মূল
অসমিয়াঃ দিগন্ত শর্মা
বাংলা
অনুবাদ: সুশান্ত কর
( শিলচর থেকে প্রকাশিত "অরুণোদয়' কাগজে বেরুচ্ছে ধারাবাহিক। ক্লিক করুন প্রথম, এবং দ্বিতীয় এবং তৃতীয় অংশ পড়তে)
জীয়াঢলের পাড়ে যা ঘটেছিল...
জীয়াঢল নদীর পাড়ে
গড়ে উঠা এক শহরের নাম ধেমাজি। জীয়াঢল-ধেমাজিবাসীর জন্যে আয়ুরেখা। জীয়াঢল নির্ণয়
করে সেই উপত্যকার জনতার ঠিকানা আর জীবন পরিক্রমা। জীয়াঢল বহু গ্রামে সংহারলীলা
চালায়, বহু গ্রামে আবার সভ্যতার নতুন রূপ দেয়। জীয়াঢল নদীটি সেজন্যেই হয়তো
ধেমাজীবাসীর জন্যে সুহৃদ বন্ধু, আবার বিষাদের আধার। বর্ষাকালের জীয়াঢল ধেমাজিবাসীর
শত্রু, শীতকালের জীয়াঢল সেই বৃহৎ সবুজ ভূমির জনগণের পরম বন্ধু। ...
কিন্তু সেই
দুঃখসুখের জীয়াঢলের পাড়ে ১৯৮৩র ফেব্রুয়ারিতে ঘটেছিল এমন এক নৃশংস ঘটনা---যা দেখে হয়তো শীর্ণ নদীর
নিজেরই বুক কেঁপে উঠেছিল। কী ঘটেছিল সেই নদীর পাড়ে?...
জীয়াঢলের পাড়ে
বৃহত্তর বিষ্ণুপুর, শান্তিপুর এলাকাতে বাস করা বাঙালিদের উপরে ১৯৮৩-র ফেব্রুয়ারিতে
চলেছিল নৃশংস আক্রমণ। উগ্র-অসমীয়ারা করেছিল সেই আক্রমণ। বাঙলাতে কথা বললেই, বা
বাঙালি হলেই যেন বাংলাদেশী---এমন এক মনোভাব সে সময়ে প্রবল হয়ে উঠেছিল। ‘আসু’ ,
সারা আসাম গণ সংগ্রাম পরিষদ’ ইত্যাদি
সংগঠনের নেতৃত্বে পরিচালিত বিদেশী বহিষ্কার
আন্দোলন এমন এক পর্যায় গিয়ে পেয়েছিল যে সেটি আর কোনো আন্দোলন হয়ে রইল না। সে
ছিল বাঙালিদের উপর অসমিয়া বা খিলঞ্জিয়াদের চালানো পরিকল্পিত আক্রমণ।
ধেমাজি শহরের উত্তর
দিকে অবস্থিত বিষ্ণুপুর , শান্তিপুর এলাকাগুলোতে হাজার হাজার অসমিয়া মানুষ গিয়ে
নির্মম আক্রমণ চালিয়েছিল। বহু গ্রামে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল, মেরে ফেলেছিল ৪০এর থেকেও
বেশি মানুষ।
৪ নং বিষ্ণুপুর
গ্রামের ভুক্তভোগী মহিলা বকুলি দেবনাথ সেই দুঃসহ দিনের বর্ণনা করেছিলেন এইভাবে, “সকালে
প্রায় নটার সময় টেকজুরি অঞ্চল থেকে এসে বহু মানুষ আমাদের গ্রামে আগুন ধরিয়ে
দিয়েছিল। মানুষজনকে খুন করেছিল। কচি কাচা শিশুদের নিয়ে আমরা পালিয়েছিলাম। উত্তর
দিকের অরুণাচল পাহাড়ে আশ্রয় নিয়েছিলাম। আমার সামনে দীনেশ দেবনাথ বলে একজন মানুষকে
কুপিয়ে মেরে ফেলেছিল। পাহাড়ে আশ্রয় নিতে গেছিল যারা তাদেরকেও সেখানে গিয়ে মেরেছিল।
বাড়ি ঘর সব পুড়ে গেছিল। পরে এসে আবার সব তৈরি করেছি।”
একই কথা বললেন ২নং
বিষ্ণুপুর গ্রামের মুক্তা রায় । তিনি বললেন, “ পাহাড়ে আশ্রয় নিলে অরুণাচলের আদি
জনগোষ্ঠীর মানুষজন আমাদের সাহায্য করেছিলেন। ভাত দিয়েছিলেন, জল দিয়েছিলেন, থাকবার
ঠাই দিয়েছিলেন। অনেক পরে আসাম সরকারের পুলিশ এসে শিবির পেতেছিল।”
সেরকমই বললেন
৫ নং টেকজুরি বিষ্ণুপুর গ্রামের মাতব্বর মানুষ
হরেন্দ্র বিশ্বাস, “ এখানে ৪০জনকে মেরেছে। আক্রমণ করতে এলে আমাদের গ্রামের
মানুষজন জীয়াঢল নদীর পাড়ের ঝোঁপেঝাড়ে গিয়ে লুকিয়ে প্রাণ বাঁচাবার চেষ্টা
করেছিলেন। আসলে ১৩ ফেব্রুয়ারিতেই প্রথম
উত্তেজনা দেখা দিয়েছিল। টেকজুরি, পাঁচআলি এসব জায়গাতে মারপিট হয়েছিল। ১৩ তারিখে
সেরকমই কিছু মানুষ আক্রমণ করতে এলে বিষ্ণুপুরের কিছু বাঙালি বাধা দিয়েছিলেন। পরদিন
১৪ তারিখে পুরো এলাকাতে এতো বড় আক্রমণ নামলো যে
হাজার হাজার আক্রমণকারীতে গোটা এলাকা ঘিরে ফেলল। সবারই হাতে দা-বর্শা –বল্লম
–মশাল। কিছু মানুষের হাতে হাতে তৈরি বন্দুকও ছিল। পরে সেদিন জীয়াঢলের পাড়ের
জঙ্গলেও যে কিছু মানুষ লুকিয়ে আছে তারা জেনে যায়।
সেই জঙ্গলের চারদিকে আগুন ধরিয়ে দিল। তার ভেতরেই কিছু মানুষ জ্যান্ত পুড়ে
গেলেন। কেউ কেউ প্রাণ বাঁচাতে নদীর বুকে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। পরে জীয়াঢলের পাড়ে বহু
মানুষের মৃতদেহের অবশেষ উদ্ধার করা
হয়েছিল। আরো কিছু মানুষকে পরদিন ১৫ ফেব্রুয়ারিতেও হত্যা করেছিল এরা।”
হরেন্দ্র বিশ্বাস
যখন বিষ্ণুপুরের বাড়িতে বসে ঘটনার বর্ণনা করছিলেন কাছে তখন বসেছিলেন এক মহিলা।
তিনি বললেন, “আমার নাম কামনা মণ্ডল। আমার পরিবারের আটজনকে (৮) সেদিন হত্যা করেছিল
ওরা।” হরেন্দ্র বিশ্বাস জানালেন, ৫ নং বিষ্ণুপুর গ্রামের কণকবালা সরকার (৬০),
রেণুবালা বিশ্বাস (৪৫), রেণুর দুই কন্যা বিচু বিশ্বাস (১২), শল্কী বিশ্বাস (১১), ছাড়াও মারা যান
লক্ষ্মীবালা মণ্ডল (৮০), ক্ষেপী বিশ্বাস ( ৪) । পুরুষদের মধ্যে ছিলেন, দীনেশ দেবনাথ (৫৫), কাশী রায় (৭০), যাদব রায়
(৬০), যদু রায় (৫৪), পরেশ ঘোষ (৪০), রমা রায় ( ২৫), রমেশ রায় (৬৫) , ধীরেন বিশ্বাস
(৩০) ।
ক্ষতিগ্রস্ত
গ্রামগুলো ছিল—১নং বিষ্ণুপুর, ২নং বিষ্ণুপুর, ৩নং বিষ্ণুপুর, ৪ নং
বিষ্ণুপুর, ৫নং বিষ্ণুপুর, ধরণী বস্তি, মাজর বস্তি, রথ বস্তি, দেউলদি বস্তি,
দুলিয়া বস্তি, মিলন গাওঁ, শিলালি গাওঁ, শান্তিপুর, আর্যবস্তি, দাস বস্তি ইত্যাদি।
তা জীয়াঢলের পাড়ের ঝোপ
জঙ্গলে যত লোককে হত্যা করা হয়েছিল, বা তার বাইরেও বিদেশী খেদার নামে যত মানুষকে
হত্যা করা হলো---তাদের পরিবারের কেউ আজ অব্দি ন্যায় বিচার পেলেন না।
উল্লেখ করা ভালো যে
বিষ্ণুপুর শান্তিপুরের এই আক্রমণের পেছনে ছিল পুরোনো কিছু ভূমি-বিবাদের ঘটনাও। এ
অঞ্চলে বাস করা বাঙালিরা ছিলেন অন্যান্য এলাকার থেকে প্রব্রজিত মানুষ। স্থানীয়
কিছু অসমিয়া মানুষের সঙ্গে তাদের ভূমি বিবাদ শুরু থেকেই ছিল। অসম আন্দোলনে
বিদেশী বহিষ্কারের নামে যখন ফ্যাসিবাদী
রূপ লাভ করল তখন ‘ভূমি বিবাদ’ হিংস্র রূপ নিল। সে যাই হোক, শিলাপাথারের আর্নে
চরাঞ্চল, চিমেন চাপরির নৃশংস ঘটনারও আগে এই ঘটনা ঘটেছিল। এবং সেটি পরবর্তী ঘটনাক্রমকে
ইন্ধন যুগিয়েছিল বলেই তাৎপর্যপূর্ণ।
দুঃখের কথা এই যে এই
ঘটনা রোধ করতে প্রশাসন যন্ত্র ব্যর্থ হয়েছিল। পরিণতিতে অজস্র নিরীহ মানুষ প্রাণ
হারিয়েছিলেন। জীয়াঢলের পাড়ে মানবতার অপমৃত্যু হয়েছিল। মোদ্দা কথা আর্নে চরাঞ্চল,
বিষ্ণুপুর, শান্তিপুর, চিমেন চাপরি
ইত্যাদি অঞ্চলে প্রায় পাঁচ শতাধিক মানুষের মৃত্যু হয়েছিল।
মানবতার পথে
হরিনারায়ণ পেগু
হিংসা রোধ করতে
গিয়ে প্রাণ দিতেও প্রস্তুত হয়েছিলেন।
অবিভক্ত লখিমপুর জেলার (বর্তমান ধেমাজি জেলা) একটি শহর শিলাপাথার।
সেই শহরের কাছেই অকাজান অঞ্চল। এই এলাকার এক বিশিষ্ট ব্যক্তি হরিনারায়ণ পেগু। যিনি
মিসিং জনগোষ্ঠীর ন্যায্য অধিকারের সংগ্রামে বহু সময় নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। টাকাম মিসিং
পরিন কেবাঙ-এর মতো সংগঠনের নেতৃত্বদায়ী অবস্থানে ছিলেন। মিসিং জনগোষ্ঠীর স্বায়ত্তশাসন
পাবার সংগ্রামে এই ভদ্রলোকের ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ।
ধেমাজি জেলাতে গণতান্ত্রিক মতাদর্শে উদ্বুদ্ধ ব্যক্তিদের মধ্যে
হরিনারায়ণ পেগু অন্যতম। মানবতাবাদ এবং গণতন্ত্র---তাঁর সংগ্রামী জীবনের আদর্শ। শিলাপাথারের
কাছে আর্নে চাপরি অঞ্চলে ১৯৮৩র ২০ ফেব্রুয়ারিতে যে গণ-সংহার সংগঠিত হয়েছিল তাতে
তাঁর ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ । তিনি সেই আক্রমণকে বাধা দিতে যৎপরোনাস্তি
চেষ্টা করেছিলেন। এমনকি গণহত্যা রুখতে
তিনি নিজের জীবন দিতেও তৈরি হয়ে পড়েছিলেন।
বিদেশী বহিষ্কার আন্দোলন এবং আর্নে চাপরির গণ-নিধন কাণ্ড সম্পর্কে
হরিনারায়ণ পেগু কতকগুলো গুরুত্বপূর্ণ
মন্তব্য করেছিলেন। যে কথাগুলোর মধ্যে বিদেশী বিতাড়ন আন্দোলনের একাংশ নেতা,
আন্দোলনের চরিত্র এবং বাঙালিদের উপরে খিলঞ্জিয়াদের চালানো আক্রমণের বহু দিক স্পষ্ট
হয়ে পড়ে।
সমগ্র ঘটনাপ্রবাহ সম্পর্কে সংক্ষেপে আমাদের কতকগুলো কথা জানিয়েছিলেন
হরিনারায়ণ পেগু, “১৯৭৯ সনের বহিরাগত বিতাড়ন আন্দোলন ১৯৮০-৮১ সনে বিদেশী বহিষ্কার
আন্দোলনে পরিণত হলো। ফলে আন্দোলনের চরিত্রও গেল পালটে। সে যাই হোক, ১৯৮২তে বিদেশী
বহিষ্কার আন্দোলনের অন্যতম কাণ্ডারি সারা আসাম ছাত্র সংস্থা গুয়াহাটির বি বরুয়া
কলেজে একটি জনজাতীয় অভিবর্তনের আয়োজন করেছিল। সেই অভিবর্তনে একাংশ জনজাতীয় ছাত্র
সংগঠন এবং নেতাদের আমন্ত্রণ জানানো হয় নি, হয়েছিল কিছু বাছাই করা সংগঠন এবং
ব্যক্তিকে। সেই অভিবর্তনে আমাদেরকেও আমন্ত্রণ জানায় নি। কিন্তু ১৯৮২র শেষের দিকে
‘আসু’ মিসিং ছাত্র সংস্থাকেও আমন্ত্রণ জানালো এবং ‘বিদেশী বহিষ্কার’ সম্পর্কে
মতামত জানাতে চাইল। তখন মিসিং ছাত্র সংস্থার থেকে বলা হলো যে বিদেশী বহিষ্কার
সম্পর্কে নৈতিক সমর্থন আছে, কিন্তু পূর্ণ সমর্থন থাকবে না। ‘আসু’ যাই করবে বা যে
কর্মসূচীই নেবে বিবেচনাবিহীনভাবে সবগুলোকে ঠিক বেঠিক যাই হোক সমর্থন জানানো যাবে
না। এর পরে ১৯৮৩তে আসামে বিধান সভার সাধারণ নির্বাচনের কথা প্রচারিত হলো। সঙ্গে
সঙ্গে চারদিকে অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতির সৃষ্টি হলো। গণতান্ত্রিক আদর্শে পরিচালিত
বামপন্থী দল এবং আন্দোলনের সমর্থকদের মধ্যে বিবাদ শুরু হলো। নির্বাচনের দিন
নির্ধারণের সঙ্গে সঙ্গে সরকারী কার্যালয়ে আগুন লাগানো, সেতু জ্বালিয়ে দেয়া, পুলিশ
থানাতে জনতার আক্রমণ ইত্যাদি ঘটনা আসামের ব্রহ্মপুত্র উপত্যকাতে সংগঠিত হলো। এমন
সময় অবিভক্ত লখিমপুর জেলার বিভিন্ন স্থানে হাজার হাজার বিদেশী আছে বলে প্রচারিত
হলো। ধেমাজির উত্তরে ১৪ ফেব্রুয়ারি বাঙালিদের উপরে আক্রমণ হলো। ২০ ফেব্রুয়ারি
নির্বাচনের দিন ছিল। সেই দিনটিতেই ধেমাজি জেলার অসম আন্দোলনের নেতৃত্ব ঠিক করলো
বিদেশীদের তাড়াতেই হবে। ‘আসু’র একাংশ নেতা মানুষজনকে সংগঠিত করতে অগ্রণী ভূমিকা
নিল। এমন কি ধেমাজি, শিলাপাথার এলাকার মিসিং জনগোষ্ঠীর মানুষকেও সংগঠিত করলো।
জনজাতি এলাকাগুলোতে বাংলাদেশী বা বাঙালি বিদেশী আছে বলে ব্যাপক প্রচার হলো। সেই
এলাকাগুলো মুক্ত করতে হবে বলে অনেকেই ঠিক করে ফেলল। প্রায় একবছর আগে আর্নে
চরাঞ্চলের বিভিন্ন অঞ্চলে সরকার উচ্ছেদ অভিযান
চালিয়ে প্রমাণ করেছিল যে এসব এলাকার মানুষজন বেদখলকারী। ফলে জনতাও এটাই বুঝলেন যে
এরা বিদেশী না হয়ে যায় না। ইতিমধ্যে বৃহত্তর জেলার বিভিন্ন সংগঠন, কিছু জনজাতীয়
ছাত্রনেতাও সংগঠিত হলেন। আর ১৯ ফেব্রুয়ারি (১৯৮৩) রাত প্রায় নটার সময় শিলাপাথারের
দক্ষিণের বরমুরীয়া গ্রামের দক্ষিণ দিকের টঙানি পথারে হাজার হাজার মানুষ জড়ো হলো।
লখিমপুর জেলারও নানা জায়গার থেকে বহু মানুষজন এলো। সেদিন রাতেই সারা আসাম ছাত্র
সংস্থার কিছু নেতা, কিছু তার স্থানীয়ও ছিল, আমার বাড়িতে এলো। মিসিং , দেউরি,
অসমিয়া অন্যান্য জনগোষ্ঠীর মানুষও আমার এখানে এলো। আমি বললাম, এতো মানুষ জড়ো হবার
আগে আমাকে অন্তত জানানো উচিত ছিল। এতো
মানুষ এই রাতে কী খাবে, কী করবে তার কিসের ঠিকানা! তখন গ্রামের দুখানা ভুষিমালের
দোকান থেকে যত চাল ছিল সব আর কিছু আলু এনে তারাই রাঁধলো। ৫ নং টঙানি প্রাঃ
বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে রান্না হলো আর লোকগুলো খেলো। কেউ কেউ গ্রামে এর তার বাড়ি গিয়েও
খাওয়া দাওয়া করলো। এরা পরিকল্পনা করেছিল যে পরদিন দক্ষিণের চর থেকে বিদেশী বলে
শনাক্ত মানুষজনকে উচ্ছেদ করতে নামবে। যেভাবে ১৯৮১তে সরকার করেছিল। কিন্তু ভোর রাতে প্রায় তিনটা বা চারটার সময়
হাজার হাজার মানুষ হাতে দা-লাঠি-বল্লম-মশাল নিয়ে গিয়ে আক্রমণ করলো। প্রথমে আক্রমণ
করল টঙানি নলবাড়ি গ্রামে। টঙানি নদীর উত্তর পাড়ের নলবাড়ি গ্রাম আক্রমণ করে রোদ
উঠলে পরে গিয়ে দক্ষিণের গ্রামগুলো আক্রমণ করে। এই খবর পেয়ে আমি বেলা প্রায় দশটার
সময় সাইকেল একটা নিয়ে মুক্তিয়ার লখিমী মিসিং গ্রামে গেলাম। সেই গ্রামে গিয়ে আমি
আক্রমণকারীদের বাধা দিলাম। ওদের সামনে দাঁড়িয়ে বললাম, আক্রমণ বন্ধ করো। গ্রাম
জ্বালানো, মানুষ মারা বন্ধ করো। আর যদি এগিয়ে যেতে চাইছ তবে প্রথমে আমাকে মেতে
এগিয়ে যাও। নইলে আমি আক্রমণ করতে যেতে
দিচ্ছি না। প্রায় একঘণ্টা ধরে ওদের সঙ্গে তর্ক বিতর্ক হলো। অবশেষে এরা আর আক্রমণ
করতে এগুলো না। কিন্তু সেই দলটিই গেল না। অন্যদিক থেকে যারা যাচ্ছিল তারাতো গেলই,
আর আক্রমণও করলো। আমি জীবন বাজি রেখেও আক্রমণ আটকাতে পারলাম না। অন্যদলগুলো হত্যা-হিংসার তাণ্ডব চালাতে চালাতে
বহুদূর এগিয়ে গেল। মানবতার সেই স্খলন দেখে
আমি ভেঙ্গে পড়লাম দুঃখে। মাঝখানে খবর পেলাম
খেরকটা, মুক্তিয়ার গাওঁ, কাকোবাড়ি গ্রামের
ধনঞ্জয় লেটুমের মৃত্যু হয়েছে। আহত হলো অনেকে। বিকেলে সি আর পি এফ টহল দিয়ে
পরিস্থিতি কিছু নিয়ন্ত্রণ করলো। পরদিন আমি বিধ্বস্ত গ্রামগুলোতে গেলাম। চরবস্তি,
আর্নে চাপরি, আর্নে পানবাড়ি, রামনগর ইত্যাদি গ্রামগুলো ঘুরে শ শ মৃতদেহ দেখলাম।
সেই বিধ্বস্ত গ্রামের ভেতরে অসমিয়া মানুষের মানবতার স্খলনের ভয়াবহ রূপ দেখে আমি
কান্না আটকাতে পারিনি, মাটিতে বসে পড়লাম। আমি চাইছিলাম---বিদেশী বহিষ্কার হোক,
কিন্তু গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া মেনে। হিংসা আর ফ্যাসিবাদের পথে নয়। আক্রমণকারীদের
অধিকাংশই ছিল মিসিং জনগোষ্ঠীর মানুষ। কিন্তু আসল কথাটি হলো---আসু আন্দোলনের নামে
জনজাতি তথা মিসিং জনগোষ্ঠীর মানুষকে ব্যবহার করলো। জনজাতিদের উপরে দোষ চাপিয়ে দিল।
এই কথাও সত্য যে একাংশ মিসিং মানুষ যেভাবে বাঙালিদের তাড়াতে গেছিল, তেমনি আরেক অংশ
বহু আক্রান্তকে আশ্রয় দিয়েছিলেন , সাহায্যও করেছিলেন নানা ভাবে। ...”
উল্লেখ করা ভালো যে আর্নে চরাঞ্চলের হত্যাকাণ্ডের মামলাতে জড়িয়ে হরিনারায়ণ পেগুকে গ্রেপ্তারও করেছিল। তিনি
বললেন, “আমি যেহেতু সংগঠনের নেতৃত্বে ছিলাম, আমার বিরুদ্ধে ১১টা মামলা রুজু করা
হলো। ১৯৮৩র ৪ মে গ্রেপ্তার করে জেলে পাঠালো। যাই হোক, পরে আমি ছাড়া পেয়ে এসেছি।
কিন্তু আমার স্পষ্ট মত, বিদেশী বিতাড়ন হতে হবে। কিন্তু গণতান্ত্রিক পথে, আইনের
পথে। গণ-নিধন যজ্ঞ করে নয়। সেই গণ-নিধন
কাণ্ডের আমি সব সময় নিন্দে করে এসেছি আর দাবি জানিয়ে এসেছি নিপীড়িতদের ন্যায়
প্রদান করতে হবে। আমার আক্ষেপ যে ১৯৮৩র ২০ ফেব্রুয়ারির সেই গণ সংহার কাণ্ড আমি
আটকাতে পারি নি। অবশেষে মানবতার স্বার্থে আমার জীবন দিতেও তৈরি হলাম। কিন্তু তাতেও
মানবতার রক্ষা করা হয়ে উঠল না। প্রায় এক হাজারের বেশি মানুষ মারা গেলেন।”
হরি নারায়ণ পেগুর এই মানবতাবাদী ভূমিকা আজও বহু মানুষকে উদ্বুদ্ধ
করে। এই মানুষটির ‘হিংসাত্মক কার্যকলাপ বিরোধী’ স্থির জন্যে সেই সংঘাতের পরেও মিসিং
এবং বাঙালিদের মধ্যে সম্প্রীতি আর ভ্রাতৃত্ব-বোধের সম্পর্ক আবার গড়ে উঠতে পেরেছে।
সেরকম মিসিং জনগোষ্ঠীর নেতা যুক্তা কুম্বাঙ আজও
১৯৮৩র ২০ ফেব্রুয়ারির গণ-নিধন কাণ্ডের নিন্দা করেন। তিনি বলেন, “ এই কাণ্ড
জাতি-জনজাতির মধ্যেকার সুসম্পর্ক চিরদিনের জন্যে ভেঙে চুরমার করেছে। জাতি গঠন
প্রক্রিয়াতে ব্যাঘাত জন্মিয়েছে।”