আমরা যারা বরাক উপত্যকাতে বড়ো হয়েছি, আমাদের
কাছে 'হিন্দিভাষী'পরিচয়টি
অজানা ছিল। আমরা তখনই উত্তরপ্রদেশ বিহারের লোকজনকে অতি সরল মনে "হিন্দুস্তানি'বলে চিনতাম এবং গ্রহণ করেছিলাম। এরা
মূলত শ্রমজীবীই ছিলেন। কিন্তু চা বাগান এলাকাতে এরা অনেকটা বর্ণহিন্দু। অর্থাৎ চা
শ্রমিক বা শ্রমিক নন অথচ একই জনজাতিদের পাড়ায় গ্রামে এরা খানিকটা সচ্ছল সমৃদ্ধ
মাতব্বর টাইপ। শ্রেণি হিসেবেও উপরের, যে চা-জনজাতিরা বাকি অসমে প্রাদেশিক
সংখ্যাগুরুবাদের চাপে অসমিয়া,তারাই বরাকে এই হিন্দুস্তানি দাপটে
"হিন্দুস্তানি' যাদের মাতৃভাষা হিন্দি (আসলে তো যোগাযোগের ভাষা সাদরি বা
সাদানি)।অসমের এই একই চা জনজাতিরা পশ্চিম বাংলাতেও দক্ষিণে "বাঙালি' (বন্দ্যোপাধ্যায় চট্টোপাধ্যায়রা যাদের
ভাষাতে কবিতা লিখে "আঞ্চলিক বাংলা' বলে চালান), উত্তর
বঙ্গে আবার হিন্দিভাষী, জানিনা ওখানে "হিন্দুস্তানি'শব্দের চলন আছে কি না। গোটা দেশেই চা জনজাতিদের ভাষা সংস্কৃতি
নিয়ে টানাটানি আছে, অধিকাংশকেই "হিন্দিভাষী'বলে চালিয়ে দেওয়া হয়! দেশে এই হিন্দিভাষীদেরই কোনো জাতি নাম
নেই। তাদের একক প্রদেশ নেই। দেশে এই নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই!
যারা দাবি করেন,অসমের
ভাষা অসমিয়া,তামিলনাড়ুর ভাষা তামিল, পশ্চিম বাংলার ভাষা বাংলা -- তাঁরা এই
প্রশ্ন জীবনেও করেন নি যে হিন্দি কোন প্রদেশের কোন জাতির ভাষা? আর
বিহার থেকে গুজরাট সব রাজ্যের ভাষাই যদি হিন্দি হয় তবে অসমের ভাষা বাংলা, বাংলার
ভাষা অসমিয়া, তামিলনাড়ুর ভাষা সাঁওতালি, পাঞ্জাবের ভাষা তামিল হবে না কেন?হিন্দির
জমিদারি মোটের উপর দেশ মেনেই নিয়েছে। এবং স্বাধীনতার আগে থেকে একই ভাষা হিন্দ্বী
বা হিন্দুস্তানি ভাষাকে হিন্দু মুসলমানে ভাগ করে সেই যে হিন্দি আর উর্দুর জন্ম
দেওয়া হল -- এবং দিল্লি লক্ষ্ণৌ এলাহাবাদ অঞ্চলে জন্মানো শৌরসেনী প্রাকৃত-জাত
ভাষাকে পাঞ্জাব সিন্ধু অঞ্চলের তথা পাকিস্তানের ভাষা বলে উর্দুকে দুই পক্ষ থেকেই
দাঁড় করানো হল (অনেকটা বাংলার "পানি'শব্দের মতো --যাকে মুসলমানেও মনে করেন মুসলমানি শব্দ, মূর্খ
বাঙালি হিন্দু তো বটেই) সেই থেকে এটা তো দাঁড়িয়ে গেল যে হিন্দুস্তান তথা ভারতের
ভাষা একটাই --হিন্দি! আমরা নীরবে মৌন সম্মতি ও স্বীকৃতি চিরদিন দিয়ে এসছি।
পাকিস্তানেও আছে "হিন্দুস্তানি'ভাষা। পাকিস্তানের ভারত থেকে প্রব্রজিত
লোক মাত্রেই মোহাজের বা হিন্দুস্তানি! স্থানীয় হিন্দুরা অবশ্যই। অথচ সেদেশের
স্থানীয় হিন্দুরা ততটাই হিন্দুস্তানি, যতটা বাংলাদেশের হিন্দু বাঙালি। তাঁদের
মাতৃভাষা পাঞ্জাবি,সিন্ধি, বালোচ, কাশ্মিরী (সে দেশে কাশ্মিরী হিন্দু কল্পনা করতে পারেন না?) ইত্যাদি।
এবং বাকি বিশ্বেও এই হিন্দিভাষীরা নিজেদের ভাষাকে হিন্দুস্তানি বলেই প্রচার করে!
বহু বলিউড সিনেমাও তাইই করে।
এই যে আমরা দাবি করি বাংলার ভাষা বাংলা, মহারাষ্ট্রের ভাষা মারাঠি, অসমের
ভাষা অসমিয়া ---এতে করে আমরা একদিকে হিন্দিকে গোল দেবার জন্য মাঠ ফাঁকা ছেড়ে দিই!
এরা বলেন, হিন্দুস্তান কি ভাষা হিন্দি। আর দিকে আমরা বাংলার অসমের
তামিলনাড়ুর অন্যান্য বড়ো ভাষা তো বটেই কিছু ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী-যাদের অস্তিত্ব মূলত
সেই রাজ্যেই তাদের অস্তিত্ব ও মর্যাদাকেও অস্বীকার করি! যে কোনো কোচ বা রাজবংশীকে
জিজ্ঞেস করুন --অসমে এবং বাংলাতে তাঁরা ভাষা ও পরিচিতি নিয়ে খুব চাপে থাকেন। কিছু
রাজবংশী ফেসবুক পেজ ঘুরে আসুন, তারাও যখন দুই রাজ্যেই 'বাংলাদেশি'অপবাদের
মুখে পড়ছেন, খুব জোর গলাতে প্রচার দিচ্ছেন, আমরা বাঙালি নই, তাই
বাংলাদেশি নই। অসমিয়াও নই। সত্য এই যে বাংলাদেশেও বিপুল সংখ্যাতে রাজবংশী আছেন।
এবং বহু বহু লোককে আমরা বাঙালি থেকে আলগা করে দেখা ভুলেই গেছি। যেমন বেগম খালেদা
জিয়ার পরিবারটি রাজবংশই! নাস্তিক নিহত ব্লগার অভিজিৎ রায়কে নিয়ে বাঙালির গৌরব
করবার কিছু নেই, তিনি রাজবংশী পরিবারের সন্তান। সেরকম পশ্চিম বাংলা ও অসমের
অসংখ্য মুসলমান আসলে রাজবংশী সমাজ থেকে ধর্মান্তরিত। বাঙালি হিন্দু সমাজ থেকে নয়।
এতসবে আমাদের মাথা ব্যথা নেই বলে, বাকি
ভারত মনেও রাখে না যে অসম ত্রিপুরার একটি বড়ো ভাষা বহু প্রাচীন যুগ থেকেই বাংলা।
না হয় বাঙালি রাজা ছিলেন না, বাঙালি রাজা থাকতেই হবে, এই
আরেক কুসংস্কার! অসমেই কি সকল রাজারা অসমিয়া ছিলেন? আহোমরা কি অসমিয়া ভাষা সঙ্গে করে
এনেছিলেন? (এমন প্রশ্ন করলে শৃঙ্খল চলিহা আমাকে ধরে পেটাবে), ঘটনা
হচ্ছে তাঁরা মন্দিরে মন্দিরে ব্রাহ্মণ বসাতে নবদ্বীপ (বাংলা) থেকে ব্রাহ্মণ
এনেছিলেন, সেরকমই সিলেট থেকে ব্রাহ্মণ নিয়েছিলেন ত্রিপুর, ডিমাছা
এবং মণিপুরের রাজারা। সেই ব্রাহ্মণেরা ছড়ান আর্য ভাষা। যা পরে কোথাও অসমিয়া, কোথাও
বাংলা, কোথাও বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি, কোথাও কোচ-রাজবংশী ভাষা বলে পরিচিতি
পায়। এবং এই পুব ভারতে আর্যভাষার বিস্তারের সূচনা করেন কামরূপের বর্মণ রাজবংশ।
ভাস্কর বর্মণের উপর কেবল অসমিয়ার অধিকার এই কুসংস্কারও না ছাড়লেই না! পুরো
বাংলাদেশটাই তো ছিল কামরূপে! আজ যদি আপনি বাংলাদেশি বলে কাউকে তাড়াতে ব্যস্ত তবে
নিশ্চিত থাকুন আপনি নরকাসুরের বংশধর বলে যে মহান সম্রাট ভাস্কর বর্মণ পরিচিতি
দিতেন তাঁর সাম্রাজ্যের প্রজাদের উত্তরসুরিদের তাড়াচ্ছেন। গৌড়ের রাজা শশাঙ্ক নিয়ে
একাংশ বাঙালি গৌরব করতেই পারেন, কিন্তু তিনি তো এক ক্ষুদ্র ভূখণ্ডের
রাজা ছিলেন, গৌড় মানে সমগ্র বাংলা কখনই ছিল না! বঙ্গ অঙ্গ পৌণ্ড্র সমতট
হারিকেল এসব গেল কই? হাওয়া হাওয়াই? সব এলাকা মিলিয়ে সুবেহ বাংলা তো গড়ে
তুললেন মোঘলেরা! তাদের সময়েই বাংলা ভাষা সাহিত্যের জোয়ার এল। কিছু মূর্খ
সাম্প্রদায়িকেরা কি না প্রচার করেন, তারা হিন্দুর বারোটা বাজালো।
যাই হোক, বর্তমানে এবং অতীতের আমাদের
সাম্প্রদায়িক এবং জাতীয়তাবাদী সমাজ-পাঠে বহু প্যাঁচ এবং গণ্ডগোল আছে। জনপ্রিয়
সমাজ বিদ্যা এসব নিয়ে মাথাই ঘামায় না! অসমিয়ার অসম তবে বডোদের কী, ডিমাছাদের
কী? সাঁওতালদের কী? নেপালি ছেলেটা তবে আর গিটার হাতে
কলকাতাতে গাইতে কী করে যায়? সুমনের গানে যে স্বপ্ন আছে? আমার
বলবার কথা হচ্ছে, যে লোকেরা কলকাতাতে নেপালি ছেলেটার গান আটকে রেখেছেন, তাঁরাই
নিষিদ্ধ করে রেখেছেন শিব সাগরে বাংলা! এদের চিন্তন পদ্ধতি এক! এরাই বাঙালুরুতে
আপনাকে বাংলা বললে পিটবে বাংলাদেশি বলে, আর হিন্দি বললে অসমিয়া নারী পুরুষও রাম
ধোলাই খাবেন।
গোঁড়ায় গলদ ভারত পাকিস্তানের শাসক
হিন্দি উর্দু নিয়ে ঘটিয়ে রেখেছেন, বাকি কিছু বড়ো জনগোষ্ঠীদের চকলেট ধরিয়ে
ভুলিয়ে রাখার জন্য ভাষা ভিত্তিক হাতে গুণা কিছু প্রদেশ দিয়েছেন, আজকাল
'ধ্রুপদি'ভাষার
স্বীকৃতি দিয়ে ধুতির কোঁচা তুলে নাচতে দিয়েছেন, তামিলদের যদিও লুঙি ড্যান্স (লুঙি
মুসলমানি পোশাক এও মূর্খদের এক কুসংস্কার, মূর্খরা গুগোল করে বর্মীদের পোশাক দেখে
নিন) --কিন্তু চিরদিন তালে ছিলেন যেটুকু আছে সেটুকুও কেড়ে খাবেন।
এরই চরম প্রকাশ মণিপুরের হিংসা! কুকি
মণিপুরি নাগাদের বিবাদ। অথচ রাজ্যটি সবার! নিজেরা হিন্দু মুসলমান করে হিন্দি
উর্দুতে ভাগ করে এখন বাকি ভাষাগুলোকেও ভাগ করে ভেঙে দখল করে ফেলবার ধান্ধা।
খেয়াল করুন, পাকিস্তানে
এবং ভারতে ভাষা আন্দোলনগুলোর বয়স প্রায় একই। ওদেশে উর্দু চাপাতে গিয়ে, এদেশে
হিন্দি চাপাতে গিয়ে! হ্যাঁ, অসমের ভাষা আন্দোলনের মূলেও সেই হিন্দি
আধিপত্যবাদ। নিজের জমিন অক্ষত রেখে এরা লাগিয়ে দিয়েছিল তামিলদের সঙ্গে যুদ্ধ!
ভাষার জন্য তামিল শহিদ বাঙালির থেকে সংখ্যাতে অনেক বেশি, বাংলাদেশ
থেকে কম কিছু গভীর ছিল না সেই লড়াই। আর অসমে চকলেট ধরাতে গিয়ে রাজ্য পুনর্গঠন
কমিশনের প্রক্রিয়া থেকে তীব্র হয় অসমিয়া বাঙালি বিরোধ। বিহারে বা গুজরাটে সেরকম
কিছুই হল না! অথচ বিহারে কম ঠকালো
না এরা। আর বাণিজ্য টেকাতে গিয়ে গুজরাটি রাজস্থানি বণিকেরা তো নিজেদের মাতৃভাষা
নিজেরাই ডোবাল! এই হিন্দু উর্দু বিবাদ বলুন, বাংলা বাংলাদেশি ভাষার বিবাদ বলুন সব
কিছুর পেছনে এই বণিকদের শয়তানি! গোটা ভারতে এরা নিজেদের বাঁধন শক্ত রাখতে চায়!
ডিমা হাচাওতে ৩০০০ বিঘা জমি দখল করে
ডিমাছা উচ্ছেদ করে, এরা দুনিয়াকে জানাতে চায় বাংলাদেশি মিঞা তাড়াচ্ছে! এই মিঞারা
কিন্তু আদত কামরূপী, অথবা এর থেকেও বহু প্রাচীন "খিলঞ্জিয়া'হরপ্পা
মহেঞ্জোদারোর সভ্যতার উত্তরাধিকারী অস্ট্রিক দ্রাবিড়দের উত্তরসূরি হয় তো। এরা না
মোঘল না পাঠান না আফগান।
এহেন অবস্থাতে, এই
যে দীর্ঘদিন ধরে হিন্দিভাষী হরিদাস পালকেও বিশ্বাস করতে দেওয়া হয়েছে, তার
ভাষা হিন্দুস্তানি (যেমন শৃঙ্খল চলিহা বিশ্বাস করে গোটা অসমের ভাষা অসমিয়া) --এর
পেছনে তো আমাদেরও মৌন সমর্থনের এক দীর্ঘ ইতিহাস আছে!
এখন এর সঙ্গে মিশেছে হিন্দুত্বের মোড়ক।
বাংলাতে "রাষ্ট্রবাদ'কথাটি ছিলই না, রাষ্ট্রীয়
গীত বলেও কিছু নেই। এখন তো দেখি তিনসুকিয়াতেও দুর্গাপূজার মণ্ডপ সাজাতে বাঙালি
মূর্খরা লেখে"রাষ্ট্রীয় গীত' (জন
গণ মন)। তো ভাষা ধর্ম এবং রাষ্ট্রকে যখন এক করে শেখানো হচ্ছে, আর
আশ্বাস দেওয়া হচ্ছে, হিন্দুস্তান (শব্দটি আবার মোঘল প্রতিষ্ঠিত, বাংলার
মতোই--এর উৎস যাই হোক) মানে হিন্দুর দেশ, আর সেই দেশের ভাষা হিন্দি সেখানে অতি
সরল বিশ্বাসে দিল্লির পুলিশ, পশ্চিম বাংলার রেল কর্মী, মেট্রো
যাত্রী, ছাত্রাবাসের ছাত্র তো দম দিয়ে বলবেই, "আমি হিন্দুস্তানি হিন্দিই বলব, বাংলা
বলতে বাংলাদেশে যাও ' (মাঝে
মধ্যে কিন্তু এরা মণিপুরিদের নাগাদের চিঙ্কি বা চিনি বলে, মণিপুরিরা
কুকিদের বর্মী বলে --রোগ থেকে কেউ মুক্ত না! )
কাছাড়ের এক "হিন্দুস্তানি'নেতা
সেদিন বাঙালিকে বলে দিলেন "বাংলাদেশি উদ্বাস্তু!' যিনি বললেন এবং যাকে বললেন দুজনেই কিন্তু 'জয় শ্রী রাম'ভক্ত
হনুমান। রামরাজ্যে থাকবেন, আর তুলসিদাসী ভাষাকে স্বীকার করবেন না, এমনও
কি হয়!
নানান রাজনৈতিক স্লোগানে (আচ্ছে দিন, স্বচ্ছ
ভারত, হরঘর তিরঙ্গা, স্বচ্ছতা হি সেবা, মন
কি বাত,… ) এখন বাঙালিই কেন, অসমিয়া উড়িয়া ভাষাতেও জলভাতের মতো
ঢুকে গেছে! বৈষ্ণব আখড়াতে ঢুকে গেছেন হনুমান আর চণ্ডীদাসের বা হাচন রাজার কৃষ্ণ
গানের জায়গা নিয়েছে হনুমান চালিশা! বোল-বোম, গণেশ চতুর্থী, ধনতেরাসে
(আধুনিক হিন্দু রীতি)ঢুকে গেছে ভোজপুরি ডিজে ( বাঙালির আত্মীয় ভাষাটিকেও যে কতভাবে
দখল করে বারোটা বাজিয়ে ফেলেছে)। আপনি এই সমস্ত নিয়ে মনে মনে থাকবেন, আর
হিন্দুস্তানিরা কেন আপনাকে বাংলাদেশি বলে তাই নিয়ে হল্লা করে বাজার গরম করবেন, এ
কেমন তর কথা?
নিশ্চয় আপনাকে কেউ 'বাংলাদেশি'বললে
আপনি চটবেন, কিন্তু তাই বলে এই ভারতের বিহার থেকে গুজরাটের মতো পাঁচ সাতটি
রাজ্যের আম জনতাকে শত্রু পক্ষে ঠেলে দেবেন, এ কেমন তর কথা? পশ্চিম
বাংলাতেও এখন মহারাষ্ট্র কর্ণাটকের দেখাদেখি, হিন্দিভাষী বিরোধিতা শুরু হয়েছে!
আসলে অসমে এই রাজনীতি বহু প্রাচীন, এরাও
অনসমিয়া মাত্রকেই অবাঞ্ছিত বহিরাগত ভাবেন। দুই দশক আগেও ব্যাপক হারে বিহারি শ্রমিক
হত্যা হয়েছে অসমে মণিপুরে মেঘালয়ে। আলফা হিন্দি বস্তিগুলোতে ব্যাপক বোমা ছুড়ত, আর
মূর্খ কিছু বাঙালি হিন্দু বলত, এই সব মিঞা মুসলমানের কাজ। কিন্তু বেশি
চাপ বাঙালির উপর, বিশেষ করে. বাংলা মূলের "নঅসমিয়া 'মুসলমান দের উপর। তাই মনে হতে পারে গর্গ
চ্যাটার্জিদের বাংলা পক্ষ শৃঙ্খল চলিহাদের লাচিত সেনার থেকে শেখেনি, শিখেছে
মহারাষ্ট্রের নব-নির্মাণ সেনার থেকে!
অসমের মতোই দেখছি, বাংলার
বহু "ধর্মনিরপেক্ষ'বাম উদারপন্থী ভাবছেন এরা কিছুটা হলেও
হিন্দুত্ববাদকে ঠেকাবে।
কিন্তু সত্য হল এরাও আসল বিপদকে আড়াল
করে সহজ রাজনীতি করে! অসম এবং মহারাষ্ট্রের জাতীয়তাবাদীদের সঙ্গে
হিন্দুত্ববাদীদের আঁতাত এখন স্পষ্ট। অসমিয়া জাতীয়তাবাদীরাই বলছেন! লাচিত সেনা
যখন নিজেদের ধর্ম নিরপেক্ষ বলছে তখন উজানের বহু অসমিয়াই বলছেন, এরা
হিন্দু মুসলমান করছেন! সেখানে বাংলা-পক্ষের মতো সংগঠনগুলো খুব বেশি দূরে থাকবে না!
হিন্দুত্ববাদীদের মতোই এরা "রোহিঙ্গামুক্ত'ভোটার লিস্টের দাবি তুলছে যখন দেশে SIR বিরোধী
লড়াই হচ্ছে! "বাংলাদেশি মুক্ত 'বলতে কতদিন! নবান্নে পালা বদল হলেই এরাও
পাল্টি খাবে, নইলে এতো সহজ সংগঠনের জোর পাবে কই? আর
এই যে বহিরাগত মুক্ত বলছে, এর সঙ্গে লাচিত সেনা বা অসমের জাতীয় সংগঠনের তফাৎ কী?
এরা হিন্দিভাষী সম্পর্কে একটি জঘন্য
শব্দ চালু করেছে "গুটকাখোর'। আম জনতা ভাবছেন গুটকাখোর আসলে বিহারি হিন্দু মুসলমান! যখন এস
আই আর বিরোধী মঞ্চে তেজস্বী সগৌরবে বলেছেন, আমরা খৈনি খাই। গুটকা খেয়ে মুখে কর্কট
রোগ বাঁধিয়েছেন মারাঠি নেতা শারদ পাওয়ার। সেগুলো প্রথম বড়ো গুটকা কোম্পানির একটি
হচ্ছে ১৯৭২ সনের "গোয়া গুটকা'। এখন যেগুলো বাজারে চলে তার অধিকাংশই
গুজরাট আর রাজস্থানের কোম্পানি! 'হিন্দি হিন্দু হিন্দুস্তানে'র
আঁতুড় ঘর! বিহার উত্তর প্রদেশ তো বেচারা অসহায় অনুচর!
গুটকাখোর বলে বিহারি নিম্নবিত্ত
মধ্যবিত্তদের শায়েস্তা করে, শ্রমজীবীদের মধ্যে ভাঙন ঘটিয়ে বাংলাকে
উদ্ধার করবেন বলে যদি কেউ স্বপ্ন দেখেন, তবে তিনি মূর্খের স্বর্গে বাস করছেন!
সমস্ত অবাঙালিদের আসলে গুজরাটি গুটকা কোম্পানির আশ্রয়ে ঠেলে দিয়ে
হিন্দুত্ববাদীদের হাত শক্ত করছেন! অসমে একই আত্মঘাতী রাজনীতি করেছে অসমিয়া
জাতীয়তাবাদীরা। বাঙালি বিহারিদের নিরাপত্তাহীনতা ঘটিয়ে হিন্দুত্ববাদের ছাদের
তলাতে পাঠিয়ে এখন অসমিয়া জাতীয় জীবনের বিপন্নতার গান গাইছেন! হিন্দুত্বের
নেশাতে মিঞা বেদখলের আড়ালে বনাঞ্চল থেকে উচ্ছেদ হচ্ছেন অসমিয়া বাঙালি নেপালি
কার্বি ডিমাছা বডো অমুসলমান কৃষক! আড়াল পড়ছে তাঁদের কান্না, আর
হাজার হাজার বিঘা মাটিতে দখল বসাচ্ছে আদানি রামদেব বাবার মতো খাটি খিলঞ্জিয়া
হিন্দুস্তানি!
অসমিয়া উচ্ছেদ হলে আর কেউ ক্ষমতার
মুখোমুখি হয়ে বলবার দম দেখায় না যে, অসমত অসমিয়ার দপদপনি চলিব।
এদের অধিকাংশকেই চাঁদা যোগান দেয়
গুজরাটি রাজস্থানি বনিক গোষ্ঠী, কিছু বাঙালি বণিকও।
এর মানে এই না যে সকল গুজরাটি
রাজস্থানিই বড়োলোক! আজ সকালেই আমাকে ভারত-ফাইবারের এক মাড়োয়ারি কর্মচারী ওর ছেলে
দুর্ঘটনাতে পড়ল বলে, টাকা ধার চাইল! হাসপাতালে যেতে টাকা নেই, দিলাম
তো। সে হয়তো সরল মনে আমাকে 'বাংলাদেশি'ই ভাবে। তাই বলে কি বিপদে পাশে দাঁড়াব না! ধর্ম কাকে বলে? কেবল
ঐ "জয়
শ্রী রাম'বললে? "বোল
বোম'করলে? আমাদের
এসব আসে না! আমাদের অবাঙালিকে ঘেন্না করার "বাঙালিআনাও'আসে না! শেষ মেশ সবটাই আদানি আম্বানি টাটা বিড়লারই ফাঁদ।
দেশভাগটাও বিড়লারাই করিয়েছিল! আমরা মারামারি কাটাকুটি করেছি, আর
এরা প্রাসাদে বসে শয়তানের হাসি হেসেছে!
'মেচুকা' (Menchukha)
ঘুরে এলাম। মধ্য অরুণাচল প্রদেশের উত্তরে শি জোমি (Shi
Yomi) জেলার ছোট্ট পর্যটন স্থল।ওখানে যাবার
দুটি পথ আছে। পূর্ব সিয়াং জেলার সদর পাশিঘাট হয়ে গেলে ৪১৪ কিলোমিটার। আর ভাটি সিয়াং
বা নিম্ন সিয়াং জেলার সদর অসম-সীমান্তের লিকাবালি হয়ে গেলে ৩৭৮ কিলোমিটার। যে পথেই
যান--- অতি দুঃসাহসী না হলে পশ্চিম সিয়াং জেলার সদর "আলো'-তে একরাত কাটিয়ে যাওয়াই
নিয়ম। ভবিষ্যতে সেই নিয়ম থাকবে না। কেন থাকবে না, কেন "দুঃসাহসী' এই যাত্রা—সেই
কথা লিখব বলেই গল্প ফাঁদা। "কী প্যাডের' বোতাম টেপা।
গল্পটা মাঝখান থেকেই শুরু হোক।
"আলো' শহরটি এত সুন্দর আর বড়ো আমাদের জানা ছিল না।তিনসুকিয়া থেকে পাশিঘাট হয়ে
গেলে আড়াইশত কিলোমিটার পথের অর্ধেকের বেশিটা সমতল।পাহাড়ি পথটাও এত ভালো এবং চওড়াযে আমাদের মেয়ে পৌষালি পুরো পথ চালিয়ে চলে যায়।শহরে
ঢোকার আগে সিয়াং আর সিয়ম নদীর সঙ্গমে সূর্যাস্ত দেখা,পথে পথে কমলার বাগান এবং অসংখ্য
ঝরনা দেখা,এবং সিয়াং নদীর পাড়ে বিশ শতকের শুরুতে ব্রিটিশের সঙ্গে অবর জনজাতির শেষ যুদ্ধের
স্মারক দেখা,শহর থেকে কিছু দূরে "রেয়ি হোমস্টে'-র মতো কোথাও থেকে রাত্রি নিবাসের
সুখ পরেও গিয়ে যখন তখন আবার অনুভব করা যেতে পারে—এই যাত্রাতে এটাই শেখা। চাই কি, সকালে
গিয়ে রাতে ফেরাও যাবে। এখন এটি বলবার গল্প নয়। বলবার হচ্ছে, পরেরটুকুন। পার্বত্য পথের
মতোই আঁকাবাঁকা হবে সেই গল্প। সিয়াং প্রসঙ্গে একটি কথা লিখে রাখা ভালো যে নদী ব্রহ্মপুত্রের
এটিই মূল স্রোত যেটি চিন থেকে এসেছে। ডিব্রু-ছয়খোয়া অভয়ারণ্যের উত্তরে ধেমাজি জেলাতে
এটিই নাম বদলে হয় ব্রহ্মপুত্র। এরও পুবে দিবাং ও লোহিতও প্রায় কাছাকাছি এসে মিলেছে।
দিবাং ও লোহিতের সংযোগেই রয়েছে তিনসুকিয়া জেলার সদিয়া মহকুমা।
ছবিতে পুরো গল্পটি এখানে রইল । এমনিতে না চললে ছবিতে টিপে যান, বা নিচের দিকদর্শক বোতাম টিপুন। সেই বোতামে উপর নিচে তিনটি ডট টিপে ছবিগুলো পুরো পৃষ্ঠা জুড়েও দেখতে পারেন। একের পরে এক ছবি চলে আসবে।
👉👉
আলো
থেকে মেচুকা পৌনে দুশো কিলোমিটার পথ। কিন্তু প্রথম পঞ্চাশ ষাট কিলোমিটার পথ কায়িং অবধি,
কায়িং পার করেও অনেকটা --- ভালো।ভাঙা,সংকীর্ণ এবং কর্দমাক্ত পথ শুরু হয় টুম্বিন থেকে।
সংকীর্ণ মানে, একেবারে পাড়ার গলি—যেখানে দুটো গাড়ি মুখোমুখি হলেই বিপদ। পাশাপাশি চলে
যাবার জায়গা সর্বত্র নেই। ওখান থেকেমেচুকা
--প্রায় দেড়শ কিলোমিটার পথ মাঝে মধ্যেই এরকম এবং ভয়ঙ্কর। আমাদের পরিবার পুব দিকের
দিবাং ড্রি উপত্যকারআনিনি- আচেসো গেছি, তারও
পুবে দং উপত্যকার কাহো-কিবিথো গেছি। সে পথে যাওয়াই ভয়ঙ্কর। সহজে লোকে সাহস করে না।
পথগুলো আগে ছিল কেবলই সংকীর্ণ, এখন চওড়া করা হচ্ছে—এখানে ওখানে পাহাড় কাটা হচ্ছে। তাতেই
সারা বছরই খুব বিপজ্জনক থাকে। ধস নামার ভয় থাকে। কিন্তু আনিনি বা কাহো পথের নব্বুই
শতাংশই ভালো, দশ শতাংশই ভাঙা ও ভয়ানক। টুম্বিন থেকে মেচুকা এর পুরো উল্টো। এর মধ্যে
শি জোমি জেলার সদর টাটো থেকে মেচুকা শেষ পঞ্চাশ কিলোমিটারের অর্ধেক সবচাইতে বাজে। একটা
পুরো গ্রামের রাস্তা আধা কিলোমিটারের মতো হবে, গাম-বুট ছাড়া হাঁটতেই পারবেন না --তার
উপর বড়ো বড়ো পাথরেই চাঁই। গাড়ির নিচে পাথর যেতে আসতে লেগেছে। চাকা পিছলে যাচ্ছে। যারা
বাইকে যাচ্ছে, তাদের বাইক আটকে যাচ্ছে।
এসবের জন্যই এই পথ এখনও সবচাইতে ভয়ঙ্কর।
এমন আরও দুই চারটি পথ অরুণাচলে আছে—যেমন প্রতিবেশী জেলার টুটিং বা টাকশিঙের পথ। সেরকম
পথে যখন ঘুরে এসেছি, এর পর এখন আমি পূর্বোত্তরের যে কোনো পাহাড়ে যেতে পারব। পারব।তার কারণ হচ্ছে, সিকিম বাদ দিলেপূর্বোত্তরের আর কোনো রাজ্যেরইআর কোনো পাহাড়ই ৬০০০ থেকে ১৩০০০ ফিট উপরে নয় । মেচুকার থেকে নিচু শিলং শহর। শিলং পিক অনেকটা
এর ধারে কাছে যায়। অরুণাচলের অতি জনপ্রিয় গিরিপথ বুমলা এর থেকে সামান্য উঁচু, কিন্তু
সেলা গিরি পথ লামাং থেকে নিচু। লামাঙের কথাতে আমরাআসব পরে।
আমার বয়সের কেউ এই পথে গাড়ি চালিয়ে
চলে গেছি বলে ভ্রমণ বিলাসী কেউ কেউ বাদে মেচুকার স্থানীয় লোকই চমকে গেছিল। আলোর
"রেয়ি হোমস্টে'র মালিক তো অত্যন্ত বাজে ঢঙেই বলেছিল, কত লোকে ট্রাকের পীঠে চড়ে
ফিরে আসে, সেসব তো দেখেন নি! ভয় পাইয়ে দিয়েছিল। অথচ ওর পাশে ছিল বোলেরো ড্রাইভার,
কেবল বয়সে ছোটো। বোলেরো মাটির থেকে ১৮০ ইঞ্চি উঁচু, টাটা পাঞ্চ ১৮৭ ইঞ্চি। ও তখন ছিল
না, ওর স্ত্রী ছিল যখন পৌষালি ওর হোমস্টেতে চালিয়ে গাড়ি নিয়ে ঢুকেছিল। দেখলে, কী
বলত জানি না।
তিনসুকিয়া ডিব্রুগড় মরাণ শিবসাগর শিলাপাথার
লক্ষিমপুর থেকে বহু লোকে সোজা মেচুকা চলে যান,পথে না থেমে। আমরা ততটা দুঃসাহসী নই,
হওয়া উচিতও না। ফেরার পথে আলো থেকে পথটা রাতে অতিক্রম করা সহজ --আমরা করেওছি। কিন্তু
যাবার পথে ঐ টুম্বিন থেকে মেচুকার দেড়শ কিলোমিটার পথের প্রতি বাঁকে মৃত্যু আপনাকে হাত
ছানি দেয়। তার উপরে যদি উল্টোদিকের গাড়ি আসে সংকীর্ণ পথে আর আপনাকে পাশ দিতে হয়
--ডানে বাঁয়ে এক ইঞ্চিও তো দেখবেন না অন্ধকারে! আর গাড়ি অচল হলে তো হয়ে গেল! সাহায্যের
হাতই তো সহজে পাবেন না। কম পাবেন, আপনার মতো আরও দুঃসাহসী কেউ আসে যদি। জীবনে ভয় পেতে
নেই, সতর্ক থাকতে হয়। আমরা তাই আলোতে থেকে গেছিলাম!
যাবার আগেও পরে অনেকেই আমাদের সতর্ক করেছেন, কেউ কেউ চটে
ও বলেছেন, আমার থেকে আগে আপনি গাড়ি চালানো শেখেন নি। যেটি তাঁরা সম্পূর্ণ অবজ্ঞা করে
গেছেন, বা জানেন না—সেটি এই তথ্য যে, এমন পথে গাড়ি চালাব বলে আমার ১০ বছরের অনুশীলন
আছে। শুরু হয়েছিল তেজু রোয়িং নামছাই দিয়ে। নইলে ৫ বছর আগেও দুবার শিলচর যেতে আমার ও
কন্যা পৌষালির প্রশিক্ষক বিকাশ দাসকে সহচালক করে সঙ্গে নিয়ে গেছিলাম। ২০২৩-শেই শুধু
স্বামী স্ত্রী একা গেছি, হাফলং পথে ডিফু হয়ে ফিরেছি। এর পরেও ভরা বর্ষাতে বহু নিচু
চেরাপুঞ্জি ডাউকি গিয়ে তবে কাহো- কিবিথো-আনিনি-আচেসো যেয়ে আজ মেকুচা যাবার সাহস করেছি।
ধা করে কাউকে সাহস করতে মানা করব। সুখে বেড়াতে যাবার জায়গাই এটা নয় এখনও, অদূর ভবিষ্যতে
হবে। আমরা তাই আলোতে থেকে গেছিলাম। আলোতে যে কেউ বেড়াতে যেতে পারেন। বড় শহরের অধিকাংশ
সুখ পাবেন। ফেরার পথে "বাসার' "লিকাবালি' "শিলাপাথার' হয়ে ফিরতে পারেন।
ওখানে হোটেল হোমস্টে আগে থেকে বুক না
করলেও চলে। আমরাও করিনি। শুধু যেহেতু পৌষালি চালাচ্ছিল, আমি কই থাকব দেখতে গিয়ে
"রেয়ি হোমস্টে' (Reyi Homestay)-র ছবি চারপাশের
দৃশ্য দেখে বলে দিলাম, আসছি। টাকা দিইনি। ৩০০০ টাকা তিনজনে একরাত। এটি ছিল ভুল সিদ্ধান্ত।
পৌঁছে খিদে পেল। শহরের মাঝখানে সড়কের পাশে "মা হোটেলে' ভাত খেয়ে নিলাম। কারণ
হোমস্টেতে গিয়ে খাবার তৈরি হতে হতে সাড়ে চারটা বেজে যাবে, অন্ধকার নামবে। হলও তাই।
পরদিন আবার অন্ধকারে বেরিয়ে গেলাম, তো যা দেখার জন্য নিলাম --তা আর হল কই? এর বহু
সস্তায় শহরে থাকার ব্যবস্থা হয়ে যেত। তার উপর হোমস্টেটি অভিজাত,গালো জনজাতির মালিকটিও
তাই। ব্যবহার সুযোগ সুবিধে ঠিকই ছিল,কিন্তু ওর প্রতি বাক্যে আভিজাত্য ঠিকরে পড়ছিল।অসম
অরুণাচলের আমলা নেতা মন্ত্রীরা ওর ওখানে যায় খায় আড্ডা মারে --এসব বলছিল। আর দেয়ালের
ছবিগুলোও বলছিল।ও আমাকে বলতেই পারত, ড্রাইভার না নিয়ে ছোটো গাড়িতে যাচ্ছেন, ঝুঁকি
নিচ্ছেন। বলে কি না, কত লোক ট্রাকের পীঠে চড়ে ফিরে সে খবর তো আপনি জানেন না!ওর ওখানে দেখেছি প্রচুর অসমের আদিবাসী কর্মী।সহযাত্রী
একজন কানে কানে বললেন, এরা সবাই কেনা দাসদাসী।পালাবার পথ বন্ধ। অরুণাচলের কোথাও কোথাও
এমনপ্রথা আছে। জনজাতিদের নিজেদের মধ্যেও আছে।
রেয়ির গল্পটির সত্য মিথ্যা যাচাই করবার অবসর মেলেনি। সত্য হতেও পারে, নাও হতে পারে।
তবে কর্মীগুলো যেন ছিল মূক-বধির।
তার উপর সারা রাত বৃষ্টি। প্রতিটি ফুটো
আমার বুকে কাঁপন ধরাচ্ছিল। এই পথে বর্ষাতে তো না-ই, বৃষ্টিতেও যাবার কল্পনা করা দুঃসাহস।
আমরা আবহাওয়া দেখে এগুচ্ছিলাম। মেঘলা দেখাচ্ছিল। এইটুকুন ঝুঁকি না নিলেই নয়। মেচুকার
ধনদুপ হোমস্টের (ধনদুপ অর্থ সফলতা) মালিক খাণ্ডু ফিলির ফোন লাগছিল, তিনি বললেন, আসতে
পারবেন। এদিকে তেমন বৃষ্টি নেই, এসে পড়ুন! শুধু ভোর ৫টার অন্ধকারে বেরিয়ে গেলে পথে
ব্লক পাবেন না, ১টার আগে পৌঁছে যাবেন। কোথাও দাঁড়াবেন না। একই কথা বললেন, কটন বিশ্ববিদ্যালয়ের
অধ্যাপক আবু হুশেন। তিনি অরুণাচল বিশেষজ্ঞ বলতে গেলে। প্রচুর দুর্গম এলাকাতে নিয়মিত
গিয়ে থাকেন।গতবারে পরিবার নিয়ে মেচুকা গেছিলেন।।
দুজনেই সঠিক বলেছিলেন। টুম্বিন অবধি অন্ধকারে চালানোই যেত, তার পর আলো হয়ে যেত।
কিন্তু সবটা ভরসা না করে, ভোরের আলো
হতে দিলাম। বেরিয়ে পথে চা খেলাম,পথের জন্য গরম বোতলে চা ও অন্য খাবার নিলাম।ব্লক বা
পথ অবরোধ অরুণাচলের পাহাড়ে একটি নিয়মিত ঘটনা।সড়ক তৈরির জন্যে এটা করে।এর জন্যেও আপনি
ঝুঁকি নিতে পারেন না, গুগোল মানচিত্র দেখে পৌঁছে যাবার।সুমো স্ট্যান্ডে গেলাম, কোথায়
কখন পথ বন্ধ হয়--খবর পাবার আশাতে। কেউ কিছু জানাতে পারলেন না। টিকিট কাউন্টারের লোক
জন বললেন, আপনি দেরি করেছেন। সোজা বেরিয়ে পড়ুন। তাই হল। গাড়ির যেটুকু তেল খালি হয়েছিল,
ভরিয়ে নিলাম। টুম্বিন পার করে "পেনে' বলে একটি জায়গাতে দেখি প্রচুর গাড়ি বাইক
দাঁড়িয়ে আছে। জিজ্ঞেস করে জানলাম, সামনে সকাল ৯টা অবধি পথ বন্ধ। ভাবলাম, কিছু খাওয়া
যাক। কিছু ছবি নেওয়া ভিডিও তোলাও হল। তখন সকাল ৮টা ৩০। এই ৯টা অবধি থামটা ভুল ছিল।
আসলে ঠিক যেখানে আটকায় তার আগে চওড়া জায়গাতে থামতে হয়। পর পর অনেকগুলো ব্লক এক সঙ্গে
খুলে আর বন্ধ হয়। আমরা দোকান হাট আর ভিড়ের মোহে পড়েছিলাম। একটি সুমো যাচ্ছিল, ও সারা
পথে যদি একটিও সঠিক তথ্য দিল! ওকে টাটোতেও পেয়েছি, ফেরার দিনেও পেয়েছি। যদি বলত,
আমার সঙ্গ ছাড়বেন না, তাও হত।
পেনে (Pene) থেকে টাটোর
মাঝে সবচাইতে বড় দৃষ্টি নন্দন জলপ্রপাত "সিকো দিদো' মেলে। সেখানেও থামিনি দুই
একটি গাড়ি থেকে ছবি নেওয়া ছাড়া। ১১টা ৪৫ এ টাটো পৌঁছে শুনি, সামনে ১২টা অবধি পথ বন্ধ।
সেই মূক সুমোও আছে। আবারও একই ভুল করলাম। বিখ্যাত "গগৈ হোটেলে' রুটি -ম্যাগির
অর্ডার দিলাম।
মেঘালয় মূলত লোকে শিলং-চেরাপুঞ্জি-ডাউকি
দেখতে যায়। জোয়াই কেলেরিহাটের সৌন্দর্য তো বহুর নজরের বাইরেই থেকে যায়। তুরার কথা
কেন যে শুনিই না। অরুণাচলেও সিংহভাগ লোক যায় তো কেবল তৈরি পথে তাওয়াং জেলা। অথচ সেলা
গিরিপথের প্রায় সমান উচ্চতাতে এই লামাং গিরিপথের মতো আরও অনেক আছে। যদিও রাজ্যের সবচাইতে
উঁচু পর্বত শিখর পুব কামেং জেলার কাংটো সিকিমকেও টেক্কা দেয়। সাড়ে তেইশ হাজার ফিট উঁচু।
ওখানে এখনও পথ তৈরি হয় নি। যাওয়া অসম্ভব অভিযাত্রী না হলে। দেশে এবং প্রদেশে আমাদের
মতো বহু ভ্রমণ বিলাসী আছেন যারা দুর্গম পথ পাড়ি দিতে ভালোবাসেন। আমার সহকর্মী অনেকে
এই ভ্রান্তি নিয়ে বসে আছেন যে ভ্রমণ বাঙালির নেশা। আজকাল অসমেরযত অসমিয়া মানুষ শুধু বাইকে করে পাহাড়ে ভ্রমণ করেন,
তত বাঙালি করেন কি না আমার সংশয় আছে। যদিও পশ্চিম বঙ্গীয় অনেক আছেন। গতবছরে আনিনিতে
দেখা হয়েছিল শান্তি নিকেতনের সন্দীপ পানের সঙ্গে। তিনি তো ফিরেই বই লিখে ছেপে দিয়েছিলেন।
সরকারি কাজের চাপ কমাতে এঁদের ভ্লগ দেখা, তাঁদের লেখা পড়া আমার প্রিয় শখের
একটি। এই যাত্রাতে আমরা আসতে যেতে অসমের তিনটি জেলা ---তিনসুকিয়া ডিব্রুগড় ধেমাজি
আর অরুণাচলের পাঁচটি জেলা ছুঁয়েছি। ধেমাজির জোনাই শহর সীমান্ত। ওখানে পাস তৈরি করতে
হয়। সীমান্তের ওপারে শহরের নাম রাসকিন। রাসকিনেই ঢুকে গেলাম পুব সিয়াং জেলাতে। এর
সদর শহর পাশিঘাট। মধ্য ও পুব অরুণাচলের সবচাইতে বড় শহর। এখান থেকেই পাহাড় শুরু হয়।
এর উত্তর পশ্চিমে পশ্চিম সিয়াং---যার সদর শহর "আলো'। এটিও বড় শহর। তারও উত্তরে
শি জোমি ( Shi Yomi) জেলা। এর
সদর শহর টাটো। টাটোর উত্তরে মহকুমা শহর "মেচুকা'। পূর্ব থেকে মধ্য ও উত্তর অরুণাচলের
সবচাইতে সুন্দর শহর, যদিও পথ দৃশ্য দিবাং ও দং উপত্যকা তুলনা রহিত। লোকে যখন বলে, অরুণাচলের
স্কটল্যান্ড বা সুইজারল্যান্ড—আমি ঠাট্টা করে বলি—আগে ঠিক করে নাও—ভারতে স্কটল্যান্ড
আছে কটা। যেখানেই দেখবেন, সেখানেই স্কটল্যান্ড। কিন্তু এইটুকুন বললেই হয়—যে হিমাচল
উত্তরাখণ্ড দর্শন এর পরে না করলেও ক্ষতি কিছু নেই।
আমাদের এবারে মাঝ বরাবর অরুণাচল দর্শন হল
মানচিত্রটা
আমি ফেরার পর আবারও দেখে বুঝলাম, আমাদের এবারে মাঝ বরাবর অরুণাচল দর্শন হল। দক্ষিণ
পুবে চাংলাং ইত্যাদি আর উত্তর পুবে শিয়াং, আপার শিয়াং এসব এখনও বাকি আছে। সাহস বেড়ে
গেছে তো। তাই অন্য অভিযাত্রীর মতো হিসেব লাগাচ্ছি। কোনো দিন চলেও যাব, যেতেও থাকব।
ফেরার পথে আরও দুটি জেলা ছুঁয়েছি। সে কথা পরে হবে।
টাটোতে পৌঁছে দেখি পেনের মতো একই ঘটনা। প্রচুর গাড়ি এবং
লোকজন। এর মধ্যে অবশ্য উল্টো পথের যাত্রীও আছেন। তখন ১২টা বাজতে ১৫ মিনিট। যাকেই জিজ্ঞেস
করি, সেই বলে এই টাটো থেকে মেচুকার ৫০ কিলোমিটার পথই সবচে বিপজ্জনক। মেচুকার হোমস্টে
মালিকও একই কথা বলছিলেন। শুধু বলছিলেন, দেড়টার আগে টাটোর পরের ব্লক এলাকাটা পেরিয়ে
গেলেই এসে যাবেন, নইলে রাত হবে। উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠা বুঝতেই পারেন। কিন্তু আমাদের হিসেবে
হাতে তখন দেড় ঘণ্টার বেশি সময়। তার উপর লোকে নয়া তথ্য জানাল, সামনে ১২টা অবধি পথ
বন্ধ। অগত্যা কী করি? ওখানে "গগৈ হোটেল' আছে। অসমের লোকজনের কাছে বিখ্যাত। চললাম
গগৈ বাবুর সন্ধানে। আমি খুল্লম খুল্লা আলাপী মানুষ। সোজা গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কত নো
আছে গগৈদা? বসে থাকা সবাইকে শুনিয়ে। দোকান চালাচ্ছিলেন, এক জনজাতি মহিলা। বললেন, তিনি
নেই। পরে আসবেন। আমার স্ত্রী-কন্যা এমন বাচালতাতে বিরক্ত হয়। কিন্তু পথে যদি আপনি আলাপ
না জমাতে নাই পারেন, তবে তথ্য গোটাতে পারবেন না। সেই তথ্য—যা আপনার যাত্রার জন্যেই
দরকার। তো, দু-প্লেট পরোটা আর এক বাটি ম্যাগির অর্ডার দিয়ে তৈরি হতে হতে, লোকজনের
সঙ্গে আলাপ জমালাম।
লোকজনে বলছিলেন, মিনিট পাঁচেকের পথেই
ব্লক আছে। ভাবলাম, এ আর এমন কী? পনেরো মিনিট দেরি হলেও তো পার করে যাব! কিন্তু কেউ
যেটি বলেন নি, সে হল --চার পাঁচ জায়গাতে এক সঙ্গে ব্লক হয়। দেড়টার আগে শেষ ব্লক পার
করতে হবে। ওখানেই ফাঁসলাম। ওদিকে গগৈ হোটেলের পরিচালিকা আয়েস করে সময় নিয়ে ভিড় সামাল
দিচ্ছিলেন। কিন্তু কাজের কথা কিচ্ছু বলছিলেন না! পাক্কা ব্যবসায়ী মহিলা। বাইরে তখন
এক ভদ্রলোক ঠিক বারোটায় যাত্রা শুরু করা সেই মূক সুমোটি দেখিয়ে বললেন, এর পেছনে চলে
যান। বললাম, খাবার অর্ডার দিয়ে দিয়েছি। যাক ও, আমি পেছন পেছন চলে যাব। তিনিও যেটি
বলেন নি, ব্লক অনেকগুলো আছে। অথচ এসবই তো জিজ্ঞেস করছিলাম। জানতে চাইছিলাম, টুম্বিন
থেকে ঘণ্টা চারেক অনেক কঠিন পথই তো পার করলাম, এখন আর নতুন কী হবে? লোকে বললেন, এতক্ষণ
মাঝে মাঝে ভালো পথ পেলেন। এখন টানা বাজে পথ পাবেন। আমি আর পৌষালি নিজেদের মধ্যে বলাবলি
করছিলাম, পুরো পথ বাজে হবে না। আমরা সঠিক ছিলাম।
শেষ তেইশ কিলোমিটার এক আধটু ভাঙা হলেও
আহামরি কিছু না। এই পথে আমরা অন্ধকারে ফিরেছিলাম। শুরুর ২৩ কিলোমিটারও সবটা ভাঙা নয়।
কিন্তু একটি গ্রামের পাশের পথ আছে, রীতিমত বর্ষার ধানের ক্ষেত। খেতের কাদায় বড়ো বড়ো
পাথরের চাঁই! যেতে আসতে গাড়ির নিচে পাথর লেগেছে। চাকা পিছলে যায়। বাইকে যারাই গেছে,
তাদের কারোরই হাঁটু অবধি প্যান্ট জুতো কিচ্ছু রক্ষা পায়নি। মরার উপর খাঁড়ার ঘা। কাদার
জায়গাটা যদিও বা চওড়া ছিল, ঠিক পার করে চড়তে যাব --সংকীর্ণ চড়াই। উপর থেকে আসছে ট্রাক।
ডানে অতি সামান্য জায়গা। তার পরে গভীর খাদ। এখন পেছনে গেলেও গাড়ি পিছলে কই যাবে জানি
না। ডানের ঐ পাশটাতে নেব বলে একটু বাঁকা করতেই গাড়ি নব্বুই ডিগ্রি ঘুরে ট্রাকের পথ
বন্ধ করে দিল। এবারে, রীতিমত পিলে চমকানো যাকে বলে। নিজেকে মনে মনে ধিক্কার দিলাম এত
সাহস করেছি বলে। কল্পনা করুন, নিজের স্ত্রী-কন্যাকে নিয়ে কী ভাবছিলাম তখন। আমার উপরে
কী অগাধ বিশ্বাসে ভর করে এরা এসেছে সঙ্গে।ট্রাক থেকে হ্যান্ডিম্যান নেমে এলে বললাম,
আপনি কিছু করে দিন। ও বলল, এতো দূর এসেছেন মানে, এটাও পারবেন। হাল্কা একসেলেটর দাবাবেন,
আর স্টিয়ারিং ডানে বামে ঘোরাবেন, সোজা রাখবেন না --কাদা সরে যাবে। তাই হল। নতুন জিনিস
শিখলাম।এই শিক্ষা আগে পরে বহু কাজে লাগল, আগামীতেও লাগবে। পথে দেখছিলাম পরে, বিআরও-র
বোর্ডে লেখা "you are stronger than you know'। হ্যান্ডিম্যানটা
(অথবা ট্রাকের সহচালক) সেই শিক্ষাই দিয়ে গেল!
নিরাপদে জায়গাটি পার করে হাসতে খেলতেযুদ্ধ জয়ের আনন্দে গানের সুরে দুলতে দুলতে এগুচ্ছিলাম।
ঘণ্টা দেড়েক পার করে গেছি। হঠাৎ দেখি দুটি জেসিবি পথ বন্ধ করে কাজ করছে। ভাবলাম পথের
পাথর সরিয়ে যাবার সুবিধে করে দিচ্ছে হয়তো। পথে এমন আরও পেয়েছি। ওমা !একটি লোক প্রথমে
হাতের ইঙ্গিতে, পরে এগিয়ে এসে বলল, পেছনে যান। ৫টা অবধি পথ বন্ধ। ৫টা মানে পুরো রাত।
বলে না, যেখানে বাঘের ভয় --সেখানে সন্ধ্যা হয়। একদম অভিজ্ঞতা হল। তখনও পথ একরকম চলাচল
যোগ্য ছিল, বললাম, যেতে দিন না। আমাদের তো জানা ছিল না। আমরা তো জানি দেড়টার আগে টাটো
পার করে ব্লকের জায়গা পার করতে হয়। সে তো আমরা বহু আগেই পার করে এসেছি। বলছে, আর
দেড়টাও বেজেছে মাত্র মিনিট দশেক আগে।বলল কিনা, মিনিট দশেক আগে এলে তো আপনি চলেই যেতেন। আমার
স্ত্রী শম্পা তো কেঁদেই ফেলল, ওকে অনুরোধ করতে গিয়ে। লোকটি নিজের অসহায়তার কথা বলে
আশ্বস্ত করল, সামনে আর বাজে রাস্তা পাবেন না। রাত হলেও যেতে পারবেন। এখন পেছনের চওড়া
জায়গাতে সরে দাঁড়ান।
তাই করতে হল। পেছনে আরও দুটি গাড়ি এসে
দাঁড়াল। এরএকটি আল্টো টেন। এর ড্রাইভারও
বলল, সামনে আর বাজে রাস্তা নেই। আমি যাব আপনার সঙ্গে সঙ্গে। আমার তো আল্টো, আপনার টাটা।
চলে যাবেন! এরই মধ্যে এসে এক মাতাল দেবদূত চলে এল। সে স্থানীয় গাঁওবুড়া। জোরে হর্ন
দিয়ে পাগল করে দিতে শুরু করল। সঙ্গে ছিল এক বয়স্ক মহিলা। মহিলাটি গিয়ে দুই জেসিবি
চালককে ধমকে পথ খুলে দিতে বাধ্য করালো। যে লোকটি আমাদের পেছনে যেতে বলেছিল, সে বলল,
এই সব দাদাগিরির জন্যই তো এখানে কাজের গতি এত ধীর। আড়াইটাতে পথ খুলে গেল। পরের বাকি
পথ তুলনাতে সত্যি ভালো। আল্টো চালকও কথা রেখেছিল। না রাখলেও পারত। সাড়ে তিনটার মধ্যে
আমরা "Welcome to Menchukha’লেখা সবুজ বোর্ডের সামনে গাড়ি দাঁড় করালাম।
২
বিকেল সাড়ে ৩টা নাগাদ ‘Welcome to Menchukha’লেখা ছোট্টো এই সবুজ বোর্ডের সামনে পৌঁছেই গাড়ি না থামিয়ে
কি উপায় ছিল? সেই "আলো'-তে যেটি সিপু অথবা সিয়ম, মেচুকাতে সেটি ইয়ারগ্যাপ (Yargyap)। ঢুকেই এই
নদী নজরে আসবে। এর এক পারে কাশ্মীর অন্যপারে শীতকালের লাদাখ দেখছেন -- মনে পড়বে। আপনার
মনে হবে মুহূর্ত আগে অবধি দীর্ঘ নরক দর্শনের পুরস্কার জুটল আপনার। আমার স্ত্রী শম্পা
--যে আলোতে একবার বলেছিল, বাদ দাও যাওয়া। চলো "জিরো' চলে যাই বেড়াতে! ---সেও
নেচে উঠল। মাইকেলের "মেঘনাদ বধ কাব্যে' মিলটনের দেখানো পথে রামচন্দ্র এমন নরক
দর্শন করে তবেই স্বর্গে পৌঁছে রাজা দশরথের দেখা পেয়েছিলেন। তাই বলে টুম্বিন, পেনেহ,
টাটোকে নরক বলবেন না! এই পথে পথে ব্লকের যন্ত্রণাতে শুধু আমাদেরই না, কোনো যাত্রীরই
সেরকম পথ দৃশ্যের স্থির বা চলচ্ছবি নেওয়াই হয় না। তাড়া থাকে পৌঁছুবার।
কিন্তু "মেচুকা'! আনিনি আচেসোর
ডিবাং উপত্যকা, কাহো কিবিথোর দং উপত্যকা অতুলনীয়! সন্দেহ নেই! "ইয়ারগ্যাপ' উপত্যকা
সে তুলনায় আহামরি কিছু না!কিন্তু এর পাড়ে "মেচুকা' শহর! নন্দন কাননে পারিজাত
যেন!
খানিক পরেই যখন শহরে ঢোকার গেটের কাছে
গাড়ি দাঁড়াল, আর দূরের বরফ ঢাকা পর্বতমালা নজরে এল, মনে হল তাওয়াঙের পরিত্যক্ত সৎ
বোনের মাথার মুকুটে জ্বল জ্বল করছে বৈদূর্যমণি! তখনই যদি সারা মেচুকা ঘুরে নিতাম? পরদিন
সারা মেচুকা জুড়ে মেঘ ছিল! এই রূপ আর দেখা হল না! পাহাড়ে এটিই লীলা! মুহূর্ত পরে কী
হবে আপনি জানেন না, পুরোটাই রহস্য। আপনি ভরসা করতে পারবেন না।
খিদেও তো পেয়েছে!শহরের মাঝে চৌরঙ্গীতে
বিমান ("বন্দর' বলব?) স্থলীর পাশেই হোটেল স্নো-ভিউর কথা আমার জানা ছিল। গাড়ি গিয়ে
থামাতেই এক ভদ্রলোক স্বাগত জানিয়ে, বলছিলেন, আইয়ে। ভাবছিলেন থাকার ঘর চাই। আসলে আমাদের
তখন খাবার চাই। হোমস্টেতে গিয়ে খাবার চাইলে রাতও নামবে আর বেরোতেও মন চাইবে না --যা
ঠাণ্ডা হাওয়া। খাবার কথা জানাতেই লোকটি বলল, কাছেই উল্টোদিকে "বুদ্ধ কিচেন' টা
ওদের। ওখানে গেলেই খাবার পাব। অপূর্ব রেস্তোরা, অপূর্ব খাবার, অপূর্ব ব্যবহার, অপূর্ব
দৃশ্য এর বাইরে। After all আপনি তো তখন নির্বাণ লাভের
পূর্ব মুহূর্তে আছেন।
এই কথা মনে করিয়ে দেওয়া ভালো, যে
অসমের বরাক উপত্যকা বা ধুবড়ি গোয়ালপাড়াকে যেমন বহু অবাঙালির মনে হয় "বাংলাদেশ',
গোটা উত্তর অরুণাচলকে আপনার মনে হবে ভুটান, তিব্বত অথবা চিন। বৌদ্ধ চিন।চিন আমাদের শত্রু ছিল নাকোনোদিন! সে দেশে আমাদের অতীশ দীপঙ্কর গেছিলেন,
আর সে দেশ থেকে ফা ইয়েন, হিউ এন সাং এসেছিলেন। পরদিন বৌদ্ধ গুম্ফাতে গিয়ে যত পুরনো
পুথি সংগ্রহ দেখেছি তাতে মনে হল ভারতের এবং বাঙালি-অসমিয়ার বহু প্রাচীন ইতিহাসও ওখানে
লুকোনো আছে। কোনো কালী মন্দিরে এসব পাবেন না। বাঙালি বৈষ্ণবের আখড়া আর শঙ্করী ধর্মের
সত্র ও নামঘরের আদিতেও এই বৌদ্ধ গুম্ফা ঐতিহ্য থেকে থাকবে।
এই গুম্ফা, গুম্বা থেকেই গুহা শব্দটি
এসছে বলে মনে হয়। গুম্ফার আগে ভারতে কোনো মন্দির ছিল না!সে যাই হোক, খেয়ে দেয়ে প্রথম যে কাজটি করা হল,
সে হল হাত মোজা কেনা! মেচুকাতে না হলেও চলত। কিন্তু দূর পাহাড়ের বরফ বলছিল, লামাং উপত্যকাতে
আমাদের বরফ পরিক্রমা আর আটকায় কে!
কোথাও বেড়াতে গেলে থাকবেন কই --এই চিন্তা
আপনার আসবেই। অরুণাচলের কোথাও আপনাকে সেসব নিয়ে ভাবতে হবে না --লিখেই দিতে পারি। ছোটোখাটো
বস্তিতে রাত নেমে এলেও কারও বাড়িতে আশ্রয় চাইলে আপনাকে বিনা পয়সাতে থাকতে খেতে দেবে
--এমন ভ্লগ আমি দেখেছি। মেচুকাতে ঢুকতেই মূল তোরণের আশে পাশে প্রচুর হোমস্টের বিজ্ঞাপন
নজরে আসবে। যে কোনোটিতেই চলে যেতে পারেন। আগে থেকে বলে না রাখলেও সমস্যা নেই। তবে কিনা
বলে রাখবার সুবিধে হল --তিনি আপনাকে পুরো পথের দিশা বলে দেবেন। ধনদুপ হোমস্টেকে আমি
তাই আগেই বলে রেখেছিলাম। ডিসেম্বরে লক্ষীমপুরের একটি অসমিয়া শিখ পরিবার ওখানে গিয়ে
সুন্দর ভিডিও করেছিলেন, তাঁদের ভিডিও দেখেই যোগাযোগ। সেই ভিডিওতে ভ্লগার মনপ্রীত কাউর
ঠিক যেমন বলেছিলেন, আমরা তেমনই পেলাম। সত্যিই এটি ‘Your home at Menchukha’. যেহেতু ওখানে সবসময় নেট মেলে
না, ভিজিটিং কার্ডের উল্টো পীঠে তিনি বাড়ির দিশা এঁকে ছেপেছেন। আগেই পাঠিয়ে রেখেছিলেন।
সামান্য জিজ্ঞাসাবাদ করেই চলে যাওয়া গেছিল। মূল শহরেই বাজারের ঠিক পেছনটায়। বাড়ির
উঠোনে গাড়ি রেখেই ঢুকে গেলাম তাঁদের রান্নাঘর তথা বৈঠক ঘরে। খাণ্ডু ফিলি তাঁর স্ত্রী
দুটি কন্যা নিয়ে সংসার (একটি কিশোরী, যে স্কুল বন্ধ বলে মায়ের সব কাজে হাত লাগাচ্ছিল।
আরটি শিশু মিষ্টি হাসি আর উচ্ছলতায় ঘর মিষ্টি করে রেখেছিল। ) এমন ভাবে এরা আপ্যায়িত
করলেন যেন আমরা বহুদিনের চেনা আত্মীয়। ঘণ্টা দেড়েক আমরা গাড়ি থেকে একটিও কিছু না নামিয়ে
সেই বৈঠক ঘরে আগুনের বিশেষ চুলোর সামনে বসে রইলাম। অবশ্য এর আগে তিনি আমাদের থাকার
ঘরটা দেখিয়ে দিলেন। পুরোটাই কাঠে তৈরি দ্বিতল ঘর। নিচের তলাতে দুটি বিছানা, চারজনে
শোয়া যেত। সঙ্গে বাথরুম, গিজার সবই ছিল। কিন্তু পুরো শহরে কদিন ধরে বিদ্যুৎ নেই। বাড়ি
বাড়ি জেনারেটর, ইনভার্টার চলছিল। গরম জলের সমস্যা হয় নি। সকাল সন্ধ্যা বৈঠক ঘরের বিশেষ
চুলোতে আগুন জ্বলছে।
পূর্বোত্তরের পাহাড়ের সমস্ত জনজাতিদের
ঘরের মাঝে একটি চুলো জ্বলে, এর উপরের একাধিক তাকে এরা খাবার সেঁকে বহুদিন রক্ষা করেন।
এমন চুলো দেখেছি আলোতে রেয়ি হোমস্টেতে। বাকি সর্বত্র এখন লোহায় তৈরি চিমনি সহ একরকম
চুলো আসে হিমাচল থেকে। দেখে মনে হবে কত বা দাম! ধনদুপের চুলোটির দাম ছিল ২৬ হাজার টাকা।
লাকড়িতে চুলো জ্বলে। এক ট্রাক লাকড়ির দাম ৩০ হাজার টাকা। যার বাড়িতে কাঠ নেই তার দুর্ভোগ
অকল্পনীয়। চারদিকে অরণ্য, তবু বিনামূল্যে কাঠ পাবার অধিকার নেই কারও। সবই পণ্য হয়ে
গেছে। যাই হোক, যখন যত গরম জল চাই ওখান থেকে নিয়ে নিন। এমন কি গ্যাসের স্টোভেই রান্না
হচ্ছিল কিছু কিছু। সুবিধে হল, চিমনি চুলো থেকে গরম জল নিয়ে গ্যাসের চুলোর পাত্রে ঢেলে
দিন, তাতে শাক সবজি চাল ডাল যখন যেমন। রান্না চাইকি আপনি নিজেও করতে পারেন।
খাণ্ডু ফিলের হাতে আঁকা মানচিত্র ১
খানিক পরেই একদল কলেজ পড়ুয়া ছাত্র
এসে ঢুকল। এরা তিনসুকিয়ার আই টি আই-র ছাত্র। এবং আরও কিছু বাইরে পড়া বন্ধু। একটি বলেরো
গাড়ি আর একটি বাইকে এরা এসছে। তখন এরা লামাং চূড়ার বরফ দেখে ফিরেছে, পরদিন ভোরে চলে
যাবে। এদের দুতিনটি বাদে বাকিগুলো এত প্রাণখোলা যে অচিরেই এরা আমাদের আপনার জন হয়ে
গেল। পুরো ভ্রমণের বিবরণ শোনাল, আগামী ভ্রমণের পরিকল্পনা শোনাল, অতীত ভ্রমণের গল্প
বলল। এরা নিজেরা রান্নার আসবাব সব নিয়ে এসেছিল। সে রাতে এরা বাইরে গিয়ে খেয়ে এল।
কারণ হোমস্টেতে যা চাইবেন তাই খেতে নাও পেতে পারেন। তার উপর ডালভাত শাকসবজি খেতে চাইলে
সাধারণ মূল্য ২০০ টাকা, মুরগি মাংস হলে ৩০০ টাকা, শূকরের মাংস হলে ৩৫০ টাকা। খাবারের
কথাটা আগেই বলে রাখতে হবে, যাতে বাজার করে রাখা যায়। কোথাও কোথাও গোমাংসও পেতে পারেন।বাইরে
খেলে যে সস্তাতে মেলে তা নয়। এরা বলছিল, বুদ্ধ কিচেনে গিয়ে থুকমা, ফ্রাইডরাইস --এসব
সস্তাতে খেয়ে এসছে। একটি ছেলের কাছে আইপ্যাড ছিল সে অচিরে পৌষালি আর খাণ্ডু ফিলির
কন্যা নিমার সঙ্গে লুডো খেলা জমিয়ে দিল। খাণ্ডু পরিবারের আতিথেয়তাতে এরা এত মুগ্ধ
ছিল যে দুজনকেই গামোছা পরিয়ে সংবর্ধনা জানিয়ে ছবি তুলল। দুই একটি ছবিতে আমরাও থেকে
গেছি।
বহু রাত হয়ে গেছিল। বিকেলে বুদ্ধ কিচেনে
মুর্গির মাংসে ভাত খেয়েছি বলে সেরাতে আমরা নিরামিষ আহারের কথা বলেছিলাম। খাণ্ডু পরিবার
ঘুমিয়ে গেছিলেন আমাদের খাবার গরম পাত্রে রেখে। আমরা নিজেরা নিয়ে খাবার সারি। ছেলেগুলো
তখনও আমাদের "সেবা'-তে স্বেচ্ছা নিয়োজিত ছিল। আমার কিছু সহকর্মীর অন্ধ বিশ্বাস
আছে যে ভ্রমণ একটি বাঙালি সংস্কৃতি। এমন অসমিয়া পর্যটক পেলেই আমি দুই একজনকে দেখিয়ে
বলি, আপনি হলেন নকল অসমিয়া! আসল অসমিয়া কাক কয় চাই লওক।
২০২৩-এর শেষ তিনদিনে আমরা আনিনি আচেসো ব্রুণি গেছিলাম।দুহাজার
টাকা দিয়ে দিগদর্শক তথা গাইড নিয়েছিলাম। ৬০ কিলোমিটার পথ যাব আসব --আরাম করে সকাল
১০টার পর রওয়ানা দিলাম। ডি আফ্রা ও চিগু ক্যাম্পে থেমে সময় নষ্ট করতে করতে গেলাম,
পৌঁছুতেই সন্ধ্যা হয়ে গেল। ফিরতে রাত। দুটি ছেলের একটির পরনে ছিল হাফপ্যান্ট। বাইকে
করে এরা গেল এল। দেরি হল বলে আরও ৫০০ টাকা চাইল। সে কথা আগে বলেনি। অথচ সোজা আগে ব্রুণি
যেতাম, ফেরার পথে সব দেখে শুনে ফিরতাম, রাতও হত না।মেচুকাতে তাই কোনো গাইড নেবার কথা
ভাবিইনি। ধনদুপের মালিক খাণ্ডু ফিলে আমাকে আর পৌষালিকে আঁকা মানচিত্র দেখিয়ে বুঝিয়ে
দিলেন --তাতেই ভালো কাজ হল। ঠিক হল প্রথম দিনে আমরা মেচুকা শহর দেখব। পর দিন আরও ৭
হাজার ফিট উপরে লামাং যাব। সেদিন মেঘে ঢেকে ফেলেছিল মেচুকার রূপ। যদি সেদিন লামাং গিয়ে
পরদিন মেচুকা দেখতাম তবে ভালো হত। কিন্তু উপায় ছিল না। লামাং যেতে হলে আগে এডিসি অফিস
থেকে অনুমতি বের করতে হবে। আর ৭ ঘাটে সেই অনুমতির কপি দিয়ে দিয়ে এগুতে হবে। সব কাজ
করে দেবার দায়িত্ব খাণ্ডু ফিলে নিজে নিলেন। আমরা শুধু আধার কার্ড দিলাম। জনপ্রতি খরচা
৩৫০ টাকা করে। ফর্ম আর জেরক্সের জন্য আরও ১০০ টাকা লাগল।
খাণ্ডু ফিলের হাতে আঁকা মানচিত্র ০২
সকাল সকাল বেরোব তো বটে। কিন্তু গাড়ি
তো পুরো নোংরা। তার উপর আসার পথে নিচে গাড়ি পাথরে লেগেছে। একটু দেখিয়ে না নিলে কেমন
হয়? তাঁর বাড়ির কাছেই একটি কারওয়াশ ও গ্যারেজ আছে। স্ত্রী কন্যাকে বললাম, তোমরা তৈরি
হও, আমি গাড়ি তৈরি করে আসি। ওরা খেয়ালই করে নি। ভেবে নিল, আমি এলে খাবে, তৈরি হবে
বেরুবে। অগত্যা ১০টা বেজেই গেল । গাড়ি খুব ভালোই স্নান সারল।গ্যারেজের কর্মী দেখে বলল,গাড়ি
নিচেও কিছু হয় নি।শুধু বাম্পারের নিচে একটি বার থাকে কাদা আটকাতে, তার একটি কোণের
ক্লিপ উড়ে গেছে। বিকেলে এলে ও করে দেবে যদি ক্লিপ মেলে। বিকেলে অন্য আরেকটি গ্যারেজে
দেখালে সেখানেও একই কথা বলল, এবং শক্ত তারে সেটি বেঁধে দিল যাতে ফেরার পথের ধাক্কাতে
বাকিটা না খুলে যায়।ওখানে আরও একটি গাড়ি এসছিল নোংরা হয়ে। শিকার করতে গেছিল। আলাপ
জমলে ওর বন্দুক নিয়ে দুএকটি ছবি তুলে নিলাম। স্ত্রী কন্যাকে ডেকে দেখালে, ওরাই বা
শিকারি ছবি না তুলে থাকবে কেন? সবই হল, সঙ্গে মন খারাপ যে দূরের বরফ ঢাকা পাহাড়গুলো
আর এদিন দেখা যাচ্ছিল না।
বর্ষপঞ্জিতে
এমন ছবি প্রচুর দেখেছেন। আমরা চোখের সামনে দেখছিলাম। পথ আলগে অদূরে ডানে বাঁয়ে দাঁড়িয়ে
পাইন বন। পথের দুপাশে সমতল ধেনো জমি। মেচুকা থেকে লামাং পথে এগোলে শহরের শেষ প্রান্তে
এই দৃশ্য। এমন দৃশ্য মেঘালয়ে দুর্লভ। যদি সকালের রৌদ্র থাকত। ছিল না। এই ঘটনাই গোটা
দিন আমাদের মন খারাপ করে রাখে। চেরাপুঞ্জি গেলেন আর জলপ্রপাত না দেখে শুধু মেঘের দেখা
পেলে যেমন হয়, এও এমন। দূরের বরফ ঢাকা পর্বত চূড়াগুলো দেখা হচ্ছিল না, দেখা হচ্ছিল
না ইয়ারগ্যাপ নদীর জলে সোনালি রোদের ঝিলিক।
স্টিয়ারিং পৌষালির হাতে। মেচুকা শহরটি
সমতল। পথগুলো চওড়া। শহরের সড়কে "ট্রাফিক' বলে কোনো বস্তু নেই। যেখানে খুশি গাড়ি
দাঁড় করালে অন্য গাড়ি এলেও পাশ দিয়ে বেরিয়ে যাবে। চৌরাস্তাতে একটি "travel
police post' দেখেছি, পুলিশ দেখিনি। খাণ্ডু ফিলির হাতে আঁকা মানচিত্রটি যাকে
বলে "Perfect'। তিনি বলছিলেন, হয় ডানের
দর্জিলিং গ্রামে থেকে শুরু করে উত্তরাপথ ধরে ৪০০ বছর পুরনো বৌদ্ধ গুম্ফা দেখে সেগং
হয়ে লামাং রোড ধরে ফিরে আসুন, অথবা উল্টো --সেগং দিয়ে ঢুকে দর্জিলিং হয়ে ঘুরে আসুন।
যে দিকেই যাবেন শেষ প্রান্তে কাফে রেস্তোরা পাবেন, দুপুরের আহার ওখানে সারতে পারেন।
আমরা সেগং থেকে দর্জিলিঙের পথ ধরলাম। কিন্তু কোন জায়গা কত কিলোমিটার --এর কোনো ধারণা
দেন নি। অগত্যা লামাং পথ ধরে এগুতে এগুতে ডান দিকে পথ পেলেই লোককে জিজ্ঞেস করি সেগং
কোথায়? শহরের ঠিক প্রান্তে নদীর পাড়ে "Adventure Park' বলে যেটি
মানচিত্রে লেখা আছে ওখানে "ছুপালা বার' আছে। নদীতে নেমে অনেক খেলার জোগাড় হচ্ছে।
নদীর একটি ছোটো শাখার উপর দিয়ে গাড়ি চালিয়েই ঢুকল পৌষালি। কিন্তু সব বন্ধ। মনে হল
মেরামতির কাজ চলছে। আগে একটি ভ্লগে দেখেছিলাম গত বর্ষাতে মেঘ ফাটা বানে এর বহু কিছুই
ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। সেখানে কিছুক্ষণ এমনি ঘোরাফেরাতেও সুখ আছে। তাই হল। গাছের গুড়িতে
বসে ছবি ওঠানো হল। এর পরে একটি ঝুলন্ত সেতু আছে। দূর থেকে দেখা তো যায়, ঢোকার পথ আর
পাইনা। পরে যাব বলে সেগঙের পথে এগুলাম।
মানচিত্র দেখে ডানে পথ পেলেই মনে হল
ঢুকি, কিন্তু কোথাও কিছু লেখা নেই। লোককে জিজ্ঞেস করে জানা গেল ৭ কিলোমিটার যেতে হবে
লামাং পথে। সেদিনের পুরো পরিক্রমা ছিল প্রায় ৩০ কিলোমিটারের। দর্জিলিং পৌঁছে বেরোতে
সন্ধ্যার অন্ধকার নেমেছিল। সংকীর্ণ পাহাড়ি পথ। কিন্তু ভালো পথ। ফলে লাল্লুং গ্রাম অবধি
মেয়ে গাড়ি চালিয়ে গেল। লাল্লুঙের পরে বৌদ্ধ গুম্ফা অবধি পথের চড়াই উৎরাই অনেক। অগত্যা
গাড়ি আমি নিলাম। এই অবধি মেচুকা ঢাকা পড়ে থাকে পাইন বনে আর তৃণঢাকা ছোটোছোটো পাহাড়ে।
"স্যামতেনইয়াগচাগ গুম্ফা'র বয়স
৪০০-র বেশি। অরুণাচলে এমন প্রচুর প্রাচীন গুম্ফা রয়েছে। ওখান থেকে ১৬ কিলোমিটার পথ
এগোলে আবার মেচুকা শহরে ঢোকা যায়। পুরো পথে অনেক সুসজ্জিত অলঙ্কৃত গ্রামের ভেতর দিয়ে
এগুতে হয়। তারমধ্যে একটি গ্রামের নামও "মেচুকা'। পুরো পথে থেকে থেকে ইয়ারগ্যাপ
তথা সিয়ম নদী আর নদীর পাড়ে মেচুকা শহর লুকোচুরি করে বার বার দেখা দেবে। নানা কোণ থেকে
নয়ন ভরে শহর দেখুন। শুধু মেঘে ঢাকা বরফের পাহাড়গুলো দেখা যাচ্ছিল না। তার মানে মাথার
মুকুট আর মণিমুক্তোগুলো সেদিন আমাদের দেখা হয় নি। মেঘলা দুপুরে চরাচর ওখানে প্রায়
অন্ধকার করে রেখেছিল। তারউপর নেই বিদ্যুৎ। প্রচণ্ড শীত। গুম্ফার যিনি দেখাদেখি করেন,
তিনিও সব দরজা বন্ধ করে ঘরের ভেতরে ছিলেন। আমাদের তিনজনের কথা শুনে বেরিয়ে এলেন, গুম্ফার
মূল ঘরের দরজা খুলে দিলেন। দ্বিতল ঘরের ভেতরটা অন্ধকার। আবছা আলোতে যা দেখলাম তাতে
মনে হল আমরা চার শতক পেছনে চলে গেছি টাইম মেশিনে চেপে। কাঠের ঘরে উপরে ওঠার কাঠের সিঁড়ি
রয়েছে দুদিকে। সেটিও সেরকম রহস্য রোমাঞ্চ ঘেরা, ঠিক বলে বোঝানো যাবে না। পরতে পরতে
রহস্য। বিচিত্র সব বৌদ্ধ দেবদেবতার মূর্তি এতসবআগে একত্রে দেখিনি। নামছাইর বিখ্যাত গোল্ডেন প্যাগোডাতেও না। প্রচুর পুরনো হাতে
লেখা পুথি আর শিলালিপির সংগ্রহ। ভাষা সাহিত্য ইতিহাসের অনুসন্ধানীদের জন্য সোনার খনি।
মেয়েকে সে কথাই বলছিলাম, এসব নিয়ে কাজ করাটা কিন্তু ব্যাপক আনন্দের হবে।
"দার্জিলিং' এবং"দর্জিলিং'
-- কোথাও কি সংযোগ আছে? সম্ভবত। "হাফলং' আর "জাফলঙে'র মতো। শহরটির নাম কেন
যে লোকে "দর্জিলিং' দিল না। "দার্জিলিং'-কে টেক্কা দিত। বৌদ্ধ গুম্ফার থেকে
১৬ কিলোমিটার এগোলে একটি নতুন নির্মিত ঝুলন্ত লোহার সেতুর আগে একটি পথ চলে গেছে
"দর্জিলিঙে'। পুরো পথে আগেই লিখেছি, মেচুকা লুকোচুরি খেলে। নানা দিক থেকে নানা
চেহারাতে দেখা দেয়। সেই মোড়ের সামান্য আগে একটি পথ আছে পাহাড় চূড়াতে উঠে যাবার।
সেই চূড়াতে বিশাল করে রোমান হরফে লেখা
আছে "MENCHUKHA'। বহু দূর থেকে দেখা যায়।
আর ওখানে চড়লেও পুরো মেচুকা উপত্যকা ছাড়াও দূরের পাহাড় দেখা যায়। কিন্তু ওখানে চড়তে
হয় পায়ে হেঁটে। ঘণ্টা দেড় দুই যেতে, সমান সময় ফিরতে। আমি আর কন্যা যাব বলে একবার
ভেবেও পরিকল্পনাটা বাদ দিই। ঐ দর্জিলং মোড়ের সামান্য আগে পথটি উপরে চলে গেছে। নিচে
প্রচুর বাইক রাখা আমরা দেখেছি। পরে অন্য ভ্লগ দেখে জেনেছি, গেলে সম্ভবত আমরা নিচে মেঘ
উপরে রোদ্দুর ঝলমল দিগন্ত প্রসারী উপত্যকা দেখতে পেতাম।
তারও সামান্য আগে পাহাড়ের গায়ে এক
গোচারণ ভূমি। গাড়িই উঠে গেল। এক বৃদ্ধ গোচারক আমাদের দেখে আলাপ জমাতে এলেন। তার থেকে
জানা গেল ওখান থেকে একটি "রোপওয়ে' তৈরি হচ্ছে, নদীর ওপাড় অবধি যাবে। একদিকে সেই
শুকনো ঘাসে ঢাকা ন্যাড়া পাহাড়, আর দিকে ইয়ারগ্যাপ নদী আর নদীর দুপাড়ে শহর। মা ও মেয়ের
সেই মাঠে সে কি উল্লাস। আর একটি কথা লেখা হয় নি, এই পথে পাহাড়ের গায়ের পাথরগুলো পুরো
কালো, এর মাঝে ছোটো ছোটো গোলাকার পাথর প্রায় ধবধবে সাদা। ঘাসে ছড়ানো সাদা মুক্তো যেন।
তার দুটি তুলেও এনেছি, এমনিই।
অরুণাচলে এই এক রীতি আছে। বলিউডের কোনো
শুটিং হল কি, কোনো নায়ক নায়িকা বেড়াতে এলেন --ব্যস তাঁর নামে নাম পড়ে গেল জায়গার।
তাওয়াঙে এমনই আছে "মাধুরী লেক'। অবশ্য কাশ্মীর হিমাচলেও এই রীতি আছে। যেমন সানি
দেওলের "বেতাব' ছবিটি যেখানে শুটিং হয় --সেটি এখন সুসজ্জিত পর্যটন স্থল। ২০১৮
নাগাদ সলমন খান মেচুকা এসছিলেন, দুপুরের আহার এই দর্জিলিঙে নদীর পাড়ের খেয়েছিলেন
--ব্যস, নাম পড়ে গেল সলমন পয়েন্ট। সেজে উঠল রিসোর্ট। "দর্জিলিং 0 পয়েন্ট রিসোর্ট'
আসল নাম।কিন্তু আচেসোর ড্রি আফরা বা চিগু ক্যাম্প গত বছর দেখবার পর এটি আমাদের কাছে
"আহামরি' কিছু মনে হল না। এর সেজে উঠা এখনও বাকি। ওখানে থাকার কটি কুটির আছে সুন্দর
--কিন্তু সেসবও চিগু ক্যাম্পে আরও বহু সুন্দর। খাবার ঘর একটি আছে, সেটিও পাকা ঘর। সাধারণ।
সেটিকে পরম্পরাগত ঘর করতে পারত বাঁশে কাঠে।অবশ্য বাঁশের ঘর মেচুকাতে নেই। কাঠের বহু
সুন্দর অন্য আরও অনেক ঘর আছে, সেগুলোর কিছু সম্ভবত রিসোর্ট বা হোমস্টেও।"সলমন পয়েন্টে' গযেটি দেখবার সেটি হচ্ছে পাহাড়ের
গায়ে সুসজ্জিত "দর্জিলিং' গ্রাম। সেই পাহাড়ের গায়ে বহু সময় ঘোড়া ছুটে। সারা
মেচুকাতে পাহাড়ে ঘোড়া চড়তে দেখা যাবে। আমরা শহরে ঢুকতেই প্রচুর দেখেছি। ফেরার দিনে
রাতভোরের অন্ধকারেও দেখা গেছিল। কোনোটারই ছবি নেওয়া হয় নি। লাল্লুং গ্রামে ঢোকার
মুখেও দুচারটি দেখেছি। সেদিন দর্জিলিঙে কোনো ঘোড়ার দেখা মেলেনি।
ঘোড়াকে গাধা বানানোর বাগ্বিধি মেচুকাতে
সত্য হয়। এসব মূলত দুর্গম পথে মাল পরিবহনের কাজে লাগে। চাংলাং জেলার মায়ানমার সীমান্তের
বিজয়নগরের কিছু ভিডিওতেও দেখেছি সপ্তাহ-খানিক পায়ে হেঁটে মিয়াও আসছেন গ্রামবাসী
--ঘোড়ার পীঠে পণ্য। অগত্যা,কাছে থেকে ঘোড়াগুলো দেখা খুব দৃষ্টিনন্দন নয়। আজকাল পথঘাট
হচ্ছে বলে, ঘোড়ার কদর কমছে --একদিক থেকে এটি সুসংবাদ। পর্যটককে পীঠে চড়িয়ে টাকা রোজগারের
বুদ্ধি দেখিনি। কিন্তু ওখানে দুটি রাজহাঁস আর একটি কবুতরের "দোস্তি' দেখার মতো
ছিল। রীতিমত "ইয়ে দোস্তি হম নেহি তোড়েঙ্গে'-র মতো বিষয়। কন্যা আর ওর মা শম্পা
বহুক্ষণ এদের সঙ্গে সময় পার করে দিল।
একটি ফটো-পয়েন্টে তর্জনি নির্দেশ দেওয়া
একটি খুঁটি আছে। পৃথিবীর মহানগর ক'টির আকাশ পথের দূরত্ব দেখিয়ে। তাতে বোঝা যায় মেচুকা
থেকে হংকং বহু কাছের নগর। দিল্লি বহুদূর। ঢুকেই খাবার সন্ধান করেছিলাম। ভাত ডাল পাওয়া
যেত, ততক্ষণে সাড়ে তিনটা। দেরি হবে। অগত্যা, চিকেন চাওমিন আর চায়ের অর্ডার দিয়েই
আমরা ওখানে সময় পার করলাম। ওখানে স্থানীয় মেম্বা জনজাতি বা প্রতিবেশী জনজাতি পোশাকে
ছবি তুলা যেত। সে পরদিন খাণ্ডু ফিলি নিজে যেচেই নিজের ঘরে তুলে দেন নিখরচাতে। খাবার
তৈরি হলে একটি শিশু কর্মী হাসতে হাসতে এসে জিজ্ঞেস করল, চাওমিন? ছেলেটি অসমের আদিবাসী
ছিল। গরম কিছু চাইনা? ও বোঝাতে চাইছিল বিয়ার ক্যান বা হুইস্কি রাম চাই কি না। শৈশবের
এই দুর্গতি হাসিমুখে সইতে হল। ওখানে আরও যে তরুণ তরুণী লাফালাফি করছিল, তাদের অনেকের
হাতে বিয়ের ক্যান ছিল।
ওখান থেকে শহরে ফিরতে ফিরতে অন্ধকার
নামে।পৌষালি আর ওর মায়ের ইচ্ছে হল কিছু মোমেন্ট কেনে। হাজার দুয়েকের মোমেন্ট দরদাম
করে গায়ে লাগা ATM- এ গিয়ে দেখি টাকা নেই। এই এক সমস্যা
আছে, সেসব জায়গাতে। তিনটি জিনিসের উপর কোনো ভরসা করতে পারবেন না। এটিএম, পেট্রল ডিজেল
এবং দূরভাষ ও আন্তর্জাল সংযোগ। এই থাকে, এই নেই। অগত্যা, নগদ টাকা নিয়ে যেতেই হবে।
সুযোগ পেলেই তেল ভরতে হবে। অবশ্য দোকানে খুচরো দামে তেল মেলে। যদিও তেল সংকট আমাদের
হয় নি। দুদিনই পাম্পে তেল ছিল। ছিল বলেই আপনি ট্যাঙ্ক ভরে নিতে পারবেন না, টাকা নগদে
দিতে হবে। তেল ছিল,তবু হাজার-খানিকের তেল নিলাম --যাতে পরদিন লামাং থেকে ফিরতে না সমস্যা
হয়। এসব করে হাজার পাঁচেক গেছিল, হাজার দশেক ছিল। মোমেন্ট কিনে বিলাসিতা করা যাবে
না। পৌষালি তখন জানাল, ওর কাছে আছে কিছু --সেই টাকাতে মোমেন্ট তথা স্মারক কেনা হয়ে
গেল। খান্ডু ফিলের সন্তান দুটির জন্য কিছু চকলেট কেনা হল। ফিরে চিমনি চুলোতে খানিক
গা গরম করেছি কি খাণ্ডু ফিলে বললেন, চলুন --তিন জায়গাতে তিনটি পাসের কপি দিয়ে আসি।
ও দিকে তাঁর উদ্বেগ পাশিঘাট থেকে বাইকে করে পাঁচটি ছেলে আসছে --বিকেল থেকে এরা সংযোগ
বিহীন। এরই মধ্যে আমরা বেরুলাম। শহরে ঢোকার মুখে খানিক বাইরে গিয়ে ইন্দো তিব্বত সীমান্ত
পুলিশ (ITBP), স্থানীয় থানা, এবং সেনা শিবিরে
তিনটি প্রতিলিপি দিয়ে আসতে হল। পাস দেখে ওরা কজন যাব কীসে যাব এসব জিজ্ঞেস করে, আধার
কার্ড দেখতে চায়। এই মাত্র। পরদিন যেতে যেতে আরও চারটি সেনা গেটে একই অভিজ্ঞতা হবে।
৩
আমাদের সংগ্রহে এখন একটি ছবি আছে, সাগর
পৃষ্ঠ থেকে ১৩০০০ ফিট উপরে ৯ কিলোমিটার বরফ ঢাকা পথ অতিক্রম করে শেষ সেনা তোরণ তথা
চতুর্থতোরণের সামনে আমাদের গাড়ি টাটা পাঞ্চ
দাঁড়িয়ে আছে। অরুণাচল পাহাড়ের নিচে নিচে নিরাপদে বেড়িয়ে যখন উপরে চড়বার আকাঙ্ক্ষা
দেখা দিল, রোয়িং থেকে ডাক দিতে শুরু করল আনিনি, নামছাই থেকে ডাক দিতে শুরু করল কাহো
কিবিটো --তখনই হঠাৎ ঠিক করলাম আমাদের গাড়ি হোন্ডাই ইয়োনের মায়া না কাটালে হচ্ছে না।
নইলে সেই গাড়ি এতো যত্নে রাখা ছিল যে বিদায় দেবার কোনো কারণই ছিল না। অভিজ্ঞ সুহৃদেরা
পরামর্শ দিলেন, সহকর্মীরাও -- পাহাড়ে যাবেনই যদি টাটা-পাঞ্চের বিকল্প নেই। আরও গাড়ি
আছে, তা কেনা আমাদের সাধ্যের বাইরে ছিল। কেনার আগে মাসাধিক কাল আমি কেবল টাটা পাঞ্চের
পাহাড়ের ভাঙা পথ অতিক্রমের ভিডিও দেখে গেছি। প্রচুর পাঞ্চ নিয়ে লে-লাদাখ হিমাচল ভ্রমণের
ভ্লগ। টাটার তো একটি বিজ্ঞাপনই ছিল যেখানে একটি নেপালি তরুণী টাটা পাঞ্চ চড়ে উত্তর
বাংলার সানদুকপার দুর্গম পথের চড়াই অতিক্রম করে পৌঁছে গেছে। এবং দুবছরের অভিজ্ঞতা বলে,
সিদ্ধান্ত ভুল ছিল না। এই মুহূর্তে দেশে সর্বাধিক বিক্রিত গাড়ি টাটাপাঞ্চ দামে ও দর্শনে
আদৌ আকর্ষণীয় নয়, কিন্তু সুরক্ষা ও শক্তিতে অন্যতম সেরা।
লামাং গিরিপথে আগামীতে ১৫০০০ কিলোমিটার
চড়া যাবে। পথ তৈরি হচ্ছে। সেলা গিরিপথের উচ্চতাও একই। কিন্তু লামাঙের ঐ ১৩০০০ বহু বেশি
দুর্গম এবং বিপজ্জনক বলেই আমাদের ভ্রমণ তালিকাতে সেলা গিরিপথ, তাওয়াং আছে সবার শেষে।
অবসরের আগে পরে। ওখানে সব কিছু তৈরি, সড়ক থেকে সরাইখানা। ওখানকার জন্য কোনো উদ্বেগ
উৎকণ্ঠার বালাই নেই যতটা রয়েছে এই মেচুকা লামাঙে। সেজন্যই মেচুকা ভ্রমণ ছিল স্বপ্ন।
তিনসুকিয়ার এত কাছে যে স্বর্গপুরি দেখে এলাম – পরের দুই সপ্তাহ আমাদের ঘরে কারও নেশা
কাটে নি।এমন কি নেশাচ্ছন্ন থেকেই কাহিনিটি
লিখছি।
আনিনি সাগর পৃষ্ঠা থেকে ৬০০০ ফিট উপরে,
মেচুকা এর থেকে সামান্য উঁচুতে। কিন্তু পরের ৫০ কিলোমিটারে প্রায় দ্বিগুণের বেশি উচ্চতা
আপনাকে অতিক্রম করতে হবে। পথ সংকীর্ণ। যদিও ভাঙা চোরা নয়। জানুয়ারি শেষে বা ফেব্রুয়ারিতে
তিনসুকিয়া ডিব্রুগড়ে টানা কদিন বৃষ্টি দিলে আনিনি মেচুকা এর সবই বরফে ঢাকা পড়ে যায়।
আমাদের চেয়ে বহু বেশি দুঃসাহসীরাই কেবল সে অভিজ্ঞতা লাভ করতে যায়। কিন্তু আমরা যখন
গেছি নিচে রোদ্দুর, তখন কেবল লামাঙেই বরফ দেখা যেতে পারত।
পথের বিপদ বুঝে প্রশাসনের সতর্কতাও
ব্যাপক। দরকার প্রশাসনিক অনুমতির। আগের রাতেই শহরে তিন জায়গাতে প্রতিলিপি দিয়ে আসবার
কথা লিখেছি। এবারে পথে ৪টা গেট পার করতে হবে এবং সব গেটে শুধু দিলেই হবে না, নাম ধাম
লিখিয়ে আধার দেখিয়ে এগুতে হবে। ফেরার সময়ও আপনার গাড়ির নম্বর দেখে তবে গেট খুলবে।
সব দিক থেকে নিশ্চিত করবে যে এই সময়ে আপনি গেছেন আর সেই সময়ে ফিরেছেন। এর বেশিটাই
আপনার নিরাপত্তার জন্য। সময়ে না ফিরলেই খবর পড়বে।
আমরা যেদিন পৌঁছেছিলাম সেদিনই তিনসুকিয়ার একটি ছাত্র দল
ওখানে গিয়েছিল। ধনদুপ হোমস্টেতেই এরা ছিল। আগের রাতে বৃষ্টি হয়েছিল। ওরা চতুর্থ চৌকি
তথা গেট অবধি পৌঁছুতে পারে নি। আমাদের ছবি ও ভিডিও দেখিয়ে বলছিল কীভাবে গাড়ি পিছলে
যায় এবং এক সংকীর্ণ পথে বহু ঝুঁকি নিয়ে গাড়ি ঘোরাতে হয়। ওদের সঙ্গে একটি মটর বাইক
ছিল সেটিও যেতে সাহস করে নি।
আমরা যেদিন যাই সেদিন মেচুকা রোদ ঝলমল।
তবু ধনদুপের আত্নীয়সম সত্ত্বাধিকারী বলে দিয়েছিলেন, বরফ দেখলেই সতর্ক হয়ে যাবেন,
ঝুঁকি নিয়ে এগুবেন না। চওড়া জায়গাতে গাড়ি রেখে দেবেন।
আমরা তাই করেছিলাম তৃতীয় গেট পার করবার
পরেই। চতুর্থটির চার-পাঁচ কিলোমিটার আগে। যদিও তৃতীয় গেটের সেনা বলেছিলেন, আজ গাড়ি
যাচ্ছে --আপনারা যেতে পারবেন। ফেরার পথে "ভারতের শেষ কাফে'-তে চা কফি খেয়ে যাবেন।
সম্ভবত সেটি পাহাড়ের গায়ে সেনার তৈরি। ফেরার সময় জিজ্ঞেস করলে জানালেন, বন্ধ হয়ে
গেছে।
সকাল ৮টা নাগাদ বেরিয়ে পড়ি। প্রথম
দুটি গেট পনেরো-বিশ কিলোমিটার গেলেই পর পর মিলবে। দ্বিতীয় গেটের কাছে চওড়া হ্যালিপ্যাড
দেখে নেমে বিরাম নিতে, ছবি ভিডিও করবার ইচ্ছে হলেও উপায় ছিল না। যত আগে গন্তব্যে পৌঁছুনো
যায় ততই মঙ্গল। ওখান থেকেই দূরের পাহাড়ের বরফ ঢাকা পাইনের সারি আর পাহাড় চূড়া দেখা
যাচ্ছিল। তৃতীয় গেট পার করতেই পথের দুপাশে বরফ দেখা দিতে শুরু করে। এরই মধ্যে চার-পাঁচ
কিলোমিটার গাড়ি চলল। রোদ এখানে মেঘ ঢাকা। জ্যোৎস্না রাতের থেকে সামান্য উজ্জ্বল। অপূর্ব
দেখাচ্ছিল চরাচর। চলচ্চিত্রে স্বর্গের দৃশ্য অমনই দেখায়।
চতুর্থ গেটের চার-পাঁচ কিলোমিটার আগে
আসামের শিলাপাথার-চিমেন চাপরি থেকে যাওয়া এক বাঙালি যাত্রীদল আমাদের গাড়ি থামিয়ে
দিয়ে বললেন, আর যাবেন না। নিরাপদ নয়। ওদের গাড়ির পেছনে আমরাও গাড়ি দাঁড় করালাম, আমাদের
পেছনে আরও গাড়ি দাঁড়িয়ে গেল। একটি খানিক বড়ো গাড়ি চলেও গেল, একটি যেতে গিয়ে পিছলে
পিছিয়ে এল। প্রচুর বাইক স্কুটি আরোহী তরুণ তরুণী ছিল, এরা তরতরিয়ে চলে গেল। কিছু
গাড়িকে আমরাও আটকে যেতে সতর্ক করে দিলাম।ওখানেই
পায়ে হেঁটে ঘোরা ফেরা করে ঘণ্টা-খানিক কাটিয়ে দিলাম। বরফ পুতুল তৈরি করলাম তিনজনে।
এরই মধ্যে স্ত্রী শম্পার পোশাকে কোত্থেকে যেন প্রচুর আঠালো চোরকাঁটা আটকে গেল। বেচারির
মন খারাপ, তাই ছাড়াতে লেগে গেল। গাড়িতে পড়ে ছাড়াবে বলেও লাভ হল না। পাশিঘাটের একটি
তরুণতরুণী দলকে আমরাই আটকেছিলাম। ওরা পায়ে হেঁটে চতুর্থ গেটে গিয়ে ফিরে এসে বলল,
গাড়ি নিয়ে যেতে পারবেন তো --অনেক গাড়ি আগে গেছে। স্ত্রী কন্যাকে বললাম, তোমরা দাঁড়াও।
চেষ্টা করি। যদি এই অবধি চড়তে পারি তবে এগিয়ে যাব। তাই হল, টাটা পাঞ্চ মাত করল। যে
গাড়িটি আমাদের আটকেছিল সেটি ছিল আলটো, যেটি পিছলে গেছিল সেটিও সেরকম একটি ছোটো গাড়ি
ছিল।
চতুর্থ গেটের সামনে গিয়ে গাড়ি দাঁড়াল।
ওখানে আরও একটি হ্যালিপ্যাড। পাহাড়গুলো ছড়ানো ছিটানো। ফলে ঠাণ্ডা যেন লাফিয়ে বেড়ে
গেল। হালকা তুষারপাতও হচ্ছিল। একটি ছোটোখাটো সেনা শিবিরও আছে। বরফ-ঢাকা ঘরগুলো দেখাও
অনন্য অভিজ্ঞতা ছিল। পুরো উৎসবের পরিবেশ ওখানে। বরফ উৎসব। সেনাদেরও সেখানে একটাই কাজ,
পর্যটকদের সঙ্গ দেওয়া। এক সেনা আমাদের সঙ্গে ছবি তুললেন, বললেন --দশদিন স্নান করেন
নি। মনে মনে ভাবলাম দশদিন স্নান না করলেও ওখানে শরীর নোংরা হবার কোনো সম্ভাবনাই নেই।
তিনি বললেনও, আপলোগ আতে হো বোলকে হম লোগ নিকলতে হ্যায়, নেহি তো এহা কাম ক্যা? মাস
তিনেক ধরে তিনি ওখানে আছেন বলে জানালেন। পরের ছুটির পরেই যদি অন্যত্র পাঠায়।
বরফে স্ত্রী কন্যার নৃত্য দেখা আমার
বাড়তি আনন্দের বিষয় হয়েছিল। স্ত্রী তো এমন কিছু ভিডিও করল যেন পরিচিত জনের সঙ্গে
ভিডিও কলে কথা বলছে। ওর এই শিশুর মতো উল্লাসের ভিডিও আমি এখনও মুগ্ধ হয়ে দেখছি বারে
বারে। আমার না হয় সাহস হচ্ছিল, কিন্তু এটি তো ঠিক -- আমার হাতে জীবন অর্পণ করে ভরসা
করে এই অবধি এসেছে। এখনো নিরাপদে বাড়ি ফেরা বাকি।
আলোতে সে একবার বলেছিল, চলো ঘুরে যাই।
পৌষালিকে জিজ্ঞেস করছিলাম, কী রে ভয় করছে? ও "না' বলে আমার সাহস বাড়াল। সবটা
কি আর ও বুঝে শোনে বলেছিল? সত্যি বলতে কি -- ভয় তো আমার নিজেরই করছিল। সেই ভয় লুকিয়ে
নিয়ে চলে এসেছি। BRO ঠিকই জানান দিচ্ছিল, লামাঙের পথে দেখেছি::
"Difficult road often leads to beautiful
destinations'. আমরা কেউ জীবনে প্রকৃতির এত সুন্দর রূপ দেখিনি। এরই মধ্যে একটি
উৎকণ্ঠা বাড়াবার ঘটনা ঘটেছে তো বটেই। পৌষালি ওর মোবাইল দিয়ে পাঠিয়েছিল গাড়িতে চার্জ
দিতে। ঠাণ্ডাতে দ্রুত চার্জ চলে যাচ্ছিল। বসে বসে ওর মোবাইলে চার্জ দিতে ভাবলাম, আমারটাতেও
দিই। সেটি আর পাই না। পুরো গাড়ি খুঁজে নেই। অথচ সামান্য আগে অন্য কাজে গাড়িতে এসে নিজের
মোবাইলে প্রথম ছবিটি নিয়েছি। গেল কই? এতেই তো আমাদের সব ডিজিটাল টাকা! ইতিমধ্যে বরফে
গড়াগড়িও দিয়েছি। বরফ ঢাকা পড়ে যায় নি তো? চৌকির সেনাকে বলাতে তিনি ও তাঁর সতীর্থ
দুয়েকজনও খোঁজাখুঁজি শুরু করলেন। হ্যালিপ্যাডে এক চক্কর কেটে আবার গাড়ি এসে দেখি আমার
মোবাইল ঠিক চার্জিং পয়েন্টের নিচে গাড়ির ভেতরে শুয়ে আছে!
এবার ফেরার পালা। হ্যালিপ্যাডের থেকে
৫/৬০০ মিটার দূরে একটি পুরনো দুর্ঘটনায় পতিত হ্যালিকপ্টার পড়ে আছে। অনেকে সেদিকেও
যাচ্ছিল। আমরা ওদিকে এগিয়েও আর যাইনি। সবার তখন নাক ঝরছে। পৌষালির নাকে রক্ত ঝরতে
শুরু করে ঠাণ্ডাতে। ফিরতে গিয়ে এক তুষার শেয়ালের দেখা মিলল, সাদা ধবধবে। সঙ্গে বরফে
ওর পায়ের ছাপও। পাহাড়ের গায়ে ওর পায়ের ছাপ অনুসরণ করতে করতে এসে গাড়িতে চাপলাম।
চৌকির সেনার থেকে বিদায় নিলাম।
পথে প্রচুর ঝরনা ছিল, তার অনেকগুলোতে
জল নামতে নামতে স্বচ্ছ কাঁচের মতো বরফ হয়ে ঝুলছিল। একটিতে নেমে ছবি নেবার চেষ্টা করলেও
সেই স্বচ্ছ বরফ ভালো আসেনি। চৌকির একটি চালের থেকে গোলাপ আকৃতির বরফ নিয়ে আমরা হাত
বিনিময় করছিলাম। সব মিলিয়ে লামাঙে আড়াই ঘণ্টা কাটিয়েছি। দেরি করে ফেলেছি। পথে আরও
বহু কিছু দেখার ছিল। খাবারও ছিল। দেড়টা তো বেজেই গেছিল ওখানে। এই শীতে এককাপ গরম কফি
বা চায়ের কি খুব দরকার না? পাবেন কই? ভারতের শেষ কাফেতে। ৩ নম্বর গেটে যে বলেছিল।
৪
লামাং গিরিপথ নিজেই সবচাইতে বড়ো দর্শনীয়
পথ। তাওয়াঙের সেলা গিরিপথ বা বুমলা গিরিপথের চাইতেও সুন্দর --লিখলে অনেকে চটে যাবেন।
কিন্তু সেটিই সত্য। অধ্যাপক আবু হুশেইন জানিয়েছেন, ১৩০০০ ফিটের উপরে আর গাছ পালা থাকে
না। লামাঙও সেলার মতো ১৫০০০ ফিটই। কিন্তু ১৩ হাজারের পরে এখনও যেতে দেয় না। দিলে হয়তো
এখানেও ন্যাড়া পাহাড় মিলবে।বুমলা গিরিপথে
ন্যাড়া পাহাড়ের পাশে কিছু বড়ো হ্রদ আছে। লামাং গিরিপথ পাইনের অরণ্য ঘেরা। পাইন বন এমনিই
সুন্দর। তার উপরে যখন বরফ পড়ে, কল্পনা করুন। সর্বোচ্চ গিরি শৃঙ্গ কিন্তু পুব কামেং
জেলার চিন সীমান্তের "কাংটো'-ও ন্যাড়াই হবে, কিন্তু দেখতে অনেকটাই কাঞ্চনজঙ্ঘার
মতো। আন্তর্জালে দেখেছি।
লামাঙের পথে অসংখ্য ঝরনা-- জলপ্রপাত
-পাহাড়ি নদী তো আছেই। তবু লোকে যেতে বা আসতে দুটি জায়গা দেখে ফেরে। একটি হচ্ছে আশির
দশকে তৈরি একটি গুরুদুয়ারা। "তপোস্থান' বলে যেটি পরিচিত। আরটি "হনুমান ফেস'।
মেচুকার থেকে পনেরো বিশ কিলোমিটার উপরে। প্রথমেসেই গুরুদুয়ারা,দ্বিতীয় সেই হনুমানের মুখ। গুরুদুয়ারাটির জায়গাটিতে বুঝি
গুরু নানকদেব তিব্বত ভ্রমণ শেষে কিছু দিন এখানে ছিলেন, এবং ধ্যান করেছিলেন। গুরু নানকের
এশিয়া ভ্রমণের মানচিত্রের একটি ছবি নিয়েছিলাম। অবিশ্বাস্য। বহুবার ভ্রমণে বেরিয়ে
রাশিয়া ছুঁয়ে পুব থেকে পশ্চিম পুরো এশিয়া ঘুরে বেড়িয়েছেন সে কালে --এমন কোনো সম্রাট
বা পর্যটকের কাহিনি আমরা শুনিনি। না চেঙ্গিশখান না হিউএন সাং। অসম্ভব ছিল। গুগোল করেও
সেরকম কোনো মানচিত্র মেলেনি। তবে মেচুকাতে তিনি সেকালে আসতেই পারেন, যদি ফা হিয়েন-হিউএন
সাঙেরা ভারতে একদিকে ঢুকে আরদিকে বেরোতে পারেন। কিন্তু ঠিক সেই জায়গাতেই এসছিলেন সে
তথ্য আশির দশকে এক মেজর কী করে নিশ্চিত হলেন সেই জিজ্ঞাসা থেকেই গেল। পথ থেকে সামান্য
নিচে নেমে গিয়ে গুরুদুয়ারা, অবশ্যই দৃষ্টিনন্দন। তার ঠিক নিচেই পাহাড়ি নদীর কলতান।
চাই কি নদীতে নেমেও যেতে পারেন।গিয়ে ঢুকতেই কিছু সেবাইত (পেশায় যারা সেনা বাহিনীর
লোক) আপনাকে স্বাগত জানাবেন। জুতো খুলে তাঁদের দেওয়া চপ্পল পরে আরও নিচে মূল গুরুদুয়ারা
দেখে আসতে বলবেন। পায়ে কাদা থাকলে ধুয়ে বা ঝেড়ে নিতে বলবেন। ওখানে একটি ছোট্টো যাদুঘরও
আছে। তাতে ছবি ও লেখায় শিখ ধর্ম কথা, ও জায়গাটির মাহাত্ম্য লেখা আছে। স্বর্ণ-মন্দিরের
একটি আদলও রাখা আছে। সেসব দেখে আসবার আগে বা পরে তাঁরা প্রসাদ তথা লঙর খেয়ে যেতে বলবেন।
না খেলে অভিমানও করবেন। আমাদের বলা হল, অনেকে ভাবেন টাকা লাগবে --তাই এড়িয়ে যান। অধিকাংশই
এখানে খেয়েই আসেন, কারণ পুরো পথে আর খাবার মেলে না যে। লোকে মাটিতে আসন পেতে খাচ্ছে
দেখে, আমার স্ত্রী চিন্তাতে পড়ে গেল। ওর কোমরে ব্যথা করে।যখন বললাম, ও কি বেঞ্চে বা
চেয়ারে বসে খেতে পারে? -- আমাদের তিনজনকেই রান্না ঘরে নিয়ে চেয়ার টেবিলেই বসিয়ে
দিল। খাবার পরে বাসনটা আপনাকে ধুয়ে আসতে হবে। ফেরার সময় বলল, লাকি-স্টোন কেভমে যাইয়ে
গা।
এর একটি কাহিনি আছে, উপরের সড়কেই মেচুকার
দিকে পঞ্চাশ ষাট মিটার নামলে উল্টো দিকে ঐ গুহা ও ঝরনা পথ। গুরু নানক এবং তাঁর এক শিষ্য
ওখানে এক পাথরে বসে ধ্যান করছিলেন, তখন এক ভালুক তাদের আক্রমণ করলে পাথরটি শূন্যে উড়া
দেয়। সেই পাথরে বুঝি এখনও তাঁদের পাগড়ির ছাপ আছে। ওখানে জলের খুব সংকট, গুরু নানকের
ইচ্ছে হল স্নান করবেন, কিন্তু যাবেন কী করে? একটি পাথর ফেটে পথ করে দেয়। তার মাঝে
দিয়ে তিনি যান। সেই থেকে বুঝি ওখানকার একটি ঝরনার জল শুকোয়ই না। ওখানে পাথরের বেশ
কিছু গর্ত আছে। জলের ভেতরে সেই গর্তে হাত ঢুকিয়ে যদি আপনি সাদা পাথর তুলে আনেন তবে
আপনার কপাল ভালো, যদি কালো পাথর তুলে আনেন তবে মন্দ। আর যদি ছাই রঙের পাথর উঠে তবে
খেলা ড্র। আমাদের কপাল মন্দ, জায়গাটি খুঁজেই পাইনি। অবশ্য তিনটি কারণও ছিল, না পাবার
--এক, মেচুকা ফিরে দিনের আলোতে রূপ দেখা এবং ঝুলন্ত সাঁকোতে চড়ার আমার লোভ ছিল। দুই,
আগের দিনে ছেলেগুলো বলেছে, ওই পথে যাওয়া খুবই কঠিন। ফাটা পাথরের মাঝ বরাবর ঢোকা সবার
কম্ম না।তিন, ওটা আমি বহু আগে একটি ভ্লগে দেখেছি, জায়গাটির উপর মেম্বা জনজাতির বৌদ্ধরাও
সমানে দাবি জানান। তাঁদের বৌদ্ধ গুরু রিমপোচে নেহ পেমা সেলপু-র ধ্যানের জায়গা বলে।
এবং পরিষ্কার ওখানে একটি গুম্ফার তোরণ ছিল। তাঁদের ক্ষোভ একটি বৌদ্ধ উপাসনা স্থলকে
১৯৮৬-তে শিখ রেজিমেন্টের কিছু সেনাকর্তা এসে তাঁদের তীর্থে রূপান্তরিত করে ফেলেন। এই
নিয়ে দ্বন্দ্ব আছেই। গুরু নেহ পেমার গল্পও গুরু নানকের গল্পের মতো প্রায় একই। বৌদ্ধদের
এমন চাপা ক্ষোভের কাহিনি সারা ভারতেই অনেক ছড়ানো আছে। সেই গুম্ফাতে যাবার লোভ হলেও
সন্ধ্যা হয়ে আসছে বলে ছেড়ে আসি। পরে জানি ওটাই সেই নানকের তপোস্থান। পরে এই কদিনে
একটি অসমিয়া কিছু তরুণের ভ্লগে দেখেছি, ওখানে যাওয়া সত্যি কঠিন। এক জায়গাতে খাড়া
কাঠের তৈরি সিঁড়ি বেয়ে নামতে হয়। সন্ধ্যাবেলা সেটা অনেক ঝুঁকির হত। যদিও কিছু সময়ের
জন্য পৌষালির মন খারাপ হয়ে গেছিল, ওর ধারণা ছিল --সড়ক ধরে সামান্য পিছিয়ে গেলে আমরা
তপোস্থান পেয়েই যেতাম। আমি ঐ ঝুলন্ত সেতুতে ঝোলার মোহে চলে এসছি তাড়া দিয়ে।
ঝুলন্ত সেতু অনেক আছে। কিন্তু সবচে
বড়োটি চোখে দেখা গেলেও পথ আর মেলে না। তার জন্য সেগং গ্রাম পেরিয়ে ৩ কিলোমিটার পর
ভুল পথে নদী পাড়ে কিছু দূর গিয়ে আবার উল্টো পথে এসে সেগঙ মোড়ে লোক জনকে জিজ্ঞেস করলে
বলল, "ওটা তো বস্তির ভেতরে। বরং কাছেই একটু সেতু আছে। আপনি এখন সেটিই দেখে আসুন।'
তারই অর্ধেক চড়ে ছবি আছে। একাই চড়েছি। মন খারাপ মেয়ে সঙ্গ দেয় নি। আর পা ফেললেই দুলে
বলে ওর মা সাহস করেনি।
"হনুমান মুখ'টি গুরুদুয়ারার সামান্য
আগে উপরে সড়কের উল্টো দিকের পাহাড়ে দেখা মেলে। যেতে আসতে এমনি দেখা যায়। পাহাড়ের গায়ে
এখানে ওখানে বৃক্ষ-বিহীন ফাঁকা জায়গা থাকে। তারই একটি দেখলে মনে হয় পুরো হনুমানের
মুখ। সম্প্রতি সড়কের পাশে একটি মন্দিরও হয়ে গেছে। যাবার পথে অন্য অন্য ফাঁকা ঠাঁই
দেখে পৌষালিকে বলছিলাম, ঐ দেখ ভুশুণ্ডি কাক, ঐ দেখ জাম্ববান, ঐ দেখ বেদব্যাস। লোকে
দেখছি হনুমান ছাড়া আর কাউকে চেনেই না। বিষয়টি সেরকমই। বছর কয় পরে হনুমান যে ওখানে
তাঁর মুখদর্শন করাবেন --এর কোনো নিশ্চয়তা নেই। নানকের ধ্যানেরও এমন নানা গল্প ইউটিউবে
মেলে। আজকাল গল্পে স্থিরতা এনে বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়াতে টিনের বোর্ডে লিখে দিয়েছে। যাই
হোক, শহরে পৌঁছাতে পৌঁছাতে আলো জ্বলে উঠেছে। সূর্যের আলোতে আর শহর দেখা হল না। তবু
একটু চা খাব বলে এক রেস্তোরার সামনে গাড়ি রেখেছি, পাশে আলো জ্বলে উঠেছে। সেই অন্ধকারেও
দূরের বরফ ঢাকা পর্বত স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। চা খাবার পর মনে হল, সন্ধ্যা পাঁচটা মাত্র।
কাল চলে যাব, তখনই হোমস্টেতে ঢুকব কেন? সেই দর্জিলিং মোড় থেকে গুম্ফার পথের দিকে গিয়ে
রাতের মেচুকা দেখব বলে পৌষালি গাড়ি চালিয়ে দিল। অপূর্ব সে দৃশ্য। সেই অন্ধকারেও দূর
পর্বতের বরফ ঠিকই দেখা যাচ্ছিল। বাজারে ফিরে এক হাজার টাকার পেট্রল ভরে নিলাম, পরদিন
অন্ততআলো অবধি তো নিশ্চিন্তে পৌঁছুতে হবে।
আড়াইশ কিলোমিটার পথ চলবার তেল ছিলই, তবু। তখনই পৌষালির চোখে পড়ল উল্টোদিকের এটিএমে
লম্বা লাইন। টাকা মিলল, ফলে হোমস্টের বিল পেলে পরে যদি নগদে কম পড়ে, তবে কী করব --সেই
উদ্বেগ থেকে মুক্তি মিলল। যদিও খাণ্ডু ফিলে বলছিলেন, তিনি কিছু একটা ব্যবস্থা করবেন।
ব্যবস্থা হয়েই গেল। পরদিনের পথের কিছু খাবার কিনে সোজা হোমস্টে। তৃতীয় সন্ধ্যা ফেরার
আগের দিন। সকালে খাণ্ডু ফিলেকে বলেছিলাম, একটি ব্লুটুথ স্পিকারের ব্যবস্থা করুন। নেট
নেই, টিভি নেই। আপনার সন্তান দুটিরও ভালো সময় কাটবে। ইউটিউব থেকে মিউজিক নামিয়ে রাখবেন।
বললেন, যদিবা চলেও নামানো তো যায় না এই স্পিডে। কথা দিলাম, আমি ফিরে অডিও ফাইল পাঠাব।
সেগুলো নিশ্চয় নামবে। বললেন, আজই কিনে নেব।সন্ধেবেলা পৌঁছুতেই বললেন, স্পিকার মাইক্রোফোনের
ব্যবস্থা হয়ে গেছে, আপনার মেয়েকে এবারে গাইতে হবে। দেখি ঢাউস সাইজের স্পিকার বেরিয়ে
এল। বললাম, এত বড়ো কিনতে বলিনি তো। ভদ্রলোক মিষ্টি একটা হাসি দিলেন। বোঝা গেল, ওটা
আগেরই ছিল।
এবারে সমস্যা হচ্ছে ভদ্রলোক ভাবছিলেন,
আমাদের গায়িকা মেয়ের কাছে ট্রাক থাকবে, সন্ধ্যা জমে যাবে। আগের দিনে পাশিঘাট থেকে কিছু
তরুণ এসছিল। এরাও অত্যন্ত সুজন। একটি ছেলের বোন বুঝি র্যাপ গান করে পাশিঘাটে বিখ্যাত।
অগত্যা গানের আসর বসে গেল। সমস্যা হল, পৌষালির কাছে না ছিল ট্র্যাক না ছিল গানের
"লিরিকস'। তবু কিছু গান হল। হিন্দি অসমিয়া বাংলা সবই হল। কেবল অরুণাচলি গান গাইবার
কেউ ছিল না। এর পর আমার মোবাইলে জগজিৎ সিং চিত্রা সিঙের এলবাম নামানো ছিল। বহু রাত
অবধি সেই গানেই সন্ধ্যা জমিয়ে রাখল।
হঠাৎ খাণ্ডু ফিলে "মেম্বা' জনজাতি
মেয়েদের বিয়ের পোশাক বের করে এনে, পৌষালিকে বললেন, পর। তাঁর কিশোরী কন্যাও পরল। দুজনে
ছবি হল। পরে আমার জন্যও একটি জামা এবং সবার জন্য টুপি বেরিয়ে এল। সবে মিলে ছবি হল।
আমি মেম্বা পোশাকের সঙ্গে আমাদের বাঙালিদের বর্মাগত জাতীয় পোশাক লুঙ্গি ছাড়িনি। ইচ্ছে
করলে প্যান্ট পরতে পারতাম। পরে মনে হল, কিছু নির্বোধেরা একে মুসলমানি পোশাক ভাবে বলেই,
সাহেবি পোশাক পরে জাতে উঠব কেন?লুঙি বর্মী
-বাঙালি –অসমিয়াদের বহু প্রাচীন পরম্পরাগত পোশাক, এমন কি বিহারিদেরও। যদি আলোতে ছবি
উঠতাম, তবে সেটিই হত "গালো' জনজাতির পোশাক। পাশিঘাটে উঠলে "আদি' পোশাক। এই
তিন জেলার এই তিনটিই প্রধান জনগোষ্ঠী। এই মেম্বারাই বুঝি তাওয়াঙে ভুটানে তিব্বতে মোনপা।
গোটা উত্তর অরুণাচলে এই জনজাতিদের দেখা যাবে। এজন্য শিলচর তিনসুকিয়ার শীতের বাজারে
অনেকে ভুটানি তিব্বতিদের মধ্যে তফাৎ গুলিয়ে ফেলেন। কিছু নির্বোধের যেমন করিমগঞ্জের
লোক দেখলে সবাইকে "বাংলাদেশী' বলে মনে হয়, মেচুকার লোকজনকে দেখলে আপনার সবাইকে
তিব্বতি বলে মনে হবে। আসলেই এরা ভারতীয় নাগরিক। শ্রমজীবী মেয়েরা যেভাবে প্যান্ট টুপি
পরে কাজে বেরোন, চিনা শ্রমজীবীদের এমন ছবি ভিডিও অনেকে দেখেছেন। খাণ্ডু ফিলের স্ত্রী
সারাক্ষণ প্যান্ট পরেই ঘরে ছিলেন।
রাতেই তাঁদের থেকে বিদায় নিয়ে রেখেছিলাম।
এটাই রীতি। ভোররাতে বেরিয়ে যেতে হলে নিশ্চিন্তে বেরিয়ে পড়ুন। দরজা গেট সব খোলাই থাকবে,
গৃহস্থ ঘুমিয়ে থাকবেন। ঘরে তালা মারবার বুঝি দরকারই পড়ে না। খাণ্ডু ফিলে বলছিলেন,
মেচুকাতে চুরির মামলা নেই বললেই চলে।
৫
কিন্তু সেরকম হয় নি। পরদিন ভোর চারটাতে
উঠে যখন পাঁচটার অন্ধকারে বেরিয়ে যাবার জোগাড় যন্ত্র করছি, দেখি গৃহস্থ স্বামী - স্ত্রী
জেগে চুলো ধরিয়ে দিয়েছেন। না, আমাদের জন্য না। দিনের পথ বন্ধের ঝামেলা এড়াতে মরানের
দুই বিহারি ভদ্রলোক ড্রাইভার নিয়ে আগের দিন সকাল দশটাতে রওয়ানা দিয়েছিলেন। এসে জানলেন,
রাতে আরও দীর্ঘ পথ বন্ধ হয়। সড়কের কাজ চলে। আটকা পড়েছিলেন। ভোর পাঁচটাতে এসে পৌঁছুলেন!
জিজ্ঞেস করলাম, ভয় করে নি? তাঁরা গাড়ি ঢোকাবেন বলে আমি গাড়িটি আগে বের করে পথে নিতে
নিতে কথা হচ্ছিল। ভয় করে নি মানে! একবার মনে হচ্ছিল, ফিরেই যাই। পরে ভাবলাম, যেদিকেই
যাই সেদিকেই তো রাত। অগত্যা চলে এলেন। পথের অন্ধকারে একটি কিউড গাড়িকে মোবিল ট্যাঙ্ক
ফাটিয়ে বসে থাকতে দেখে এসেছেন। দূর দূর অবধি না মানুষ না গাড়ি। "গলত ডিসিশন থা'---
স্বীকার করলেন। সেই সকালে লামাঙে বরফ দেখে পরদিন তাঁদের ফেরার পরিকল্পনা।পথে বারো ঘণ্টা
কিচ্ছু পেটে পড়েনি। এসেই কিছু খাবার চাইলে ফিলে দম্পতি চট জলদি ম্যাগি করে দিলেন। তারপরেও
এরা দরদাম করছিলেন দেখে মনে মনে রাগই উঠল। বললাম, "ঘরে এসছেন। নিশ্চিন্ত থাকুন।'
গৃহিণীকে বললাম, চা হবে? হয়ে গেল। পয়সা দিতে চাইলাম। হাতের ইশারাতে হেসে হেসে মানা
করলেন। ফিরে এসে এখনও মনে হচ্ছে, আত্মীয় রেখে এলাম।
অন্ধকারে বাজারে এসে দেখি সুমো কয়েকটি
যাত্রার প্রস্তুতি নিচ্ছে। গুটিকয় বাইক আমাদের পিছু পিছু এগুলো। বাজে অংশে পৌঁছুতে
পৌঁছুতে ভোরের আলো ফুটে গেছিল। অপূর্ব সব সূর্যোদয়ের দৃশ্যও দেখা হয়েছে। কিন্তু তখন
তো আগে "টাটো' পার করবার তাড়া। গাড়ি সোজা এসে টাটোতে থেমেছিল, সকাল আটটার আগেই।
গরম বোতলে কিছু চানিতে নিতে আমি একা এক কাপ
খেয়েও নিলাম। দিন দুই রোদ দেওয়াতে পথে সেদিন কাদা কম ছিল।
দুর্গম ঠাঁই গিয়ে পৌঁছুনো মানে হচ্ছে
আপনি অর্ধেক পথ ভ্রমণ করলেন। নিরাপদে ফিরে আসবার উদ্বেগ আমাদের তাড়া করছিলই। পুরো পথে
একথা আমি স্ত্রী -কন্যাকে বলছিলাম। যদি অক্ষত গাড়ি নিয়ে ফিরতে পারি, তবেই জয় সম্পূর্ণ।
সেটি আর হল না। কিন্তু সে ঘটনা বহু পরে ঘটেছে। তাই পরেই বলছি।টাটো পার করে কিছু এগিয়ে
পথ ভুল করে ফেললাম। হত না, যদি না পৌষালি ঘুমিয়ে পড়ত পেছনে গিয়ে। সে জানে টুম্বিন
অবধি ওর কোনো কাজ নেই, পথও এদিন তুলনামূলক শুকনো ছিল। পেছনে চলে গেল। সূর্যোদয়ের রূপ
দেখা ওর তেমন করে আর হল না। আসার দিনে এই দুর্গম পথ ওর মা ঘুমিয়ে পার করেছে। এই নিয়ে
বাপে -মেয়েতে অনেক হেসেছি। যে পথে লোকের ঘুম ছুটে যায়, সেই পথ ও পার করেছে নিশ্চিন্তে
ঘুমিয়ে। আসলে আগাম সতর্ক হয়ে বমির ট্যাবলেট খেয়েছিল, তাতেই ঘুম। এসব পথের
"পথিক তুমি পথ হারাইয়াছ?' --খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। বহুতে এই ভুল করেন। রাতে না
আসা এর জন্যেও উচিত। মোড়গুলোতে লেখা থাকে না। কিন্তু ওখানে লেখা ছিল, মোড়ের মাঝখানে,
পথের উপর পাথুরে ফলকে। তবু আমরা পথ ভুল করেছি রূপের মোহে পড়ে। উপরের পাকা পথটি ছিল
দৃষ্টিনন্দন, নিচের পথটি ভাঙা। সেই ভাঙা পথে কিছু দাঁড়ানো গাড়ি আর টিনের চাল দেখে মনে
হল বিআরও আবাস। চলে গেলাম তালিহার পথে। তালিহা আরও দেড়শ কিলোমিটার দূর আপার সুবনসিরি
জেলার গ্রাম। বহুদূর গিয়ে পথটিকে অচেনা মনে হল স্ত্রী শম্পার। আমারও মনে হল এতক্ষণে
সিকোদিদো জলপ্রপাত এসে যাবার কথা। লোকজনকে জিজ্ঞেস করে জানলাম, ভুল পথে এসে গেছি আট
কিলোমিটার। তাতে আধাঘণ্টা নষ্ট হল।
যদিও টাটো পার করবার পর এটি নিশ্চিন্ত
ছিলাম, এর পর অবরোধে আটকা পড়লেও টুম্বিন পার করে যাব দিনের আলোতে। এর পর ঝড় এলেও আমাদের
পায় কে? সিকোদিদোতে এবারে তাই নিশ্চিন্তে নেমে কিছুটা সময় পার করলাম। এই পথে এটিই
সবচে উঁচু বড়ো জলপ্রপাত। বর্ষার দিনে সড়কে দাঁড়ানোও কঠিন করে ওর জলের ছিটে। পেনে পাবার
কিছু আগে ঘটল সেই বিপত্তি। হেসে খেলেই এগুচ্ছিলাম। এক জায়গাতে অনেকগুলো গাড়ি সামনে
থেকে এসে চলে গেল। তার মানে কোনো অবরোধ খুলেছে। আর এটাই বিপদ ডেকে আনল। আরও কিছু দূর
এগিয়ে একটা সংকীর্ণ চড়াই উঠতে যাব, সামনে দাঁড়ানো চালক বিহীন বলেরো। আর নামছে অনেকগুলো
ট্রাক। পেছনে যে যাব, সেদিকেও গাড়ি। একটি বিআরও ট্রাক এগিয়ে বাঁদিকের পেছনটা ছুঁয়ে
দিল। সাধারণত এমন অবস্থায় গাড়িগুলো দাঁড়ায়। একে অন্যকে সাহায্য করে। কখনও সহচালক
থাকলে নেমেও পথ করে দেয়। এই ট্রাক তা করল না। সম্ভবত এর জন্য যে ওরও সামনে পেছনে গাড়ি,
আর ডান পাশেই গভীর খাদ। এমন অবস্থায় সিদ্ধান্ত নেওয়া কঠিন হয়। আমারও ডানে ডালপালা
ঘাস লতা ঢাকা নালা। দিলাম উপরে সামান্য টান। বিকট শব্দ হল। তখন একটি লোক বলেরোর পেছন
থেকে বেরিয়ে আমাকে সাহায্য করল আগুপিছু করে পাশে সরাতে। অনেক বড়ো বড়ো গাড়ি পেরিয়ে
গেল। কিন্তু উল্টো দিক থেকে আসা ট্রাকে লাগল জ্যাম। যে লোকটি সাহায্য করল সে বলল, গাড়িটি
দাঁড়িয়ে আছে, ধরুন গিয়ে। ধরলাম বটে, কিন্তু এই বিপজ্জনক জ্যামে আর কতটুকু কী করি?
দেখি বাম্পার খানিক ফুটো আর চ্যাপটা হয়ে গেছে। পাঞ্চের শরীর। সব আঘাত এই ফাইবার অংশের
উপর দিয়ে যায়। অন্য গাড়ি হলে পেছনটা ঝুলে যেত, না বাঁধলে এগুনো কঠিন হত। ৯০ ডিগ্রি
বাঁকা হয়েছিল। হাত দিয়ে ঠেলতে অনেকটা সোজাও হয়ে গেল। পরে যখন এগুচ্ছি, দেখি ঐ বলেরোর
যাত্রীরা সংকীর্ণ পথের পাশে বিদ্যুতের খুঁটিতে কাজ করছে। ওদের সামান্য পেছনে চওড়া জায়গা
ছিল। বললাম, কথাটা। মানল কই? সেখানে ঐ লোকটিও ছিল যে আমাকে পাশে সরাতে সাহায্য করে।
সে তখন সুর বদলে বলে, আপনি আরেকটু ডানে সরে দাঁড়াতেই পারতেন।
মনের সেই স্ফূর্তি চলে গেল। যদিও মানসিক
প্রস্তুতি ছিলই। ওভাবে বেড়াতে বেরোলে থাকবেন কই, খাবেন কী? --এই সবের সঙ্গে নিজের ও
গাড়ির চিকিৎসার হিসেবটাও করে বেরোতে হয়। অল্পে গেল বলে রক্ষা। তাও কিনা "ভালো'
পথে। এর থেকে কত বিপজ্জনক পথ নিরাপদে পার করে এসছি।
পেনে পৌঁছে সংকেত পেয়ে গেলাম সামনে
অবরোধ আছে। অনেক গাড়ি বাইক দাঁড়িয়ে আছে। তবু যতদূর এগুনো যায় বলে এগুলাম। সামান্য
এগিয়ে আটকা পড়েই গেলাম। মিনিট পাঁচেকে দুটি সুমো এসে বলে কয়ে সেই অবরোধ খুলে দিল।
কিলোমিটার খানিক গিয়ে আবার অবরোধ, এবারে ঘণ্টা দেড়েক।
তবু বেলা দেড়টা নাগাদ টুম্বিন পেরিয়ে
গেলাম। গাড়ি নিয়ে নিল পৌষালি। কায়িং পার করে আলোর পথে এগুচ্ছি। মা মেয়েতে প্রস্তাব
দিল আলোতে থাকার দরকার নেই। লিকাবালি শিলাপাথার পথটা সত্তর আশি কিলোমিটার কম পড়ে। ঐ
পথে বাড়ি চলে যাই। যেতে তো পারি। কিন্তু রাতের পাহাড়ে গাড়ি চালাবার রোমাঞ্চ আছে, মুগ্ধতা
নেই। ভেবেছিলাম, আলোতে থেকে পরদিন ভোরের আলোয় পাহাড় পেরিয়ে যাবার সুখই হবে অন্যরকম।
কিন্তু বিক্ষত গাড়ি আমারও মন খারাপ করে দিল। অগত্যা ফেরাই ঠিক হল।
অসম সীমান্তে ভাটি বা নিম্ন সিয়াং জেলার
সদর লিকাবালির পথে যেতে হলে আলোতে ঢোকার দরকার পড়ে না। রাজ্যের মাঝ বরাবর জেলাগুলোকে
যুক্ত করে পুবে পশ্চিমে আরও একটি সড়ক তৈরি হচ্ছে। সেই পথে "লেপা রাডা' জেলার সদর
"বাসার' হয়ে বেরিয়ে যাওয়া চলে। কিন্তু বিকেল তিনটা। খাবার খেতে হবে। কায়িং
থেকে আলো অনেক ধাবা হোটেল চোখে পড়লেও সুবিধে হচ্ছিল না। ফলে আসার পথে যে খেয়েছিলাম,
সেই "মা হোটেলে' গিয়ে ঢুকলাম। সেদিনই নজরে পড়ল, পাশের হোটেলটি "মুসলিম হোটেল'।
বাঙালির "বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য' যারে কয়। মনের টানে প্রাণের টানে বিদেশ গেলে
থাকবে পাশাপাশি। কিন্তু "হিন্দু মুসলমান' বিভাজন রেখাটি অক্ষত রাখবে। গোমাংস একটি
কারণ বটে হোটেলটি "মুসলিম' হবার। কিন্তু নাহলেও পারত। এই পথে বহু হোটেলে গোমাংস
মেলে। আলো ঢোকার মুখে একটি বিফ কর্ণারে খেতে মেয়ে বা ওর মা কোনো আপত্তি করেনি। কিন্তু
ওখানে ভাত রুটি ছিল না। ছিল শুধু "বিফ আইটেম'। বিকেল তিনটায় "আইটেম' পরখ
করবার শখ হল না। মা হোটেলে সেই শিলাপাথারের দলটিকে আবার পেলাম যাদের লামাঙে পেয়েছিলাম।
পেনের অবরোধেও পেয়েছি।জিজ্ঞেস করলে তাঁরা জানালেন পাশিঘাট হয়ে ফিরবেন, কারণ রাসকিন
জোনাই চিমেন চাপরিতে সহযাত্রী আছেন। আর লিকাবালি পথটি ভালো, কিন্তু চড়াই উৎরাই অনেক
বেশি। তাঁরা সঠিক ছিলেন। কেবল চড়াই উৎরাই না, মাঝে মাঝেই এক দুই কিলোমিটার পথ তৈরি
হয় নি। ভাঙা আর সংকীর্ণ। ফলে পৌষালি বেশিক্ষণ চালাতে পারল না। স্টিয়ারিং চলে এল আমার
হাতে। সন্ধ্যা পাঁচটায় বাসার ও রাত পৌনে দশটায় যখন বাড়ি পৌঁছেছি আমাদের সবার তখন
মাথা ঘুরছে। পাশিঘাট পথে এলে হয়তো এটা হত না। সময়ও খুব বাঁচল বলে মনে হল না।
ডিব্রুগড় পার করে ভাবছি, কোথাও খেয়েই
ফেরা যাক। অগত্যা সুইগি জোমাটোর কথা মনে এল। তাতে সময় বাঁচবে। পৌষালি অর্ডার করল।
আমরা এসে গাড়ি থেকে নেমেছি এদিকে, ওদিকে খাবারও চলে এল। নিরাপদে দুর্গম পাহাড় থেকে
ফেরার আনন্দে সেরাতে আমাদের "পার্টি' হল।
পরদিন সকালে আর মাথাঘোরা রইল না বটে।
কিন্তু পাহাড় যে নেশা ধরিয়ে দিল সে নেশা আজ সপ্তাহ পার করেও যায় নি কারও। নাগাল্যাণ্ডের
পাহাড়ে আমার জন্ম, পাহাড় অতিক্রম না করে আবাল্য আমরা শিলচর করিমগঞ্জেরকেউ বাড়ির বাইরে যাইনি।
কিন্তু নিজেরা গাড়ি চালিয়ে "ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া… ' হিমালয়
ঘুরে আসার আনন্দ কোনো "মাতাল'-কে বোঝানো কঠিন।
পাহাড়ের দেবতা আমাদের রাতের স্বপ্নে দেখা দিচ্ছেন এখনও।
বলতে পারেন রীতিমতো "নিশির ডাক'। পৌষালি একটি ভ্লগ তৈরি করছে। আমি এই গল্প লিখছি।
অন্য বহু কাজে ফাঁকিও দিতে হচ্ছে। আর খবর নিতে শুরু করেছি বলেঙ, টুটিং, টাকসিং, দাপোরিজোর।
ভূগোল দেখছি হিমালয়ের।
৭ জানুয়ারি আমরা রওয়ানা দিই। সেই রাত
আলোতে কাটাই। পরের তিনরাত মেচুকা কাটিয়ে ১১ জানুয়ারি রাতে বাড়ি ফিরি। পরদিন থেকে ছিল
পৌষ সংক্রান্তি-বিহুর বন্ধ। গাড়ি স্বরূপে ফিরল ১৬-তে। ১৭-তে স্নান করে "শুদ্ধ'
হল। পরদিন মেয়ে ঘর ফাঁকা করে প্রবাসে উড়ান দিল। গল্পের নটে গাছটি এখানেই মুড়োলো…