বাংলা অনুবাদ: সুশান্ত কর
(জিতেন বেজবরুয়া তরুণ অসমিয়া বামপন্থী
লেখক। লেখাটি অসমিয়াতে অসমিয়া পাঠকের জন্যেই লিখেছেন। এন আর সি নিয়ে মমতা
ব্যানার্জির সাম্প্রতিক মন্তব্য এবং বরাক উপত্যকাতে কিছু ব্যক্তি সংগঠনের
প্রতিক্রিয়ার সমালোচনা দিয়ে তিনি শুরু করেছেন, এবং বাঙালির সমস্যা বুঝে নেবার চেষ্টা করে
বাঙালিদের কিছু গণতান্ত্রিক পরামর্শও দিচ্ছেন। কিন্তু আসলে তার লক্ষ অসমিয়া
গণতান্ত্রিক মন, যাকে বাঙালির সমস্যার দিকে টানবার চেষ্টা করেছেন। দুই সম্প্রদায়ের
গণতান্ত্রিক মানুষের মধ্যে একটি সংলাপ গড়ে উঠবার ইচ্ছেও প্রকাশ করেছেন। তিনি
বাঙালিকে অসমিয়া হয়ে যাবেন, এমন আশা করবার প্রয়াসের বিরুদ্ধে মতপ্রকাশ করেছেন।
তিনি লিখেছেন, “বিদেশীর নামে বাংলা
মূলের বা বাঙালি মুসলমানের
মতো
করে বাঙালি হিন্দুদের উপরেও
হয়রানি হচ্ছে। সেক্ষেত্রে অসমীয়া জাতীয়তাবাদী দল-সংগঠনগুলোরও ঐতিহাসিক ভূমিকা রয়েছে।
এর বিরুদ্ধে বাঙালি সমাজের
থেকে গণ আন্দোলন গড়ে তোলা দরকার।’ কিন্তু
সেই গণআন্দোলন প্রক্রিয়াতে মমতা ব্যানার্জির অতিপ্রতিক্রিয়ার সমর্থন আসামেও জুটতে
পারে, এহেনসম্ভাবনার কথাটি লেখাতে পরিসরের জন্যেই সম্ভবত এড়িয়ে গেছেন। নইলে আমরা নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন
নিয়ে অসমিয়া গণতান্ত্রিক সমাজেরও অতি প্রতিক্রিয়া দেখেছি। দিল্লির যুব হুঙ্কার
সমাবেশে অখিল গগৈর মতো ‘ফ্যাসীবাদ বিরোধী’ ব্যক্তিরও দুই কোটী হিন্দু বাঙালিকে
নিয়ে ভোট বেঙ্ক গড়ে উঠবার অতিশয়োক্তিও শুনেছি। অথচ ডি-ভোটারের নামে যে লক্ষাধিক মানুষের উপরে যে অমানবিক ঘটনাগুলো ঘটে, যাদের নাম এন আর সি-তেও
আসবার সম্ভাবনা নেই, সেই নিয়ে তাঁর সেরকম হুঙ্কার শুনিনি। তবু লেখক বাঙালিদের ভেতরেও এবং
অসমিয়া বাঙালিদের মধ্যেও আলোচনার দরকারটি মনে করেছেন। তিনি লিখেছেন, ‘সংঘাতের
বাস্তব কারণগুলো
কী কী সেসব আলোচনা করা দরকার, খারাপ পাওয়া- ভালো
পাবার কথাটি সরিয়ে রেখে ।’ আমাদের
মনে হলো, কথাগুলো বাঙালি পাঠকের কাছেও পৌঁছুনো দরকার। নইলে সংলাপ শুরুই হবে না।
তাই অনুবাদ করে নেয়া।--অনুবাদক )
ল ৩১ ডিসেম্বর, ২০১৭তে এন আর সির প্ৰথম খসড়া প্ৰকাশ পাবার পরের উৎকণ্ঠা আর বিভ্রান্তিতে পূর্ণ পরিবেশে পশ্চিম বাংলার মুখ্যমন্ত্ৰী মমতা ব্যানার্জি এই সম্পর্কে যে কথা গুলো বললেন এবং তার পরে যেসব ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াগুলো হচ্ছে সেসব পরিস্থিতিকে আরো জটিল
করে তুলেছে। তিনি বললেন, অসমের এন আর সি প্রক্রিয়াটি হচ্ছে বাঙালিদের তাড়াবার এক চক্রান্ত মাত্র। এটি অত্যন্ত
স্পষ্টভাবেই ভুল তথ্যের উপর ভিত্তি করে বলা উস্কানিমূলক বক্তব্য, যা অসমের সাম্প্রতিক পরিবেশে অশান্তি সৃষ্টি করতে
পারে। অতএব এইধরনের বক্তব্যের সরাসরি নিন্দা করা দরকার। পশ্চিম বাংলার বৰ্তমান রাজনৈতিক প্ৰেক্ষাপটে বিজেপির বিরুদ্ধে নিজের অবস্থান শক্তিশালী করবার জন্যেই যে মমতা বাঙালি সেন্টিমেণ্টের
ব্যবস্থা নিয়েছেন, সেটুকু বুঝতে সমস্যা
হয় না। এক কথাতে এ হচ্ছে বাঙালি জাতীয়তাবাদকে নিয়ে তৃণমূল আর বিজেপির মধ্যে টানাটানি তথা
প্রতিদ্বন্দ্বিতা। কিন্তু অসমের জ্বলন্ত পরিস্থিতিতে এর অনেক ভয়ংকর সম্ভাবনা আছে বলেই যেন মনে হয়।
সে যাই হোক, মমতা ব্যানার্জির এই বক্তব্যকে কোনো বিক্ষিপ্ত-ব্যক্তিগত
বক্তব্য বলে সরিয়ে রাখতে পারি
না। সে ঘটনার পরে পরেই বরাক উপত্যকাতে বিভিন্ন ব্যক্তি আৰু সংগঠন এন আর সির বিরুদ্ধে একই রকমের অভিযোগ উত্থাপন করছেন দেখা যাচ্ছে। প্রকাশিত প্ৰথম খসড়াটিতে যে
অজস্ৰ সমস্যা এবং উল্টোপাল্টা
ব্যাপার আছে সেই নিয়ে সামান্যও সন্দেহ নেই। সেসব আসলে অবধারিতও ছিল। অসম সরকার বহু টালবাহানা করে করে উচ্চতম ন্যায়ালয়ের প্ৰবল চাপেই শেষ মুহূর্তে তাড়াহুড়ো করে এই খসড়াটি প্ৰকাশ করতে এগিয়ে এসেছে। ফলে খসড়াটি স্বাভাবিকভাবেই বহু দিক থেকেই আংশিক এবং ত্রুটিপূৰ্ণ। এবং এর ভিত্তিতে এই মুহূৰ্তটিতে মূল সমস্যাটি সম্পর্কে, অৰ্থাৎ বিদেশী প্ৰশ্নটি সম্পর্কে কোনোভাবেই শেষ
সিদ্ধান্ত করতে পারি না, এমনকি যুক্তিসংগত অনুমান করতেও অসুবিধে। ফলে আমার মনে হয় এন আর সির খসড়াটির
সমস্যাগুলোর অধিকাংশই মূলত আমলাতান্ত্ৰিক এবং প্রায়োগিক। ধরুন, কারো পরিবারে একজনের নাম এসেছে,
কিন্তু অন্য পাঁচজনের আসে নি, কারো নাম-উপাধি ভুলকরে এসেছে ইত্যাদি ইত্যাদি। উজান অসমের মানুষের নাম বেশি করে অন্তৰ্ভুক্ত হয়েছে, বরাকের হয় নি – এর পেছনেও নিশ্চয় এরকম কারণই নিহিত রয়েছে। আমরা
অন্তত: এই অবধি এন আর সি প্ৰক্ৰিয়ার মধ্যে কোনো ষড়যন্ত্ৰমূলক পরিকল্পনা লুকিয়ে থাকবার কোনো লক্ষণ দেখতে পাই নি। ফলে বিভিন্ন বাঙালি ব্যক্তি-সংগঠন আমলাতান্ত্ৰিক-প্রায়োগিক ঘটনা একটিকে ভুল করে রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের রূপে উপস্থাপন করতে চাইছেন। এক্ষেত্রে বিশেষ করে বাঙালি বিদ্বৎসমাজের একাংশ অগ্ৰণী ব্যক্তির ভূমিকা অনাকাঙ্ক্ষিত এবং হতাশাজনক। এন আর সি প্ৰক্ৰিয়াটির বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করে
, তার বৃহত্তর গ্ৰহণযোগ্যতাকে আঘাত করে বাঙালি সমাজের কোনো লাভ হবে বলে মনে হয় না। এন আর সি সম্পূৰ্ণ বেরিয়ে গেলে বিদেশী সমস্যাটির কতটা সমাধান হবে সে পরে কথা : কিন্তু তার ফলে বিদেশী সমস্যার সমীকরণটি যে গুণগতভাবে অনেকটাই বদলে যাবে , তার সমাধানের জন্যে নতুন দিক উন্মোচিত হবে সেটি
নিশ্চিত। অৰ্থাৎ অসমের বিদেশী সমস্যাটির ঐতিহাসিক যাত্ৰাপথে এন আর সি একটি বড় পদক্ষেপ। ফলে বিদেশী সমস্যাটির ঐতিহাসিকভাবে একটি পদক্ষেপ এগিয়ে যাবার জন্যে এই প্ৰক্ৰিয়াটি ভালোয় ভালোয় হয়ে
যাওয়াটা দরকারি, এবং সেটি সবারই কাম্য
হওয়া উচিত। একে প্ৰতিহত করলে বা ব্যাঘাত
জন্মালে সমস্যাটি বরং বেশি জটিল রূপ নিয়ে ঘূর্ণিতে ঘুরতে
থাকবে এবং তার ফলে অন্যদের সঙ্গে বাঙালি সমাজের জন্যেও বেশি সমস্যার সৃষ্টি করবে। যদি এন আর সির প্ৰক্ৰিয়াতে কোথাও বা বিশেষ ঘটনা ঘটেছে যেখানে বাঙালি মানুষের বিরুদ্ধে সরকারি কোনো কৰ্মচারী ষড়যন্ত্ৰ করছে বা অসমীয়া
জাতীয়তাবাদী সগঠনের মানুষ প্ৰক্ৰিয়াটিতে হস্তক্ষেপ করছে (কেউ কেউ এমন অভিযোগ করেছেন), তবে সেই ঘটনাগুলো ফাঁস করা হোক এবং আইনি প্ৰক্ৰিয়ার আওতাতে আনা হোক। অন্যদিকে, প্ৰথম খসড়াতে যে সব অসম্পূৰ্ণতা এবং ত্রুটি দেখতে
পাচ্ছেন সেগুলোর প্রতি সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হোক। লক্ষণীয় যে বৃহত্তর ঐতিহাসিক-রাজনৈতিক ভূমিকা যাই থাক, সম্প্রতি এন আর সি প্রসঙ্গে অসমিয়া জাতীয়তাবাদী এবং
জনগোষ্ঠীগত দল-সংগঠনগুলোর মনোভাব দেখা
যাচ্ছে সহযোগিতামূলকই। আসলে এর অন্যথা হওয়া সম্ভবই নয়, কেননা এই দল-সংগঠনগুলো নিজেদের কথাতেই বাঁধা পড়ে গেছে। ফলে বাঙালী বিদ্বৎ সমাজ তথা দল-সংগঠনগুলোও যদি এই প্ৰক্ৰিয়াতে আশানুরূপ ধরনে সহযোগিতা করেন তবে এন আর সি
সুসম্পন্ন হয়ে যেতে সুবিধে হবে। সুখের বিষয় যে বাঙালি সমাজের অনেক ব্যক্তি তথা
সংগঠন এর জন্যে এগিয়েও এসেছে। স্বাভাবিকভাবেই মমতা ব্যানার্জির বক্তব্যেরও
বিরোধিতা করা হয়েছে তাদের তরফে।
অসমিয়া মানুষের মধ্যে নিজেদের
পরিচয় সংকট নিয়ে যে ভীতি রয়েছে তার পেছনে বেশ কিছু আর্থ-সামাজিক কারণ রয়েছে, বিদেশী প্রব্রজন সমস্যা তার মধ্যে একটি। সেসব
ইতিমধ্যে বিস্তৃত আলোচিত হয়েছে। অসমে জাতীয়তাবাদী রাজনীতির অন্তহীন আধিপত্যের পেছনেও প্রধানত এই পরিচয় সংকটই লুকিয়ে রয়েছে। ফলে অসমে অন্যান্য যে কোনধরনের রাজনীতির জন্যে ময়দান মুক্ত করতে হলে, প্ৰগতিশীল রাজনীতির বীজ বপন করতে হলে তার আগেই এই পরিচয় সংকটের প্ৰশ্নটির একটি মীমাংসা করে নেয়াটা দরকারি। সেই দিক থেকে এন আর সির একটি ভূমিকা আছে। নিজেকে অসমিয়া বলে পরিচয় দেয়া-নাদেয়া অন্যান্য ‘খিলঞ্জিয়া’ জনগোষ্ঠীর জন্যেও বিদেশী প্ৰব্ৰজন জনবিন্যাসগত সমস্যার থেকে শুরু করে অনেক আৰ্থ-সামাজিক সমস্যার সৃষ্টি করেছে৷ ফলে অসমিয়া মানুষকে,
অসমের ভূমিপুত্র জনগোষ্ঠীদের এন আর সি লাগবেই। এর থেকে বাঙালিরাও নিশ্চয় নিশ্চয় বাদ পড়েন না৷ সে যাই হোক, এন আর সি প্ৰশ্নটির আছিলা নিয়ে বাঙালি সমাজের যেটুকুন ক্ষোভ এবং অভিযোগ উঠে আসছে তাও আসলে তাৎক্ষণিক নয় – সে দীৰ্ঘদিনের পুঞ্জীভূত বিষয়। বিদেশীর নামে বহু বাঙালি মানুষ হয়রানির মুখে পড়ে আসছেন সে সত্য। এখানে স্পষ্ট হয়ে যাওয়া ভালো যে এখন বাঙালিকে তাড়াবে বলে যে হুলস্থূল হচ্ছে, তা হচ্ছে মূলত হিন্দু বাঙালিদের নিয়েই হচ্ছে, বাংলা মূলের মুসলমানদের নিয়ে নয়। সে যাই হোক, বিদেশীর নামে বাংলা মূলের বা বাঙালি মুসলমানের মতো করে বাঙালি হিন্দুদের উপরেও হয়রানি হচ্ছে। সেক্ষেত্রে অসমীয়া জাতীয়তাবাদী দল-সংগঠনগুলোরও ঐতিহাসিক ভূমিকা রয়েছে। এর বিরুদ্ধে বাঙালি সমাজের থেকে গণ আন্দোলন গড়ে তোলা দরকার। অসমিয়া গণতান্ত্ৰিক-প্ৰগতিশীল শক্তিগুলোকেও এতে সহযোগ করতে হবে। কিন্তু সম্প্ৰতি বৃহৎ বাঙালি জাতীয়তাবাদের যে ঢেউ দেখা যাচ্ছে তাতে সাধারণ বাঙালি জনতার এধরণের এবং অন্যান্য আৰ্থ-সামাজিক সমস্যার বড় একটা গুরুত্ব থাকতে দেখা যায় না। এই বাঙালি জাতীয়তাবাদ চালিত হচ্ছে মূলত বৃহৎ বাঙালি জাতির সাংস্কৃতিক অভিমানকে কেন্দ্র করে। বাঙালিরা হচ্ছেন এক বড় জাতি, অসমিয়ার মতো ছোট নয় – যাদের নিজেদের একটি দেশ আছে, একটি প্রদেশ আছে, অতি সমৃদ্ধ ভাষা-সংস্কৃতি আছে। সেরকম অবস্থাতে তাদের অসম রাজ্যে অসমিয়া জাতির কাছে একরকম অনুগত হয়ে থাকতে হচ্ছে। অসমের রাজনীতিতে হোক, প্ৰশাসনে হোক, গণমাধ্যমে হোক, গণ পরিসরের উপরেই হোক –
অসমিয়াদের আধিপত্য আছে, বাঙালির নেই। যেসব এলাকাতে বাঙালিরা একত্রিত হয়ে একটি সমাজ রূপে টিকে আছেন, সেখানে তাদের নিজের ভাষা-সংস্কৃতি নিৰ্বিঘ্নে টিকিয়ে রাখতে পারছেন। কিন্তু যেসব এলাকাতে তাদের অসমিয়া বা অন্য গোষ্ঠীর মানুষের মধ্যে বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকতে হচ্ছে সেই এলাকাগুলোতে সেভাবে টিকিয়ে রাখতে পারেন নি। সেসব
কারণে তাদের মধ্যে রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক ক্ষোভ এবং অভিযোগ থাকাটি স্বাভাবিক। অসমিয়া জাতীয়তাবাদী দল-সংগঠনগুলোর বিদ্বেষমূলক
মনোভাব তথা কাজ-কর্ম
এক্ষেত্রে ইন্ধন যুগিয়ে আসছে। এটি এক অনস্বীকাৰ্য বাস্তব সত্য। কিন্তু প্ৰশ্ন হল এখান থেকে তারা যাবেন কই? এটি একটি জটিল প্ৰশ্ন যার উত্তর সহজে পাওয়া কঠিন। কিন্তু উত্তর সন্ধানটি
অধিক জরুরি হয়ে পড়েছে বলে মনে হয়।
অসমিয়া জাতীয়তাবাদের উন্মেষ কাল থেকেই অসমিয়া-বাঙালি সংঘাত নানা
রূপে চলে আসছিল, বিশ শতকের শেষের দিকে সেটি অধিক তিক্ত হয়ে পড়েছিল। সাম্প্রতিক সময়ে এই সংঘাত হয়তো কিছু সুপ্ত রূপে ছিল। কিন্তু এন আর সি-কে নিয়ে মমতা ব্যানার্জির বক্তব্যের পরে যা সব ক্ৰিয়া-প্ৰতিক্ৰিয়া দেখতে পাওয়া যাচ্ছে, তাতে মনে হচ্ছে যেন অসমিয়া-বাঙালি সংঘাত আবার নতুন মোড় নিতে
যাচ্ছে,জঙ্গি রূপ নিতে শুরু করেছে। সেটি যদি
বাস্তবে ঘটে তবে সে কারো জন্যেই মঙ্গলজনক হবে না। ফলে অসমিয়া-বাঙালি উভয় জাতিরই গণতান্ত্ৰিক-প্ৰগতিশীল
শক্তিগুলোর দরকার সময় থাকতেই সতৰ্ক হয়ে একটি সমাধানের জন্যে চেষ্টা করা ভালো। একটি কথা ঠিক যে অসমিয়া-বাঙালি মধ্যে দীৰ্ঘদিনের সমন্বয়ের একটি ঐতিহ্যও রয়েছে – সেটি বড় মূল্যবান জিনিস। কিন্তু সেসবের স্মরণ মাত্র এই সংঘাতের মোকাবেলা করতে আমাদের খুব একটা সাহায্য করতে পারবে বলে মনে হচ্ছে না। সংঘাতের বাস্তব কারণগুলো কী কী সেসব আলোচনা করা দরকার, খারাপ পাওয়া- ভালো পাবার কথাটি সরিয়ে রেখে । সে যাই হোক, অসমিয়া-বাঙালি সংঘাত নিরসনের জন্যে কিছু মানুষ পৃথক রাজ্য গঠনের পোষকতা করেন। আমাদের মনে হয় নতুন নতুন রাজ্য গঠনের দাবিতে উত্তাল অসমের প্ৰেক্ষাপটে সেই উপায় বাস্তবসন্মত এবং ফলপ্ৰসূ হবে না। বাঙালিপ্ৰধান এলাকাতে অসমিয়া বা অন্যান্য গোষ্ঠীর মানুষের বিরুদ্ধে নৃগোষ্ঠীয় পরিষ্করণের সম্ভাবনাও নাকচ করতে পারি না। তবে কী করে সংঘাত নিরসন হবে সেটি বিদ্বৎ সমাজের আলোচনার বিষয়। কিন্তু একটি কথা ঠিক যে
বৃহৎ বাঙালি জাতীয়তাবাদ অসমের বাঙালিকে রক্ষা তথা উদ্ধার করবে না। অসমের বাঙালি সমাজকে অসমের মাটিতে নতুন রাজনীতির সৃষ্টি করতে হবে। সেটি কী রকম হবে সে তাদের নিজেদের মধ্য থেকেই নির্ধারিত হতে হবে। প্ৰতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলগুলো যে তাদের সাহায্য করবে না সেটি বাঙালি জনতা বুঝতে
পারছেন। অন্যদিকে, অসমিয়া জাতীয়তাবাদী শক্তিগুলোর বাঙালিদের অসমিয়া করবার চেষ্টা না করাই ভালো– তাদের নিজেদের মতো থাকতে দেওয়া দরকার। একপ্ৰকার উগ্ৰ জাতীয়তাবাদ আরেক প্ৰকার উগ্ৰ জাতীয়তাবাদের জন্ম দেয়। অসমিয়া উগ্ৰ জাতীয়তাবাদ এবং বাঙালি উগ্ৰ জাতীয়তাবাদ – এই দুটিই সমান ভয়ঙ্কর এবং সমান গণবিরোধী। ফলে গণতান্ত্ৰিক-প্ৰগতিশীল শক্তিগুলোর এর দুটিরই বিরোধিতা এবং সমালোচনা করা দরকার।
অন্যদিকে, এন আর সি-র মধ্যদিয়ে বাঙালি তাড়াতে চাওয়া হচ্ছে বলে যে হুলস্থূল হচ্ছে তার মধ্যে যে প্ৰকৃত সত্যটি লুকিয়ে পড়েছে সেটি হচ্ছে
হিন্দু জাতীয়তাবাদের প্ৰশ্নটি। এন আর সি প্ৰকৃতপক্ষে কে চাইছে না ? কে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের মাধ্যমে হিন্দু বিদেশীদের ডেকে আনতে চাইছে
এবং অসম চুক্তিকে নস্যাৎ করতে চাইছে?
এর উত্তর সবাই জানেন। কিন্তু এন আর সিকে সমালোচনা করা বাঙালি বিদ্বৎ সমাজ এই আসল প্ৰশ্নটি সম্পূৰ্ণ এড়িয়ে চলছেন। (অন্য সময়ে হিন্দু জাতীয়তাবাদের প্ৰতি তাদের দৃষ্টিভঙ্গি কী রকম সে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র কথা।) সমগ্ৰ ভারতবর্ষের সঙ্গে অসমেও এখন হিন্দু জাতীয়তাবাদী শক্তি আধিপত্য প্ৰতিষ্ঠা
করতে সক্ষম হয়েছে। এরকম প্ৰেক্ষাপটে অসমিয়ারা বাঙালির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্ৰ করছেন না বাঙালিরা অসমিয়ার বিরুদ্ধে করছেন, সেটি আসল প্ৰশ্ন নয়। আসল প্ৰশ্ন হল, হিন্দু জাতীয়তাবাদী
শক্তিগুলো কী করছে এবং কাকে কার বিরুদ্ধে ব্যবহার করছে? দেখা গেছে যে এন আর সি-র বিরুদ্ধে বিষোদ্গার যে চিন্তার,যে
দলের মানুষই করে থাকুন না কেন আর তাদের নিজেদের ইচ্ছা
যাই হোক – এর শেষ মুনাফা কিন্তু হিন্দু জাতীয়তাবাদীদেরই হবে। কেননা,
এন আর সি প্ৰক্ৰিয়াটির আদৰ্শগত বিরোধী তারাই । আলোচ্য বিতরকের ফলস্বরূপে বিতর্কের কেন্দ্ৰবিন্দুটি অন্যান্য দল-সংগঠনের দিকে চলে গেল, আর আর চতুর হিন্দু জাতীয়তাবাদীরা একেবারেই গোবেচারার মতো আড়ালে থেকে গেল। সংক্ষেপে
লিখতে গেলে এন আর সি-কে কেন্দ্র করে সত্যি যদি কোনো ষড়যন্ত্র রয়েছে তবে
সে হলো হিন্দু জাতীয়তাবাদী শক্তিগুলোর হিন্দু বিদেশীদের নাগরিকত্ব দেবার ষড়যন্ত্র।
হিন্দু
জাতীয়তাবাদী শক্তিগুলো একটি সমসত্ব এবং অখণ্ড হিন্দু বাঙালির পরিচিতি নিৰ্মাণ করতে চাইছে এবং নিজেকে তাদের ত্ৰাণকৰ্তা রূপে প্ৰতিষ্ঠা করতে চাইছে। কিন্তু এর আড়ালে বাঙালি জনতার স্বার্থ লুকিয়ে নেই, লুকিয়ে আছে হিন্দু রাষ্ট্র গঠনের পরিকল্পনা। হিন্দু বাঙালিদের অসম থেকে তাড়াতে চাওয়া
হচ্ছে বলে বৃহৎ বাঙালি জাতীয়তাবাদের পোষকতা করছেন যে বাঙালিরা তাঁরা জ্ঞাতে-অজ্ঞাতে এই হিন্দু
জাতীয়তাবাদী পরিকল্পনাকে হাওয়া
দিচ্ছেন বলেই আমাদের মনে হচ্ছে। এই হিন্দু
জাতীয়তাবাদী প্রকল্প যেমন অসমিয়া
জনতার স্বার্থের পরিপন্থী, একইরকম সে বাঙালি মানুষেরও
স্বার্থবিরোধী। অসমিয়া-বাঙালি সবারই উচিত তার
বিরুদ্ধে দৃঢ়তার সঙ্গে দাঁড়িয়ে পড়া।