কম্প্যুটার, ইন্টারনেট, মাতৃভাষা এবং
আন্তর্জালিক অভিধান ‘শব্দ’:
ইংরেজির আধিপত্যকে বিদেয় দিয়েই হবে কম্প্যুটার ও ইন্টানেটের প্রথম আন্তর্জাতিকীকরণঃঃ
বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ছাত্র হবার সুবাদে এক সময় আমার ইংরেজি লিখতে হাত কাঁপত। বলতে হলে বোধহয় এখনো ঠোঁট কাঁপবে। আজ আমি একটি কাগজ ( প্রজ্ঞান) নিয়মিত সম্পাদনা করি যার বেশির ভাগ লেখাই থাকে ইংরেজিতে। এ দরকারে এবং আনুষঙ্গিক আরো অজস্র দরকারে আজ আমাকে রোজ ইংরেজি লিখতে হয়। আমার হাত কাঁপে না। কারণটি, আর কিছু নয়। ইচ্ছা,নিষ্ঠা, দৃঢ়তা –এই ভারি শব্দগুলো উচ্চারণ করা যেতেই পারে। কিন্তু সহজ শব্দটি হচ্ছে ‘কম্প্যুটার’। আজ অনেকদিন ধরে কলম চালাই না। পিড়িতে বসে রাতের খাবার না খেয়েও যদি কোনো বাঙালির লজ্জা না হয়, আমার তবে কলম না চালাবার জন্যে লজ্জা কিসের?
দুটোই লেখার যন্ত্র। তাতে, কম্প্যুটারেও হাত কাঁপবার কথা ছিল বটে । কিন্তু কাঁপে যে না, তার কারণ এর সঙ্গে এক বিশাল অভিধান পাওয়া যায়। যে আপনা আপনি আমার লেখার ভুল ধরে ফেলে এবং মুহূর্তে ঠিক করে নিতে পারি। অনেক সময় আমার বাক্যের ভুলও ধরে দেয় কম্প্যুটার। অন্ততঃ কলমে লিখলে যতটা ভুল থাকতে পারত তার প্রায় আশি শতাংশই এখন থাকবার সম্ভাবনা নেই। আর এই ইংরেজিতেই আমাকে আমার লেখালেখির এবং পত্রিকা সম্পাদনার কাজে দেশে বিদেশে বহু লেখকের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হয়। দেশে বিদেশে যোগাযোগ করতে হলে যে আন্তর্জালিকার ( ইন্টারনেট) দরকার পড়ে সেতো অভিধানকে আরো বিশাল করে দিয়েছে। আপনি যে ইংরেজি শব্দটি এম.এস.ওয়ার্ডে খুঁজে পাবেন না, তাকে সেখান থেকেই ক্লিক করে দিন, সে আলাদীনের প্রদীপের মতো সারা পৃথিবী থেকে খুঁজে এনে সেই শব্দের অর্থ আপনার ডান হাতের কাছে ফেলে দেবে। সুতরাং আর ভয় কিসের? আপনাকে বিশেষ শ্রম করতে হবে না।
আচ্ছা কেমন হতো, যদি আপনি এরকমই নির্ভয়ে বাংলা লিখতে পারতেন? আমার এ ক’বছরের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি অসম তথা পূর্বোত্তর ভারতের বহু পাঠকই মন খারাপ করে বলবে, ওটি হবার নয়! ছাপাখানাতে যে বাংলাতে কাজ করা যায় এই যথেষ্ঠ। বিশ্বায়নের যুগে এমন বাংলার বিশ্ব জয়ের স্বপ্ন দেখাই বৃথা। বিশেষ করে আমার মতো বাংলার ছাত্রই যখন গৌরবের সঙ্গে শোনাচ্ছি ইংরেজিতে হাত পাকাবার গল্প , তখন আর ভরসা কোথায়!
যে বাঙালিরা আমার সঙ্গে রোমান অক্ষরে বার্তা বিনিময় করেন, তাদের বেশির ভাগই অসমের লোক। তাদের আমি প্রায়ই রসিকতা করে শোনাই ‘ত্রয়ী’ ছবির কেষ্ট মুখার্জীর সেই বিখ্যাত সংলাপ , “বাংলায় ফিরে এসো , বাবা!” ইংরেজিতেই বিশ্বায়ন হবে –এটি যে কেমন সেকেলে আর উত্তর ঔপনিবেশিক ধারণা তা আগামী কয়েক বছরের মধ্যেই আমাদের সব্বার চোখের সামনে জলের মতোই স্পষ্ট হয়ে যাবে। সেই ২০০২তে তিনসুকিয়া থেকে প্রকাশিত ‘দৃষ্টি’ বলে একটা কাগজে আমার তখনকার অধ্যয়ন-অনুসন্ধানের উপর ভিত্তি করে ‘অসমে ব্যবহারিক বাংলা শিক্ষার সংকট’ নামে এক প্রবন্ধে লিখেছিলাম “কম্প্যুটার ইংরেজি ছাড়া বোঝেনা—এ অবশ্য ডাহা মিথ্যা প্রচার। তা যদি সত্যও হয় তবে ভারতবর্ষ সেই দেশ যেখানে তাকে বহু ভাষার পাঠ দেয়া যায়। সে পাঠ না নেয়, তবে পুরোনো প্রযুক্তির আস্তাকুড়ে তাকে ঝেড়ে ফেলে আমাদের তৈরি করে নিতে হবে আরো আধুনিক সেই যন্ত্র যে ঈশ্বরের পাশে বসবে না। স্বয়ং ঈশ্বরকে -–যিনি বাংলা বোঝেন না—জায়গা ছাড়ার নোটিশ দেবে। যে বলবে—শুনবে বোঝবে শুধু ইংরেজি নয়—মানুষের ভাষা। তার মাতৃভাষা। সে ভাষার শত বৈচিত্রকে সে বুকে ধরবে পরম গৌরবে আর মমতায়। অচিরেই তা হতে যাচ্ছে বলে আমাদের বিশ্বাস। এবং কম্প্যুটারই তা করবে...।”
কিন্তু উত্তর ঔপনিবেশিক ধ্যানধারণাতে আচ্ছন্ন ভারতে কাজটা হয় নি। হয়েছে ‘ইনটারনেট কোর্পোরেশন ফর এসাইনড নেমস এণ্ড নাম্বার্স’( ICANN) নামের আন্তর্জাতিক সংস্থাটির ক’মাস আগে সিওলে অনুষ্ঠিত বাৎসরিক সভাতে। নামেই প্রকাশ ওদের কাজটা কী। ওরা বলছে ইংরেজির কাঁধে চড়ে ইন্টারনেট ও কম্প্যুটারের বিশ্বায়ন সম্ভবই নয়। কারণ এখনো বিশ্বের অধিকাংশ মানুষ থেকে গেছেন এই ভাষাটির আওতার বাইরে। যথার্থ আন্তর্জাতিকীকরণ সম্ভব শুধু ইন্টারনেটকে ‘বহুভাষী’ করে ফেলে তবেই। এটা অন্তত; ব্যবসায়িক স্বার্থে হলেও এই প্রযুক্তিবিদেরা এখন স্বীকার করতে চলেছেন। তারা কম্প্যুটারের সাংকেতিক ভাষাকে লাতিন থেকে অলাতিনে রূপান্তরিত করবার কাজটি সেরে ফেলেছেন। সংস্থাটির চেয়ারমেন পিটার ডেঙ্গেট থ্রাসের ভাষাতে , ‘চার দশক আগে ইন্টারনেটের যাত্রা শুরুর পর এই প্রথম এক সর্ববৃহৎ প্রযুক্তিগত পরিবর্তন আসতে যাচ্ছে।‘ একে তিনি বলছেন ইনটারনেটের আন্তর্জাতিকীকরণের পক্ষে প্রথম এক ঐতিহাসিক পদক্ষেপ!
এই ঘটনা শুধু, কম্প্যুটার প্রযুক্তিতেই বিপ্লব আনতে যাচ্ছে না। এর এক সুদূর প্রসারী সাংস্কৃতিক –রাজনৈতিক প্রভাব সারা বিশ্বেই পড়তে যাচ্ছে। যে সব ছোট ছোট ভাষাকে উপভাষা বলে ‘কাগুজে’ পণ্ডিতেরা এককোনে ঠেলে দিচ্ছিলেন সেগুলোও এখন মাথাতুলে দাঁড়াচ্ছে আর দাঁড়াবে। সারা পৃথিবীতেই এবারে টিভি চ্যানেলগুলোর মতোই ইনটারনেট ব্যবসায়ীরাও মাতৃভাষার প্রচার ও প্রসারে জোর দিতে যাচ্ছে। এবং ভারতের মতো দেশে ইংরেজি জানা 'সাহেব'রা এবারে ‘সেকেলে’ হতে চললেন। গেল ১৬ নভেম্বর,০৯ থেকে নতুন ব্যবস্থাটি পৃথিবীর বহু দেশেই কাজ করতে শুরু করেছে। অর্থাৎ যাকে আমরা ‘ওয়েব আইডি’ বা ‘ডোমেইন নেম’বলি, সেটি আর অদূর ভবিষ্যতে শুধু লাতিনে বা ইংরেজিতেই থাকছে না। বাংলা হিন্দিতেও পাওয়া যাবে। শুনেছি বাংলাদেশে এটি এখনই কাজ করতে শুরু করেছে। ভারতেও প্রক্রিয়াটি শুরু হয়েছে। এর জন্যে সরকারি তরফেও বেশ কিছু প্রশাসনিক উদ্যোগ প্রস্তুতির দরকার পড়বে। গেল ১০ ফেব্রুয়ারিতে গুয়াহাটিতেই এ নিয়ে সচেতনতা বাড়াবার জন্যে একদিনের এক কর্মশালা হয়ে গেল। পান বাজারের হোটেল প্রাগ কন্টিনেন্টালে এই ওয়ার্কশপের আয়োজক ছিল যৌথভাবে ভারত সরকারের তথ্য প্রযুক্তি মন্ত্রক ও সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্ট অফ আডভান্সড কম্প্যুউটিং (C-DAC) ।
এরকম সময়ে আমরা যদি কোনো প্রস্তুতিই না নিই তবে যে আমাদের অনেকটা পিছিয়ে যেতে হবে সে আর বিচিত্র কী? ছাপাখানাতে যে ভাবে বাংলা লেখা হয় তাই দেখে আমাদের অনেক বাঘা বাঘা পণ্ডিত লেখক সাহিত্যিকেরও পিলে চমকে যায়। তারা আর নিজে বসে কম্প্যুটারে বাংলা লেখার সাহস করে উঠতে পারেন না। নিজের সংগ্রহে একটি কম্প্যুটার থাকলেও না। অবশ্যি এই চিত্রটি অসম তথা পূর্বোত্তর ভারতের। জানি না, কেন। বাকি ভারতে কিন্তু আজকাল বোধহয় এমন কোনো লেখকই নেই যিনি তাঁর মাতৃভাষাতে লিখবার বেলা কম্প্যুটার না ব্যবহার করেন। আগে যারা টাইপ রাইটার ব্যবহার করতেন তাদের প্রায় প্রত্যেকেতো বটেই, নতুন প্রজন্মের আরো অজস্র লেখক এই সারিতে যোগ দিচ্ছেন। এবং কম্প্যুটার লেখকের সংখ্যা বহু বাড়িয়ে দিচ্ছে বলেই আমার বিশ্বাস। আজকাল বহু লেখকেরই নিজেদের ব্লগ বা ওয়েবসাইট রয়েছে। তাঁরা যখন বই করে সে লেখাগুলো প্রকাশ করেন , সেখানেও সে ব্লগের কথা উল্লেখ থাকে দেখি। বহু বড় কাগজের সঙ্গে ছোট কাগজেরও রয়েছে নিজেদের ব্লগ। লিটিল ম্যাগ মেলা নিয়ে সম্প্রতি শিলচর খুব মেলা হয়ে গেল। লিটিল ম্যাগ কাগজের সম্পাদকদের এক আলাদা অভিমানও থাকে । কিন্তু সেই অভিমানীরা কি খবর রাখেন আজকাল ‘ব্লগ সাহিত্য’ বলেও সাহিত্যের এক শক্তিশালী ধারা গড়ে উঠছে। যশোধরা রায় চৌধুরী ,অতিথি হয়ে গিয়ে, শিলচরের সেই মেলাতে এ কথা বলেওছেন শুনেছি। ‘রোধে তার গতি’ এমন সাধ্য কারো নেই। এর একটা বড় কারণ ব্লগে লিখবার জন্যে আপনাকে কোনো নাক উঁচু সম্পাদক বা প্রকাশকের পেছনে লেগে থাকতে হয় না। অমুক বাজে লেখে বলে লেখার বাজার থেকে ‘আউট’ করে দেবার সম্পাদকীয় ‘দাদাগিরি’ একেবারেই মাঠেমারা যেতে চলেছে! সেখানে আপনিই লেখক, আপনিই সম্পাদক, আপনিই প্রকাশক। আর কাউকে পড়াবার জন্যে বই নিয়ে বাড়ি বাড়ি ঘুরতে হয় না, আপনি নিজের বাড়িতে বসেই দেখবেন আপনার পাঠক ছড়িয়ে আছেন বিশ্বময়! আমরা এ নিয়ে বিস্তৃত পরে কখনো লিখব। আপাততঃ কিছু ভালো বাংলার সঙ্গে অন্য ভারতীয় ভাষার ব্লগের ও কাগজের ঠিকানা আপনারা এই ব্লগের লিঙ্কে দেখে নেবেন আশা করি ।
কিন্তু সবচে; বড় যে কারণটির জন্যে ব্লগ লেখার সংস্কৃতি দ্রুত ছড়াচ্ছে তা হলো, বাংলা লেখার উপায়টি মোটেও ছাপাখানার মতো দামি আর পিলে চমকাবার মতো নয়। একে ‘ইউনিকোড’ বলে । সহজেই আপনি বিনামূল্যে ইন্টারনেট থেকে নামিয়ে নিয়ে লিখে যেতে পারেন, যেভাবে ইংরেজি লেখেন। বাংলা,অসমিয়া, মনিপুরি লিখবার জন্যে ‘অভ্র’ খুব ভালো এবং জনপ্রিয় সফটওয়ার। এতে প্রচুর ফণ্ট বৈচিত্র পাওয়া যায়, একেবারে ছাপাখানার মতো। এতে কেবল অসমিয়া লিখবার জন্যে ‘ৰ,ৱ’ এমন দু’একটা বর্ণে একটু জটিলতা রয়েছে। তাও তেমন কিছু নয়। ‘বরাহ’ দিয়ে ভারতের সব ভাষাতে লেখা যায়। অসমিয়া-বাংলা-মণিপুরি ভাষাগুলো লিখবার জন্যে অসমে তৈরি হয়েছে ‘আদর্শরত্নে’ । গোগোল নিজেও আজকাল ভারতীয় ভাষা লিখবার উপযোগী সফটওয়ার সমর্থণ নিজে দিয়ে থাকে। এছাড়াও আরো প্রচুর রয়েছে। আমরা ক’টির নাম নিলাম মাত্র। শুধু সংক্ষেপে বলে রাখি যে আমরা ব্লগের কথা বললাম বলে যেন কেউ মনে না ভাবেন যে শুধু সাহিত্যের কাজই হচ্ছে ওখানে। অসমে আবার আমরা বাংলাতে কিছু লেখালেখির কথা বললে সাহিত্য আর সমাজ বিজ্ঞান ছাড়া বিশেষ কিছু বুঝি না। আসলে এখনই যে কেউ ইচ্ছে করলে বাংলা , অসমিয়া , হিন্দিতে যাকে বলে ‘ওয়েব সার্চ’---করতে পারেন। করেন খুব কম লোকে। কারণ ঐ আমাদের উত্তর ঔপনিবেশিক মনের সংস্কার সহজে যাবার নয়। তার উপর এখানে কিছু উপাচার্যের পদবীর ব্যক্তিও মনে করেন, ইন্টারনেট ‘বই সংস্কৃতি’কে ধ্বংস করছে। এতে বুঝি কেবল দুষ্ট ছেলে মেয়েরা বসে গেম খেলে আর ছবি দেখে! আমি নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি আমি মাও -ৎসে-তুঙের রচনাবলী পুরো এবং মার্ক্সের ‘পুঁজি’ পুরোটা ইন্টারনেটে প্রথম পেয়ে সংগ্রহ করে রেখেছি। তাও বিনা মূল্যে! পড়া হয় নি সবটা। আমার ইচ্ছে নয়, বিদ্যে কম বলে। পড়ে বুঝব না। তা ওটি আমাদের তিনসুকিয়ার বাজারে পেতে গেলে আলাদীনের প্রদীপের সহায় নিতে হবে! সম্প্রতি পশ্চিম বাংলার ‘ভাষা প্রযুক্তি গবেষণা পরিষদ’ আই আই টি খড়গপুর ও শিবপুর বি ই কলেজের শিক্ষকদের সঙ্গে নিয়ে পুরো রবীন্দ্র রচনাবলী ইন্টারনেটে তুলে দিয়েছে। তাদের পরিকল্পনা আছে অদূর ভবিষ্যতে বঙ্কিম, বিদ্যাসাগর, শরৎ চন্দ্র, নজরুলদেরকেও ইন্টারনেটে নিয়ে আসার। যদিও এদের সবার রচনারই সবটা নাহলেও অনেকটাই এখনই নেটে পাওয়া যাচ্ছে। সম্প্রতি প্রকাশিত সুবীর ভৌমিকের ‘The Troubled Periphery’ বইটির কথা আমরা ইন্টানেটে যারা লেখাপড়া করি তারা ভ্রুণাবস্থাতেই তাঁর নিজের সুসজ্জিত ব্লগ থেকে জেনে গেছি এবং বাড়িতে বসে কিনে এনে অনেকে তা পড়েও ফেলেছি! এও জেনেছি তিনিই বোধহয় একমাত্র বাঙালি বুদ্ধিজীবি যিনি নিজে পূর্বোত্তরীয় বলে এক আলাদা গৌরব বোধ করেন। উৎসর্গের পৃষ্ঠাতে নিজের মেয়ের পরিচয় দিতে গিয়ে লিখেছেন, ‘The Daughter of North East’! ‘সুসজ্জিত’ লিখে মনে পড়ল ব্লগ বা সাইট সাজাতে না জানলেও কোনো সমস্যা নেই । বাংলাতেই ‘বাংলাহ্যাক্সের’ মতো বেশকিছু সাইট রয়েছে যারা নিখরচাতে পরামর্শ দিয়ে থাকে।
শব্দ ঃ তৈরি হচ্ছে পূর্বোত্তরের ভাষাগুলোর ‘Virtual Babel Tower’:
তাহলে রইল বাকি, আমরা যা দিয়ে আলাপ শুরু করেছিলাম, সেই অভিধান ! ইংরেজির মতো স্বতঃস্ফূর্ত কাজ করবার মতো অভিধান এখনো কোনো ভারতীয় ভাষার নেই বটে, সেটি হবে ঐ ‘আই.সি.এ.এন.এন’ নামের সংস্থাটির প্রকল্প যখন পুরো মাত্রায় কাজ শুরু করবে তখন। আমি নিজে যদিও এখনো পরীক্ষা করিনি তবে অপেন অফিস এবং মাইক্রোসফট২০০৭ যে বাংলা-অসমিয়া সংস্করণ ছেড়েছে তাতে ইতিমধ্যে সেই ব্যবস্থা থাকলেও থাকতে পারে। কিন্তু আপনি সাইট খুলে দেখে নেবার মতো বাংলাতে সংসদের অভিধান থেকে শুরু করে প্রচুর আছে। গোগোল ব্যবহার করে বাংলা লিখলে সেটি শুরুতেই আপনাকে অনেক শব্দের বিকল্প সামনে এনে দেয়,আপনি পছন্দের শব্দটি ব্যবহার করতে পারেন। ‘অভ্র’ও এম এস ওয়ার্ডের মতো অনেক বাংলা শব্দ সমর্থণ করে। বিশেষ করে দিন, মাসের নামের মতো বহু প্রচলিত শব্দগুলো লিখতে শুরু করলেই সে পুরো শব্দ দেখাতে শুরু করে । আপনি সেটিতে টিপে দিলেই এ বসে যায়। হিন্দি সহ অন্য ভারতীয় ভাষারও প্রচুর আছে। নেই অসমিয়ার এবং অন্য পূর্বোত্তরীয় ভাষার অভিধান। এবং নেই সিলেটি সহ বাংলা ভাষার পূর্বোত্তর ভারতীয় উপভাষাগুলোকে সমর্থণ করবার মতো কোনো অভিধান। সেই খালি জায়গাকে ভরে তুলতে গেল ক’বছর ধরে তৈরি হচ্ছে ‘শব্দ’ ( XOBDOঃ ) । এর ওয়েব ঠিকানা হচ্ছেঃ http://www.xobdo.org/ । ভাষার প্রশ্নে যে বৈচিত্র নিয়ে আমাদের গোটা দেশে গৌরব করে বেড়াবার কথা ছিল তাকেই আমরা কাজিয়ার বিষয় করে রেখেছি গেল প্রায় এক শতাব্দি বা তারো বেশি সময় ধরে। ‘শব্দ’ সেই গৌরবকে প্রতিষ্ঠা দেবার ঐতিহাসিক দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছে। অচিরেই এটি হবে পূর্বোত্তর ভারতের সবচে’ বড় আর বৈচিত্রময় অভিধান ও বিশ্বকোষ। আমরা তাই নিয়েই লিখব বলে এখন কলম তুলে নিয়ছি। থুড়ি, কম্প্যুটারের বোতাম টিপে চলেছি!
ধানবাদের ইন্ডিয়ান স্কুল অব মাইন্সের পেট্রলিয়াম প্রযুক্তিতে স্নাতক বিক্রম বরুয়া টেস্কাস টেক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর সম্পূর্ণ করে মেক্সিকো, যুক্তরাষ্ট্র হয়ে সংযুক্ত আরব আমিরাতের আবুধাবিতে গিয়ে থিতু হয়েছেন। সেখানে তিনি এক তেল সংরক্ষণাগারে অভিযন্তার দায়িত্বে কাজ করেন। ২০০৬এর শুরুতে আরবের মরুভুমিতে নিঃসঙ্গ জীবন যাপন করবার দিনগুলোতে স্বাভাবিকভাবেই দেশের নদী-পাহাড় –সবুজ অরণ্য তার কাছে ডাক পাঠাতো। ছেলেবেলা থেকেই কল্পবিজ্ঞানের গল্পে ও নানা প্রবন্ধপাতি অসমিয়াতে লিখে তিনি হাত পাকিয়েছেন। বিদেশে যখন নিজের ল্যাপটপে লিখবেন বলে ভাবছিলেন তখন স্বাভাবিক ভাবেই তাঁর দরকার পড়ছিল এক অভিধানের । গোগোলে যখন তিনি অনুসন্ধান করলেন বাংলা, হিন্দি, পাঞ্জাবি, মালয়ালম ভাষাতে বেশ কিছু অভিধানের খোঁজ পেলেন। অসমিয়াতে একটিও নয়।
ব্যস, আর যায় কোথায়! ২০০৬এর মার্চের ১০ তারিখে ‘আসামনেট’ইয়াহু গ্রুপে ( অসমের মানুষের সবচে’ সক্রিয় আন্তর্জালিকা গোষ্ঠী) তিনি ‘শব্দে’র যাত্রা ঘোষণা করলেন। কম্প্যুটার প্রযুক্তিতে তিনি যে তেমন দক্ষ ছিলেন তা নয়, না ছিল তাঁর ভাষা বিজ্ঞানের উপর কোনো অধ্যয়ন! যারা মনে করেন কোনো এক বিষয়ে হাজারটা বই গিলে না খেয়ে কাজে হাত দেয়া উচিত নয় তাঁরা যে কেমন সেকেলে লোক, বিক্রম তাঁর উজ্জ্বল উদাহরণ! চাই কেবল স্বপ্ন আর সেই স্বপ্নকে সাকার করবার এক দৃঢ় আকাঙ্ক্ষা। বাকি কাজ আপনি এগোয়। শুরু শুরুতে বিশ্বের নানা কোন থেকে প্রিয়ঙ্কু শর্মা, পল্লব শইকিয়া, উজ্জ্বল শইকিয়ারা এসে যোগ দেন। ধীরে আরো অনেকে। প্রিয়ঙ্কু শব্দকে জীবনী শক্তি যোগাবার সঙ্গে সঙ্গে এর প্রচারে উঠে পড়ে লাগেন। প্রচার বিমুখ হয়ে শব্দের এক পাও এগুনো সম্ভব ছিল না, আজো নয়। কেন না এর চাই সারা বিশ্বের যেখানেই পূর্বোত্তরের মানুষ রয়েছেন তাদের থেকে অনেক অনেক সহকর্মী। পল্লব ‘হৃদয়ে’র মতোই আড়ালে থেকে এর প্রাণ স্পন্দনকে সচল রাখবার কাজ করছিলেন। অর্থাৎ , তিনি যাকে বলে ‘ডাটাবেস’ তার কাজটা দেখছিলেন। এখনো তাই করে যাচ্ছেন। এই বিক্রম, প্রিয়াঙ্কু, পল্লব মিলে এখনো 'শব্দ' সাইটের বছরের ডোমেন ভাড়াটা বহন করেন। উজ্জ্বল শইকিয়াও শুরুর দিকে ‘শব্দে’র সাইট গড়ে তুলতে বেশ খাটাখাটুনি করেছেন। একে একে এলেন দিপাঙ্কর এম বরুয়া, দ্বীপায়ন বরুয়া, অপূর্ব মিলি, রাজীব কুমার দত্ত, নীলোৎপল বরপূজারী, কিশোর কুমার বর্মন, রুবুত মাউত, হাসিনুস সুলতান, রূপম কুমার শর্মা, রেশ্মী রেখা দত্ত, সুদীপ্তা গগৈ আনিসুজ্জামান এমন আরো অনেকে।
গুয়াহাটি আই আই টিতে এক বড় কর্মীগোষ্ঠী গড়ে উঠল। বুলজিৎ বুড়াগোহাঁই, ঋতুরাজ শইকিয়া, স্বপ্নিতা কাকতি, অর্চনা রাজবংশী, সঞ্জীব শর্মা, ড০ কৃষ্ণা বরুয়া এমন আরো অনেককে নিয়ে। এদের সবার চেষ্টাতে বহু শব্দ ‘শব্দে’ এসে জমা হলো। ২০০৭এর ১৭ জানুয়ারীতে আই আই টি ক্যাম্পাসেই ‘শব্দে’র প্রথম মুখোমুখী বসে এক সফল সভা হলো। এর আগে সবই হচ্ছিল ইণ্টারনেটে। শুরু থেকেই ‘শব্দে’র সম্পাদনার সমস্যা ছিল। একা বিক্রম এদিকটা সামলাতেন। ২০০৭ থেকে প্রিয়াঙ্কুও তার সঙ্গে এ কাজে হাত বাড়ালেন। পরে রূপঙ্কর মোহান্ত এবং রূপকমল তালুকদার এসেও এ কাজে লেগে পড়লেন।
২০০৭এর শেষের দিকে ‘শব্দে’র ডাটাবেসকে ‘মাইক্রোসফটে’র MSSQL প্রযুক্তি থেকে ‘ওপেন সোর্সে’র MySQL এ স্থানান্তরণ ঘটিয়ে সাইটিকেও সাজিয়ে তোলা হয়। পল্লব এবং বিক্রমকে এর জন্যে পৃথিবীর দু’প্রান্তে থেকেও বহু খাটাখাটুনি করতে হয়েছিল। কাজটি বড় চাট্টিখানি ছিল না মোটেও। পিয়াঙ্কু, যিনি এখন উত্তর কোরিয়ার হাংকুক বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদেশ বিষয়ে অধ্যাপনা করে তখন ফ্লরিডা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছিলেন ।একই বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্প্যুটার বিজ্ঞানের ছাত্র সাকিব রহমানকে সঙ্গে নিয়ে তিনিও দিনে রাতে কাজ করে সাইটটিকে তার বর্তমান রূপ দেন। বিক্রমের ভাষাতে, “ Thus, our beloved princes XOBDO got a new look… almost like a bridal make-up!”
২০০৮এর জানুয়ারীতে ফ্রেন্ডস অব আসাম এ্যাণ্ড সেভেন সিস্টার্স ( FASS) তাদের বার্ষিক সভাতে সুযোগ করে দেয় ‘শব্দ’এর সাইটকে জন সমক্ষে তুলে ধরতে । প্রচার মাধ্যমগুলো সে ঘটনাকে দারুণভাবে তুলে ধরে। এর পেছনে অবশ্য বুলজিতের এক বড় ভূমিকা ছিল। এবারে ওর ভূমিকা প্রশ্নাতীত। অসমের যেকোনো ভালো ভালো সদর্থক কাজের সংবাদ সংগ্রহ করা ও সেগুলোকে যথাসম্ভব বেশি প্রচার দেয়াটা ওঁর অনেকটা ‘শখে’র মতো। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি এখনো গুয়াহাটি আই টি আইর গবেষণা ছাত্র। সে বছরের শুরু অব্দি ১০,২০০ অসমিয়া শব্দ সংগৃহীত হয়েছিল । সে বছরে ২০,০০০ এর লক্ষ্যমাত্রা স্থির করা হয়েছিল। এ কোনো সহজ কাজ ছিল না। কেবল শব্দ জুড়ে যাওয়াইতো আর কাজ নয়, এগুলোর শব্দতাত্বিক বিশ্লেষণ, যথার্থ ইংরেজি সহ বিভিন্ন ভাষাতে এদের অর্থ লেখা , সেই সঙ্গে এটাও নিশ্চিত করা যে শব্দগুলোর পুনরুক্তি হয় নি এমনি আরো কত কিছু! প্রায় দৈনিক হিসেব রাখার নিয়মানুবর্তীতা মেনে বছর শেষের আগেই বড়দিনের দিনে সেই লক্ষ্যে গিয়ে পৌঁছানো গেছিল পৃথিবীর নানা কোনে ছড়িয়ে থাকা ‘শব্দ’ কর্মীদের কাছে সে ছিল যথার্থই এক উৎসবের মুহূর্ত।
আগে যাদের নাম উল্লেখ করা গেল তারা ছাড়াও সে বছর এসে কাজে নেমেছিলেন বিরাজ কুমার কাকতি, অঞ্জলি সনোয়াল, প্রশান্ত বরা, পার্থ শর্মা, প্রবীন কাকতি, প্রসেনজিৎ খনিকর, মৌসুমী হাজরিকা, আব্দুল ওয়াহাব, পাপড়ি গগৈরা লেগে থেকে সেই লক্ষ্যমাত্রাতে পৌঁছুনো সম্ভব করে তুলেন। একই বছরে প্রবাদ-প্রবচন যোগ দেবারও এক ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়। এ পর্যন্ত পূর্বোত্তরের অন্য সব ভাষাকে ‘অন্য ভাষা’ ( Other Languages) বলে উল্লেখ করা হতো। সেবারেই ‘শব্দ’ ঠিক করে কাউকে এভাবে স্বতন্ত্র করার কাজটা ঠিক হচ্ছে না। সমস্ত ভাষাগুলোরই সমান মর্যাদা ও স্বীকৃতি থাকা উচিত। সুতরাং সাইট সম্পাদনা করে সমস্ত ভাষা নাম স্বতন্ত্র ভাবে লেখা শুরু হয়।
২০০৯তে পূর্বোত্তরের অন্য ভাষা থেকেও বেশ কিছু সহযোগী এসে যোগ দেন। তাই , মিশিং ভাষার শব্দ যোগাচ্ছেন অঞ্জলি সনোয়াল, মাড় শব্দ যোগাচ্ছেন লালরেমথাঙ মাড়, খাসি শব্দ যোগাচ্ছেন বানলাম ওয়ার্জর, মৈতৈ শব্দ প্রদান করে যাচ্ছেন মোহেন নাওরেম, ডিমাসাতে রয়েছেন বেশ ক’জন কুলেন্দ্র দাউলাগাপু, অনুজ ফঙলোসা, অর্ণব ফঙলোসা এবং উত্তম বাথাহি, প্রণব দোলে মিশিং , নব বডো এবং নওগওত ব্রহ্ম যোগাচ্ছেন বডো এবং মর্নিঙ্কি ফাঙশো ও দীপক টুমুঙ যোগাচ্ছেন কার্বি ভাষার শব্দ। এখন সারাবিশ্বে ‘শব্দে’র প্রায় ১২০০ সদস্য ছড়িয়ে রয়েছেন । যদিও তাদের সবাই সমান সক্রিয় নন।
এ পর্যন্ত যতগুলো শব্দ এতে এসছে তার এক সাম্প্রতিক( ২০ সেপ্টেম্বর, ২০০৯) হিসেব এরকমঃ
ভাষা | শব্দ সংখ্যা | ভাষা | শব্দ সংখ্যা |
অসমিয়া | ২২৬২৮ | ককবরক | ৩০৬ |
ইংরেজি | ১২৪২৩ | বিষ্ণুপ্রিয়া | ২৩৩ |
ডিমাসা | ২৭০৫ | নাগামিজ | ১৩৮ |
কার্বি | ১৩৭০ | মিজো | ১২০ |
মৈতৈ | ৯৩০ | গারো | ১১৭ |
তাই | ৯১৫ | চাকমা | ৮৭ |
বডো | ৮০৪ | আপাতানি | ৭৫ |
মাড় | ৬৩২ | আও | ৭৩ |
খাসি | ৪০৫ | মনপা | ১৮ |
মিশিং | ৩৬৪ | কাওব্রু (রিয়াং) | ০ |
এই তালিকাতে বাংলা নেই। নেই হিন্দি । পূর্বোত্তরের আরো দুটো প্রধান ভাষা। নেপালিও নেই। নেই আরো বেশ কিছু প্রাচীন ভাষা। থাকা উচিত ছিল কী?
বাংলা , হিন্দি , নেপালি ভাষা এবং পূর্বোত্তর ভারতঃ
এই কথাটাই আমি বিক্রম এবং শব্দের অন্য বন্ধুদের অনেক দিন আগেই জিজ্ঞেস করেছিলাম, বাংলা নেই কেন? শব্দের সঙ্গে আমার যোগাযোগ ২০০৮এর মাঝামাঝি। আমাদের তিনসুকিয়া কলেজের নিয়মিত প্রকাশনা ‘প্রজ্ঞানে’র জন্যে ‘শব্দ’ সম্পর্কিত তথ্যাদি পাঠান বুলজিৎ । সেখানে তা ছাপাও হয়। সেই থেকে তিনি আমাদের কাগজের এক সক্রিয় শুভানুধ্যায়ী। ‘প্রজ্ঞানে’র ‘প্যানোরামা’তে চোখ ফেরালেই বুলজিৎকে অনেকটা চেনা যায় । আমি নিজেও বাংলাতে লেখার সঙ্গে অসমিয়াতে লিখি । অসমিয়া থেকে অনুবাদের কাজ করি । আর যেহেতু তা ব্লগে করি, অন্য অভিধানের সঙ্গে ‘শব্দ’ও সেই থেকে আমার সহযোগী। ‘শব্দে’র নিজের গোগোল বন্ধু গোষ্ঠী আছে (xobdo@googlegroups.com )। এছাড়াও আমাদের মত বিনিময় হয়ে থাকে ‘ফাস’, আসামনেট’, ‘শিলচর’(Silchar@yahoogroups.com ) ইয়াহু গোষ্ঠীতে। বিক্রম বলছিলেন বাংলাতে ইতিমধ্যে অনেক অভিধান রয়েছে। আরেকটা জমবে কিনা , এ নিয়ে তাঁর সংশয় আছে। কিন্তু সেই অভিধানগুলোতে ‘হে-তাই’ ( He-She / 3rdt person, singular number) নেই, নেই ‘লগে লগে’, ‘বিয়ানি বেলা’, ‘হাইঞ্জা বেলা’ , ‘কিয়ানো’,‘কুশিয়ার’ এমন আরো কত কিছু। তিনি যখন জেনেছিলেন এ হচ্ছে ‘সিলেটি’ তখন কথাটা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করেছিলেন । প্রিয়ঙ্কু এবং অন্যেরা এমন আরো অনেকে খবর নিয়ে জেনেছিলেন , যে অবিভক্ত বাংলাদেশে একে একসময় স্বতন্ত্র ভাষা হিসেবে দাঁড় করাবার চেষ্টা হয়েছিল । সিলেটি নাগরি লিপিও গড়ে তোলার চেষ্টা হয়েছিল। এখনো সে চেষ্টা একেবারে বাদ পড়ে নি। বরং বিদেশেও কোথাও কোথাও একে স্বতন্ত্র ভাষা হিসেবে শেখানোই হচ্ছে। অসমিয়া ভাষা তাত্বিকেরাও একে নিয়ে বেশ আলোচনা করেছেন, বেনুধর রাজখোয়া থেকে শুরু করে প্রায় সবাই। উপেন রাভা হাকাচামতো একে অসমের এক প্রাচীন স্থানীয় ভাষাই বলেন। যদিও এঁরা প্রায় সবাই একে হয় অসমিয়ার উপভাষা বা বৃহত্তম অসমিয়ার অংশ হিসেবে দেখেছেন। প্রিয়ঙ্কু আমার প্রথম জিজ্ঞাসার ক’দিন পরেই জানান, ব্যাপারটা ওঁদের বিবেচনাতে আছে। সিলেটিকে আলাদা ভাষা বা উপভাষা হিসেবেও নেবার কথা বিবেচিত হচ্ছিল। কিন্তু , আমি ওঁদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে জানাচ্ছিলাম, কেবল সিলেটি নিলেতো হবে না, ‘কাছাড়ি বাংলা’র কথা যে কেউ বলে না। আর দক্ষিণ ত্রিপুরার প্রধান উপভাষা কুমিল্লার ভাষার কী হবে? এ ছাড়া পদ্মা নদীর গোটা পূর্ব পারের বাঙালি, যারা পূর্বোত্তর ভারতে এসছেন বা আছেন, তারাই বা বাদ যাবেন কেন? এগুলো আলোচনা চলছিল।
সম্প্রতি একটা লেখাতে বিক্রম শুরুতেই প্রশ্ন করেছেন, “ How many of you, whose mother tongue is Assamese, have the basic knowledge of the languages of the neighboring states, like Khasi, Ao, Mizo, Meetelon? Let alone these languages, how many of you know even the basics of few languages of Assam itself? Like Bodo, Mising, Rabha, Karbi? Probably very few of you are, that can be counted on finger-tips. The reverse is also true… there is hardly any genuine effort to learn Assamese by the non-native-speakers residing in the state, let alone those in the neighboring seven-sister states. Can we break this barrier?’ এই যে ‘barrier’---- এ কেবল মানবিক সম্পর্কের নয়, পরম্পরার, ইতিহাসের, সংস্কৃতির এবং ভূগোলেরো বটে। বিক্রমের কথাগুলোর Assamese শব্দের জায়গাতে Bengali বসিয়ে দিয়েও একই প্রশ্ন ছোঁড়ে দেয়া যায়। এঁরা যেমন সিলেটি বা কাছাড়ি সম্পর্কে বিশেষ জানতেন না, আমি লক্ষ্য করেছিলাম বাঙালি বন্ধুরাও জানতেন না, কাছাড়ে সিলেটির আরো এক প্রাচীন রূপান্তর ‘কাছাড়ি’ও বটে! এটা শিলচর শহরের অনেকেও জানেন না, বা জানলেও আলাদা করে স্বীকার করতে চান না। সেই ক্ষোভে সম্প্রতি হাফলঙের জগন্নাথ চক্রবর্তী, যিনি আদতে হাইলাকান্দির সন্তান, এক ঢাউস সাইজের অভিধান লেখে নাম দিয়েছেন, ‘ বরাক উপত্যকার আঞ্চলিক বাংলা ভাষার অভিধান ও ভাষাতত্ব। ’ আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘ইটা কোন বা’ষা? সিলেটি অইলে ইতো খালি বরাকর বা’ষা নায় !” তাঁর জবাব ছিল, “চিলটি নায়। চিলটি হ’কলে আমারতাইনতর ভাষারে মান্যতা দেইন না, এর লাগ্গিউ নাম দিলাইলাম ‘বরাক বাংলা’!” অভিধানের অনেক জায়গাতে তিনি ‘আঞ্চলিক বাংলা’ কথাটিও ব্যবহার করেছেন। ‘লেখকের নিবেদনে’ এক জায়গায় লিখেছেন, “ ঢাকা বাংলা একাডেমি প্রকাশিত মুহম্মদ শহীদুল্লাহ সম্পাদিত ‘বাংলাদেশের আঞ্চলিক ভাষা অভিধান’ এ সিলেট অঞ্চল স্বাভাবিকভাবে অন্তর্ভূক্ত হলেও বরাক উপত্যকার আঞ্চলিক বাংলা সম্ভবত আলাদা রাষ্ট্রের অঞ্চল বলেই বাদ পড়েছে। আর কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘আঞ্চলিক বাংলা ভাষার অভিধান’ সংকলন প্রকল্পটি যেহেতু পশ্চিমবঙ্গ কেন্দ্রিক তাই ওখানেও স্থান হয়নি বরাক উপত্যকার।” ছেলেবেলা তাঁর মুখের বাংলা শোনে যে সেখানকারই বাঙালি আত্মীয় তাঁর মা-বাবাকে পরামর্শ দিতেন , ‘ এসব গ্রাম্য নীচ লোকের ভাষা না শেখাতে...।” এই তথ্য তিনি বেশ খেদের সঙ্গেই উল্লেখ করেছেন।
‘কাছাড়ি হকল, চিলটি হকল আর অইলগিয়া ( হ’লগৈ) অসমিয়া সকল’—এদের যে এক প্রাচীন ঐতিহাসিক আত্মীয়তা রয়েছে এ কথা আমরা জেনেও না জানার ভান করে থাকি । বাঙালিতো আমরা বটেই--- এনিয়ে যেন কেউ আমার কথাগুলোকে ভুল না বোঝেন। কিন্তু বাঙালি বলে প্রমাণ করবার দৌড়ে আমরা এতো বেশি পশ্চিমের ( কলকাতা) দিকে তাকিয়ে থাকি যে অসমিয়া সহ অন্যরাতো বটেই, নিজেদের দিকেই ভালো করে তাকাবার আমাদের ফুরসত মেলে না। আমার মনে আছে প্রথম প্রথম তিনসুকিয়া শহরে এক অনুষ্ঠানে শক্তিপদ ব্রহ্মচারির এক কবিতা পড়তে আমার পা কাঁপছিল। এই ভয়ে যে, কোনো বাঙালি যদি আমাকে জিজ্ঞেস করে বসেন, ‘কে সে হরিদাস বাবাজী?’ কলকাতাতেতো এঁর নাম শোনা যায় নি!
বাঙালির বড় ভাগটা যেহেতু পূর্বোত্তরের বাইরে থাকেন, অবাঙালি অনেকেই আমাদের ‘বহিরাগত’ বলে ভেবে নেন, ‘খিলঞ্জিয়া’র তালিকাতে হিসেবই করেন না। আমরাও যেন এই সত্যকে প্রমাণ করবার জন্যে সদাব্যস্ত। আমাদের আচারে ব্যবহারে এবং অনুষ্ঠানে । তাই সামাজিক হাজারটা প্রশ্নে বাঙালিকে দেখা যাবে নীরব দর্শক। আমাদের মধ্য সংঘাত ভেদাভেদ আছে। নেইটা-- কার মধ্যে? নাগা-কুকী বছরে সাতবার রক্তাক্ত সংঘাতে ব্যস্ত হয়। তাই বলে, এতো নৈরাসক্তি আর নিস্পৃহতা নিয়ে কেউ বাস করে না। তাই বলে, এই সত্যকে ভুলব কী করে যে ‘চুঙ্গা পিঠা’ আর ‘মেড়ামেড়ির’ ঘর না হলে আমাদেরও পৌষ সংক্রান্তি জমে উঠে না! সম্প্রতি আমি অসমিয়া ‘ফেলানি’ উপন্যাসখানা ব্লগে অনুবাদ করছি। করতে গিয়ে এমন অনেক শব্দে আটকে যাচ্ছি । আমার মনে হচ্ছে এমন বহু শব্দ রয়েছে যেগুলো আমাদের ভাষাতে রয়েছে । কিন্তু যেহেতু আমাকে কলেজ ষ্ট্রিটের অভিধান অনুসরণ করতে হবে আমাকে সেগুলো কেবল অসমিয়া বলে বাদ দিতে হবে। যারাই অনুবাদ করেন তারাই নিশ্চয় আদর্শ বাংলাতে প্রথম পুরুষের একবচনে লিঙ্গ ভেদ ( সিলেটিঃ হে –তাই) না থাকার যন্ত্রণাটা উপলব্ধি করেন। এতোটা সাহস অবশ্যি আমি এখনো করতে পারিনি, কিন্তু আমার প্রায়ই মনে হয়, ‘আমার লগে’, ‘চড়াই’, ‘কুশিয়ার’ ইত্যাদি প্রয়োগ করতে পারব না কেন? এগুলোতো আমাদের নিজেদের শব্দ। এতে ভেজালটা কোথায়? ‘উরুকার মেজি’র বদলে আমি কেন ‘মেড়ামেড়ির ঘর’ (স্মরণ করুনঃ অসমিয়া মেরঘর, বেড়াতে ঘেরা ঘর) ব্যবহার করে আত্মীয়তাটা জাহির করব না? কেন আমাকে এর জন্যে টীকা দিয়ে লিখতে হবে ‘ভোগালি বিহুর এক বিশেষ পরম্পরা!’ আমারটা বুঝি দিব্বি উবে যাবে আলেয়ার আলোর মতো সমস্ত মান্য স্মৃতি থেকে ? কিন্তু আমি জানি ‘মেরামেড়ির ঘরের’ও টীকা নাদিলে উজানের বাঙালি কিছুই বুঝবেন না। তার সংস্কৃতি এবং কলকাতার থেকে পাওয়া বইতে শব্দটি নেই !
এক নতুন সাম্রাজ্যের সন্ধানে ‘শব্দ’- বাংলা ,হিন্দি , নেপালি এবং আদি ভাষাতেও চাই স্বেচ্ছাসেবীঃ
গেল জানুয়ারির ১২ তারিখে গুয়াহাটিতে ‘শব্দে’র সভা বসেছিল। সেই সভাতে সিদ্ধান্ত হয়ে গেল এবার থেকে আদি, বাংলা, হিন্দি ও নেপালিও ‘শব্দে’র অংশভাগী হবে। ১১, ১২ দু’দিন গুয়াহাটির মাছখোয়া আই.টি.এ সেন্টার ফর পারফর্মিং আর্ট প্রেক্ষাগৃহে বসেছিল প্রথমবারের মতো পূর্বোত্তর ভারতীয়দের আন্তর্জাতিক সম্মেলন NEIIM 2010 । আয়োজক ছিল ‘ফাস’ এবং অসম সরকার। সম্মেলনের শেষে ‘শব্দে’র সভা বসে। সেখানে বিক্রম, প্রিয়ঙ্কু, বুলজিত, বিরাজ, প্রশান্ত, পাপড়িরা, ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন আকলান্তিকা শইকিয়া, ভাষ্কর জ্যোতি দাস, নীলোৎপল ডেকা এবং বর্তমান লেখক।
‘শব্দে’ বাংলার প্রবেশ বাংলার পক্ষে দুটো কাজ করবে। বাংলা ভাষাতে পূর্বোত্তরের স্বতন্ত্র অস্ত্বিত্ব ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে পূর্বোত্তরের অন্য ভাষার সঙ্গেও নিজের আত্মীয়তার সূত্রে এখানকার আলো হাওয়ার কাছেও নিজের অস্ত্বিত্ব ঘোষণা করবে। কেবল বাংলা নয় হিন্দির, নেপালি, পক্ষেও কথাটা সত্যি। এতো কেবল এক অভিধান নয়! বিক্রম সম্প্রতি এর এক সংজ্ঞা দেবার চেষ্টা করেছেন এরকম, ““XOBDO is a precise and detailed online multi-directional multi-lingual multi-media based dictionary-cum-phrasebook-thesaurus-cum-encyclopaedia of the languages of the North-East India!!” তিনি আরো লিখেছেন, “Search some very basic words like ‘mother’, ‘bamboo’, ‘river’ etc. You will get the corresponding words in almost all the major languages of the North-East – Bodo, Mising, Khasi, Karbi, Meetelon in addition to English and Assamese. Or, search the Dimasa word ‘dilao’ or the Karbi word ‘lut’ and find out what does it mean in Assamese or English or any other language of the North-East. You can actually search a word of any language and find the equivalent words in all the available languages. In other words, XOBDO is multi-directional and multi-lingual. In one article, XOBDO has been described as the ‘virtual Babel Tower of the North-East’. বাইবেলীয় পৌরাণিক গাঁথার ‘বেবেল মিনারে’র মতো সত্যি সত্যি ‘শব্দ’ স্বর্গ ছোঁয়ার সম্ভাবনা রাখে।
আমরা বিক্রমের বক্তব্যের সমর্থণে একটি উদাহরণ দিতে চাইব। ইংরেজি ‘Bamboo’ শব্দটির এখন অব্দি যে অর্থগুলো পাওয়া গেছে তা এরকমঃ অসমিয়াতে ‘বাঁহ’, বাংশ, বডো-ঔয়া (ow-vaa) , মিশিং-দিবাং (dibang), খাসি-উ স্কং (u skong) , গারো-ওয়া (wa.a), মৈতৈ-ওয়া (waa) মিজো-মাউ (mau) ,কার্বি-ছেক (chek), নাগামীজ –বাশ (bas) ডিমাসা-ওয়াহ (woah)। এবারে যখন বাংলা অর্থ প্রবেশ করবে, কী আসবে? সব্বাই জানেন-বাঁশ, বংশ । জগন্নাথ চক্রবর্তী আরো এক প্রতিশব্দের কথা জানিয়েছেন –‘বা’ ( পৃঃ ২৫৮)। তিনি এর সংস্কৃত উৎসের কথা জানিয়েছেন, লিখেছেন, সং-বংশ। সত্যি হতেও পারে। কিন্তু এখানেই তাঁর অভিধানের সীমাবদ্ধতা। সংস্কৃতের সঙ্গে সমস্ত সম্পর্কের উল্লেখ করেছেন। যেখানে তা পারেননি নীরব থেকেছেন। যথেষ্ঠ সম্ভাবনা থাকা সত্বেও ভোট –মোঙ্গলীয় উৎসের দিকে তেমন তাকান নি। সংস্কৃত ‘ঘ’ প্রত্যয় নিয়ে 'বশ' ধাতু থেকে আসা ‘বংশ’ শব্দটির অর্থ আমরা সবাই জানি। কুল । এর থেকে তৃণ জাতীয় উদ্ভিদের কল্পনাটা বড্ড কষ্টকর। এর থেকে বডো-ঔয়া (ow-vaa) থেকে গারো-ওয়া থেকে ডিমাসা-ওয়াহ থেকে অসমিয়া বাঁহ থেকে (সিলেটি বাংলা বাহ ?) বরাক (কাছাড়ি )বাংলা বা থেকে বাংলা বাঁশ থেকে এবং ‘প্রোথিতে’র মতো সংস্কৃত উৎস শব্দ ‘বংশ’ গড়ে দেয়া হয়েছে, ভাবা যায় না কি? আমরা অবশ্য নিশ্চিত নই। একটা সম্ভাবনার কথা বলছি। দ্রাবিড় বা অস্ট্রিক উৎস থেকেও আসতে পারে। কন্নড় ‘বানবু’ থেকে কোঙ্কনি ‘মাম্বু’ পোর্তুগীজ হয়ে গিয়ে ইংরেজিতে ‘ব্যাম্বো’ (থেকে অসমিয়া ও সিলেটিতে তুচ্ছার্থে‘বাম্বু’) হয়েছে। মালয় দ্বীপেও এর প্রতিশব্দ রয়েছে ‘সামাম্বু’। এবারে, এই যে সংস্কৃত ছেড়ে আমি অন্যদিকে দৃষ্টি ফেরালাম এটা ‘শব্দ’ আমাকে বাধ্য করল। বডো- ডিমাসা প্রতিশব্দগুলো না দেখলে আমি ভাবতামই না যে ‘বাঁশ’ পূর্বোত্তর ভারত সহ এই দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ারই সংস্কৃতির এক ঘনিষ্ঠ অঙ্গ। শ্যামের ‘বাঁশি’ এদিক থেকেই বাংলাতে এবং তার পরে সারা ভারতে (হিন্দি ‘বাঁশরি’) গিয়ে ‘রাধা’কে ডাক পাঠালেও পাঠাতে পারে। এই তথ্যের উল্লেখ করলে আমাদের সম্মান বাড়ে বই কমে না। অন্তত ‘দাদা’, কাকা’র মতো শব্দগুলো যে গেছেই এদিক থেকে এনিয়ে আমরা প্রায় নিশ্চিত। এগুলো সংস্কৃতে আর কৈ খুঁজে পাওয়া যাবে?
এভাবে ভাষাগুলোর তুলনামূলক অধ্যয়নে ‘শব্দ’ এক বিশাল উৎস ভাণ্ডারের কাজ করবে, এটি প্রায় নিশ্চিত । সে বহু অনুসন্ধানকে ইতিমধ্যে উস্কেও দিচ্ছে। তার উপর ভাষাগুলোর মধ্যে পারস্পারিক অনুবাদের কাজেও ‘শব্দ’ এক সহজ সহায়ক হতে পারে। ‘শব্দে’র কর্মীরা যদিও সারা বিশ্বে ছড়িয়ে আছেন, তবু তাদের প্রায় সব্বারই বাড়ি ঘর এই ঈশান কোণে। কিন্তু বাংলা- হিন্দি-নেপালির মতো ভাষাগুলো এসে প্রবেশ করাতে আমরা আশা করতেই পারি এবারে ‘শব্দে’র বিস্তার পশ্চিম তথা বায়ু কোণ অব্দি ছড়িয়ে যেতেই পারে । শব্দ যোগাতে পারে পূর্বোত্তর ভারতের অনুবাদ সাহিত্যকে এক নতুন শক্তি। অনুবাদের মধ্যি দিয়েই যেমন ভাষাগুলোর সমস্ত লিখিত পরম্পরা পরস্পরের মধ্যে আরো ছড়াতে পারে তেমনি বাংলা, হিন্দি ইত্যাদি ভাষাতে অনুদিত হয়েই এখানকার সমস্ত লিখিত পরম্পরা বাকি ভারতে তার বিজয় নিশান ছড়াতে পারে।
খরগোশ এবং কচ্ছপের সেই প্রাচীন গল্পের অর্বাচীন রূপান্তর এবং ‘শব্দ’:
এ পর্যন্ত এসে আমার সেই খরগোশ আর কচ্ছপের গল্পটির কথা মনে পড়ে গেল। সেই যে খরগোশ ঘুমিয়ে গেছিল আর কচ্ছপ দৌড়ে ওকে পেছনে ফেলে দিয়েছিল। সেটি প্রাচীন গল্প । গল্পটির এক অর্বাচীন কম্প্যুটার সংস্করণ তৈরি হয়ে গেছে। দুর্দান্ত ! সংক্ষেপে সেটি এই। খরগোশ বেচারা মন খারাপ করে ভাবতে বসলে, সে ওমনটি হারল কেন? অতি আত্মবিশ্বাসই তার বিপদ ডেকে এনেছে--- সে বুঝতে পারল। সুতরাং ,সে আবারো গিয়ে দৌড়ের প্রস্তাব দিল কচ্ছপকে । কচ্ছপ বেচারা রাজি হয়ে গেল। এবারে কিন্তু খরগোশই জিতল। ধর্য্য, স্থর্য্য নিয়ে যে এগোয় সেও জেতে বটে। কিন্তু বিজয়ী হবার জন্যে স্থৈর্য আর দৃঢ়তার সঙ্গে দ্রুতি অনেক বেশি জরুরি ব্যাপার। সেটি কচ্ছপের জানা ছিল না। এবারে কচ্ছপ এক দুষ্ট চাল চালল। হেরে এসে সে আরেকবার দৌড়ের প্রস্তাব দিলে খরগোশ আবারো একই ভুল করল। এবারে পথ বেছে নেবার দায়িত্ব নিয়েছিল কচ্ছপ। যে পথে এগুলো তার মাঝে রয়েছে এক নদী। সেটি পেরিয়েও এর পরেও যেতে হবে আরো বহু দূর। খরগোশ বেচারা যখন আগে আগে এসে ভাবছে কী করবে, কচ্ছপ এসে দিব্বি সাঁতার কেটে পেরিয়ে গেল। হেরে গিয়ে খরগোশ ভাবল, নিজের ক্ষমতার সীমাবদ্ধতাটা তার জানা উচিত ছিল । এতোবার দৌড়ঝাঁপ করতে করতে ওদের মধ্যে একটা বন্ধুত্বও হয়ে গিয়েছিল। তাই খরগোশ এসে বলল, নিজেদের মধ্যেতো অনেক প্রতিযোগিতা হলো। এবারে চলো, আমাদের প্রতিযোগিতা হবে ঐ পথের সঙ্গেই। নিজেদের মধ্যে কেবল সহযোগিতা। এবারেও তারা ঐ নদী পথটাই বেছে নিল । কিন্তু এবারে নদী অব্দি পথে খরগোশ কচ্ছপকে পিঠে তুলে নিল। নদীতে আসতেই কচ্ছপ নেমে গিয়ে খরগোশকে পিঠে নিয়ে নদী সাঁতরে পেরিয়ে গেল। বাকিটা পথ আবারো খরগোশের পিঠে চেপে আগের দিনের জায়গাতে গিয়ে যখন ওরা পৌঁছলো বেলা ডুবতে তখনো অনেক অনেক অনেক বাকি।
পুরো গল্পটির এক ফ্লাস প্রস্তুতি আমার নিজের ব্লগে রয়েছে। আমি নিজেও প্রায় সমস্ত কাজে এই গল্পের আধুনিক শিক্ষা কাজে লাগাই। ‘শব্দ’ও তাই করে । করতে বলছে, সব্বাইকে। নইলে যে তার পথ চলা হবেই না। যেখানে ছিল দাঁড়িয়ে থাকবে। দাঁড়িয়ে থাকবে গোটা পূর্বোত্তর! তাই কি ! তা হলে চলুন, সেই খরগোশ আর কচ্ছপের মতো আমরা সবাই সেই দৌড়ের অর্বাচীন সংস্করণে নাম লেখাই। আজই গিয়ে ‘শব্দে’র সাইটটি খুলুন আর মাউসে ক্লিক করে লিখতে বসে পড়ুন পূর্বোত্তরের সমস্ত ভাষা সাহিত্যের এক নতুন ইতিবৃত্ত।
০০০০০০০০০০০০~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~০০০০০০০০০০০০০০০
ঋণ স্বীকারঃ এ প্রবন্ধ লিখতে সম্প্রতি প্রকাশিত বিক্রম বরুয়ার দুটি লেখা থেকেও সাহায্য নিয়েছিঃ Making of XOBDO , p 105, FRIENDS, একটি ‘ফাস’ প্রকাশনা এবং The Virtual ‘Bebel Tower of North East’ , p69 , স্মরণিকা –NEIIM 2010