(নিখিলভারত বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলনের কোকড়াঝাড় শাখার মুখপত্র 'প্রান্তিক'-এ প্রকাশিত)
এক যে
ছিল রাজা। তাঁর নাম ছিল রাধারাম। রাজ্যের নাম ছিল প্রতাপগড়। রাজা বললেই আমাদের মনে হয় তিনি সসাগরা পৃথিবীর
অধীশ্বর ছিলেন। ঘোড়াশালে ঘোড়া থাকত, হাতিশালে হাতি। দাসদাসীতে পরিপূর্ণ তাঁর বিশাল
রাজপ্রাসাদ। আর রাজা মানেই ভোগ বিলাসে পরিপূর্ণ এক সুখের জীবন। সেসব ঠাকুরমার
ঝুলির গালগল্প। আমাদের রাজার সেরকম কিছুই
ছিল না। প্রতাপগড় রাজ্যটিও আহামরি কিছু ছিল না। তখনকার বাংলার শ্রীহট্টের একটি
ছোট্ট অংশ প্রতাপগড়।এখনকার অসমের করিমগঞ্জ জেলার উত্তরের কিছুটা ছেড়ে প্রায়
পুরোটা। সেখানেও নানা সময়ে ছোটবড় নানান রাজা রাজত্ব করছেন। কোনো কালে বুঝি এখানে প্রতাপ সিংহ বলে কোনো এক
রাজা ছিলেন। সেও গালগল্পই। তবে কিনা ত্রিপুরার রাজারা এখানে প্রায়ই শাসনের বিস্তার
ঘটাতেন, তাদের মধ্যে এক রাজা ছিলেন প্রতাপ মাণিক্য। তাঁর আমলে মালিক
প্রতাব বলেও এখানে এক সামন্তরাজা ছিলেন। মালিক প্রতাব মুসলমান ছিলেন। লোকে বলত
রাজা। আর আমাদের রাধারাম হিন্দু। তাঁকে লোকে নবাব বলত। নবাব রাধারাম। গল্পের
বাইরের গল্প এরকমই হয়।
তখন ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানি সিরাজদ্দৌলাকে পরাস্ত করে বাংলা
দখল করেছে। ব্রিটিশের বিরুদ্ধে মীরকাশিমের শেষ বিদ্রোহ বক্সারের যুদ্ধও হয়ে গেছে। পরে সিলেট আসামের অংশ হলেও তখন তো ছিল সেই সুবেহ
বাংলারই অংশ। কোম্পানি সেখানে শাসন বিস্তার করেছিল। ভূ-রাজস্ব লুণ্ঠনের সঙ্গে
চুন-সুরকি আর হাতি চালানের ব্যাপক ব্যাবসাও শুরু করেছিল। আর ছোটখাটো সামন্তরাজা -জনজাতি প্রধানদের বশ করে শাসন পাকা
করছিল। সেসব যখন করছিল এখানে ওখানে প্রচুর বিদ্রোহ হয়েছিল। আমাদের নবাব রাধারামের
সঙ্গেও হয়েছিল। প্রতাপগড়টা তো ছিল বাংলার প্রান্তে। অসম যখন এলো, তখন অসমেরও প্রান্তে।
তাই নবাব রাধারামের গল্প সেখানকার লোকে গানে গল্পে মনে রাখলেও আমাদের বিদ্যালয়
পুথিতে ঠাই পেল না। তায় প্রথম যিনি রাধারামের গল্প নিয়ে ইতিহাসের পুঁথি
লিখলেন---সেই অচ্যুত চরণ তত্ত্বনিধি রাধারামকে পারলে প্রায় লুটেরাই বানালেন। কারণ
তিনি ব্রিটিশ সরকারের কর্মচারী ছিলেন, আর ব্রিটিশকে ক্ষুণ্ণ করতে পারতেন না। তো,
লুটেরার গল্প স্কুলে পড়িয়ে কে ছাত্রদের মাথা খাবে? খায় নি। ঠাকুরমার ঝুলি জাতীয় কোনো কলকাতা শহুরে প্রকাশিত
বইতেও তাঁর গল্প ছাপা হলো না। লোকেও না জেনেই রইল। অথচ সেই একই সময়ে বা তারও আগে ফাঁসী হওয়া
মহারাজ নন্দকুমারের ফাঁসির গল্প--- সারা দেশের লোকে জানে। সিরাজদ্দৌল্লার কথা তো
দুনিয়া জানে।
নবাব রাধারাম জন্মেই রাজা বা নবাব কোনোটাই ছিলেন না। তাঁর
বাবা রাজারাম দত্ত এক সাধারণ সিলেটি মধ্যবিত্ত ছিলেন। ছেলে রাধারামের পায়ে এক অদ্ভুত
রোগ ছিল। পা দুটি অস্বাভাবিক মোটা ছিল। এহেন রোগ থাকা লোককে লোকে বলত গোধা। এবং
পরিবার পরিজন সেরকম লোককে ভয়ে বা ঘৃণাতে এড়িয়েও চলত। ভাগ্যিস এক সন্নেসী রাধারামের
বাড়িতে এসেছিলেন। তখনকার পীর ফকির সন্নেসীরাই ছিলেন চিকিৎসক। সন্নেসীকে ভক্তিভরে
খুব সেবাযত্ন করলে তিনি রাধারামের চিকিৎসা করে সারিয়ে তুললেন। রাধারাম সন্নেসীর
সঙ্গ নিয়ে বাড়ি ছেড়ে তাঁর সঙ্গে চলে এলেন প্রতাপগড়ে। গুরুশিষ্য চরগোলার যেখানে এসে
প্রথম রাত কাটিয়েছিলেন—সে জায়গাটিকে এখনো লোকে বলে ‘সন্ন্যাসী-পাট্টা’। সেখানে রাধারামকে ছেড়ে গুরু
চলে গেলেন ছাতা-চূড়া পাহাড়ে তপস্যার জন্যে। চরগোলার কথা এখন লোকে জানে ভালো। তখন
পুরো এলাকাই ছিল ঘন জল জঙ্গলে পরিপূর্ণ।
যে কিছু লোক আশেপাশে ছিল তাদের দেবতা ছিলেন ‘সহিজা বাদশা’। তিনি বা কে সেই নিয়ে আমাদের
এখন মাথা না ঘামালেও চলবে। শুধু ভেবে রাখা ভালো, হয়তো এই সন্ন্যাসীর মতো কোনো
মুসলমান পীর এখানে কোনো এককালে আখড়া বানিয়েছিলেন। সেরকম পীরেরাও রোগশোক থেকে লোককে
মুক্ত করতে পারতেন বলে লোকে দেবতা বলে মেনে নিত। আর জলে জঙ্গলে বাঘের দেবতার সঙ্গে
এক করে নিত। তার মানে লোকে বিশ্বাস করত--- ইনি বাঘ শেয়াল থেকেও জঙ্গলে তাদের রক্ষা
করবেন। এই লোক হিন্দুও হতো, মুসলমানও হতো। লোকের মনে আজকের মতো ভেদবুদ্ধি ছিল না।
তাই সন্ন্যাসী রাধারামকে বললেন, “‘যাঁর আমল তাঁহার দোহাই’ তুমি সহিজাকে বিশেষ
ভক্তি করবে। তাতেই তোমার উন্নতি অনিবার্য।’ বোঝাই যায় গ্রামে বাড়িতে অবজ্ঞার শিকার
রাধারামকে ভাগ্যের কাছে হার না মানবার জেদে পেয়ে গেছিল। সেই থেকে রাধারাম সহিজা বাদশার
ভক্ত হলেন, এবং ওখানেই বাড়ি করে থেকে গেলেন।
কিন্তু লোকজন নেই -- খাবেন কী , পরবেন কী? কাছেই
প্রতাপগড়ের জমিদার গোলাম আলির বাড়ির কাছে দোকান দিলেন। সেই দোকানে জমিদার বাড়ির
অনেক বাকি পড়ে গেল। ব্রিটিশ আমলের জমিদারও তো সেরকম। কোম্পানির দয়াতেই টিকে
থাকেন। সেই জমিদার টাকা দিতে পারলেন না,
তাঁকে কিছু জমি দিয়ে দিলেন। টাকার তখনো চলও বিশেষ হয়নি, সেও সমস্যা ছিল। লোকে
বিনিময় প্রথাতেই ভরসা করত। সেই জমিকেও নানা উপায়ে খাটিয়ে বুদ্ধিমান এবং উচ্চাকাঙ্ক্ষী
রাধারাম এমন করলেন যে একসময় গোলাম আলির অধিকাংশ জমি নিজের দখলে নিয়ে নিলেন। জমিদারের ছেলে গোলাম রাজা চৌধুরী এই দখলদারিকে
স্বাভাবিক ভাবে নিলেন না। আগেকার দিন হলে তো যুদ্ধ হয়েই যেত। কিন্তু তখন কোম্পানি
আমল। ফলে গোলাম রাজা মামলা করলেন কলকাতার আদালতে। মামলা একেবারে রাধারামের বিপক্ষে গেল না। তিনি
বেশ কিছু অংশের আইনি মালিক হলেন এবারে। কতটা কী --
এতো সব বিস্তৃত ইতিহাসে আমরা যাচ্ছিনা।
গল্পের মজা থাকবে না।
শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত থেকে |
গোলাম
রাজার সঙ্গে রাধারামের মামলা দেখে কেউ ভেবে বসবেন না এ হিন্দু মুসলমানের কাজিয়া।
সেইসব তখন ছিল না, গল্প যত এগুবে স্পষ্ট হবে। এ নিতান্তই রাজায় প্রজায় জমির বিবাদ।
প্রজা রাধারাম এবারে রাজা হবার স্বপ্ন দেখছেন। মামলাতে বিজয়ী হলেও রাধারামের রাগ
গেল না। রাগটা ব্রিটিশের কোম্পানির উপরেও চড়ল। কারণ, যতটা দখলে নিয়েছিলেন , সব জমি
তাঁর থাকে নি। যদিও সেই জমিতেই তিনি বিশাল বাড়ি করেন পরে। লোকে সেই বাড়িকে পরেও
বহুদিন ‘বড়বাড়ি’ বলে জেনে এসেছে। তিনি
পাশের কুকি জনজাতি সর্দারদের সঙ্গে বোঝাপড়া করলেন। এতে তাঁর প্রভাব প্রতিপত্তি
এতোই বাড়তে শুরু করল যে ক্রমেই নিজেকে নবাব বলে প্রচার দিতে শুরু করলেন। নবাবী
বাড়াবার জন্যে তিনি তখনো স্বাধীন ত্রিপুরার রাজা মহারাজ দুর্গা মাণিক্যের সঙ্গে
গিয়ে দেখা করেন। এখন যারা অসমে বলে ‘অসমকে ত্রিপুরা হতে দেবে না’ তারা সেই সব
ইতিহাসের গল্প খুব কমই জানেন। পরে যে
অংশটি অসমে আসবে, সেই অংশে ত্রিপুরা রাজার তখনো শাসন ছিল। তাঁর কিছু জমিজমা এখানে
ছিল, সেই অংশের শাসন ভার দিয়ে দিলেন রাধারামকে। রাধারাম কোম্পানিকে কানাকড়ি রাজস্ব
দিতেন না, ত্রিপুরার মহারাজকেও কিছুই দিতেন না। কিন্তু মহারাজের নাম ব্যবহার করাটা
কুকিদের উপরে প্রভাব বিস্তারে তাঁকে সাহায্য করেছিল। পরে যদি কোনো কুকি সর্দার বাগ মানেনও নি, রাধারাম
এবং তার ছেলে রণমঙ্গল---যাকে আমাদের এই হঠাৎ নবাব
সেনাপতি পদ দিয়ে রেখেছিলেন--- যুদ্ধে পরাভূত করে তাদের বশ করতেন। ক্রমে তাঁর রাজবাড়ির কাজকর্ম এবং প্রয়োজন বাড়তে
থাকে। তাঁর রাজ্যের সীমাও বিস্তৃত হয়।
উত্তর সীমাটি ছিল এখনকার শনবিলের উত্তরপাড় বরাবর পুবে পশ্চিমে। পুবে এখনকার
হাইলাকান্দি জেলা, পশ্চিমে পাথারিয়া পাহাড়, দক্ষিণে এখনকার মিজোরাম। বাড়ির চারপাশে
তিনি বিচারালয়, সেনানিবাস, কয়েদখানা ইত্যাদি তৈরি করিয়ে ফেলেন। একটি দুর্গও করে
ফেলেছিলেন। এখনো সেই ভাঙা জঙ্গলাকীর্ণ দুর্গটি আছে। লোকে ‘কেল্লাবাড়ি’ বলে চেনে। তিনি ঠিক করলেন --- স্বজাতীয় কিছু লোক এনে
বসাবেন। কিন্তু এই জলজঙ্গলে কে থাকতে আসে?
তবু একটি কাছাড়ি বাড়ি চালাবার মতো কুশলরাম সরকার নামে এক ব্যক্তিকে এনে প্রচুর জমি দিয়ে বসালেন। সেই বাড়িটি পরে
নবাবের অফিস এবং সরকারের বাড়ি বলেও ‘সরকার বাড়ি’ বলেই লোকে চিনতে শুরু করে। না
পেরে পরে বিভিন্ন জায়গা থেকে, দলিত হিন্দু মুসলমান মানুষকে নিয়ে এলেন কায়িক শ্রম
করবার জন্যে। বোঝাই যায় এদের কাজ ছিল জঙ্গল কেটে চাষাবাদ করা,কারিগরি করা , মাছ ধরা
ইত্যাদি। এদের মধ্যে বহু মুসলমান কিরানও ছিলেন। এদের কোনো মাইনে ছিল না। কেবল থাকো
–খাও- কাজ করো -- চুক্তি।
ক্ষমতা
এবং প্রতাপ যত বাড়ছিল রাধারামের দম্ভও পাল্লা দিয়ে বাড়ছিল। তিনি যে খুব
প্রজানুরাগী নবাব হচ্ছিলেন এমনও না। অচ্যুত চরণ তাঁর কিছু স্বেচ্ছাচার এবং নিষ্ঠুরতারও
বর্ণনা দিয়েছেন। এই যেমন, কেউ তাঁর বিরুদ্ধাচরণ করলেই তিনি কুকি সর্দারদের লাগিয়ে
তাঁকে হত্যা করে ফেলতেন। অচ্যুত চরণ লিখেছেন, ‘বন্য কুকি’। সেখানেই পক্ষপাত
স্পষ্ট। কুকি সহ দক্ষিণ অসমের তাবৎ জনজাতিদের তখন ব্রিটিশের এবং দশসনা ব্যবস্থা
এবং চুনাপাথর আর হাতি চালানের বিরুদ্ধে
বিদ্রোহ করবার সঙ্গত কারণ আছে—সেগুলো ‘বন্য’ লিখবার সময় লেখক বিবেচনাতে রাখেন নি। এমন
একটি গল্পও লিখেছেন, নবাব রাধারাম শিকার
করতে নৌকা নিয়ে শণবিলে বেড়াতে যেতেন। একবার নৌকার নিচ দিয়ে একটি বড় মাছ যাচ্ছিল। মাঝি
নবাবের অনুমতি না নিয়েই সেই মাছকে বর্শা দিয়ে মেরে ফেললে নবাব খুশি হন নি। মাঝিকে
মাছের মতো নৌকার নিচে যেতে বলেন। মাঝি গেলে তাকে মাছ মারবার মতোই বর্শা বিদ্ধ করে
মেরে ফেলেন। এমন আরো বহু কাহিনি রয়েছে নিশ্চয়। কিন্তু লিখেছেন অচ্যুত
চরণ। দোষ দায় দিয়ে লাভ নেই। রাধারামের কাহিনিও তিনিই প্রথম লিখে জানবার ব্যবস্থা
করে দেন। তাঁর দুই খণ্ডে ‘শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত’ ব্রিটিশ ভারতে যে কটি ইতিহাস কোনো
বাঙালি বা ভারতীয়ের হাতে রচনা শুরু হয় তারই অন্যতম। তবু, বিনা প্রশ্নে মেনে নেওয়ার
তো আজ কোনো মানে নেই। সিরাজদ্দৌলার যেমন মীরজাফর, নবাব রাধারামের
তেমনি এক সহচর ছিলেন কানুরাম দে। তাঁকে
‘চৌধুরী’ বলে অচ্যুত চরণ লিখলেও অধ্যাপক কামালুদ্দিন তথ্যসহকারে দেখিয়েছেন, জমিদার
হলেই চৌধুরী উপাধি মেলে। কানুরাম জমিদার ছিলেন না। হয়তো পরে পুরস্কার স্বরূপ
জমিদারি পেয়ে থাকবেন। বড়জোর রাধারামের নায়েব গোমস্তা জাতীয় কেউ ছিলেন। কানুরাম অচ্যুত
চরণের প্রপিতামহ বৈষ্ণব শান্তরামকে প্রতিবেশী জফরগড় পরগণার মৈনা গ্রামে এনে বসতি
করতে দেন। ফলে পক্ষপাত তো কিছু স্বাভাবিক। কানুরাম প্রথম জীবনে রাধারামের বন্ধুই
ছিলেন। প্রতিবেশী জফরগড়ের জমিদার ওলি মোহাম্মদ তাঁকে আপন সন্তানের মতো দেখতেন। ওলি
মোহম্মদের বদান্যতায় কোম্পানির প্রথম দশসনা বন্দোবস্তের সময় নিজেও একটি তালুকের
ব্যবস্থা করেন।
রাধারামের
উন্নতিতে বন্ধু কানুরামেরও বেশ যোগদান ছিল। কিন্তু কানুরাম তাঁকে প্রজাদের প্রতি
সদয় ব্যবহার করবার পরামর্শ যেমন দিতেন ব্রিটিশের সঙ্গেও সদ্ভাব রাখবার পরামর্শ
দিতেন। রাধারাম এগুলো কানেও তুলতেন না। গোলাম রাজার সঙ্গে রাধারামের বিবাদ ছিলই।
নইলে তিনি নবাবী বিস্তারে মন দেবেন কেন?
একরাতে রাধারাম বহু কুকিদের সঙ্গে নিয়ে গোলাম রাজার বাড়ি আক্রমণ করেন।
অনেকে মারা যান, ধন সম্পদও হাতছাড়া হয়। কানুরামের সাহায্যে গোলাম রাজা পালিয়ে প্রাণ
রক্ষা করেন। কিন্তু এ নিছক ডাকাতি ছিল না। রাধারাম বা কুকিরা যে আসলে ব্রিটিশের
শাসন মেনে নিতে চাইছিলেন না---তা বোঝা যায় এর পরেই এরা চরগোলা থানা আক্রমণ করেন।
সম্ভবত গোলাম রাজার পক্ষে কোম্পানির যোগদান ঠেকাতে। এই সব ঘটনা ঘটছে ১৭৮৬তে। এই করে তিনি নিজের বিপদও বাড়িয়ে দিলেন। থানা
আক্রমণকে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের প্রমাণ হিসেবে হাজির করে গোলাম রাজা সরকারের কাছে গিয়ে নালিশ করলেন। সিলেটের
রেসিডেন্ট এবং কালেক্টর লিণ্ডসে সাহেব রাধারামকে দমনের জন্যে শনবিল দিয়ে
গোলা-বারুদ, বন্দুক-কামান দিয়ে একদল সৈন্য পাঠান। এই লিণ্ডসে নিজে একজন চুনাপাথর
এবং হাতি চালানের কারবারীও ছিলেন। শনবিল হচ্ছে গোটা সিলেটের এক ভয়াবহ বিশাল বিল।
সাগর সমান ঢেউ তার জলে। প্রাণ থাকতে সহজে
লোকে এই বিলে নৌকা নামাত না। প্রবাদ ছিল, ‘শনবিলে নড়ে চড়ে, রাতায় পরান মারে’। সেই
বিলেই তুমুল যুদ্ধ হল। দুই পক্ষেই প্রচুর গুলিগোলাআর তিরধনুক চলল। কিন্তু নৌ
যুদ্ধে রাধারামের সেনা ততদিনে বেশ পাকা হয়ে উঠেছে। সেনা সমেত তিনি বেশ কিছু
কোম্পানি নৌকা ডুবিয়ে দিলেন। প্রথম
ধাক্কাতে হার মেনে কোম্পানি আরেক দফা সৈন্য পাঠায়। সেবারে যে যুদ্ধ হলো তাঁর বর্ণনা
অচ্যুত চরণ সেকালীন সাহিত্যিক গদ্যে বেশ রসিয়ে লিখেছেন, “ ভীষণ বাত্যায় শণবিল
রুদ্রমূর্ত্তী ধারণ করিল, ধবল ফেণরাশি বিকীর্ণ করিয়া, সাগরোর্ম্মির ন্যায় বিশাল
তরঙ্গমালা বিস্তার করিয়া, গভীর গর্জ্জনে সৈন্য-কোলাহল ডুবাইয়া দিয়া, সৈন্যপূর্ণ
নৌকাগুলি মুহূর্ত্ত মধ্যে কুক্ষিগত করিল! গবর্ণমেণ্ট দেখিলেন যে রাধারামকে দমন
করিতে একটু বিশেষ আয়োজন আবশ্যক; যেমন ভাবিতেছিলেন, ব্যাপার তদ্রূপ সহজ নহে।” প্রথম
শনবিল যুদ্ধে এভাবে রাধারামের জয় হলো।
যুদ্ধে
জয় হলে রাধারাম বন্ধু কানুরামকে বলেন, “ঘরের ইন্দুর বান্ধ কাটিতেছে।” একই বাক্যের
উল্লেখ কামালুদ্দীন আহমেদের ‘করিমগঞ্জের ইতিহাসে’ও আছে। কিন্তু কথাটি যে কোত্থেকে
নিলেন তার উল্লেখ নেই। সম্ভবত কোনো প্রচলিত পুস্তক থেকে। মোদ্দা কথা কানুরামের
বিশ্বাসঘাতকতাতে সংশয় হলো। রাধারাম ঠিক করলেন কানুরামকে শাস্তি দিতে হবে। অর্থাৎ
হত্যা করতে হবে। ইতিমধ্যে আরেকটি ঘটনা ঘটেছে। কিছু ‘ব্যভিচারী’ স্ত্রীপুরুষ
প্রজাকে জোড়ায় জোড়ায় বেঁধে গুলি করে মেরে শাস্তি দিচ্ছিলেন রাধারাম। শেষ
স্ত্রীলোকটি সহিজা বাদশার দোহাই দিয়েছিল। সেই দোহাই অস্বীকার করেই রাধারাম সেই
স্ত্রীলোককে হত্যা করেন। গল্পটি সত্যও হতে পারে, মিথ্যেও হতে পারে। মিথ্যে এর
জন্যে যে তাতে অহঙ্কার আর ক্ষমতার লোভে সহিজা বাদশার দোহাই অবজ্ঞার জন্যেই
রাধারামের পতন শুরু হয় এমন একটি গল্পের সহজ যুক্তি দাঁড় করানো যায়। ইতিহাসের গভীরে
যারা ঢোকেন না, তাঁদের কে বোঝাবে কে যে সেই সময় ব্রিটিশ কোম্পানিকে বেশিদিন
ঠেকাবার ক্ষমতা প্রতাপগড়ের এই ছোট্ট নবাবের এমনিতেই ছিল না। সহিজা বাদশার দোহাই
মানলেও। যাই হোক, পরে রাধারামের অনুতাপ হলো । মহিলাটিকে মারলেন বলে নয়, বাদশার
দোহাই অস্বীকার করলেন বলে। তিনি ঠিক করলেন ঘটা করে কালীপুজো করে পাপ স্খালন করবেন,
এবং সেখানে কানুরামকেই বলি দেবেন। কানুরাম এসবের কিছুই টের পান নি। তাঁকে ঘটা করে
নিমন্ত্রণ করলে তিনি দুই মুসলমান সর্দার এবং বিজয় নামে এক ক্রীতদাসকে সঙ্গে নিয়ে
নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে আসেন। বুদ্ধিমান
বিজয় ষড়যন্ত্রটি টের পায়। সে কানুরামকে আড়ালে নিয়ে গিয়ে সতর্ক করে দেয়। বিজয় বলবান
ছিল। কানুরামকে পিঠে এক কাপড়ে বেঁধে সে জঙ্গলের পথে অদৃশ্য হয়ে যায়। এসে
প্রতাপগড়ের জমিদারদের বাড়ি পৌঁছায়।
রাধারামের সেনা বহু সন্ধানেও তাঁকে আর পায় নি। এই কালীপুজোর গল্পটি অধ্যাপক
কামালুদ্দীন আহমেদ নিঃসংশয়ে স্বীকার করতে চান নি।
পরদিন
কানুরাম সব কথা সরকারের কানে তুললেন।
কানুরাম রাধারামের হাড়ির খবর জানতেন। তিনি সব পথ বাৎলে দিলে এবারে ব্রিটিশ
সেনার অভিযান সফল হলো। ব্রিটিশ সেনার বন্দুকের সামনে কুকি সেনার তির-বল্লম টিকল
না। রাধারাম পালালেন ছদ্মবেশে। তাঁর সেনাপতি অর্থাৎ ছেলে রণমঙ্গল আগেই মারা
গেছিলেন। অন্য তিন ছেলেরাও পালায়। সেনারাও ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে। বড় ছেলে জয়মঙ্গল কিছু
দিন পাখি শিকারির বেশে ঘুরে বেড়ালেও অচিরেই ধরা পড়েন। রাধারামকে কোম্পানি সেনা
সিদ্ধেশ্বর বারুণী মেলাতে ধরে। লোহার খাঁচাতে পুরে সিলেট পাঠায়। অধ্যাপক কামালুদ্দীন
আহমেদ লিখেছেন, পথেই রাধারাম আত্মহত্যা করেন। অর্থাৎ তাঁকে শাস্তি দেবার অধিকার
তিনি বিদেশী ব্রিটিশ সরকারকে দেন নি। এভাবেই
এক স্বাধীন চেতা নবাব পরাজয় বরণ করেও বিজয়ীর মতো শহীদের মৃত্যু বরণ করেন। সব
রাজার গল্পের শেষটা সুখের হয় না। নবাব রাধারামেরও হয় নি। সমস্যা এই যে, ইংরেজ
আমলের সুবিধেভোগী মধ্যবিত্তলোকে তাঁর এই শহিদী মৃত্যুকেও স্মরণে রাখে নি। চাইলেই
তিনি ব্রিটিশের অধীনতা স্বীকার করে নবাবীকে নিষ্কণ্টক করতে পারতেন। যেমন তাঁরই
ছেলে জয়মঙ্গল করেছিলেন।
নবাব
রাধারাম যে দলিত-জনজাতি প্রজাদের বসিয়েছিলেন, তাদের স্বপ্ন লোকগানে ভাষা পেয়েছিলে
এরকম, “কান্দেরে চরগোলার লোক
দেশদেশান্তর/ জয়মঙ্গল আসিবে যবে চরগোলা নগর/ ডোমচাড়ালে মিলাইয়া বানাইয়া দিমু
ঘর।” রাধারামের মৃত্যুর পরে জয়মঙ্গল
বহুদিন কোম্পানির কারাগারে কাটান। তখন প্রতাপগড়ের সেই জমিদার চৌধুরীরা রাধারামের
তাবৎ সম্পত্তি দখলে নিয়ে গেলে কারাগার থেকেই জয়মঙ্গল বার্তা পাঠান, ‘প্রতাপগড়ের
মাটি প্রতাপগড়েই থাকিবে’। তাতে
জমিদার গোলাম রাজা চৌধুরী ভয়ে জমি ছেড়ে দেন। সেকালের প্রায় সমস্ত পরাস্ত নবাব
রাজাদের উত্তরপুরুষের মতো জয়মঙ্গলও কালে কোম্পানির বশ্যতা স্বীকার করে নিয়ে নিজেকে
মুক্ত করেন, এবং ব্রিটিশের সেবক হিসেবে জমিদারি চালাতে শুরু করেন। প্রতাপগড়ের হাতি
চালানে তিনি সাহেবদের সহযোগী হয়েছিলেন। কুকিদের প্রতিও বাবার মতো তাঁর কোনো
বন্ধুত্ব ছিল না। বরং কুকি বিদ্রোহ দমনে তিনি ব্রিটিশের সহযোগিতাই করেছিলেন। যে
পরাজয় তাঁর বাবা স্বীকার করেন নি, তিনি তা করেছিলেন। এবং ব্রিটিশ শাসনকে পাকা করবার সঙ্গে সঙ্গে নিজের
জমিদারিকেও নিষ্কণ্টক করেছিলেন।