( অক্টোবর, ১৮তে উন্মোচিত 'উজান' চতুর্দশ বর্ষ সংখ্যাতে প্রকাশিত)
আসামের উচ্চতর
মাধ্যমিক শিক্ষা পর্ষদের মুদ্রিত নির্দেশিকাতে শিক্ষকদের জন্যে এই কটি কথা লেখা
আছে :
·
ছাত্রদের পাঠ পড়ে নিজে নিজে বুঝতে শেখানো
·
লিখে কোনো কিছু বোঝানোর ক্ষমতা অর্জনে
সহায়তা করা
·
কানে শুনে কোন কিছু বোঝার ক্ষমতা অর্জনে
সহায়তা করা
·
শুদ্ধভাবে কথা বলা শেখানো
·
বিদ্যাচর্চায় আগ্রহী করে তোলা।
এই নির্দেশিকার উল্লেখ দিয়েই শুরু
হয়েছে সঞ্জীব দেবলস্করের ‘শিক্ষা জগতের আলো আঁধার’ বইটির প্রথম নিবন্ধ ‘এক ভিলেজ
স্কুলমাস্টারের স্বীকারোক্তি’। কথাগুলো খুব ভালো।
আরো বহু বহুদিন প্রাসঙ্গিক থাকবে। ঠিক যেমন এখনো সমান প্রাসঙ্গিক রয়েছে দুই শতক
পুরোনো ফরাসি বিপ্লবের সেই বিখ্যাত ‘সাম্য-মৈত্রী-স্বাধীনতা’র স্লোগান। তার পরে
আমরা ক্রমাগত দেখেছি গণতান্ত্রিক তথা পুঁজিতান্ত্রিক ফ্রান্সের হাতে কীভাবে বিপন্ন
হয়েছে গোটা বিশ্বের মানুষের স্বাধীনতা এবং সাম্য। মৈত্রী তো অবশ্যই।
পুরো বইটি পড়তে পড়তে যেকোনো পাঠকের মনে হবে বিদ্যাচর্চাতে লেখকের নিজের আগ্রহ
তো প্রশ্নাতীত। কিন্তু সেটি যে ছাত্র বা সহকর্মীদের
মধ্যে রয়েছে, বা তিনি ছড়িয়ে দিতে সক্ষম বলে আত্মবিশ্বাসী---সেরকমটি দু’চারটি
ব্যতিক্রম বাদ দিলে মনে হবে না। আদি অন্ত বইটিতে হতাশার সুর। হতাশার স্বীকারোক্তি। এমন কি পুণ্যপ্রিয় চৌধুরী যে প্রচ্ছদ পরিকল্পনা
করলেন---সেখানেও বালিয়াড়িতে পদচিহ্ন। সেই চিহ্ন তো থাকবে না। স্বাভাবিকভাবেই মনে দেখা দেয় পরের প্রশ্ন,
পা দু’টি এগুচ্ছে কই? শক্ত মাটি অথবা জলের
দিকে? এ নয় তো অন্তর্জলি যাত্রা?
আমরা সঞ্জীবের বই নিয়েই কথা বলবো। তার আগে কিছু প্রাসঙ্গিক তথ্য দিয়ে রাখতে
চাই। সবার জন্যে শিক্ষার ধারণাটি দুনিয়াতে প্রথম প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি পায়
বিপ্লবোত্তর রাশিয়াতে। কারণ সেই রাষ্ট্র চেয়েছিল শ্রমিকদের দেশের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে
আসতে। যেখানে কিনা বাকি সব শ্রেণি শাসিত সমাজ এবং রাষ্ট্র চায় অনুগত প্রজা তৈরি
করতে। নিয়ন্ত্রিত সেবক তথা শ্রমিক তৈরি করতে। আমরা ব্রিটিশ ভারতে ম্যাকলের শিক্ষানীতিটির কথা জানি—যেখানে
শাসনের এবং শোষণের উদ্দেশ্যটি নগ্নভাবে পরিষ্কার ছিল। ফলে সবার জন্যে শিক্ষা সেই
বেদ বাইবেলের যুগ থেকেই সারা দুনিয়াতেই নিষেধ ছিল। বাস্তবে এখনো চেহারাটি পাল্টায়
নি। কেবল ঐ রুশ-বিপ্লবের ঢেউ যখন সারা দুনিয়াতে ছড়াচ্ছিল, চীনেও যখন বসন্ত দেখা
দিয়েছিল—একে একে দেশ তাঁদের প্রেরণাতে স্বাধীনতার যুদ্ধকে তীব্র করছে দ্বিতীয়
বিশ্বযুদ্ধ আসতে আসতে---তখন তাদেরই চাপে রাষ্ট্রসংঘ ১৯৪৮এ মানবাধিকার সংক্রান্ত
ঘোষণা পত্রে স্বীকার করেছিল,সমস্ত মানুষেরই আছে শিক্ষার অধিকার। কিন্তু
বিশ্বনেতাদের এই ঘোষণাকে কাজে পরিণত করবার জন্যে বসতে সময় লেগেছিল আরো চার দশকের
বেশি। ১৯৯০তে থাইল্যান্ডে
‘সবার জন্যে শিক্ষা’ নিয়ে মতবিনিময় করতে একটি বিশ্ব সম্মেলন বসে। তারও এক দশক পরে
আফ্রিকার সেনেগালের রাজধানী ডার্কারে বসেছিল ‘সহস্রাব্দের শীর্ষ-বৈঠক’ নামে
পরবর্তী সম্মেলন। সেখান থেকে ইউনেস্কোর
নেতৃত্বে শুরু হয় বিশ্বজুড়ে ‘সবার জন্যে শিক্ষা’র লক্ষ্যকে বাস্তবায়িত করবার
প্রয়াস। বিশ্বজোড়া নানান সরকারি বেসরকারি সংগঠনের সঙ্গে এই প্রয়াসের আরেকটি বড়
সহযোগী হচ্ছে বিশ্বব্যাংক। ডারকারে শুধু শিক্ষার জন্যে ২০১৫ অব্দি বিশ্বজোড়া ছটি
লক্ষ্য নির্ধারিত হয়েছিল, আনুষঙ্গিক আরো কিছু বিষয়ে আটটি লক্ষ্য। শেষোক্তটির গাল
ভরা নাম হচ্ছে ‘সহস্রাব্দের বিকাশ লক্ষ্য’ (MDG)—সেগুলোর ভেতরে ক্ষুধা নিবৃত্তি, শিশু ও
মায়ের স্বাস্থ্য থেকে শুরু করে অনুন্নত দেশগুলোর উন্নতি আদিতে পারস্পরিক সহযোগিতার
কথাও আছে। স্বাভাবিক ভাবেই অন্য বহু কিছুর সঙ্গে শিক্ষাসংক্রান্ত সরকারী নীতিতেও
এই সিদ্ধান্তগুলো প্রভাব ফেলতে শুরু করে। তারউপরে বিশ্বব্যাংক নিজেও রাষ্ট্রগুলোকে
শিক্ষা সংস্কারে আর্থিক সহযোগিতা করবার আছিলাতে সরকারী নীতি পরিবর্তনেও চাপ সৃষ্টি
করে। আমাদের দেশের সর্বশিক্ষা অভিযান, গেল দশকের শিক্ষার অধিকার সংক্রান্ত সংবিধান
সংশোধনী সবই এই প্রক্রিয়ার ফল। সঞ্জীব দেবলস্করের নিবন্ধগুলোর অধিকাংশই এই সময়ের
লেখা। আমাদের ব্যবস্থাপকদের কথা এবং কাজের সঙ্গতি বুঝতে এই তথ্যগুলো সাহায্য করবে।
আমরা ‘মাধ্যমিক শিক্ষা পর্ষদের’
পাঁচটি নির্দেশিকার কথা দিয়ে শুরু করেছিলাম। সেগুলোকে ‘ভালো’ এর জন্যে বলেছিলাম,
যে ছাত্রদের ‘বিদ্যাচর্চায় আগ্রহী করে তোলা’র কথাতেই শেষ হয়েছে। যে শিক্ষক সেটি
পেরেছেন,তিনি যে সফল শিক্ষক তাতে কোনো সংশয় নেই। কিন্তু যে দেশ তা করে উঠতে পেরেছে?
ততটা তো আমরা ভাবিই নি! এইটাই ভাবা দরকার। রবীন্দ্রনাথের সেই কথাগুলো মনে হয়
অপ্রাসঙ্গিক হবে না,“বিদ্যালয় যেখানে চারি দিকের সমাজের সঙ্গে এমন এক হইয়া মিশিতে
পারে নাই, যাহা বাহির হইতে সমাজের উপরে চাপাইয়া
দেওয়া, তাহা শুষ্ক তাহা নির্জীব। ... এমন
অবস্থায় বিদ্যালয় একটা এঞ্জিন মাত্র হইয়া থাকে—তাহা বস্তু জোগায়, প্রাণ জোগায় না।” (শিক্ষাসমস্যা/ শিক্ষা) যা হোক, আরো
দুবার ‘অর্জন’ কথাটি আছে। অন্যত্র না থাকলেও যা আছে শব্দগুলোর অর্থ তাইই। আমরা
‘বিদ্যাদান’ কথাটির সঙ্গে পরিচিত। কিন্তু সে শিক্ষককে মহিমান্বিত করবার জন্যে আদ্যিকালে
চালু ছিল। তার বিপরীতে ‘শিক্ষা পাওয়া’র কথাও চালু আছে। সে আদর্শ ছাত্রেরা কখনো বা
গুরুর কাছে ঋণ স্বীকার করতে গিয়ে বলে থাকেন। কিন্তু আসল কথাটি তো দেনা-পাওনার নয়,
প্রেরণা আর অর্জনের। প্রাণ তখন আর একদিকে যোগায় না, দুদিকেই সঞ্চারিত হয়। আমাদের
ভাষাতে তাই ‘জ্ঞানার্জন’ বলেও একটি কথা চালু রয়েছে। মাধ্যমিক শিক্ষা পর্ষদ
শিক্ষকের জন্যে নীতি নির্দেশিকা তৈরি করতে গিয়ে ‘দেশ’কে টেনে এতোশত কথা ভেবেছেন কি না, আমাদের
জানা নেই।
কিন্তু ‘অর্জন’-এর বাইরেও এরা কিছু করবার কথা লিখেছেন। সেটি হলো, ছাত্রকে পড়তে,
লিখতে, শুনতে এবং বলতে শেখানো। এতেই অবশ্য শিক্ষার কাজ সাঙ্গ হয় না। বিজ্ঞানের
‘কেলাসে’র বাইরে আমাদের হাতে কলমে কিছু করাকে শিক্ষার অঙ্গ বলে কোনোদিনই ভাবা হয়
না। খুব যান্ত্রিক ভাবে স্বাস্থ্য ঠিক রাখবার জন্যে খেলাধুলা, আর নৈতিক মূল্যবোধ
শেখাবার জন্যে কিছু ধর্মপাঠ করাবার কথা ভাবা হয়ে থাকে। আর কিছু না হোক,দিনের
শুরুতে প্রার্থনা করতে তো বাধ্য করাই হয়। তারপরে ছাত্র যতই দুষ্টামো করুক,শিক্ষকও
যতই নষ্টামো করুন প্রার্থনার উপরে কোনোদিনই কোনো দায় বর্তাতে আমরা দেখি নি।
সাহিত্যের ক্লাসে কেন কাউকে কবিতা লিখতে হয় না,আবৃত্তি করতে হয় না,নাটক করতে হয়
না---এরকম কত প্রশ্নই আমরা কোনোদিনই করি নি। আমরা ধরে নিয়েছি শিক্ষা মূলত সাঙ্গ হয়
‘লেখা পড়া শেখা’-তে। আর পড়াটা যেহেতু আছেই, এবং সম্ভবত শিক্ষকে ছাত্রে সংলাপ
যেহেতু চলবে, বলতে শুনতেও জানতে হবে। কাজগুলো চলবে ভাষাতে। তাই তাঁরা যে কথাগুলো
বলেছেন, সেগুলো মূলত ভাষার সঙ্গে সম্পৃক্ত। ভাষার চারটি পায়ের কথা বলেছেন।
“উদ্দেশ্যগুলো কত সহজ অথচ এটা রূপায়ণের পথে কত বাঁধা!” সব বাঁধা নিয়ে সঞ্জীব
লেখেন নি। কেবল লেখা নিয়েই লিখেছেন । প্রথম প্রবন্ধে।
লেখা কর্মটিও যে শেখার জিনিস সে তো আজকাল ভাবাই হয় না। লিখনশৈলী নিয়ে
অভিজ্ঞ শিক্ষকই নেই। একের পরে এক অক্ষর জুড়ে শব্দ লেখা,শব্দের পরে শব্দ জুড়ে বাক্য
সাজানোটা যে ‘আনন্দদায়ক হতে পারে---এটা বোঝার দায় কার’ সঞ্জীব লিখেছেন,তিনি জানেন
না।স্বাভাবিকভাবেই বানানের প্রসঙ্গটিও লিখতে গিয়েই আসে। কিন্তু সেদিকটায় এখানে
বেশি এগোন নি। ‘একাদশ’কে ‘ত্রকাদশ’, ‘ত্রয়োদশী’ কে ‘এয়োদশী’, ‘ব্রাহ্মণ’ কে
‘ব্রাক্ষণ’ লিখে ফেললে বহু শিক্ষকও ধন্দে পড়ে যাবেন,সে বানান ভুল না বর্ণ চেনার
ভুল। স্পষ্টতই দ্বিতীয়টি। যুক্তবর্ণের জটিলতা এমনিতেও বাংলাতে কম নেই। হিসেব করলে সেগুলো
চিনা হরফ সংখ্যাকেও হার মানাবে। আর আজকাল সেগুলো সেভাবে যত্ন করে শেখানোও হচ্ছে
না। শুধু তাই নয়, নিজের অভিজ্ঞতার থেকে তিনি জানালেন, উঁচু ক্লাসের ছাত্রেরা চ, ছ
পড়ছে ‘ছোট চ’, ‘বড় চ’ বলে। তার মানে শিক্ষক
লেখা শেখাতে ফাঁকি দিতে গিয়ে, কথাটি অবশ্য সঞ্জীব লেখেন নি সরাসরি, ভুলেই যাচ্ছেন
বাংলাতে দুটির উচ্চারণ তফাৎ আছে। অসমিয়াতে নেই বলেই তাদের প্রথম চ, দ্বিতীয় চ দিয়ে
কাজ চালাতে হয়।তাঁরা নিরুপায়। সেখানে বাংলার ছাত্রেরা, নিশ্চয়ই শিক্ষকেরাও, উপায়ের
ধার ধারছেন না। তাঁর প্রস্তাব পুথি
গবেষণার বিষয়টি প্রাগ্রসর স্তরে আটকে না রেখে একেবারেই নিচু স্তরে নামানো দরকার,
যাতে লেখন শৈলীর বিবর্তন সম্পর্কেও ছাত্র-শিক্ষক দুই পক্ষেরই কিছু চর্চা হয় ধারণা
মেলে। আমাদেরও মনে হয়, অন্তত উচ্চতর মাধ্যমিক স্তর অব্দি নামিয়ে আনলে শিক্ষকদের বোধটি
তো স্পষ্ট হতেই পারে। ইংরেজি that শব্দটি লিখতে কলম
তুলা উচিত নয় তিনবারের বেশি। সেখানে তাঁর অভিজ্ঞতা ছাত্র তুলছে ছবার।যতি চিহ্নের
শেখাবার তো ব্যবস্থাই নেই ভালো করে।ফলত সাধারণ ভাষা শিক্ষা করে যারা বেরোচ্ছেন
তারা দেয়ালে, সাইনবোর্ডে, টিভিতে সর্বত্র ভুলই ভুল লিখছেন। স্কুলগুলোতে সবচাইতে
বেশি খরচা হয় ভাষা শিক্ষাতে। কোনো কোনো স্কুলে অসমিয়া মণিপুরি বাংলা হিন্দি ইংরেজি
সংস্কৃত আরবি ফারসি নিয়ে আটটি ভাষা শেখার ব্যবস্থা আছে। অথচ কোনোটাই ভালো করে
শেখানো হয় না। শেখাবার লোকও নেই। লেখা তো বটেই, বলা,পড়াটাও না। সংস্কৃত,আরবি,ফারসির
মতো ভাষাকে স্নাতকোত্তর স্তরে ঠেলে দিয়ে ভাষার চাপ কমিয়ে, অন্তত ভালো করে বাকিগুলো
শেখানোতে জোর দেবার প্রস্তাব তিনি রেখেছেন। বিষয়টি নিয়ে তিনি যতটা গভীরে ভাবার
যাত্রা করলেন, সেখানে সহযাত্রীর অভাবের পীড়াতেই লেখাটি শেষ হলো। লাখো টাকা
অপপ্রয়োগ করে কোনোক্রমে খাড়া করা স্কুলের ঘরে
সপারিষদ নেতা-মন্ত্রী ফিতে কাটতে এলে শিক্ষক-শিক্ষিকা-ছাত্র-ছাত্রীদের
বাধ্য হয়েই গাইতে হয় রবীন্দ্র সঙ্গীত,‘মহিমা তব উদ্ভাসিত মহা গগন মাঝে, বিশ্ব জগত
মণিভূষিত বেষ্টিত চরণে।’ পুরো ব্যবস্থার
প্রতি বিদ্রুপবানে বৃহত্তর সত্য এই ভাবেই উচ্চারণ করলেন তিনি।
লেখা নিয়ে লেখকের ভাবনা আরো গভীরে গেছে ‘কালি কলম মন, লেখে তিনজন’ প্রবন্ধে।
ছন্দে মেলানো শিরোনাম। সেখানে কাগজে কলমের প্রথম ছোঁয়া থেকে একটি লেখার ছেপে
বেরিয়ে আসবার পুরো প্রক্রিয়াটির কথা বিশদে লিখেছেন। কমেও ছবার পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যায় একটি
লেখা। আধা তার লেখেন লেখক, বাকিটা দাঁড় করান ছাপাখানাতে যারা কাজ করছেন,সম্পাদক
সহ।একটি লেখার মানের সবটার গৌরব যেমন লেখকের নয়, দোষের সবটাও তাঁর নয়।তাই বলে
লেখকের দায়কে তিনি খাটো করেন নি কিছুতেই। বরং বাড়িয়েছেন। আমাদের যাদেরই টুকটাক
সম্পাদনার অভিজ্ঞতা রয়েছে,তারা দেখেছি লেটার প্রেসের জমানা চলে যেতেই বহু লেখক
লেখা ছাপতে দেবার ন্যূনতম নিয়মকানুনকেও তোয়াক্কাই করেন না। অপাঠ্য হাতের লেখাতে,যথেচ্ছ
কাগজে লিখে বা জেরক্স করে বা টাইপ করে পাঠিয়ে দিচ্ছেন। যেভাবে সম্পাদককে সেগুলোর
পাঠোদ্ধার করতে হয়, সেই শ্রম হরপ্পার পাথুরে ফলকে দিলে এতো দিনে ভাষার ইতিহাসের
মোড় ফেরানো যেত।ছাপাখানা বান্ধব
করে একটি লেখাকে দাঁড় করাবার বিষয়টি নিয়ে বেশ গভীরে গিয়ে ভেবেছেন।শুধু লিখতে
জানলেই হলো না, লেখককে চিনতে হবে কাগজ, কলম, কালি
এবং অতিঅবশ্যই হাতের লেখাকে করে তুলতে হবে সৃজন কর্ম। বরাক উপত্যকার
বিখ্যাত কিছু লেখকের নজির দিয়েছেন, দু’একখানার ছবিও জুড়ে দিয়েছেন। লেখাটি আদতে ছিল
নিজেরই স্কুলে ‘লিখন কর্মশালা’তে বলা। স্বাভাবিকভাবেই অন্যরকম হতে পারত না। তবে
আমরা আশা করব--- লেখা শিল্পের পতনের পেছনের আর্থ-সামাজিক তথা প্রযুক্তিগত কারণটি
নিয়ে তিনি পরে আরো ভাববেন। কারণ মনে হয় না, লেখার সেই স্বর্ণযুগ আর ফিরে আসবে
বলে। বর্তমান আলোচকও দীর্ঘদিন ধরে কলমের
ব্যবহার করছেনই না, আর কাগজ বলতে অধিকাংশই JK Copierএর A4 শিট। এখন তো বিদ্যালয়-মহাবিদ্যালয়েও
ক্রমেই ডিজিট্যাল ব্ল্যাকবোর্ড এসেই যাচ্ছে।
অবশ্য প্রযুক্তি নিয়ে তিনি ভেবেছেন ‘গণমাধ্যম ও বাংলা বানান প্রসঙ্গে’
নিবন্ধে।কথা যখন লেখা নিয়েই হচ্ছে, তখন বানান বিষয়টিও সেরে নেয়া যাক। বানান কোথায়
ভুল হয়,কেন ভুল হয়---সেসব তিনি বেশ বিস্তৃতই লিখেছেন। সত্যজিৎ রায়ের ছবি ‘পথের
পাঁচালি’র টাইটেল কার্ডে ‘সহযোগীতা’ বানান থেকে যাবার কথাও যেমন জানিয়েছেন, তেমনি
তাঁর নিজের লেখাতেও বহু ভুল থাকে সেই স্বীকারোক্তি দিয়েই শেষ করেছেন। ফলে কোথাও
বানান ভীতি বাড়াবার চেষ্টা করেন নি। প্রযুক্তির বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে ভাষাও
পাল্টাবে,স্বাভাবিকভাবে বানানও---তিনি সে মেনে নিয়ে রক্ষণশীলতার বিরুদ্ধে
দাঁড়িয়েছেন শুরুতেই। তাই বলে একটি প্রতিষ্ঠিত ভ্রান্তি ‘আজকাল বানানের কোনো নিয়ম
নেই’---এর পক্ষে কেন দাঁড়ানো যাবে না সেই কথাই লিখে গেছেন। এটি স্বীকার করে নিয়েও
যে “প্রমিত বানান-বিধি, স্বীকৃত বানান অভিধান, পরিবর্তিত বানানের রূপ---এসব বিষয়
সাধারণ মানুষের কাছে নিতান্তই অপ্রয়োজনীয়,দুর্লঙ্ঘ্যও।” তাঁর জোরটি মূলত লেখক
সম্পাদকদের ’পরেই। তাঁর পরামর্শ তাঁদের জন্যে ‘বই পড়া একই সঙ্গে হয়ে উঠুক বই
দেখাও।’ জনপ্রিয় পাঠশালা পাঠ্য ‘বর্ণবোধ’
যেভাবে সাধারণের বানান বোধটাও পাকা করে ফেলে, তেমনি একই প্রকাশকের ছাপা ‘পঞ্জিকা’ই
যে বানান বিভ্রান্তির বড় উৎস সেই কথা তো আমরা কমই ভেবে দেখেছি। সেখান থেকেই তাবৎ
পুজো অনুষ্ঠানের চিঠি, চাঁদার বই, প্রচার পত্রে, ধর্ম সংক্রান্ত বই পত্রিকাতে এক
বিকল্প বানান (অ)বিধি প্রতিষ্ঠা পায়। তার মানে, পঞ্জিকা যদি বানান বিধি অনুসরণ
করে, বা অন্য ধর্মেরও প্রচারকদের যা কিছু বই পত্র আছে, সেই সবেও সংস্কার চালানো
যায়-- তবে সাধারণেরও একটি বড় ভাষা-সমস্যাকে
অনেকটাই সমাধান করে ফেলা যায়। কিন্তু সেই দুঃসাহস করে কে? সঞ্জীবের রসবোধ
দুর্দান্ত। তিনি বার্টাণ্ড রাসেলের একটি সতর্কবাণী শুনিয়েছেন,“পণ্ডিতের সঙ্গে তর্ক
করো না,পণ্ডিতের পাণ্ডিত্য আছে,তোমার তা নেই।” আমরা যেটি বুঝলাম,ভাষাতে বানান ভুল চলতেই থাকবে।নির্ভুল
লেখাটি ‘লেখক’দের কাজ। তিনি বানান দেখা,বানান শেখার জন্যে রবীন্দ্রনাথের নজির
দিয়েছেন, ‘গীতবিতান’ দেখতে বলেছেন। রবীন্দ্রনাথের মানের না হলেও--- সঞ্জীবের
মানেরই সই---যদি লেখককুলের সংখ্যা বাড়াবার পরিবেশ একটি মেলে---যেমন আছে বাংলাদেশে,
আছে পশ্চিম বাংলাতে---বা অসমেও অসমিয়াদের মধ্যে---তবেই শুদ্ধ বানানে পড়বার
সৌভাগ্যও আমাদের বাড়বে। সেই পরিবেশের কথা লিখতে গেলে আমাদের বানান বিধিতে আটকে
থাকলে চলবে না,বাইরেও বেরোতে হবে।
পরিবেশ এতোটাই প্রতিকূল যে বিদ্যালয়গুলোতেই লেখক তৈরির পথ হচ্ছে বন্ধ। সঞ্জীবই
লিখেছেন, “ইদানীং প্রায় দুই দশক ধরে আমরা লক্ষ করেছি আমাদের স্কুল-কলেজে মাতৃভাষা
মাধ্যমের ছাত্রদের হাতে যেসব পাঠ্যপুস্তক তুলে দেওয়া হয় এগুলো সবই অনূদিত বই,কোন
মৌলিক রচনা নয়। কিন্তু ষাট, সত্তর দশকে তো এরকম ছিল না, ইতিহাস,ভূগোল,বিজ্ঞান এবং
সাহিত্যের বই যেমন ছিল মৌলিক,তেমনি মুদ্রণের পরিপাট্যে,বাঁধাইয়ের কুশলতায় ছিল যাকে
বলে ‘রিডার্স ফ্রেণ্ডলি’।” প্রবন্ধটির নাম তাই ‘প্রসঙ্গ : অনূদিত পাঠ্যপুস্তক’।এই অনুবাদ যে কেবল বাংলা বইয়েরই হচ্ছে তাই নয়। NCERT, SCERT-র নির্দেশে নতুন পাঠ্যক্রমের নতুন বই
প্রথমে ইংরেজিতে লেখা হয়, সেখান থেকে অসমিয়াতে অনূদিত হচ্ছে। তার থেকে বাংলা,
হিন্দি, মণিপুরি, বডো ইত্যাদি ভাষাতে।এই বিশাল অনুবাদ যজ্ঞের পেছনে গভীরে গিয়ে
কোনো ভাবনা চিন্তা দেখা যাচ্ছে না। যারা করাচ্ছেন এবং যারা করছেন—দুই পক্ষই মনে
রাখছেন না, “সার্থক অনুবাদ মানে একটা সৃজন কর্মই।” দ্রুত কাজ করাবার জন্যে একই
বইয়ের এক একটি অংশ একাধিক লোককে ধরিয়ে দেওয়াতে রচনাভঙ্গি,বাকরীতি,বানান সবেতেই
ভিন্নতা দেখা দেয়। আক্ষরিক অনুবাদে ভাষার প্রাণ তো থাকেই না, অর্থেরও বিড়ম্বনা ঘটে
যায়। তিনি একটি নজির দিয়েছেন, এক অনুবাদক ইংরেজি পদগুচ্ছ ‘in the long run’এর বাংলা অনুবাদ করেছিলেন,‘দীর্ঘতম দৌড়ে’। তার মানে
অনুবাদককে অনুবাদ তত্ত্ব বুঝতে জানতে হবে,ভাষাতত্ত্ব বুঝতে হবে।অভিধান ঘাটাবার --
তাও সম্পর্কিত নানা ভাষার, নানা প্রকারের-- অভ্যাস থাকতে হবে। কেবল টাকা দিয়ে
খাটিয়ে দিলেই হবে না। অথচ হচ্ছে তাই। সব চাইতে বড় বিড়ম্বনাটি হচ্ছে ‘প্রাইমার’এরও অনুবাদ হচ্ছে।
এটি একটি অসম্ভব এবং অবাস্তব ধারণা বলে তিনি সঠিকভাবেই ধরেছেন।
প্রাইমার অনুবাদের বিষয়টি গুরুগম্ভীর। এই নিয়ে আরেকটি স্বতন্ত্র রচনাই তিনি
লিখেছেন। নামেই বিড়ম্বনা-- ‘শিকন পুথি’। বাংলা বইয়ের
অসমিয়া নাম। বাংলাতে ‘পুথি’ শব্দটি আছে বটে, কিন্তু সেতো আদ্যিকালের হাতে লেখা
পাণ্ডুলিপির নাম।স্কুলে পড়বার বইকে কেউ ‘পুথি’ বলে না। আর ‘শিকন’ তো বাংলা শব্দই
না। শুরুতেই একটি ভুল শিক্ষা। শুধু নামটি বাংলা হলেই হলো না।সঞ্জীব লিখেছেন,“ শিশুদের পাঠ্যপুস্তকের নামকরণ সহজ সুন্দর,
আলঙ্কারিক এবং কাব্যিক হওয়া চাই।” এই প্রসঙ্গে আমাদের মনে পড়লো একটি সুবিখ্যাত
অসমিয়া শিশু পাঠ্যের কাব্যিক নাম --
‘কুঁহিপাঠ’। বইটির অনুবাদ এবং সম্পাদনার সময়েই নাম পালটাবার সুপারিশ করেছিলেন সঞ্জীব।
কিন্তু কাজ হয় নি। দিন পনেরো সময়ে যুদ্ধকালীন তৎপরতাতে বইটি ছাপা হয়ে যায়। প্রাপ্য ‘মজুরি’ও দেওয়া হয়
রসিদ ছাড়াই। তিনি একটি চিঠি দিয়েছিলেন
সর্বশিক্ষা কর্তৃপক্ষের কাছে। সময়ে পৌঁছুবে বলে হাতে হাতে দিয়েছিলেন। পৌঁছুলো কি
না জানেন না। সেটি পরে শিলচরের দৈনিক সাময়িক প্রসঙ্গে ছাপা হয় ২০১০এ। এই প্রবন্ধের
শেষেও ছেপে দিয়েছেন।তাতে জানা গেল ‘শিকনপুথি’ নাম পাল্টে ‘অনুশীলন বই’ করবার
পরামর্শ দিয়েছিলেন। কিন্তু শুরুতেই শিশু পাঠ্যের অনুবাদ প্রকল্পটিই তিনি উঠিয়ে
দেবার সুপারিশ করেছিলেন। কাজ কিছুই হয় নি।
সমস্যাটি যে সারা দেশেরই সে তো এই
কথাতেই স্পষ্ট যে আমরা লিখলাম অসমিয়া বইও অনূদিত হচ্ছে। এই পরিবেশটাই সহায়ক হয়ে
উঠেছে এক পুরোনো ‘গোপন যুদ্ধে’র। এই শিরোনামে শুরুতেই সঞ্জীব লিখলেন,“আসাম যে একটি
বহুভাষী রাজ্য এটা রাজ্যের একটি প্রভাবশালী গোষ্ঠী মন থেকে মেনে নিতে পারছে না।”
তিনি ১৯৮৮তে হাইলাকান্দিতে অনুষ্ঠিত অসম সাহিত্য সভার অধিবেশনের সেই সব কুখ্যাত
ঘোষণার স্মৃতিচারণ করেছেন,যেখানে বলা হয়েছিল বরাক উপত্যকার ভাষা বাংলা নয়। তার
স্মরণিকাতে অভিনেতা নাট্যকার তথা নাট্যপ্রভাকর উপাধিতে ভূষিত সত্যপ্রসাদ বড়ুয়ার
কিছু পরামর্শের কথা উল্লেখ করেছেন। সত্যপ্রসাদ লিখছেন, অসম সাহিত্য সভার উচিত
বরাকের স্থানীয় কথ্য ভাষাতে কিছু বই পত্র ছাপানো, যার মাঝে মধ্যে অসমিয়া ঢুকিয়ে
দেওয়া হবে। তাতে অসমিয়া ভাষার সঙ্গে বরাকের ভাষার যোগসূত্র স্থাপিত হবে।তাঁরও আগে
১৯৫৯-৬০এ সাহিত্য সভার সভাপতি ছিলেন অতুল চন্দ্র হাজরিকা। তিনি লিখেছিলেন,“কাছাড়ে
যদি মানুষ থাকত, আসামে যদি মানুষ থাকত, আর অসম সাহিত্য সভার গায়ে যদি জোর থাকত,
তবে...।” অসম্পূর্ণ কথাটি
অনুবাদেই আছে। সম্পূর্ণ করেছেন সঞ্জীব নিজে। এক দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনার কথা
লিখেছেন। স্পষ্ট নয়—সেগুলো অতুল চন্দ্র হাজরিকারই পরামর্শ কি না। অতুল চন্দ্র
কিন্তু মারা গেছেন হাইলাকান্দি অধিবেশনের আগেই, ১৯৮৬তে। ফলে তাঁর পক্ষে সম্ভব ছিল
না সত্যপ্রসাদ বড়ুয়ার পরামর্শগুলোর সম্প্রসারণ করা। হয় কথাগুলো প্রাচীনতর, অথবা
পরের কারো। সেই পরিকল্পনাগুলো হচ্ছে, প্রাথমিক স্তর থেকে উচ্চতর মাধ্যম অব্দি
যেটুকু বাংলা পড়ানো হয় সবেতেই প্রচুর অসমিয়া শব্দ অনুচ্ছেদাদি ঢুকিয়ে দেওয়া।
অসমিয়া বাক্যের আদলে বাংলা বাক্য তৈরি করা। আর বাংলা প্রাইমার তুলে দিয়ে অসমিয়া
প্রাইমারের অনুবাদ প্রচলন করা। আমরা দেখবো, ঠিক এই কাজগুলোই হয়ে আসছে। স্কুলের ভেতরে এবং বাইরেও। যেমন ‘আরক্ষী’,
‘স্মৃতিগ্রন্থ’, ‘আলোচনী’, ‘মুরব্বী’ এমন প্রচুর শব্দ বাংলাতে ঢুকে যাচ্ছে, যার
কোনো সঠিক বাংলা অর্থ হয় না। পদবিন্যাস রীতিও পাল্টে যাচ্ছে ‘আগ বাড়িয়ে দেওয়া
চাই’,‘বলেছিলে না’ ইত্যাদি।সবচাইতে হাস্যকর নজির সঞ্জীব দিয়েছেন রেশন দোকানের নাম
যখন হয়েছে ‘আমার দোকান’। বাংলাতে এই অসমিয়া শব্দবন্ধের অর্থ দাঁড়ায় ‘আমাদের দোকান’। বাঙালি সেসব না জেনে বুঝেই ব্যবহার করে যাচ্ছেন। বলতে গেলে অসমিয়ারও বারোটা
বাজাচ্ছেন। তাই সঞ্জীব লিখেছেন, এগুলো অসমিয়া ভাষার জন্যেও ক্ষতিকর। স্কুলের
প্রশ্ন পত্রে ঢুকে যাচ্ছে, ‘সা-সম্পত্তি’, ‘সকল ধরণের পৃথিবীতে থাকা জিনিস’-এর মতো
কিম্ভূত পদবিন্যাস। কেউ যে উপর থেকে সুসংগঠিত ভাবে করছেন সেরকম নয়। প্রতিবাদ
প্রতিরোধ করলে অসমিয়া বুদ্ধিজীবী শিক্ষাবিদদের সহায়তাতে কিছু প্রতিবিধানের
ব্যবস্থার কথাও সঞ্জীব লিখেছেন। উলটে বাঙালিদেরও একাংশের,“কিছুটা অসচেতনতায়,
কিছুটা অজ্ঞতায় এবং কিছুটা ইচ্ছায়ও প্রতিষ্ঠা পেয়েছে।” সঞ্জীব এও দেখিয়েছেন কী
ভাবে আমাদের গোপন সম্মতিতে হিন্দি ইংরেজি আগ্রাসনও সমাজকে গ্রাস করে নিচ্ছে। তিনি
এও স্বীকার করেন “পাশাপাশি দুটো ভাষার অবস্থান সাধারণ বাঙালিকে বিভ্রান্ত করে।”
কিন্তু যারা ‘আসাম’-এর বদলে ‘অসম’ লেখেন তারা তো আর সাধারণ নয়। আনন্দবাজার পত্রিকা
তাদের ‘ব্যবহার বিধি’তে ‘অসম’ লিখবার নির্দেশ দিয়ে রেখেছে। এবং বহু শিক্ষিত
লেখকেরাও সেই নির্দেশ মেনে চলেন। তার মধ্যে বর্তমান আলোচকও রয়েছেন। তাই তাঁর
বক্তব্য ‘...আগ্রাসন আমাদের সম্মতি নিয়েই আসে।’ এক ভাষা থেকে আর ভাষা শব্দাবলী
সংগ্রহ করলে যে সমৃদ্ধ হয়--- সেই কথা সঞ্জীব মনে রেখেছেন। তার পরেও তাঁর বক্তব্য--
গেল শতকের ষাটের দশক অব্দি অসমিয়া ভাষাতে বাংলার অনুপ্রবেশ সমস্যা তৈরি করে
রেখেছিল। এককালে তারাও বাঙালির দেখা দেখি ‘আসামী’ লিখতেন—এখন আর লেখেন না। সেরকম
বহু সতর্কতা এবং সংস্কার যখন অসমিয়াদের মধ্যে কাজ করছে, তার বিপরীতে অসমে
বাঙালিদেরই একাংশ এক নয়া ‘সমন্বয়তত্ত্ব’ দাঁড় করাচ্ছেন--- যার “...ছদ্মবেশে এ এক
নতুন আগ্রাসন যার প্রভাবে আসামে এক নতুন বাংলা ভাষার জন্ম হচ্ছে যে ভাষার সঙ্গে
বাংলা ভাষার প্রথম ভুবন পশ্চিম বঙ্গ এবং দ্বিতীয় ভুবন বাংলাদেশের ভাষার সঙ্গে
ব্যবধান দুস্তর।” তিনি যে পরামর্শটি দিচ্ছেন, তারও মূল কথা বাঙালিরও দরকার-- সেই
অসমিয়া পথই অনুসরণ করা।অর্থাৎ তারা যেভাবে বাংলার অনুপ্রবেশ প্রতিরোধ করছেন,বাঙালিরও
দরকার অসমিয়ার অনুপ্রবেশ প্রতিরোধ করা।স্বাতন্ত্র্য বিসর্জন দিয়ে নয়, রক্ষা করেই
সত্যিকার সহাবস্থান এবং প্রীতির সম্পর্ক দাঁড়াতে পারে। এবং আমরাও তাঁর সঙ্গে সহমত
পোষণ করি যখন লেখেন,“...এটা করলে আসামের বাঙালিরা তাদের কাঙ্ক্ষিত সম্ভ্রম এবং
ভালোবাসাও আদায় করতে সক্ষম হবে।”
কিন্তু আমাদের বক্তব্য হচ্ছে, সমস্যা
এর চেয়েও জটিল। সঞ্জীবের এই বার্তাগুলো
আসামের তাবৎ লেখকদের মধ্যে পৌঁছে দেওয়া গেলেও, যা হয়তো গেছেও, শিক্ষক-শিক্ষিকাদের
মধ্যেই তো ছড়িয়ে দেওয়া দুষ্কর। আর সেটি করা না গেলে বাকি ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে
ছড়িয়ে দেবার উপায় কী? ‘ইচ্ছায়’ এগুলো হবার পরিমাণ খুবই কম। এই ‘অসম-আসামে’র মতো
দু’চারটি বিষয় ছাড়া। সেখানেও ‘আসাম’কে একেবারে বাদ দেয় নি কেউ। এখনো ব্রহ্মপুত্রের
বাঙালি ‘আসাম’ বলেনও, লেখেনও।আনন্দবাজারের নির্দেশিকা কিছু ছিল না কি না আম জনতা
সেসব জানেন না। আমরা তাই বানান সম্পর্কে যা লিখেছিলাম, এখানেও তাই লিখি,যদি
‘পরিবেশ একটি মেলে’ তবে বার্তাগুলো ভেতর থেকে জন্ম নেবে এবং ছড়াবে। ঠিক এই পথে তো
সারাভারতেই ইংরেজি ব্যাপক ভাবে বাংলাতে প্রবেশ করছে। হিন্দিও। আমরা সেগুলো নিয়ে তো সেভাবে ভাবছি না। কারণ
সেখানে জানি আর্থ-রাজনৈতিক কারণগুলো না পাল্টালে কিছু হবার না। অসমিয়ার বেলাও একই।
অসমিয়াদের মধ্যেও ইংরেজি –হিন্দি এমন কি বাংলার অনুপ্রবেশ নিয়ে এখনো ক্ষোভ আছে।
সংবাদ মাধ্যমের অধিকাংশ বিজ্ঞাপন, কেন্দ্র সরকারের বহু বিজ্ঞপ্তি, এমন কি
প্রাতিষ্ঠানিক সাইনবোর্ডেও কলকাতাতে বাংলা থেকে অনুবাদ হয়ে আসে। অসমিয়াতেও বাংলা
সম্পর্কেই বেশি সংবেদনশীলতার প্রকাশ ঘটে। বাংলার অনুপ্রবেশ রোখার ভাষিক রাজনীতি
কখনো বা এতোই প্রকট হয় যে কোনো বাঙালি যদি অসমিয়া বলতে বা লিখতে গিয়ে বাংলা
প্রকাশভঙ্গীর ছোঁয়া লাগিয়েই দেন তবে অনেকেই ক্ষুণ্ণ হন। ভাবেন বুঝি ইচ্ছে করেই এটা
করা হচ্ছে। বর্তমান আলোচকেরই এমন অভিজ্ঞতা রয়েছে। যার জন্যে অসমিয়া চর্চার
উৎসাহটাই মিলিয়ে যায়। ভাটি অসমের বহু অসমিয়া আছেন ‘দেওবার’ না বলে ‘রবিবার’
বলে,‘দেউতা’ না বলে ‘বাবা’ বলে বিপাকে পড়েন। সঞ্জীব সেই পদ্ধতি বাংলাতে অনুসরণ
করতে বলছেন। আমরা দেখেছি, যারা শুদ্ধ করে বাংলা লিখবার চেষ্টা করেন---তারা এখনো
বঙ্কিম বিদ্যাসাগর নিদেন পক্ষে শরৎ চন্দ্রের বাংলাতে আটকে থাকেন। তৎসম শব্দের
ঘনঘটা ঘটান। ‘সর্বসাধারণ’ শব্দটি সেরকম একটি। অসমিয়াতে খুব চলে। কিছু বাঙালি,যাদের
খানিক নাক উঁচু, ভাবেন বোধহয়, বাংলা তো অসমিয়ার থেকে আরো সমৃদ্ধ ভাষা।তাই শব্দটি
তো চালানো চাইই। আরেকটি বাড়তি ‘ব’-ও জুড়ে দেওয়া চাই। লেখা চাই ‘সর্ব্বসাধারণ’। বাংলাতে যে
‘সাধারণ-বিশেষ’ বলে বিপরীত সহজ সরল
শব্দজোড় রয়েছে তাদের জানায়টা কে? ইংরেজি ‘general public’-এর অনুবাদে বাংলা অসমিয়া দুই ভাষাতেই ‘জনসাধারণ’ বলে আরেকটি অতি সুন্দর শব্দ
তৈরি আছে। সেখানে ‘সর্ব্বসাধারণে’র উটকো উৎপাত যে রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তীর মতো অনুষ্ঠানেও
কী করে আসন টেনে বসে পড়ে ভেবে কিনারা মেলা দুষ্কর।
পঞ্জিকার এবং ধর্মগ্রন্থের বেশি কোনো বাংলা বই তো ঘরে ঘরে নেই। বহু শিক্ষকের
কাছেও নেই। বাজারেও নেই। পত্রিকাও নেই। যা কিছু আছে সবই অসমিয়া ভাষাতে।আর না
চাইলেও দিনে রাতে সেগুলো পড়তে হয়। স্কুলে কলেজে, অফিসে আদালতে, স্কুলে কলেজে
সর্বত্র। স্বাভাবিক ভাবেই যা কিছু শব্দ বা শব্দবিন্যাসের অভ্যাস গড়ে উঠে সবই
অসমিয়া পড়ে।মাঝে কিছু প্রাদেশিক অসমিয়া টিভি চ্যানেল বাংলা সংবাদ পড়া চালু করেছিল।
মূল অসমিয়া থেকে দ্রুত অনুবাদ করতে গিয়ে বাঙালি সাংবাদিকেরাই এতো বাজে লিখেছেন এবং
পড়েছেন যে শোনা যায় স্রেফ টি আর পি-র অভাবে সেগুলো বন্ধ হলো। ভূপেন হাজরিকা মারা
গেলে তিনসুকিয়ার কিছু চ্যানেলে বাংলা সংবাদে বলছিল, তিনি এতো সনে ‘জন্মেছে’, এতো
সনে বিদেশে ‘গেছে’, এতো গান ‘গেয়েছিল’---ইত্যাদি। এগুলো সমন্বয় তত্ত্বের ফল নয়, অসমিয়াদের
খুশ করবার জন্যেও না। বরং আমাদের ভয় ছিল ভূপেন হাজরিকাকে অপমান করা হচ্ছে বলে না
কেউ হল্লা জুড়েন বিপরীত দিক থেকে। বাংলা বুঝা কিছু অসমিয়ার তাই করাই উচিত ছিল, তবে
বড় উপকার হতো। আর গ্রামাঞ্চলে আগেও খুব বেশি বাংলা স্কুল ছিল না,এখন শহরাঞ্চলেও
দ্রুত কমে যাচ্ছে। বাংলা স্কুলেই ভরে যাচ্ছেন অন্য মাধ্যমের শিক্ষকে। সেরকম স্কুল
থেকে উঠে আসা ছাত্র যদি নিজের স্কুলেও বাংলা পড়ান -- কী পড়াবেন? আর যদি কিছু
লেখেন? একটি মারাত্মক ‘সমন্বয় তত্ত্ব’ আছে আমরা অস্বীকার করি না। কিন্তু বিপরীত পথও
সবটা কণ্টক মুক্ত নয়,এবং সুগভীর দৃষ্টির দান নয়। অসচেতনতা আর অজ্ঞতাতে যারা
কাজগুলো করছেন,তারা সবাই ‘সমন্বয়তত্ত্ব’ ধরে সচেতনে করছেন বলে প্রচার পেলে---হতাশাটি
দুদিকেই কাজ করে। ইংরেজি, হিন্দি সহ তাবৎ আগ্রাসনের মুক্তির একটি সার্বিক পথ যদি
বের করা যায়---তবে হয়তো বা অসমিয়া আগ্রাসন মুক্তিরও পথ যেমন মেলে, অসমিয়াও বাংলার
আগ্রাসন ভয় থেকে মুক্ত হতে পারে। যদিও অসমিয়ার উপর বাংলার আগ্রাসন আজ আর তত তীব্র
নয়। অন্তত এর কোনো সরকারি প্রাতিষ্ঠানিক প্রয়াস নেই। আজ যখন সরকারি স্কুলগুলো
মাত্রেই বিপন্নতার মুখোমুখি সেখানে অসমিয়াও তো খুব আত্মতুষ্ট হয়ে বসে নেই। অতুল
চন্দ্র হাজরিকা যে সময়ে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনাটির কথা ভেবেছিলেন---সেই সময়টিই এখন
আর নেই--- এখন সময় অসমিয়াকেও বৈমাত্রেয় করে ফেলেছে। তবে সব কিছুর পরেও বাংলাদেশ
এবং পশ্চিম বাংলার প্রমিত বাংলা এক হয়ে নেই। এমন কি ভাষা-অভিধান চিন্তাও এক খাতে বইছে না। খুঁটিয়ে দেখলে দেখা যাবে পূর্বোত্তরের বাংলারও
স্বাতন্ত্র্য চিহ্ন ক্রমশ স্পষ্ট হচ্ছে। সেরকম সার পানি পেলেও--- সে যে চেহারা
নিয়ে সবার সামনে গিয়ে দাঁড়াবে---তা অপর দুই বাংলার মতো এক হবে না। বিশ্বজুড়েই
ইংরেজিরও সেরকম প্রকারভেদ আছে, আর তা স্বীকৃতি পাচ্ছে। অসম তথা
পূর্বোত্তরের বাংলাতে অসমিয়ার সব কিছু বাদ দেওয়া যাবেও না,দরকারও নেই। যেমন ‘উপায়ুক্ত’। আরক্ষী না হয় বাদই
দেওয়া গেল--- ‘উপায়ুক্ত’-কে যদি ‘পুলিশ’-এর মতো বাংলা প্রবেশাধিকার দিয়েই দিয়েছে,
বরাকেও দিয়েছে---সেটি আর আটকানো যাবে বলে মনে হয় না। উচিতও না। সেরকমই ‘অসম’ লিখলে
আপত্তি তখনই মানায় যখন ‘আসাম’ লেখা বাঙালি একেবারেই বাদ দেবেন। ততক্ষণ অব্দি কিছুই
প্রমাণ হয় না, যা করছেন সবই ভয়ে আর তোষামোদে। আমরা দেখিনি ‘আসাম’ লিখে কোনো বাঙালি
কোনোদিন বিপাকে পড়েছেন। ‘উজান’ পত্রিকার বিজ্ঞাপনেই ‘আসাম’-এর দেখা মিলবে। বর্তমান
লেখাটিও তাই ‘আসাম’ দিয়েই শুরু হয়েছে।
এই নিবন্ধেই সঞ্জীব তাঁর নিজের করা একটি অনূদিত বই থেকে অন্যের করা প্রশ্নের
বিড়ম্বনার কথা লিখেছেন।প্রশ্ন কর্তা অনূদিত বই থেকে নয়,মূল ইংরেজি বই দেখে নিজের
মতো করে বাংলা করে দিয়েছেন। সেখানে ঐ ‘সা-সম্পত্তি’, ‘সকল ধরণের পৃথিবীতে থাকা
জিনিষ’-এর মতো কিম্ভূত পদবিন্যাস ঢুকে গেছে। এ তো মূল্যবোধের প্রশ্ন। ‘শিক্ষা,শিক্ষক ও
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বিবর্তনে মূল্যবোধের প্রশ্ন’-এ সেরকম বহু কথাই সঞ্জীব আলোচনা
করেছেন। সেখানে এই অভিজ্ঞতার কথাও রয়েছে -- সেই ১৯৮১তেই স্কুলের চাকরিতে যোগ দিয়ে
প্রথম দিনেই এই প্রশ্নের মুখে পড়েছিলেন,আপনি কত টাকা দিয়েছেন? আজ যখন বিশ্বব্যাংকের
তদারকিতেই সব হচ্ছে, তখন তো এই প্রশ্নও আমাদের তুলা দরকার কতটা প্রত্যক্ষ এবং
পরোক্ষ মুনাফা তারা ভারতে শিক্ষার জন্যে ধার দিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন? ‘দেনা-পাওনা’র সংকট তো সেখান থেকে শুরু হচ্ছে। সে
যাই হোক, আমরা প্রশ্নপত্রের বিড়ম্বনার কথা লিখছিলাম। সেসব তিনি আরো বিস্তৃত
লিখেছেন ‘সর্বশিক্ষার একটি প্রশ্নপত্র’-এ। বানান যতি চিহ্ন ইত্যাদি প্রসঙ্গও
এসেছে। এসেছে মূল পাঠ্যবইতেই এমন বহু ভুল এমন কি,তথ্য ভুলের কথাও। তিনি জানিয়েছেন
‘আদর্শ বাংলা পাঠ’ প্রথম ভাগের ১৯৯৮তে প্রকাশিত দশম সংস্করণে প্রায় ১০৮টি শুদ্ধির
দরকার। আমরা উচ্চ মাধ্যমিকের ২০১৭তে প্রকাশিত দ্বিতীয় বর্ষের এবং এবারে ২০১৮তে প্রকাশিত
প্রথম বর্ষের বাংলা বই সম্পর্কেও একই কথা বলতে পারি। দুটিরই সম্পাদনা সমিতিতে আছেন
রাজ্যের স্বনামধন্য শিক্ষক-গবেষক-কবি-লেখকেরা। এর থেকে যোগ্য লোকেদের নিয়ে
সম্পাদনা সমিতি হতেই পারে না। কিন্তু কেন ভুল হয়,সম্পাদনা সমিতিরই দু’চারজনের
সঙ্গে কথা বলে দেখেছি---তাঁদের কোনো নিয়ন্ত্রণই নেই এতে। আমলাতান্ত্রিক
ব্যবস্থাটির ভেতরেই তো কোনো নিষ্ঠা আর আন্তরিকতা নেই। দেশসেবার মনোবৃত্তির কথা তো
তুলেই লাভ নেই। যদি এমন হতো যে সম্পাদনা সমিতির হাতেই দায়িত্ব থাকত—পাণ্ডুলিপি
তৈরি থেকে ছাপাখানা থেকে বের করে আনা অব্দি পুরো কাজের স্থান-কাল- আয়-ব্যয়
নির্ধারণের তবে একটি দায়বদ্ধতার প্রশ্ন তুলা যেত।
এই অব্দি লেখা-পড়ার বিষয়গুলো নিয়ে রচনাগুলো আমরা ছুঁয়ে এলাম। এবারে বলার
ভাষাতে তিনি প্রবেশ করেছেন ‘ভাষাহারা প্রজন্ম’-এ। সেখানে গুয়াহাটির একটি টিভি
চ্যানেলের টক শো-তে অসমিয়া ছেলে মেয়েদের মুখে সাবলীল অসমিয়া শুনে ‘সশ্রদ্ধ প্রণাম’
জানিয়েছেন। বিপরীতে ‘বরাক উপত্যকার ছেলেমেয়েরা মফস̖সলীয়, কিন্তু
কসমোপলিটান সংস্কৃতির কুপ্রভাবে আক্রান্ত,ভাষাহারা’ বলে আক্ষেপ জানিয়েছেন। তারা যে
হিন্দি-ইংরেজি- এবং স্থানীয় মুখের ভাষা মেশানো,তাও সেগুলোরও মান রূপটি
নয়,‘জগাখিচুড়ি’ ভাষা হাট বাজার থেকে সামাজিক মাধ্যম সর্বত্র ব্যবহার করছে — সেই
নিয়ে ভাবতে পরামর্শ দিচ্ছেন। রসিকতা করে বলতে ইচ্ছে করে, এরই জন্যে আমরা বরাকে
ব্রহ্মপুত্রে, অসমিয়া বাঙালি-তে সমন্বয়ের কথা বলি। অসমিয়াদের থেকে শেখার আছে বহু কিছু।
কিন্তু এ নিতান্ত রসিকতা। অসমিয়া ছেলে মেয়েরা এতো প্রশংসার পাত্র-টাত্র নয়। সেই টক
শো-তে কোনো কারণে লেখক শুনে ফেলেছিলেন আর কি। এমন কি অসমিয়া বৈদ্যুতিন
সংবাদমাধ্যমগুলোও ভাষার বারোটা বাজাচ্ছে বলে অসমিয়া সমাজেও আক্ষেপ আছে। চরিত্রের
দিক থেকে এই আক্ষেপ একেবারেই ভাষা-নিরপেক্ষ এবং সর্বভারতীয়। হিন্দি বুদ্ধিজীবীদের
কথাতে কান পাতলেও আক্ষেপ শুনা যাবে---সারা দেশে হিন্দির চাইতে বিপন্ন ভাষা আর
দ্বিতীয়টি নেই। আর কথাটি একেবারে অশুদ্ধও নয়! আমাদের একটি ভাবনা আছে। সামাজিক
মাধ্যমে এই সেদিনও রোমান হরফের রমরমা ছিল। বহু ভাষাদক্ষ লেখকেরাও রোমানে অভ্যস্ত
ছিলেন। আমরা বাংলা হরফে লিখতে বললে বলতেন, যারা বাংলা হরফে লিখছেন তারা আগে ভাষা
শুদ্ধ করুন। এই সব পুরোনো তর্কের সাক্ষ্য আমাদের পুরোনো লেখাতে মিলবে। এখন আর
আমাদের বলতে হচ্ছে না,মোবাইল কোম্পানিগুলো ব্যবস্থা করে দিয়েছে। এবং বাংলা লেখার
পরিমাণ এতো বেড়েছে---যে এখন ‘কার হেন সাধ্য যে সে রোধে তার গতি’। দেখতে চাইলে ভাষার
বিপন্নতা হু হু করে বেড়ে দৃষ্টির বাইরেও চলে গেছে --দেখা যাবে। কিন্তু বিপরীতে সম্পন্নতা এবং সৃজনশীলতার ভাড়ারও পরিমাণে সাগর
সদৃশ। মানের কথাটি ভাবতে হলে পরিমাণের কথাটিও ভাবতে হয় বৈকি। দুটো অবিচ্ছেদ্য
দ্বান্দ্বিক সম্পর্কে বাঁধা। সুতরাং কোথাও আমাদের প্রান্তিকতা,আমাদের সংখ্যালঘু
মানসিকতা আমাদের দৃষ্টিকে আচ্ছন্ন করছে কি না — সেই কথাটিও ‘বিস্তর ভাবনা চিন্তার
প্রয়োজন।’ আমাদের ‘দুর্যোগ’ প্রতিরোধ দরকার, কিন্তু সে কি হবে ‘সুযোগে’র দিকে চোখ
বন্ধ করে? তবে তো হতাশার থেকে মুক্তি নেই।
প্রায় একই বিষয় নিয়ে তিনি কিছু গভীরে গিয়ে ভেবেছেন ‘বরাক উপত্যকার গ্রামীণ
জীবনে ভাষা-শিক্ষা’ নিয়ে যেখানে লিখেছেন। গ্রাম নিয়ে ভেবেছেন বলেই সেখানে কিছু
আনকোরা নতুন কথাও রয়েছে। রয়েছে এই উপলব্ধি যে “...মাতৃভাষা শিক্ষার ক্ষেত্রটি
গ্রামের দিকে সরে যাচ্ছে...।” ফলে “... পাঠ্য-পুস্তক বিভ্রান্তির প্রত্যক্ষ আঘাত এসে
লাগে ওই গ্রামীণ জীবনেই।” সেখানে শিক্ষাদান পদ্ধতি প্রসঙ্গে দু’চারটি মৌলিক কথা
লিখেছেন যা আমাদের ব্যাপক ভাবনার বিষয় হওয়া দরকার। কিন্তু বিষয়টি সেভাবে
স্পষ্টভাবে আসে নি। বিদ্যালয়-বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকেরা পাঠদানের বেলা স্থানীয়
ভাষাবৈচিত্র্য (উপভাষা) ব্যবহার করছেন। সভাসমিতিতে সরকারি কর্মকর্তারা মৌখিক
ভাষাতে কথা বলছেন। তাঁর একটি অভিজ্ঞতার কথা লিখেছেন, যেখানে এক গ্রামে শিক্ষা বিষয়ের
সভাতে শ্রোতারা বলে উঠছেন, “সভার ভাষা শিষ্টজনের ভাষাই হওয়া উচিত।” যে শ্রোতা
‘শিষ্টজনের ভাষা’ বললেন তিনি নিজেকে ‘অশিষ্ট’
ভাবেন না তো? বহু আগে হেমাঙ্গ বিশ্বাস আমাদের এক অন্য গল্প শুনিয়েছিলেন। গ্রামের
কৃষক সভাতে কলকাতার এক কমরেড বাংলাতেই বলছিলেন। কৃষক কমরেড সভার শেষে বলছেন,“কইছইন
ভালাউ। কিন্তু বাংলাত কইলে বা’লা আছিল।” লিখলাম স্মৃতি থেকে। সেই কৃষক শ্রোতার
‘বাংলা’ শব্দের মানে হচ্ছে ‘সিলেটি’। তা হলে এই সব বিচ্ছিন্ন অভিজ্ঞতার থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়া
কঠিন। কিন্তু যেখানে মোক্ষম কথাগুলো সঞ্জীব লিখেছেন,তার খানিকটা এরকম,“মাতৃভাষা
পাঠদান কালে আবার স্থানীয় উপভাষা অর্থাৎ দেশজ শব্দ, বাকধারা, উপমা,প্রকাশ ভঙ্গি
ইত্যাদিকে উপেক্ষা করে শিষ্ট ভাষা এবং দেশজ ভাষার মধ্যে একটি দুস্তর প্রাচীর তৈরি
করে দেওয়া হয়েছে আমাদের পাঠদান পদ্ধতির দোষেই। এর ফলে শিষ্ট ভাষার সঙ্গে দেশজ ভাষার
বিচ্ছেদ ঘটাও অস্বাভাবিক নয়।ছাত্র-ছাত্রী, শিক্ষক কিংবা সাধারণ জনগণের মনে সন্দেহ
জাগতেই পারে ছাপার অক্ষরের ভাষাটা বুঝিবা তাদের নিজস্ব কিছু নয়, উপর থেকে চাপিয়ে
দেওয়া একটি বিদেশী ভাষাই।” এই সুযোগেই যে কিছু মানুষ বরাক উপত্যকার ভাষা বাংলা নয়
বলে নানা সময়ে প্রচার দিয়ে এসেছেন, সত্যটি তিনি স্বীকার করেছেন। তিনি এর পরে
লিখেছেন, “... শিষ্ট ভাষা শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে দেশজ ভাষা শিক্ষারও প্রয়োজন রয়ে
গেছে...।” আরো লিখেছেন, “ ...dialect হলো সর্বজন ব্যবহৃত শিষ্ট বাংলা ভাষার feeder language এবং এ উপভাষাই মূলভাষা অর্থাৎ standard language কে জোগায় তার প্রাণরস...।” তাঁর এই
উপলব্ধিই সম্প্রসারিত হয়েছে যখন সম্প্রতি বরাক উপত্যকা বঙ্গ সাহিত্য ও সংস্কৃতি
সম্মেলনের পরিচালিত দূর শিক্ষাক্রমের পাঠ্যবই সম্পাদনা করেছেন। সেখানে
‘শিষ্টভাষা’, ‘উপভাষা’ জাতীয় পরিভাষা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন। আমরা স্বপ্ন দেখব সেই
দিন আসবে, যখন পাঠশালা পাঠ্য বইতে ছাত্র তার ঘরে বলা ভাষার রূপ রস গন্ধ পড়তে পাবে।
এবং আত্মসম্মান বোধে উদ্বুদ্ধ হবে।
লেখা-পড়ার কথা এইটুকুনই। এবারে তাকানো যাক ‘কেমন চলছে আমাদের স্কুলগুলো’। তিনি শুরুতেই লিখে
দিয়েছেন, “এ রচনাটিকে কেউ যেন রম্যরচনা হিসেবে না দেখেন।’ লিখেছেন সেই রম্যরচনার
ঢঙেই। সেখানে প্রথম ভাগে লিখেছেন প্রতিটি স্কুলে একটি ‘স্কুল ম্যানেজমেন্ট’ কমিটি
থাকলেও ৯০% স্কুলেরই প্রধানদের ‘ম্যানেজমেন্ট’ নিয়ে কোনো প্রশিক্ষণই নেই। ফলে
পরিচালন পদ্ধতি বলে কিছুই নেই সরকারি স্কুলে। অন্যদিকে বেসরকারি স্কুলগুলোতে মাইনে
কম। চাকরির নিরাপত্তা নেই। শিক্ষাগত যোগ্যতাও আহামরি নয়। তবু পরিচালন পদ্ধতি ভালো।
মিশনারি স্কুলগুলোতে সেই নিয়ে রীতিমত প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এই সব সীমাবদ্ধতা
সত্ত্বেও এককালে ‘হেডমাস্টারে’রা তো
সিস্টেমের ভেতরে থেকেই স্কুলগুলো ভালো চালাতেন। তিনি ষাট সত্তর দশক অব্দি এমনটাই
হচ্ছিল লিখেছেন,পরে এই ক্ষীণধারাটি আশি এবং নব্বুই দশককেও স্পর্শ করেছিল।কারণগুলো
লিখেছেন,এঁরা ‘কিছুটা জন্মসূত্রে প্রাপ্ত বিশেষ প্রতিভারও অধিকারী, আবার অনেকে
একেবারে স্ব-শিক্ষিত।’ এগুলো যদি এখন আর কারণ হতে পারছে না তবে তার দায় তো সময়কে নিতে
হয়,প্রধান শিক্ষক বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো নেবে কেন? এহেন আবেগিক কথা বাদ দিলে
আমাদের মেনে নিতে অসুবিধে নেই, “এঁরা একটা সময়ের প্রয়োজনে সৃষ্ট...।” “এঁদের
চালিকাশক্তি ছিল দেশপ্রেমের আদর্শ।” দেশ স্বাধীন হবার পরের তিন চার দশক অব্দি
স্বাধীনতা আন্দোলনের একটি রেশ ছিল, দেশ গড়বার স্বপ্ন ছিল। সেই স্বপ্নে এরা অনেকেই
জীবনভর ত্যাগের তাড়নাতে ব্যস্ত থাকতেন। একটি সম্মানও আদায় করে নিতেন। বহু কাঠখড়
পুড়িয়ে সরকারি স্বীকৃতি যদি স্কুলের জন্যে আদায় করে নিতে পারলেন---তবে তার জন্যেও
নতুন স্বাধীন দেশের কথা ভেবে ক্ষমাঘেন্না অনেকে করে ফেলতেন। স্মরণ করা যাক যে
স্বাধীনতার পরে পরেই তৈরি রাধাকৃষ্ণান আয়োগ এবং দেড় দশক পরের কোঠারি আয়োগের
মর্মবস্তুতে ‘দেশপ্রেম’ ছিল। কিন্তু ১৯৮৬র নতুন শিক্ষানীতিতেই সরকারী দায় এড়ানোর
সূচনা হলো,বাণিজ্যবুদ্ধি এসে ঢুকল। আর নব্বুই দশকে যখনই বিশ্বায়নের মন্ত্রে দীক্ষিত
করা শুরু হলো---তখন তো সেই স্বপ্নের আর অবশিষ্ট কিছু রইল না। ‘নয়া-উপনিবেশ’ তখন আর
তত্ত্বে নেই, একেবারে চোখের সামনে নগ্ন হয়ে পড়েছে। ১৯৯০তে যে ‘সবার জন্যে শিক্ষা’
আন্দোলনটি শুরু হলো---সেখানে বিশ্বব্যাংকও প্রবেশ করল। আর ব্যাংক যখন বলল,উচ্চশিক্ষাতে
সরকারি সহায়তার লাভ বড়লোকেরা তুলে—অনেকেরই মনে হলো এতো ‘শ্রেণিসংগ্রামে’র কথা। সেই
সঙ্গে এও বলে দিল, প্রাথমিক-মাধ্যমিক শিক্ষাতে বিনিয়োগের ফিরতি লাভ যতটা
উচ্চশিক্ষাতে সেরকম নেই। লাভলোকসানের হিসেবে কষে শুরু হলো গালভারী ‘সবার জন্যে
শিক্ষা’ আন্দোলন। দুনিয়া জুড়ে ধনি-দরিদ্রের দু’রকম শিক্ষাকে নতুন করে
প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিয়ে দেওয়া শুরু হলো। আর আমরা কেমন বোকা বনে গিয়ে মেনেও
নিলাম। আগেকার শিক্ষকেরা বিদেশী তাড়িয়েছেন
অনেকে। নতুন শিক্ষকদের শেখানো হলো বিদেশীদের ছাড়া আমাদের মুক্তি নেই। ক্ষমা ঘেন্নাও করে হলেও যে স্বদেশী সরকারের ভরসাতে জীবনের শেষদিন অব্দি
তাকিয়েছিলেন, সেই সরকারই জানিয়ে দিল শিক্ষার সব দায় আর সে নিচ্ছে না। শিক্ষার
বেসরকারি করণ হচ্ছে, আর সেখানে বিদেশী পুঁজি, বিদেশী পদ্ধতি, বিদেশী ভাষা সবই
আসছে।স্বাভাবিক ভাবেই ভরসাটি তো আর রইল না, তার জায়গা নিল সংশয় সন্দেহ। আগেকার শিক্ষকদের
তো সেদিনই মৃত্যু ঘোষণা করে ফেলা হলো। জন্ম হলো নতুন যুগের নতুন শিক্ষকের। ‘জন্ম
সূত্রে প্রাপ্ত বিশেষ প্রতিভার’ এরাও অধিকারী। সরকারী স্কুলের শিক্ষকদের সেই
সামাজিক সম্মান রইল কই? সম্মানের হয়ে গেল বেসরকারিকরণ। ক্ষতিপূরণে একাংশ সরকারী শিক্ষকের
মাইনেটাই মোটা হলো –যার থেকে বঞ্চিত বেসরকারি শিক্ষকেরা। বাকিদের না রইল সম্মান, না চাকরির
নিরাপত্তা, না মোটা মাইনে। শিক্ষকদের মধ্যে এখন কতশত শ্রেণিভেদ, কতশত প্রকার ভেদ।
স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় অব্দি। একটি মহৎ কাজ করতে যে ঐক্যবোধ দরকার---সেটিকেই তো
সমূলে নষ্ট করে ফেলা হলো উপর থেকে। সঞ্জীব সেই যুগসন্ধিক্ষণের শিক্ষক বলেই তাঁর
হাহাকার ‘ আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম...’
“ইদানীং সারাবছরই স্কুলে আসতে থাকে মোটা,মাঝারি অঙ্কের টাকা, গাড়ি ভর্তি
আসবাব, বিজ্ঞানের সরঞ্জাম, সাইকেল, আসে রান্নার সামগ্রী কেনার টাকা, রান্নাঘর
নির্মাণ, পুনর্নির্মাণের টাকা...” -- কোত্থেকে আসে? ২০১৪ থেকে ২০১৭-১৮ প্রতিবছর
শিক্ষা খাতে কেন্দ্র সরকারের বাজেট বরাদ্দ ৬.১৫% থেকে প্রায় অর্ধেক কমে ৩.৭১% হয়েছে।গুণোৎসব পরবর্তী সরকারী সমীক্ষাতে বলছে, খোদ মুখ্যমন্ত্রীর
বাড়ির কাছে চাবুয়াতে গেল দুই বছরে বন্ধ হয়ে গেছে ত্রিশখানা স্কুল। জুলাই মাসে আমরা
শুনেছিলাম, শিবসাগরে হাজারো শিক্ষক বহু মাস মাইনে পান নি বলে গণ-আত্মহত্যার হুমকি
দিচ্ছিলেন। লখিমপুরে চারদিনের অনশনে বসেছিলেন। তাহলে টাকা আসছে কোত্থেকে, উড়ছে
কোথায়? তারপরেও এটা সত্য যে আমরা দেখছি শিক্ষকের চাকরি দেওয়া থেকে শুরু করে ছাত্রদের
সাইকেল বা কম্প্যুটার দেবার প্রদর্শনী হচ্ছে খচ্চা করে সংবাদ মাধ্যম ডেকে এনে। সংবাদ মাধ্যমের
সামনেই সব অপমান জুটছে শিক্ষক প্রধান শিক্ষকদের, উল্লাসে মত্ত হচ্ছেন ঈর্ষান্বিত
সহকর্মী। পুরো ব্যবস্থাতেই তো বিসঙ্গতি। বেচারা নয়া জমানার প্রধান শিক্ষকের সামনে
তো বিসঙ্গতির মেলা—‘হট্টমেলা’ । একেকটি স্কুলে সেই মেলার বিবরণ সঞ্জীব লিখেছেন রসিয়ে বসিয়ে।
পড়ে ‘মা সরস্বতী নিশ্চিত দীর্ঘশ্বাস ফেলেছেন’।
বাকি যে চারটি রচনা রইল একেও এই রচনারই সম্প্রসারণ বলতে পারি এই অর্থে যে
লেখকের শ্বাসটি এখানেও দীর্ঘতর হয়েছে। সঙ্গে পাঠকেরও মনে সংক্রমিত হয় নীরব বিষাদ।
এগুলো রসরচনা নয়। ‘শিক্ষা,শিক্ষক ও শিক্ষা আধিকারিকেরা’ শুরু হয়েছে উপেন্দ্রচন্দ্র
গুহকে দিয়ে---যিনি সেকালীন সুরমা উপত্যকার ডি আই ছিলেন। ১৯১০এ লিখে প্রকাশ করেছিলেন সুবিখ্যাত ‘কাছাড়ের
ইতিবৃত্ত’। সেরকমই সুরমা উপত্যকারে এস আই মহামহোপাধ্যায় পদ্মনাথ ভট্টাচার্য
বিদ্যাবিনোদ—যিনি পরে কটনেও অধ্যাপনা করেছেন। এ বছর তাঁর জন্মের দেড়শত বছর পালিত
হচ্ছে। সুবিখ্যাত ‘কামরূপ শাসনাবলী’ গ্রন্থ প্রণয়ন করেছিলেন। সম্পাদনা করেছিলেন
‘হেড়ম্ব রাজ্যের দণ্ডবিধি’,’ হেড়ম্ব রাজ্যের ঋণদান বিধি’ ইত্যাদি গ্রন্থ। কামরূপ
অনুসন্ধান সমিতির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন। আমরা জানি অসম সাহিত্য সভার
প্রতিষ্ঠার পেছনেও তাঁর শ্রম এবং চিন্তা কাজ করেছিল। তাঁর প্রেরণাতেই অচ্যুতচরণ
চৌধুরী তত্ত্বনিধি লিখেছিলেন দুই খণ্ডে মহাগ্রন্থ ‘শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত।’ এমন আরো
বেশ কিছু পরিদর্শকদের গল্প শুনিয়েছেন সঞ্জীব যারা কেবল স্কুল দেখে না দেখে কাল
কাটিয়ে চলে যান নি। যারা গেল দুই তিন দশকে পরিণত হয়েছেন বিরল প্রজাতিতে। সেরকমই
বিরল প্রজাতির বিগত দিনের কিছু শিক্ষকদের স্মরণ করেছেন শেষ নিবন্ধে। ‘তাঁদের
প্রণাম’। “অবসরের দিনে একখণ্ড গীতা বা কোরান এবং একটি লাঠি হাতে বিদ্যালয় থেকে রিক্ত
হস্তে বেরিয়ে আসতেন এসব মাস্টারমশাইরা।” সেরকম
‘শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পত্র-পত্রিকা’-র কথা শুরু হয়েছে প্রায় শতাব্দী প্রাচীন
‘শিক্ষাসেবক’-এর কথা দিয়ে। শেষ হয়েছে
২০১৩-১৩র ‘রাষ্ট্রীয় মাধ্যমিক শিক্ষা অভিযান’-এর মাসিক ‘জ্ঞান সাগর’ নামের ব্যর্থ
প্রকল্পের কথা দিয়ে। ঠিক সেখানেই নয়। কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের এ.পি.আই ধরবার জালস্বরূপ যে গবেষণা পত্রিকা আদির জোয়ার
উঠেছে—সেগুলোর কথাতে। যার মূল প্রেরণাই হলো ‘Write and be damned; publish and perish’।
সঞ্জীবের একটি লেখা শুরু হয়েছে আলফাঁস দুঁদে নামে এক ফরাসি লেখকের ‘শেষ পাঠ’
নামের ছোট গল্পটি দিয়ে যেখানে ‘গ্রামীণ জীবনে ভাষা শিক্ষা’ নিয়ে লিখেছেন। গল্পটি দেশে
সিবিএসই স্কুল পাঠ্যক্রমেও রয়েছে। সম্প্রতি দীপেন্দু দাস ‘শেষ পাঠ’ নামেই একটি বাংলা গল্প লিখেছেন।বাংলাতে এই ফরাসি
গল্পের পুনসৃজন করেছেন। কিন্তু গল্পটি
অসমের বাঙালি রাজনীতির বয়ান তৈরিতে বহু আগে থেকেই নিজের ভূমিকাটি রাখছে। প্রায় শতাব্দী
কাল আগে, বিশ শতকের বিশের দশকে সিলেট-কাছাড় জেলার বাংলা ভুক্তির প্রসঙ্গে শিলঙের
আসাম বিধান পরিষদে বলতে গিয়ে জননেতা ব্রজেন্দ্র নারায়ণ চৌধুরী এই গল্পটির কথা
উল্লেখ করেছিলেন। সঞ্জীবই লিখেছেন। গল্পটি
ফ্রান্স-জার্মান সীমান্তের আলজাঁ
বলে একটি এলাকার। আলজাঁ এবং লোর্যাঁ জার্মানরা দখল করে নিয়েছিল ১৮৭০-৭১এর ফরাসি-জার্মান
যুদ্ধের সময়। ফরাসি স্কুলগুলোতেও ফরাসি বদলে জার্মান পড়াবার নির্দেশ দিল নয়া সরকার।
ফরাসি ভাষা-সাহিত্যের শিক্ষক মঁশিয়ে আঁমেল কীভাবে শেষ দিনের পাঠ পড়ালেন—সেইই গল্প। এক ফাঁকিবাজ ছাত্র
সেদিন ক্লাসে গিয়ে দেখল কড়া শিক্ষক সেদিন একেবারেই স্নেহময়ে পরিণত। সে যখন ভালো
করে ফরাসি পড়তে পারল না—তিনি বকা দিলেন না। উলটে সবাই মিলে পড়া এবং পড়ানোকে কেমন
ফাঁকি দিচ্ছিলেন সেইসবই বললেন। লোকেও এতো সুন্দর মিষ্ট ফরাসি ভাষাকে অবহেলা করে
বলতে লিখতে ভুলে যাচ্ছিল। আজ সেই ফরাসির স্কুলে শেষদিন। পেছনে গ্রামের জনাকয়
প্রবীণ মুরব্বিরাও এসে বসেছেন। এক ফাঁকে তিনি বোর্ডে লিখলেন, “ফ্রান্স,আলজাঁ,ফ্রান্স,আলজাঁ’। কথক ছাত্রের মনে
হলো শব্দগুলো গোটা পাঠঘরে,বিদ্যালয়ে, আকাশে বাতাসে পতাকা হয়ে উড়ছে। যে কিনা এতোদিন
পাঠের কিছুই বুঝতে পারত না, এদিন যাই পড়াচ্ছিলেন বলছিলেন শিক্ষক, সবই জলবৎ তরল হয়ে
তার মর্মে গিয়ে পৌঁছাচ্ছিল। তার মনে প্রশ্ন দেখা দিচ্ছিল, গাছে বসা পায়রাগুলোও কি
এর পরে কেবল জার্মানই বলবে? একেবারে শেষে নীরব শিক্ষক বোর্ডে লিখলেন,‘ফ্রান্স
দীর্ঘজীবী হোক!’ ছাত্রদের বললেন, তোমরা যেতে পারো। গল্পটি এখানেই শেষ। মাতৃভাষা
এবং দেশের প্রতি প্রেমের এক মর্মস্পর্শী গল্প সন্দেহ নেই। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ
ছোটগল্পগুলোর একটি।
কিন্তু সঞ্জীব যেভাবে লিখেছেন,“এর পরবর্তী অধ্যায়ের জন্যে যেতে হবে ইতিহাসে---
কী ভাবে ফরাসি জাতি মাতৃভাষাকে স্বীয় মহিমায় প্রতিষ্ঠিত করল, প্রিয় মাতৃভূমির
দাসত্ব-শৃঙ্খল মোচন করল, ফরাসি ভাষাকে বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাষা হিসেবে
প্রতিষ্ঠিত করল।”---সেরকম কিছুই হয় নি। সুতরাং এর থেকে যদি এই তত্ত্ব দাঁড় করিয়ে দিই যেভাবে সঞ্জীব
লিখছেন,“বরাক উপত্যকা ইতিমধ্যে নিজেদের ঐতিহ্য বিচ্যুত হয়ে নিজেদের যথেষ্ট ক্ষতি
সাধন করে ফেলেছে। এখন একমাত্র মাতৃভাষাই শেষ অবলম্বন।” আর বলি, “...গ্রাম থেকেই
শুরু হোক আমাদের আগামী দিনের জয়যাত্রা” তবে সে যতই মধুর শোনাক-- সমস্যার মূলেই
যাওয়া যাবে না,সমাধান তো দূর অস্ত। ফরাসি ভাষা সাহিত্যে এর আগেই বিশ্বে সম্মানিত
ভাষা সাহিত্য ছিল। হ্যুগো, বালজাক, মোঁপাসারা আলফাঁস দুঁদের সমকালেই বিশ্বসাহিত্যে
দাপিয়ে বেড়াচ্ছিলেন। এবং বাকি দুনিয়াতে এখন যদি ফরাসি পঞ্চম জনপ্রিয় ভাষা তার কারণ
কোনো ভাষা আন্দোলন নয়--- ইংরেজি বা স্পেনীয়র মতোই তার সাম্রাজ্যবাদী অভিযান। সে
নিজের বিশ্বের বহু ভাষাকে গিলে খেয়ে বড় হয়েছে। আলজাঁ এবং লোর্যাঁ এখনো জার্মানির
অধিকারেই রয়েছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে ১৯১৯এ কিছুদিন ফ্রান্সের দখলে গেছিল এই
মাত্র। তখনো এই এলাকার আশি শতাংশের বেশি মানুষের ভাষা ছিল জার্মান। এখনো তাই আছে,
দ্বিতীয় ভাষা ফরাসি। ছোট ছোট আরো কিছু ভাষার মানুষও সেখানে রয়েছেন। আর লেখক আলফাঁস দুঁদে আলজাঁ এবং
লোর্যাঁ-র লোকই ছিলেন না। দক্ষিণ ফ্রান্সে জন্মেছিলেন। ব্যক্তি হিসেবে খুব ভালো রাজনীতির
প্রতিনিধিত্ব করতেন না। ফরাসি-জার্মান যুদ্ধের দিনগুলোতেই ফরাসি শ্রমিক শ্রেণি
বিশ্বে প্রথমবারের মতো কিছু দিনের জন্যে প্যারিসে শ্রমিকশ্রেণির রাজ কায়েম
করেছিল---ইতিহাসে যা প্যারি কম্যুন বলে বিখ্যাত। দুঁদে সম্রাট তৃতীয় নেপোলিয়নের
সমর্থক ছিলেন--- জার্মান বিদ্বেষী তো ছিলেনই। ইহুদী বিদ্বেষীও ছিলেন। সিমেটিক
বিরোধী একটি কাগজও সম্পাদনা করতেন। তিনি আসলে ইউরোপে জাতিরাষ্ট্রগুলো গড়ে উঠবার
দিনগুলোর বৌদ্ধিক নেতৃত্ব, যে রাষ্ট্রগুলো অন্যদিকে দুনিয়াময় প্রতিদ্বন্দ্বিতা
করছিল সাম্রাজ্যবিস্তার করে বাকিদের পদানত করতে। সুতরাং তারা আমাদের আদর্শ হতে পারেন
না।
সঞ্জীব লিখেছেন শহরে যারা ভাষা নিয়ে কথা বলেন, বা অনুষ্ঠানাদিতে শোভাবর্ধন
করেন তাদের একাংশ “...আবার সংস্কৃতিকে অবলম্বন করে রাজনৈতিক, সামাজিক প্রতিষ্ঠা
লাভের অভিলাষী।” দীপেন্দু দাস
তাঁর গল্পে ‘বাবা’-কে দিয়ে এই কথাটিই আরো
স্পষ্ট বলিয়েছেন, “...এই সমস্যা শুধু বাংলার নয়, অসমিয়া ভাষার সমস্যাটাও তাই। জড়
অনেক গভীরে। রাজনীতির রং শুধু শত্রু খোঁজে অন্যের মধ্যে। এটা সহজ বলে। লোক ক্ষেপীয়ে
তোলা যায় বলে।” আমাদের এই সহজ পথ অতিক্রম করে এগোতে হবে।
যে আলোর কথা সঞ্জীব লিখেছেন তার অধিকাংশই বিগত দিনের। সেই আলো তিনি অনাগত দিনে
ছড়িয়ে দেবার চেষ্টা করেছেন, করতে গিয়ে কিছু মৌলিক নতুন কথাও শুনিয়েছেন—যেমন বানান
নিয়ে, মুখের ভাষার সম্মান নিয়ে ইত্যাদি। বহমান দিনের শুনিয়েছেন আঁধারের গল্প। ‘আমাদের গেছে যে দিন,
একেবারেই কি গেছে?’ -- তা হয়তো না। কিন্তু এ আঁধার তো অন্য আঁধার, নিত্যদিনের
ভোরের মতো করে তো আলো আপনাতেই আসবে না। সঞ্জীব বয়সে প্রবীণ হলেও মননে এখনো নবীন।
সেই শিক্ষা সেবক বা তাঁরও আগে থেকে শিক্ষক-লেখকদের যে বিশেষ ঐতিহ্য প্রবহমান তিনি
সেই প্রবাহে নব সংযোজন-- সে কথা ভূমিকাতে অধ্যাপক অমলেন্দু ভট্টাচার্য লিখেছেন।
আমরা আশা করব তিনি বা আমাদের মতো তাঁর পাঠকেরা এখানে থামবো না।আমরা যেন বিশ্বজুড়া
‘সবার জন্যে শিক্ষা’ আন্দোলনের ভালোমন্দের থেকে আমাদের সমস্যাকে আলগা করে না রাখি।
সলিল চৌধুরীর কথায় সুরে আমাদের গান হোক, ও আলোর পথযাত্রী,এ যে রাত্রি এখানে থেমোনা/এ বালুচরে আশার তরণি তোমার যেন
বেঁধোনা...