আমার চেতনার রঙে রাঙানো এই খেলা ঘরে:

~0~0~! আপনাকে স্বাগতম !~0~0~

*******************************************************************************************************

Friday, 8 March 2019

নারী এবং শ্রম



মাদের ভারতীয়মনকে আজকাল তিনতালাক নিয়ে খুব ব্যস্ত করে রাখা হয়েছে। যখন বাস্তবে তিনতালাকের থেকে না বলে কয়ে বৌ ছেড়ে দেবার অর্থনীতি এবং ধর্মনীতি দুটিই বহু প্রবল। তালিবান শাসনে আফগান মেয়েদের দুর্দশা নিয়ে এক বাঙালি মহিলা বই লিখে খুব বিখ্যাত হয়ে গেছিলেন। কিন্তু তিনি খবর নেন নি, তার মতো বাড়ির বাইরে কাজ করে রোজগার করা মহিলার সংখ্যানুপাত নিজের দেশে এতো কম যে পরিমাণটি পাকিস্তান থেকে সামান্য উপরে মাত্র ২৭%। গোটা বিশ্বে এই ক্ষেত্রে ভারতের স্থান ১৩১এ। বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কার থেকে বহু পেছনে। চীনের কথা তো বলেই লাভ নেই। নেপালের মতো কেউ পাত্তা দেয় না, দেশেও ৮০% মহিলা বাড়ির বাইরে কাজ করে রোজগার করেন। এটি খুব গুরুত্বপূর্ণ। নারীই আদিম শ্রমিক। এখনো প্রতিটি পরিবারের কায়িক শ্রমিকের বেশিটাই মহিলারাই দেন... পারিবারিক রাজনীতির চাপটা যদি হিসেবে নেই তবে মানসিক শ্রমের ভাগটাও কম কিছু নয়। কিন্তু ধান্দাবাজ সমাজ মনে করে তারা কোনো কাজ করে না, বাপ-বরে -পোলায় খাওয়ায় পরায় বলে তাঁরা বেঁচে বর্তে থাকেন। অতএব তাদের ধর্মীয় কর্তব্য হলো নিজের সেবাটুকু চালিয়ে যাওয়া। নারীশ্রমকে সেবাযত্নের মতো মিষ্টি নাম দিয়ে রেখেছে সমাজ। এই সামাজিক ধান্দাবাজির বারোটা বাজতে পারে, যদি ঐ ভারতের যে ছবিটা ২৭% বলছি, সেটি যদি উলটে যায়। সেবাযত্নের নামেও বিনামূল্যে নারীশ্রমের লাভ তুলা বন্ধ হতে হবে। ইতিমধ্যেই নারীশ্রমের বহু কিছুরই মূল্যের বিনিময়ে হস্তান্তর শুরু হয়েছে। যেমন ধরুন, মশলা বাটতে হয় না। অন্যের গুড়ো করে দেওয়া মশলার প্যাকেট খুলে তরকারিতে ঢেলে দিলেই হলো। মোবাইল এপস টিপলেই ডোমিনোজ ম্যাকডোনাল্ড বাড়িতে খাবার পৌঁছে দিচ্ছে ২৪x৭। বহু বড় শহরে নগরে যখন তখন যা চাই খাবার পৌছে দিচ্ছে। আজকাল পথের পাশে লাইন দিয়ে জল আনবার মারামারি করতে হয় না বহু শহরে। কাপড় কাচবার ঝামেলা নেই। তো কেবল প্রযুক্তি নয়, পুঁজিবাদী অর্থনীতিই পথ দেখাচ্ছে, নারীশ্রমের রূপান্তর ঘটছে কীভাবে। কিন্তু সেই সব ঘটছে বাজারের চাহিদানুসারে। বাজারের স্বার্থে। সেই স্বার্থেই এবারের নারীদিবসের গালভরা এক ভাবনা রাখা হয়েছে 'Balance for Better' (ভালোর জন্যে ভারসাম্য) । সেই ভারসাম্য শ্রমের বাজারে আসা চাই--- নারীপুরুষের সমান কর্মের সুযোগ চাই, সমাজ কাজের সমান মজুরি চাই। আর সেটি বাজার নয়, মেয়েদেরই স্বার্থে। বলা ভালো মানবতার স্বার্থে। সেখানেই ভারত এখনো ব্যর্থ। ভারত একটু বেশি ব্যর্থ। বিশ্বব্যাংকের রিপোর্টে যেসব দেশের অনুপাত বেশি বলে দেখিয়ে থাকে, সেখানেও প্রশ্ন--- সমান কাজের সমান মূল্য কতটা পাচ্ছে। এমন আরো বহু প্রশ্ন আছে, কাজের চরিত্র ইত্যাদি। তারপরেও বাড়ির বাইরে মেয়েদের কাজে যোগ দেওয়াটাই শুভারম্ভ। এখন , ভারতে পুরুষকেই কাজ দিতে পারছে না, নারীদেরকে তো আরো না। দেবার মালিকেরা তিনতালাক নিয়ে ব্যস্ত। যাতে আজীবন নারী পুরুষের কাঁধে চেপে থাকে। পুরুষও মারুক ধরুক জ্বালিয়ে মারুক কাঁধের ভার কাঁধে রাখুক। আসল সমস্যা ঢাকা থাক। নারী বলেই নয়, যে কোনো মানুষের মান সম্মান সবই নির্ভর করে তার শ্রমের উপরে। শ্রমের প্রকার ভেদের উপরে মর্যাদার মাত্রাভেদ। ফলে পুরুষ ভালো হোক, মেয়েদের মর্যাদা দিক--- বললেই দেবে না, যদি রান্নাঘর থেকে মেয়েদের মুক্ত করা না যায়। বাড়ির বাইরে কাজে গেলেই নারী নিরাপদ হয়ে যান না। আমাদের অভিজ্ঞতা বরং উলটো বলে। কিন্তু যে সমাজে শ্রম বিভাজনের চরিত্রটি এমন হবে যে নারী শ্রমের সামাজিক সাংস্কৃতিক মূল্যের সঙ্গে বৈষয়িক মূল্যটার অস্তিত্বও আমরা মেনে নিচ্ছি---সেখানে নারীর নিরাপত্তাও বাড়বে বই কমবে না। ঘটনা চক্রে আজ আমার জন্মদিন। প্রৌঢ় হতে চললাম। বলা ভালো হয়েই গেছি। এক কন্যা সন্তানের বাবা আমি। আমার নিরাপত্তা ডোর ছিঁড়ে বেরিয়ে যাবার বয়স হচ্ছে কন্যারও। তার বাসযোগ্য একখানা দেশ সমাজ গড়া তো হলো না। কোনো বাবার সে একার কাজ না। এমন বহু কন্যাকেও, পুত্রকেও হয়তো আরো কয়েক প্রজন্ম লড়তে হবে। এবং সেই লড়াই নারীর একার হবে না। সমস্যাটি যেহেতু শ্রমের সঙ্গে জড়িয়ে আছে, নারীর লড়াই আসলেই শ্রমজীবীর লড়াই। সেজন্যেই বিশ্বনারীদিবস আজকাল কোর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোও পালন করলেও শুরুটা হয়েছিল কম্যুনিস্ট নারীদের হাতেই, পুরুষ কমরেডদের সঙ্গে নিয়েই। আর সেভাবে না দেখলেও, এই লড়াই যে কোনো নারীর বর, ভাই, বাবা, কাকা, মামা, বন্ধুদেরও---নারী মাত্রেরই অপমান যাদের বিপর্যস্ত করে। বৈপরীত্য এই যে তাকে যারা অপমান করেন, তারা আবার তার জন্মদাত্রী মা-ও হতে পারেন, জন্মদাতা বাবাও হতে পারেন। সেই মা-বাবা হয়তো নিজের ঘরের পাপ ঢেকে তিনতালাকি দেশপ্রেমেও ব্যস্ত থাকেন। সাম্প্রদায়িকতার আফিম খাইয়ে মূল সমস্যার থেকে হয়তো তারাই আপনার আমার নজর ফিরিয়ে দিচ্ছেন। এই সব শয়তানির ফাঁদ কাটবার শক্তিতে যেন জোয়ার আসবার বদলে বয়সের সঙ্গে ভাটা না নামে। দিনভর আমাকে যারা জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানিয়েছেন---তাদের অশেষ ধন্যবাদ। আপনাদের শুভেচ্ছা অর্থহীন হয়ে যাবে, জীবন হয়ে যাবে নিরর্থক যদি জন্মদিনের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা নারীদিবসের পণ-প্রতিজ্ঞার কথা মনে না রাখি।