং ৮,৫০২। পরিসংখ্যাগুলো খুব সুশৃঙ্খল নয়। কিন্তু বৃদ্ধির গতি যে ধীর এটি অনুমান করা যায়। ১৯৮৯-৯১ হচ্ছে এমন সময় যখন বিদেশীবা বহিরাগততাড়িয়ে অসমিয়া জাতির স্বার্থসুরক্ষার দাবিতে ছবছরের অসম আন্দোলনের থেকে উঠে আসা দল অসম গণ পরিষদ প্রথম পাঁচ বছরের সরকার চালিয়ে ফেলেছে। এবং হতাশ জনজাতিরা চারদিকে নিজেদের দাবি নিয়ে লড়াইতে নেমেছেন আবার। সেই অগপ আমলে জনজাতিদের আর চাকরি পেতে গেলে ভালো বংশের হতে হবে বলে লিখিত কানুন ছিল না বটে, কিন্তু কার্যত তাই হয়েছিল।১৯৮৫ থেকে ৮৭ এই দু'বছরে সরকার ১,১৩, ৪১৩ জনকে নিয়োগ দেয়। সচিবালয়ে ২৭০১ নিয়োগের বিপরীতে জনজাতি মাত্র ১০৭। ৮৩২ জন চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীর মধ্যে সেখানে মাত্র ১৮ জন জনজাতি। সংরক্ষিত শূন্য আসন পড়ে ছিল নিম্নবর্গের কেরানির চাকরিতে ২৮ %, টাইপিস্টের চাকরিতে ১৬ % ১০
         মূলত পূর্ববঙ্গীয় বাঙালি কৃষকদের আগমনকে কেন্দ্র করে কৃষক জনগোষ্ঠীর মধ্যে যে সংঘাত ব্রিটিশ আমলে দেখা দিয়েছিল, তার নিরসনে লাইন প্রথা চালু করা হয়েছিল। সেই প্রথাটি পর্যালোচনা করবার জন্যে ব্রিটিশ আমলেই হকেনহল কমিটিকে দায়িত্ব দেয়। কমিটি কাজ করবার সময়েই জনজাতিদের জমিতে অজনজাতি (মূলত পূর্ববঙ্গীয়) কৃষকদের বসাবার বিরুদ্ধে জনমত প্রবল হয়। ১৯৩৯এ গোপীনাথ বরদলৈয়ের নেতৃত্বাধীন সরকার একটি প্রস্তাবও নেয়, সমতল এবং পাহাড়ের জনজাতি, চা-জনজাতি অধ্যুষিত সেই সব অঞ্চল যেখানে নেপালিরাও চাষাবাদ এবং গোপালন করেন, এবং তপশিলি জাতির বসতি অঞ্চলে ভূমি হস্তান্তরে নিষেধাজ্ঞা জারি করতে। স্বল্পস্থায়ী এই সরকার পড়ে গেলে শাইদুল্লাহ সরকার এই নিয়ে উৎসাহ দেখায় নি। কিন্তু ১৯৪৭এই আবার গোপীনাথ বরদলৈ সরকার ক্ষমতাতে এসে ১৮৮৬র অসম ভূমি এবং রাজস্ব আইনে নতুন করে ১০ নং একটি অধ্যায় জুড়ে দিয়ে জনজাতীয় ভূমি বেষ্টনীর ( Tribal Belts and Blocks) একটি ব্যবস্থা করেছিলেন কিন্তু যেহেতু এর পরিচালনা তথা রক্ষণাবেক্ষণের ভার অসমিয়া মধ্যবিত্তের হাতেই থেকে গেছিল জনজাতীয়দের সুরক্ষা দিতে এটি ব্যর্থ হয়েছিল। প্রায়ই জনজাতিদের আপত্তিকে উপেক্ষা করে এর ভেতরে অজনজাতিদের ভূমি পত্তন দেয়া হয়েছিল। কোনও ধরণের আইনি সুরক্ষা না দিয়ে এসব জমিতে দেশভাগের পরে আসা বহু শরণার্থীদেরও বসানো হয়েছিল। তার উপরে নানা বাহানাতে এই জমি সংরক্ষণ মুক্ত করে দেয়া হতো। অনেক সময় জনজাতিদের উচ্ছেদ করা হতো, আর হলে বিশ ত্রিশ বছর অব্দি এরা কোন ক্ষতিপূরণের মুখ দেখতেন না। একটি প্রজন্মের আয়ু ফুরিয়ে যেতো। এগুলো স্বাধীনতার পরেও চলতে থাকে, ঔপনিবেশিক আইনের উপরে কিছু বিধিনিষেধের প্রলেপ পরিয়ে। এমনকি জাতীয়তাবাদীঅগপ সরকারও ব্যতিক্রমী কিছু করে নি। ইন্দিবর দেউরি লিখেছেন, “ ‘অসম চুক্তির ১০ নং দফার সুযোগ গ্রহণ করে অগপ সরকার বেদখলকারী উচ্ছেদ করবার নামে সরকারী ভূমি এবং সংরক্ষিত ভূমির থেকে শুধু জনজাতীয় গরীব কৃষকদেরই ব্যাপক হারে উচ্ছেদ করতে লেগে গেল। অথচ সেই দফারই অন্তর্গত ট্রাইবেল বেল্ট এবং ব্লকের ভূমির থেকে অবৈধ অজনজাতীয় দখলকারীর উচ্ছেদ করতে কোন ব্যবস্থাই নিলো না।১১ জনজাতীয় ব্লকে অজনজাতি বিশেষ করে মুসলমান কৃষকের বসতিকে নিয়ে সংঘাত এখনো জিইয়ে রেখে দেয়া হয়েছে, ২০১২তে বডোল্যাণ্ড সংঘাতেও প্রশ্নটিকে আবার সামনে নিয়ে আসা হয়েছিল। যে বর্ণহিন্দুশাসক শ্রেণি এককালে এই বিশৃঙ্খল কারবারটি করেছিলেন তারা এখনো এর কোনও সুস্থ সমাধান করেন না। দুপক্ষকে পরস্পরের বিরুদ্ধে মাঝে মধ্যে লেলিয়ে দেন মাত্র। অথচ, পূর্ণ বড়ো ২০০৭এর এক লেখাতে জানাচ্ছেন, অসমের ২৩টি জেলাতে পতিত জমি রয়েছে ২০,০১৯.১৭ বর্গকিলোমিটার, যা কিনা রাজ্যের মোট ভৌগোলিক অঞ্চলের ১৫.৫২% কিন্তু কোনও জনজাতি বা অন্য কৃষকদের মধ্যে এগুলো বিলিবন্টনের কোন ব্যবস্থাই করা হয় নি। ১২এখন অবশ্যি অসমে জেলার সংখ্যা ২৭। কিন্তু মূল পতিত জমির হিসেবে তাতে কোনও হেরফের হয়েছে বলে মনে হচ্ছে না। তার মানে বাংলাদেশীদের জন্যেই জনজাতিরা ভূমিহারা হচ্ছেন এই প্রচার একপক্ষীয় এবং উদ্দেশ্যপূর্ণ। সেই সঙ্গে প্রতি বছর ব্রহ্মপুত্রের ভাঙ্গনে কত মানুষ আরো নতুন করে ভূমি হারিয়ে অসংগঠিত অনিশ্চিত শ্রমের বাজারে যোগ দিচ্ছেন, সেই স্বতন্ত্র আলোচনার দিকে আমরাতো যাচ্ছিই না।
    হীরেন গোঁহাই লিখেছেন, “ ...অসমের জনজাতি মানুষের অবস্থা ঔপনিবেশিক ব্যবস্থার ফলে সাধারণ অসমিয়ার থেকেও নিচে নেমে গেছিল। সাধারণ অসমিয়াদেরও অর্থনৈতিক সংকট হয়েছিল। কিন্তু যে ধরণের আর্থ-রাজনৈতিক ব্যবস্থার ফলে বুনিয়াদী শ্রমজীবী মানুষের এমন দুর্দশা হয়েছিল তার বিশেষ কোনও পরিবর্তন আনতে পারে নি স্বাধীনতা। অধিকাংশ জনজাতি মানুষ জীবিকার্জনের জন্যে অন্যদের নিচে পড়ে রইলেন।বর্ণহিন্দুদের মধ্যে রায়তী কৃষক কল্পনা করা আর আকাশে কুসুম কল্পনা একই। আমরা আলাদা করে অসমিয়া বা সিলেট কাছাড়ের বাঙালি তপশিলি জাতির কৃষকদের কথা আলোচনা করলাম না, কারণ তাদের ভাগ্যও জনজাতিদের থেকে তেমন পৃথক কিছু ছিল না। আমাদের বলতে হবে, আরো দুই বড় প্রব্রজিত কৃষক জনগোষ্ঠী পূর্ববঙ্গমূলীয় মুসলমান এবং ঝাড়খণ্ডী আদিবাসি কৃষকদের নিয়ে। এরাই এখন অসমের সবচে দুই বড় কৃষি জনগোষ্ঠী।

  

তোমার মার কান্দুনি , নদীর কুল ভাঙনি , আযাইরা পাটর ফুল , ভাবীর নাকে নাক ফুলঃ

              অসমে আহোম রাজাদের আমলেই বহু মুসলমান এসে বসতি করেছিলেন, রাজা উৎসাহিত করতেন। মোঘল-তুর্কদের সঙ্গে যুদ্ধে যারা বন্দি হয়েছিলেন তেমন অনেককেও জমি বাড়ি দিয়ে নানা বৃত্তিতে কাজে লাগিয়েছিলেন আহোম শাসকেরা। এরাই এখন অসমিয়া গরিয়া, মরিয়া বলে পরিচিত। আর ব্রিটিশ আসবার আগেই ধুবড়ি জেলার সিকিভাগ মানুষ ছিলেন মুসলমান।১৩ মুসলমান মানুষ বর্ণহিন্দুদের আগেই প্রবেশ করেছিলেন দ্বাদশ শতকে-- লিখেছেন মেদিনী চৌধুরী। ১৪ সেটি একটু অতিকথন। ভাস্কর বর্মার কামরূপেই ব্রহ্মপুত্র তথা সুরমা উপত্যকাতে ব্রাহ্মণ বসিয়ে আর্যীকরণের সঙ্গে স্থায়ী কৃষির সূচনার ঐতিহাসিক নজির আছে। তবে ব্যাপক ব্রাহ্মণ প্রব্রজন দ্বাদশ শতকের আগে হয় নি বলেই মনে হয়। কিন্তু তখন থেকেই গোয়ালপাড়ার মানাহ বা মানস নদীর পশ্চিমে মুসলমান শাসন কায়েম হয়ে গেছে। বহু বডো, রাভা, রাজবংশী মানুষ ইসলামে দীক্ষা নিয়ে মুসলমান হয়ে গেছেন। এই রাজবংশীদের বাঙালি বলে দেখিয়ে গোয়ালপাড়ার বঙ্গীয়করণের একটি প্রয়াস ব্রিটিশ ভারতেও হয়েছিল এবং ১৯৩১ অব্দি এই বিভ্রান্তি বজায় ছিল।১৫ এখনো বহু বাঙালির সংস্কার রয়েছে জেলার মানুষের অধিকাংশের পরিচয় মূলত বাঙালি বলে । গোয়াল পাড়াতে ব্রিটিশ প্রবেশ করেছিল আঠারো শতকেই, দখল পুরো করে ১৮২২এ, বাকি ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা দখলে আনে ১৮২৬এ, এগুলো আমরা আগে লিখে এসছি। ১৮৩৬ থেকেই এরা চায়ের ব্যবসা শুরু করে, কিন্তু এর বাইরে এদের মূল ব্যবসাই ছিল জমি এবং ফসলের পণ্যীকরণ।
             ব্রিটিশ আসবার আগে মানের দীর্ঘ আক্রমণে অসমের ব্যাপক লোকহানীর ফলেও এখানে লোক কমে গেছিল। যারা ছিলেন, তাদের আপসে রায়তারী ব্যবস্থার মধ্যে এনে উৎপাদন এবং রাজস্ববৃদ্ধিও সহজ হচ্ছিল না। ফলে ব্রিটিশ এবং পাট্টাদার অসমীয়া বর্ণহিন্দু সমাজ দুইই অসমে ব্যাপক প্রব্রজনের পক্ষে ইচ্ছে পোষণ করতে শুরু করেন। অসমের নবজাগরণের দূত বলে যাদের মনে করা হয়ে থাকে সেই, আনন্দরাম ঢেকিয়াল ফুকন, হলিরাম ঢেকিয়াল ফুকন থেকে শুরু করে গুণাভিরাম বরুয়াদের প্রত্যকেই আহোম, বডো ইত্যাদি জনজাতিদের সম্পর্কে অন্ত্যজ, ‘ম্লেচ্ছ, ‘দৈত্য, ‘অসুর, ‘ইতরইত্যাদি শব্দ ব্যবহার করলে কী হবে বাঙালি বিহারি এবং অবশ্যই ব্রিটিশের প্রশংসাতে ছিলেন পঞ্চমুখ। বস্তুত, প্রাক-ব্রিটিশ ভারতের মোঘল শাসনকে যেমন অন্ধকার যুগবলে চিহ্নিত করা হয়েছে এমন এক উদ্যোগ প্রাক-ব্রিটিশ অসমের কোচ-আহোম রাজ্য সম্পর্কেও নেয়া হয়েছিল পূর্ণদ্যমে। আর এতে ব্রিটিশ এবং অসমিয়া বর্ণহিন্দুর সঙ্গে প্রব্রজিত বাঙালি বর্ণহিন্দুও যে যোগ দিয়েছিলেন তেমনটি ভাববার যথেষ্ট সংগত কারণ আছে। একেতো অসমিয়া বর্ণহিন্দুর সমর্থনেই উনিশ শতকের মাঝামাঝি প্রায় তিন দশক অসমের প্রশাসনিক ভাষা হতে পেরেছিল বাংলা আর ১৮৩৫ থেকেই এই রাজ্যে নতুন যেসব বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হতে শুরু করে সেগুলোতে শিক্ষকের পদও দখল করেন বাঙালিরাই। ১৬ ভূমি বন্দোবস্তির দায়িত্বও যে মূলত মাড়োয়াড়িদের সঙ্গে সিলেটিরা নিজের হাতে তুলে নিয়েছিলেন, আমরা আগেই লিখেছি। এতে যে অসমিয়া বর্ণহিন্দু খুব অসন্তুষ্ট ছিলেন এমনটি মনে করবার কোনও কারণ নেই, বলি নারায়ণ বড়া লিখছেন, “ সুশিক্ষিত বাঙালি মানুষ যত বেশি করে আসামে আসেন, এই দেশের ততই মঙ্গল।১৭ প্রব্রজন বাড়াবার বিচিত্র উদ্যোগ নিলেই উনিশ শতকের শেষের আগে প্রশাসনিক এবং চা-বাগানের শ্রমিক কর্মচারীদের বাইরে আর কোনও রকম প্রব্রজন ব্যাপক আকার নেয় নি। অথচ শাসকদের মূল ভাবনাই ছিল ভূমি রাজস্বের বৃদ্ধি। ...unless Assam is colonized from Bengal, there is no prospect or hope of the province being fully under cultivation for centuries to come” গাঁও জেলার প্রশাসক ক্যাপ্টেন বাটলার ১৮৫৪তে এক সরকারি প্রতিবেদনে লিখছেন। ১৮ তার জন্যে এরা শুরু থেকেই বাংলাদেশের সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতিতে মন দিয়েছিল। উনিশ শতকের শেষ অব্দি এদের এই উদ্যমে বিশেষ কোনও ফল না মিললে এরা পূর্ব উত্তর প্রদেশ এবং উত্তর বিহার থেকেও মানুষ নিয়ে আসবার উদ্যম নেন। ব্রিটিশের উদ্যম কম দেখলে অসমীয়া বর্ণহিন্দু সমাজ দল বেঁধে তার জন্যে স্মারক পত্র দিয়ে চাপ দিচ্ছিলেন। ১৮৮৬তে যখন ভূমি রাজস্ব আইনের প্রয়োগ হচ্ছে তখন এই চাপ এতো বাড়ে যে সরকার অসমে এলে রেল এবং জাহাজ ভাড়া হ্রাস করা, খাজনাবিহীন ভাবে ভূমি বন্দোবস্তি দেবারও ব্যবস্থা করে ফেলেছিল। কেউ কেউ সরকারি ভাবে অসমে আসবার জন্যে বিজ্ঞাপন জারি করতেও ইচ্ছে জানিয়েছিলেন। বাংলাদেশে সেটি করাও হয়েছিল।
              নবজাগরণের দেশের থেকে আসা ব্রিটিশ শাসকদের এবং তাদের দেশীয় সহযোগীদের ডাকে এরফলে বিচিত্র জনগোষ্ঠীর লোক অসমে এসেছিলেন। কিন্তু এসেছিলেন ভারতীয় জাতপাত এবং শ্রেণি ধর্ম মেনে। কোনও ভাবেই ব্রিটিশ এগুলো ভাঙেনি, বা ভাঙ্গতে চায়ও নি। পুনর্বিন্যস্ত করেছিল মাত্র । চা-বাগানে শ্রম বিক্রি করতে এসছিলেন মূলত মধ্যভারতীয় আদিবাসীদের বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মানুষ। ২) অথচ একই চা-বাগানের প্রশাসনিক কর্মচারী হয়ে এসছিলেন বাঙালি বাবুরা । বাবুসেই থেকে চা-বাগানগুলোতে একটি প্রতিষ্ঠিত প্রশাসনিক শব্দ। এখন অসমিয়া কর্মচারী অনেকে থাকলেও তারাও বাবুপরিচালক মানে সাহেব। কারণ এই সেদিন অব্দি এরা সত্যি সাহেবছিলেন। ৩) রাস্তাঘাট, সেতু, গৃহ নির্মাণ, রেল-লাইন বসানো ইত্যাদি কাজের জন্যে বিহার , উড়িষ্যার দলিত হিন্দু। ৪) গো-পালন এবং দুধের যোগান ধরা, চৌকিদার, সাহেব- বাবুদের বাড়ির কাজ করবার জন্যে নেপালের নেপালি মানুষ। সাধারণ কৃষক বা গোর্খা রেজিমেন্টের অবসর প্রাপ্ত সৈনিক। ৫) বাঙালি হিন্দু, মাড়োয়াড়ি, কিছু পরিমাণে ঢাকার মুসলমান এবং বিহারি ব্যবসায়ী কিম্বা সুদের কারবারি মহাজন। ৫) কৃষি কাজের জন্যে ময়মন সিংহ, রংপুর থেকে ব্যাপক সংখ্যাতে মুসলমান এবং কিছু পরিমাণে হলেও হিন্দু নমঃশূদ্র ইত্যাদি দলিত কৃষক। এখনো এই মানুষগুলোর বৃত্তি এবং বর্ণ অধিকাংশ স্থলে একই।
             আমরা এখন কথা বলব এই শেষোল্লেখিত কৃষক জনগোষ্ঠীটিকে নিয়েই। একটি প্রচলিত ধারণা আছে যে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকাতে বাঙালি কৃষক মানেই ময়মন সিংহের থেকে আসা মুসলমান। যারা মিঞা মুসলমান বা পমুয়াবা ভাটিয়ামুসলমান বলে পরিচিত। আজকাল জনশ্রুতিতে এবং সংবাদপত্রের ভাষাতেও এরা প্রায় সবাই বাংলাদেশী। আসলে এই সংখ্যাটা হবে ৮৫ % বাকি ১৫ % ময়মন সিংহের হিন্দু বাঙালি। সিলেট অসমে যুক্ত হলে সেখান থেকেও ব্যাপক মুসলমান কৃষকের প্রব্রজন তখন অবিভক্ত কাছাড় এবং প্রতিবেশি ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার অবিভক্ত নওগাঁ জেলাতে হয়েছিল।
             যেমন চা-বাগানের দরকারে আদিবাসীদের নিয়ে আসা হয়েছিল, বাংলাদেশের কৃষকদের অসমে নিয়ে আসার পেছনে প্রথম প্রেরণাটি ছিল কলকাতা তথা বাকি বাংলাদেশে ক্রমান্বয়ে বেড়ে চলে পাটকল গুলোর চাহিদা মেটানো। উনিশ শতকের শুরু থেকেই বাংলাদেশে পাট উৎপাদনে বিশেষ আগ্রহী হয় ব্রিটিশ বণিকেরা। ১৮৫৪ নাগাদ এরা কলকাতার কাছে শ্রীরামপুরে পাটকল গড়ে তোলে। তিনদশকের ভেতরে কলকাতা শহরের কাছে সতেরোটি, বাকি বাংলাদেশে আঠারোটি কল গড়ে উঠে। প্রায় বিশ হাজার শ্রমিক সরাসরি এই কলগুলোতে শ্রমে নিয়োজিত হয়েছিল। শরৎচন্দ্রের মহেশগল্প ভালো বর্ণনা করেছে, কোন পরিস্থিতিতে এক কৃষক ভূমিহীন হয়, পাটকলে শ্রমবিক্রি করতে যায়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় এই কলের সংখ্যা দাঁড়িয়েছিল ৬৪, যুদ্ধ শেষ হতে না হতে সেই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৭৬। আর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরুতে এই সংখ্যা ছিল ১১০।১৯ পাটগুলো বিদেশেও রপ্তানি হতো, আর যুদ্ধের বাজারে এর চাহিদাও বেড়েছিল ব্যাপক। সেই চাহিদা মেটাতে অসমেও এর ফলন ছড়ানোটা দরকার হয়ে পড়েছিল, সেটি করতে পারতেন শুধু বাংলাদেশের কৃষকেরাই। তাই এই সময়েই প্রব্রজনে জোরটি পড়ে। উনিশ শতকের শেষে চট্টগ্রাম বন্দর লামডিং হয়ে থেকে ডিব্রুগড় অব্দি প্রতিষ্ঠিত অসম বাংলা রেলওয়েও কাজটিকে সহজ করে দেয়। তারউপরে ১৯০৫এর কার্জনের বঙ্গভঙ্গ পরিকল্পনা অনুযায়ী ঢাকাতে রাজধানী করে পূর্ববঙ্গ এবং অসমপ্রদেশ গড়বার ফলেও অনুকূল রাজনৈতিক পরিবেশ গড়ে উঠে। ১৯০১-০২ সনে অসমে মরাপাট চাষের এলাকা ৫ হাজার একর থেকে বেড়ে চার দশক পরে ১৯৪১-৪২ এ দাঁড়ায় ২৭৭ হাজার একর। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে অতিষ্ঠ কৃষকেরাও কোন না কোন ভাবে বাংলার থেকে বেরুতে চাইছিলেন, জমিদার এবং ব্রিটিশ প্রশাসনের অনেকেও কৃষি বিদ্রোহ এড়াতে সেখানকার কৃষককে এখানে এনে বিদ্রোহ প্রশমন করতে চাইছিলেন, এগুলো ছিল প্রব্রজনের তাৎক্ষণিক রাজনৈতিক প্রেরণা। প্রব্রজন ঘটিয়ে যে পাট্টাদারেরা মুনাফা বাড়াবার তালে আগে থেকেই ছিলেন, এরা এই সুযোগের পূর্ণ সদব্যবহার করলেন। সবাই যে পাট চাষে নিয়োজিত হলেন তা নয়, আর অন্যদিকে এখনো অনেকে অসমে পাটচাষে নিয়োজিত এই তথ্য যেন আমরা মনে রাখি। অসমীয়া মহাজনদের অনেকেই বাংলাদেশের মতো জমিদার হবার লোভে দুদ্দাড় এদের বসাতে শুরু করলেন অনাবাদী জমিতে। বহু সময় একসনা পাট্টার জমি থেকে পুরোনো রায়ত উঠিয়েও এদের বসানো হলো, সরকারী মাটিও মুক্ত করে দেয়া হলো। এরা জমি ফেলে রাখতেন না, গোটা বছরে এক ফসল কেটে তোলবার পরেই অন্য ফসল চাষে মন দিতেন, নিচু জমিকেও চাষের উপযোগী করে তুলতে পারতেন এবং সবচেগুরুত্বপূর্ণ কথা হলো বছর ভর এদের শ্রমের সঙ্গে টেক্কা দিতে পারতেন না জনজাতি বা অসমিয়া অন্য কৃষকেরা। এই সব বাংলাদেশের কৃষকদের গুণকীর্তনে তখনকার অসমীয়া মধ্যবিত্ত পঞ্চমুখ। অনেকেই জমি কেনাবেচার ব্যবসাতে নেমে পড়লেন, টাকা ধার দিয়ে বড় সড় মহাজনও হয়ে উঠলেন অনেকে। এই মহাজনী সুদের কারবারে মাড়োয়ারিরাও যোগ দিয়েছিল ভালো সংখ্যাতে , এমন কি এখন যখন রাজ্যের সত্রগুলোর জমি বাংলাদেশীরা দখল করে ফেলেছে বলে জাতীয়তাবাদীসংগঠনগুলো বেশ হাওয়া গরম করে রাখে, সেই সব সত্রগুলোর অনেকেও নতুন জমিদার এবং মহাজন হয়ে উঠবার ব্যবসাতে নেমেছিলেন। বিশেষ করে বরপেটা সত্রের কথা উল্লেখ করেছেন দেবব্রত শর্মা।তখন অসমিয়াদের মধ্যে জমি ব্যবসার কেমন ধুম পড়েছিল তার এক মজার বিবরণ জগন্নাথ বুজরবরুয়ার এক সাক্ষ্যে আছে, “ তখন বরপেটার মানুষের মনে পমুয়ার কাছে জমি বিক্রি করে ধনী হয়ে উঠবার ধুম উঠেছিল। এঁরা জঙ্গলের ভেতরের অঞ্চলে গিয়ে জঙ্গল ভেঙ্গে জমি বের করেন , গ্রাম বসিয়ে সেখানে থাকেন, ‘পমুয়াএলেই তাদের কাছে জমি বিক্রি করে চলে যান। ২০ প্রথম দিকে এরা গোয়ালপাড়া, বরপেটা জেলাতে গিয়েই বসতি করেছিলেন। ধীরে ধীরে কামরূপ, মঙ্গলদৈ এমন কিছু জেলাতে ছড়িয়ে পড়েন। এদের এই বিস্তারে জনজাতি বা পুরোনো অজনজাতি রায়তেরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছিলেন বা তাদের মধ্যে অসন্তোষ ছড়াচ্ছিল বলে এখন খুব বলা হয়ে থাকে, কিছুটা নিশ্চয় ছড়িয়েছিল। কিন্তু এই সব প্রব্রজিত কৃষকদের অধিকাংশই বসেছিলেন ব্রহ্মপুত্রের চর অঞ্চলে। যার জন্যে এদের অন্য পরিচয় দাঁড়ালো চরুয়া। এখনো এদের নব্বুই শতাংশ এই সব অঞ্চলেই বাস করেন, অস্থায়ী চরের সঙ্গে অস্থায়ী এদের কৃষিজমি, বসত ভিটা এবং ভূমি ব্যবস্থা। সুতরাং সত্যি সত্যি এরাই কতটা জনজাতিদের পক্ষে বিপদের কারণ হয়েছিলেন আর কতটা সরকার এবং বাকি পাট্টাদারেররা এদের বিপদ ছিলেন এটি সূক্ষ্ম অধ্যয়ন দাবি করে। তবে কৃষকদের নিজেদের মধ্যে জমি নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা অস্বাভাবিক কিছু নয়।
              ২০এর দশক থেকেই এই প্রব্রজন অসমের জনবিন্যাস এবং সংস্কৃতির বিপদ ডেকে আনবে বলে অনেকেই কথা বলতে শুরু করেন। হঠাৎ এই জনবিন্যাস সচেতনা নিজেই তার রূপ পাল্টাতে শুরু করে। মজা হলো অন্যদের সম্পর্কে নয় তেমন, বিশেষ করে এই কৃষকেরাই অসমের ভাষা এবং ধর্ম বিন্যাস পালটে ফেলবেন বলে অনেকেই অভিমত জানাতে শুরু করেন। সেই চাপ এতো প্রবল হয় যে ১৯২০এই সরকার বহুবিতর্কিত লাইন প্রথাচালু করে। চা- বাগানের শ্রমিক লাইনের মতো পমুয়া লাইন। এই প্রথা অনুযায়ী পমুয়াদের নির্বিচার পুরোনো অসমের বাসিন্দাদের প্রতিবেশী হতে বাধা দিল। জমি চিহ্নিত হলো লাইনের কোনদিকে পমুয়ারা বাস করতে পারবেন, কোনদিকে পারবেন না--জানিয়ে। মুসলমান কৃষকেরা শুরু থেকেই এর বিরুদ্ধে ছিলেন, মৌলানা ভাসানী এর বিরুদ্ধে লড়েই অসমের এই সব কৃষকদের নেতৃত্বে উঠে এসছিলেন। একে অনেকে এখনো তাঁর মৌলবাদ বলে চিহ্নিত করে থাকেন। মুসলমানদের মধ্য প্রভাব বিস্তারে ব্যর্থ পুরোনো কমিউনিস্টরাতো বটেই। অথচ এই প্রথাটি চিহ্নিত হওয়া উচিত ছিল হিন্দু জাতব্যবস্থার অস্পৃশ্যতার ঔপনিবেশিক রূপ বলে, জনজাতিরাও নিজের বাইরে এক অস্পৃশ্য জনগোষ্ঠী পেয়ে আত্মতুষ্ট বোধ করতে পারেন। আর হয়েওছে এই। স্পষ্টতই এটি সামাজিক মেলামেশা তথা আত্মীকরণ প্রক্রিয়ারও বিরোধী ছিল। মুসলমানে ছেয়ে গেলে বাকিদের ধর্মান্তরিত করে ফেলে হিন্দু সংখ্যা কমিয়ে ফেলা হবেএহেন প্রচারকে কিন্তু কেউ তেমন সাম্প্রদায়িকতা বলে চিহ্নিত করছিলেন বলে দেখা যায় না। কিন্তু এই অসমিয়া শাসক শ্রেণির সবাই যে এই লাইন প্রথার সমর্থক ছিলেন, তাও নয়কারণ এ তাদের ব্যবসাবুদ্ধির বিপরীত ছিল। এদের প্রশ্রয়েই লাইন প্রথা প্রায়ই অমান্য করা হতো, দুর্নীতিবাজ আমলারাও সুযোগ নিত। ১৯১৯এর অসম সাহিত্য সভার সভাপতি কালীরাম মেধির মতো অনেকেই তখন থেকে এদের সামনে অসমীয়া ভাষা এবং সংস্কৃতিকে গ্রহণ করবার শর্ত উপস্থিত করতে শুরু করলেন। ভূমি এবং কৃষিবাণিজ্য সংক্রান্ত একটি সমস্যা এভাবে অসমের জাতীয়রাজনীতিকে রূপ দিতে শুরু করল। এগুলো আকস্মিক ভাবে এদের সংখ্যাবৃদ্ধির জন্যেই ঘটেনি। যদিও অনেকেই এই ভাবেই ঘটনাকে ব্যাখ্যা করতে চান। প্রব্রজনের ফলে অসমে জনগোষ্ঠীগুলোর মধ্যে আত্তীকরণের কোনোদিনই কোন সমস্যা হয় নি, এমনকি বাংলাদেশে থেকে প্রব্রজিত ব্রাহ্মণ পরিবারগুলোও এখানে এসে নিখাদ অসমিয়া হয়ে গেছেন, অসমিয়া গরিয়ামুসলমান নামের উৎসই বাংলা শব্দ গৌড়। বরং বিশ শতকের জাতীয়চেতনার জোরজবরদস্তিই এই পথে মূল প্রতিবন্ধক হিসেবে দেখা দিয়েছে বলে এখন অধিকাংশ চিন্তকই একমত।
              দেখা যাবে, ১৯০৫এ বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন দেশীয় রাজনীতিকে একাধারে বাঙালি, হিন্দু এবং ভারতীয় জাতীয়তাবাদে রাঙিয়ে দিচ্ছে। অসমকে নিয়েও টানাটানি হচ্ছে। স্বাভাবিক ভাবেই অসমিয়া মধ্যবিত্ত যাদের সিংহভাগ তখন শিক্ষা, বাণিজ্য এবং আইনি দরকারে নিয়মিত কলকাতা যেতেন এগুলোর দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছেন। বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের অসম শাখা গড়ে উঠছে, তার অসম শাখা গড়বার প্রয়াস হচ্ছে এবং কামরূপ অনুসন্ধান সমিতি গড়ে উঠছে, তারও ধারাবাহিকতাতে ১৯১৭তে অসম সাহিত্য সভাও গড়ে উঠছে। কিন্তু ১৯১৯এর মণ্টেগু-চেমসফোর্ড শাসন সংস্কারের মধ্যি দিয়ে ভারতে নির্বাচনী রাজনীতিরও সূচনা হচ্ছে। দলিত, জনজাতি এবং ধর্মীয় সংখ্যালঘু বিশেষ করে মুসলমানদের জন্যে সংরক্ষণের প্রস্তাবও থাকছে তার মধ্যে। সুতরাং ভাষিক, ধর্মীয় তথা জনগোষ্ঠীগত চেতনা হঠাৎ প্রবল হয়ে পড়ছে সর্বত্র। আমরা এর আগে দেখিয়েছি, এই সময়েই অসমে সাইমন কমিশন আসছে এবং জনজাতি সংগঠনগুলোও নিজেদের অন্যান্য দাবিদাওয়ার সঙ্গে সংরক্ষণ, পৃথক নির্বাচক মণ্ডলী এবং অবশ্যই নিজেদের পরিচিতির সমস্যা সংক্রান্ত প্রস্তাব নিয়ে গিয়ে হাজির হচ্ছেন। জাতীয় কংগ্রেস থেকে সুরেন্দ্রনাথ বাড়ুজ্যের মতো প্রতিষ্ঠাতাদের প্রস্থান এবং গান্ধির প্রতিষ্ঠা, অসমে ১৯২১এ তার প্রাদেশিক শাখার প্রতিষ্ঠাএই সব ঘটনাগুলো খুব কাছাকাছি ঘটছে। সুতরাং অসমীয়া বর্ণহিন্দুকে তাঁর রাজস্ব-মোহের অতিরিক্ত রাজনৈতিক আধিপত্য তথা ভোট ভিত্তি নিয়ে ভাবতে হচ্ছে। তাই এখন থেকে সে বৃহত্তর অসমিয়া জাতি গঠন সম্পর্কে নতুন প্রকল্প উপস্থিত করছে। বাঙালি বর্ণহিন্দু রায়ত নয়, তারা পাট্টাদার , জমিদার, আমলা , শিক্ষক ইত্যাদি। যাদের মধ্যে অসমিয়াকে বাংলার উপভাষা বলে ভাবা আর না ভাবলেও হীনতর ভাবার উচ্চমন্যতা ছিলই। সুতরাং তাদেরকে অসমিয়া করা যাবে না। তাঁরা যদি অসমে আধিপত্যের জায়গা থেকে ধীরে ধীরে নীরবেও সরে দাঁড়ান তবে স্বাগত। তাই কামরূপ অনুসন্ধান সমিতির যাত্রা বাঙালিদের সঙ্গে নিয়ে শুরু হলেও, অসম সাহিত্য সভা ক্রমেই রাজ্যের বাঙালি বৌদ্ধিক শ্রেণিটিকে দূরে ঠেলে দেয়া হচ্ছে। বা বাঙালি বৌদ্ধিক শ্রেণিটি সরে দাঁড়াচ্ছেন। বেণুধর রাজখোয়ার সঙ্গে ত্রিশের দশকে ধুবড়ি সাহিত্য সভার বাঙালি কর্মীদের সংঘাত বা লক্ষ্মীনাথ বেজবরুয়ার সঙ্গে সেকালের অন্যতম সিলেটি গবেষক পণ্ডিত পদ্মনাথ ভট্টাচার্য বিদ্যাবিনোদের সংঘাত থেকে শুরু করে সিলেট নিয়ে অসম বিধান সভার গোটা সংঘাতময় ইতিহাস এই প্রসঙ্গে আমরা স্মরণে আনতে পারি। দেশভাগের আগে অব্দি সিলেটি বর্ণহিন্দু নেতৃত্বও কিন্তু অসম থেকে বেরিয়ে যাবার জন্যেই উদগ্রীব ছিলেন। গুয়াহাটিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রস্তাব এলে তাদের অনেকেই সিলেটে বিশ্ববিদ্যালয়ের দাবিতে সরব হয়েছিলেন। ফলে এদের কিম্বা এদের আধিপত্যাধীন জনতাকে অসমিয়া করা ছিল দুষ্কর। ১৯৬১র ভাষা আন্দোলনে সেটি বড় করেই প্রমাণিত হয়ে গেছে।
              সহজে অসমিয়া করা যাবে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার ভাষা-ধর্ম নির্বিশেষে রায়তদেরকে এমন ভাবাটা ছিল খুবই সহজ। কিন্তু সেই রায়তদের মধ্যে দুই বৃহৎ জনগোষ্ঠী ময়মনসিংহের হিন্দু-মুসলমান কৃষক এবং চা-বাগানের আদিবাসী অতি সম্প্রতি মাত্র এসছেন। তাদের অসমিয়া করে ফেলবার জন্যে নতুন সূত্র নির্মাণ দরকার পড়ছিল। তার সূচনা ছিল এই লাইন প্রথা। অনেকের ধারণা, প্রথাটি কেবল মুসলমানের জন্যে ছিল, হিন্দু কৃষকের সংখ্যাল্পতার জন্যেই তাদেরও এক বড় অংশের অস্তিত্বের ব্যাপারটি এখনো হিন্দু বাঙালি লেখক-বুদ্ধিজীবীর চিন্তাতেও জায়গা করেছে বলে মনে হয় না। ভাষার সমস্যাটিকে এহেন শ্রেণি-বর্ণের দৃষ্টিতে বাঙালিরা অন্তত এখনো দেখতেই শুরু করেন নি। তারা একে দেখেন, নিছক জাতীয়তাবাদ বনাম সাম্প্রদায়িকতার মধ্যবিত্তীয় দৃষ্টিতে। দেবব্রত শর্মা এই লাইন প্রথা নিয়ে বেশ রসিকতা করে লিখেছেন, “ পেছনে ফিরে তাকালে আমরা শুধুমাত্র একটিই লাইনদেখব না, দেখব অসমের মানুষকে ভাগ করে রাখা তিনটি লাইন বা রেখা। এই তিনটি লক্ষণরেখা হচ্ছে অভিবাসী বিরোধী লাইন, পাহাড় এলাকাতে প্রযোজ্য ইনার লাইনএবং চাবাগানের কুলী লাইন। মজার কথা হলো, অসমিয়া মধ্যবিত্তের দৃষ্টিভঙ্গি লাইনে লাইনে বদলে যায়। তাঁরা অভিবাসী বিরোধী লাইনের দৃঢ় সমর্থক হলেও পাহাড় এলাকাতে তাদের নিজেদের প্রবেশ অধিকার নিষেধ করা ইনার লাইনের তারা ছিল তীব্র বিরোধী। অন্যদিকে চা-বাগানের লাইনসম্পর্কে তাঁরা সম্পূর্ণ নিস্পৃহ বা উদাসীন। তাঁরা চা-বাগানের লাইনে ঢোকতেও চাইতেন না, উলটো বাগানের ঝাড়খণ্ডী আদিবাসীদের তাঁদের সঙ্গে মেলামেশা করতে দিতেও আগ্রহী ছিলেন না। তাই এই তিনটি লাইনের নিষ্পত্তি রাজনৈতিক সুবিধাভিত্তিক নয়, গণতান্ত্রিক নীতিভিত্তিক হওয়াটা দরকার।২১ তবে শুরুতেই সবাই লাইন প্রথার দৃঢ় সমর্থক ছিলেন না। দীর্ঘদিন এটি অসমের রাজনীতিকে সরগরম করে রাখে ১৯২৭এ অসম বিধান পরিষদের এক বিতর্কে নবীন চন্দ্র বরদলৈ যতটা সম্ভব প্রব্রজন যাতে বাধাগ্রস্ত না হয় সেই নিয়ে নিজের ভাবনা ব্যক্ত করেছিলেন । ২২ পরের বছর এই নিয়ে একটি সর্বদলীয় সমিতি গঠিত হয়। এক দশক পরেও ১৯৩৮এ লাইন প্রথা সমিতি যখন রাজ্য জুড়ে সমীক্ষা চালায় এই নিয়ে তখন এদের অসমীয়া ভাষা সংস্কৃতি গ্রহণ করবার দাবি অনেক সবল হয়ে উঠছে। কিন্তু সেই সমিতিও মত ব্যক্ত করে যে, “Proper development of Assam’s agriculture would not be possible without the aid of the immigrants and hence settlement of immigrants would have to continue” কিন্তু সঙ্গে এই কথাও বলে যে, “ The line system should be further tightened in order to protect the tribals in particular” ২৩এই দুই সমিতির নেতৃত্বে কিন্তু ছিল ব্রিটিশ সাহেব, সঙ্গে প্রাদেশিক বিভিন্ন দলের প্রতিনিধিরা অবশ্যি ছিলেন। এই লাইন প্রথাকেই পরে ১৯৪৭এ জনজাতীয় ভূমি বেষ্টনী দিয়ে প্রতিস্থাপিত করা হয়। চল্লিশের দশকে মুসলিম লীগের শাইদুল্লাহের নেতৃত্বাধীন সরকার নতুন করে ব্যাপক প্রব্রজন ঘটিয়েছিল বলে অভিযোগ করা হয়ে থাকে। শাইদুল্লাহ এবং গোপীনাথ বরদলৈ তথা লীগ এবং কংগ্রেসের রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতাও এই সময় বিষয়টিকে জটিল করে রেখেছিল আমরা এই নিয়ে বিস্তৃত আলোচনাতে এখানে যাচ্ছি না। কিন্তু কৃষকদের দুর্দশার ব্যাপকতা বোঝাতে এই তথ্যের উল্লেখ মনে হয় জরুরি যে আমরা দেখালাম মূল ক্ষমতাটি তখনো ব্রিটিশের হাতে আর তারা কিম্বা অসমিয়া মধ্যবিত্তের কেউই অর্থনৈতিক কারণে প্রব্রজনের বিরোধী কোনদিনই ছিলেন না। এখনো নয়। এখনো অসমের বাইরে বাকি দেশ থেকে শ্রমিক প্রব্রজন করানো হয়েই থাকে। তাদের বিরোধটি উঠে আসত রাজনৈতিক আধিপত্যের সমস্যার থেকে। যুদ্ধের বাজারে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীকে খাদ্য যোগাতে গিয়ে বাংলাদেশ কেমন ভয়াবহ মন্বন্তরের মুখে পড়েছিল সে আমরা ভালো জানি। সেই একই দরকারে অসমে উৎপাদন বাড়িতে চাহিদা মেটাবার চাপ অসম সরকারে উপরেও ছিল, সঙ্গে ছিল অসমিয়া মধ্যবিত্তের নিজেরও দুহাতে অর্থ রোজগারের সুযোগ। তারা সেই সুযোগ হাত ছাড়া করেন নি। সরকারের নেতৃত্বে শাইদুল্লাহ ছিলেন বলে অনেকেই মনে করেন গোটা সরকারটাই মুসমান এবং মুসলিম লীগের ছিল। এটি সত্য নয়। ১০৮জন সদস্যের বিধান সভাতে ৩৪ জন মুসলিম বিধায়কের মধ্যে শাইদুল্লাহের সমর্থক ২৩ জনের বেশি ছিলেন না।তিনি নিজেও অসমিয়াই ছিলেন, পূর্ববঙ্গমূলীয় নন। বাকি ৩২/ ৩৩ জন যাদের সমর্থনে তাঁর সরকার চলত তাঁরা হিন্দুই ছিলেন। শাইদুল্লাহ মন্ত্রীসভার নয়জন মন্ত্রীর ছজনই ছিলেন অমুসলমান। ২৪ এই সমস্ত তথ্য ঢেকে ফেলেই এখনো বহাল অসমের জাতীয়তাবাদীরাজনীতি। যুদ্ধের বাণিজ্যে লাভান্বিত মুসলমান মধ্যবিত্তের সংখ্যাও কিন্তু খুব বেশি নয়। হলে অসমের রাজনীতির রঙও শুধু এই পূর্ববঙ্গমূলের মুসলমান কৃষক জনতাকে ঘিরে ঘুরত না। হীরেন গোহাঁই ভারতের মুসলমান সমাজ সম্পর্কে যে কথা লিখেছেন, সেখানে অসমের আগর ব্যবসায়ীদের ব্যতিক্রম মাত্র বলে তার কারণ উল্লেখ করেছেন এভাবে, “...ভারতীয় মুসলমানের বেশিরভাগই শ্রমজীবী মানুষ, কৃষক, শ্রমিক অথবা কুটির শিল্পী। সরকারি চাকুরে, উকিল, ডাক্তার ইত্যাদি বৃত্তিজীবী মানুষ কিছু আছেন। বড় পুঁজিপতি নেই বললেই চলে, বিশেষ করে আজকের সমাজে পুঁজির প্রসারের জন্যে সরকারের সঙ্গে যে ঘনিষ্ঠতার দরকার পড়ে, মুসলমান ব্যবসায়ী পুঁজিপতিরা সেই ঘনিষ্ঠতা আশাই করতে পারেন না।( অসমের আগর ব্যবসায়ী ইত্যাদি একাংশ কিছুদূর ব্যতিক্রম কেননা সরকারের উপরে এদের সেভাবে নির্ভর করতে হয় না।)” ২৫ মধু কিশোয়ারের একটি নিবন্ধের উল্লেখ করে তিনিও মত ব্যক্ত করেছেন এই লিখে যে, “ আজও, ধর্মনিরপেক্ষতা সম্পর্কে বহু বক্তৃতা সত্ত্বেও বেশিরভাগ হিন্দুই তাদের সঙ্গে অস্পৃশ্যের মতো ব্যবহার করেন।এগুলো সাচার কমিটির প্রতিবেদনের বহু আগেকার কথা।
          ১৮৮৬র ভূমিরাজস্ব আইনে ভূমি কিম্বা রাজস্বের কথা থাকলেও রায়তের অধিকার নিয়ে কোন কথা ছিল না আমরা আগেই লিখেছি। রায়তী স্বত্বের কথা ভেবে ব্রিটিশ ভারতে আরো তিনটি আইন হয়, গোয়ালপাড়া প্রজাস্বত্ব আইন ১৯২৯, সিলেট প্রজাস্বত্ব আইন ১৯৩৬ এবং বাকি সমতল অসমের জন্যে প্রজাস্বত্ব আইন ১৯৩৫। সবগুলোকে এক আইনের অধীনে আনা হয়েছিল মাত্র ১৯৭১এ, নতুন আইনের নাম হয় অসম অস্থায়ী বন্দোবস্তি এলাকা স্বত্ব আইন, ৭১ (The Assam Temporarily Settled Areas Tenancy Act. 1971) বাকি ব্রহ্মপুত্র এলাকাতে পাটচাষের জন্যে প্রব্রজন শুরু হবার আগেই গোয়ালপাড়ার জমিদারেরা চর অঞ্চলে কৃষক বসাতে অনেকটাই সফল হয়েছিলেন। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের এলাকাতে জমিদার এবং কৃষকের মাঝখানে বহু মধ্যস্বত্ব ভোগী বাকি বাংলাদেশের মতোই গড়ে উঠেছিল, এই মধ্যস্বত্বভোগীরা নানা ভাবে উঁচু মাত্রার খাজনা এবং নানা উপঢৌকন দিতে কৃষকদের বাধ্য করতেন। জমিদারদের প্রত্যক্ষ খাজনা দিতেন এমন রায়তের সংখ্যা খুবই সামান্য ছিল। এদের অধিকাংশই ছিলেন ভূমিমালিকানাবিহীন কৃষিমজুর। বরং জমিদারির বাইরে অস্থায়ী বন্দোবস্তি এলাকাতে অনেকেরই এক সনা পাট্টা ছিল।২৬ চরের নদী জলে ডুবে যাওয়া এবং বছর কয় পরে অন্যত্র ভেসে উঠা চিরদিনই একটি সমস্যা। নতুন ভেসে উঠা চরের মালিকানা নিয়ে জমিদারে প্রজাতে সংঘাতও প্রায়ই লেগে থাকত। এই নিয়ে ভূমিরাজস্ব আইনে কোনও ব্যবস্থা ছিল না। ১৮৯৭ থেকে ১৯২৯ অব্দি এ ক্ষেত্রে The Bengal Alluvion And Diluvion Regulation , 1825 অসমেও বলবত ছিল। এই আইনে সরকারি মালিকানার কথাটা ছাড়া আর কারো কথাই স্পষ্ট ছিল না। জাহাজ চলাচল করে এমন বড় নদীতে চর উঠলে যদি সেই চর এবং নদীর পাড়ে পায়ে হেঁটে চলাচল করা না যায়,সেটি সাম্রাজ্যের অধীনে যাবে। যদি পায়ে চলাচল করে পেরোনো যায় তবে সবচেকাছের মালিকানাতে যাবে। মালিকানা বিহীন কৃষকের কোনও কথাই নেই। বাকি অসমেও এমন জমি সরাসরি সরকারের দখলেই যেতো। সরকার ফেলে রাখত বা পত্তন দিত। সাধারণত নতুন চর ভেসে উঠলেও কৃষকদের নিজেদের মধ্যেই কাড়াকাড়ি পড়ে যায়। কেউ সরকার ব্যবস্থা করে দেবে বলে বসে থাকে না। এর জন্যে চরের জমিতে ব্যাপক আকারে বেদখল এবং সীমাবিবাদ ঘটেই থাকে। কোনও আইনই এই নিয়ে কিছু করতে পারে নি। নিজের মালিকানাতে থাকা চর ডুবে গিয়ে কখনো বা বহু বছর পরেও ভেসে উঠে। ততদিন যদি রায়ত খাজনা দিয়ে গেছেন তবে জমিতে তার দাবি থাকবে, কিন্তু খাজনা না দেয়া আর মালিকানা ছেড়ে দেয়াকে সমার্থক বলে ভাবা হয়। খুব কম সংখ্যক কৃষকই সেই জমির জন্যে খাজনা দিয়ে যাবার ক্ষমতা রাখেন, যেখানে আর তিনি চাষাবাদ করতে পারেন না। এই নিয়ে আশির দশকের মাঝামাঝি প্রয়াত পরাগ কুমার দাস লেখা একটি প্রতিবেদনে সরস বিবরণ রয়েছে,এই বিষয়ে অধ্যয়নে লেখাটি পথিকৃৎ বলে বিবেচিত হয়ে থাকে । পরাগ লিখেছিলেন, “... নতুন চর উঠলেই তাদের মধ্য মাটি নিয়ে কাড়াকাড়ি শুরু হয়। যে জায়গাতে চর উঠল, সেখানে যদি আগে স্থায়ী গ্রাম ছিল তবে পুরোনো ম্যাদী পাট্টা যাদের ছিল তাদের মধ্যে এবং নতুন দখলদারদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়, পরিবারের মানুষের মধ্যেই কাটাকাটি হয়। চরগুলো দেখতে প্রকাণ্ড যদিও সেখানে খেতের উপযোগী মাটি একেবারেই কম থাকে। কখনো বা আবার চাষাবাদ করা জমির উপর দিয়ে নদী বালি ফেলে সেগুলো একেবারেই নষ্ট করে দেয়। কোথাও যদি সামান্য একটুকরো বালিচর দেখা দেয় তারা তারউপরেই ক্ষুধার্ত দৃষ্টি রাখেনযদি আগামী বছর নদী তার উপর একটু পলি ফেলেই রেখে যায়! বর্ষাতে এদের দুর্দশার অন্ত থাকে না। নদী প্রায় সমস্ত অঞ্চল ডুবিয়ে দেবার ফলে উঁচু জায়গা দেখে চাং বেঁধে অর্ধাহারে অনাহারে দিন কাটাতে হয় এদের। জল শুকোবার সঙ্গে সঙ্গে আবার চাষের উপযোগী জমির সন্ধানে সংগ্রাম আরম্ভ হয়। জলে ধ্বসে যাওয়া চরের বাসিন্দাদের কখনো বা মাটির খুঁজে নৌকো করে সদলবলে অন্য জায়গাতে যেতে হয়নতুন জায়গার অসমিয়ামানুষের জন্যে এরা নতুন মুখ হয়ে পড়ে।
              এই অঞ্চলগুলোতে পুরোনো মাতব্বরী প্রথা এবং শাসকদলটির রাজনৈতিক শোষণ প্রক্রিয়ার মূলে ছিল ভয়াবহ ভূমি সমস্যা। কোনও জায়গাতে নতুন চর একটা উঠলেই যে জমির টুকরোটার জন্যে নিয়মিত বার্ষিক খাজনা দিয়ে যেতে পারে জমির টুকরো তার হয়ে যায়। ফলে, তুলনামূলক ভাবে যারা সমৃদ্ধ তারা কিছু ধনের বিনিময়ে একদিক থেকে জমি গ্রাস করে যাচ্ছিল। আর অন্য দরিদ্র ভূমিহীনেরা তাদের অনুগ্রহে উপরি পাওনাদিয়ে সেই জমিগুলোতে চাষাবাদ করে জীবিকা নির্বাহ করতে বাধ্য হচ্ছিলেন। কে কত জমি দখল করে নিয়মিত খাজনা দিয়ে নিজের দখলে আনতে পারে, তার উপর মাতব্বরি খেতাব নির্ভর করে; এবং সাধারণ মানুষকে অনুগ্রহ লাভের জন্যে এদের কথামতেই ওঠবস করতে হয়। ফলে শাসকদলগুলো অর্থের প্রলোভনে এই মাতব্বরদের হাত করেই এক একটা সুরক্ষিত ভোট ব্যাংকের অধিকারী হয়ে পড়ে। মাতব্বরেরা যাতে কারোরই প্ররোচনাতে বিদ্রোহাচরণ না করতে পারে, তারও ব্যবস্থা করে রেখেছিল ভূমি বন্দোবস্তির নিয়ম কানুনের মধ্যি দিয়ে। এসব অঞ্চলে কোনও জমিতে ম্যাদী পাট্টা দেয়া হয় না; জমিগুলো বছরের পর বছর ধরে খাস পাট্টার নিয়মে চলে আসছেজমির মালিক প্রত্যেক বছরে খাজনা দিয়ে একবছরের জন্যে পাট্টা নবীকরণ করে নিতে হয়। সত্তর বছর অব্দি একই জমির টুকরোতে বার্ষিক খাজনা দেয়া মানুষের সঙ্গেও দেখা হলো---এরাও দেখি সেই খাস পাট্টার ভিত্তিতেই এখনো দখলী স্বত্ব লাভ করছেন; আগামী বছর হয়তো সরকার সেই জমি তাদের নামে নবীকরণ নাও করতে পারে। এসব কারণে এই মানুষগুলো শাসনে থাকা দলটিকে অসন্তুষ্ট করতে পারে না।২৭ এই কথাতেই স্পষ্ট যে এক আমলাতান্ত্রিক সামন্তবাদ এখনো সে অঞ্চলে বহাল তবিয়তে টিকে আছে। কিন্তু আমাদের মধ্যবিত্তের ব্যবস্থা নিরপেক্ষ সমালোচনার বিষয় হন শুধু সেই মাতব্বর বা মোল্লারাই। তারা মুসলমান জনতাকে এই মোল্লাদের খপ্পর থেকে বেরিয়ে আসবার ফতোয়াতো জারি করেন, কিন্তু বাস্তব উপায়টি জানেনও না, এই নিয়ে ভাবেনও না। সাম্প্রদায়িকতা এভাবে ধর্মনিরপেক্ষমনকেও গ্রাস করে। মোল্লার খপ্পর থেকে এই সব ভদ্রলোকেদের খপ্পরে পড়বার মানেই হলো, কড়াই থেকে জ্বলন্ত চুলোতে ঝাঁপ দেয়া এই কথা পরিভ্রমী শ্রমিকদের চাইতে আর কেই বা ভালো জানেন।
    আরো বিচিত্র সমস্যা আছে। একটি চর ডুবে তার জায়গাতে অনেকগুলো চর ভেসে উঠতে পারে। ব্রহ্মপুত্রের উত্তর পাড়ের চরগুলোর বরং কিছু স্থায়ী চরিত্র আছে , মূল স্থলভূমির সঙ্গে এদের চরিত্রগত তফাৎ অতি সামান্যই। কিন্তু দক্ষিণ পাড়ের চরগুলো অতি ভুর। হাজার হাজার একর জমি প্রতি বছরই ব্রহ্মপুত্রের বুকে ধ্বসে গিয়ে এই পাড়ে নিত্য সমস্যা জিইয়ে রাখে। বহু পুরোনো গ্রাম বসত ভিটা সহ ডুবিয়ে নিয়ে যায়। এতে তপশিলি জাতি, জনজাতির কৃষক পরিবারগুলোও নিত্য ক্ষতিগ্রস্ত হন। ব্রহ্মপুত্রের পাড় ধ্বসে যাওয়াটা বানের চেয়ে কম ভয়াবহ নয়, বছরে ৮০ বর্গকিলোমিটারের হিসেবে ১৯৫৪ থেকে ২০১০এর মধ্যে অসমের ৪০০০ বর্গকিলোমিটার ভূমি ব্রহ্মপুত্রে মিশে যায়। অসমের স্থলভাগের এটি ৭.% অনুমান করতে অসুবিধে নেই যে এগুলো অধিকাংশই আবাদি জমি। নদী পাড়ে সাধারণত জমি পড়ে থাকে না। মোট২৫০০ গ্রামের ৫০ লক্ষ মানুষকে বিপন্ন করেছিল এই ভূমিক্ষয়। আরো ২৫টি এমন সম্ভাব্য ক্ষয়প্রবণ এলাকা চিহ্নিত করেছে অসমের জল সম্পদ বিভাগ। ২৮ কৃষিকর্ম ছেড়ে এদের অনেকেই এখন বাকি ভারতে অসংগঠিত শ্রমের বাজারে গিয়ে যোগ দিচ্ছেন। কিন্তু সমস্যা হয় এই ময়মন সিংহ মূলীয় কৃষকদের নিয়ে। এদের শ্রমিকে রূপান্তরও এতো সহজ হয় না। অসম তথা পূর্বোত্তরেতো বটেই, বাকি ভারতেও এরাই যখন তখন বাংলাদেশীবলে সন্দেহের শিকার হয়ে স্থানীয়দের কিম্বা পুলিশী জুলুমের মুখে পড়েন। অনেক সময় প্রাণও বিসর্জন দিতে হয়। পুরোনো অঞ্চল থেকে দূরের নতুন কোনও গ্রামে গিয়ে একই পদ্ধতিতে বসতি করলেও, বা নতুন গ্রাম পত্তন করলেও এদের রক্ষা নেই। সন্দেহজনক নাগরিকবলে বিবেচিত হন। আজকাল বন্যাটন্যা হলে বহু সময় সরকার খাজনা মকুবের কথা ঘোষণা করে থাকেন। কিন্তু হয় জীবিকার সন্ধানে কৃষক পরিবার অন্যত্র চলে গেছেন বলে খবর পান না, বা আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন, অনেক সময় কতদিনের জন্যে কোন শ্রেণির কৃষককে মকুব করা হবে ইত্যাদি সরকারী ভাষ্য এই সব নিরক্ষর কৃষকদের মধ্যে স্পষ্ট হয় না বলেও সুবিধে পাবার থেকে বঞ্চিত হন। ১৯৯১র জনগণনার তথ্য অনুযায়ী অসমে কৃষি শ্রমিকের শতকরা হার ১২.০৮ % একই সূত্রে এও জানায় যে ধুবড়ি, গোয়ালপাড়া, বরপেটা, বঙাইগাঁও ইত্যাদি ভাটি অসমের জেলাগুলোতেই কৃষি শ্রমিকের সংখ্যা বেশি, অধিকাংশ পূর্ববঙ্গমূলীয় কৃষকেরা এই জেলাগুলোতেই বাস করেন, আর এই জেলাগুলোই ব্রহ্মপুত্রের ভাঙ্গনেও সবেচবেশি ক্ষতিগ্রস্ত জেলাগুলোর অন্যতম। ২৯ ১৯৭৯এ পুরোনো গোয়াল পাড়া এলাকাতে জমি জরিপের একটি কাজ শুরু হয়েছিল। কিন্তু বিদেশী বিতাড়ন আন্দোলনের দিনগুলোতে সে আর এগোয় নি। ১৯৮৩তে আবার শুরু হলেও প্রয়োজনীয় মণ্ডলের অভাবে কাজ এগোয় নি। ১৯৯৪তে ভাটি অসমের কিছু চর অঞ্চলে পনেরো বছরের বেশি যাদের দখলে জমি আছে তাদের ছয় বিঘা অব্দি চরের মাটিতেই পাট্টা দেবার কাজ শুরু হলেও বিদেশী নাগরিকের প্রশ্ন তোলে আটকে দেয়া হয়। বিদেশীর প্রশ্নটি যে শেষ অব্দি কৃষকের হাতে জমির বিপক্ষে যায় এই তথ্যে এটা শুধু আরো স্পষ্ট হয়। অথচ এই কৃষকেরাই এখনো অসমের সমগ্র কৃষি উৎপাদনের মূল শক্তি। কৃষি কর্মে এদের দক্ষতা এবং অবদান নিয়ে অসমের মাটিতে কেউ প্রশ্ন তুলবার নির্লজ্জতা আজ অব্দি দেখিয়েছেন বলে নজরে পড়ে নি। সেটি অন্য প্রসঙ্গ যে পরজীবী মধ্যবিত্ত কৃষির দুনিয়া নিয়ে খবরও রাখেন না বিশেষ। বাজারে আলু পেঁয়াজের দর চড়ে গেলে এরা সরকারের নিন্দেতে সরব হন বটে, কিন্তু এই প্রশ্ন করেন না যে অসমে কেন আলু উৎপাদন হবে না! করলে কে করবে?


পাকা খাতায় লেখা লি নাম , রে লম্পটিয়া শ্যাম ; ফাঁকি দিয়ে চ লালি আসাম :
            গেল ২০১২র ডিসেম্বরের শেষে দুনিয়া যখন যিশু খৃষ্টের জন্মদিনের উৎসবে মত্ত, তার ঠিক পরদিনই তিনসুকিয়া জেলার একটি বাগানে শ্রমিকেরা ম্যানেজারের বাংলো ঘেরাও করে ম্যানেজার দম্পতি সহ জ্বালিয়ে দেয়। পরে শোনা যায় যে কেউ কেউ সেই পোড়া দেহের মাংস খেয়েও ফেলে। স্বাভাবিক ভাবেই কাগজে পত্রে নিন্দার ঝড় বয়ে যায়। বহু শ্রমিক এবং আদিবাসী সংগঠনও এই নৃশংসতার নিন্দে করেন। কিন্তু সংবাদ মাধ্যম এবং জেলার শহুরে মধ্যবিত্তদের অনেকেই শ্রমিকদের অসভ্য, নরমাংসভোজী বর্বর ইত্যাদি বলে নিন্দাতে মুখর হন, অসমিয়া মধ্যবিত্তদের মধ্যে নানা জায়গাতে প্রতিবাদী শোকসভাও অনুষ্ঠিত হয়। এবারে , এই শ্রমিক বা আদিবাসীদের উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে যখন নিয়ে আসা হয়েছিল অসমের চা-বাগানে কাজ করবার জন্যে তখন তার পদ্ধতিটিও কিন্তু মোটেও মানবিক, বা সুসভ্য কিছু ছিল না। বাংলা প্রেসিডেন্সি থেকে নদী পথে যে জাহাজগুলোতে করে এই আদিবাসীদের আনা হয়েছিল, তার একটির নাম ছিল বার্মা। এর একটি প্রতিবেদন (Report on Cholera on Board the streamer ‘Burma’, 1872, Govt. of Assam) লিখেছিল এরকম,“ কয়েকটি ফ্লেটে কুলিদের উপর মহলাতে রাখা হয়। এর তক্তাগুলোর মধ্যে ফাঁক থাকে। তরল পদার্থ এর মধ্যিদিয়ে ভালো করেই গড়িয়ে নামতে পারে। অন্যদিকে ঠিক নিচের মহলে বড় বড় বয়লারে খাবার রান্না হয়। বয়লারে করেই ভাত নিয়ে গরম গরম পাতে ঢেলে দেয়া হয়, যে পাতে হয়তো সামান্য আগেই কলেরা আক্রান্ত অন্য কুলি ভাত খেয়ে গেছে...” ৩০ মধ্যভারতের ঝাড়খণ্ড সাংস্কৃতিক অঞ্চল থেকে আঠারো শতকের ত্রিশের দশক থেকেই এই সব আদিবাসই শ্রমিকদের মরিশাস, ফিজি, ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জ সহ দুনিয়ার বহু জায়গাতে চা, কফি , চিনি উৎপাদনের জন্যে ব্রিটিশ নিয়ে যেতে শুরু করেছিল। অসম, উত্তর বাংলাতেও তখন থেকেই এদের নিয়ে আসা শুরু হয়। সেখানকার ব্রিটিশ-জমিদারী যৌথ নিপীড়নের থেকে এরাও পালাতে চাইতেন, আর ব্রিটিশও সেখানকার বিশাল বিশাল সব গণবিদ্রোহের থেকে আত্মরক্ষা করতে চাইত। বাকি সস্তা শ্রমের চাহিদা মেটানোর ব্যাপারটিতো ছিলই।
              ১৯৩৭এ ব্রিটিশ অসমে ব্যবসা ভিত্তিক চা চাষ শুরু করে। এমন নয় যে ব্রিটিশই এ দেশে চায়ের আবিষ্কার করেছিল। চায়ের ব্যবহার চীনারা জানতেন বহু আগে থেকেই এবং চীন থাকে অসমে প্রাক-ব্রিটিশ যুগে প্রব্রজিত চিংফৌ জনজাতির লোকেরা চা পানে অভ্যস্ত ছিলেন। ব্রিটিশ শুধু এর অর্থনৈতিক তথা পণ্য হিসেবে গুরুত্ব অনুধাবনে বিলম্ব করেনি। ১৮৩৯এ গড়ে তোলে আসাম কোম্পানি, ১৮৪০ থেকেই গড়ে উঠে বাগান। শুরুতে এরা চীন থেকে শ্রমিক এনেছিল। কিন্তু এরা এতো সস্তা দরে কাজ করতে আগ্রহ না দেখানোতে কিম্বা এদের নিয়ে আসার ব্যয় প্রচুর হওয়াতে অসমের জনজাতি বা অন্যান্য দলিত জনগোষ্ঠীর মানুষকে নিয়োজিত করবার চেষ্টা নেয়। সেটিও সফল হয় নি। স্থানীয় হবার সুযোগ নিয়ে এরাও দর কষাকষির ক্ষমতা রাখতেন, তার উপরে যত শ্রমিকের দরকার ততটা এখান থেকে পাওয়াও কঠিন ছিল। ব্রিটিশের দরকার ছিল এমন শ্রমিক যাদের মজুরি এবং অন্যান্য সুবিধা ইত্যাদি হবে অতি কম, কিন্তু সঙ্ঘবদ্ধ প্রতিবাদও সংগঠিত করতে পারবে না এমন সামাজিক এবং মানসিক ভাবে অতিদুর্বল কিছু ক্রিতদাসতুল্য । ফলে তৈরি হলো দেশীয় লোকেদের দিয়েই দালাল বাহিনী, যারা টাকার বিনিময়ে ঝাড়খণ্ড তথা মধ্যভারতের অরণ্য অঞ্চল থেকে শ্রমিক চালান দেবে। এই শ্রমিক আমদানি এবং স্থানীয় শ্রমিক নিয়োগের প্রক্রিয়াটি পাশা পাশি চলে শতাব্দের শেষ অব্দি। স্থানীয়দের চা-বাগানের কাজে লাগাবার জন্যেও বিচিত্র উপায় নিয়েছিল তারা। এই সময় তাদের কৃষিজমিতে খাজনা ৬০ থেকে ১০০ % অব্দি ইচ্ছেমতো বাড়িয়ে দেবার আরো একটি কারণই ছিল যাতে পরম্পরাগত চাষাবাদ ছেড়ে সবাই চা-এর বাগানে চাষে যোগ দিতে বাধ্য হয়। বাংলাদেশে নীল চাষের নিয়োগের মতো না হলেও এই প্রয়াসও কম নিপীড়ক কিম্বা কুটকুশলী ছিল না। ১৮৬১ থেকে ৯৪ অব্দি রঙিয়া-নলবাড়ি-বরমা-লছিমা-পথরুয়া ঘাটের কৃষক বিদ্রোহের এবং বহু শহীদী মৃত্যুর কারণই ছিল এই। ৩১বহু বডো তথা অন্য জনজাতি মানুষ চা-বাগানে কাজে যোগও দিয়েছিলেন। কিন্তু বাগানের নির্মম আচরণে বিতুষ্ট হয়ে এরা কাজ ছেড়ে যেতে থাকেন। এদের যাবার উপায় ছিল বলে। প্রব্রজিত আদিবাসীদের সেই সুযোগটাই সহজ ছিল না। বিশ শতকে তাই স্থানীয়দের নিয়োগ বন্ধ হয়ে যায়। ১৯৩১ অব্দি এই শ্রমিকের সংখ্যা অসমে ১৫ লক্ষ ছাড়িয়ে যায়, অসমের মোট জনসংখ্যাই তখন ছিল ৫৫ লক্ষ মাত্র।৩২ ১৯৫০ অব্দি প্রায় এক শতকে নিয়ে আসা শ্রমিকের সংখ্যা ৩৩ লক্ষ ছাড়িয়ে গেছিল। ৩৩
              দেশি ঠিকাদার নিয়োগ করা হতো। এরা ভয়, প্রলোভন দেখিয়ে বা জোর জবর দস্তি এই শ্রমিকদের সেখানে চুক্তিবদ্ধ করে এখানে নিয়ে আসত। ইচ্ছে মতো কাজ ছেড়ে যাবার অধিকারও আর থাকত না একবার চুক্তি সই করলে পর। চুক্তি বা agreement করে নিয়ে আসত বলে এগ্রিমেন্ট লেবারবলা হতো, শ্রমিকদের নিজেদের এবং প্রতিবেশীদের মুখে সেই শব্দই পরে গিরমিটবা গিরমিটিয়াতে পরিণত হয়। মহাত্মা গান্ধিও শুরুতে এক বছরের গিরমিটেগেছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকাতে। নিজেকে তিনি তাই পহেলা গিরমিটিয়াবলতেন। এমনই দাবি করেন, ১৯৯৯তে এই নামে একটি জনপ্রয় হিন্দি উপন্যাসের লেখক গিরিরাজ কিশোর। বইটি সম্প্রতি The Girmitiya Saga ইংরেজি অনুবাদেও বেরিয়েছে। গান্ধি সেখানে গেছিলেন ১৮৯৩তে। সুতরাং বাস্তবে তিনি পহেলাহতে পারেন না, আর অসমের গিরমিটশ্রমিকদের প্রতি তিনি তাঁর গোটা রাজনৈতিক জীবনে কোন সহানুভূতি দেখান নি, এমনকি অসহযোগ আন্দোলনেও যাতে এরা যোগ দিয়ে চা-বাগান মালিকদের বিপদে না ফেলে সেটি নিশ্চিত করেছেন বলে দেবব্রত শর্মা তথ্য দিয়ে দাবি করেছেন। আদিবাসীরা এক সময় হরিজনতালিকাভুক্ত হয়ে সংরক্ষণের সুবিধে দাবি করলে গান্ধি Young Indiaতে ২৯ জুন ১৯২১শে লেখা এক নিবন্ধে এর তীব্র বিরোধিতা করেন। এখনো এরা অসমে তপশিলি জনজাতি হিসেবে স্বীকৃতির দাবিতে লড়ে যাচ্ছেন। বাংলা বা বেঙল প্রেসিডেন্সিথেকে আনা হয়েছিল বলে স্থানীয়রা এদের বহুদিন বঙালি কুলিও বলতেন। এখন অসমিয়া বাঙালি জাতীয়তাবাদের উত্থানের যুগে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকাতে এদের অসমিয়া, বরাক উপত্যকাতে হিন্দি কিম্বা বাঙালি বলে চালিয়ে দেয়া হয়। এরা অসমিয়া বাংলা বা হিন্দি ভাষা মাধ্যমে পড়াশোনা করেন। গোটা অসমে এদের কোন একক জাতি কিম্বা ভাষা পরিচয় এখনো নেই। যেনবা থাকতে নেই। লোক মুখে মুসলমান যেমন বাংলাদেশি, সন্দেহভাজন নাগরিক কিম্বা বাঙালএরা এখনো কুলি কিম্বা লেবার কিম্বা চা-জনজাতি
             যাই হোক, আমরা তাদের অসমে আসার কাহিনি লিখছিলাম। জাহাজে এদের তৃতীয় শ্রেণির সুবিধেও মিলত না। গরু মোষের থেকে বেশি সুবিধে দিয়ে তাদের আনা হতো না। জাহাজ আরো ছিল। পাঞ্জাব, ‘সিমলা, ‘প্রগ্রেসইত্যাদি নাম। কিন্তু কাম সেই একই ছিল। উপর মহলাতে শ্রমিকদের মাথার উপরে কিছু থাকত না । রোদে পুড়তে হতো, বৃষ্টিতে ভিজতে হতো, শীতে জমতে হতো। কলেরা আক্রান্ত বহু শ্রমিক ব্রহ্মপুত্রে ঝাঁপিয়ে আত্মহত্যা করতেন। কখনোবা কর্তৃপক্ষই আক্রান্তকে পাড়ের ঘন জঙ্গলে জোর করেই নামিয়ে দিত। বাকি যাত্রীদের নজরের সামনে কেউ আত্মহত্যা করুক এটা চাইত না। পরিমাণ এতো বেশি ছিল যে সেটি আটকাতে উঁচু করে এক সময় রেলিং বসানো হয়। Planters Raj to Swaraj গ্রন্থে অমলেন্দু গুহ লিখেছেন, ১৮৬৩ র মে মাস থেকে ১৮৬৬র মে মাস অব্দি ৮৪,৯১৫জন শ্রমিকে মধ্যে প্রায় ৩০ হাজার জনের মৃত্যু হয়। দেবব্রত শর্মা লিখেছেন, ১৮৪১এ ছোট নাগপুর থেকে নিয়ে আসা ৬৫২জন আদিবাসীদের একজনও বাগিচা অব্দি এসে পৌঁছোন নি। এখানে আসার পরেও রোগ শোক ক্ষমা না করে অত্যন্ত কম মজুরিতে এদের কাজ করতে বাধ্য করা হতো। উনিশ শতকের শেষভাগে ১৮৬৮নাগাদ যেখানে ব্রহ্মদেশে কাজ করতে যাওয়া এক অস্থায়ী শ্রমিকের মজুরি ছিল মাসে ত্রিশ টাকা, সেখানে অসমে এদের গড় মাইনে ছিল পাঁচ টাকা, মহিলা হলে চার টাকার থেকেও কম। বারো বছরের নিচের শিশুদেরও কাজ করতে হতো। মাইনে ছিল তিন টাকা। সেই টাকাও দেবার সময় নানা বাহানাতে বাস্তবে কমিয়ে দেয়া হতো। এখনো ব্রহ্মপুত্র উপত্যকাতে একজন শ্রমিকের দৈনিক ৮৯টাকা মাত্র। সরকারি ন্যূনতম মজুরির থেকে বহু কম। ছুটির দিনের মজু্রি বলে কোনও জিনিস তখনো ছিল না, এখনো নেই। কাজ করতে না চাইলে বা সাতদিনের বেশি অনুপস্থিত থাকলে হাজত বাস নিশ্চিত ছিল। বেত চাবুকের মারাতো সাধারণ কথা ছিল। কাজ পালানো শ্রমিকদের মারধর করা, ধরিয়ে দেয়ার জন্যে অসামরিক লোককেও নানা প্রলোভন দিয়ে লাগানো হতো। পুরস্কার ঘোষণা করা হতো। সেই পুরস্কারের টাকা আবার শ্রমিকের মাইনে থেকেই কেটে রাখা হতো। স্থানীয় অসমিয়া-বাঙালি বাবুরা নিজেরাই প্রচুর জনজাতীয় বা অন্যান্য লোক লাগিয়ে এদের ধরে আনার ব্যবসা ফেঁদেছিল। তাতে সাহেবদের লাভ আরেকটা হতো এই যে স্থানীয় মানুষের সঙ্গে এদের এক ঘৃণার সম্পর্ক স্থাপিত হতো, যা এখনো সফলতার সঙ্গে বহাল। বাগানের ভেতরেও লেবার বা কুলি লাইনছিল আলাদা। বাগানের বাইরেও সুকৌশলে ইচ্ছেমতো চলা ফেরার অধিকার ছিল না। মাইনে দেয়া হতো টাকার বদলে কোম্পানি টোকেনে। যে টোকেনে বাগানের বাইরে কোন কাজ চলত না। এর অর্থ এই যে নিজস্ব অর্থনীতি-আইন কানুন নিয়ে বাগানগুলো প্রতিটি ছিল এক একটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্র। অস্কার ফ্লেক্স বলে এক জার্মান চা বাগান আধিকারিক অসম ১৮৬৪নামে একটি বই লিখেছিলেন। সেখানে এক সাহেবের দেয়া বয়ান এরকম, “ সরকারের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক যদিও ভালো, তবু এখানে দূরত্ব অনেক বেশি। আমাদের এখানকার চা বাগানগুলোর সদর দফতর হলো শিবসাগর, সেখানে যাওয়াটা অনেক সময় এবং শ্রমসাপেক্ষ। ফলে উকিল হাকিম আমরা নিজেরাই। প্রতিটি কোম্পানি এক একখানা দেশের মতো। ম্যানেজার হলেন রাজা, সিনিয়র এসিস্টেণ্ট প্রধানমন্ত্রী, এসিস্টেন্টরা উঁচু পদের আমলা... মজুর-শ্রমিকদের পরিচালনা করতে গিয়ে আমরা অসমিয়া আর মজুদের মধ্যে দাবা খেলতে থাকি।৩৪এখনো এই অবস্থা বিশেষ পাল্টায় নি। এরা পঞ্চায়েতে ভোটের অধিকার পেয়েছেন মাত্র এই সেদিন গেল শতকের নব্বুইর দশকে। ফলে বাগানের দুর্বিসহ জীবনও এদের আয়ু কেড়ে নেবার পক্ষে ছিল যথেষ্ট । দেবব্রত শর্মা লিখেছেন, বাগানগুলোতে মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ৫৫.৬৬ % এক বাগান ম্যানেজার দম্পতির মৃত্যুতে আতঙ্কিত যে মধ্যবিত্তরা এখনো এই সব শ্রমিকদের অসভ্য বর্বর বলবার জন্যে ব্যস্ত হয়ে পড়েন তাদের কাছে এই সব ইতিহাসের বর্বরতার কোনও খবরই নেই!
            পালাতে ব্যর্থ এই সব শ্রমিকেরা গান্ধির সত্যাগ্রহ কিম্বা অসহযোগ আন্দোলনের জমানাতে সেই আন্দোলনেও যোগ দিচ্ছিলেন বা দিতে যাচ্ছিলেন আর কংগ্রেস নেতৃত্ব সেগুলো আটকাবারও সব ব্যবস্থা করতেন। কেননা ততদিনে তাদের অনেকেই ছিলেন চা-বাগানের মালিক। বাংলা কংগ্রেসের নেতা চিত্তরঞ্জন দাশ, আনন্দ মোহন বসুরও অসমে চায়ের বাগান ছিল। ৩৫ চা-শ্রমিকদের নিয়ে কংগ্রেসের ট্রেড ইউনিয়নটি অসমে গড়ে উঠে স্বাধীনতার পরের মাসে মাত্র, তাও কমিউনিস্টদের আটকাবার জন্যে। ১৯২১শের মে মাসে চরগোলাতে শ্রমিকেরা মাইনে বাড়াবার আন্দোলন শুরু করেন ।অনেকে দল বেঁধে সিলেটের চরগোলা থেকে প্রচুর শ্রমিক ঝাড়খণ্ডে ঘুরে যাবার জন্যে বেরিয়েছিলেন। ৮ হাজারের বেশি শ্রমিক বেরিয়ে যেতে সফলও হয়েছিলেন। কিন্তু দেবব্রত শর্মা লিখেছেন, পুলিশের গুলিতে প্রাণ দিয়েছিলেন প্রায় শ তিনেক শ্রমিক। আমরা সেদিকে এর বেশি যাচ্ছি না। আমাদের গন্তব্য এই সব প্রব্রজিত ঝাড়খণ্ডী আদিবাসীদের সঙ্গে কৃষি এবং ভূমির সম্পর্ক সন্ধান।
               এর আগে দেখিয়েছি ১৮৩৮ থেকেই কীভাবে প্রায় বিনামূল্যে চা-বাগান মালিকেরা বিশাল পরিমাণ জমি দখলে নিতেন। আর কী সামান্য পরিমাণ কর দিতেন! অমলেন্দু গুহ Plnaters Raj To Swaraj গ্রন্থে লিখেছেন, ১৮৭০ -৭১ অব্দি প্রায় ৭ লক্ষ একর জমি এদের দখলে যায়। তার মাত্র ৮ % অর্থাৎ ৫৬ হাজার একর জমিতে এরা চা চাষ করেন। বাকিগুলো এমনিই দখলে রাখেন। বাকি কৃষকদের যখন প্রতি একরে কর দিতে হচ্ছিল ১ টাকার থেকে ৩ টাকা, বাগান মালিকেরা কর --যখন যে জমিতে দিতে হতো-- দিতেন মাত্র ৩ থেকে ৯ আনা। অসমিয়া কেউ যদি বাগান করতে চাইতেন তবে তাঁকে তবে ঐ ১ টাকার থেকে ৩ টাকাই দিতে হতো। দেশীয়দের তাবেদারদের মধ্যে কেউ প্রতিদ্বন্দ্বী স্বাধীন শিল্পমালিক হিসেবে উঠে আসুক এটা নীতিগতভাবেই চাইত না। মণিরাম দেওয়ানের সঙ্গে ব্রিটিশের দ্বন্দ্বের মূল কারণই ছিল এই। পড়ে থাকা জমিতে এরা উদ্বৃত্ত আদিবাসীদের কিম্বা স্থানীয় জনজাতিদের রায়ত হিসেবে বসিয়ে দিত। বিশেষ ঋতুতে যখন বাড়তি শ্রমিকের দরকার পড়ত এদের কাছে লাগাবার কৌশল নিয়েছিল। এভাবে এক অদ্ভুত ধরণের জমিদারি ব্যবস্থাও এরা বাগানকে ঘিরে গড়ে তুলেছিল । জোর করে জনজাতিদের জমি দখল, পড়ে থাকা জনজাতিদের জমিকে পতিত হিসেবে দেখিয়ে নিজের দখলে নিয়ে আসা এবং দুটো জনজাতি গ্রামের মধ্যে নিজের জমি পড়লে মাঝে বেড়া তুলে দিয়ে যাতায়াত বন্ধ করে দিত। ফলে জনজাতি অর্থনীতি এবং সমাজ কাঠামো বিধ্বস্ত হবার মুখে পড়ে যেতো।
             ‘গিরমিটিয়াশ্রমিকেরা পাঁচ বছরের জন্যে চুক্তিবদ্ধ হতো। সময় পেরুলে এরা নানা কারণে নিজের আদি-বাসস্থানে ফিরে যেতে পারত না। কারণ, নিয়ে আসার জন্যে মালিক পক্ষের ব্যবস্থা যা হোক একটা থাকলেও ফেরার কোনও ব্যবস্থা ছিল না। দেশেও তাঁদের অধিকাংশই তখন ব্রিটিশের ভূমিনীতির জন্যে পুরুষানুক্রমের ভূমিহারা। সেখানেও কোনও কাজের নিশ্চয়তা ছিল না। আর ফিরে গেলেও আবার সেই দালাল ঠিকাদারদের খপ্পরে পড়ার বিপদ। এর চেয়ে বরং এখানেই চা-বাগানের পাশের জমিতে থেকে গিয়ে পরে আবার দরকারে চুক্তিবদ্ধ কিম্বা অস্থায়ী শ্রমিক হবার সুযোগ নেয়া ভালো বলে বিবেচনা করে তাঁরা থেকে যেতে শুরু করেন। এরাই ক্রমে অসমের সমাজে প্রাক্তন চা-শ্রমিকবলে পরিচিত হতে শুরু করেন। এদের সংখ্যা এখন মোট আদিবাসই শ্রমিকের বেশি বই কম হবে না। উমানন্দ ফুকন একটি হিসেবে দেখিয়েছিলেন, ১৯৮১ সনে অসমে এই আদিবাসীদের মোট সংখ্যা ৩৬ লক্ষ হবে, তার ১৯.২ লক্ষ প্রাক্তন চা শ্রমিক৩৬ এই হিসেবে সামান্য গরমিল আছে মনে হয় কারণ, ১৯৫০এই এদের সংখ্যা ৩৩ লক্ষ ছাড়িয়েছিল। অসমের জনসংখ্যা এখন ৩ কোটি ১২ লক্ষ ছাড়িয়ে গেছে, এখন এই সংখ্যাতে আরো লাখ ত্রিশেক জোড়া যাবে হয়তো। কিন্তু সব মিলিয়ে এরা যে অসমের মোট জনসংখ্যার এক পঞ্চমাংশ এবং জনগোষ্ঠীটির অধিকাংশই বাগানের বাইরে বাস করেন এই নিয়ে কোনও বিতর্ক নেই। প্রব্রজিত বাঙালি মুসলমানের সঙ্গে এই সংখ্যা প্রায় সমান হবে। ভাটি অসমে এমন প্রচুর আদিবাসই বিশেষ করে সান্তাল বসতি আছে যারা কোনোদিনই চা-বাগানের কাজে নিয়োজিত হন নি। লোকে তাদেরকেও কোনও যুক্তিবুদ্ধি ছাড়াই প্রাক্তন-চা শ্রমিকবা চা-শ্রমিকবা চা-জনজাতিবলে থাকেন।
              ১৮৬০ সন থেকেই মোটামোটি এই প্রাক্তন চা-শ্রমিকদের বসতি একটি চেহারা নিতে শুরু করে। বাগান মালিকেরাও এদের নিজের বা অন্যের রায়ত হিসেবে পেতে উৎসাহ দেখাতো। একেতো তাতে রাজস্ব বাড়ে। দ্বিতীয়তঃ বাগানের একটা সমস্যা ছিল, চা পাতা তোলার ঋতুতে বাড়তি শ্রমিকের দরকার পড়ত। শুধু এর জন্যে সারা বছর স্থায়ী শ্রমিক পোষা লাভজনক নয় । তখন এই রায়তদের কাজে লাগাতো। যদিও নতুন শ্রমিক আমদানির সঙ্গে সঙ্গে এই প্রাক্তন চা শ্রমিকের বসতি বিস্তারের কাহিনিরও ব্রিটিশ থাকতেই অন্ত পড়ে, ব্যবস্থাটি কিন্তু মোটের উপর এখনো তাই আছে। এই বসতিগুলোর অনেকে নিশ্চয়ই চাষাবাদ বা অন্যান্য উপায়ে দুটো বেশি পয়সার মুখ তখনো দেখতেন, এখনো দেখেন। ছোট হলেও এক মধ্যবিত্ত শ্রেণি এদের মধ্য থেকে গড়ে উঠেছে। রাজনৈতিক নেতৃত্বও বিকশিত হয়েছে। এখন তো আলাদা সাহিত্য সভাও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু বাড়তি শ্রমিকের চাহিদা এখনো এই সমাজের ভূমিহীন বা অতি দরিদ্র কৃষকের থেকে মেটানো হয়। সম্ভবত এটি একটি কারণ যে এদের কারো শরীর থেকে লেবারকিম্বা চা-শ্রমিকহবার দাগ কিছুতেই ধুয়ে যায় না। উমানন্দ ফুকন বছর কয় আগে ডিব্রুগড় শিবসাগর জেলার ১৫টি বাগানের পাশে থাকা এইসব আদিবাসীদের উপরে এক সমীক্ষা চালিয়েছিলেন। তিনি দেখিয়েছেন, ৩৩.% পরিবারের ভিটে বসতির জমিটুকুও নেই। মাত্র ৩৬.৮৫ পরিবারের হাতে চাষাবাদের জমি আছে। সেই জমি ম্যাদী না এক সনা পাট্টার তিনি উল্লেখ করেন নি। ১৪.০৩ % অন্যের জমিতে কৃষি কাজ করেন। জনগোষ্ঠীটির ৫০.৮০% মানুষ এখনো কৃষির উপরে নির্ভর শীল, ৪৪.৭৪% বিভিন্ন ক্ষেত্রে শ্রম বিক্রি করে জীবিকার্জন করেন।

ভর দুপুরের রোদে , দ্বিধার দুয়োর ধরে দাঁড়িয়েছে তৃ তীয় বিশ্বের পাথুরে মানুষঃ

           আমরা কথামতো মোটা দাগে অসমের ভূমি ব্যবস্থার একটা ছবি উপস্থিত করলাম। পাহাড় তথা বরাকউপত্যকার ছবি সামান্য আলাদা হবে। কিন্তু মোটের উপর এখনো সেই রায়তারী ব্যবস্থার আদলেই রয়ে গেছে ভূমি ব্যবস্থা। সুতরাং আমাদের ছেড়ে যাওয়া অংশটুকুর বাস্তবতাও অনুমান করতে বিশেষ বেগ পাবার কথা নয়। এর বাইরেও কথা থাকে। প্রাদেশিক উৎপাদনে কৃষির অংশ বা গুরুত্ব কতটা, প্রাদেশিক নিয়োগ ক্ষেত্র হিসেবেই বা কৃষির বর্তমান বাস্তবতা কী? আমরা দেখিয়েছি, এখনো ভূমি ব্যবস্থা মোটের উপর ঔপনিবেশিক আমলের মতোই থেকে গেছে। আইনটিও পাল্টায় নি। সেখান থেকেই প্রশ্ন উঠে, ঔপনিবেশিক শক্তির সঙ্গে এই কৃষির সম্পর্ক কী থেকে গেছে? থেকে তো গেছেই। নতুবা কৃষিতে ভর্তুকি দেয়া কিম্বা উঠিয়ে দেবার প্রশ্নে পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে এখনো অন্য তৃতীয় বিশ্বের সঙ্গে তর্কে লিপ্ত হয় কেন ভারত। কিম্বা খুচরো কারবারে বিদেশী বিনিয়োগ করতে গিয়ে কৃষি পণ্যের বাজারে মধ্যস্বত্বভোগীদের স্বার্থের প্রসঙ্গ তোলে কেন সরকার? বান নিয়ন্ত্রণ কিম্বা সেচ ব্যবস্থা কীভাবে কৃষিতে প্রভাব ফেলে বা সেগুলোর উপরে প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ দিয়ে কীভাবে কৃষিপণ্যের উৎপাদন নিয়ন্ত্রিত হয়, কীভাবে স্থানীয় ফসল নষ্ট করে, রপ্তানির ব্যবস্থা না করে, প্রদেশের বাইরের কিম্বা বিদেশের কৃষি পণ্যের আমদানির পথে খুলে দেয়া হয় এসব আমরা কিছুই আলোচনা করলাম না। এগুলোকেই আমরা বলতে চাইছি আনুভূমিক অধ্যয়ন। ভারতে কৃষি তথা ভূমিব্যবস্থা এবং উৎপাদন সম্পর্ক নিয়ে যারা বিদ্যায়তনিক অধ্যয়ন করেছেন অমিত ভাদুড়িকে তাদের অগ্রগণ্য বলে বিবেচনা করা হয়। চার দশক আগে লেখা তাঁর এক নিবন্ধে তিনি পূর্বভারত বিশেষ করে পশ্চিম বাংলার সম্পর্কে দাবি করেছিলেনঃ ১) ব্যাপক অ-বিধিবদ্ধ ভাগ চাষ প্রথা, ) ক্ষুদ্র প্রজাদের চিরস্থায়ী ঋণগ্রস্থতা, ) গ্রামাঞ্চলে শাসক শ্রেণির চরিত্রগত বৈশিষ্ট্যতারা একাধারে জমির মালিক এবং ঋণদাতা, ) গ্রামীণ বাজারের বিশেষ ঐতিহাসিক চরিত্র যেখানে ক্ষুদ্র প্রজাদের প্রবেশাধিকার সীমিত এবং এই প্রকার বাজারের বিচিত্র সংগঠনের মাধ্যমে ক্ষুদ্রপ্রজাদের অনিচ্ছাকৃত বিনিময়ে জোর করে অংশ গ্রহণ করানো হয়। --এই চারটি বৈশিষ্ট্যে দেখায় উৎপাদন পদ্ধতিটি এখনো আধা-সামন্ততান্ত্রিক থেকে গেছে। তিনি বৈশিষ্ট্যগুলো ব্যাখ্যা করেছিলেন, আমরা সেটি করছি না। কিন্তু এগুলো আমরা অসমেও এখন একই রকম দেখব। লেখাটির শেষে মন্তব্য করেছিলেন, আধাসামন্ততন্ত্রে শ্রেণি ক্ষমতার প্রশ্নটি জরুরি। "প্রজাদের চিরঋণী থাকাটাই যেহেতু মূলত আধা-সামন্ততান্ত্রিক ভূস্বামীদের ক্ষমতার ভিত্তি এবং আমার ধারণা, ব্যাপক অ-নথিভুক্ত প্রজাস্বত্বের সঙ্গে ঋণগ্রস্থ প্রজাদের দারিদ্র্যের গভীর সম্পর্ক আছে--এটা মনে হয় বলা যায় যে, আধা-সামন্ততান্ত্রিক জমিদারেররা সচেতন ভাবে প্রযুক্তিগত উন্নতি নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে নিশ্চলতা ও নিম্ন ক্ষমতা বজায় রেখে চিরাচরিত ঋণগ্রস্থতাকে কাজে লাগিয়ে তাদের রাজনৈতিক ক্ষমতা কায়েম রাখার চেষ্টা করবে।অসমে আমরা এর অন্যথা হতে দেখিনি। ইতিমধ্যে পশ্চিম বাংলাতে তিন দশকের বাম শাসন ফুরিয়েছে, বহু প্রচারিত অপারেশন বর্গাহয়ে গেছে। পূর্বভারতের কৃষিতে আধা-সামন্ততন্ত্রের একটি বিশ্লেষণনামে লেখাটি সেপ্টেম্বর,১২ সংখ্যাতে আবার ছেপেছে অনীককাগজ। বিশেষ কোন পরিবর্তন করেন নি, একটি সংযোজন অংশ যোগ করেছেন লেখক। সেখানে লিখেছেন, “গত চল্লিশ বছরে অনেক কিছুই নিশ্চয় বদলিয়েছে। আমার ভাসা ভাসা ধারণা, উৎপাদন বহু জায়গায় বেড়েছে, কিন্তু তার সঙ্গে বেড়েছে কৃষকের ঋণের বোঝা। মনে হয় না সে ঋণ ব্যাংক বা সরকার থেকে পাওয়া যায় এবং সেই অর্থে 'অপারেশন বর্গা' সীমিত।
             আমরা অসমে কৃষকের হাতে জমির প্রশ্নে এখনো রাজ্যে লড়াই হতে দেখি, কিন্তু খাজনা নিয়ে কথা হতে তেমন আর দেখি না। তবে কি ভূস্বামীদের লুণ্ঠন বন্ধ হয়ে গেছে? না অন্য চেহারা নিয়েছে? আমরা শুনি কৃষি পণ্যের ন্যায্যমূল্যের দাবিতে কৃষকের লড়াইর কথা। ২০১১র অক্টোবরে দরং জেলার বেচিমারিতে পাটের ন্যায্যমূল্যের দাবিতে লড়াই করতে গিয়ে চারজন কৃষক পুলিশের গুলিতে প্রাণ দিয়েছেন। তার মানে, কৃষিপণ্যের বাজার দর এখনো মোটেও কৃষক তথা উৎপাদকের নিয়ন্ত্রণে নেই। নিয়ন্ত্রক বাজার এবং প্রশাসন। ফলে জমি হাতে থাকলেও কৃষিকাজে অনেকে যেমন হতাশ হয়ে সে কাজ ছেড়ে দিচ্ছেন, তেমনি বহু কৃষি মজুরও গ্রামাঞ্চলে কাজ না পেয়ে বেরিয়ে পড়ছেন। অসমের লোকেরা কাজ করেনা বলে যে মধ্যবিত্তীয় বদনাম যখন প্রচুর আমরা তখন ২০১২র কোকড়াঝাড় দাঙ্গার সময়ে দেখেছি দক্ষিণ ভারত থেকে হাজারো তরুণ প্রাণভয়ে বাড়ি ফেরার জন্যে রেলে চেপেছেন। এরা অসমের গ্রামীণ তপশিলি জাতি-জনজাতি কৃষকের ঘরেরে ছেলে মেয়েরা, সেখানে গেছেন অসংগঠিত ক্ষেত্রে গতরের শ্রম বিক্রি করবার জন্যে। কোর্পোরেট বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে যারা মানসিক শ্রম দেন তাঁরা ফেরেন নি । বরং পলরুয়া লরাবোরে দেশর আগত অসমিয়ার সন্মান হানী করিলেবলে বিদ্রূপ করে গেলেন। এমনটা হয় কেন? এই প্রশ্নগুলো আমরা তুলিনি। তুললে অনেক প্রশ্নই তুলতে হয়। সবুজ বিপ্লব এবং বিশ্বায়ন পরবর্তী ভারতের সঙ্গে অসমেও কৃষিতে পুঁজিবাদের প্রবেশ ব্যাপক হয়েছে বটে, কিন্তু কৃষক স্বাধীন বণিক কিম্বা শ্রমিকে পরিণত হয় নি। তার উপরে ঋণদাতা মহাজনের শাসন রয়েই গেছে। বরং নানা ভাবে বেড়েছে, সেই সঙ্গে সে এখন প্রথাগত কৃষির থেকে অনেক দূরে এসে যেতে বাধ্য হয়েছে। এখন আর সে জমিতে হাল ঠেলে না সর্বত্র, বীজগুলোও নিজের উৎপাদিত নয়। ক্রমেই তাকে ট্রেকটর, বিদ্যুৎ চালিত সেচ ব্যবস্থা, উন্নত ফলনশীল বীজ, রাসায়নিক সার, কীট নাশকের মোহে বেঁধে ফেলা হয়েছে। এর প্রত্যেকটির জন্যেই সে দেশী-বিদেশী বাজার এবং ব্যবস্থার বেশি বেশি করে অধীনস্থ হয়ে গেছে। হাল এবং গরু যেমন তার নিয়ন্ত্রণে থাকত এর একটাও কৃষকের নিয়ন্ত্রণে থাকে না। পশুপালনেরও একই অবস্থা। সে যা বাজার থেকে কেনে এবং বেচে সব কিছুর দরই বাজার ঠিক করে। তার ভাগ্য স্থির করেন ঈশ্বর কিম্বা আল্লাহ। আমাদের মধ্যবিত্তরা প্রগতিশীল নাস্তিকেরা সেই ঈশ্বরকেও মাঝে মধ্যে কেড়ে নেবার জন্যে লেখালেখি করে থাকেন সামন্তব্যবস্থাটিকে অক্ষত রেখেই। এসব রইল। আমরা ভূমি নিয়ে আলোচনা করছিলাম। সেই নিয়েই সাম্প্রতিক বাস্তবতার কিছু আভাস দিয়ে আমরা দাঁড়াবো।
               জমির মূল মালিক এখনো সরকারই। কৃষকদের হাতে জমি তুলে না দেবার আর একটি বড় সুবিধে এই যে সরকার নিজে বা সরকারকে পাশে নিয়ে চা-বাগান মালিকদের মতো যে কোন ভূস্বামী বা পুঁজিপতি ইচ্ছেমতো কৃষক উচ্ছেদ ঘটিয়ে অন্যান্য লাভজনক প্রতিষ্ঠানের জন্যে জমি নিয়ে নিতে পারেন। আমরা গুয়াহাটির বেলতলার কৃষক বিদ্রোহের কথা বলছিলাম। এক সময় উজান বাজার, পল্টন বাজার, ভরলু মুখ নিয়ে যে গুয়াহাটি শহর ছিল সেখানে কিছু বড় অসমীয়া বাঙালি বর্ণহিন্দুও ভূস্বামীও বাস করতেন। চারপাশে বডো-রাভা-খাসিয়া জনজাতিরা তাদের রায়ত হিসেবে চাষাবাদ করতেন। এগুলো সেই অর্থে তাদেরই জমি ছিল। বেলতলার বিদ্রোহ তারাই করেছিলেন। এখন সেই গুয়াহাটি মহানগর। জনজাতিদেরই নিত্য উচ্ছেদ করা হয় অবৈধ দখলদার বলে! মহানাগরিকরা নীরব থাকেন। কৃষক আন্দোলনের চাপে নানা সময়ে স্বাধীন সরকারও ১৮৮৬র ভূমি রাজস্ব আইন বলবৎ রেখেও একের পরে এক ভূমি নীতি ঘোষণা করে গেছে। ১৯৫৮, ১৯৬৮, ১৯৭২, ১৯৮৯তে এমন ভূমি নীতি বেরিয়েছিল। এই নীতিগুলোর মধ্যেই কেমন পাট্টাদারেরাই অগ্রাধিকার পেয়েছিলেন, তার নজির ১৯৫৮র নীতি। সেখানে ভূমি পত্তন দেবার অধিকারী চিহ্নিত হয়েছিল এভাবে: ) যেসব পাট্টাদার বন্যা, নদী ধ্বস, ভূমিকম্প, বা সর্বজনীন স্বার্থে ভূমি অধিগ্রহণে জমি হারিয়েছিলেন। খ) ভূমিহীন কৃষক এবং স্থানচ্যুত যারা। গ) নদীধ্বসে ভূমি হারিয়ে উপায়ুক্তের অনুমতিতে যারা কোনও সংরক্ষিত এলাকাতে বাস করছেন, তাদের বিকল্প ভূমি না দেয়া অব্দি সরানো হবে না। এই ব্যবস্থা ব্যর্থ হয়। ১৯৬০-৬১এ রাষ্ট্রীয় নমুনা সমীক্ষা (NSS) সরকারিভাবে অসমের ১৫ % পরিবারকে ভূমিহীন বলে নিশ্চিত করে। ১৯৮৯র ভূমিনীতিতে বলা হলো নিয়মিত প্রিমিয়াম আদায় দিলে একসনা পাট্টাকে এক সময় ম্যাদীপাট্টাতে রূপান্তরিত করা হবে। এই ব্যবস্থাটি আগেও ছিল, কিন্তু এটি রাজস্ববিভাগের সরকারি আমলাদের বাড়তি রোজগারের পথ করে দিয়েছিল। প্রিমিয়ামের পরিমাণও বেশি আর এর সঙ্গে কর্মচারীদের এক বড় পরিমাণ উৎকোচ না দিলে কোনও কাজই হতো না। ১৯৮৪তে প্রিমিয়াম দেয়া কৃষক পাট্টা পান নি এমন তথ্যের উল্লেখ করেছেন, ‘বৃহত্তর গুয়াহাটি মাটি পত্তন দাবি সমিতিএকটি সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে। ৩৭ তার উপরে তাদের দেখাতে হয় দশ কিম্বা তার বেশি সময় ধরে একই জায়গাতে বা পূর্ববাসস্থানের নথিপত্র; যা বানাক্রান্ত , ধ্বসবিধ্বস্ত এবং স্বল্প শিক্ষিত কৃষকেরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখাতে ব্যর্থ হন। কিন্তু এই সব সুবিধেই জুটিয়ে নেয় বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো, বিশ্বায়ন পরবর্তী অসমে যাদের পদধ্বনী সজোরে শোনা যাচ্ছে। সেই সঙ্গে আমরা যেন মনে রাখি মধ্যবিত্তের জন্যে গৃহনির্মাণ নিজেও এখন এক অর্থকরী শিল্প’—যা নগর কিম্বা মহানগরে ক্রমেই বাড়ছে। সঙ্গে বাড়ছে তপশিলি-জাতি জনজাতি এবং সংখ্যালঘু কৃষকদের ভিটে ছাড়া হবার আতঙ্ক। চর অঞ্চলে মাতব্বরদের মতো নগর মহানগর বা যেখানেই তারা এই আতঙ্কে থাকেন, সেখানেই শাসক শ্রেণি তথা দলের থেকে তাদের এক ত্রাতাও অবতরিত হন। যার ইচ্ছের বিরুদ্ধে তারা পাটি ফেলেন না। কেউ ভূমি আন্দোলনে নামার আবেদন নিয়ে গেলেও অনেকে বলেন, ‘আমরা রাজনীতি করিনা৩৮ আজ অব্দি কৃষকদের পক্ষে গ্রহণযোগ্য কোন ভূমি জরিপও অসমে হয় নি।
              ‘কৃষকের হাতে জমির দাবি এখনো তার বাস্তবতা হারায় নি, গোটা ভারতেই জল জমি জঙ্গলের দাবিতে কৃষক আন্দোলনের চাপ যে বাড়ছে এবং সেই চাপে সরকার একটি নতুন ভূমি সংস্কার আইন আনতে যাচ্ছে, সে কথা আমরা শুরুতেই বলেছি। বেশ কিছু ভালো ভালো প্রস্তাব এতে আছে, কিন্তু নয়া-ঔপনিবেশের পুঁজিপতি এবং ভূস্বামীদের ক্ষমতা এবং অধিকার হনন করে কাজের কাজ কী হবে এই নিয়ে সন্দেহ সহজে যাবার নয়। এদের দ্বারাই সংগঠিত অসম আন্দোলন পরবর্তী অসমে সব কৃষকের হাতে জমিবলতেই অনেকে ভয় পান। যদি বাংলাদেশীতে জমি নিয়ে যায়! বাস্তবে কিন্তু, এই সব বাঙালি মুসলমানের দাবিকেও অস্বীকার করা কঠিন। এদের বাদ দিয়ে অসমে আজ আদৌ কোনও কৃষক আন্দোলন দাঁড়াতে পারে না, পারেও নি। সীমাবদ্ধ যেসব আন্দোলন হচ্ছে তার নেতৃত্ব যারা দিচ্ছে কৃষক মুক্তি সংগ্ৰাম সমিতিএর অন্যতম। এর তরুণ নেতা আজকাল গোটা ভারতে সুপরিচিত নাম, অখিল গগৈ। তাদের দাবি খিলঞ্জিয়া কৃষকের হাতে জমি!’ ‘খিলঞ্জিয়ামানে ভূমিপুত্র। তিনি প্রায়ই অসমিয়া জাতীয় স্বার্থেদৃষ্টিতে কৃষক সমস্যাকেও তুলে ধরেন। তফাৎ হলো প্রতিপক্ষ যখন পুঁজিবাদী বিকাশের সঙ্গে জাতীয় স্বার্থকে এক করেন, তিনি তপশিলী জাতি-জনজাতি-সংখ্যালঘু কৃষকের অধিকার বাদ দিয়ে কোনও জাতীয়সমৃদ্ধির দাবি করেন না। এই সুযোগে বেশকিছু সংখ্যালঘু হিন্দু-মুসলমান তাঁর পাশে দাড়িয়েও যান। এর বেশি, এগোন না। কিন্তু যাকে বলে গণভিত্তি, সেটি এখনো পূর্ববঙ্গীয় হিন্দু মুসলমান কিম্বা ঝাড়খণ্ডি আদিবাসীদের মধ্যে লাভে সমর্থ হয়েছেন বলে দেখা যাবে না। মানে দাঁড়ালো এই যে জাতে-পাতের ভারতীয় ব্যবস্থাকে না ছুঁয়ে গিয়ে, পরিচিতির প্রশ্নকে এড়িয়ে গিয়ে আদৌ কোনও কৃষক আন্দোলন অসম তথা ভারতে হয় নি, হবে না। প্রশ্ন হলো ব্যবস্থাটিকে আপনি কীভাবে অধ্যয়ন করবেন এবং অধিকাংশ কৃষক জনগোষ্ঠীর ঐক্যের দৃষ্টান্ত স্থাপন করে প্রত্যাহ্বান জানাবেন। শ্রমিক-কৃষক ভাই ভাইএকটি বামপন্থী মন্ত্র মাত্র, কোনও কাজের কথা নয়। ভারত তথা অসমে এই কথার অর্থ উদ্ধারই এক জটিল সংগ্রামী পথের কাজ। সাধারণত ধরে নেয়া হয় যে প্রব্রজিত পূর্ববঙ্গমূলীয় কেউ খিলঞ্জিয়া নন। আলফাতো দাবি করে ১৮২৬এর ইয়াণ্ডাবু সন্ধির আগে যারা অসমে ছিলেন, তারাই শুধু খিলঞ্জিয়া। তার মানে, বর্তমান লেখকও খিলঞ্জিয়া নন। কিন্তু কৃষক মুক্তি অসম চুক্তিমেনে দাবি জানান, ১৯৭১এর ২৫এ মার্চের পরে অসমে আসা কাউকে জমি দেয়া যাবে না। আপাত দৃষ্টিতে এর একটি শাসক শ্রেণির স্বার্থ বিরোধী দিকও আছে। এর মানে হলো, এই সময়ের পরে আসা কোনও বিনিয়োগকারীকেও জমি কেনাবেচার অধিকার দেয়া যাবে না। কী দাঁড়ায়, এখনো দেখা বাকি। তবে পূর্বোত্তরের যেসব রাজ্যে এখনি বহিরাগতকে জমি বিক্রি নিষিদ্ধ করা হয়েছে দেখা গেছে বিনিয়োগকারীদের তাতে করে আটকানো যায় নি। তারা স্থানীয়দের নামে জমি কিনে ছোট সহযোগী করে নিয়ে বাণিজ্য বাড়িয়ে নিয়ে চলেন। এভাবে জনজাতিদের মধ্যে মধ্যবিত্ত গড়ে উঠবার পথও প্রশস্ত হয়। বিপদে পড়েন, যারা নানা ভাবে সহযোগী ছোট উদ্যোগী, ব্যবসায়ী বা কিম্বা শ্রমিক হিসেবেও সেখানে যান। এক বিছানার বাসা ভাড়ার জন্যেও অকল্পনীয় উঁচু হারে দাম গুনতে হয়। তার উপর উঠতি জনজাতীয় মধ্যবিত্তের মুনাফার হার বাড়াবার স্বার্থে বহিরাগত বিদ্বেষের যত মারও তাদের উপর দিয়েই যায়। দর কষাকষির ক্ষমতা এদের এতে কমতে থাকে সে হচ্ছে গে বাড়তি কথা। আমরা পাহাড়ের কথা আলোচনা করতে পারলে বিষয়টি আরো স্পষ্ট হতো। ইনার লাইননিয়ে দেবব্রত বিদ্রূপটি করেছিলেন এরই জন্যে। ভূমি অধিগ্রহণ আইন হয়ে গেল, ভূমি সংস্কার আইন হবার পথে। সেগুলো প্রয়োগে আসার পর আনুভূমিক তথা কালিক অধ্যয়নের দরকার অনেকে বেড়ে যাবে। আশা করছি, আমরাই তাতে আবার হাত দেবো পরে কখনো।





সূত্র নির্দেশ :
) নতুন পদাতিক; ধারাবাহিক চারটি সংখ্যা; মার্চ-এপ্রিল-মে অক্টোবর, ২০০৩; মুখ্য সম্পাদক:
হীরেন গোহাঁই; গুয়াহাটি।
)সন্তোষ রাণা,খাদ্য নিরাপত্তা ও জমি অধিগ্রহণ আইন প্রসঙ্গে, অরুণোদয় , অক্টোবর, ২০১৩ সংখ্যা; সম্পাদক: চন্দন সেনগুপ্ত; শিলচর।
) শৈলেন বরকটকী,অসমত সামন্তবাদর উত্থানত নববৈষ্ণব ধর্মর ভূমিকা, নতুন পদাতিক, ৬ষ্ঠ বর্ষ, ৪র্থ সংখ্যা,১৫ জানুয়ারি, ২০০৫।
) অনিল রায় চৌধুরী; প্রাক-স্বাধীনতা কালর অসমর কৃষক অভ্যুত্থান; নতুন পদাতিক;৭ম বর্ষ, ৫ম সংখ্যা; ২৬ মার্চ ২০০৬।
)
) নন্দেশ্বর তালুকদারর সতে সাক্ষাৎকার, নতুন পৃথিবী, একবিংশ বছর, চতুর্থ সংখ্যা, অক্টোবর-ডিসেম্বর , ২০০০ ; সম্পাদক হীরেন গগৈ; গুয়াহাটি।
) ইসমাইল হুসেন (জ্যেষ্ঠ)অসমর জনজাতি আরু কম্যুনিস্ট আন্দোলন; নতুন পদাতিক, ৬ষ্ঠ বর্ষ, ৩য় সংখ্যা, অক্টোবর ২০০৪
8) শ্রেণি সংগ্রাম, ১৯৮২ বিহু সংখ্যা, সম্পাদক: কিশোরী মোহন শর্মা; গুয়াহাটি;পৃঃ৩৬।
)অসম আন্দোলন আরু জনগোষ্ঠীগত সমস্যা; অসম আন্দোলন:প্রতিশ্রুতি আরু ফলশ্রুতি; হীরেন গোঁহাই এবং দিলীপ বরা সম্পাদিত সংকলন; ২য় সংস্করণ, বনলতা, ডিব্রুগড়-গুয়াহাটি, ২০০৭।
১০) মেদিনী চৌধুরী; ঐ।
১১) অসম আন্দোলন আরু জনগোষ্ঠীয় প্রশ্ন; অসম আন্দোলন:প্রতিশ্রুতি আরু ফলশ্রুতি; হীরেন গোঁহাই এবং দিলীপ বরা সম্পাদিত সংকলন।
১২)বড়ো খেতিয়কর সমস্যার রূপ রেখা; পূর্ণ বড়ো; নতুন পৃথিবী; ২৭ বর্ষ, ১ম সংখ্যা, জানুয়ারি-মার্চ, ২০০৭
১৩) অমলেন্দু গুহ;ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার অসমিয়া সমাজত বহিরাগত: এটি দৃষ্টিপাত;চরচাপরির জনজীবন-সংঘাত আরু সৌরভ; সম্পাদনা শহিদুল ইসলাম এবং টুনুজ্যোতি গগৈ; পৃথিবী প্রকাশন; এপ্রিল ২০১০, গুয়াহাটি,পৃঃ ১৪ ।
১৪) অসমর চরবাসী আরু নদী কাষরীয়া মুসলমান কৃষকসকলর আর্থসামাজিক গুরুত্ব; চরচাপরির জনজীবন-সংঘাত আরু সৌরভ; পৃঃ৪০
১৫) অমলেন্দু গুহ; ; পৃঃ২১
১৬) প্রব্রজনকারীর সমস্যা আরু অসমঃ আনন্দরাম ঢেকিয়াল ফুকনর পরা গোপীনাথ বরদলৈ লৈকে; রমেশ চন্দ্র কলিতা, অসম আন্দোলন:প্রতিশ্রুতি আরু ফলশ্রুতি; পৃঃ ১৬ ।
১৭) রমেশ চন্দ্র কলিতার পূর্বোক্ত প্রবন্ধে উচ্চশিক্ষানামে বলি নারায়ণ বড়ার লেখা মৌ চতুর্থ সংখ্যা, ১৮৮৭ থেকে উদ্ধৃত এবং বর্তমান লেখক কর্তৃক অনুদিত; পৃঃ১৭
১৮) রমেশ চন্দ্র কলিতার উপরোক্ত প্রবন্ধে উদ্ধৃত; পৃঃ ১২।
১৯) ; পৃঃ ২১ ।
২০) রমেশ চন্দ্র কলিতার উপরোক্ত প্রবন্ধে উদ্ধৃত;পৃঃ ২৬ ।
২১) জনগোষ্ঠীগত উত্থান-জাগরণ, অসমিয়া জাতিগঠন প্রক্রিয়া আরু জাতীয় জনগোষ্ঠীগত অনুষ্ঠানসমূহ, একলব্য প্রকাশন, যোরহাট, দ্বিতীয় প্রকাশ ৪ ফেব্রুয়ারি, ২০০৭; পৃঃ ৩৭৬ ।
২২)রমেশ চন্দ্র কলিতা, ; পৃঃ ৩০ ।
২৩)অসম আন্দোলন:প্রতিশ্রুতি আরু ফলশ্রুতি বইতে মেদিনী চৌধুরীর অসম আন্দোলন আরু জনগোষ্ঠীগত সমস্যা প্রবন্ধে উদ্ধৃত; পৃঃ ২৫২ ।
২৪)অসম আন্দোলন আরু সংখ্যালঘুর সমস্যা, অসম আন্দোলন আরু ফলশ্রুতি; মছউদুল হক; পৃঃ৩০৬
২৫)অসমিয়া মুসলমানর অতীত আরু ভবিষ্যৎ; চরচাপরির জনজীবন-সংঘাত আরু সৌরভ; পৃঃ৩০।
২৬)ড০ অহিজুদ্দিন শেখ, চর অঞ্চলত ভূমি পত্তন আরু মাটি পত্তনর সমস্যা,চরচাপরির জনজীবন-সংঘাত আরু সৌরভ; পৃঃ১০৪
২৭) চর অঞ্চলর বাস্তব চিত্র আরু বিদেশী সমস্যার সমাধান; চরচাপরির জনজীবন-সংঘাত আরু সৌরভ; পৃঃ ৬৫ ।
২৮)Brahmaputra Erosion Destroys Nearly 4,000 Sq Km Of Assam Land;The Hindu; February 4, 2010
২৯)অসমর কৃষি উৎপাদন আরু গরাখহনীয়া সমস্যা, ইসমাইল হুসেন জ্যষ্ঠ;চরচাপরির জনজীবন-সংঘাত আরু সৌরভ; পৃঃ ১০২ ।
৩০) দেবব্রত শর্মার ব্যবহৃত উদ্ধৃতি ; পৃঃ ৩৪৮।
৩১)অসমর চা বনুয়াঃ এটা শোষিত জনগোষ্ঠী; শশী শর্মা; নতুন পদাতিক;১ম বর্ষ, ১১শ সংখ্যা; আগস্ট, ১৯৯৯; পৃঃ ১৪ ।
৩২)দেবব্রত শর্মা; পৃঃ ৩৪৬ ।
৩৩) অসমর চাহ জনগোষ্ঠীর দুর্দশা আরু সংগ্রামঃঅতীত আরু বর্তমান; ডাঃ জয়দেব শর্মা; নতুন পদাতিক; ১ অক্টোবর, ২০১৩ সংখ্যা;পৃঃ ১৪ ।
৩৪) ডাঃ জয়দেব শর্মার পূর্বোক্ত প্রবন্ধে উদ্ধৃত; নতুন পদাতিক; ১ অক্টোবর, ২০১৩ সংখ্যা; পৃঃ ১৬ ।
৩৫)দেবব্রত শর্মা; পৃঃ ৩৬৩ ।
৩৬)অসমর প্রাক্তন চা-বনুয়া সকল; নতুন পৃথিবী; ২৫ বর্ষ, ২য় সংখ্যা; এপ্রিল-জুন ২০০৪; পৃঃ৯।
৩৭)নতুন পদাতিক;১৫ ডিসেম্বর, ২০১৩; পৃঃ ১৪।
৩৮)অনুভব দত্ত;গুয়াহাটির ভূমি সমস্যা, ভারসাম্য বিশিষ্ট উন্নয়ন আরু উচ্ছেদ অভিযান; নতুন পদাতিক; ৬ষ্ঠ বর্ষ, ৩য় সংখ্যা; ২৫ অক্টোবর, ২০০৪; পৃঃ২৪।
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~