![]() |
| ৬ নম্ভেম্বর, ২৫-শে সাময়িক প্রসঙ্গে প্রকাশিত |
দেখে এলাম "রৈ রৈ বিনালে'। না, দেখতে যেতে পারেন। অনেকে যেমন ভাবছেন প্রথম সপ্তাহ বলে দর্শক খুব চেঁচামেচি করবেন, কান্নাকাটি করবেন --সে রকম কিছু আমি সস্ত্রীক যে হলে ১লা নভেম্বর, দ্বিতীয় রাতে ৮টার দর্শনী তিনসুকিয়াতে দেখলাম --সেরকম কিছু হল না। শুরুতে যখন জুবিন হাজির হয় তখন "জয় জুবিন দা' ধ্বনি দিয়েছেন কিছু দর্শক। এই মাত্র। কেউ যদি কেঁদেছেন তবে তাও ছবি শেষে নজরে পড়ে নি। ছবিটি শোকান্তক হলে হয় তো কাঁদতেন।
১৯৯৮-তে জুবিনের "শব্দ' এলবামে একটি গান ছিল "রৈ রৈ বিনালে'। জুবিনের সামাজিক-রাজনৈতিক দৃষ্টি অনুধাবনে ঐ এলবামটি খুব গুরুত্বপূর্ণ। আগে যারা শোনেনি, ইউটিউবে পেয়ে যাবেন, শুনে নিতে পারেন। এলবামের এই গানটি আপনি চান কিম্বা না চান বহুবার শুনেছেন, রেলে-বাসে-গাড়িতে-কাফেতে-হাটে-বাজারে চলতে ফিরতেও।অতি জনপ্রিয় গানগুলোর একটি। "বিনালে' মানে কাতর প্রার্থনা বা আকুতি—কেঁদে কুটে কিছু চাওয়াও বলতে পারেন। বাংলাতে এর প্রতিশব্দটি খানিক দীর্ঘ একটি শব্দজোড়– "অনুনয় বিনয়', "ইনিয়ে বিনিয়ে'। ‘বিনয় করে’ বহু বাংলা বাউল-আগমনী-বৈষ্ণব গানে আছে, অনুকূল ঠাকুরের প্রার্থণায় আছে ‘বার বার করো বিনতি’। ওটাই অসমিয়া ‘বিনালে’। কেবল ‘কান্না’ বললে কোনো অর্থ হয় না। "রৈ রৈ মানে' থেকে থেকে—রয়ে রয়ে। সিলেটি বাংলাতে শব্দটি প্রচলিত আছে। রবীন্দ্রগানে আছে “শ্রাবণ বরিষণ পার হয়ে কী বাণী/ আসে ঐ রয়ে রয়ে।” হয়তো ‘বিনতি’-র কান্নার স্বর আপনাকে শুনতে বাধা দিয়েছে।এক গুরু গম্ভীর গানে জুবিনের পশ্চিমা রক-মিশ্রণও আপনাকে চেনা জগতের বাইরে পা ফেলতে বাধা দিয়ে থাকতে পারে। গানের কথাগুলো আমরা পুরোটা দিলাম, গানের কলির পুনরুক্তি বাদ দিয়ে। অসমের পাঠকের জন্যে এর বাংলা অনুবাদ অদরকারি বলেই মনে হচ্ছে: রৈ রৈ বিনালে/নিশায়ে বিনালে/রাতিপুয়াবলে কিমান পর/ডাওরে ডাওরে/এন্ধারে সিপারে/জেউতি লুকালে অসীমত/নভবা কথাও হঠাতে হয় চাগে/পায়ো হেরুয়ালো/বুজি পোয়ার আগতে/রৈ রৈ বিনালে/…/জেউতিও নাইকিয়া/রৈ রৈ বিনালে/…/জানো বুজো তথাপিও নোয়ারো/নিজর মাজত তোমাকেই সামরো/…/সপোনর রথ আজি হতবাক স্তব্ধ/জীবনর পথ আজি মলিন বিবর্ণ/জীবনর যাত্ৰা তোমাতেই বিলীন/রৈ রৈ বিনালে/…/তোমাতেই বিলীন…!!/…/মায়া মাথোঁ এতিয়ার যৌবন/পল অনুপল হেরুয়াইছো ক্ষণ/…/অহোরাত্রি অনাবিল স্বপ্ন প্রতারিত/বাস্তব মোর কাষত ক্ৰন্দন বরষিত/আগত সূৰুযর দিবাস্বপ্ন/দিবাস্বপ্ন…!!/ রৈ রৈ বিনাল…।
আপাত দৃষ্টিতে গানটিকে একটি র্যোমাণ্টিক গান বলে মনে হবে। কিন্তু বন্ধু প্রাগজ্যোত গগৈ ফেসবুকে এক নিবন্ধে লিখেছেন, জুবিন মানে ব্লেণ্ডিং। এই কথাগুলোই ধরুন, ""সপোনর রথ আজি হতবাক স্তব্ধ/জীবনর পথ আজি মলিন বিবর্ণ/জীবনর যাত্ৰা তোমাতেই বিলীন'' বা ""মায়া মাথোঁ এতিয়ার যৌবন/পল অনুপল হেরুয়াইছো ক্ষণ/...বাস্তব মোর কাষত ক্ৰন্দন বরষিত/আগত সূৰুযর দিবাস্বপ্ন/দিবাস্বপ্ন…'' এই বেদনা বৃহত্তর সামাজিক যৌবনের, একক প্রেমাহত তরুণের নয়। এই খানে ছবিটি মাত করেছে। আমরা বলছি, আরও বিস্তৃত। পুরো গল্প তো লেখা যাবে না এখনই। কিন্তু এইটুকুন লিখতে পারি, যেভাবে মিডিয়া হল্লা করছিল—জুবিন জীবনের শেষ মুহূর্তের সঙ্গে সিনেমার গল্প মিলে গেল কী করে—সে রকম কিছুই নেই ছবিতে। না, এই ছবির নায়ক রাহুল/রাউল ছবির মাঝামাঝিতে সাগরের ছোট্ট দুর্ঘটনাতে মারা যায় নি। এটি একটি "সুখান্তক' মিষ্টি প্রেমের গল্প।
এই কথা জেনে অনেকে নাখুশ হতেই পারেন যে ছবির মূল প্রেম কাহিনির কাঠামোটি একেবারে মৌলিক নয়। এই গল্পের প্রথম উদয় হয় ২০০১-এর জনপ্রিয় তামিল ছবি "মিন্নালে'-তে। পরিচালক ছিলেন গৌতম বাসুদেব মেনন। ত্রিকোণ প্রেমের গল্প। বিয়ে স্থির নায়িকার জীবনে দ্বিতীয় পুরুষ আসে। এবং শেষ মুহূর্তে সেই দ্বিতীয় পুরুষের সঙ্গে বিয়েটা হয়। বিখ্যাত তামিল ও হিন্দি ছবির নায়ক মাধবন সেই দ্বিতীয় পুরুষের ভূমিকায় কাজ করেন, নায়িকা রিমা সেন। প্রথম পুরুষ আব্বাস। একই বছরে একই পরিচালক ছবিটি হিন্দিতে করেন—"রেহনা হায় তেরে দিল মে' নামে। দ্বিতীয় পুরুষটি সেই মাধবন, নায়িকা দিয়া মির্জা, এবং প্রথম পুরুষ শইফ আলি খান। মাধবন ও দিয়ার এটি প্রথম হিন্দি ছবি ছিল। সিনেমা হলগুলোতে খুব চলেছিল। হেরিস জয়রাজের সঙ্গীত পরিচালনাতে জয়শ্রী রামনাথের কণ্ঠে "জরা জরা বেহেকতা দিল' গানটি এককালে খুব মুখে মুখে ফিরত। আমি নিজেও সিনেমাটি না দেখলেও গানটি আমার সংগ্রহে গত দুই দশক ধরে সংগ্রহে আছে। আগে সিডিতে ছিল, এখন পেন-ড্রাইভে, ডেক্সটপে আছে। এখনও মুগ্ধ হয়ে শুনি। ২০১০-এ এর একটি বাংলা নকল বাজারে ছাড়েন নকল ছবির খ্যাতনামা পরিচালক স্বপন সাহা "মন নিয়ে।' ঋষি, শুভ্রা কুণ্ডু, রজতাভ দত্ত প্রমুখ অভিনয় করেন। হুবহু হিন্দি তথা তামিল ছবির অক্ষম প্রতিলিপি। যদি আমাকে কেউ বলেন, তিন প্রতিলিপির মধ্যে শ্রেষ্ঠত্বের বিচারে তালিকা বদ্ধ করতে তবে ক্রমাঙ্ক তিনে রাখব এই "মন নিয়ে'-কে। দুইয়ে "রহনা হায় তেরে দিল মে' এবং প্রথম অবশ্যই এই "রৈ রৈ বিনালে'। জুবিনের ছবিটি প্রতিলিপি তো নয়ই—এদের প্রতিটির তুলনায় বহু উচ্চমার্গের ছবি। কাঠামো তথা আধারটির জন্যে ঋণী হলেও আধেয়টি জুবিনের সম্পূর্ণ নিজস্ব। তামিল ছবি দেখিনি যদিও একই পরিচালক যেহেতু হিন্দি করেছেন—বলতেই পারি—ছবিটি শেষের কিছু আগে অবধি জঘন্য ছবি বলে মনে হয়। আশি নব্বুইর দশকে গ্রাম ছেড়ে শহরে আসা ছেলে-মেয়েদের মা-বাবার বিরুদ্ধে গিয়ে প্রেম-প্রতিজ্ঞার গল্প বলত বলিউড। ধনি-দরিদ্র-জাত-পাতের বেড়া ভেঙে ফেলত। শেষ ছবি বোধ করি রাজকাপুরের ‘হেনা’। নব্বুইর শেষদিক থেকে নতুন শতকের শুরুতে বিশ্বায়নের দাপটে যখন বিদেশ পাড়ি দেয়া শুরু হয়েছে—তখন আবার পালটা দেশপ্রেমের ঢেউতে মা-বাবা-পরম্পরার কাছে আত্মসমর্পণ শিখেছে বলিউডের প্রেমিক প্রেমিকারা। এরই ধারাবাহিকতায় এখন ছবি হয় ‘কেরালা স্টরি’। সেই সময়ের কিছু বিখ্যাত ছবির কথা মনে পড়ছে—"হাম সাথ সাথ হায়', "হম আপকে হ্যায় কৌন' ইত্যাদি। এই সিরিজে গৌতম বাসুদেব মেননের ছবিটি। স্বপন সাহা ‘বেদের মেয়ে জ্যোৎস্না’-র জনপ্রিয়তা দেখে বাংলা ছবিতে ঢুকেন। কেউ যেন না ভাবেন আমি ‘বেদের মেয়ে জ্যোৎস্না’-র নিন্দে করছি। ষাটোর্ধ বয়সে ঢুকে দুই দশক তিনি বাংলা ছায়াছবির বিশাল বাজার গড়েছিলেন, তাঁর ৫০-এর বেশি ছবিতে অভিনয় করে "মহানায়ক' হয়েছিলেন প্রসেঞ্জিৎ। কিন্তু এর একটিও মৌলিক ছিল না, না ছিল সৃজনশীল। তিনি কখনও একই সেটে দিনে তিনটি ছবির শুটিং করতেন একই অভিনেতা অভিনেত্রীদের নিয়ে। বাকিটা ভেবে নিন। করতেন যাত্রা পালা ধরণের ছবিই। গ্রাম বাংলার বাজার ধরবেন বলে। তাঁর ছবিগুলোর নাম কী ছিল— "এম এল এ ফাটাকেষ্ট', "বাবা কেন চাকর' ইত্যাদি। তিনি হঠাৎ করে বসলেন "মন নিয়ে'। নামটিও ষাটের উত্তম-সুপ্রিয়া অভিনীত সলিল সেন পরিচালিত এক বিখ্যাত বাংলা ছবি থেকে ধার করা। এতে জুবিন গান গেয়ে ফেলেছিলেন। টাইমস অব ইণ্ডিয়া সেবছরই জানুয়ারি ২৩-এ একটি প্রতিবেদনে লেখে “Other than Zubeen Garg’s music, there is nothing much to look forward to in Mon Niye. Simply put, this venture just plays around with the audience’s mon and money”
আমি জানি না, যে বাঙালি দর্শক "পিয়ারে পিয়া', "বোঝে না সে বোঝে না' জাতীয় গানে মাতাল হলেন তাঁরা কেন এই ছবির জুবিনের গানের সন্ধান পেলেন না। জুবিনের সব গানই কি শোনার মতো? এই ছবির গান শোনার মতোই ছিল। লেখাই বাহুল্য ছবিটি ফ্লপ করেছিল। সঙ্গে মার খেয়েছিল জুবিনের বাংলা ছবিতে গাওয়া শ্রেষ্ঠ দুই চারটি গান। বিশেষ করে অনিন্দিতা গাঙুলির সঙ্গে গাওয়া "চেনা চেনা দিন'। ছবির সঙ্গীত পরিচালনার পুরো দায়িত্বে ছিলেন জুবিন। গানটির কথা যদিও প্রিয় চট্টোপাধ্যায়ের। এই গানটিরই অসমিয়া রূপান্তর রয়েছে "রৈ রৈ বিনালে'-তে -- "সপোন সপোন যেন' । ছবির সেরা গান। বাংলা ও অসমিয়া ছবির গানের দৃশ্যায়ন দেখলেই যে কেউ বুঝে যাবেন জুবিন কোন উচ্চতায় গানটিকে নিয়ে গেছেন তাঁর নিজের পরিচালিত ছবিতে। সামাজিক মাধ্যমে আমি "মন নিয়ে' ছবিটিকে "ফালতু' বলাতে এক তরুণ আমাকে উপদেশ দিতে আসছিলেন,কারও সৃষ্টিকে ফালতু বলা উচিত নয়। অথচ পাশাপাশি দেখলে যে কেউ এই শব্দটি উচ্চারণ করবেন। "রই রই বিনালে' গানটি তো জুবিন নিজেই সময়োচিত পুনঃসৃজন করে এই ছবিতে আবারও রেখেছেন, নিজের পুরনো বহু শোনা গানকে এভাবে নতুন ছবিতে নেবার ঝুঁকি কজন পরিচালক নেবেন, জানি না। রবীন্দ্র সঙ্গীত, জ্যোতি সঙ্গীত হলে কথাটি আলাদা ছিল। নিজের ছবিতে প্রবল আত্মবিশ্বাসে জুবিন নিজের গানকে সেই মর্যাদা দিয়েছেন।
কিন্তু কেবল সিনেমাটোগ্রাফিই নয়, জুবিনের ছবিটি আরও বহু কারণে বাণিজ্যিক ছবিগুলোর মধ্যে একটি সেরা নির্মাণ। হ্যাঁ, বাণিজ্যিক ছবিই এটি। কিন্তু বাকি দুই ছবি দেখতে বসলে শেষ মুহূর্তের আগে অবধি নায়ক চরিত্রটি দর্শকের সামান্যও সহানুভূতি আদায় করতে ব্যর্থ হবে। আদি অন্ত সে প্রেমের জন্যে প্রবঞ্চনা, গুণ্ডামি কী না করে। দুই কলেজ পড়া ছাত্র। উপরের ক্লাসের ছেলেটি তুলনামূলক ভাবে ভালো, নিচের ক্লাসে পড়া ছেলেটি বখাটে বাউণ্ডুলে। বহু পরে এরা এক মেয়ের প্রেমে পড়ে—উপরের ক্লাসেরটির সঙ্গে ওর বিয়ে ঠিক করা, নিচের ক্লাসেরটি হঠাৎ দেখে প্রেমে পড়ে। এবং সেই প্রেম পাবার জন্যে—সে যা দরকার সবই করে। এমন কি মেয়েটিকেও শেষে ধমকি টমকি দিয়ে শেষে ওর বোধোদয় হয়—কাজগুলো ভালো হয় নি। ঐ প্রেমে ব্যর্থ যে তরুণ প্রেয়সীকে হত্যা করে বা এসিড ছুঁড়ে মারে—তাদের কাছে হয় তো শেষে একটা বার্তা যায়—কাজটি ভালো নয়। এই মাত্র। নায়িকা নিছক নায়িকাই। ওর কোনো স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্ব বলে কিছুই নেই। সে ঐ বখাটে বাউণ্ডুলেকেই শেষে বরণ করে নেয়। বছর কয় আগে লাল্লনটপে একটি সাক্ষাৎকারে দেখছি দিয়া মির্জা জানাচ্ছেন, তিনি পরিচালককে এই প্রশ্নটি করেছিলেন। তার মানে খুব স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্নটি জাগে, ভালো ছেলেটিকে রেখে মেয়েটি ঐ বখাটে ছেলেকে বেছে নিল কেন? জুবিনের ছবিতে এমন প্রশ্ন করবার কোনো সুযোগই নেই।
জুবিনের নায়িকা ‘মৌ’ নিজের পরিচয়ে উজ্জ্বল। একটি ইভেন্ট ম্যানেজম্যান্ট কোম্পানির সে মালিক ও ম্যানেজার। সেই সুবাদের গানের অনুষ্ঠানও আয়োজন করে। শিল্পী জোগাড় করে তাদের মঞ্চ দেয়। সেই সুবাদে সে আগে থেকেই গায়ক নীরের বাগদত্তা। এই সময়ে আসরে প্রবেশ করে নতুন প্রতিভা রাহুল বা রাউল। নীর প্রথম নায়ক, রাহুল দ্বিতীয় নায়ক। মৌ বাস্তবেই নায়িকা মৌসুমি আলিফার ডাক নাম। নামটি জুবিনের দেয়া বহু আগে। সেই নামই ছবিতে আছে। প্রথম নায়কের ভূমিকায় রয়েছেন জয় কাশ্যপ। বাসুদেব মেনন বা স্বপন সাহার ছবিতে দ্বিতীয় নায়কের বন্ধুরা হয় ভাঁড় নয় গুণ্ডা। ওর বাবা অনুপম খের বা রজতাভ দত্তও তাই—আদ্যন্ত ভাঁড়। রাহুলের বাবা –মা নেই। খুড়ো সেই জায়গা নিয়েছেন –তিনি তাঁর সৎ পথের প্রদর্শক। বন্ধুরাও কেউ না গুণ্ডা না ভাঁড়। রাহুল তো অন্ধ। যার ভূমিকায় রয়েছেন জুবিন স্বয়ং। তার কোনো বন্ধু নেই। আছে মৌ-র সহকর্মী। আচুর্য বরপাত্র —আরও এক জনপ্রিয় অসমিয়া সঙ্গীত শিল্পী --- তিনজনেরই নিরপেক্ষ বন্ধুর দায়িত্ব পালন করে দর্শক মন হয় করেছেন। তিনি যে এত ভালো অভিনয় করেন, আমার অন্তত জানা ছিল না।
এই গল্পে কোনো বখাটে বাউণ্ডুলে নেই, জুবিন আগেই জানিয়েছিলেন—কোনো মারামারি বাজে কথা থাকবে না। নেইও। প্রথম নায়ক সেই অর্থে মেনন বা সাহার ছবিতেও দুষ্ট খলনায়ক নয়—কিন্তু মারা-মারি কুস্তিতে পাকা। এই ছবিতে নীর সামান্য দাম্ভিক এবং প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বাজারের সঙ্গে থাকতে আগ্রহী। গান তার কাছে পণ্য—রাহুলের কাছে নয়। এইখানেই জুবিন। গল্পের দ্বন্দ্বের মূলও এখানেই। প্রমোতে সবাই একটি সংলাপ শুনেছেন, ""মই অন্ধ নহয়, আর্টিস্ট। আর্টিস্টর এটায় পলিটিক্স। সদায় রাইজর লগত, রজার লগত নহয়।'' প্রথম বাক্যাংশটি এবং শেষ বাক্যগুলো ছবিতে এক সঙ্গে নেই। আছে দুই আলাদা প্রেক্ষিতে। কিন্তু প্রমোতে এটি ঠিক ঠাক কেন্দ্রে ধরে আমাদের জানানো হয়েছে। গল্পটি কোন পথে এগুবে। অন্ধ নায়ককে দেখে কবিতা পাঠকদের মনে পড়বে জীবনানন্দ দাশের সেই অসামান্য পঙক্তি “যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশি আজ চোখে দেখে তারা”। বাসুদেব মেনন বা স্বপন সাহারা সস্তার প্রেম কাহিনির বাইরে এতসব ভাবতে যান নি। জুবিন ওখান থেকে শুরু করেছেন। আর্টিস্ট তথা শিল্পী থাকবে জনতার সঙ্গে ,শাসকের সঙ্গে নয়—এই সব কথাতেই মোহিত হয়ে মৌ এই অন্ধ ছেলেটির ব্যক্তিত্বের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে গেছে। নীর থেকে দূরে সরে গেছে। যদিও ওর অপূর্ব গলা শুনে প্রতিভাকে আগেই আবিষ্কার করে নীর। পরে ও। সেই সঙ্গে গল্পে আছে পুরুষ-তন্ত্রের মার। মৌ একে চিহ্নিত করে। প্রেমে কোনো তরফেই কোনো প্রবঞ্চনা নেই, সামান্য স্বাভাবিক মান অভিমান ঈর্ষা আছে—কিন্তু প্রবঞ্চনা নেই, নেই হিংসা। এমনকি মেনন বা সাহার ছবিগুলোর মতো প্রথম নায়ক দয়া করে বিয়ে ভেঙে প্রেয়সীকে দান করে না, বিয়েটা নায়িকা স্বয়ং ভাঙে। সিদ্ধান্তটি ওর নিজস্ব। নীর সেটা সানন্দে মেনে নেয়—এমন একটা দৃশ্য শেষে রয়েছে। এ যেন নারী-সিদ্ধান্তের কাছে পুরুষতন্ত্রের পরাজয়। কোনো প্রধান চরিত্রই দর্শকের অশ্রদ্ধা পাবে না। একটি অপ্রধান কিন্তু গল্পের দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ ও শ্রদ্ধেয় চরিত্রে বাংলা তথা ইংরাজি ছবির অভিনেতা ভিক্টর ব্যানার্জিও রয়েছেন। যদিও অপ্রধান এবং অশ্রদ্ধেয় চরিত্র মৌ-র বাবা ও বিধায়ক আছেন। বিধায়কের মধ্যে দর্শক বহু চেনা প্রাক্তন আলফা রাজনৈতিক নেতার প্রতিচ্ছবি দেখেও পুলকিত বোধ করবেন।
আমরা শুরু করেছিলাম এই লিখে যে ছবির গল্প কাঠামোটি মৌলিক নয়। কিন্তু এইভাবে "রৈ রৈ বিনালে'-র গল্পটি হয়ে উঠেছে "সোসিয়েল লেফট', " বিষ্ণু রাভা-চে গুয়েভারা-চার্লি চ্যাপলিনে'-র ভাবশিষ্য জুবিনের নিজস্ব গল্প। ছবিটি এরই জন্যে দেখতে হবে, মনে রাখতে হবে।
গল্পের বুননটি ঠাস এবং কাব্যিক। উপস্থাপনও দৃষ্টি-শ্রব্য-নন্দন। মেনন বা সাহার ছবি নয়—যদিও বলিউড বাণিজ্যিক ছবির দক্ষতা মেননের ছবিতে রয়েছে। মূলে হাল্কা ছোট্টো একটি প্রেমের গল্প। কিন্তু জুবিন যেভাবে এতে সমাজ-ইতিহাস-রাজনৈতিক বোধের স্বাক্ষর রেখেছেন তা অসমিয়া বাণিজ্যিক ছবিতে বিরল। সমান্তরাল ধারার ছবিতে প্রচুর আছে এই সব। জুবিন এই দুই ধারার ‘ব্লেণ্ডিং’ ঘটিয়ে ছবিটিকে করে তুলেছেন এক ‘আধুনিক রূপকথা’। রূপকথা এর জন্যেও যে এটি শেষ পর্যন্ত একটি সুখান্তক এবং স্বপ্ন পূরণের গল্প। বাস্তবে এত সহজে স্বপ্ন পূরণ হয় না । কিন্তু রূপকথা স্বপ্ন দেখায়, সাহস যোগায়। ছবিটি এখানেই সার্থক । বস্তুত বাণিজ্যিক প্রেম কথাকে একটি কাব্যিক রূপকথাতে পরিণত করতে পারাই ছবিটির বড়ো অর্জন। অন্যভাষাতে এমন ছবি হয়তো বিরল নয়, আমির খানের ছবিগুলোর কথা দর্শকের মনে পড়বে সহজে। কিন্তু আমাদের সেদিকে এখন পা ফেলবার জো নেই।
বাণিজ্যিক উপাদান আছে বলে আনুষঙ্গিক বাস্তবতাবাদী যুক্তির কিছু খামতি আছে। কিন্তু রুচি সম্মত ভাবে। যুক্তির অভাব ধরুন, অসমের শিল্পীর গানের স্টেজ থুড়িই না "ইণ্ডিয়ান আইডলের' স্টেজের মতো হয়। সেখানে আয়োজক সংগঠনের দাদারা দৃষ্টিকটুভাৱে স্টেজে ভিড় করে দাঁড়িয়ে থাকে!
গল্পের বুননটি ঠাস বলছিলাম—কোথাও অহেতুক প্রসারণ নেই, নেই ডিটেলিং। আবেগিক নাট্যমুহূর্ত নেই। যথা সম্ভব সংক্ষেপে গল্পগুলো এগিয়েছে। যেমন ধরা যাক আলঝাইমার রোগে আক্রান্ত হয়ে মৌ-র মা দীর্ঘদিন শয্যাশায়ী। গ্রামের বাড়ি ফিরে যাবার আগে জুবিন তাঁর কাছে যায়। ওর চলা বা ঘরে প্রবেশও দেখানো হয় না। দেখানো হয়—সে তাঁর বিছানার পাশে নষ্ট হারমোনিয়াম ঠিক করে দিয়ে বলে, ঠিক হয়ে গেছে। বহুদিন পরে তিনি চোখ মেলে তাকান। পরিচারিকা দৌড়ে যায় মৌকে খবর দিতে। এহেন সংক্ষিপ্তীর তোড়ে এক সময় যখন রাহুল সাগরে ডুবে জল খেয়ে অজ্ঞান ওকে সেখানে ওভাবেই রেখে এসে যায় মৌ নীরের সঙ্গে কাজিয়া করবে বলে। সুস্থ হয়ে চোখ মেলা অবধি অপেক্ষাই করেনি।
অভিনয়ের কথা কাকে ফেলে কার কথা লিখি, কেউ হতাশ করেন নি। আর জুবিন তথা রাহুল তো আদি-অন্ত গুরু-গম্ভীর এক আদর্শ পরায়ণ নির্মোহ ব্যক্তিত্ব, বাস্তবের জুবিনের মতো। না সে মদ খায় না ছবিতে। সংলাপ অনেকগুলোই মনে রাখবার মতো। একটি তো ঐ "আর্টিস্টর এটায়ে পলিটিক্স...'; বিধায়ককে যখন নীর "স্যর' বলে সম্বোধন করছে, রাহুল বলছে, বিধায়ক স্যর হলেন কবে? যার থেকে কিছু শেখার নেই—তাকে স্যর বলতে নেই। সেরকমই রাহুলের পছন্দের লিলি যখন গাছ থেকে তুলে নিয়েছিল মৌ—টের পেয়ে রাহুল বলে, ফুল পাড়তে নেই। গাছ কষ্ট পায়। তেমনি আছে, ""গছজোপা দেখিবলে বর ধুনিয়া। কিন্তু শিপাইহে জানে, বগাবলে কিমান টান।'' এমন আরও কিছু আছে। সব কথা লিখে ফেললে ছবি কেন কেউ দেখতে যাবেন? কিন্তু সব শেষে পর্দায় ভেসে ওঠা কথাটি বাদ দিই কেন? শেষে "সমাপ্ত' বলে লিখে দেয়া হয় নি। বদলে লেখা ছিল ""শেষ বুলিলেই তো শেষ নহয়, আকৌ আরম্ভ হয়।'' কথাটি বাসুদেব মেননের ছবিতে অনুপম খের তার বখাটে ছেলের ভূমিকাতে অভিনয় করা মাধবনকে বলছিলেন। রজতাভ ‘ মন নিয়ে’ ছবিতে বলেছিলেন কি না মনে নেই। এমনিতে ছবিটি কার্বন কপিই। কিন্তু এই ছবিতে এর মানেটাই হয়ে গেছে অন্য। যেন জুবিন বলছেন, আমার তো মৃত্যু হয় নি। দেখছ কি না মরোণোত্তর আরও এক নতুন জীবন শুরু হয়েছে। যেন বলছেন, এই ছবি শেষ—বুঝতে পারছ কি—অসমিয়া ছবিকে, অসমিয়া গানকে, অসমের সাংস্কৃতিক সামাজিক রাজনৈতিক আবহকে কোথায় নিয়ে যেতে হবে? অসমিয়া ছবিই কেন, ভারতীয় ছবিই নয় কেন? এই ছবি আরও এক নতুন আরম্ভ "মাথোন'।
ছবিটি বহু উঠে আসা লেখক শিল্পীদের স্বপ্ন দেখাতে পারে। বাজারের বিপদ প্রতিষ্ঠানের শঙ্কার সম্পর্কে সতর্কও করতে পারে। জুবিনকে আমরা এভাবেই দেখছি—প্রতিষ্ঠানের ভেতরে প্রতিষ্ঠানের বিরোধী লোক। সেই জন্যেই তাঁকে প্রাণ দিতে হল অকালে। ছবিটি কী করতে পারে, কেমন তার রেশ থাকবে, প্রভাব পড়বে--- দেখার জন্যে এই সময় খুবই নবীন, একেবারেই কাঁচা। অঙ্কুরোদ্গম হচ্ছে মাত্র।
শুরু করেছিলাম এই লিখে যে অনেকে ভাবছেন প্রথম সপ্তাহ বলে দর্শক খুব চেঁচামেচি করবেন, কান্নাকাটি করবেন। না, নাম দেখিয়ে শেষ করা অবধি দর্শক নড়েন নি, তারও কারণ ছবির শুটিঙের কিছু দৃশ্য ছাড়াও জুবিনজীবনের কিছু ছবি পাশা পাশি দেখানো হচ্ছিল। আমরা যখন বেরিয়ে আসছি তখন রাত ১১টার দর্শনীর দর্শক ঢুকছেন।
