আমার চেতনার রঙে রাঙানো এই খেলা ঘরে:

~0~0~! আপনাকে স্বাগতম !~0~0~

*******************************************************************************************************

Wednesday, 16 April 2014

আধুনিক ভাষাবিজ্ঞান, সমাজভাষা বিজ্ঞান এবং রবীন্দ্রনাথ



( ২৮, ২৯ জুন,২০১১ গুয়াহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত জাতীয় আলোচনাচক্রে পাঠ করবার জন্যে) 
          পাণিনির ব্যাকরণকে আজকাল গোটা বিশ্ব দাবি করে আধুনিক ভাষাবিজ্ঞানের, এমন কি চমস্কি প্রবর্তিত রূপান্তরমুলক সৃজনমূলক ভাষাবিজ্ঞানেরও আদিগ্রন্থ। এটি যেমন আমাদের পক্ষে গৌরবের তেমনি এ আমাদের এক সর্বনাশেরও কারণ। আমরা জানি, এর পর ভারতে যতগুলো ব্যাকরণ লেখা হয়েছে সেগুলো ওই পাণিনি ব্যাকরণেরই টীকাভাষ্য। দার্শনিক মতপ্রস্থান অনুযায়ী কেউ কেউ টীকাভাষ্যের বয়ানে, গ্রহণ বর্জনে রকমফের ঘটিয়েছেন কিন্তু মূলগত ভাবে সেগুলো পানিনি ব্যাকরণেরই উত্তরভাষ্য বলা চলে। পালি-প্রাকৃত ভাষারও ব্যাকরণ যে কয়টি লেখা হয়েছে সেগুলোতেও তার ব্যত্যয় হয়নি। এমন কি প্রথম যে প্রাকৃত ব্যাকরণের খবর পাওয়া যাচ্ছে সেই হেমচন্দ্রের ‘সিদ্ধহেম শব্দানুশাসনে’ও তাই আর সেটি রচিত হচ্ছে প্রাকৃতের বয়স সহস্রাব্দ পার করাবার পর খ্রীষ্টীয় একাদশ দ্বাদশ শতকে। ততদিনে প্রত্ন বাংলাও   দেখা দিচ্ছে , চর্যাপদের কবিতাগুলো লেখা হয়ে যাচ্ছে। সুতরাং বাংলা ব্যাকরণ বা অভিধানের জন্যে যে আমা

বাংলা শব্দতত্ত্ব

দের ১৭৩৪ খৃস্টাব্দে  পোর্তুগীজ পাদ্রি মনোএল দ্য আসসুম্পসাউ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে তাতে অবাক হবার কিছু নেই।
          মনোএলের ‘ভোকাবুলারিও এম ইদিওমা বেনগল্লা, ই পোর্তুগিজঃ দিভিদিদো এম দুয়াস পার্তেস’ নামে বইটি ১৭৪৩এ পোর্তুগালের রাজধানী থেকে ছেপে বেরোয়। পাণিনির দেশে এইটিই ছিল বাংলা ভাষার ভাষাচিন্তা সংক্রান্ত প্রথম বই। আজকের পরিচিত মান বাংলাভাষাতেও লেখা নয় বইটি। বাংলাদেশের রাজধানী শহর ঢাকার অদূরে বর্তমানে গাজীপুর জেলার অন্তর্ভুক্ত, তৎকালীন ভাওয়াল পরগণার বাংলা ভাষার  উপর ভিত্তি করেই মনোএল লিখেছিলেন এই বই। কিন্তু পরে যেটি বাংলা লেখার ভাষা সাধুভাষা হিসেবে গড়ে উঠবে তার প্রবণতাও এর মধ্যে দেখা যাচ্ছিল। যে সাধুভাষার দীর্ঘ  ক্রিয়াপদগুলো মূলতই ছিল পূর্ববাংলার উপভাষাগুলোর থেকে নেয়া। কিন্তু সেই ভাষাকেই শ্রীরামপুর মিশনের সময় থেকে  সংস্কৃত শব্দবহুল প্রায় সংস্কৃত করে ফেলবার এতো বেশি আয়োজন হলো যে বঙ্কিম থেকে রবীন্দ্রনাথের যুগ অব্দি তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহের এক প্রস্তুতির বেলা আমাদের কাটাতে হলো। মনোএলের পর মাঝের এই প্রায় দেড় শতকে এই বাংলা ভাষাতে দেশি বিদেশি পণ্ডিতেরা অজস্র ব্যকরণ এবং অভিধান লিখেছেন। কিন্তু সেগুলো ছিল হয় ইংরেজি নতুবা সংস্কৃত ব্যাকরণ এবং অভিধানের ছাঁচে ঢালা। এর বাইরে ভাষাতত্ব নিয়ে আমাদের ভাবনা এগুলোই না।  কারণ, কৃত্তিবাস থেকে ভারত চন্দ্রের এক দীর্ঘ সময় কাল পার করে এলেও ঔপনিবেশিক সূত্রে পাওয়া ইংরেজি আমাদের সম্পদ বাড়ালো যেমন, বিপদেও তেমনি জড়ালো অনেক বেশি, অনেক জটিল করে। আমরা আবার নতুন করে অবিশ্বাস করতে শুরু করলাম যে বাংলাভাষা দিয়ে ভদ্র সমাজে দুটো কাজের কাজ চালানো যেতে পারে। সেই অবিশ্বাস বর্জনের কাজটা বিদ্যাসাগর-বঙ্কিমেরা কিছুদূর এগিয়ে দিলেন। কিন্তু যাকে বলে কোমরে কাছা বেঁধে নেমে পড়া সে কাজটা প্রথম করলেন রবীন্দ্রনাথ।
রবীন্দ্রনাথ বাংলা ভাষার প্রথম ভাষাবিজ্ঞানী

   আমরা বিদ্যালয় শিক্ষকরা অন্তত সবাই জানি  সাধুভাষাকে ‘সুয়োরানী’ অবিধা দিয়ে বিশ শতকের শুরুতে প্রতিস্থাপিত করেছিলেন যে দুই বিশাল ব্যক্তিত্ব তাঁদের অন্যতম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। অনেকের ধারণা মূল কাজটি করেছিলেন প্রমথ চৌধুরী। রবীন্দ্রনাথের মতো বিশাল ব্যক্তিত্বকে সঙ্গে নিয়ে আসলে তিনি তাঁর কাজটাকে সহজ করে নিয়েছিলেন।তাতে মিথ্যে কিছু নেই। কিন্তু, তাতে এই ধারণা হয় যে সাহিত্যে অদ্বিতীয়মেধার পুরুষ হলেও ভাষার উপর সেই জোর বোধহয় রবীন্দ্রনাথের ছিল না। সত্য হলো, ভারতবর্ষে ভারতীয়ের মধ্যে  আধুনিক ভাষাতত্বের  সূচনাটাই হয়েছিল রবীন্দ্রনাথের হাতে। বাংলা ১৩০০ সনে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ স্থাপিত হলে পরের বছর থেকে নিয়মিত বেরোতে থাকে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ পত্রিকা । বাংলা সাহিত্যের সামগ্রিক উন্নতি এর উদ্দেশ্য ছিল বটে, কিন্তু ভাষার ক্ষেত্রে এর লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছিল  সংস্কৃত এবং ইংরেজি শাসিত প্রথাগত বাংলা ব্যাকরণের অনুশাসন থেকে বাংলাকে মুক্ত করা। রমেশচন্দ্র দত্ত এর প্রথম সভাপতি ছিলেন। নবীন চন্দ্র সেন এবং রবীন্দ্রনাথ ছিলেন প্রথম সহ-সভাপতি । সংগঠকদের কেউই প্রথাগত ভাবে ভাষাত্বাত্বিক ছিলেন না। তবু এই পত্রিকাতেই যে সব লেখা বেরোতে থাকে তাতেই পরবর্তী বাংলা ভাষা চিন্তার গতিপথ নির্ণীত হয়ে যায়। রবীন্দ্রনাথের বড়দাদা দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর যেভাবে তাতে ‘উপসর্গের অর্থ বিচার’,  রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যেভাবে ‘বাংলা উচ্চারণ’, ‘বাংলা কৃৎ এবং তদ্ধিত প্রত্যয়’ বিচার করতে শুরু করেন  তাতে এখনো স্কুলপাঠ্য বইয়ের প্রচ্ছদে নাম দেখা যায় এমন বহু ব্যাকরণবিদকে লজ্জা দেবার পক্ষে যথেষ্ট। রবীন্দ্রনাথের ‘শব্দতত্বে’র নিবন্ধগুলো সেখানেই প্রকাশিত হয়। প্রকাশিত হবার আগে এগুলো সভ্যদের মাসিক অধিবেশনে  পড়া এবং আলোচনা করা হতো।   বাংলা প্রত্যয় সম্পর্কিত আলোচনাতে হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর সঙ্গে মিলে তিনিও বেশ কিছু প্রাদেশিক শব্দ সংগ্রহ করে সেগুলোর বিশ্লেষণ করেছিলেন। ১২ আশ্বিন, ১৩০৮ এর পঞ্চম অধিবেশনে তাঁর পঠিত সেই নিবন্ধ   শুনে পুরাতন পন্থীদের বৈয়াকরণিক এবং রবীন্দ্রবিরোধী পক্ষের ভাষাচিন্তাবিদ সতীশ চন্দ্র বিদ্যাভূষণও বলেছিলেন, “ শাস্ত্রী মহাশয় এবং রবীন্দ্রবাবু বাংলাভাষার প্রকৃতি নির্ণয়ে যেরূপ পরিশ্রম করিতেছেন, তাহাতে তাঁহাদিগকে বাংলাভাষার পাণিনি বলিলেই হয়। ১ এই পাণিনিদ্বয়ের একজন হরপ্রসাদ শাস্ত্রীযে দশক দুই পরে ‘চর্যাপদ’  আবিষ্কার করে বাংলাভাষা চর্চার খোলনলচে পালটে দেবেন এটা সম্ভব করেছিল বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের এহেন উদ্যোগ। ‘চর্যাপদ’ কালিক ভাষাচিন্তার থেকে বাঙালি ভাষা চিন্তকদের দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিয়ে যায় কালানুক্রমিক এবং ঐতিহাসিক ভাষাতত্বের দিকে আর সম্ভব করে সুনীতিকুমারের মতো আশ্চর্য প্রতিভার আবির্ভাব। সেই সুনীতি কুমারও রবীন্দ্রনাথ এবং বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের কথা বলতে গিয়ে তাঁর প্রথম বিখ্যাত গ্রন্থের (ODBL) মুখবন্ধেই লিখেছেন, “ ...But the first Bengali with a scientific insight in to attack the problems of the language was the poet Rabindranath Tagore…” সুনীতি কুমার আজীবন বহুবার রবীন্দ্রনাথের কাছে তাঁর ঋণ শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেছেন।ঐ মুখবন্ধেই তিনি আরো লিখেছেন, “...it is flattering for the votaries of Philology to find in one who is the greatest writer in the language, and a great poet and seer for all time, a keen philologist as well, distinguished alike by an assiduous  enquiry into the facts of the language and by a scholarly appreciation of the methods and findings of the modern western philologist. The work of Rabindranath in the shape of a few essays (now collected in one volume) on Bengali phonetics, Bengali onomatopoetics, and on the Bengali noun, and other topics, the earliest of which appeared in the early nineties, and some fresh papers appeared only several years ago. These papers may be said to have shown to the Bengali enquiring into the problems of his language the proper lines of approaching them.”     তাঁর অনুগামী সুকুমার সেন রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে লিখেছেন, “ ভাষাবিজ্ঞানের সূত্র ধরিয়াই রবীন্দ্রনাথ আধুনিক বাঙ্গালাভাষার উচ্চারণরীতির এবং ব্যাকরণের কোনো জটিল সমস্যার বিশ্লেষণ ও সমাধান করিয়াছিলেন। ...এই প্রবন্ধগুলির কথা মনে রাখিলে রবীন্দ্রনাথকে বাঙ্গালী ভাষাবিজ্ঞানীদের মধ্যে প্রথম বলিতেই হয়।” ২

বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ , কালিক ভাষাবিজ্ঞান  এবং রবীন্দ্রনাথ
          মনোএলের বইটি অবশ্যি, ধর্মীয় আবহের বাইরে তেমন প্রচারে মুখ দেখেনি। প্রথম যে ব্যাকরণের নাম আমরা বেশ ঘটা করে জানি সেটি  ১৭৭৮এ প্রকাশিত ন্যাথনিয়েল ব্র্যাসি হ্যালহেডের ‘ এ গ্রামার অফ দি বেঙ্গল ল্যাংগুয়েজ’ । এর খ্যাতি জড়িয়ে আছে এর মূদ্রণ ইতিহাসের সঙ্গে। পঞ্চানন কর্মকার এর জন্যেই ধাতুতে প্রথম বাংলা হরফ ঢালাই করে প্রথম একটা আদর্শ দাঁড় করিয়েছিলেন। এর পরের বই ১৭৯৯ এবং ১৮০২তে দুই খণ্ডে প্রকাশিত হেনরি পিটস ফরস্টারের ‘এ ভোকাবুলারি, ইন টু পার্টস , ইংলিশ অ্যাণ্ড বোংগালি অ্যাণ্ড ভাইস ভার্সা।’ এই শেষের বই দুটি পরে বাংলা ব্যাকরণ এবং অভিধানের এক ঐতিহ্য তৈরি করে।  প্রচুর বাঙালিও সমগ্র উনিশ শতক জুড়ে ব্যাকরণ এবং অভিধান রচনা করতে থাকেন। কিন্তু ভাষাতত্বের চর্চা এর বাইরে বেরোয় নি। নিতান্তই ব্যবহারিক প্রয়োজনে এগুলো লেখা হতো। আদর্শ হিসেবে বিদেশিরাই মূলত ইংরেজি ব্যাকরণ আর পাণিনিভাষ্যকে মান্য হিসেবে নিয়ে নিয়েছিলেন। বাঙালিরাও এর বাইরে বেরোবার দরকার বোধ করেননি। এ সময়ে ভাষাটাকেই তাঁরা প্রায় সংস্কৃততুল্য করে ফেলছিলেন। এনিয়ে বঙ্কিমই প্রথম কলম ধরেছিলেন তাঁর ‘বাঙ্গলা ভাষা’ প্রবন্ধে। তাঁর এই কথাগুলো স্মরণ করুন, “...সংস্কৃত প্রিয়তা এবং সংস্কৃতানুকারিতা হেতু বাঙ্গালা সাহিত্য অত্যন্ত নীরস, শ্রীহীন, দুর্বল এবং বাঙ্গালা সমাজে অপরিচিত হইয়া রহিল...।” সমস্ত মহত্ব নিয়েও পাণিনি ব্যাকরণ তার দরকারেই এক অনুশাসনিক ধারা গড়ে তুলেছিল। তেমনি ইংরেজিতে জনসনের অভিধানও এক রক্ষণশীল অনুশাসনিক ধারা গড়ে তুলেছিল আঠারো শতেকের মাঝামাঝি সময় থেকেই (১৯৫৫)। এর সঙ্গে ঔপনিবেশিক শাসনের রাজনৈতিক সূত্রও অনেকে জুড়ে থাকেন।  অনুশাসনিক ধারাকে প্রত্যহ্বান জানালো যে ‘অক্সফোর্ড অভিধান’ তার কাজ শুরু হয়েছিল মাত্র উনিশ শতকের শেষে ১৮৮৪তে , আর শেষ হয় ১৯২৮এ।
            
           আঠারো শতকের শেষের দিকে ভারতের রাজধানী শহর কলকাতাতে এশিয়াটিক সোসাইটির প্রতিষ্ঠার সভাতে উইলিয়াম জোনসের বক্তৃতাতে যদিও কালানুক্রমিক ভাষাতত্বের সূচনা হয়েছিল এই ধারা এরপরে দীর্ঘদিন কেবল ইউরোপেই সমৃদ্ধ হয়। এর কিছু উড়ো উড়ো খবর বরং বাঙালিদের মধ্যে এই বিশ্বাসকে দৃঢ় করছিল যে ‘সংস্কৃত বাংলা ভাষার জননী’ । ঐ উনিশ শতকের শেষের দিকে জন বীমস, জ্যুল ব্লক, গ্রিয়ার্সন আর হ্যর্নলের কাজগুলোর মধ্য দিয়েই শুধু বাঙালি প্রথম এর সঙ্গে পরিচিত হয়। রবীন্দ্রনাথ এদের আদি পুরুষ। সুনীতি কুমার এরপর পূর্ণ প্রথম পুরুষ।
           ফার্দিনান্দ দ্য সস্যুরেরCourse in General Linguistics(১৯১৬)  বইটি তখনো বেরোয় নি । কালিক ভাষাবিজ্ঞানের সঙ্গে পৃথিবী তখনো পরিচিত হয় নি। সুনীতিকুমারের ভাষা অধ্যয়ন এরপরে ভারতে এক দীর্ঘদিনের ঐতিহাসিক তুলনামূলক ভাষাবিজ্ঞানের ঐতিহ্যের সূচনা করবে। ভাবতে অবাক লাগে রবীন্দ্রনাথ এবং তাঁর সহকর্মীরা তখনি কালিক ভাষা অধ্যয়নের এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়ের স্বাক্ষর রাখবেন। অথচ দুই ধারার মধ্যে কোনো বিরোধ ছিল না। আগেকার বৈয়াকরণিক আর আভিধানিকদের গভীর বিশ্বাস ছিল যে সংস্কৃতই বাংলার জননী, আর সংস্কৃত ব্যাকরণই এর আদর্শ।  শ্রীনাথ সেন যেমন লিখছেন তাঁর ‘প্রাকৃত ব্যাকরণ এবং অভিধানে’, “ বাঙ্গলা ভাষা সংস্কৃত ব্যাকরণের দ্বারা প্রশমিত হইতে পারে এবং তাহা হইলেই ইহার কল্যাণ” তিনি আরো স্পষ্ট করেই লিখছেন, বাংলা ব্যাকরণ,” সংস্কৃত ব্যাকরণের অনুষঙ্গী হইতে পারে, স্বতন্ত্র ব্যাকরণ হইতে পারে না।” সুতরাং দ্বিজেন্দ্রনাথ-রবীন্দ্রনাথ দুই ভাই এবং সাহিত্য পরিষদের অপরাপর বিদ্বজ্জনেরা সেই কাজগুলোই করলেন যেগুলো করলে বাংলাকে বাংলা বলে দাঁড় করানো যায়। কেরি যেখানে লিখেছিলেন বাংলার তিন চতুর্থাংশ শব্দ সংস্কৃত, সেখানে ‘বাংলা ভাষা পরিচয়ে’ গিয়ে  রবীন্দ্রনাথ লিখে ফেললেন, “বানানের ছদ্মবেশ ঘুচিয়ে দিলেই দেখা যাবে, বাংলায় তৎসম শব্দ নেই বললেই হয়।”ব্যাকরণের প্রচলিত উপাত্তগুলোকেই ধরে ধরে তাঁরা সমালোচনা শুরু করলেন, আর দেখিয়ে গেলেন সংস্কৃতের থেকে বাংলার তফাৎটা কোথায়। এই করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথকে দেখা গেল অসমিয়া-ওড়িয়া সহ আশেপাশের বেশকিছু  ভাষা নিয়েও তুলনামূলক আলোচনাও করে নিতে।  হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর ‘চর্যাপদে’র আবিষ্কারটাও মোটেও আকস্মিক ছিল না। তাও ছিল বাংলার ‘বাঙ্গালি’ত্ব আবিষ্কার প্রয়াসের অংশ মাত্র। সুনীতিকুমার যে এর পরে বাল গঙ্গাধর তিলকের সংস্কৃতের ‘পাঁচ হাজার বছরের’ বয়সের দাবির অযাথার্থ্য প্রতিষ্ঠার সঙ্গে মাগধি অপভ্রংশ বলে বাংলার এক অকৃত্রিম জননী আবিষ্কার করে ফেললেন   তাও ঐ সময়ের দাবিই ছিল। উল্লেখ করা ভালো যে, সুনীতি কুমার যদিও তাঁর গবেষণার কর্ম করেছিলেন লণ্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর আগে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রেমচাঁদ রায়চাঁদ বৃত্তি পেয়ে বাংলা ধ্বনিতত্ব নিয়ে গবেষণা করেছিলেন। তাঁর তখনকার গবেষণা পত্রের বিচারক ছিলেন রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী এবং হরপ্রসাদ শাস্ত্রী। 
আধুনিক ভাষা অধ্যয়নে রাবীন্দ্রিক  ধারা এবং  পরবর্তী বন্ধুর পথ
          সুনীতি কুমার যদিও শুধু বাংলাতেই নয় গোটা ভারতেই আধুনিক ভাষাতত্ব চর্চার যুগান্তর নিয়ে এলেন, কিন্তু এলেন মুলত তাঁর ইংরিজেতে লেখা বিখ্যাত গবেষণা গ্রন্থটি দিয়ে। ফলে তাঁর পদ্ধতি এবং ভাষামাধ্যম দুটোরই গভীর প্রভাব পড়ল ভাষাতাত্বিকদের উপর। ভারতীয় উপ মহাদেশে অধিকাংশ ভাষাচর্চা এখনো হয় ইংরেজিতেই। আর দীর্ঘদিন তাঁরা মূলত বুঁদ হয়ে রইলেন কালানুক্রমিক ভাষাতত্বের চর্চাতে। রবীন্দ্রনাথ যে ধারার সূচনা করেছিলেন সেই পথে ঘুরে গেলেন অতি অল্পই। কালিক ভাষাতত্বের চর্চা শুরু হলো বাংলাদেশে মুহম্মদ আব্দুল হাই সম্পাদিত ‘সাহিত্য’পত্রিকা (১৯৫৭) এবং ‘বাংলা একাডেমী পত্রিকা’কে (১৯৫৭) কেন্দ্র করে। হুমায়ুন আজাদ লিখেছেন, “পরের দশকগুলোতে দেখা যায় কলকাতার মুক্তি ঘটেনি, কিন্তু ঢাকা এগিয়ে গেছে, আয়ত্ত্ব করেছে আধুনিক ভাষাতত্বের প্রণালী পদ্ধতি...”   ৩এই কথাকে সমর্থণ করছেন রামেশ্বর শ্ব। লিখছেন, “বাংলাদেশে মুহম্মদ শহীদুল্লাহের পরে আধুনিক কালে যেসব গবেষণা হয়েছে তা  অধিকাংশই বর্ণনামূলক (Descriptive) বা রূপান্তরমূলক সৃজনমূলক ( Transformational Generative) ব্যাকরণের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে, ঐতিহাসিক ভাষাতত্বের চর্চা বিশেষ চোখে পড়ে না।”৪ হুমায়ুন আজাদ আক্ষেপ করে লিখেছেন, “ সুনীতি কুমার, মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, ও সুকুমার সেন বাঙলা ভাষা ও শব্দের ইতিহাস অনেকটা আলোকিত করেন; এবং এমন একটি ধারণার সৃষ্টি হয় বাঙলা ভাষাঞ্চলে যে ভাষার বিবর্তন বর্ণনাই ভাষাতত্ব। এ সময়ে বাঙলা ভাষা সম্পর্কে বর্ণনামূলক কাজ বিশেষ হয় নি, যা হয়েছে তার ওপরও অপ্রতিরোধ্য প্রভাব ফেলেছে ইতিহাস। আমাদের কালানুক্রমিক ভাষাতাত্বিকেরা যখন বাঙলা ভাষার ব্যাকরণ লিখেছেন, তখন তাঁরা স’রে যেতে পারেন নি প্রথাগত পথ থেকেঃ তাঁরা অনুসরণ করেছেন প্রথাগত ইংরেজি ও সংস্কৃত ব্যাকরণপ্রণেতাদেরঃ এবং কালানুক্রমিক উপাত্তের সাহায্য নিয়েছেন সমকালীন বাঙলা ভাষা ব্যাখ্যা –বর্ণনায়।” ৫
             শহীদুল্লাহের সমালোচনাতে হুমায়ুন আজাদ বেশ কঠোরই । লিখেছেন, তিনি এবং সমকালীন অন্যেরা তাঁদের ব্যাকরণে, “ ধ্বনিপ্রকরণ পরিচ্ছেদে মিশিয়ে দিয়েছেন সংস্কৃত ও কালানুক্রমিক ধ্বনিতত্ব, এবং দিয়েছেন বাঙালা ধ্বনিশৃঙ্খলার এলোমেলো বিবরণ।”৬ আমাদের এখনকার প্রচলিত একটি ব্যাকরণ থেকে উদাহরণ দিলে স্পষ্ট হবে। ঠাকুর ভ্রাতৃদ্বয় এবং তাদের সহকর্মীরা কতটা এগিয়ে ছিলেন সময়ের থেকে। আমাদের হাতে ছিল রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়েরই প্রাক্তন বাংলা বিভাগীয় প্রধান ড০ নির্মল দাসের বই ‘ভাষাবীথি’। বইটি অসম মাধ্যমিক শিক্ষা  পরিষদের অনুমোদিত ব্যাকরণ বই। এর উপসর্গের  সংজ্ঞা দিতে গিয়ে তিনি শুরুতেই লিখছেন , “ যে ‘অব্যয়’ শব্দ ধাতুর আগে বসে ধাতুর সঙ্গে মিশে ধাতুকে অবলম্বন করে অর্থযুক্ত শব্দের সৃষ্টি করে ঐ সব  অব্যয়কে বলা হয়ে থাকে উপসর্গ।”  তিনিই লিখেছেন, “ সংস্কৃত ভাষায় বৈয়াকরণেরা এই সঙ্গা নির্দেশ করে গেছেন...” অতএব, বাংলা ভাষাতেও “খতিয়ে দেখলে দেখা যাবে ‘আসমুদ্র’ শব্দের ‘আ’ হলো শুদ্ধ অব্যয়, উপসর্গ নয়।” ( পৃঃ  ১৫৬) এবারে দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর বিখ্যাত প্রবন্ধ ‘ উপসর্গের অর্থ বিচারে’ সংস্কৃত বা ইংরেজি কোনো সংজ্ঞার ধারে কাছেও যান নি। সোজা লিখেছেন, বাংলা ‘নি’ উপসর্গে হাড়ে হাড়ে অনুপ্রবিষ্ট অর্থ বোঝায়, ‘আ’ উপসর্গে তার বিপরীতে বোঝায় ‘উপর উপর সংলগ্ন হওয়া”। ‘নি’র ইংরেজি অর্থ দিয়েছেন, ‘inhere’, ‘আ’এর adhere’। এবং তাঁর মতে  ‘আসমুদ্র পৃথিবী’ কথার অর্থ—‘যে পৃথিবীর অন্তভাগ সমুদ্রের সঙ্গে সহিত সংলগ্ন’৭   এবারে এই সহজ ছাত্র বোধ্য ব্যাখ্যাতে পাণিনি পতঞ্জলিদের অনুমোদন রয়েছে কিনা তার ধারে কাছেও তিনি যান নি। এই প্রবন্ধের বিরোধীতা করে লিখেছিলেন রাজেন্দ্র চন্দ্র শাস্ত্রী। রবীন্দ্রনাথ তাঁর বড়দাদার সমর্থণে কলম ধরে লিখেছিলেন, “ শ্রীযুক্ত দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর মহাশয় তাঁহার প্রবন্ধে ব্যাপ্তিসাধন প্রণালী দ্বারা (generalization) উপসর্গের বিচিত্র ভিন্ন অর্থের মধ্য হইতে আশ্চর্য নৈপুন্য সহকারে এক মূল অর্থ উদ্ধারের চেষ্টা করিয়াছেন। এ সম্বন্ধে এই প্রথম চেষ্টা।”৮ ‘আ’ উপসর্গ সম্পর্কে তিনি লেখেন, “ আ উপসর্গের অর্থ নিকট সংলগ্নতা; ইংরেজি উপসর্গ a( aback, asleep, জর্মান an ( ankommen অর্থাৎ আগমন), লাটিন ad, ইংরেজি অব্যয় at সংস্কৃত আ উপসর্গের প্রতিরূপ” এই অব্দি সব ঠিকই আছে। কিন্তু এর পরেই লিখছেন, “ এই নৈকট্য অর্থ সংস্কৃত ভাষায় স্থিতি এবং গতি অনুসারে আ এবং অভি এই দুই উপসর্গে বিভক্ত হইয়াছে। যাহা নৈকট্য প্রাপ্ত হইয়াছে তাহা আ এবং যাহা নৈকট্যের চেষ্টা করিতেছে তাহা অভি উপসর্গের দ্বারা ব্যক্ত হয়।” এবারে এই প্রণালীতে সংস্কৃত ব্যাকরণে আলোচনা হয়েছিল কি না, এমন প্রশ্নের উত্তরে রবীন্দ্রনাথ লিখছেন , “জানি না... কথা এই যে তাহারা যাহা স্থির করিয়াছেন তাহা প্রত্যক্ষ না থাকায় তাঁহাদের কথা আমরা মানিয়া লইতে পারি, পরখ করিয়া লইতে পারি না।”
ভাষাবিজ্ঞানের রবীন্দ্রনাথের কাজ
          
         তথ্যগুলো সংক্ষেপে উল্লেখ করলাম এই সংকেত দিতে যে কেন আমাদের দৃষ্টি রবীন্দ্রনাথ থেকে ঘুরে গেল। কথাগুলো স্পষ্ট হবে যদি রবীন্দ্রনাথের কাজের পরিচয় তুলে ধরা যায়। ‘শব্দতত্বে’ রচনাগুলো আগেই লিখেছি বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সূচনালগ্নে লেখা। কতকটি তার আগেই লেখা, কতকটি তারপরে। ১২৯২ থেকে ১৩১১ এই প্রায় দুদশক ধরে লেখা হয়ে ১৩১৫তে ( ইং ১৯০৯) বই হিসেবে বেরোয়। লেখাগুলো বেরিয়েছিল বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ পত্রিকা ছাড়াও বালক, সাধনা, ভারতী পত্রিকাতে। তার রচনা তালিকাটি এরকমঃ ১) বাংলা উচ্চারণ, (১২৯২) ২) স্বরবর্ণ ও, ৩) স্বরবর্ণ এ, ৪) টা টো টে, (১২৯৯)৫) বীমসের বাংলা ব্যাকরণ, ৬) বাংলা বহুবচন, ৭) সম্বন্ধে কার, (১৩০৫) ৮) বাংলা শব্দদ্বৈত, ৯) ধ্বন্যাত্মক শব্দ, (১৩০৭)১০) বাংলা কৃৎ ও তদ্ধিত, (১৩০৮) ১১) ভাষার ইঙ্গিত (১৩১১) আরো কিছু লেখা গ্রন্থবদ্ধ হবার সময় বাদ পড়লেও, ১২৫তম জন্মজয়ন্তীতে বিশ্বভারতীর প্রকাশিত সুলভ সংস্করণের সৌজন্যে আমাদের দেখবার সৌভাগ্য হয়েছে। সেগুলোর মধ্যে ১৩০৫ এ লেখা ‘ভাষা বিচ্ছেদ’এর মতো প্রবন্ধও রয়েছে যেখানে তিনি অসমিয়া ওড়িয়াকে স্বতন্ত্র ভাষা বলে দাঁড় করাবার প্রয়াসে আক্ষেপ প্রকাশ করছেন। এছাড়াও আছে, ১) একটি প্রশ্ন (১২৯২), ২) সংজ্ঞাবিচার, (১২৯২), ৩) ‘নিছনি’ (১২৯৯), ৪) ‘পঁহু’  ( ১২৯৯), ৫) প্রত্যুত্তর, পঁহু প্রসঙ্গ ১ ( (১২৯৯) এবং ২ (১২৯৯)  ৬) উপসর্গ সমালোচনা  (১৩০৬), ৭) প্রাকৃত ও সংস্কৃত (১৩০৮), ৮) বাংলা ব্যাকরণ (১৩০৮),  ৯) বিবিধ  (১৩০৫-১৩১২) , ১০) বাংলা ক্রিয়াপদের তালিকা (১৩০৮) । অবশ্যি রবীন্দ্রনাথের জীবৎকালেই ১৩১৫র পরের কালের ভাষাবিষয়ক লেখাগুলো নিয়ে ১৩৪২ এ ‘শব্দতত্বে’র দ্বিতীয় সংস্করণ বেরোয়, আমাদের আলোচ্য রচনাবলীতে কোনো কারণবশত সেগুলো অন্তর্ভূক্ত হয় নি। তৃতীয় আরেকটি বৃহৎ সংস্করণ বেরিয়েছে ১৩৯১ সনে। সম্পাদকেরা এর বিন্যাসব্যবস্থাপনার জন্যে সুকুমার সেনের উপদেশ শিরোধার্য করেছিলেন। সেটিও আমাদের দেখা হয় নি।
         তেইশটি অধ্যায়ে সম্পূর্ণ ‘বাংলাভাষা পরিচয়’ একটি পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থ। ১৯৩৮এ এটি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ছেপে বের করে। ততোদিনে ভাষাচার্য রূপে স্বীকৃত সুনীতি কুমার চট্টপাধ্যায়কে উৎসর্গ করেন এটি  বইটি নিজেই একটা অসামান্য ব্যাকরণ বলে বিবেচিত হতে পারত। কিন্তু সেটি, প্রণালীবদ্ধ ছিলনা। বিজনবিহারী ভট্টাচার্য তাঁকে অনুরোধ করেছিলেন এই বইটিকে ভাষাবিজ্ঞানের ভূমিকা হিসেবে নিয়ে যেন তিনি সেই পথে কাজ আরম্ভ করেন। উত্তরে তিনি লেখেন, “...মানুষের মূর্তির ব্যাখ্যা করবার ভার যে নিয়েছে তাকে তুমি মানুষের শরীরবিজ্ঞানের উপদেষ্টার মঞ্চে দাঁড় করাতে চাও...” ৯  । এই বইতে দেখা মিলবে ভারতের প্রথম সমাজ ভাষাবিজ্ঞানীরও বটে। কিন্তু তাতে আমরা পরে আসব।
           বস্তুত দুটি নয়, ‘ছন্দ’ নিয়ে তিনটি বইতে এবং আরো বেশকিছু প্রবন্ধ এবং চিঠি পত্রে ছড়িয়ে আছে তাঁর ভাষা চিন্তা। ‘ছন্দ’ সম্পর্কেও প্রবোধ চন্দ্র সেন এবং অমূল্যধন মুখোপাধ্যায়ের সশ্রদ্ধ উক্তিগুলো আমরা জানি। অমূল্যধন বরং তিনি কেন ‘পদ্ধতিগত ভাবে পূর্ণাঙ্গ’  আলোচনাতে হাত দিলেন না তাই নিয়ে আক্ষেপই করেছেন। কিন্তু যেটুকু করেছিলেন তাই ছিল তাঁদের পথের দিশা। আমরা বর্তমান আলোচনাতে ‘ছন্দ’প্রসঙ্গ টানব না পরিসরের কথা ভেবে।
 অনুশাসনিক ব্যাকরণ -অভিধানের বিরুদ্ধে রবীন্দ্রনাথ
       ‘শব্দতত্ব’ থেকে আমরা বাংলা প্রত্যয় সংক্রান্ত প্রবন্ধটিকে আপাপত তুলে নেব। এর এক গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস আছে। ড০নির্মল দাস পূর্বোক্ত ‘ভাষাবীথি’ তে লিখেছেন, “ যে বর্ণ বা বর্ণসমষ্টি ক্রিয়ামূল অর্থাৎ ধাতুর উত্তর এবং শব্দমূল অর্থাৎ প্রতিপাদিকের উত্তর যুক্ত করে নতুন শব্দ গঠন করা হয় তাঁকে বলে প্রত্যয়।” এই উত্তরগুলো কিন্তু ছাত্রদের কাছে অনুচ্চারিতই রয়ে গেল ‘ধাতু, প্রতিপাদিক’ শব্দগুলোর মানে কী। সেগুলোকে নাহয় পারিভাষিক শব্দবলে ছেড়েই দেয়া গেল, তাই বলে ‘উত্তর’ কথাটার অর্থতো ছাত্ররা একটাই জানে যে জিনিসটা লেখা খুবই কঠিন, নোট না দেখে কিছুই বলা যাবে না। ওদিকে আজ কিন্তু অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন ‘প্রত্যয়’ না বলে ‘পরসর্গ’ বলা যাবে না কেন, কেন উপসর্গকে বলা যাবে না, পুরোসর্গ? তাই বোধহয় রবীন্দ্রনাথ বাংলা উচ্চারণ নিয়ে আলোচনাতে  বিলেতে তাঁর সংগৃহীত শব্দাবলী হারিয়ে যাওয়ার গল্প শোনাতে গিয়ে এক জায়গাতে লিখছেন, “ ...বুড়ার খেলা বুড়ার পুতুলের জায়গা ছেলের খেলা ছেলের পুতুল অধিকার করিয়া বসিল। প্রত্যেক বৈয়াকরণের ঘরে এমনই একটি করিয়া মেয়ে থাকে যদি, পৃথিবী হইতে সে যদি তদ্ধিত প্রত্যয় ঘুচাইয়া তাহার স্থানে এইরূপ ঘোরতর পৌত্তলিকতা প্রচার করিতে পারে, তবে শিশুদের পক্ষে পৃথিবী অনেকটা নিষ্কণ্টক হইয়া যায়।” প্রত্যয় নিয়ে এ রসিকতা মাত্র ছিল না। তা বোঝা যাবে তাঁর ‘বাংলা কৃৎ ও তদ্ধিত’ প্রবন্ধটি পড়লে।
     এর আগে রবীন্দ্রনাথ ‘আইঢাই, আঁকুবাকু, আনচান, ইলিবিলি’ ইত্যাদি বিশেষণ এবং ক্রিয়াবিশেষণগূলো বাংলা অভিধানে কেন স্থান পায়নি আক্ষেপ জানিয়ে একটি দীর্ঘপ্রবন্ধ লেখেন, সেগুলোর উপর আলোচনা করেন। প্রবন্ধটির নাম ‘ধন্যাত্মক শব্দ’। শব্দগুলো নিজেই তিনি সংগ্রহ করেছিলেন। শেষে পরিষদের অন্যদেরকেও বিশুদ্ধ বাংলা শব্দসংগ্রহে নেমে পড়বার আহ্বান জানালে ব্যাপক সাড়া মেলে। এই কাজে তাঁর ঘনিষ্ট সহযোগী ছিলেন হরপ্রসাদ শাস্ত্রী। শব্দগুলো সংগ্রহ হতে থাকলে এগুলো ব্যাখ্যা, বিশ্লেষণ শ্রেণিবিন্যাসের সমস্যা উঠে আসে। স্বভাবতই ব্যাকরণ বিতর্কও দেখা দেয়। তাতে অন্যদের মধ্যে দুটো দুর্মূল্য প্রবন্ধ লেখেন হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, এবং রামেন্দ্র সুন্দর ত্রিবেদী। হুমায়ুন আজাদ প্রথমজন সম্পর্কে লিখেছেন, “শাস্ত্রী একটু বেশি পরিমাণেই ছিলেন বাংলাপন্থী—রবীন্দ্রনাথ ও রামেন্দ্রসুন্দরে যে ভারসাম্য ও গভীরতা বিদ্যমান, তা নেই হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর বাংলাভাষাবোধে, কিন্তু তিনি প্রথাগত বাংলা ব্যাকরণের ত্রুটিগুলো , অন্তত বাহ্যিক ত্রুটিগুলো, বেশ ভালোভাবেই শনাক্ত করেছিলেন।” ১০ রামেন্দ্রসুন্দর সম্পর্কে তাঁর বক্তব্য, “রামেন্দ্রসুন্দর এ –প্রবন্ধে ( বাঙ্গলা ব্যাকরণ) ব্যাকরণ সম্পর্কে এমন কিছু ধারণা ব্যক্ত করেন, যা পাশ্চাত্যেও উন্মেষিত হয় কয়েক দশক পরে—সাংগঠনিক ও রূপান্তরমুলক সৃষ্টিশীল ভাষাতাত্বিকদের রচনায়। তিনি যে ব্যাকরণের কথা বলেন, তা প্রথাগত –আনুশাসনিক নয়, তা বর্ণনামূলক। তাঁর মতে, ‘ভাষার গঠনপ্রণালীতে কতকগুলি নিয়ম আছে। শব্দের গঠনে পদের গঠনে ও বাক্যের গঠনে এইরূপ নিয়ম আবিষ্কারই ব্যাকরণের উদ্দেশ্য।”১১ । কিন্তু এঁরা কেউই পূর্ণাঙ্গ বই লিখে রেখে গেলেন না। এই যে ‘নিয়ম আবিষ্কারই ব্যাকরণের উদ্দেশ্য’ -- এর প্রেরণা কিন্তু পরিষদের মাসিক অধিবেশনগুলো। এই অধিবেশনগুলোতে তর্কবিতর্কের পরিণামে পঞ্চম অধিবেশনে রবীন্দ্রনাথ তাঁর প্রত্যয় নিয়ে প্রবন্ধটি পাঠ করেন।  এই প্রবন্ধে তাঁর সহযোগী ছিলেন, ব্যোমকেশ মুস্তফী। মুস্তফীর আলাদা প্রবন্ধটিও রবীন্দ্রনাথের প্রবন্ধের পরিশিষ্টরূপে পরিষদের পত্রিকাতে ছাপা হয়েছিল।
        যদিও তিনি সারা বাংলার শব্দসংগ্রহেই নেমেছিলেন, এবং সেকালেই ভাবতেন “বাংলাদেশের ভিন্ন ভিন্ন অংশে যতগুলি উপভাষা প্রচলিত আছে তাহারই তুলনাগত ব্যাকরণই যথার্থ বাংলার বৈজ্ঞানিক ব্যাকরণ।” ১২ তবু এই প্রবন্ধের আলোচিত শব্দগুলোর বানানে কলকাতার উচ্চারণ অনুসরণ করেছিলেন। কারণ তখন , “ বাংলাদেশের অপরাপর বিভাগের উচ্চারণকে প্রাদেশিক বলিয়া গণ্য করাই সংগত।”১৩ এতেই ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে পরে তিনি কলকাতার ভাষাকেই  মানভাষাতে চালু করবার দিকে এগুবেন। তখনো কিন্তু প্রমথ চৌধুরী তাঁর সঙ্গ নেন নি। ইতিমধ্যে শতাধিক বাংলা অভিধান বেরিয়ে গেলেও শুরুতেই তিনি লিখছেন, “ আজ পর্যন্ত বাংলা অভিধান বাহির হয় নাই।” ইঙ্গিতটা এখানেও স্পষ্ট। পরিভাষার সমস্যা নিয়ে বলতে গিয়ে লিখছেন, “ সংস্কৃত ব্যাকরণের পরিভাষা বাংলা ব্যাকরণে প্রয়োগ করা কীরূপ বিপজ্জনক তাহা মহামহোপাধ্যায় শাস্ত্রীমহাশয় ইতিপূর্বে ব্যাখ্যা করিয়াছেন।” নতুন পরিভাষা নির্মাণে নিজের অক্ষমতার কথা জানিয়েও শুরু করছেন এই বলে, “সংস্কৃত ব্যাকরণে যাকে ণিজন্ত ধাতু বলে বাংলায় তাহাকে ণিজন্ত বলিতে গেলে অসংগত হয়; কারণ সংস্কৃত ভাষায় ণিচ প্রত্যয় দ্বারা ণিজন্ত ধাতু সিদ্ধ হয়, বাংলায় ণিচ প্রত্যয়ের কোনো অর্থ নাই।”১৪ তিনি একে নৈমিত্তিক ধাতু নাম দিচ্ছেন। এবং সেরকম প্রত্যয়যুক্ত শব্দকে সোজা ‘অন’ প্রত্যয়ের শ্রেণিতে  মাতন, কাঁদন, গড়ন, ইত্যাদি শব্দের তালিকা তৈরি করছেন পরে। অথচ ‘ভাষাবীথি’র লেখক এযুগে দাঁড়িয়েও দিব্ব্যি এমন শব্দ  বিশ্লেষণ করে দেখাচ্ছেন এরকম, পঠ-ণিচ+অন=পঠন, ধৃ-ণিচ+অন= ধারণ। ১৫ তাঁর অধি-আপি+(ণিচ)+অন=অধ্যাপনকেতো বাংলা বলে চেনাই মুস্কিল।  এগুলোকে তিনি অবশ্যই বাংলা ব্যাকরণে সংস্কৃত কৃৎ প্রত্যয়ের তালিকাতে দেখাচ্ছেন। এই নিয়ে তখনি রবীন্দ্রনাথ লিখছেন বাংলা প্রত্যয়গুলোর মধ্যে, “কোনগুলি প্রকৃত বাংলা ও কোনগুলি সংস্কৃত, তাহা লইয়া তর্ক উঠিতে পারে। সংস্কৃত হইতে উদ্ভূত হইলেই যে তাহাদের সংস্কৃত বলিতে হইবে, এ কথা মানি না। সংস্কৃত ইন প্রত্যয় বাংলায় ই প্রত্যয় হইয়াছে, সেইজন্য তাহা সংস্কৃত পূর্বপুরুষের প্রথা রক্ষা করে না। দাগি (দাগযুক্ত ) শব্দ কোনো অবস্থাতেই দাগিন হয় না।  বাংলা অন্ত প্রত্যয় সংস্কৃত শতৃ প্রত্যয় হইতে উৎপন্ন, কিন্তু তাহা শতৃ প্রত্যয়ের অনুশাসন লঙ্ঘন করিয়া একবচনে জিয়ন্ত ফুটন্ত ইত্যাদিরূপ ধারণ করিতে লেশমাত্র লজ্জিত হয় না।”১৬  এবারে ‘ভাষাবীথি’র লেখক কী কাণ্ড ঘটিয়েছেন দেখা যাক। তিনি মহ+শতৃ=মহৎ, জাগৃ+শতৃ= জাগৃৎ এমন নজির দিয়ে এইটুকুন লিখেছেন, এগুলোর বাংলাতে স্বাধীন ব্যবহার নেই, সমাসবদ্ধ হয়ে ব্যবহৃত হয়। কিন্তু তার পরেই বিড়ম্বনা। দুটো বাক্যে শব্দগুলোর নজির টেনেছেন –১) সাধু ব্যক্তি সর্বদা মহৎ ব্যবহার করেন; ২) তুমিতো জাগ্রৎ-অবস্থায় স্বপ্ন দেখিতেছ। এর কোনোটিতেই সমাস নেই। আর হলন্ত ‘জাগ্রৎ’ যে কী বস্তু বোঝাতে শিক্ষকেরও ঘাম ঝরে যাবে এটি নিশ্চিত, ছাত্র কী ছার! রবীন্দ্রনাথ সরাসরিই বাংলা ‘ৎ’ প্রত্যয়ের উল্লেখ টেনে মানৎ, বসৎ থেকে শুরু করে সুড়ুৎ,  ফুড়ুৎ এমন সব শব্দকেও ঢুকিয়ে দিয়েছেন। আমরা আশা করতেই পারি ছাত্রদের সেগুলো দিলে তারা ‘পটাৎ’ করে হজম করে নিয়ে সুবোধ বালক হয়ে দেখিয়ে দিত ।
রবীন্দ্রনাথের মতে , “হিন্দি পারসি প্রভৃতি হইতে বাংলায় যে সকল প্রত্যয়ের আমদানি হইয়াছে , সে সম্বন্ধেও আমার ঐ একই বক্তব্য। সই প্রত্যয় সম্ভবত..হিন্দি বা পার্শি ; কিন্তু বাংলা শব্দের সহিত তাহা মিশ্রিত হইয়া ট্যাঁকসই, প্রমাণসই, প্রভৃতি শব্দ সৃজন করিয়াছে। ওয়ান প্রত্যয় সেরূপ নহে দারোয়ান, পালোয়ান শব্দ আমরা হিন্দি হইতে পাইয়াছি,প্রত্যয়টি পাই নাই। অর্থাৎ যেসকল প্রত্যয় সংস্কৃত অথবা বিদেশীয় শব্দসহযোগে বাংলায় আসিয়াছে, বাংলার সহিত কোনো প্রকার আদানপ্রদান করিতেছে না, তাহাকে আমরা বাংলা প্রত্যয়রূপে স্বীকার করিতে পারি না।” আমরা জানি যেকোনো প্রচলিত বাংলা ব্যাকরণেই ‘ওয়ান’ প্রত্যয়টির উল্লেখ স্বতন্ত্ররূপেই রয়েছে। আমাদের উল্লেখ করা ‘ভাষাবীথি’ও ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু ‘ওলা’ বা ‘ওয়ালা’ প্রত্যয়ের উল্লেখ রবীন্দ্রনাথ নিজেই করছেন , কারণ এগুলো কাপড়ওয়ালা, ছাতাওয়ালা, রিক্সাওয়ালা-র মতো বিশুদ্ধ বাংলা শব্দ তৈরি করছে।  তেমনি আছে ‘গির’ থেকে ‘গিরি’, ‘দার’ ইত্যাদি প্রত্যয়। আমরা আগে উল্লেখ করা ‘ৎ’ এর মতো ‘ট্ট’ (ভরট্ট), ‘অং, আং, ইং’ ( ভড়ং, বড়ং, খোলাং) ‘অঙ্গ, আঙ্গ, অঙ্গিয়া’ ( সুড়ুঙ্গি, বিরিঙ্গি)  এমন আরো কিছু প্রত্যয়ের কথা লিখেছেন রবীন্দ্রনাথ যেগুলোর সন্ধান ‘ভাষাবীথি’র মতো ব্যাকরণে অনুসন্ধান করাটাই বৃথা।
           প্রবন্ধটি সম্পুর্ণ নয় নিজেই বারে বারে উল্লেখ করেছেন।  কিছু কিছু ইঙ্গিত দিয়েছেন যেগুলোর নিয়ম বের করতে হবে। যদিও কলকাতার উচ্চারণ অনুসারে বানান বুঝবার চেষ্টা করবেন লিখেছেন নিজের প্রবন্ধেই ‘বড়াং’-এর মতো প্রাদেশিক শব্দের উল্লেখ করেছেন । এবং অন্যদের প্রাদেশিক শব্দ সংগ্রহ করে কাজ সারতে বলছেন। এও বলছেন তাঁরা আগষ্ট ফ্রেডরিখ হ্যর্নলের লেখা Comparative Grammar of Gaudian Language থেকে যথেষ্ট সাহায্য পাবেন। তার মানে বইটি তাঁকেও ভাবতে সাহায্য করেছে।
এই প্রবন্ধ দারুণ আলোড়ন তুলেছিল পরিষদের ভেতরে । এটি  এবং সঙ্গে হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর প্রবন্ধের বিরোধিতা করে শরচ্চন্দ্র শাস্ত্রী ভারতীতে ‘নতুন বাংলা ব্যাকরণ নামে একটি প্রবন্ধ লেখেন। মোটের উপর রবীন্দ্রনাথের প্রায় সমস্ত সিদ্ধান্তের তিনি প্রতিবাদ করেন। তাঁর অবস্থানটা বোঝা যাবে এই উল্লেখ থেকে, “রবীন্দ্রবাবু দীর্ঘ ঈকারের প্রতি একান্ত অপ্রসন্ন। তিনি উহার নির্বাসন দণ্ড ব্যবস্থা করিয়া কালাপানি পার করিয়া দিয়াছেন। তাঁহার সূত্র অনুসারে পাঁচী বামনী প্রভৃতি একাদশটি স্ত্রীলিঙ্গ শব্দ দীর্ঘ ঈকারের কারাগৃহ হইতে মুক্তিলাভ করিয়া হাঁফ ছাড়িয়া বাঁচিয়াছে। আর কলুনী প্রভৃতিরও ঐ অবস্থা। ঠাকুরাণী, নাপতিনী, জেলেনি প্রভৃতিকে আর দীর্ঘ ঈকারের গুরুভার বহন করিতে হইবে না। আর সেই চিরকালের সংস্কৃত ‘মালিনী’ নূতন আইন অনুসারে  হ্রস্ব হইয়া মালিনি হইয়া বসিয়াছেন।” ১৭ এবারে, আমরা জানি এই শব্দগুলোর অনেকগুলোই এখন ঈ-কার বাদ দিয়েই প্রচলিত।  এই প্রবন্ধই রবীন্দ্রনাথকে উদ্বুদ্ধ করে ‘বাংলা ব্যাকরণ’ প্রবন্ধটি লিখতে। রবীন্দ্রনাথের প্রবন্ধটি পড়লে জানা যাবে শরচ্চন্দ্রের প্রবন্ধের মধ্যে বিশুদ্ধ জোয়াচুরি রয়েছে। রবীন্দ্রনাথের প্রবন্ধটি পরিষদের কাগজে ছাপা হবার আগেই এর প্রতিবাদে লেখা প্রবন্ধ ছেপে বেরিয়ে গেছিল। ছাপাখানা থেকে লেখাটির এক প্রুফ সংগ্রহ করে নিয়ে গিয়ে কাজটা করে ফেলাতে তিনি বেশ রুষ্ট হয়েই লিখেছেন, “ আমার সাক্ষী হাজির হয় নাই, এই অবকাশে বাদের পূর্বেই প্রতিবাদকে পাঠক সভায় উপস্থিত করিয়া একতরফা মীমাংসার চেষ্টা করাকে ঠিক ধর্মযুদ্ধ বলে না।” বোঝা যাচ্ছে তিনি এবারে অনুশাসনিক ব্যাকরণের বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধে নামছেন। শরচ্চন্দ্রের প্রবন্ধের ভেতরেও সততার অভাব ছিল। তিনি লিখছেন, “...দুই মহানুভব বাঙ্গালা ব্যাকরণ প্রণয়নে বদ্ধকর, উভয়েই ক্ষমতাশালী। ইঁহাদের সহায় ও সামর্থ্য যথেষ্ট। ইচ্ছা করিলে ইঁহারা কোনো প্রবল স্রোতকেও ফিরাইয়া অন্য দিগগগামী করিতে পারেন। তবে ঐরূপ কার্য্যে অগ্রসর হইবার পূর্বে বিচার করা কর্ত্তব্য বাঙ্গালা ভাষাকে সংস্কৃতের সাহচর্য্য হইতে বিচ্যুত করায় লাভ ও ক্ষতি কতদূর। ...। ইঁহারা ‘বিসমিল্লায় গলদ’ প্রভৃতি যে সকল ভাষা বলাইতে ইচ্ছুক উহা একান্তই অশ্রদ্ধেয়।” ১৮এই ‘ব্যাকরণ প্রণয়নে বদ্ধকর’ কথাগুলো রবীন্দ্রনাথের প্রবন্ধে কোথাও নেই, বরং তিনি শুধু ভাবনাগুলোকে উস্কে দিচ্ছেন কিম্বা তাঁর লেখাতে ভুল থাকতে পারে--- এই কথাগুলো তাঁর প্রবন্ধে যেমন বারে বারে রয়েছে শরচ্চন্দ্রও শুরুতেই এই কথাগুলো উল্লেখ করেছেন। তার পরেও এভাবেই খোঁচা দিয়ে শেষ করছেন।  আর ‘ইচ্ছা করিলে ইঁহারা কোনো প্রবল স্রোতকেও ফিরাইয়া অন্য দিগগগামী করিতে পারেন।” এই কথাগুলো উঠে আসছে শরচ্চন্দ্রের নিজের ব্যাকরণ দর্শন থেকে। রবীন্দ্রনাথ যার গোড়া মেরে বিরোধিতা করছেন, লিখছেন, “ যে কথাগুলো লইয়া আমি আলোচনা করিয়াছিলাম, তাহাদিগকে বাংলায় রাখা বা বাংলা হইতে খারিজ করিয়া দেওয়া আমার বা আর কাহারও সাধ্যই নহে তাহারা আছে, এবং কাহারো কথায় তাহারা নিজের স্থান ছাড়িবে না। জগতে যেকোনো জিনিসই আছে, তাহা ছোট হোউক আর বড়ো হউক, কুৎসিত হউক আর সুশ্রী হউক, প্রাদেশিক হউক আর নাগরিক হউক, তাহার তত্বনির্ণয় বিজ্ঞানের কাজ। শরীরতত্ব কেবল উত্তমাঙ্গেরই বিচার করে এমন নহে, পদাঙ্গুলিকেও অবজ্ঞা করে না। বিজ্ঞানের ঘৃণা নাই, পক্ষপাত নাই।”১৯  এই প্রবন্ধটি নিয়ে যখন পরিষদের অধিবেশনে আলোচনা হয় তার কার্যবিবরণীতে মেলে সেখানে রবীন্দ্রনাথ আরো বলছেন, “ আমিই ব্যাকরণ লিখিতেছি বা লিখিব এরূপ দুরভিসন্ধি আমার? আমি কতকগুলো শব্দ সংগ্রহ করিয়া দিয়াছি, ভবিষ্যৎ ব্যাকরণের কার্যের জন্য উপকরণ সংগ্রহ করিয়া দিয়াছি বলিয়াই কি আমার এতোটা অপরাধ হইয়াছে। যাঁহারা এই সকল শব্দকে slang বলিয়া ঘৃণা করেন আর ভাষার মধ্যে আমিই এই সকল slang আমদানি করিতেছি বলিয়া আমার উপর খড়্গহস্ত হইয়া উঠিতেছেন, তাঁহাদের একটা কথা বলিবার আছে, আমি আমদানি করিতেছি এটা কী রকম কথা। পিতৃপিতামহাদি হইতে এই সকল শব্দ কি আমরা পাই নাই।” ২০এই প্রসঙ্গে আমাদের সাম্প্রতিক অসমে ‘অসমিয়া জাতীয় অভিধান’ নিয়ে তর্ক এবং তাদেরও ঠিক এরকম অবস্থানের কথা  সবার মনে পড়বে। মূলপ্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ এই প্রসঙ্গে আরো লিখছেন, “বাংলা বলিয়া একটা ভাষা আছে, তাহার গুরুত্ব মাধুর্য ওজন করা ব্যাকরণের কাজ নহে।   সেই ভাষার নিয়ম বাহির করিয়া লিপিবদ্ধ করাই তাঁহার কাজ। সে-ভাষা যে ইচ্ছা ব্যবহার করুক বা না করুক তিনি উদাসীন কাহারও প্রতি তাঁহার কোনো আদেশ নাই, অনুশাসন নাই। জীবতত্ববিৎ কুকুরের বিষয়েও লেখেন, শেয়ালের বিষয়েও লেখেন। কোনো পণ্ডিত যদি  তাঁহাকে ভর্ৎসনা করিতে আসেন যে শিয়ালের কথাটা এতো আনুপূর্বিক লিখিতে বসিয়াছ, শেষকালে যদি লোকে শেয়াল পুষিতে আরম্ভ করে!—তবে জীবতত্ববিদ তাহার কোনো উত্তর না দিয়া তাঁহার শেয়াল সম্বন্ধীয় পরিচ্ছেদটা শেষ করিতেই প্রবৃত্ত হন।”২১ ব্যাকরণের কাজ সম্পর্কে তিনি মোক্ষম কথা এই প্রবন্ধে যা লিখেছেন আসলে তা ভাষাবিজ্ঞানের মূল কথাতো বটেই, ভাষাগুলোর স্বাতন্ত্র্য কিসে চিহ্নিত হয় সে সম্পর্কেও গোড়ার কথা এটিই। তিনি লিখছেন, “বস্তুত প্রত্যেক ভাষার নিজের একটা ছাঁচ আছে। উপকরণ যেখান হইতেই সে সংগ্রহ করুক, নিজের ছাঁচে ঢালিয়া সে তাহাকে আপনার সুবিধামত বানাইয়া লয়। সেই ছাঁচটাই তাহার প্রকৃতিগত, সেই ছাঁচেই তাহার পরিচয়। উর্দুভাষায় পারসি আরবি কথা ঢের আছে, কিন্তু সে কেবল আপনার ছাঁচেই চতুর ভাষাতত্ত্ববিদের কাছে হিন্দির বৈমাত্র সহোদর বলিয়া ধরা পড়িয়া গেছে। আমাদের বাঙালি কেহ যদি মাথায় হ্যাট, পায়ে বুট, গলায় কলার এবং সর্বাঙ্গে বিলাতি পোশাক পরেন, তবু তাঁহার রঙে এবং দেহের ছাঁচে কুললক্ষণ প্রকাশ হইয়া পড়ে। ভাষার সেই প্রকৃতিগত ছাঁচটা বাহির করাই ব্যাকরণকারের কাজ। বাংলায় সংস্কৃতশব্দ ক’টা আছে, তাহার তালিকা করিয়া বাংলাকে চেনা যায় না, কিন্তু কোন্‌ বিশেষ ছাঁচে পড়িয়া সে বিশেষরূপে বাংলা হইয়া উঠিয়াছে, তাহা সংস্কৃত ও অন্য ভাষার আমদানিকে কী ছাঁচে ঢালিয়া আপনার করিয়া লয়, তাহাই নির্ণয় করিবার জন্য বাংলা ব্যাকরণ।” ২২ আলতাফ চৌধুরীকে লেখা চিঠিতে আরবি পার্শি শব্দকে বাংলাতে চালু করবার প্রসঙ্গেও তিনি ঐ ছাঁচের কথা তুলেছেন। শব্দের আমদানিকে কিন্তু স্বাগত জানিয়েছেন বিরোধীতা করেন নি। লিখেছেন, “ভাষার মূল প্রকৃতির মধ্যে একটা বিধান আছে যার দ্বারা নূতন শব্দের যাচাই হতে থাকে, গায়ের জোরে এই বিধান না মানলে জারজ শব্দ কিছুতেই জাতে ওঠে না।” এই ছাঁচের পরিচয় করিয়ে দিতে তিনি অনেক নজির টেনেছেন, সেই প্রসঙ্গেই বাংলাতে সম্প্রদান কারক যদি থাকে তবে সন্তাড়ণ কারক কেন থাকবে না, দ্বিববচন কেন থাকবে না এই বহুচেনা প্রশ্নগুলোও এখানেই তুলছেন। আমরা সেগুলো আর টানব না। বরং চলে যাব ‘বাংলা ভাষা পরিচয়ে’।
  বাংলা ভাষা পরিচয়ঃ ভাষার ভূগোলে পায়ে চলা পথের ভ্রমণকারী
  
         ‘শব্দতত্ত্বে’র প্রায় চারদশক পর ১৯৩৮এ ‘বাংলা ভাষা পরিচয়ে’র লেখার ভাষাটাই একেবারে পালটে গেছে। শব্দতত্ত্বে যে কলকাতা এবং তার আশেপাশের উচ্চারণকে আশ্রয় করে শব্দ বিশ্লেষণ করবেন বলে লিখেছিলেন, সেটি ততদিনে তাঁর লেখার ভাষা হয়ে উঠেছে। কেন উঠেছে আর ওঠা উচিত তাই নিয়ে এই গ্রন্থের অনেকগুলো পৃষ্ঠাও তিনি ব্যয় করছেন। আমরা আগেই লিখেছি, খানিক প্রণালী বদ্ধ হলে এই বইটিই আধুনিক যুগের সেরা ব্যাকরণ হয়ে উঠতে পারত।  তা হয় নি বটে, কিন্তু বাংলাতে আধুনিক ভাষাবিজ্ঞানের আদি বইগুলোর একটি এই বইটিও বটে ।  ভূমিকাতে তিনি লিখেছেন, সুনীতিকুমারের সঙ্গে আমার তফাৎ এই—তিনি যেন ভাষা সম্বন্ধে ভূগোল বিজ্ঞানী, আমি যেন পায়ে চলা পথের ভ্রমণকারী।” এই কথাটি এই বইয়ের রচনাশৈলী সম্পর্কেও সত্য । সামান্য ভাষাতত্বে আগ্রহ রাখেন এমন যেকোনো পাঠক এটি সুখপাঠ্য ভ্রমণকাহিনির মতোই পড়ে ফেলতে পারেন। আমাদের ভাষাতত্বের নিরস পাঠ্যক্রমে একে জায়গা দিলে মরুদ্যানের বাতাসে শ্বাস নিয়ে দু’দণ্ড জিরোনো যেত। ‘শব্দতত্বে’র থেকে এটি সুশৃঙ্খল আর সমৃদ্ধ। যদিও এতে অধ্যায়গুলো আলাদা আলাদা নামে চিহ্নিত নয় তবু  এদের আলাদা করে চেনা যায়, ভাষা কী, ভাষার কাজ কী, সাহিত্যে ভাষার কাজ কী, মাতৃভাষাই বা কি বাংলা ভাষা কাকে বলে, এর উৎপত্তির রহস্য কী, এর প্রাদেশিক স্বরূপ, চলিত এবং সাধু ভাষা এইসব সমস্যার সঙ্গে তিনি ছুঁয়ে গেছেন কারক, প্রত্যয়, পদ, ক্রিয়া, কাল ইদ্যাদি নানা ব্যাকরণিক বিষয়।  স্বাভাবিক ভাবেই উত্তর সুনীতিকুমার  যুগে এখানে তিনি কালানুক্রমিক ভাষাতত্বের দিকে বেশ ঝুঁকেছেন বটে কিন্তু মূল ঝোঁক সেই কালিক ভাষাবিদ্যার দিকেই। কিন্তু তুলনামূলক ভাষাতত্বকে এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব ছিলও না, যানও নি। কিন্তু যেজন্যে এই বইটির গুরুত্ব তা এই যে  এটিতেই তিনি একজন পাকা সমাজ ভাষাবিজ্ঞানী হিসেবে দেখা দিচ্ছেন। বিশেষ করে যখন চলিত সাধুর তর্কে অনেকগুলো অধ্যায় ব্যয় করেন। বস্তুত এই বইতে তিনি মূলত বাংলা চলিত ভাষার তত্ব প্রতিষ্ঠার কাজই করেছেন।  অথচ সেই তাত্বিকের শৈলীটি সাহিত্যিকের । তিনি লিখছেন, “... সীমাসরহদ্দ নিয়ে মামলা করে না চলতি ভাষা। স্বদেশী বিদেশী হালকা ভারী সব শব্দই ঘেষাঘেষি করতে পারে তার আঙিনায়। সাধুভাষায় তাদের পাসপোর্ট মেলা শক্ত।”২৩ আমরা এই চেনা তর্ক নিয়ে বেশি এগুবো না। বরং পা রাখব, মাতৃভাষা, রাষ্ট্রভাষা, ভাষা জাতীয়তাবাদ  তর্কে রবীন্দ্রনাথ কী লিখছেন।
মাতৃভাষা, রাষ্ট্রভাষা, ভাষা জাতীয়তাবাদ  তর্কে রবীন্দ্রনাথ
          এই অভিযোগ করা হয়েই থাকে, তিনি রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ‘হিন্দি’র সমর্থণ করেছিলেন। হিন্দিরা অনেকসময় এই তথ্যকেই ব্যবহার করেন নিজেদের গৌরবচিহ্ন হিসেবে। কিন্তু সব পক্ষই ব্যবহার করেন এই ‘বাংলাভাষা পরিচয়ে’র অষ্টম অধ্যায়ে লেখা তাঁর এক মন্তব্য , “... হিন্দুস্থানিকে ভারতের রাষ্ট্রীয় ব্যবহারের জন্যে এক ভাষা বলে গণ্য করা যেতে পারে। তার মানে, বিশেষ কাজের প্রয়োজনে কোনা বিশেষ ভাষাকে কৃত্রিম উপায়ে স্বীকার করা চলে, যেমন আমরা ইংরেজি ভাষাকে স্বীকার করেছি।” ২৪এই দাবি ভারতীয় জাতীয়তাবাদের সঙ্গে, জাতীয় সংহতির সঙ্গে, জাতিরাষ্ট্রের ধারণার সংগে খুব খাপ খায়। কিন্তু যে রবীন্দ্রনাথকে আমরা জানি , চিনি--- তাঁর ব্যক্তিত্বের সঙ্গে খুব খাপ খায় কি? তিনিতো জাতীয়তাবাদের বিরোধী ছিলেন বলেই বেশ খ্যাতি –কুখ্যাতি দুটোই আছে। এর জন্যে ক্ষুব্ধ ভারতীয় স্বদেশিরা  ১৯১৬তে সানফ্রান্সিকোর এর হোটেলে তাঁকে হত্যা করবার ষড়যন্ত্র করেওছিল, যার থেকে তিনি অল্পের জন্যে বেঁচে । ২৫ অভিযোগ জানাবার কিম্বা গৌরব করবার –দুটো পক্ষই এই নিয়ে তখন আর বিশেষ ভাবেন না। আর ভাবলেও বড় বিড়ম্বনা, যারা তাঁকে আন্তর্জাতিকতাবাদী বলে ভাবেন তাঁরা তাঁকে একেবারে বিশ্বমানব টানব বানিয়ে ছাড়েন, যেন দেশ, জাতি , ধর্ম নিয়ে তাঁর কোনো ভাবনাই ছিল না। একটি বহুল প্রচলিত মত তাঁকে নিয়ে রয়েছে যে ইনি বড্ড স্ববিরোধী ছিলেন। ভারসাম্য বলে কোনো বস্তুই ছিল না , এই ভদ্রলোকের। এই এক কথা, অন্যত্র অন্য কথা লিখে গেছেন -- বলে গেছেন। তাঁর কোনো এক কথাতে ভরসা করা বড় বিপজ্জনক। তাই, তাঁর সাহিত্য শিল্প নিয়ে যতই মাতামাতি হোক, তাঁর রাজনীতি দর্শন নিয়ে  আগ্রহ দেখা যায় খুবই কম, অন্তত যারা  আধুনিকতা নিয়ে স্পর্শকাতর  তাদের কাছে। আমরা ধারাবাহিক ভাবে তাঁর রাজনীতি আর দর্শন নিয়ে লেখাগুলো পড়ে দেখেছি ।  তিনি সর্বত্র ঐ ‘পায়ে চলা ভ্রমণকারী’র কাহিনির মতোই সমস্ত গদ্যগুলো লিখে গিয়ে  নিজেই এই বিভ্রান্তির সুযোগ করেদিয়ে গেছেন। তবু, ছোটখাটো অন্যমনস্কতাগুলোকে বাদ দিলে তাঁর মধ্যে এক ধারাবাহিক উত্তরণ রয়েছে। যেমন শিল্প বা সাহিত্যের ব্যাখ্যাতে, তেমনি ধর্মের ব্যাখ্যাতে, দেশ এবং সমাজের স্বরূপ ব্যাখ্যাতে, একটি শব্দ ‘সামঞ্জস্য’, তিনি বহুবার ব্যবহার করেছেন। এহেন ব্যক্তির চিন্তাতে কোনো ‘সামঞ্জস্য’ নেই শুধু তিনিই বলতে পারেন যিনি তাঁর চিন্তার দ্বান্দ্বিকতাকে বিষয়ের স্থানকালের প্রেক্ষাপটে  না পড়তে পারেন। ‘জীবন স্মৃতি’র একেবারে শেষের দিকে ‘চিত্রা’ কাব্যে যে ‘জীবনদেবতা’ ধারণার শুরু তার উল্লেখ করে বলা কথাগুলো একবার  লক্ষ্য করা যাক, “জীবনে এখন ঘরের ও পরের, অন্তরের ও বাহিরের মেলামেলির দিন ক্রমে ঘনিষ্ঠ হইয়া আসিতেছে। এখন হইতে জীবনের যাত্রা ক্রমশই ডাঙার পথ বাহিয়া লোকালয়ের ভিতর দিয়া যে-সমস্ত ভালোমন্দ সুখদুঃখের বন্ধুরতার মধ্যে গিয়া উত্তীর্ণ হইবে, তাহাকে কেবলমাত্র ছবির মতো করিয়া হালকা করিয়া দেখা আর চলে না। এখানে কত ভাঙাগড়া, কত জয়পরাজয়, কত সংঘাত ও সম্মিলন। এই-সমস্ত বাধা বিরোধ ও বক্রতার ভিতর দিয়া আনন্দময় নৈপুণ্যের সহিত আমার জীবনদেবতা যে-একটি অন্তরতম অভিপ্রায়কে বিকাশের দিকে লইয়া চলিয়াছেন তাহাকে উদ্‌ঘাটিত করিয়া দেখাইবার শক্তি আমার নাই।” মুস্কিল হলো, এই শক্তি আমাদেরো অতি অল্প আছে। তাই সেই ‘জীবনদেবতা’কে নেহাতই ঔপনিষদিক ব্রহ্ম ভেবে আমরা হাঁফ ছেড়ে বেঁচে গেলাম। সেই দৃষ্টি নিয়ে হয় প্রশংসা নতুবা নিন্দে করে গেলাম। দ্বন্দ্বই প্রকৃতির বিকাশের মূল—এই দার্শনিক সত্যকে কিম্বা তথ্যকে আমরা তাঁর ‘বিকাশের দিকে লইয়া চলিয়াছেন’  কথাটার মধ্যে পড়তে একেবারেই ব্যর্থ হলাম। 
          ‘বাংলা ভাষা পরিচয়ে’ হিন্দিকে রাষ্ট্রভাষা করবার পক্ষে তাঁর মন্তব্যটি নিতান্তই শিথিল । হয়তো, এই নিয়ে তখনো তাঁর ভাবনা স্থির হয়ে উঠতে পারে নি, তাই আপাতত তর্ক এড়াতে চাইছিলেন। কিন্তু সমর্থণ যে করতে পারছেন না, পুরো অধ্যায়টা মন দিয়ে পড়লেই বোঝা যায়। তাঁর পুরো কথাটি ছিল , “বাংলাভাষা ভারতবর্ষের প্রায় পাঁচ কোটি লোকের ভাষা। হিন্দি বা হিন্দুস্থানি যাদের যথার্থ ঘরের ভাষা, শিক্ষা-করা ভাষা নয়, সুনীতিকুমার দেখিয়েছেন, তাদের সংখ্যা চার কোটি বারো লক্ষের কাছাকাছি। এর উপরে আছে আট কোটি আটাশি লক্ষ লোক যারা তাদের খাঁটি মাতৃভাষা বর্জন করে সাহিত্যে সভাসমিতিতে ইস্কুলে আদালতে হিন্দুস্থানির শরণাপন্ন হয়। তাই ...” এর পরেই সেই আগে উদ্ধৃত কথাগুলো রয়েছে। তার পরেই আবার  রয়েছে, “কিন্তু ভাষার একটা অকৃত্রিম প্রয়োজন আছে; সে প্রয়োজন কোনো কাজ চালাবার জন্যে নয়, আত্মপ্রকাশের জন্যে। রাষ্ট্রিক কাজের সুবিধা করা চাই বই-কি, কিন্তু তার চেয়ে বড়ো কাজ দেশের চিত্তকে সরস সফল ও সমুজ্জ্বল করা। সে কাজ আপন ভাষা নইলে হয় না। দেউড়িতে একটা সরকারি প্রদীপ জ্বালানো চলে, কিন্তু একমাত্র তারই তেল জোগাবার খাতিরে ঘরে ঘরে প্রদীপ নেবানো চলে না।”  ছোট এই অধ্যায়টি শেষ হচ্ছেই আমাদের চেনা রাবীন্দ্রিক উক্তি দিয়ে, “... ভারতবর্ষেও ভিন্ন ভিন্ন ভাষার উৎকর্ষ-সাধনে দ্বিধা করলে চলবে না। মধ্যযুগে য়ুরোপে সংস্কৃতির এক ভাষা ছিল লাটিন। সেই ঐক্যের বেড়া ভেদ করেই য়ুরোপের ভিন্ন ভিন্ন ভাষা যেদিন আপন আপন শক্তি নিয়ে প্রকাশ পেলে সেই দিন য়ুরোপের বড়োদিন। আমাদের দেশেও সেই বড়োদিনের অপেক্ষা করব— সব ভাষা একাকার করার দ্বারা নয়, সব ভাষার আপন আপন বিশেষ পরিণতির দ্বারা।” বোঝাই যাচ্ছে তখনি যে সরকারি প্রদীপের দরকারে ঘরে ঘরে বাতি নেভানোর খেলা চলছিল, ভাষাগুলোকে একাকার করবার রাজনীতি চলছিল তার বিরুদ্ধে রবীন্দ্রনাথের আসলে  ক্ষোভের উদ্গীরণ ঘটেছে এই অধ্যায়ে এসে। স্পষ্টতই তার এই ক্ষোভ হিন্দির একাধিপত্যের বিরুদ্ধে , কিন্তু একা বাংলার পক্ষেও নয়। ভারতের সব ভাষার হয়ে লিখছেন উগ্রজাতিয়তাবাদ বিরোধী রবীন্দ্রনাথ। তাঁর ভাবনাগুলোর দ্বান্দ্বিক উত্তরণের ভালো নজির পাওয়া যাবে এরা আগের সপ্তম এবং অষ্টম অধ্যায় পাশাপাশি পড়লেও। সাতের  অধ্যায়ে দেখা যাবে তিনি জাতীয়তার ভাবনার পশ্চিমি উৎসের দিকে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছেন। জানাচ্ছেন ‘মাতৃভাষা’, ‘মাতৃভূমি’ ধারণাগুলোই দেশীও নয়। তার পরেও জাতীয়তার পক্ষে মধুর বাক্য চয়ন করছেন আর লিখছেন, বেদের যুগে,“ ... শোচনীয় আত্মবিচ্ছেদ ও বহির্বিপ্লবের সময়ে ভারতবর্ষে একটিমাত্র ঐক্যের মহাকর্ষশক্তি ছিল, সে তার সংস্কৃতভাষা।”২৬ খানিক পরে আবার লিখছেন, “বাংলাদেশের ইতিহাস খণ্ডতার ইতিহাস। পূর্ববঙ্গ, পশ্চিমবঙ্গ রাঢ় বারেন্দ্রের ভাগ কেবল ভূগোলের ভাগ নয়; অন্তরের ভাগও ছিল তার সঙ্গে জড়িয়ে, সমাজেরও মিল ছিল না। তবু এর মধ্যে যে ঐক্যের ধারা চলে এসেছে সে ভাষার ঐক্য নিয়ে।” কিন্তু পরের অধ্যায়ে যেই তাঁকে হিন্দির একাধিপত্যের বিরোধীতা করতে হবে তখন তাঁর মনে পড়ছে, “এই প্রসঙ্গে য়ুরোপের দৃষ্টান্ত দেওয়া যাক। সেখানে দেশে দেশে ভিন্ন ভিন্ন ভাষা, অথচ এক সংস্কৃতির ঐক্য সমস্ত মহাদেশে।” এর মধ্যে তাঁর সুবিধেবাদ, স্ববিরোধীতা খুঁজে পাওয়া খুবই সহজ। কিন্তু সে হবে ঐ একদেশদর্শীর কাজ। ভাষাকে ঐক্যের একটা আধার বলে তিনি মেনে নিচ্ছেন বটে, কিন্তু একমাত্র আধার বলে যারা জোরের সঙ্গে দাবি করেন রবীন্দ্রনাথের অবস্থান তাঁদের বিরুদ্ধে মাত্র। অন্যত্র বহু লেখাতে দেখা যাবে সম্প্রদায়গত ধর্মকেও  ঐক্যের আধার হতে পারার বাস্তবতাকে তিনি একেবারে উড়িয়ে দিচ্ছেন না। কাশি হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে যখন তিনি ঠিক শতবর্ষ আগে সেই ২৯ অক্টোবর, ১৯১১তে রিপন কলেজে বক্তৃতা করছেন তখন শুরুতেই  মুসলমানদের জন্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রস্তাবকে সমর্থণ জানিয়ে বলছেন, “ আমার নিশ্চয় বিশ্বাস , নিজেদের স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন প্রভৃতি উদ্‌যোগ লইয়া মুসলমানেরা যে উৎসাহিত হইয়া উঠিয়াছে তাহার মধ্যে প্রতিযোগিতার ভাব যদি কিছু থাকে তবে সেটা স্থায়ী ও সত্য পদার্থ নহে । ইহার মধ্যে সত্য পদার্থ নিজেদের স্বাতন্ত্র্য উপলব্ধি । মুসলমান নিজের প্রকৃতিতেই মহৎ হইয়া উঠিবে এই ইচ্ছাই মুসলমানের সত্য ইচ্ছা।”২৭ হিন্দুমুসলমানে ঐক্যের তিনি যে সূত্র ওই বক্তৃতাতে দিয়েছেন, তা আজকেও বহু অসাম্প্রদায়িক ব্যক্তিও উচ্চারণ করতে  দ্বিধাবোধ করবেন, “আজ আমাদের দেশে মুসলমান স্বতন্ত্র থাকিয়া নিজের উন্নতিসাধনের চেষ্টা করিতেছে । তাহা আমাদের পক্ষে যতই অপ্রিয় এবং তাহাতে আপাতত আমাদের যতই অসুবিধা হউক , একদিন পরস্পরের যথার্থ মিলনসাধনের ইহাই প্রকৃত উপায় । ধনী না হইলে দান করা কষ্টকর ; মানুষ যখন আপনাকে বড়ো করে তখনই আপনাকে ত্যাগ করিতে পারে । যত দিন তাহার অভাব ও ক্ষুদ্রতা ততদিনই তাহার ঈর্ষা ও বিরোধ । ততদিন যদি সে আর কাহারও সঙ্গে মেলে তবে দায়ে পড়িয়া মেলে — সে মিলন কৃত্রিম মিলন । ছোটো বলিয়া আত্মলোপ করাটা অকল্যাণ , বড়ো হইয়া আত্মবিসর্জন করাটাই শ্রেয়।” ২৮
অসমিয়া ভাষা এবং রবীন্দ্রনাথ
     
      এই প্রসঙ্গেই মনে পড়ে অসমিয়া ভাষা নিয়ে রবীন্দ্রনাথের অবস্থানের কথা। ভাষাটিকে তিনি একসময় বাংলার উপভাষা বলেই মনে করতেন। কিন্তু সে ঐ উনিশ  শতকের শেষের কথা। বাংলা ১৩০৫, ইংরেজি ১৮৯৮। এখনকার রবীন্দ্ররচনাবলীতে ‘শব্দতত্বে’র পরিশিষ্টে একটি উটকো প্রবন্ধের সন্ধান মেলে, ‘ভাষাবিচ্ছেদ।’ সেটি শুরুতে রবীন্দ্রনাথ গ্রন্থবদ্ধও করেননি। কিন্তু একে উটকো বলবার কারণ তা নয়।  বইটির আর সব প্রবন্ধকেই বিশুদ্ধ ভাষাবিজ্ঞানের শাখাতে ফেলে শ্রেণিবদ্ধ করা চলে, এই একটিকেই সমাজভাষাবিজ্ঞানের সারিতে ফেলে সাজাতে হবে।  ততদিনে তিনি নাথান ব্রাউনের অসমিয়া ব্যাকরণ পড়ে ফেলেছেন। যেটি কিনা প্রথম দাবি করে যে অসমিয়া বাংলার উপভাষা নয়। ফ্রেডরিখ হ্যর্নলের গৌড়ীয় ভাষার ব্যাকরণও পড়ে ফেলেছেন। আমরা নজির দিয়ে দীর্ঘ করব না, শুধু বলব, ঠিক যে যে যুক্তিতে ১৯১৩ থেকে বেনুধর রাজখোয়ার Notes on Sylheti Dialects বেরোবার পর থেকে সিলেটি উপভাষাকে বহু অসমিয়া ভাষাতাত্বিক অসমিয়ার উপভাষা বলে দাবি করে আসছেন রবীন্দ্রনাথ ঠিক ঐ একই যুক্তিতে সেই প্রবন্ধে ওড়িয়া আর অসমিয়াকে বাংলার উপভাষা বলে দাবি করছেন। চাঁটগেয়ে, সিলেটি উপভাষাগুলো যে মান বাংলার থেকে অসমিয়ারই খুবই কাছের ভাষা তা বেনুধর রাজখোয়ার একযুগ আগে রবীন্দ্রনাথই প্রথম চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেন। তফাৎ হলো, ঐ যুক্তিগুলো ব্যবহার করে একদল যখন বাংলার উপভাষাগুলোকে অসমিয়ার বলে দাবি করে আসছেন রবীন্দ্রনাথ তখন  পুরো অসমিয়া ভাষাটাকেই বলছেন বাংলার উপভাষা মাত্র। এবং কেউ কেউ একে আলাদা করে ফেলতে চাইছে বলে বেশ উষ্মাই প্রকাশ করে লিখছেন এরা নিজেদের বিপদ নিজেরাই ডেকে আনবেন, না পাবেন ভালো চাকরি, না পারবেন ভালো সাহিত্যের ঐতিহ্য তৈরি করতে। চারদশক পরে যিনি লিখবেন, “য়ুরোপের ভিন্ন ভিন্ন ভাষা যেদিন আপন আপন শক্তি নিয়ে প্রকাশ পেলে সেই দিন য়ুরোপের বড়োদিন। ” ‘ভাষাবিচ্ছেদে’ তাঁরই যুক্তি, “বৃটিশ দ্বীপে স্কটল্যাণ্ড, অয়র্ল্যাণ্ড ও ওয়েল্‌সের স্থানীয় ভাষা ইংরেজি সাধুভাষা হইতে একেবারেই স্বতন্ত্র। তাহাদিগকে ইংরেজির উপভাষাও বলা যায় না। উক্ত ভাষাসকলের প্রাচীন সাহিত্যও স্বল্পবিস্তৃত নহে। কিন্তু ইংরেজের বল জয়ী হওয়ায় প্রবল ইংরেজিভাষাই বৃটিশ দ্বীপের সাধুভাষারূপে গণ্য হইয়াছে। এই ভাষার ঐক্যে বৃটিশজাতি যে উন্নতি ও বললাভ করিয়াছে, ভাষা পৃথক থাকিলে তাহা কদাচ সম্ভবপর হইত না।” ভাষাবিচ্ছেদ বুদ্ধির জন্যে তিনি বৃটিশ সাহেবের নিন্দে করছেন, ঐক্যের বুদ্ধিটা আবার সেই বিলেত থেকে নিতেই পরামর্শ দিচ্ছেন। এই রবীন্দ্রনাথ একেবারেই উগ্রজাতীয়তাবাদী। এই সত্য উচ্চারণ করতে আমাদের কোনো দ্বিধা থাকাই উচিত নয়। পরবর্তী যে রবীন্দ্রনাথের পরিচয় আমরা ইতিমধ্যে দিয়ে এসছি তাঁকে দিয়েই এই উনিশ শতকীয় রবীন্দ্রনাথ এবং তাঁর পরিবেশকে  খণ্ডন করা যায়। আমাদের শুধু  মনে রাখতে হবে,  ‘প্রত্যেক ভাষার নিজের একটা ছাঁচ আছে’ এই কথাটা যে প্রবন্ধে  প্রথম তাঁর উপলব্ধিতে আসছে সেই ‘বাংলা ব্যাকরণ’ লিখতে তখনো তাঁর  তিন বছর বাকি। সেটি লেখা হয় বাংলা ১৩০৮এ। তাছাড়া অসমিয়ারা নিজেরাই এর আগে ভাষাটির অবস্থান ঠিক করে উঠতে পারেন নি, তাঁরা বাংলাতে লিখতেন , বাংলাতে পড়তেন। বিশ্বাসই করতেন না, অসমিয়াতে সাহিত্য চর্চা হতে পারে। ঠিক বঙ্কিমের আগের বাঙালিদের মতো।  ড০ প্রফুল্ল চন্দ্র মহন্ত তাঁর ‘অসমিয়া মধ্যবিত্ত শ্রেণির ইতিহাসে’ হেমচন্দ্র বরুয়ার একটি উক্তি তুলে দিয়েছেন, “উল্লিখিত সময়ত অসমত বঙ্গালী, ভাষাৰ বৰ আদৰ আছিল, মাতৃভাষাক সকলোৱে ঘিনাইছিল—ইস্কুলত বঙ্গালী, কাছাৰীত বঙ্গালী, ডেকাবিলাকৰ আলাপত বঙ্গালী আৰু তেওঁলোকৰ চিঠিতো বঙ্গালী ভাষাহে চলিছিল। সকলোৱেই বঙ্গিনী বঙ্গীয়াক সঙ্গিনী কৰি লইছিল, অবশ্যে ময়ো এই নিয়মৰ বাহিৰ নাছিলো, বঙ্গ ভাষা মোৰ বুকুর কুটুম আছিল।” ২৯ ।শুধু তাই নয়, ভাটি অসমের ভাষাকে উজানের অসমিয়ারাই অসমিয়া বলে জাতে তুলতে চাইতেন না। ‘সাহিত্য সভার কথা’ বইতে  শরৎচন্দ্র গোস্বামী লিখেছেন, “ অসমীয়া ভাষাৰ সঙ্কীর্ণতা ইমান বাঢ়িছিল যে শিবসাগৰত নোকোৱা শব্দ এটা ব্যবহাৰ কৰিলেই ভাষা চুৱা হ'ল বুলি কিছুমান উজনীয়া লোকে আটাহ পাৰি ফুৰিছিল। কামৰূপীয়া বা গোয়ালপৰীয়া মাত কথাতো বঙলুৱাই। যি বিশিষ্ট ভাষাৰ বহির্ভূত। এনে সংকীর্ণতাৰ ফলত নামনি অসমৰ অনেকেই অসমীয়া লিখিবলৈ ভয় কৰিছিল। … এনে অবস্থাত কামৰূপত তেতিয়াও কেইজনমান ক্ষমতাসম্পন্ন লোক আছিল, যে ভাবিছিল যে কামৰূপীয়া মানুহে উজনীয়াৰ ইমানবিলাক অত্যাচাৰ আৰু অবিচাৰ ( ভাষা বিষয়ত) সহ্য কৰাত কৰি তেওঁলোকে বঙালী ভাষাকে গ্রহণ কৰা ভাল।”৩০ সুতরাং রবীন্দ্রনাথের ভাষাচিন্তার আদিযুগের অবস্থানকে এই বাস্তবতার থেকেও বিবেচনা করতে হবে। ‘ভাষাবিচ্ছেদ’ তিনি যে শ্রাবণে লিখছেন তার দুমাস আগে জ্যেষ্ঠ মাসে লিখছেন,  ‘বাংলা বহুবচন’।  সেখানে আবার উত্তর ভারতীয় প্রায় সমস্ত আর্য ভাষার সঙ্গে ওড়িয়া এবং অসমিয়াকে স্বতন্ত্র ভাষা বিবেচনা করেই এক তুলনামূলক আলোচনা করেছেন। এবং আমাদের ধারণা কোনো ভারতীয়ের হাতে অসমিয়া ভাষার তুলনামূলক অধ্যয়ন এটিই প্রথম। দুমাস পরে তবে সেই অসমিয়া –ওড়িয়াকে বাংলার উপভাষা বলছেন কেন? এর উত্তর একটাই হতে পারে, সময় কখনো এরৈখিক নয়, অতীত থেকে ভবিষ্যতের দিকে তাঁর টানা যাত্রা নয়। তাকে স্থানের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন করে কিছুতেই বোঝা যাবে না। নেশন, জাতীয়তাবাদ নিয়ে তাঁর জিজ্ঞাসাগুলো তখনই দানা বাঁধছিল। কিন্তু সে তীব্রতা পায় ১৯০৫এর বাংলা ভাগ বিরোধী আন্দোলনের সময় থেকে। স্বদেশিরা যখন আন্দোলনের ব্যর্থতার দায় মুসলমান সহ অন্যদের উপর চাপাচ্ছেন আর বাঙালিকে ভাগ করবার দায় চাপাচ্ছেন বিলেতিদের উপর, তিনি তখন বাঙালির নিজের ভেতেরেই বিভেদের কারণ অনুসন্ধানে নেমেছেন এবং জাতীয়তাবাদের স্বরূপ উন্মোচন করছেন। তাঁর তখনকার বহু মূল্যবান মন্তব্যের মধ্যে এই কথাগুলোও আজ অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক , “ আসল কথা আমাদের দুর্ভাগ্য দেশে ভেদ জন্মাইয়া দেওয়া কিছুই শক্ত নহে, মিলন ঘটাইয়া তোলাই কঠিন। বেহারিগণ বাঙালির প্রতিবেশী এবং বাঙালি অনেকদিন হইতেই বেহারিগণের সঙ্গে কারবার করিতেছে, কিন্তু বাঙালির সঙ্গে বেহারির সৌহার্দ্য নাই সেকথা বেহারবাসী বাঙালিমাত্রেই জানেন। শিক্ষিত উড়িয়াগণ বাঙালি হইতে নিজেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র বলিয়া দাঁড় করাইতে উৎসুক এবং আসামিদেরও সেইরূপ অবস্থা। অতএব উড়িষ্যা আসাম বেহার ও বাংলা জড়াইয়া আমরা যে দেশকে বহুদিন বাংলাদেশ বলিয়া জানিয়া আসিয়াছি তাহার সমস্ত অধিবাসী আপনাদিগকে বাঙালি বলিয়া কখনো স্বীকার করে নাই, এবং বাঙালিও বেহারি উড়িয়া এবং আসামিকে আপন করিয়া লইতে কখনো চেষ্টামাত্র করে নাই,  বরঞ্চ তাহাদিগকে নিজেদের অপেক্ষা হীন মনে করিয়া অবজ্ঞা দ্বারা পীড়িত করিয়াছে।”৩১ এই স্বর্ণাক্ষরগুলো আজকের অসমেও আমাদের আধার পথের আলো হতেই পারে, এই নিয়ে কি আর কোনো সংশয় থাকা উচিত?  


তথ্য সূত্রঃ
১) পৃঃ ৮১৯,রবীন্দ্ররচনাবলী, ৬ষ্ঠ খন্ড, ১২৫তম জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে প্রকাশিত সুলভ সংস্করণ, বিশ্বভারতী
২)  পৃঃ ৪১৫, বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস , সুকুমার সেন, চতুর্থ খণ্ড,  আনন্দ প্রকাশনী।
৩) পৃঃ ১০১, অবতরণিকাঃবাঙলা ভাষাতত্ব, বাংলা ভাষা , প্রথম খন্ড, সম্পাদক হুমায়ুন আজাদ,আগামী প্রকাশনী, ফেব্রুয়ারী, ১৯৯৭, ঢাকা।
৪) পৃঃ ৭০৯, রামেশ্বর শ্ব, সাধারণ ভাষাবিজ্ঞান ও বাংলাভাষা, পুস্তক বিপনি, ১৩৯৯ ।
৫) পৃঃ ২১, অবতরণিকাঃবাঙলা ভাষাতত্ব, বাংলা ভাষা , প্রথম খন্ড, সম্পাদক—হুমায়ুন আজাদ, আগামী প্রকাশনী, ফেব্রুয়ারী, ১৯৯৭, ঢাকা।
৬) পৃঃ ৪২, অবতরণিকাঃবাঙলা ভাষাতত্ব, বাংলা ভাষা , প্রথম খন্ড, সম্পাদক—হুমায়ুন আজাদ, আগামী প্রকাশনী, ফেব্রুয়ারী, ১৯৯৭, ঢাকা।
৭) পৃঃ ৩২৬, উপসর্গের অর্থবিচার, দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর,  বাংলা ভাষা , প্রথম খন্ড, সম্পাদক—হুমায়ুন আজাদ, আগামী প্রকাশনী, ফেব্রুয়ারী, ১৯৯৭, ঢাকা
৮)  পৃঃ ৭৪৪,উপসর্গ সমালোচনা, রবীন্দ্ররচনাবলী, ৬ষ্ঠ খন্ড, ১২৫তম জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে প্রকাশিত সুলভ সংস্করণ, বিশ্বভারতী  
৯) পৃঃ ৬২৩, রবীন্দ্ররচনাবলী, ১৩শ খন্ড, ঐ)
১০) পৃঃ ৪০, অবতরণিকাঃবাঙলা ভাষাতত্ব, বাংলা ভাষা , প্রথম খন্ড, সম্পাদক—হুমায়ুন আজাদ, আগামী প্রকাশনী, ফেব্রুয়ারী, ১৯৯৭, ঢাকা। 
১১) ঐ ।
১২) পৃঃ ৬৬২,  ছাত্রদের প্রতিসম্ভাষণ, আত্মশক্তি,রবীন্দ্ররচনাবলী, ২য় খন্ড, ঐ। 
১৩)  পৃঃ ৬৩৩, বাংলা কৃৎ ও তদ্ধিত, রবীন্দ্ররচনাবলী, ৬ষ্ঠ খন্ড, ঐ ।
১৪) পৃঃ ৬৩৪, ঐ ।
১৫)   পৃঃ ১৩০,ভাষাবীথি, ড০ নির্মল দাশ, অরিয়েন্টাল বুক কোম্পানী প্রাইভেট লিমিটেড, পানবাজার গুয়াহাটি, ফেব্রুয়ারী, ২০০১।
১৬)  পৃঃ ৬৩৪,বাংলা কৃৎ ও তদ্ধিত, রবীন্দ্ররচনাবলী, ৬ষ্ঠ খন্ড, ঐ
১৭) পৃঃ ১৬৯, নূতন বাংলা ব্যাকরণ, শরচ্চন্দ্র শাস্ত্রী, বাংলা ভাষা , প্রথম খন্ড, সম্পাদক—হুমায়ুন আজাদ, ঐ) 
১৮) ঐ ।
১৯)  পৃঃ ৭৫০, বাংলা ব্যাকরণ, শব্দতত্ত্ব, রবীন্দ্ররচনাবলী, ৬ষ্ঠ খন্ড,ঐ।
২০)  পৃঃ ৮২০,গ্রন্থপরিচয়, রবীন্দ্ররচনাবলী, ৬ষ্ঠ খন্ড, ঐ ।  
২১) পৃঃ ৭৫৬, বাংলা ব্যাকরণ, শব্দতত্ত্ব, ঐ ।
২২) পৃঃ ৭৫১, ঐ 
২৩) পৃঃ ৫৮৫, রবীন্দ্ররচনাবলী, ১৩শ খন্ড, ঐ
২৪) পৃঃ ৫৮৩, রবীন্দ্ররচনাবলী, ১৩শ খন্ড,ঐ।
২৫)http://www.newworldencyclopedia.org/entry/Rabindranath_Tagore#Political_views
২৬) পৃঃ ৫৮২, রবীন্দ্ররচনাবলী, ১৩শ খন্ড, ঐ ।
২৭) পৃঃ ৬০৬, পরিচয়, হিন্দুবিশ্ববিদ্যালয়, রবীন্দ্ররচনাবলী, ৯ম খন্ড,ঐ।
২৮) ঐ ।
২৯)  পৃঃ১৮৮, অসমীয়া মধ্যবিত্ত শ্রেণিৰ ইতিহাস,ড০ প্রফুল্ল চন্দ্র মহন্ত, লৱার্স বুক স্টল, গুৱাহাটি, ২০০৯
৩০) পৃঃ ১৫০-৫১; 'সাহিত্য সভাৰ কথা'; শৰৎ চন্দ্র গোস্বামী ৰচনাৱলী; পৃঃ ২৪৮, অসমীয়া জাতি গঠন প্রক্রিয়া আৰু জাতীয় জনগোষ্ঠীগত অনুষ্ঠান সমূহ-তে উদ্ধৃত।
৩১)  পৃঃ ৭১৪, সদুপায়, সমূহ, রবীন্দ্ররচনাবলী, ৫ম খন্ড, ঐ ।
অন্যান্য গ্রন্থঃ
১) Origine and development of Bengali language, Suniti Kumar Chatterji; Rupa & Co, Culcatta,