জঙ্গি হামলাতে পাহাড় লাইন দিয়ে গাড়ি না চললেও বরাক উপত্যকা, ত্রিপুরা ও মিজোরামে বুঝি খাবারের অভাব হবে না । কাগজে আজ এরকম সংবাদ বেরিয়েছে । প্রতিদিন সড়ক পথে ২৫ ট্যাঙ্কার ডিজেল, পেট্রোল ও কেরোসিন যাচ্ছে। আর চাল ডাল এগুলো প্রতিদিন ৩৪২টি ট্রাকে করে গিয়ে পৌঁছুচ্ছে। কেবল রামনগর এফসিআই গোদামেই দৈনিক ২৫৮০ মেট্রিক টন করে চাল গম আসছে । সংবাদটি শ্রুতি মধুর নিঃসন্দেহে । তাই বোধহয় বরাকের মধ্যবিত্ত নীরব নির্বিকার । তাদের দিনকাল ভালোই যাচ্ছে । উত্তর কাছাড় জ্বললেও তাদের কিছু যায় আসে না । ওসব ‘আসামে’র ব্যাপার, ‘আসাম’ দেখুক ! তারা এখন মাতৃভাষা নিয়ে ব্যস্ত । সামনেই ১৯শে মে কিনা । তার উপর আগামী বছর এ দিনটির পঞ্চাশ বছরের উৎসবের শুরু । এই নিয়েই তাদের গত পঞ্চাশ বছরের যত যুদ্ধ , যত বীরত্ব।
শিলচরের ‘ভাষা শহিদ ষ্টেশন শহিদ স্মরণ সমিতি’ ক’বছর আগে যাত্রা শুরু করেছিল এই দাবিতে যে শিলচর ষ্টেশনকে ভাষা শহিদ ষ্টেশন নাম দিতে হবে। সে দাবি পূরণ হয়েছে । এবারে তারা দাবি তুলছে ১৯মে কে জাতীয় মাতৃ ভাষা সুরক্ষা দিবস হিসেবে ঘোষণ করতে হবে। এর জন্যে তারা ত্রিপুরা ও পশ্চিম বাংলা সরকারের সঙ্গেও যোগাযোগ গড়ে তুলবে। এরা ১৯ মে’তে বরাকের সমস্ত স্কুক-কলেজ ও অফিস বন্ধ ঘোষণার দাবি জানিয়ে ইতিমধ্যে জেলা উপায়ুক্তের কাছে স্মারক পত্রও দিয়েছে। এ নিয়ে আজ কাগজে খবর বেরিয়েছে।
যেখানে ব্রডগেজ লাইন তৈরিতে এতো হাঙামা হচ্ছে, সেখানে সেগুলো নিয়ে হৈচৈ না করে ওরা কেন শহিদ ষ্টেশনের নামাকরণ নিয়ে এতো হৈচৈ করেছিলো তাই আমার বোধগম্য হয়নি । এবারে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ( ২১ ফেব্রুয়ারি ) থাকতে ওরা আবার জাতীয় দিবস চাইছে কেন , এও বোঝা মুস্কিল । কেন ওরা কেবল পশ্চিম বাংলা আর ত্রিপুরার সরকারের সঙ্গে কথা বলবে, কেন অসম সহ আর কোনো সরকারের সঙ্গে নয় ? দিবসটি বাংলা ভাষার সঙ্গে সম্পৃক্ত বলে? বরাকে এতো মনিপুরি থাকতে মনিপুর সরকারের সঙ্গে কথা বলবার ভাবনা ওদের মাথাতে এলো না কেনো ? বরাকের বাংলা ছাড়া আর কোনো ভাষা-ভাষির লোকেদের নিয়ে এদের কোনো মাথা ব্যথা আছে কি?
******
সেদিন ‘দেশ’ কাগজে ‘পশ্চিম বঙ্গের কথ্যভাষা’ নামে তাপস ভৌমিকের সম্পাদিত (কোরক।কলকাতা-৫৯। ৮০.০০) বইয়ের আলোচনা প্রসঙ্গে সুভাষ ভট্টাচার্যের ‘ পশ্চিমবঙ্গের ভাষা-ভূগোল ও তার সীমানা’ নামে এক প্রবন্ধ পড়লাম । তাতে তিনি এক জায়গায় লিখেছেন, “ ... ‘কামরূপী বনাম কামতাপুরি’ প্রবন্ধে লেখক নির্মল দাশ শুধু যে কর্মসূত্রে উত্তরবঙ্গকে ভালোভাবে জানার সুযোগ পেয়েছেন তা নয় , তাঁর ভাষা-গবেষণার একটা বড় অংশই উত্তরবঙ্গের ভাষা নিয়ে আলোচনা। তাঁর নিবন্ধটি একটি বিচ্ছিন্নতাবাদী প্রবণতার বিরুদ্ধে অত্যন্ত শক্তিশালী সংগত ও সময়োপযোগী উচ্চারণ । দেশের নানা স্থানে কিছুকাল ধরে মূলস্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে টুকরো টুকরো অস্তিত্বকেই প্রতিষ্ঠা করবার যে বিপজ্জনক ও নিন্দার্হ আয়োজন চলেছে, তেমনই একটি তথাকথিত ‘আন্দোলন’ কামরূপীকে ‘কামতাপুরি’ নাম দিয়ে তাকে উপভাষা নয়, ‘ভাষা’ হিসেবে প্রতিপন্ন করার অপচেষ্টা । ঐতিহাসিক, ভাষাতাত্বিক বা সামাজিক কোনো বিবেচনাতেই কামতাপুরিকে একটি পৃথক ভাষা বলা যায় না । এই আন্দোলনের প্রবক্তাদের তরফে এমনও অবাস্তব ও হাস্যজনক দাবি প্রচার করা হচ্ছে যে, কামতাপুরির তুলনায় বাংলাভাষা অর্বাচীন এবং গৌরবেও হীনতর । নির্মল দাস যুক্তিনিষ্ঠভাবে ভাষা বিজ্ঞানের আলোকে এই যুক্তিহীন নীতিহীন বক্তব্যকে খণ্ডন করেছেন’’
আমরা বইটি পড়িনি। সুতরাং নির্মল দাস কতটা যৌক্তিক জানবার সুযোগ হয় নি । কিন্তু এই আলোচক সুভাষ ভট্টাচার্যের যে ‘যুক্তি’র অভাব আছে সে নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই । অসমে অসমিয়ারাও এই ‘যুক্তি’ ও ভাষাতেই ‘এই যুক্তিহীন নীতিহীন বক্তব্যকে খণ্ডন’ করে বলবেন ভাষাটি অসমিয়া ।
বছর কয় আগে কিছু কামতাপুরি সংগঠন তাদের ভাষার স্বীকৃতি ও অন্য কিছু দাবিতে কামতাপুর বন্ধের ডাক দিয়েছিল। এ নিয়ে কথা হচ্ছিল আমার এক জ্যষ্ঠ সহকর্মীর সঙ্গে। তিনি লিবারেশন সিপিআই ( এমএল) করতেন । তিনি বলছিলেন এদের এই আন্দোলন অনৈতিক। এরা অসমিয়া । আমার বক্তব্য ছিল, ওদিকে পশ্চিম বাংলার মুখ্যমন্ত্রী বলবেন ওরা বাঙালি; আপনি বলবেন ওরা অসমিয়া—ভালো হয় না কি ওরা কী সেটা ওরাই ঠিক করুক। ওদের সে স্বাধীনতা থাকাটা কি উচিত নয় ? তিনি খুব রেগে গেছিলেন। আমি তখন অসমিয়া ঘৃষ্ট ‘হ’ উচ্চারণ করতে পারতাম না। উনি বিষয় বদলে আমাকে চেপে ধরলেন আমাকে ঠিক করে ‘ অহ’মিয়া’ উচ্চারণ করতে হবে । আমি যতই বলি আমি সেটি এখনো রপ্ত করিনি , করব। উনি চেপে ধরে বলেন, এ বুঝি আমার ইচ্ছেকৃত ত্রুটি । আমি অসমিয়া পছন্দ করিনে তাই শুদ্ধ উচ্চারণ করছিনা । তাঁকে কী করে তখন বোঝাই যে আমরা বাঙালিরা বাংলাটাও অনেক সময় শুদ্ধ উচ্চারণ করিনা, আর এ নিয়ে আমরা খুব একটা ক্ষুন্নও হই না। তিনি উত্তেজনার বশে বোধহয় এও লক্ষ্য করেন নি যে আমি ‘কামতাপুরি’র উপর বাংলার দাবিটাকেও প্রত্যহ্বান জানাচ্ছি। সুতরাং আমি আর যাই হই বাঙ্গালি উগ্রজাতীয়তাবাদী নই ।
এই লেখকও সেরকম উত্তেজিত হয়ে ভাষাতত্বের যুক্তি টুক্তি সব ভুলে গেছেন। একটা উপভাষা স্বতন্ত্র ভাষা হতে পারে না সে রকম কোনো কড়াকড়ি আইন আছে না কি ? তা ছাড়া ওরা স্বতন্ত্র ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পাবার যোগ্য কিনা ওটি ঠিক করবে কে ? ওরা নিজেরা না কলকাতার ‘ভদ্রলোকেরা’, যাদের তিনি সঙ্গে রাখতে চাইছেন ? তাদের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা টদ্ধা খুব যে নেই এতো তাঁর ভাষার ব্যবহারেই বেশ বোঝা যায় । ঠিক আছে, ‘কামতাপুরি’ ভাষাটি বাংলার থেকে খুব একটা প্রাচীন নয়, বা গৌরবেও শ্রেয় নয়। কিন্তু এটিতো ঠিক যে উপভাষার বিকাশের হার যেহেতু শ্লথ তাই তার মধ্যে প্রাচীনতার ছাপটা একটু বেশিই থাকে । বাংলার প্রাচীনতার অধ্যয়নেও এই সত্য বেশ কাজে দিতে পারে । কিন্তু তাঁর উগ্রজাতীয়তাbbaবাদের কাছেতো এখন ‘এহ বাহ্য !’
কলকাতার ‘ভদ্রলোকেরা’ একসময় অসমিয়াকেও বাংলার উপভাষা বলবার গোঁয়ার্তুমি করেছিল । এখন ইতিহাস অন্যকথা বলছে । কামতাপুর আর বরাকের মধ্যে মিল আছে। অসমের যেমন দক্ষিণাংশ, বাংলার তেমনি উত্তরাংশ—সবদিকদিয়েই অবহেলিত । কথা হলো আমাদের শিলচরের ভাষা-কর্মীরা কাদের সঙ্গে একাত্ম বোধ করেন । কলাকাতার ‘ ভদ্রলোক’ না উত্তরবঙ্গের এই কামতাপুরি ও গোর্খাদের সঙ্গে ? জাতীয় মাতৃভাষা দিবসে ওরাও কি আমাদের সহযাত্রী হবে ?
কলকাতার ‘বাবু’রা আজকাল টাটাদের সঙ্গে খুব দোস্তি করছেন । আর লড়াই করছেন লালগড়ে আদিবাসীদের সঙ্গে, নন্দিগ্রাম সিঙ্গুরে দলিত মুসলমানদের সঙ্গে, কামতাপুরে কোচ-রাজবংশীদের সঙ্গে। শিলচরেরে ‘বাবু’দেরো টাটা না হোক ‘গোয়েল-গোয়েঙ্কা –আগরওয়ালাদের সঙ্গে বেশ ‘দোস্তি’ আছে বলে মনে হচ্ছে। তাই তারা ভোটের সময় মুসলমান আর অন্য সময় ‘অসমিয়া’দের সঙ্গেই লড়াইতে ব্যস্ত থাকেন । মালিনি বিল কাণ্ডের সময়তো দেখলাম ঐ ‘শহীদ স্মরণ সমিতির’ কর্তাব্যক্তি দু’একজন তাদের শ্রেণী ভাইদের পক্ষ নিতে গিয়ে দরিদ্র কৈবর্তদের বিরুদ্ধেও নির্লজ্জের মতো দাঁড়িয়ে গেলেন। তাদের এমন দৃষ্টি ভ্রম না থাকলে তাঁরা দেখতেন পাহাড় লাইনে সারা বছর ট্রেন না চললে সবচাইতে বেশি লাভবান কারা হয় । ডিমাছারাতো নয়ই, অসমিয়ারাও নয়। হয় যারা শিলং হয়ে ট্যাংকার আর ট্রাক পার করে আনবার সওদা করে । এই সওদাগরদের জন্যেই উত্তর কাছাড় না খেয়ে মরে, গুলি খেয়ে মরে, আর জ্বলে পুড়ে মরে জাতি দাঙার আগুনে। এই বর্বতার থেকেও কি ১৯শে মেতে স্কুল-কলেজ ছুটি থাকাটা বেশি জরুরী ?
সাময়িক প্রসঙ্গের জন্যে ঃ লিখে শেষ ১২।৫৪ ১৩।০৫।০৯
1 comment:
Nice article. Hope the readers try to realize the reality of the movement. Every word is crying due to the chronic pain of the poor and middle class peoples of Barak valley.
Post a Comment