আমার চেতনার রঙে রাঙানো এই খেলা ঘরে:

~0~0~! আপনাকে স্বাগতম !~0~0~

*******************************************************************************************************

Wednesday, 28 June 2017

আদভিয়া




মূল ইংরাজি:  সিগ্রন শ্রীবাস্তব
বাংলা অনুবাদঃ সুশান্ত কর।

(সিগ্রন শ্রীবাস্তব জার্মান মূলের এক ভারতীয় লেখিকা। থাকেন দিল্লিতে। জন্ম ১৯৪৩এ। বহুমুখী প্রতিভাধর এই লেখিকার এক ভাল চিত্র এবং ভাস্কর্য শিল্পীও। মূলত কিশোর কিশোরীদের জন্যে ২৫টিরও বেশি বই তিনি লিখেছেন। অধিকাংশই ছোট গল্প। সব চাইতে জনপ্রিয় বইটির নাম A Moment of Truthযেটিতে প্রায় সারা দুনিয়ার প্রেক্ষাপটেই গল্পগুলো লিখেছেন। আদভিয়াসেই সংকলনের অন্যতম সেরা গল্প। ছোটদের জন্যে বহু ছায়াছবি এবং দূরদর্শন প্রকল্পেও তিনি কাজ করেছেন।  ---অনুবাদক )
[অনুবাদটি করিমগঞ্জ থেকে প্রকাশিত 'সেবা' পত্রিকার জন্যে করা হয়েছিল। সেখানে ছাড়াও প্রকাশিত হয়েছে বাংলাদেশের ওয়েব পত্রিকা  এনটিভি-তেও।]

মি নিশ্চিত নই আফগানিস্তানকে আমি ভালোবাসি কি বাসি না। বাবা ভালোবাসেন। যদিও তিনি এখানে এসেছেন মাসচারেকই হল। খানাবাদ সেচ প্রকল্পে ইঞ্জিনিয়ার তিনি।
ভাই আর আমি  দিল্লিতে কাকা-কাকিমার কাছে থাকি।  সম্প্রতি বাবা-মায়ের সঙ্গে ছুটি কাটাবো বলে এসেছিকুন্দুজ শহরে। শহরটি রুশ সীমান্ত থেকে খুব বেশি দূরে নয়। সপ্তাহ শেষের বন্ধে আমরা ঐতিহাসিক স্থান বাক দেখে ফিরছিলাম। ফেরার পথটাই বড় বিরক্তিকর ঠেকল। পাথুরে পার্বত্য পথের স্থবিরতা, কোত্থাও এক চিলতে সবুজ নেইপাহাড়ের গায়ে ভূতুড়ে সব গর্ত, পথের দু’ধারে ছড়ানো ছিটানো পাথর, ধুলো আর অসহ্য গরম। আমার ভীষণ অস্বস্তি করছিল। পাশে বসা ভাইয়ের দিকে তাকালাম। হঠাৎই যে এমন কিছু কথা বলল যা আমিও আসলে ভাবছিলাম, “দেখ ওদিকে! মনে হয় না ঐ জায়গাগুলো ডাকাতদের লুকোনোর আদর্শ জায়গা?”
মা খানিক সচকিত হয়ে কৌতূহল নিয়ে বাবার দিকে তাকালেন, বাবা হালকা একটা হাসি দিলেন। পথের থেকে নজর না সরিয়ে বললেন,“এই নিয়ে বলবার মতো পুরোনো বাসিন্দা আমি হইনি আফগানিস্তানে। কিন্তু সহকর্মীদের থেকে যা শুনেছি আর দেখেছি আফগানরা বরং বেশ বন্ধুসুলভ আর অতিথিপরায়ণ হয়।”
            গাড়ির সামনের গ্লাসে বাবার চোখে আমার চোখ পড়ল। আমার দিকে তাকিয়ে হাসলেন,বললেন,“এই পূজা! এত ভীতু দেখাচ্ছে কেন? আমরা এই তাশখুরঘানে পৌঁছুলাম বলে,সেখান থেকে কুন্দুজ খুব দূরে নয়।” আমাদের মেজাজ বদল করতে তিনি বললেন,“তার বদলে  তোরা  কিছু পুরোনো দিনের গান করে শোনাস  না কেন?”
            ফলে আমরা গলা ছেড়ে জোরে জোরে গাইতে শুরু করলাম। এমন জোরে যাতে সব ভয় আর ডাকাত থাকলে ওরাও পালিয়ে যায়।
পথটা নেমে আবার যেখানে উঠে যাচ্ছিল বাবা গাড়িটা সামান্য ধীর করে আনলেন, এবং ডান দিকে গিয়ে দাঁড়ালেন। “ভাবনার কিছু নেই।” আমাদের আশ্বস্ত করে বললেন,“এই, পেছনের চাকাগুলো একটু দেখে নিচ্ছি।” তিনি গাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলেন। আমরা সব কটা দরজা খুলে দিলাম যাতে খোলা বাতাস কিছু ভেতরে ঢুকে। কিন্তু যে বাতাস ঢুকল সে ছিল প্রচণ্ড গরম আর শুকনো।
মা পায়ের কাছ থেকে ফ্লাস্কটা তুলে নিলেন। আমি রুমাল দিয়ে কপাল মুছে নিলাম। কুন্দুজে গিয়ে পৌঁছেই ঠাণ্ডা জলে গা ডুবিয়ে অনেকক্ষণ ধরে স্নান করতে হবে –আমি ভাবছিলাম।
            “পূজা একটু জল খাবি?” মা জিজ্ঞেস করলেন। আমি মাথা নাড়িয়ে হাত বাড়ালাম,আর তাঁর ওপাশটায় পথের দিকে তাকালাম। যা দেখলাম তাতে হাত থেকে কাপ পড়ে গেল।আমার জিন̖সে আর গাড়ির ম্যাটে জল গড়িয়ে পড়ল।
            “পূজা!” , মা বকা দিয়ে উঠলেন।
            ‘গাধা!” ভাই ঘোঁত করে উঠল।
       
     মায়ের বিস্মিত মুখের ওপারটাতেই আমার চোখ আটকে গেছে। দুটো লোক আমাদের গাড়ির দিকে ধেয়ে আসছে। দু’জনের একজন খানিক লম্বাটে । সে প্রায় গাড়িতে হুমড়ি খেয়ে পড়ল বলে, অন্যটি পেছনে সহজে দাঁড়াতে পারছিল না । খোঁড়াচ্ছিল। পুরো মুখ ঢাকা পাগড়ির ভেতর থেকে চোখগুলো ওদের জ্বল জ্বল করছিল। হাঁটু অব্দি কালো কোট। দু’দিকে লম্বা হাত ঝুলছে যেন কোনো দৈত্যাকার পাখির পাখা। ওরা সোজা আমাদের দিকে আসছিল। আমি ওদের দিকে দেখিয়ে চীৎকার করে বললাম, “ ডাকাত! ডাকাত!” মা ঘুরে তাকালেন। একটা লোক লাঠি একটা মাথার উপরে ঘোরাচ্ছে আর চেঁচাচ্ছে “আদভিয়া!”
               মাও ভয় পেয়ে গেলেন। তাঁর হাত থেকে  ফ্লাস্ক পড়ে গেল কোলে। জানালার থেকে দূরে সরে গিয়ে তিনি ফিসফিসিয়ে বাবাকে ডাকলেন, “ রোহণ! রোহণ! বাঁচাও!”
            “পাপা! পাপা!”, আমিও চেঁচিয়ে উঠলাম এবং গাড়ির অন্যদিক দিয়ে বেরিয়ে যাব বলে ভাইয়ের উপর দিয়ে চলে যাচ্ছিলাম। সে আমাকে উলটো ঠেলে দিল এবং কড়া স্বরে বলল,“পেছনে যা পূজা! বোকার মতো করিস না!” সে দরজার বাইরে গিয়ে বাবাকে ডাকল,“পাপা,ডাকাত!ওরা সোজা আমাদের দিকে আসছে।চলে এসো।আমাদের যেতে হবে! গাড়ি স্টার্ট দাও পাপা! জলদি! প্লীজ!”
            সুধীর,আমার ভাই,জোরে দরজা বন্ধ করে আমাদের চেঁচিয়ে বলল,“দরজা বন্ধ কর জানালার গ্লাসগুলো তোল তাড়াতাড়ি!”
            ভয়ে অবশ আমি গাড়ির সিটে হেলান দিলাম।আমার দিকে তেড়ে আসা লোক দুটোর দিকে তাকাচ্ছিলামলম্বাটি ইতিমধ্যে গাড়ির বনেটের কাছে পৌঁছে গেছে।ওর বাঁ হাত মায়ের দিককার জানালাতে পৌঁছে গেছে।দুই একবার লেগে পিছলেও গেছে। সে কিছু একটা বলে চেঁচাচ্ছিল।
            “ জানালাটা বন্ধ কর মা!” ভাই চেঁচাচ্ছে শুনতে পেলাম,“দরজা লক কর মা।দরজা বন্ধ করতে হবে। তোর দিকের জানালাটা তোল̖ পূজা! শুনতে পাচ্ছিস?”
            শুনতে আমি ঠিকই পাচ্ছিলাম। কিন্তু মনে হচ্ছিল যেন বহু দূর থেকে সে বলে যাচ্ছে।আমি নড়তে চাইছিলাম, চাইছিলাম জানালাটা তুলি।কিন্তু পারিনি।আমি বুঝতে পারছিলাম বাবা  স্টিয়ারিঙের ফাঁক দিয়ে নিজেকে গলইয়ে দিচ্ছিলেন, এবং নিজের পাশের জানালাটা বন্ধ করে চেঁচিয়ে নির্দেশ দিলেন,“দরজা বন্ধ কর!দরজা বন্ধ কর!”তারপরে তিনি চাবি ঘোরাতে শুরু করলেন। এক ! দুই! গাড়ি স্টার্ট নিয়ে নিল।
            আপনা আপনি আমি জানালার হ্যাণ্ডেল ধরতে এগোলাম। দ্রুত ঘোরাতে গিয়ে হাত ফসকে যাচ্ছিল। যে লোকটা মায়ের জানালার কাছে এসে পড়েছিল আমার নজর ওর উপর আটকে আছে। এদিকে আমার হাত উলটো দিকে ঘুরছিল আমি খেয়াল করে নি। ফলে বন্ধ হবার বদলে জানালা আরো খুলে যাচ্ছিল। লোকটি ওর হাত ঠেলে ঢুকিয়ে দিল। ততক্ষণে আমি ভুলটি ধরে ফেলে গ্লাস তুলতে শুরু করেছি। ওর হাত সেই গ্লাসে আটকে গেল। সে গ্লাস ধরে ফেলল, এবং নিচের দিকে চেপে জোর খাটিয়ে আবার খুলতে চেষ্টা করল।কিন্তু গ্লাস ধীরে ধীরে হলেও উপরে উঠে যাচ্ছিল,যদিও কষ্ট হচ্ছিল তুলতে। শেষে যখন একেবারে উপরে উঠে গেল জানালার ফ্রেমের সঙ্গে ডাকাতের আঙুল চেপে ধরল। লোকটি উফ- আহ করে জানালা ছেড়ে দিল। সে জানালাতে ঘুসি চালাল, ওর লাঠি দিয়ে ঘা কতক বসাল। পরে লাঠি ছেড়ে দুই হাতে দরজার হাতল ধরে চেষ্টা করল। মায়ের দিকে তাকিয়ে চেঁচিয়ে গেল। যা বলছিল, শোনাচ্ছিল ‘আদভিয়া।’
            ও ব্যর্থ হলে পেছন থেকে অন্য লোকটিও এল। সে আমার জানালায় চেপে ধরল। মুঠি দিয়ে ঘুসি চালাল। উপরের ফাঁক দিয়ে ঘুসিটা আমাকে ছুঁয়েই ফেলছিল। আমার হাত ধরে ফেলে নিজেকে সামনে ঠেলে দিচ্ছিল। রক্তলাল চোখে আমার দিকে তাকিয়ে গর্জে যাচ্ছিল ‘আদভিয়া! আদভিয়া!’
            ওর দিকে তাকিয়ে আমি না পারছিলাম নড়তে,না কিছু বলতে। আমি শুধু পারছিলাম ওর ধুলোভরা দাড়িভরা নোংরা মুখের দিকে তাকাতে আর বারে বারে ওর চেঁচিয়ে বলা শুনতে,“আদভিয়া, আদভিয়া! লুতফুন মারা দাওয়া বিত্তে।” আমার হাত ঝাঁকিয়ে অন্য হাতটাও ভেতরে নিয়ে আসছিল।আমি চীৎকার দিলাম,“পাপা!”
            সামনের সিটের পেছনটায় আমাকে যেন ছুঁড়ে ফেলল প্রায়, আবার ধাক্কা খেয়ে পেছনে চলে গেলাম। ডাকাতটাও সামনের দিকে ঝাঁকুনি খেল একটা। সে আমার হাত ছেড়ে জানালা ধরে ঝুলে পড়ল। গাড়িতে গতি আসতেই ও পড়ে যাচ্ছিল পথে, কিন্তু জানালা ছাড়েনি। বাঁ হাতে তখনো ধরে রেখেছে। ওর নোংরা মাথাটা উপরে নিচে দুলছিল, আর সে পেছনে পেছনে দৌড়ে দৌড়ে চেঁচিয়ে যাচ্ছিল, “আদভিয়া, আদভিয়া, আদভিয়া।”
           
(সৌজন্যঃ এন টিভিবিডি)
একবার, দুবার, বারেবার।
            তারপর ওর হাত ছুটে চলে গেল গাড়ি থেকে। ওর হাত, ওর মুখ এবং ওর কণ্ঠ। আমাদের গাড়ি এবড়োখেবড়ো ভাঙা পথ দিয়ে দ্রুত ছুটল। পেছনে পড়ে রইল ধুলোর মেঘ।
আমি আর পেছনে ফিরে তাকাই নি। কিন্তু সুধীর তাকিয়েছিল। আনন্দে সে চেঁচিয়ে জানালো, ‘ওদের হারিয়ে দিয়েছি! ওদের থেকে ছাড়া পেয়ে গেছি! পা! ওয়াও!”
সে আমার দিকে তাকাল ভীষণ তাচ্ছিল্যভরে, “ তুই এতো বোবা হতে পারিস কী করে পূজা? তুই জানিস না কী করে জানালার কাঁচ তুলতে হয়?”
“বন্ধ কর ওকে বকা!” বাবা বললেন,“এমন পরিস্থিতিতে অমনতর হয়েই থাকে।”
“কিন্তু ডাকাতগুলো ওকে প্রায় গলা চেপে ধরতে যাচ্ছিল”, সে গলা চড়িয়ে বলল।
“না ধরে নি!”, আমি মিনমিনে প্রতিবাদ করলাম।
“বেশ! সময় পেলে ও ছুরি বের করে ধরত, তুই...”
“সুধীর!” এবারে মা বললেন, “ তুই থামবি। ঠাকুরকে অশেষ ধন্যবাদ যে আমরা সবাই রক্ষা পেয়ে গেছি।”
“ঠিক আছে।” খানিক বিরক্তিভরে বলে সে আরেকবার আমার দিকে একটা তাচ্ছিল্যের নজর ছুঁড়ে দিলজানালার বাইরের দিকে তাকিয়ে সে মাথা দুলিয়ে গলা চড়িয়ে বলল,“আমরা ওদের হারিয়ে দিয়েছি! বাবা তুমি দারুণ! তুমি মুহূর্তের মধ্যে গাড়ি চালিয়ে দিয়েছ।”
ওই কয়েকটি মুহূর্ত আমার কাছে মনে হচ্ছিল অনন্ত কাল।
“এই লোকগুলো”, ভাই বলে গেল,“আমাদের ঘড়ি,মায়ের চেন নিয়ে যেতে চাইছিল। আমরা ওদের আচ্ছা সামাল দিয়েছি। হারিয়ে দিয়েছি!” আনন্দে ও নিজের হাতে তালি দিল। কিন্তু আমার সে রকম কোনো আনন্দ হচ্ছিল না।
আমার প্রায় কান্না পাচ্ছিল, মাথার ভেতরে যেন তখনো প্রতিধ্বনিত হয়ে চলেছে,“আদভিয়া,আদভিয়া।”

***
“পা”, রাতের খাবার পরে শেষঅব্দি আমি মুখ খুললাম, “আমি ডিকশনারিতে ‘আদভিয়া’ শব্দটা দেখতে চাই। জানতে চাই শব্দটির মানেটা কী?”
“ওটার মানে ‘হাত তোল”, খিরের শেষ চামচটা মুখে নিতে নিতে ভাই বলল,“নইলে ‘আমি তোমাকে খুন করব’ নইলে...।”
“সুধীর!” মা ওকে চুপ করাল। বাবা শোবার ঘর থেকে একটি ভারি ডিকশনারি নিয়ে ফিরলেন।  
শব্দটা খুঁজে পেতে তাঁর মুহূর্ত সময়ও লাগল না,কিন্তু মুখে ঊচ্চারণ করতে মিনিট খানিক সময় নিলেন। তাঁর মুখ বিবর্ণ হয়ে এল,চোখ ভার হয়ে এল। ধরা গলাতে তিনি বললেন,“আদভিয়া মানে ‘ঔষধ’।”
বহুক্ষণ কারো গলা থেকে কোনো শব্দ বেরোল না।এক সময় মায়ের গলা থেকে বেরোল হাহাকার,“ হায় রামো! হায় রামো!” আবার। আবার।
আমি তাঁর দিকে তাকালাম।ভাইয়ের দিকে তাকালাম।এবং তাই করলাম যা আমি সেই বিকেল থেকে করতে চাইছিলাম। কেঁদে ফেললাম।


Thursday, 22 June 2017

মৃত্যু সংবাদ




মূল অসমিয়া: জেহিরুল হুসেইন
বাংলা অনুবাদ: সুশান্ত কর
 (অসমিয়া কথাশিল্পী জেহিরুল হুসেইন, যিনি "নাইচকা' বলেও পরিচিত ছিলেন তাঁর 'চিলিকন ভেলীর মানুহ' গল্প সংলনের তৃতীয় গল্প এটি )
দন রাজখোয়া বারান্দার থেকেই দেখলেন গেটের আগল সরিয়ে হুক খুলে ছোট্ট একটি মেয়ে ঢুকছে।
মদন  কাছের টিপয় থেকে চশমাটা নিয়ে পরতে যেতেই মেয়েটি বারান্দার কাছে চলে এলো। সে মদন রাজখোয়া যাতে শুনতে পান, সেভাবে চেঁচিয়ে বলল,--- জ্যাঠামশাই, মিশন রোডে যে থাকেন, আপনাদের কী হন, মারা গেছেন।
            রাজখোয়া ‘কী বললি,ভালো করে বল দেখি নি’ বলে শেষ করে উঠতে না উঠতেই সে  ফিরে আবার গেটের কাছে পৌঁছে গেল।
            --- এই মেয়ে ! মিশন রোডের প্রতাপ গোঁহাই বুঝি?
            সে গেট খোলে রাস্তাতে পা ফেলল।
            ---আমি কিছু জানি না। ফোনে খবর এল। আমাদের বাবু, আপনাদের ঘরে খবরটা দিতে আমাকে পাঠালেন। ...
            বাকিটা কী বলল মদন রাজখোয়া শুনলেন না । মেয়েটি ইতিমধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল
            মিশন রোডেরই খবর যখন, প্রতাপ গোঁহাই না হলে কে হবে? মৃত্যুর খবর দেবার মতো মিশন রোডে আর তো কেউ নেই! কী করেন না করেন ভাবতে ভাবতে মদন রাজখোয়া ভেতরের দিকে তাকিয়ে গিন্নিকে  উদ্দেশ্য করে চিৎকার দিলেন, --এই যে শুনছ, এদিকে এসো তো দেখি। বড় বাজে খবর গো।
            শ্রীমতী রাজখোয়া ধেয়ে এসে জিজ্ঞেস করলেন, ---কী বাজে খবর?
            --- এই , প্রতাপ বুঝি মারা গেছে। শইকীয়াদের বাড়ির কাজের মেয়েটি এসে খবর দিল। প্রতাপের বাড়ি থেকে বুঝি
           ফোন করেছিল।
            গিন্নি অবাক হয়ে স্বামীর দিকে তাকিয়ে বললেন, ---কী বলছ? প্রতাপ গোঁহাই মারা গেছেন? তুমি কি পাগল হলে? আজ এই দু’দিন হলো আমাদের বাড়ি এসে আমার সঙ্গে অনেকক্ষণ কথা বলে গেলেন। কোনো অসুখ বিসুখ নেই,সুস্থ মানুষটি। আমার মনে হয়  প্রতাপ নয়,অন্য কেউ। মেয়েটাকে ভালো করে জিজ্ঞেস করলে কি?
            --- দাঁড়াও দাঁড়াও! তুমি পেক পেক কর না।আমাদের পাশের বাড়ির শইকীয়াবাবুর কাণ্ড দেখমৃত্যুর মতো ভয়ঙ্কর একটা সংবাদ পাঠাল কিনা এই কচি কাজের মেয়েটিকে দিয়ে। আমাদের পরিবারের সঙ্গে প্রতাপ গোঁহাইর সম্পর্ক কি তিনি জানেন না? ফোনে রিং করলেও এ বাড়ি থেকে শোনা যায়। তিনি তো নিজে দু’পা হেঁটে এসে খবরটা দিয়ে যেতে পারতেন। কী যে দায়িত্বজ্ঞানহীন নিষ্ঠুর এই মানুষগুলো।আত্মকেন্দ্রিক,স্বার্থপর;নিজের বাইরে কিছুই চেনে না এই লোকগুলো।...
            শ্রীমতী রাজখোয়া বাধা দিয়ে বললেন,প্রতাপ গোঁহাই কী করে মারা গেলেন বলে বললে? কী জানি তিনি নন,অন্য
কেউ?
            --- কিছুই বলতে পারি না। মেয়েটি ‘মারা গেছেন’ বলেই ফিরে চলে গেল। ভালো করে জিজ্ঞেসই করতে পারলাম
                না।
            খানিক সময় ভেবে শ্রীমতী রাজখোয়া বললেন, --এখন তবে কি করবেন? আপনি কি এতো দূর যেতে পারবেন?
            মদন রাজখোয়ার রাগ উঠেছিল।স্ত্রীর উত্তর না দিয়ে শইকীয়াবাবুর বিরুদ্ধে গালি বর্ষণ করেই গেলেন।---বড় তার ফোন রে!সেটি নিয়ে বাহাদুরি কী,দেখো না!আমাদের ফোনের কানেকশনটা পেতে দে না,তোদের কুকুর বলেও মান দেবো না। টেলকম ডিপার্টমেণ্টটাই কি কম? সিকিউরিটি জমা নেবার আজ এক বছর হলো,কুকুরগুলোর সাড়াশব্দটি নেই।ঘুষ না খাওয়ালে এ দেশে সামান্য একটা কাজও যদি হয় না। ...
            স্ত্রী ধৈর্য হারালেন।স্বামীর মুখের উপরে চেঁচিয়ে বললেন,
            --- আপনি কি টেলকম কোম্পানিকেই গালি দিতে থাকবেন, না প্রতাপের খবরটাও নেবেন?
            মদন রাজখোয়া থেমে গেলেন।স্ত্রীর মুখে ‘প্রতাপ’ শব্দটি তাঁর বুকে শেল মারবার মতো মারল গিয়েবুকে একটা প্রচণ্ড ব্যথা অনুভব করলেন।সঙ্গে সঙ্গে মুখখানা এক বোবা যন্ত্রণাতে বিকৃত হয়ে গেল,‘ এই প্রতাপটা...’। কিছু একটা বলতে গিয়েও তাঁর কথা বেরুলো না। স্ত্রী তাঁর বুকে পিঠে মালিশ করতে শুরু করলেন।মদন রাজখোয়ার চোখজোড়া বেয়ে জল উপচে পড়ল।
            শোক অল্প শান্ত হলে ভেজা স্বরে স্ত্রীকে বললেন,
 --- তুমি এক কাজ কর।শইকীয়াবাবুদের বাড়ি গিয়ে একটু কনফার্ম হয়ে এসো তো।আসলে কে মারা গেছে,কী
     হয়েছে? কখন মারা গেল। ছোট্ট মেয়েটাকে কীই বা বলতে বলল, আর সেই বা এসে কী বলে গেল।
            শ্রীমতী রাজখোয়া শইকীয়া বাবুদের বাড়ি যাবার পরে মদন রাজখোয়া আবার আরাম চেয়ারে বসলেন যদিও শান্তিতে থাকতে পারলেন না।মানুষটা আরাম চেয়ারে বসেও ছটফটাতে থাকলেন।মাঝে মাঝে ধুতির কোঁচাতে চোখের জল মোছে গেলেন।
            প্রতাপ গোঁহাইর স্মৃতি তাঁকে তাড়া করতে শুরু করল।এই শূন্যতা আর হাহাকার মদন রাজখোয়ার বুকখানাকে মোচড় দিয়ে গেল।অতি প্রিয়জনের বিয়োগেও তিনি এতো শূন্যতা এতো হাহাকার অনুভব করেন নি।অথচ প্রতাপ গোঁহাই যে তাঁর রক্তের সম্পর্কে কেউ হন তেমনটাও না।একজন হিতাকাঙ্খী বন্ধু মাত্র।কিন্তু প্রতাপ গোঁহাইর মতো বন্ধু পাওয়াটা পরম সৌভাগ্যের কথা।
            প্রতাপ গোঁহাই না হলে মদন রাজখোয়ার জমি-বাড়ি-সংসার কিছুই হয়তো সহজে হত না।জীবনের যে কোনো সিরিয়াস সিদ্ধান্তে প্রতাপ গোঁহাই পাশে থাকেন।বিয়েটিয়ে,মেয়েদেখা,মাটি কেনা,ঘর বানানো সবেতেই প্রতাপ গোঁহাই।এমন কি বিয়ের পরেও ডাক্তার,মেটারনিটি,ধাই খোঁজে আনা,রণি-বনিদের কোষ্ঠী বানানো,স্কুলে ভর্তি করা অব্দি সমস্ত দায়িত্ব আর চিন্তা প্রতাপ গোঁহাইর উপরে ছেড়ে দিয়ে মদন রাজখোয়া আরামে দিন কাটিয়েছেন। তেমন এক বন্ধুর মৃত্যুতে তিনি কাছে থাকতে না পেরে নিজেকে তাঁর বড় অপরাধী বলে মনে হল।
            প্রতাপ গোঁহাই রাজখোয়া পরিবারের ছায়াটির মতো।শহরের এক মাথার উপকণ্ঠ অঞ্চলে বাড়ি বানিয়ে প্রতাপদের পরিবার চলে যাবার পরে যোগাযোগ কিছু ক্ষীণ হল যদিও উৎসবে-পার্বণে,সুখে-দুখে,মাঙ্গলিক কাজেকর্মে প্রতাপ গোঁহাই সব বাধা ঠেলে মদন রাজখোয়ার বাড়িতে এসেই পড়েন।ইস!এই মানুষটি কিনা হঠাৎ মরে গেল। যেন ডানহাতটাই খসে গেল।
            বেশিক্ষণ বসে থাকতে পারলেন না।লাঠিতে ভর দিয়ে ধীরে ধীরে দাঁড়ালেন।তাড়া দেবার মতো করে ঘরের ভেতরের রণি-বনিকে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে ডাকলেন। বাবার চীৎকারে মেয়ে অতিষ্ঠ হয়ে বেরিয়ে এল।
            মেয়েকে তিনি বললেন,
 --- খবরটি কি শুনেছিস?
            --- কী খবর বাবা?
            --- প্রতাপ কাকা মারা গেছেন।
            মদন রাজখোয়ার গলায় কান্নার সুর। বনি সামান্য অবাক হয়ে বলল,
            ---  ইস! কী করে? কখন? আজ দিন কয় আগেই তো কাকু আমাদের বাড়িতে এসেছিলেন।
            --- কী করে মারা গেল,কিছুই জানি না।শইকীয়াদের বাড়িতে ফোন করেছিল।ওদের কাজের মেয়েটি এসে বলে
                গেল। সেও ভালো করে কিছু বলতে পারে নি। তোর মাকে পাঠিয়েছি ওদের বাড়িতে খবরটা ভালো করে নিয়ে
                আসতে।
            --- মাকে রূপাদিদের বাড়িতে যেতে দিলে কেন?
            বনির চোখে মুখে রাগ আর বিরক্তি স্পষ্ট হয়ে উঠল।
            --- কেন? গেলে কী হবে?
            --- রবিবারে ওরা টিভি দেখাতে ব্যস্ত থাকে। বাইরের লোকজন গেলে বিরক্ত হয়।
            ---  তুই এসব কী বলছিস? এ একটি মৃত্যু সংবাদ! তাও যার তার নয়, প্রতাপ কাকার।
            --- হলেও...
            বনি কিছু একটা বলে প্রতিবাদ করতে যাচ্ছিল। বাবার গলার স্বরে চুপ মেরে গেল।
            --- মানুষের মৃত্যুতে তোদের এই সব আলট্রা মডার্ন ভদ্রতা চলে না।  মৃত্যুর কাছে কি রবিবার সোমবার রয়েছে? মা
                ওখানে আড্ডা দিতে যায় নি না?...
            বনি বাবার কথাতে কোনো জবাব না দিয়ে নিজের শোবার ঘরে গেল; টিভি চলছে।
            বিস্ময়ে হতবাক মদন রাজখোয়া। কী আশ্চর্য! প্রতাপ গোঁহাইর মৃত্যুর সংবাদ পেয়েও মেয়েটি সামান্য প্রতিক্রিয়াও
            প্রকাশ করল না। সামান্যও বিচলিত হল না!  এক ফোটা চোখের জল বেরুলো না। এই মেয়েটিকে কাঁধে নিয়ে প্রতাপ এক সময় দুর্গাপুজো, কালীপুজো দেখিয়ে বেড়িয়েছিলওকে কোলে করে মাঝবয়সী লোকটি পূজার মেলাতে ঘোড়ার চরকিতে চড়েছিল। সে সব কথা কিনা সে ভুলে গেল।
            রণি কাপড় চোপড় পরে কোথাও যাবার জন্যে বেরুচ্ছিলসে বাবার সামনে এসে বলল,
            --- প্রতাপ কাকা বুঝি মারা গেছেন বাবা?
            কোনো উত্তর না দিয়ে শূন্য দৃষ্টিতে ছেলের দিকে তাকিয়ে রইলেন মদন রাজখোয়া।
            সার্টটা এমনিই একবার ঠিকঠাক করে রণি বললে,
            --- মরবে না কেন? হার্ট উইক মানুষ। তার উপরে খাবেন মদ, পেকেট পেকেট সিগারেট। নিশ্চয় সিভিয়ার হার্ট
                এটাক।
            রণির কথাতে গুরুত্ব না দিয়ে রাজখোয়া বললেন,
            --- তুই মাকে স্কুটারে নিয়ে গিয়ে প্রতাপ কাকার বাড়িতে রেখে আয়। পারলে আমিও যেতাম। গাড়ি একটা জোগাড়
    করতে পারলে বিকেলে যাব। কী ই বা করছে ওরা। ছেলে-মেয়েরাও বড় ছোট রয়ে গেল।
বাবার কথা শোনে রণি ক্ষেপে গেল।
--- এখন আমি কিছুতেই যেতে পারব না বাবা!
রণির কথা শোনে মদন রাজখোয়া থ হয়ে গেলেন,
--- তুই কী বলছিস?  তুই না নিয়ে গেলে মাকে নিয়ে যাবে কে? যে সে কেউ তো নয়,প্রতাপ কাকা। যা তা করে অন্য
     কাজ ফেলেও মাকে রেখে আয় গিয়ে।
--- প্রতাপ কাকু হলেও আমি এখন যেতে পারব না। আমাদের নেচার ক্লাবে আজ প্রথম প্রতিষ্ঠা দিবস। আমি

   সেক্রেটারি হয়ে কী করে না গিয়ে থাকি বাবা? তার উপরে কেরালার প্রখ্যাত পরিবেশবিদ কৃষ্ণমূর্তি ক্লাবের
   মেম্বারদের সামনে একটি স্পিচ দেবেন। আমি কী করে দায়িত্ব এড়াই বলো?
--- ঠিক আছে। তুই মাকে মিশন রোডে কাকার বাড়িতে রেখে ক্লাবে গেলে হবে না? ক’ মিনিটের পথই বা মিশন
    রোড?
--- তুমি যে কী বলো বাবা? মিশন রোডের যা অবস্থা স্কুটারে করে গেলেই বুঝবে। ঘণ্টাখানিক তো লেগেই যাবে।
     তার থেকে এক কাজ করি, আমি ক্লাবের থেকে তাড়াতাড়ি এসে বিকেলে মাকে নিয়ে যাব। মারা যে যাবার তিনি
     তো গেলেনইএত দৌড়ে দৌড়ে গিয়ে মা কী করবেন?
মুখে কিছু না বলে সকরুণ নয়নে মদন রাজখোয়া ছেলের দিকে তাকিয়ে রইলেন।এই ছেলেটিকে হাইস্কুলে এডমিশন দেবার দিনে প্রতাপ গোঁহাই কি নাওয়া-খাওয়া, অফিস সব বিসর্জন দিয়ে স্কুলের মুখে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে নি? তার জন্মের সাত দিনের মধ্যে গিয়ে এলেঙী সত্রের গোঁসাইর হাতে তার কোষ্ঠী বানিয়ে আনে নি? আজকের এই সফল ছেলের সঙ্গে ছেলেবেলা ক্রিকেট খেলে আনন্দে কি আত্মহারা হয় নি প্রতাপ গোঁহাই? আর সে ? রণি? প্রতাপ কাকু না হলে ওর মুখের ভাত হজম হত না একদিন। সারা দিন বাদুড়ের মতো ঝুলে থাকত প্রতাপের গলায়,তার জন্যে মায়ের কম বকা খেয়েছিল? সেসব কিছু আজ সে ভুলে গেছে।
মানুষ এতো হৃদয়হীন অকৃতজ্ঞ কী করে হয়? কিসের জন্যে রণি-বনি আজ এমন অমানবিক ব্যবহার করছে? এই মেয়ে বনি। সে আজকাল কিছু কৃত্রিম আন্তরিকতাহীন ভদ্রতা দেখিয়ে বেড়ায়। ভেতরে ভেতরে স্বার্থপর আত্মকেন্দ্রিক। কিছু উদ্ভট যুক্তি দিয়ে আত্মপক্ষ সমর্থন করে সে নিজের খোপের ভেতরে ঢোকে বসে থাকে। দেশের সব ছেলেমেয়ে যদি এমনটাই হয়, তবে কী হবে? মদন রাজখোয়া আর বেশি ভাবতে পারলেন না।
প্রতাপ যে তাদের ভালোবাসতো তার অন্তরালে কোনো স্বার্থ ছিল না।ছিল অকৃত্রিম স্নেহ,বন্ধুত্ব আর হৃদয়ের অনুভূতি। এই কটি মানবিক গুণের জন্যেই সে আপনার করে নিয়েছিল রাজখোয়া পরিবারটিকে।রণি-বনির একজন নিজের কাকার অভাব পূরণ করেছিল প্রতাপ গোঁহাই।মানুষের বিপদে আপদে সাহায্যের হাত বাড়ানো তাঁর স্বভাব।ফোন থাকা শইকীয়াবাবুদের জমিটা কেনার সময় প্রতাপ গোঁহাই কি কম সাহায্য করেছিল?প্রতাপ মাঝে না ঢুকলে তো সেই জমি শইকীয়াদের হাতছাড়াই হয়ে যেত। অথচ,সেই শইকীয়াবাবু কিনা প্রতাপের মৃত্যুর খবর কাজের মেয়েকে দিয়ে পাঠিয়ে নিজে টিভি দেখাতে ব্যস্ত হয়ে রয়েছে। আহ! কী অদ্ভুত পরিবর্তন হয়েছে এই মানুষগুলোর।
কথাগুলো ভাবতে ভাবতে মদন রাজখোয়াকে দ্বিগুণ শোকে চেপে ধরল। ধৈর্যের সীমা হারিয়ে এবারে হু হু করে কেঁদে চেয়ারেই ঢলে পড়ল।  
রণি ইতিমধ্যে স্কুটার নিয়ে ক্লাবে গেল।বনি রবিবারের টিভিতে ব্যস্ত। শ্রীমতী রাজখোয়া শইকীয়াবাবুদের বাড়ি থেকে এসে প্রতাপ গোঁহাইর মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করলেন।ম্যাসিভ হার্ট এটাক।রাতে মারা গেছে।বিছানাতে পড়ে ছিল,সকাল হলেই সবাই টের পান।
বয়ে নেমে আসা চোখের জল ধুতির কুঁচোতে মোছে ভেজা গলাতে মদন রাজখোয়া জিজ্ঞেস করলেন,
--- কী করবে এখন?এত দূর কি একা যেতে পারবে? ছেলে তো যাবে না,ওর বুঝি ক্লাবে মিটিং আছে।
--- কিসের মিটিং?
            --- কিসের মিটিং আর? বন্য প্রাণী কী করে ভালোবাসতে হয়। পরিবেশ কেন রক্ষা করতে হবে, সেসবই হবে। স্কুটার
   নিয়ে ইতিমধ্যে গেছেই। তুমি এখন কী করবে কর।
            স্ত্রী ভেজা চোখজোড়া তুলে বললেন,
            --- আমি একাই যাই।আপনি পারলে বিকেলে একটা গাড়ি নিয়ে আসবেন।
            --- পারবে কি তুমি একা? মিশন রোডে প্রতাপদের বাড়ি খোঁজে বের করতে? এত সহজ নয়।
            --- পারব,তুমি ভেবো না। আগে বার দুয়েক গেছি না? লোককে জিজ্ঞেস টিজ্ঞেস করে বের করে নেব।
            --- অসুবিধে কিছু নেই। ব্যাপ্টিস্ট চার্চটা পার হয়ে ডান দিকে ঘুরে যাওয়া ছোট রাস্তা দিয়ে কিছু দূর গেলেই প্রতাপ
                 দের বাড়ি। কাছের বড় গাছটার নিচে পানের দোকান একটি পাবে। সেখানে জিজ্ঞেস করলেই বলে দেবে।
                 নাহলে বনিকে নিয়ে যাও। সে পারবে। ওর কোনো এক বান্ধবী থাকে না ওখানে?
            শ্রীমতী রাজখোয়া চটে গিয়ে বললেন,
            --- আপনিও বললেন ভালো কথা। ও যাবে? একটি পরে ওর বান্ধবী দুজন আসবে।টিভিতে কী এক বিশেষ প্রোগ্রাম 
 দেখতে। ভদ্রাসন টলে গেলেও আপনার মেয়ে আজ টিভির সামনে থেকে নড়বে না।কত যে কথা,কত যে যুক্তি 
 ওর। আপনি আমি কি আর পারব ওর সঙ্গে? তার উপরে এবারে গ্র্যাজুয়েট হবে। যে সে কথা নয়। তার সঙ্গে 
 আমার টক্কর!
বিড় বিড় করতে করতে তিনি ভেতরে কাপড় পাল্টাতে চলে গেলেন।
কোনো উপায় না পেয়ে বাড়ির সামনে দিয়ে যাচ্ছিল এক রিক্সা,ওকেই দাঁড় করিয়ে শ্রীমতী রাজখোয়া চড়লেন। লাঠিতে ভর দিয়ে মদন রাজখোয়াও খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে গিয়ে রিক্সার পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন।স্ত্রী আর রিক্সাওয়ালার সাহায্যে কুঁ কাঁ করতে করতে তিনিও রিক্সাতে উঠে বসে গেলেন।রিক্সাওয়ালাকে আস্তে আস্তে চালাতে বলে দু’জনেই মিশন রোডের দিকে রওয়ানা দিলেন।
মদন রাজখোয়া এবং তাঁর স্ত্রীকে দেখে প্রতাপ গোঁহাইর পত্নী ‘কী দেখতে এলে গো!’ বলে চেঁচিতে কান্না জুড়ে দিল। মৃতকে এখনো শ্মশানে নিয়ে যায় নি।মদন রাজখোয়া প্রতাপ গোঁহাইর শবটি জড়িয়ে হু হু করে কেঁদে ফেললেন।সারা বাড়িতে আবার কান্নার রোল উঠল।
মদন রাজখোয়া শ্মশানে যেতে পারলেন না।সারা দিন ওদের বাড়ি থেকে প্রতাপের ছেলেমেয়েকে বুকে জড়িয়ে সান্ত্বনা দিলেন।প্রতাপের স্ত্রীকে বুঝিয়ে নানা দিশা পরামর্শ আর সাহস দিলেন।বিকেলে স্বামী-স্ত্রী দু’জনে আবার রিক্সা একটাতে উঠে বাড়ি ফেরার জন্যে বেরিয়ে পড়লেন।
--- আপনারা আসতে থাকবেন গো! ও দাদা! ও বৌদি!
বলে প্রতাপের স্ত্রী আবার কান্না জুড়ল।চোখের জল  ফেলে ফেলে রণি-বনিকেও পাঠাতে বলল।
বাড়ির সামনে রিক্সার থেকে নেমে ভেতরে উঠোনে ঢুকতে না ঢুকতে মদন রাজখোয়া বাড়ির ভেতর থেকে কান্নার স্বর শোনে বেশ একটি অবাক হল।আবার কারো কিছু একটা হয়ে গেল বুঝি?
--- এই বনি যেন কাঁদছে মনে হচ্ছে।ব্যাপারটা কী? সে কি এখন গিয়ে প্রতাপের মৃত্যু উপলব্ধি করতে পারল? ছোট
     থাকতে প্রতাপ কি ওকে কম আদর করেছিল? এখন গিয়ে ওর সেসব মনে পড়েছে হয় তো।
            মদন রাজখোয়া খোঁড়াতে খোঁড়াতে ভেতরে ঢোকার আগেই স্ত্রী দৌড়ে ভেতরে চলে গেলেন। মেয়েটিকে একা রেখে গিয়ে ভেতরে ভেতরে তিনি খানিক চিন্তিতই ছিলেন।
            মদন রাজখোয়া চেয়ারে বসে আবার প্রতাপের কথা স্মরণ করলেন। খানিক পরে স্ত্রী ভেতর থেকে বেরোলে, পরম মমতায় জিজ্ঞেস করলেন,
            --- কী হল? বনির সঙ্গে আরো কেউ আছে যেন মনে হচ্ছে?
            দুঃখের মধ্যেও স্ত্রীর মুখে এক বিবর্ণ হাসি খেলে গেল।
            --- ভালো কথাই বললেন আপনি। কই প্রতাপের জন্যে কাঁদছে আপনার মেয়ে?
            পরম বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে মদন জিজ্ঞেস করলেন,
            --- তবে?
            ব্যঙ্গ করে হেসে স্ত্রী বললেন,
--- টিভিতে লেডি ডায়নার ফিউনারেল প্রশেসন দেখে শোকাকুল হয়ে পড়েছে আপনার মেয়ে।সঙ্গে আরো    
    কজনায় মিলে দোহার দিচ্ছে।
            কিংকর্তব্যবিমূড় হয়ে মদন রাজখোয়া ‘হা’ করে মুখ মেলে স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে রইলেন। মুহূর্ত পরে যেন কিছু একটা বুঝতে পারলেন তিনি। চেয়ার থেকে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়িয়ে স্ত্রীর কাছে এগিয়ে গিয়ে কাঁধে ধরে বিষাদ ভরা কণ্ঠে বললেন,
            --- বুঝলে? আজ কেবল প্রতাপ গোঁহাইর নয়,সঙ্গে আমাদের দু’জনেরও মৃত্যু হল।

~~~০০০~~~