বরাক বাঁধের বিরুদ্ধে
।। সুশান্ত কর ।।
(লেখাটা আজ ০৯-০৭-০৯ তারিখের দৈনিক জনকণ্ঠে ছেপেছে | উপরের ইংরেজি শিরোনামে ক্লিক করুন, কাগজটা খুলবে ।
১৯৫৪ তে প্রথম টিপাইমুখ বাঁধ তৈরির সিদ্ধান্ত হয় । জাপানি কারিগরি সহায়তা কাজে লাগিয়ে বাঁধটি তৈরি হবে ঠিক হয়েছিল। তখনকার মূল্যে খরচ ধরা হয়েছিল আনুমানিক ১,০৯৭ কোটি টাকা। এখনকার মূল্যে প্রায় ৪,৮৮২ কোটি টাকা। সেই থেকে আজ প্রায় ৫৫ বছর ধরে শোনা যাচ্ছে টিপাই মুখে বরাক বাঁধ হচ্ছে । এখনো হচ্ছে ! দেশের অন্যান্য বড় বাঁধের বিরুদ্ধে যখন বড় বড় আন্দোলন গড়ে উঠছে তখন বরাক উপত্যকার মানুষকে রীতিমত আশ্বস্ত করা হয়েছে যে এই বাঁধ তাদের চির দিনের বন্যা ও বিদ্যুৎ সংকট দূর করবে আর বরাকের মধ্যবিত্ত তা বিশ্বাসও করে বসে আছেন । এর বিরুদ্ধে যে কোনো স্বরকে তারা প্রতিবেশী রাজ্য বা দেশের ষড়যন্ত্র হিসেবে ভাবতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছেন। কী আশ্চর্য! এই রাজ্যেরই অন্যত্র ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার অববাহিকা অঞ্চলের মানুষ যখন উঁচু বাঁধের বিরুদ্ধে সরব তখনো বরাকের মধ্যবিত্ত মানুষ ‘বরাক বাঁধের’ মায়া জালে বাঁধা রয়েছেন।
এই মায়া জালের রহস্য নিয়ে মনিপুরেরে লেখক ইয়েঙ্খম জিলাঙ্গাম্বা কাংলা অনলাইনের এক নিবন্ধে১ খুব সুন্দর মন্তব্য করেছেন। তিনি লিখেছেন, সমাজের কিছু অংশের মানুষের কাছে আধুনিকতা আর উন্নয়ন মানে বিশাল সব প্রকল্প—বড় বাঁধ, বড় সেনা বাহিনী , বড় আমলা বাহিনী, বড় শক্তি প্রকল্প ... উন্নয়নের এই বাকধারাতে সবকিছুর বিশালতার কল্পনাকে কেন্দ্রীয় বিষয় করে তোলার ব্যাপারটি উপনিবেশোত্তর ভারতে সবচে ভালো ধরা পড়েছিল নেহেরুর এই কথাতে যে,” Big Dams are the Temples of Modern India'. কারা লাভবান হবে এবং তাদের সে লক্ষ্যটি কী--- উন্নয়ন প্রকল্পের আকারটি তার সঙ্গে ঘনিষ্ট ভাবে জড়িত। জিলাঙ্গাম্বার মূল বক্তব্য , নতুন গড়ে উঠা মধ্যবিত্ত যাদের প্রচুর সম্পদ রয়েছে তারা নিজেদের চারপাশে সবকিছুকে এতোবড় করে দেখতে চায় যেন নিজেদের দেশের বা বিদেশের অন্যান্য অগ্রসর অংশের শ্রেণিভাইদের নিজেদের সমগোত্রীয় বলে কল্পনা করতে পারে। এরই জন্যে ভারতের মধ্যবিত্ত পোখরাণে পারমানবিক বোমা বিষ্ফোরণেরও পক্ষে দাঁড়িয়েছিল। “In their civilization hierarchy' these are the ladders to achieve development.”
জিলাঙ্গাম্বার বক্তব্য অনুসরণ করলে আমাদের বুঝতে অসুবিধে হয় না , কেনো গেল দেড় দশকে নিজের বাবার নামে এক খেলার ষ্টেডিয়ামের বাইরে আর তেমন কিছু সফলতা না দেখাতে পারলেও আমাদের সদ্য পরাজিত সাংসদ ছাড়া কেন আমাদের বরাকের মধ্যবিত্তের এক বড় অংশ নিজেদের বড় অসহায় বোধ করেন। সৌরভ সুনীল বা কিশোর কুমার গাঙ্গুলীর মতো নিজেদের লোক বলে পরিচয় দেবার জন্যে বিশাল ব্যক্তিত্ব সারা ভারতে তাদের আর কেউ নেই যে !! সুতরাং তিনি যা বলবেন তাই বেদ বাক্য !! তিনি বলে গেছেন, বরাক বাঁধে আমাদের মুক্তি! সুতরাং আমাদের মুক্তি বটে!!
যে নেহেরু একসময় বলেছিলেন , ‘বড় বাঁধগুলো হচ্ছে আধুনিক ভারতের মন্দির’ সেই তিনিই কিন্তু অভিজ্ঞতার থেকে শিক্ষা নিয়ে নিজের মত পাল্টেছিলেন । অরুন্ধতী রায় বহুবার কথাটার উল্লেখ করেছেন তাঁর লেখাতে । বিখ্যাত রাজনৈতিক ঐতিহাসিক রাম চন্দ্র গুহ২ লিখেছিলেন, জীবনের শেষের দিকেই ১৯৫৮তে সেচ ও শক্তি সংক্রান্ত কেন্দ্রীয় বোর্ডের এক সভাতে নেহেরু বলেছিলেন, ‘আমাদের এক বিপজ্জঙ্ক দৃষ্টিভঙ্গী গড়ে উঠছে।’ তিনি একে বলেছিলেন ‘বিশালত্বের রোগ’ (Disease of Giganticism) । নেহেরু বলেছিলেন, “শুধু এটা দেখাবার জন্যে যে আমরাও বড় কাজ করতে পারি ----বড় কাজ করা বা কাজের কথা ভাবাটা মোটেও ভালো দৃষ্টিভঙ্গি নয়। আধ ডজন জায়গাতে এক ডজন বড় প্রকল্পের থেকে ছোট ছোট সেচ প্রকল্প, ছোট ছোট শিল্প,ছোট ছোট শক্তি উৎপাদন কেন্দ্র অনেক বেশি করে এদেশের চেহারা পাল্টে দিতে পারে।” নেহেরুর এই বক্তব্য পাওয়া যাবে নেহেরু স্মারক যাদুঘর ও গ্রন্থাগারের ১৯৮৮তে প্রকাশিত বিজ্ঞান ও সমাজ বিষয়ে নেহেরুর বক্তৃতামালাতে । ভাষণটির শিরোনাম ‘ Social Aspects of Small and Big Projects’ . তাঁর এই মত পালটানোর কারণ ব্যাখ্যা করে শ্রী গুহ লিখেছেন, তাঁর ছিল বৈজ্ঞানিক মন। অভিজ্ঞতা আর নতুন তথ্য পাতি যদি অন্য কথা বলত, তবে তৎক্ষণাৎ তিনি মত পাল্টাতে দ্বিধা করতেন না।
কিন্তু, ততদিনে বোধহয় সেই ‘বিশালত্বের রোগ’ বেশ জাঁকিয়েই বসেছে। নিরাময়ের অতীত হয়ে গেছে। তাই তাঁর সময়ে উদ্বোধন করা নর্মদা বাঁধের কাজ যেমন পরে থামে নি তেমনি এখোনো হাজারো নতুন বাঁধের বড় কল্পনা আমাদের রোমাঞ্চিত করে। শিঙ্গুর থেকে টাটাদের চলে যাওয়া বিলাসী মধ্যবিত্তকে হতাশ করে । কত যে মানুষ কীট পতঙ্গের মতো কীট পতঙ্গের সঙ্গে করে তাতে বিপন্ন হবে তার হিসেব মধ্যবিত্ত করে কই ! সেই কীট পতঙ্গগুলো যদি বেশি ‘বেগড়বাই’ করে তবে দেশদ্রোহী, বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী, স্বার্থান্বেষী ইত্যাদি অবিধা দিয়ে পুলিশ-মিলিটারি লেলিয়ে দিলেই হলো। দেশটাতো আর এই কীট পতঙ্গদের নয় !
আমরা যারা বরাক ডামের স্বপ্নে বিভোর তাঁরা ভেবেও দেখি না যে স্বাধীনতার পর থেকে এই যে হাজার হাজার বাঁধ তৈরি হলো তারা আসলে এ দেশটাকে দিয়েছে কী? দেড় দশক আগে বিশ্বায়নের শুরুর দিনগুলোতে এই উল্লসিত মধ্যবিত্তরা আমাদের মতো মুখ্যুসুখ্যুদের যেমন ধমক দিয়ে জানাচ্ছিল যে বিশ্বায়ন আমাদের দেশকে উন্নত বিশ্বের সারিতে নিয়ে যাবে, তারা এখন মন্দার বিশ্বে নির্লজ্জের মতো মৌনব্রত অবলম্বন করে বসে আছে। এম-বি-এ পড়াবার স্বপ্ন নিয়ে বড় করা ছেলেক নীরবে আই-এ-এস পরীক্ষার জন্যে প্রস্তুত করছে। তেমনি পঞ্চাশের দশকে এই মধ্যবিত্তরা জানাচ্ছিল বড় বড় বাঁধ না হলে নতুন এই রাষ্ট্রকে নিজের পায়ে দাঁড় করানো যাবে না। এতোদিনে এরা এ দেশে দশটা পাঁচটা নয় তিন হাজার ছ’শটা বড় বাঁধ তৈরি করে ফেলেছে। তার পরেও এই গ্রীষ্মে আমরা দেখেছি সারা দেশ বৃষ্টির অভাবে খরাতে জ্বলছিল। দিল্লি থেকে শুরু করে নগরে নগরে জলের জন্যে হাঙ্গামা হয়েছে। পুলিশের লাঠি গ্যাস ছুঁড়েছে। বিদ্যুতের অভাবে নাকাল হয়েছে দেশে মানুষ । বন্ধ রয়েছে কল কারখানা। এখোনো এই দেশে ২০ কোটি লোকের কাছে বিশুদ্ধ পানীয় জল এক দুঃস্বপ্ন। ৬০ কোটিরো বেশি লোক তিন দিক সাগর ঘেরা এই দেশে শুধু জলের অভাবে স্বাস্থ্যকর পরিচ্ছন্ন জীবন যাপন থেকে বঞ্চিত হয় । ঐ মিথ্যেবাদী মিথ্যুক মধ্যবিত্ত তখন সেই নাটকের দৃশ্যগুলো নিজেদের শীততাপ নিয়ন্ত্রিত ঘরে বসে ফ্লাট টিভিতে বসে দেখে আর উপভোগ করে ।
অরুন্ধতী রায় তাঁর বিখ্যাত ধ্রুপদি রচনা “The Greater Common Good” এ লিখেছেন আমরা এ পর্যন্ত সারজা ক্রিকেটে কতটা উইকেট হারালাম হিসেব করে বলে দিতে পারব, কিন্তু কেউ জানে না এতোগুলো বাঁধ ঠিক কত মানুষকে এ পর্যন্ত ভিটেচ্যুত করেছে। ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অব পাব্লিক এ্যাডমিনিস্ট্রেশ্যন একবার ৫৪ খানা বড় বাঁধের দ্বারা ঠিক কত মানুষ ভিটেচ্যুত হয়েছেন তার একটা হিসেব বের করেছিল। তারা দেখিয়েছিল প্রতিটি বাঁধ গড়ে ৪৪,১৮২ মানুষকে বাস্তুচ্যুত করেছে। অরুন্ধতী তাঁর স্বাভাবিক রসবোধ ব্যবহার করে বলেছেন , চলুন, ধরে নেয়া যাক যে এই হিসেবে কিছু ভুল ভ্রান্তি আছে। আমরা ধরে নিই যে বাঁধ প্রতি ১০,০০০ মানুষই বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। তাহলেও শুধু স্বাধীনতার পরে তৈরি ৩,৩০০ বাঁধে বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা দাঁড়ায় ৩ কোটি ৩০ লক্ষ !! তিনি পরিকল্পনা আয়োগের আয়ুক্ত এন সি সাক্সেনার উদ্ধৃতি দিয়ে জানিয়েছেন সংখ্যাটা আসলে ৫ কোটির কম হবে না। গুজরাটের জনসংখ্যার থেকেও এ সংখ্যাটা বড়। অস্ট্রেলিয়ার জনসংখ্যার থেকে তিন গুণ বেশি এ সংখ্যা ! পেলেস্তাইন যুদ্ধের স্মরণার্থীদের থেকে এই সংখ্যা দশগুণ বেশি । ১৯৪৭এর দেশ ভাগে যত লোক স্মরণার্থী হয়েছিলেন তার থেকেও তিন গুণ বেশি লোক বড় বাঁধের ঠেলায় হাজার বছরের বাড়ি ছাড়া হয়েছেন। অরুন্ধতী দেখিয়েছেন বাবরি মসজিদ নিয়ে যাঁরা দেশ কাঁপাবার রাজনীতি করে তাঁদের সমর্থণে গুজরাটের সরকার প্রত্ন প্রস্তর যুগের বহু প্রাচীন মন্দির তথা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকেও জলের তলায় নির্বিকার তলিয়ে যেতে দিয়েছে। আমরা এখন এর সঙ্গে ‘রামসেতু’ নিয়ে এদের রাজনীতির ভণ্ডামোকেও স্মরণ করতে পারি নিশ্চয়ই। ‘রামসেতু’ নর্মদা বাঁধের নিচে হলে ওরা মুখে কুলুপ এঁটে বসে থাকত ।
আমাদের বিলাসী মধ্যবিত্ত পাঠকেরা নিশ্চয়ই ভাবছেন, দেশভাগের স্মরণার্থীদের মতো এই বাঁধে বাস্তুচ্যুতরা নিঃস্ব হয় নি কেউ। সরকার নিশ্চয় এদের যথোপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দিয়েছে। আমরা সে হিসেবে গিয়ে এ লেখা দীর্ঘ করছিনা। শুধু অরুন্ধতীর একটা কথা উদ্ধার করছি। তিনি লিখেছেন, ‘এই জনজাতীয় কৃষক মানুষের কাছে টাকার ব্যবহারযোগ্যতা ততটাই যততা সর্বোচ্চ ন্যায়ালয়ের মুখ্য বিচারপতির কাছে একটি সারের বেগ।” শিলচর-গুয়াহাটির মতো শহুরের বহু মানুষের ধারণাই নেই যে টিপাইমুখের ধারে কাছে যারা বাস করেন সেই সব মার-জেলিয়াংরঙদের বহু মানুষ সারা জীবনে টাকার একটা মূদ্রা না ছুঁয়েও দিব্ব্যি সুখের জীবন পার করে দিতে পারেন। নদী এবং পাহাড়ের অরণ্য তাদেরকে মাতা-পিতার মতোই লালন করে। কিন্তু এই ভারতবর্ষকে শহুরে-ভারত জানাবার চেষ্টা করেছে কবে? শহুরে মানুষের কল্পনা বিলাশকে তুষ্ট করতে এখন সেই মাতা-পিতাকের বধের বন্দোবস্ত হচ্ছে!! টিপাইমুখে শিলচরীয়দের স্বপ্নের বাঁধ হচ্ছে। এই সব জনজাতীয় কৃষকদের হাতে টাকা তুলে দেয়ার অর্থ হলো গে’ রাজা হরিশ চন্দ্রকে ‘দাসে’র বাজারে বিক্রী করে দেয়া।
দশ বছর আগে ( ১৯৯৯) অরুন্ধতী লিখেছেন , আন্তর্জাতিক বাঁধ-শিল্প বছরে দুশো কোটি ( বিশ বিলিয়ন) ডলারের ব্যবসা করে । আপনি পৃথিবীর যেখানেই যান না কেন ( পশ্চিমী বিশ্ব বাদ দিয়ে, ওরা এখন নিজেরা বড় বাঁধ তৈরি করে না) চিনে, জাপানে, মালয়েশিয়াতে, থাইল্যাণ্ডে, ব্রাজিলে, গুয়াতেমালাতে --- আপনি সেই একই নাটকের মুখোমুখি হবেন, একই অভিনেতাদের পাবেন সেখানে। লোহার ত্রিভুজ ( রাজনীতিবিদ, আমলা আর বাঁধ তৈরির কোম্পানীগুলো ), সেই সব চক্র যারা নিজেদের আন্তর্জাতিক পরিবেশ পরামর্শদাতা বলে পরিচয় দিয়ে থাকে ( কিন্তু আসলে যাদের মাইনে দেয় ঐ বাঁধ-তৈরি করিয়েরা ) এবং প্রায়শই সেই সব্বার প্রতিবেশী বন্ধুটি- বিশ্ববেঙ্ক । সেই একই সংলাপ, সেই আদর্শে ‘মানুষের জন্যে বাঁধে’র স্লোগান, গণপ্রতিরোধের নিষ্ঠুর অবদমন । তিনি আরো লিখেছেন, “আমাদের সময়ের সবচে’ বড় রসিকতাটা হলো এই যে –আমেরিকার মানুষ তিয়েনানমেন স্কোয়ারের গণহত্যার প্রতিবাদ করে , কিন্তু বেঙ্ক তাদেরই টাকা এনে চিনের থ্রী জর্জেস বাঁধে ঢালে যেখানে তের লক্ষ মানুষকে ঘরবাড়িও ছাড়া করা হয়েছে।”
২০০৫এর ডিসেম্বরেরে শেষে বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত হয়েছিল ‘আন্তর্জাতিক টিপাইমুখ বাঁধ সম্মেলন ( ITDC -2005)’ । সেখানে উপস্থিত ছিলেন পূর্বোত্তর ভারত সহ দক্ষিণ এশিয়ার বহু দেশের প্রতিনিধিরা । এমনকি ভারত বাংলা যৌথ নদী আয়োগের পূর্বতন সদস্য অর্জুন নিশাদও ঐ সম্মেলনের নেতৃত্বদায়ী ভূমিকা পালন করেছিলেন । ভারতের পরিবেশবিদ তথা ‘River Basin Friends of Assam’ এর সমন্বয়ক রবীন্দ্রনাথ ওখানে উপস্থিত থেকে বলেছিলেন , টন টন বালি কাঁদা ঐ বাঁধ থেকে ভেসে এসে বাংলাদেশকে ঢেকে দেবে । মনিপুরেরে হাজারো ভূমিপুত্রদের ভিখারীতে পরিণত করবে। একই আওয়াজ শোনা গেছিল মনিপুরেরে প্রতিনিধি দেবব্রত রায়ের কণ্ঠেও । তিনি বলেছিলেন, এই বাঁধ সাংস্কৃতিক ধ্বংসলীলা চালাবে । ৪
ঐ সম্মেলনে উপস্থিত থেকে রবীন্দ্রনাথ আরো বলেছিলেন , " এই বিদ্যুৎ আমাদের ঘরগুলোকে আলোকিত করবে না ।... গোটা ব্যাপারটাই হচ্ছে সিমেন্ট-রড-টার্বাইন মাফিয়াদের ব্যবসায়িক স্বার্থের কথা মাথায় রেখে”৫
বরাক ( মনিপুরেরে স্থানীয় ভাষাতে যার নাম তুইলুয়াং) ও তুইভাই নদী যেখানে জুড়েছে তার ৫০০ মিটার নিচে এই বাঁধ হচ্ছে । এর উচ্চতা ধরা হয়েছে ১৬২.৮০ মিটার । এই উচ্চতা খুব একটা হেলা ফেলার নয় । তাতে আবার জায়গাটি ভূকম্পপ্রবণ এলাকা । সারা বিশ্বের জৈববৈচিত্রে ভরপুর যে ৩৫টি মাত্র জায়গাকে ‘জিনেটিক হটস্পট’ বলে চিহ্নিত করে রাখা আছে টিপাইমুখ বাঁধের জায়গাটি তাদের একটি। সুতরাং ওখানকার জৈববৈচিত্রের যে বারোটা বাজবে তা আর বলতে । দেবব্রত যে সাংস্কৃতি ধ্বংসলীলার কথা বলেছেন তার কারণ ঐ বাঁধ ওখানকার ২৭৫.৫০ বর্গ কিলোমিটার এলাকার ১৪০০ মার আর জেলিয়াংরঙ জনজাতীয় পরিবারকে ঘর ছাড়া করবে । বরাকে মানুষও বাঁচবে না। অন্য আপদ গুলো নিয়ে যদিবা আপাততঃ নাও লিখি এতো লেখাই যায় যে বাঁধ ভাঙা বানের তোড়ে ভেসে যাবার ভয় বরাকের মানুষকে প্রতিনিয়ত কুরে কুরে খাবে। ঠিক যেমন পাকিস্তানের পারমানবিক বোমা না আলকায়দার হাতে গিয়ে পৌঁছোয়--- সে ভয় এখন মার্কিনী দোসরদের কুরে কুরে খাচ্ছে । কিন্তু আপাততঃ বরাকের ‘আঞ্চলিক বাঙালি জাতীয়তাবাদ’ প্রতিবেশী বিপন্ন মানুষ ও প্রাণিজগতের কান্নাতেও কান দেবার প্রয়োজন মনে করছে না। ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদ’ ছাড়া আর কোনো কারণ নেই ---কেন তারা প্রতিবেশীদের প্রতিবাদ মিছিলে যোগ দেবেন না ।
কিন্তু, মনিপুর সঠিক ভাবেই এই প্রতিবাদে যোগ দিয়েছে । যত দিন যাবে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকাও এতে যোগ দেবে। আপাতত ব্রহ্মপুত্রের মানুষ এ নিয়ে নীরব বোধ হয় এর জন্যে যে বরাকের উন্নয়নে পথের কাঁটা হবার তাদের পুরোনো দুর্নাম আছে। কিন্তু সে দুর্নামের ভয় কাটিয়ে তারাও যোগ দেবেন । কেননা তারাও লড়ছেন ব্রহ্মপুত্রের উপনদীগুলোর উৎসমুখে অরুনাচলে ভারত সরকারেরে বাঁধ তৈরির পরিকল্পনার বিরুদ্ধে। গেল ১৪ মার্চ তারিখে পিপলস মুভমেন্ট ফর সুবনসিরি ব্রহ্মপুত্র ভেলি ( PMSBV) নামের সংগঠনটি লক্ষিমপুরে বৃহৎ বাঁধ বিরোধী আন্দোলনের আন্তর্জাতিক দিবস পালন করে নিজেদের আন্তর্জাতিক আন্দোলনের অংশীদার করেছে। সদিয়াতে বিভিন্ন সংগঠন ঐদিন বিশাল গণ সমাবেশ করেছে। যেখানে সারা রাজ্য থেকে পরিবেশবিদরাও গিয়ে জড়ো হয়েছিলেন। খুব শীঘ্রই এই আন্দোলন সারা রাজ্য কাঁপাবে। বরাক উপত্যকা কি নির্লজ্জের মতো এর দিকে তাকিয়ে নিজেদের বিপদের দিন গুণবে ?
আশার কথা যে ইতিমধ্যে ( বাঙালি উগ্রজাতীয়তাবাদী আঞ্চলিকতাবাদের ভয়ে ) কাঁপা কণ্ঠে হলেও দু’একটি কণ্ঠ সরব হতে শুরু করেছে। চন্দন সেনগুপ্ত বহুদিন ধরে এ নিয়ে লিখছিলেন। মাস কয় আগে বিজয়া কর সোমের এক লেখা এ নিয়ে পড়েছি মনে পড়ছে। এই সেদিন অসম বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞানের অধ্যাপক পার্থঙ্কর চৌধুরী দৈনিক যুগশঙ্খে লিখলেন,’ বরাক বাঁধ বিতর্কে অন্য একটি দৃষ্টি কোণ।’ তিনি বছর দুই আগে তাঁকে পাঠানো বাংলাদেশের পরিবেশ আন্দোলনের ( BAPA) নেতৃত্ব মো হিলাল উদ্দিনের এক মর্মস্পর্শী ই-মেল তুলে ধরেছেন। এ মেলটির বহুল প্রচার হওয়া উচিত ভেবে আমিও হুবহু তুলে ধরলাম,ঃ
“ শুভেচ্ছা নেবেন । আমাদের মাতৃভাষা একটাই, ‘বাংলা’। আর এজন্যেই অসমের ‘কাছাড়’ ও বাংলাদেশের ‘ঢাকা’ উভয় স্থানের লোকই রক্ত ঝরিয়েছে । মাতৃভাষা বাংলা ছাড়াও আমাদের (উভয় দেশের ) নিজস্ব নদী বরাক । একাংশ লোকের মাত্রারিক্ত ‘চাওয়া -পাওয়া’ বরাক ও মেঘনা উপত্যকার মানব সভ্যতাকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে । বরাক আমাদের যোগাযোগের ধারা, প্রকৃতিরূপী জননী –আমাদের নাড়ীর যোগসূত্র স্থাপনের উৎস ।
আমাদের দেশের একজন খ্যাতনামা পরিবেশবিদ , এ এম এ মুহিথ গত মাসে ( আগষ্ট, ২০০৭) কাছাড় সফরে গেছিলেন। টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে বাংলাদেশ তথা বরাক/মেঘনার বুকে সম্ভাব্য বিপর্যয়ের কথা বিশদভাবে তোলে ধরাটাই ছিল তাঁর সফরের মূল উদ্দেশ্য । কিন্তু শিলচর শহরেরে কিছু লোক তাঁর কুশ পুত্তলিকা দাহ করল এবং ঘণ্টা মধ্যে সে দেশ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্যে ফতোয়া জরি করল । তারা উন্নয়ন-এর প্রকৃত অর্থ বোঝে না, উন্নয়নের নামে যে ধ্বংস লীলা চলবে , সেটা দেখার দূরদৃষ্টি তাদের নেই । সত্যি তাদের জন্যে করুণা হয়।”
অরুন্ধতী লিখেছেন, “Big Dams are to a Nation's 'Development' what Nuclear Bombs are to its Military Arsenal. They're both weapons of mass destruction. They're both weapons Governments use to control their own people. Both Twentieth Century emblems that mark a point in time when human intelligence has outstripped its own instinct for survival. They're both malignant indications of civilisation turning upon itself. They represent the severing of the link, not just the link - the understanding - between human beings and the planet they live on. They scramble the intelligence that connects eggs to hens, milk to cows, food to forests, water to rivers, air to life and the earth to human existence.”
আমাদের বরাক উপত্যকা এ দেশের পশ্চাদপদ এলাকাগুলোর একটি-- এনিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। সন্দেহ নেই যে নিয়মিত বানের জলে এ উপত্যকার নাভিশ্বাস বেরোবার উপক্রম হয়। বৃষ্টির অল্প অভাবেই এ উপত্যকার মাটি ফেটে চৌচির হয় । বিদ্যুতের অভাবে নাগরিক জীবন এখানে হররোজ নরকের স্বাদ-গন্ধ ভোগ করে। তাই বলে কি সভ্যতাকে ধারণ করবার মানবিক বুদ্ধিও আমাদের ভ্রষ্ট হয়ে গেছে যে শিয়রে মৃত্যু আসন্ন জেনেও আমরা নীরবে আছি। তাকে স্বাগত জানাবার জন্য সমস্ত আয়োজন সম্পূর্ণ করছি? সিলেট –বাংলা-বাঙালির ঐক্যের কথা নাহয় ছেড়েই দিলাম । ওদেশ বিদেশ এখন । সেই বিদেশের লোকের জন্যে, একাত্তরে ( ৭১) আমাদের প্রেম কেন উথলে উঠেছিল, সে কি সত্যি প্রেম ছিল না আরো এক প্রতিবেশী পাকিস্তানের প্রতি ঘৃণাটা বড় ছিল--- সে প্রশ্নও না হয় নাই করলাম । কিন্তু আমাদেরই নদী বরাক –সুরমা যাদের নিয়ে বহু গান গেয়েছি, কবিতা করেছি তার জন্যে আমাদের দরদ লুকোলো কোথায় ? মনিপুর ডুববে, বাংলাদেশ শুকিয়ে যাবে--আমরা কি সত্যি তাদের রক্তে সোনার স্বর্গ গড়ব বলে ভাবছি ? আমরা কি ভাবছি---নগর পুড়ে ছাই হবে আর আমাদের এই দেবালয় দিব্বি বেঁচে যাবে ? সত্যি, আমাদের বুদ্ধির জন্যে করুণা হয় !!
তথ্য সূত্রঃ
১। Big is not always the Best, Kangla online .Com, July 5, 2009.
২। Prime Ministers and Big Dams , Hindu, December, 05
৬। বরাক বাঁধ বিতর্কে অন্য একটি দৃষ্টি কোণ; পার্থঙ্কর চৌধুরী, দৈনিক যুগশঙ্খ
( জুন, ০৯ ২২শে লেখা শুরু করে জুলাই ,০৯ ৫ এ লেখা শেষ: এ লেখাটি দৈনিক জনকণ্ঠে প্রকাশিত।)