আমার চেতনার রঙে রাঙানো এই খেলা ঘরে:

~0~0~! আপনাকে স্বাগতম !~0~0~

*******************************************************************************************************

Friday, 13 June 2025

জানালার কাছের সেই গাছটা ৸ মূল অসমিয়াঃ নিরুপমা বরগোহাঞি

 

মূল অসমিয়াঃ নিরুপমা বরগোহাঞি

বাংলা অনুবাদ: সুশান্ত কর

(অনুবাদটি শিলঙের বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদেরর মুখপত্র 'কর্মশালা'-তে প্রকাশিত হয়। এখানে দেখা পড়া যাবে। 


ঘরটা ঠিকঠাক করতে ঢুকে খানিকক্ষণ বিভা তার মাঝখানটায় দাঁড়িয়ে রইল তারপর প্রায় কিছুই না করে বিছানাটায় লম্বা হয়ে শুয়ে চোখ দুটো বুজে দিল

তার "কুমারী জীবনে'- ঘরধনি ঘরের একমাত্র মেয়ে বিভা বিয়ের পরে অন্যের ঘরে চলে যাবার পরেও ঘরটা তারই হয়ে থেকে গেল কারও হাতে হস্তান্তরিত হল না অবশ্য কখনও বা বাড়িতে অতিথি অভ্যাগত বেশি হলে, অতিথির জন্যে রাখা স্বতন্ত্র ঘরটায় জায়গা না হলে তার এই ঘরটা খুলে দেওয়া হয়, তারপরে আবার তালাবন্ধ করে রাখা হয় বিভা যখন বাপের বাড়ি ক'দিন থাকতে আসে তখন আবার সেই বন্ধ ঘরটা খোলা হয় কিন্তু যখন সে একা না এসে প্রদীপের সঙ্গে আসে , তখন তারা দু-জনে থাকে অতিথির সেই স্বতন্ত্র ঘরটায় কারণ বিভার এই ঘরটা যথেষ্ট ছোটো বিভার মায়েরা বোঝেন যে এখানে প্রদীপের কষ্ট হবে কিন্তু অতিথির ঘরটা যথেষ্ট বড়ো, প্রদীপের সেখানে কষ্ট হয় না

বিয়ের পর বিভা দুবার একা বাপের বাড়ি এসেছিল, প্রদীপের সঙ্গ ছাড়াতখন তার আগের ঘরটায় একা ছিল আগের মতোই কিন্তু অবাক করা কথা এই যে একই ঘরে একই বিছানায় কুমারী জীবনের মতো রাত কাটালেও বিভার এমন লাগছিল যেন সে এক অতিথি মেয়ের মতো শুয়ে আছেঅবশ্য এটা ঠিক যে প্রদীপের সঙ্গে অতিথির ঘরে থাকার বেলা তার অনুভূতিটার তীব্রতা একটু বেশি হয় তার উপর প্রদীপ সঙ্গে থাকলে মায়ের সঙ্গে,দাদা বৌদির সঙ্গে,ভাইপোদের সঙ্গে বিভার যোগটা বড়ো কম হতে পায় প্রদীপের পরিচর্যা করা, ওর সঙ্গে এখানে ওখানে যাওয়া এসবেই বেশি সময় যায় বিভার তখন এমন মনে হয় যেন স্বামীর ঘরটাকে সে বাপের বাড়িতেও টেনে এনেছে  বিভার ভাল্লাগে না যে কদিন  সে বাপের বাড়ি থাকে, তার মন যায় সে কদিন পুরোপুরি বাড়ির মেয়ে হয়ে থাকবার সে যে এখন অন্য এক বাড়ির বৌ, আর একটা মানুষের স্ত্রীবিয়ের পর থেকে মৃত্যু পর্যন্ত পালন করবার এই ভূমিকাটা সে এই 'দিন ভুলে থাকতে চায় তার অবশ্য কোনো গূঢ় বেদনাদায়ক কারণ নেইকেবল আলাদা আলাদা সময় আলাদা আলাদা ধরণে কাটাতে চাওয়ার এক ছোট্টখাট্টো বাসনা

প্রদীপ যখন আসে না, বিভা যখন একা একা আসে,আর এসে যখন তার এই ছোট্ট ঘরটা পুরনো দিনের মতো অধিকার করে নেয় -- তখন বিভা আবার একবার কুমারী জীবনের হারিয়ে যাওয়া দিনগুলোতে ফিরে যাবার চেষ্টা করে; সেগুলো অতীতের বুক থেকে টেনে নিয়ে আসবার চেষ্টা করে কিন্তু হায়! নদীর স্রোত কি আর কেউ উলটো বইয়ে দিতে পারে? ফেলে আসা জীবন যেন কেউ আবার ঘুরিয়ে দিতে পারে? এইচ জি ওয়েলসের "টাইম মেশিন' বইটি বিভার চেতনা থেকে কোনো দিন মুছে যেতে পারে না কল্পবিজ্ঞানের উপন্যাস,অথচ মানুষের হৃদয়কে ঠাঁই দিয়েছে সবার উপরে বইটির কথা সে ভুলতেই পারেনি আজও তার এই ঘরটায় যখন একা নিঃসঙ্গ থাকে, কুমারী-বেলার দিনগুলো আবার যাপন করবার চেষ্টা করে,তখন নিজের মনে মনে আওড়ায়,       ""টাইম মেশিনের মতো যান একটা পেলে আমি শুধু তার অতীত মুখী চাবিটাই টিপতাম,আমি শুধু আমার স্বপ্নের মতো হারিয়ে যাওয়া অত্যন্ত মধুর অতীতের রাজ্যটিতে বিচরণ করতাম,আমি কখনও ভবিষ্যতের যন্ত্রমানবের বিভীষিকাতে পাড়ি দিতাম না'' অতীত জীবনের দিনগুলো ঘুরিয়ে না পেলেও বিভা তার মেয়েবেলার ঘরটার চার দেয়ালের মধ্যে সেই দিনগুলো আবার যাপন করবার চেষ্টা করেতার সমস্ত জিনিস পত্রও যেখানে যেমনি ছিল,তেমনি আছে বাথরুমে যাবার দরজার কাছে ড্রেসিং আয়নাটা,তার গায়ে গায়ে ওয়ারড্রবটা,দেয়াল ছুঁইয়ে রাখা ডিভানটা,দেয়ালে হেলান দিয়ে রাখা তার কুশন চারটা,ডিভানে শুইয়ে রাখা তার সেতারটা (সেতারটা অবশ্য তার নিয়ে যাবার ইচ্ছে ছিলকিন্তু কোনো ধরণের সঙ্গীতের প্রতি প্রদীপের অনুরাগ না থাকাতে সে সেটাও সঙ্গে নেয় নি), বইগুলো সহ ছোট্ট আলমিরাটা,পড়ার টেবল আর ছোটো পালঙ্কটাঘরের আকারের চাইতে আসবাবপত্র যথেষ্টই কিন্তু বুদ্ধি করে হিসেব করে সাজিয়ে রাখার জন্য সবই খাপ খেয়ে গেছেএর ফলে অবশ্য ঘরটিতে নড়াচড়া করবার জন্যে জায়গা অবশিষ্ট থাকে নি, কিন্তু বিভার এমনটা থেকেই ভালো লাগছিল বাবা বড়ো একটা ঘর নেবার কথা বললে, সে অসম্মতি জানিয়ে বলেছিল, ""বড়ো ঘরে জিনিসপত্রগুলো দূরে দূরে থাকলে সেগুলোর প্রতি আপনার ভাবটা আসবে না বাবা এখানে এরকম গায়ে গায়ে ঠেসে থাকলে এদের আমি বেশি করে পাব ''

বাবা সেদিন মেয়ের কথায় হেসেছিলেন আর বলেছিলেন, ""পাগলি কোথাকার!'' কিন্তু মেয়ে তাকে গাছটির কথা বলে নি তখন বললে মনে হয় তাঁর মতো সহজ-সরল-স্বাভাবিক আর সুস্থ মনের মানুষটি মেয়ের মগজের সুস্থতা নিয়ে সত্যিই শঙ্কিত হয়ে পড়তেন

বিভা বাবাকে বলেনি যে গাছটির জন্যে সে এই ঘরটি ছেড়ে যাবার কথা কল্পনাও করতে পারে না পুব দিকের জানালার দিকেই গাছটা বিভাদের জমিতে নয়, শইকীয়াদের প্রকাণ্ড বাড়িটার পেছনের জমিতে গাছটি দাঁড়িয়ে আছে গাছটি কেটে সে বাড়ির লোকগুলো মাটির টুকরোটি কেন কাজে লাগায়নি, কেন আজকের গাছপালা ধ্বংস করে অভ্যস্ত মানুষ সেভাবে কোনো কাজে না লাগা গাছটা ফেলে রেখেছেতার সম্ভাব্য কারণগুলো ভেবে বিভা নিজের মনে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিল যে আগে সেই জায়গাটিতে দুটি পুরনো রীতির পায়খানা ছিল বলেই মনে হয় এঁরা ঘেন্নাতে শাক-সবজির খেত করবার কথা ভাবেন নিএমন কি তাতে একটা কলার চারাও রোপণ করেন নি ভালোই হয়েছে বিভার জন্যে তা শাপে বর হয়েছে গাছটা কেটে ফেললে সে কী করে সহ্য করত! এই গাছটার জন্যেই রবার্ট ফ্রস্টের কবিতাটা বিভার মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল:

                        Tree at my window, window tree,

My sash is lowered when night comes on;

But let there never be curtain drawn

Between you and me.

            বিয়ে হয়ে যাবার পর গাছটাকে ফেলে যেতে বিভার অবস্থা শকুন্তলার মতোই হয়েছিল কিন্তু সে বেদনার কথা কাউকে বলতেও পারে নি সংসারের প্রতিটি লোকই এত সহজ, প্রতিটি মানুষেরই মন এক একটা সরলরেখার মতো এত সোজা যে তারা তার ব্যতিক্রম দেখলেই অস্বাভাবিকতা বলে ধরে নেয় মানুষগুলোর এই মানসিকতা বিভা ঠিকই বুঝতে পারে তাই গাছটার সঙ্গে তার সম্পর্কের কথা সে কাউকে বলেনি

            বিভা জানত যে তার একদিন বিয়ে হবে আর তখন এই ঘর ছেড়ে তাকে চলে যেতে হবে যেহেতু সে প্রেমে পড়ে নি, সে জন্য এই ভাবটা তার মনে বহু বেদনার সঞ্চার করেছিলএকটা যুবতী মেয়ে বিয়েটাকে ভয়ের চোখে দেখে--- তাও সংসারের স্বাভাবিক সহজ নিয়মের ব্যতিক্রম কিন্তু সে নিজেকে এমন এক ব্যতিক্রম বলে জানিয়ে বাবার মনে দুঃখ দিতে চায় নি তাছাড়া সত্যি সত্যি সে এক ব্যতিক্রম নয় কোনোদিন বিয়ে না করে চিরদিন কুমারী হয়ে থাকবেএমন কথাও বিভা ভাবেনি কিন্তু চেখভের একটি জীবনীতে একবার একটা কথা পড়ে তার এমন লাগছিল যেন জীবনীকার তার কথাই লিখছেন, সেই যেন চেখভ! কিন্তু হায়! কোথায় চেখভ আর কোথায় সে! কোথায় স্বর্গের তারা আর কোথায় এই পৃথিবীর এক সামান্য ধূলিকণা তথাপি চেখভের বিষয়ে লেখা এই কথা 'টিতে সে নিজেকে খোঁজে পেয়েছিল:

            "" He read much and thought much. He was gay and friendly companion, but a profoundly independent individual,jealously protecting independence from the interference of others. Liberty! In the word may be summed up all aspirations of youthful Chekhov.”

         


   বিভা যে ধনি ঘরের মেয়ে হল,ছোটো বড়ো আর কোনো বোন ছাড়া একমাত্র মেয়ে হল -- তাও মনে হয় তার স্বাধীন আর নিঃসঙ্গ মন একটা গড়ে ওঠাতে ইন্ধন যোগাল সে সম্পূর্ণ নিজের একটা ঘর পেল, ইচ্ছেমতো বইপত্র কেনার টাকা পেলআর সবচে' বেশি পেল ধনি ঘরের একমাত্র কন্যার প্রতি প্রশ্রয় ভরা অতি বেশি আদর সুতরাং সে নিজের মনমতো একটা জগৎ গড়ে তুলল আর তার চারদিকে একটা নিজস্ব মনের প্রাচীর তুলে নিয়ে  নিজের নিঃসঙ্গতা আর স্বাধীনতা সুরক্ষিত করে তার মধ্যে যেন আত্মগোপন করে রইল বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে তার অতি অল্প সম্পর্কই রইল

            অতীতের সেই নিঃসঙ্গ স্বাধীন জীবন কত মধুময় ছিলবই আছে, সঙ্গীত আছে, কবিতা আছে, মা-বাবার হৃদয় উজাড় করা মমতা আছে জীবন তাকে অকৃপণ ভাবে কত না দিয়েছে!

            তার উপর সেই গাছটা তো আছেই সাধারণ গাছ একটাতেও সে কি বিচিত্র জগৎ একটা লুকিয়ে আছেতাকে আবিষ্কার করতে যে জানে সে জানে নতুন পাতা বেরোবার সময় থেকে ধরা যাকলাঠির মতো শুকনো ডালগুলো ভেদ করে যখন কোমল পাতার সবুজ খুদে পাতাগুলো থরে বিথরে ডালের এখানে ওখানে ফুটে বেরোয়দেখে বিভার চিরদিনই বিস্ময় জাগে, এতদিন ,

""কোথা সংগোপনে ছিলি আত্মবিস্মৃতির কোণে?''  এত বিবর্ণ শুকনো ডালগুলোতে এর সতেজ আর স্নিগ্ধ সবুজের সমারোহ হল কী করে? কিন্তু বিস্ময়ের উপরেও বিস্ময়, মুগ্ধতার পরেও মুগ্ধতাএর পর যে থুপে থুপে রাঙা ফুলগুলো তাদের নয়ন জোড়ানো সজ্জা নিয়ে ফুটে বেরোলতারাই বা কোথায় লুকিয়েছিল? দেখতে না দেখতে বিভার হৃদয় আপ্লুত করে সব কটা ডাল নিয়ে পুরো গাছটাই রাঙা হয়ে পড়ল তারপর আরম্ভ হল আরও এক কারবার কোত্থেকে এসে ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি দিনে রাতে গাছটাতে কিচিরমিচির শুরু করল সে পাখিগুলোর দিকে মুগ্ধ বিস্ময়ে তাকিয়ে বিভা ভাবেএই সুন্দর সুন্দর পাখিগুলো এতদিন কোন অচেনা অরণ্যে লুকিয়ে ছিল? একমাত্র টিয়া পাখির বাইরে অন্য পাখিগুলো বিভার অচেনা কিন্তু সে অচেনা পাখিগুলোর অনেকে টিয়ার থেকেও সুন্দর, কী বিচিত্র তাদের পালকের কারুকার্য, কী অপরূপ রঙের বাহার! কখনও বা দু'একটা লাল পালকের পাখি এমন করে ফুলের মধ্যে মিশে থাকে যে তাদের ফুল বলেই ভ্রম হয় তাকিয়ে তাকিয়ে বিভার ক্লান্তি আসে না, সেই পাতা , সেই ফুল, সেই পাখিকে উদ্দেশ্য করে সে আনমনে বলে, ""তোমাদের জন্যেই আমি নাগরিক কংক্রিটের অরণ্যে থেকেও বসন্ত আসার আভাস পাই''

            একদিন সেই ফুলগুলো মিলিয়ে যায় কিন্তু ইতিমধ্যে গাছটাতে আবার সবুজের সমারোহ শুরু হয়ে যায়তাই ঝরা ফুলের জন্য মনখারাপের অবকাশ বিভার থাকেই না এক সময় ঘন সবুজ পাতায় গোটা গাছটাই সতেজ হয়ে পড়েঅবশ্য এখন আর পাখিগুলো আসে না,এখন আর আগের মতো এদের কিচির মিচির কূজন শোনা যায় না কিন্তু গ্রীষ্মের প্রখর রোদে, চারদিকের কংক্রিটের বাড়িগুলোর মধ্যে সেই সবুজের প্রাচুর্য সমস্ত ক্ষতিপূরণ করে দিতে পারে গাছটার এই সবুজ রূপটা অনেকদিনের  জানালার কাছের গাছটাএই সবুজ পাতায় ভরা গাছটাই

            এরই মধ্যে বিভা আগে না পড়া এন্ডারসনের একটি রূপকথা পড়ে নিল বিভার এখন এমন রূপকথা পড়বার বয়স নেই কিন্তু এণ্ডারসনের গল্প তার খুব প্রিয়লিটল মারমেড, দ্য এলফ অব দ্য রোজ, দ্য ডেইজিইত্যাদি গল্পগুলো পড়লে এখনও তার শরীর রোমাঞ্চিত হয় এণ্ডারসন পেলে সে না পড়ে পারে না আর এখনও হঠাৎ হাতের কাছে পাওয়া "ফেয়ারি টেলস'টা পেয়ে বিভা সঙ্গে সঙ্গে পড়ে ফেলল আর বইটার "দ্য ফার ট্রি' গল্পটি পড়ে সে অল্প স্তম্ভিত হল খানিক পরে দীর্ঘ এক শ্বাস টেনে আনমনে বলল, ""ভাগ্যিস, আমার জানালার কাছের গাছটা ফার বা তেমন কাজের গাছ নয়ঈশ্বরকে ধন্যবাদ যে, ভাগ্যিস আমার কাছের গাছটা কোনো কাজেই লাগে নাসামান্য এক মাদার গাছ! নইলে যে অদূরদর্শী মানুষগুলো গাছপালা নির্বিচারে ধ্বংস করে অভ্যস্ত তারা এণ্ডারসনের ফার গাছটার মতো আমার এই মাদার গাছটিকেও কেটে ফেলত!...''

বিভার বিয়ে হল প্রদীপ দত্তের সঙ্গে প্রদীপ দত্ত একজন বড়ো সরকারি আমলা আদর্শ বর হবার যেসব যোগ্যতা জরুরি তার সবই তার ছিল তাই বিভার মা-বাবা আর দাদা তেমন এক সুযোগ্য ছেলের হাতে বিভাকে তুলে দিয়ে সুখী হয়েছিলেন বিভার যদিও মনে হচ্ছিল যে এই করে মা-বাবারা ওকে এক বধ্যভূমির দিকে এগিয়ে দিয়েছেন---তবু সে এই বিয়েতে কোনো আপত্তি করেনি বিয়ে তো করতেই হবে তার বাইরে আগামীর সুদীর্ঘ জীবন কাটাবার বিকল্প বিভার কি আর আছে কিছু? নেই, কিছুই নেই সুতরাং বিয়েতে আপত্তি করে একমাত্র মেয়ে হয়ে মা-বাবার মনে দুঃখ দেবার কী দরকার? অনর্থক সে কাউকে কষ্ট দিতে চায় না অবশ্য জীবনে যদি বিভা এমন এক মানুষের সঙ্গ পেত যে তার চোখেই গাছটাকেও দেখত, আর কেবল রবার্ট ফ্রস্টের কবিতাই নয়,   --

""You stand apart from the crowd

One, among so many women you pass by

And raise a tempest in my heart''

            এমন কবিতাও তাকে শোনাতে পারত, তবে এমন এক মানুষের জন্য সে আকাশ পাতাল তোলপাড় তোলপাড় লাগিয়ে দিতে পারত এমন এক পরম যোগ্য লোককে যদি বাবারা কোনো বৈষয়িক কারণে অযোগ্য বলে আপত্তি করতেন তবে বিভা বিরাট বিদ্রোহ করত যে মানুষকে বিয়ে করে সে তার সযত্ন লালিত স্বাধীনতাকেও হেলায় বলিদান করতে পারে,তেমন মানুষের জন্য বাড়ি কেন, বিভা ঈশ্বরের বিরুদ্ধেও দাঁড়াতে পারত

            কিন্তু তেমন একজন মানুষ তার জীবনে যখন শুধু মানস মূর্তিই হয়ে রইল,তেমন অবস্থায় প্রদীপ দত্তের বাইরে আর কোনো যোগ্যতর স্বামীকে বরমাল্য অর্পণ করতে পারে? সুতরাং প্রদীপ দত্তের সঙ্গে বিভার বিয়ে হয়ে গেলবাবা বিভার সঙ্গে করে জিনিসপত্রও প্রচুর দিলেন সেই সব নিষ্প্রাণ সুন্দর আর চকমকে জিনিসপত্র বিভার নতুন বাড়ির শোভা বাড়াল তার নিঃসঙ্গ ঘরটাতে আগের সব জিনিস পড়ে রইলতার কিছুই বিভা সঙ্গে নিল না তার এমন লাগছিল যেন বিয়ের উজ্জ্বল ফার্নিচার,দামী নতুন কাপড়, ঘর সাজানোর বিচিত্র সব জিনিসের মাঝখানে করুণ আর মলিন হয়ে পড়বার খুব সম্ভাবনা থাকা পুরনো জিনিসগুলোর কিন্তু হৃদয় আছে বাইরে রঙিন এই নতুন জিনিসগুলোর মতো নিষ্প্রাণ আর হৃদয়হীন নয় এখন সে-হারা ঘরটাতে সেইসবগুলোই তার বিরহে নীরবে চোখের জল ফেলবে

            কিন্তু সে সেইসব জিনিসগুলোর একটিকেও তার সঙ্গে নিতে পারে না যদি নিয়ে যায়,তবে যখন মাঝে মধ্যে বাপের বাড়ি আসবে,তখন সে শূন্য ঘরটা চারদিক থেকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে তার বুকে হাহাকার জাগিয়ে তুলবেসেই জিনিসগুলোযা তার অতীতটাকে সম্পূর্ণ হারিয়ে যেতে না দিয়ে কিছু হলেও ধরে রাখতে পারে সে জিনিসগুলো স্থানচ্যুত হওয়া মানেই তার অতীতের দৈহিক সত্তাও বহু পরিমাণে লুপ্ত হওয়া

            কত মমতার অতীত,আর অতীত মানেই তার ঘরটা;তার ঘরটার জিনিসপত্রগুলো আর জানালার কাছের গাছটা; অতীত মানেই নিঃসঙ্গতা; অতীত মানেই স্বাধীনতা আর সে নিজে গড়ে নেওয়া সাম্রাজ্যটাকে আপন ইচ্ছার পরিচালনায় অবাধ আর মুক্ত করে রাখা; আনন্দময় বিচরণ যখন সে নবম শ্রেণির ছাত্র ছিল তখন মহাকবি গ্যাঁটের একটি বাণী কাগজ একটাতে লিখে নিয়েছিল লিখে ফটো স্ট্যান্ড একটিতে লাগিয়ে পড়ার টেবলে রেখে দিয়েছিল গ্যাঁটে সেই বাণীটিতে বলেছিলেন, জীবনটাকে সরস করে রাখতে হলে মানুষের উচিত প্রতিদিন একটি ভালো কবিতা পড়া অতীতে নবম শ্রেণির ছাত্র কিশোরী বিভা সেই উপদেশ আক্ষরিক অর্থে পালন করেছিল

            সেই অতীত! সময়গুলো কী করে যে উড়ে উড়ে চলে যাচ্ছিল বিভা টেরই পাচ্ছিল না স্কুল আছেকলেজ আছেআছে কলেজের পড়াশোনা পড়াশোনায় সে কোনোদিনই তেমন ভালো ছিল না কোনোক্রমে পাশটা করে যেতে পারলে হয়লেখাপড়ার বেলা তার উচ্চাকাঙ্ক্ষা বলতে ছিল এতটুকুই তাই অল্প সময় স্কুল কলেজের পাঠ্যপুস্তক পড়াশোনা করেই সে বিচরণ করছিল "অপাঠ্য' বইয়ের মায়া মুগ্ধকর জগতে কিন্তু বিভা পড়েই ক্ষান্ত ছিল  নিজে কোনো ধরণের কিছু লেখার চেষ্টা করে নি অবশ্য ডায়েরিকে যদি লেখা বলে দাবি করা যায়, তবে বিভা ডায়েরি লিখেছিল বটে আর সেই দিনপঞ্জির পাতাগুলো ভরে গিয়েছিল কোনো বাহ্যিক ঘটনার বিবরণে নয়, ভরেছিল নানা বিষয় নিয়ে তার মনে মাঝে খেলা করা নানান ভাবনাগুলোতে


            তার উপরেও বিভার অতীত পূর্ণ হয়েছিল কবিতা আর সেতারের ঝঙ্কারে সেতারটা তার আঙুলের ছোঁয়ায় প্রাণ পেয়ে উঠেছিল অসমিয়া, ইংরাজি, বাংলা কবিতার বইতে তার টেবল ভরে গিয়েছিল মন ভরে গিয়েছিল তার উপর গাছটা তো ছিলইসেও এক জীবন্ত কবিতা,"" I have never seen a poem lovly as a tree.''একজন কবি ঠিকই লিখেছিলেন

            কিন্তু সবই এখন অতীত আর এগুলো অতীত হয়ে যাওয়াতে বিভা কোনো আপত্তিও করল না বা সেগুলোকে চিরবর্তমান করে রাখার কোনো অপচেষ্টা করল না একটা ব্যাপারে বিভা নিজেকে খুব চিনতে পেরেছিল বলে ভেবেছিলমেয়েটি সে অলীক স্বপ্ন বিলাসী বেহিসেবি মনের নয় সুদীর্ঘ ভবিষ্যৎ একটা পূর্ণ জন্যে তার এই অতীতের সামগ্রীগুলোই যথেষ্ট নয়সুতরাং প্রদীপ দত্তকে বিয়ে করে অতীতকে সে অতীত হয়ে যেতে দিলে, আর পরম আগ্রহে লালন করা স্বাধীনতাকে বিসর্জন দিতেও তৈরি হল

            প্রদীপ দত্তের সঙ্গে সে অসুখী হয়েছিল বলেও বলতে পারে না যুবতী মেয়ে একটার কাছে বিবাহিত জীবনের মাধুর্য বড়ো অল্প নয় তদুপরি প্রদীপ ছেলেটি হল উদার আর মমতাময় সে উপহার দেওয়া কাপড় গয়নাগুলো তাকে তেমন উচ্ছ্বসিত করতে না পারলেও তার মায়াভরা অন্তরটা বিভাকে বিগলিত করে রেখেছিল আর মনে এক ধরণের একটা আত্মতৃপ্তি লাভ করেছিল যে সেও প্রদীপকে সুখী করতে পারছে কিন্তু এই আত্মতৃপ্তি যে সত্য নয় প্রদীপের দুই একটা উষ্মার থেকেই বিভা ধীরে ধীরে বুঝতে শুরু করে রাজা থিডাস বুঝি যাই স্পর্শ করেছিলেন তাই  সোনা হয়ে যেতে শুরু করেছিল অথচ সেই দুর্লভ সোনার সমুদ্রই মানুষটার জীবনে চরম ট্র্যাজেডি নামিয়ে এনেছিলআসলে সংসারে সচরাচর নিয়মের ব্যতিক্রম হলেই বোধহয় জীবনে ট্র্যাজেডি নেমে আসেই তারও হল তা-সে যদি আর দশটা মেয়ের মতো সহজ সাধারণ হত, তবে সে প্রদীপকে সুখী করতে পারত; তার জীবনে এই ট্র্যাজেডি নেমে আসত না

            প্রদীপ হঠাতই রাগ দেখিয়েছিল এরকম"" ! এই সস্তা হিন্দি সিনেমাটা দেখার তোমার মন নেই! থাকবে না- তো! তুমি হলে পণ্ডিতনী মানুষএই সিনেমা টিনেমাগুলো কি তোমার ভালো লাগবে?...'' , "" হাজার বই পড়ে দেখাও না কেন, মেয়েদের যে বুদ্ধি খাটো সে খাটোই আমার সঙ্গে ঘের দেখাতে এস না, বুঝলে?...'', ""আদর করে শাড়িটা এনে না দিয়ে তোমাকে বুঝি বা 'টা কুইনাইনের বড়ি এনে দিয়েছি আর কি! মুখটা দেখে তো এমনটাই লাগল উজাড় করে বই কতকগুলো এনে দিলে মুখে হাসি বেরুত নিশ্চয় সংসার চালাতে হলে মেয়েদের বই পড়বার দরকার পড়ে না, বুঝলে! আমাদের মা পাঠশালার ঘাটও পার হননি, কিন্তু বাবাকে তিনি যদ্দুর সুখী করেছিলেন তোমাদের মতো প্রগতিশীলেরা তা কল্পনাও করতে পারবে না'', "" তোমার মতো বই-পত্র না পড়তে পারি বা সেরকম আজেবাজে বই পড়বার সময় আমাদের না হতে পারে, কিন্তু সরকার আমার বুদ্ধি আর দক্ষতার স্বীকৃতি হিসেবেই এই নতুন কাজটায় ট্র্যান্সফার করেছে এমন দায়িত্বপূর্ণ আর কঠিন কাজ যে যাকে তাকে ভার দিতে পারি না'', "" 'টা বই পড়েছ বলে নিজেকে খুব কেউ-কেটা ভেবে দেমাক দেখাতে থেকো না মিসেস শইকীয়াও তোমার মতো বিএ পাস; তার সঙ্গে মেলামেশার কথা বললেই তোমার গা জ্বলে কিন্তু উনি যে আমার উপরওয়ালার স্ত্রী তা তুমি ভুলে যাও, আমার চাকরি জীবনেও কখনও তুমি বিপদে ফেলবে আসলে আজেবাজে বইগুলোই তোমার মাথা খেয়েছে বইর কথা জীবনে ফলাতে গেলেই  মানুষের বিপদ হয় বইয়ের বড়ো বড়ো কথাগুলো আজকের দারুণ প্রতিযোগিতামূলক জীবন যাত্রায় সাহায্য করা তো দূরেই থাক, বরং জীবন যুদ্ধে পরাস্তই করে''


            অসহায় বেদনায় বিমূঢ় হয়ে থাকে বিভা তার বই পড়ার ব্যাপারটা নিয়ে প্রদীপ এত স্পর্শকাতর কেন?  সে তো প্রদীপকে কোনোদিন একটা বই এনে দিতে বলে নি, বই সম্পর্কে কোনো একটা কথাও বলে নি, সংসারের তুচ্ছতম কোনো কাজের ক্ষতি করেও বই পড়েনিতবুও প্রদীপের এই জ্বালা কেন?

            বিয়ের দু-বছর পর কোনো এক সরকারি প্রজেক্ট নিয়ে জার্মানি গেল; তার এক বছর পরে খবর এল যে প্রদীপ আর ঘুরে আসবে না সেখানেই সে জীবনের দ্বিতীয় চাকরি আর দ্বিতীয় স্ত্রী নিয়ে স্থায়ীভাবে বাস করতে শুরু করেছেসংসারের সবাই প্রদীপকে দোষল,দোষল না শুধু বিভাবেচারা প্রদীপ! প্রদীপের আসল জ্বালা শেষে বিভা বুঝতে পেরেছিল মেয়েদের উপর পুরুষের পারস্পরিক আধিপত্যের মানসিকতায় পুষ্ট পুরুষ একজন হয়ে প্রদীপ স্ত্রীর সামনে কেবল হীনমন্যতায় ভুগল বিভাকে বিয়ে করে সে কোনোদিন সুখ পেল নাতার আর বিভার মাঝখানের বইয়ের দুর্ভেদ্য প্রাচীরটার জন্য অগ্নিসাক্ষী করে বিয়ে করা স্ত্রীটিকে সে কোনোদিনই নিজের অধিকারভুক্ত করে পেল না

            কিন্তু দোষ না দেওয়া এক, আর দুঃখ না পাওয়া আরেক ব্যাপার অতএব প্রদীপকে দোষ দিতে না পারলেও, দুঃখ না পেয়ে থাকাটা বিভার হল না কোনোদিন না দেখা সাত সমুদ্র তেরো নদীর পারের এক শ্বেতাঙ্গিনীর প্রতি ঈর্ষায় তার হৃদয় রক্তাক্ত হতে থাকল  বিভা আশ্চর্য হয়ে ভাবলআমরা আসলে নিজেকেই কত কম জানি আমারও যে হৃদয়ে এত ঈর্ষার বিষ লুকিয়ে ছিল কোনোদিন কি কল্পনা করতে পেরেছি!

প্রদীপ জার্মানি যাবার পরের বছরটা বিভা শ্বশুর শাশুড়ির সঙ্গে ছিল কিন্তু প্রদীপের বিয়ের খবরটা পাবার পরে সে মা-বাবার কাছে ফিরে এল আর কোনো ছেলে-মেয়েও হয় নি যে সেই সন্তানের মধ্য দিয়ে শ্বশুর বাড়ির সঙ্গে সেতু বন্ধন হবে

অতীতের সেই ছোট্ট ঘরটা তার হয়েই ছিল এখন সে সেটি ঠিকঠাক করে নিতে কিছু না করে বিছানায় গা এলিয়ে দিল

দরজায় কেউ টোকা দিল

"" কে? ভেতরে এস''

হাতে এক কাপ চা হরলিক্স নিয়ে বিভার বৌদি ভেতরে এলেন

"" আরে ! তুমি দেখছি কিছুই কর নি বিছানায় শুয়ে আছ দেখছি আমি ভাবলাম কাজ করে করে তুমি ক্লান্ত হতে পার এক কাপ হরলিক্স নিয়ে যাই ঘরটা যা অন্ধকার লাগছেনা? , তুমি জানালার পর্দাগুলোও তুলে দাও নি দেখি,উঠো তো! হরলিক্সটা খাও! আমি পর্দাগুলো তুলে দিচ্ছি''

অনিচ্ছাসত্ত্বেও বিভা উঠে বসল বৌদি জানালার পর্দাগুলো তুলে দিল আর ঘরটায় ঢোকার পরে প্রথমবারের মতো পুব দিকের জানালার গাছটা দেখবে বলে তাকাতেই বিভা আঁতকে উঠল

""বৌদি, গাছটা কই গেল!''

"" কোন গাছ? তুমি এভাবে চীৎকার করে উঠলে কেন?''

"" গাছটা; জানালা দিয়ে দেখা যেত যে গাছটা, এখানে ছিল না একটা?''

""ওহ! সেই মাদার গাছটার কথা বলছ?'' বিভার বৌদি সহজ স্বরে বললেন, "" শইকীয়ারা তো সেই কবেই গাছটা কেটে ফেলল মাদার গাছ কোনো কাজের হয় না,না? এখন তারা এখানে একটা ঘর তুলে বড়ো ঘরটার পাশ দিয়ে পথ বের করে ভাড়া দেবে বলছেআমিও তোমার দাদাকে বলেছি যে আমাদের পেছন দিকের মাটিটা এমনি পড়ে আছে শইকীয়াদের মতো আমাদেরও ঘর একটা তুলে ভাড়া দেওয়া উচিত আজকের দিনে লোকে এমনি এমনি মাটি ফেলে রাখে না বিশেষ করে গুয়াহাটি শহরে ঘরের ভাড়া যেভাবে বাড়ছে, একটা ভাড়া ঘর থাকলে আর কিছু না করলেও হয়, বসে বসে খেতে পার বা ধর, দরকারি এটা ওটা জিনিস করালে সে পয়সায়''

বিভা মুখে কিছু বলল না নীরবে হরলিক্সের কাপটা মুখে তুলে নিল তার মানে পড়ল এণ্ডারসনের সেই "ফার ট্রি ' নামের গল্পটার শেষ বাক্যটি:

"" But that was the past, and the tree also, past! past! for all stories must come to an end sometime or other.''

--- ---- ---

মূলে অনুবাদ করা হয়েছিল -১০/ ১১/ ২০০৩

সংশোধন করা হল-------- ১৯-২০/ ০৩/২০২৫