স্কুলে পড়বার কালেই বিখ্যাত ‘বাঁশি’ কাগজে তাঁর কবিতা প্রকাশিত হয়। এর পরে আর থেমে থাকেন নি। তাঁর সাহিত্যিক অবদানের জন্যে অসম সরকার তাঁকে শ্ৰীমন্ত শঙ্করদেব পুরস্কারে সম্মানিত করেছিলেন। এছাড়াও অসম উপত্যকা সাহিত্য পুরস্কার থেকে শুরু করে অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মানে তিনি জীবনভর ভূষিত হয়েছেন। ‘পিতা-পুত্ৰ' উপন্যাসের জন্যে ১৯৭৮তে তাঁকে সাহিত্য অকাডেমি পুরস্কার প্রদান করা হয়। যদিও ভারতীয় সমাজে দেখা দেওয়া অসহনশীলতার প্রতিবাদে ২০১৫ তে এই পুরস্কার ও সঙ্গে পাওয়া নগদ অর্থ তিনি ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। ২০০১ এবং ২০০২ বছর দুটিতে দুবার তিনি অসম সাহিত্য সভার সভাপতির আসন অলংকৃত করেন।
বিবাহসূত্ৰে তিনি অসমের আরও এক প্রখ্যাত কথা শিল্পী নিরুপমা বরগোহাঞির স্বামী ছিলেন এবং দুজনে এক সঙ্গে ‘পুআর পূরবী সন্ধ্যার বিভাস' নামের উপন্যাসটি লিখেছিলেন। হোমেন বরগোঁহাঞি ‘সাউদর পুতেকে নাও মেলি যায়', ‘হালধীয়া চরায়ে বাওধান খায়', ‘অস্তরাগ' ইত্যাদি অনেকগুলো উপন্যাস ছাড়াও আত্মজীবনী, স্মৃতি-কথা, প্ৰবন্ধ-সংকলন, গল্প-সংকলন এবং বেশ কিছু কবিতার রচয়িতা। তাঁর উপন্যাস ‘হালধীয়া চরায়ে বাওধান খায়'-র কাহিনি ভিত্তি করে তৈরি জাহ্নু বরুআর চলচ্চিত্র ১৯৮৮ -তে শ্ৰেষ্ঠ ছবির রাষ্ট্ৰীয় চলচ্চিত্ৰ পুরস্কার লাভ করেছিল। এছাড়াও অনেক আন্তর্জাতিক পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছিল। এবছরে ১২ মে দিনে কোভিড আক্রান্ত হয়ে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যু কালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৯। ‘তিমির তীর্থ’ আজ থেকে আধা শতক আগে ১৯৭০-এর মার্চে আরও একখানা উপন্যাস ‘কুশীলবে’র সঙ্গে যুগলে যুগলে প্রকাশিত হয়েছিল গুয়াহাটির স্টুডেন্টস স্টোর্স থেকে। এই প্রকাশনা আর হোমেন বরগোহাঞির লেখক জীবন ছিল অবিচ্ছেদ্য। তাঁর অধিকাংশ রচনা এখান থেকেই প্রকাশিত হয়েছিল।
সদ্য প্রয়াত কথা শিল্পী হোমেন বরগোহাঞির লেখা খুদে উপন্যাস ‘তিমির তীর্থ’ প্রকাশিত হয় ১৯৭৫-এ। প্রকাশক স্টুডেন্টস̖ স্টোর্স, গুয়াহাটি। এক সাংবাদিকের রক্তাক্ত অন্তর্দ্বন্দ্ব ও আত্মশুদ্ধির কাহিনি। লেখক নিজেও ব্যক্তিগত জীবনে সাংবাদিক ছিলেন। ফলে এর মধ্যে তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের ছায়াপাত ঘটলেও একে আত্মজৈবনিক উপন্যাস বলা যাবে না। কিন্তু সমকালীন অসমের আর্থ-সামাজিক পরিবেশের একটি রেখাপাত তো ঘটেইছে।]
{ এই উপন্যাসটি প্রথমে ধারাবাহিকভাবে ২০২১-এ প্রকাশিত হয় অঞ্জলি সেনগুপ্ত সম্পাদিত ‘অন্যদেশ’-এ। ধারাবাহিক ভাবে নয় অধ্যায়গুলো এখানে দেখা যেতে পারে। ১ম ভাগ, ২য় ভাগ, ৩য় ভাগ, ৪র্থ ভাগ, ৫ম ভাগ, ৬ষ্ঠ ভাগ, ৭ম ভাগ, ৮ম ভাগ, ৯ম ভাগ। সম্প্রতি প্রকাশিত হল সঞ্জয় সাহা সম্পাদিত ‘তিতির' কাগজে। }
বহুদিন পর প্রহ্লাদ স্ত্রীকে নিয়ে সিনেমা দেখতে বেরোচ্ছিল। দুজনেই পোশাক আসাক পরে বেরুতে যাবে মাত্র, তখনই কাজের ছেলেটি এসে খবর দিল---বাইরে একজন অতিথি এসছে। মুহূর্তেই দুজনের মুখ কালো হয়ে এল। ললিতা হতাশায় ভেঙে ধপ করে বিছানাতে বসে পড়ল। বলল, “ তুমি কিন্তু পাঁচ মিনিটের মধ্যে লোকটাকে বিদেয় দিতে হবে। মরবার জন্যে আর আসবার সময় পেল না। বেছে বেছে আজই এসময়ে এসে হাজির। আমি কিন্তু ঘড়ির কাঁটায় তাকিয়ে বসে থাকব। পাঁচ মিনিটের মধ্যে ওকে বিদেয় করে না এলে আমিই বাইরে গিয়ে বলে দেব, সিনেমার টিকেট করা আছে। না গেলেই নয়।”
কোনও কথা না বলে সান্ত্বনার ছলে প্রহ্লাদ স্ত্রীর মুখে হাতটা বুলিয়ে দিল, তারপর গম্ভীর মুখে বেরিয়ে গেল।
পাঁচ মিনিটের ঠাঁই দশ মিনিট চলে গেল, কিন্তু প্রহ্লাদের ভেতরে আসবার নামই নেই। ললিতা যদিও নিজেই গিয়ে অতিথি বিদেয় করবার হুমকি দিয়েছিল, তাই বলে মুখের সব কথা কি আর কাজে পরিণত করা যায়? সে শোবার ঘর থেকে বেরিয়ে বসবার ঘরের দরজার পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে স্বামী আর অতিথির কথা শুনবার চেষ্টা করল। কিন্তু লোকটা এত সরু গলাতে কথা বলছিল যে শ্রবণের সব শক্তি ব্যয় করেও একটা শব্দও ভালো করে ধরতে পারল না। লোকটাই শুধু কথা বলছে। প্রহ্লাদের মুখে রা নেই। পর্দা সামান্য ফাঁক করে খুব সতর্কতার সঙ্গে ললিতা দু-জনকে দেখবার চেষ্টা করল। অতিথিটি একটু মোটাসোটা যত্নে পেটা লোক, পরনে খদ্দরের ধুতি আর পাঞ্জাবি। একবার দেখলেই বোঝা যায় রাজনীতির লোক। লোকটার মুখের কথাগুলো ললিতা ধরতে পারল না বটে, ভাবভঙ্গী দেখে এটা আঁচ করল যে খুবই বড় বা জরুরি কোনো কথা সে স্বামীকে বলছে। সে তার দৃষ্টি লোকটার মুখের থেকে সরিয়ে এনে স্বামীর মুখের উপরে ফেলল। তার মুখের ভাব দেখে বেশ অবাক হল। সাধারণত মানুষের সঙ্গ সে বড় ভালোবাসে না। ঘরে কখনও কেউ এলেও সে মুখে এমন এক শুকনো আর নির্বিকার ভাব ফুটিয়ে তুলবে যে সেই ব্যক্তি গেলেই যেন রক্ষা পায়। কিন্তু আজ ললিতা দেখে অবাক হল এই দেখে যে লোকটার দিকে শরীর হেলিয়ে এত মনোযোগের সঙ্গে সে লোকটার কথা শুনছে যেন এই কথা ক’টির উপরেই তার গোটা ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে।তার চোখে বিস্ময়, বিমূঢ়তা আর নিবিষ্টতা সব ভাব একসঙ্গে ফুটে উঠেছে।প্রহ্লাদের মুখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে ললিতা উপলব্ধি করল যে সিনেমা দেখার আশা এখানেই ছেড়ে দেওয়া ভালো। প্রহ্লাদের মন থেকে সিনেমাতে যাবার চিন্তা বোধহয় হাজার মাইল দূরে সরে গেছে। দাঁতে দাঁত চেপে সে ভেতর ঘরের দিকে পা বাড়াল। কাপড়চোপড় খুলে এদিক ওদিক ছড়িয়ে ঘরে পরা কাপড় পরে ঘোর সন্ধ্যায় বিছানায় গা এলিয়ে দিল।
ললিতার ছেলেমেয়েরা—মানিক আর মুনমুন দিনের খেলা শেষে ঘরে ফিরে এল। এসময়ে মাকে এভাবে শুয়ে থাকতে দেখে বেশ অবাক হল। দুটিতেই এক সঙ্গে চেঁচিয়ে উঠল, “মা, খিদে পেয়েছে। কিছু খেতে দাও!” ললিতা মৃদু ধমকে বলল, “ আমাকে জ্বালাবি না। রান্না ঘরে গিয়ে কী পাস দেখ গে যা! খেয়ে ভালোয় ভালোয় পড়তে বস!”
মানিক আর মুনমুন বুঝল যে আজ খবর আছে। বেশি আহ্লাদ করলে মায়ের থেকে আজ ধমক, চাই কি কিলও জুটতে পারে। বেশি বাক্য ব্যয় না করে ওরা মনে মনে রান্নাঘরে গিয়ে ঢুকে পড়ল।
ইতিমধ্যে বোধহয় এক ঘণ্টা সময় পেরিয়ে গেছে। ললিতার রাগটাও একটু হাল্কা হয়ে এসেছে। প্রহ্লাদ এখনও ভেতরে এল না বলে সে বেশ অবাক হল। আজ অব্দি ঘরে আসা কারও সঙ্গে প্রহ্লাদের এতটা সময় কাটানো ললিতার মনে পড়ে না। অল্প আগেও বাইরের ঘরে কথা পেতে থাকবার গুনগুন শব্দ একটা ওর কানে আসছিল। কিন্তু এখন তাও নেই। এত নীরবে লোক দুটি করছে কী? মনের কৌতূহল দমাতে না পেরে সে বিছানার থেকে উঠে দাঁড়াল আর বাইরের ঘরের দরজার দিকে এগিয়ে গেল।
ওমা! দরজায় দাঁড়িয়ে দেখে ঘরে এখনও আলো জ্বালানো হয় নি। ঘরটাতে শুধু অন্ধকারই নয়, সম্পূর্ণ নীরবতা বিরাজ করছে। পর্দাটা উঠিয়ে ভেতরে উঁকি দিল সে। অন্ধকারে প্রথমে কিছুই নজরে পড়েনি। কিন্তু তারপরেই মনে হল ঘরটিতে শুধু একটিই লোক রয়েছে। তার মানে অতিথি সেই কখন চলে গেছে। সুইচ টিপে আলো জ্বালিয়ে দিল।
আলো জ্বলবার সঙ্গে সঙ্গে প্রহ্লাদ চমকে উঠে নড়ে চড়ে বসল। অপ্রস্তুত হয়ে ললিতার মুখের দিকে তাকিয়ে সে শুধু বলল, “অহ, তুমি।”
ললিতা মুখে একটাও কিছু না বলে স্বামীর মুখে স্থির দৃষ্টি ফেলে কাছে এগিয়ে গেল এবং সামনের চেয়ারটাতে বসল। তারপর প্রহ্লাদের চোখে চোখ রেখে শান্ত স্বরে জিজ্ঞেস করল , “তোমার আজ হয়েছে কী? কোনও বড় ঘটনা নিশ্চয়। না হলে তুমি এমন কর না। কী হয়েছে , আমাকে বলবে?”
সহজ হবার চেষ্টা করে প্রহ্লাদ। মুখে হাসি একটা এনে বলে,“হবার কী আছে? কিছু হয় নি। এমনিতেই এটা ওটা ভেবে বসে ছিলাম।”
ললিতা মুখের গম্ভীর ভাব বজায় রেখে বলল, “জীবনে আগে কখনও এমনটি করেছ বলে তোমার মনে পড়ে কি? কোনদিনই বা ঘরে আসা মানুষের সাথে বসে বসে এক ঘণ্টা কথা বলেছিলে?--- ঐ লোকটা কে ছিল? আগে তো কোনও দিন একে আসতে দেখিনি।”
প্রহ্লাদ উঠে দাঁড়াল।পকেট থেকে চারমিনার একটা বের করে জ্বালিয়ে বলল,“ তুমি ঠিকই ধরেছ। লোকটা আমাদের ঘরে আগে কখনও আসে নি। এই প্রথম এসছে। আমি অবশ্য লোকটাকে আগেই চিনি। জগন্নাথ চৌধুরী। কংগ্রেসি এম এল এ। ... আমার আজ সত্যিই খারাপ লাগছে ললিতা। আজ প্রায় এক বছর পর এত হ্যাপার পর সিনেমাটা দেখব বলে বেরুচ্ছিলাম। অসময়ে লোকটা এসে সব নষ্ট করে দিল। কাল নিশ্চয়ই যাব---ভূকম্প হোক আর প্রলয় আসুক। এখন ওঠো। এক কাপ চা দাও আমাকে। কথা বলে বলে গলাটা শুকিয়ে গেছে।”
প্রহ্লাদ ভেতর ঘরের দিকে পা বাড়াল।
ললিতা বসে রইল। গম্ভীর অথচ চড়া গলাতে বলল, “আমার কাছে কোনও কথা গোপন করবার থাকে তবে আর কিছু বলতে হবে না। আমি তোমাকে জোর করব না। এম এল এ লোকটা তোমাকে এমন কি কথা বলল যে তুমি স্থান কাল ভুলে পাথরের মূর্তির মতো একই জায়গাতে বসে ছিলে? নিশ্চয়ই সে তার মেয়ের বিয়েতে ডাকে নি?”
প্রহ্লাদ ঘুরে তাকিয়ে বলল,“তা বটে,মেয়ের বিয়ের নেমতন্ন নয়। কিন্তু সে শুধু আমাকেই ডেকে রাজভোগ খাওয়াবার মতো ব্যাপার বটে। ... জানোই তো,খবরের কাগজের লোকের কাছে কত লোক আসে কত কথা নিয়ে। কোনও একটা কথা না থাকলে এম এল এ-র মতো মানুষ আমার ঘরে আসতে যাবে কেন?... এসো এসো , সময়ে তোমাকে সবই বলব। এখন আগে চা এক কাপ আমাকে দাও”
ললিতা কিছু বলার অপেক্ষা না করে সে ভেতরে চলে গেল।
কিছুক্ষণ ললিতা সেখানেই ঠায় বসে রইল। ওর মনে নিশ্চিত ধারণা হল যে আজকে প্রহ্লাদ ওর থেকে কিছু একটা লুকোবার চেষ্টা করছে। সাধারণত সে এমনটা কখনও করে না।যেখানে যা ঘটে বা শুনে প্রতিটি কথা তার ললিতাকে বলা চাইই। তার কোনো বন্ধুবান্ধব নেই।ললিতাই একমাত্র বন্ধু।ললিতার সঙ্গে কথা বলাই তার একমাত্র বিলাস,একমাত্র সান্ত্বনা,একমাত্র বিনোদন। ঘরেই বা বাইরে --- কার সঙ্গে কী আলাপ হল---তার সব কটা শব্দও বাদ না দিয়ে ললিতাকে সে বলে শোনায়। আজই তার ব্যতিক্রম হল।ওর মনে নানা দুশ্চিন্তা ঠাঁই নিন।চিন্তার দোহায় যেন দেহটা হেলে পড়ছে।এমনই এক ভঙ্গীতে সে বসার থেকে উঠল আর ধীরে ধীরে রান্নাঘরে পা বাড়াল।
খানিকক্ষণ পরে তৈরি চা এক কাপ ললিতা প্রহ্লাদ বসে থাকা কোঠায় ঢুকতে যাবে ঢুকতে যাবে--- কানে এল মানিক আর মুনমুনের সঙ্গে খুব আড্ডা জমিয়েছে। মুনমুন বলছে,“জানো বাবা, মা না ভীষণ খারাপ। আজ আমাদের উপর শুধু শুধু রাগ করেছে।” মাণিক সঙ্গে জুড়ল,“দেখো তো বাবা, খেলার থেকে এসে মাকে কিছু খাবার দিতে বললাম। মা রাগ করে বলে কি না ---রান্না ঘরে যা পাবি গে খা। আমরা এসে দুটো শুকনো রুটিই শুধু পেলাম। আর কিচ্ছুটি নেই। গরুর ছালের মত দুটো শুকনো রুটি। সেগুলো কি খাওয়া যায়? আজ আমরা কিছুই খাইনি বাবা।”
বেদনায় ভেজা স্বর নিয়ে প্রহ্লাদ জিজ্ঞেস করল , “আজ খেলার থেকে এসে তোমরা কিছু খাও নি?”
বাবার থেকে সহানুভূতি পেয়ে ঝরনা দুটোর বাঁধা মুখ খুলে গেল যেন।একসাথেই ওরা ঢের কীসব এটা-ওটা বলতে শুরু করে দিল। মানিক বোনকে মাঝে ধমকে থামাবার চেষ্টা করে বলল,“ দাঁড়া না! আমি বাবাকে কথাটা বুঝিয়ে বলি।জানো বাবা,আমাদের সঙ্গে রানা আর নান্টুরা খেলা শেষ করে ঘরে গিয়ে পড়তে বসবার আগে রোজ এক গ্লাস হরলিক্স খায়।রুটি মাখন এগুলো তো খায়ই।আমাদেরই রোজ মুড়ির নাড়ু,নইলে রুটির সঙ্গে ঠাণ্ডা জল এক গ্লাস খেতে হয়। আমাদের জন্য তুমি হরলিক্স আনো না কেন,বাবা? খেতে যা ভাল্লাগে। আমি একদিন রানাদের ঘরে খেয়েছিলাম।”
“আমিও খেয়েছিলাম।” মুনমুন গর্বের সঙ্গে কথায় কথা জুড়ল।
প্রহ্লাদ দু-জনের দুই গালে চুমো খেয়ে বলল,“আনব,আনব আমার সোনারা!আমিও তোমাদের জন্যে নিশ্চয় একদিন হরলিক্স আনব।হরলিক্স আনব,ওভালটিন আনব,জাম-জেলি আনব...।”
আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে শিশু দুটি এক সঙ্গে চেঁচিয়ে উঠল,“আর কী কী আনবে বাবা? বল না, আর কী কী আনবে?”
পর্দা ঠেলে ললিতা ভেতরে এল। মানিক ও মুনমুনের চোখের দিকে তাকিয়ে সে বলল,“ তোরা পড়া শুরু করিস না কেন?খালি খেলা আর গল্প,গল্প আর খেলা!পড়বি কখন?” প্রহ্লাদের দিকে তাকিয়ে বলল,“তুমি তোমার ঘরে এসো।ওদের পড়তে দাও।হাওয়া মিঠাই খাইয়ে এদের আর পাগল না করলেও চলবে।”
বাতাসে বাতি নেভার মতো তিনেরই মুখের হাসি নিভে মুহূর্তে আঁধার নেমে এল।মানিক মুনমুন মুখ কাঁচুমাচু করে বই মেলে ধরল।
নীরবে চা-কাপ খেয়ে শেষ করলে ললিতা প্রহ্লাদকে বলল,“তুমি বিছানায় অল্প শোও।আমি মাথাটা একটু টিপে দিই।”
প্রহ্লাদ অবাক হয়ে বলল,“কেন? আমি তো তোমাকে মাথাব্যথা করছে বলে বলিনি।”
“তুমি তর্ক না করে বিছানায় শুয়ে পড়।” ললিতা কড়া হুকুম দিল। সুইচ টিপে আলোটা নিভিয়ে দিল। দীর্ঘ একটা শ্বাস টেনে আত্মসমর্পণের ভঙ্গীতে প্রহ্লাদ সটান বিছানায় শুয়ে পড়ল।বিছানাতে পড়েই শুধু সে অনুভব করল সত্যিই তার হাত পা মেলে আরাম করবার প্রয়োজন ছিল।তার মাথার কাছে বসে ললিতা কপালে হাত বুলাতে শুরু করল।অপরিসীম আরামে প্রহ্লাদের সারা শরীরে শিহরণ খেলে গেল।কিছুক্ষণ চিৎ হয়ে শুয়ে সে ডানদিকে কাত হয়ে শুল আর ছোটো ছেলে মাকে যেমন করে---দুই হাতে ললিতার কোমর জড়িয়ে ধরে মুখটা তার কোলে গুঁজে দিল।মুখে একটাও কথা না বলে ললিতা তার সারা মাথা মালিশ করে দিল। মাথা মালিশ হলে গলা হাত পিঠও মালিশ করে দিল। ললিতা কিছু না বললেও প্রহ্লাদ অনুভব করল--- ওর আঙুলগুলো যেন আবেগে জড়িয়ে এসে বহু কথা বলতে শুরু করেছে। ওর হৃদয়ের সমস্ত মমতা যেন আঙুলগুলোর মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে তার সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়েছে। জ্যা-বদ্ধ ধনুর মতো টান হয়ে থাকা তার শরীরের স্নায়ুর জটিল বন্ধনগুলো ধীরে ধীরে শিথিল হয়ে এল। এক অপরিসীম আরাম আর মাধুর্যের আবেশে তার চেতনা তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে এল।সে আরো জোরে কোমরটা জড়িয়ে ধরে কোলের আরও গভীরে ডুব দিল।ওর কাপড়ে দিনের কাজের গন্ধ, ঘামের গন্ধ, রান্নাঘরের নানা মশলা তেল হলদির গন্ধ। কিন্তু প্রহ্লাদের মনে হল পৃথিবীর দুর্মূল্যতম সুরভির নির্যাস থেকেও ললিতার শাড়ির এই গন্ধটা বেশি মধুর। আঁধার ঘরটিতে নিশ্ছিদ্র নীরবতাটি এক সর্বক্লান্তিহর মধুর সুরের মতো তার কানে বাজতে শুরু করল। আর কোনও এক সময়ে গভীর ঘুমে ঢলে পড়ল।
****
রাতে ভাত খাবার জন্য ললিতাকে বেশ বেগ পেতে হল।দিন জুড়ে খেলাধুলোর পর ক্লান্ত হয়ে দিনের শেষে শুয়ে পড়া শিশুর মতো প্রহ্লাদ কিছুতেই আর উঠতে চায় না।বহু কষ্টে ললিতা তাকে ভাতের টেবিল অব্দি টেনে আনল।কিন্তু সেই টেবিলে শুরু হল আরও এক যুদ্ধ।ভাতের থালাতে হা না দিয়েই গর্জে উঠল প্রহ্লাদ,“এই গরুর দানাগুলো আর কত খাওয়াবে? দিনের পরে দিন গোটা জীবনটাতেই আমার অরুচি ধরে গেছে।”
মানিক আর মুনমুন এর মধ্যেই ভাত খাওয়া সেরেইছিল। বাবার কথায় তারাও থালা দুখানা ঠেলে দিয়ে বলল,“এই গরুর দানাগুলো আমরাও খেতে চাইনে বাবা!কিন্তু না খেলে মা আমাদের মেরে আধমরা করে দেবে।আমাদের জোরে খাওয়াচ্ছে।”
ললিতা প্রথম গ্রাসটা মুখে নিচ্ছিল মাত্র। কিন্তু স্বামী আর সন্তান দুটোর কীর্তি দেখে আধোপথ থেকে হাতটা আবার থালায় নামিয়ে আনল।শান্ত দৃষ্টিতে স্বামীর দিকে তাকিয়ে বলল,“ ডায়োজিনিসের গল্প তুমিই আমাকে একদিন শিখিয়েছিলে---নিজের আদর্শ বিসর্জন না দিয়ে বা কারও পায়ে তেল না দিয়ে জীবন কাটাতে হলে শাক-পাতা খেয়েই জীবন কাটানো শিখতে হবে। আজ যদি নতুন করে ভাবছ যে সে শিক্ষা মূল্যহীন,তবে যাও না!কারও হাতে পায়ে ধরে ভালো চাকরি একটা নিলেই হল। আমার কী! তুমি থলি ভরে টানা এনে দিলেই আমি রোজ মাছ মাংস রেঁধে দেব।”
ললিতা নীরবে খেতে শুরু করে।
ললিতা লক্ষ করে নি,কিন্তু ওর কথাগুলো শোনে সাপে কাটা লোকের মতো প্রহ্লাদের মুখ যন্ত্রণায় বিকৃত হয়ে পড়ল। কয়েকটি মুহূর্ত সে স্তব্ধ এবং নিশ্চল হয়ে রইল।তারপর থালা টেনে কাছে এনে খেতে শুরু করল।মানিক মুনমুনও তার অনুসরণ করল।সেদিন তাদের রাতের আহার ছিল মোটা চালের ডাল,অল্প জলের মতো ডাল,আর কয়েক ফোঁটা তেলে ভাজা বেগুন। দুই গ্রাসের মতো খেয়ে প্রহ্লাদ অনুভব করল ভাতগুলো তার গলা দিয়ে যেতে চাইছে না।প্রতি গ্রাস ভাতের সঙ্গে এক এক ঢোক জল খেয়ে ভাতগুলো সে ভেতরে ঠেলে দেবার চেষ্টা করল।খেয়ে শেষ করাটা তার জন্যে এক যন্ত্রণার কাজ হল। তার ইচ্ছে হল আধো ভাত খেয়েই বাকিটাতে জল ঢেলে উঠে চলে যায়।কিন্তু ললিতার দিকে না তাকিয়েও স্পষ্ট অনুভব করল সে তার প্রতিটা গতিবিধি চোরাচোখে লক্ষ করছে।প্রহ্লাদ ঈশ্বর শয়তান রাজা মহারাজা বাঘ ভালুক কিছুতেই ভয় পায় না।সে এক dare-devil বলে সমাজে একটা নামই আছে।কিন্তু অবাক করা কথা হল—ললিতার ভয়ে মনে মনে সে সারাক্ষণ কম্পমান থাকে। এ ভয় অবশ্য অপরাধী যেমন পুলিশ বা বিচারকদের ভয় করে তেমন ভয় নয়।এ হল প্রাণাধিক প্রিয়জনে কোনোভাবে আঘাত পাবে বলে সদা সতর্ক হয়ে থাকার ভয়।ললিতা প্রহ্লাদের উপর মুখ ফুটিয়ে কদাচিৎই রাগ করে,কিন্তু ওর সামান্যতম ভ্রু সংকোচনও তার জন্যে এক নির্দেশ বা সতর্কবাণী।সে তখন সঙ্গে সঙ্গেই বুঝে নেয় নিশ্চয়ই কোনও ভুল করতে চলছে। খেতে খেতেই বাঁকা চোখে একবার সে ললিতার মুখের দিকে তাকাল। অন্য মনস্ক হয়ে আছে আর সে ভাবনার বেদনার ছাই ওর মুখটাকে কালো আর গম্ভীর করে তুলেছে।প্রহ্লাদ জানে ওর এই গাম্ভীর্য রাগ বা অভিমানের নয়। স্বামী সন্তানেরা যে খেয়ে তৃপ্তি পাচ্ছে না---তেতো ঔষধের বড়ি গেলার মতো অতি কষ্টে গলা দিয়ে পার করছে—এ অনুভূতিই ওর মনে ভীষণ যন্ত্রণা দিতে শুরু করল। ভাত খাওয়াতে আগ্রহ দেখিয়ে গ্রাস একটা চিবিয়ে চিবিয়ে মানিককে বললে,“কী রে মানিক! অনেকদিন পর বেগুন ভাজা। দারুণ লাগছে, না?” “একদম না!” মানিক চড়া গলায় ঘোষণা করল, “ এই জলে ভেজা বেগুন খেয়ে আমার বমি পাচ্ছে।”
প্রহ্লাদ আর টু শব্দটি করল না। কিন্তু সেই মুহূর্তে গলাটা বাষ্পরুদ্ধ হয়ে আসছে যেন অনুভব করল। এই কচিকাঁচা শিশুগুলো! ওদের এখন পুষ্টিকর খাদ্য চাই, কত স্বাদ-সুগন্ধ-রুচিকর খাবার খেতে ওদের আগ্রহ! কিন্তু গরীব বাবার সন্তান হয়ে এদের জন্মের থেকে ডালের জল আর বেগুন পোড়া খেতে হচ্ছে। ইচ্ছে করলে কাল সকাল থেকেই সে ওদের ঘি-দুধ-মাছ-মাংস খাওয়াতে পারে! এদের জীবনের নিম্নতম প্রয়োজন আর সুখ –স্বাচ্ছন্দ্যের থেকে বঞ্চিত করার সত্যি কি তার কোনো নৈতিক অধিকার রয়েছে? জীবনের কোন আদর্শের বেদিতে সে তার সন্তানের কল্যাণ আর আশা আকাঙ্ক্ষা বলি দিচ্ছে?
****
ওদের সবার বিছানা একটা ঘরেই। এক বড় বিছানায় মা আর সন্তানেরা শোয়। আর একটি বিছানাতে প্রহ্লাদ একা শোয়। বিছানায় শুয়ে শুয়ে কিছুক্ষণ বই পড়ার অভ্যাস আছে ললিতার। কিন্তু আজ বিছানাতে পড়েই আলো বুজিয়ে দিল। কতক্ষণ নীরবে পড়ে রইল। অল্প পরে গভীর ঘুমে মানিক মুনমুনের শ্বাস নেবার শব্দ পাওয়া গেল। প্রহ্লাদ মনে মনে এক মৃদু আতঙ্ক অনুভব করল।এতক্ষণ ধরে যা নিয়ে সে ভয় করছে তা নিশ্চয় আর কয়েক মুহূর্তে ঘটবেই। ললিতা তাকে জিজ্ঞেস করবে,“সন্ধ্যাবেলা যে লোকটা এসেছিল সে সত্যিই কী বলে গেছে, বল।” সাধারণত প্রহ্লাদ এই সময়ের জন্যে সারাদিন জুড়ে মধুর আশায় পথ চেয়ে থাকে। বিছানায় শুয়ে শুয়ে ঘুম না আসা অব্দি দু-জনে একথা ওকথা কয়ে থাকে।প্রহ্লাদ ললিতাকে বলে শোনায় সারাদিনের তার অভিজ্ঞতার কথা---কার সঙ্গে কই দেখা হল,কে তাকে কী বলল,কোথায় কার সম্পর্কে কী শুনতে পেল—এই সব।ললিতাও তাকে বলে দিনটাতে সে কী কী করল,দুপুর বেলার খাবার পর কী বই পড়ল,ঘরে কে কে এসেছিল,পাড়ার প্রতিবেশীদের সম্বন্ধে নতুন কী কী কথা কানে এল ইত্যাদি। দিনের অভিজ্ঞতা নিয়ে কথা যখন ফুরিয়ে যায় তাদের মন তখন উড়ে যায় কখনও বা অতীতের বুকে, কখনও বা ভবিষ্যতে। তাদের মনে পড়ে বিয়ের আগের প্রেম পর্বে এক অরণ্যে ঘুরতে গিয়ে চুমু খেতে যাচ্ছে,তখনই এক কাঠবেড়ালি ঝোপের থেকে বেরিয়ে কেমন তাদের ভয় পাইয়ে দিয়েছিল।এক পূর্ণিমা রাতে দু-জনে হাত ধরাধরি ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে নীরবে দাঁড়িয়ে থাকার বেলা হঠাৎ এক অপার্থিব, অনির্বচনীয় অনুভূতি কেমন করে এক পলকা বাতাস যেমন হঠাৎ এসে গাছের পাতা,তৃণের ডগা দুলিয়ে দিয়ে যায়---তেমনি তাদের দুটি শরীর কাঁপিয়ে দিয়ে গিয়েছিল।একবার অভিমান করে ললিতা এক সপ্তাহের জন্যে প্রহ্লাদের কাছে আসে নি। চিঠিও লেখেনি।তাতে সে ব্লেড দিয়ে কেমন করে আঙুল কেটে রক্ত দিয়ে ললিতাকে চিঠি দিয়েছিল।যৌবনের সেই সব উন্মাদ দিনগুলোর সুধাময় কথা-কণিকাগুলো একটা একটা করে ওরা স্মরণ করে।আর পুরো অতীতের জীবনটা যেন আরও একবার যাপন করে ফিরে আসে।দুজনেরই মনে এমন বিস্ময়কর এক ক্ষমতা আছে যে জীবনের জমা কিছুই অতীতের অতল গর্ভে হারিয়ে যায় নি। ইচ্ছে করলেই স্মৃতি থেকে সত্তায়,সত্তার থেকে স্মৃতিতে এরা অবাধে বিচরণ করতে পারে। মাঝে মধ্যে এরা স্বপ্নের বুকেও এক একবার অভিযান করে আসে।স্মৃতি-সত্তা-স্বপ্নে,অতীতে বর্তমানে ভবিষ্যতে এখনও হাত ধরাধরি করে আরণ্যক ভ্রমণ করে রোজ রাতে।এখন।এই সময়ে।অনেক রাত অব্দি জেগে এখনও এরা আকাশে কুসুম ফোটায় ꠩ কেমন করে আশ্রমের মতো ছোট্ট এক ঘর করবে,তাতে ফুলের কী কী গাছ রুইবে।অল্প টাকা জমাতে পারলেই কী করে পুরিতে ঘুরতে যাবে আর সমুদ্রের গর্জন কানে নিতে নিতে দু-জনে পরস্পরের দেহের সমুদ্রে,হৃদয়ের সমুদ্রে ডুব দেবার প্রয়াস নেবে ইত্যাদি। কিন্তু স্মৃতি যেমন আনন্দে উত্তেজনায় এদের সঞ্জীবিত করে তুলে,স্বপ্ন তেমন পারে না।মুখ ফুটিয়ে বলতে না পারলেও মনে মনে দু-জনেই জানে যে তাদের এই নিরাকার স্বপ্ন কোনোদিন সাকার চেহারা নিয়ে ধরা দেবে না। কিন্তু অন্যে যদি ব্যথা পায় তাই নিজ হৃদয়ের নিরাশা দু-জনের কেউই মুখে প্রকাশ করে না।
আজ বিছানাতে পড়ে প্রহ্লাদ নিজে কোনও কথা শুরু করলই না।বরং সে জোরে শ্বাস টেনে ঘুমিয়ে পড়ার ভান করল। স্বামীর কাজ কারবার আজ ললিতাকে যে বেশ হতবুদ্ধি করে তুলেছে তাতে সন্দেহ নেই।ললিতার সাড়া না পেয়ে একদিকে প্রহ্লাদ যেমন স্বস্তি অনুভব করল,ললিতা মনে মনে অস্থির হয়ে উঠল।তাদের জীবনে যেন হঠাৎই এক ছন্দপতন হতে শুরু করল।কান খাড়া করে প্রহ্লাদ ললিতার শ্বাসের শব্দ শোনার চেষ্টা নিল।ললিতা তার উপরে অভিমান করল না রাগ করল?তখনই সে অনুভব করল যে কেউ তার মশারি তুলে ধরছে।কী হচ্ছে ভালো করে বোঝার আগেই সে দেখল ললিতা তার পাশে শুয়ে দুই হাতে জোরে জড়িয়ে ধরেছে।কখন যে সে নেমে এল,এত চুপি চুপি নেমে এলোই বা কী করে তার কিছুই প্রহ্লাদ টেরই পেল না।
মুখে কোনও কথা না বলে অসীম মমতায় প্রহ্লাদ ললিতার মাথাটা পিষে দিতে শুরু করল।ললিতার এই কাজের অর্থ সে বুঝে।যখনই ললিতা বুঝে যে কোনও এক দুশ্চিন্তা বরকে পীড়ন করছে,মানুষটা হঠাৎ নীরব হয়ে পড়েছে,দূরে সরে গিয়ে নিজের নিঃসঙ্গতার খোলাতে লুকিয়ে পড়ছে---তখনই সে নিজের বিছানা ছেড়ে এসে বরের বিছানা গ্রহণ করে।এরকম সময় সে বোধহয় অনুভব করে যে এখন আর মুখের কথা যথেষ্ট নয়,এখন কেবল সারা শরীরের ভাষাতে সে হৃদয়ের গভীর সহানুভূতিটুকু ব্যক্ত করতে পারে বা বরকে দূরে সরে যাবার থেকে বাধা দিতে পারে।প্রহ্লাদও ভালো বুঝতে পারে এ ললিতার দেহের প্রয়োজন নয়।এ তার দেহের প্রয়োজন।স্বামীর সঙ্গে নিবিড়তম ঐক্য স্থাপন করবার প্রয়োজন।কিন্তু আজ সে এমন ভান করল যেন ললিতার এই উঠে আসবার অর্থ সে বুঝেইনি।বলল,“তোমার হয়েছে কী ললিতা? ঘুম পাচ্ছে না?”
আদর করে স্বামীর বুকের মধ্যে মুখটা বেশি করে গুঁজে দিয়ে ললিতা বলল,“তার আগে তোমার কী হয়েছে সে কথা বল না কেন?তোমার যে আজ কিছু একটা হয়েছে সে কথা আমি বুঝতে পারিনি বলে মনে করেছ কি? তোমাকে চিনতে আমার বাকি আছে?”
প্রহ্লাদ তার নগ্ন বুকে ললিতার ঠোঁটের কোমল ছোঁয়া আর নাকের গরম নিঃশ্বাস তার পুরো শরীরে এক মধুর পুলকের শিহরণ জাগিয়ে তুলল।কিছু সময়ের জন্য সে মনের সব দুশ্চিন্তা এবং অস্বস্তি ভুলে গেল।তার হঠাৎ মনে হল--- কালো মেঘের বুক চিরে রোদের একফালি সোনালি কিরণ যেমন হঠাৎ বেরিয়ে আসে,ঠিক তেমনি এই সব বিরল মুহূর্তের মধ্য দিয়েও যেন জীবনের দুর্লভ সুধার দুই একটা কণিকা গলে পড়ে। দশবছরের বিবাহিত জীবনে প্রহ্লাদকে একটা কথা শিখিয়েছে যে প্রেমপূর্ণ সবচে বড় দান হল নিঃসঙ্গতার থেকে মুক্তি।সে নিঃসঙ্গতা শুধু মনের নয়,দেহেরও।গভীর কৃতজ্ঞতায় সে ললিতাকে জোরে জড়িয়ে ধরল।আর আলতো করে ঠোঁটে একটা চুমু খেল।প্রহ্লাদের চুমার মাধুর্য লেহন করে করে ললিতা কিছু সময় নীরবে রইল।তার পর আবার সেই আগেকার প্রশ্নে ঘুরে এল,“তুমি আজ আসল কথাটা আমাকে বল না কেন?তুমি বুঝে পাও না যে তুমি যতই আমাকে কথাটা ভোলাবার চেষ্টা করছ ততই আমার কৌতূহল বেড়ে যাচ্ছে।”
প্রহ্লাদ শেষঅব্দি হার মেনে নিয়ে বলল,“ললিতা জীবনে কখনও কোন কথা তোমার থেকে গোপন করেছি,বলতে পার?”একটা কথা ঠিক,আজ আমি এক ভীষণ বড় বিষয় মনে মনে ভাবছি।কিন্তু এখন অব্দি চিন্তাটা আমার নিজের মনেই সম্পূর্ণ স্পষ্ট হয়ে উঠেনি। কথাটা আমি নিশ্চয় তোমাকে বলব। কিন্তু আগে পুরো কথাটা আমাকে ভেবে নিতে দাও। তোমাকে এখন শুধু এইটুকুই বলে রাখি কোনও ভয়ের কথা নয়,দুশ্চিন্তা করার কথা নয়।বরং এ আমাদের জন্যে এক বড় সৌভাগ্যের পূর্ব-সংকেত। কাল সকালে ঘুম থেকে উঠেই দিন শুরু করার আগে কথাটা তোমাকে বলব।এখন তুমি নিশ্চিন্ত মনে শুয়ে থাকো। আমি তোমার গা মাথা আস্তে আস্তে টিপে দিচ্ছি। তুমি ঘুমিয়ে পড়ো।
বুকের থেকে প্রকাণ্ড পাথর যেন গড়িয়ে পড়ে গেল।বরকে অবিশ্বাস করার মতো কখনও কোনও কারণ ঘটেনি। ললিতার এক প্রচণ্ড স্বস্তির ভাবে শিথিল হয়ে এল।হাঁটু মুড়ে প্রহ্লাদের দু-পায়ের ফাঁকে ভর দিয়ে সে ঘুমোবার জন্যে তৈরি হল। বাবা যেমন ছোটো মেয়ের গায়ে হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়াবার চেষ্টা করে প্রহ্লাদও ললিতার সঙ্গে সেভাবেই করতে শুরু করল।দশ মিনিটের মধ্যে গভীর ঘুমে ললিতা ডুবে গেল।
নিদ্রিতা প্রেয়সীকে বুকের মাঝে নিয়ে প্রহ্লাদ আরও কিছুক্ষণ জেগে কাটাল।
মানুষের জীবনে এমন এক একটা মুহূর্ত আসে যখন দুই বা ততোধিক পথের মধ্যে একটা বেছে নিতে হয়।গড় কাপ্তানি রাস্তার মতো জীবনের রাস্তাতেও কোনও পথ নির্দেশ লেখা থাকে না,অন্য কেউও এক্ষেত্রে বিশেষ সাহায্য করতে পারে না। দুটি কর্তব্যের মধ্যে যখন শুধু একটিকে বেছে নিতে হয়---মহাভারত যাকে বলেছে ধর্ম সংকট---তেমন সংকটের সময় বিবেকবান মানুষ পুরো একা হয়ে পড়ে। প্রহ্লাদের জীবনে আজ হঠাৎ তেমন এক মুহূর্ত এসে হাজির।
জগন্নাথ চৌধুরী এম–এল –এ-কে প্রহ্লাদ ব্যক্তিগতভাবে চেনে না।অসমের রাজনীতিতে সে একজন ধুরন্ধর ব্যক্তি। পর্দার আড়ালে থেকে সে অসমের রাজনীতি অনেকটাই নিয়ন্ত্রণ করে।এমন একটা লোক হঠাৎই তার ঘরে এসে উপস্থিত হওয়াতে সে বেশ অবাক হয়েছিল।সে নিশ্চয়ই প্রহ্লাদের ঘরে চা-পান খেয়ে আড্ডা দিতে আসেনি।মতলব একটা থাকতেই হবে।কিন্তু সেটি কী? সে মানুষের সঙ্গে খুব একটা গলাগলি করে না।কেউবা উপযাচক হয়ে ঘনিষ্ঠতা করতে এলেও সে খুব একটা প্রশ্রয় দেয় না।জগন্নাথ চৌধুরী তার সঙ্গে আলাদা কী কী বিষয়ে উত্থাপন করতে পারে খুব দ্রুত তার কয়েকটি সে মনে মনে অনুমান করে নিল। আর মানসিক মানসিক ঢাল-তলোয়ারে সুসজ্জিত হয়ে তার মুখোমুখি হবার জন্য প্রস্তুত হল।
জগন্নাথ চৌধুরীও চতুর লোক।তিনি বোধহয় ঠিক করেই নিয়েছিলেন যে প্রহ্লাদের মতো মানুষের সঙ্গে ধানাই পানাই করে বেশি কথা বলে লাভ নেই।বেশি ভূমিকা বা বাগাড়ম্বর করলে বরং তার মনে সন্দেহ জাগারই সম্ভাবনা।আসন গ্রহণ করেই তিনি আরম্ভ করলেন,“কোনও দিন না আসা মানুষটা আজ আপনার ঘরে এসছি।অতএব বুঝতেই পারছেন কোনও একটা গরজে এসছি। এটাও বুঝতে পারছেন নিশ্চয় গরজটা আপনার নয়,আমার।অবশ্য শুধু আমার বললেই ভুল হবে,গোটা দেশের গরজ। আশা করছি আপনি আমাকে নিরাশ করবেন না।”
নিজের মুখটাকে প্রশ্নবোধক চিহ্ন একটার মত করে প্রহ্লাদ জগন্নাথ চৌধুরীর মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। তিনি আশা করেছিলেন তাঁর কথা শুনে প্রহ্লাদ যারপর নাই কৌতূহলী হয়ে পড়বে এবং মুখ খুলে সেই কৌতূহল প্রকাশ করবে।কিন্তু সেসব কিছু না করে নীরব হয়ে থাকতে দেখে তিনি সামান্য হতাশ হলেন।কিছুক্ষণ থেমে থেকে তিনি আবার আরম্ভ করলেন,“দেশের উন্নতির জন্য সরকারের যেভাবে কাজ করা উচিত সেভাবে করতে পারে নি।এ কথাটা আপনার চেয়ে ভালো আর কেই বা বুঝে? জীবনভর আপনি অন্যায় অবিচার অকর্মণ্যতার বিরুদ্ধে লড়ে এলেন।শাসন যন্ত্রের আনাচ-কানাচ আপনি খুব ভালো চেনেন। কিন্তু কথা একটা হল কি জানেন প্রহ্লাদ বাবু,ভালো কাজ করবার আমাদের সরকার বা নেতাদের সদিচ্ছার যেমন অভাব সুদক্ষ লোকের।বেশি ভালো কাজ যে শুধু সদিচ্ছার অভাবেই খারাপ হয় তাই নয়--- যে কাজে যেমন মানুষকে দিতে হয় তেমন মানুষ না পাওয়াও আমাদের ব্যর্থতার প্রধান কারণ।আমাদের সবচে’ বড় অভাব হল দক্ষতার অভাব যোগ্যতার অভাব।Pursuit of excellence যে কথাটি জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আমাদের মূল মন্ত্র হওয়া দরকার সেটি আমাদের দেশে একেবারেই নেই। তারচে’ও দুঃখের ব্যাপার—যাদের কিছু যোগ্যতা আছে,কাজ করবার তুখোড় সামর্থ্য ও বুদ্ধিবৃত্তি আছে---তাঁরা নিজে দায়িত্ব নিতে এগিয়ে না এসে শুধু বাইরে থেকে সমালোচনা করেন। আপনি কী বলেন?”
প্রহ্লাদ একটা হাসি ছুঁড়ে দিয়ে বলল,“এখন অব্দি আপনার ভূমিকাটাই শুনলাম।আসল কথা শুনি নি।আপনি যেটি বলবার জন্যে আমার এখানে এলেন সে কথাটি একসঙ্গে বলে ফেলুন।”
“বলব, বলব! বলব বলেই তো এসেছি।” ছোট্ট কাশি একটা তুলে জগন্নাথ চৌধুরী আসল কথাটা বলবার জন্য তৈরি হলেন,“আপনার কথাই ধরুন। আপনার মতো যোগ্যতা আর বুদ্ধিবৃত্তি থাকা লোক অসমে ক’টা আছে?আপনার অর্থনীতি নিয়ে যে জ্ঞান আর ক্ষুরধার বিশ্লেষণী শক্তি সেটুকু যদি শুধু সমালোচনার কাজে ব্যবহৃত না হয়ে গঠনমূলক কাজে ব্যবহৃত হয়,তবেই দেশের উন্নতিতে বেশি কাজে আসবে বলে আপনি মনে করেন না কি?আপনি যদি রিপোর্টার না হয়ে একটা কাগজের সম্পাদক হতেন তবুও একটা কথা ছিল।তখন একটা সান্ত্বনা থাকত যে যোগ্যতা একটা স্বীকৃতি পেল।সমাজে তার প্রাপ্য স্ট্যাটাস পেল। কিন্তু ঠাকুর ঘরের বাতির মতো আপনার মতো একজন মানুষ শুধু মাত্র রিপোর্টার হয়েই জীবনে অজ্ঞাত,অখ্যাত থেকে যাবেন—এর চে’ দুঃখের ব্যাপার আর কী হতে পারে! আর, সে কথা নয় যেতেই দিন।আমি আপনাকে যে কথা বলতে এসছি সেটিই শুনুন।অসম সরকারের দেখুন হঠাৎ একটা সুমতি হয়েছে,তাঁরা একটা ‘অর্থনৈতিক গবেষণাকেন্দ্র’ শুরু করতে চাইছেন। এই কেন্দ্রের কাজ হবে অসমের অর্থনীতির বিষয়ে নানা রকম সমীক্ষা আর গবেষণা করে সরকারকে অর্থনৈতিক পরিকল্পনা করতে সাহায্য করবে।অবশ্য বিষয়টা যদিও সরকার শুরু করবে—এ একটা সরকারি বিষয় হয়ে থাকবে না।অনুষ্ঠানটি সম্পূর্ণ স্বায়ত্ত শাসিত হবে।কিন্তু সরকার অনুষ্ঠান একটা শুরু করলেই তো হল না।তাকে চালাবার জন্য উপযুক্ত লোকের দরকার পড়বে। যোগ্য লোকের হাতে না পড়লে এও আর দশটা অনুষ্ঠানের মতো আবর্জনার স্তূপে পরিণত হবে।এখন যোগ্য লোকের সন্ধানে পুরো দশ চষে বেড়ানো হচ্ছে।দিন দুই আগে গেছিলাম মুখ্যমন্ত্রীর কাছে একটা কাজে।তখন কথা প্রসঙ্গে কথাটা উঠল।আমার চট করে আপনার কথা মনে পড়ল। মুখ্যমন্ত্রী বললাম,“আপনারা সবসময় লোক নেই নেই বলে থাকেন।কিন্তু প্রতিভা খুঁজে বের করার চেষ্টা করেন না।আমাদের মধ্যে গণ্ডায় গণ্ডায় প্রতিভাশালী লোক নেই বটে,কিন্তু খুঁজতে জানলে দু-একজন যে কোত্থাও বেরোবে না এও সত্য নয়।ছাইচাপা সোনার মতো আমাদের কাছেই কোথাও কোথাও প্রতিভা লুকিয়ে আছে।”তারপরেই আপনার কথাটা তুললাম।আমার ভয় ছিল,আপনার নাম শুনে তিনি ঝ্যাং করে উঠবেন।আপনি তো আর অসমের কংগ্রেস সরকারকে এমনি ছেড়ে দেন নি,কাপড়ে চোপরে ন্যাংটো করে রেখেছেন।কিন্তু আমাদের মুখ্যমন্ত্রীর একটা ব্যাপার স্বীকার করতেই হবে,শত্রু হলেও গুণীর গুণ স্বীকারে তিনি কখনও পেছন পা হাঁটেন না।আপনার নাম শুনে তিনি ভীষণ আগ্রহ প্রকাশ করলেন।সঙ্গে শুধু অল্প সন্দেহ প্রকাশ করলেন---আপনার মতো স্বাধীনচেতা মানুষ সংবাদপত্রের কাজ ছেড়ে সরকারি প্রতিষ্ঠান একটার দায়িত্ব নিতে আসবেন কি না?আমি তাঁকে বললাম,‘আপনি সে ভার আমাকে দিন।আমি যেভাবেই পারি প্রহ্লাদবাবুকে নিয়ে আসছি।আমাদের লোক বেশি নেই;যে দুই চারজন আছেন তারাও যেচে দেওয়া সুযোগ আর দায়িত্ব পরিহার করে এরকম মাথা লুকিয়ে থাকতে পারেন না...’এইমাত্র আমার কথা।মুখ্যমন্ত্রীর কাছে ফুটানি মেরে বড় আশাতে আমি আপনার কাছে এসেছি। এখন আপনি যা বলেন।”
সঙ্গে সঙ্গেই কিছু না বলে কিছুক্ষণ প্রহ্লাদ জগন্নাথ চৌধুরীর মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।তাঁর দীর্ঘ কথাগুলো শুনে মনের ভেতরে তার একটা আলোড়ন যদিও উঠল বারে সে নির্বিকার দেখাবার চেষ্টা করল।সত্যি বলতে,এমন প্রস্তাব শোনার জন্য সে সামান্যও প্রস্তুত ছিল না।বেশিরভাগ মানুষও আসে কোনও খবর দিতে।সবাই যে সমাজ বা দেশের স্বার্থেই খবরগুলো দেয় তাও নয়।ক্ষমতার রাজনীতি একটা দলের ভেতরেই নানা মানুষকে পরস্পরের শত্রু করে তুলে।বহু লোকে ঘনিষ্ঠ সহকর্মীর বিরুদ্ধেও প্রহ্লাদকে নানান খবর দেয় উদ্দেশ্য গায়ের ঝাল মেটানো কিংবা প্রতিদ্বন্দ্বীকে ঘায়েল করে নিজের পথ সুগম করা। রাতের আঁধারের আড়াল রেখে বহু মন্ত্রীর আগমনও তার এ ঘরে হয়ে থাকে--- আর বহু চমকপ্রদ খবর সে মন্ত্রীদের থেকেই পেয়েছে।আরেকদল লোক আসে নিজেদের স্বার্থ হানিকর খবরের প্রকাশ বন্ধ করতে।এরা হাতজোড় করে অনুরোধ করে, নতুবা পুরস্কারের লোভ দেখায়--- তাতেও কাজ না হলে কেউবা ভীতি প্রদর্শনও করে থাকে।এমনই কিছু একটা উদ্দেশ্য নিয়ে জগন্নাথ চৌধুরীও এসেছেন---প্রথমটা সে এরকমই ভেবেছিল।কিন্তু তাঁর মুখে সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত অন্য একটা কথা শুনে সে এত অপ্রস্তুত হল যে কী উত্তর দেবে তাই না ভেবে পেয়ে কিছুক্ষণ চুপ রইল।
প্রহ্লাদকে চুপ করে থাকতে দেখে জগন্নাথ চৌধুরীই আবার বললেন,“ অহ!আপনাকে আসল কথাটাই বলা হয় নি। কত মাইনে পাবেন তাও নিশ্চয় আপনার জানা উচিত। মুখ্যমন্ত্রী এখন পনেরোশ’ দেবার কথা ভাবছেন।অবশ্য আপনি চাইলে দুই আড়াইশ’বাড়িয়ে দেওয়া এমন কঠিন কাজ হবে না।... আমি তা’লে আজ উঠি।মুখ্যমন্ত্রীকে বলব,আপনার সম্মতি রয়েছে।”
“আমি তো বলিনি আপনাকে,আমি সম্মত।” প্রহ্লাদ হঠাৎই রূঢ়ভাবে বলে উঠল,“আপনি বরং মুখ্যমন্ত্রীকে বলবেন যে তাঁর অফারটার জন্য ধন্যবাদ।কিন্তু গ্রহণ করতে না পেরে আমি দুঃখিত।”
জগন্নাথ চৌধুরী প্রায় উঠেই যাচ্ছিলেন।প্রহ্লাদের কথাতে আবার বসে পড়লেন।আহত কণ্ঠে বললেন,“বলুন তো দেখি মশাই,এই সুবর্ণ সুযোগটা হাতে পেয়ে হারাচ্ছেন।সরকার তো আপনাকে একটা চাকরি নিতে বলছে না।নিজের প্রতিভাকে যাতে দেশের কাজে লাগাতে পারেন তার জন্যে একটা সুযোগ হে দিতে চাইছে।আপনি বরং কথাটা আরেকবার ভেবে দেখুন, প্রহ্লাদবাবু।আমার মনে হচ্ছে, অফারটা না নিলে আপনি একটা বড় ভুল করে বসবেন।”
ঘরটা অন্ধকার হয়ে এসেছিল।তবু উঠে গিয়ে আলো জ্বালবার কথা না ভেবে প্রহ্লাদ বলল, “দেখুন চৌধুরিবাবু আমি গরিব মানুষ।টাকার খুবই দরকার।মাসে পনেরোশ’ মাইনে আমার জীবনের অনেক কথাই পালটে দেবে ঠিক।আমার যে লোভ হচ্ছে না তাও বলব না।তবুও পদটা গ্রহণ করতে আমি অক্ষম।কারণ আমার মনে হয় আপনার অর্থনৈতিক গবেষণা কেন্দ্রের কাজ করবার জন্য দুই একজন উপযুক্ত মানুষ খুঁজলে অবশ্যই পেয়ে যাবেন।কিন্তু আমি যে কাজটা এখন করছি তার জন্য দ্বিতীয় লোক পাওয়া দুষ্কর। কথাটা আমার অহংকার বলে ভাববেন না।যা সত্য তাই বললাম।”
জগন্নাথ চৌধুরী তবুও নিরাশ না হয়ে বললেন,“দেখুন প্রহ্লাদ বাবু,বয়সে আমি আপনার চেয়ে বড়।বোধ হয় আপনার বাবার বয়সীই হব।জীবনে অভিজ্ঞতারও নিশ্চয়ই দাম আছে।আপনার বয়স তো বোধহয় এখনও চল্লিশের ঘাট পেরোয় নি। যৌবনের উৎসাহ আর আদর্শবাদীতার কিছু অবশেষ এখনও আপনার হাতে জমা আছে।তার জোরেই ভাবছেন যে পৃথিবীটা শুধু আপনার কাঁধেই দাঁড়িয়ে আছে।কিন্তু এ ভাবনাটা বড় ভুল।বলদ একটার গায়ে মাছি একটা বসেছিল।বলদটা কান-মাথা ঝাঁকাচ্ছে দেখে মাছিটা ভাবছিল যে তার ভার সইতে না পেরেই বোধহয় বলদটা এমন ছটফট করছে।কিন্তু বলদটা যে তার অস্তিত্বই টের পায় নি মাছি বেচারা তা আঁচ পর্যন্ত করতে পারে নি।আমরা বেশিরভাগ লোকই এই ভুলটা করি।যৌবনের শ্রেষ্ঠ বছরগুলো আপনি সমাজের জন্য উৎসর্গ করলেন।এখন আপনার নিজের কথাও ভাবার সময় হল।নিজের স্ত্রী সন্তানের কথাও ভাবতে হবে। সমাজের প্রতি যেমন আপনার কর্তব্য আছে স্ত্রী সন্তানের প্রতিও একটা কর্তব্য কি নেই?আমি জানি,আজ অব্দি আপনার এক টুকরো মাটি নেই। বাড়ি একটা নেই। যা উপার্জন করেন তাতে স্ত্রী সন্তানের পেট ভালো করে ভরাতে পারবেন না। আজ হয়তো আদর্শের নেশাতে এসব কথা ভাববার আপনার সময় নেই।কিন্তু দিন একটি আসবে—যখন আপনি বুড়ো হবেন, দুর্বল হবেন,যে সমাজের জন্যে আপনি জীবনপাত করলেন---সেই সমাজ আপনার খবর নেওয়া দূরে থাক,আপনার ত্যাগগুলোর স্বীকৃতিটুকুও দেবে না।তখন অতীতের দিকে তাকিয়ে আপনি শুধু অনুভব করবেন এক বিশাল শূন্যতা।তখন আপনার অভিমান হবে,অনুতাপ হবে--- কিন্তু করবার কিছু থাকবে না।পৃথিবীতে হাজার হাজার লোকের এ দশা হয়েছে।আপনার না হয়ে কখনও থাকবে না। আমি বুড়ো লোক।শুনতে খারাপ দেখালেও আরও একটা কথা বলে রাখি,শুনুন।অনেক মানুষ জীবনে সুযোগ এলেও তাকে পায়ে ঠেলে দেয়।তার কারণ কিন্তু শুধু আদর্শ নিষ্ঠাই নয়।আসল কারণ অহংকার।কী জানি লোকে বাজে ভাবে নেয়,কী জানি ইমেজ নষ্ট হয়—এই ভয়।অনেক লোক নিজের রক্ত নিংড়ে এই অহংকারকে লালন করে আর তিলে তিলে মৃত্যু বরণ করে। মানুষ হয়ে জন্ম নেবার এক এক বড় যন্ত্রণা।থাক,সে কথা থাক।বুড়ো মানুষের এই একটা বড় দোষ—একবার মুখ খুললে আর বন্ধ হবার নাম নেয় না।আপনি এখনই আমাকে কথা দিতে হবে না।পুরো কথাটা ভালো করে ভেবে দেখুন।স্ত্রীর সঙ্গেও কথা বলুন। তার পর আমাকে জানান।দুদিন পরে আবার আসব। আজ শুধু এইটুকুই বললাম যে দেশের ভালোর জন্যেই এ পদটাতে আপনাকে আমরা চাইছি।
****
"পনেরোশ’ টাকা মাইনে? নিদ্রিতা স্ত্রীকে নিজের বাহুবন্ধন থেকে মুক্ত করে বালিশটাতে ভালো করে শুইয়ে দিয়ে দিল। নিজে হাত পা লম্বা করে মেলে আরাম করে এক দিবা মধুর স্বপ্নের মতো প্রহ্লাদ ভাবতে শুরু করল---পনেরোশ’ টাকা মাইনে?চল্লিশের ঘাটে পা দিতে আর মাত্র দুই বছর রয়েছে। যৌবনের দিনগুলো প্রায় শেষই হল। এখন তার এমন এক বয়স যখন তার মতো সাধারণ মানুষের জীবনে আর নতুন কিছু ঘটার সম্ভাবনা থাকে না। এখন শুধু ঘটতে পারে অতীতের ক্লান্তিকর আর অন্তহীন পুনরাবর্তন।দিনের পরে দিন।মাসের পর মাস।কলুর বলদের মতো মৃত্যুর মুহূর্ত পর্যন্ত চক্রাকারে ঘুরতে থাকার যন্ত্রণা।বারো বছর সংবাদপত্রে সাংবাদিকের চাকরি করে এই আটত্রিশ বছর বয়সেও তার মাইনে হয়েছে মাত্র পাঁচ শত টাকা। অসমীয়া সংবাদ পত্রের যা অবস্থা তাকে পাঁচশ টাকার বেশি মাইনে দিতে মালিকেরও সংগতি নেই।সে কথা সে বুঝে।পাঁচশো টাকার ভেতরে দেড়শত টাকা ঘর ভাড়া দিতেই যায়।বাকি সাড়ে তিনশো টাকাতে এ দুর্মূল্যের বাজারে মোটা চালের ভাত, ডালের জল আর বেগুন ভাজার বাইরে স্ত্রী-সন্তানকে আর কিছু খাওয়াবার সাধ্য তার নেই।প্রোটিনের অভাবে ছেলেমেয়ের দৈহিক আর মানসিক স্বাস্থ্য কেমন ব্যাহত হয় এ নিয়ে সে নিজেই সংবাদপত্রে বহু তথ্যপূর্ণ প্রবন্ধ লিখেছে।কিন্তু তার নিজের ছেলেমেয়েরাই দুমাসের মাথায় একবার মাছ-মাংসের চেহারা দেখতে পায় কি না পায়---তারই ঠিক নেই।স্ত্রীর অবস্থা আরও শোচনীয়।ভারতীয় নারীর সতীত্ব ধর্ম রক্ষা করে ললিতা এই অভাবের সংসারে সবই স্বামী সন্তানকে খাওয়াবার চেষ্টা করে নিজে প্রায় আধপেটাই থাকে।ঘরে কখনও মাছ একটুকরো এলে ললিতার পাতে তার অবশেষটুকুই পড়ে। না খেয়ে না খেয়ে বত্রিশ বছরের মেয়েটার পঞ্চাশ বছরের মহিলার মতো চেহারা হয়েছে।প্রহ্লাদের নিজের অনেক শখ-আহ্লাদ ছিল।মাসে মাসে বই কিনে লাইব্রেরি করা।একটা রেকর্ড প্লেয়ার কিনে মাঝে মধ্যে ভালো ভালো গান দুই একটা শোনা,বছরে কখনও কোথাও বেড়াতে যাওটা।এখন এসব শখ পূরণ হওয়া দূরের কথা,জীবনে যে কখনও এসব স্বপ্ন দেখেছিল সেসব কথাই গেছে ভুলে।তার জীবন এখন বাস্তবিক অর্থেই শুধু দিন যাপনের,শুধু প্রাণ ধারণের গ্লানি।জীবনে যে কখনও এই অবস্থার পরিবর্তন হবে সে আশাও সে এখন আর মনে আনে না।মাইনে হয়তো বছরে বিশ টাকা বাড়বে,কিন্তু সে অনুপাতে নিত্যব্যবহার্য জিনিসপত্রের দামও বাড়বে।খাদ্য সন্ধানী বন্য জন্তু বা আদিম মানুষের মতো তার পুরো জীবন শেষ হয়ে যাবে দুবেলা দুমুঠো খাদ্যের সন্ধানে।সেই ভয়ঙ্কর ভবিতব্যকেই সে এখন মেনে নিতে শিখেছে।না মেনে আর লাভ নেই।কিন্তু হঠাৎ এই পনেরোশ’ টাকার মাইনে অবর্ণনীয় সুযোগ।আলাদীনের আশ্চর্য প্রদীপ হাতে এলেও বোধহয় সে এরচে’ বেশি চমকিত হত না।
আলাদীনের প্রদীপের মতোই পনেরোশ’ টাকার এ চাকরি তার জীবনটাকে না চেনার মতো সমূলে পালটে দিতে পারে।অবশেষে সে মানুষের মতো বাঁচতে শুরু করতে পারে।যৌবনের আবেগ আর আদর্শবাদের মোহে আবদ্ধ হয়ে সে এক এক করে অনেক সোনালি সুযোগ নষ্ট করেছে।পড়াশোনায় সে অত্যন্ত মেধাবী ছিল।তখন চাকরি সমস্যাও আজকের মতো তীব্র ছিল না।ইচ্ছে করলেই একটা ভালো চাকরিতে ঢুকে সে আজ নিশ্চিন্ত নিরুদ্বেগ আর আরামের জীবন যাপন করতে পারত। বেশিরভাগ সহপাঠীরাই --- যাদের তার সঙ্গে এক আসনে বসবার যোগ্যই ছিল না—জীবনে একটা ক্ষেত্রে অন্তত তার চেয়ে বেশি বুদ্ধির পরিচয় দিয়েছে।প্রহ্লাদের মতো নিজেকে যৌবনসুলভ ভাবালুতা বা স্বপ্ন বিলাসিতা দিয়ে অন্ধ হতে দেয় নি তারা। এক এক করে জীবনের সব সুযোগ গ্রহণ করেছে।এদের মধ্যে কেউ আজ উঁচু পদের আমলা,কেউ ডাক্তার,কেউ উকিল, কেউবা সফল রাজনৈতিক।তারা ভালো ঘরে থাকে,ভালো খায়,ভালো মটরগাড়িতে ঘুরে।তাদের সুবেশা সুন্দরী স্ত্রীদের শরীর থেকে বিচ্ছুরিত হয় আরাম পুষ্ট জীবনের ঔজ্জ্বল্য আর সুরভি।এ সবই তার নিজেরও হতে পারত।তাদের সবার থেকে প্রতিভা আর যোগ্যতা ছিল তার বেশি।ঈশ্বর তাকে প্রতিভা আর দিলে কী হবে সদ্ব্যবহারের বুদ্ধি তেমন দেন নি।সঙ্গীরা যেদিন সামাজিক মানমর্যাদা,ধনদৌলত,সুন্দরী পত্নী আর বিলাস-বৈভবের স্বপ্ন দেখছিল সেদিন প্রহ্লাদের কানে এসেছিল এক অপরিচিত দুর্গম পথের আহ্বান।যুগে যুগে যেসব মানুষ পৃথিবীটা ভেঙে চুরে চায় এক নতুন গড়ে তুলতে আর জীবনকে চায় এক নতুন অর্থ দিতে প্রহ্লাদ ছিল তাদেরই একজন।
যৌবনের অহংকারে ভোগ বিলাস আর আরাম স্বাচ্ছন্দ্য তার চোখে ছিল পরম অবহেলা আর ঘৃণার বিষয়।প্রতি মুহূর্তে ঐ সময় সে জপ করত গ্যাটের মহামন্ত্র--- হে স্বর্গীয় শক্তি,যে মানুষ কখনও চোখের জল মুছে মুছে আহার করে নি আর বিষাদের রাত জেগে চোখে জলে বালিশ ভেজায় নি তেমন মানুষ কখনও তোমাকে লাভ করতে পারে নি।” সেই স্বর্গীয় শক্তির সন্ধানই ছিল সেদিন তার জীবনের পণ।বহুমূল্য সুদৃশ্য মটরগাড়িতে সুন্দরী স্ত্রীকে বসিয়ে ক্লাবে বা পার্টিতে যাবার কল্পনা সেদিন তাকে রোমাঞ্চিত করতে পারে নি।তার অন্তর রোমাঞ্চিত করে তুলেছিল এমন এক পথিকের দৃশ্য--- যে কিনা রক্তাক্ত পায়ে সুদূরে এক দুর্গম পথ ধরে এগোচ্ছে।যার বজ্র গম্ভীর আহ্বানে শুয়ে থাকা মানুষেরা এক এক করে জেগে উঠছে; পথের শেষে যার জন্য অপেক্ষা করছে সমস্ত জীবনের পুরস্কার স্বরূপ মান-সম্মান বা বিলাস –বৈভব নয়, আছে ঘাতকের ছুরি বা বন্দিশালার লৌহকপাট।এমন এক উন্মাদ বাসনা তাকে এত আবিষ্ট করে রেখেছিল যে কলেজে পড়তে এসেই সে এক গুপ্ত বিপ্লবী দলে যোগ দেয়।পঞ্চাশের দশকের প্রথম বছর ক’টা তখন।মেধাবী ছেলেদের জন্যে চারদিকে তখন ভালো চাকরি বাকরির সুযোগ। সে সবই উপেক্ষা করে সে হল বিপ্লবী।সরকার যখন দলটাকে বে আইনি ঘোষণা করে ধরপাকড় আরম্ভ করল প্রহ্লাদ আত্মগোপন করে পালিয়ে বেড়াল।কিছুদিন পরে ধরা পড়ল আর দুবছর কাটাতে হল জেলে।জেল থেকে বেরিয়ে বাবার চাপে আবার পড়তে বাধ্য হল।কিন্তু জীবনের যে দুর্গম পথের আহ্বানে একদিন সে সর্বস্ব পণ সংকল্প করেছিল সেই আহ্বান তখনও তার সঙ্গ ছাড়ে নি।কিন্তু এখন?তার মুখে এসে পড়া ললিতার চুল কটা আলতো করে গুছিয়ে দিয়ে প্রহ্লাদ নিজেকে প্রশ্ন করল---‘সুদীর্ঘ পনেরো বছরের পর,হাজারটা উপবাসী দিন আর জেগে থাকা রাত পার করে যৌবনের এই পড়ন্ত বেলায় সেই আহ্বান এখনও আমার রক্ত টগবগিয়ে তুলে কি?যৌবনের যে অহংকারে একদিন আমি সমস্ত পৃথিবীর বোঝা নিজ কাঁধে তুলে নিয়েছিলাম সে অহংকার আজও অটুট আছে কি? শীতের দিনে যখন গরম কাপড়ের অভাবে কেঁপে কেঁপে মানিক আর মুনমুনের স্কুলে যাবার দৃশ্য দেখে আমার কলজে ফাটার উপক্রম হয়; অত্যধিক পরিশ্রম,অর্ধাহার আর রোগের যন্ত্রণায় যখন ললিতার এ যৌবনেই কোমর ভেঙে নুয়ে পড়বার উপক্রম দেখি বোবা যন্ত্রণায় দেয়ালে মাথা কুটে আমার মরে যেতে মন চায়।তখনও আমার সে অহংকারকে বুকের রক্ত খাইয়ে জিইয়ে রাখার দুঃসাহস বাকি আছে কি?’
প্রহ্লাদ সঙ্গে সঙ্গে এ প্রশ্নের উত্তর দিল না।সে ভালো করেই জানে যে সে প্রশ্নের কোনও সহজ সরল উত্তর নেই।আর বাস্তব বুদ্ধি যে উত্তর দেবে,বিবেক তার প্রতিবাদ করে উঠবে।অহংকার তার টুঁটি চেপে ধরার প্রয়াস নেবে।মনের সেই দ্বন্দ্ব চলতে দিয়ে সেই পনেরোশ’ টাকা মাইনের চাকরিটার চিন্তা করা অনেক ভালো।মাসে পনেরোশ’ টাকা মাইনে তার গোটা জীবনকে পুরো পালটে দিতে পারে।
জীবনে সে বহু কষ্ট ভোগ করেছে।বেশির ভাগ কষ্টই সে স্বেচ্ছাতে বরণ করে নিয়েছে।যে সময়ে সে হাত মেললেই যে কোনো সরকারি চাকরির নিযুক্তি পত্র পেতে পারত। সে সময়ে স্বেচ্ছায় হাত মেলে দিয়েছিল গ্রেপ্তারি পরোয়ানার দিকে।অবশ্য সরকারি চাকরি না করেও সে সুখে স্বাচ্ছন্দ্যে খেয়ে দেয়ে থাকতে পারত,কারণ তার অনেক পৈত্রিক সম্পত্তি ছিল।ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে বিশ্বাস না করা বহু মার্ক্সবাদী বন্ধুকে সে দেখেছে---যারা গ্রামে একটা ছোটোখাটো জমিদারি চালিয়ে শহরে কম্যুনিস্ট রাজনীতি করে।অথবা দরিদ্র আধিয়ারকে বঞ্চিত করে সে জমি মহাজনকে বিক্রি করে শহরে ভাড়াঘর সাজিয়ে তুলে। কিন্তু প্রহ্লাদের সেটুকু সুবুদ্ধিও হল না।যেহেতু সে নিজে ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে বিশ্বাস করে না আর অনুপস্থিত জমিদারের ভূমিকাও নিতে চায় নি,সেই জন্যে পৈত্রিক জমির নিজের অংশটুকুরও স্বত্ব আধিয়ারদের ছেড়ে দিল। গত বারো বছর ধরে সে নিজের আর ছোট্ট পরিবারটার প্রাণ রক্ষা করবার জন্য প্রাণান্তকর পরিশ্রম করছে।তবুও কোনোদিন এরা কেউ পেট ভরে খেতে পায় নি। ললিতা বহুদিন ধরে রক্তাল্পতাতে ভুগছে।ডাক্তার অনেক সুপথ্য আর টনিকের ব্যবস্থা দিয়ে গেছে। কিন্তু সেসব কেনার সামর্থ্য তার আজ অব্দি হয় নি।কোনোদিন যে হবে তার কোনও আশাও নেই।কিন্তু নিজেকে এভাবে সবদিক থেকে বঞ্চিত করেও ইতিমধ্যে প্রায় দুই হাজার টাকার ধার তাত কাঁধে।আর দু-মাসের ঘরভাড়াও বাকি পড়েছে।তাগাদা করে কেউ তাকে ব্যতিব্যস্ত করে নি যদিও ঋণী হবার গ্লানি আর দুশ্চিন্তা সারাক্ষণ তাকে পীড়ন করে চলেইছে।পীড়ন করে কেননা ধার শোধ করবার কোনও উপায় তার চোখে পড়ে না।কিন্তু এত কষ্ট ভোগার মূল্য কী? কী মহৎ উদ্দেশ্যে সে এমন এক দুঃখের জীবন বরণ করে নিয়েছে? এ ত্যাগের বিনিময়ে নিজের বা সমাজের কোনও মঙ্গল হয়েছে কি? জমা খরচের হিসাব করে সে দেখল—লাভের ঘরে একটা বিশাল শূন্য।জীবনের এক মহৎ আদর্শের জন্য গত পনেরো বছর ধরে সে কৃচ্ছ্র সাধন করছে বলে ভেবে সে আত্মপ্রসাদ লাভ করছিল।নির্মোহ দৃষ্টিতে গভীর ভাবে চিন্তা করে সে দেখল এর কোনও মূল্য নেই।গেল পনেরো বছরে যে কাজ সে করেছে সেটুকু না করা হলেও সমাজের তিল পরিমাণও ক্ষতি বৃদ্ধি হত না।এক ক্ষুদ্র অকিঞ্চিৎকর খবরের কাগজের মন্ত্রী আমলা ব্যবসায়ী আদি ক্ষুদ্র অকিঞ্চিৎকর মানুষগুলোর ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অপকর্মের সংবাদ দেয়া।সে কেবল কারও বসার ঘরের মুখরোচক গল্পের বিষয়বস্তুর যোগান দিতে পারে,কারোবা কেবল ক্ষোভ নির্গমনের পথ খুলে দিতে পারে;কিন্তু এ নিশ্চয় এমন এক মহৎ Cause নয় যে তার জন্যে কেউ একজন তার জীবন উৎসর্গ করল বলে ভেবে আত্মপ্রসাদ লাভ করতে পারে।সে একদিন বিপ্লবের স্বপ্ন দেখেছিল।সমাজকে ভেঙে চুরে নতুন করে গড়ার স্বপ্ন দেখেছিল।কিন্তু সেই বিপ্লবী আজ পরিণত এক পতিত আর রুগ্ন সমাজের দিনগত পাপক্ষয় লিখে রাখার সাংবাদিকে।এমন কি সমাজের প্রকৃত পাপের রূপ উদ্ঘাটনেরও সুযোগ আর সাহস তার আজ অব্দি হয়ে উঠেনি।তাহলে সে করছে কী এতদিন ধরে?কী আদর্শের বেদীতে স্ত্রী আর সন্তান দুটোর স্বাস্থ্য আনন্দ আর ভবিষ্যৎকে বলি দিচ্ছে? হঠাৎ এক নতুন আলোয় সে তার গোটা জীবনটার দেখা পেল আর অনুভব করল এক জঘন্য বেশ্যাবৃত্তির বাইরে সে জীবনে আসলে আর কোনও কাজই করেনি। বেশ্যা নিজের দেহ বিক্রি করে ক্ষুন্নিবৃত্তি করে।সে তাই বুঝি বা করছে নিজের বুদ্ধি বিক্রি করে।এ অর্থহীন আত্মক্ষয়ী কৃচ্ছ্র সাধনার থেকে নিজের মিথ্যে অহংকার বিসর্জন দিয়ে পনেরোশ’ টাকা মাইনের চাকরিটা গ্রহণ করা নিশ্চয়ই কোনও অপরাধ বা অগৌরবের কথা হবে না।আর কিছু না হলেও এই পনেরোশ’ টাকাতে ছেলেমেয়ে দুটোর পেটে একমুঠো বেশি ভাত দিতে পারবে।তাদের মুখে ক ফোঁটা দুধ দিতে পারবে।বাবা হিসেবে সন্তানের প্রতি তার নিম্নতম দায়িত্বগুলো পালন করতে পারবে।জগন্নাথ চৌধুরী এলে সে নিশ্চয় বলে দেবে যে,নিশ্চয় বলে দেবে,নিশ্চয় বলে দেবে...।
আধো ঘুমে প্রহ্লাদ শুনতে পেল দূরের থানার ঘড়িতে দুটো বাজার ঘণ্টা বাজছে।তারপর সে আর কিছুই বলতে পারে না। ছোট্ট শিশু যেমন মাকে ধরে তেমনি ললিতাকে জড়িয়ে সে ঘুমের কোলে ঢলে পড়ল।
সকাল বেলা ঘুম ভাঙতেই প্রহ্লাদের রাতের গোটা ব্যাপারটা মনে পড়ল।কিন্তু কথাগুলো তার স্বপ্ন যেন মনে হল।সে সত্যিই কি ভেবেছিল জগন্নাথ চৌধুরীর প্রস্তাবে সম্মতি দেবে? অসম্ভব। সুস্থ মগজে এমন একটা কথা সে নিশ্চয়ই ভাবে নি।হয় সে স্বপ্ন দেখছিল অথবা দিনের ক্লান্তি আর তন্দ্রার জড়িমাতে অবশ করে তোলা এক মানসিক অবস্থাতেই শুধু সে এমন একটা কিছু ভাবতে পেরেছিল। নিজের বুকে হাত বুলোতে বুলোতে সে ভাবল---যে অহংকারকে বুকের রক্ত পান করিয়ে আজন্ম লালন করে এসছি,যে অহংকার আমার দ্বিতীয় প্রাণ তাকে এখন আমি হত্যা করে নিজে কী করে বেঁচে থাকব?
ললিতা বিছানার কাছে এসে ডাক দিল,“ সাতটা বেজে গেল।তুমি বিছানা ছেড়ে উঠবে নি কি?”
“আজ আমার শরীরটা ভালো বোধ হচ্ছে না ললিতা।” প্রহ্লাদ স্ত্রীর আদর পাবার আশায় স্বরটা করুণ করে বলল, “স্নান করার সময় না হওয়া অব্দি আজ আমি শুয়ে থাকব।আমাকে এখানেই এক কাপ চা দাও।”
প্রহ্লাদের শরীর ভালো নেই শুনে ললিতা হঠাৎ অস্থির হয়ে উঠল,“কী হয়েছে তোমার? মাথা ব্যথা করছে? জ্বর হয় নি তো?” কাছে বসে কপালে হাত দিল।
প্রহ্লাদ ললিতার হাতটা নিজের চোখ দুটোর উপর চাপ দিয়ে ধরে বলল,“আমার যে অসুখ করেছে ডাক্তারি শাস্ত্রে তার কোনও নাম নেই ললিতা। কিন্তু তার লক্ষণগুলো তোমাকে বলতে পারি।প্রথম লক্ষণটা এই যে এ অসুখে আক্রান্ত লোকের দিনে রাতে স্ত্রীর আদর পাবার ইচ্ছে যায়।”
“ঠাট্টা করো না।” ললিতা স্বামীর কপাল টিপে দিয়ে বলল,“তোমার সত্যিই কিছু একটা হয়েছে। কপালটা গরম হয়ে উঠেছে।”
প্রহ্লাদ খলখল করে হেসে উঠে স্ত্রীকে বুকের মধ্যে টান মেরে আনবার চেষ্টা করল।ললিতা জোরে বাধা দেবার চেষ্টা করে বলল,“তুমি কি দিনে দিনে বুড়ো হচ্ছ,না শিশুটি হতে চাইছ?ছেলেই তোমার কাঁধের সমান হতে চলল,তবু দিন দুপুরে এসব কাণ্ড করতে লজ্জা হয় না? হঠাৎ যদি ছেলেমেয়ে দুটো এসে পড়ে কেমন লাগবে?”
“খুব ভালো লাগবে।” প্রহ্লাদ বলল,“তুমিই দেখি লোকজনকে বেল থাকো তোমার তিন ছেলেমেয়ে---মানিক, মুনমুন আর শ্রী যুক্ত প্রহ্লাদ হাজরিকা।তাই যদি হয়,তবে বাচ্চামো করবার অধিকার আমার নিশ্চয়ই আছে।”
“দেখি,আমাকে ছাড়ো।তোমার জন্য চা এক কাপ করে আনি।ঘরটার সব কাজ পড়ে আছে।তোমার সাথে বসে বসে রং করে থাকলে আমার সংসার চলে না।”
খানিকক্ষণ পরে চা এক কাপ এনে প্রহ্লাদকে দিয়ে ‘সংসার চালাবার’ জন্যে চলে যাচ্ছিল,খাপ করে প্রহ্লাদ তার আঁচল ধরে বলল,“তুমি যেতে পারবে না।আমার কাছে অল্প বস।”
“তোমার আজ হলটা কী?আমার কাছে বসে থাকলে মানিক মুনমুনের ভাত রেঁধে দেবে কে? স্কুলে যেতে হবে না? স্ত্রীর সঙ্গে এরকম দিনে রাতে প্রেম করে থাকতে হলে ঘরে দুটো চাকর রাখতে হয়।”
“এবার সত্যিই চারক রাখব,জানো?”, প্রহ্লাদ চায়ের কাপ মুখে দিয়ে বলল।
“চাকর রাখবে? কোথাও লটারির টাকা পেলে বুঝি?” ললিতা ব্যঙ্গ করে জিজ্ঞেস করল।
“টাকা শুধু লটারির থেকেই আসে না।তুমি তোমার স্বামী-রত্নটির মূল্য বুঝে না পেলে কী হবে?পাকা জহুরি ধূলি বালিতে পড়ে থাকা এই রত্নটিকে ঠিকই খুঁজে বের করেছে। ... বসই না,খানিকক্ষণ আমার কাছে!”
ললিতা স্বামীর কাছে বিছানায় বসে প্রহ্লাদের চোখে খুব গভীর এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,“আমার একটা কথা সবসময়েই স্বপ্ন যেন মনে হয়।বিশ্বাস করতে মন চায় না।আমাদের বিয়ের ক’বছর হল –তোমার মনে আছে? বারো বছর,পুরো বারো বছর!কিন্তু আজও তুমি আমার সঙ্গে এমন ব্যবহার কর যেন আমাদের বিয়ে হল এই গতকাল। কোনও মেয়ের এতটা সৌভাগ্য কী করে হতে পারে? সত্যি করে বল দেখি তুমি আমার সঙ্গে অভিনয় কর, না সত্যি তোমার মনটা এত সুন্দর?”
চা-কাপটা শেষ করে কাছের টেবিলে রেখে প্রহ্লাদ দু’হাতে ললিতাকে মুখের কাছে টান দিয়ে আনল আর পরিপূর্ণ দৃষ্টিতে ওর চোখ দুটোতে তাকিয়ে বলল, “তোমার প্রশ্ন শুনে আমার সক্রেটিসের একটা কথা মনে এল।একদিন সক্রেটিস বন্ধু একজনকে বললেন,‘কী অবাক করা কথা জান নিকারেটাস বুঝি ওর স্ত্রীকে ভালোবাসে,আর ওর স্ত্রীও বুঝি নিকারেটাসকে ভালোবাসে।স্বামী-স্ত্রী পরস্পরকে ভালোবাসে এর চেয়ে অবাক করা কথা যেন এ পৃথিবীতে আর দুটো নেই।তোমার প্রশ্নটাও এরকমই হল না কি?”
স্বামীর প্রেমপূর্ণ দৃষ্টি আর মধুর কথা ললিতার মনে এমন এক প্রবল আবেগের উথাল পাথাল ঢেউ তুলল যে তার আনখশির দেহটা থরথর করে কেঁপে উঠল।নিপুণ হাতের ছোঁয়ায় সুপ্ত তার মুহূর্তে ঝংকৃত হয়ে উঠার মতো ওর সমস্ত হৃদয় গান গেয়ে উঠল।প্রহ্লাদও মুগ্ধ দৃষ্টিতে ললিতার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখতে পেল---প্রাত্যহিক তুচ্ছতার আবরণ খসে গিয়ে ওর আবেগ বিহ্বল মুখটাতে এমন এক নবীন লাবণ্য ফুটে উঠেছে যে লাবণ্য শুধু প্রেমের আপন হাতে তৈরি। এক অপার্থিব শিল্প কর্ম। সে খুব ধীরে ধীরে ললিতার মুখটা নিজের মুখের কাছে নিয়ে এল। আর দু-হাতে মুখটা ধরে আলতো করে একটা চুমা খেল।ঠিক সে মুহূর্তে মানিক কিছু একটা খুঁজে সে ঘরে চলে এল আর মা-বাবাকে চুম্বনরত দেখে ভূত দেখার মতো দৌড়ে পালাল। ললিতা লজ্জায় মরে যায় আর কি। অর্থহীন কীসব চেঁচামেচি শুরু করে দিল।
কিন্তু কেবল প্রেম আর মানুষকে কদিন আর বাঁচিয়ে রাখতে পারে---ললিতা চলে যাবার পরে প্রহ্লাদ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবল।ললিতার বয়স মাত্র বত্রিশ। অথচ রোগ পরিশ্রম আর অর্ধাহারে ওর অবস্থা দেখলে মনে হয় যেন পঞ্চাশ বছর বয়সের মহিলা।তাদের পাশের বাড়ির জয়ন্ত চৌধুরী ব্যারিস্টারের স্ত্রী অপর্ণা ললিতার সমবয়সী।কিন্তু বিলাস বৈভবে জীবন কাটানো অপর্ণার রূপ আর স্বাস্থ্যের দীপ্তি দিনে দিনে যেন উজ্জ্বল হয়েই চলেছে।দু-জনকে এক সঙ্গে দেখলে মা-ঝি বলেই মনে হয়।প্রহ্লাদের ইচ্ছে যায় তার স্ত্রী দীর্ঘ যৌবনা হয়ে থাক,সুন্দরী আর স্বাস্থ্যবতী হয়ে থাক,বিচিত্র সুন্দর সাজপোশাকে তারও শরীর বিচিত্র সুরে গান করতে থাকুক।তার কি ইচ্ছে হয় না শরীরের সেই শতদল প্রতি প্রভাতে নিতি-নব বর্ণগন্ধে প্রস্ফুটিত হয়ে উঠুক।আর জীবনটাকে নিতি-নব ধারায় প্লাবিত করে রাখুক? কী আদর্শের বেদীতে সে তার সেই অন্তহীন,উদ্দেশ্যহীন, প্রচণ্ড অথচ স্বাভাবিক লোভ বিসর্জন দিয়েছে?এই অর্থহীন,উদ্দেশ্যহীন ত্যাগের দ্বারা কার কী মঙ্গল করছে?... আবার তার মনটা ঘুরে এল জগন্নাথ চৌধুরীর পনেরোশ’ টাকার মাইনের চাকরির প্রস্তাবে।অতি শীঘ্র এ নিয়ে কিছু একটা হেস্ত নেস্ত না করলেই নয়। নিজেকে ফাঁকি দিয়ে কী লাভ?চাকরিটার প্রতি তার প্রচণ্ড লোভ হচ্ছে।জীবনে অনেক সুযোগ সে স্বেচ্ছায় নষ্ট করেছে।দারিদ্র্যের দাসত্ব আর আত্মক্ষয়ী অহংকারের লৌহ বন্ধন থেকে মুক্তি পাবার এই তার শেষ সুযোগ।এ সুযোগ যদি হারায়,তবে এ অভিশাপের থেকে তার আর কোনোদিনই মুক্তি পাবার নিশ্চয়ই কোনও আশা নেই।
****
পর্বতের এক দুর্গম অদৃশ্য উৎসের থেকে একদিন বেরিয়ে এসেছিল এক খরস্রোতা ঝরনা।তার স্রোতের বুকে খসে পড়ছিল এক অখ্যাত পার্বতী শিলা।পথে সে ঝরনা তার মতো করে আরও কত ঝরনার সঙ্গ পেল।আর সব ক’টা মিলে মিশে এক বিশাল নদীর রূপ নিয়ে বিস্তীর্ণ সমভূমি হয়ে সাগর অভিমুখে এগিয়ে গেল।সেই খসে পড়া পাথর টুকরোও সঙ্গে সঙ্গে এগুলো।সে আরও কত পাথরের সঙ্গ পেল।কিন্তু এ ওর গায়ে ধাক্কা খেতে খেতে আঘাতে আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হয়ে অবশেষে সে ক্ষীণকায় মিহি বালু-দানাতে পালটে গেল।সে এমনই পালটাল যে আদিরূপটা কল্পনা করাও দুষ্কর হল।
নিজের বর্তমান অবস্থা কল্পনা করে প্রহ্লাদের প্রায়ই এমনই এক উপমা মনে পড়ে।আজ থেকে পনেরো বিশ বছর আগে সে কী ছিল,আর আজ কী রূপ নিয়েছে?আজ থেকে বিশ বছর আগে যৌবনের গরীয়ান সূর্যোদয়ের শত-ক্লান্ত বর্ণচ্ছটায় উদ্ভাসিত হয়ে সে নিজেকে অনুভব করেছিল একজন দেবতা বলে--- যে সে স্থূলবুদ্ধি ভোগ-সর্বস্ব আর স্বার্থপর সাধারণ দেবতা নয়।সে ছিল প্রমিথিউস!সেই দুর্বিনীত দেবতা---মানুষের দুঃখে যে দেবতার প্রাণ কেঁদে উঠেছিল,মানুষকে মুক্তি দেবার জন্যে যে দেবতা দেবরাজের অন্তহীন ভয়ঙ্কর রুদ্ররোষ বরণ করে নিয়েছিল।সেদিন তার এমন এক অভ্রংলেহি অহংকার ছিল যে সারা পৃথিবীকে শুনিয়ে সে চিৎকার করে বলতে পারত,‘In simple truth, I harbars hate against all the Gods.’সে বলতে পারত,‘For your vile slavery, be assured, never would I change my unhappy lot.’
কিন্তু আজ?মাত্র বিশ বছরের ব্যবধান!ইতিহাসের বিচারে এক চোখের পলকও নয়।কিন্তু আজ মাত্র পনেরোশ’ টাকার চাকরি একটার জন্য,এক গ্রাস বেশি ভাত খাবার লোভে,আর স্ত্রী-সন্তানের হায়ে কাপড় একটুকরো বেশি দেবার জন্যে লালায় তার জিহ্বা ভরে আসছে।শক্তিমানের কাছে নতজানু হয়ে হাতজোড় করতে সে প্রস্তুত হচ্ছে।প্রমিথিউসের কী অবিশ্বাস্য রূপান্তর! কী দুঃসহ করুণ পরিণতি!
ষষ্ঠ শ্রেণির ইংরাজি পাঠ্যপুথিতে পড়া কথা একটা প্রহ্লাদের প্রায়ই মনে পড়ে : Two men looked through the prison bars,one saw the mud and the other stars.জীবনের প্রতি মুহূর্তে এমন ঘটনা ঘটে থাকে।একই ব্যাপার,একই ঘটনার প্রতি মানসিক প্রকৃতি আর অবস্থা ভেদে নানা মানুষের মনে নানা প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়।
গ্রামের সমৃদ্ধ চাষি গুণাভিরাম হাজরিকার দুজন ছেলে ছিল।প্রদ্যুৎ আর প্রহ্লাদ।গুণাভিরাম হাজরিকার নিজের শিক্ষা দীক্ষা বেশি ছিল না;কিন্তু শিক্ষার প্রতি ছিল তাঁর প্রবল অনুরাগ।দুই ছেলেকেই উচ্চশিক্ষিত করে তোলাই ছিল তাঁর জীবনের লক্ষ্য।তাঁর ভাগ্য ভালো যে প্রদ্যুৎ আর প্রহ্লাদও বর্ণপরিচয়ের দিন থেকে পড়াশোনায় অসাধারণ কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছিল।সে জন্য ছেলে দুটোকে পড়াশোনায় সবরকম সুবিধা দিতে গুণাভিরাম কখনও কোনও কার্পণ্য করেন নি।দুই ছেলের জন্যই ভালো গৃহশিক্ষক রেখে দিয়েছিলেন আর সে শিক্ষকের পরামর্শ অনুসারেই তাদের জন্য এক ছোট্ট লাইব্রেরিও করে দেন।
প্রদ্যুৎ তখন ক্লাস সেভেন আর প্রহ্লাদ সিক্সের ছাত্র।বাৎসরিক পরীক্ষা এক মাস থাকতে বাবা দুজনকে কাছে ডেকে বললেন,“তোরা দুজনেই ক্লাসে প্রথম হয়ে আসছিস।আর জানি যে এবারেও হবি।কিন্তু এবার যদি শতকরা আশির উপরে পেয়ে প্রথম হস,তবে আমি একটা করে পুরস্কার দেব।কী চাই তাই বল।”
প্রদ্যুৎ কিছু বলবার আগেই প্রহ্লাদ বলেছিল,“আমার বই চাই বাবা,আর কিছু চাই নে।কিন্তু যে বই আমি বলব,সেটি দিতে হবে।”
বাবার মুখে আনন্দ আর গর্বের হাসি ফুটে উঠল।প্রহ্লাদকে কাছে টেনে মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করলেন।প্রদ্যুতের আর কিছু চাইবার ইচ্ছে ছিল যদিও ছোটো ভাইয়ের বাবার থেকে পাওয়া আদরের পরিমাণ দেখে বলল,“আমারও বই চাই।”
সেবার সেই পরীক্ষায় দুজনেই শতকরা নব্বুইর উপরে পেয়ে প্রথম হল।বাবা ডেকে বললেন,“তোদের কী কী বই চাই লিস্ট করে দে।ডাকে আনিয়ে নেব।”
দুজনেই ম্যাগাজিনের বইয়ের বিজ্ঞাপন দেখে তালিকা করতে বসে গেল।ওদের বাড়িতে ‘আবাহন’ পত্রিকাটা নিয়মিত আসত।প্রদ্যুৎ তাতে তার মনোমতো বইয়ের নাম পেল না। সে সময়কার নতুন প্রকাশিত ‘গোলাই সিরিজ’ নামের গোয়েন্দা কাহিনিগুলো ওর অতি প্রিয় ছিল।গ্রামের লাইব্রেরি থেকে সে বইগুলো এনে পড়েছিল।তারই একটার শেষ পৃষ্ঠাতে সিরিজের সব ক’টা বইয়ের নাম দেখে তালিকা একটা করে সে বাবাকে দিল।অর্ধ্বশিক্ষিত গুণাভিরামের কাছে বই মাত্রেই ছিল পবিত্র বস্তু। তিনি বিনা বাক্য ব্যয়ে প্রদ্যুতের তালিকা মঞ্জুর করলেন।
‘আবাহনে’র বইয়ের তালিকা দেখে প্রথম যে বই গ্রামের হাইস্কুলের ক্লাস সিক্সের ছাত্র প্রহ্লাদ নির্বাচন করল,সেটি হল কার্ল মার্ক্সের ‘কম্যুনিস্ট ম্যানিফেস্টো’র অসমিয়া অনুবাদ।অনুবাদ করেছিলেন কেদারনাথ গোস্বামী।তখনই কেন প্রহ্লাদ এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছিল পরে সে বহুবার ভেবে দেখেছে।তার অশিক্ষিত বাড়িটিতে বা প্রত্যন্ত গ্রামটিতে কার্ল মার্ক্সের নাম সে এর আগে কখনও শুনেনি।দেশ তখনও স্বাধীন হয় নি,গ্রামের লোকের মুখে মুখে ফিরছিল কেবল গান্ধি নেহরু আর সুভাষের নাম। আলোচনার বিষয় ছিল শুধু স্বাধীনতার আন্দোলন।এও ঠিক নয় যে সমাজে চলতে থাকা দারিদ্র্য-শোষণ আর অন্যায় অবিচার তার মনকে বিদ্রোহী করে তুলেছিল আর সে সচেতনভাবে দরিদ্র জনতার মুক্তির কোনও এক পথের সন্ধান করে অবশেষে মার্ক্সকে আবিষ্কার করেছিল।সমৃদ্ধ ঘরে লালিত প্রহ্লাদের পক্ষে সমাজের অন্ধকার দিকটা জানার তখনও সুযোগ হয়নি।তবুও কম্যুনিস্ট ইস্তাহারের প্রতি প্রহ্লাদের আকৃষ্ট হবার সহজ কারণ এটিই ছিল যে বইটার বিজ্ঞাপনের ভাষাতে তার কল্পনা প্রবণ মনটাতে অবুঝ আবেগের এক স্পন্দন তুলেছিল।তখন যে আবেগ ছিল তার কাছে দুর্বোধ্য,আজ সে তার স্বরূপ ভালো বুঝতে পারে।কিছু মানুষের মনে আদর্শের প্রতি এক সহজাত অনুরাগ থাকে।সবার নিশ্চয়ই থাকে না।খুবই ছেলেবেলার থেকে প্রহ্লাদের মনে এক আদর্শের মোহ ছিল;বয়স বাড়ার সঙ্গে যোগ হল ত্যাগ আর দুঃখ বরণের প্রতি এক তীব্র আকর্ষণ,বিদ্রোহ বা বিপ্লবের প্রতি এক রোম্যান্টিক অনুরাগ।নিজের মনটা ভালো করে বিশ্লেষণ করে সে পরে আরও একটা কথা বুঝে উঠেছিল যে তার মনে ছিল সমাজের সংখ্যালঘিষ্ঠের প্রতি এক স্বাভাবিক আকর্ষণ।অর্থাৎ বেশির ভাগ লোকে যেটি ভাবছে বা করছে তা না করে তার বিরুদ্ধে দাঁড়ানো সংখ্যালঘিষ্ঠ দলে যোগ দিয়ে নিজের বৈশিষ্ট্য প্রমাণ করার উগ্র আকাঙ্ক্ষা। সে সময় দেশের স্বাধীনতার জন্য হওয়া বিয়াল্লিশের বিপ্লব তিন বছর আগে শেষ হয়েছিল।দেশে তখন চলছিল স্বাধীনতার জন্য আপোস আর আলাপ আলোচনার চেষ্টা।যে করেই হোক স্বাধীনতা লাভ অবশ্যম্ভাবী বলে লোকে ভাবতে আরম্ভ করেছিল।‘আবাহনে’র পৃষ্ঠায় ‘কম্যুনিস্ট ইস্তাহারে’র বিজ্ঞাপন পড়ে প্রহ্লাদ অনুভব করল ঠিক এই মুহূর্তে কোনও এক বই যদি তাকে বিপ্লবের পথে আহ্বান জানাতে পারে,তার সামনে কারাগারের দ্বার মুক্ত করতে পারে,তার থেকে চরম ত্যাগ দাবি করতে পারে তবে সে বইটি এই। দেশ স্বাধীন হবার সঙ্গে সঙ্গে গান্ধির শিষ্যেরা হবেন শাসক,বিপ্লবের রক্তাক্ত পথে পথ চলবার অধিকার থাকবে কেবল মার্ক্সের শিষ্যদের।যৌবনের দূরাগত পদধ্বনি অনেকের মনে নিয়ে আসে ভোগ বিলাসের স্বপ্ন,কিন্তু আরও অনেকের মনে সে জাগিয়ে তুলে মৃত্যুর সঙ্গে খেলা করার কামনা।প্রহ্লাদ ছিল এই দ্বিতীয় শ্রেণির মানুষ।সে শুধু ‘কম্যুনিস্ট ইস্তাহারে’র নামটা লিখে বাবাকে দিল।
বইয়ের নামটা পড়ে বাবা জিজ্ঞেস করলেন,“এ কেমন বই রে?বইয়ের এমন নাম তো আগে শুনিনি।খুব ভালো গল্পের বই বুঝি?”
প্রহ্লাদ গর্বের সঙ্গে বলল,“গল্প না বাবা,প্রবন্ধের বই। আমার প্রবন্ধ পড়তে বেশি ভালো লাগে।”
যথা সময়ে বইটা ডালে এল,আর প্রহ্লাদ উত্তেজিত হয়ে পড়তে শুরু করল।সত্যি বলতে গেলে আদি অন্ত পড়েও সে বইটার বিন্দু বিসর্গ কিছু বুঝে পেল না।কিন্তু যেটি বুঝতে চাইছিল,তা বুঝতে পারল। বইটা তার উপরে মন্ত্রের মতো কাজ করল। এই ছোট্ট বইটার দুর্বোধ্য শব্দগুলোর মধ্যে মিশে আছে কোনও এক প্রচণ্ড শক্তি সারাজীবন ধরে সে সেই শক্তির সাধনা করবে। বইটার থেকে আর কিছু চায় নি,চাইছিল শুধু একটা স্বপ্ন।কৈশোরের সবচে’ মূল্যবান আর প্রার্থিত সম্পদ।সেই স্বপ্ন সে পেল। বইটা পড়ে শেষ করে নিজেকে নিজে সে বলল,“বড় হয়ে আমি কম্যুনিস্ট হব।”তারপর সে বইটাতে নিজের নাম লিখল : কমরেড প্রহ্লাদ হাজরিকা।
কলেজে গিয়েই সে বিপ্লবী কম্যুনিস্ট পার্টিতে নাম লেখাল।কিন্তু সে কথা পরে হবে।জীবনে সে কী হতে চেয়েছিল, আর কী হল গিয়ে ভেবে ভেবে অতীতের আরও অনেক কথা প্রহ্লাদের মনে আসে।লোকে কথায় বলে, “একই গাছের পান, কীই বা হবে আন।”কিন্তু একই গাছের পান যে কত ভিন্ন হতে পারে তা ভাবলেও অবাক হতে হয়।প্রদ্যুতের সঙ্গে সেই ছেলেবেলা থেকে একটা ব্যাপারে তার ভীষণ মিল ছিল।আর তা হল পড়াশোনায় দুজনেই দারুণ মেধাবী ছিল।কিন্তু আর সবেতেই এক সুমেরু তো অন্যে কুমেরু।প্রদ্যুৎ ছিল পড়াশোনা করে বড়লোক,অন্যদিকে প্রহ্লাদ ছিল ক্ষীণকায়,স্বল্পবাক আর অতিশয় লাজুক।মানুষের সঙ্গকে সে সব সময়েই ভীষণ ভয় পেত।তার একমাত্র সঙ্গী ছিল বই।বই পড়ে পড়ে তার অবস্থা হয়েছিল প্রায় ডন কুইক্সোটের মতো।সে সারাক্ষণ স্বপ্ন দেখত ---একদিন সে হবে জগতের সেরা বিপ্লবী।তার মেঘমন্দ্র উদাত্ত আহ্বান শুনে হাজার হাজার মানুষ ঘরের বাঁধন আরাম শয্যা ছেড়ে বিপ্লবের রক্তাক্ত রাজপথে বেরিয়ে আসবে।তার নাম শুনেই পৃথিবীর অত্যাচারী আর নিষ্ঠুর শাসকবর্গের চোখের ঘুম উড়ে যাবে।কিন্তু যে মানুষটি একদিন সমস্ত পৃথিবীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করবে,তার বিদ্রোহের প্রথম রেওয়াজ নিজের ঘরেই আরম্ভ হয়।প্রহ্লাদেরও হয়েছিল।জীবনের প্রথম বয়সের সেই এক ঘটনা প্রহ্লাদের মনে মুছতে না পারা দাগ বসিয়ে রেখে গেছে।
প্রহ্লাদের ঘরে রমেশ নামের এক চাকর ছিল।প্রায় পাঁচ বছর তাদের ঘরে থাকার পর একদিন সে দশটা টাকা চুরি করে পালাল।প্রদ্যুৎ তখন ক্লাস নাইনে পড়ে।প্রহ্লাদ এইটে।প্রদ্যুৎ ঘোষণা করল যে সে তাকে ধরে এনে কঠোর শাস্তি দেবে। সামান্য একটা চাকরের এমন স্পর্ধা সে কখনও সহ্য করবে না।কাজের অতি প্রয়োজনের সময় চাকরটা পালিয়ে যাওয়াতে বাবারও ভীষণ রাগ উঠল।তিনি প্রদ্যুতকে পুরো সমর্থন দিলেন।
বাবা আর দাদার এ আলোচনায় ঢুলে প্রহ্লাদ বলল,“বাবা, তোমাদের একটা কথা আমার ভালো লাগে নি।রমেশের বাবা খুব বিপদে পড়ে তাকে আমাদের ঘরে এনে রেখেছিল।তাদের দারিদ্র্যের সুযোগে তুমি মাত্র দশ টাকা মাইনেতে তাকে চাকর করে রাখলে।সে খুবই ছোট্ট ছিল তখন।কিন্তু এখন বড় হবার পরেও এতদিনে তার একটাকাও মাইনে বাড়ালে না।সে অন্যত্র বিশ পঁচিশ টাকার চাকরি পেয়ে ভালোয় ভালোয় আমাদের থেকে যেতে চাইছিল। কিন্তু তোমরা নানা ভয় দেখিয়ে সেটাও তাকে করতে দিলে না।প্রতিটা লোকের বুঝি নিজের উন্নতির জন্য চেষ্টা করা আর নিজের পছন্দ মতো কাজ খুঁজে নেবার অধিকার নেই?সে সম্পূর্ণ নিরুপায় হয়ে আমাদের ঘরের থেকে পালিয়ে গেছে।এখন তাকে খুঁজে এনে শাস্তি দেবার কথা ভেবো না।সে বড় অন্যায় হবে।”
প্রহ্লাদের কথা শেষ হবার জন্যে প্রদ্যুৎ কোনোক্রমে ধৈর্য ধরে রাখছিল।শেষ হওয়া মাত্র অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে বলল,“বাহ! বাহ! আজই জানলাম,আমাদের ঘরে একজন ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠিরের অবতার আছেন।দেখ,তোর শরীর যেমন রোগা ---হাঁটতে নুয়ে পড়ে,তোর মনটাও মেয়েদের মতো দুর্বল।আসলে তুই মেয়ে হয়ে জন্মালে বেশি ভালো ছিল।এমন দুর্বল মন নিয়ে আজকের সংসারে করে খেতে পারবিনে,বুঝলি?বইয়ের পোকা তুই যা তোর বইয়ের মধ্যে মুখ গুঁজে পড়ে থাক গে যা! আমাদের কথাতে তুই কথা বলতে আসবি নে।”
দৈহিক স্বাস্থ্য আর রূপের দিক থেকে প্রদ্যুতের কাছে এত নিষ্প্রভ ছিল যে তার মনে এক হীনমন্যতার ভাব গড়ে উঠেছিল। এখন প্রদ্যুৎ নির্মম ভাষাতে তার স্বাস্থ্যের প্রতি কটাক্ষ করাতে অন্তরে সে মরণান্তিক আঘাত পেল।উদ্গত ক্রন্দনটুকু জোর করে সংবরণ করে সে বাবার প্রতি আবেদন জানাল,“বাবা, তুমি কিছু বল না কেন? তুমিও দাদার কথাই কি সমর্থন কর?”
বাবা বললেন,“আমার আবার বলার কী আছে?প্রদ্যুৎ যা বলছে,ঠিকই বলছে।তুই যে আজ রমেশের হয়ে ওকালতি করতে এসেছিস,ওর করাটা তুই সমর্থন করিস না কি?একদিকে ন্যায় অন্যায়ের কথা বলছিস,আর দিকে চুরির সমর্থনে বলছিস যে বড়? প্রদ্যুৎ ঠিকই বলছে।সংসারে তুই যে করে খাবি,সে লক্ষণ দেখছি নে।”
প্রহ্লাদ আজ কিছু দিন থেকে লক্ষ্য করছে যে প্রায় সব কথাতে বাবা আজকাল প্রদ্যুতের প্রতি পক্ষপাত দেখাচ্ছেন। হয়তো তার সুন্দর স্বাস্থ্য,সপ্রতিভ আচরণ আর প্রখর বুদ্ধিবৃত্তি তার এক উজ্জ্বল ভবিষ্যতের ইঙ্গিত দেয়;সংসারের যে কোনও কাজে কৃতকার্য হবার জন্য যেন তাঁর জন্ম হয়েছে।বাবার মনে স্বাভাবিকভাবেই একটা আশার সঞ্চার হয়েছে যে প্রদ্যুতই তাঁর জীবনের স্বপ্নকে বাস্তবে পরিণত করতে পারবে।সে জন্য আজ কাল তিনি প্রহ্লাদের তুলনায় স্পষ্টতই প্রদ্যুতের প্রতি পক্ষপাতিত্ব দেখান।এখন সে কথাটা এত বেশি স্পষ্ট হয়ে পড়ল যে তার মনে হল যেন বুকের মধ্যি দিয়ে একটা শেল এফোঁড় ওফোঁড় করে চলে গেল।
উত্তেজিত হয়ে সে বলল,“বাবা,তুমি যে চুরি করার কথা বলছ,চুরি আসলে করছে কে?আমি বলতে চাইছি,চুরি যদি কেউ করেছে তবে সে তুমি করেছ।একটা ছেলেমানুষকে তার দারিদ্র্যের সুযোগ নিয়ে আজকের দিনে মাত্র দশটাকা মাইনেতে তুমি খাটিয়ে নিয়েছ।রমেশকে তার প্রাপ্যের থেকে বঞ্চিত করে তুমি তার জীবনের সমস্ত আশা আকাঙ্ক্ষা আর স্বপ্নকে চুরি করেছ।চুরি নয়, ডাকাতি করেছ।জীবনে দু-টাকা বেশি রোজগারের জন্যে অন্যত্র সে যেতে চাইছিল।তুমি নানা ভীতি দেখিয়ে তাকে যেতে দিলে না।সে অবস্থাতে পালিয়ে যাওয়া ছাড়া তার আর কী উপায় ছিল?ভেবেছিলাম পৃথিবীতে ক্রীতদাসের যুগ কবে শেষ হল।কিন্তু সে আমার ভুল।আমাদের নিজেদের ঘরেই ক্রীতদাস আছে।তুমি নিজে চোর হয়ে এখন এক অসহায় ছেলের বিরুদ্ধে চুরির অভিযোগ আনাটা তোমার মুখে শোভা পায় না বাবা।বইতে ধনির দ্বারা দরিদ্রের শোষণের যে কথাগুলো লেখা আছে,তার এক জ্বলন্ত উদাহরণ হলে তুমি নিজে।যাই হোক,এখন কিন্তু তোমরা রমেশকে খুঁজে এনে তাকে কোনও শাস্তি দিতে পারবে না।কথা খারাপ হবে,আমি তোমাকে বলে রাখলাম।”
প্রহ্লাদ কথাগুলো বলেছিল।আর রাগে কাঁপতে কাঁপতে বাবা তার কথাগুলো শুনছিলেন।এখন তার কথাগুলো শেষ হতে না হতে তিনি তার গালে এক প্রকাণ্ড চড় মেরে বললেন,“দৈত্য কুলে তুমি বেশ,প্রহ্লাদ হয়ে দেখা দিয়েছ,না? আমার ধন সম্পত্তি যদি চুরি করে করা জিনিস হল,তবে তুই তার উপরে বসে বসে খাচ্ছিস কেন?আজই তুই আমার ঘর থেকে বেরিয়ে যা। ... প্রদ্যুৎ দেখছিস কী?এখনই গিয়ে ঐ খেতে না পাওয়া কুকুরটাকে খুঁজে পেতে বেঁধে নিয়ে আয়।সুপুরি গাছে বেঁধে চাবুক পেটা করে আমি ওর পিঠের ছাল-বাকল তুলব।কী খারাপ কথা হয়,দেখব।ঠোঁট চাপলে এখনও দুধ বেরোয় সে তার বাবাকে কিনা শোনায় সতর্কবাণী।”
প্রহ্লাদদের ঘরে একটা বড় ঘোড়া ছিল।প্রদ্যুৎ ঘোড়ায় চড়তে খুবই পাকা।সুন্দর পোশাক আসাক পরে সে যখন ঘোড়া ছুটিয়ে যায় দেখে মনে হয় বুঝিবা রাজকুমার যাচ্ছে।পথের পথিকরা ফিরে ফিরে চায়।বাবার কথাগুলো মাত্র সে ভেতরে গিয়ে সাজ পোশাক পরে হাতে চাবুক একটা নিয়ে বেরিয়ে এল।উঠোনে এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে প্রহ্লাদের দিকে বাঁকা চোখে চেয়ে কটাক্ষ-বাণ ছুঁড়ল। তারপরেই ঘোড়ার পিঠে এক লাফে উঠে পলাতক ক্রীতদাসের সন্ধানে বিদ্যুৎ বেগে ছুটে চলল।
প্রহ্লাদ দুপুরে ভাতটাত না খেয়ে শুয়ে থাকল।
বেলা পড়ে গেলেও প্রহ্লাদ শুয়েই রইল।বাইরে হঠাৎ হুলুস্থূলু শুনে কী হয়েছে দেখবার জন্য সে বেরিয়ে এল।বেরিয়ে দেখে প্রদ্যুৎ তার অভিযানে সফল হয়েছে।রমেশকে সে ধরে এনেছে আর তাই দেখবার জন্যে উঠোনে লোকজন ভিড় করেছে। প্রদ্যুৎ ইতিমধ্যে রমেশকে উত্তমমধ্যম শাস্তি নিশ্চয়ই দিয়েছে।তার সারা গায়ে এর দাগ পড়েছে।কিন্তু এর পরেও বাবা তাকে সুপারি গাছে বাঁধার হুকুম দিলেন।রমেশ বলির পাঠার মতো ভয়ে কাঁপছিল।প্রহ্লাদের চোখের সামনে সত্যি তাকে সুপারি গাছে বাঁধা হল।সে আর ধৈর্য ধরতে পারল না।বাবার কাছে গিয়ে বলল,“বাবা রমেশ দোষ একটা করেছে মানছি।কিন্তু সে পাঁচ বছর আমাদের ঘরে থেকে মানুষের মতো হয়ে গেছে।তোমার কি হৃদয় বলে কিছু নেই?যদি তুমি রমেশকে এখন কোনও শাস্তি দাও তবে জেনে নিও,আজ থেকে আমি আর তোমার ছেলে নই।এ ঘরে আর জল এক ফোঁটাও আর আমি ছোঁব না। না খেয়ে মরে যাব, তবু।
বাবার হুকুম পাওয়া মাত্র প্রদ্যুৎ চাবুকের কোপটা বসিয়েই দিল।সঙ্গে সঙ্গে রমেশ পশুর মতো আর্তনাদ করে উঠল। প্রহ্লাদ দৌড়ে ভেতরে গিয়ে আবার বিছানায় পড়ল।
পুরো তিনদিন কিচ্ছুটি না খেয়ে সে বিছানায় পড়ে রইল।অবশেষে সে অবশ্য অনশন ভাঙতে বাধ্য হল,কেননা সাথে করে মা-ও জল স্পর্শ বাদ দিয়েছেন।কিন্তু সেই ঘটনার পর বাবা আর দাদার সঙ্গে তার যে মনোমালিন্যের সূচনা হল জীবনে কখনো এর অন্ত পড়েনি।
কলেজে গিয়ে কম্যুনিস্ট পার্টিতে যোগ দিয়ে সে আরও একটা কাণ্ড করল।একবার বন্ধে ঘরে এসে সে বাবাকে বলল, “তুমি বেঁচে থাকতে জমি বাড়ি আমার আর দাদার মধ্যে ভাগ করে দেবে কি?”
সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে বাবা বললেন,“কেন? নিজের ঘর সংসার না হতেই তুই আলাদা হতে চাস নিকি? তোর মতলবটা কী?”
বাস্তববুদ্ধিহীন প্রহ্লাদ বলল,“আমি ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে বিশ্বাস করি না।আমার ভাগের জমি বাড়ি আমি আধিয়ারদের মধ্যে ভাগ করে দিতে চাই।”
অট্টহাস্য করে বাবা বললেন,“পাগল আর কি!কেউ এসে কি গৃহস্থকে বলে কখনও,আপনি আমাকে সিন্দুকের চাবিটা দিয়ে খানিকক্ষণ চোখ বোজে থাকুন তো,আমি আপনার ঘর থেকে সোনাদানা চুরি করে নিয়ে যেতে চাইছি।এই বুদ্ধিতে তুই সংসারে করে খেতে চাইছিস,হ্যাঁ?যা করলি ভালোই করলি।আমার জমিজমার এক কণাও তুই পাবি না।সব আমি প্রদ্যুতের নামে লিখে রেখে যাব।
অবশ্য গুণাভিরাম হাজরিকা এই এক ব্যাপারে নিজের কথা মতো কাজ করেন নি।তাঁর মৃত্যুর পর দেখা গেল জমি জমা তিনি সবই দুই ছেলের নামে সমানে লিখে রেখে গেছেন।
প্রদ্যুৎ তখন পুলিশ সুপার।আর প্রহ্লাদ শিবসাগর জেলার কোনও এক ভেঞ্চার স্কুলের শিক্ষক।বাবার মৃত্যুর পরে পরেই সে নিজের ভাগের জমিজমা আধিয়ারদের মধ্যে ভাগ করে দিল।প্রদ্যুৎ তার ভাগের মাটি বিক্রি করে ডিব্রুগড়ে পাকা বাড়ি একটি সাজিয়ে তুলল।
অতীতের কথাগুলো আজ নতুন করে প্রহ্লাদের মনে পড়ছে।একই মা-বাবার দুটো সন্তান—অথচ তাদের আদর্শ ও অভীপ্সা ছিল কত আলাদা।প্রদ্যুৎ চাইছিল শুধু ধন,মান,ক্ষমতা,বিলাস সম্ভোগ।যেমনটি চায় লোকে তেমনটি সব কি আর পায়? প্রদ্যুৎ কিন্তু পেয়েছে।সে পুলিশের বড় সাহেব।বিরাট তার ঘর।উপচে পড়া বিলাস সামগ্রী।সুন্দরী পত্নী।কী নেই তার!আঙুলের মৃদুতম সংকেতে দশ-বারোটা সেপাই গৃহ ভৃত্যের মতো তার সেবা করবার জন্য তৈরি।প্রহ্লাদ সেসব কিছুই চায় নি।সে শুধু চাইছিল জীবনের কোনও এক মহৎ আদর্শের সাধনায় পুরো জীবন উৎসর্গ করতে।আর যেহেতু ত্যাগ ছাড়া কেউই আদর্শের সাধনা করতে পারে না সে জন্য সম্ভবপর সমস্ত ত্যাগ করতেও সে তৈরি ছিল।ত্যাগ নিশ্চয়ই সে করেছে।নিজের প্রতিভাকে কেবল বৈষয়িক স্বার্থের জন্যে কোনোদিন সে প্রয়োগ করেনি।নিজে বেছে নেওয়া পথে সে তাকে সমাজের কাজেই লাগিয়েছে। পৈত্রিক সম্পত্তির উপর সে সারাজীবন বসে খেতে পারত,কিন্তু সেটুকুও ত্যাগ করে সে দারিদ্র্যে আর দুঃখ বরণ করে নিয়েছে। কিন্তু সারা যৌবন আদর্শের সাধনাতে অতিবাহিত করে আর তার কী উপলব্ধি হচ্ছে?আর তার মনে কেন ক্লান্তি এসেছে? কেন আজ সে জগন্নাথ চৌধুরীর ফাঁদে নিজেই ধরা দিতে যাচ্ছে?
প্রদ্যুৎ জীবনে যা চেয়েছিল তাই পেয়েছে।সে সম্পূর্ণ!পরিতৃপ্ত।কিন্তু প্রহ্লাদ জীবনে যা চাইছিল,তাই পেয়েছে কি? আদর্শের সাধনা তাকে অবিমিশ্র আনন্দ দিতে পারল কি? কখনও কোনও মুহূর্তে সে অন্য এক জীবনের প্রতি প্রলুব্ধ হয় নি?
নিজেকে পরীক্ষা করে দেখার এক বড় সুযোগ প্রহ্লাদের হয়েছিল। প্রদ্যুৎ তখন যোরহাটের পুলিশ সুপার।প্রায় পাঁচ বছর দু-জনের মধ্যে দেখাদেখি দূরের কথা পত্রালাপ পর্যন্ত ছিল না।হঠাৎই একদিন প্রহ্লাদ প্রদ্যুতের থেকে একটা চিঠি পেল, “তোদের অনেকদিন দেখিনি।একবার দেখতে মন যাচ্ছে।আগামী জানুয়ারির ২১শে বাবার বাৎসরিক শ্রাদ্ধের দিন।তোরা সবাই আমাদের ঘরে কদিন থাকবি বলে আসবি। শ্রাদ্ধটা এক সাথে করব।”
প্রহ্লাদ কখনও মা-বাবার শ্রাদ্ধ করে না।কারণ সেসব সংস্কারে তার বিশ্বাস নেই।কিন্তু প্রদ্যুতকে দেখার খুব ইচ্ছে তার হল।হাজার হোক সহোদর ভাই।ললিতাও কোনও আপত্তি করেনি।সে বলল,“আর কিছু না হলেও দুদিনের জন্যে তুমি বিশ্রাম পাবে।দুবেলা দুটো খাবার জোটাতে যে অমানুষিক পরিশ্রম করছ,কোনোদিন না অসুখ করে বিছানায় পড় সেই চিন্তায় আমার ঘুম গেছে।”
প্রদ্যুতের ঘরে গিয়ে বিলাস সম্ভোগের আতিশয্যে তাদের দিশেহারা হবার উপক্রম হল।প্রদ্যুৎ ভোগী মানুষ।বিচিত্র সুখাদ্য তার জন্যে জীবনের আনন্দের এক প্রধান উৎস।দাসদাসী ঘেরা নবাবের মতো তার আরাম পুষ্ট জীবন।এমনি যে পায়ের জুতা দুটোও তার নিজেকে খুলতে হয় না।পুরো ঘরটাতে এক ক্লান্তিহর মধুর নীরবতা।ঘরে ঘরে দামী কোমল কার্পেট পায়ে হাঁটার মৃদুতম শব্দটাকেও শোষণ করে নেয়।সন্ধ্যাবেলা স্কচ-হুইস্কির গ্লাস হাতে নিয়ে প্রদ্যুৎ আরাম করতে বসে। রেডিওগ্রামে তখন বাজতে থাকে মোজার্টের সিম্ফনি বা রবীন্দ্রসঙ্গীত।প্রদ্যুতের স্ত্রীর দামী শাড়িতে আবৃত সুন্দর সোনালি শরীর প্রতি মুহূর্তে বিচ্ছুরণ করে মদির সুরভি।সৌন্দর্যের দীপ।ইন্দ্রিয় সঞ্জাত উত্তেজনার অতীন্দ্রিয় উত্তাপ—“Beautiful idle woman blossoming before him like flower of flesh.”
এক সপ্তাহ প্রদ্যুতের ঘরে থেকে প্রহ্লাদরা আবার নিজের দারিদ্র্যের মাঝে ঘুরে এল।
ঘরে যেদিন এল সেই সন্ধ্যায় বিছানায় শুয়ে শুয়ে প্রহ্লাদ কিছু একটা ভাবনায় তন্ময় হয়ে আছে দেখে ললিতা জিজ্ঞেস করল,“এত অন্যমনস্ক হয়ে কী ভাবছ?দুবার ডাকলাম,কানেই গেল না যে? দাদাদের বাসাতে এক সপ্তা ভোগ বিলাসের মধ্যে কাটিয়ে এসে এখন নিশ্চয়ই তুমি অনুতাপ করছ?ভাবছ যে তোমার জীবনটা বৃথাই গেল? ইচ্ছে করলে তুমিও তো এমন এক সুখী বিলাসী জীবন পেতে পারতে। হ্যাঁ কি না?”
“সে প্রশ্নটা আমি তোমাকেই করব বলে ঘরে ফিরে আসা অব্দি অপেক্ষা করছিলাম।” প্রহ্লাদ সস্নেহ দৃষ্টিতে ললিতার মুখে তাকিয়ে বলল,“দাদাদের বাসায় থাকার সময় বৌদি আমার মুখের সামনেই বলে ফেলেছিল,‘প্রহ্লাদ তুমি ললিতার অবস্থাটা কী করেছো দেখেছ?এ যুবতি বয়সে ওর যে হাড় মাস ক’টা গুনা যাচ্ছে।তার উপর যে কাপড় পরে আমাদের ঘরে এসেছে, সে তো আমাদের ঘরে কাজ করা বিহারি মেয়ে লোকটাও পরে না।”ললিতা আমি দেখছি শুধু শুধুই এক আদর্শের নামে এই দারিদ্র্য বরণ করে নিয়েছি।অহংকারের বেদীতে নিজের জীবনটা উৎসর্গ করেছি।কিন্তু তুমি নিজে কী পেলে?তোমার দিদিদের মতো ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ারকে বিয়ে করলে না বলে আজ তোমার অনুতাপ হয় না?”
“হয় না।” ললিতা প্রহ্লাদের বিছানায় বসে তার চুলে আঙুল বুলিয়ে বললে,“কারণ দিদিরা ভালো খেতে পাচ্ছেন, ভালো পরতে পারছেন,মটর গাড়ি দৌড়চ্ছেন,ছেলেমেয়েকে দুন পাবলিক স্কুলে পড়াচ্ছেন।কিন্তু আমি যে জিনিস পেয়েছি,যা পেলে অন্য সব কিছুই তুচ্ছ হয়ে যায়,যা না পেলে অন্য সব পাওয়া অসার---সেটি তারা পান নি।”
“বাহ! বাহ! আকাশবাণী গুয়াহাটি কেন্দ্রের নাটকে যেন অভিনয় করছ।” প্রহ্লাদ ললিতাকে বুকের মধ্যে টেনে নিল, “আরও এক ধাপ এগিয়ে গিয়ে মৈত্রেয়ীর মতো বললে না কেন,‘যেনাহাং নামৃতস্যাম,কিমহং তেন কুর্য্যাম?’” সে দেব দুর্লভ বস্তুটি কী জানতে পারি কি?”
ললিতা প্রহ্লাদের বুকে মুখ লুকিয়ে বলল,“ নিশ্চয় পারো।সে বস্তুটা হল তোমার প্রেম। বিয়ের পনেরো বছর পরেও দিদিদের তাদের স্বামীরা দিনে দশবার এমন করে বুকে টেনে নেয় না। সব মানুষই দিনে দিনে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যায়;প্রতি মুহূর্তে তিলে তিলে তাদের মৃত্যু হয়।যৌবনের আবেগ,আদর্শপরায়ণতার অহংকার—এ সবই একদিন পরিণত হয় অতীতের ফেলে দেওয়া আবর্জনায়।কিন্তু তুমি আমাকে অবাক করে দিয়েছ।প্রতি ভোরেই তুমি নতুন করে জন্ম নাও।বেশিরভাগ লোকেরই জীবনে একবার মাত্র বসন্তকাল আসে।তারা জীবনে Renewal, Refreshment, Rebirth কী বস্তু দ্বিতীয়বার চিনতেই পারে না।কিন্তু তোমার আছে প্রতিদিনই নিজেকে নতুন করে সৃষ্টি করতে পারবার দুর্লভ ক্ষমতা।এইই হল অমৃত।আর যে মানুষ অমৃতের স্বাদ পেয়েছে একবার তার আর কোনও কিছুর প্রতি লোভ থাকে না।
প্রহ্লাদের ঠোঁটের হাসি হঠাৎ মিলিয়ে গেল।ললিতার পিঠে হাত বুলিয়ে দিয়ে সে গম্ভীর স্বরে বলল,“ললিতা তুমি বোধহয় নিজেকে মোহাবিষ্ট করছ,প্রতারণা করছ।আজ আমার কি মনে হচ্ছে জানো?যে আদর্শে আমি নিজেকে জীবনের সব সুখ –স্বাচ্ছন্দ্যের থেকে বঞ্চিত করেছি,আর তোমার মাথাতেও দারিদ্র্যের দুর্বহ বোঝা তুলে দিয়েছি,সে আদর্শকে বাস্তবে রূপায়িত করবার জন্য বাস্তবে আমি কিছুই করি নি।জীবনটা শুরু করেছিলাম মার্ক্সবাদী বিপ্লবী হয়ে।কিন্তু আমার সে বিপ্লবের স্বপ্ন আজ কোথায় গেল? দু-পা এগোতে না এগোতে আমার ক্লান্তি এল।আর আজ যে সংগ্রাম করছি সে শুধু আমার নিজের বেঁচে থাকার সংগ্রাম। যে সংগ্রাম মোটে বা রিকশাওয়ালা একজনও করছে।”
“মিথ্যে বলে অহেতুক নিজেকে শাস্তি কেন দাও?” ললিতা মাঝে ঢুকে বলল,“পৃথিবীর আর কেউ না জানলেও আমি তো অন্তত জানি যে তুমি অন্তত প্রতিবাদের স্ফুলিঙ্গ একটা হলেও জ্বালিয়ে রেখেছ।অন্যায়ের সাথে আপোস করতে অস্বীকার করে ন্যায়ের আদর্শের পুজো করছ।আর কিছু না হলেও অন্তত একটা স্বপ্নকে বাঁচিয়ে রেখেছ।পৃথিবীতে এইটুকুনই বা কজনে করে?হতে পারে বর্ষার ভরা নদীর তুলনায় তুমি বৃষ্টির জলবিন্দু মাত্র।কিন্তু প্রকৃতির বিচারে সে জলবিন্দুও মূল্যহীন নয়।মানুষ কাঠের মূল্য দেয়,ফুলের মূল্য দেয়,ফলের মূল্য দেয়---কিন্তু গাছের পাতা মানুষের চোখে সম্পূর্ণ মূল্যহীন।অথচ হাজারো বছর ধরে এই গাছের পাতাও নিজে পচে মাটিকে উর্বর করে।নতুন জীবনের জন্য জমি তৈরি করে।ইতিহাস তো আর কজন বীরের সৃষ্টি নয়,যদিও তাদের নামই ওখানে লেখা মেলে।নীরবে সবার নজরের অলক্ষে পচা গাছের পাতার মতো কোটি কোটি অনামা নগণ্য মানুষ যদি নিজের নীরব আত্মদান আর সহজ কাজ দিয়ে পৃথিবী উর্বর করে না রাখত, তবে সে কবেই মরুভূমিতে পরিণত হত।জীবনে মানুষের কখনও পুরস্কার,প্রতিদান আর স্বীকৃতির আশাতে কাজ করা উচিত নয়।
ললিতাকে বুকের মাঝে নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ প্রহ্লাদ নীরব আর নিশ্চল হয়ে পরে রইল।আবেগের আবেশ নেমে যাবার পর বলল,“তোমার তো খুব অহংকার জীবনে কখনও মিথ্যে বল নি।কিন্তু আজ বললে।আমি নিজেকে কখনও প্রতিদিন সৃষ্টি করিনি। সেটি করে আসছ তুমি। ওয়ার্ডসওয়ার্থ নিশ্চয় তোমার কথা ভেবেই লিখেছিলেন
A perfect woman nobly planned
To warn, to comfort and command;
And yet a spirit still and bright
With something of angelic light.
বাংলার কবি বুদ্ধদেব বসুও লিখেছেন,‘দিলে তুমি দিতে পারো ঈশ্বরেরও বেশি।’একজন ভালো মহিলা যে এক একটা মানুষের জীবনে কী মিরাকল ঘটাতে পারে,সে কথা আমার মতো এক ভাগ্যবানের বাইরে আর কে বুঝবে?তবুও ললিতা, মাঝে মাঝে আমার মনে প্রচণ্ড অপরাধ বোধ হয়।তুমি আমার তথাকথিত আদর্শের নামে মার্টিয়ারডম বরণ করে নিয়েছ।কিন্তু আমি ভাবি,আমি আসলে চেকভের ‘Uncle Vaniya’ নাটকের সেই লেখক নয় তো?সেই লেখক গোটা জীবন ধরে একটা বই লেখার নামে স্ত্রীর মাথায় দুর্বহ দারিদ্র্য আর দুঃখকষ্টের জীবন তুলে দিয়েছিল।স্ত্রীও ভাবছিল যে প্রতিভাবান স্বামীর সাধনাকে সফল করে তুলবার জন্য এটুকু ত্যাগ স্বীকার তার পবিত্র কর্তব্য। কিন্তু শেষে দেখা গেল মানুষটার অণুমাত্র প্রতিভা ছিল না।পুরো জীবন জুড়ে সে সৃষ্টি করল মাত্র কিছু আবর্জনা।অথচ তার জন্যই এক মহিলার গোটা জীবন নষ্ট হয়ে গেল।তুমি কেমন করে বলতে পারো যে আমিও ঠিক তাই করছি না?”
ললিতা স্বামীর আলিঙ্গন থেকে নিজেকে মুক্ত করে বিছানায় বসে বলল,“আমি সবসময়েই বলে আসছি না যে তুমি একটা মেসোকিস্ট। আবোলতাবোল বকা এখন বাদ দাও।আমার রাঁধতে যাবার সময় হল।দাঁড়াও তোমার প্রথম প্রশ্নটা ছিল, “আমরা দাদাদের ঘর থেকে কী শিক্ষা নিয়ে এলাম? তুমি কি বলছ এ নিয়ে?”
প্রহ্লাদ নাটকীয় ভাবে বলল,“দাদার সফলতার চে’ আমি আমার ব্যর্থতাকে বারবার বরণ করে নেব।স্থূল ভোগ আর ঐশ্বর্যের সেই কারাগারে মানুষের স্বপ্ন আর স্বর্গীয় অতৃপ্তির তিলে তিলে মৃত্যু ঘটে।সে ক্ষয়ে ক্ষয়ে শেষ হয়ে যায়।আমি মুক্ত পথিকের মৃত্যু বরণ করতে চাই।কারাগারের কয়েদীর মৃত্যু নয়।”
বিছানায় শুয়ে শুয়ে কেবল দিবাস্বপ্ন দেখে থাকলেই বা নিজের সঙ্গে নিভৃত আলাপ করে থাকলে প্রহ্লাদের পেটের ভাত জোটে না।বিকেল হতেই তাকে কাজে বেরিয়ে যেতে হল।জগন্নাথ চৌধুরী আরও দুদিন পরে আসবে।কোনও একটা সিদ্ধান্ত নেবার জন্য তার হাতে এখনও অনেক সময় আছে।তার উপর তার ভাগ্য ভালো যে ললিতা কালকের প্রসঙ্গ এখনও উত্থাপন করে নি।বেচারি মনে হয় কথাটা ভুলেই গেছে।
অফিসে সম্পাদক বললেন,“ইন্ডিয়ান সায়েন্স কংগ্রেসের আগামী বছরের অধিবেশন গুয়াহাটিতে বসার কথা আছে। অভ্যর্থনা সমিতির সম্পাদক ড০অরুণ চৌধুরী আমাকে অল্প আগে ফোনে বললেন,সে সম্পর্কে বুঝি কি একটা খবর দেবার আছে কালকের কাগজে না গেলেই নয়।আমি আপনাকে তাঁর ওখানে পাঠিয়ে দেব কথা দিয়েছি।যান তো,চট করে ওঁর ওখান থেকে গিয়ে আসুন।
ড০চৌধুরী গুয়াহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক।জালুকবাড়ি থাকেন।বিকেল চারটা নাগাদ প্রহ্লাদ গিয়ে ওর ঘরে পৌঁছল।তাকে বসতে দিয়ে ড০চৌধুরীর স্ত্রী বললেন,“আপনাকে অল্প বসতে হবে।উনি পুজোয় বসেছেন।”
“পুজোয় বসেছেন?” প্রহ্লাদ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, “এ বিকেল বেলা পদার্থ বিজ্ঞানের অধ্যাপক ল্যাবরেটরিতে না থেকে পুজোয় বসেছেন?”
ড০চৌধুরীর স্ত্রী অপ্রসন্ন হয়ে মুখে বললেন,“পদার্থ বিজ্ঞানের অধ্যাপক হলেও তিনি মানুষ,জানোয়ার তো নন।পদার্থ বিজ্ঞানের অধ্যাপক হলেন বলেই কি জীবন থেকে গুরু গোস্বামীদের বাদ দিতে হবে?আপনাকে ঘণ্টা খানিক বসতে হবে।না হলে ঘুরে ফিরে ঘণ্টা খানিক পরে আসতে পারেন।”
প্রহ্লাদের যাবার জায়গা ছিল না।সে বসে রইল।বসে বসে আধা ঘণ্টা খানিক পরে তার বেজার লেগে গেল।এক ঘণ্টা পরে যখন তার ধৈর্যচ্যুতি ঘটার উপক্রম হয়েছিল,ঠিক সেই সময় ড০ অরুণ চৌধুরী বেরিয়ে এলেন।তাঁর পরনে একটা ধুতি, খালি পা,খালি গায়ে একটা চাদর,আর কপালে ছাইয়ের এক মস্ত ফোঁটা।প্রশান্ত সহাস্য মুখে তিনি বললেন,“ক্ষমা করবেন, আপনাকে অনেকক্ষণ বসিয়ে রাখলাম। আমি এসময় রোজই ‘বাবা’র পূজাতে বসি।”
প্রহ্লাদ কোনও কিছুই না জানার ভান করে বলল, “কোন বাবা?” ড০চৌধুরী চোখ দুটো মুদে বিড়বিড় করে কোনও এক নাম স্মরণ করলেন।তারপর বললেন,“গেল বছর হায়দ্রাবাদে বিজ্ঞান কংগ্রেসের অধিবেশন বসেছিল।সেখানে গিয়েই ঘটনাচক্রে বাবার সঙ্গে সাক্ষাৎ হল।ওসমানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অধ্যাপকের সৌজন্যে।ভগবানের অপার করুণা প্রহ্লাদবাবু, সেই সাক্ষাৎ আমার জীবনের গতি একেবারে পালটে দিল।আজ আমি অন্তরে যে শান্তি অনুভব করছি তাকে আমি ভাষায় বোঝাতে পারি না।আপনাকে বলি,পারলে আপনিও একবার গিয়ে বাবার আশীর্বাদ নিয়ে আসবেন। জীবনে যে শান্তি পাবেন—এর কোনও তুলনা নেই।
প্রহ্লাদ বলল,“ড০চৌধুরী আপনি শান্তি পেয়েছেন শুনে ভালো লেগেছে।আমার যদি জীবনে কখনও শান্তির প্রয়োজন পড়ে তখন আপনার উপদেশ স্মরণ করব।কিন্তু আপাতত বাবার সম্বন্ধে আপনাকে দুটো প্রশ্ন করি,অবশ্য আমার কৌতূহলটা নেহাতই সাংবাদিক সুলভ।মূলত কী কী কারণে বাবা আপনাকে আকর্ষণ করলেন?তাঁর চরিত্র মাহাত্ম্য,ব্যক্তিত্ব,ধর্মজ্ঞান না আর কিছু?”
ড০ চৌধুরী ভাবলেন প্রহ্লাদ বোধ হয় ‘বাবা’র প্রতি আকৃষ্ট হতে শুরু করেছে।‘বাবা’র জন্য আরেকজন ভক্ত সংগ্রহ করতে পারার সম্ভাবনা দেখে তিনি হঠাৎ উৎফুল্ল হয়ে উঠলেন।পরম উৎসাহে বলতে শুরু করলেন,‘চরিত্র মাহাত্ম্য বা ব্যক্তিত্বটা নিশ্চয়ই আছে।কিন্তু আরও হাজারজন মানুষেরও সেটা থাকতে পারে।কিন্তু বাবার প্রধান আকর্ষণ এটাই যে ‘ভগবানে’র পূর্ণ অবতার।আজকের এ চরম সংশয়বাদ আর অবিশ্বাসের যুগে শুধু চরিত্র মাহাত্ম্যে মানুষকে ঈশ্বরের পথে আকর্ষণ করা যায় না। পৃথিবীর থেকে দিব্য শক্তি এখনও সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয় নি,এক একজন অবতারী পুরুষের মধ্যে তার পূর্ণ প্রকাশ ঘটে---মানুষকে সে কথা প্রমাণ করে দেখাতে হবে।এমনকি যিশুখ্রিস্টও মানুষকে ঈশ্বরের পথে টানতে মিরাকলের আশ্রয় নিয়েছিলেন।বাবার মধ্যে আমি সেই দিব্য-শক্তির পূর্ণ প্রকাশ দেখলাম।শূন্যে হাত মেলে তিনি যখন বিভূতি সৃষ্টি করে দেখালেন।আমরা সবাই তাকিয়ে থাকতে থাকতেই যখন বাবার উপর পুষ্পবৃষ্টি হল।শূন্য থেকেই দশটা হাতঘড়ি বের করে উপহার দিলেন।তখন এমন কোনও নরাধম থাকতে পারে কি---যার মাথা এ সাক্ষাৎ মানব দেবতার চরণে আভূমি নত না হবে?আমার মনের সমস্ত সন্দেহ আর অবিশ্বাস মুহূর্তে মিলিয়ে গেল,ঠিক যেমন করে সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে রাতের অন্ধকার মিলিয়ে যায়।ঈশ্বরহীন হৃদয় মরুভূমির বাইরে আর কিছু নয় প্রহ্লাদবাবু।আপনি যদি ঈশ্বরকে পেতে চান,তবে অবিশ্বাসী আর সংশয়বাদী এই বিশ শতকেও মিরাকল খুঁজে পেতে চান তবে একদিনও দেরি না করে একবার বাবার দর্শন করে আসুন গে। আমার কথার হাতে হাতে প্রমাণ পাবেন।”
প্রহ্লাদ মুহূর্ত খানিক নীরব রইল।ড০ চৌধুরী ভাবলেন,তাঁর কথাগুলো ইতিমধ্যে প্রহ্লাদের উপর মন্ত্রশক্তির মতো কাজ করতে আরম্ভ করেছে।অসমে বাবার ভক্তের সংখ্যা আরেকজন নিশ্চয়ই বাড়ল।প্রহ্লাদ হঠাৎ বলে উঠল,“ড০ চৌধুরী আমিও মিরাকলে বিশ্বাস করি।আমি নিজের চোখে মিরাকল দেখেছি।আর সে মিরাকল যে মানুষ করেছে আমি তাঁকে সহস্রবার প্রণাম করি।”
ড০ চৌধুরী উচ্ছ্বসিত হয়ে বললেন,“আমি আপনাকে দেখেই বুঝেছি প্রহ্লাদবাবু,আপনি নিশ্চয়ই একজন আধ্যাত্মবাদী ভক্তি পরায়ণ মানুষ।আপনি সাধারণ মানুষ নন।বলুন তো বলুন,আপনার গুরু কে? কী কী মিরাকল আপনি দেখেছেন? এসব কথা শোনাও পুণ্যের কাজ।”
“আপনি ঠিকই বলেছেন ড০ চৌধুরী।” প্রহ্লাদ শান্তভাবে বলল,“আমি অজস্র মিরাকল দেখেছি আর শুনেছি। আমরা যে দুজন মিরাকলের কথা বলে বলে এখন বসে আছি ঠিক এখন আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশযান জুপিটার কোটি কোটি মেইল অতিক্রম করে বৃহস্পতির আকাশমার্গে গিয়ে প্রবেশ করছে।আর কবছরের মধ্যে সে সৌরজগৎ পার করে মহাকাশে যাত্রা করবে। আমাদের পৃথিবী এক বিশ্বের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র গ্রহ; এই গ্রহের পিঠে বসে অণু পরিমাণ এই মানুষ নামের জীবটা কোটি কোটি আলোকবর্ষ দূরের মহাকাশের স্বরূপ সন্ধান করছে---এর চে’ বড় মিরাকল কিছু আছে কি?ঠিক এই মুহূর্তে পৃথিবীর শ’ শ’ গবেষণাগারে জেনেটিক্স বা প্রজনন-তত্ত্বের বিষয়ে এমন কতকগুলো অবিশ্বাস্য গবেষণা হচ্ছে যার ফলে মানুষ প্রাণ সৃষ্টির প্রক্রিয়াতেও হস্তক্ষেপ করতে পারবে আর নিজের ইচ্ছে অনুযায়ী নতুন নতুন জীব সৃষ্টি করতে পারবে। এর চেয়ে বড় মিরাকল কী আছে? পৃথিবীর শত শত গবেষণাগারে কৃষি বিজ্ঞানীরা আজ অধিক ফসল দিতে পারা বিচিত্র শস্যের বীজ উদ্ভাবন করছেন। যা না করলে পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষ ইতিমধ্যে দুর্ভিক্ষের মুখে পড়ত।হাজার হাজার বছর ধরে কত সব কালান্তক বীজাণুর হাতে মানুষ পরাজিত হয়ে আসছিল আর রোগ যন্ত্রণার কাছে অসহায় আত্মসমর্পণ করে আসছিল। কোনও বাবার মন্ত্রের প্রভাবে সেসব রোগ এক এক করে পৃথিবী থেকে বিদেয় নেয় নি।মানুষের পরম শত্রু সে সব রোগ পরাজিত হয়েছে বিজ্ঞানীর গবেষণাগারে। এর চে’ বড় মিরাকল আর কিছু আছে কি?”
ড০ চৌধুরীর মুখের প্রশান্তি হঠাৎ অন্তর্হিত হল।তিনি ক্রুদ্ধ হয়ে জিজ্ঞেস করলেন,“আপনার লেকচার ছাড়ুন প্রহ্লাদবাবু! কী বলতে চাইছেন,তাই বলুন।”
প্রহ্লাদ শান্তভাবে বলল,“ড০ চৌধুরী আমি এটাই বলতে চাইছি যে আপনি দেখার চে’ বড় মিরাকল আমি দেখেছি। আর যে মানুষ এই মিরাকলটা সম্ভব করে তুলেছে,আমি তাকে হাজার বার প্রণাম করি। নবজাগরণের উজ্জ্বল প্রভাতে ইউরোপ এই মানুষকে আবিষ্কার করেছিল :What a piece of work is a man! How noble in reason! How infinite in faculty! In form, in moving, how express and admirable! In action, how like an angle! In apprehension, how like a god! The beauty of the world! The paragon of animals!” ত্রিশ হাজার বছর ধরে দেবতার সাহায্যে মানুষ যে কাজ করতে পারে নি,নিজের প্রকৃত মহত্ব আবিষ্কারের মাত্র তিনশ বছরের মধ্যে ইউরোপের লোক তারচেয়ে হাজারগুণ বেশি অসাধ্য সাধন করেছে।আজ মহাকাশের বুকে অনন্তের প্রান্তসীমাতে সে মানুষ দাঁড়িয়ে ঘোষণা করছে : I am God! আর আপনি? যে মন্ত্রের বলে মানুষ একটা একটা করে প্রকৃতির সমস্ত রহস্য উন্মোচিত করে দেবতার মতো শক্তির অধিকারী হল সেই মন্ত্রই আপনাকে বিন্দু মাত্র বিস্মিত আর আকৃষ্ট করে না। সে মন্ত্রের সাধনায় জন্য আপনি মোটেও অনুপ্রাণিত বোধ করেন না। আপনি ল্যাবরেটরিতে বসে বসে গবেষণা করার বদলে ঘরে বসে জপ করছেন কিনা কেবলই ‘বাবা’র নাম। আধুনিক জ্ঞানবিজ্ঞানের চর্চার জন্য প্রতিষ্ঠিত এই বিশ্ববিদ্যালয়ের নেতৃত্বের ভার পড়েছে আপনার মতো মানুষের হাতে। দেশের জন্য এর চেয়ে বড় দুর্ভাগ্যের কথা আর কিছু হতে পারে কি?”
প্রহ্লাদ যাবার জন্য তৈরি হল।
ড০ চৌধুরী রাগে কাঁপতে কাঁপতে বললেন,“আপনার ভাগ্য ভালো যে আজ আপনি আমার ঘরে অতিথি।না হলে আমি আপনার মদগর্বী কথার উপযুক্ত প্রত্যুত্তর দিতাম।আপনার মতো ব্লেকমেইলার জার্নালিস্ট অনেক দেখেছি।নিজে যে সব কথা বুঝেন না সেসব কথায় এরকম নাক গলাতে গেলে কখনও কিন্তু কোথাও আপনাকে অপমানিত হতে হবে।আপনার বিষয়ে লোকে কী ভাবে আপনি মনে হয় সেইসব কথা জানেন না।জানলে এরকম সাধুতা আর পাণ্ডিত্য জাহির করে ফিরতেন না।”
প্রহ্লাদ নম্র ভাবেই জিজ্ঞেস করল,“আমার সম্বন্ধে লোকে কী ভাবছে অনুগ্রহ করে বলবেন কি?”
ড০ চৌধুরী বললেন,“নিশ্চয়ই বলে দেব।গুহায়াটিতে শুধু আপনারটাই খবরের কাগজ নয় বুঝলেন?বাকি খবরের কাগজ আপনার সম্পর্কে কী লেখে দেখেন নি?আপনি একজন টাইম সার্ভার আর ব্লেকমেইলার।এক সময়ে আপনি ছিলেন একজন মার্ক্সিস্ট বিপ্লবী।সেই মানুষটা এখন হল গিয়ে এক বুর্জুয়া কাগজের সাংবাদিক।খবরের কাগজে আপনি সারা রাজ্যের লোককে চোর বলে বেড়ান।কিন্তু তলায় তলায় কী করছেন?ব্লেকমেল করে টাকা যোগাড় করছেন।সরকার থেকে চুপি চুপি নানা অনুগ্রহ বাগাচ্ছেন। কিন্তু মানুষের চোখে আর কতদিন আপনি এভাবে ধূলি দেবেন? যান! যান! আর বেশি দিন নেই। আপনার আসল স্বরূপ সমানে বেরিয়ে যাবে।”
বজ্রাহত মানুষের মতো প্রহ্লাদ খানিকক্ষণের জন্য স্তম্ভিত হয়ে গেল।তারপর প্রকৃতিস্থ হয়ে সে হাসি একটা ফুটিয়ে তুলে বলল,“নমস্কার ড০ চৌধুরী আপনার অনেক সময় নষ্ট করল।এখন বিদায় নিই।” যে উদ্দেশ্যে সে ড০ চৌধুরীর কাছে এসেছিল তা একেবারেই ভুলে গেল।
টাইম সার্ভার! ব্ল্যাকমেইলার! প্রহ্লাদের মনের মধ্যে ড০ চৌধুরীর সেই নিষ্ঠুর শব্দ ক’টি বার বার প্রতিধ্বনিত হতে শুরু করল।মানুষের ঈর্ষা এবং ঘৃণার সঙ্গে সে ভালোই পরিচিত। গুয়াহাটি তথা অসমের পুরো বৌদ্ধিক পরিবেশটাই নানা কারণে এমনভাবে দূষিত হয়ে গেছে যে এখানে মানুষ প্রতিটি শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে ঈর্ষার বিষবাস্প সেবন করতে হয়।এর কারণও সে জানে না নয়।সমাজের মঙ্গলের জন্য চিন্তা করা অনেক শিক্ষিত আর চিন্তাশীল মানুষ এখন অসমেও অনেক বেরিয়ে এসেছে। কিন্তু তারা কাজ করবার পথ খুঁজে পাচ্ছে না।তরঙ্গ মুখর কর্ম প্রবাহে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারলে তাদের মানসিক শক্তি আর প্রতিভা সমাজে যে কৃষ্টি-শীল বিপ্লবের সৃষ্টি করতে পারত তাই করার সুযোগ না পেয়ে তারা এখন সে শক্তিকে প্রয়োগ করছে পারস্পরিক চরিত্রহননের ধ্বংসলীলায়।এজন সেজনকে কল্পনা করে সামাজিক প্রগতির প্রতিবন্ধক বা শত্রু রূপে।গার্হাট হপটমান ঠিক এরকম চরিত্রগুলোকে নিয়েই রচনা করেছিলেন তাঁর ‘নির্জন জীবন’ নামের বিখ্যাত নাটক। সে সময়ের জার্মানিতে তিনি যেসব আদর্শবাদী অথচ স্পর্শকাতর আর দুর্বল চরিত্রের তরুণদের দেখা পেয়েছিলেন,এক করুণ বিচ্ছিন্নতাবোধ যে সব তরুণদের মনে এক গভীর আধ্যাত্মিক শূন্যতার সৃষ্টি করে তাদের নিঃসঙ্গ করে তুলেছিল অসমেও আজ তেমনি একদল আদর্শবাদী অথচ কর্ম বিমুখ তরুণের সৃষ্টি হয়েছে।তারা এজন সেজনকে পীড়ন করে খুব সম্ভব এই আত্মপ্রসাদ লাভ করছে যে তারা সমাজের শত্রু নিপাত করছে।মানুষের প্রগতির পথ সুগম করছে। ভলতেয়ার লিখেছিলেন,“ ঈশ্বর যদি নেই তবে মানুষের তাঁকে আবিষ্কার করে নিতে হবে।”এসব লোকেও বোধহয় ভাবে যে কারও বিরুদ্ধে যদি বদনাম রটাবার কোনও কারণ নেই তবে প্রয়োজনে তেমন এক কারণ আবিষ্কার করে নিতে হবে।প্রহ্লাদ সেসব কথা বোঝে না,সে জন্য সে কারও বিরুদ্ধে নিন্দা বা ঈর্ষায় বিচলিত হয় না।তবু সেও রক্ত মাংসের এক দুর্বল মানুষ।কখনও মানুষের নিন্দা বা ঈর্ষার বিষক্রিয়া এত তীব্র হয় যে সে দস্তুর মতো ভীষণ যন্ত্রণা অনুভব করে। এক প্রচণ্ড নিঃসঙ্গতা বোধ তাকে দুর্বল করে তুলে।
আজও তার এমনি এক অবস্থা হল।ড০ চৌধুরীর কথাটাই তাকে শেলের মতো বিঁধতে থাকল।নিজের মানসিক যন্ত্রণার কারণ বিশ্লেষণ করে সে হঠাৎ একবার অনুভব করল যে তার মনেও হয়তো এক গোপন অপরাধ বোধ আছে।সে সত্যিই কি একদিক থেকে বলতে গেলে ‘টাইম সার্ভার’ই নয়?যৌবনের শুরুতে যে পতিত সমাজ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সে বিদ্রোহ করার সংকল্প নিয়েছিল,সমাজকে ভেঙে গুড়িয়ে সে এক নতুন সমাজ সৃষ্টি করার স্বপ্নে দেখেছিল,আজ জীবিকার তাড়নাতে সে বুঝি সেই সমাজ ব্যবস্থারই ক্রীতদাস হয়ে কাজ করে নি?আদর্শের জন্য সে বুঝি নিজের সর্বস্ব ত্যাগ করতে পেরেছে?পারে নি।বরং একটু একটু করে সে শত্রুর সঙ্গে আপোস করেছে আর নিজের প্রতিটি স্খলনকে সে র্যা শনেলাইজ করার চেষ্টা করছে।নির্মল বিবেকের বর্মে সে নিজেকে সম্পূর্ণ আবৃত করতে পারে নি।ফলে তার অনাবৃত দুর্বল স্থানে এসে লেগেছে নিন্দুক আর সমালোচকের বিষাক্ত তীর।তার কলজে চিরে ফোয়ারার মতো রক্ত বেরোচ্ছে।প্রতি মুহূর্তে নীরব যন্ত্রণায় সে কাৎরাচ্ছে।কোনও নিন্দুক তার প্রকৃত শাস্তিদাতা নয়।তার যন্ত্রণার কারণ হল নিজের অপরাধী বিবেক।নিন্দুকের বিরুদ্ধে তার কোনও অভিযোগ নেই।তার মনে শুধু একটাই দুঃখ যে যে সব লোক তাকে সমালোচনার বিষবাণে ক্ষতবিক্ষত করছে,সেসব লোকেরও তাকে সমালোচনা করবার কোনও নৈতিক নেই।জীবিকার জন্য যেমন সে এই সমাজব্যবস্থার দাসত্ব করছে তারাও ঠিক তাই করছে। অথচ নিতান্ত মামুলি কারণে তারাও তাকে সমালোচনা করবার সুযোগ পেয়েছে যে সুযোগের থেকে সে বঞ্চিত।বেরিয়ে আসুক সেই সমালোচক বিবেক যার নির্মল।যে সর্বত্যাগী।বিপ্লবের দুর্গম পথে পথ চলতে পা দুটো রক্তাক্ত আর ক্ষতবিক্ষত।তার অভিশাপ বাণী সে আশীর্বাদ বলে মাথা পেতে নেবে।
পানবাজারে বাসের থেকে নেমে প্রহ্লাদ ঘরে না গিয়ে প্রভাত বরুআর ঘরের দিকে পা বাড়াল।প্রভাত আরেকটা কাগজের সাংবাদিক।প্রহ্লাদের একমাত্র ঘনিষ্ঠ বন্ধু।প্রহ্লাদ আজ অনেকদিন তার দেখা পায় নি।প্রভাত প্রহ্লাদকে দেখে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল,“কীরে প্রহ্লাদ!আজ দেখছি অমানিশায় চাঁদ উঠল।খবর কী?”
“খবর এটাই যে আমি এখন ব্ল্যাক মেইলার।” প্রহ্লাদ চেয়ার একটাতে ধপাস করে বসে বলল।
চেয়ারে বসতেই টেবিলে রাখা বইটার দিকে চোখ পড়ল।কভারে অত্যন্ত কামোদ্দীপক ভঙ্গির এক নগ্নিকার ছবি। ইংরাজি পর্ণগ্রাফি Sensuous Women । প্রভাত লজ্জা পেয়ে তাড়াতাড়ি বইটা সেলফে রেখে বলল,“তুমি এমন অতর্কিতে এসে পড়লে যে বইটা লুকোবার সময়ই পেলাম না।মিথ্যে বলে লাভ কী ভাই,আমি এই সব বই পড়ে বেশ আনন্দ পাই।”
“লুকোতে হবে কেন?” প্রহ্লাদ সহজে মুখে হাসি একটা এনে বলল,“আমি কি তোমার কথা জানি না নিকি?তুমি বাইরে মরুভূমি ভেতরে রসের ফল্গুধারা।তা তুমি এই বয়সেও অবিবাহিত মানুষ।এই সব বই পড়ে থাক।বেশ তো।কিন্তু তুমি অন্তত এই বাহাদুরি করতে পারবে না যে অসমে পর্ণগ্রাফির বিগেস্ট কালেকশনটা তোমারই আছে।”
“কার আছে?” প্রভাত মিকচার সিগারেট একটা পাকাতে শুরু করে প্রশ্ন করল।
“ড০ অরবিন্দ বরুআর।”নামটা উচ্চারণ করেই প্রভাতের মুখে ফুটে উঠা প্রতিক্রিয়া উপভোগ করে প্রহ্লাদ একটা মুচকি হাসি হেসে নীরব হয়ে রইল।
প্রভাত অবিশ্বাসের সুরে বলল,“কী বলছ?সেই ষাট বছরের বৃদ্ধ আমাদের সবার ‘স্যর’! রাতের গভীর নিদ্রাতে যে মানুষটি শিলালিপি,তাম্রলিপি আর প্রাচীন মুদ্রার বাইরে কিছু স্বপ্ন দেখেন না,যে মানুষটাকে... যে মানুষটাকে আমরা আদর্শ নৈতিক চরিত্রের জীবন্ত প্রতিমূর্তি বলে ভাবি!”প্রভাতের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে প্রহ্লাদ বলল,“ প্রাচীন গ্রিসে ইস্কাইলাসের নাটক অভিনীত হবার সময় নৈতিক সততার গুণ ব্যাখ্যা করে কোনও অভিনেতা কোনও একটা সংলাপ বললেই যেমন দর্শকের চোখ আপনা আপনি দর্শক আসনে বসা এরিস্টাইডিসের মুখের দিকে গেছিল ঠিক তেমনি আদর্শের প্রসঙ্গ উঠলেই প্রথমে যে মানুষটির কথা আমাদের মনে আসে...”
“সেই ড০ অরবিন্দ বরুআ এ বয়সে পর্ণগ্রাফি পড়েন? আমি বিশ্বাস করি না।”
“এমন কি বড় কথা হল?” নাটকীয় ভঙ্গি ছেলে প্রহ্লাদ বলল,“এই সহজ কথাটা তুমি কেন মেনে না নাও যে প্রতিটা মানুষই একই সময়ে দুটো আলাদা জগতে বাস করে?একটা বাইরের—যেখানে মানুষ সমাজের একজন হয়ে বাস করে; যেখানে তার প্রতিটা কাজ;প্রতিটা গতিবিধির উপর সহস্র মানুষের দৃষ্টির আলো পড়ে।যেখানে সে প্রতি পায়ে সমাজের অনুমোদন আর প্রশংসা চায়; যেখানে সে প্রতি মুহূর্তে আত্ম সচেতন আর ইতিহাস চেতন;যেখানে তার জীবন অন্য আরও অনেক জীবনের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য ভাবে গাঁথা।আর অন্যটি হল তার অন্তরের জগৎ।প্রাইভেট ওয়ার্ল্ড বা অধিক শুদ্ধ করে বললে তার প্রাইভেট হেল।যেখানে তিনি ভয়ঙ্কর ভাবে নিঃসঙ্গ,দায়মুক্ত আর স্বাধীন।যেখানে নিষিদ্ধ্বতম ভাব-চিন্তা আর কামনাবাসনাগুলোও অরণ্যের হিংস্র পশুর মতো অবাধে বিচরণ করে।শেকল ছেড়ে মুক্ত হওয়া,মানুষকে কামড়াতে চাওটা কুকুরের মতো যেখানে মানুষের মনের অন্ধকার প্রবৃত্তিগুলো মুক্ত হয়ে বাইরে বেরোতে প্রতি মুহূর্তে যুদ্ধ করে থাকে আর তাদের বেঁধে রাখার চেষ্টা করতেই মানুষের জীবনের বেশির ভাগ সময় যায়...।”
অবাক বিস্ময়ে প্রভাত কিছুক্ষণ প্রহ্লাদের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। অন্যমনস্কভাবে সিগারেটে ঘন ঘন দু-বার টান দিয়ে শেষে বলল,“প্রহ্লাদ আজ নিশ্চয় কিছু একটা গণ্ডগোল হয়েছে।কিন্তু আমি ধরতে পারি নি—সে গণ্ডগোলটা তোমার না আমার।”
“তার মানে?” প্রহ্লাদ একটু অবাক হয়ে প্রশ্ন করল।“দাঁড়াও! দাঁড়াও!আমাকে পুরো কথাটা ভালো করে বুঝতে দাও।”প্রভাত হতবুদ্ধি হওয়া মানুষের মত বলতে শুরু করল,“তুমি এসেই প্রথমে ঘোষণা করলে যে তুমি একটা ব্ল্যাক মেইলার। সে কথাটা ভালো করে যাচাই করবার আগেই তোমার চোখে পড়ল আমার Sensuous Woman-এর উপর। তারপর তুমি যে লেকচার আরম্ভ করলে--- একসঙ্গে তোমার মুখে এতগুলো কথা শোনা আমার পুরো জীবনে মনে পড়ে না। বলতে পারব না কেন,তোমাকে আজ বড় প্রকৃতিস্থ লাগছে না।নিশ্চয়ই আজ তোমার কোনও একটা কিছু হয়েছে।বল,প্রহ্লাদ কী হয়েছে আমাকে খুলে বল।আজ নিশ্চয়ই তোমার কিছু একটা বড় কিছু হয়েছে।”
প্রহ্লাদ প্রভাতকে উদগ্রীব করে রেখে কিছু সময় নীরব হয়ে রইল।এক মানসিক অন্তর্দ্বন্দ্বের ছায়া তার মুখটাকে গম্ভীর করে তুলল।কিছু সময় পর খুবই ক্লান্ত স্বরে সে বলতে শুরু করল,“প্রভাত,আজ বাড়ি গিয়ে আমি ভাত খেতে পাব কি না তার ঠিক নেই। বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসার সময় ললিতা চাল কেনার টাকার কথা বলেছিল। আমি না শোনার ভান করে চলে এলাম। সুতরাং ঘরে ফিরে যদি ভাত খেতে পাই তবে নির্ঘাৎ বুঝতে হবে যে হয় ললিতা বিপদে আপদে লাগতে পারে বলে জমিয়ে রাখা শেষ কপর্দকটা পর্যন্ত ব্যয় করেছে।অথবা লাজ লজ্জা ছেড়ে কাছের মজিদ উকিলের বাড়ি গিয়ে তাঁর থেকে ধার এনেছে গিয়ে। এই যার বাড়ির দশা সেই মানুষটা ইউনিভার্সিটির বিদগ্ধ পণ্ডিত ড০ চৌধুরীর ঘরে গিয়েছিলাম। গিয়ে তাঁর মুখে কী শুনে এলাম জান?আমি বুঝি একটা ব্ল্যাকমেইলার।অর্থাৎ ক্ষমতাশালী মানুষের বিষয়ে গোপন ক্ষতিকর খবর সংগ্রহ করে সেগুলো প্রকাশ করে ভয় দেখিয়ে তাঁদের থেকে টাকা সংগ্রহ করে থাকি।ড০ অরবিন্দ বরুআ আর Sensuous Woman -এর মধ্যে কি তুমি কোনো সংযোগ খুঁজে পেলে প্রহ্লাদ?
প্রভাত হতবুদ্ধি হয়ে শুধু মাথাটা নাড়ল। অর্থাৎ সে প্রহ্লাদের কথার মাথামুণ্ডু কিছু ধরতে পারে নি।
“অতি সহজ।” প্রহ্লাদ বলতে শুরু করল,“অসমের সর্বশ্রেষ্ঠ জীবিত ঐতিহাসিক ড০ অরবিন্দ বরুআর সামনে কথা বলতে গিয়ে আমরা এক মুহূর্তের জন্যও কি কল্পনা করতে পারি যে অসমের বিগত ত্রিশটা শতাব্দীর স্মৃতি রোমন্থনের বাইরে এই ষাট বছরের প্রশান্ত মানুষটার মনে আর কোনও চিন্তা ঠাঁই পেতে পারে?কিন্তু এই বৃদ্ধ বয়সে তাঁর অবসর বিনোদনের একমাত্র পন্থা হল পর্ণগ্রাফি পড়া।নিশ্চয়ই তাঁর মনে এমন এক অনিবার্য তাগিদ আছে,তাড়না আছে—যার জন্য তাঁকে এই বৃদ্ধ বয়সেও পর্ণগ্রাফি পড়ে vicarious pleasure আদায় করতে হয়।অর্থাৎ মানুষ একজনকে বাইরে থেকে দেখেই তাঁকে যা বলে ভাবি,তিনি আসলে তাই নন।সম্পূর্ণ মানুষটাকে আমরা কখনও জানতে পারি না।আজকাল ইউরোপ আমেরিকাতে জীবনী রচনার এক নতুন পদ্ধতি বেরিয়েছে—যাকে বলা হয় Psychohistory।আমরা যদি ড০ অরবিন্দ বরুআর Psychohistory রচনা করতে পারতাম তবে হয়তো এই বৃদ্ধ বয়সেও তাঁর পর্ণগ্রাফিপ্রীতির আসল ব্যাখ্যা খুঁজে পেতাম।যাই হোক,আমি যে কথাটা তোমাকে বলতে চাইছিলাম,তার থেকে সরে এলাম।আমি তোমাকে বলতে চাইছিলাম,ড০ অরবিন্দ বরুআর পাবলিক ইমেজের অন্তরালে লুকিয়ে থাকা আর একটা রূপ যেমন কোনও মানুষ কখনও দেখেনি,ঠিক তেমনি তোমার বন্ধু এই প্রহ্লাদ হাজরিকার আর একটা রূপও অন্যের কথা বাদ দাও---তুমি নিজেও কোনও দিন দেখ নি।”
প্রহ্লাদ অল্প থেমে রইল।
প্রভাত আরেকটা সিগারেট জ্বালিয়ে বলল,“দাঁড়াও,তুমি আমার সামনে কোনও স্বীকারোক্তি করতে এসছো না কি? খ্রিসচিয়ানরা মরার সময় সে কাজটা করে।তুমিও আমার কাছে কোনও স্বীকারোক্তি করে গিয়েই তেমন কোনও এক কাণ্ড করবার কথা ভাব নি তো?”
“তুমি সব কথা এমন হাল্কা করে ফেল কেন?”প্রহ্লাদ ক্লান্তিতে করুণ স্বরে বলল।তারপরে হঠাৎ যেন নতুন কোনও কথা একটা মনে পড়ে গেছে,সেরকম মুখ করে সে কথার সুর পালটে বলল,“অবশ্য তুমি নিজের অজান্তেই খুব সত্য কথাগুলো বলে ফেলেছ।আমি আসলে তোমার সামনে স্বীকারোক্তি একটা করতেই এসেছি।সঙ্গে এটিও সত্য যে তোমার সামনে স্বীকারোক্তি করবার পরে আমাকে হয়তো আত্মহত্যাও করতে হতে পারে।চমকে ওঠো না।আমি যে আত্মহত্যার কথা বলছি, সেটি আসলে মানসিক।”
প্রভাত হঠাৎ গম্ভীর হয়ে কিছুক্ষণ প্রহ্লাদের চোখের দিকে তাকিয়ে রইল,তারপর কোমল শান্ত গলায় বলল,“বল! কী বলতে চাইছ,বল।”
প্রহ্লাদ কথা বলবার জন্য ঠোঁট মেলেও থেমে গেল।তার পুরো মুখে একটা লজ্জার আভা দেখা দিল।প্রভাত ঠিক বুঝতে পারল---প্রহ্লাদের মনের মধ্যে একটা ভীষণ অন্তর্দ্বন্দ্ব চলছে।সে ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করে রইল।কিছুক্ষণ প্রহ্লাদ নিজের সঙ্গে নিজে যুদ্ধ করে পরে বলল,“আচ্ছা প্রভাত,তোমাকে যদি হঠাৎ কেউ পনেরোশ’ টাকা মাইনের চাকরি একটা দিতে চায়,তুমি কী করবে?”কথাগুলো বলেই জীবনে প্রথম দেহ বিক্রি করতে তৈরি নিষ্পাপ কিশোরীর মতো প্রহ্লাদ লজ্জিত আর বিষণ্ণ হাসি মুখে নিয়ে এল।
প্রভাত তাকে চমকে দিয়ে হঠাতই খিলখিলিয়ে হেসে উঠল,“ও!কথা তবে এই!তোমাকে কেউ পনেরোশ’ টাকার চাকরি দিচ্ছে।সোজা না বলে আমার গায়ে খোঁচা দিয়ে বলছ কেন?কিন্তু ভাই,প্রশ্নটা আমাকে করে কী লাভ? আমাকে তো আর কেউ এমনটি যাচবে না।যাচলে এক মুহূর্তের জন্য আমার ভাবার দরকার পড়বে না।এক লাফে চাকরিটা কেড়ে নেব।”
“কেন” বোকার মতো প্রহ্লাদ প্রশ্ন করল।
“কেন,মানে! কুকুরের মতো জীবনের আধা বয়স পার হল।খবরের কাগজের সাব-এডিটরি করে মাইনে পাই সাতশো টাকা।আজকের দুর্মূল্যের বাজারে সে টাকার ডালভাত খাবার কটাও জোটে না।অভাবের চিন্তায় আজ অব্দি বিয়েটাও করতে সাহস জোটাতে পারিনি।সে জায়গায় খেলার পুরস্কার পাবার মতো যদি হঠাৎ পনেরোশ’ টাকা পাবার মতো এই মাইনের চাকরি একটা পেয়ে যাই তবে সেটি কেন নিতে হবে সেই প্রশ্ন উঠতে পারে বুঝি?”
“কিন্তু... কিন্তু” বিশ্বাসের জোর না পাওয়া মানুষের মতো দুর্বল গলায় প্রহ্লাদ বলল,“টাকাই কি একমাত্র প্রশ্ন? তোমার টাকার বড় প্রয়োজন হতে পারে,কিন্তু তাই বলে অন্যায় কাজ করবার জন্য কেউ ঘুষ হিসেবে টাকা দিলেও তুমি নেবে কি? কেউ তোমাকে খুনের কাজে লাগাতে চেয়ে টাকা দিলেও কি নিয়ে নেবে? যে সত্য প্রকাশ করলে মানুষের মঙ্গল হয়---তেমন সত্য গোপন করবার জন্য উপহার দিলেও তুমি সে টাকা নেবে কি?”
“তুমি এই সব কি জট লাগিয়ে কথা বলছ,প্রহ্লাদ? আগে বললে চাকরির কথা,এখন আবার বের করছ ঘুষের কথা। আমি তোমাকে এ সহজ সরল কথাটাই বলতে চাইছি যে বেশি মাইনের চাকরি পেলে আমি নিশ্চয়ই নেব।তোমারও নেয়া উচিত। টাকার জন্যই তো চাকরি করছি।তা হলে যে চাকরিতে বেশি টাকা পাবে সেই চাকরি নেবে না কেন?”
প্রভাতের নির্বোধ যুক্তি শুনে প্রহ্লাদ কিছুক্ষণ চুপ রইল।তার জীবনের এ জটিল সমস্যা বা মানসিক অন্তর্দ্বন্দ্ব নিয়ে আলোচনা করবার জন্য প্রভাত উপযুক্ত মানুষ কি না,সে নিয়ে তার মনে সন্দেহ উপস্থিত হল।কিছু সময় মনে মনে চিন্তা করে অবশেষে সে বলল,“তুমি একটা কথা ঠিকই বলেছ।কথাগুলো আমি সোজা-সাপটা না বলে বড় ঘুরিয়ে বলেছি।যে মানুষের বিবেক নির্মল নয়,যে মানুষ মনের মধ্যে গোপন অপরাধ বোধ লালন করে সেসব মানুষই সহজ সত্যের দিকে রাস্তা না নিয়ে এভাবেই নিজের সঙ্গে লুকোচুরি খেলে।আর যেতে দাও সেই সব কথা।সংক্ষেপে আমার সমস্যাটা এই যে একজন ক্ষমতাশালী রাজনৈতিক নেতা নিজে যেচে এসে আমাকে একটা বড় চাকরি দিচ্ছে।যে সময় পাথরে মাথা কুটে মরলেও চাকরি পাওয়া যাচ্ছে না,তখন আমার মতো একটা মানুষকে কেউ যেচে চাকরি দিতে এলে তাঁর আসল মতলব সম্পর্কে সন্দেহ হওয়াই খুব স্বাভাবিক নয় কি? অবশ্য এক্ষেত্রে সন্দেহের অবকাশ নেই। জগন্নাথ চৌধুরীর আসল মতলব আকাশের দুপুর রোদের মত পরিষ্কার। কথাগুলো আমি তোমাকে ভেঙে বলছি।কথাগুলো আমি তোমাকে ভেঙে বলছি।ঘটনাচক্রে কিছুদিন আগে অসমে একজন অত্যন্ত ক্ষমতাশালী নেতা তথা মন্ত্রীর বিষয়ে তাঁর নিজের হাতে লেখা একটা কাগজ আমার হাতে পড়েছে।তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী অন্য একজন নেতা চুরি করে এনে কাগজটা আমাকে দিল।কাগজটাতে মন্ত্রীর বেনামী ব্যবসা সম্পত্তির পরিমাণ,কর ফাঁকি দেওয়া আদি অনেক বিপজ্জনক তথ্য লেখা আছে।কাগজটা কোনও ভাবে প্রকাশ পেলেই নেতাটির রাজনৈতিক মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী।কিন্তু আমার সম্পাদক সেসব তথ্য প্রকাশ করতে রাজি নন।তাঁর ধারণা যে সেই তথ্যগুলো প্রকাশ পেলে দীর্ঘ মানহানির মামলায় লুটোপুটি খাওয়া ছাড়াও তাঁর চাকরিটিও যাবে।অনেকদিন ধরে কাগজটি আমি বুকে বেঁধে ফিরছি।মন্ত্রীটি কথাটা জানতে পেরেছে।তিনি এও বুঝতে পেরেছেন যে কাগজটা আমার হাতে থাকা পর্যন্ত তাঁর শান্তি স্বস্তি আর নিরাপত্তা নেই।আমাদের সম্পাদক যে কোনও মুহূর্তে মত বদলাতে পারেন।আমি কাগজটা অন্য কোনও সাহসী সংবাদপত্রের সাংবাদিককে দিয়ে দিতে পারি।এমন কি বিরোধী পক্ষের কোনও এম পি বা এল এল এ-কে দিয়েও দিতে পারি।আমি আজ অব্দি কাগজটা আর কাউকে দিইনি এর জন্যেই যে তারা কাগজটি প্রকাশ না করে ব্ল্যাকমেইলের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে পারে।এখনও আশা রাখছি যে সময় হলে আমাদের কাগজেই তথ্যগুলো প্রকাশ করতে পারব।সে সম্ভাবনা রোধ করবার জন্য মন্ত্রীর দালাল জগন্নাথ চৌধুরীর দ্বারা আমার কাছে এই চাকরির অফার।এখন কথাটা বুঝলে?”
“কিছুই বুঝিনি।”প্রভাত চট করে উত্তর দিল,“ঘটনাটা শুনলাম।কিন্তু তোমার সমস্যাটা কী কিছুই বুঝিনি।তুমি শুরুতে এসেই আমার মনে এমন এক ধারণা সৃষ্টি করতে চেষ্টা করলে যে তোমার মনের মধ্যে কোনও একটা দ্বন্দ্ব চলছে।গোটা দুনিয়া জানে যে ড০ অরবিন্দ বরুআ একজন জ্ঞান তপস্বী পণ্ডিত ইতিহাস চর্চার বাইরে আর কোনও ধান্দা নেই।কিন্তু তুমি জান যে তাঁর জীবনে পর্ণগ্রাফির জন্যেও স্থান রয়েছে।তেমনি পুরো অসম জানে যে প্রহ্লাদ হাজরিকা একজন সৎ,আদর্শবাদী বিবেকবান সাংবাদিক।আদর্শের জন্য সে স্বেচ্ছায় চরম দারিদ্র্য বরণ করে নিয়েছে।কোনও প্রলোভন তাকে টলাতে পারে না।কিন্তু এখন কি তুমি এটিই বলতে চাইছ না যে বাইরে তোমাকে যেমন দেখায় তুমি আসলে তেমন মানুষই নও?মনের মধ্যে তুমিও লালন করছ গোপন লোভ আর উচ্চাকাঙ্ক্ষা?সোজা ভাষায় বলতে গেলে এই পনেরোশ’ টাকার চাকরির প্রতি তোমার মনে প্রচণ্ড লোভ জন্মেছে।শুধু চক্ষু লজ্জার জন্যেই এটি নিতে পারছ না?মোট কথা তোমার সমস্যাটা হচ্ছে,to take or not to take। একেবারে হেমলেটিয় নৈতিক সংকট!”
প্রভাতের শেষ কথা কটিতে এমন এক শাণিত বিদ্রূপের সুর ফুটে উঠল যে প্রহ্লাদে হৃদপিণ্ডে একটি শেল যেন এ ফোঁড় ও ফোঁড় করে চলে গেল।হঠাৎ এক প্রকাণ্ড শারীরিক আর মানসিক দুর্বলতা তাকে চেপে ধরল।চেয়ারটার থেকে উঠে গিয়ে সে প্রভাতের বিছানায় গিয়ে গড়িয়ে পড়ল।চোখ দুটো মুদে অনেকক্ষণ স্থির হয়ে পড়ে রইল।সে মনে কষ্ট পেয়েছে বলে বুঝতে পেরে প্রভাত লঘু পরিহাসের সুরে কথা দুই একটা বলতে শুরু করল।কিন্তু কোনও কথাই প্রহ্লাদের কানে গেল না।এটা ওটা নানা কথা বলেও প্রভাত যখন প্রহ্লাদের মুখে কথা বের করতে পারল না তখন ধৈর্যচ্যুত হয়ে প্রায় চেঁচিয়ে বলল,“দেখ প্রহ্লাদ, তুমি আমাকে যতটা গাধা বলে মনে কর,আমি তত গাধা নই। বুঝলে?তোমার মনে আসলে কীসের দ্বন্দ্ব চলছে সে আমি বুঝিনি মনে করেছ কি?আমি সবই বুঝতে পেরেছি।শুধু তোমাকে আঘাত দেবার জন্যে ইচ্ছে করেই এভাবে বলেছি।মানুষের মাঝে মাঝে আঘাত পাওয়াটা খুবই ভালো।কেবল ভালোই নয়,মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য সে অতি দরকারিও।শোন,আসলে তোমার মনে কোনও লোভ নেই।এখনও কোনও লোভের উদয় হয় নি।কিন্তু তোমার মনে এক প্রচণ্ড অভিমান পুঞ্জিভূত হয়েছে।আমি জানি, তুমি জীবনে এক আদর্শ মেনে চলতে গিয়ে অনেক ত্যাগ করেছ।বহু প্রলোভন জয় করেছ।স্বেচ্ছায় চরম কৃচ্ছ্র সাধনের পথ বেছে নিয়েছ।কিন্তু তোমার মনে এটাই অভিমান যে সমাজ তোমার এই দুঃখ ব্রতের কোনও স্বীকৃতি দেয় নি।বরং মানুষ নানা মিথ্যা কুৎসা রটনা দিয়ে তোমার জীবন দুর্বিষহ করে তুলেছে।কত মানুষ তোমার বিরুদ্ধে কত মিথ্যে বদনাম করে ফিরে।কেউবা বলে তুমি সি আই এ-র এজেন্ট।কেউ বা বলে শাসকদলের সঙ্গে তোমার গোপন মিতালি আছে।আর এর সুযোগ নিয়ে তুমি অনেক সা-সম্পত্তি করে নিচ্ছ।কেউ বা বলে,তুমি মন্ত্রীর দালাল।তোমার অনেক বেনামী ব্যবসা আছে।এসব কথা আমার কানে পড়েনি বলে ভেবো না।এ কথাও সত্য যে অনেক মানুষ এসব কথা বিশ্বাস করে।মানুষকে দোষ দিয়ে লাভ নেই।গোটা সমাজটাই এমন হয়ে পড়েছে যে সততাকে জীবনের এক স্বাভাবিক কথা বলে ভাবতে মানুষ ভুলে গেছে।সে এমন এক বিরল ব্যতিক্রম যে মানুষ শেয়ালের শিং আছে বলে বিশ্বাস করলেও কারও বা সততা আছে বললে সহজে বিশ্বাস করতে চায় না।চারদিকের ঈর্ষা,সন্দেহ আর ঘৃণার শরাঘাতে জর্জরিত হয়ে তোমার মনে হঠাতই এক বড় দুর্বলতা এসেছে।তুমি হয়তো ভাবতে শুরু করেছ---সব রকমে সৎ হয়ে থেকেও যদি তুমি মানুষের চোখে মতলববাজ,স্বার্থপর আর ভণ্ড হয়েই থাকলে তবে আর এই কৃচ্ছ্রসাধনের মূল্যই বা কী? অর্থই বা কী?এমন করে থেকে তুমি একুল ওকুল দুকুল হারিয়েছ।ঘরে তোমার ছেলেমেয়ে দুবেলা দুমুঠো পেট ভরে খেতে পায় না।অথচ লোকে ভাবে তুমি প্রস্টিট্যুশন অর্থাৎ সাংবাদিকতার বেশ্যাবৃত্তি করে টাকার পাহাড় বানিয়েছ।সুতরাং এই মূল্যহীন কৃচ্ছ্রসাধন করে নিজেকে আর ছেলেমেয়েকে সব দিক দিয়ে বঞ্চিত করার থেকে না চাইতে এসে পড়া পনেরোশ’ টাকার চাকরিটা নিয়ে অন্তত একটা কুল রক্ষা করে চলাই বেশি ভালো।এটুকুই তোমার মনের ভাব নয় কি? সত্যি করে বল!”
প্রহ্লাদ চোখ দুটো মেলে কিছুক্ষণ প্রভাতের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।তাকে অত্যন্ত ক্লান্ত আর বিষণ্ণ দেখাচ্ছিল।কী একটা বলতে চেয়েও কথা বলতে যেন সে শরীরের জোর খুঁজে পাচ্ছিল না।কিছু সময় তেমনি নীরব হয়ে থেকে অবশেষে সে বলল,“আচ্ছা প্রভাত,আমি মেনে নিয়েছি তুমি অনেক পরিমাণে আমার মনের ভাব ধরতে পেরেছ।তর্কের খাতিরে এটাও ধরে নাও—এটাই আমার প্রধান সমস্যা,একমাত্র সমস্যা।অনেস্টলি একটা কথা বল তো---আমার অবস্থায় পড়লে তুমি নিজে কী করতে?সব অহংকার বিসর্জন দিয়ে তুমি এ চাকরিটা নিতে কি না মনের মধ্যে গোপন লোভ,ক্ষোভ আর অভিমান দমন করে রেখে নিষ্ফল আত্মক্ষয়ী দারিদ্র্যের মধ্যে জীবনটা শেষ করতে?”
প্রভাতের মুখের স্বাভাবিক চপলতাটুকু হঠাৎ মিলিয়ে গেল। গম্ভীর হয়ে সে বলল,“আমাদের এই গম্ভীর আলোচনার বিষয়বস্তুটা কী প্রহ্লাদ?কোনও কুচক্রী রাজনৈতিক নেতা অসমের একজন সৎ আদর্শবাদী সাংবাদিককে পথভ্রষ্ট করবার জন্য উপহার হিসেবে এক লোভনীয় চাকরি এগিয়ে দিচ্ছে।চাকরিটা সে নেবে,না নেবে না---সেটাই তার সামনে বড় প্রশ্ন।কিন্তু প্রহ্লাদ,আমি নির্মমভাবে তোমাকে একটা কথা বলি—তুমি রাগ কর না।সামান্য চাকরি একটার প্রস্তাব পেয়েই যে মানুষের মনে দ্বন্দ্ব উপস্থিত হয়,লোভের উদয় হয়, কর্তব্যাকর্তব্যের উভয় সংকট সৃষ্টি হয়--- তেমন মানুষকে সৎ আর আদর্শবাদী বলতে পারি কি? আমি যদি বলি যে তোমার মনে সারাক্ষণ লোভ ছিল,ছিল না শুধু সুযোগ---সেই জন্যেই তুমি এতদিন সততা আর আদর্শের মুখোস একটা পরে মানুষকে ফাঁকি দিয়ে ঘোরাফেরা করতে পারছিলে।কিন্তু প্রথম সুযোগের গন্ধ পাওয়া মাত্রই তুমি মুখোস খুলে নিজের আসল রূপে বেরিয়ে এসছ।তবে এর উত্তরে তুমি কী বলবে?অবশ্যই এই কথাও ঠিক যে পৃথিবীতে বীর আর অসম সাহসী বলে পরিচিত অনেক মানুষ প্রকৃতপক্ষে ছিল নৈতিক আর শারীরিকভাবে কাপুরুষ।কাপুরুষতাকে গোপন করবার জন্যই তাদের অতিমাত্রায় বীরত্ব দেখাতে হয়েছিল।তোমার ক্ষেত্রেও যদি ঠিক তাইই হয়েছে,তবে সে কথা আমি জানিনে।যেহেতু মনে মনে তুমি খুব লোভী,সেই জন্যেই বাইরে তুমি খুব বেশি পরিমাণে নির্লোভ আর ত্যাগীর ভূমিকাতে অভিনয় করতে হয়েছে।”
প্রহ্লাদ কিছু একটা বলবে বলে প্রভাত অপেক্ষা করে রইল।কিন্তু প্রহ্লাদ কোনও কিছু না বলে এক দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল।দুজনে কিছুক্ষণ নীরব হয়ে রইল।হঠাৎ একবার নীরবতা ভেঙে প্রহ্লাদ করুণ একটা হাসি হেসে বলল,“প্রভাত,তুমি একটা কথা জান যে গ্রামে আমার অনেক পৈত্রিক সম্পত্তি আর ছোটোখাটো একটা জমিদারি ছিল? আজকের বাজারে কম করে হলেও তার মূল্য লাখ টাকা হত।কিন্তু আমি সেই কবেই সে জমিজমা আমাদের আধিয়ারদের দান করে দিয়েছি।তবুও আমি এক বুর্জুয়ার দালাল।অন্যদিকে আমাদের বিখ্যাত কম্যুনিস্ট নেতা ত্রিনয়ন কাকতি গ্রামে একটা জমিদারি রেখে আর শহরে দুটো করে পাকাঘর বানিয়েও সমাজে বিপ্লবী আর সর্বহারার বন্ধু বলে পরিচিত।আর একজন কম্যুনিস্ট নেতা দিগম্বর শহরীয়ার কথা বলি শোনো।সম্প্রতি তিনি নতুন ঘর একটা করে গৃহপ্রবেশ উৎসবে আমাদেরও নিমন্ত্রণ করেছিলেন।গিয়ে দেখি ঘরে তাঁর সত্যনারায়ণ পুজোর বিশাল আয়োজন।তাঁর স্ত্রীও কম্যুনিস্ট পার্টির সক্রিয় সদস্যা।একদিন ললিতা রাস্তায় তাঁর দেখা পেল। শহরীয়া দেবীর কপালে এক বিশাল সিঁদুরের ফোঁটা।গলায় এক নার্জি ফুলের মালা আর হাতে একটা টোপলা নিয়ে রিক্সায় করে ঘরে যাচ্ছেন।তাঁর মূর্তি দেখে কৌতূহলী হয়ে ললিতা জিজ্ঞেস করল,“মালা টালা পরে কোত্থেকে এলেন?” কম্যুনিস্ট নেত্রী অম্বা শহরীয়া অম্লান বদনে জবাব দিলেন,“আর বলবেন না, বুঝলেন কি না! গেলবার দিগম্বর নির্বাচনে দাঁড়ালে কামাখ্যাতে মানত করেছিলাম! আজ তাই দিয়ে এলাম।”
প্রহ্লাদ অল্প চুপ করে রইল। প্রভাত জিজ্ঞেস করল, “তোমার সমস্যাটার সঙ্গে এসব কথার সম্পর্ক কী?”
প্রহ্লাদ কিছু একটা বলতে গিয়েও বলল না।কোনও এক অনুশোচনার গ্লানি মুহূর্তের মধ্যে তার মুখ আঁধার করে ফেলল।নিজেরই কথার প্রতিবাদ করবার মতো মাথা ঝাঁকড়ে ঝাঁকড়ে সে সম্পূর্ণ অন্য সুরে বলল,“আমি বড় ভুল করেছি প্রভাত। এসব কথা বলে আমি ভীষণ বড় ভুল করেছি।কী অধিকার আছে আমার...।”
প্রভাত খুবই অবাক হয়ে বলল,“আরে হঠাৎ কী হল তোমার? কী ভুল হবার কথা বলছ?”
“এতক্ষণ ধরে বলছি কী তোমাকে?”প্রহ্লাদ বলল,“বলছিলাম,মানুষের নিন্দা আর সমালোচনার বিষাক্ত তীর আমাকে কী করে জর্জরিত করছে--- সেসব কথা।কিন্তু এখন নিজে কী করছি?ত্রিনয়ন কাকতি আর দিগম্বর শহরীয়ার নিন্দাতে পঞ্চমুখ হয়ে উঠেছি।আমি খুব ভালো করেই জানি প্রভাত,অন্তত আমার সে অধিকার নেই। Judge not,that ye be not judged---মানুষ একজনের বাইরেরটা দেখে আমরা তার সম্বন্ধে কদ্দূরই বা জানি?ত্রিনয়ন কাকতি বা দিগম্বর শহরীয়ার আজকের আদর্শচ্যুত আর ভোগ সর্বস্ব জীবন যদ্দূর সত্য,ঠিক তদ্দূরই সত্য তাঁদের অতীতের ত্যাগ,আদর্শের জন্য অপরিসীম দুঃখ স্বীকার।তাঁদের সমালোচনা করবার অধিকার কারও নিশ্চয়ই আছে।কিন্তু সেই ব্যক্তি কখনও আমি নই।তুমি জান প্রভাত,আমরা সবাই—আমি, ত্রিনয়ন কাকতি, দিগম্বর শহরীয়া---আমরা সবাই প্রায় একই সময়ে একই সঙ্গে বিপ্লবী জীবন আরম্ভ করেছিলাম। আমি নিশ্চিতভাবে জানি যে যে গভীর আদর্শনিষ্ঠা আর আবেগের সঙ্গে আমরা সেই দুর্গম পথে পা দিয়েছিলাম---সেই আদর্শনিষ্ঠা আর আবেগে বিন্দুমাত্র ফাঁকি ছিল না। জীবনে একটা সময় এসেছিল—যে সময়ে আমরা সবাই হেসে হেসে ফাঁসিকাঠে চড়তে পারতাম। কিন্তু সেই সময় কখন কী করে পেরিয়ে গেল আমরা কেউ বলতেই পারলাম না।মাঝে মাঝে আমার মনে হয়---যৌবন কালটা জীবনের শ্রেষ্ঠতম সময় এ জন্য নয় যে, সে সময়েই ভোগের শক্তিও অপরিমেয় হয়।যৌবন জীবনের শ্রেষ্ঠ ঋতু এ জন্য যে সে সময় অপরিমেয় প্রাণ প্রাচুর্যের বলে মানুষ অতি অকৃপণ হতে পারে।জীবনকে বেপরোয়া ভাবে খরচ করতে পারে।মৃত্যুর চোখে চোখ রেখে মানুষ বলতে পারে যে মৃত্যুর চেয়ে জীবন বেশি মহৎ আর বলশালী।আজ আমরা যার জন্য হাহাকার করে মরি সে আমাদের হারানো যৌবন।আমাদের হারানো স্বপ্ন আর আদর্শ।... ত্রিনয়ন কাকতি বা দিগম্বর শহরীয়াকে সমালোচনা করবার কোনও অধিকার আমার নেই প্রভাত।আমরা প্রত্যেকে সমান ক্লান্ত,পরাজিত আর নতজানু।কালের বিনাশী শক্তির কাছে আমরা প্রত্যেকে পরাজয় স্বীকার করেছি।জীবনকে বিকাশের পথে এগিয়ে নিয়ে যাবার বদলে আমরা প্রত্যেকে হয়ে পড়েছি জীবনের পিঠে দুর্বহ বোঝা স্বরূপ।আঁদ্রে মালরোর Man’s Estate উপন্যাসটা পড়েছ? পড়ো।আমি দেব তোমাকে।ব্যর্থ বিপ্লবের পরে তাঁর উপন্যাসের চরিত্রগুলো মানবিক পরিস্থিতিকে অতিক্রম করবার জন্য নানা পথের আশ্রয় নিচ্ছে।ফেরেল মুক্তি পাচ্ছে সেক্সের মধ্যে,ক্লেপিক জুয়া খেলার মধ্যে চেষ্টা করছে কালহনন আর আত্মবিস্মরণের। চেন খুঁজে পাচ্ছে হিংসা আর রক্তপাতের মাদকতা।আর বুড়ো গিসরের জন্য আছে আফিমের নেশা। আর আমরা?... আমার কথা শুনে শুনে তোমার ঘুমই এল।মাফ কর,তোমার অনেক সময় নষ্ট করলাম।আজ এ কথাগুলো আমার কাউকে বলার ভীষণ প্রয়োজন হচ্ছিল।আর কিছু না হলেও বুকটা বড় হাল্কা লাগছে। যাই হে! রাত অনেক হল।”
প্রভাতের আপত্তিতে কান না দিয়ে প্রহ্লাদ প্রায় দৌড়ে বেরিয়ে গেল।
****
প্রহ্লাদ রাত করে ঘরে ফিরে দেখে ছেলেমেয়েরা শুয়ে গেছে। ললিতা বিছানায় বসে ওর ছেঁড়া পেটিকোট একটা সেলাই করছে। সেলাই থেকে মাথা না তুলে প্রহ্লাদকে জিজ্ঞেস করল, “এত দেরি হল কেন?”
ললিতার এত শুকনো ঠাণ্ডা গলা প্রহ্লাদ অনেকদিন শোনেনি।গায়ের কাপড় খুলতে খুলতে সে চুরি করে দু-একবার ললিতার দিকে তাকাল।অনেকদিন রোগে ভোগে এই মাত্র উঠে বসা মানুষের মতো তাকে ক্লান্ত রোগা আর দুর্বল দেখাচ্ছিল। আজ নিশ্চয়ই ওর শরীর মনের উপর দিয়ে ধকল একটা গেছে---প্রহ্লাদ মনে মনে ভাবল। সে শান্ত গলাতে বলল,“এই আজ দেরিই হয়ে গেল।অনেকদিন পর প্রভাতের ওখানে গেছিলাম। ওখানে কথা বলতে বলতেই...”
তার কথা ফুরোতে না দিতে ললিতা মাঝপথেই বলল,“কোনও ভাবে জানছিলে যে আজ ঘরে চাল নেই,আমার হাতে পয়সা একটাও নেই,আজ ঘরের মালিকও ভাড়া খুঁজতে আসবে, তোমার সেই জগন্নাথ চৌধুরী না কাকতি লিডারটাও তোমার সন্ধানে আসবে---সে জন্য সব আপদ আমার উপর ঠেলে বন্ধুর ঘরে পালিয়ে বেড়ালে।”
কিছুক্ষণেরে জন্যে প্রহ্লাদ স্তব্ধ হয়ে গেল।অনেকদিন ললিতার মুখে এমন রূঢ় কথা শুনেছে বলে তার মনে পড়ে না। আজ পুরো দিনটাই তার উপর কোন কুগ্রহ চেপেছে বুঝি?বাইরে বেরিয়ে গেল--- প্রফেসর চৌধুরীর মুখে শুনতে পেল সেই বুকের রক্ত জল করা কথা কটি। কষ্টেসৃষ্টে বাড়ি ফিরে এল তো চির মমতাময়ী মৃদুভাষিণী স্ত্রীর মুখে শুনতে হল কখনও না শোনা রূঢ় কথা।মিথ্যে অভিযোগ।হঠাৎ এক বিরাট অবসাদ তাকে গ্রাস করতে শুরু করল।সেখানেই বসে পড়বার ইচ্ছে হল। কোনোক্রমে দাঁড়িয়ে থেকে স্ত্রীর মুখের দিকে তাকাল।আবিষ্কার করবার চেষ্টা করল রাগটা কৃত্রিম অর্থাৎ কেবল অভিনয় কি না। কিন্তু সে হতাশ হল।ললিতার শীর্ণ শুকনো মুখটাতে সত্যি সত্যি এক যন্ত্রণা আর ক্রোধের আভা ফুটে উঠেছে।হঠাৎই নিজেকে সে ভীষণ নিঃসঙ্গ অনুভব করল।তার শেষ আশ্রয়ও যেন ভেঙে চুরমার হবার জোগাড়।সেও ভারি গলায় বলল,“জগন্নাথ চৌধুরী কিছু বলে গেছে কি?”
ললিতা বলল,“চিঠি একটা লিখে রেখে গেছে। সেটি টেবিলের উপরে আছে।”
চিঠিটা দেখবে বলে সে টেবিলের দিকে এগিয়ে গেল।কিন্তু টেবিলে চোখ পড়ার আগেই পড়ল ললিতার মুখের দিকে। ললিতার কথাগুলো যেন এখনও সে বিশ্বাস করতে পারে নি।কাছে থেকে আলোতে ললিতার মুখের দিকে ভালো করে তাকালে তার নজরে পড়ল---অস্বাভাবিক লাল দেখাচ্ছে।কপালের ডান দিকে রগ একটা ফুলে রীতিমত নাচছে।চিঠির কথা ভুলে সে ললিতার কপালে হাত দিল।জ্বরে মুখটা ওর পুড়তে শুরু করেছে।সে এক অস্ফুট আর্তনাদ করে উঠল,“ইস!ললিতা!তোমার দেখছি মস্ত জ্বর উঠেছে।”
“জ্বরই উঠল বোধহয়।” ললিতা আগের চে’ কোমল গলায় বলল,“জ্বর থেকেও মাথার ব্যথা আরও কাহিল করেছে। আমি সেই কখন শুয়ে পড়তাম।তোমার পথ চেয়ে শুধু বসে আছি।কিছু একটা অল্প রেঁধে রেখেছি।তুমি খাও।আমি আর আজ খেতে পারব না।”
ললিতা শুয়ে পড়তে তৈরি হল।
প্রহ্লাদ জগন্নাথ চৌধুরীর চিঠিটা খুলে পড়তে শুরু করল,“প্রিয় প্রহ্লাদবাবু,আপনার সিদ্ধান্তটা জানতে এসেছিলাম। মুখ্যমন্ত্রী বড় তাগাদা দিচ্ছেন।তা আমারই দুর্ভাগ্য যে আপনাকে পেলাম না।এক জরুরি সামাজিক অনুষ্ঠানে আমি কাল শিলং যাচ্ছি।দিন তিনেক পরে ফিরে আসব।এসেই আপনার সঙ্গে দেখা করব।আশা করি,দেশের বৃহত্তর স্বার্থের কথা ভেবে আপনি আমাদের নিরাশ করবেন না।”
প্রহ্লাদ রান্নাঘরে গেল।টেবিলে তার ভাত ঢাকা।ঢাকনা তুলে দেখে---ভাত,অল্প ডাল আর সামান্য আলু ভাজা। কিছুক্ষণ সে চেয়ারটাতে এমনি বসে রইল।তারপর ভাত ক’টা আবার ঢেকে রেখে বেরিয়ে গেল।মানিক-মুনমুনদের কাল সকাল বেলা যদি খাবার কিছু না থাকে তবে এ ভাতগুলোই কাজে আসবে।
সে বিছানাতে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে ললিতা বলল,“আজ তোমার এত তাড়াতাড়ি খাওয়া হয়ে গেল?”
প্রহ্লাদ বলল,“কেন,যেটুকু সময় লাগে,সেটুকুই তো লাগল।” অনেকক্ষণ দুজনে নীরব আর নিশ্চল হয়ে পড়ে রইল। নীরবতা এর গম্ভীর হয়ে পড়েছিল যে ললিতার বুকের ধুকপুক শব্দটাও প্রহ্লাদ যেন শুনতে পাচ্ছিল।এমনটা ওর মনে হচ্ছিল। হঠাৎ সে অনুভব করল এ নীরবতা দুজনের মাঝে প্রাচীর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।জীবনে এতটা নিঃসঙ্গ সে কক্ষনো অনুভব করে নি। তার পুরো শরীরে একটা গোপন ভয়ের শিহরণ ঢেউ খেলে গেল।সবাই তাকে ত্যাগ করেছে।সংসার ত্যাগ করেছে।আদর্শ ত্যাগ করেছে।যৌবন ত্যাগ করেছে।শেষ আশ্রয় ছিল ললিতা।শেষ অব্দি সেও না ত্যাগ করছে।সে হাতটা মেলে ললিতার কপালটা ছুঁল। জ্বরে ওর শরীর পুড়ে যাচ্ছে যেন।অপুষ্টি আর হাড়ভাঙা খাটুনি মানুষটাকে অকালে বুড়ি আর বেমারি করে ফেলেছে।জীবনে অনেকবার মুখোমুখি হওয়া প্রশ্নটা আবার একবার তার মনে জেগে উঠল।জীবনের ঠিক কী আদর্শের বেদীতে সে তার ভালোবাসার মেয়েটিকে বলি দিচ্ছে?চেখভের ‘আঙ্কল ওয়ানিয়া’ নাটকের সেই অক্ষম আত্মপ্রতারক লেখকের কথা আরও একবার তার মনে পড়ল।বেচারি স্ত্রীটি ভাবছিল তার স্বামী মস্ত বড় লেখক,সমস্ত জীবন সে এক মাস্টারপিস লেখার কাজে উৎসর্গ করেছে।এ ধারণার বশবর্তী হয়ে সে তার স্বামীর জন্যে পুরো জীবনপাত করল।পরে জীবন সন্ধ্যায় এসে দেখা গেল যে স্বামীটির বিন্দু মাত্র প্রতিভা ছিল না।এক দুঃসাধ্য নিষ্ফল কাজে সে নিজের জীবনটা তো অপচয় করলই সঙ্গে স্ত্রীর জীবনটাও সমূলে ধ্বংস করল।সে কি নিজেও আজ ঠিক তাই করছে না?ললিতার জ্বর-তপ্ত কপালে হাত বুলিয়ে প্রহ্লাদ ডাক দিল,“ললিতা!”
প্রহ্লাদের আর কিছু বলতে হল না।ললিতা বলে ডাক দেবার সঙ্গে সঙ্গে ও তার মনে জমা হওয়া সব কথা যেন বুঝে নিল।মান-অভিমান সব ভুলে সে স্বামীর বুকের কাছে চেপে এল আর দু-হাতে তাকে জড়িয়ে ধরে বলল,“আমার আজ বড় ভয় হচ্ছে,ভয়ে আমার জ্বর উঠে গেছে।”
“ভয়?” প্রহ্লাদ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল,“কীসের ভয়?” ললিতা বুকের মধ্যে থেকে চিঠি একটা স্বামীকে দিয়ে বলল,“এই চিঠিটা পড়ে দেখ।তুমি বেরিয়ে যাবার পরে পরেই পিয়ন দিয়ে গেল।কী ভেবে যেন চিঠিটা আমি খুলে পড়লাম, বলতে পারব না।কিন্তু এখন ভাবছি পড়ে ভালোই করলাম।না হলে এ চিঠিটার কথা তুমি নিশ্চয়ই আমার কাছে বলতে না চেপে যেতে।” বিস্ময়ে প্রহ্লাদ কিছুক্ষণ প্রহ্লাদ হতভম্ব হয়ে রইল।তারপর কম্পিত বুকে বিছানার থেকে উঠে এল।আলো জ্বেলে চিঠিটা পড়তে শুরু করল।
প্রিয়
প্রহ্লাদ হাজরিকা,
আমি আপনার শুভাকাঙ্ক্ষী।সে জন্যই আপনাকে সময় থাকতে সাবধান করে দিতে চাইছি।আপনি কারও কথা না শুনে যে তদন্তে নেমেছেন,সে তদন্ত এই চিঠি পাবার সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ করুন।অন্যথা আগামী দুমাসের মধ্যে আপনার পত্নী অকাল বিধবা হবে।এ সাবধান বাণীকে স্রেফ এক ঠাট্টা ভেবে যদি আপনি উড়িয়ে দিতে চাইছেন তবে একটা কথা আপনার মনে পড়িয়ে দেই।আপনার নিশ্চয় মনে আছে,আজ প্রায় দুমাস আগে পুলিশ ইন্সপেক্টর দয়াল হাজরিকার একটা স্কুটার দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়। আমাদের সাবধান বাণী না শোনার জন্যেই বেচারার এমন করুণ মৃত্যু হতে পারল। যে কোনও মুহূর্তে এমন আরও এক দুর্ঘটনা হতে পারে।গুয়াহাটির পথে এমন দুর্ঘটনায় কত মানুষ মরে কেবা তার খবর রাখে?এমনকি পুলিশের লোক দেখানো তদন্ত একটাও হবে না।আপনাকে আমাদের এই প্রথম আর শেষ সাবধান বাণী।আপনার পত্নী অকালে বিধবা হয়ে পথের ভিখারি হোন, এ আমরা চাই না।
ইতি
আপনার শুভাকাঙ্ক্ষী
‘সর্দার’
চিঠিটা পড়ে শেষ করে প্রহ্লাদ আরও একবার পড়ল।ললিতার কথা একেবারে ভুলে গিয়ে সে কিছুক্ষণ থমকে রইল। হঠাৎ একবার ললিতার গলা শুনে সে চমকে উঠল,“তুমি বিছানায় উঠে এস।আমাকে এসে কথাগুলো বল।”
টেবিলের দেরাজে চিঠিটা রেখে সে আবার বিছানায় পড়ল।ললিতা তাকে জড়িয়ে ধরে আর্তস্বরে বলল,“মাণিক মুনমুনের শপথ নিয়ে বলছি,আমাকে সব কথা খুলে বল।একটাও কথা আমার থেকে লুকোতে পারবে না।বল,বলছি না। তাত্তাড়ি বল। বল না কেন?”
হঠাৎ সে হুক হুক করে কাঁদতে শুরু করল।
ললিতার পিঠে হাত বুলিয়ে বুলিয়ে প্রহ্লাদ কিছুক্ষণ নীরব রইল।মনে মনে সে ভাবতে শুরু করল,“কী আশ্চর্য যোগাযোগ!জগন্নাথ চৌধুরীর স্বনামা চিঠি আর সর্দারের বেনামা চিঠি—দুটোই একসঙ্গে এল।দুজন নিশ্চয় পরস্পরের সঙ্গে আলোচনা করে চিঠি দুটো লেখেনি।অথচ দুজনের উদ্দেশ্য একই।শুধু কৌশল আলাদা।একজন ভীতি প্রদর্শন করছে,অন্যজনে প্রলোভিত করছে।এই ভীতি প্রদর্শন যে ধোড়া সাপের ফিসফিসানি নয়,বিষধর কালান্তক শাপের দংশনোদ্যত প্রস্তুতি সে কথা আমি ভালো করেই জানি।একদিন আমি রাস্তায় হেঁটে যাবার সময় এক দ্রুতগামী লরি এসে আমাকে ধাক্কা দিয়ে পিষে গুড়িয়ে চলে যাবে,পরদিন খবরের কাগজে বেরোবে যে রাস্তায় লরি দুর্ঘটনায় সাংবাদিক প্রহ্লাদ হাজরিকার মৃত্যু।ইন্সপেক্টর দয়াল হাজরিকার মৃত্যুও এভাবেই হয়েছিল।নগরওয়ালা মামলার তদন্ত করেছিলেন যে পুলিশ আধিকারিক কাশ্যপ---তাঁরও মৃত্যু এভাবেই হয়েছিল।ভারতে ফিজিক্যাল এনিহিলেশনের এই এক নয়া খেলা শুরু হয়েছে।কোনও সন্দেহ নেই যে আজ আমার বিরুদ্ধে ডেথ সেন্টেন্স,মৃত্যু দণ্ডাজ্ঞা জারি হয়ে গেল।আজ থেকে আমি ফাঁসির অপেক্ষমাণ কয়েদি।খুব শীঘ্রই আমাকে করণীয় কী তা ঠিক করে নিতে হবে।”
ললিতা গায়ের জোরে তাকে ঝাঁকিয়ে বলল,“তুমি চুপ করে আছ কেন?কিছু একটা আমাকে বল না কেন? মনে রেখো,আমি তোমাকে মানিক আর মুনমুনের শপথ দিয়েছি।”
প্রহ্লাদ শান্তভাবে বলল,“অধৈর্য হয়ো না ললিতা।জীবনে আমি তোমার থেকে কোনও কথা গোপন করিনি।আজও করব না।কিন্তু আমার কথাগুলো বলবার আগে জীবনে অনেকবার করা প্রশ্ন আজ আর একবার করছি।আজ আমরা দরিদ্র।কিন্তু তুমি জান,এ দারিদ্র্য আমরা স্বেচ্ছায় বরণ করে নিয়েছি।আমাদের গ্রামে থাকা লাখ টাকার পৈত্রিক জমিবাড়ি যখন আমি আমার ভূমিহীন আধিয়ারদের দান করে দেই তুমি তখন বাধা দাও নি।বরং উৎসাহ দিয়েছিলে।কেন?”
ললিতাও সমান শান্তভাবে উত্তর দিল,“পৃথিবীতে ধনসম্পত্তি থাকা মানুষ অনেক আছে।কিন্তু হৃদয় থাকা মানুষের সংখ্যা অতি নগণ্য।গতানুগতিক জীবনে ধরাবাঁধা পরিচিত পথ পরিহার করে নিজের জন্য আলাদা পথ কেটে নিয়ে পারা মানুষ খুব কম।কোটির মধ্যে কখনও বা একজন বেরোয়।আমার বাবা ছোটো থাকতে আমাদের রামায়ণ মহাভারত পুরাণ উপনিষদের অনেক সুন্দর গল্প বলে বলে নীতিশিক্ষা দেবার চেষ্টা করতেন।তারই একটা গল্প আমার ভাবপ্রবণ কোমল মনে বড় রেখাপাত করেছিল।ঋষি যাজ্ঞবল্ক্য যখন তাঁর সমস্ত সম্পত্তি গরু গাড়ি দুই পত্নীর মধ্যে ভাগ করে দিয়ে স্বয়ং বনবাসী হতে যাচ্ছিলেন তখন দ্বিতীয়া পত্নী মৈত্রেয়ী তাঁকে বললেন,‘যেনাহং নামৃতস্যাম কিমহং তেন কূর্যাম’—যার দ্বারা অমৃত লাভ হয় না,তাই নিয়ে কী করব? আমি ধনসম্পত্তি চাইনি,চেয়েছিলাম তোমাকে।”
প্রহ্লাদ বলল,“সে ছিল বালিকা বয়সের ভাবপ্রবণ হৃদয়ের কথা।জীবনের একটা সময় অনেক লোকই এরকম ভাবে। প্রাণশক্তির প্রাচুর্যের মানুষ তখন পার্থিব সুখ-সম্ভোগ,ধনসম্পদকে অতি তুচ্ছ বলে গণ্য করে।এক অপার্থিব জগৎ তখন মানুষকে দু’হাত তুলে ডাকে।কিন্তু উষার ভুবনমোহিনী সোনালি আলো মানুষের মনে যে অপার্থিব আবেগ জাগিয়ে তুলে,ভর দুপুরের অগ্নিবর্ষী সূর্য সেই একই আবেগকে কখনোই জাগিয়ে তুলতে পারে না।সে বরং চোখকে দগ্ধ করে।দেহমনকে ক্লান্ত করে। জগন্নাথ চৌধুরীর মতো যে দেশসেবক একদিন যৌবনের আবেগে ব্রিটিশ সরকারের হাকিমের পথ ত্যাগ করে লৌহ শৃঙ্খল আর কারাগার বরণ করে নিয়েছিল,সমগ্র জীবন বিপন্ন করেছিল,সেই মানুষটা আজ পঞ্চায়েতের সভাপতির পদ একটাও ত্যাগ করতে পারে না।সত্য বল ললিতা,আজ তুমি যখন পেট ভরে খেতে পাও না,টাকার অভাবে রোগের চিকিৎসা করতে না পেরে তিলে তিলে নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে এগিয়ে যাও,সন্তানের সামান্য আশা আকাঙ্ক্ষাও পূরণ করতে পার না,আর যখন বিশেষ করে জান যে এই সমস্ত ত্যাগ আর কৃচ্ছ্রসাধন একেবারেই অর্থহীন,তা দিয়ে নিজের বা সংসারের বিন্দুমাত্র কল্যাণ হয় নি,তখনও তোমার সামান্যও অনুতাপ হয় কি না?জীবনটা নতুন করে আরম্ভ করতে,অভাবমুক্ত জীবন একটা পেতে,জীবনে সামান্য সুখ স্বাচ্ছন্দ্যের মুখ দেখতে তোমার একবারও ইচ্ছে হয় না?”
ললিতা কোনও কিছু না ভেবে উত্তর দিল,“ইচ্ছে হলই বা।কিন্তু সেই সুযোগ এখন পাব কী করে? জীবনের এখন শেষ সময়। ফুরিয়ে যাবার সময় হল।এখন আর জীবনটা নতুন করে আরম্ভ করার কথা ভাবতে পারি কী করে?”
ললিতার কথাগুলোর আসল অর্থ বুঝে নিতে প্রহ্লাদ কিছু সময় নিল।তারপর খুব ধীরে ধীরে সে বলল,“তাহলে একটা সুযোগ যদি আসে তুমি নেবে?”
হঠাৎ পরিবেশ লঘু করবার চেষ্টা করে ললিতা অল্প হেসে নিয়ে বলল,“লটারিতে লাখ খানিক পেলে বুঝি?তার বাইরে তো আমাদের ভাগ্য পরিবর্তনের কোনও উপায় আমি দেখছি না। ... কিন্তু দাঁড়াও!এসব গাঁজাখুরি গল্প বলে তুমি আমাকে আসল কথাটা ভোলাবার চেষ্টা কর না।আমাকে সেই চিঠিটার কথা বল।তুমি এমন কি করেছ –যার জন্য সর্দার না কি সেই লোকটা আমাকে বিধবা করেই ছাড়বে?” ওর কথায় আগের ভয় আর উৎকণ্ঠা পুরোটাই আবার ঘুরে এল।
ললিতার এবার ধৈর্যচ্যুতি ঘটল।সে উত্তেজিত হয়ে বলল,“তুমি যে ঘুরিয়ে প্যাঁচিয়ে দীর্ঘ ভূমিকা জুড়ছ,আসল কথাগুলো তাড়াতাড়ি বল না কেন? এমন এক চিঠি পাবার পর মেয়ে মানুষের মনের অবস্থা কী হতে পারে তুমি কল্পনা করতে পার না কি? তোমার থেকে আর কোনও কথা শুনতে চাই না।এখনই আমাকে তোমার আসল কথাটা বলতে হবে।”
প্রহ্লাদ দীর্ঘ এক শ্বাস ছেড়ে বলল,“শুনতেই যদি চাইছ তবে শোন।সংক্ষেপেই বলছি।খুব টায়ার্ড ফিল করছি।বেশি কথা বলবার শক্তি নেই শরীরে।তুমি জান যে আমাদের দেশে মাল পরিবহনের প্রধান উপায় রেলগাড়ি।রেলের এই মালগাড়ি করে যত জিনিস আনা হয় তার আধাটাই কিন্তু গন্তব্যে গিয়ে পৌঁছয় না।আধা জিনিসই মাঝপথে চুরি হয়।যে দুর্বৃত্তরা কাজটা করে তাদের ওয়াগন ব্রেকার বলে।রেলের ওয়াগন ভেঙে তারা লাখ লাখ টাকার জিনিস কতগুলো অসৎ ব্যবসায়ীকে সস্তা দামে বিক্রি করে।ব্যবসায়ীরা আবার সেগুলো চড়া দামে বিক্রি করে কোটি কোটি টাকার মুনাফা করে।এক বিশাল আর দুর্জেয় পাপচক্র দীর্ঘকাল ধরে সারা দেশে এই বেপরোয়া দিনে ডাকাতি করছে।এর ফলে কী বিপুল পরিমাণের জাতীয় ক্ষতি হয় তার হিসেব পাওয়াও দুষ্কর।জিনিসের কৃত্রিম অভাব হয়।মূল্যবৃদ্ধি হয়।কালোটাকার পাহাড় সৃষ্টি হয়।রেলওয়ের যে বিরাট আর্থিক ক্ষতি হয় তা পূরণ করা হয় যাত্রীভাড়া আর কর বৃদ্ধি ইত্যাদি করে।অথচ এসব কুকর্ম কখনও ধরা পড়ে না কেন?সরকার বছরের পর বছর ধরে এই সব ভয়ঙ্কর দিনে ডাকাতি অসহায় দর্শকের মতো চেয়ে দেখে কেন? পুলিশে খবর দিলে এই সব ওয়াগন ব্রেকার ধরা দূরের কথা,সামান্য একটা তদন্তও হয় না কেন?সশস্ত্র রেলওয়ে প্রটেকশন ফোর্সের চোখে ধুলো দিয়ে দিনে দুপুরে রেল ওয়াগন থেকে হাজার হাজার টন জিনিস পত্র উধাও হয়ে যায় কী করে?”
এক সঙ্গে অনেকগুলো কথা বলে প্রহ্লাদ বোধ হয় সামান্য ক্লান্ত হল।কিছু সময় নীরব হয়ে থেকে সে দুই একবার দীর্ঘ শ্বাস নিল তার মনে পড়ল যে আজ তার পুরো দিনটা মানসিক অশান্তি আর উত্তেজনার মধ্য দিয়ে গেছে।আজ রাতে সে ভাত খায় নি।ভাঙা শরীর আর মন নিয়ে ঘরে ফিরে এসে ললিতাকে রুগ্ন আর মৃতপ্রায় অবস্থাতে দেখে আজ তার দুঃখের পাত্র উপচে পড়ছে।কথা বলবার ইচ্ছে তার একেবারেই হচ্ছিল না,প্রতিটা শব্দ উচ্চারণে তার ক্লান্তি বাড়ছিল।তার শুধু ইচ্ছে হচ্ছিল চিরদিনের মতো সম্পূর্ণ নীরব হয়ে যেতে।জীবনের সংগ্রামে চূড়ান্ত পরাজয় বরণ করে নিতে। কিন্তু সে অনুভব করল,ললিতা প্রায় রুদ্ধ শ্বাস নিয়ে তার কথা শোনার জন্যে কান খাড়া করে রেখেছে।যদি সে আজ চুপ করে থাকে পুরো রাত ওর শোয়া হবে না। পুরো জীবন নীরব যন্ত্রণায় ছটফট করে মরবে।
প্রহ্লাদকে নীরব দেখে ললিতা বলল, “এসবের মধ্যে যে তুমি এসে পড়লে কী করে?”
“কী আশ্চর্য!” প্রহ্লাদ বিষাদ মাখানো হাসিতে বলল, “আমি ভেবেছিলাম যে অল্প আগে আমি যে কটা প্রশ্ন করলাম, তোমার মনেও সেই একই প্রশ্নের উদয় হবে,আর তুমি আমার থেকে সেগুলোর উত্তর চাইবে।তা না করে তুমি কিনা শুধোলে আমি এসবের মধ্যে এলাম কী করে?নিজের স্বার্থের প্রশ্ন যখন এসে পড়ে,তখন বেশিরভাগ মানুষের জন্যই জীবনের আর সব বড় বড় কথা অতি তুচ্ছ হয়ে যায় না? আরও শোন।আমার আজ সব কথা তোমাকে বলতেই হবে।দেশের আরও অনেক জায়গার মতো আমাদের এখানেও নিউ গুয়াহাটি স্টেশনের রেলওয়ে ইয়ার্ডে বছরের পর বছর ধরে এই দিনে ডাকাতি চলে আসছে। দেশের নানা জায়গা থেকে শতশত ওয়াগন এসে এখানে জমা হয়। সেগুলোতে গম,চাল,চিনি,মিঠাতেল,ডালডা আদি নানা খাদ্যসামগ্রী থাকে।এক সুসংগঠিত চোর আর ওয়াগন ব্রেকারের দল নিয়মিতভাবে সেখান থেকে সেগুলো বিক্রি করে কিছু ব্যবসায়ীকে বিক্রি করে।কিন্তু কখনওই তারা ধরা পড়ে না।কাগজে সবিস্তারে খবর বেরোলেও কোনও কাজ হয় না।পুলিশকে খবর দিলেও কোনও তদন্ত হয় না।তোমার মনে আছে কি আজ প্রায় বছর দেড়েক আগে যখন গুয়াহাটির খোলা বাজারে চালের দাম কিলোতে তিনটাকা হয়েছিল তখন একদিন একজন বিহারি মহিলা মাথায় একটা চালের বস্তা নিয়ে আমাদের ঘরে চাল বিক্রি করতে এসেছিল?দাম চাইছিল মাত্র দেড় টাকা?তোমার মনে কোনও প্রশ্ন জাগেনি?কিন্তু আমার জেগেছিল।কারণ অস্বাভাবিক কিছু একটা দেখলে প্রশ্ন করা আর উত্তর খোঁজাই আমার জীবিকা।আমি একজন সত্যান্বেষী সাংবাদিক।কেঁচো খুড়তে গিয়ে সাপ বেরিয়ে এল।জানলাম, রেলওয়ের জিনিস চুরি করা ছোটো ছোটো চোরগুলো অনেক গরিব মহিলাকে কমিশন দিয়ে সেই চোরাই মাল বিক্রিতে নিয়োগ করে।কিলোতে দেড়টাকা দামে চাল বিক্রি করে পঞ্চাশ পয়সা সে মহিলাকে কমিশন দিলেও চোরগুলোর লোকসান কিছু নেই।কারণ তার জন্য তাদের পকেট থেকে একটা পয়সাও যায় নি।কিন্তু এগুলো হল খুচরো চোর। কোটি কোটি টাকার লেনদেন করা আসল বড় চোরগুলো তাদের চুরির মাল বিক্রি করে গুয়াহাটির অনেক বড় বড় ব্যবসায়ীকে। কিন্তু তারা কখনোই ধরা পড়ে না।কারণ,কোটি কোটি টাকার এই পাপ ব্যবসার অংশীদার অনেকে।এ অংশীদারগুলো হল চোরের দল,ওয়াগন ব্রেকারের দল,রেল-কর্মচারী,রেলওয়ে প্রটেকশন ফোর্স,অসামরিক পুলিশ আর দেশের হর্তাকর্তা অনেক বড় বড় রাজনৈতিক নেতা।দেখেও না দেখার ভান করে থাকার জন্য পুলিশ কমিশন পায় ওয়াগন ব্রেকার আর ব্যবসায়ীর থেকে।সেই পুলিশের মধ্যে যদি বা দুএকটা ব্লেকশিপ বেরোয়—যেমন ইন্সপেক্টর দয়াল হাজরিকা।যেসব মানুষ বিবেক নামের এক দুরারোগ্য ব্যাধিতে ভোগে,তাদের নিজের দুঃসাহস আর স্পর্ধার মূল্য চুকোতে হয় নিজের প্রাণ দিয়ে।সরকার সব জেনে শুনেও কেন নীরব আর নিষ্ক্রিয় দর্শক হয়ে থাকে? কারণ সরকারের এই চোরাই মালের ব্যবসা করে কোটিপতি হয়েছে এমন ব্যবসায়ীর বেতনভোগী এজেন্টরা হচ্ছে সরকারের ভিত্তি।মানুষ ভাবে যে দেশ চালায় সে সরকার।কিন্তু সরকারকে চালায় কে? সরকার চালায় এই ব্যবসায়ীরা।এক এক জন ধনি ব্যবসায়ী এক দেড়শ নেতা-পালিনেতাকে পোষে। সংসার চালাবার খরচ থেকে আরম্ভ করে নির্বাচন খরচ পর্যন্ত, মাসে বিমানে দিল্লি যাওয়া আসার খরচ থেকে শুরু করে ছেলেমেয়ের পড়াশোনা, বিয়ের খরচ পর্যন্ত ---- আমাদের বেশিরভাগ দেশ নেতার সমস্ত আর্থিক দায়িত্ব বহন করে এ ব্যবসায়ীরা।কোনও কোনও সমাজবাদী দেশনেতার ছেলে কোন ব্যবসায়ীর ধনে বিদেশে উচ্চশিক্ষা নিয়ে এসেছে সে কথাও আমরা জানি।আমাদের বাইরেও হয়তো অনেকে জানে।কিন্তু একটা কথা বেশির ভাগ জানে না যে কোনও ব্যবসায়ীই সৎ উপায়ে অর্জন উপার্জন করা ধন এমন পরার্থে ব্যয় করে না।ভাড়াটে রাজনৈতিক দালাল পোষে রাখতেও ব্যয় করে না।চুরি-ডাকাতি করে উপার্জিত কালোটাকাতেই এরা দেশের শাসকদের কিনে রাখে।এ এক vicious circle বা দুষ্টচক্র।রাজনীতিকদের ব্যবসায়ীকে দরকার নিজেদের পরিবার চালাবার জন্য,ইলেকশন খেলার জন্য,রাজনীতি করবার জন্য।ব্যবসায়ীর রাজনীতিককে দরকার আইনের চোখে ধুলো দেবার জন্য,ধরা না পড়ে অবাধে পাপ ব্যবসা চালাবার জন্য।নিউ গুয়াহাটি রেলওয়ে ইয়ার্ডে চলা দিনে ডাকাতি কোনও দিন ধরা না পড়বার কারণ এটাই।এই দিনে ডাকাতি বাধা দেবার বা ধরার দায়িত্ব যাদের উপর সমাজ ন্যস্ত করেছে তাদের প্রত্যেকেই--- রাজনীতিক,সরকারি আমলা,পুলিশ—প্রত্যেকেই ওয়াগন ব্রেকার আর কালোবাজারির থেকে কমিশন পায়।এই পাপচক্রের প্রধান অস্ত্র দুটি --- টাকা আর হত্যা।তুমি যদি টাকা নিয়ে সন্তুষ্ট না হও,তবে একমাত্র বিকল্প হল তোমাকে একেবারে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া।কারণ মরা মানুষ কখনও কথা বলে না।দয়াল হাজরিকা মুর্খামি করে টাকাকে তুচ্ছ জ্ঞান করেছিল।ফলে আজ তার হাড়ে ঘাস জন্মাচ্ছে।যেভাবে এ হত্যাকাণ্ডগুলো হয় সেগুলো ধরবারও কোনও উপায় নেই।কারণ এসব আকস্মিক মৃত্যু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বন্দুকের গুলি বা ছুরির আঘাত থাকে না।তুমি রাস্তা দিয়ে হেঁটে,সাইকেলে বা স্কুটারে যাচ্ছ।হঠাৎ প্রচণ্ড বেগে ট্রাক একটা এসে তোমাকে পিষে গুড়িয়ে একটা মাংসপিণ্ডে পরিণত করে চলে গেল।”
ললিতা একটু নড়ে চড়ে দুহাতে প্রহ্লাদকে জোরে জড়িয়ে ধরল।
“এখন নিশ্চয়ই তুমি বুঝেছ।”প্রহ্লাদ বলে গেল, “আজ একই দিনে দেশনেতা জগন্নাথ চৌধুরী আর ‘নিনাও সর্দারে’র চিঠি দুটো আসার অর্থ কী?গত ছয় মাস ধরে আমি অবিরাম তদন্ত করে এই সমগ্র পাপচক্রের সমস্ত গোপন তথ্য উদঘাটন করেছি।আমার রিপোর্ট আমাদের প্রকাশ তো করলই না,বরং সেই কথা জগন্নাথ চৌধুরীকে জানিয়ে দিল।আমাদের কাগজে এই সব ভয়ঙ্কর তথ্য প্রকাশ হতে পারে বলে জগন্নাথ চৌধুরী এখন মোটেও ভয় করে না।তবুও সাবধানের মার নেই।আমার হাতে এই সব তথ্য থাকা পর্যন্ত সে বা তার অংশীদারেরা কখনও পুরো নিশ্চিন্ত হতে পারে না।আমি কৌশল করে অন্য কোনও কাগজে এই সব তথ্য প্রকাশ করবার ব্যবস্থা করতে পারি।জগন্নাথ চৌধুরীকে ব্লেকমেইল করতে পারি।তাই চিরদিনের জন্য আমার মুখ বন্ধ করতে তারা এক সঙ্গে দুদিক থেকে অস্ত্র শানাচ্ছে।একটা হল লোভনীয় চাকরির প্রলোভন।অন্যটা হল ‘সর্দারে’র চিঠির ভীতি প্রদর্শন।”
ললিতার সারা গায়ের উপর দিয়ে একটা ভয়ের শিহরণের ঢেউ খেলে গেল।সে প্রহ্লাদের আরও ঘনিষ্ঠ হয়ে আতঙ্কিত গলায় বলল,“ কিন্তু তুমি যে বললে,---তারা পুলিশ ইন্সপেক্টর দয়াল হাজরিকাকে হত্যা করছে।তুমি যদি জগন্নাথ চৌধুরীর প্রস্তাবে সম্মত হয়ে চাকরিটা না নাও,তুমি যদি চুপচাপ থাকো...।”
“তবে তুমি একদিন খবর পাবে যে তোমার স্বামী প্রহ্লাদ হাজরিকা পথে লরি চাপা পড়ে মাংসপিণ্ডে পরিণত হল।” প্রহ্লাদ এক তিক্ত নির্মম হাসি হাসল।
দুজনেই কিছুক্ষণ নীরব হয়ে রইল।
ললিতার ভয়ে কেঁপে উঠারুগ্ন বুকের ঢুক ঢুক শব্দগুলো প্রহ্লাদের কানে পড়তে শুরু করল।কিন্তু হঠাৎ সে ললিতার প্রতিও নির্মম হয়ে উঠল।ওর যতগুলো দুঃখ পাবার আছে একসঙ্গেই পাক।একটু একটু করে পেয়ে কী লাভ?সে আবার বলতে শুরু করল,“শোন ললিতা,কথা শেষ হয় নি।আরও কথা আছে।গেল কদিন ধরেই শুনছি আমাদের কাগজটা যেকোনও দিন বন্ধ হয়ে যেতে পারে।কাগজটা অনেক লোকসানে চলছে।সার্কুলেশন দ্রুত কমে আসছে।সম্পাদক সরকারের সঙ্গে একটা গোপন চুক্তি করেছে।আগামী ছয়মাসের মধ্যে রাজ্যসভাতে অসমের এক আসন শূন্য হবে।এই ছয়মাসের মধ্যে আমাদের সম্পাদক সরকারের এমন একটা উপকার করে দেবে যে --- আমার রিপোর্টটা প্রকাশ না করে ইতিমধ্যেই একটা উপকার তো করেইছে--- তাঁকে রাজ্যসভাতে কংগ্রেসের মনোনয়ন দেওয়া হবে।কাগজের মালিককে প্রেসটা বড় করবার জন্য সরকার একটা বড় রকমের ঋণ দেবে।খবরের কাগজের লোকসানি ব্যবসা ছেড়ে সে সরকারের বড় বড় কাজের ঠিকা পাবে। মরবে তবে কে? তোমার স্বামীর মতো কয়েকটি হতভাগা। তোমার সামনে এখন জীবন মরণ সমস্যা।একদিকে হত্যার হুমকি আর কর্মচ্যুত হবার নিশ্চিত সম্ভাবনা।অন্যদিকে জগন্নাথ চৌধুরীর এগিয়ে দেওয়া পনেরোশ’ টাকা মাইনের চাকরি।গোটা জীবন আদর্শের কথা বললে। আমিও বললাম।তথাকথিত আদর্শের নামে সর্বস্ব ত্যাগ করেও আর চরম দুঃখব্রত বরণ করে নিয়েও কারও থেকে একদিনের জন্যও কোনও স্বীকৃতি পাইনি।একটা প্রশংসার উক্তি শুনি নি।বরং জীবন জুড়ে শুনতে হয়েছে নিন্দার শরাঘাত।পান করতে হয়েছে ঈর্ষা আর সন্দেহের হলাহল।সেসবও সহ্য করতাম,যদি দেখতাম যে সমগ্র জীবন ধরে অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে করা যুদ্ধে একটাও অন্যায়ের প্রতিকার করতে পেরেছি।বরং আমার সমস্ত আঘাত হাতির পিঠে অঙ্কুশের মারের থেকেও নিষ্ফল আর অসার প্রতিপন্ন হয়েছে।তবুও আমার একটা সান্ত্বনা ছিল।অন্যে যে যাই বলুক আমি নিজে বিশ্বাস করি যে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ,অন্যায়ের প্রতিকার করতে না পারলেও বা অন্যায়কারীকে শাস্তি দিতে না পারলেও প্রতিবাদ যে করে তার মনটা অন্তত মহৎ হয়ে থাকে।এ তার নৈতিক জীবনকে বলবান করে তুলে।মানুষের হৃদয়ে প্রতিবাদের তুষের আগুনটুকু জ্বালিয়ে রাখে। অনুকূল পরিবেশ তৈরি হলে একদিন তার থেকেই দাবানল জ্বলে উঠবে।সেই আগুন নিশ্চয় একদিন পুঞ্জিভূত পাপ আর অন্যায় অবিচারকে পুড়িয়ে ছাই করবে।আর কিছু করতে না পারলেও আমি এই তুষের আগুনটা জ্বালিয়ে রেখেছিলাম। ‘মানুষের আত্মাকে রক্ষা করতে না পারলেও তাকে রক্ষা করবার জন্য যোগ্য করে রেখেছিলাম।’ কিন্তু আজ তো আমার চরম সর্বনাশ উপস্থিত। আর এক সপ্তাহ বা এক মাসের পর আমি হয় সপরিবারে পথের ভিখিরি হব অথবা ‘সর্দারে’র লরির তলায় চাপা পড়ে পথের কুকুরের মতো মৃত্যু বরণ মৃত্যু বরণ করব।কিন্তু এখনও আমার হাতের মুঠোয় আছে জগন্নাথ চৌধুরীর পনেরোশ’ টাকা মাইনের চাকরির প্রস্তাবটা।ললিতা,আমার সহধর্মিণী,আমার জীবনের এই ধর্ম সংকটের সময় তুমি আমাকে কী করতে উপদেশ দাও?”
ললিতা অনেকক্ষণ নীরব থেকে পরে বলল,“জীবনে কোনোদিনই তোমাকে উপদেশ দেবার ধৃষ্টতা আমার হয়নি। আজও হবে না।তুমি কখনও ভুল করনা—এই বিশ্বাসই আমার জীবনের ধ্রুবতারা। ... আমি বুঝতে পারছি, আমাদের জীবনে এক বড় পরীক্ষার সময় উপস্থিত হয়েছে।সে পরীক্ষার ফলাফল পৃথিবীর কাউকে স্পর্শ করবে না।কারও জীবনে তিলমাত্র ক্ষতিবৃদ্ধি ঘটাবে না।কিন্তু আমাদের এ ছোট্ট গরিব পরিবারটার জন্য এ জীবন-মরণ সমস্যা। ... তুমি নিজে কী করবে বলে ভেবেছ?”
প্রহ্লাদ হঠাৎ বিছানার থেকে উঠে গিয়ে লাইটটা জ্বালাল আর টেবিলে পড়ে থাকা দুটো চিঠি তুলে নিয়ে পরম ঘৃণায় টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেলল।ললিতা মশারির ফাঁক দিয়ে স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। চিরকালের পরিচিত মানুষটাকে হঠাৎ আর খুব অচেনা যেন লাগল।প্রহ্লাদের মুখের থেকে এমন এক জ্যোতি বেরোতে শুরু করেছে যা সে এর আগে কোনও দিন দেখেনি।প্রহ্লাদ লাইটটা নিভিয়ে আবার বিছানায় এল।কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল – নিশ্ছিদ্র অন্ধকারের ভেতর থেকে ওর স্বর যেন গলার থেকে না বেরিয়ে বহু উপরের কোনও অশরীরী কণ্ঠের থেকে বেরোচ্ছে যেন মনে হল,“ললিতা এমন এক সংকট আমার জীবনে কোনও দিনই আসে নি।অতীতেও হাজারো মানুষের জীবনে এসেছিল। ভবিষ্যতেও হাজারো মানুষের জীবনে আসবে।প্লেটোর রিপাবলিকে আডিমেণ্টাস দুজন মানুষের জীবনের ছবি এঁকেছেন। একজন ভয়ঙ্কর পাপী আর শয়তান। কিন্তু তার জীবন অতিবাহিত হল পরম সুখে।মৃত্যুর মুহূর্তেও সে লাভ করল সমস্ত মানুষের শ্রদ্ধা আর সম্মান।অন্যজন সারাজীবন অশেষ দুঃখ বরণ করে সৎ পথে থেকেও সবার থেকে পেল শুধু নিন্দা,অপবাদ আর ধিক্কার।কেবল তাই নয়,শেষ অব্দি তাকে ক্রুশে বিঁধে হত্যা করা হল।এ দুজনের নমুনা দেখিয়ে আডিমেণ্টাস প্লাটিনাসকে জিজ্ঞেস করলেন,‘তুমি এই দুয়ের মধ্যে কোন জীবনটা বেছে নেবে?’ প্লাটিনাস উত্তর দিল, ‘যে মানুষ শুধু সততার জন্যই সৎ জীবন বেছে না নেয়, অর্থাৎ কোনও পুরস্কারের আশাতে সৎ জীবন কামনা করে,তেমন মানুষ আসলে কখনোই সৎ জীবন কামনাই করে না।’
কিছু সময় পরেই প্রহ্লাদ গভীর ঘুমে ঢলে পড়ল।তার নাক দিয়ে মৃদু ঘর্ঘরধ্বনি বেরোতে শুরু করল।ললিতার চোখে অনেকক্ষণ ঘুম এল না।অনাগত অনাহার আর দুঃখ কষ্টের দিনগুলো ওর চোখের সামনে ভাসতে শুরু করল।কিন্তু কী আশ্চর্য! সে সামান্যও ভয় পায়নি।প্রহ্লাদের দেহের ছোঁয়াতে যেন কী এক অমৃত ছিল, সেই অমৃত তার মনটাকে অভয় আর আনন্দে ভরিয়ে তুলল।সুপ্ত সন্তানের চুমো খাবার মতো সে প্রহ্লাদের ঠোঁটে আলতো করে একটা চুমো খেল।তারপর তাকে জড়িয়ে ধরে সেও নিশ্চিন্ত মনে ঘুমিয়ে গেল।
সমাপ্ত