(লেখাটি প্রকাশিত হয়েছিল 'ইরাবতী' শারদ সংখ্যা ২০২১-শে)
দু |
না,সুজিৎ চৌধুরীর রচনার নিন্দে করা আমাদের উদ্দেশ্য নয়।তথ্যের প্রাচুর্যে আমাদের লাভ বই কোনও ক্ষতি হয় করেনি সুজিৎ চৌধুরীর রচনা।সিলেটের সমাজ ও সময়কে ধরে রেখে আমাদের মতো পরের কালের মানুষকে ভ্রমণ করিয়েছেন তিনি।আর প্রতিটি প্রসঙ্গে—সে খেলা হোক,খাবার হোক,পড়া হোক,পাড়া হোক সব কিছুকে নিয়ে একেকটি অধ্যায় সাজিয়েছেন সুজিৎ চৌধুরী।আমাদের তাঁকে মনে পড়ল মূলত একটি মিলের জন্যে।দুই রচনাই দেশভাগের বেদনায় বিধুর। সুজিৎ যেখানে থেমেছেন,ঠিক সেখানেই মুক্তি যাত্রা শুরু করেছেন যেন।সুজিতের শেষ বাক্যটি ছিল এরকম, “রাজনৈতিক ভূগোলের ভারতবর্ষে আমরা ঢুকলাম আধঘণ্টার মধ্যে---কিন্তু পিতৃপুরুষের স্বপ্নের ভারতের সন্ধান এখনও চলছে।” আর মুক্তি চৌধুরীর প্রথম বাক্যই শুরু হয়েছে এই লিখে, “ আমি যে দেশে জন্মেছিলাম, আমার সে দেশ হঠাৎ একদিন বিদেশ হয়ে গেল। তাই আমি এখন শুধু পুরোনো সেই দেশের মানচিত্রে ঘুরে বেড়াই।” দুজনের দুই বাক্যেরই ব্যঞ্জনা কেমন একই অর্থে এসে প্রবেশ করে গেল। সেই পরের বেড়ানোর কথাই লিখেছেন মুক্তি চৌধুরী। কিন্তু আপন খেয়ালে,ঐতিহাসিকের অনুসন্ধিৎসা নিয়ে নয়। ফলে মুক্তির রচনাতে নিজের কথা খুব যে বেশি কিছু রয়েছে তা কিন্তু নয়। তাঁর বাল্য-বেলার আপন জন যাদের কথা বাদ দেয়া কঠিন তাঁদের রেখেছেন।কিন্তু বড় বেলাতে যাদের কথা বাদ দিলে চলে নির্মমভাবে বাদ দিয়েছেন। ফলে আপন স্বামী সন্তানের কথা বিশেষ কিছুই নেই।বক্তা পক্ষে,প্রচলিত ব্যাকরণে যাকে বলে উত্তম পুরুষে গল্প বলা শুরু হয় নি। অন্যপক্ষের তথা প্রথম পুরুষের এক চরিত্রকে বেছে নিয়েছেন,তাকে নাম দিয়েছেন ‘খেয়ালি’। এই গল্প খেয়ালির গল্প, এই কাব্য খেয়ালির কাব্য। এই ‘খেয়ালি’ নামটিও নেয়া রবীন্দ্র কবিতার থেকে। ‘মহুয়া’ কাব্যগ্রন্থে এই নামে একটি কবিতা আছে “ ... যুগান্তরপার হতে কোন্ পুরাণের কথা শোনে।/ইচ্ছা করে সেই রাতে / লিপিখানি লেখে ভূর্জপাতে/লেখনীতে ভরি লয়ে দুঃখে-গলা কাজলের কালি--/নাম কি খেয়ালী।”
এই কাব্যের একটি সলতে পাকানোর পর্ব রয়েছে।আমাদের অনুমান করে নিতে কোনও সমস্যা নেই।ডিসেম্বর ২০১২তে প্রকাশিত হয় প্রসূন বর্মন সম্পাদিত ‘নাইন্থ কলাম’ কাগজের ‘দেশভাগ-দেশত্যাগ ꠩ প্রসঙ্গ উত্তর-পূর্ব ভারত’ সংখ্যা। পরে এটি বই আকারেও বেরোয়। সেখানে মুক্তি চৌধুরীরও একটি রচনা রয়েছে ‘স্মৃতিকথা’ নামের শেষাংশে।‘ভাঙা- ভারত কথা’। বই দুটিতে যে তারই বিস্তার ঘটেছে এটি ক্রম মেনে পড়লেই স্পষ্ট হয়ে যায়। উলম্বে ও আনুভূমিক দুভাবেই বিস্তার। এক অনামিকা মেয়ের জন্মদিনের গল্পে শুরু।সেখানে ছড়ার অন্তাক্ষরি হবে।মেয়েটি যেই ‘তেলের শিশি ভাঙল বলে খুকুর ‘পরে রাগ করো…’ ছড়াটির প্রথম কয়েক সারি আউড়ে গেল মা দিলেন থামিয়ে। মুক্তি চৌধুরী প্রবেশ করে গেলেন ‘ভাঙা-ভারতে’র ‘কথা’য়। “ভাঙা- ভারতের দুই খণ্ডের মানুষের বুকের ভেতরে খোদাই করা আছে তাদের নিজ অঞ্চল,পরিবেশ-প্রতিবেশ, বিড়ম্বনা-বিপর্যয়ের একান্ত চিত্রমালা, প্রতিজন বাস্তুহারার জীবনে ছিল এবং আছে সেই অশ্রুসজল আখ্যানের টুকরো কথা। অগণিত এই দুঃখ সুখের স্মৃতির আঁচড়েই রচিত হতে পারে ভাঙা-ভারতের ইতিকথা--- ভাঙা –ভারত কথা।” নিজের ‘সেই অশ্রুসজল আখ্যান’ শোনাবেন বলেই ‘সেই তো আমার আমি’ বইটি লেখা বুঝাই যায়। এটি পড়ে যখন পাঠকের চাপ বাড়ল,তাতেই জন্ম নিল দ্বিতীয় বই ‘ছিন্নমূলের ছেঁড়াপাতা’। নাইন্থ কলামে প্রকাশিত সেই ‘কথা’তেই প্রাথমিক কিছু কথা জানা হয়ে যায়। মৌলভিবাজার মহকুমার আছে গোপীনাথপুরে তাঁর পৈত্রিক ভিটা। সেখানেই তাঁর জন্ম। তিনি মা-বাবার প্রথম সন্তান। তাই সবাই ‘আহ্লাদে আদরে মুড়ে’ রেখেছিলেন। দেশভাগের সঙ্গে সঙ্গেই নয়, “১৯৫০-এর তাণ্ডবের পর পূর্বপাকিস্তানের সংখ্যালঘুদের আবার এমন মনোভাব হয়েছিল যে অনেকেই সোমত্ত ও উঠতি-বয়সী মেয়েদের দেশে রাখা যুক্তি-যুক্ত মনে করলেন না।” তাতেই এক পিসির সঙ্গে মুক্তিকে দেশ ছেড়ে চলে আসতে হয় গুয়াহাটিতে।বাকি পরিবার পড়ে থাকে সেই দেশেই। তাঁর কাছে দেশভাগের অন্য অর্থ তাই দাঁড়ায় পরিবারেরও বিভাজন। মা-বাবা ঠাকুরমা কাকা কাকিমাদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া। “এভাবেই ভাঙা-ভারতের দু-খণ্ডেই হয়তো অনেকে অনেক খণ্ডিত ভুবনের সৃষ্টি হয়েছিল—কেউ তা জানে, কেউ জানে না।” সেদেশ থেকে আসা ‘ঠাকুরদার চিঠিতে চলত দেশভাগের বেদনার বিলাপ—বিচ্ছিন্ন অভিশপ্ত অবস্থার বিলাপ।’ মুক্তি চৌধুরীর আলাপেও সেই একই বিলাপ।কিন্তু কোথাও কোনও বিদ্বেষ নেই।কেন নেই,তার একটি ব্যাখ্যা সেই ‘কথা’তেই রয়েছে। ঠিক আগের বছর ২০১১-তে তিনি সিলেট গেছিলেন।নিজেই হিন্দু স্বজনদের প্রশ্ন করেছিলেন,“আমাদের বিগত প্রজন্মের দেশত্যাগ কি আপনাদের যুক্তিযুক্ত মনে হয়?” একদল অবশ্যই বলেছেন,তখন অন্যরকম সম্ভব ছিল না।কিন্তু আর দল ‘ক্ষোভে-রোষে বললেন’, “দেশভাগের জন্যে তাঁদের দেশত্যাগ মোটেই সমর্থনযোগ্য নয়। এতে যাঁরা রইলেন,তাঁদের মনোভঙ্গ তো হলই উপরন্তু বাস্তবক্ষেত্রেও নানা সমস্যার সৃষ্টি হয়েছিল। বরং নিজের দেশে নিজের অধিকার আদায় করে সাহসের সঙ্গে বাস করা উচিত ছিল। তাঁদের ভুলের জন্য আমাদেরও খেসারৎ দিতে হয়েছে।” ঠিক এমন জবাবই যেন তিনি চাইছিলেন।এমন তো নয় যে জবাবটি শুনেই প্রশ্নটি তাঁর মনে এসেছিল। “প্রতিপক্ষ এবারে আমাকে লক্ষ করেই বললেন, --‘আচ্ছা আপনিই বলুন না,ভারতের বুকে হানাহানি-মারামারি খুনোখুনি কি কম আছে…?” প্রশ্নের বিস্তার এমন করে হল গুলিয়ে যায় প্রশ্নগুলো আদতেই ‘প্রতিপক্ষ’-এর না লেখিকার নিজের। বাংলায় বা অসমে বাঙালিদের নিজেদের মধ্যেই ‘বাস্তুহারা’দের হেয়জ্ঞান করে অপমান নিজেও কম দেখেন নি। ‘খেসারৎ’ নিজেকেও কম দিতে হয় নি অসমে বাঙালি হয়ে একের পরে এক হত্যালীলায়। যার কথা থাকবে ‘ছিন্নমূলের ছেঁড়াপাতা’ বইটিতে। অথচ ‘নিরাপত্তা’র স্বার্থে শুধু শুধু তাঁকে পরিজন থেকে বিচ্ছিন্ন জীবন যাপন করতে হয়েছিল।ফলে যে বিপন্ন বিষাদ তাঁকে গ্রাস করেছিল তাতে স্বাভাবিক ছিল লেখিকার মনের এই প্রশ্ন,“তবে কেন নিজদেশ ছেড়ে আবার একই বিপাকে পড়া!নিজের ঘরবাড়িতে থেকে এই প্রতিকূলতা মোকাবিলা করলে কী এমন সর্বনাশ হত আর!...” দেশ যখন স্বাধীনতার উৎসবে মাতে “তখন আমার ভেতরে শত শত দুখের প্রদীপ জ্বলে জ্বলে পোড়ে---পুড়ে পুড়ে জ্বলে। আমার ভাঙা-ভারতে কেবল দীর্ঘশ্বাসের বাতাস বয়।”
আগেই লিখেছি প্রতিটি অধ্যায় শিরোনাম বেছে নিয়েছেন রবীন্দ্রসঙ্গীত থেকে। ‘কিছু বলব বলে…’ দিয়ে শুরু। এর পরে ‘আনন্দেরই সাগর হতে…’, তারপরে ‘যখন ভাঙল মিলন মেলা’।ক্রমে ক্রমে ‘শেষ কথাটি…’ অব্দি এগিয়েছে। এভাবেই দ্বিতীয় বইটিও এগিয়েছে। শুধু বেখাপ্পা লাগে শুরুর ‘প্রস্তাবনা’ নামটি। এর পক্ষে যুক্তি একটাই যে এটি তাঁর স্মৃতিকথার অংশ নয়। দুই বইয়ের মাঝের কথা। দ্বিতীয় বইয়ের জন্মকথা।এর শুরু হয়েছে ‘… ভাবনারে কী হাওয়ায় মাতালো’ দিয়ে। শেষে রয়েছে ‘ব্যথায় কথা যায় ডুবে যায়।’ শিরোনাম নয় যেন করুণ সুরে ব্যথার যত কথার আবহ সঙ্গীত।
আটটি মাত্র অধ্যায়ে খুদে বই ‘সেই তো আমার আমি’।মুল গল্প শুরু হয়েছে দ্বিতীয় অধ্যায় ‘আনন্দেরই সাগর হতে…’ ‘ছোট্ট মেয়ে। বছর চার পাঁচ বয়স। ধরা যাক নামটি তার খেয়ালি।’ তার ‘সাদামাটা ঘরবাড়ি, প্রাচুর্য নেই তবে নিরন্তর বইছে সোহাগের নদী’। সেই নদীতে ঠাকুরদা ঠাকুরমা কাকা পিসি আর পড়শিদের আদরে আহ্লাদে বড় হচ্ছে খেয়ালি। টগর কামিনী জবা গুলঞ্চের বনে প্রজাপতির সঙ্গে লুকোচুরি খেলছে। ভেসে বেড়াচ্ছে রূপকথা আর ব্রত কথার জগতে। ছড়া কেটে, গান গেয়ে, ধামাইল নেচে, শাড়িতে আলতায় কুমকুমে সেজে, লুটের নকুল বাতাসা নাড়ু মোয়া কুড়িয়ে দিন কেটে যাচ্ছিল তার সোহাগ নদীতে। এই সুযোগে বহু পুরোনো বিস্মৃত ছড়া, ধামাইল গান আর রূপকথার সঙ্গে পরিচয় ঘটিয়ে দেন লেখিকা রসের হাড়ি গড়িয়ে না দিয়েই। অন্তত লতা মুঙ্গেশকরের গলাতে আশির দশকের শুরুতে জনপ্রিয় গানের কলি ‘ওঠো, ওঠো সুরযাইরে ঝিকিমিকি দিয়া’ যে পুব বাংলার সূর্যব্রতের গান থেকে নেওয়া আমাদের জানা ছিল না এই বইটি পড়বার আগে। না তিনি সেই কথা উল্লেখ করে ভার বাড়ান নি,তাঁর নদী বয়ে গেল ‘আপন বেগে পাগল পারা’। অবলীলায়। এরই ফাঁকে টুপ করে লেখিকা জানিয়ে দিলেন তাঁর ঠাকুরদা সরকারি পোস্ট মাস্টার ছিলেন। শাসকের উপরে ক্ষোভে চাকরি ছেড়ে দিয়ে অনিশ্চিত জীবন বেছে নিয়েছিলেম। কখনও কোনও স্কুলে কখনও চা বাগানে কাজ করেছেন। সঙ্গে সম্প্রদায় নির্বিশেষে ছাত্রদের বাড়িতে ডেকে পড়িয়েছেন। সেকালেই সমাজ নিন্দা তুচ্ছ করে নিজের আঠারো বছরের মেয়েকে নার্সিং পড়াতে শিলং পাঠিয়েছিলেন, ছেলে বৌকে নিজে লেখাপড়া শিখিয়েছেন। খেয়ালিরও বর্ণপরিচয় তাঁর কাছেই। তাঁর কাছেই ছন্দজ্ঞান। রামায়ণ মহাভারত জাতকের গল্পের সঙ্গে গান্ধি নেহরু সুভাষের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু কোথাও এই তথ্য নেই যে ঠাকুরদার বা সেই বিধবা পিসির নামটি কী? কী হয়েছিল সেই পিসির পরের জীবনে? নেই ঠাকুরমার নাম। তিনি ঠিক কবে সেই ঘুমন্ত রাজকন্যের অকল্পনীয় দীঘল চুল অনুসরণ করে নদী অরণ্য পাহাড় পর্বত অতিক্রম করে রাজপুত্রের যাত্রার ‘কিচ্ছা’ শুনিয়েছিলেন। তার পরে কী হল সেই গল্পের শোনা হল না খেয়ালির। কারণ ঘুমন্ত রাজকন্যের কাছে পৌঁছুতে না পৌঁছুতেই সে নিজেও ঘুমে ঢলে পড়েছিল। ঠাকুরমা নিশ্চিন্তে মশারি গুঁজে দিয়ে বুকের পাশে পাশবালিশটা ধরিয়ে দিয়েছিলেন। তাতে আমাদের ক্ষতি বিশেষ হয় না। ‘খেয়ালি ছবি আঁকে’ আর সেই ছবির ভেতরে আমরাও ছবি হয়ে যাই ডুবে।
খুব খেয়াল করলে তবে আমাদের জানা হয় খেয়ালির বাবা কাজ করতেন ‘লস্করপুর’ চা বাগানে। তথ্যটা জানাবেন বলে জানানো হল না। শুধু লেখা হল এই কথা “ভারতের মতো এক বিশাল বিচিত্র দেশে যে জন্মেছে তা-ও জানে না খেয়ালি। শুধু ‘সিলেট’, ‘কুলাউড়া’, ‘ছপাখন’ , ‘গোপীনাথপুর’ ‘কাদিপুর’ আর বাবার চা বাগান ‘লস্করপুর’-এর নাম জানে সে। পরগনা, জেলা, প্রদেশ, দেশ, মহাদেশের মাথামুণ্ডু বোঝার তো ক্ষমতাই নেই।” এভাবেই গ্রামের জমিদার পুত্রে নীরদ রায়ের গল্প বলেছেন,যিনি শিশু খেয়ালিকে প্রজাপতিকে নিয়ে এরই জন্যে খেলা করতে মানা করেছিলেন যে এরা মরে যাবে। তিনি স্বাধীনতা সংগ্রামীও ছিলেন। সংগ্রামের টানে জেলেও গেছিলেন। সন তারিখের উল্লেখ ছাড়াই আমাদের চেনানো হয়ে গেল কোন কালের কথা কইছে খেয়ালি।
তার পর ‘যখন ভাঙল মিলন মেলা’—১৯৪৭ এল। তাতে দেশভাগ, সিলেট গণভোট, র্যাডক্লিফ মিশনের কথা আছে। যেটুকু না থাকলে নয়। এরই ফাঁকে আমাদের জানা হল খেয়ালির দিন কাটত গ্রামের বাড়িতেই। মাঝে মধ্যে আসা হত লস্করপুর চাবাগানে মা বাবার কাছে।সেখানে এসে বা আসবার আগে গ্রামের বাড়িতেও বড়দের মনখারাপ মুখে ‘নেতা’,‘দেশভাগ’,‘গণভোট’, ‘হিন্দু-মুসলমান’ শব্দ কটা ঘুরে ঘুরে শুনে ওর শুধুই মনে হয়, “…যদি এতই মনখারাপ, তাহলে ভাগ না করলেই হল।” সে চলে যায় দীপুদের বাড়ি কুমির কুমির খেলতে। তারও চেয়ে ভালো ওদের বাড়ির আম গাছের ফাঁক দিয়ে শেষবেলার সুর্যিমামার রংবদল দেখা। দেশ গেল ভেঙে,থেমে গেল স্লোগান, থামল মিছিল। খেলাতে ব্যস্ত রইল শিশু খেয়ালি। ‘দেশভাঙা বা মনভাঙার কোনো খেলা তাদের’ শেখা হল না।
যে দিনগুলি আর ‘সোনার খাঁচায় রইল না’ তাঁরই কথা যে বলা হবে ‘...নানা রঙের দিনগুলি’তে বোঝাই যাচ্ছিল। সেদিনগুলো শুধুই নিষ্পাপ খেলার নয়, দুষ্টুমিরও। লস্করপুর চা বাগানের স্কুলে পড়তে যেত খেয়ালি। সেই স্কুলে শ্রমিক ঘরের ছেলে গৌরচন্দ্র অঙ্কে পায় একশোতে একশো। অগত্যা ঈর্ষাতে ওর সঙ্গে কথা বন্ধ। সেই বাঁধ আবার খুলল কীভাবে? ফুলচুরিতে বেরিয়ে। বাগানের ডাক্তার জ্যাঠামশাইর বাড়ির স্থলপদ্ম যখন পাড়তে পারছিল না, তখন পথ দিয়ে যাচ্ছিল দেখে ডাক দিল, ‘আয় না রে গোরা, দেনা ওই ফুলকটা পেড়ে।’ অগত্যা সিদ্ধান্ত হল, “ মুখ পোড়া ওই অঙ্কগুলোর জন্যে গোরাকে আর গোসা দেখানো ঠিক হবে না।” এমন আরও বহু চুরির গল্প রয়েছে সেই রঙিন দিনগুলোতে। বাড়ির আচারটা, সন্দেশটা চুরি করে বন্ধুদের সঙ্গে ভাগ করে খাবার ব্যাপার তো অতিসাধারণ। চাল ডাল আলু বেগুন চুরি করে ভিখিরি বৈষ্ণবদের খানিক বাড়তি দেওয়া। আর আছে কোজাগরী পূর্ণিমার রাতের চুরি। সেরকম এক চুরির রাতে “ শৈশব-কৈশোরের সন্ধিক্ষণে খেয়ালি এক অভিনব পন্থায় জাতপাতের গোঁড়ামির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল।” এর পেছনে গোরার সঙ্গে সন্ধির কোনও ভূমিকা আছে কি না স্পষ্ট নয়। সেখানেও আছে জাত বিদ্বেষ। স্কুলের মাস্টার মশাইই বলছিলেন, “... কুলির ছেলেটা কিনা পুরো নম্বর নিয়ে বেরিয়ে গেল...।” খেয়ালির এই “‘কুলির ছেলে’র সঙ্গে কম-বেশি নম্বরের সম্পর্কের ব্যাপারটি কোনো অবস্থায়ই মাথায় ঢুকত না।” গোরার সঙ্গে ভাব সেই মাথাকেই করেছিল ভারমুক্ত। প্রতিবেশীর তৃতীয় পক্ষের স্ত্রীকে মাসিমা বলে ডাকত খেয়ালি। আদরে আবদারে খামতি ছিলনা কিছুতেই। তাঁর কাছেই রবীন্দ্রগান সহ কত গান গল্প, শুকতারা, শিশুসাথীর মতো কত শত বই পত্রিকার সঙ্গে পরিচয় ঘটেছিল খেয়ালির। শুধু সেই ব্রাহ্মণ মাসিমা জাত বাঁচিয়ে চলতেন। বিশেষ করে রান্নাঘরে। সেই মাসিমার এক নাতনি ছিল খেয়ালির খেলার সাথি।তাকেই সঙ্গে নিয়ে এক কোজাগরী পূর্ণিমার রাতে সেই রান্নাঘর লণ্ডভণ্ড করেছিল সে। পরদিন আর মাসিমাকে পাওয়া যাচ্ছিল না। বিকেলে গিয়ে দেখল, তিনি বিছানাতে শুয়ে আছেন। তাঁর আশঙ্কা জ্বর এসছে। সারা দিন গেছে তাঁর রান্নাঘর সূচি পবিত্র করতে। সে ‘অঙ্গীকার করেছিল নিজের কাছে’ “ ‘জাতের নামে’ সীমাহীন ‘বজ্জাতি’ দেখলেও এমন স্নেহকে এভাবে অবমাননা” করবে না আর।
তারপর ‘আকাশ হতে খসল তারা’। খেয়ালির মামার বাড়ি ছিল সিলেটের পশ্চিমে খুঁজখাই গ্রামে। বহু পুরুষের বাস তাদের। চারপাশে মুসলমান বসতি। তাতে কোনোদিনই কোনও সমস্যা হয় নি। সিলেট গণভোটের দিনেও বাড়িটি প্রচার কেন্দ্র ছিল। ১৯৫০-এ স্থিতি বিগড়ে গেল। এক শীতের দিনে দাদু আক্রান্তও হলেন মুসলমান দুষ্কৃতির দ্বারা।এক সময়ে বাড়িটিও আক্রান্ত হল। এবং তাঁরা দেশ ছাড়তে বাধ্য হলেন। এসে উঠলেন শিলচর নরসিং স্কুলের উদ্বাস্তু শিবিরে।এমন সময়ের বাড়ির মেয়েদের নিরাপত্তার কথা ভেবে খেয়ালিকে কিছুদিন ‘হিন্দুস্তানে’ কাকিমার বাবার বাড়িতে পাঠানো হয়েছিল। সেখানে এসেই লোকের মুখে একদিকে শোনা যাচ্ছিল উদ̖বাস্তুদের দুর্দশা আর অবমাননার কথা আর বড়দের মুখে মুখে মুসলমানের নিন্দে। খেয়ালি এর কারণ কিছুই বুঝত না।কারণ তাদের চা-বাগানে ঠিকাদার চাচার সঙ্গে আরও অনেক চাচা আসেন। তাদের কেউকেউ মন্দ ভাবার কোনও কারণ সে কোনোদিনই দেখেনি।মাস দুয়েক থেকে সেবারে আবার বাড়ি ফিরেছিল খেয়ালি। দুর্গোৎসব গেল। দীপাবলি এল। বাড়িতে আবার কানাঘুষা শোনা গেল তাকে আর ছোটো পিসিকে গুয়াহাটি পাঠিয়ে দেবার প্রস্তাব পাঠিয়েছেন মেজ পিসি। সেই মেজ পিসির কী যে নাম। বড় পিসি বলেও কেউ রয়েছেন কি না। তিনি কেনই বা গুয়াহাটি থাকেন, কিছুই স্পষ্ট নয়। অনুমান করে নিতে পারি তিনি সেই বিধবা পিসি যাকে ঠাকুরদা নার্সিং পড়তে শিলং পাঠিয়েছিলেন। দীপাবলি গেল, ভাই ফোঁটাও গেল। উৎসবের আনন্দে কোনও ভাটার টান নজরে এল না। তবু শীত পড়তেই সেই পিসি এলেন। এবং ভাইঝি ও ছোটবোনকে নিয়ে দেশ ছাড়লেন। সুজিৎ চৌধুরীর হারানো দিন যারা পড়েছেন তাঁদের মনে পড়বে, পাইলগাঁও ছেড়ে যাবার পথে যখন সিলেটের বাসে চাপছিলেন তখনই একের পরে এক “পাইলগাঁওয়ের রাশি রাশি স্মৃতি মনের মধ্যে ভিড় করল।” এই কথা ইতিহাসের কথা। “বাজার হাট, গ্রাম,ধানক্ষেত দু’পাশে দ্রুত আসছে আর মিলিয়ে যাচ্ছে।” যাত্রা পথের এই সাধারণ বাস্তবতার কথাও আছে।কথাটি অসাধারণ হয় পরের বাক্যে “ বাস চলেছে সেরপুর থেকে সিলেটের দিকে,আর আমরা চলেছি শৈশব থেকে কৈশোরের পথে।” কিন্তু মুক্তি চৌধুরী যখন লেখেন, “ তারপর স্টেশন ছাড়ালেই একদল ছেলে বই খাতা নিয়ে পথ চলছে---গুটি কয় গরু এদিক ওদিক ছুটোছুটি করে ঘাস খাচ্ছে। ভাবতে অবাক লাগে যে ট্রেনে যেতে যেতে জীবনে একবারই শুধু ওদের সঙ্গে দেখা হয়। প্রাণ চাইলেও কখনই আর ধরা দেয় না এরা? কখনই না, একেবারেই না।”—তখন সে হয়ে উঠে ‘দর্শন’। সামান্য সংহত রূপ দেবার জন্যে ঘষামাজা করলেই হয়ে উঠত কাব্য। যে কোনও যাত্রা সম্পর্কে এ এক চিরন্তন উচ্চারণ।
সেই রেল যাত্রা সেরে গুয়াহাটির মাছখোয়ার এক ভাড়া বাড়িতে এসে উঠলেন। ছোটো পিসি সঙ্গে ছিলেন বোঝা যায়। মেজো পিসিও। কিন্তু সম্ভবত তাঁরা তিনজনেই ছিলেন না। আর যে কারা সঙ্গে ছিলেন বোঝা যায় না সহজে। সে বাড়ির পরিসর অল্প, প্রশ্রয়ও ততোধিক কম। তবু শেকড় ছড়াতে থাকে। দুই চারজন প্রতিবেশীর আদর যত্নে মন গুয়াহাটির আকাশে বাতাসে পাখা মেলতে শুরু করে।একদিন এসে পৌঁছন পান বাজারে স্কুলে,নাম লেখাবেন বলে। সেখানেই দরখাস্ত ও কাগজপত্র দেখে এক কর্মচারী যখন বললেন, “ অ,রিফিউজি,আসল বাড়ি তবে সিলেট।” খেয়ালির জানা হল,এই দেশে তার কোনও ‘আসল বাড়ি’ নেই। বছর ঘুরতে আরও একবার বাড়ি পাল্টাতে হয়েছিল। যাদের সঙ্গে ছিলেন তাঁদের সঙ্গে থাকাও সহজ হচ্ছিল না। অগত্যা মাঝে একবার মা-বাবা এসে তাকে সিলেটের বাড়ি নিয়ে গেছিলেন তো বটে, কিন্তু ফিরেও আসতে হয়েছিল। ক্রমে ক্রমে গিয়ে পৌঁছান শ্যামাদার ‘রবিবাসরীয় আসরে।’ শ্যামাদার নামটি তো নেই কিন্তু আসরটি যে গুয়াহাটির বৌদ্ধিক জগতে বেশ প্রভাব ফেলেছিল সে বোঝা যায়। নানা গুণীজনের সমাবেশ ঘটত সেখানে। ১৯৫১-৫২ থেকে এর শুরু। ‘কুঁড়ি’ নামে একটি হাতে লেখা কাগজও বেরুত। মাঝে মধ্যে নাটকও হত। সবেতেই হাত পাকাচ্ছিল খেয়ালি। পিসিদের ব্যাপক প্রশ্রয় ছিল। এক কাকার কথাও আছে। এবং আছে গোপনে তাঁরা বইপত্র বাদ্যযন্ত্রের ব্যবস্থা করে দিতেন। সেই গোপনীয়তা যে কাদের থেকে তা লেখিকা স্পষ্ট করেন নি। যাদের সঙ্গে ছিলেন তাঁরা যে মন থেকে নেন নি, মেনে নিয়েছিলেন মাত্র নানাভাবেই লিখেছেন। কিন্তু সম্ভবত আশ্রয় দিয়েছিলেন বলেই কৃতজ্ঞতার বশেই স্পষ্টবাক হন নি লেখিকা। লিখেওছেন,“নানাক্ষেত্রে নিজের ন্যায়- অন্যায় বিচারবোধ স্বচ্ছ হলেও বেশিরভাগ সময়েই নানা হিসেবের নিয়ন্ত্রণে পঙ্গু হয়ে থাকত এর বহিঃপ্রকাশ।” এই পঙ্গুত্ব তাঁর এই বইতেও আড়াল থাকেনা। শুধু বয়ন নৈপুণ্যে আড়াল করে গেছেন। কিন্তু এই ‘পঙ্গু’ত্বে পেছনে কেবল হিসেবই কাজ করছিল না। একেবারে শেষে ‘শেষ কথাটি...’-তে তিনি যে কৈফিয়ত দিয়েছেন এক কল্পিত বান্ধবীকে তাতে এক সহানুভূতিও স্পষ্ট হয়। সবাইই তো ছিলেন কোনও না কোনও ভাবে ‘দেশভাগেরই ঝঞ্ঝা-তাড়িত’। ফলে “ এই পরিস্থিতিতে স্বাভাবিকভাবেই স্বার্থপরতা বিবেক বুদ্ধি,স্নেহমমতা,বিচার-বিবেচনাকে কলুষিত ও মালিন্যময় করেছে,মানবিক গুণগুলিকে প্রাধান্য দিতে পারেনি সাধারণ মানুষ। তাই নির্দয়তার অভিযোগ এনে এদের দোষত্রুটির পরিমাণ নিরূপণের চেষ্টাও অনুচিত।”
অষ্টম শ্রেণিতে পড়বার সময় একদিন আর সেই বাড়িতে ফেরা হল না তার আর ছোটো পিসির। তাঁদের আশ্রয় দিলেন পাড়ারই এক ব্রাহ্মণ পরিবার। পরিবারের কারও নাম নেই। কেবল ‘রাণীমাসি’র উল্লেখে বোঝা যায় তিনি গৃহকর্তৃ। প্রায় বছর দেড়েক সেই অনাত্মীয়ের বাড়িতে আত্মীয়বৎ আদরে ছিলেন পিসি ভাইঝি।
রবিবাসরীয়ের সুবাদেই তখনকার বাঙালি ছাত্র সম্মেলনের বাৎসরিক সম্মেলনেও খেয়ালি নিয়মিত যোগদান করতে থাকে। তিনি রবিবাসরীয়ের মতো আরও বেশ কিছু অনুষ্ঠানের উল্লেখ করেছেন। নামোল্লেখ করেন নি। ‘ছিন্নমূলের ছেঁড়াপাতা’য় এক ঝলক মণিমেলা ও ‘খেলা’র উল্লেখ রয়েছে—যেখানে তাঁর যাতায়াত স্কুলে বয়সেই ছিল। সম্ভবত ‘সব পেয়েছির আসর’ বা ‘কিশোর সভা’ও ছিল। আনন্দবাজার পত্রিকা গোষ্ঠীর বিমল ঘোষের দ্বারা পরিচালিত হত প্রথমটি, আর দ্বিতীয়টি যুগান্তরের স্বপন বুড়ো তথা অখিল নিয়োগীর দ্বারা। পত্রিকা দুটির শিশু বিভাগগুলো এতই জনপ্রিয় ছিল যে এই সংগঠন দুটির শাখা তখন সিলেট সহ অসম বাংলার বহু জায়গাতেই গড়ে তুলেছিলেন বাঙালি পাঠকেরা। ‘কিশোর সভা’র প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন কবি সুকান্ত। যাই হোক, সেই ছাত্র সম্মেলনের অধিবেশনগুলো উপলক্ষে লিখে, গান করে প্রচুর পুরস্কার যেমন জুটতে থাকে তেমনি খেয়ালির কাছে আসবার সুযোগ ঘটে তখনকার অসম ও বাংলার বিখ্যাত সব বিদ্বজ্জনের। প্রচুর নাম। ছোটো পিসির বান্ধবী শুক্লা পিসির জ্যেঠতুতো দাদা ছিলেন কবি শঙ্খ ঘোষ। তিনি নতুন বিয়ে করে গুয়াহাটিতে বোনের বাড়িতে এলে তাঁদের সঙ্গে সাক্ষাতের কাহিনিটি ছোট্ট হলেও বেশ চিত্তাকর্ষক। এমনি করেই একদিন এই ছাত্র সম্মেলনেরই অধিবেশনেই দেখা হয়ে গেল হেমাঙ্গ বিশ্বাসের সঙ্গে। তাঁর সঙ্গে বেশ কিছুদিন লোকগানের অনুশীলনেরও সুযোগ মিলল। তাঁর সঙ্গে দেশবাড়ির কথা বলতে বলতেও বাড়ে নৈকট্য। মাঝে মধ্যে গণনাট্যেও যাতায়াত শুরু করে খেয়ালি। ১৯৫৬-৫৭-তে চিকিৎসার জন্যে তিনি চিনে চলে গেলেই সেই সান্নিধ্যে ছেদ পড়ে।
সুজিৎ চৌধুরীর ‘হারানো দিন হারানো মানুষ’-এর পরতে পরতে হাস্যরসের ছড়াছড়ি। উদাহরণ স্বরূপে আমরা দ্বিতীয় পর্বে সিলেটের জিন্দাবাজারে দাদার সঙ্গে মাছ কিনতে যাবার গল্পটি মনে করতে পারি। থলে নিয়ে যান নি বলে কাগজের মোড়কে মাছ কিনে ফিরছিলেন, পথে কাকের ঠোকরে ভেজা কাগজের মাছ সব পথে গড়াগড়ি দিল। সেখানে প্রেমাঙ্কুর আতর্থীর ‘মহাস্থবির জাতকে’র সেই ঘটনার উল্লেখ আছে যেখানে লেখকের বাবার হাত থেকে চিলে মাছ কেড়ে নিয়ে গিয়েছিল। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘অর্ধেক জীবনে’ চিলে হাত থেকে সন্দেশ নিয়ে যাবার গল্পটির উল্লেখ করেছেন। তো সুজিৎ রসিয়ে লিখছেন, “দেখা যাচ্ছে লেখকের আভিজাত্য অনুসারে আক্রমণকারী পাখির আভিজাত্য বদলে যাচ্ছে। ওদের ক্ষেত্রে আক্রমণকারী যদি চিল হয়, আমার ক্ষেত্রে তা কাক হওয়াটাই স্বাভাবিক। রবীন্দ্রনাথের হাত থেকে ছোঁ মেরে নিয়ে যাওয়ার কোনও ঘটনা ঘটলে পাখিটা নিশ্চয়ই হত বাজপাখি।” তেমন কিছুই মুক্তি চৌধুরীর রচনাতে মিলবে না। এই নিয়ে সম্ভবত তাঁকে জীবনেও প্রচুর কৈফিয়ত দিতে হয়েছে। বইটিতেও দিতে ভুল করেন নি। ‘শেষ কথাটি...’-তে সেই দরকারে এক বান্ধবীকে কল্পনা করে নিয়েছেন। সেই বান্ধবী তাঁরই ‘অন্য আমি’।আমরা আগেই লিখেছি কোন বিপন্নতা তাঁকে কেন গ্রাস করে। সুজিৎ চৌধুরীদের বিষয় সম্পত্তি সহ বিশেষ কিছু হারাতে হয় নি। যে জীবন সিলেটে ছিল বাবা বিভূতি ভূষণ সেই জীবনেরই পুনর্নির্মাণ করে ফেলেছিলেন করিমগঞ্জে এসে। সেও তো সিলেটেরই আরেক অংশ।মুক্তি চৌধুরী তাঁর নিজের আধখানাকে সেই দেশে রেখে এসেছিলেন।
কিন্তু নটে গাছটি ওখানে মুড়োয় নি। তখনও সম্ভবত ভাবেন নি ‘খেয়ালি’র আরও গল্প তিনি লিখবেন। তাই ‘শোনা যায়, শেষ বয়সে...’ --- সন তারিখ নেই। আমরা জানি সেটি ২০১১-তে।--- ‘শোনা যায়, শেষ বয়সে...’ খেয়ালি বাংলাদেশে গেয়েছে। “...সেই ফেলে আসা ‘আধ-খানা আমি’র স্পর্শ সুখ আশায় ঢেউয়ের মতো ভেসে বেড়িয়েছে।” ফেরার পথে নিয়ে এসেছিল লালন ফকিরের সাধন পীঠে কেনা একটি একতারা আর জন্মভূমির একমুঠো কালো মাটি।
কিন্তু দ্বিতীয় পর্বের শুরুতেই এসে হানা দেয় সেই সখি। শুরু তো হয়েছে ‘ছিন্ন মূলের ছেঁড়া পাতা’ ‘প্রস্তাবনা’ নামের একটি বেখাপ্পা প্রথা মেনে। তার পরে এক পৃষ্ঠার ‘আমি হৃদয়ের কথা বলিতে ব্যাকুল।’ সেখানে খুব ছোট্ট করে নেহরুর দুই একটি উক্তির উল্লেখ করে আভাস যেন দিয়ে রাখলেন মাত্র---স্বাধীন দেশের সব নাগরিক স্বাধীন হলেন তো? এর পরেই ‘...ভাবনারে কী হাওয়ায় মাতালো”। সেই সখি এসে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল, “...এরপরও তো কাঙ্খিত-অনাকাঙ্খিত দিবারাত্রিতে গাঁথা সময় চলেছে গড়িয়ে---তোমার বিষাদে ছলোছলো শৈশব কৈশোর এস নোঙর বেঁধেছে যৌবনের উপবনে, প্রৌঢ়ত্বের প্রাঙ্গণে। ... এই বাকি সময়টা বুঝি তোমার কাছে এতটাই গুরুত্বহীন!” যে কথাটি আমরা এখানে স্পষ্ট করে নিতে চাই সেই বিষাদ ব্যক্তির হয়ে থাকে নি আর। সমষ্টির হয়ে উঠেছে বলে ব্যক্তির কথা এখানেও আর থাকে না বেশি। কিন্তু সম্ভবত মাঝে পাঠ প্রতিক্রিয়া পেলেন বলেই তার প্রভাবে সমষ্টির তথ্যে এই দ্বিতীয় বইটি বেশ ভারি হয়ে পড়েছে। আগেরটি যদি হালকা মেঘে ইলশে গুড়ি বৃষ্টি ঝরিয়েছে, দ্বিতীয়টি তবে কালো মেঘের বর্ষণ। তাতে দুই বইয়ের স্বাদ সামান্য হলেও পাল্টে গেছে। কিন্তু উঠে এসেছে পূর্বোত্তরের মানুষের জীবন নিয়ে বিশেষ করে বাঙালি জীবন নিয়ে কিছু মৌলিক প্রশ্নও। অথবা সেই প্রশ্নগুলোর তাঁর ‘খেয়ালে’ জবাব। তিনি কোনও বিপর্যয়ের জন্যেই কোনও সম্প্রদায়কে দায়যুক্ত করেন নি। যদি করেছেন, তবে সে একটি মাত্র ঘটনাকে। সেই ঘটনার নাম ‘দেশভাগ’। আমরা সেই বর্ষণের কিছু আভাস দিতেই পারি। নইলে আর লিখতে বসা কেন?
শুরুতেই যেমন কটন কলেজের ‘প্রতিষ্ঠা’ নিয়ে বেশ বিস্তৃতই লেখা রয়েছে। কলেজের সামনে দিয়ে মেয়েবেলাতে ফুল কুড়োতে যেতেন, তখন তো আর ভাবেন নি এই কলেজই পরের জীবনে তার ছাত্র ও কর্মজীবন কেটে যাবে। আমরা জানি তিনি কটনের অধ্যক্ষাও ছিলেন। একটুকুর জন্যে পড়ার দিনে তাঁর কলেজ সন্দিকৈ কলেজ হয়ে যেতে পারত। তিনি বিজ্ঞানে ভর্তি হয়ে পরে কলাতে আসতে চেয়েছিলেন। শেষে কটনেই ব্যবস্থা হয়ে যায়। কটনের কথাতেই এসে পৌঁছুলেন তাঁর সঙ্গীত জীবনের কথাতে।
কটনের খুব কাছেই সারা রাতের শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের আসরে গিয়ে গান শোনার অভিজ্ঞতা হয়েছিল সেই কিশোর কালেই।বড়ে গোলাম আলিকেও শোনা হয়েছিল।তেমনি দশম শ্রেণিতে পড়বার কালে সারা অসম ভিত্তিক সংগীত প্রতিযোগিতাতে যোগ দেবেন বলে পদাবলী শিখতে হাজির হয়েছিলেন গিয়ে নিরাপদ মুখোপাধ্যায়ের কাছে। তিনি ডাক ও তার বিভাগে কাজ করতেন। বদলির চাকরিতে তখন গুয়াহাটি ছিলেন বছর কয়। তখন তাঁর বাড়িতেই রবিবারে রবিবারে সাপ্তাহিক গানের আসরে আসতেন আরও বহু গুণী শিল্পী।সেই প্রতিযোগিতার প্রতিটি বিভাগে উৎরে যাওয়াতে শিল্পী নিরাপদ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে যে আত্মীয়তার সূচনা হল---তা সারা জীবনের অর্জন হয়ে রইল। পরের জীবনে তাঁর কলকাতা বাড়িতে গিয়েও আরও বহু গুণীজনকে কাছে থেকে দেখার আলাপ করবার সুযোগ ঘটেছিল। তেমনি স্নাতকোত্তর পড়বার কালে আলাপ হয় এক সরোদ শিল্পী শিপ্রা ব্যানার্জির সঙ্গে। তিনি আলা উদ্দিন খাঁ-এর কাছেও শিখেছিলেন। গুয়াহাটির এক কলেজে ভিন রাজ্য থেকে এসে দীর্ঘদিন ইংরাজিতে অধ্যাপনা করেছেন। গড়ে তুলেছিলেন ‘সুরছন্দ’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান। সেই সংগঠন মাসিক সঙ্গীতানুষ্ঠানের আয়োজন করতেন। সেখানে সারা ভারত থেকে শিল্পীরা আমন্ত্রিত হয়ে এসে গাইতেন,বাজাতেন। আলি আকবর খাঁ-ও এসে বাজিয়ে গেছিলেন। সেরকমই আলাপ হয়েছিল, আত্মীয়তা গড়ে উঠেছিল বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের সঙ্গে।
আর সেই কটনের কথা হবে আর ষাটের ভাষা আন্দোলন ও রঞ্জিত বরপূজারির কথা হবে না—তাই কি হয়? হতে পারত। এই প্রসঙ্গে আমাদের মনে পড়ে আরও এক অসমের জাতিকা সিলেটি কন্যা এবং একই সঙ্গে সঙ্গীত শিল্পী বিজয়া চৌধুরীর ‘সিলেট কন্যার আত্মকথা’-র কথা। ঠিক এক দশক আগে ২০০৪-এ অনুষ্টুপ বের করেছিল বইটি। তিনি মুক্তি চৌধুরী বা সুজিৎ চৌধুরীর মতো থিতু হয়ে বসতে পারেন নি। দেশে বিদেশে প্রবাসী হয়ে কাল কাটিয়েছেন। সেভাবেই শিল্পী হয়ে উঠবার কঠিন যাত্রাটি সেরেছেন। সেই যাত্রার স্বাদ অন্যরকম। ১৯৬০-এ তিনি বিলেতেই ছিলেন। সেখানেই সেই বছরে তাঁর বিয়ে হয়। সেই জন্যেই শিলচর থেকে উড়ে গেছিলেন। কিন্তু বিবাহ বার্ষিকী উৎযাপন করেন ১৯৬১-র আগস্টে শিলঙে এসে। অথচ ভাষা আন্দোলন সহ কোনও ঘটনারই উল্লেখ নেই।প্রবাসী ছিলেন বলেই এটা হতে পেরেছিল। মুক্তি চৌধুরীর বেলা ঠিক এর উলটোটি ঘটেছে।প্রতিবেশের কথাই রয়েছে বেশি। আমরা যদি বই দুটির নাম দিতে পারি ‘মুক্তি চৌধুরী ও সমকালীন অসমের সমাজ’ তবে অনেকটা আক্ষরিক হয়। কিন্তু তিনি তো লিখেছেন ‘কাব্য’। তাই ‘ছেঁড়াপাতা’তে যেটুকু যা সম্ভব তাই লিখেছেন, সেটুকুই। ১৯৬০-৬১, ১৯৭২, ১৯৭৯-৮৫ পাতা ছেঁড়ার সব রহস্যকেই ধরেছেন।
ভাষা আন্দোলনের দিনগুলোতে তিনি কটনেই পড়ছেন। ঘটনাক্রম খানিক বিস্তৃতই লিখেছেন। পেছনকার কারণটিও সন্ধানের চেষ্টা চালিয়েছেন। “তবে খেয়ালি ভাবে, অসমে ভাষাকেন্দ্রিক সমস্যা সৃষ্টিতে দেশভাগও পরোক্ষভাবে হয়তো কিছু ইন্ধন যুগিয়েছিল।” কারণ সিলেট সহ প্রতিবেশী জেলাগুলো থেকে উদ̖বাস্তু স্রোত। কিন্তু প্রচারের বিপরীতে বাস্তবটা যে ভিন্ন তাঁর তিনি অধ্যাপক মণিরুল হাসানের গ্রন্থ থেকে তথ্য দিয়ে দেখিয়েওছেন। কটন কলেজে ৪ জুলাই রঞ্জিত বরপূজারির হত্যা—তার আগে পরে বাঙালিদের উপরে আক্রমণের অন্ধকারের বান্ধবী সঙ্গীত শিল্পী দীপালি বরঠাকুর যে ‘আচমকা আলোর ঝলক’ দেখালেন তাতে খেয়ালি দেখতে পায় ‘নিশ্চিন্ততার পথ’। দীপালি বড়ঠাকুরের উল্লেখটি যদিও সংক্ষিপ্ত আমাদের মনে পড়ছিল এমনটা এই ছবিই, তার চেয়েও বেশি কিছু চিত্রিত হয়েছিল সেকালের প্রেক্ষাপটে লেখা একমাত্র যে বাংলা উপন্যাস যুধাজিতের ‘মেখলা পরা মেয়ে’ ---তার নায়িকা শিবানীকে। ‘ধর্মের কোন্দল থেকে ভাষার লড়াইর কোপে’ পড়ে খেয়ালির মনে যখন প্রশ্ন জাগে “...এবারে যাবে কোথায়? কোন নিরাপদ দেশে?” তখন “...আবার দীপালির অমল হাতের উষ্ণ স্পর্শের অন্তরঙ্গতায় জুড়িয়ে যায় ভেতরের জ্বালা যন্ত্রণা।” এর আগে আমরা বিজয়া চৌধুরীকে নিয়ে লিখতে গিয়ে অন্যত্র লিখেছিলাম, “তবে কি বইটির নাম হতে পারত না ‘অসম কন্যার আত্মকথা’? এটি একটি দ্বিমুখী প্রত্যাখ্যানের আখ্যান। অসমিয়া না হলে অসমিয়া জাতীয়তাবাদী মনও কাউকে অসমের সন্তান বলে সহজে স্বীকার করে না। তেমনি বাঙালি মধ্যবিত্তেরও একটি প্রবণতা আছে, নিজেদের অসমে ‘প্রবাসী’ ভাবার। আর সিলেটিদের তো অবশ্যই একটি অভিমানও আছে। হিন্দিতে ‘অভিমান’ অর্থ কখনো ‘গৌরব’ কিংবা ‘দম্ভ’ও হয়। সিলেটিদের মনে এই দুই অর্থই ক্রিয়াশীল থাকে। তার ঐতিহাসিক কারণও রয়েছে নিশ্চয়। প্রথমত ব্রিটিশ ভারতে জোর করে সিলেটকে অসমে নিয়ে আসা, এবং দেশভাগের কালে অসমিয়া জাতীয়তাবাদী শাসকশ্রেণির একে জোর করে অসমের বাইরে ঠেলে দেবার চেষ্টা করা।ফলে অবচেতনে নির্বাসিতা ‘সিলেট’কে ধরে রাখবার বিপরীতে অসমকে প্রত্যাখ্যানের একটি মনস্তত্ত্ব সিলেটি মনেও কাজ করে। বৌদ্ধিক জগতেও দেখা যাবে সিলেট কিংবা এরই সম্প্রসারিত অঞ্চল কাছাড় তথা এখনকার বরাক-উপত্যকা নিয়ে যত অধ্যয়ন হয়ে থাকে বাকি অসম এমন কি বাঙালি জীবন নিয়েও কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে অধ্যয়ন অনুসন্ধিৎসা সময় যত এগুচ্ছে আর সেরকম সমানুপাতিক নয়,কমে আসছে।এর নানা সমস্যাও আছে নিশ্চয়।সব বৌদ্ধিক অনুশীলনকেই ‘অসমিয়া জাতীয়তাবাদের’ অনুমোদন লাভের একটি অলিখিত সামাজিক নিয়ম রয়েছে।” মুক্তি চৌধুরীর বই দুটিকে আমরা এই ব্যতিক্রমের সারিতে রাখতে চাই। দীপালি বরঠাকুরের বা এমন আরও অনেক উল্লেখে যেন মনে না হয় যে তাঁরও “‘অসমিয়া জাতীয়তাবাদের’ অনুমোদন লাভের” কোনও প্রয়াস রয়েছে। তাঁর পুরো রচনাতে কেবলই জন্মভূমিকে ছেড়ে আসবার কারণটিকে ক্রমাগত লঘু করবার প্রয়াস আছে। জন্মভূমি আর কর্মভূমির মধ্যে ফারাকটি যে খুবই কম—তাই দেখাবার প্রয়াস রয়েছে। এখানেও যদি লড়াই করতে পারেন, ওখানেই বা লড়তে দোষ কী ছিল? এখানে একটি কথার উল্লেখ তো করতেই পারি। তখনকার পুব পাকিস্তান, বর্তমান বাংলাদেশ প্রসঙ্গে নারীর নিরাপত্তার প্রশ্নটি প্রচারিত হতেই থাকে।তরুণী কিশোরীদের নিরাপত্তার কথা ভেবেই তো বাকি পরিবার রয়ে গেলেন আর মুক্তি চৌধুরী তাঁর পিসিদের সঙ্গে চলে এলেন। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে অসম আন্দোলনের দিনেও অসমে কোনও নারীই নিশ্চিন্তে থাকতে পারেন নি। ভাষা আন্দোলনের দিনে কত শত বাঙালি নারীদের হত্যা ধর্ষণ আর শ্লীলতা হানি হয়েছিল তার বিস্তৃত বর্ণনা সম্প্রতি উঠে এসেছে দেবব্রত শর্মা ও দয়াসাগর কলিতার গবেষণা গ্রন্থ ‘১৯৬০ চনর ভাষা আন্দোলন’-এ। খেয়ালিরও মনে হচ্ছিল কানে শোনা যেই ভৈরবপুলের হত্যালীলার আবহেই যেন সে বাস করছে গুয়াহাটি শহরে।
‘সেই অন্ধকারের উৎস হতে উৎসারিত আলো’ হাতে তখন হেমাঙ্গ বিশ্বাস ও ভূপেন হাজরিকার নেতৃত্বে ‘Let Us Meet Cultural Troupe’ শিলং থেকে শুরু করে গোটা ব্রহ্মপুত্র উপত্যকাতে হিংসার বিরুদ্ধে সাংস্কৃতিক অভিযান। সেই অভিযানে তৈরি হয়েছিল দুটি ঐতিহাসিক গান---‘হারাধন –রংমনের গান’, ও ‘মানুষ মানুষের জন্য’। এর মধ্যে দ্বিতীয়টি বাংলা হিন্দি সহ ভারতের নানা ভাষাতে অনূদিত হয়ে এখন বিখ্যাত। সেই অভিযানে যাবার প্রবল ইচ্ছে ছিল খেয়ালির। কিন্তু একে বাঙালি, তায় মেয়ে। পরিজনদের অনুমতি মিলল না, উপেক্ষা করবার সাহসও হল না। কিন্তু পাড়ারই গণনাট্য সঙ্ঘের কর্মী প্রণব ঘোষের বাড়িতে গিয়ে প্রতিদিন খবর সংগ্রহ প্রায় নিয়মেই পরিণত হয়েছিল।
‘...একসময় আকাশ থেকে মেঘ কাটতে লাগল।’ বন্ধ কলেজের অসমিয়া সহপাঠীদেরই অনেকে বাড়ি এসে আবার ক্লাসে যোগ দিতে বলল। সম্ভবত তারা এমন বহুকেই বলে কয়ে কলেজে ফিরিয়েছে। কিন্তু গোমটভাবটা তখনও পুরো কাটেনি। দর্শনের ক্লাসে গিয়ে দেখেন অসমিয়া বান্ধবীরা বান্ধবীরা সরে সরে বসেছে। শিক্ষক কনক দাস এসে সবাইকে পাশাপাশি বসতে ‘সমন’ দিলেন। আবার এমন অধ্যাপকও ছিলেন যিনি বিদ্রূপ করে জিজ্ঞেস করেছিলেন, “ কি? এ্যাদ্দিন কোথায় ছিলে? কলকাতায় পালিয়েছিলে বুঝি? তা ওখানে বুঝি কোনও ব্যবস্থা হল না? ফিরে এলে কবে?” বিদ্বেষের অন্ধত্ব এতই গাঢ় তখনও ছিল, এখনও আছে কিছু লোকের মনে। ধরেই নেওয়া হয়, বাঙালি যখন কলকাতা তো যাবেই পালিয়ে। এমন ঘায়ে প্রলেপ মাখাবার মতো অধ্যাপকেরও অভাব ছিল না। তাঁদের অনেকে কথা তিনি বেশ বিস্তৃতই লিখেছেন—যেমন তারিণী কান্ত ভট্টাচার্য বা অধ্যাপক বিজন কৃষ্ণ চৌধুরীর কথা। বিরিঞ্চি কুমার বরুয়ার অধীনে গবেষণা করবেন বলে ঠিক করাই হয়ে গেছিল। তাঁর অকাল মৃত্যুতে করলেন গিয়ে অধ্যাপক অজিত দত্তের অধীনে। সেই প্রসঙ্গে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের রেক্টর ত্রিগুণা সেনের স্নেহ সান্নিধ্যে এক মিষ্টি বিকেলের বর্ণনা করেছেন। করতে করতেই এসেছে অধ্যাপক লক্ষ্মীনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়ের কথা। কটনের এককালে অধ্যক্ষ ছিলেন। তাঁকে মুক্তি চৌধুরী দেখেন নি কখনও, শুনেছেন বহু জনশ্রুতি। এর মধ্যে একটি এমনও আছে যে “...সন্তানের অকাল মৃত্যুর পর শবদাহ করে এসে যথারীতি শ্রেণিকক্ষে উপস্থিত হয়ে পাঠদান করেছিলেন তিনি।” তিনি অবসর নেবার পরে ছেলের কাছে গিয়ে মিরাটে থাকতেন। মুক্তি চৌধুরী তখন কটনে পড়ান। তাঁরও এক দিদি মিরাটে থাকেন। তাঁর আমন্ত্রণে মিরাট গেলে এক বিকেলে রবাহূত হয়ে ‘বয়সের ভারে ন্যুব্জ’ অধ্যাপক লক্ষ্মীনারায়ণ শুধু এই শুনে তাঁকে দেখতে হাজির হলেন যে, তিনি কটনে পড়ান। তাঁর থেকে কটনের কথা, গুয়াহাটি শহরের কথা শোনা যাবে। শোনা যাবে অসমের কথা। কর্মভূমির প্রতি এহেন স্বতোৎসারিত প্রীতির সংবাদ উগ্রজাতীয়তাবাদীরা রাখেন কি না আমরা জানিনা। তাঁরা এখনো বাঙালিকে ‘দেশপ্রেমে’র পাঠ পড়ান।
কিন্তু ‘নিত্য নিষ্ঠুর দ্বন্দ্বে’র পালা তো শেষ হবার ছিল না। পরের বছরেই তো শিলচরে বাংলাকেও রাজ্যের সহযোগী ভাষা করবার দাবিতে এগারোজন শহিদ হলেন। ১৯৫০-এ পুব পাকিস্তানে হত্যালীলায় বিপন্ন মামার বাড়ির লোকেরা শিলচরে এসে শরণ নিয়েছিলেন। এক দশকের পরেই শিলচরে এই হত্যালীলাতে আতঙ্কটি খুব স্বাভাবিক। কিন্তু তাঁর দাদু আরও এক বিপন্নতার কথা বলেছিলেন তাঁকে। “...শিলচরের এক পুরোনো বাসিন্দা নাকি তাঁকে বলেছিলেন যে পাকিস্তানি বাঙালিরা এসেই সব গণ্ডগোল পাকিয়েছে। নইলে এই টাটকা ছেলেমেয়েগুলোকে এভাবে প্রাণ দিতে হত না।” স্কুলে যাবার প্রথম দিনেই যে ‘রিফিউজি’ শব্দটির সঙ্গে তাঁর পরিচয় ঘটেছিল আমরা আগেই লিখেছি।গবেষণা কালে দীর্ঘদিন কলকাতা থাকাকালেও এমন উষ্মা ব্যঙ্গ বিদ্রূপের সাক্ষী তাঁকে হতে হয়েছিল। ‘রিফিউজি’ মেয়েরা সাইকেল চালায়, চাকরি করতে ছোটে—দেখে বহুর নাক কোঁচকাত।
সেই দশকেই ১৯৬৫-তে ভারত পাক যুদ্ধ হল। আর মুক্তি চৌধুরীর পরিজন তখনও সেই দেশেই থাকেন। খেয়ালি যে ‘ভয়ে আতঙ্কে ছটফট’ করতে থাকবে স্বাভাবিক। উদাসীন থাকা তাঁর পক্ষে সম্ভবই ছিল না। “ নিজের জন্মভূমি ও ঘনিষ্ঠ জনের বাসভূমি বলে রাজনীতির মারপ্যাঁচে বীতরাগ খেয়ালিও তখন ওই দেশের রাজনৈতিক হালচাল সম্পর্কে বেশ সজাগ ছিল।” সেই প্রসঙ্গেই তিনি ছুঁয়ে গেলেন বাহান্নর ভাষা আন্দোলন এবং মুক্তিযুদ্ধের কাহিনি। খুব স্বাভাবিক যে খেয়ালির মনে প্রশ্ন দেখা দেবে, “...জীবনে তবে কোনটা সঠিক? ধর্ম না ভাষা---না অন্য কিছু?” কোনও জবাব কোথাও দেবার চেষ্টা করেন নি লেখিকা। দুয়েতেই কিন্তু তৈরি হয় ‘সংখ্যাগুরুবাদ’। যে সংখ্যাগুরুবাদের সারাক্ষণ ভয়---সংখ্যালঘু হয়ে পড়বার। সব অধিকার আর মর্যাদা হারাবার আশঙ্কাতে সে নিজেই সংখ্যালঘুদের কাছে হয়ে উঠে মূর্তিমান আতঙ্ক। বৈষম্যকে দেয় বৈধতা।
সেই ১৯৪৭-৫০-এর পরে আবারও শরণার্থীর স্রোত বইল অসমে,মেঘালয়ে,ত্রিপুরাতে। তাদের অধিকাংশ চলে গেলেন। কিন্তু বহু রয়েও গেলেন। স্বাভাবিকভাবেই অসমের ভাষিক জাতীয়তাবাদের সংখ্যালঘু হয়ে পড়বার আতঙ্ক প্রাণ ফিরে পেল। স্নাতকোত্তর অব্দি ইংরাজির সঙ্গে কবলই অসমিয়া ভাষাকে মাধ্যম করবার দাবিতে আরও একবার ত্রাস নেমে এল। খেয়ালির এবারেও মনে হয় দেশভাগ না হলে সম্ভবত এসবের কিছুই হত না। বাড়িতেই পিসি পিসতুতো দিদিদের সঙ্গে এই নিয়ে তাঁর তর্ক হয়। সেই সঙ্গে এই কথাও স্বীকার করছেন, “ আর বাঙালিদের না উঁচু ভাবও এর জন্য অনেকটা দায়ী। আত্মম্ভরিতার অনল অনেক সময়েই গ্রাস করেছে তাদের মানবিক উদারতাকে।”
এই প্রতিটি হাঙামাতে এদেশে বা সেদেশে তাঁর কোনও না কোনও আত্মীয় বিপন্ন হয়েছেন। বাহাত্তরের হাঙামাতেও ডিব্রুগড়ের কাছে বকখালি চা-বাগানে ম্যানেজার ছিলেন তাঁর এক আত্মীয় সতীন্দ্র কুমার দাস। তাঁর বাংলো আক্রান্ত হয়। কন্যা মনীষী নিহত হয়। গুয়াহাটিতে এক অসমিয়া অধ্যাপকের বাড়িতে ভাড়া থাকতেন মুক্তি চৌধুরী। সেই বাড়িটিও তাঁকে ছাড়তে হয়। বহু সহানুভূতিশীল অসমিয়া ভদ্রলোকেরাও অসমিয়া পাড়া ছাড়বার পরামর্শ দেন। এদের মধ্যে সাহিত্যিক বীরেন্দ্র কুমার ভট্টাচার্যও ছিলেন, যিনি বাড়িতে এসে নিরাপত্তার স্বার্থেই দুঃখ প্রকাশ করে বাঙালি পাড়াতে চলে যেতে বললেন। মুক্তি চৌধুরী লিখছেন, ‘ দুই দশক পার না হতেই’ অসমে ইংরাজি মাধ্যমের স্কুল কলেজের ছড়াছড়ি। আর মেয়েরা মেখলা বা শাড়ি ছেড়ে এখন টপ জিনস পরছে। অথচ এই সবের জন্যেই কতনা রক্তপাত, ঘর পোড়ানো আর ধর্ষণ।
বাহাত্তরের ত্রাস সাময়িক স্তিমিত হয়েছিল মাত্র। দশক শেষ না হতেই মঙ্গলদৈ লোকসভা আসনের উপনির্বাচনকে কেন্দ্র করে শুরু হল ‘অসম আন্দোলন’। ১৯৮৫ অব্দি টানা ছবছর চলল। নেলি, গহপুর, গোঁসাইগাওঁ, শিলাপাথারে লাখো লোক আবারও ঘর হারিয়ে বাস্তুচ্যুত হলেন। অসমের অন্যত্র ও প্রতিবেশী রাজ্যে শরণার্থী হলেন। হাজারো মারা গেলেন। সমানে ধর্ষিতা হলেন। অসমিয়া সমাজের প্রতি সামান্যতম বিদ্বেষ না থাকা সত্ত্বেও কেবল বাঙালি ছিলেন বলে এবারে আর ভাড়া বাড়ি নয়, প্রদেশটাই ছেড়ে যেতে হয় কি না মুক্তি চৌধুরীর আশঙ্কা দেখা দিয়েছিল। এই দীর্ঘ আন্দোলনে ছাত্র-ছাত্রী এবং সহকর্মীদের বহুর থেকে আশ্বাস যেমন পেয়েছেন অবিশ্বাস আর ঘৃণার আঁচও তাঁকে সইতে হয়েছিল। “ কর্মক্ষেত্রে শিক্ষিতজনের অমার্জিত আলাপে-সংলাপে এই বিদ্বেষের তীব্রতা গোপন রইল না। বাক্যবিন্যাসে রইল না সৌজন্যের ছায়ামাত্র।” এই আন্দোলনগুলোর কথা বেশ বিস্তৃতই টেনেছেন তিনি। উল্লেখ করেছেন নানা জনের নানা দৃষ্টিভঙ্গির কথা। কিন্তু নিজে শমে ফিরেছেন সেই ‘দেশভাগে’ এসে।
অসম আন্দোলনের ধ্বনি প্রতিধ্বনিত হয়েছিল ত্রিপুরাতেও। তখন বামফ্রন্ট সরকার সদ্য এসেছে ক্ষমতাতে। ১৯৮৯-তে স্বশাসিত জেলা পরিষদের বিল পাস হল। তবুও ‘বিদেশি বিতাড়নে’র ধুয়া উঠল। আগুনে ঘি ঢালল ‘আমরা বাঙালি’ দল। বাঙালির হাতে নিহত হলেন শিক্ষক প্রভাত দেববর্মা সহ কিছু জনজাতি মানুষ।প্রতিক্রিয়াতে ঘটল ‘মান্দাই’ হত্যালীলা। খেয়ালির সেই একই সিদ্ধান্ত “এতেও রয়েছে দেশভাঙার পরোক্ষ ইন্ধন।”
১৯৮৩-তে নেলি হত্যার বছরে আই এম ডি টি আইন এল। ২০০৫-এ এটি সর্বোচ্চ আদালতে পরিত্যক্তও হল।১৯৮৫-তে অসম চুক্তি হল। এর পরেও কেটে গেছে তিনের বেশি দশক। বিদেশি বাছাই ও বহিষ্কারের পথের সন্ধানে ডি-ভোটার এল, ডিটেনশন ক্যাম্প এল। এল এন আর সি। প্রচুর মানুষ নিতি-নব আইনের গ্যাঁড়াকলে নিঃস্ব হলেন, আত্মহত্যাও করলেন। কেউ জানে না এই ‘পথের শেষ কোথায়’? এই প্রশ্নে এসে খেয়ালির কলমে লেখিকা মুক্তি চৌধুরী থামেন এসে, “ ভারতভাগের সত্তর বছর পরেও যদি এই সমস্যা অমীমাংসিত হয়ে রইল, তবে এর শেষ কোথায়?—কোন পথে?”
তা খেয়ালির কি নিজের কাছে নিজের কৈফিয়ত দেওয়া হল? হল না তো। ‘ব্যথায় কথা যায় ডুবে যায়’ এবং গেল। আর তাতেই কাব্য হল এরকম,“এক কৃষ্ণা চতুর্দশীর রাতে খেয়ালির আজন্ম সঙ্গিনী সেই বান্ধবী এল সাজিভরা প্রশ্ন নিয়ে।বাইরে হালকা হাওয়া বইছিল,আকাশে নিস্তেজ তারাদের ঝাপসা সাজ। ঘুমকাতুরে জোনাকিরাও যেন ঠিকঠাক আলমোড়া ভাঙতে পারছিল না। দূর প্রান্তরে ঝিঁঝিঁর একটানা সুর। তবু অদ্ভুত এক করুণ নৈঃশব্দে ডুবেছিল গোটা পৃথিবী।” তারপরে কী হল? “বহুদিন পর আবার এক নিঝুম রাতে ভারতের পুরোনো মানচিত্রটি খুলল খেয়ালি।” তাঁর সে কৈফিয়তের পালা শুরু হয়েছিল এই ‘মানচিত্রে’র কথাতে। আমরা লিখেছিলাম। এত দূর এসে কি মনে আছে? “খেয়ালির দুচোখে অশ্রুনদীর প্লাবন—চোখমুখ সব বানভাসি। সেই কবে সে-ও তার ভারতবর্ষকে হারিয়েছে---হারিয়েছে কত প্রাণের মানুষ---হারিয়েছে তার ভালোবাসার দেশ। তবু কেন যে এখনও বুকের কাছে আঁকড়ে রয়েছে অখণ্ড ভারতের সেই পুরোনো মানচিত্র সে নিজেও জানে না। হ্যাঁ--- মানচিত্রটি জলে ভেজা।” বইটির একটাই ত্রুটি। চোখে জল যত আছে, আগুন তত নেই। মানচিত্রটিকে আগুনে সেঁকার কথা নেই। j