(C)Image |
আজ কাল খুব ধর্ম সংস্কারের কথা বলছেন
হিন্দুত্ববাদীরা। তাতে বহু ধর্মনিরপেক্ষও বিভ্রান্ত। খোদ
তসলিমা নাসরিণ, যিনি নিজেতো নাস্তিক, কিন্তু পরামর্শ দেন ইসলামের সংস্কারের।
বুঝিবা দুনিয়ার আর সবাই মানুষ, তাই তাদের সব ধর্মে সংস্কার ফনস্কার হয়ে গেছে।
শুধু ইসলামে বিশ্বাসীরাই মানুষ নয় ---তারা শুধুই মুসলমান। তাই দুনিয়ার
কোনো প্রাকৃতিক-সামাজিক -রাজনৈতিক আইন তাদের উপরে বলবৎ হয় না। যা কিছু
বলবৎ হয় সবই আল্লাহর আইন--এই তত্ত্বে নাস্তিক তসলিমাপন্থীরাও বিশ্বাস
করেন। আর হিন্দুত্ববাদীদের কথাতো বলেই লাভ নেই---রাজা রামমোহন থেকে নেতাজি
সুভাষ, ডারউইন থেকে আইনস্টাইন সবাই তাদের মানুষ। সংস্কার না ইউরোপে, না ভারতে আকাশ থেকে পড়ে নি। ইউরোপে
ধর্ম সংস্কার সামন্তবাদের শেকড় উপড়ে ফেলে দিয়ে ফরাসী বিপ্লব থেকে
শুরু করে দেশে দেশে বোর্জুয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্ভব করেছিল। যার
স্লোগান ছিল 'সাম্য মৈত্রী স্বাধীনতা'র। কিন্তু সেই প্রতিশ্রুতি কি রক্ষা
করেছিল? বিপ্লবের দিন কয় পরেই নেপোলিয়ন বোনাপার্ট-১ এবং পরে ২। দেশে দেশে সাম্রাজ্যবাদী অভিযান---যার বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়ায় প্যারি কম্যুন। স্মরণ করিয়ে দেয় ফরাসী বিপ্লবের প্রতিশ্রুতি। সেই অসম্পূর্ণ প্রতিশ্রুতি রক্ষার লড়াই এখনো লড়ছে দুনিয়ার অসমতার শিকার মানুষ। ইউরোপে যে সামন্ত শাসকদের বিরুদ্ধে বোর্জোয়ার স্বাধীন বিপ্লব বা বিদ্রোহ হলো, সেসব এরা এর পরে আর এশিয়া আফ্রিকা লাতিন আমেরিকার মতো দেশে হতে দিল কই? তৃতীয় বিশ্বের এই সব দেশে কর্তব্যতো হাজির হলো এর পরে, আধুনিক পুঁজিবাদী ঔপনিবেশিক
শক্তিগুলোর থেকে দেশ স্বাধীন করবার। তবু সেই সব উপনিবেশে শাসক শ্রেণি
মাত্রেই ইউরোপ থেকে নিয়েছে অনেক। আধাখেঁচড়া করে হলেও ভারতের মতো দেশেও
হিন্দু ধর্মে এবং সমাজের উপরের স্তরে 'সংস্কার' বলে কিছু জিনিস হয়েছে। রাজা রামমোহন
দিয়ে ভারতে যার শুরু। কিন্তু উনিশ শতক ফুরোতে না ফুরোতে সেই ধর্ম
সংস্কারের এক দিকে যেমন নাস্তিক আর কম্যুনিস্টদের উত্থান ঘটিয়েছে, আর দিকে ঘটিয়েছে হিন্দু জাতীয়তাবাদের উত্থান। আজ যাকে আমরা হিন্দু ধর্ম বলে জানি, এ আসলে সেই ব্রিটিশ ভারতে নবনির্মিত হিন্দু
ধর্ম। সেই ঘটনা কি ইসলামে ঘটে নি? আলবৎ ঘটেছে। সবই ঘটছে। ফলে মুসলিম লীগের
রাজনীতিও এসছে, আবার প্রথম জীবনে মুসলিম লীগ শেষ জীবনে আওয়ামী লীগ মুজিবর
রহমানও এই উপমহাদেশেই দেখা দিয়েছেন। মুসলিম লীগ পিতার কম্যুনিস্ট সন্তান
বদরুদ্দিন ওমরও এসছেন। আরবে আবদুল ওয়াহাবের বিপরীতে ভারতে শাহ ওয়ালিউল্লাহ থেকে শুরু করে আহমেদ রেজা খান বেহরেলভি, তিতুমীর হয়ে মৌলানা ভাসানি অব্দি কত
কে! এখনো নিরন্তর সেই সংগ্রাম চলছে ভারতেও , সারা বিশ্বেও। বস্তুত ব্রিটিশ ভারতে
দেওবন্দকে কেন্দ্র করে এই ভারতীয় ইসলাম দাঁড়িয়ে বাকি বিশ্বে
ছড়িয়েছে বললেও ভুল হয় না---যে ইসলামের এক উজ্জ্বল প্রতিনিধি মৌলানা আবুল
কালাম আজাদ। আবার তালিবানেরাও বলে তারা দেওবন্দের অনুগামী। তা হলে 'সংস্কারে'র কথা এলে মুসলমানে জবাব দিতে পারেন না কেন? কারণ, শিক্ষার অভাব। তারা নিজেরাও এতো শত ইতিহাস জানেন না। হিন্দুরা জানে না কেন? কারণ, হিন্দুত্ববাদীরা কোনোদিনই এইটুকু জানবারও আগ্রহ নেয় নি যে রামমোহন থেকে বিবেকানন্দের শিক্ষারও অনেকটাই ইসলাম থেকে জাত। মানবেন্দ্রনাথ রায় থেকে অমর্ত্য সেনের মতো নাস্তিকেরা এই সব জানেন---সাধারণ কম্যুনিস্ট কিম্বা নাস্তিক এতো শত জানে না কেন? কারণ ধর্ম সম্পর্কে কষ্ট করে জানতে তাদের অনীহা। কিন্তু সব চাইতে বড় যে কারণ, তা এই যে ভারতে হিন্দু ধর্ম সংস্কারক মাত্রেই ছিলেন
ব্রিটিশ শাসকের সহযোগী। রামমোহন টু বিবেকানন্দ কেউ ব্রিটিশ
শাসকের বিরোধিতা করেন নি। বঙ্কিমের এবং প্রথম জীবনে রবীন্দ্রনাথেরও ব্রিটিশ
বিরোধিতা ছিল দোলাচলে ভরা। অন্যদিকে আব্দুল ওয়াহাব থেকে শুরু করে মৌলানা
ভাসানীদের সংস্কার আন্দোলন ছিল চিরদিনও পশ্চিমা উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে
রাজনৈতিক সংগ্রামের অংশ বিশেষ ---যারা ভারতীয় বর্ণ হিন্দু মধ্যবিত্ত কোনোদিনই
ভালো নজরে নেয় নি। ছোটজাত মুসলমানের প্রতি অস্পৃশ্যতাতো ছিলই, এখনো আছে। সঙ্গে সেই অপ্সৃশ্যতার নয়া যুক্তি তৈরি হলো---যারা সাহেবদের বিরোধিতা করে ---তারা আবার আধুনিক বুঝি! তাদের সংস্কার চাই। নইলে দুনিয়ার কারোরই মুক্তি নেই। সত্য বটে, বিশ্বায়নেই যাদের মুক্তিতে বিশ্বাস---তারা সবেতেই
সংস্কারই সন্ধান করেন। মক্কা টু ওয়াশিংটন সর্বত্র। তাদের
মুক্তির দৃষ্টিই পরাধীনতার দৃষ্টি। ঔপনিবেশিক শাসনের দোষে
দুষ্ট। এই প্রশ্নও করেন না, আল বেরুনি, চিস্তি, কবির, শাহজালাল, আজান ফকির, লালন ফকির, হাছন রাজার ইসলাম গেল কই? কে মারল? কে ধ্বসালো! সে কি শুধুই আল কোরান? না কি WTO? --এই বারে দেখুন শুরু হবে গালি---বন্ধ করুন মশাই
আপনার লাল -কোরান! :) কারণ এই সত্য লুকোলে কী হবে! রাজা
রামমোহনের দেশে এখনো যোগী আদিত্যনাথ, সাধ্বী প্রাচীদেরই রমরমা। এখনো এই
দেশে সতী দাহ হয় এখানে ওখানে, বাল বিবাহ হরদম হয়, কন্যাদের জন্মের আগেই মেরে ফেলা হয়, বিধবা বিবাহ হয় না। ইসলামেও তাই হয় শুধু--এতো হাজারো সংস্কারক দেখা দেবার পরেও। যদি সংস্কারই করতে হয় তবে ফরাসী বিপ্লবের সেই অসম্পূর্ণ কর্তব্য সমাধা করুক। তার পরে দেখুক, কই থাকে ইসলাম, আর কই থাকে হিন্দুত্ববাদ। কই থাকেন তসলিমা নাসরিণ আর ধর্মদ্রোহীরাই বা।