(এক বছরের জন্যে আমি লেখা লেখি থেকে ছুটি নিয়ে বসে আছি। কিন্তু কিছু কিছু চাপ এড়ানো কঠিন। রবিবারের বৈঠকের ব্যস্ত সম্পাদক সৌমেন কিম্বা সম্পাদনা সহযোগী বাসবদারা এসব ভুলে টুলে হিসেবে ধরে যখন বৃহস্পতিবারর দিনক্ষণ বেঁধে দিয়েছিল, আমার তখন তিন তল্লাটাতে বৃহস্পতির দেখা নেই। দিনভর ব্যস্ততার পরে এক রাতে বসে লিখে ফেলে ভাবছিলাম, খুব ফাঁকি দেয়া হলো। মন খারাপ ছিল। ভালো লিখিনি বলে। তবু যখন, ছেপে বেরুলো আর বন্ধুরা ফোনে মেসেজে জানালেন তাদের ভালো লাগার কথা তখন চাপ মুক্ত হয়েছি-- এইটুকু বলতে পারি। )
১
দশক দুই আগে ১৯৯৫র পুজোর দিন কতক আগে। মামার বাড়ি করিমগঞ্জে বেড়াতে গেছিলাম। সে, প্রায়ই যেতাম। আর গেলে, যেখানে যত কাগজ জমা আছে জড়ো করে পাতা ওলটানোটা আমার স্বভাব ছিল। তেমনি এক কাগজে শালিমার তেলের বিজ্ঞাপন দেখে আমার এক বোন বলেছিল, “দাদা, দেখ কেমন সুন্দর কবিতা দিয়েছে।” দেখি বিজ্ঞাপনটি বেশ ছন্দে মেলানো। বললাম , “ এ হলো বিজ্ঞাপন। দাঁড়া, একে একটা কবিতায় পালটে দেয়া যাক।” পুজো নিয়ে সেই আমার প্রথম এবং এযাবৎ শেষ লেখা।
“ শিশির ভেজা শিউলি তলে
রোদের লুটোপুটি;
পুজো মানেই ভিড়ের ট্রেনে
জানালা তোলা ছুটি।
পুজো মানেই ঘরের টানে
বাঁধন যত ছেঁড়া;
কাশের বনে পথ হারিয়ে
ছেলেবেলায় ফেরা।
পুজো মানেই সে কবেকার
প্রেমতলার মোড়;
তনু-দীপুর সাথে সেবার
মিশন রোডে ভোর।
ছোট বৌদি চায়ের কাপে
কতদিনের পর!
পুজো মানেই, কোথায় থাকে
তরুণিমার বর?
এবং তারপর...
বিসর্জনে ঢাকের কাঠি,
বেলুন সাদা লালে;
স্টেশন জুড়ে ধোঁয়া এবং
টোল পড়ে না গালে।”
আমার প্রবাস জীবন শুরু হয় তারও তিনবছর পরে। তখনো তার নামগন্ধ কোথাও নেই। তবু যেন কোথাও একটা আভাস পেয়েছিলাম এমন ছড়িয়ে পড়ার। সবাই কেমন ছড়িয়ে পড়ছে, আর আমিও যে ছিটকে যাবো----আঁচ করছিলাম । নইলে ঠিক এই ভাবে পঙক্তিগুলো আসত না। তবু তো আশা করেছিলাম, পুজো আমাকে ‘ভিড়ের ট্রেনে জানালা তোলা ছুটি’ দেবে । সে আশাও খানিক বেশিই ছিল। তাও দেয় নি। তো পুজো নিয়ে লিখবটা কী?
মনে পড়ে এক সপ্তমী সন্ধ্যাবেলা আমি পথের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। বড়কাকা কখন দিনের পরিশ্রম সেরে ফিরে আসবেন। আসার পথে আমার আর কোলের খুড়তুতো ভাইটির জন্যে জামা নিয়ে আসবেন। সেই জামা পরে কাকিমা সহ আমরা চারজনে পুজো দেখতে বেরুবো। আমার জন্যে তখন আরো বরাদ্দ হবে একটা খেলনা বন্দুক। আর এক বাক্স টিকলি। তাতে বারোটা টিকলি থাকবে। হিসেব করে চারদিনে ফোটাতে হবে। একটা ফুরোলে আর দু’টো জুটবে না। এখন আমার সন্তানের সেই সমস্যা নেই। কিন্তু বিনিময়ে যে দাম দিতে হয়েছে, সে এই প্রবাসী জীবন। আমাদের যে ছিল পথ হারিয়ে ফেলার কাশ বনের ছুটি-- সেই বনটাই ওর হারিয়ে গেছে। স্কুলের প্রজেক্টে এসে ফ্যাভিকলে স্যাঁটে গেছে। পুজোর চারদিনের ছুটি এমন মনে রাখার মতো কিছু না। না তার, না আমার। ফলে এই পঙক্তিগুলো সত্য হয় নি ওর জীবনেও , ‘বিসর্জনে ঢাকের কাঠি,/বেলুন সাদা লালে।...’। ‘স্টেশন জুড়ে ধোঁয়া’ টা না হয় এক প্রাক-ঐতিহাসিক গল্প। কিন্তু আমাদের গল্পে তার পরে থেকেই এক দীর্ঘ মেগা-ব্লক। শীতে যাই, কিম্বা বর্ষাতে-- হাত গুনা দিন। স্থির করে রাখা দিনে পৌঁছুতে পারব কিনা, কিম্বা ফিরতে --- সেই উদ্বেগ থাকে আমাদের সব যাত্রার সঙ্গী। আর গেলেও, কোনও ছোট বৌদির সঙ্গে চায়ের কাপ আড্ডা জমানো যায় না তরুণিমাকে নিয়ে। সে গল্প হয় উঠতে বসতে, ছুটতে ছুটতে। সামান্য সময় দেখা করে কর্তব্য করতে করতে। তরুণিমার সঙ্গেও তাই। বাকি কথা ফোনে হবে, আশ্বাসে ফেরা হয়। এর পরে ফোন করা ভুলে যাই---সব্বাই। এইতো জীবন।
২
আমার পাঠশালা-স্কুলের কাল কেটেছে মা-বাবার থেকে দূরে। তাতে একটা লাভ হয়েছে এই --চিঠি লেখালেখিটা আয়ত্ত হয়ে গেছিল খুব ছোট থেকেই। পরে সেটি সঞ্চারিত হয়েছিল বন্ধুদের মধ্যে। এবং অবশ্যই বান্ধবীতে। ১৯৯৩র সেপ্টেম্বর ৩০শে মহারাষ্ট্রের লাতুরে ভীষণ ভূমিকম্প হয়ে গেছিল। ওদিকে যখন লাখো মানুষ বিপন্ন --দেশ তখন প্রস্তুতি নিচ্ছিল শারদোৎসবের। যে কোনও সংবেদনশীল মানুষের কাছে মনে হতেই পারে এ নির্লজ্জ অশ্লীলতা। আর সেই নির্লজ্জতা যে শিলচর কলকাতার মতো শহরে নজরে পড়বে বেশি এতো না লিখলেও বোঝাই যায়। তো, আমার এক বন্ধু কবিতা লিখত। কলকাতার কোনও এক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ত। চিঠিতে আলাপ, চিঠিতে বন্ধুত্ব । বলা যেতে পারে পত্র-মিতালি। সে লিখেছিল, “লাতুর আমাকে ব্যথিত করেছে। সেই ব্যথাতে নুন ছেটাচ্ছে কলকাতা। কলকাতা নির্বিকার উৎসবের প্রস্তুতি নিচ্ছে।” আমি তখন এক তরুণীর হৃদয়ে তরণি বাইছি। কিছুতেই কিনার পাচ্ছি না, কিন্তু হালও ছাড়ছি না। সেই উৎসাহে টগবগে বন্ধুকে উত্তরে লিখলাম, “মনে করা যাক দেশে সবাই বেদনা বিধুর। কেউ উৎসব করছে না। বেদনার ভারে নুয়ে যাবে না? এই উৎসবই কি লাতুরের সেই বিপর্যস্ত মানুষকে দেখাবে না মাথা তুলে দাঁড়াবার স্বপ্ন? উৎসবের দিনেই কি প্রতিদিনের ছোট ছোট বিষণ্ণ বিচ্ছিন্ন মানুষগুলো নিতান্ত অদরকারি আনন্দরূপে পরিপূর্ণ মানুষ হয়ে দেখা দেয় না? উৎসব আছে বলেই কি এই দুনিয়াতে বেঁচে থাকার ইচ্ছেটা বেড়ে যায় না?” আমাকে তখন আচ্ছন্ন করে রেখেছেন রবীন্দ্রনাথও। মনে কি পড়ে ‘উৎসবের দিনে’ তাঁর সেই বিখ্যাত উচ্চারণ, “জগতের যেখানে অব্যাহতশক্তির প্রচুর প্রকাশ, সেইখানেই যেন মূর্তিমান উৎসব।” বন্ধুটি কী লিখেছিল এর পরে সে মনে নেই। কিন্তু তাই বলে রবীন্দ্রনাথ কোনোদিন দুর্গাপুজোর আয়োজন করেন নি, সে বেশ জানি। আমিও করিনা, করব না। অন্যে করলেও সেই আয়োজনে থাকি না। থাকব না। লাতুর কিন্তু এখনো আমার পিছু ছাড়ে না। একটা উৎসবের স্বপ্ন পিছু ছাড়ে না যার পাশাপাশি কোনও লাতুর থাকবে না। কাশ্মীর থাকবে না। থাকবে না গোয়ালপাড়া, জলে ডোবা বিপন্ন গুয়াহাটি। এই বিপন্নতার পাশাপাশি যারা উৎসবে নির্বিকার থাকতে পারে আর পুজোর ঠাকুরকে সামনে রেখে লুঙি-তোলা নাচে মাতাল হতে পারে তাদের আমার অশ্লীল বলেই মনে হয়। তাদের সঙ্গে আমার নেই কোনও আত্মীয়তা।
আমার আছে এক অন্য উৎসবের স্বপ্ন। যে কোনও স্বপ্নের মতোই তার চেহারা স্পষ্ট নয়। সেই উৎসব হতে এখনো অনেক বাকি। আমার আছে শুধু জীবন জুড়ে তারই জন্যে প্রস্তুতি, আর দিন গুনা। সেদিন কোনও কিশোর সারাদিন খেটে বড়কাকা বাড়ি ফিরবেন আর জামা কিনে আনবেন বলে পথের পাশে দাঁড়িয়ে থাকবে না। সেই স্মৃতি আমার পিছু ছাড়ে না এখনো। আমার সত্তাটাই গড়ে উঠেছে এই ভাবে। তাই, বাৎসরিক এই উৎসবের দিনগুলোতে সেই স্বপ্নগুলো যেন আরো একটু প্রবল হয়, হয় স্পষ্টতর। শারদোৎসবের থেকে আমার পাওনা এইটুকু। তবু এই চলমান উৎসবের ছোঁয়া আর ছায়া এড়িয়ে থাকা এখনো কঠিন। ঋতুটাই এমন। রাতের অন্ধকারেই ফোটে শিউলি। সকাল হতে না হতে ঝরে গিয়ে ছড়িয়ে পড়ে শিশিরে, ধূলিতে একসা। তবু তার যেটুকু সৌরভ তার থেকে আত্মরক্ষার কথা কেউ ভুলেও কল্পনা করে না। বরং পায়ের তলাতে পিষে না যায়, একটা একটা করে গুটিয়ে এনে যেমন কেউ যেমন বাড়ির ভেতরে বাটিতে সাজিয়ে রাখে। আমিও তেমনি ছোট ছোট উপকরণে তৈরি করি নিজের উৎসব। নইলে পুজোর দিনগুলোই আমার বছরে সবচাইতে নিরানন্দের দিন। ছিল তখনো, আছে এখনো।
হাতে বিশেষ কাজ, নেই। কাছে কোনও বন্ধু নেই। এই ক’দিন মোটের উপরে আমি গৃহ বন্দি। কেমন করে কাটবে, আগাম বলে দিতে পারি। সবই প্রায় ধরাবাঁধা। দেরি করে ঘুম থেকে উঠবো। ফেলে রাখা বই পত্র কিছু পড়ে ফেলব। শারদ সংখ্যার পাতা ওলটাবো হয় তো। তাই বলে, সেগুলো না পড়লে পরে দিন ব্যর্থ হয়ে যাবে এমন কোনও আবাল্য সংস্কার গড়ে উঠবার ফুরসতই হয় নি । যা কিছু পড়েছি, বন্ধু বাড়ি থেকে এনে। তাই আমার লেখালেখির দরকারে যা পড়বার, বন্ধুদের পাঠানো বই পত্রিকা যা জমে আছে –আমি সেগুলোই পড়ব। তার মধ্যে শারদ সংখ্যা থাকে তো ভালো, নববর্ষ সংখ্যা হলেও কোনও ক্ষতি নেই। সেরকম কাগজও পড়া হয় নি, পড়ে আছে। আমি যে বাড়িতে থাকি, তার উঠোনেই পাড়ার বারোয়ারি পুজোটা হয়। সেখানে সারা দুপুর ছুটোছুটি করবে আমার কৈশোরে পা দেয়া কন্যা। তার ছুটোছুটি দেখব। দুপুরটা সেও ঘুমিয়ে কাটাবে। সন্ধ্যে বেলা ওর মায়ের সঙ্গে গিয়ে বসবে মণ্ডপে। মণ্ডপে তখন কান ঝালাপালা হিন্দি ভজন চলবে, ‘ওম জয় অম্বে গৌরী...’ । আমি তখনো বইয়ের পাতায় বা কম্পিউটারে । আমার কম্পিউটারে হয়তো বাজবে, কিশোর কুমারের ‘আমার পূজার ফুল’; বাজতে পারে সাবিনা ইয়াসমিনের, ‘আমি রজনীগন্ধা ফুলের মতো’; কিম্বা শ্রেয়া ঘোষালের ‘মায়াবন বিহারিণী আমি নই...।’ আজকাল ফেসবুকে আড্ডা জমে , হয়তো জমাবো। অথবা পড়া বই নিয়ে ফোন করব গুয়াহাটি বা শিলচরের কোনও বন্ধুকে। বান্ধবীকে নয় কেন? সত্যিইতো, নয় কেন? কারণ, সেই স্বপ্নের উৎসব এখনো আসে নি। সুতরাং অপ্রয়োজনের ফোনটি আসবে, কিম্বা যাবেও কোনও বন্ধুরই কাছে। মা-বাবার ফোন আসবে। আসবে ভাই বোনেদের। বাড়ির শিশুদের সঙ্গে সামান্য ঠাট্টা করব হয়তো ফোনে । খুব রাত করে, যখন ভিড় কমবে--- স্ত্রী কন্যাকে নিয়ে বেরুবো। বড় লোকেদের বড় বাজেটের পুজোগুলো দেখে আসব। একদিন অবশ্যই খাওয়া হবে বাইরে। কোনও রেস্তোরাতে। দশমীর দিনে ভর দুপুরের রোদের তলায়, রাজপথের পাশে গিয়ে দাঁড়াবো। একে একে ট্রাকবাহনা শব্দ-দূষিতা দেবী মূর্তির নদী পথে যাওয়া দেখব। ফেরার পথে জিলিপি বুন্দিয়া সন্দেশ রসগোল্লা নিয়ে ফিরব। এমনি করেই কেটে যাবে দিন।
এখানে আয়োজকেরা খুব ধর্ম মানেন। পুজোর তিনদিন ‘ওম জয় অম্বে গৌরী’ বা এমন কিছু গান ছাড়া কিছুই বাজবে না। এই না বাজার ক্ষতিটা পুষিয়ে নিতে আজকাল ‘ কাঁটা লাগে’র সুরে গৌরীগানও বাজারে বেরিয়ে গেছে। কিন্তু দশমীর দিনে অতি অবশ্যই ‘গৌরী’ বিদেয় নেবেন। সেদিন ‘কাঁটাই লাগ’বে। গেল বছরে খুব লুঙ্গি তোলা হয়েছিল। অন্য তিনদিন যারা চরণামৃত পান করে উপোস ছিলেন, তারা সবাই না হলেও অনেকেই এদিনে মদে মত্ত হবেন। আরতির নৃত্য পরিবর্তিত হবে পাথুরে নৃত্যে। ইংরেজিতে তাকে বলে বুঝি ‘রক ড্যান্স’। এ এখন মোটের উপর সর্বভারতীয় জাতীয় সংস্কৃতি। গণেশ থেকে সরস্বতী-- সব পুজোতেই হয়। এই শহরে আলাদা কিছু হয় না। আলাদা যা হয়, সে বছর কয় আগে আমার এক অভিজ্ঞতার কথা জানালে স্পষ্ট হবে। আমার পাড়াতে , আমাদের বসত বাড়ির উঠোনে যে পুজো হয় সেখানে দিন ভর এই অম্বিকা গৌরীর ভজন শুনে শুনে ক্লান্তিতে থাকতে না পেরে আমার সংগ্রহের একটি বিচিত্র বাংলা গানের সংগ্রহ নিয়ে গিয়ে দিয়েছিলাম বাজাবার জন্যে। একটি ছেলে সেই সিডি বাজিয়েছিল। প্রথম গানটিই ছিল, কিশোর কুমারে গাওয়া ৭৭এর সেই ‘কবিতা’ ছায়াছবির বিখ্যাত গান , “শোন শোনগো সবে শোন দিয়া মন...” সেই বনের ধারে ছোট্ট নদীর ধারে এক রাখাল ছেলের গল্প। মনে পড়ে? আমাদের শিশু কিশোর মনও কেমন স্বপ্ন দেখা শিখেছিল গানটি শোনে। কিন্তু ‘হঠাৎ কী হলো মনে...’ আয়োজকদের একজন তেড়ে এসে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন, কে বাজিয়েছে এই গান! পুজোর আসরে এমন গান বন্ধ করো। গান বন্ধ হয়ে গেল। এর পরেই বেজে উঠতে পারত সবিতা চৌধুরী, যশোদাসের গাওয়া ‘শ্রীকান্তের উইল’ ছায়াছবির সেই সুমধুর গান, “নাম শকুন্তলা তার, যেন বৃন্তচ্যুত ফুলভার”। তার বদলে আবার বেজে উঠলেন সেই অনুরাধা পড়োয়াল। কী ধর্ম রে বাবা। মনে হচ্ছিল, সেই আসরে যদি প্রাণ খুলে রামপ্রসাদী আগমনীও গেয়ে উঠতে পারতাম খালি গলাতে, সেই তখন হয়ে উঠত গণসঙ্গীত। সেই সন্ধ্যার বড়সড় এক বিপ্লব। যা ভাবা যায় তা কি আর করা যায়? ভাগ্যিস, আজকাল দেব অধিকারীর দৌলতে বাজারে খুব জনপ্রিয় হয়েছে, ‘ঢাকের তালে কোমর দোলে’ ...তো রক্ষা পেয়েছে বাংলা গান আর বাংলা ভাষা। ধ্বনি দিতেতো ইচ্ছেই করে, জয় বাজার বাবা কি জয়!
৩
দুর্গাপুজোর সঙ্গে বেলেল্লাপনাটা নতুন কিছু নয়। যারা জানেন এর ইতিহাস তারা জানেনই। কিন্তু জমিদারদের পুজোকে জনতার বারোয়ারি করবার আয়োজন যেমন দেখেছি, তেমনি বাজারের বণিক পুঁজির পুজো করে ফেলাটাও তো দেখছি। সবাই যখন এই পুজোকে নিয়ে টানা টানি করছিলেন, তখন একদল বুদ্ধিমান লোক এর একটা ধর্মনিরপেক্ষ সাংস্কৃতিক রূপও গড়ে তুলেছিলেন। এ সবাই জানেন যে দুর্গাপুজোকে ঘিরে বাকি ভারতে যাই হোক, অসমেও এক বিশাল সাংস্কৃতিক উত্থান ঘটেছিল বাঙালির নেতৃত্বে। বছর কয় আগে প্রকাশিত মার্ঘেরিটার শতাব্দী প্রাচীন দুর্গা পুজোর স্মরণিকা একটা পড়বার সৌভাগ্য হয়েছিল। সেখানে একটি লেখাতে পেয়েছিলাম, স্বাধীনতার আগে আগে পুজোর তিনদিনে নাটক হতো। দু দিন বাংলা, একদিন অসমিয়া। এক সময় অসমিয়ারা দাবি জানালেন, অসমিয়া নাটকও দু'দিন করতে হবে। বাঙালির বনেদি অংশটি তখন শাসকের জাত। প্রশাসনের বেশিটাই তাদের দখলে। সুতরাং ক্ষমতার দম্ভ ছিল। তারা জানালেন, হবে না। অভিমানে অসমিয়ারা বছর দুই আলাদা পুজো করলেন। বছর দুই পরে চারদিনে নাটকের আপস রফা হলে পরে দুই পুজো আবার এক হয়েছে। সেই স্মরণিকা পড়ে আমার মনে হয়েছে, অসমের শুধু প্রাচীন দুর্গাপুজোগুলোর ইতিবৃত্তও যদি কেউ আলাদা করে অধ্যয়ন করেন তবে এখানকার বাঙালি সমাজতো বটেই প্রতিবেশী অসমিয়া সমাজের সঙ্গে সম্পর্কটাও অনেক বেশি স্পষ্ট হবে। স্পষ্ট হবে শাসনের এবং শোষণের ইতিহাসটাও।
যে তিনসুকিয়া শহরে কিশোর কুমারের কণ্ঠে রাখাল ছেলের গল্প শুনতে দেয়া হলো না, এই শহরের প্রাচীন দুটি প্রেক্ষাগৃহই কিন্তু দুর্গাপূজাকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠা। প্রথমটি গোলাপ চন্দ্র রবি চন্দ্র নাট্য মন্দির এবং দ্বিতীয়টির নাম এখনো ‘দুর্গাবাড়ি প্রেক্ষাগৃহ।’ না, তার কোনোটিতেই এখন পুজোর তিনদিনে পারলৌকিক ধর্মসম্পর্করহিত মানবিক কোনো নাটক হয় না, গান হয় না, কবিতা পাঠের আসর বসে না, সেরকম কোনও আড্ডাই জমে না যে ‘তনু-দীপুর সাথে সেবার মিশন রোডে ভোর’ করে ফেলবার মতো নেশার টানে ছুটে যাবো। কিম্বা স্বপ্ন দেখবো যে একদিন ছুটে যাবে আমার সন্ততি। একমাত্র ‘উজান’ --একটি সাহিত্যের পত্রিকা এখনো লাজ রাখে এই শহরের ইহলৌকিক বৌদ্ধিক পরম্পরার । শারদ সংখ্যা হিসেবে বছরে একটি বেরোয়। এবারেও বেরিয়েছে । আর দুই একটা গানের সিডি বেরোয় কোনও বা বছর। শুনেছি এবারেও বেরিয়েছে। এখনো হাতে আসে নি। জানি না গেয়েছেন কে? কেই বা কথা লিখেছেন, দিয়েছেন সুর ।
৫
এই গল্পটি সত্যি। তনু দীপু নয়। ওটা কবিতার নাম। গদ্যের আসল নাম অভীক আর বিশ্বতোষ । আমার কৈশোর কালের বন্ধু। নতুন গোঁফ গজিয়েছে। বাড়ি থেকে বেরুবার বেহিসেবী অনুমতি মেলে। আর না মিললেও আদেশ অমান্য করবার সাহস জুটেছে। আমরা তিন বন্ধুই তখন এক সাংস্কৃতিক সংগঠনের সদস্য। সেই সুবাদে অন্য বহু সংগঠনের সদস্য সদস্যাদের সঙ্গে আলাপ আছে, আছে বন্ধুত্ব। সেরকমই এক আধো আলাপ হওয়া কিন্তু বহু চেনা শিল্পীর প্রেমে পড়েছে অভীক । এইবারে, অভিকের যন্ত্রণা যদি আমাদের সবার না হলো তবে আর বন্ধু কিসের! বন্ধুত্বের অগ্নি পরীক্ষা দেবার এমন সুবর্ণ সুযোগ কেউ হাতে পেয়ে ছুঁড়ে ফেলে! বহুদিন ধরে বহুভাবে চেষ্টাতেও অভিক কথাটা ওকে বলতে পারে নি। সে সময় শহরে সব চাইতে সুন্দরী শকুন্তলা। কন্যা থাকবে হয়তো আরো। কিন্তু তাঁর মতো আবৃত্তি করতে পারে ক’জনা। সে হোক রবীন্দ্রনাথের ‘দেবতার গ্রাস’, সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ‘মেজাজ’ । তো, পুজোর দিনগুলোতে তো আমাদের আর করবার কিছু ছিল না। আমরা স্থির করলাম অভীকের স্বপ্ন সফল করিয়েই ছাড়তে হবে। সে কবে কার! ১৯৮২-৮৩র কথা। অভীক থাকত তারাপুরের আর এম এস কোয়ার্টারে।ওর বাবা চাকরি করতেন। সপ্তমী অথবা অষ্টমী সন্ধ্যাতে আমরা জড়ো হলাম ওর বাড়িতে। এই তিন ছাড়াও ছিল , আরো দু’তিনজন । তাদের এখন নাম ভুলে গেছি। ঠিক হলো, নিশ্চয়ই সেই শকুন্তলা সেই রাতে শহরের কোনও মঞ্চে কবিতা বলবে। আর বলবেই যদি, যেখানে যত মঞ্চ আছে আমরা চষে ফেলব সেই রাতে। যেখানেই পাওয়া যাবে, সেখানেই অভীক ওকে দাঁড় করিয়ে দিয়ে বলবে,......! হারাবার আর কীই বা আছে, জয় করবার জন্যে আছে গোটা বিশ্ব। আমরা উদ্দীপনাতে ভরপুর। অভীক ও রাজি হয়ে গেল। শুরু হলো ইটখোলা পূজা মণ্ডপ থেকে। পায়ে হেঁটে। সেখান থেকে আর্যপট্টি। যে আর্যপট্টির পুজো বিখ্যাতই নাটকের জন্যে। নদী-বাঁধ ধরে এসে সদর ঘাটের সেতুর তলা দিয়ে ঘুরে তারাপুর কালী মোহন রোড। সেখান থেকে শেখরদার বাড়ির সামনে মিশন পাড়া, আরো সামান্য এগিয়ে পুলিশ রিজার্ভ । যে রিজার্ভে অতি অবশ্যি যাত্রা হতো। সেখান থেকে প্রেমতলা হয়ে নরসিংটোলা পৌঁছুতে পৌঁছুতে রাত্রি কাবার। জোনাকি তারারাও তখন ঘুমিয়ে পড়েছে, কোনও আসরেই সে এলো না। বলাটা হলোই না অভীকের । ক্লান্তিতে তখন আমাদের আর পা চলে না...। পরে বুঝেছি, ব্যাটা দেখা হলেও বলত না। এতোটা সাহস ছিল না ওর। রাজি হয়েছিল ছুটতে, যদি দেখাটুকু হয়ে যায়। একটুকু। ভিড়ের পেছন থেকে। সেটুকুই বা কম কীসে? শোনা হয়ে যায় তার কণ্ঠ...। হলো না...।
অভীক এখন কোথায় আছে? বহুদিন তার কোনও খবর জানি না। সেই আবৃত্তির কণ্ঠও শুনেছি, নীরব এখন।
তিনসুকিয়াতে? সত্যি নীরব... হয়তো বা সরব হবে। অন্য কোনওখানে। অন্য কোনো উৎসবের দিনে।