(ছবি আন্তর্জাল থেকে সংগৃহীত) |
২১দিন ভারত বন্ধ। মানে করোনার জন্যে লকডাউন। আরেকটু ঠিকঠাক করে লিখলে কোভিড ১৯ বা, নোভেল করোনার জন্যে। অনেকে আদর করে বাংলাতে বলছেন, তালাবন্ধ! শুনেই অনেকে প্রশ্ন তুলেন, খাবে
কী লোকে? বিশেষ করে যাদের দিন আনতে পান্তা ফুরোয়। দিনে রোজগার তো রাতে চুলো জ্বলে। লাখো
শ্রমজীবীদের আমরা দেখেছি, শতাধিক মাইল তল্পি তল্পা হাতে ও শিশু কোলে হেঁটে একাধিক
রাজ্য পার করে বাড়ি ফিরছেন। দেখেছি স্টেশনে আটকা পড়া হাজারো
মানুষ যখন ঠাসাঠাসি করে বাসের ছাদে চড়ছেন, পেটোয়া সংবাদ মাধ্যম চেঁচিয়েছে, দেখুন প্রধান মন্ত্রী সতর্ক করে দিয়েছেন, তবু
লোকের ভাবনা চেতনাতে ঢুকছে না! তারা
নির্দেশ অমান্য করেছেন। ভক্তরা বলে গেছেন, পুলিশের লাঠিই একমাত্র ঔষধ। লাঠিতে এমন বহু মানুষও দেশে আহত হয়েছেন, যাদের
কিন্তু অনুমতি ছিল বেরিয়ে যাবার। কেউ
কেউ নিহত হবার কথাও শুনেছি। এই
সব নিয়ে আপনি প্রশ্ন করছেন কি, ভক্তরা লাগাতার বলে
যাচ্ছেন, এখনো রাজনীতি!! ডোনাল্ড ট্রাম্পও তাঁর দেশে বলছেন, এখন
সময় নয় রাজনীতি করবার। যার বিরুদ্ধে অভিযোগ
তিনি শুরুতে করোনার কোনো বিপদকে গুরুত্বই দেন নি।
দেশে আক্রান্ত লোক রেখে তিনি ভারত ভ্রমণে এসেছিলেন, ‘নমস্তে ট্রাম্প’
করে নির্বাচনী প্রচার করতে। গুজরাটি ব্যবসায়ী এবং ভোটারের এখন
মার্কিন মুলুকে ব্যাপক দাম। তিনি যদিও
করোনা নিয়ে আসেন নি, থাকতে থাকতেও দিল্লিতে হত্যালীলা শুরু হয়েছিল, সম্প্রদায় ধরে। দেশের লোকেই দেশের লোক মারছিল। এখন
সেই ট্রাম্পের দেশ আক্রান্তের সংখ্যাতে গোটা বিশ্বকে ছাড়িয়ে
গেছে। যেতেই তিনি চিনা
রাষ্ট্রনায়ককে ফোন করেছেন, যাদের
গালি পেড়ে দিন কতক আগে জীবাণুর নাম দিয়েছিলেন, চিনা জীবাণু। চিনও বিপরীতে
বলেছিল, মার্কিন সেনারাই জীবাণু চিনে ছেড়ে গেছে গেল বছরে। এখন, চিনও
জানিয়েছে তামাম চিকিৎসা সামগ্রী ও সেবা নিয়ে সে এখন মার্কিনিদের পাশে দাঁড়াবে।
তা, ভক্তরা লাঠি রাজনীতি
করছেন, বাকিদের রাজনীতি করতে মানা করছেন। কপাল ভালো যে তারা করোনাতঙ্কে নিজেরা বাড়ির বাইরে বেরোতে পারছেন না। নইলে নিজেরাই
লাঠি চালিয়ে বহুকে হাসপাতালে পাঠাতেন। গণপিটুনিতে
এদের বিশ্বজোড়া খ্যাতি আছে।
যেন বা যারাই
প্রভুর নির্দেশ অমান্য করবেন, তারা সবাই "দেশদ্রোহী', এবং
তাদের উচিত পাকিস্তানে চলে যাওয়া। অন্তত , করোনার
আগে এরা হুমকি এভাবেই দিতেন।
প্রশ্ন উঠছিল, বিপন্ন
মানুষের জন্যে সরকারি ত্রাণ কই?
অনেকেই প্রস্তাব দিচ্ছেন, এই
করুন, সেই করুন। প্রাক্তন অর্থমন্ত্রীও দশদফা প্রস্তাব দিয়েছিলেন ২৫শে মার্চ। ২৬শে মার্চ সরকার কিছু ব্যবস্থা ঘোষণা
করতে, কোথাও
কোথাও দেখলাম, ভক্তির
আনন্দে ঘোষণা: এই তো দিলেন ত্রাণ। রাজনীতি যারা করছিলেন, তাদের
এবারে মুখ বন্ধ হবে। আরে বাবা, এতো বড় দেশ, এতো
বড় কাজ কিছু তো সবুর করতে হয়।
আমরাও বলি, লাঠি যে
চালাতে বলছেন, কিছু তো সবুর করতে হয়। নেতারা বললেন, আর
লোকে সব জেনে বুঝে মেনে নেবে--- এমনটা ১শ ৩০ কোটি মানুষের দেশে
কি খানিক অতি আশা নয়? আমিও গেল পরশু, আমার
পাড়াতে প্রচুর বাইক ঘুরা ঘুরি করতে দেখে, প্রথমে ভেবে না পেয়ে কিছু --
ফেসবুকে দিলাম। এক বন্ধু পরামর্শ দিলেন, পুলিশকে
জানান। তিনি নিজেও জানালেন। আমাকেও বললেন, টুইট
করতে। তিনিও করলেন। এই সব করতে না করতেই দেখি, আমাদের
পাড়াতে সাইরেন সহ ভ্রাম্যমাণ পুলিশ এলো। এই সংবাদ অন্যদেরও জানিয়ে
বললাম, আপনারাও তাই করুন। পরে বিকেল হতে না হতে শুনি বহু জায়গাতে নির্মম লাঠি চলেছে। আমাদের পাড়াতে অবশ্য সেরকম দেখিনি। শুনেছি, বহু
জায়গাতে পুলিশ মোদীর দোকানও খুলতে দেয় নি। দুধের
গোয়ালাকেও ধরে পিটিয়েছে। তারমানে, পুলিশের কাছেও স্পষ্ট
নয় কী করতে হবে, আর কী নয়। লাঠি চালাতে বললে পুলিশ ভাঙা ঘাড়ের রোগীর ঘাড়েও চালিয়ে দিতে পারে। বিশ্বাস নেই।
এরকম হয়।
কারণ, ‘কথা’
একটি বক্তার মুখ থেকে বেরোলে খুব কম সময়ে, খুবই কম মানুষের কাছে তার যথার্থ অর্থ নিয়ে পৌঁছয়। পথ হাঁটতে হাঁটতে সেই ‘কথা’ করোনা জীবাণুর
মতোই ছড়ায়, দরকারে রূপও পাল্টায়। আর ক্ষমতার কেন্দ্র থেকে বেরুলে তো কোনো কথাই নেই।
তাই ২২শে মার্চ যখন দেশের প্রধান বলেছিলেন, বিকেলে
ব্যালকনি বা বারান্দার থেকে চিকিৎসকদের ধন্যবাদ
জানিয়ে তালি বাজান, ঘণ্টা বাজান। আমরা দেখেছি, হাজারো
লোক গোটা দেশে পথে বেরিয়ে গেছিলেন ,
দেশ থেকে করোনা তাড়াবার এমন অভূতপূর্ব পথ বের করবার জন্যে দেশনেতাকে অভিনন্দন জানাতে।
কার্ফু দিনের শেষে পরিণত হলো কীর্তনে। এর পরেও
অনেকে নিজের বাড়ির ভাড়াটে চিকিৎসক,
নার্সদের বলে দিয়েছিলেন -- বাড়ি
ছাড়তে। সেরকম 'দেশপ্রেমে'র
কাহিনিও বিশ্বের সংবাদ মাধ্যমে করে ছড়িয়েছে। এই সব কীর্তনীয়ারাই এমন বিপদ বাড়ালেন যে, একের
পরে এক প্রদেশ লকডাউন ঘোষণা দিল,
মাঝ পথে থেমে যাওয়া রেল থামিয়ে গোটা দেশ রেল একেবারেই থামিয়ে দেওয়া হলো। এরা কীভাবে বাড়ি ফিরবেন, কী
বিপদে পড়ে ফিরবেন, কী বিপদ নিয়ে
ফিরবেন--এই সব অস্থিরতা আর আশঙ্কার মাঝেই গোটা দেশে ২১
দিনের জন্যে লকডাউন ঘোষণা হলো।
এর পরে আর কোনো বিকল্প ছিল না। আমাদের সেই নিয়ে প্রশ্ন নেই।
অনেকে এও বলছেন, কীর্তনটা না করে, লকডাউন
আরো আগেই করা দরকার ছিল। কিন্তু এর পরে থেকে যে ভক্তকুলের
লাঠি-তত্ত্ব ছড়াচ্ছে, সেটি করোনার চাইতে কম বিপজ্জনক নয়। এই তত্ত্বের মূল কথা হলো, আপনি ঘরে থাকুন, ঘরে
থাকতে বলুন। এর বাইরে মুখ
বন্ধ রাখুন। নইলে করোনা ছড়াবে। তা কেউ
কেউ রসিকতা করে বলছেন, সবই করুন, চিকিৎসকেরা যা বলছেন।
কেবল ভক্তবাণীতে কান দেবেন না।
তা ভক্তরা কি কেবল, রবিবারের
পবিত্র কীর্তনেই কাজ শেষ করেছেন?
এখন কি সবাই বাড়ি
বাড়ি বন্দি আছেন? আমাদের অভিজ্ঞতা বলে, তাদের
সিংহভাগ মনে করেন, ভগবতী বাসন্তী সবই ঠিক করে দেবেন। মনে রাখবেন,
এখন নবরাত্রি চলছে। আর বাঙালিরাও এই সময়ে বাসন্তী পুজো করেন, আর
করবেন। বাকি যেটুকু অবশিষ্ট থাকবে, সবই
ঠিক করে দেবেন, প্রধান সেবক, যার
কিছু দৈব ক্ষমতা আছে।
খামোখা ভাববেন না যে আমরা মিথ্যে গল্প
শুনাচ্ছি।
আমাদের আবাসিক প্রকল্পে এক বিহারি
জ্যোতিষ আছেন। বিশাল কারবার। হাজারো বই হিন্দিতে ছেপে দেশে বিনা পয়সাতে বা পয়সা
নিয়ে বিলি বণ্টন করেন। দেশ প্রদেশ থেকে লোকের যাতায়াত লেগেই থাকে। আমাদের লিফটটি এদের অতিথিতেই ব্যস্ত থাকে। মূল
চেম্বার বাইরেই। কিন্তু বাড়িতেও যাতায়াত লেগে থাকে আরকি।
আর পুজো পার্বণ তো বলে কথাই নেই। এই কদিন নবরাত্রির
উৎসব চলছে। তো, গত পরশু কথায় কথায় বললেন, করোনা
নিয়ে যেভাবে গোটা দেশ লকডাউন করে দিলেন মোদিজী, তার
জন্যে সাহস দরকার। মানতেই হবে, তাঁর মধ্যে দৈবী শক্তি আছে। গোটা বিশ্বে
এমন কেউ সাহস করবে না।
এখন, তিনি কখন বলছেন এই সব
কথা? আসলে বিকেলে আমরা সোসাইটির লোকজনে তাঁকে ডেকে পাঠিয়েছিলাম,
নিচে। তাঁর এক ভাই বিহার থেকে এবং নিজের
মেয়ে দিল্লি থেকে এসেছেন। এদের বাড়িতে বসিয়ে রেখে
দিয়েছিলেন। আমরা কেউ জানতাম না। কেউ কেউ বলছিলাম, এমন
কেউ এলে কেউ গোপন করবেন না। ভয় পাবেন না, আমরা আপনাদের সঙ্গে আছি। কেবল ব্যবস্থা নেবেন। কিন্তু তিনি সবাইকে ঘরে রেখেছেন। দল
বেঁধে নবরাত্রীর কীর্তনও করছেন। কাল পুলিশ
এসেছিল। পরে স্বাস্থ্য কর্মীও কেউ। বাইরের দেয়ালে নোটিশও সেঁটে গেছে। এসে বলে
গেছে মেয়ে আর ভাইকে কাল পাঠাবেন পরীক্ষার জন্যে। আর বাইরে বেরুবেন না বাড়ির কেউ। কিন্তু এদের উৎসবে পাশের ফ্ল্যাট থেকেও লোকজন
আসছিলেন। আমরা চেপে ধরাতে , জানালেন ---তারা
স্বাস্থ্য বিধি মেনে চলছেন। আর এক ভাই মাত্র বাইরে থেকে যাতায়াত করবেন। কেউ লিফট ব্যবহার করবেন না। তখনি এই
বাণী ঝাড়ছিলেন, মোদীর নিশ্চয় কোনো
দৈবী শক্তি আছে। তাঁকে বললাম, খানিক দুনিয়ার খবর
নেবেন। মোদী বরং কিছু দেরিই করেছেন,
তাঁর বন্ধু ট্রাম্পের মতো। এবং এখন যখন করলেন, তখন মাঝপথে আটকে থাকা লাখো বিপন্ন
মানুষকে ভগবান ভরসা ছেড়ে
দিয়েছেন। এখনো ঘোষণা দেন নি, শ্রমজীবীরা
কী করে খাবে? সবার ব্যাঙ্ক একাউন্ট নেই, কাজের কোনো প্রমাণ পত্র নেই। ইত্যাদি।
তিনি সম্ভবত এই বিপদের দিনে আমার এই সব ‘রাজনৈতিক' কথাতে
কিছু ক্ষুণ্ণই হলেন। আফটার অল̖ নবরাত্রীর দিনে, আমি
তাঁর অবতার পুরুষের নিন্দে করে ফেললাম। রক্ষা যে তিনি ভাড়া থাকেন। তো, কাল সকালে শুনি তাঁর ভাই লিফটে উঠানামা
করেছেন দেখে আবাসিক সোসাইটি দেখাশুনা করেন এমন এক কর্তা
ব্যক্তি তাকে কিছু অশোভন কথাই শুনিয়ে দিয়েছেন । মানে আমাদের
মতো গোপাল টোপাল বলেন নি, আর কি। কী সব ... বাচ্চা টাচ্চা বলে দিয়েছেন। মানে সম্ভবত বরাহপাল ইত্যাদি, আপনার
অশোভন প্রতিশব্দ ভেবে নিন।
জেনে আমি বললাম, এতোটা
নিষ্ঠুর হবেন না। কেবল কেয়ার টেকারকে বলে দিন, এরা যাতে লিফট ব্যবহার করতে না পারে। তখনই জানলাম, তিনি
, মানে যিনি বরাহপালকে গালি দিয়েছেন, নিচে
জল আর স্যানিটাইজারের
ব্যবস্থা রেখেছেন। কেন? প্রশ্ন করে জানলাম, ভক্তের
তো আমাদের আবাসিক প্রকল্পে অভাব নেই, যারা স্বপ্ন দেখেন ভগবান মোদী সব ঠিক করে দেবেন। নিজেরা যা খুশি করুন। তারা কাজের
মহিলাদের মানা করেন নি। মহিলারা আসছেন। যাচ্ছেন।
তাদের জন্যে এই ব্যবস্থা। ব্যস,
আছে এক
হোয়াটস এপ গ্রুপ। আমি প্রশ্ন করলাম,
দুনিয়ার শ্রমজীবীদের বলা হয়েছে ঘরে থাকতে। লোকে না খেয়ে মারা যাবার জোগাড়। আর আপনারা এদের সবেতন
ছুটি দিতে পারেন না? এতোই স্বার্থপর
আপনারা? আমি জানি যে কাজ না করলে অনেকে মাইনে কাটেন। মাড়োয়ারি,বাঙালি, বিহারি নির্বিশেষে।
কেউ কম যান না। সব্বাই কিন্তু ভক্ত। এরা ঠাকুরের প্রশংসাও
এতো করেন না, যত প্রধান সেবকের করেন আর কি। তাই প্রশ্ন করলাম,
আপনারা কি এতোই দরিদ্র যে কিছুদিন কাজ
না করলেও কাজের মহিলাকে মাইনে দিতে পারবেন না? মাইনে
কাটা যাবার ভয় থাকলে কাজের লোকগুলোও আসবে। আমার কথাতে কাজ হয়েছে। মেন গেটে তালা পড়েছে। পরদিন
থেকে কোনো কাজের লোক আসবে না, দুধ সবজি নিয়ে এলে
বাড়ির গেটের বাইরে দাঁড়াবে। লোকে গিয়ে সেখান থেকে
সংগ্রহ করবে। এখন আশাতে আছি, আমার নিন্দে মন্দ হবে বেশ। স্যর বেশি রাজনীতি করেন বলে। বলা যায় না, মিথ্যে কোনো মামলাও
হয়ে যেতে পারে। ইতিমধ্যে
সেরকম এক মামলাতে আমি সভাপতি পদ ছেড়ে
বসে আছি। এখন বলতে গেলে আমাদের কোনো নিয়মমাফিক সোসাইটিও
নেই। দুজনে এমনি কিছু কাজ চালান আর কি। মামলা আমার পক্ষে
গেলেও, ভেতরে এখনো কিছু ‘ভক্তে’র
সঙ্গে বোঝাপড়া বাকি।
(২)
এবারে তবে
খানিক আমাদের আবাসিক প্রকল্পের কথা ছেড়ে শহরে এগোই। আজ বাজার করতে গেছিলাম। পরশুও গেছিলাম। ফিরে এসে গায়ের পোশাক, বাজারের
ব্যাগ , খাবার
দাবার সব জলে ধুয়ে দিয়েছিলাম। স্নানও
করে নিয়েছিলাম। আজ কী করলাম, কী দেখলাম
সেই গল্পটি বলি।
আজ পার্স নিইনি। সামান্য কিছু জিনিসের জন্যে যা কিছু টাকা লাগবে সার্টের
প্যাকেটে নিলাম। মোবাইল ঘরে ছেড়ে, বাজারের
ব্যাগ হাতে বেরিয়ে গেলাম।
বেরুতেই দেখি প্রতিবেশীর
ঘর থেকে একটি তরুণী আর এক বয়স্কা বেরুচ্ছেন। হাতে পুজোর থালা। দুজনের কেউ এখানে থাকেন না। আত্মীয়া। তার মানে,
নবরাত্রিতে যাতায়াত চলছে।
বিদ্যুৎ ছিল না। তাই লিফট বন্ধ। হেঁটে ছ'তলা
নিচে নামলাম। নামতে নামতে দেখি,
সেই পণ্ডিতজীর মেয়ে এবং দুই আত্মীয়
নামছেন। দুই আত্মীয় এখানে থাকেন না। তার মানে, যাতায়াত চলছে। দেখভাল করবার যে
কর্মচারিটি আছে, তাকে জিজ্ঞেস করে জানলাম, তাদের
হাসপাতালে ডাক পড়েছে। পরীক্ষা করাতে হবে। বেশ। তা এক প্রতিবেশীর
সঙ্গে দেখা হলো। এই যাতায়াত নিয়ে কথা হলো। হতাশা ব্যক্ত করে বললেন, কী
করবেন? নিজেরা গা বাঁচিয়ে থাকলেই হলো। তা আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, বাজারে
যাচ্ছেন, মাস্ক পরেন নি কেন? বললাম, দরকার
নেই তো! খামোখা আমরা পরে
চিকিৎসকদের জন্যে অভাব ডেকে আনছি কেন? আমার
সর্দি কাশি নেই। সাইনুসাইটিস আছে। আজ কোনো সমস্যা
নেই। থাকলে পরতাম। তা ছাড়া আমি মাস্ক পরে যারা ভিড়ে ঠাসাঠাসি
করে, তাদের গা তো ঘেঁষবই না।
তা আমার একটি সাইকেল
আছে। আমি চালাই, ধারে কাছে গেলে।
আর চালায় ওই দেখাশোনা করবার ছেলেটি, যাকে
কেয়ার টেকার বলে।
সাইকেলটা
নিয়ে, ওকে বললাম, দেখ আমি কী করি। তুইও করবি। বাইরে জল
সাবান রাখা ছিল। নিয়ে হাতল,বেলে
সাবান মেখে ওকে বললাম, জল ঢাল। ধুয়ে বেরিয়ে গেলাম। দেখি এখানে ওখানে ভুষিমালের দোকান খোলা আছে। সুযোগে
অন্য মণিহারি দোকানও আধা কপাট খুলে রেখেছে দুই চারটা।
প্রচুর বাইক, স্কুটি ঘুরছে। কোথাও বা মাস্ক পরে দুজন সওয়ারি। অনেককে দেখে মনেও হলো না, এরা
বাজার করতে বেরিয়েছেন। চালাচ্ছেন পুরুষ, পেছনে
মহিলা বসে।
আমাদের বাড়ির কাছে তামোলবাড়িতে ছোট্ট
একটি বাজার বসে। সেখানে কিচ্ছুটি নেই। তখন অবশ্য সকাল
সাড়ে নটা। নটার থেকেও তো খুলতে দিয়েছিল। দুই একজন জানালেন
ভোর থেকে লোকে নিয়ে যাচ্ছিল। এক-দুজন বসেছিল, মাছ নিয়ে। চলে গেছে। গেলাম মিনিট দশেক সাইকেল চালিয়ে আমাদের কলেজের কাছে। সেখানে
ঢেলাঘাট থেকে বিচিত্র মাছ আসে, এতো
বিচিত্র তো শহরের বড় বাজারেও বসে না। সেখানেও কিচ্ছুটি
নেই। ফলে এলাম, ঘুরে বড় বাজারে। তিনসুকিয়াতে সেটি ডেইলি
বাজার বলে পরিচিত। মূল প্রবেশ পথে পুলিশ ঢুকতে দিল
না। বলল, পাশের পথ দিয়ে যান। তার মানে,
ফিরে থানা চারআলি থেকে ডানে মোড়তে হবে। সেখান থেকে
বেশকটি প্রবেশ পথ আছে। তারই একটি দিয়ে ঢুকে মাছবাজারে
ঢুকতে যাব --
এক সশস্ত্র সেনা পথ আটকালেন। বললেন, দু'মিনিট
দাঁড়িয়ে যান, ভেতরে লোক গা ঠেসাঠেসি করছে। তাঁর
সামনেই একটি জটলা। আমি খানিক পিছিয়ে গেলাম।
একটি পরে দুজনকে যেতে দিলেন। চলে গেল জনা দশেক। তিনি
কিন্তু লাঠি চালালেন না। তার মানে সব্বাই সর্বত্র লাঠি চালাচ্ছে -- এরকম নয়। ভেতরে গিয়ে
তেমন ভিড় দেখলাম না। কিন্তু দুই একটি দোকানে তিন
চারজনে ঠাসাঠাসি করছেন নজরে এলো।
শুকনো
মাছ, তথা শুটকি দোকানে গেলাম। জাতে সিলেটি বলে আমাদের একটি জাতের টান আছে। জোরে বললাম, আপনার ভাইর দোকান তো
ইতিমধ্যে বন্ধ, আপনারটাও বন্ধ কবরার
ইচ্ছা নি? আপনে কেনে সবরে কইন না, সরিয়া
দাঁড়াইতা? ওর দাদার দোকান ছিল
উলটো দিকে। বছরখানিক আগে রোগে ভুগে মারা গেছেন। বলেন কিনা, শুনইন
না মাইনসে। কিতা করন? বললাম, আপনে
দিবা না জিনিস। তেইত্তো অইল। কাজ হলো । ছিলেন
দুই চারজন । নীরবে সরে দাঁড়ালেন।
মাছ নিতে
এলাম। কমই ছিল। সবই বড় মাছ। এক ব্যাটা থামিয়ে একটা ল্যাজ দেখিয়ে বলল, বোয়াল
আছে। নিয়ে যান। দেখে মনে হলো , মিথ্যে বলছে। ক'ড
মাছ দেখিয়ে বলছে , বোয়াল। চলে যাচ্ছিলাম, একটা
বোয়ালের মাথা দেখাল। ভাবলাম হতেও পারে, আমি মাছ চিনি কম। ল্যাজটা কাটিয়ে তুলে নিলাম। বেরিয়ে আসতে আসতে দেখি, সেই
সেনার পায়ের কাছেই টুকরিতে ধনে পাতা লঙ্কা
নিয়ে বসেছে এক মহিলা। তার সামনে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে দুই
মহিলা। সেনাকে বললাম, আপনার সামনেই দেখি লোকের ভিড়। বললেন, কী আর করবেন। কত বলে বোঝাবেন, যদি
নিজে থেকে কেউ না বোঝেন? বুঝলাম, সেনাটি বেশ ভদ্রলোক।
আদা রশুন কেনার
ছিল। বাজারে দেখা মিলল না। ভেতরে গেলে হয়তো মিলত। ইচ্ছে হলো না। বেরিয়ে এলাম। আসতে আসতে দেখেছিলাম, রাজপথে
জি এন বি রোডে অনেকেই শাক সবজি ফল নিয়ে এখানে ওখানে
ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে আছেন। কিন্তু সর্বত্র মানুষের হালকা হলেও
জটলা। একা দোকানির সন্ধানে বেশ কিছু দূর সাইকেল চালিয়ে এগুলাম। শেষে হতাশ হয়ে এক ঠেলার সামনে দাঁড়িয়ে দূর থেকে বললাম , রসুন
দিতে। বেচারা তখন জটলা সামাল দিতে ব্যস্ত। সব্বাই নিজের
হাতে আলু প্যাঁজ নিচ্ছে। দুই একজন মুখোষ পরা সাহেব
সুবো রয়েছেন।
কিন্তু মুখখানা পাশের লোকটির মুখের কাছে ঝুঁকিয়ে দিয়েছেন। বেশ
কিছুক্ষণ দোকানি আমাকে পাত্তাই দিল না। ফলে, গলা উঁচিয়ে বললাম,
আমি আপনার কাছে যাচ্ছি না। দেবেন তো
বলুন, নইলে যাই।
হুশ ফিরল।
পাওয়া গেল। আজ ঠিক করেই গেছিলাম,
যেখানেই ভিড় দেখব, গলা
চড়াব। কারণ পরশু এক মাংস দোকানির কাছে গেছিলাম। এই
বস্তুটি আমাদের ঘরে আসে কম। কিন্তু শুনছিলাম, লোকে
খামোখা মাংস খাওয়া বন্ধ করাতে অনেকেই লোকসান দিচ্ছেন। ফলে গেছিলাম, এক
একা দোকানি দেখে। সেও সিলেটি। কেটে দিচ্ছিলই, হঠাৎ তিন বীরপুরুষ এসে নামল একই মটর সাইকেলে চড়ে। একজনের মুখে সুশোভিত মুখোশ। লাফ দিয়ে নেমে একাবারে আমার ঘাড়ে এসে পড়ে আর কি। দ্রুত নিজেই পিছিয়ে গেলাম। বলছে, কতরে? দোকানি বলল, একশ
বিশ। সিলেটিতে বাবু বললেন, দে দেখি! আইজ দুইশ বিশ অইলেও সমস্যা নাই। আবার কবে পাইমু। বুঝলাম, এও
আমারই মতো জাতের টান দেখাচ্ছে। এই প্রবাসে এক সিলেটি
আরেক সিলেটি পেলে এমনিই দিল দরিয়া হয়ে যায়, আর
অন্য জাতধর্ম দেখে না। কিন্তু বাবুরা মনে হয় নতুন চাকরিতে ঢুকেছেন। প্রবাসে মেছ করে থাকেন। তাই সব্বাই এক মটরসাইকেলে চড়ে এসেছেন, বাজার
করতে। এদের বাবুগিরি দেখে, আমার
সিলেটিগিরি উবে গেছিল। নিজে দূরে সরে গিয়ে গা বাঁচিয়েছিলাম।
কিন্তু মন বাঁচাতে পারিনি। একটি অস্বস্তি কাজ করছিল। মনে হচ্ছিল, কিছু
লোক যদি ভুল করেই তবে , না বললে তো ভুল করতেই থাকবে। তাই আজ আর নীরব থাকিনি কোথাও।
কিন্তু আজ দুই চারটি দোকানে দেখেছি, দোকানি একফুট দূরে দূরে সাদা বৃত্ত এঁকে দিয়েছেন,থানা চার আলি দিয়ে ফেরার পথে চোখে পড়ল, থানার সামনে দিয়ে লম্বা লাইন। সবাই একফুট দূরে দূরে দাঁড়িয়ে আছেন। সবাই সবজি বাজারে ঢুকবেন। তার মানে,ধীরে ধীরে কিছু ব্যবস্থা ঠিকও হচ্ছে। সবার জন্যে সর্বত্র লাঠি ব্যবহারও হচ্ছে না, বহু সময় লাঠি দেখালেও কাজ হয়। বহু সময় দেখাদেখিও ব্যবস্থাপনা হয়। কেবল সরকারের জন্যেই ‘সবুর' করতে হয় না। দেশের মানুষের জন্যেও "সবুর' করতে হয়। সরকারকে প্রশ্ন করলে যদি রাজনীতি করা হয়, তবে মানুষকে লাঠি পিটিয়ে মানুষ করতে বললে, তার থেকেও আরো বড় এবং ভয়ানক রাজনীতি করা হয়।
যারা
প্রশ্ন করছেন, তারাই তো
অব্যবস্থা নজরে আনছেন। ফিরে এসে টিভি খুলে দেখলাম, দেশের বহু জায়গাতে আটকে পড়া প্রব্রজিত শ্রমিকদের দুর্দশা আজ চারদিন পরে কেন্দ্র
সরকারের নজরে পড়েছে। দিল্লি সরকারের নজরে যদিও শুরু
থেকেই বিষয়টি ছিলই। দিনে চারলাখ বিপন্ন লোককে তাঁরা
বিনে পয়সাতে খাওয়ানো পরানোর ব্যবস্থা করছেন। কেন্দ্র সরকার
এখন বাকি সরকারগুলোকে নির্দেশ দিয়েছেন, কে কতটা গুরুত্ব দিয়ে
নিলেন, দেখতে এখনো সময়ের দরকার হবে। "সবুর' তো
করতেই হবে। অব্যবস্থা দেখলে, লাঠিই যদি
একমাত্র ঔষধ কেউ এই বিপন্নতার দিনে মনে করেন, আমরা চড়া গলাতে বলব, প্রশ্ন
তুলা এর থেকে বহু বেশি স্বাস্থ্যকর এবং গণতান্ত্রিক ঔষধ।
অনেকেই
স্বাস্থ্যবিধি মানবেন না। গোটা পথে বহুকে দেখছিলাম, গাড়ি নিয়ে বেরিয়েছেন। যেন সুখভ্রমণ করছেন। সরকারি বিধি তো বলছে, পায়ে
হেঁটে বেরোতে। কিন্তু আমি নিজেও যতটা পথ পাড়ি দিয়েছি, পায়ে
হেঁটে সম্ভব ছিল না। বহুর
বাড়িতে বিলাসিতার অংশ হিসেবেই হয়তো
সাইকেল একটা রাখবার দরকারও মনে করেন নি। আর রাখলেই হয় না।
নিয়মিত না চালালে সাইকেল একটি বড় হ্যাপা। আমারটি আবাসনের কেয়ার টেকার ছেলেটি
চালায় বলে, যত্নে আছে। তো,
এই সব হবে। শহর বা গ্রামে যারা বাড়ি ঘরে আছেন তাদের অধিকাংশ মানুষ নির্দেশিকা মেনে চলছেন,পারছেন বলেই---তাঁরাই
সম্পদ সুরক্ষিত রাখবেন। যারা মানছেন না, হয়তো
পারছেন না বলেও,তাদের সংখ্যা শহরে খুবই কম। এরা কিছু
বিপদ বাড়ালেও বাড়াতে পারেন। কিছু করবার নেই। কিন্তু শহুরের নজরের বাইরে আছেন লাখো মানুষ যারা বাইরে থেকে প্রব্রজিত শ্রমিক। চল্লিশ
থেকে পঞ্চাশ কোটি দেশে এদের সংখ্যা। এর আধা দূরের ভিন প্রদেশে বাস করেন। এরা হাজারে হাজারে পথ হাঁটছেন। এমন পথ সম্ভবত
দেশভাগের দিনেও লোকে হেঁটে অতিক্রম করেনি। ইন্ডিয়া টুডে একটি প্রতিবেদন করেছে। শিরোনাম দিয়েছে, “India under lockdown: The great migrant
story.” এরা তো বিপদে আছেনই। বাড়ালেই কি আর কমালেই কী? ব্যবস্থাপকেরা তো শুরুতে এদের কথা কল্পনাতেই আনেন নি। এদের উপরে যদি কেউ লাঠির ওষুধ চালাতে বলেন, বলতেই পারেন। প্রথম দুই একদিন কিছু সংবাদ মাধ্যম সেরকম পরামর্শ দিচ্ছিলেন। কিন্তু মনে রাখা ভালো, ভারত দেশটা এরাই নির্মাণ করেন। এরা যদি হাতে লাঠি নেন, এবং সেই লাঠিতে পতাকা জুড়েন তবে এক নয়া ভারত সৃষ্টিও করে ফেলতে পারেন। যা সুখবিলাসী ভক্তরা কল্পনাও করতে পারবেন না। বিপদ
কেবল দেশের লোকেই বাড়ায় না। যিনি "চিনাভাইরাস' আবিষ্কার
করেছেন, সেই ডোনাল্ড ট্রাম্প, যার কথা শুনে বহু ভারতীয় ভক্তও বলছিলেন, আমেরিকা
কেন চিন আক্রমণ করে না---তাদের হতাশ করে ট্রাম্প এখন
কী করে চিনের কাছে সাহায্যের আবেদন পৌঁছে দিলেন, আমরা আগেই লিখেছি।
আমি আতঙ্কে আছি, আমাদের
আবাসিক প্রকল্পে যে মেয়েটি প্রশাসনের নজরে আছে, না হোক, তবু সেই মেয়েটি যদি অসুস্থ হয় তবে আমাদের কিছু প্রতিবেশি কী
ব্যবহার করবেন! এই দেশে সকলি সম্ভব। ঈশ্বর আর
রাষ্ট্রনায়কের নাম নিতে নিতে ভক্তিভরে প্রতিবেশি প্রতিবেশিকে
বলতে পারেন, আপনি বাড়ি ছাড়ুন। সরে পড়ুন। অসম্ভব কিছু
না। সেসব লড়াই তো এখনো বাকিই আছে। পরিজন পরিজনকে কীভাবে লোকে ছেড়ে পালায় মহামারিতে, শরৎচন্দ্রের শ্রীকান্ত যারা পড়েছেন---তারা জানেন ভালো।
ফিরে এসে সাইকেল রেখে, আবাসনের
দেখাশুনার ছেলেটিকে বললাম, তুই যদি সাইকেল নিয়ে বেরোস, তবে
আমার মতো হাতল ধুয়ে নিয়ে বেরুবি রে। অকারণে এক্কেবারেই বেরুবি না।
ঘরে এসে আজ শুকনো মাছ রেখে দিলাম রোদে, বাকি
সব ধুতে হলো। বাজারের ব্যাগটিও। মাছ দেখেই তো স্ত্রীর মুখ পুরো কালো। বেরুবার আগে কিছু আলো ছড়িয়ে গেছিলাম। সেই বাতি পুরো নিভে গেছে। এ তো তুমি ক’ড মাছ নিয়ে এসেছো, বোয়াল কই! যাও নিয়ে। ওকে বলো, ঠকালো কেন! দেয় না দেয়, বলে তো এসো। চিনবে কি দোকানিকে? একবার যাবার জন্যে তৈরিও হচ্ছিলাম। পরে মনে হলো, লোকটির কাছে তো মাছ ছিলও না, বদলে কী দেবে? টাকা আদায় করতে যে কাজিয়াটা করতে হবে, সেই ইচ্ছেটা হলো না। ধুতে গিয়ে দেখি, সত্যি হাতটা তেলতেলে হয়ে গেছে।
আজ আর জামা ধুই নি।
বাইরেই একটি সুতোতে ঝুলিয়ে রাখলাম,
পরে বেরুলে
পরব বলে। সাইকেলের চাবিটিও সাবান জলে ধুয়ে মনে হলো না, আমার
হাত দিয়ে একটিও করোনা কণা ঘরে এলো বলে। বিশ
টাকার একটি নোট ফিরে এসেছে। আলগা রেখেছি। এখন সেই
ব্যটা যদি কিছু সঙ্গে আনে, আমার কিছু করবার নেই। ফুলপ্রুফ বলে কিছু হয় না।