আমার চেতনার রঙে রাঙানো এই খেলা ঘরে:

~0~0~! আপনাকে স্বাগতম !~0~0~

*******************************************************************************************************

Friday, 22 August 2025

হিন্দুস্তানি-বাংলাদেশি বিবাদে দীর্ণ বাঙালির উগ্রজাতীয়তাবাদী ঝোঁক এবং হিন্দুত্ববাদের ফাঁকা মাঠ

 


আমরা যারা বরাক উপত্যকাতে বড়ো হয়েছি, আমাদের কাছে 'হিন্দিভাষী' পরিচয়টি অজানা ছিল। আমরা তখনই উত্তরপ্রদেশ বিহারের লোকজনকে অতি সরল মনে "হিন্দুস্তানি' বলে চিনতাম এবং গ্রহণ করেছিলাম। এরা মূলত শ্রমজীবীই ছিলেন। কিন্তু চা বাগান এলাকাতে এরা অনেকটা বর্ণহিন্দু। অর্থাৎ চা শ্রমিক বা শ্রমিক নন অথচ একই জনজাতিদের পাড়ায় গ্রামে এরা খানিকটা সচ্ছল সমৃদ্ধ মাতব্বর টাইপ। শ্রেণি হিসেবেও উপরের, যে চা-জনজাতিরা বাকি অসমে প্রাদেশিক সংখ্যাগুরুবাদের চাপে অসমিয়া,তারাই বরাকে এই হিন্দুস্তানি দাপটে "হিন্দুস্তানি' যাদের মাতৃভাষা হিন্দি (আসলে তো যোগাযোগের ভাষা সাদরি বা সাদানি)।অসমের এই একই চা জনজাতিরা পশ্চিম বাংলাতেও দক্ষিণে "বাঙালি' (বন্দ্যোপাধ্যায় চট্টোপাধ্যায়রা যাদের ভাষাতে কবিতা লিখে "আঞ্চলিক বাংলা' বলে চালান), উত্তর বঙ্গে আবার হিন্দিভাষী, জানিনা ওখানে "হিন্দুস্তানি' শব্দের চলন আছে কি না। গোটা দেশেই চা জনজাতিদের ভাষা সংস্কৃতি নিয়ে টানাটানি আছে, অধিকাংশকেই "হিন্দিভাষী' বলে চালিয়ে দেওয়া হয়! দেশে এই হিন্দিভাষীদেরই কোনো জাতি নাম নেই। তাদের একক প্রদেশ নেই। দেশে এই নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই!

          যারা দাবি করেন,অসমের ভাষা অসমিয়া,তামিলনাড়ুর ভাষা তামিল, পশ্চিম বাংলার ভাষা বাংলা -- তাঁরা এই প্রশ্ন জীবনেও করেন নি যে হিন্দি কোন প্রদেশের কোন জাতির ভাষা? আর বিহার থেকে গুজরাট সব রাজ্যের ভাষাই যদি হিন্দি হয় তবে অসমের ভাষা বাংলা, বাংলার ভাষা অসমিয়া, তামিলনাড়ুর ভাষা সাঁওতালি, পাঞ্জাবের ভাষা তামিল হবে না কেন?হিন্দির জমিদারি মোটের উপর দেশ মেনেই নিয়েছে। এবং স্বাধীনতার আগে থেকে একই ভাষা হিন্দ্বী বা হিন্দুস্তানি ভাষাকে হিন্দু মুসলমানে ভাগ করে সেই যে হিন্দি আর উর্দুর জন্ম দেওয়া হল -- এবং দিল্লি লক্ষ্ণৌ এলাহাবাদ অঞ্চলে জন্মানো শৌরসেনী প্রাকৃত-জাত ভাষাকে পাঞ্জাব সিন্ধু অঞ্চলের তথা পাকিস্তানের ভাষা বলে উর্দুকে দুই পক্ষ থেকেই দাঁড় করানো হল (অনেকটা বাংলার "পানি' শব্দের মতো --যাকে মুসলমানেও মনে করেন মুসলমানি শব্দ, মূর্খ বাঙালি হিন্দু তো বটেই) সেই থেকে এটা তো দাঁড়িয়ে গেল যে হিন্দুস্তান তথা ভারতের ভাষা একটাই --হিন্দি! আমরা নীরবে মৌন সম্মতি ও স্বীকৃতি চিরদিন দিয়ে এসছি। পাকিস্তানেও আছে "হিন্দুস্তানি' ভাষা। পাকিস্তানের ভারত থেকে প্রব্রজিত লোক মাত্রেই মোহাজের বা হিন্দুস্তানি! স্থানীয় হিন্দুরা অবশ্যই। অথচ সেদেশের স্থানীয় হিন্দুরা ততটাই হিন্দুস্তানি, যতটা বাংলাদেশের হিন্দু বাঙালি। তাঁদের মাতৃভাষা পাঞ্জাবি,সিন্ধি, বালোচ, কাশ্মিরী (সে দেশে কাশ্মিরী হিন্দু কল্পনা করতে পারেন না?) ইত্যাদি। এবং বাকি বিশ্বেও এই হিন্দিভাষীরা নিজেদের ভাষাকে হিন্দুস্তানি বলেই প্রচার করে! বহু বলিউড সিনেমাও তাইই করে।

     এই যে আমরা দাবি করি বাংলার ভাষা বাংলা, মহারাষ্ট্রের ভাষা মারাঠি, অসমের ভাষা অসমিয়া ---এতে করে আমরা একদিকে হিন্দিকে গোল দেবার জন্য মাঠ ফাঁকা ছেড়ে দিই! এরা বলেন, হিন্দুস্তান কি ভাষা হিন্দি। আর দিকে আমরা বাংলার অসমের তামিলনাড়ুর অন্যান্য বড়ো ভাষা তো বটেই কিছু ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী-যাদের অস্তিত্ব মূলত সেই রাজ্যেই তাদের অস্তিত্ব ও মর্যাদাকেও অস্বীকার করি! যে কোনো কোচ বা রাজবংশীকে জিজ্ঞেস করুন --অসমে এবং বাংলাতে তাঁরা ভাষা ও পরিচিতি নিয়ে খুব চাপে থাকেন। কিছু রাজবংশী ফেসবুক পেজ ঘুরে আসুন, তারাও যখন দুই রাজ্যেই 'বাংলাদেশি' অপবাদের মুখে পড়ছেন, খুব জোর গলাতে প্রচার দিচ্ছেন, আমরা বাঙালি নই, তাই বাংলাদেশি নই। অসমিয়াও নই। সত্য এই যে বাংলাদেশেও বিপুল সংখ্যাতে রাজবংশী আছেন। এবং বহু বহু লোককে আমরা বাঙালি থেকে আলগা করে দেখা ভুলেই গেছি। যেমন বেগম খালেদা জিয়ার পরিবারটি রাজবংশই! নাস্তিক নিহত ব্লগার অভিজিৎ রায়কে নিয়ে বাঙালির গৌরব করবার কিছু নেই, তিনি রাজবংশী পরিবারের সন্তান। সেরকম পশ্চিম বাংলা ও অসমের অসংখ্য মুসলমান আসলে রাজবংশী সমাজ থেকে ধর্মান্তরিত। বাঙালি হিন্দু সমাজ থেকে নয়।

       এতসবে আমাদের মাথা ব্যথা নেই বলে, বাকি ভারত মনেও রাখে না যে অসম ত্রিপুরার একটি বড়ো ভাষা বহু প্রাচীন যুগ থেকেই বাংলা। না হয় বাঙালি রাজা ছিলেন না, বাঙালি রাজা থাকতেই হবে, এই আরেক কুসংস্কার! অসমেই কি সকল রাজারা অসমিয়া ছিলেন? আহোমরা কি অসমিয়া ভাষা সঙ্গে করে এনেছিলেন? (এমন প্রশ্ন করলে শৃঙ্খল চলিহা আমাকে ধরে পেটাবে), ঘটনা হচ্ছে তাঁরা মন্দিরে মন্দিরে ব্রাহ্মণ বসাতে নবদ্বীপ (বাংলা) থেকে ব্রাহ্মণ এনেছিলেন, সেরকমই সিলেট থেকে ব্রাহ্মণ নিয়েছিলেন ত্রিপুর, ডিমাছা এবং মণিপুরের রাজারা। সেই ব্রাহ্মণেরা ছড়ান আর্য ভাষা। যা পরে কোথাও অসমিয়া, কোথাও বাংলা, কোথাও বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি, কোথাও কোচ-রাজবংশী ভাষা বলে পরিচিতি পায়। এবং এই পুব ভারতে আর্যভাষার বিস্তারের সূচনা করেন কামরূপের বর্মণ রাজবংশ। ভাস্কর বর্মণের উপর কেবল অসমিয়ার অধিকার এই কুসংস্কারও না ছাড়লেই না! পুরো বাংলাদেশটাই তো ছিল কামরূপে! আজ যদি আপনি বাংলাদেশি বলে কাউকে তাড়াতে ব্যস্ত তবে নিশ্চিত থাকুন আপনি নরকাসুরের বংশধর বলে যে মহান সম্রাট ভাস্কর বর্মণ পরিচিতি দিতেন তাঁর সাম্রাজ্যের প্রজাদের উত্তরসুরিদের তাড়াচ্ছেন। গৌড়ের রাজা শশাঙ্ক নিয়ে একাংশ বাঙালি গৌরব করতেই পারেন, কিন্তু তিনি তো এক ক্ষুদ্র ভূখণ্ডের রাজা ছিলেন, গৌড় মানে সমগ্র বাংলা কখনই ছিল না! বঙ্গ অঙ্গ পৌণ্ড্র সমতট হারিকেল এসব গেল কই? হাওয়া হাওয়াই? সব এলাকা মিলিয়ে সুবেহ বাংলা তো গড়ে তুললেন মোঘলেরা! তাদের সময়েই বাংলা ভাষা সাহিত্যের জোয়ার এল। কিছু মূর্খ সাম্প্রদায়িকেরা কি না প্রচার করেন, তারা হিন্দুর বারোটা বাজালো।

যাই হোক, বর্তমানে এবং অতীতের আমাদের সাম্প্রদায়িক এবং জাতীয়তাবাদী সমাজ-পাঠে বহু প্যাঁচ এবং গণ্ডগোল আছে। জনপ্রিয় সমাজ বিদ্যা এসব নিয়ে মাথাই ঘামায় না! অসমিয়ার অসম তবে বডোদের কী, ডিমাছাদের কী? সাঁওতালদের কী? নেপালি ছেলেটা তবে আর গিটার হাতে কলকাতাতে গাইতে কী করে যায়? সুমনের গানে যে স্বপ্ন আছে? আমার বলবার কথা হচ্ছে, যে লোকেরা কলকাতাতে নেপালি ছেলেটার গান আটকে রেখেছেন, তাঁরাই নিষিদ্ধ করে রেখেছেন শিব সাগরে বাংলা! এদের চিন্তন পদ্ধতি এক! এরাই বাঙালুরুতে আপনাকে বাংলা বললে পিটবে বাংলাদেশি বলে, আর হিন্দি বললে অসমিয়া নারী পুরুষও রাম ধোলাই খাবেন।

গোঁড়ায় গলদ ভারত পাকিস্তানের শাসক হিন্দি উর্দু নিয়ে ঘটিয়ে রেখেছেন, বাকি কিছু বড়ো জনগোষ্ঠীদের চকলেট ধরিয়ে ভুলিয়ে রাখার জন্য ভাষা ভিত্তিক হাতে গুণা কিছু প্রদেশ দিয়েছেন, আজকাল 'ধ্রুপদি' ভাষার স্বীকৃতি দিয়ে ধুতির কোঁচা তুলে নাচতে দিয়েছেন, তামিলদের যদিও লুঙি ড্যান্স (লুঙি মুসলমানি পোশাক এও মূর্খদের এক কুসংস্কার, মূর্খরা গুগোল করে বর্মীদের পোশাক দেখে নিন) --কিন্তু চিরদিন তালে ছিলেন যেটুকু আছে সেটুকুও কেড়ে খাবেন।

এরই চরম প্রকাশ মণিপুরের হিংসা! কুকি মণিপুরি নাগাদের বিবাদ। অথচ রাজ্যটি সবার! নিজেরা হিন্দু মুসলমান করে হিন্দি উর্দুতে ভাগ করে এখন বাকি ভাষাগুলোকেও ভাগ করে ভেঙে দখল করে ফেলবার ধান্ধা।

খেয়াল করুন, পাকিস্তানে এবং ভারতে ভাষা আন্দোলনগুলোর বয়স প্রায় একই। ওদেশে উর্দু চাপাতে গিয়ে, এদেশে হিন্দি চাপাতে গিয়ে! হ্যাঁ, অসমের ভাষা আন্দোলনের মূলেও সেই হিন্দি আধিপত্যবাদ। নিজের জমিন অক্ষত রেখে এরা লাগিয়ে দিয়েছিল তামিলদের সঙ্গে যুদ্ধ! ভাষার জন্য তামিল শহিদ বাঙালির থেকে সংখ্যাতে অনেক বেশি, বাংলাদেশ থেকে কম কিছু গভীর ছিল না সেই লড়াই। আর অসমে চকলেট ধরাতে গিয়ে রাজ্য পুনর্গঠন কমিশনের প্রক্রিয়া থেকে তীব্র হয় অসমিয়া বাঙালি বিরোধ। বিহারে বা গুজরাটে সেরকম কিছুই হল না! অথচ বিহারে কম ঠকালো না এরা। আর বাণিজ্য টেকাতে গিয়ে গুজরাটি রাজস্থানি বণিকেরা তো নিজেদের মাতৃভাষা নিজেরাই ডোবাল! এই হিন্দু উর্দু বিবাদ বলুন, বাংলা বাংলাদেশি ভাষার বিবাদ বলুন সব কিছুর পেছনে এই বণিকদের শয়তানি! গোটা ভারতে এরা নিজেদের বাঁধন শক্ত রাখতে চায়!

ডিমা হাচাওতে ৩০০০ বিঘা জমি দখল করে ডিমাছা উচ্ছেদ করে, এরা দুনিয়াকে জানাতে চায় বাংলাদেশি মিঞা তাড়াচ্ছে! এই মিঞারা কিন্তু আদত কামরূপী, অথবা এর থেকেও বহু প্রাচীন "খিলঞ্জিয়া' হরপ্পা মহেঞ্জোদারোর সভ্যতার উত্তরাধিকারী অস্ট্রিক দ্রাবিড়দের উত্তরসূরি হয় তো। এরা না মোঘল না পাঠান না আফগান।

এহেন অবস্থাতে, এই যে দীর্ঘদিন ধরে হিন্দিভাষী হরিদাস পালকেও বিশ্বাস করতে দেওয়া হয়েছে, তার ভাষা হিন্দুস্তানি (যেমন শৃঙ্খল চলিহা বিশ্বাস করে গোটা অসমের ভাষা অসমিয়া) --এর পেছনে তো আমাদেরও মৌন সমর্থনের এক দীর্ঘ ইতিহাস আছে!

এখন এর সঙ্গে মিশেছে হিন্দুত্বের মোড়ক। বাংলাতে "রাষ্ট্রবাদ' কথাটি ছিলই না, রাষ্ট্রীয় গীত বলেও কিছু নেই। এখন তো দেখি তিনসুকিয়াতেও দুর্গাপূজার মণ্ডপ সাজাতে বাঙালি মূর্খরা লেখে "রাষ্ট্রীয় গীত' (জন গণ মন)। তো ভাষা ধর্ম এবং রাষ্ট্রকে যখন এক করে শেখানো হচ্ছে, আর আশ্বাস দেওয়া হচ্ছে, হিন্দুস্তান (শব্দটি আবার মোঘল প্রতিষ্ঠিত, বাংলার মতোই--এর উৎস যাই হোক) মানে হিন্দুর দেশ, আর সেই দেশের ভাষা হিন্দি সেখানে অতি সরল বিশ্বাসে দিল্লির পুলিশ, পশ্চিম বাংলার রেল কর্মী, মেট্রো যাত্রী, ছাত্রাবাসের ছাত্র তো দম দিয়ে বলবেই, "আমি হিন্দুস্তানি হিন্দিই বলব, বাংলা বলতে বাংলাদেশে যাও ' (মাঝে মধ্যে কিন্তু এরা মণিপুরিদের নাগাদের চিঙ্কি বা চিনি বলে, মণিপুরিরা কুকিদের বর্মী বলে --রোগ থেকে কেউ মুক্ত না! )

কাছাড়ের এক "হিন্দুস্তানি' নেতা সেদিন বাঙালিকে বলে দিলেন "বাংলাদেশি উদ্বাস্তু!'  যিনি বললেন এবং যাকে বললেন দুজনেই কিন্তু 'জয় শ্রী রাম' ভক্ত হনুমান। রামরাজ্যে থাকবেন, আর তুলসিদাসী ভাষাকে স্বীকার করবেন না, এমনও কি হয়! 

নানান রাজনৈতিক স্লোগানে (আচ্ছে দিন, স্বচ্ছ ভারত, হরঘর তিরঙ্গা, স্বচ্ছতা হি সেবা, মন কি বাত,… ) এখন বাঙালিই কেন, অসমিয়া উড়িয়া ভাষাতেও জলভাতের মতো ঢুকে গেছে! বৈষ্ণব আখড়াতে ঢুকে গেছেন হনুমান আর চণ্ডীদাসের বা হাচন রাজার কৃষ্ণ গানের জায়গা নিয়েছে হনুমান চালিশা! বোল-বোম, গণেশ চতুর্থী, ধনতেরাসে (আধুনিক হিন্দু রীতি)ঢুকে গেছে ভোজপুরি ডিজে ( বাঙালির আত্মীয় ভাষাটিকেও যে কতভাবে দখল করে বারোটা বাজিয়ে ফেলেছে)। আপনি এই সমস্ত নিয়ে মনে মনে থাকবেন, আর হিন্দুস্তানিরা কেন আপনাকে বাংলাদেশি বলে তাই নিয়ে হল্লা করে বাজার গরম করবেন, এ কেমন তর কথা?

         নিশ্চয় আপনাকে কেউ 'বাংলাদেশি' বললে আপনি চটবেন, কিন্তু তাই বলে এই ভারতের বিহার থেকে গুজরাটের মতো পাঁচ সাতটি রাজ্যের আম জনতাকে শত্রু পক্ষে ঠেলে দেবেন, এ কেমন তর কথা? পশ্চিম বাংলাতেও এখন মহারাষ্ট্র কর্ণাটকের দেখাদেখি, হিন্দিভাষী বিরোধিতা শুরু হয়েছে!

আসলে অসমে এই রাজনীতি বহু প্রাচীন, এরাও অনসমিয়া মাত্রকেই অবাঞ্ছিত বহিরাগত ভাবেন। দুই দশক আগেও ব্যাপক হারে বিহারি শ্রমিক হত্যা হয়েছে অসমে মণিপুরে মেঘালয়ে। আলফা হিন্দি বস্তিগুলোতে ব্যাপক বোমা ছুড়ত, আর মূর্খ কিছু বাঙালি হিন্দু বলত, এই সব মিঞা মুসলমানের কাজ। কিন্তু বেশি চাপ বাঙালির উপর, বিশেষ করে. বাংলা মূলের "নঅসমিয়া ' মুসলমান দের উপর। তাই মনে হতে পারে গর্গ চ্যাটার্জিদের বাংলা পক্ষ শৃঙ্খল চলিহাদের লাচিত সেনার থেকে শেখেনি, শিখেছে মহারাষ্ট্রের নব-নির্মাণ সেনার থেকে!

অসমের মতোই দেখছি, বাংলার বহু "ধর্মনিরপেক্ষ' বাম উদারপন্থী ভাবছেন এরা কিছুটা হলেও হিন্দুত্ববাদকে ঠেকাবে।

কিন্তু সত্য হল এরাও আসল বিপদকে আড়াল করে সহজ রাজনীতি করে! অসম এবং মহারাষ্ট্রের জাতীয়তাবাদীদের সঙ্গে হিন্দুত্ববাদীদের আঁতাত এখন স্পষ্ট। অসমিয়া জাতীয়তাবাদীরাই বলছেন! লাচিত সেনা যখন নিজেদের ধর্ম নিরপেক্ষ বলছে তখন উজানের বহু অসমিয়াই বলছেন, এরা হিন্দু মুসলমান করছেন! সেখানে বাংলা-পক্ষের মতো সংগঠনগুলো খুব বেশি দূরে থাকবে না! হিন্দুত্ববাদীদের মতোই এরা "রোহিঙ্গামুক্ত' ভোটার লিস্টের দাবি তুলছে যখন দেশে SIR বিরোধী লড়াই হচ্ছে! "বাংলাদেশি মুক্ত ' বলতে কতদিন! নবান্নে পালা বদল হলেই এরাও পাল্টি খাবে, নইলে এতো সহজ সংগঠনের জোর পাবে কই? আর এই যে বহিরাগত মুক্ত বলছে, এর সঙ্গে লাচিত সেনা বা অসমের জাতীয় সংগঠনের তফাৎ কী?

          এরা হিন্দিভাষী সম্পর্কে একটি জঘন্য শব্দ চালু করেছে "গুটকাখোর'। আম জনতা ভাবছেন গুটকাখোর আসলে বিহারি হিন্দু মুসলমান! যখন এস আই আর বিরোধী মঞ্চে তেজস্বী সগৌরবে বলেছেন, আমরা খৈনি খাই। গুটকা খেয়ে মুখে কর্কট রোগ বাঁধিয়েছেন মারাঠি নেতা শারদ পাওয়ার। সেগুলো প্রথম বড়ো গুটকা কোম্পানির একটি হচ্ছে ১৯৭২ সনের "গোয়া গুটকা'। এখন যেগুলো বাজারে চলে তার অধিকাংশই গুজরাট আর রাজস্থানের কোম্পানি! 'হিন্দি হিন্দু হিন্দুস্তানে'র আঁতুড় ঘর! বিহার উত্তর প্রদেশ তো বেচারা অসহায় অনুচর!

        গুটকাখোর বলে বিহারি নিম্নবিত্ত মধ্যবিত্তদের শায়েস্তা করে, শ্রমজীবীদের মধ্যে ভাঙন ঘটিয়ে বাংলাকে উদ্ধার করবেন বলে যদি কেউ স্বপ্ন দেখেন, তবে তিনি মূর্খের স্বর্গে বাস করছেন! সমস্ত অবাঙালিদের আসলে গুজরাটি গুটকা কোম্পানির আশ্রয়ে ঠেলে দিয়ে হিন্দুত্ববাদীদের হাত শক্ত করছেন! অসমে একই আত্মঘাতী রাজনীতি করেছে অসমিয়া জাতীয়তাবাদীরা। বাঙালি বিহারিদের নিরাপত্তাহীনতা ঘটিয়ে হিন্দুত্ববাদের ছাদের তলাতে পাঠিয়ে এখন অসমিয়া জাতীয় জীবনের বিপন্নতার গান গাইছেন! হিন্দুত্বের নেশাতে মিঞা বেদখলের আড়ালে বনাঞ্চল থেকে উচ্ছেদ হচ্ছেন অসমিয়া বাঙালি নেপালি কার্বি ডিমাছা বডো অমুসলমান কৃষক! আড়াল পড়ছে তাঁদের কান্না, আর হাজার হাজার বিঘা মাটিতে দখল বসাচ্ছে আদানি রামদেব বাবার মতো খাটি খিলঞ্জিয়া হিন্দুস্তানি!

অসমিয়া উচ্ছেদ হলে আর কেউ ক্ষমতার মুখোমুখি হয়ে বলবার দম দেখায় না যে, অসমত অসমিয়ার দপদপনি চলিব।

এদের অধিকাংশকেই চাঁদা যোগান দেয় গুজরাটি রাজস্থানি বনিক গোষ্ঠী, কিছু বাঙালি বণিকও।

       


    এর মানে এই না যে সকল গুজরাটি রাজস্থানিই বড়োলোক! আজ সকালেই আমাকে ভারত-ফাইবারের এক মাড়োয়ারি কর্মচারী ওর ছেলে দুর্ঘটনাতে পড়ল বলে, টাকা ধার চাইল! হাসপাতালে যেতে টাকা নেই, দিলাম তো। সে হয়তো সরল মনে আমাকে 'বাংলাদেশি'ই ভাবে। তাই বলে কি বিপদে পাশে দাঁড়াব না! ধর্ম কাকে বলে? কেবল ঐ "জয় শ্রী রাম' বললে? "বোল বোম' করলে? আমাদের এসব আসে না! আমাদের অবাঙালিকে ঘেন্না করার "বাঙালিআনাও' আসে না! শেষ মেশ সবটাই আদানি আম্বানি টাটা বিড়লারই ফাঁদ। দেশভাগটাও বিড়লারাই করিয়েছিল! আমরা মারামারি কাটাকুটি করেছি, আর এরা প্রাসাদে বসে শয়তানের হাসি হেসেছে!