দিগন্ত শর্মা |
(দিগন্ত শর্মা,
সাদিন কাগজের সাংবাদিক এবং অনুসন্ধানী লেখক। এর আগে তিনি ‘ নেলি
১৯৮৩’ নামে
একটি অনুসন্ধানমূলক প্রতিবেদন লিখেছিলেন তিনি। বর্তমান অনুবাদক সেটি বাংলাতে অনুবাদ করেছিলাম। দু’টিই আগে পরে
বই হিসেবে বেরোয়। সেই বইতে মূলত ধরা হয়েছিল ধর্মীয় সংখ্যালঘু তথা মুসলমানদের উপরে নেমে আসা আক্রমণের ছবি। এবারে বাঙালি হিন্দুর উপরে কেমন অত্যাচার
নেমে এসেছিল, সেই প্রশ্নের উত্তর সন্ধানে তিনি ঘুরেছেন ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার পূব থেকে পশ্চিমে। আর লিখছেন এই নিবন্ধ।
ধারাবাহিক ভাবে এটি এই ব্লগ ছাড়াও প্রকাশিত হবে, আরো দুই একটি ব্লগে এবং ছাপার
অক্ষরে বেরুবে শিলচর থেকে প্রকাশিত চন্দন সেনগুপ্ত সম্পাদিত মাসিক ‘অরুণোদয়ে’। লেখকের
সঙ্গে কথা বলতে চাইলে যোগাযোগ করুন, এই নম্বরে: ৯৮৫৪৬-৩১৯২৮। )
( মিছিলা নমশূদ্র) |
মূল অসমিয়াঃ দিগন্ত শর্মা
বাংলা অনুবাদঃ সুশান্ত কর
১৯৭৯এর প্রথম
ভাগে অসমের মঙ্গলদৈ লোকসভা সমষ্টির সাংসদ হীরালাল পাটোয়ারির আকস্মিক মৃত্যু হয়। সে
বছরের শেষের দিকে আসনে উপনির্বাচনের সিদ্ধান্ত নেয় নির্বাচন আয়োগ। একই সঙ্গে ঐ
বছরের এপ্রিল মাস থেকে ভোটার তালিকাতে নাম ভুক্তির কাজ আরম্ভ করে। মে’ মাস
অব্দি এই ভোটার তালিকা সংশোধনের কাজ অব্যাহত ছিল। কিন্তু মে’মাসের
প্রথম সপ্তাহে ভোটার তালিকাতে প্রচুর অবৈধ বিদেশীর নাম ঢোকে গেছে বলে এক অভিযোগ
উত্থাপিত হয় । বলা হয়, কংগ্রেস (আই) দল
নিজের ভোট ব্যাঙ্ক শক্তিশালী করতে কৌশলে সন্দেহজনক
নাগরিকের নাম ভোটার তালিকাতে ঢুকিয়েছে। এই
অভিযোগ উত্থাপন করে পুরো আসাম কাঁপিয়ে তোলে ‘সারা
আসাম ছাত্র সংস্থা’। এর আগে অসমে বিদেশী অনুপ্রবেশ থেকে
শুরু করে বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের দাবিতে সারা আসাম ছাত্র সংস্থা, সংক্ষেপে
‘আসু’ বিভিন্ন প্রতিবাদী কর্মসূচী রূপায়ণ করে আসছিল। অন্যদিকে সংসদে তখন ভারতীয়
জনতা পার্টির নেতা অটল বিহারি বাজপেয়ী ১৯৭৯র আগেই অসম সহ সমগ্র পূর্বোত্তরে
বাংলাদেশীদের অবাধ অনুপ্রবেশ হচ্ছে বলে বক্তব্য রেখেছিলেন। সেই বক্তব্য অসমের
একাংশ সচেতন ব্যক্তি, রাজনৈতিক নেতা এবং ছাত্র সংগঠনের
নেতৃত্বকে আন্দোলনমুখী করে তোলে। এর আগে ‘আসু’ মুখ্যমন্ত্রী গোলাপ বরবরাকে কয়েক
দফা দাবি সম্বলিত স্মারকপত্র প্রদান করেছিল। এমনকি তারা প্রধানমন্ত্রীকেও সত্তর
দশকের মধ্য ভাগ থেকেই নানা দাবিতে স্মারকপত্র দিয়ে আসছিল। কিন্তু কেন্দ্রের সরকার
সেই সব সমস্যা সমাধানের জন্যে বিশেষ কোনো পদক্ষেপ নেয় নি। ১৯৭৭এ জরুরি অবস্থার পরে
কেন্দ্রের সরকার বদল হলো। অসমেও সরকার বদল
হলো। একই সময়ে অত্যন্ত শক্তিশালী ছাত্র সংগঠন সারা আসাম ছাত্র সংস্থারও নেতৃত্ব
বদল হলো। ‘আসু’র নেতৃত্বে এলেন
প্রফুল্ল কুমার মহন্ত এবং ভৃগু কুমার ফুকন।
মঙ্গলদৈ লোকসভা আসনের উপনির্বাচনকে কেন্দ্র করে উত্থাপিত বিদেশী নাগরিকের
প্রশ্নটিকে ‘আসু’ নেতৃত্ব বড় করে
তোলে ধরলেন। মঙ্গলদৈ লোকসভা চক্রে ভোটার তালিকাতে বিদেশী নাগরিকের নাম অন্তর্ভুক্ত
হয়েছে বলে নির্বাচনী আয়োগের কার্যালয়ে হাজার হাজার অভিযোগ পত্র প্রেরণ করে।
নির্বাচনী আয়োগ সেগুলো পরীক্ষা নিরীক্ষাও করেন। গুরুত্বপূর্ণ কথা এই যে নির্বাচন
আয়োগও এই সব অভিযোগ-পত্রের ৬৪.২৮% সত্য
বলে ঘোষণাও করে। অর্থাৎ আয়োগ স্বীকার করে নেয় যে প্রায় ৪৫,০০০
ভোটার এই চক্রে সন্দেহজনক নাগরিক।
মিছিলা নমশূদ্র |
দিগন্ত শর্মার আগেকার বইএর বাংলানুবাদের প্রচ্ছদ |
(এক)
সবুজ
আর্নে চরের রক্তাক্ত অধ্যায়
ছেঁড়া পা ছুঁয়ে মিছিলা নমশূদ্র নীরবে কাঁদছিলেন |
মিছিলা নমশূদ্র
যখন আমাদের কথাগুলো বলছিলেন কচি কাঁচা ছেলে মেয়ে, যুবক যুবতী, বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা পাশে
দাঁড়িয়ে বসে সব কথাই শুনছিলেন। কিছুক্ষণ সবাই নির্বাক হয়ে পড়লেন। নীরবতা ভেঙ্গে
আমরাই মহিলাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তার পরে কী হলো?’
‘তারপরে আমি সেখানেই পড়ে রইলাম। পরে গ্রামের অন্য
মানুষকে সঙ্গে নিয়ে আমাকে তুলে নিয়ে এলেন স্বামী। জ্ঞান যখন ফিরে এলো, আমার
অবশিষ্ট পাটুকু কাপড়ে বাঁধা ছিল। অসহ্য ব্যথায় আমি ছটফট করছিলাম। এরই মধ্যে আমি
স্বামীকে জিজ্ঞেস করলাম ছেলেমেয়ের কথা। তখনই তিনি হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করলেন।
বললেন, আমাদের বারো বছরের ছেলে বিজয় আর ছয় বছরের মেয়ে শ্রীমতীকে ঘাতকেরা কেটে মেরে
ফেলেছে। আমি যেখানে পড়ে ছিলাম, সেখানেই বুঝি বিজয় আর শ্রীমতীরও মৃতদেহ পড়ে
ছিল। স্বামীকে জিজ্ঞেস করলাম, বড় মেয়ে
রীণা কই? তিনি বললেন, রীণার (১৬) হাতে দায়ের ঘা পড়েছে, পিঠে একটা তির বিঁধেছে। ওকে
মাটিতে পড়ে থাকতে দেখে হয়তো ওরা মৃত বলে ভেবেছিল, ছেড়ে চলে গেছে। আমার পা কাটার
যন্ত্রণা দ্বিগুণ বাড়িয়ে দিল এই সন্তান হারাবার দুঃখ, এরপরে স্বামী আমাকে ভৈরবপুর আশ্রয় শিবিরে নিয়ে এলেন...।’
‘ঠিক
মনে নেই। কিন্তু এটা মনে আছে---আমার এই পা আর সন্তানকে কেড়ে নিয়ে গেছে অসমিয়াদের
যে আক্রমণ সেটি ঘটেছিল ১৯৮৩র ফেব্রুয়ারি মাসে। মানে ফাল্গুন মাসের প্রথম সপ্তাহে।
সেদিনটির পরে আর আমি স্বামী ছাড়া নড়াচড়া করতেই অক্ষম হয়ে গেলাম। এদিকে আমাদের বাড়িঘরও আক্রমণকারীরা জ্বালিয়ে
ফেলেছিল। আশ্রয় শিবির থেকে প্রথমে লখিমপুর হাসপাতালে, পরে ডিব্রুগড় হাসপাতালে থেকে
মাস ছয়েক চিকিৎসা করালাম। এর পরে গ্রামে
যদিও বা ঘুরে এলাম বছর না ঘুরতেই হঠাৎই একদিন আমার স্বামী নরেশ নমশূদ্রের মৃত্যু হলো। বাড়িতে পড়ে রইলাম সেই
দাঙ্গাতে পঙ্গু আমি আর আমার কন্যা। আমার পা নেই, আর কন্যা রীণার আহত হাত। উঃ কী যে
যন্ত্রণা...!’
ছেঁড়া
পা ছুঁয়ে মিছিলা নমশূদ্র নীরবে কাঁদছিলেন। তাঁর বয়স এখন ষাট পার করেছে। ৩২ বছর আগে
বিদেশী বিতাড়নের নামে অসমিয়া জাতির
অস্তিত্ব রক্ষার নাম নিয়ে হাতে কর্মে একাংশ বাঙালির উপরে যে হিংস্র আক্রমণ সংঘটিত
হয়েছিল, তারই সাক্ষী হিসাবে আজও ধেমাজি জেলার শিলাপাথার থানার অন্তর্গত আর্নে রামনগর গ্রামে আছেন মিছিলা নমশূদ্র। স্বামীর মৃত্যুর পরে সম্পূর্ণ অসহায় হয়ে
পড়েছিলেন মিছিলা। কিন্তু আন্দোলনকারী দায়ের ঘায়ে আহত কন্যা রীণাকে স্থানীয় এক তরুণ
বিয়ে করে, মিছিলার দৈনন্দিন জীবনের চালিকা শক্তি এখন সেই মেয়ে জামাইই। দুখানি ক্র্যাচ দু’দিকে ধরে কোনোক্রমে চলাফেরা
করেন মিছিলা। প্রতিমুহূর্তে তাঁর ছেঁড়া পা তাঁকে মনে করিয়ে দেয় অসমিয়া জাতির
সংগঠিত সেই নৃশংসতা আর বর্বরতার কথা। শুধু যে এই মিছিলা নামের মহিলাটির বেলা, তাই
নয়। বৃহত্তর আর্নে চর অঞ্চলে মিছিলা নমশূদ্রের সেই ছিন্ন পাখানি এখন অসমিয়া
উগ্রজাতীয়তাবাদের নির্মম ঘৃণনীয় তথা নারকীয় অধ্যায়ের জ্বলন্ত সাক্ষ্য। মিছিলা যখন ক্র্যাচ
দু’খানাতে ভর করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এদিকে ওদিকে ঘুরে বেড়ান, তখনই যেন গ্রামবাসীর
(সে সময়ের ভুক্তভোগী) চোখে ভেসে উঠে নৃশংস সেই সব আক্রমণের ছবি।
পক্ষের শূন্য কপাল |
মহিলাটি কথা
থামালেন। খানিক সবাই নিস্তব্ধ হয়ে রইলেন। তারপরে বড় কষ্টে আটকানো গলাতে মহিলাটি
বলে গেলেন, ‘ সেদিন আমার সামনেই স্বামীকে হত্যা করল ওরা। আমাকেও আক্রমণকারীরা
মারতে আসছিল। স্বামী আমাকে দৌড়ে পালাতে বলে নিজে ওদের বাধা দিতে দৌড়ে গেলেন। দুই
পা দৌড়ে গেছি কি পেছনে ফিরে দেখি, আমার স্বামীকে কোপাচ্ছে ওরা। উনি গড়িয়ে পড়ে
গেছেন, সেই শরীরে লাঠি দিয়ে ঘা দিচ্ছে।
তারপরে কিছু লোকে আমাদের বাড়িতে আগুন দিল।
আমি দৌড়ালাম। ইতিমধ্যে গ্রামের মানুষজনও দৌড়োচ্ছে প্রাণ বাঁচাতে। আমি দৌড়ে
দৌড়ে প্রাণ বাঁচালাম। কিন্তু আমার সিঁথির সিঁদুর হারালাম। বিয়ের মাত্র সাতদিন
পরেই।' আমাদের সামনেই মহিলাটি হুহু করে কেঁদে ফেললেন। আমরা দেখে গেলাম শুধু---তাঁর
দুই গাল বেয়ে নামছে চোখের জল। দেখে গেলাম, তাঁর শূন্য কপাল। গেল তিনটা দশক তিনি
পার করেছেন এই দুঃখের বোঝা বয়ে বয়ে। বিয়ের
সময় তাঁর বয়স ছিল মাত্র ষোল। নাম তাঁর পক্ষ নমশূদ্র। আর্নে রামনগরের উপেন্দ্র
নমশূদ্রের বাইশ বছরের ছেলে মাণিক নমশূদ্রের সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল পক্ষের। মিছিলার
ছিন্ন পা, পক্ষের শূন্য কপাল---অসমিয়া উগ্রজাতীয়তাবাদী , অসমের অস্তিত্ব রক্ষার
নামে সংগঠিত ঘাতক বাহিনী এই সমাজকে দেয়া ‘নির্মম উপহার’ ।
(ক্রমশ:)
~~~~০০০~~~
লেখাটি আর যেখানে পড়া যাবেঃ
১) http://swabhimanngo.blogspot.in/2015/05/blog-post_28.html
২) http://ishanerpunjomegh.blogspot.in/2015/05/blog-post_28.html
লেখাটি আর যেখানে পড়া যাবেঃ
১) http://swabhimanngo.blogspot.in/2015/05/blog-post_28.html
২) http://ishanerpunjomegh.blogspot.in/2015/05/blog-post_28.html