আমার চেতনার রঙে রাঙানো এই খেলা ঘরে:

~0~0~! আপনাকে স্বাগতম !~0~0~

*******************************************************************************************************

Friday, 17 November 2017

১৯৮৩র অসম: নিপীড়িত বাঙালি হিন্দু-৫



মূল অসমিয়াঃ দিগন্ত শর্মা
বাংলা অনুবাদ: সুশান্ত কর
  ( শিলচর থেকে প্রকাশিত 'অরুণোদয়' কাগজে বেরুচ্ছে ধারাবাহিক। ক্লিক করুন প্রথম, এবং দ্বিতীয়,    তৃতীয় এবং চতুর্থ অংশ পড়তে) 
মন্দিরের নাগাড়ার শব্দে আজও শিহরিত হন
গোরেশ্বরের ভাষিক সংখ্যালঘু জনতা

শ্বর উপাসনার জন্যে বহু মন্দিরে প্রদীপ জ্বালবার সঙ্গে নাগাড়া বাজানো হয়। নাগাড়ার শব্দ ভক্তি-প্রাণ ব্যক্তিকে খানিক সময়ের জন্যে হলেও মাথা নোয়াতে বাধ্য করে। কিন্তু কামরূপ জিলার গোৰেশ্বৰ শহরের নিকটবর্তী হাজলপাড়া, বেতনা, সিলকিঝাড় ইত্যাদি গ্রামের ভাষিক সংখ্যালঘু জনতা আজও শিহরিত হন নাগাড়ার শব্দ শুনলে। মন্দিরে সন্ধ্যা বেলা বাতি জ্বালবার পরে দূরের কোনো গ্রাম থেকে যখন নাগাড়ার শব্দ ভেসে আসে, তখন সে এলাকার বাঙালীদের মনে ভেসে আসে আতঙ্ক জর্জরিত একটি দিনের কথা। যে দিনটিতে সেই বাঙালী সম্প্রদায়ের মানুষের উপরে অসমীয়া মানুষেরা অত্যন্ত নির্দয়ভাবে আক্রমণ করেছিল। হত্যা করেছিল শতাধিক লোককে। ...
সেই আক্রমণ চালাবার আগে চারদিকে নাগাড়া বাজিয়ে একত্রিত হয়েছিল হাজার হাজার আক্রমণকারী। ‘নাগাড়ার শব্দ’ ছিল ছিল বিদেশী তাড়াতে লাঠি-বল্লম-দা –তলোয়ার- তির ধনুক নিয়ে দলে বলে অসমীয়া মানুষকে বেরিয়ে আসবার আহ্বান জানাবার সংকেত।  সেই সংকেত যেন ছিল গণনিধন যজ্ঞের শুরুর বার্তা।
সেদিনটি ছিল ১৮ ফেব্রুয়ারি, ১৯৮৩ সন। কামরূপ জেলার গোরেশ্বর শহরের কাছের আটটি গ্রামে আক্রমণ করেছিল উগ্রজাতীয়তাবাদী অসমীয়া মানুষজন। সেই গ্রামগুলো ছিল হাজলপাড়া, বেতনা, সিলকিঝাড়, ৫ নং গোরেশ্বর, বালাহাটী, গোঁহাই গাঁও, জানপাড়া এবং ২ নং গোরেশ্বর। পুরো আঠারোটি গ্রাম ধ্বংস হয়েছিল। সেই ভয়াবহ দিনটির মনে করে হাজলপাড়া গ্রামের পঙ্কজ বিশ্বাস বলেছিলেন,“বিদেশী বহিষ্কার আন্দোলন বা অসম আন্দোলন ছিল আমাদের জন্যে এক মূর্তিমান আতংক। বিশেষ করে ১৮ ফেব্রুয়ারি দিনটিতে আমরা প্রায় আটখানা গ্রামের মানুষ ১৬০জন আত্মীয় পরিজনকে হারিয়েছিলাম। সে দিনটির স্মৃতি আমাদের এমন ব্যথিত করে যে সেসব মনে পড়লেই কষ্ট হয়।মন্দিরের নাগাড়ার শব্দে প্রায়ই আমাদের সেই আতংকময় দিনটিকে মনে করিয়ে দেয়। কারণ নাগাড়া বাজিয়েই আক্রমণকারীরা একত্রিত হয়েছিল। প্রথমে হাজলপাড়া, সিলকিঝাড়, আর তারপরে অন্যান্য গ্রামগুলো আক্রমণ করেছিল। আসলে ১৭ তারিখে,অর্থাৎ আগের দিনে রামপুর (গোঁহাই হাউলি) গ্রামের নাগাড়া বাজিয়ে আক্রমণকারীরা জড়ো হয়েছিল। সেদিন রাতেই বরনদীর পুব পাড়ের অর্থাৎ দরং জেলার ঝালুকবাড়ি গ্রামে আগুন দিয়েছিল।পরদিন সকাল থেকেই কামরূপ জেলার বাঙালি বসতিপূর্ণ গ্রামগুলোতে আক্রমণ করেছিল।আমরা পালিয়েছিলাম।কিন্তু গ্রামের অনেকেই মারা পড়েছিলেন। ৩ নং হাজলপাড়া গ্রামের সুকোমল বিশ্বাসের পরিবারের ১৪ জন লোককে হত্যা করে ফেলে। সেরকম ধীরেন দাসের মা-বাবাসহ ৯ জন মানুষকে হত্যা করেছিল।”
সুকোমল বিশ্বাস জানালেন যে তাঁর পরিবারের বসন্ত বিশ্বাস (৬৫), সুকেশ বিশ্বাস (৪৫), পরিমল বিশ্বাস (৪০),কানন বিশ্বাস (২০), ভুবন বিশ্বাস (১২), বিজয় বিশ্বাস (১১), অণিমা বিশ্বাস (১৫), সন্ধ্যারানি বিশ্বাস (১৪), সুষমা বিশ্বাস (১৫), বিমল বিশ্বাস (৩৪) কে হত্যা করেছিল।
সুকোমল বিশ্বাস বললেন,“এখন সেসব কথা কেউ মনে করিয়ে দিলে আমাদের অনেক কষ্ট হয়সেদিন আমার উপরেও আক্রমণ হয়েছিল।মারা গেছি ভেবে আক্রমণকারীরা ফেলে চলে যায়।কিন্তু পরে জ্ঞান ফিরে আসাতে বেঁচে গেলাম। আজ আমি শরীরে মনে সেই সংঘাতের ক্ষতচিহ্ন নিয়ে বেঁচে আছি। ...”
কথাগুলো বলে সুকোমল বিশ্বাস শোকবিহ্বল হয়ে নীরব হয়ে পড়েছিলেনবিদেশী বিতাড়ন আন্দোলনের এক ভুক্তভোগী ধীরেন দাস বললেন,“আমার বাবা সুরেন্দ্র দাস,মা শান্তি দাস থেকে শুরু করে ৯ জন আত্মীয়কে হত্যা করেছে আন্দোলনকারীরা।আমরা কি অসমিয়া ভাষার শত্রু, না অসমিয়া জাতির শত্রু আজও বুঝে উঠতে পারি নি।১৯৬০এর ভাষা আন্দোলনেও আমরা আক্রান্ত হয়েছিলাম।সে যাই হোক,আমরা নির্যাতিত,নিপীড়িত মানুষের আজ অব্দি ন্যায় লাভ করতে পারি নি।এক এক জন মৃত ব্যক্তির বিপরীতে পাঁচ হাজার টাকা,আহত ব্যক্তির জন্যে দু হাজার টাকা এককালীন সাহায্য দিয়েছিল সরকার। এ কি সত্যিই প্রকৃত ক্ষতিপূরণ? দোষী আজও শাস্তি পেল না। ...”
এলাকাটিতে ক্ষেত্র অধ্যয়ন করে দেখা গেল যে সেই বাঙালিদের গ্রামগুলোতে আন্দোলনকারী,আক্রমণকারীরা শুধু যে মানুষ মেরেই ক্ষান্ত হয়েছিল তাই নয়।অনেকে গ্রামগুলোর থেকে মানুষের বিষয়-আসয়ও লুঠ করেছিল। উল্লেখযোগ্য যে গোরেশ্বর এলাকার বাঙালিদের গ্রামগুলোতে এবং দরং জেলার খৈরাবাড়ি এলাকাতে বিভিন্ন ভাষিক সংখ্যালঘু বসতিপূর্ণ গ্রামে চালানো আক্রমণের ফলে কয়েক শত মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। হাজার হাজার মানুষ হয়েছিল গৃহহারা। গোরেশ্বর রেলস্টেশনে প্রায় ১৫ হাজার মানুষ আশ্রয় নিয়ে অনাহারে অনিদ্রাতে দিন কাটিয়েছিলেন। এমন কি অঞ্চলটির ৫ হাজার মানুষ পরে পশ্চিম বাংলাতে আশ্রয়ের সন্ধানে গিয়েছিলেন।প্রায় ২৫ দিন ভুক্তভোগীরা আশ্রয় শিবিরে থেকে আবার গ্রামে ফিরে এসেছিলেন। ফিরে এসে দেখেন ভিটে-বাড়িতে শুধু ছাই আর ছাই। ...
‘আসু’,গণ সংগ্রাম পরিষদ,কর্মচারী পরিষদ ইত্যাদি সংগঠন আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে বিদেশী বহিষ্কারের নামে যে কলঙ্কিত ইতিহাস রচনা করল তার জীবন্ত সাক্ষ্য হাজলপাড়া,বেতনা,সিলকিঝাড়,গোরেশ্বর এবং দরং জেলার খৈরাবাড়ি এলাকার ভুক্তভোগী বাঙালি সম্প্রদায়ের জনতা।যারা আজও অপেক্ষা করছেন ন্যায় পাবার জন্যে।কিন্তু বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ ভারতবর্ষের প্রশাসনযন্ত্র উগ্রজাতীয়তাবাদের শিকার,ফ্যাসিবাদের বা সংঘাতের বলি অসমের মানুষকে ন্যায় দিতে ব্যর্থ হয়েছে। তার বিপরীতে দেশের অন্য প্রান্তের গোষ্ঠী বিদ্বেষ,সাম্প্রদায়িক সংঘাতের বলি মানুষজনকে কিছু হলেও ক্ষতিপূরণ দিয়েছে। উদাহরণ স্বরূপে ১৯৮৪ সনের ‘শিখ গণনিধন’ কাণ্ডের ক্ষতিগ্রস্তদের সরকার কয়েক লক্ষ করে ক্ষতিপূরণ দিয়েছে।২০০২এর গুজরাটে যারা সাম্প্রদায়িক সংঘাতের সৃষ্টি করেছিল তাদের একাংশকে অন্তত আদালত দোষী সাব্যস্ত করেছিল।গুজরাটের বিজেপি সরকার তথা নরেন্দ্র মোদী সরকার কেবিনেট মন্ত্রী মায়া কোডনানিকে গুজরাতের আদালত শাস্তির বিধান দিয়েছে। কিন্তু অসমে ১৯৮৩তে অনুষ্ঠিত সংঘাতে হাজার হাজার মানুষ প্রাণ হারাবার পরেও সেই গণসংহারকান্ডগুলোর কোনো বিচারই হল না। বরং যে সব মামলা রুজু করা হয়েছিল সেগুলোও আসাম সরকার বন্ধ করে দিল।হত্যাকারীদের সরকারী পৃষ্টপোষকতাতে মুক্ত করে দিয়ে সমগ্র ন্যায় ব্যবস্থাটিকেই কলুষিত করেছিল

শিলাপাথার কাণ্ড এবং
তেওয়ারি আয়োগের প্রতিবেদন
আক্রমণ করতে উসকে দিয়েছিল সরকারি আধিকারিকই

১৯৮৩র  জানুয়ারি থেকে এপ্রিল মাস অব্দি অসমে সংগঠিত হিংসাত্মক ঘটনাগুলো সম্পর্কে তদন্ত করতে ত্রিভুবন প্রসাদ তেওয়ারির নেতৃত্বে সরকার একটি তদন্ত আয়োগ গঠন করেছিল। যে আয়োগ সমগ্র ঘটনাবলী তদন্ত করে ১৯৮৪ সনে অসম সরকারের কাছে একটি প্রতিবেদন দাখিল করে।সেই প্রতিবেদনে অবিভক্ত লখিমপুর জেলার (তখন ধেমাজি ছিল মহকুমা) ঘটনাবলীর তথ্য ছিল। তেওয়ারি আয়োগের প্রতিবেদনে সংঘাতের পেছনকার বহু কথা উন্মোচিত করেছিল। বিশেষ করে সাধারণ জনতাকে নিরাপত্তা প্রদানে যে প্রশাসন যন্ত্র সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছিল তার স্পষ্ট উল্লেখ আছে এই প্রতিবেদনে।  উল্লেখ্য যে গত ত্রিশ বছরে অসম সরকার এই প্রতিবেদন প্রকাশ্যে আনে নি।প্রকারান্তরে সরকারের গড়ে দেওয়া আয়োগের প্রতিবেদনকে সরকারই লুকিয়ে রেখে ন্যায় ব্যবস্থাকে প্রহসনে পরিণত করেছে। এই প্রতিবেদনে আর্নে চাপরি,চিমেন চাপরি ইত্যাদি অঞ্চলের,শিলাপাথার শহরের পাশের স’সাইতি,বামগাঁও,ইত্যাদি অঞ্চলে সংঘটিত ঘটনা,ধেমাজি শহরের উত্তর দিকে অবস্থিত বিষ্ণুপুর,শান্তিপুর এলাকাতে সংগঠিত ঘটনা সম্পর্কে কতকগুলো তথ্য রয়েছে।প্রতিবেদনে স্পষ্ট উল্লেখ করা হয়েছে আক্রমণকারীরা আসলে কোন শ্রেণির অন্তর্গত। সেখানে উল্লেখ আছে যে আর্নে চরাঞ্চলে সংঘটিত ঘটনাগুলোতে সাম্প্রদায়িক বা ধর্মীয় বিদ্বেষ ছিল না।বিপরীতে হিংসাত্মক ঘটনার আড়ালের এক অন্যতম কারণ ছিল ভূমিকেন্দ্রিক বিবাদ।প্রতিবেদনে লিখেছে এইভাবে,“It is clear that the rioting and group clashes did not take place on communal lines.In Arena (Arne) Chapari the Mishings and Assamese attacked the Bengali Hindus... In Bishnupur the Mishings and the Assamese attacked Bengali Hindus.In all cases the basic background of the clashes was one of land disputes.”
‘মিসিং জনগোষ্ঠী’ এবং ‘অসমিয়া জনগোষ্ঠী’র লোকে বাঙালি হিন্দুদের উপরে আক্রমণ চালিয়েছিল সেই সিদ্ধান্ত নেবার আগে বিভিন্ন জাতি-জনগোষ্ঠী এবং সরকারি আমলা –আধিকারিকদের থেকে শুরু করে প্রায় অর্ধ শতাধিক মানুষের সাক্ষ্য গ্রহণ করেছিল তেওয়ারি কমিশন।অন্যদিকে,পুলিশ-প্রশাসন যে হিংসাত্মক ঘটনা ঘটবে বলে জেনেও সুরক্ষা ব্যবস্থা গ্রহণ করতে ব্যর্থ হয়েছিল সে কথাও প্রমাণ করেছে আয়োগ। তেওয়ারি আয়োগের প্রতিবেদনে পুলিশ প্রশাসনের সম্পর্কে উল্লেখ আছে এইভাবে,“There was also anticipation of the occurrence  at Arena (Arne) Chapori but police force could not be posted there in time.The officers who were made responsible for maintaining  law and order in Dhemaji Sub-division lacked determination and failed to take initiative in mobilising the available resources to tackle a very difficult situation.”
পুলিশ যে হিংসাত্মক ঘটনার আগে তথ্য পেয়েও পরিস্থিতি সামাল দিতে বিশেষ কোনো চেষ্টা করেনি তার বিস্তৃত ব্যাখ্যার দরকার নেই।
অন্যদিকে সেই সময়কার লখিমপুর জেলার উপায়ুক্ত তথা রাজ্য সরকারের জ্যেষ্ঠ আমলা কে সি মজুমদার তেওয়ারি আয়োগের সামনে কতকগুলো গুরুত্বপূর্ণ তথ্য প্রকাশ করে দিয়েছিলেন। উপায়ুক্ত মজুমদার তেওয়ারি আয়োগের সামনে সাক্ষ্য দিয়েছিলেন যে জেলার দুই আধিকারিক আর্নে চরাঞ্চলে আক্রমণে উসকানি দিয়েছিলেন।এ সম্পর্কে আয়োগ উল্লেখ করেছে এভাবে,“The Deputy Commissioner,in his deposition,stated that two Mishing Officers,namely Shri Lakheswar Pait, Executive Magistrate and Shri J C Pegu,Additional District Magistrate posted at Shilapathar,in his view,instigated the Local Mishing people to grab the land by force and to drive away the refugees.He also stated that the performance of the two A D Ms. Namely Shri H K Barua and Shri J C Pegu was not up to the mark 14.2.83”
উল্লেখযোগ্য যে লক্ষেশ্বর পাইত এবং জে সি পেগুকে পরে প্রশাসন বরখাস্ত করেছিল এবং আধিকারিক দু’জন তাদের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ অস্বীকার করেছিলেন।যদিও এক উপায়ুক্তের ভাষ্যতে বেরিয়ে পড়ে সমগ্র পরিস্থিতির আড়ালে ঠিক কোন ধরনের শক্তি ক্রিয়া করেছিল।এই প্রতিবেদনে উন্মোচিত হয়েছে বিষ্ণুপুর,শান্তিপুর,চিমেন চাপরি,আর্নে চাপরি ইত্যাদি জায়গাতে সংগঠিত হিংসাত্মক ঘটনার আগে প্রশাসন ঠিকই খবর পেয়েছিল,কিন্তু বাঙালি হিন্দুদের আক্রমণকারীদের থেকে রক্ষা করতে বিশেষ পদক্ষেপ গ্রহণ করে নি। অর্থাৎ প্রশাসনের একাংশ আধিকারিকের রহস্যজনক ‘অবহেলা’র পরিণতিতে বহু মানুষ প্রাণ হারালেন। তেওয়ারি আয়োগের প্রতিবেদনের মতে প্রশাসনিক দুর্বলতার জন্যে সমগ্র জেলাতে ১৯৮৩র জানুয়ারি থেকে এপ্রিল মাস অব্দি ১,৩৮৯টা হিংসাত্মক ঘটনা সংগঠিত হয়েছিল।অন্যদিকে সংঘর্ষ সৃষ্টির আড়ালে ‘আসু’ এবং গণ সংগ্রাম পরিষদের ভূমিকা সম্পর্কে তেওয়ারি কমিশন বিভিন্ন ব্যক্তি এবং আধিকারিকদের সাক্ষ্যের উদ্ধৃতি দিয়ে এই কথা লিখেছে, “The circumstances leading to the disturbances which took place during January to April, 1983 were provided by the fact that when it was decided to hold the general elections certain sections of public instigated by ASSU/AAGSP and political parties like,BJP,Janata and Lok Dal and some anti-social elements decided to boycott the election and even resorted to violence to further their objective.”

অবিভক্ত লখিমপুর জেলার অন্তর্গত বৃহত্তর ধেমাজি মহকুমার বিষ্ণুপুর,শান্তিপুর,আর্নে চাপরির বেশ কিছু গ্রাম,চিমেন চাপরির কিছু গ্রামে পরিকল্পিত ভাবে হিন্দু বাঙালিদের আক্রমণ করবার পেছনে ‘আসু’,সারা আসাম গণ সংগ্রাম পরিষদ (AAGSP),ভারতীয় জনতা পার্টি ইত্যাদি শক্তি যে ছিল সেসব ব্যাখ্যার প্রয়োজন নেই। এমন কি আঙুল দিয়ে দেখাবার দরকার নেই  শিলাপাথারে হাজার হাজার হিন্দু বাঙালির রক্তে দোল উৎসব করেছিল কারা।     

Thursday, 16 November 2017

কেন্নো পোকার রেল


মূল অসমিয়া: নবকান্ত বরুয়া
বাংলা অনুবাদ: সুশান্ত কর

(সুপর্ণা ভট্টাচার্য সম্পাদিত, শিলচর থেকে প্রকাশিত শিশু সাহিত্য পত্রিকা 'কাশফুলে'র শারদ সংখ্যা, ২০১৭তে প্রকাশিত হল)



[ কেরেলুয়ার রেল’ নবকান্ত বরুয়ার প্রসিদ্ধ শিশু নাটকগুলোর একটি। মূলত ‘আকাশবাণী’র জন্যে এমন বেশ কিছু নাটক তিনি লিখেছিলেন। ফলে মঞ্চ নির্দেশনা বলে সেরকম কিছু নেই। পদ্যে লেখা হলেও অভিনয়ের সময় কখনো বা পরিচালকেরা এতে সুরসংযোজন করে গীতিনাট্যেরও রূপ দিয়েছিলেন। বাণী কটকীর মতো কোনো কোনো পরিচালক ‘মুখোশ নাটক’-এ পরিণত করে এগুলো মঞ্চেও পরে অভিনয় করান। অন্য দুই এক নাটকের সঙ্গে ‘কেরেলুয়ার রেল’ নাটকটি যোরহাট , গৌহাটিতে বেশ ক’বার অভিনীত হয়েছিল। নবকান্ত লিখেছেন, এগুলো এতোই জনপ্রিয় হয়েছিল যে এককালে ছেলেমেয়েরা পথে ঘাটেও এর সংলাপ আওড়াতো। নাটকটির পাণ্ডুলিপি লেখকের কাছে ছিল না। আকাশবাণীতে নাটকটি অভিনয় করেছিলেন ভারতী বরুয়া, তিনি বহু পরে স্মৃতি থেকে এর পুনরুদ্ধার করে ছাপা সম্ভব করেছিলেন। ‘মনত পরার শব্দ’, ‘কাগজ কলমর রণ’, ‘ গোলাপ আরু বেলি’, ‘মই টুনটুনিয়ে টুনটুনালো’ এই চারখানা নাটক সহ ‘কেরেলুয়ার রেল’ নিয়ে  শিশু নাটকের সংকলন বেরিয়েছিল প্রথমে ১৯৮৪তে  ‘মনত পরার শব্দ’ নামে। ১৯৯০তে বইটির দ্বিতীয় সংস্করণে নাম হয় ‘কেরেলুয়ার রেল’। এই সবক’টি আবার সংকলিত  হয় তাঁর মৃত্যুর পর ২০০৩এ ‘অন্বেষা’ প্রকাশিত এবং গগণ চন্দ্র অধিকারী সম্পাদিত ‘ নবকান্ত বরুয়া শিশু সাহিত্য সমগ্র---প্রথম খণ্ড’-তে। যেখান থেকে আমরা অনুবাদের পাঠটি নিয়েছি। তিনি নিজে এগুলোকে ‘ননসেন্স রাইম’ গোত্রের বলেছেন। কিন্তু ‘রাইম’ বললে আমরা যা বুঝি, এর ছন্দ হবে ছড়ার--- সে নাটকগুলোতে নাটকের দাবি মেনে ‘ছড়া’র বহু কিছুই নেই, ‘ননসেন্সে’র সবটাই রয়েছে। মাত্রার বৈচিত্র্য আছে, গদ্যের চলন দেবার চেষ্টাও আছে। অন্ত্যানুপ্রাসও আছে, আছে শ্রুত্যনুপ্রাস।আবার বহু জায়গাতে নেই। অনুবাদ করতে গিয়ে আমাদের এই সব সমস্যার মোকাবেলা করতে হয়েছে। আমরা প্রথমত, চেষ্টা করেছি বাংলা ছন্দের তিন রীতিরই আশ্রয় নিয়ে পদ্যের ধাঁচটা রাখতে। এবং যথাসম্ভব সর্বত্র অন্ত্যানুপ্রাস রাখতে। ফলে বহু সংলাপ ছাড়তে এবং কিছু সংলাপ জুড়তে হয়েছে বাংলায়। বহু শব্দকে নিয়েও খেলা করতে হয়েছে, তাতেই ‘বরসা, মশেলা, কিইচ্ছা’ শব্দগুলো এসেছে। যদিও নাটকের মূল গল্প কাঠামোটি অক্ষতই থেকেছে। দ্বিতীয়ত রেলযাত্রীরা বহুভাষিক হয়ে থাকে, এই কথাটি লেখক মনে রেখে শুধু অসমিয়া নয়, মাঝে মধ্যেই বাংলা, হিন্দি এবং ইংরেজি কথন ভঙ্গীরও মিশেল ঘটিয়েছেন। একটি পুরো বাংলা পঙক্তি ছিল ‘কোথায় যাচ্ছ বরের পোলা’। সমস্যা হলো -- একে কি উলটে অসমিয়া করব? তাতে পাঠক ভাবতে পারেন, আমরা অনুবাদ করতে ভুলে গেছি। তো অসমিয়া আমরা রাখিনি। কিন্তু তৃতীয় সমস্যাটি আরো জটিল। তৃতীয় জিরাফের নাম ছিল ‘চিকুট’। এটিকে যমক অলঙ্কার করে ব্যবহার করেছেন।  ‘চিকুট’-এর অর্থ অসমিয়াতে ‘চিমটি’— এবং ‘চিমটি’ ধরে এর পরে গল্প এগিয়েছে। অথচ বাংলা উচ্চারণে শব্দটি হবে ‘সিকুট’ -- যার আর অন্য কোনো অর্থ হয় না। এই সমস্যাকে আমাদের সমাধান করে এগোতে হয়েছে। কী করেছি সে যথাস্থানে পড়াই ভালো। নবকান্ত লিখেছিলেন, “এই নাটককেইখনত কোনো বিশেষ মূল্যর দাবি নাই।” আমাদেরও এই অনুবাদ নিয়ে একই কথা। একটা পরীক্ষা করা হল, এই মাত্র।


আর হ্যাঁ, ছবিগুলো এঁকে দিয়েছেন দুর্লভ ভট্টাচার্য। সুকুমার রায়ের রচনাগুলোর মতোই এই ছবিগুলো ছাড়া নবকান্ত বরুয়ার রচনাও অসম্পূর্ণ। বাংলার পাঠকের অবশ্য তাঁর রচনাগুলো পড়লে উপেন্দ্র কিশোর, সুকুমার রায়দের মনে পড়বে। রবীন্দ্রনাথ সহ এঁদের কাছে ঋণ নবকান্ত স্বীকার করেন। বর্তমান সংকলনেও ভূমিকা লিখতে গিয়ে বীরেন্দ্রনাথ দত্ত সেসব বিস্তৃত আলোচনা করেছেন। আমরা যেন মনে রাখি, উপেন্দ্র কিশোর এবং সুকুমার রায়েও লুই ক্যারল সহ বহু পশ্চিমা লেখকের প্রেরণা কাজ করছিল, নবকান্তেও তার ব্যতিক্রম ঘটে নি। তার সঙ্গে শুধু তাতে বাংলার ঐতিহ্যের সংযোজন ঘটেছে। তার পরেও সুকুমার রায়েরই মতো নবকান্তের রচনা তাঁর নিজেরই রচনা, মৌলিক। ‘কোনো কবি বা কোনো শিল্পী সম্পূর্ণ এককভাবে অর্থপূর্ণ হ’ব নোয়ারে।’ বীরেন্দ্রনাথ দত্তের এই কথাটি মনে রেখে যদি এই একক অনুবাদ নবকান্তের বাকি রচনাতে প্রবেশে আগ্রহ বাড়ায় তবেই আমাদের এই পরীক্ষা, এই  শ্রম সফল।    ---অনুবাদক]       



ধুয়া: ঝোঁক ঝোঁক ঝোঁক ঝোঁক
পীঁ পীঁ পীঁ পীঁ
রেল চলে চলে রেল
             কেন্নো পোকার রেল চলে পাঞ্জাব মেল।

বিছা: মাকড়ি দি গো মাকড়ি দি;
বলছি তুমি, বাড়ি আছো কি?

মাকড়সা: না থেকে ভাই  কই বা যাব,
             তাঁত মেলানো, কই বা থুব?
বিছা: কী বা তুমি বুনছ দিদি?
মাকড়সা: আয় তোরে ভাই দেখিয়ে দি,
               ...... ফুল
বিছা: তোমার জন্যেই এনেছিলাম এক লাছি উল।
মামার  ছেলেকে দিতে  সোয়েটার চাই।
মাকড়সা: আগে কেন বলিস নি রে, ভাই?
  পরশু দেখ, লাগিয়েছি এইখানা তাঁত
  বাতাসে ছিঁড়ল কিনা সুতোটার গাঁট
             এক মাথা টানি যদি আর মাথা ছিঁড়ে
    আগেকার মতো যদি কিছুতেই জুড়ে।
বিছা: আগের মতো লাগলে তবে,---  হবে
মাছিরাম কেরানিকে খবরটা তো দেবে।
কী দারুণ গো, কী দারুণ! নকল করা জানে
আমরা কী গো! মানুষই তো দেখে হার মানে!
মাকড়সা: চল̖ , তবে কেন্নো রেলে ওর খবরে যাই।
মাছিরাম কেরানিটাকে কই বা গিয়ে পাই?
বিছা এবং
মাকড়সা: কেন্নো পোক ঝোঁক ঝোঁক, এই র্যা্লা!
দাঁড়াও দেখি,যাচ্ছ কোথা নবাব পোলা?
কাপলিং ছেঁড়া দেখি পাঞ্জাব মেল
ঠেল রে  গজরা, ইঞ্জিন ঠেল!
ধুয়া:  ঝোঁক ঝোঁক ঝোঁক ঝোঁক
পীঁ পীঁ পীঁ পীঁ
রেল চলে চলে রেল
চলে পাঞ্জাব মেল।

                                              কেন্নো: যাবে যদি, খোলো সাহেব
                        কালো ওভার ক’ট;
        মেমও ছেঁড়ো লাল রশি
                        লাগবে  চাকায় জট ।
                        করো না কো ঠেলা ঠেলি
                        ডান হাতে টিকিট কিনে
                                                              বাম হাতে দোয়ার মেলি
                                                              নাও গো বসার সিট চিনে।
                                                              গল্প করো, আলাপ করো,
                                                              কার পরিচয় কী?
                                                              পি পি পি!
                                                              মিষ্টি কথায় তুলে ধরো। 
                                                              অচেনা কোনো প্যাসেঞ্জার
                                                             নিয়ে আমি  যাই--
                                                              এমন কোনো  কারবার
                                                             আমার তো গো নাই।
 বিছা:      ইনি মিসেস মাকড়ি দিদি তাঁত বুনেন ভালো।
চরকা নেই, মাকু নেই অন্ধকার বা আলো।
চিকন করে সুতো কাটেন,তাঁত বুনেন বসে
              পাড়া পড়শি কেউ শোনে না সাড়া শব্দ এসে।
              রান্না করা নেই, নেই তেল  মশেলা
              লিকুইড ডায়েটে  রোজ চলে  দু’বেলা।
মাকড়সা: একে তো চেনোই, নাম শ্রী বিছাধর
  গায়ে কালো সোয়েটার বরসা ঋতুভর।
সরু গলা, যায় না খোলা
এ নিয়েই পথ চলা।
সবাই: এভাবেই যাই তবে, চলো!
কী বলো ভাই, কী বলো?
কেন্নো: যাই তবে এভাবেই
ওঠো,আছো যেভাবেই।
আগে গিয়ে বলে দিও,নেমে যাবে কই!
মাকড়সা: মাছিরাম মশায়ের বাড়িমুখে অই!
কেন্নো: কে সে মাছিরাম?
           কীই বা ভালো নাম?
             নীলচে
             না কালচে,
             বোতলা না মৌ,
          না ঐ  আদরের কুনকুনি বৌ
          ফলে ফলে ডিম পাড়ে,
                  বাকিদের বাড়িঘর ---
                    কে  চেনে  কারে!
মাকড়সা: আম ঝুলে ডালে ডালে
  নীল মাছি পালে পালে
  যেখানে মানুষ থাকে
  মাছি ঘুরে ঝাঁকে ঝাঁকে।
বিছা: এ মাছি  গো, সে মাছি না;
           কাঁঠালের আঠাতে তার পাখা লাগে না।
           আসলে কী গল্প জানো,
  বলি তবে,মানো কি মানো।
  মাছিমরা ছিল তার নাম,
  তখনো জন্মে নি তো রাম।
  যখন মরা মরা চেঁচিয়ে,
  উঁইঢিবি গুড়িয়ে
  বেরিয়ে রত্নাকর,
              লেখে রামায়ণ
              আমাদেরও মাছিবর,
  মাছিরাম কেরানিতে পেলো প্রমোশন।
কেন্নো: ঠিক আছে, ঠিক হ্যাঁয়!
দেখি, গাড়ি কই যায়!
উঠে যাও এইবার
আমিই ইঞ্জিন,আমিই ডেরাইভার!
                         ধুঁয়া নেই, ধূলি নেই
                         লাল এক রেল...
                         ঠেল রে গজরা, ইঞ্জিন ঠেল!
 
ধুয়া:  ঝোঁক ঝোঁক ঝোঁক ঝোঁক
পীঁ পীঁ পীঁ পীঁ
        রেল চলে চলে রেল
                        কেন্নো পোকার রেল
                        চলে পাঞ্জাব মেল!

বিছা:        আরে! এ যে আরো আছে প্যাসেঞ্জার
               রকম রকম কত রকম দেখো ফ্যাশন যার।
        ইনি মিস্টার গো বরুয়া, তাঁর ভাঙা মটর গাড়ি।
মাকড়সা: কলকাতা যাবেন বুঝি, হবে রিপিয়ারি?
কেন্নো: এ যে দেখি শিরি যুক্ত পি পিঁপড়া বাবু
             জংলি শসার বিচি লেগে হলেন বুঝি কাবু?
বিছা:        পি পিঁপড়া? নাম শুনি নি। কোথায় নিবাস?
কেন্নো:       পি কক্, পি হেন্ ---এদের পাশাপাশি বাস।
             সোনা পিঁপড়া, ডাঁই পিঁপড়া, পিঁপড়া আছে কত!
             লিখেছে এদের কথা শাস্ত্র আছে যত।
             কলহ না করে যেন কর্ম করে খায়,
             শিরি কিষ্ণ শেখালেন-- গীতাতে বাখায়!
              সব পিঁপড়া মিলে নিল পি পিঁপড়া নাম।

সবাই: বলো রাম রাম!
               উঠে যাও, উঠে যাও! কথায় কী কাম?   

ধুয়া:  ঝোঁক ঝোঁক ঝোঁক ঝোঁক
পীঁ পীঁ পীঁ পীঁ
            রেল চলে চলে রেল
                        কেন্নো পোকার রেল
                    চলে পাঞ্জাব মেল!

পিঁপড়া: কে কে শুনবে বলো, মজার কিইচ্ছা।
                রূপকথা জানি বেশ, শোনাই যত ইচ্ছা।
মাকড়সা: কিচ্ছা জানো! বেশ!
    সেই যে রাজা ছিল, গোধার দেশ!
বিছা: নইলে,সেই যে ছিল রাজহাঁস এক,
সোনার ডিম দিত। প্যাঁক প্যাঁক প্যাঁক!
নতুবা সেই বুড়ো
কচু খেতে সারা দিন মাটি গুড়ো গুড়ো...
পিঁপড়া: সেসব কথা,কথা কি এমন
অং বং চং
এ মন তালাসি, পেয়েছি নূতন
গল্প বলার ঢং।
 গোবরে পোকা: বলো বলো বলো! কিসের ঢং?
                       চিনের যাদু বুঝি, চিং চাং চং !
                  নাকি সেই আলাদিনের  আশ্চর্য বাতি,
                       কেঁচোমাটি সন্ধানে হাম কলকাতা যাতি।  
                 দৈত্যটা শিখেছে কি নতুন কেরামতি?
                         রেডিয়েটার হয়েছে লিক, চাই মেরামতি।
পিঁপড়া:       এক ছিল বন্ধু
              তার ছিল সন্দুক।
গোবরে পোকা: সন্দুকে বন্ধু থাকা কাহানি নেই মাঙতা।
পিঁপড়া: আরে, বলা ভুল হয়েছে,
                কী যেন,প্যাঁচ লেগেছে।
                 এইবার গল্প বলি, একদম টাটকা!
                 নেই কোনো ফাটকা।
                এক ছিল বন্দুক,
                না ছিল সন্দুক।
                 বন্ধুরা প্যাঁচিয়ে দিল রাং রাং রাং তা।
                  তবে বুঝো এইবার
                 কিছু কর কানটার।
                  কালো কচু তুলে এনে কান করো সাফ।
                  চিড়িয়াখানায় যেয়ে
                 তামোল পান  খেয়ে
                  একা একা  চরছিল তিনটি জিরাফ।
সবাই: জিরাফ!
পিঁপড়া:       হ্যাঁ, জিরাফ!
স্বরটা ভীষণ রাফ।
সারাটা শরীর ভরে তুল তুলে পাফ।
কপালে রয়েছে এক ছোট ফুট নোট
ওরা যে  বংশের, তার নাম হলো কূট।
সবাই: জানি, জানি, সেতো জানি!
মাটিতে গজায় লংকা ধানি।
কূট বংশ মহা বংশ
চাণক্যের অংশ
চিত্রকূটের সরোবরে
চরে পরম হংস।
গোবরে পোকা:      প্রথম জিরাফের নাম কি বা কূট,
বিসকূট, মিসকূট না কিসকূট?
পিঁপড়া: কেবলই ই কুট!
ওর ভাই সই করে
মিস্টার বি কুট।
তারও যে ছোট ভাই
  মিস্টার চি কুট।
ইকুট বিকুট  ভাই
তামোল পান খাই
জিহ্ব দেয় পুড়িয়ে
পাণ মশলা কুড়িয়ে
পায় কই---
                        যায় তার সন্ধানে।
কেবা বলো, জুড়ায় জ্বালা  মন দানে!
বাড়িতে তখন বসে   কোন কূট?
বাতাও ভাই, বাতাও দেখি! কোন কূট?
সবাই: সিকুট  সিকুট চিকুট!
পিঁপড়া: চিকুট! অসমিয়া চিকুট ।
                     চিকুট মানে চিমটি।
                        খাও, পাও টেরটি।
                                     ( পিঁপড়া সবাইকে চিমটি কাটে।
বিছা: আরে আরে আরে! পি পিঁপড়া  চিমটি কাটো কেন?
পিঁপড়া: আকাশ কেন নীল,পাহাড় কেন খাড়া? জানো না যেন!
লবণ জলে উঠেনা কেন সাবানের ফেন্?
চিমটি দিলে বাচ্চারা হে করে ঠেন্ ঠেন্!

বিছা: খবরদার! আমায় যদি কাটো!

তবে এই যে ফুলের ঝাড়ু,
  আমার গায়ে দেখ̖ছো, গাড়ু!
ছিঁড়ব তোমার পিঠে, দেখি কেমন করে ঝাঁটো।
মাকড়সা: পি  পিঁপড়া কেটে দিল। আনো রে আনো, টিংচার।
গোবরে পোকা: গো বরুয়াকে কাটিস যদি হবি তবে পাংচার।
পিঁপড়া: এসব এখন রাখো,
    কেন্নো রেলটা দেখো।
                                                         সবাই ওকে চিমটি কাটো, কুট!
    ইকুট বিকুট চিকুট। কাট কুট কুট!
সবাই:        হেইও!  হেই! উঠ উঠ উঠ!
    চিকুট চিকুট চিকুট!
 কেন্নো: খবরদার! খবরদার!
    পিপিলিকা খবরদার!
                 খবরদার বিছাধর!
                  মাকড়িদি নট নড়াচড়!
                 এতোক্ষণ ছিলাম রেল
                 খেলছিলাম মজার খেল
                    জানো না কি, পূর্বপুরুষ আমার অষ্টাবক্র
    গা প্যাঁচিয়ে হচ্ছি দেখো সুদর্শন চক্র।
মাকড়সা: আমার সুতা ছিঁড়িল
বিছা:              আমার জামা ফাটিল
গোবরে পোকা: আমার পাখা ঝরিল
পিঁপড়া: আমি হলাম চ্যাপেটা। এখন কী করি লো!
সবাই: বাঁচাও ! বাঁচাও!   হে অষ্টাবক্র পুত্র।
          চক্র যদি না মেলে দাও, পালাই তবে কুত্র?
কেন্নো: বেশ!
                 তবে চিমটিও যেন হয় শেষ!
                 উঠে এসো, উঠে বসো ! চালাই আবার রেল।
                 গার্ড বাবু বাজাও হে! বাজাও হুইসেল।     
 
ধুয়া:  ঝোঁক ঝোঁক ঝোঁক ঝোঁক
পীঁ পীঁ পীঁ পীঁ
                  রেল চলে চলে রেল
                        কেন্নো পোকার রেল
                        চলে পাঞ্জাব মেল।


                         ~~~~~০০০~~~~~

 
   
   
   



Tuesday, 26 September 2017

হরেন্দ্রনাথ বরঠাকুর এবং তাঁর শিশু নাটক

।। সুশান্ত কর।।

(গত ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৭তে তিনসুকিয়ার 'উজান সাহিতো গোষ্ঠী' এক সভাতে হরেন্দ্রনাথ বরঠাকুরকে সংবর্ধনা জানায়। সেখানে এই শিশু সাহিত্যিক তথা নাট্যকারের জীবন এবং কর্মের পরিচয় দিতে গিয়ে এই বক্তৃতাটি তৈরি হয়ে যায়। মূল অনুষ্ঠানে এর একটি সংক্ষিপ্ত বয়ানই পরিবেশিত হয়েছিল। এখানে রয়েছে সম্পূর্ণ এবং বিস্তৃত )



“আমার নাটকগুলো সত্যি নাটক হয়েছে কি হয় নি, সে নিয়ে আমার নিজেরই সন্দেহ আছে। প্রত্যেকটি নাটকই তাগাদাতে লেখা। অভাব আর চাহিদা পুরাতে লেখা। লেখে উঠে, বা মঞ্চায়ন দেখে আমি সবসময় ভীষণ একটা অসন্তুষ্টিতে ভুগী। জানি না কিসের তাড়নাতে নাট্যপীঠ বা প্রশান্ত শর্মা আমার নাটকগুলো এতো যত্ন করে রেখেছেন---যে কাজগুলো কিনা আমি নিজেও করবার দরকার মনে করি নি। কেনই বা তিনি এই সংকলন এতো কষ্টে আর শ্রমে প্রকাশ করতে গেলেন, সে আমার কাছে একটি উত্তর বিহীন প্রশ্ন হয়েই আছে। আমার ভয় হচ্ছে, এই সমস্ত শ্রম এবং আন্তরিকতা সুধী সমাজের বিচারে শেষঅব্দি একমুঠো নষ্ট ফসলে না পরিণত হয়। সেরকম হলেও আমার দিক থেকে খেদ করবার কিছু থাকবে না। সে আমার অজ্ঞতা, বৌদ্ধিক সীমাবদ্ধতা এবং অপরিপক্বতা বলে দ্বিধাহীনভাবে মেনে নেব।” কথাগুলো আমরা অনুবাদ করে নিয়েছি। লিখেছিলেন   হরেন্দ্রনাথ বরঠাকুর তিন বছর আগে তাঁর ‘শিশুনাট সমগ্রে’।  তিনি আরো লিখেছিলেন, “নাট্যকার হবার ধৃষ্টতা আমার কোনোদিনই ছিল না, এখনো নেই। ছাত্রবেলা এবং যৌবনবেলাতে লেখা বহু নাটক আমি নিজেই নষ্ট করে ফেলেছি...” ---এই সব উচ্চারণ যার তিনি এবারে ২০১৭তে অসমীয়া শিশু সাহিত্যে, তথা নাটকে জীবনজোড়া অবদানের জন্যে সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছেন। আর কথা গুলো লিখেছিলেন তিনবছর আগে প্রকাশিত তাঁর নাট্য সমগ্রে। শিবসাগরের ‘নাট্যপীঠে’র হয়ে বইটি সম্পাদনা করেছিলেন নাট্যপরিচালক, প্রশিক্ষক, অভিনেতা প্রশান্ত শর্মা।  আপনাদের মনে হতে পারে আকাদেমি পুরস্কার বুঝিবা নিজের সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে তাঁর ধারণাকে প্রথমবারের জন্যে ভ্রান্ত প্রমাণ করে দিল। এমন ভ্রান্তি আমাদের অনেকরই হয়ে থাকে। বুঝিবা স্বীকৃতি একটি প্রতিষ্ঠান দিলেই দেয়া হলো। আসলে ততদিনে তাঁর নাটক সারা অসমেই বহুবার অভিনীত হয়ে গেছেই। অধিকাংশেরই উদ্যোক্তা এই নাট্যপীঠ এবং পরিচালক প্রশান্ত শর্মা। কিছু নাটক করেছিল উত্তরলখিমপুরের ‘নাবিক’ নাট্যগোষ্ঠী। তাদের দরকারে তাঁরা নাটক চেয়ে গেছেন, আর হরেন্দ্রনাথ বরঠাকুর লিখে গেছেন। ১৯৯৬র ১লা জানুয়ারিতে আরেক প্রখ্যাত নাট্যকার সফদর হাসমির মৃত্যুদিনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল নাট্যপীঠ। সেই থেকে তাঁদের অধিকাংশ নাটকই লিখেছেন হরেন্দ্রনাথ বরঠাকুর। কেবল ‘রজার দেউল’ এই একটি নাটকই বিশের বেশিবার অভিনীত হয়েছে। বাকিগুলো মিলিয়ে কবার অভিনীত হয়েছিল আমরা একটা অনুমান করে নিতে পারি। দর্শক সমালোচকেরা যদি ইতিমধ্যে নাটকগুলোর সমাদর না করতেন, তবে তাঁর লেখা নাটকগুলোর থেকে দশখানা নাটক এখান ওখান থেকে সংগ্রহ করে নিজে উদ্যোগী হয়ে প্রকাশ করতে উৎসাহী হতেন না প্রশান্ত শর্মা। তিনি ভেতরে কী কষ্ট করেছিলেন আমরা শুনেছি, দেখিনি। কিন্তু বাইরে আমরা দেখেছি কত শুভানুধ্যায়ীর থেকে পাই পাই করে অর্থ সংগ্রহ করে ব্যয়ভার সংগ্রহ করেছেন। এবং প্রকাশ করেছিলেন ২০১৪র ফেব্রুয়ারির এক বিকেলে তিনসুকিয়া মহাবিদ্যালয়ে এক গুণীজন সমাবেশে। তাঁর পরেও যখন নিজের এই সব অসন্তুষ্টির কথা তিনি ‘নাট্যকার’ আমাদের জানান, তাকে নিছক ‘বিনয়’ বললে তাঁর অসম্মান করা হয়। তিনি অন্তর থেকে জানেন, শিল্পীকে যখন নিজের কাজে সন্তুষ্টি আর দম্ভে পেয়ে বসে তখনই তাঁর ‘যবনিকা পতন’ হয়। নিজের ‘সীমাবদ্ধতাটি’ জেনে একটি অসন্তুষ্টি তাঁর মনে কাজ করে বলেই তিনি মহৎ নাট্যকার, মহৎ শিল্পী। এটা যে কোনো নবীন শিল্পীর কাছে শেখার জিনিস।
            তবে এখানে জানিয়ে নিই, যে বইটির কথা আমরা উল্লেখ করলাম এটিই তাঁর নাটক নিয়ে জীবন জোড়া কাজ নয়। জনপ্রিয় প্রকাশনা সংস্থাগুলো আজঅব্দি তাঁর দিকে যে খুব একটি নজর দিয়েছে, সেরকম আমরা দেখিনি। কিন্তু নিতান্তই আত্মীয় বন্ধু বা নিজের প্রয়াসে প্রকাশিত  তাঁর রচনার সংখ্যা নিতান্ত কম নয়।আটটি পথ নাটক, বেশ কিছু একাঙ্কিকা, দুটি পূর্ণাঙ্গ নাটক লেখা ছাড়াও শিশুনাটক নিয়ে তাঁর সুগভীর তাত্ত্বিক অধ্যয়নের খতিয়ান রয়েছে ‘প্রসঙ্গ অসমীয়া শিশু-নাট্য’ নামে একটি প্রবন্ধ সংকলনে, যেটি অসম সাহিত্য সভার তিনসুকিয়া শাখা প্রকাশ করেছিল ২০০৫এ। ‘খরিয়ে মেলিলে বাট’,‘কণ পরুয়ার বিলৈ’ সহ বেশ কিছু শিশু উপন্যাস, বেশ কিছু কবিতাও তিনি লিখেছেন--- যদিও সেগুলো বই আকারে বেরিয়েছে বলে কোনো সংবাদ আমাদের কাছে নেই।তাঁর লেখা বহু প্রবন্ধপাতি অসমিয়া –বাংলা ছোটকাগজে,স্মরণিকাতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। বহু অনুবাদও তিনি করেছেন।ভগৎ সিংহের সুবিখ্যাত বই তাঁর অনুবাদে ‘মই কিয় নাস্তিক হলো’ নামে দশকখানিক আগে প্রকাশিত হয়েছিল। এখন তিনি ব্যস্ত রয়েছেন সুকান্ত ভট্টাচার্যের শিশুরচনাগুলোর অনুবাদে। এই সব কাজের জন্যে ইতিমধ্যে বেশকিছু পুরস্কারেও সম্মানিত হয়েছেন। তবে শেষ প্রকাশনা অবশ্যই ‘হরেন্দ্রনাথ বরঠাকুর শিশু-নাট সমগ্র’। এবং এই বইটি থেকেই তাঁর দিকে আকাদেমির নজর পড়ে। তাই আমরা সেটি নিয়ে কিছু কথা বলতে চাই, যাতে তাঁর কাজের সম্পর্কে কিছু ধারণা মেলে।
           দশখানা নাটক। তার প্রথমটি ‘প্লেটফর্ম’ এবং ‘একলব্যর বিচার’ ছাড়া বাকি প্রত্যেকটিই বলতে পারি স্পষ্টতই রূপক নাটক। কারণ সেগুলোতে জীব-জন্তু গাছপালা সবাই চরিত্র এবং তারা নিজেদের মধ্যে এবং শিশুদের সঙ্গে কথাও বলে, কাজও করে। এমন কি একটি নাটকে ‘পলরীয়া প্রতিধ্বনী’তে  ‘প্রতিধ্বনী’ও কথা বলে। প্রতীকের রূপকথা উপকথার আদল রয়েছে প্রায় সবকটিতে।  কিন্তু এর একটিও অবাস্তবও নয়, নয় পৌরাণিকও।
     
    ‘প্লেটফর্ম’ নাটকটিকে আপাতদৃষ্টিতে একটি ‘বাস্তববাদী’ নাটক বলা যেতে পারে। নয়টি দৃশ্যে রেলস্টেশনের প্লেটফর্মের ভবঘুরে দরিদ্র শিশুদের গল্প। তাদের কেউ স্টেশনেই গান করে হাত পেতে পয়সা রোজগার করে, কেউ বুট পালিশ করে, কেউ সামান্য টাকার বিনিময়ে সিনেমার পোস্টার সাঁটে শহরের দেয়ালে দেয়ালে। এদের রোজগার যত্রতত্র, কিন্তু মাথা গুঁজবার ঠাই এই স্টেশন প্লেটফর্ম। তাদের জাতধর্মের কোনো ঠিকানা নেই। ‘রানি’ বলে মেয়েটিকে দলনেত্রী বানিয়েছে। রোজগারের টাকা সবাই এসে ওকে দেয়, সে হিসেব করে ওদের ‘সংসার’ সামাল দেয়। আর পি এফ, স্টেশন মাস্টার, বাইরের দুনিয়ার বাবুদের উপেক্ষা, অবজ্ঞা, অত্যাচারে জীবন কাটে।সন্ত্রাসী আক্রমণে রেলবন্ধ হলে এরা বিপন্ন হয়, যাত্রী নেই। ফলে রোজগার জোটে না। জোটে না খাবার। বাইরের শহরে সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামা হলেও যেমন জীবন যাপন করা কঠিন হয়, তার উপরে প্রশ্ন উঠে এদের কার ধর্ম বা কী? সাংবাদিক যতীন এদের বন্ধু হয়, দলের সদস্য হয়। তাদের লিখতে পড়তে শেখায়, গাইতে শেখায় নতুন গান। এবং শেষে প্রতিবাদ করতে। এবং নাটকের শেষে এদের টিকিট কেটে রেলে চড়িয়ে পাঠায় অন্যান্য প্লেটফর্মে গিয়ে তাদের মতো যেখানে যত পথশিশু রয়েছে তদের সংগঠিত করতে। এমন করে পথশিশুদের সংগঠিত করা সম্ভব কি না, যখন কি না স্টেশন কর্তৃপক্ষই এদের স্টেশন থেকে তাড়াতে চাইছে, তখন মধ্যবিত্ত যতীন মামার এই পদক্ষেপ অসচেতনভাবে হলেও কর্তৃপক্ষের কাজটিই সহজ করে দিল কি না  খুব কট্টর বাস্তববাদী তথা যৌক্তিক অবস্থান থেকে এই প্রশ্ন উঠতেই পারে। কিন্তু যদি প্রশ্ন করি, একটি সুন্দর জীবনের স্বপ্ন দেখা এবং দেখানোর এই ভিন্ন নাট্যকারের সামনে কী পথই বা খোলা ছিল, তখন এইটুকুন খামতি বাস্তবতার দিক থেকে আমাদের মেনে নিতে বেগ পেতে হয় না।
                  বাকি নাটকগুলোতে সেই সমস্যা নেই। প্রতীকী নাটক দুরকমের হয়ে থাকে। এই যেমন রবীন্দ্রনাথের ‘রক্তকরবী’ আদি হচ্ছে সাঙ্কেতিক নাটক। সেখানে  রাজা-নন্দিনী-রঞ্জন ইত্যাদি চরিত্রগুলোর মর্ম দর্শকের বোঝা কঠিন হয়ে পড়ে নাট্যকারের ভাবনার সঙ্গে আলাপ না থাকলে। যদিও নাট্যকার ক্রমেই কিছু স্পষ্ট করেও থাকেন, কিছুটা দর্শকের বোধের উপরে ছেড়ে দেন। হরেন্দ্রনাথ বরঠাকুরের নাটকগুলো সেই অর্থে সাঙ্কেতিক নাটক নয়। এগুলোতে মানবেতর প্রাণী, জড় পদার্থ এমন কি প্রাকৃতিক ঘটনাতেও মানবিক চরিত্র আরোপ করেছেন তিনি। সেই অর্থে এই সব উপস্থাপনাকে অবাস্তব বলে মনে হতে পারে,কিন্তু নিজেদের অন্তর্বস্তু নিয়ে চরিত্রগুলো এমন কি কল্পিত কাহিনিও অনেক বেশি বাস্তব হয়ে উঠে। এই ব্যক্তি-বস্তু বা ভাবের বিশেষ কোনো মর্ম এমনিতে স্বাভাবিক অবস্থাতে আমাদের কাছে স্পষ্ট ধরা নাও দিতে পারে, নাট্যকার তাই স্পষ্ট –রূপময় এবং বাস্তব করে তুলেন।  হরেন্দ্রনাথ বরঠাকুরের বাকি সব নাটক এই গোত্রের,অর্থাৎ যাকে বলে রূপক নাটক। অবশ্য শিশুনাটকে এই রূপক আশ্রয়ের একটি অন্যতর ব্যাখ্যা হরেন্দ্রনাথ বরঠাকুরের রয়েছে, যার সঙ্গে আমাদের বিদ্যায়তনিক পরিচয় সাধারণত কম হয়। সেসব তিনি লিখেছেন ঐ ‘প্রসঙ্গ অসমীয়া শিশু-নাট্য’ বইতে। সেখানে তিনি ১৮ বছর অব্দি শিশুদের বয়স ভেদে মানসিক অবস্থা নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা করেছেন। এবং লিখেছেন,  তিন থেকে পাঁচ বা ছয় বছর বয়স অব্দি শিশুরা বিমূর্ত ধারণা করতে পারে না। অর্থাৎ মানুষে পশু পাখিতে তফাৎ সেরকম করতে পারে না। পশুপাখির কথা বলা তার কাছে খুবই স্বাভাবিক বলে মনে হয়।মানুষের পিঠে পাখা জুড়ে দিয়ে পরি বানিয়ে ফেললে শিশু তাকে অবাস্তব বলে মনে করে না। ফলে শিশুর দিকথেকে নাটকগুলো রূপক নাহয়ে হয়ে পড়ে বাস্তব। এই বয়সের শিশুর মধ্যে ‘অনুকরণপ্রিয়তা’ প্রবল থাকে। ফলে সে বড়দের আচরণ অনুকরণ করে। পুতুল নিয়ে রান্নাবাটি খেলে, পুতুলকে খাইয়ে দেয় ঘুম পাড়িয়ে দেয় ইত্যাদি। হরেন্দ্রনাথ বড়ঠাকুরের নাটকে সেভাবে পুতুল খেলা দেখব না। কিন্তু এই অনুকরণপ্রিয়তার কথাই মনে হয় তিনি ভেবেছেন যখন বেশ কিছু নাটকে আমরা দেখব শিশুরা আদালত বসিয়ে দিয়েছে, প্রতিবাদী বা শোক সভা করছে। সাত থেকে চৌদ্দ-পনেরো বছরের শিশুদের প্রবণতা হচ্ছে সমবয়সীদের মধ্যে দল গঠন, দলের প্রতি আনুগত্য। ফলে বহু নাটকেই দেখব শিশুরা দল বেঁধে করছে যা করবার, প্লেটফর্মে সবাই দলনেত্রী রানির আনুগত্য মেনে নিয়েছে।যাই হোক, আমরা তাঁর নাটকে চলে যাই।  
             দ্বিতীয় নাটক ‘বালিমাহীর কথা’ নাটকটি তৈরি হয়েছে গল্পের ভেতরে রয়েছে গল্প দিয়ে। মূল গল্পটির শুরু একটি বাস্তব গল্প দিয়ে যেখানে পপী-পিঙ্কুমণি-মাইনারা একটা খোলা জায়গাতে খেলছিল। কিন্তু কী খেলা হবে সেই নিয়ে ওদের মধ্যে তর্ক বাঁধল, জায়গাটি খেলার জন্যে উপযুক্তি বিবেচিত হলো না। ফলে তারা শিশুসুলভ ঠাট্টা তামাসা করে নিজেরাই রেল হয়ে ‘ঝক-ঝক রেলগাড়ি চলে রেলগাড়ি’ গান গেয়ে ‘কণখুড়ার’ বাগিচাতে গিয়ে উপস্থিত হয়। সেখানে গিয়ে বাগিচার বিপর্যস্ত অবস্থা দেখে এরা বড় মর্মাহত হয়। গাছগাছালি কেটে ফেলা হয়েছে। ভাঙ্গা পাখির বাসা ইত্যাদি দেখে এরা বেশ মর্মাহত হয়। ফলে তারা কি কিছুই খেলল না? অবশ্যই খেলল। মৃতগাছগাছালির জন্যে একটি শোকসভা বসালো, সেই সভা পরিণত হল প্রতিবাদী সভাতে। এবং সিদ্ধান্ত হল বাগিচাটিকে জনতার বাগিচা ঘোষণা করে এখানে আবারও বাগিচা সাজিয়ে তুলতে হবে। তারা বাগিচা সাজাচ্ছে, দিন যাচ্ছে। পপীর কিন্তু ভাবনা যে পাখিটির বাসা ভেঙ্গেছিল, সে আবার ফিরে আসবে কি না। একরাতে সে স্বপ্নে দেখতে পেল সেই পাখিটি একটি  ‘বালিমাহী’ অর্থাৎ খঞ্জনা। সবাই জানতে চাইল স্বপ্নে সে কী দেখেছে? সর্বত্র বাসা বাঁধবার জায়গা খুঁজে পাখিটি হয়রান, পাচ্ছে না কোথাও। এবারে সেই স্বপ্নের কথাটিকে নিয়ে পপী এবং বন্ধুরা তৈরি করে একটি নাটকের ভেতরে নাটক, যেটি বিশুদ্ধ এক রূপকাংশ। খঞ্জনা গাছের কাছে যায়, ঘরের কাছে যায়, ঝর্ণার কাছে যায়, পর্বতের কাছে যায়। তার ডিম পাড়বার সময় হয়েছে, বাসা বাঁধবার জায়গা চাই। অথচ, সর্বত্র দূষণে সবাই বিপন্ন , কেউ তাকে নিরাপদ ঠাই দেবার প্রতিশ্রুতি দিতে পারল না। স্বপ্নের কথা ওখানেই শেষ। কিন্তু স্বপ্নে-বাস্তবে এক হয়ে যায়, যখন শেষে ক্লান্ত খঞ্জনাটি সত্যি এসে পপী-পিঙ্কুদের সামনে অচেতন হয়ে পড়ে যায়। তারা তাকে সেই নির্মীয়মাণ বাগিচাতে আশ্রয় দেয়, শুশ্রূষা করে সুস্থ করে তুলে এবং শপথ নেয় এক দূষণমুক্ত পৃথিবীর গড়বার।
            তৃতীয় নাটক ‘জোনমণির স্বর্গযাত্রা’তেও সেরকম নাটকের ভেতরে নাটক রয়েছে। গল্পটি তিনি নিয়েছেন পোল্যান্ডের লেখক আইজাক বাসেভিচ সিঙ্গারের একটি গল্প ‘মূর্খের স্বর্গ’ থেকে। জোনমণি অলকা ভাইবোন। প্রাতিষ্ঠানিক স্কুলশিক্ষাতে জোনমণির কোনো আগ্রহ নেই। তার বোন অলকা ঠিক বিপরীত। জোনমণি ছবি এঁকে প্রজাপতি ধরে, খেলাধুলো করে ভালো পায়। পড়াশোনা করে নয়। ওদিকে বাড়িতে খুব চাপ। তার মন খারাপ হতে থাকে এই বন্দি দশাতে। সে গল্পচ্ছলে ঠাকমার থেকে জানতে পায় যে স্বর্গেই একমাত্র সুখ, কিন্তু সেখানে লোকে না মরে যেতে পারে না। সুতরাং সে মরবে বলে স্থির করে ফেলল, খাওয়া দাওয়া ছেড়ে দিল। কেউ এই অসুখের কোনো কারণ জানে না। প্রতিবেশী এক দাদু রহস্যটি ভেদ করলেন। তিনি স্বর্গ নিয়ে একটি নাটক তৈরি করেন। জোনমণির ঘরটিকে স্বর্গের মতো সাজিয়ে তুলেন। অলকার জনাকয় বান্ধবীদের সাজানো হলো পরি। সেই নাটকে তার এই বোধ হলো যে যত সুখ এই মাটির পৃথিবীতেই। সরাসরি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বিরুদ্ধে কোনো কথা নেই, বটে। কিন্তু প্রতিবেশী দাদুটি যেভাবে নেচে গেয়ে নাটক করে তাঁকে জীবনে শিক্ষাটি দিলেন---তাতে বিকল্প শিক্ষার একটি ভাবনার বীজ তো বপন করেই এই নাটক।
             চতুর্থ নাটক ‘বেলি ওলোয়া সাধু’ সেরকম কেশব মহন্তের একই নামে একটি গল্পের নাট্যরূপ। এর একটি প্রস্তাবনা দৃশ্য রয়েছে, যেখানে ঘোষক বা সূত্রধার কেশব মহন্তের ভূমিকাতে অবতীর্ণ হন, এবং একদল ছেলে মেয়েকে ঘুমিয়ে পড়া সূর্যের ঘুম ভাঙাবার গল্প বলতে শুরু করেন। এই গল্পই ক্রমে নাটকে পরিণত হয়।  সেই নাটকে অলঙ্কৃতা আফ্রিদি ইত্যাদি কচিকাঁচারা বড় চিন্তিত হয়ে পড়ে কী করে সূর্যের ঘুম ভাঙানো যায়, এতো দূর সূর্যের কাছে যায়ই বা কে আর কীভাবে? চিলকে ডাকা হলো।  চিল গিয়ে বাকি পাখিদের কাছে সমস্যাটি তুলে ধরল। তারপরে পাখিদের মধ্যে নানান তর্ক বিতর্ক দ্বিধাদ্বন্দ্বের ছবি যেভাবে নাটকে উপস্থাপিত হয়---সে আমাদের সংগঠন করবার, মহৎ উদ্দেশ্যে ত্যাগ করবার না করবার, ঈর্ষা-বিদ্বেষ, মিথ্যাচারের শিকার হবার অভিজ্ঞতার গল্প। দুঃসাহসিক অভিযানে টিয়া যেমন ফাঁকি দেয়, কোকিল তেমনি প্রাণ দেয়। ময়ূর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। প্রতি যাত্রাতেই জোনাকি ওদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যায়। শেষে গিয়ে মোরগ সফল হয়। এটি রূপকথারই গল্প। কিন্তু হরেন্দ্রনাথ বড়ঠাকুরের কলমে যেন অন্ধকার থেকে আলোর বিশ্বে যাত্রার মানুষের সংগ্রামের গল্পে পরিণত হয়েছে।

             
পঞ্চম নাটক ‘পলরীয়ার প্রতিধ্বনি’র গল্প অনেকটা সেই ‘বালিমাহীর কথা’র মতোই । সেখানে যদি দূষণে তবে এখানে নগরায়ণে শিশুদের খেলবার ঠাই নেই হয়ে যাবার সংকটের গল্প। গল্পটি জার্মান লেখক ফ্রেডরিখ ফ্লেডের শিশু উপন্যাসের ডব্ল্যু কে হোমসের কথা ইংরেজি  অনুবাদ "রানওয়ে ইকো’র অসমীয়া নাট্যরূপান্তর। ত্রিকূট পর্বতের আকর্ষণ হল সেখানে গিয়ে কিছু বললেই সে কথার তিনবার প্রতিধ্বনি হয়। ফলে সারা দুনিয়ার বহু লোক সেই পর্বতে ভ্রমণ করতে যায়। কমলা ললিতা পপী পিঙ্কিরা সনিয়ারাও পরিবারের সঙ্গে একদিন সেখানে গিয়ে হাজির হল, সঙ্গে গাইড মিঃ হক। কিন্তু আশ্চর্য! সেদিন কোনো প্রতিধ্বনি শোনা গেল না। ক্লান্ত প্রতিধ্বনি ঠিক করেছে সে আর মানুষের বিনোদন করবে না। তার চেয়ে মানুষের দুনিয়াতে নিজেই কিছুদিন ঘুরে আসবে। এর পরে যা সব কীর্তি সে করে তা হাস্যরসের ঝর্ণা বইয়ে দেয় নাটকে। সে সনিয়াদের স্কুলে গিয়ে প্রধান শিক্ষিকার ভূগোল ক্লাসে প্রশ্নের জবাব দেয় , তাও ভুল জবাব। ছাত্ররা বিদ্রূপ করছে ভেবে প্রথমে যদিও তিনি চটেন, পরে রহস্য না ধরতে পেরে খানিক আতঙ্কিত হন।   সনিয়াদের খেলবার জায়গা নেই, রাজপথের পাশে খেলে। সেখানেও সে গিয়ে সনিয়ার মায়ের ভূমিকাতে নামে, মায়ের ডাক ভেবে পথ পেরোতে গিয়ে সনিয়া দুর্ঘটনাতে পড়ে। একটি ট্রাকের নিচে পড়তে পড়তে সে বেঁচে যায়। ড্রাইভার আর সনিয়ার মায়ের সংলাপে প্রতিধ্বনি জানতে পায় পাশেই নিঃসন্তান প্রতাপশালী মানুষ অরবিন্দ চৌধুরীর দেয়াল ঘেরা একটি বাগিচা এমনি পড়ে আছে, যেটি সে খুলে দিলেই শিশুরা বেশ খেলতে পারে। এইবারে সে অরবিন্দ চৌধুরীর পেছনে পড়ে যাতে বাগিচাটি খুলে দেয়। অরবিন্দ চৌধুরী রহস্য ভেদ করতে পুলিশ পৌরসভা সবার শরণাপন্ন হয়। কিন্তু কিছুতেই বাগিচা খুলে দেবে না। এদিকে অদেখা প্রতিধ্বনির জ্বালায় তার আহার নিদ্রা সবই বিপন্ন । শেষে সে বাগিচা খুলে দিতে রাজি হলে প্রতিধ্বনি সনিয়ার থেকে বিদায় নিয়ে আবার সেই পর্বতে ফিরে যায়। মানুষের নগর তার কাছে মোটেও আমোদজনক মনে হলো না, বরং মিঃ হকের মতো মানুষ বেকার হয়ে যাওয়ার বেদনা সে অনুভব করে। হক হঠাৎ আবিষ্কার করেন প্রতিধ্বনি ফিরে এসেছে।  কচিকাঁচারা আবার সেই পাহাড়ে যায়, প্রতিধ্বনি জানায় সে তাদের ভালোবাসে, গান ভালোবাসে। নাটক এখানেই শেষ হয় শিশুদের একটি গানে। সেই গানের আহ্বানটি এরকম: আমাদের মনের কথা পৃথিবীকে শোনাতে তুমি পথ দেখাও প্রতিধ্বনি, মেঘে মেঘে ঢেউ তুলে প্রতিধ্বনিত হোক সেই কথা।
            ‘একলব্যের বিচার’ নাটকটি নামে মনে হয় একালেও কোনো গুরু বুঝিবা  শিষ্যের বুড়ো আঙুল না হলেও সেরকম কোনো দক্ষিণা দাবি করবেন। না শেষ অব্দি সেরকম কিছু হয় না। এই নাটকের গুরু দ্রোণাচার্যের বিপরীত, সুবিবেচক এবং সুবিচারকও। কিন্তু ঘটনা সেই একই, দরিদ্র ছেলে মোহনের ইচ্ছে সে ছবি আঁকা শেখে। কিন্তু উপায় নেই। তাকে এই বয়সেই রোজগার করে খেতে হয়। সুতরাং সে কাজ নিল এক চারুকলা বিদ্যালয়ে। আঁকিয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের ব্রাশটা, তুলিটা, ক্যানভাসটা গুছিয়ে রেখে, চা এনে দেয়, বাসনপত্র ধুয়ে দেয়, বিদ্যালয় সাফাই করে। সে বিদ্যালয় থেকে প্রায়ই রং তুলি হারিয়ে যেতে শুরু করলে কৈফিয়ত দেবার দায়টাও ওর উপরেই পড়ে। যদিও কেউ সেরকম অত্যাচার বা গালিগালাজ তাকে করে নি। একদিকে নাটকের রহস্য আর দিকে দারিদ্র্য এবং সততাকে ঘনীভূত করতে তার মতো আরো দু’চারজন বস্তির ছেলেকেও মাঝে মধ্যে নাটকে নিয়ে আসেন নাট্যকার। তারা মাটিকে আঁকিবুঁকি করে, রং নেই ব্রাশ নেই। স্টুডিওর এটা ওটা কৌতূহল বশে ধরলে মোহন তাদের ধরতে মানাও করে। আর ছাত্রী গায়ত্রী এসে ওদের কিছু চাইলে চুরি না  করে  বলে নিয়ে যাবার মধ্যবিত্তসুলভ উপদেশ দিয়ে কিছু রং তুলি দিতে চাইলে, ওদের আত্মমর্যাদাতে বাধে। ওরা না নিয়ে চলে যায়। তা হলে, হারাচ্ছে কী করে?  সুতরাং শিক্ষক রবিন চৌধুরী এক অভিনব অনুসন্ধান প্রক্রিয়া শুরু করলেন,সবাইকে নিয়ে। সেই সবার মধ্যে মোহনও রয়েছে। তার উপরে দায়িত্ব পড়ল, রাতেও সে স্টুডিওতে থাকবে আর নজর রাখবে কে রং তুলি সরাচ্ছে।  দেবজিৎ বলে একটি ছাত্রের আধো আঁকা একটি ক্যানভাস এক সকালে আবিষ্কৃত হল সম্পূর্ণ হয়ে গেছে, এবং ছবি দেখে সবাই মুগ্ধ হয়ে গেল। ছাত্রেরা মনে করে এই কাজ শিক্ষক ছাড়া আর কারো নয়, কিন্তু তিনি দাবি করেন এমন ভালো ছবি তিনিও আঁকতে পারবেন না। সুতরাং সন্দেহ সেই বস্তির ছেলেদের কিংবা মোহনের উপরে ঘনীভূত হল। বস্তির ছেলেরাও ঘটনাচক্রে  সন্দেহের বাইরে চলে গেলে, এক রাতে রবিন চৌধুরী এসে মোহনকে হাতে নাতে ধরে ফেলেন। সে তখন ছবি আঁকছিল। তার ভয় হলো , এবারে তার চাকরিখানা যাবে। কিন্তু সেরকম কিছু হলো না। পুলিশেও দেয়া হলো না। বিদ্যালয়েই একটি নকল আদালত বসল, এবং জানা গেল যে মোহন প্রখ্যাত শিল্পী চন্দ্রকান্ত দাসের ছেলে। যাকে সমাজ তথা বর্তমান শিল্পীরাও স্মরণে রাখে নি।  সুতরাং বিচারের রায়ে স্থির হলো, মোহন এবং তাঁর মায়ের দায়িত্ব এখন থেকে বিদ্যালয় নেবে, সে স্বাধীন ভাবে এই বিদ্যালয়ে থেকেই শিল্প চর্চা করবে। এভাবে প্রতিভার প্রতি সামাজিক দায়বদ্ধতার নাটক হয়ে উঠে ‘একলব্যর বিচার’ । এই সংকলনে এটি দ্বিতীয় বাস্তববাদী নাটক। এইখানে একটি কথা উল্লেখ করা ভালো, তিনি মনে করেন শিশু যেহেতু সমাজের উৎপাদন ব্যবস্থার সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত নয় বা নীতিগতভাবে যুক্ত থাকার কথা নয় ফলে তাদের কোনো শ্রেণি চরিত্র থাকবার কথা ছিল না। কিন্তু শিশু যে পরিবারে বড় হয়ে উঠে সেই পরিবারের শ্রেণিচরিত্র তাকে শৈশব থেকেই পেয়ে বসে। কথাগুলো তাঁর সেই ২০০৫এর প্রবন্ধ বইতে তিনি লিখেছেন। এবং এই নাটকে শিশুদের মধ্যেকার সেই শ্রেণি-দ্বন্দ্বকেও তিনি সুকৌশলে চিত্রিত করেছেন।
            একটি জনপ্রিয় ছড়াগান-- অসমিয়াতে যাকে বলে ওমলা-গীত-- ‘অ’ ফুল , অ’ ফুল নুফুলো কিয়’র নাট্যরূপান্তর ‘নুফুলা ফুলর মালিতা’ । ছড়াটি সরাসরি নাটকে নেই। মাঝে মাঝে বিভিন্ন চরিত্রের সংলাপে ছড়িয়ে আছে। ছোট্ট ছড়া । আমরা অন্য সূত্র থেকে তুলে দিচ্ছি, তাতে ধারণা একটি করে নেয়া সহজ হবে। একই ছড়া লক্ষ্মীনাথ বেজবরুয়ার ‘এজনী মালিনী আৰু এজোপা ফুল’ রচনাতে খানিক অন্যরকমও রয়েছে   ...
' ফুল অ' ফুল ! নুফুল কিয় ?
-- গৰু‌ৱে যে আগ খাই মইনো ফুলিম কিয় !
' গৰু অ' গৰু ! আগ খ‌া‌ৱ কিয় ?
-- গৰখীয়াই যে মোক নৰখে মইনো নাখাম কিয় !
' গৰখীয়া অ' গৰখীয়া ! গৰু নৰখ কিয় ?
-- ৰান্ধনিয়ে যে ভাত নিদিয়ে মইনো ৰখিম কিয় !
' ৰান্ধনি অ' ৰান্ধনি ! ভাত নিদিয় / নাৰান্ধ কিয় ?
-- খৰিকটীয়াই যে খৰি নিদিয়ে মইনো ৰান্ধিম কিয় !
' খৰিকটীয়া অ' খৰিকটীয়া ! খৰি নিদিয় কিয় ?
-- বৰগছ যে কাতি থৈছো নুশুকাইনো কিয় !
' বৰগছ অ' বৰগছ !  নুশুকা‌ৱ কিয় ?
-- মেঘে যে বৰষুণ দিয়ে মইনো শুকাম কিয় !
' মেঘ অ' মেঘ !  বৰষুণ দিয় কিয় ?
-- ভেকুলীয়ে যে টোৰটোৰাই মইনো নিদিম কিয় !
' ভেকুলী অ' ভেকুলী !  টোৰটোৰা‌ৱ কিয় ?
-- মই কৰো টোৰ টোৰ
   মেঘে কৰে গুৰ গুৰ
   বৰষুণ দিয়ে হুৰ হুৰ

   বোপা-ককাৰ সহজতো মইনো এৰিম কিয় !
             জোনমণি সেউতী শেওয়ালিরা এক সকালে আবিষ্কার করে তাদের প্রিয় সুন্দর বাগিচার ফুলগুলো কেউ খেয়ে গেছে। এরা তদন্ত শুরু করে ফুলকে জিজ্ঞেস করে জানে গরুতে খেয়ে গেছে। কাজলি রাঙলি গরুদের জিজ্ঞেস করে জানে রাখাল কর্তব্যে অবহেলা করাতে খাবার না পেয়ে এরা যা পেয়েছে তাই খেয়েছে... এই ভাবে নাটকের গল্প এগোয়। শেষে একটি বিচার সভা বসে। এবারে এতোগুলো চরিত্রের কাকে আসামী করা যাবে আর কাকে নয় তার বিচারও বেশ চিত্তাকর্ষক ভাবে করিয়েছেন নাট্যকার। দেখা গেল কাউকেই শাস্তি দেয়া যাচ্ছে না, দিলে দিতে হয় ‘অন্যের উপরে দায় চাপিয়ে দেবার মানবিক স্বভাবটিকে’। আর ‘ভেকুলি’ তথা বেঙ যে বলছে, ‘বোপা-ককাৰ’ রীতি সে ছাড়বে কেন একেই বলে ‘কূপমণ্ডুকতা’। হাজার বছরের অভ্যাসকে সে কোনো প্রশ্ন না করে পালন করে আসছে। তার শাস্তি হলো না, কারণ সরাসরি সে কোনো অন্যায় করে নি। কিন্তু শিক্ষার ব্যবস্থা হলো। স্থির হলো ওকে কুয়ো থেকে বের করে সাগরে ছেড়ে দেয়া আসবে, যাতে দুনিয়াটাকে ভালো জানতে চিনতে পায়। শুনেই বেঙ দিল লাফ, ছেলেমেয়েরা পিছু নিল ওকে ধরবে বলে---এমন এক হাস্যরসের দৃশ্যে নাট্যকার নাটকটিকে শেষ করে কেবল যে নাটকটিকে রসসিক্ত করলেন তাই নয়, আমাদের হাজারো কুসংস্কার এবং পারম্পরিক অভ্যাসকে নিয়ে নিজেও যেন খানিকটা হেসে নিলেন। সম্পাদক জানিয়েছেন নাটকটি ইতিমধ্যে জয়ারানি রায় গোয়ালপাড়িয়া ভাষাতে অনুবাদ করেছেন, আর সেখানকার ‘মাটিয়া’ সংস্থা ২০১৩র অক্টোবরে সেটির অভিনয় করে।
            ‘জোন-তরার সাধু’ অষ্টম নাটক। না চাঁদ বা তারার গল্প নয়। জোন , তরা নামে দুই খরগোশের গল্প। নাটকের শেষের দিকে কাকের সংলাপে যদিও রয়েছে ‘জাকেই পরম বল’ অর্থাৎ ‘একতাই বল’---আমাদের মনে হয়েছে ---এটি সত্য। কিন্তু তারও থেকে সত্য সেই বাংলা প্রবাদ ‘সৎ সঙ্গে স্বর্গবাস, অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ’। হরিণার সংলাপেও সেই আভাস স্পষ্ট।  ‘বেলি ওলোয়া সাধু’র মতোই এই নাটকেও ঠাকুরদার গল্প বলার আদল দেয়া হয়েছে। জোন তরা ভালুক জাম্ববন্তের আশ্রয়ে ছিল ভালোই। ধূর্ত শেয়ালে সন্ধানে ছিল কবে এদের ধরে খায়। একদিন ভালুক গেল ভাগ্নের বিয়ে খেতে । একহাড়ি মধু রেখে গেল  জোন তরার দায়িত্বে । সেই সুযোগে শেয়াল এসে ওদের আস্থাভাজন হলো কৌশলে । এবং মধুগুলো খেয়ে নিল। ভালুক ফিরে এলে সব দায় চাপিয়ে দিল জোন তরার উপরে। দু’জনে মিলে এদের আক্রমণ করল। কাকের দল ওদের বাঁচিয়ে দিল। কাক এসে নিয়ে গেল ওদের কাছের এক বনে নিয়ে গেল। সেখানে ঝর্ণা আছে, হরিণের মতো তৃণভোজী প্রাণী আছে। আছে ফুল ফল।  সবচাইতে বড় কথা ‘জাকত থাকি হারিলেও/ পাওঁ আমি সুখ, / আটায়ে ভগাই লওঁ/ হাৰি যোৱাৰ দুখ/ মৰিলেও জাকেই হঁও মৰণৰ ভাগী।’
          ‘রজার দেউল’ সেই ‘বালিমাহীর কথা’ বা ‘নুফুলা ফুলর মালিতা’ র মতোই অনেকটা। সেই বিপন্ন প্রকৃতি, বিপন্ন শৈশবের গল্প।  নাটকগুলো ক্রমান্বয়ে পড়ে গেলে একটি ধারণা গড়ে উঠতে থাকে যে শিশুদের তিনি সামাজিক কম, বেশি প্রাকৃতিক জীব হিসেবে উপস্থিত করেছেন। অথবা শৈশবের আড়ালে আসলে প্রকৃতি বিচ্ছিন্ন আমাদের সামাজিকতার প্রতি নাট্যকারের বিক্ষোভ যেন প্রায় প্রতিটি নাটকে ছড়িয়ে আছে।  এই নাটকে সেটি বিদ্রোহের রূপ ধরে। নাটকের নামটি নিয়েছেন, তিনি একটি বিখ্যাত শিশুখেলার ছড়া থেকে। সেই ছড়ার খানিকটা আমরা দিচ্ছি এরকম:  এইটো কাৰ দৌল?/ৰজাৰ দৌল/ভাঙিম নে নেভাঙিম?/নাভাঙিবা/ক’লী-ব’গীক মাতিম নে নেমাতিম?/নামাতিবা।...”
       
   জোন সোন মালতিদের কাছে রোদ আসে দেশবিদেশের রং নিয়ে বিক্রি করবে বলে। বিক্রি আর করে কই? বিলিয়ে দিয়ে যায়। সে যেতেই ওদের হাতের রংও চলে যায়। এবারে , রং পায় কই। অনেক ভেবে এরা নগরের সবচাইতে বড় বাগিচাতে গেল ফুলের থেকে রং নেবে বলে। গিয়ে দেখে সব ফুল অযত্নে নুইয়ে পড়েছে। এরা সেই বাগিচাকে যত্ন করে আবার সজীব করে তুলে। তখনই শুরু হয় রাজ-পুরোহিতের উপদ্রব। রাজার গড়া মন্দিরের জন্যে সব ফুল নিয়ে যাবে। নিয়ে যাওয়া মানে একরকম বাগিচা ধ্বংস করাই। প্রতিবাদ করতে মালিকে বন্দি করে নিয়ে যায়। আবার ‘বেলি’ তথা রোদ আসে। কচিকাঁচারা আবার আশার আলো দেখে। রোদ ওদের প্ররোচিত করে এই রাজার মন্দির ভাঙতে হবে। সে তাদের সেই দেউল ভাঙার মন্ত্র শেখায়। সেই মন্ত্র সেভাবেই এরা উচ্চারণ করে যেভাবে আবহমান কাল থেকে শিশু সমাজে খেলাটি প্রচলিত। কিন্তু শেষে নাট্যকারের সংযোজন...একটি গানে, “ ভাঙো নে নাভাঙো লাগে কিয় সুধিব/ রজার দ’ল ভাঙিবর হ’ল...” তাদের গানের শেষে দেউল ভেঙেই পড়ে। এই নাটকটি নিয়ে সদ্যপ্রয়াত নন্দকিশোর মহেশ্বরী একটি ছায়াছবি করবার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। কিন্তু শেষমেষ হয়ে উঠেনি। হরেন্দ্রনাথ বরঠাকুরের সঙ্গে ব্যক্তিগত আলাপে জানলাম সেন্সরবোর্ড রাজার দেউল ভাঙবার দৃশ্যে ছাড়পত্র দেয় নি বলে হয় নি। পরিচালক নাট্যকারকে জিজ্ঞেস করলে তিনিও সেই অংশ বাদ দিয়ে এগোতে রাজি হন নি। অসমের বিশেষ করে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার বাংলানাটকে কিন্তু এরকম সাহসী নাটক এখনো দুর্লভ। 
         শেষ নাটক ‘অমাতর মাত’ । ‘ জোন-তরার সাধু’র মতো এও হিংস্র জন্তুর বিরুদ্ধে অহিংস্র প্রাণীদের বিদ্রোহের নাটক। কিন্তু সেখানে আধুনিক রাষ্ট্রের ‘অভয়ারণ্য’ ঘোষণার রাজনীতির প্রসঙ্গটিও নিয়ে এসেছেন। অভয়ারণ্যে জীবজন্তু হত্যা আইনত নিষিদ্ধ হল তো বটে। কিন্তু আইনের ফাঁকে না হিংস প্রাণীর প্রাণী হত্যা বন্ধ হল, না হলো মানুষের হাতে নিরীহ জন্তুর বিপন্নতার কোনো শেষ। বাধ্য হয়ে তৃণভোজী প্রাণীগুলো জোটবদ্ধ হল। সেই বিদ্রোহে মৌমাছি, বোলতা ইত্যাদি সব চাইতে ক্ষুদ্র প্রাণীগুলোর ঐক্য সাহস এবং কর্মদক্ষতা খুব কাজে এলো। ক্ষুদ্র বলে এদের উপেক্ষা না করবার ফলে তৃণভোজী প্রাণীদের সাহস এবং দক্ষতা এতোটাই বৃদ্ধি পেল যে বনরাজা বাঘ তাদের আক্রমণে মৃতপ্রায় হয়ে গেল। কিন্তু বাঘকে মারেন নি নাট্যকার। চরিত্রটি যদিও প্রতীকী , বাস্তব জগতে বিপন্ন প্রকৃতির শিকার বাঘও। তাকেও বাঁচিয়ে রাখার দায় মানুষের। সুতরাং কোনো ভুল বার্তা না যায়, তাই পরিচালককে নির্দেশ দিয়ে রেখেছেন শেষ দৃশ্যে হয় বাঘকে অচেতন দেখাবার জন্যে কিছু করুন, অথবা বাঁধন ছিঁড়ে পালিয়ে যাওয়া দেখান যেমন তিনি।
         প্রতিটি নাটক একাঙ্কিকা। সবচাইতে বেশি এগার দৃশ্যের নাটক ‘পলরীয়া প্রতিধ্বনি’, আর সবচাইতে ছোট  পাঁচ অঙ্কের নাটক ‘জোন-তরার সাধু’। ‘রজার দেউলে’ কেন কোনো দৃশ্য বিভাজন নেই, সে আমাদের স্পষ্ট হলো না। নাট্যকার বা সম্পাদকের ভুলেও হয়ে থাকতে পারে। হরেন্দ্রনাথ বরঠাকুর একজন কবিও। নাটকগুলোতে অনেক প্রচলিত এবং পরিচিত শিশু পাঠ্য ছড়া, গান, লোককাহিনি, উপকাহিনির আংশিক বা সম্পূর্ণ ব্যবহার আছে, যদিও বেশ কিছু গান কবিতার কথা তাঁর নিজেরই লেখা। নিছক গল্পে বা ভাববস্তুতেই নয়, নাটকগুলোকে রসসিক্ত করে তুলবার যাবতীয় আয়োজন তিনি করেছেন এই সব ছড়ায়, গানে এবং অভিনয় কালে নাচবার সুযোগ করে দিয়েও। এইখানে বলে রাখা ভালো, অসমিয়া আধুনিক শিশু সাহিত্য যদিও মূলত লক্ষ্মীনাথ বেজবরুয়ার হাতে শুরু, নাটকের শুরু জ্যোতিপ্রসাদে। তাঁর ‘নিমাতী কইনা’ প্রথম শিশুদের জন্যে লেখা কাব্যনাটক।প্রচলিত লোককাহিনি,কিন্তু তিনি নিয়েছেন লক্ষ্মীনাথ বেজবরুয়ারই রচনার থেকে। জ্যোতিপ্রসাদের সম্পর্কে হরেন্দ্রনাথ লিখেছেন,“জ্যোতিপ্রসাদের উল্লেখযোগ্য কৃতিত্বটি হল---তিনি অসমিয়া শিশুনাটকের পরম্পরাগত ধারাটিকে চিহ্নিত করে স্থানীয় উপকরণেই উন্নততর আধুনিক মানের শিশুনাটক সৃষ্টির চেষ্টা করেছিলেন। অসমীয়া আধুনিক শিশুনাট্য সাহিত্যের এটিই ইতিবাচক তথা প্রগতিশীল ধারা। এই ধারাটিকে বিকশিত করে নেবার উপরেই অসমিয়া শিশু সাহিত্যের ভবিষ্যৎ আজও নির্ভরশীল।” (অসমীয়া শিশু নাট্যধারার গতি-প্রকৃতি; প্রসঙ্গ অসমীয়া শিশু নাট্য; পৃ:৩৫ থেকে বাংলাতে অনূদিত।) ফলে তিনি নিজে যে সেই ধারারই অনুবর্তী হয়ে কাজ করবেন, সে লেখাই বাহুল্য। শিশু নাটক খুব বড় হওয়া উচিত নয়, মিনিট বিশেকে শেষ হতে পারলে ভালো -- সেসব তাঁর সুগভীর অধ্যয়ন এবং অভিজ্ঞতার থেকে নেয়া সিদ্ধান্ত। সেই সঙ্গে তিনি শিশুনাটক পরিবেশনার সময় মঞ্চ, আলো, শব্দ সংযোজন, দর্শকাসনের ব্যবস্থা ইত্যাদি নিয়েও সুগভীর অধ্যয়ন করেছেন। যেমন তিনি লিখেছেন, শিশুনাটক পরিবেশনের সময় হল পুরো অন্ধকার করা উচিত নয়। অভিনেতা-অভিনেত্রীকে দর্শকের প্রতিক্রিয়া দেখতে দেয়া উচিত। সেই সব প্রসঙ্গ আমরা নাটকের পাঠ আলোচনাতে বাদ দিতে পারি। কিন্তু তথ্য হিসেবে একটি কথার উল্লেখ মনে হয় থাকা ভালো যে তিনি মনে করেন প্রসেনিয়াম পদ্ধতিতে আদর্শ শিশুনাটক পরিবেশিত হতে তথা বিকশিত হতে পারে না,তার জন্যে পরম্পরাগত লোকনাট্যের অভিনয় পদ্ধতি না হলেও, পথ নাটক পদ্ধতিই ভালো। যদিও তিনি যখন নাটকগুলো লিখেছেন, বর্তমান বাস্তবতার সঙ্গে সমঝোতা করেই লিখেছেন,এবং সেগুলোতে মঞ্চনির্দেশনাও ভালোরকমই দেয়া রয়েছে।