দিগন্ত শর্মা |
(দিগন্ত শর্মা,
সাদিন কাগজের সাংবাদিক এবং অনুসন্ধানী লেখক। এর আগে তিনি ‘ নেলি
১৯৮৩’ নামে
একটি অনুসন্ধানমূলক প্রতিবেদন লিখেছিলেন তিনি। বর্তমান অনুবাদক সেটি বাংলাতে অনুবাদ করেছিলাম। দু’টিই আগে পরে
বই হিসেবে বেরোয়। সেই বইতে মূলত ধরা হয়েছিল ধর্মীয় সংখ্যালঘু তথা মুসলমানদের উপরে নেমে আসা আক্রমণের ছবি। এবারে বাঙালি হিন্দুর উপরে কেমন অত্যাচার
নেমে এসেছিল, সেই প্রশ্নের উত্তর সন্ধানে তিনি ঘুরেছেন ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার পূব থেকে পশ্চিমে। আর লিখছেন এই নিবন্ধ।
ধারাবাহিক ভাবে এটি এই ব্লগ ছাড়াও প্রকাশিত হবে, আরো দুই একটি ব্লগে এবং ছাপার
অক্ষরে বেরুচ্ছে শিলচর থেকে প্রকাশিত চন্দন সেনগুপ্ত সম্পাদিত মাসিক ‘অরুণোদয়ে’। এবারে দ্বিতীয় পর্ব। লেখকের
সঙ্গে কথা বলতে চাইলে যোগাযোগ করুন, এই নম্বরে: ৯৮৫৪৬-৩১৯২৮। )
মূল অসমিয়াঃ দিগন্ত শর্মা
বাংলা অনুবাদঃ সুশান্ত কর
হাত জোড় করছি – জমি বাড়ি সব ছেড়ে যাবো, আমাদের মেরো না: মহিলার নাম সোনামতি। ৮৩র ফেব্রুয়ারির হিংসাত্মক ঘটনার কথা বলতে গিয়ে মুখ খুলেই হু হু করে কাঁদতে শুরু করলেন। শাড়ির আঁচলে দুই গাল বেয়ে নেমে আসা চোখের জল মোছবার চেষ্টা করলেন যদিও, স্রোত থামবার নামই করল না। মুহূর্ত কয় আমরাও বেশ অস্বস্তি অনুভব করলাম। “মহিলাকে সেই সব দুঃখের দিনের কথাগুলো জিজ্ঞেস করে কি ভুল করলাম কিছু?”—এমন একটা ভাবনা নাড়িয়ে গেলো। ঠিক সেই সময় আর্নে রামনগরের কিছু মানুষ বলতে শুরু করলেন---না কেঁদে থাকবে কী করে? চোখের সামনে পরিবারে সমস্ত মানুষকে মেরে ফেলল।
ধীরে ধীরে সোনামতি বলতে শুরু করলেন, “
ওই উত্তর দিক থেকে লাঠি-বল্লম-তিরধনুক-তলোয়ার নিয়ে প্রচুর মানুষে যখন আমাদের
বাড়িটি ঘিরে ফেলল, পালাতে চাইলাম। কিন্তু পারলাম না। আক্রমণকারী দলটি আমাদের
পরিবারটিকে ধরে ফেলল। আমি ওদের পায়ে ধরে
কাকুতি মিনতি করলাম, “হাত জোড় করছি, পায়ে পড়ছি। এই জমিবাড়ি ছেড়ে আমরা চলে
যাবো।আমাদের মেরো না।” খানিক থেমে জল চোখে তিনি আরো বললেন, “ কিন্তু ওরা আমার
অনুরোধে কান দিল না। আমার চোখের সামনে আমার মানুষটিকে (স্বামী), আমার মা আর চার
বছরের মেলে চামেলিকে ঘা মারতে শুরু করল। আমি দু’বছরের ছেলে কাজলকে নিয়ে যে দিকে
চোখ যায় দৌড়োলাম। কিন্তু পেছন থেকে কেউ একজন আমাকে লাঠির ঘা মারতেই আমি গড়িয়ে
পড়লাম। তারপর আর কিছুই বলতে পারি না। পরদিন দু’জন মানুষ আমাকে ধরে দাঁড় করিয়ে
দিলেই দেখলাম, আমি বাড়ির কাছেই পড়েছিলাম। আমার পাশেই শুয়ে শুয়ে কাঁদছে ছেলে কাজল।
ঐ দু’জনের একজন আমাকে ধরে দাঁড় করিয়ে গ্রামের অন্য মাথায় শিবিরে নিয়ে এলেন। অন্যজন
কাজলকে কোলে করে নিয়ে এলেন। গ্রামের লোকেরাই জানালো সেদিনের আক্রমণে আমার বর
রাজকুমার নমশূদ্র, মা কুমুদিনী নমশূদ্র , আমার মেয়ে চামেলি মারা গেছে...।
ওদিকে সেই সময়, আমি চারমাসের গর্ভবতী ছিলাম। সব হারিয়ে আমি উপায়হীন
হয়ে পড়লাম। আহত শরীর , পেটে বাচ্চা। সেই
সঙ্গে আহত দুবছর বয়সী কাজল। শিবিরে যে ডাক্তারেরা এসেছিলেন, তারা তার চিকিৎসা
করেছিলেন বটে কিন্তু মাস কয় পরে সেও মারা গেল। ভালো চিকিৎসা করাতে পারলাম না। গর্ভের সন্তানটিই জীবনের ভবিষ্যৎ ভেবে আশাতে বেঁচে রইলাম। সেই সন্তানেরই আমি মা এখন।
সেই অন্যায়ের বিচার আমি পেলাম না। হয়তো ন্যায়, কোনোদিনই পাবো না। ...”
ঈশ্বর নমশূদ্রের সারা গায়ে এখন আঘাতের চিহ্ন |
সোনামতি, পক্ষ, মিছিলা...অজস্র মহিলার
জীবনে অন্ধকার নামিয়ে এনেছিল বিদেশী বহিষ্কার আন্দোলনের ফ্যাসিস্ট কার্যকলাপ। সারা
আসাম ছাত্র সংস্থা, সারা আসাম গণসংগ্রাম পরিষদ এবং এদের সমর্থক (অসম সাহিত্য সভা)
সংগঠনের নেতৃত্বে একাংশ উগ্র-অসমিয়াদের দ্বারা
সংগঠিত বাংলাভাষী গণনিধন কাণ্ডের পরিণতিতে
ধেমাজির শিলাপাথারের নিকটবর্তী আর্নে রামনগর গ্রামের বহু পরিবার নিঃশেষ হয়ে গেছিল। কিন্তু
শুধু ঐ আর্নে রামনগরই নয়। এই গ্রামের পাশের ‘আর্নে তিরাশি’ গ্রামেও শতাধিক মানুষকে
এরা হত্যা করেছিল। ‘অসমের অস্তিত্বরক্ষা’র আন্দোলনের ঘাতক বাহিনীর লোকেরা।
শিলাপাথারের কাছের বৃহত্তর আর্নে চর অঞ্চলের অন্তর্গত ‘আর্নে তিরাশি’ নামের
গ্রামেই ১৯৮৩র ফেব্রুয়ারি মাসে সব চাইতে বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। গ্রামের নাম এমন হবার কারণ ছিল, মাত্র তিরাশিটি
পরিবার শুরুতে এই গ্রাম বসিয়েছিল। সেই তিরাশি
পরিবারের গ্রামে মৃতের সংখ্যা ছিল শতাধিক। গ্রামের কোনো এক পরিবারের একটি কুঁড়েঘরও
যদি দাঁড়িয়ে থাকতো। আক্রমণকারীরা পুরো গ্রাম জ্বালিয়ে নিঃশেষ করেছিল। সেই গ্রামের
এক ব্যক্তি ঈশ্বর নমশূদ্র। প্রায় ৭০ বছর বয়সের এই বৃদ্ধের বিদেশী বিতাড়ন
আন্দোলনের সময় বয়স ছিল দুই কুড়ি। ঈশ্বর
নমশূদ্রের সারা গায়ে এখন আঘাতের চিহ্ন।
মাথাতে যদি দায়ের ঘায়ের চিহ্ন, পিঠে বল্লমের, পায়ে বন্দুকের গুলির চিহ্ন ,
তো হাতে তলোয়ারের ঘা। বুকে ধনুক থেকে ছোঁড়া তির বেঁধার চিহ্ন স্পষ্ট।
মাথাতে যদি দায়ের ঘায়ের চিহ্ন |
ঈশ্বর নমশূদ্র বলছিলেন, “আমাদের
গ্রামের চারদিকে উঁচু উঁচু খাগের জঙ্গল ছিল। তাই আক্রমণ করতে ওরা ঠিক কোনদিক থেকে
আসছিল ধরা যায় নি। কিন্তু ওরা যে হা রে রে রে !---- করে আসছিল সেটা টের পাওয়া
যাচ্ছিল। কী করা ঠিক হবে ভাবতে ভাবতেই
ভোরের দিকে অসমিয়া, মিশিং জনগোষ্ঠীর একাংশ মানুষ গ্রাম ঘিরে ফেললো। হাতে তাদের
অগুণতি অস্ত্র-শস্ত্র। আমাদের বাড়ি ছেড়ে পালাবার বাইরে উপায় ছিল না। তাই সবাই
দক্ষিণের ব্রহ্মপুত্র নদীর দিকে দৌড় দিল। কিন্তু ওরা যে আমাদের সবাইকে ঘিরে
ফেলেছে, বুঝতে পারি নি। অন্যদের মতো আমিও ন’মাসের ছেলে অজিতকে কোলে করে প্রাণ
বাঁচাতে দৌড় দিলাম। কিন্তু সামনের থেকে একদল লোক আমাকে আটকে দিল। ওদের কেউ আমাকে
লম্বা লাঠি দিয়ে মারলো । আমি গড়িয়ে পড়ে
গেলাম। আমার হাত থেকে ছিটকে পড়ে গেল
ন’মাসের শিশুটি। কই পড়ল ---দেখবার জন্যে ফিরে তাকাতেই দেখি মাটিতে পড়ে কাঁদছে
শিশুটি, ওকেই ঘা মেরে দুই টুকরো করে ফেলল। দেখে আমি চীৎকার করে উঠেছি কি, ওদের কেউ
আমাকে দা দিয়ে ঘা দিল, কেউ বল্লমে খোঁচালো,কেউ তির দিয়ে বুকে পিঠে বিঁধল। ওরা গেল কিন্তু
পরে ঘরে আগুন দিতে এলো আরো একদল, তারা গুলি ছুঁড়লে আমার পায়ে গুলি লাগলো।আমি
অজ্ঞান হয়ে পড়ে রইলাম। সেদিন সন্ধ্যাতে কেউ আমাকে তুলে নিয়ে গেলো। পরদিন আশ্রয়
শিবিরে ডাক্তার এলো।চিকিৎসা করল। প্রায় এক মাস পরে লখিমপুর গিয়ে হাসপাতালে ভর্তি
হলাম। আমার পুরো শরীরে আঘাতেচিহ্নগুলোর চিকিৎসা করাতে গিয়ে বহু টাকা ব্যয় হলো।
আজও কখনো শরীরের প্রচণ্ড ব্যথাতে আমি ছটফটাতে থাকি। সেই নৃশংস আক্রমণে মরে গেলে ভালোই ছিল। কিন্তু
মরলাম না। মানুষের হিংস্রতার সাক্ষী হয়ে বেঁচে আছি। কিন্তু শরীরে আঘাতের
ব্যথা-বেদনার থেকেও মনে যে ঘায়ের দাগ থেকে গেলো ---তার যন্ত্রণা
যে কী বিষম বোঝাতে পারবো না। সেই যন্ত্রণার চিকিৎসা হাসপাতালে হবে কী করে?
পিঠে বল্লমের |
পায়ে বন্দুকের গুলির চিহ্ন |
তো হাতে তলোয়ারের ঘা |
বুকে ধনুক থেকে ছোঁড়া তির বেঁধার চিহ্ন স্পষ্ট |
আর্নে তিরাশি গ্রামের ঈশ্বর নমশূদ্রের সারা শরীরের আঘাতের দাগগুলো
শুধু ঐ বল্লম-দা-তলোয়ার-তিরধনুকের আঘাতের দাগ নয় । তাঁর শরীরের
প্রতিটি ক্ষতচিহ্নই ‘অসম –অসমিয়ার অস্তিত্বে’র নামে একাংশ ‘খিলঞ্জিয়া’ অসমিয়ার
সুপরিকল্পিত ভাবে প্রদর্শন করা নির্লজ্জ হিটলারি চরিত্রের স্বাক্ষর। ‘অসম
আন্দোলনে’র নেতৃত্ব তথা সমর্থক লোকজনের সৃষ্ট ফ্যাসিবাদী কার্যকলাপের জ্বলন্ত
প্রমাণ।
ঈশ্বর নমশূদ্র যখন কথাগুলো বলছিলেন
আর্নে তিরাশি গ্রামের মানুষজন ভিড় করেছিলেন। তারই মধ্যে এক বৃদ্ধা মাথায় গালে হাত
দিয়ে কথাগুলো শুনছিলেন। ঈশ্বরের দিকে পলক না ফেলে তাকিয়ে ছিলেন। তাঁর সঙ্গে যখন
কথা বলতে চাইলাম, গ্রামের লোকেরা বললেন, তিনি ভালো করে কথা বলতে পারেন না। আগে
গ্রামের একজন সক্রিয় মহিলা ছিলেন তিনি। তাঁর নাম দিবাসী নমশূদ্র। শরীরে তাঁর তির বিঁধেছিল। যখন দৌড়ে পালাচ্ছিলেন তিরের ঘায়ে গড়িয়ে পড়েছিলেন। পড়ে পড়েই
দেখছিলেন তাঁর বাবা-স্বামী-পুত্রকে কোপিয়ে কোপিয়ে কাটছিল। সেই থেকে দিবাসী আগের
মতো আর কথা বলতে পারেন না। এমনকি স্বামী-পুত্র এবং বাবার নামগুলোও ভুলে গেছেন।
কারো বুঝতে বাকি থাকে না যে ১৯৮৩র ফেব্রুয়ারি মাসে ‘আসু’, ‘সারা আসাম গণসংগ্রাম
পরিষদে’র নেতৃত্বে চলা আন্দোলনের অস্ত্রধারীরা যখন বাঙালিদের উপরে আক্রমণ নামিয়ে
এনেছিল এমন বহুজনের জীবনে অন্ধকার নামিয়ে এনেছিল।
দিবাসী নমশূদ্রের মতো মহিলার জীবনেও নামিয়ে এনেছিল অকাল অন্ধকার---যার
জন্যে তিনি হারালেন স্মৃতিশক্তি।
অসমের
অস্তিত্বরক্ষার নামে আন্দোলনকারীর হিংস্রতাতে
নিস্তব্ধ কিশোর,
নিঃশেষিত পরিবার:
“আমাদের আর্নে তিরাশি গ্রামে
আন্দোলনকারীরা যখন আক্রমণ করে কে কোনদিকে
পালিয়েছিল কোন ঠিক-ঠিকানা ছিল না। সবাই শুধু প্রাণটাই বাঁচাতে চাইছিল। পরদিনই শুধু
আমরা জানতে পারছিলাম কার পরিবারের কতজন মরেছে, বা কার ঘরে কতজন বেঁচে আছে। গ্রামের একটাও ঘর দাঁড়ানো ছিল না। সব কটিতে এই
আক্রমণকারীরা আগুন দিয়েছিল। ঘটনার পর দিনে পুরো আর্নে তিরাশি গ্রামে হিসেব
করে বের করতে হয়েছিল, কে আহত, কে নিহত আর কারাই বা অক্ষত বেঁচে আছেন। আমাদের
গ্রামের লোকজনের খবর করে, খোঁজে বের করে , নদীর পারেও গিয়ে মানুষজনকে জিজ্ঞেস করে
দেখি পনেরো ষোল বছর বয়সের কিশোর মাখনদের বাড়ির লোকজন কাউকে পাওয়া যাচ্ছে না।”
---আর্নে তিরাশি গ্রামের এক বৃদ্ধ আমাদের সামনে ‘সংঘাতকালে’র বর্ণনা দিচ্ছিলেন এই
ভাবে। তিনি যখন কথাগুলো বলছিলেন, এক যুবক তাঁর মুখের দিকে তাকিয়েছিল নিষ্পলক। তাকে
দেখিয়ে বৃদ্ধ বললেন, এই সেই মাখন নমশূদ্র। আন্দোলনকারীদের নিপীড়নের শিকার। ঘটনার
পরদিন ওকে নদীর পার থেকেই উদ্ধার করা হয়েছিল। ওর বাবা সার্থক নমশূদ্র, মা
ময়নাবালা এবং তিন বোনের মৃতদেহ পাওয়া
গেছিল গ্রামের মাঝ বরাবর বেরিয়ে যাওয়া পথের পাশে।” জিজ্ঞেস করলাম, ওর তিন বোনের
নাম কী ছিল? মাখন সামান্য অপেক্ষা করে কী যেন মনে করল। আর আটকানো স্বরে বলল,
বীণামতি নমশূদ্র, রশুমতি নমশূদ্র, খকিলা নমশূদ্র।
বলেই
মাখন ওখানে বসেই হু হু করে কেঁদে ফেলল। কিছুক্ষণের জন্যে আর্নে তিরাশি গ্রামে
আমাদের মাঝখানে মৌনতা ছেয়ে ধরল। সেই মৌনতা আবার ভাঙল, “ ওকে আমরা এর পরে গ্রামের
মানুষই বড় করলাম। ঘর সাজিয়ে দিলাম নিরাশ্রয় ছেলেটির। ওকে সান্ত্বনা দেবার আরো কোনো
ভাষা আমাদের জানা ছিল না।” সেই বৃদ্ধ আবার বললেন, “ মাখনের পরিবারের তবু একজন
বেঁচে রইল। কিন্তু আরান মণ্ডলের পরিবারের সব্বাইকে হত্যা করেছিল আন্দোলনকারীরা।
মোট কথা শতাধিক মানুষকে এরা সেদিন খুন করেছিল। আহতেরতো কোনো হিসেবই নেই। গেল তিনটা
দশক ধরে আমরা অপেক্ষা করে রইলাম, এই গণহত্যার, এই নির্মম কাণ্ডের বিচার হবে। ন্যায় পাবো আমরা---দোষীরা শাস্তি
পাবে। কিন্তু দেখলাম এই দেশে আমাদের মতো নির্যাতিতেরা বিচার পায় না। এই গণতন্ত্র,
এই প্রশাসন ব্যবস্থার প্রতি আমাদের আস্থা হারিয়ে গেছে। আমাদের আর্নে চরাঞ্চলের
গ্রামগুলোতে আক্রমণ করে গ্রামের মানুষজন তাড়িয়ে অসমিয়াদের দখলে নেবার চেষ্টা
করেছিল আক্রমণকারীরা। আক্রমণ করবার সময়
আমাদের বাঙালিদের বিদেশী বলে প্রচার করেছিল। সেসব কথা আমরা সেই ঘটনার পরে জানতে
পাই। কিন্তু সত্যিই কি আমরা বিদেশী?” ---তাঁর মুখ থেকে নিরবচ্ছিন্নভাবে বেরুচ্ছিল
কথাগুলো। তাঁর কথাতে ক্ষোভ আর হতাশার ছবি
স্পষ্ট।
উগ্রজাতীয়তাবাদী
অসমিয়াদের একাংশ মানুষ আর্নে চরাঞ্চলের হাজার হাজার জনতার উপরে আক্রমণ চালাবার
জন্যে যে পূর্বপরিকল্পনা করেছিল, গোপনে সংগঠিত হয়েছিল---লখিমপুর জেলার (তখনকার)
বিভিন্ন জায়গার মানুষ সেই সব কথাও এই বাঙালি মানুষজনে পরে জেনেছিলেন। কিন্তু যে
দুই গ্রামের কথা লিখলাম, তারও আগে এই পুরো চরাঞ্চলে প্রথম আক্রমণ এরা নামিয়েছিল
নলবাড়ি গ্রামে।
প্রথম আক্রমণ হয়েছিল নলবাড়িতে।
যেখানে ঘরের ভেতরেই জ্বালিয়ে দেয়া
হয়েছিল সোনাই মণ্ডলকে।
আর্নে রামনগর, আর্নে তিরাশি, পানবাড়ি, কাকবাড়ি , মুক্তিয়ার, বর্মণ বস্তি, কেম্পবস্তি, দিঘলীয়া বস্তি ইত্যাদি গ্রামে প্রায় একই সময়ে আন্দোলনকারীরা আক্রমণ চালিয়েছিল। কিন্তু এগুলোর ভেতরে প্রথম আক্রমণ করেছিল কই?
ভুক্তভোগী
লোকজন আমাদের জানালেন, প্রথমে আক্রমণ হয়েছিল টেঙানি নলবাড়ি গ্রামে। আর্নে
চরাঞ্চলের অন্তর্গত নলবাড়ি গ্রামের একাংশ মানুষ জানিয়েছিলেন সেই ভয়াবহ দিনের
কথা। সেই গাঁয়ের সঞ্জয় রায়ের বাড়িতে বসে
গ্রামের বয়োজ্যেষ্ঠ কিছু মানুষ আমাদের সামনে বর্ণনা করেন, ১৯৮৩র ফেব্রুয়ারিতে বিদেশী
বহিষ্কার আন্দোলনের সময় তাদের উপরে আক্রমণ নামার দিনের কথা। সে গ্রামের সুনীল রায়
বলছিলেন, “আমাদের গ্রামের চারপাশে নলবন ছিল। লম্বা লম্বা নলবনে ভরা ছিল বলেই এই
গ্রামের নাম পড়েছিল নলবাড়ি।” এমনিতে এর আসল নাম টেঙানি নলবাড়ি।
একাজান
গ্রামপঞ্চায়েতের অন্তর্গত আমাদের টেঙানি নলবাড়ি গ্রামেই প্রথম আক্রমণ করেছিল,
আক্রমণকারীরা। হাজার হাজার অসমিয়া, আর জনজাতি মানুষ এসে ভোরে আমাদের গ্রামে আক্রমণ করে, আর অতি
নৃশংসভাবে সোনাই মণ্ডলকে হত্যা করে।”
এইটুকু বলে কিছু সুনীল রায় কিছুক্ষণ
থামলেন। তাঁর পাশেই বসেছিলেন সেই গ্রামের আরো
কিছু মানুষ। তাদের দিকে তাকিয়ে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, “ সোনাই মণ্ডলের বৌয়ের নাম কী
ছিল যেন?” কেউ একজন জবাব দিলেন, “শ্যামলা।” “হ্যা, শ্যামলা।”আবার বলতে শুরু করলেন
সুনীল রায়, “ ওরা যে আমাদের গ্রামে আক্রমণ করবে সে আমরা আগেই খবর পেয়েছিলাম। অসমিয়াদের একাংশ যদিও আমাদের আক্রমণ করতে
এসেছিল, তাদেরই একাংশ আমাদের আগেই জানিয়ে দিয়েছিলেন যে ছাত্র সংস্থার নেতৃত্বে
আন্দোলনের সমর্থকেরা যেকোনো সময় গ্রামগুলোতে আক্রমণ নামাতে পারে। খারাপ মানুষের মতো ভালো মানুষওতো আছে। খবরটি পেয়ে আমরা গাঁয়ের লোকে রাতে রাতে পাহারা
দেবার গ্রামরক্ষী বাহিনী তৈরি করেছিলাম।
আমাদের গ্রামে যখন আক্রমণ করে তার সামান্য আগেই গ্রামরক্ষীরা সারা রাত
পাহারা দিয়ে গিয়ে শুয়েছিল মাত্র। গ্রামের একদিকে তাদের জন্যে একটা বাঁশখড়ের ঘরও
তৈরি করা হয়েছিল। পাহারা শেষে সোনাই মণ্ডল সেখানেই শুয়ে পড়েছিল। ও গভীর ঘুমে শুয়ে
থাকতেই আমাদের গ্রাম আক্রান্ত হলো। লোকে
পালাতে শুরু করল। হুলস্থূল চারদিকে।সবাই আর্তনাদ, চিৎকার চেঁচামেচি করে দৌড়াদৌড়ি শুরু করল। কিন্তু সোনাই মণ্ডল সেই ঘরে
শুয়ে ছিল। ওকে সেখানেই আক্রমণকারীরা পেল, আর দা দিয়ে কোপালো। ঘরে আগুন দিয়ে সেই
আগুনেই ওকে ছুঁড়ে ফেলল। পরে শুনতে পাই, আগুনে ছুঁড়ে ফেলবার আগে অব্দি সোনাই বেঁচে
ছিল। ওদিকে সোনাইর বৌ শ্যামলা দৌড়ে প্রাণ বাঁচালো যদিও স্বামীর মৃত্যুর পরে এ রাজ্যে থাকবে না বলে পশ্চিমবাংলার
ক্রান্তিহাটে চলে যায়। এখানকার জমি বাড়ি সব ত্যাগ করে চলে যায় শ্যামলা।” সুনীল রায়
যখন কথাগুলো বলছিলেন তখন সঞ্জয়ের মতো একালকার তরুণরা নীরবে কথাগুলো শুনছিল। সেখানে
আরো কিছু যুবতী, বৌমানুষেরাও ছিল যারা সেই নৃশংস ঘটনাগুলো দেখে নি। কিন্তু গ্রামের
বড়োদের মুখে তিন দশক আগেকার সেই নির্মম ঘটনা শুনে নতুন প্রজন্মের কী ধারণা হবে
সেটাই প্রশ্ন।
সুনীল
রায় আরো বললেন, “ গ্রামেরই জগদীশ সরকারের কন্যা শেফালি সরকারকে (১৫) ওরা কোপিয়ে
খুন করে। কী দোষ ছিল ঐ কিশোরীর? সেভাবেই নিরুদ্দেশ হয়ে গেল হরিপদ রায়। সেরকম আরো
বহু পুরুষ-মহিলার আজঅব্দি কোনো খবর বেরোয় নি। বহুদিন পরে নলবনের মাঝখানে কিছু নরকঙ্কাল
পাওয়া গেছিল। কিন্তু সেই নরকঙ্কালগুলো ছিল
কাদের শনাক্ত করবে কে? আমাদের গ্রামের
অনেকেই দৌড়ে দৌড়ে প্রাণ বাঁচালেন যদিও পরে শুনেছি এই গ্রামে হামলা করবার পরে ওরা
শিলাপাথার থেকে ব্রহ্মপুত্রের পাড় অব্দি পুরো অঞ্চলটিতেই বিদেশী খেদার নামে আক্রমণ
নামিয়েছিল।”
অসমিয়া
উগ্রজাতীয়তাবাদী তথা বিদেশী খেদার জন্যে মারণাস্ত্র যারা এসেছিল, বা বিদেশী বলে
ভেবে ‘মানুষে’র বাড়ি ঘরে আগুন দিয়ে ‘অগ্নিশিখা’ নিয়ে অসমিয়া জাতির ‘অস্তিত্ব’
রক্ষা করতে যারা এসেছিল তারা শিলাপাথারের বৃহত্তর অঞ্চলে চালিয়েছিল গণনিধন পর্ব।
অসমিয়া জাতির নামে চালানো এই বর্বর গণহত্যা অভিযানের প্রথম শিকার ছিল সোনাই মণ্ডল।
(ক্রমশ:)
লেখকের দূরভাষ: ৯৮৫৪৬-৩১৯২৮। লেখক
‘সাদিন’ কাগজের স্টাফ রিপোর্টার।