আমার চেতনার রঙে রাঙানো এই খেলা ঘরে:

~0~0~! আপনাকে স্বাগতম !~0~0~

*******************************************************************************************************

Saturday 17 April 2010

।। যারা বানান ভুল করে তাদের পক্ষে দু’এক কলম ।।


(প্রবন্ধটি লিখতে গিয়ে  সংসদ প্রকাশিত রমেন ভট্টাচার্যের 'বাংলা বানান নিয়ম ও অনিয়ম' থেকে কিছুটা সাহায্য নিয়েছি। লিখেছিলাম বছর দুই আগে আমাদের কলেজের বাংলা বিভাগীয় পত্রিকা 'আশা'র জন্যে। সেটিকেই একটু সম্পাদনা ও সংযোজন করে এখানে তুলে দিলাম)



বানান আমরা প্রায় সবাই কখনো না কখনো ভুল করিআমরা বাক্যের গঠনেও ভুল করিক্রিয়া সর্বনামের, সাধু-চলিতের ব্যবহারে আমাদের ভুল কখনো বা রীতিমতো কৌতুক নক্সার বিষয় হতে পারেসে ঐ পর্যন্তইসচরাচর তা নিয়ে কেউ বিশেষ চোখ রাঙায় নাকিন্তু বানান ভুল? কিছু স্ব-ঘোষিত মাস্টার মশাই সারাক্ষণ বেত হাতে দাঁড়িয়ে থাকেন, যেন ভুল করলেই বলবেন---দেখি , হাত তোল! মাতৃভাষা পালটে ফেলেও রক্ষে নেইসব ভাষারই ঘোষিত মাস্টার মশাইরা খুব রাগ করেন, এ নিয়ে আমি দীর্ঘদিন ভাববার চেষ্টা করেছিএ রীতিমত গবেষণার বিষয়  হতে পারেসে গবেষণা করিনি, তবে মনে হয়েছেবাক্য ভুল নিয়ে হৈচৈ করবার জন্যে যে পরিমাণ মাস্টার-ডিগ্রীর দরকার  আমাদের বেশিরভাগেরই সে পরিমাণ নেইসে যাক, আমরাও খুব জ্ঞানী গুণী নই, তাই আপাতত বানান নিয়েই বলবউদ্দেশ্য , বেত-হাতে কড়া মাস্টার মশাইদের মার থেকে আমাদের স্বগোত্রীয় ছাত্রদের তথা অর্ধক্ষম লেখকদের রক্ষা করতে কিছু টিপস দেয়া
তার আগে কিছু কথা বলে নেয়া জরুরিবানান ভুল নিয়ে ভয় করবার এক্কেবারেই কিছু নেইমাস্টারমশায়ের বেতের ভয়ে যারা সুবোধ বালকের মতো পড়তে বসে, তারা ছাত্র ভালো হতে পারে, এদেশের শিক্ষা ব্যবস্থার অগ্রগতির ইতিহাসে সে সব ছাত্রদের অবদান প্রায় শূন্যসে সব কথা নিয়ে আমরা অন্যত্র কোনো এক সময় তর্ক করবকিন্তু ভাষার অগ্রগতির ইতিহাসে  এ কথা একশ পাঁচ আনা সত্যিপানিনি প্রণম্য ব্যক্তিমারাত্মক ব্যাকরণ লিখেছিলেনযাতে কেউ ভাষার ব্যবহারে ভুল না করে তার জন্যে পরবর্তী গুরুদেবেরা তাঁদের আশ্রমে বারো বছর শুধু ব্যাকরণ পড়াবার ব্যবস্থা রেখেছিলেনতাঁরা এরকম এক মহান আবিষ্কারও করেছিলেন যে কোনো ভাষাকে গণ ব্যবহারের জন্য মুক্ত করে দিলে সে আর অক্ষয় থাকে নাতাই ব্রাহ্মণ আর ক্ষত্রিয় পুরুষ বাদ দিয়েআর সমস্ত লিঙ্গ বর্ণে সংস্কৃতের ব্যবহার নিষিদ্ধ করে রেখেছিলেনতাতে হলোটা কী? সংস্কৃত যেমন ছিল এখনো প্রায় তেমনি আছে বটে তার ক্ষয় হয়েছে অন্য দিকে যাদের জন্য ভাষা তারা তার ব্যবহার ছেড়ে দিয়েছেব্যবহারিক জীবনে তার আধিপত্য প্রথমে ফারসি পরে ইংরাজির এবং অতি অবশ্যই নব্য ভারতীয় ভাষাগুলোর প্রত্যাহ্বানের মুখে পড়ে এখন কেবল ঠাকুর ঘরে তার প্রাণটা কোনোক্রমে বাঁচিয়ে রেখেছেবৈদিক আর্য ভাষার ভুল ব্যবহারে চিন্তিত হয়ে পানিনি-পতঞ্জলি-কাত্যায়নেরা ব্যাকরণের কড়া শাসন কায়েম করে সে ভাষার থেকেই সংস্কৃতের জন্ম দিলেনঅন্যদিকে প্রাকৃতজনেরা প্রাকৃত উপায়ে পাওয়া প্রাকৃত ভাষা বৈদিকের ভুল ব্যবহার করতে করতে , করতে করতে আর পাল্টাতে পাল্টাতে আজকের বাংলা পর্যন্ত পৌঁছে গেলেনলোকে যদি ভুলই না করত  তবে কি আর আহ মরি বাংলা ভাষার জন্ম হতো !   
সুতরাং ভাষার ভুল ব্যবহার তেমন কোনো গুরুতর অপরাধ নয়বরং এক পুণ্য কর্ম, এতে ভাষার আয়ু বাড়েপ্রখ্যাত ভাষাতাত্বিক মুহম্মদ শহীদুল্লাহ লিখেছিলেন, পাঁচকোটি বাঙালির অধিকাংশই বানান ভুল করে  তখন সংখ্যাটা পাঁচকোটিই ছিলএখন প্রায় পঁচিশ কোটি বাঙালি  হবে যারা বানান ভুল করে তাদেরও সংখ্যা সমানুপাতে বেড়েছে বৈ কমেছে বলে কোনো খবর পাওয়া যায় নিস্কুলের মাস্টার মশাইএর বেত যে তার পরিমাণ কিছু কম করতে পেরেছে, তাতো মনে হয় নাবরং মাস্টার মশাইরাও কী রকম ভুল করেন তার নজির আমাদের অসমে প্রচলিত উচ্চতর মাধ্যমিক বাংলা সাহিত্য সংকলন নামের পাঠ্য বইটিসম্প্রতি সোমা আচার্য নামে এক শিক্ষিকা যুগশঙ্খে এ নিয়ে এক দীর্ঘ প্রবন্ধ লিখেছেনদৈনিক যুগশঙ্খের মতো অসমের জনপ্রিয় কাগজও যে কত ভুল করে কিম্বা ব্যতিক্রমী ব্যবহার করে সুযোগ পেলেই আমি সেগুলো টুকে রাখিতার কিছু এখানে তুলে দিলে মন্দ হবে না  
২৩ জানুয়ারি,১০ এ প্রথম পৃষ্ঠাতে শিরোনাম বরণের দিনেই অন্তর্দ্বন্দ্বের সুর, গড়হাজির সাংসদরাহওয়া উচিত ছিল গরহাজিরএমন এর জায়গাতে কিম্বা তার বিপরীত ব্যবহারতো আখছার চোখে পড়েকিন্তু স্থানীয় উপভাষা  বা অসমিয়া সহ অন্যভাষার প্রভাবে ভাষা কী রূপ নিচ্ছে তার উদাহরণ বেশ চিত্তাকর্ষকযেমন ধরুনঃ ৩০ মার্চ,১০ যুগশঙ্খের তৃতীয় পৃষ্ঠাতে  ফন্সেকা আত্মীয় সম্পর্কে তথ্য দিলে পুরস্কার দেবে শ্রীলঙ্কা পুলিশএই সংবাদের একজায়গাতে আছে,”তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগঅবৈধ প্রতিরক্ষা চুক্তি থেকে তিলক রত্নের কোম্পানী অনেক অর্থ কামিয়েছে‘ , ‘অনেক অর্থ তিলকরত্নে কামিয়েছেন বলে অভিযোগশুদ্ধ বাংলাতে হওয়া  উচিত ছিল উপার্জন করেছেনউপার্জন অর্থে কামাইশব্দের ব্যবহার সিলেটি-কাছাড়িতে আছেলেখক তাই দিব্বি কাগজে চালিয়ে দিয়েছেন অসমিয়া প্রভাবের নজির এই কথাগুলোঃ ৩ ডিসেম্বর,০৯এ পরেশ বরুয়া ছাড়া ফলপ্রসূ হবে না শান্তি আলোচনা এই শিরোনামাতে সংবাদে লেখা হয়েছেঃ ১)কিন্তু পরেশ অবিহনে শান্তি আলোচনা অনুষ্ঠিত করলে ফল বিপরীত হতে পারে ২) মুকুল মহন্ত বলেছেন আলোচনার প্রতি আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হওয়ার ক্ষেত্রে পিসিজি পূর্ণ সহযোগ করবে প্রথম বাক্যের অবিহনে এবং দ্বিতীয় বাক্যের সহযোগ করবে অসমিয়া থেকে সরাসরি অনুবাদে চলে এসছেঅথচ শুদ্ধ ও প্রচলিত বাংলাতে হওয়া উচিত ছিল ছাড়াই এবং সহযোগিতা করবেহিন্দির প্রভাবে ভাষার পরিবর্তনতো আজকাল সবেতেই জলভাতের মতো কথা৫ডিসেম্বরে ,০৯  যুগশঙ্খের তৃতীয় পৃষ্ঠাতে সংবাদ শিরোনাম মেজাজ হারালেও প্রণবজীর দক্ষতা মানতেই হবেঃ সুষমাএই সংবাদে লেখা হয়েছেঃ ইতিমধ্যে সিপিএমের বৃন্দা কারাতের সঙ্গেও তিনি কড়াভাবে পেশ হয়েছেন প্রণবজীটা নাহয় মানা গেল, নেতাজী যখন আছেন তিনিও থাকতে পারেনপেশ হয়েছেনটা কোন দেশের বাংলা? আরো মজার নজির এই সংবাদঃ ১০ফেব্রুয়ারি, ১০ তারিখের যুগশঙ্খের  পাঁচ পৃষ্ঠার এক সংবাদে লিখেছেঃ দুষ্প্রাপ্য হুদু চড়াইয়ের অস্বাভাবিক মৃত্যুএই শিরোনামের সংবাদ শুরু হয়েছে এই বলে,” দুদুটি দুষ্প্রাপ্য হুদু পাখির অস্বাভাবিক মৃত্যুতে এলাকার মানুষ চিন্তিত হয়ে পড়েছেন...  চড়াই বাংলাতে এক বিশেষ পাখি ইংরেজিতে যাকে Sparrow বলেসব পাখিকে চরাইবলে অসমিয়াতেনিশ্চিত যে এখানে তার প্রভাব পড়েছে শুধু তাই নয়, হুদু হচ্ছে সেই পেঁচা পাখি যে ডাকলে বা যাকে দেখলে অমঙ্গল হয়বাংলাতে এই অপবাদ আছে লক্ষীপেঁচাহতে পারে হুদু ঐ লক্ষীপেঁচাইসাংবাদিকটির সে জিজ্ঞাসা নিয়ে ভাববার সময় ছিলনা হয়তো, কলমের ডগাতে যা এসছে লেখে ফেলেছেন কিন্তু এরকম ভুলই যে একটি সল্প পরিচিত জনগোষ্ঠীর কাছে কতটা অপমানজনক হতে পারে তার নজির এই সংবাদঃ ২০ জানুয়ারি, ১০ তারিখের যুগশঙ্খে  এনএসসিএন (আই এম)-এর মদতেই উত্তর কাছেড়ে জঙ্গি তৎপরতাশীর্ষক সংবাদে এক জায়গাতে লেখা হয়েছে এই জঙ্গি তৎপরতায় এনএসসিএন (আই এম)- ছাড়াও হোমার পিপল কনভেনশনও (এইচপিচি) জড়িতইংরেজি Hmar এই সংবাদে হয়েছে হোমারহওয়া উচিৎ মাড়বাঙালিরা যে শুধু নিজের জাতি ও ভাষা সম্পর্কেই কতটা অজ্ঞ তাই নয়  পূর্বোত্তরের  অন্য জনগোষ্ঠিদের সম্পর্কে কত অজ্ঞ, এটা একটা নজির অথচ কাছাড়, উত্তর কাছাড়ে মাড়েরা  বেশ সুপরিচিত জনগোষ্ঠী
এই লেখকেরা যখন বাংলাতে স্কুলপাঠ্য বই লেখার বরাত পান তখন সেখানেও তাঁরা এমন ভাষা বদলের সুমহান কীর্তি  অনায়াসে করে ফেলেনসেই বই বরাক উপত্যকাতে পৌঁছুলে যখন কেউ কেউ অসমিয়া আগ্রাসনের নজির দেখে পথে নেমে প্রতিবাদের ধ্বজা তুলেন তখন আমার ভীষণ হাসি পায়একেই বলে উদোর পিন্ডি বুধোর ঘাড়েহয়, সেই বাঙালি লেখকদের কাজের আন্তরিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলুন নতুবা এসব পরিবর্তনকে অসমের মতো বহুভাষিক রাজ্যে এক স্বাভাবিক স্বাস্থ্যের লক্ষণ বলে গ্রহণ করুন। বস্তুত ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার বহু কবি লেখকেরা সে কাজটাই সজ্ঞানে করে চলেছেন। যেমন প্রখ্যাত ঐতিহাসিক ও কবি অমলেন্দু গুহের এক কবিতার ক'টি পংক্তি এরকম,     "...সাদা ধবধবে লুইতের পার কাছিমেরা ডিম পাড়ে/আমার ভায়ের মুখে চমকায় মিতালির ভালোবাসা,/দিঘলিদিঘির কোণটায় বসে গান গায় বারে বারে,/ও মোর অসম দেশ মরমিয়া, আ মরি বাংলা ভাষা।..." এতে '  লুইত, দিঘলি,মরমিয়া'  এমন কি 'মোর' শব্দটিও অসমিয়াই, কেননা শব্দটি এখন আর বাংলাতে কেউ লেখে না।
           এগুলোকে স্বাস্থ্যের লক্ষণ বললে কারো  কারো গোঁসা চড়তে পারে।  তাই  আরো কিছু প্রতিষ্ঠিত  নজির তুলে ধরলে ভালো হবেআমরা সবাই জানি ২১ ফেব্রুয়ারি দিনটি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসএর পেছনে বাংলা ভাষা নিয়ে লড়াইয়ের এক বড় যোগদান রয়েছেঅথচ কেউ কোনোদিন প্রশ্ন করিনি যে পদগুচ্ছটির প্রথম আন্তর্জাতিক শব্দটিই সঠিক কিনাইংরাজি International এর নকলে শব্দটিকে যে চালিয়ে গেছি তাই নয়, তারই অনুকরণে আবার আন্তঃসম্প্রদায়, আন্তঃমহাবিদ্যালয় ইত্যাদি শব্দও তৈরি করে নিয়েছিশুদ্ধ অর্থে শব্দটি হওয়া উচিত ছিল সর্বজাতিকমাস্টার মশাইরা ভুল লেখেন এবং লিখতে বলেন এরকম আরো কিছু বিখ্যাত শব্দ হলোঃ জীবনী, প্রাগৈতিহাসিক, সমসাময়িক, বার্ষিকী, মণ্ডলী, শতাব্দী ইত্যাদিসুতরাং আমাদের পরামর্শ হলোছাত্ররা ইচ্ছে মতো ভুল বানান, ভুল ভাষা লিখে যেতে পারেভুল করবার সাহস না করতে পারলে কে আর কবে শুদ্ধটা রপ্ত করতে পেরেছে?  এ নিয়ে অহেতুক রাতের ঘুম বারোটা বাজাবার কারণ দেখি না
          কেউ কেউ যে আমাদের সে ঘুমে ব্যাঘাত ঘটান তার অনেক সঙ্গত কারণ আছে বটে, কিন্তু একটা কারণতো এই যে তাঁদের সংস্কৃতের ঐতিহ্য সূত্রে পাওয়া পণ্ডিতি অভিমান প্রচণ্ডদুই সহস্রাধিক বছর সংস্কৃত ব্যাকরণের শাসনে থেকে আমাদেরও সেই শাসন-রোগে পেয়ে বসে আছেএকেতো সংস্কৃত ব্যাকরণের নকলে বাংলা ব্যাকরণ টিকিয়ে রেখে দিব্যি ছাত্র পড়াচ্ছিতায় আবার অন্যত্র নীরব থাকলেও বানান ভুল করলেই সেই নকল মোটা-ব্যাকরণ মাথায় ছূঁড়ে মারবার জন্যে সংস্কৃতায়িত হাত আমাদের নিসপিস করেবিদ্যাসাগর যখন বাংলা বর্ণমালা থেকে ঋৃ ( দীর্ঘ ঋ) আর ৯(দীর্ঘ ৯) কে বাদ দিয়েছিলেন তখনো সে পণ্ডিতদের হাত কম নিশপিশ করেনি ভাগ্যিস! তিনি তাতে বিচলিত হননি
            তা, ভুল করা যেতেই পারেকিন্তু মুস্কিল হলো, পঁচিশ কোটি বাঙালি যদি পঁচিশ কোটি রকমের বাংলা লিখতে শুরু করে তা হলেতো হয়েই গেলসে ভাষা নিয়ে আর কাজ কী? কেউতো আর কারো কথা বুঝবে না যে যার নিজের সাতকাহন লিখে যাবে, পড়বার কেউ থাকবে নাভাগ্যিস! বাস্তবে এরকমটা হয় নাভাষা তার আপন সামঞ্জস্য নিজেই অনেকটা বাঁচিয়ে রাখেঅথবা বোধহয় বলা ভালো ব্যক্তি মানুষ ভাষার ব্যবহারের বিশৃঙ্খলা বাড়ালেও সমষ্টি মানুষ একটা শৃঙ্খলা নিয়েই আসেবিচিত্র সব কারক কাজ করে তার পেছনেতবুও রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, এমন একটা অনুশাসন দরকার যাতে প্রকৃত বাংলার লিখনে বানানের সাম্য সর্বত্র রক্ষিত হতে পারে আমরাও তাঁর এ পরামর্শে দ্বিরুক্তি করি নানিজের ঘরে যা হোক একটা কিছু ডাল-ভাতে রোজকার খাবার চলে যায়কিন্তু ঘরে দুজন অতিথি এলেই মাছ-মাংস কিছু একটা ভালো ব্যবস্থা করতে হয়আর বিয়াপার কিছু হলেতো কথাই নেইসেদিন পাচক থেকে শুরু করে রান্নার উপকরণ, পদের রূপ রস গন্ধ স্বাদ সবই মোটের উপর সর্বমান্য হওয়া চাইহয় না, কিন্তু চেষ্টাটা সেরকমই থাকা চাই অনুশাসনটা অতিথি সেবার জন্য হওয়া চাইসে অনুশাসন যদি গায়ে পড়ে খাবারকে রক্ষা করবার দায় নিতে চায় তবে আর হয়েই গেলঅতিথি অভুক্ত থাকাটা আর কেউ আটকাতে পারবে নাভাষা ব্যবহারের কথাও তাই
             সংস্কৃত স্বতন্ত্র ভাষাই নয়ব্যাকরণ প্রভুর নির্দেশে সে ওঠ বস করেবাংলা সচল স্বতন্ত্র ভাষা, ব্যাকরণকে সে বরং কখনো সখনো কাজে সহায় হবে বলে অনুচরের মতো কাজে লাগায়লোকে যখন গাড়ি চড়ে বাড়ি যাবার কথা বলে তখন অনুশাসন তাদের গাড়ী করতে বাড়ী বয়ে নিয়ে যেতে চাইলেই মুস্কিলসুজ্যি যখন পূব আকাশে পাড়ি জমায়, পাখি যখন দিনের প্রথম গানটি গেয়ে উঠে তখন সুজ্যি নয় সূর্য; পূব নয় পূর্ব নয় পূর্ব্ব ; পাখি নয় পাখী এসব মরা কথার কড়া সুর শুনতে কারই বা ভালো লাগে অনুশাসনের বুড়ো ঠাকুরদাকে তখন সবিনয়ে বলা যেতেই পারে , মহাশয়, বৃদ্ধ হইয়াছেনআপাততঃ বিশ্রাম গ্রহণ করিলে আপনার এবং আমাদের উভয় পক্ষের স্বাস্থ্যর পক্ষে তাহা অতীব সুখের বিষয় বলিয়া বিবেচিত হইবে এ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের এক উক্তি মনে পড়ছেঃ সংস্কৃত সব্দ বাংলায় অনেক আছে, এবং চিরদিনই থাকিবেইসেখানে সংকৃতের রূপ ও প্রকৃতি আমাদের মানিতেই হইবেকিন্তু যেখানে বাংলা শব্দ বাংলাই সেখানেও শাসন যদি আমরা টানিয়া আনি, তবে রাস্তা যে পুলিশ আছে ঘরের ব্যবস্থার জন্যেও তাহার গুঁতো ডাকিয়া আনার মতো হয়সংস্কৃতে কর্ণ লিখিবার সময় মূর্ধণ্য ণ ব্যবহার করিতে আমরা বাধ্য, কিন্তু কান লিখিবার বেলাও যদি সংস্কৃত অভিধানের  কানমলা খাইতে হয় তবে এ পীড়ন সহিব কেন?
    রবীন্দ্রনাথের অনুরোধে অনুশাসন তৈরির একটা শুরুয়াত ত্রিশের দশকে করেছিল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় তখন উপাচার্য ছিলেনবিশ্ববিদ্যালয় একটা সমিতি তৈরি করেছিলআর সে সমিতি কেবল অ-তৎসম শব্দগুলোর বানান রীতি নির্দেশিকা স্থির করে একটি পুস্তিকা ১৯৩৬এর মে মাসে বের করেছিলপরবর্তী জুন মাসের মধ্যে সে পুস্তিকার তৃতীয় সংস্করণও বেরিয়ে গেছিলকিন্তু হলে হবে কি? বানান পণ্ডিতেরা কখনো নির্বিরোধ কিছু মেনেছেন কি? সে সমিতি কিছু বিকল্প বানান প্রস্তাবও দিয়েছিলতাতে এতো প্রবল ঝড় উঠেছিল যে বহুদিন এরপর আর কেউ তেমন চেষ্টা করবার মতো উৎসাহ জোটাতে পারেন নিস্বাধীন বাংলাদেশে কিছু হয়ে থাকলে আমরা তেমন খবর জানি নাসাতের দশকের শেষে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় দ্বিতীয় আরেক বানান সংস্কার সমিতি তৈরি করেছিলকিন্তু সেটি তার কাজ করেই উঠতে পারেনিশেষে আশির দশকের মাঝামাঝি পশ্চিম বঙ্গ বাংলা আকাদেমি একটি বানান সংস্কার উপ-সমিতি গঠন করেতার পরামর্শ সবাই মেনে নেয় নিআনন্দ বাজার পত্রিকাও তাদের নিজেদের মতো করে এক প্রয়াস করেছিলসে দুটির মধ্যে বহু ঐক্য থাকলেও অনৈক্যও কম নেই কিছুরবীন্দ্রনাথের সেই সর্বত্র সাম্য রক্ষা করবার মতো অনুশাসন এখনো গড়া যায় নিকোনোদিন যাবেও নাবিশৃঙ্খলার তত্ব যারা বোঝেন তাঁরা এ নিয়ে কোনো গোঁ ধরেনো না আরএখনকার শিক্ষিত জন মোটা মোটি এই দুই উদ্যোগের দ্বারাই কমবেশি প্রভাবিত অধিকাংশই আকাদেমির বানান বিধি অনুসরণ করে থাকেনবিধি মাত্রেই অনুসরণ করা খুবই কঠিনআইন জানি না বললে আদালত শোনে না বটে, তবু বাস্তব এই যে লোকে আইনের বিষয়ে খুবই কম জানেধর্মবিধি যাতে লোকে ভুলে না যায় তার জন্য দৈনন্দিন ধর্মগ্রন্থ পাঠের প্রস্তাব প্রায় সব ধর্মেই আছেযারা সে নির্দেশ অনুসরণ করে তারা যে কী রকম বিধির বাঁধনে ধর্মকেই ফেলে সে আমরা হররোজ দেখে আসছিসুতরাং বিধি মুখস্থ  করবার পরামর্শ আমরা কিছুতেই দেব না এ হলো আমাদের প্রথম টিপ
    রবীন্দ্রনাথ ছাড়াও সুনীতি চট্টপাধ্যায় থেকে রামেশ্বর শ্ব হয়ে পবিত্র সরকারদের মতো ভারত বিখ্যাত ভাষাবিদদের গেল এক শতাব্দি জোড়া সাধনার একটা লাভ হয়েছে এই যে আমরা একটা কথা সহজ করে বুঝে গেছিবাংলা এতো মিষ্টি ভাষা কেন সে প্রশ্ন যদি কেউ করে, তার প্রশ্নের জবাবটা জেনে গেছিমেদ কমালে কাকেই বা মিষ্টি না দেখায়! সংস্কৃত একটি মেদবহুল ভাষা, বাংলা তার উল্টোটা ছিল না, এরকমটা ছিল নাতারও মেদ প্রচুর ছিলরীতিমতো ঘাম ঝরিয়ে মেদ কমাতে হয়েছে, আর এখনো সে চেষ্টাতে তার কোনো কার্পণ্য নেইযিনি এই কথাটি না বুঝবেন, তিনি বাংলা ভাষার মর্ম কথাটিই বুঝবেন নাঅদ্য বিকাল তিন ঘটিকায় বিদ্যালয় প্রাঙ্গনে এক মহতী সভা অনুষ্ঠিত হইবে...  এধরণের বাংলা উনিশ শতকে শিক্ষিত লোকেরাই গড়ে তুলেছিলেন, কিন্তু একুশ শতকে কেবল অশিক্ষিত লোকেই ব্যবহার করে যার ভাষাটির মর্মধর্মের সম্পর্কে কোনো সাধারণ জ্ঞানই নেই
মেদ ঝরাবার চেষ্টাতে আকাদেমি বাংলা লিপিকে নিয়েও পড়েছিলআর খুব ভালো কাজ করেছিলকী অদ্ভূৎ না, আমরা বর্ণমালাতে ঋ-র পর ৯, য-এর পর ব পড়ে এসছি, অথচ ব্যবহার বিশেষ করিনিকখনো প্রশ্ন করিনি ণ, ঞ, য, ঢ়, ষ এগুলোর উচ্চারণ কী রকম? এগুলো বর্ণমালাতে আছে কী করতে? আর যুক্তাক্ষর ক্ষ, ঙ্গ, হু, হ্ম, ণ্ড, ত্থ, ক্র,ত্রু, রূ, গু, শু-ইত্যাদির কী চেহারা! এগুলোর মানেটা কী?  অথচ ঠিক করে না লিখতে পারবার জন্যে মাস্টার মশায়ের কতনা বেতের মার নীরবে সহ্য করে গেছি! হলহেড সাহেব ছাত্রদের জন্য বাংলার প্রথম যে ব্যাকরণ লিখেছিলেন  সেটি ছাপবার বেলা বাংলা প্রাচীন পুথির আদর্শে উইলকিনসন সাহেব পঞ্চানন কর্মকারের হাত দিয়ে লিপিগুলো তৈরি করে দিয়েছিলেনসেই লিপি এখনো চলছেরাজা রামমোহন রায় তাঁর গৌড়ীয় ব্যাকরণে সেই তখনই (১৮৩৩) এগুলোর যৌক্তিকতা  নিয়ে সংশয় জানিয়ে রেখেছিলেনসেই লিপি শতাব্দি ধরে এই কিম্ভূতকিমাকার যুক্তাক্ষরগুলো বেমালুম চলে আসছেকিছু কিছু অবশ্য আমাদের অভ্যাসে এতো দৃঢ়মূল হয়ে গেছে যে চট জলদি স্বভাব পালটানো মুসকিল আছেযেমনঃ ক্ষ না  লিখে /ক্ ষ/, হ্ম না লিখে /হ্ ম/  লেখার সমস্যা আছেকিন্তু ক্র না লিখে ক-এর নিচে র-ফলা  , ত্রু না লিখে ত-এর নিচে র-ফলা এবং তাতে উ-কার কিম্বা , গুরু না লিখে গ এবং র-এর নিচে উ-কার  (  ইউনিকোডে ঠিক নতুন প্রস্তাবটা লিখে দেখানো যাচ্ছে না  বলে দুঃখিত। )   লিখলে শেখা এবং বোঝা দুটোই কী সহজ হয়ে যায় না? এগুলো আজকাল চলছেএবং চলবেহুজুগের মতো সহজে বিদেয় নেবে নাএরকম মেদ ঝরাবার কাজে নিজেকে ব্যস্ত করলে বাংলা ভাষা ও বানান এমনি এমনি শুদ্ধ আর মিস্টি হতে থাকবেএ হলো আমাদের দ্বিতীয় টিপ
শুদ্ধবাদিরা অবশ্য তাতে প্রচন্ড রাগ করবেন, তাদের সে রাগে গুরুত্ব না দিলেই হলোশুদ্ধবাদিরা অবশ্যি পণ্ডিত মানুষকিন্তু পণ্ডিতেরা আর প্রগতি আনলেন কবে? তারাতো কেবল ঐতিহ্য আর পরম্পরা বিপন্ন হবার আতংকে কাল কাটিয়ে গেলেনভাগ্যিস, প্রমথ  চৌধুরী রবীন্দ্রনাথের মতো বলবানকে সঙ্গে পেয়েছিলেন! নইলে সাধু বাংলাকে বিদায় জানাবার যেরকম প্রয়াস তিনি করেছিলেন, সাধুরা তাঁর প্রাণ বিপন্ন করে তুলতেনএখনো অসমের বিদ্যালয়গুলো বাংলা প্রশ্নপত্রে সেই সাধুরা অক্ষয় গৌরবে বিরাজ করেনকাল যত কলি হয় তাঁরা ততই কল্কি আসার অপেক্ষাতে সতর্ক আর বিনিদ্র রজনী যাপন করেন! আমরা না সাধু পুরুষ, না শুদ্ধ মানুষশুদ্ধ বানান লেখার কথা বলবার মানে যদি এই হয় যে পুরোণো মেদ বহুল ভাষাকে রক্ষা করা, আমরা তার মধ্যে নেইবরং বলব, চলুন, আমরা ভুল করিবেশ করিভালো করিচলুন, মেদ আমরা মেদ ঝরাইভাষাকে সহজ করি, সরল করিযত আবর্জনা, সব বিদেয় করি
আমাদের জটিলতা কোথায় হয়? কোথায় আমরা দিশা হারাইসব বানানে আমরা জট পাকাই নাআম লিখতে গেলে খুব অন্যমনস্ক না হলে  কেউ আমরা জাম লিখি নাআমাদের সমস্যা হলো সমষ্যালিখব কিনা তাই নিয়েভুল লিখতে গিয়ে ভূল লিখে ফেলিবই পরা শেস করে জামা পড়ে ঘড় থেকে বেড়িয়ে বাজার হয়ে এক বন্ধুর বারি দিব্যি বেরিয়ে আশিটেড়ও পাই না কোথাও একটা বর গণ্ডগোল হয়ে গেছে সমোচ্চারিত বা প্রায় সমোচ্চারিত ধ্বনি হলেই সব কেমন তালগোল পাকিয়ে যায়এছাড়াও জট পাকায় যদি শব্দে যুক্তাক্ষর থাকেআর যুক্তাক্ষরগুলোই জোর গলায় মেদ ঝরানোর সাক্ষর যোগায়সপ্ত=সাত, ভক্ত=ভাত হলো বলেই না ভাষা বাংলা জন্মালোযেখানে তা হলো না, সেখানেও বানানে মূলের বর্ণগুলো অক্ষত থেকেও উচ্চারণে রইল নাবানানে লক্ষণ থাকলেও উচ্চারণ আমরা লোক্খন করিআর শেষের অ-স্বরটির ব্যবহার বাংলাতে প্রায় নেই বললেই চলেবিশ্বকে উচ্চারণে আমরা বিশশ করে ফেলিবিস্ময়কে করি বিশশয়এরকম গণ্ডগোলের জন্যে সান্ত্বনা লিখতে গিয়ে প্রায়ই আমরা সান্তনা বা শান্তনা লিখে ফেলিএগুলো মূলত সংস্কৃত থেকে হুবহু বাংলাতে আসা তৎসম শব্দ নিয়ে হওয়া সমস্যাএ সমস্যা আছে আর থাকবেওকারণ, একেতো সংস্কৃত ব্যাকরণ নির্দেশিত ভাষাদ্বিতীয়তঃ তার উপর একা বাঙালির কোনো অধিকার নেইসেগুলোতে আমাদের ব্যাকরণের মার সহ্য করতেই হবেতথাপি, যেগুলো বাংলাতে বহুল ব্যবহৃত হচ্ছে সেগুলোতে রবীন্দ্রনাথের পরেও অনেকেই কাঁচি চালাবার পরামর্শ দিচ্ছেনযেমন আজকালঃ
১)তদ্ভবতেতো বটেই, তৎসমতেও রেফের পর ব্যঞ্জন বর্ণের দ্বিত্ব হয় নাঅর্থাৎ পূর্ব্ব, অর্চ্চনা, কর্ত্তা, কর্ম্ম, ধর্ম্ম ; ইত্যাদি লেখার দায় নেইসোজা পূর্ব,অর্চনা, কর্তা ইত্যাদি লিখলেই হল
         ২) (ক) যুক্তাক্ষরে নাসিক্য ধ্বনির ব্যবহারে সংস্কৃত এক মজার নিয়ম ছিলপরের ধ্বনিটি যে বর্গের আগের নাসিক্য ধ্বনিটি সাধারণত সেই বর্গের হতোযেমনঃ গঙ্গা, পঞ্চম, কণ্টক, সম্মন্ধ ইত্যাদিবাংলাতেও প্রায় তাই আছে
             (খ)  কিন্তু আর এর জায়গাতে হামলা চালিয়ে তার সাম্রাজ্যের অনেকটাই বিস্তার ঘটিয়েছেএবং  মার্কিন সাম্রাজ্যবাদিদের মত এখন অব্দি থামবার নাম করছে নাবিদ্যাসাগর মশাই লিখতেন বাঙ্গালাআমরা তাকে কত সহজ আর মিষ্টি করে বাংলা করে ফেলেছিকার সাহস, আমাদের ব্যাকরণে ভুল দেখায়? সন্ধিতে কারের জায়গাতে এর বিকল্প বিধান সংস্কৃতেই ছিলযেমনঃ ভয়ংকর, সংগম  বানানগুলো চলতবিশ্ববিদ্যালয় তার অনুসরণে অলংকার, সংগীত, সংঘ লিখবার বিধান  অনেক আগেই দিয়েছিলআর এতো দিনে আমরা অভ্যস্তও হয়ে গেছি
          (গ) সন্ধি ছাড়া অন্যত্র তৎসম শব্দের বানানে বাদ দেবার বিধান কেউ দেননিকিন্তু আমাদের মতো ব্যাকরণ না মানা অল্প-শিক্ষিতেরা এতো দুর্দণ্ড প্রতাপে র ব্যবহার চালিয়ে অংক,সংগ , গংগা, বাংলা, মংগল, লিখে গেলাম যে প্রবোধচন্দ্র সেনের মতো কেউ কেউ আমাদের পক্ষে দাঁড়িয়ে বললেন, ভালোই হলো এতে ভ্রান্তি কম হবে এবং যুক্তাক্ষরের ব্যবহারও কিছু কম হবে এরকমই হয়, সাধারণে আগে ভাষা পাল্টায়, পণ্ডিতেরা পরে তা নিয়ে মত দাঁড় করান
            (ঘ) কিছু বানানে অবশ্যি আমরা এতোতাই অব্যস্ত যে কে সেখানে নাক গলাতে দিতে রুচিতে বাঁধেঅম্বর,কম্বল,ডিম্ব, সম্বলএগুলো এখনো পাল্টায়নি
              (ঙ) আবার এর সংগে স্বর যুক্ত করতে না পারার একটা সমস্যা আছে সেখানে রেখে দেয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজযেমনঃ বাংলা’—কিন্তু বাঙালিবাঙালির মতো কিছু শব্দে ঙ্গ-এর ধ্বনিটি একেবারেই খসে পড়াটাও লক্ষ্য করবার মতো
          ৩. সংগে স্বরধ্বনি নিয়ে তৈরি যুক্তাক্ষরগুলোকে আমরা প্রায়ই যুক্তাক্ষর বলি নাবোধহয় পদান্ত স্বরকে ঝেড়ে ফেলবার আমাদের এক অন্তর্লীন প্রবণতা আছে, তাইকিন্তু , তুমি গাছ থেকে নাম আর তুই গাছ তেকে নাম--এই বাক্যে নাম শব্দের উচ্চারণ আর অর্থ কোনতাই এক নয়শেষেরটিতে ম-এর পরে পদান্ত অ-টি নেইসে আমরা অভ্যাস বশে বুঝে যাই । কোথাও বুঝবার সমস্যা হলে, বিশেষ করে যদি স্বল্প পরিচিত বিদেশী শব্দ হয় একটা হস (্  ) চিহ্ন দিয়ে দেওয়া হয়যেমনঃ তখ্ ত, জেম্ স বণ্ড্ ইত্যাদি অন্যত্র এর ব্যবহার জট পাকায় বৈ কমায় নাকলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় অ-সংস্কৃত শব্দে শুধু হস (্) বাদ দেবার পরামর্শ দিয়েছিলেনকিন্তু লোকে তৎসমতেও তা আজকাল ব্যবহার করছে নাআকাদেমি বলে দিয়েছেন, শব্দান্তে হস্ চিহ্ন দেওয়ার প্রয়োজন নেইবিদ্বান্ না লিখে বিদ্বান লেখাই সংগত
         ৪. ব্যঞ্জনের সাথে যুক্ত ই,ঈ,উ,ঊকারের ব্যবহার অত্যন্ত পীড়াদায়ককোথায় যে কোনটা বসবে তা সারা জীবনেও স্থির করা সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়
          (ক) আকাদেমি বলছেন, তদ্ভব শব্দে প্রায় সর্বত্র দীর্ঘ ধ্বনি দুটোকে (ঈ,ঊ) বাদ দেয়াই বুদ্ধিমানের কাজপাখি, বাড়ি, শাড়ি, উনিশ, উর্বর, কুমির, শ্রেণি চলবেপাখী , বাড়ী, ঊনিশ ইত্যাদি না লিখলেও চলবে
          (খ) দেশ জাতি লিঙ্গ বোঝাতে কার লাগবেই এমন যুক্তির পক্ষেও আকাদেমি কোনো সমর্থণ পাননিতারা তাই জাপানি,বাঙালি, ইংরাজি, আরবি লিখবার পরামর্শ দিয়েছেন
          (গ) উপযোগিতা, প্রতিযোগিতা, স্বামীস্ত্রী ইত্যাদি বানান লিখতে গিয়ে প্রায়ই আমাদের এক বিচিত্র অভিজ্ঞতা হয়মূল শব্দগুলো তৎসম আর সেগুলোর শেষে -কার যুক্ত হয় উপযোগী, প্রতিযোগী, স্বামী ইত্যাদি কিন্তু প্রত্যয়যুক্ত হলেই বা অন্যে শব্দের সাথে সন্ধি হলেই কার এসে জুড়ে বসে। রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত অনেকেই এ নিয়ম পাল্টাবার কথা ভাবেন নি। আমরা প্রায়ই উপযোগীতা, প্রতিযোগীতা, মনস্বীতা মন্ত্রীসভা  লিখবার মতো ভুল করেই বসি। এগুলোর উৎপাত খুব কম নয়। বাংলাতে এমন শব্দ সংখ্যা           প্রচুর ।মূল শব্দের ঈ-কারতো পাল্টানো যাবে না। তাই আকাদেমির প্রস্তাব , সংস্কৃত ইন প্রত্যয়যুক্ত পদের শেষে যে দীর্ঘ -কার হয় তা ভিন্ন প্রত্যয়যোগে বা সমাসনির্মাণেও হ্রস্ব কার হবে না, দীর্ঘ ঈ-কারই থাকবে। এতে শব্দগুলোর বদ্ধ আর স্বতন্ত্র রূপের মধ্যে বৈষাদৃশ্য থাকবে না, জটিলতাও কমবে। সুতরাং নির্বিকার প্রতিযোগীতা, মন্ত্রীসভা, স্বামীস্ত্রী লেখা যাবে।
        (ঘ) অর্থ যেখানে পালটে যাবে সেখানে সরলীকরণের কোনো নীতিই খাটবে না কূল আর কুল-কে এক করা যাবে না। তেমনি আর কীএর মধ্যে তালগোল পাকানো যাবে না।
        (ঙ) অভ্যাসে আটকালেও কখনো কখনো চাইলেও দীর্ঘ স্বরকে বাদ দেয়া যায় না জিবন লিখলে সত্যি জীবন নিয়ে টানাটানি পড়ে যেতে পারে।
        ৫. খুবই নীরবে, বেশ ভালো রকমই মুস্কিলে ফেলে -কার কারের ব্যবহার। ছেলেটি বড় ভাল, মেয়েটি কী কালগো! এরকম কথা বললে নারীবাদিরা রাগ করতে পারে , বানানবাদিরা রাগ করবার খুব একটা উদাহরণ নেই। কিন্তু করা উচিত। আমার অভিমত তোমার মত নয়এবাক্যটার অর্থ কী দাঁড়ালো?  এরকম গণ্ডগোল এড়াবার জন্যে  শব্দগুলোর যেটির উচ্চারণে পদান্ত -কার আছে তার শেষে স্পষ্ট করেই কার দিয়ে দেওয়াই ভালো। সে অনুযায়ী ছেলেটি ভালো (ভাল কপাল), মেয়েটি কালো (কাল সময়), তোমার মতো (মত অভিমত, চিন্তাধারা) করে ফেলাই সমীচীন। বানান পাল্টালে অর্থ পাল্টে যায় এরকম আর কিছু শব্দ বিশেষ করেই মনে রাখতে হয়।
         ৬. বাংলা তদ্ভব উচ্চারণে য-এর ব্যবহার নেই। বানানেও প্রায় হয়ই না। এই কথাতা স্পষ্ট জেনে নেওয়া ভালো।
            (ক) সংস্কৃত 'যা'-এর মতো ধাতু থেকে উৎপন্ন কিছু শব্দ আর যখন, যেমন এর মতো অব্যয় কটিতেই তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে। তা নইলে আমরা যুগল-কে জোড়, যাতৃ-কে জা, কার্য্য-কে কাজ বানিয়ে -কার নিয়ে এসে সহজ করে রেখেছি।
           (খ) খুব বাধ্য না হলে -ফলার ব্যবহারও অক্ষত রাখিনি। বিশেষ করে পদান্ত -এর পর আবার য-ফলাতো আমাদের কাছে অসহ্য মনে হয়েছে। তাই আজকাল আমরা নির্বিকার কার্য্যও আর লিখিনা। কার্য, সূর্য, ভট্টাচার্য ইত্যাদি লিখে চলেছি।
          ৭. এরকম বাংলাতে একটি উপদ্রবী ধ্বনি। এর উচ্চারণ কেউ জানে না। অন্য মূর্ধণ্য ধ্বনির সঙ্গেই এর যৎ সামান্য কিছু উচ্চারণ বেরোয়। ন-এর স্বতন্ত্র উচ্চারণ আছে।
           (ক) সুতরাং সর্বত্র -এর ব্যবহারে কাজ চলে যায়। রাণী না লিখে রানি লিখলে তার আভিজাত্য মোটেও খাটো হয়ে যায় না।
           (খ) অনেকেতো ঘুণ্টি, ঠাণ্ডা, লণ্ঠন না লিখে ঘুন্টি,ঠান্ডা, লন্ঠন লিখবার পরামর্শ দিয়ে থাকেন। আমরাও তাতে আপত্তি করবার কারণ দেখি না।
           (গ) ভারতীয় আর্য ভাষাতে মূর্ধণ্য ধ্বনিগুলো অনেক পরের সংযোজন ।সম্ভবতঃ দ্রাবিড় ভাষার প্রভাবে। কিন্তু তার পর এতো জাঁকিয়ে বসেছে যে সবসময়ই এক স্বতন্ত্র মর্যাদার আব্দার নিয়ে এসে হাজির হয়। বাংলাতেও বিশুদ্ধ মূর্ধণ্য ধ্বনি নেই। এগুলো উত্তর দন্ত মূলীয়। সে যাই হোক মূর্ধণ্য ধ্বনির যোগে তৈরি প্রচুর তৎসম শব্দ বাংলাতে প্রচলিত আছে। সুতরাং এর অত্যাচার সহ্য করা ছাড়া উপায় নেই।
          (অ) এ নিয়ে একটি সহজ নিয়ম অবশ্য বহুল প্রচলিত আছে আর  আমরা সবাই জানিও। তা এই  যে, পরে অন্য মূর্ধণ্য বর্ণ থাকলে বা আগে ঋ,র , ষ থাকলে নাসিক্য ধ্বনিটি হয়।  যেমনঃ ঋণ, পরিমাণ,তৃণ, কণ্টক ইত্যাদি। বাদ বাকি নিয়মগুলো বেশ জটিল। একটু কষ্ট করে মনে রাখলেই মান বাঁচানো সহজ হবে।
         (আ) পর-,পার-, উত্তর-,চান্দ্র-,নার-,নারা- এবং রাম- শব্দের পরের অয়ন শব্দে ’—‘ হয়ে যায়। যেমনঃ রামায়ণ, নারায়ণ ইত্যাদি। অন্যত্র যা ছিল তাই থাকে। যেমনঃ রবীন্দ্রায়ন, মূল্যায়ন।
         (ই)  সে রকমই প্র, পূর্ব, অপর পুরসর্গের পর অহ্ন শব্দের –‘ হবে। প্রাহ্ণ, পূর্বাহ্ণ, অপরাহ্ণ। কিন্তু মধ্যাহ্ন, সায়াহ্ন। সময় বোঝাবার এই শব্দগুলোর ব্যবহার আজকাল অতি অল্প,তাই রক্ষে।
         (ঈ) ত্রিনয়ন, দুর্নাম, এরকম কিছু সমাসবদ্ধ পদের পূর্ব পদে ঋ,র,ষ থাকলেও উত্তর পদে হবে না।
          ৮. শিস দেয়াটা খুব ভালো গুণ নয়। মেয়েদের সামনেতো কস্মিন কালেও নয়। এই শিস ধ্বনি কেবল মেয়েদেরই উত্যক্ত করে না, ভাষাকেও বড় বিপাকে ফেলে। বাংলাতে এক ছাড়া আর কারো কোনো স্বতন্ত্র উচ্চারন নেই। সার আর ষাঢ় না লিখে শার লিখলে উচ্চারণে কোনো গোল হবে না। দন্ত্য ধ্বনির সাথে আর মূর্ধণ্য ধ্বনির সাথে এর কিছু উচ্চারণ শুধু কতকগুলো যুক্তাক্ষরে আছে। সেগুলোও বেশির ভাগ তৎসম। যেমনঃ স্মৃতি ,কষ্ট, ইত্যাদি। তার জন্যে অন্যত্র যেমনটি হয়েছে এখানেও সর্বত্র এর ব্যবহার করলে কাজ সহজ হয়ে পড়ত। কিন্তু অভ্যাস বলেও একটা কথা আছে। যে শব্দগুলো বহুল প্রচলিত তার বানান হঠাৎ পাল্টে ফেললে নিজেক কেমন বোকা বোকা মনে হয়। তাই স,ষ বহাল তবিয়তে রাজ করতে পারছে।
            (ক) মূলতঃ শিস ধ্বনি তিনটি থাকা শব্দের বানানেই তৎসম শব্দের রীতি দুএকটি ছোটখাটো ব্যতক্রম বাদ দিলে ( মনুষ্য-মিনসে, শ্রদ্ধা-সাধ ) তদ্ভতেও থেকে গেছে। যেমনঃ মশকমশা, পিতুঃস্বসাপিসি, শস্যশাঁস, সর্ষপসরিষা ইত্যাদি।
            (খ) তা হলে সমস্যা রইল বিদেশি শব্দে। সেগুলোতে সাধারণত মূলের উচ্চারণ অনুসরণ করা হয়। আর তাই পুলিশ, পেনসিল, শয়তান, পোশাক, জিনিস, এরকম বানানই প্রচলিত। এসবে মোটের উপর আমরা অভ্যস্ত।
            (গ) কিন্তু বিদেশি শব্দগুলোর মূলের উচ্চারণ আমরা জানব কী করে? বিদেশি ভাষাতে যেগুলো তেমন শোনা যায় না, অথচ বাংলাতে বহুল প্রচলিত সেগুলো বাংলার স্বাভাবিক প্রবণতা অনুসারে উচ্চারিত হয়। এবং বানানে একটা বিভ্রান্তি থেকেই যায়। তাই সহর, সয়তান, পুলিস বানানগুলোকেও দিব্বি ভিসা বাড়িয়ে ঠাই দিতে হয়। অর্থাৎ অভ্যাসই এই ক্ষেত্রে বিধিবদ্ধ নিয়ম।
            (ঘ) আকাদেমি এ জটিলতার কথাও মনে রেখেছেন। এক সহজ নিয়মে তাঁর একেও সরল করে দিয়েছেন। ইঊরোপিয় শব্দের সাথে আমাদের যোগ সমকালীন, এ কথা মনে রেখে বোধহয় তাঁরা উচ্চারণ অনুযায়ী বানান তথা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রহণ করা প্রতিবর্ণীকরণ নীতি মেনে নিয়েছেন। আরবি-ফারসি মূল শব্দের বেলা তাঁরা বলেছেন, মূলে শিস ধ্বনি তিনটির যেটিই থাকুক না কেন বাংলা বানানে সর্বত্র ব্যবহৃত হবে। যেমনঃ মাশুল, হিশেব, শাদা ইত্যাদি। প্রচলিত নাম শব্দে কে রাখবার পরামর্শ দিয়েছেন। যেমনঃ ইসলাম, মুসলমান, সুফি, সোফিয়া ইত্যাদি।
             ৯. র,ড়,ঢ় নিয়েও একই রকম সমস্যা আছে। তবে ষাঢ়, আষাঢ়-এর মতো দুএকটি শব্দ ছাড়া এর  ব্যবহার নেইই প্রায়। শব্দকটা মনে রাখলেই হলো। জায়গা দখল নিয়ে জোর লড়াই করে অন্য দুটি। দুটোরই  জোর বড় কম নয়। এ ক্ষেত্রে অর্থ মনে রাখলেই কাজ চলে যায়। আগে উল্লেখ করা বাক্য-বই পরা শেস করে জামা পড়ে ঘড় থেকে বেড়িয়ে বাজার হয়ে এক বন্ধুর বারি দিব্যি বেরিয়ে আশিটেড়ও পাই না কোথাও একটা বর গণ্ডগোল হয়ে গেছে এরকম লিখলে মহাভারত অশুদ্ধ হয় না অবশ্য। আমাদের অসমের বাংলা সংবাদ পত্র গুলো যে আখছার এমন লিখে তার নজির আগেই দিয়েছি। কিন্তু এরকম বাক্য পড়ে অনেকেই কিছু বুঝে উঠতে পারবে না। তাই পাঠকের কথা মনে রাখলে একটু সুবিধে হয় কথাটা এই মাত্র। বাক্যটির শুদ্ধ রূপ হবে—“ বই পড়া  শেষ করে জামা পরে ঘর থেকে বেরিয়ে বাজার হয়ে এক বন্ধুর বাড়ি দিব্যি বেরিয়ে আসিটেরও পাই না কোথাও একটা বড় গণ্ডগোল হয়ে গেছে প্রায় সমোচ্চারিত শব্দগুলোর  তালিকা মনে রাখা এসব শব্দের জটিলতা এড়াবার কোনো উপায় নেই।
            ১০. বাংলা বর্ণমালাতে দুটো কেন আছে এ কৌতুহল অনেকেরই মনে আছে। এ নিয়ে অসমিয়া হিন্দিতে কোনো সমস্যা নেই । তাদের অন্তস্থ-ব এর স্বতন্ত্র ব্যবহার আছে। লিপিতেও বর্ণ দুটি আলাদা। যেমন অসমিয়াতে আর । বাংলাতে সর্বত্র বর্গীয়-ব । কিছু তৎসম শব্দের যুক্তাক্ষরে অন্তস্থ-ব এর ব্যবহার আছে, সেগুলোও লিপিসাম্যের জন্যে বোঝা মুস্কিল হয়। ত্বক,স্বাধীনতা, স্বামী, বিল্ব এরকম কিছু শব্দ। বিল্ব শব্দের অসমিয়াতে উচ্চারণ শুনেছি অনেকটা বিল্ বর মতো বাংলাতে বেশির ভাগ যুক্তাক্ষর সমীভূত হয়। এখানেও তার ব্যতিক্রম হয় না। বিল্ব উচ্চারিত হয় বিল্ল । অথবা দ্বিতীয় ব্যঞ্জন একটা রেশ রেখে যায়, স্পষ্ট উচ্চারিত হয় না , সেখানে উচ্চারণে একটা জোর পড়ে মাত্র। উচ্চারিত হয় ,  ' সাধিনতা, ' তক,  ' সামি ইত্যাদি। এসব শব্দের বানান মনে রাখা বেশ একটু কঠিন বটে। অভ্যাসের উপর নির্ভর করা ছাড়া উপায় নেই।
                 এ পর্যন্ত এসে আমরা বানান সমস্যা নিয়ে সব কথা বললাম বলে দাবি করব না, কিন্তু যে যায়গাগুলো আমাদের বেশি বিভ্রান্ত করে সে নিয়ে কাজ চালিয়ে দেবার মতো কথা বলেছি বলে দাবি করতেই পারি। আগে দুটো টিপস দিয়েই রেখেছি। এবার আরো চারটি মাত্র সূত্রে ( বা টিপস) আমাদের কথাগুলোকে গুটিয়ে আনতে পারি।
(ক) সংস্কৃত তথা শব্দে বানানের ব্যাকরণ সিদ্ধ নিয়ম মনে রাখার আমাদের এক বাধ্যবাধকতা আছে। নিয়ম মুখস্থ  করে এ সব মনে রাখবার উপায় নেই। অনবরত লিখে ভুল-শুদ্ধের দ্বান্দ্বিকতার মধ্যে দিয়ে যাওয়া ছাড়া আর অন্য কোনো উপায় নেই।
(খ) সংস্কৃত তথা তৎসম শব্দো যদি বহুল প্রচলিত হয় তবে অনেক ক্ষেত্রেই এবং অবশ্যই অন্য সমস্ত অ-সংস্কৃত (তদ্ভব, দেশি, বিদেশি,) শব্দের বানানে সাধারণত সমোচ্চারিত ধ্বনিগুলোর মধ্যে বহুল ব্যবহৃত ধ্বনিটির বর্ণই (ই-কার, উ-কার, জ ইত্যাদি) ব্যবহৃত হবে।
(গ) সরলী করণের এই নিয়মটি খাটবে না যদি অর্থ পাল্টে যায়। তীর অর্থে কূল শব্দটিকে রাখতেই হবে, কুল করে ফেললে তার অর্থ হয়ে যাবে বংশ। নদীর পাড় আর নদী পার কথা দুটোর মধ্যে তফাৎ রাখতেই হবে। রঙ্গ-কে রং করে ফেললে সত্যি সত্যি রঙ্গ হয়ে যাবে।
(ঘ) অভ্যাস কথাটা যখন বানান সম্পর্কে ব্যবহার করব তখন বুঝতে হবে সমগ্র জাতির অভ্যাসের কথা বলা হচ্ছে। একটা জাতির অভ্যাসও কালে কালে পাল্টায়। কিন্তু ধাঁ করে দিন কয়েকের মধ্যে পাল্টাতে হলে সে আমাদের মতো সাধারণ মানুষের কাজ নয়। তার জন্যে রবীন্দ্রনাথের মতো বিরাট ব্যক্তিত্বের অথবা জনপ্রিয় সংবাদপত্রের প্রয়াসের দরকার পড়ে। যতদূর জানি, অভ্যাসের বশে শ্রেণী শব্দটি অনেকদিন পাল্টাতে চাইছিল না। আকাদেমি প্রস্তাব করেছিল। আনন্দবাজার পত্রিকাগোষ্ঠী তাকেও শ্রেণি করে তুলেছিল। অসমের বাংলা দৈনিক ও টিভিগুলো নিবন্ধন অর্থে পঞ্জিয়নকে প্রচলিত করে ছাড়বেই যেন মনে হচ্ছে। সে অবশ্যি নতুন শব্দ আমদানির কথা। আমাদের মতো সাধারণ ঘরের বৌরা যেমন মন না চাইলেও কপালে এক আধটু সিঁদুর ছুঁইয়ে রাখেন, অভ্যাসে বাঁধা পড়া বানানগুলো ব্যবহার করার একটা অভ্যাস তেমনি না থাকলে গড়ে নেয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই।
ছাত্রদের জন্যে আরেকটি অর্থাৎ সপ্তম কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ টিপস দিয়ে রাখতে পারিঃ  তাতে  পরীক্ষাতে অন্ততঃ ১০ (দশ) গ্রেস মার্ক্স  পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু ভয় হয় ছাত্ররা তা অনুসরণ করবে কিনা তাই নিয়ে। একটা  দুটো বই অবশ্যই সারা জীবন সংগে রাখতে হবে, যদি জটিল বিশেষ করে তৎসম শব্দগুলো অহেতুক ভুল করে মানহানি না করতে হয়। বই দুটোর কথা কোনো সিলেবাসে লেখে না। একটির কথাতো কখনোই লেখে না। ছাত্ররা আমাদের বুদ্ধিমান; তারা সিলেবাসের বাইরে বই প্রায় পড়েই না। সিলেবাসেরো বাজে বই পড়ে একেবারে সময় নষ্ট করে না। সোজা নোটের সন্ধানে বাজারে যায়। তা, এই দুটোর নোটও পাওয়া যায় না। পরীক্ষাতেও তার থেকে কমন প্রশ্ন আসে না। তাই খুব কম ছাত্র বই দুটো সংগ্রহ করে পৈত্রিক অর্থের অপচয় করে। অল্পবুদ্ধিরা বুঝে গেছে আমরা অভিধান আর ব্যাকরণ বইএর কথা বলছি। বুদ্ধিমানদের সুবিধের জন্যে বলে রাখি বানান কিংবা বাক্যের গঠন টুকলিফাই করবার জন্যে এ দুটো  খুব কাজের বই। যত খুশি নকল করো কেউ তার জন্যে ভেরিফাই করে কানমলা দেবে না। আর যদি আকাদেমি বানান অভিধান রাখতে পারো তবে তো কোনো কথাই নেই! বহু মাস্টার মশাইর তর্জনও ঠাণ্ডা করা একেবারেই সহজ হয়ে যাবে। চাই কি তারাও আবার বানানের ক্লাস নাম লেখাতে পারেন! আমি নিজে সে ক্লাসের এখনো ফেল করা ছাত্র কিন্তু! কাউকে ভয় করি না, দিব্বি ভুল করি!

**************************** 8888**************************************
গেল ৪ও ৫মে এই লেখাটি দুটি সংখ্যাতে শিলচরের জনকন্ঠে প্রকাশিত হয়েছে।
এখানে তা দেখা যাবে । প্রথমাংশদ্বিতীয়াংশ
এনিয়ে একটি অধ্যাপক আবুল হোসেন মজুমদার একটি চিঠি পাঠিয়েছে ২২ মে তারিখে।
 দেখা যাবে এখানে।এর উত্তরে লিখলামঃ
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~

            গেল ৪ ও ৫ মে তারিখে জনকন্ঠে প্রকাশিত আমার লেখা ‘ যারা বানান ভুল করেন তাদের পক্ষে দু’এক কলম’ লেখাটা নিয়ে গেলকাল ( ২২শে মে) শ্রদ্ধেয় আবুল হোসেন মজুমদারের মতো কৃতী অধ্যাপক ও বিদগ্ধজন কলম ধরাতে প্রথমেই তাঁকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আমিও যে ‘আখছার’ বানান ভুল লিখেছি সেটি শুধু প্রমাণ করে যে আমরা সব্বাই বানান ভুল করি। আমি শেষে লিখেওছি, বানানের ক্লাসে আমি ‘ফেল করা ছাত্র’।স্যরের থেকে বরং জানা গেল যে মালয়েশিয় প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীর নাম ‘মাহাথিরে’র বদলে হওয়া উচিত ছিল ‘মাআছি’র’ । তো  দেখুন, ওরাও ভুল করে! এখন আকাদেমিতে দেখছি ‘আকছার’ই হবে।আসলে আমরাতো সংশয় হলে তবে গে’ অভিধান দেখি। আমার সংশয় হচ্ছিল না। কিন্তু এই ভুল এটাও প্রমাণ করে যে আমরা সমোচ্চারিত ধ্বনিতে ভুলগুলো করি। ‘ক’ আর ‘খ’ তাই কি না।আর ‘ছ’ মহাপ্রাণের টানে ‘ক’ মহাপ্রাণ হয়ে যাওয়াইতো স্বাভাবিক।
        ‘Inter’ এর তর্জমা ‘সর্ব’ হবে বলিনি। এটা বোধহয় আমার ভাষার গণ্ডগোল। আমি বরং লিখেছি, ‘inter’ এর নকলে আমরা তর্জমা করে নিয়েছি ‘আন্তর’। নকল ছাড়া এই ‘আন্তর’এর অন্য কোনো উৎস আমি পাইনি। স্যর জানালে উপকৃত হব। তবে হ্যাঁ, internationalএর বাংলা অর্থ কি পৃথিবীর সমস্ত জাতি নয়, সেই অর্থে আমি লিখেছি ‘সর্বজাতি’। তবে এখানেও বোধহয় আমি একটু ভুল করে নিয়েছি। আকাদেমি লিখছে 'সার্বজাতিক'।
          বাঙলাদেশের বানান চর্চার খবর জানিয়ে স্যর আমাকে উপকৃত করলেন। আমি অবশ্যি বাংলাদেশে চর্চা হয় নি বলিনি, বলেছি আমি সেটা জানি না। তবে কিনা,আমার এ লেখাটা জনকন্ঠ ছাড়াও আমার নিজের ব্লগে রয়েছে (http://ishankonerkotha.blogspot.com/) এছাড়াও রয়েছে একটি পশ্চিম বাংলা ও আরেকটি বাংলাদেশের সামাজিক ব্লগে ( কফিহাউস এবং আমারব্লগ) । ওরা প্রায় প্রত্যেকে নিজেদের কাজ আসবে বলে লেখাটা রেখে দিয়েছেন বলে জানালেও স্যরের দেয়া তথ্যগুলো দিতে পারেন নি বলে আমি একটু ক্ষুন্নই ছিলাম। অবশ্যি, এটিতো কেজো কথার লেখা, তাই তাদের কাছে কাজে আসাই যথেষ্ট মনে হয়ে থাকবে বোধহয়।
    বাকি , স্যর যা বললেন, আমাদের বানান ভুলের কারণ নিয়ে  সে নিয়ে আমি আর কী বলব? ভুল যে অনিবার্য সেটিই তো আমি বলতে চাইলাম। সে নিয়ে কড়াকড়ি করলে হতাশা ছাড়া কিছু মেলে না। স্যরের চিঠিতেও সেই হতাশা রয়েছে। আমার মতে বানান টানান এগুলো, গায়ের পোষাকের মতো। কোথায় যাচ্ছি, তার উপর নির্ভর করে কতটা সেজে যাব। অনেক জায়গায় যথাযথ সাজসজ্জা ছাড়া যেতেই পারি। আমি তো ইংরেজির ছাত্র নই। যতদিন ইংরেজি ভুল করব এই ভয়ে সিঁটিয়ে থাকতাম এক লাইনও ইংরেজি লিখতে পারতাম না।আজকাল ভুলের থোড়াই কেয়ার করি। ভুল ইংরেজিতে আমি গোটা বিশ্বের সঙ্গে যোগ রক্ষা করি। যোগটা যেখানে হয়ে যাচ্ছে, সেখানে ভুল না শুদ্ধ লিখছি, সেটি কী অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যাচ্ছে না?
              যারা বেশি করে সামাজিক অনুষ্ঠানাদিতে যোগ দেয় পোষাক নিয়ে তাদের রুচিবোধ উন্নত থাকে। বাংলার চর্চা বাড়লে বাকিটা আপনি হবে। ব্রহ্মপুত্র উপত্যকাতে বাঙালিরা তুলনামূলকভাবে বাংলা উচ্চারণ বানান বাক্য বেশি ভুল করেন । কারণটা বোঝা কঠিন নয়। গেল ১লা বৈশাখে ডিগবয় থেকে ঘটা করে একটি ছোট কাগজের সংখ্যা বেরুলো। উপত্যকার একটি জনপ্রিয় দৈনিকে  তার সচিত্র সংবাদও বেরুলো। যিনি সম্পাদক তাঁর যেকোনো প্রকাশিত বইতে এক দীর্ঘ আত্মপরিচিতি থাকে। আমার হাতে তার এক সংখ্যা যখন পড়ল দেখি তিনি সম্পাদকীয়তেই ঁ যোগ করে ‘ভিড়’ বানানে ‘ভিঁড়’ বাড়িয়েছেন। এবারে তাকে যদি বলতে যাই এই ভুল হলো কেন, বেচারা যাও একটা কাগজ করেছেন তাও না করতে পারেন হতাশাতে! বরাক উপত্যকার লোকেরা যতটা ভাবেন এখানে বাংলা ভাষার অধিকার এখন ততোটা সংকোচিত নয়। উজান অসমে একটি স্বতন্ত্র বাংলা টিভি চেনেল রয়েছে। কিন্তু ওরা যে বাংলা বলেন তাতে আপনার আমার কানে হাত দেবার জোগাড় হবে। কিন্তু আপাতত যে বলছেন তাই কি যথেষ্ট নয়?
              বরং শুদ্ধ করতে গিয়ে তাঁরা অহেতুক অসমিয়াদের মতো তৎসম শব্দের ভিড় বাড়ান। এক দিন এক সাংবাদিক  ভদ্রলোককে বলেছিলাম। তিনি বললেন এগুলো বাদ দিলে কি বাংলার আভিজাত্য কমে যাবে না! বললাম যে কাজটা রবীন্দ্রনাথ করে গেছেন তাতে আপনাদের আপত্তি কোথায়! তিনি একটু অবাক হলেন! বোধহয় বিশ্বাসও করেন নি। আমার লেখাটা সেরকম যত অবিশ্বাসের বিরুদ্ধে।
সুশান্ত কর



Wednesday 14 April 2010

বহাগতো শুধু এক ঋতু নয়


বহাগতো শুধু  এক ঋতু নয়

(ইংরেজি ভাষার অসমিয়া  লেখিকা উদ্দীপনার
সম্প্রতি We Called the river Red’ থেকে নেয়া Bohāg Māthu Eti Ritu Nahaiকবিতার অনুবাদ)

দেশের বাড়িতে আজ আবার বিহু এসেছে ।

হয়তো  এখন আকাশে বাতাসে কেবলই বহাগ
হয়তোবা মৃত্যু
হয়তো চারদিকে ঢোল পেঁপা গগনাবাজছে
হয়তোবা বুলেট
হয়তো গাছে গাছে কপৌ ফুটে ছড়িয়েছে সৌরভ
হয়তোবা রক্ত

...বুলেট , রক্ত আর মৃত্যু, মৃত্যু, রক্ত আর বুলেটঃ ওইতো ওখানে সব।
আমি এই বিদেশ বিভূঁইয়ে হয়তো বেশ আছি,
হয়তোবা, দেশের বাড়িতে...

কিন্তু , আজ আবার সেই দেশের বাড়িতে
বিহু এসেছে,
আর আমি একা পড়ে আছি বাইরে , বাড়ি থেকে দূর বহু দূর।

***
টীকাঃ
১)বহাগঃ আক্ষরিক অর্থ ‘বৈশাখ’। এখানে ‘বহাগ ঋতু’ কিন্তু ‘বসন্ত’। এটি ভূপেন হাজারিকার এক বিখ্যাত গানের প্রথম কলি।
২) পেঁপা, গগনাঃ পেঁপা –শিঙার চাইতে আকারে ছোট মহিষের শিঙে তৈরি বাদ্য। গগনা- বাঁশে তৈরি এক বাদ্য যন্ত্র, যেটি অসমেই দেখা যায়। দুটোই বিহুর অবিচ্ছেদ্য অংশ।
৩) কপৌঃ অর্কিড। এই ফুল ছাড়া বিহুর সাজসজ্জা অসম্পূর্ণ।
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~ 

 Bohāg Māthu Eti Ritu Nahai
(Bohāg is not merely a season)

It is Bihu back home

Perhaps there is bohāg in the air,
Perhaps death
Perhaps dhol-pepā-gaganā sound
Perhaps bullets.
Perhaps the kapou is in the bloom
Perhaps blood.

…bullet,blood and death, death,blood and bullet: that’s all there is.Perhaps I am better away; or perhaps,better home…

But it is Bihu today
Back home,
And I am away.
******** ******
'স্ফুলিঙ্গ ' কাব্যগ্রন্থে রবীন্দ্রনাথের প্রায় এমনই এক কবিতা
এখানে তুলে দেয়া একেবার অপ্রাসঙ্গিক হবে নাঃ
১২৩ নং কবিতাতে তিনি লিখছেনঃ


নববর্ষ এল আজি
       দুর্যোগের ঘন অন্ধকারে;
আনে নি আশার বাণী,
       দেবে না সে করুণ প্রশ্রয়।
প্রতিকূল ভাগ্য আসে
       হিংস্র বিভীষিকার আকারে;
তখনি সে অকল্যাণ
       যখনি তাহারে করি ভয়।
যে জীবন বহিয়াছি
       পূর্ণ মূল্যে আজ হোক কেনা;
দুর্দিনে নির্ভীক বীর্যে
       শোধ করি তার শেষ দেনা।




*** ***
 'বহাগ মাথো এটি ঋতু নহয়' ভূপেন হাজরিকার এই গানের দুটো কলি শুনতে
অনুগ্রহ করে ব্লগের মূল গানটি বন্ধ করুনঃ

Bahag Eti Matho Ritu Nahay

by Bhupen Hajarika