“আমাৰ ,ভাৰতবর্ষৰ এই খণ্ডৰ অধিবাসিসকলৰ, এই যে মাতৃভাষাবোৰঃ/অসমীয়া,মণিপুৰি,বাংলা,বডো,ভোজপুৰী,মিছিং,চিলেটী,নেপালী,খাচি,হিন্দী, ৰাজস্থানী,/কার্বী,তিৱা,ডিমাছা,জেমিনাগা,টাংখুল,আঙ্গামী,কুকি,মিজো,মনপা,ককবৰক…/আমাৰ অতিকৈ প্রিয় তথা পূজ্য।...” এভাবেই শুরু হয়েছে সুপরিচিত অসমিয়া তরুণ কবি ঋতুরাজ কলিতার এক আশ্চর্য সুন্দর গদ্য কবিতা। কবিতাটি দীর্ঘ। সবটা তুলে দেয়াটা এই প্রবন্ধের পক্ষে বিরক্তিকর হবে। আমি বরং প্রাসঙ্গিক ক’টা পংক্তি তুলে দিচ্ছি।“…তথাপি, কাকতৰ পাত তথা দূৰদর্শনৰ পর্দাত ভিন ভিন বাতৰিবোৰ দেখি-শুনি…আমাৰ মনত কিয় জানো এই সন্দেহ আহে/যে আমার এই ভাষাবোৰ/সঁচাকৈয়ে জানো প্রকাশ কৰিব পাৰে সকলোধৰণৰ মানুহৰ মর্মবেদনা?...।যদি প্রতিটো ভাষাই সকলোৰে সুখদুখ সমানেই প্রকাশ কৰিব পাৰিলেহেতেন/তিনিচুকীয়াৰ গাঁওবাসীৰ কণ্ঠত শুনিলোহেঁতেন জানো সেই সংগঠন আৰু সেই ব্যক্তিৰ বাবে জিন্দাবাদ ধ্বনি, যাৰ নির্দেশিত গণহত্যাত নিহত হৈছে তিনিচুকীয়াৰেই শতাধিক অন্যভাষী…বুজাব পাৰিছে জানো অসমৰ চৰ অঞ্চলৰ পৰা উজনিৰ ইটাভাটালৈ ট্রাকেৰে গৈ থাকোঁতে/বিদেশী আখ্যা দি যেয়ে –সেয়ে ঘন্টাৰ পিচত ঘন্টা ভোকে-পিয়াহে আৱদ্ধ কৰি ৰখাৰ যাতনা?...।”
স্পষ্ট যে উগ্রজাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে কবি কন্ঠ সোচ্চার। ঋতুরাজ অসমের সর্বজন শ্রদ্ধেয় লেখক বুদ্ধিজীবী হীরেন গোহাঁই সম্পাদিত বহুল প্রচারিত ছোট কাগজ , ‘নতুন পদাতিকে’র অন্যতম সহযোগী সম্পাদকও বটে। কবিতাটি সে কাগজেরই সাম্প্রতিক সংখ্যাতে ( ১০ এপ্রিল,১০) প্রকাশিত হয়েছে। সুতরাং তিনি একেবারে যে সে ব্যক্তি নন।
না, না। ঋতুরাজ কিম্বা তাঁর কবিতা আমাদের আলোচনার বিষয়ই নয়। আমাদের বিষয়, ‘সিলেটি’ শব্দটি। সে আবার বাংলার থেকে স্বতন্ত্র উল্লেখ করবার মতো আলাদা মাতৃভাষা হলো কবে? অনেক অসমিয়া লেখক বুদ্ধিজীবী ‘সিলেটি’কে বাংলার থেকে স্বতন্ত্র পূর্বোত্তর ভারতীয় ভাষা হিসেবে ভাবতে ভালোবাসেন। ‘নিন্দুকে’রা বলেন এ হলো বাংলার থেকে আলাদা করে পরে অসমিয়ার স্বগোত্রীয় বলে চালিয়ে দিয়ে সেই ভাষাতেই মিলিয়ে দেবার পরিকল্পনা মাত্র। ঋতুরাজ কিম্বা তাঁর মতো বাম প্রগতিশীলদের কলমেও যখন সেই পরিকল্পনার ছায়ার দেখা মেলে তখন চোখ আমাদের একটু কোঁচকায় বটে। মনে হয় যেন বাম দক্ষিণ নির্বিশেষে অসমিয়া মানেই উগ্রজাতীয়তাবাদি। কিন্তু ব্যাপার এতো সহজ নয়। সে নিয়ে আমরা পরে আসছি।
সাম্প্রতিক অসমে ময়মন সিংহ থেকে ১৯৭১এর মার্চের আগে আসা মুসলমানেরা আদমসুমারীতে নিজেদের মাতৃভাষা কী লেখাবেন তাই নিয়ে আলো হাওয়া বেশ উত্তপ্ত হয়েছে। বছরের আগামীদিনগুলোতে আরো হবে এই আশঙ্কাই করা যায়। যারা বলছেন, ‘বাংলা লেখান’ তাদের সম্পর্কে অসমিয়া ভাষার পক্ষের লোকেরা বলছেন এসব বরাক উপত্যকার বাঙালি উগ্রজাতীয়তাবাদীদের প্ররোচনা। অসমিয়া জাতিকে ভাঙ্গার ষড়যন্ত্র।এক বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য গড়বার সৎপ্রয়াসে বাঙালিরা জল ঢালছেন। অন্যদিকে এই ‘সৎপ্রয়াসকে’ বাঙালি মাত্রেই উগ্রজাতীয়াতাবাদ আখ্যা দিয়ে আসছেন। বলছেন, এ হলো বাঙালির সংখ্যা কমিয়ে আধিপত্য বিস্তারের প্রয়াস মাত্র। মুসলমানদের মধ্যে যারা বলছেন, ‘অসমিয়া লেখান’-তাদের সম্পর্কে বাংলার পক্ষের লোকেরা বলছেন ‘বিশ্বাসঘাতক’! আর যারা বলছেন, ‘বাংলা লেখান’ তাদের সম্বন্ধেও অসমিয়ারা অন্যকোনো শব্দ ব্যবহার করছেনই না। অসমিয়ারা বলছেন এতোদিন ঘরের বাইরে অসমিয়া লিখে পড়ে কথা বলে এই মুসলমানেরা অসমিয়া হয়েই গেছেন। বিরুদ্ধবাদিরা জিজ্ঞেস করছেন, তবে যে মূলস্রোতের অসমিয়ারা ঘরের বাইরে ইংরেজিতে লেখা পড়া করছেন, কথা বলছেন তারা কি ইংরেজ হয়ে গেলেন? ভোটের বাজার তাতে কতটা সরগরম হবে তাতো আগামি দিনে দেখাই যাবে। কিন্তু আপাতত যে এতে পত্রিকা কাগজগুলোর বাজার বেশ জমে উঠেছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু যে ব্যাপারটি খোদ মুসলমানদেরকে ভাবাচ্ছে, বাঙালি বলে লিখলেও বরাকে ‘বাঙাল’ আর ব্রহ্মপুত্রে ‘বাংলাদেশি’ এই অবিধা তাদের যাবার নয়। কেউই তাদের পুরো বাঙালি কিম্বা পুরো অসমিয়া বলে মেনে নেবার মতো অবস্থাতে নেই। মেনে নেবেন এই আস্থাও কেউ যোগাবার মতো কোনো আয়োজন করছেন না। যার মারটা জোরালো, তার হাত থেকে বাঁচবার জন্যে তাঁদের দিকেই ঝুঁকে পড়বার সম্ভাবনাই বেশি এই মুসলমান মানুষগুলোর । অসমিয়ারা সংখ্যাগরিষ্ঠ । সুতরাং তাদের দিকেই ভিড়ে যাবার সম্ভাবনা যথারীতি প্রবল। যেমনটি তারা এতোদিন করে এসছেন। যদি তা না করেন তবে সে হবে এক ঐতিহাসিক ঘটনা। সেটি ভালো কি মন্দ হবে সে তর্ক আমরা আপাতত না হয় তুলছি না।
এই মুসলমানেরা থাকেন মূলত ব্রহ্মপুত্রের চর অঞ্চলে। তাদের বেশির ভাগ আসলে গরীব কৃষক, জেলে। জল জমিতে কাজ না মিললে তারা পাথর ভেঙে বড়লোকদের গাড়ি চলবার পথ তৈরি করে দিতে ছড়িয়ে পড়েন পূর্বোত্তরের অন্যত্র। সেখানে তাদের কপালে কী জোটে ঋতুরাজ লিখেছেন সেটিই, “বুজাব পাৰিছে জানো অসমৰ চৰ অঞ্চলৰ পৰা উজনিৰ ইটাভাটালৈ ট্রাকেৰে গোই থাকোঁতে/বিদেশী আখ্যা দি যেয়ে –সেয়ে ঘন্টাৰ পিচত ঘন্টা ভোকে-পিয়াহে আৱদ্ধ কৰি ৰখাৰ যাতনা?...।” এসব দেখে শুনে অন্নদা শঙ্করের সেই কবিতাকে খানিকটা পালটে দিয়ে আবৃত্তি করতে ইচ্ছে জাগে, “তেলের শিশি ভাঙল বলে খোকার পরে রাগ করো?/ তোমরা যে সব বুড়া খোকা ‘অসম’ ভেঙে ভাগ করো। তার বেলা? ” এই গরীব মুসলমানেরা নিজেদের অসমিয়া লিখিয়ে পিঠ বাঁচাবার যে সংগ্রামটি করেন তা খুব কম বাঙ্গালি জাতি ভাইয়ের চোখে পড়ে। কেন না ভাষা কিম্বা ধর্ম যার আধারেই ‘জাতি’ গড়বার স্বপ্ন দেখুন সেই স্বপ্নদ্রষ্টারা শ্রেণিগত ভাবেই মধ্যবিত্ত। সেই শ্রেণি অবস্থান থেকে উপরে যত দূরেই তাদের চোখ যাক না কেন তলার দিকে সে চোখ পড়ে অতি অল্প।
আমাদের নিজেদের ‘চোখ’কে নিয়ে খুব অহঙ্কার রয়েছে। নিজেদের খুব সত্যদ্রষ্টা বলে ভাবতে আমরা ভালোবাসি। প্রায়ই ধমকে দিয়ে পরকে বলি, ‘তুমি কি আমার থেকে বেশি জানো?” সত্য হলো, আমরা কেউই বেশি জানি না। ঋতুরাজ জানেন না যে ‘সিলেটি’ বাংলার এক উপভাষা মাত্র, আলাদা কারো মাতৃভাষা নয়। এই না জানার উপর ঋতুরাজের নিজের খুব একটা দখল নেই। তিনি সেই ছেলে বেলা থেকে স্কুল পাঠ্য সমস্ত অসমিয়া বইতে, সভা সমিতিতে সেরকমই শুনে এসছেন। অত্যুৎসাহীরা ‘সিলেটি’কেও অসমিয়ার উপভাষা বলে বৃহৎ অসমিয়া জাতি গড়বার স্বপ্ন দেখেছেন , দেখিয়েছেন। কিন্তু যারা জানেন যে সিলেটিদের মধ্যে গরীব শ্রমিক, কৃষক থাকলেও এক শক্তিশালী মধ্যবিত্ত বৌদ্ধিক সমাজ রয়েছেন তারা সে উৎসাহ খানিকটা দমিয়ে এনে একে বাংলার থেকে আলাদা ভাষা হিসেবে ভাবতে ভালো বেসেছেন। বানীকান্ত কাকতি কে বাদ দিলে আমি এখনো কোনো অসমিয়া বইতে একে বাংলারই এক উপভাষা বলে সানন্দ স্বীকৃতি দিতে দেখিনি। । ব্যাপারটার শুরু হয়েছিল সেই ১৯১৩তে । যখন বেনুধর রাজখোয়া সিলেট জেলা মেজিষ্ট্রেট ছিলেন, তিনি তখন একটি বই লেখেন যার নাম ছিলঃ Notes on the Sylheti Dialect . তিনি দেখিয়েছিলেন যে সিলেটি উপভাষাটি আদর্শ বাংলার থেকে অসমিয়ার অনেক কাছের ভাষা । তিনি বিশেষ করে উল্লেখ করেছিলেন যে সিলেটিরা শিষ ধ্বনি স (s) কে অসমিয়াদের মতো 'স' (X) উচ্চারণ করে । এরা অল্প /h/-এর দিকে হেলে পড়ে, আদর্শ বাংলার -'সে', 'ঐ',' সেইটি'---র বদলে তারা বলে, 'হি' /he/ ( অস. সি /xi/), হউ /hou/ (অস. সৌ /xou/) , হেইটো ( অস. সেইটো /xeito/) ইত্যাদি । বেনুধর রাজখোয়া অসমিয়া লিপিতে লেখা এক পুরোনো সিলেটি 'পদ্মাপুরাণে'র পাণ্ডুলিপিও দেখেছিলেন । তার পর একেবারেই সাম্প্রতিক গুয়াহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অসমিয়া বিভাগের অধ্যাপক ভাষাবিদ উপেন রাভা হাকাসামের বই ‘অসমীয়া আৰু অসমৰ তিব্বত বর্মীয় ভাষা’ এবং ‘অসমীয়া আৰু অসমৰ ভাষা-উপভাষা’ বই দুটিতেও বেনুধর রাজখোয়ার সেই শতাব্দি প্রাচীন তত্বের প্রতিধ্বনি শোনা যাবে। মাঝখানের ভাষাবিদেরা এ নিয়ে কী লিখে গেছেন উপেন রাভা হাকাচাম থেকেই না হয় তার নজির টানা যাক , “ অবশ্যে পৰবর্তী কালত ড০ উপেন্দ্র নাথ গোস্বামীয়ে তেওঁৰ ‘অসমীয়া ভাষা আৰু উপভাষা’ (১৮৮৬)নামৰ পুথিত ড০ প্রমোদচন্দ্র ভট্টাচার্যৰ সুৰতে সুৰ মিলাই ক’বলৈ অকণো সংকোচ বোধ কৰা নাই যে “ কাছাৰী উপভাষাটো কামৰূপী উপভাষা আৰু অসমীয়া মান্য ভাষাৰ ওচৰ চপা। ইয়াত শতকৰা পয়সত্তৰটা শব্দ সজাতীয় শব্দ।” ( পৃঃ ১১; ‘অসমীয়া আৰু অসমৰ তিব্বত বর্মীয় ভাষা ) । এরা পণ্ডিত মানুষ। কিন্তু তা সত্বেও তাঁদের ‘চোখ’ যে সর্বত্রগামী হয় নি সেতো বেনুধর রাজখোয়ার ঐ ছোট্ট উল্লেখটিতেই স্পষ্ট। হেইটো ( অস. সেইটো /xeito/) সিলেটি শব্দই নয়। সিলেটি শব্দ হবেঃ হকটা বা হটা বা হিটা। তাঁর অসমিয়ার সাদৃশ্য সন্ধানী চোখ ‘হিটা’কে ‘হেইটো’ শুনেছিল।
এমন সীমাবদ্ধতা প্রায় শতাব্দী পরের উপেন রাভাতেও রয়েছে। তিনি বাংলা বলে যে ভাষার নজির দিয়ে তুলনা টেনেছেন তা প্রায়ই বাংলা সাধু ভাষা। মুখের বদলে কৃত্রিম ভাবে গড়ে তোলা সাহিত্যের ভাষা। যেমন তিনি লিখেছেন, “ অসমীয়াৰ সৈতে সাদৃশ্য থকা প্রধান কেতবোৰ ৰূপতাত্বিক বৈশিষ্ট হ’ল—ভবিষ্যত কালৰ প্রথম পুৰুষৰ ৰূপ –ইমু ( যাইমু, কৰিমু),তু,অসমীয়া –ইম/ম কিন্তু বাংলা –ইব, দ্বিতীয় পুৰুষৰ ৰূপ –ইবা ( যাইবা, কৰিবা) তু, অসমীয়া-ইবা/বা কিন্তু বাংলা –ইবে, তৃতীয় পুৰুষৰ ৰূপ –ইব (কৰিব) ,তু অসমীয়া –ইব/-ব কিন্তু বাংলা –ইবে...” ( পৃঃ ১২’ঐ) এমন নজির তাঁর দুটো বইতেই প্রচুর রয়েছে। বস্তুত প্রায় সবই এরকম। প্রথম,দ্বিতীয়, তৃতীয় পুরুষ বিভাজন বাংলাতে নেই। আমি যদ্দুর জানি অসমীয়াতেও নেই। আসলে তিনি প্রথম বলতে উত্তম পুরুষ,দ্বিতীয় বলে মধ্যম আর তৃতীয় বলে প্রথম পুরুষ বুঝিয়েছেন সেটি অসমীয়া নজির থেকে স্পষ্ট। তাই যদি হয়, তবে উত্তম পুরুষে আদর্শ চলিত বাংলার রূপ আসলে –ইব নয় -ব ( আমি যাব, খাব।) সাধু বাংলাতে –ইব ( যাইবে, খাইবে), তেমনি মধ্যম পুরুষের চলিত বাংলার ইবে নয়, বে ( তুমি যাবে, খাবে), প্রথম পুরুষের চলিত বাংলার রূপ ইবে নয়, মধ্যম পুরুষের মতোই –বে ( সে যাবে, খাবে)। সিলেটি উদাহরণও যথাযথ নয় এখানে। মধ্যম পুৰুষৰ ৰূপ –ইবা এবং তার দৃষ্টান্ত মোটেও যাইবা, কৰিবা –কোনোটাই নয়। সে হবে –ইও ( যাইও, করিও) । তৃতীয় পুরুষের ৰূপ অসমীয়ার মতোই –ইব/ব হয় বটে । কিন্ত ‘কৰিব’ শব্দটি তার দৃষ্টান্ত হতে পারে না। এটি একেবারেই উত্তম পুরুষের সাধু বাংলার রূপ, সিলেটি মোটেও নয়। সিলেটি হবে ‘ হে যাইব, করব, খাইব, মরব ইত্যাদি। অসমিয়াতে ‘সি কৰিব’, কিন্তু সাধু বাংলাতে , ‘আমি করিব’ । এ ধরণের দৃষ্টান্ত দেয়া আর সিদ্ধান্ত টানা থেকে একটা কথাতো পরিষ্কার যে উপেন রাভা অবরোহী পদ্ধতিতে অনুসন্ধান চালিয়েছেন। অর্থাৎ, সিদ্ধান্ত কী টানতে হবে তাঁর আগেই জানা ছিল, পরে তিনি তার অনুকূলে দৃষ্টান্ত সংগ্রহ করে গেছেন। সেটি করতে গিয়ে সিলেটিকে যতটা পারেন অসমিয়ার মতো করে ফেলেছেন, আর বাংলাকে যতটা সম্ভব সাধু করে দূরে ঠেলে দিয়েছেন। তাতে অসমীয়া অক্ষত থাকলেও বাংলা বা সিলেটি কেউই তাদের যথাযথ রূপ এবং চরিত্রে তাঁর গ্রন্থে এসে উপস্থিত হয় নি। বৈজ্ঞানিক নৈরাসক্তি তাঁর অধ্যয়নে পাওয়া যাবে না। তাঁর পরেও কিন্তু তাঁর মন্তব্য আমরা সিলেটিরা বুঝি যথেষ্ট বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান না করেই একটা ভুল ধারণা নিয়ে বসে আছি যে আমাদের মাতৃভাষা বাংলা। প্রমোদ চন্দ্র ভট্টাচার্যের একটি উদ্ধৃতি দিয়ে তিনিও লিখেছেন, “এনেদৰে কাছাৰ অঞ্চলৰ ভাষা-উপভাষাৰ তুলনামূলক বিচাৰ-বিশ্লেষণ কৰিলে কাছাৰীয় উপভাষা সীমান্তৰ মাত -কথা ৰূপে বঙলাতকৈ অসমীয়া ভাষাৰ ওচৰ চপা আৰু ঘনিষ্ঠ ৰূপ বুলি প্রমাণ কৰিব পাৰি... কিন্তু কাছাড় আৰু কৰিমগঞ্জ অঞ্চলৰ কথিত ভাষা-উপভাষাৰ বৈজ্ঞানিক আৰু ক্ষেত্র অধ্যয়নমূলক বিচাৰ বিশ্লেষণ নোহোৱাৰ বাবে,... পুৰণি ভুল ধাৰণাই এই অঞ্চলৰ কথিত ভাষা-উপভাষাক বঙলা বুলিহে অভিহিত কৰি চৰকাৰী ব্যৱস্থা লোৱা হৈছে।” ( পৃঃ১২; ঐ)
তাঁর নিজের অধ্যয়নই যে যথেষ্ট বৈজ্ঞানিক নয় সেতো পাঠক মাত্রেই আগে দেয়া নজির থেকে ধরে নেবেন। বোঝাই যায় জাতীয়তাবাদ তাঁর দৃষ্টিকে নিয়ন্ত্রিত আর সীমাবদ্ধ করেছে। এমন জাতি, বর্ণ, অঞ্চল, শ্রেণি বা অন্যান্য সামাজিক স্বার্থ আমাদের দৃষ্টিকে নিয়ন্ত্রিত করে বলেই সমাজ বিজ্ঞান আজো বিশুদ্ধ বিজ্ঞান বলে স্বীকৃতি পেলনা।“কাছাৰীয় উপভাষা সীমান্তৰ মাত -কথা ৰূপে বঙলাতকৈ অসমীয়া ভাষাৰ ওচৰ চপা আৰু ঘনিষ্ঠ ৰূপ বুলি প্রমাণ কৰিব পাৰি...”-- তাঁর এই কথাৰ সঙ্গে কোনো বাঙালিই দ্বিমত পোষণ করবেন না। রবীন্দ্রনাথ অব্দি তাঁর প্রথম জীবনের এক রচনাতে লিখেছেন, “ বীরভূমের কথিত ভাষার সহিত ঢাকার ভাষার যে প্রভেদ, বাংলার সহিত আসামির প্রভেদ তাহা অপেক্ষা খুব বেশি নহে।” (পৃঃ ৭৩৯, ভাষাবিচ্ছেদ;পরিশিষ্ট,শব্দতত্ব; রবীন্দ্ররচনাবলী, ৬ষ্ঠ খন্ড;১২৫তম জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে বিশ্বভারতী প্রকাশিত সুলভ সংস্করণ) । এই কথা প্রতিষ্ঠার জন্যে উপেন রাভার দরকার ছিলনা সিলেটি উদাহরণকে অসমিয়াপ্রায় আর বাংলা উদাহরণকে সাধু বাংলা করে দূরে ঠেলবার। এর পক্ষে তিনি বহু বাংলা ভাষাবিদদের থেকেও নজির পেয়ে যেতেন। চাইকি শুধু সিলেটি কেন পূর্ব বাংলার আরো আরো উপভাষার অধ্যয়ন করলেও তিনি সেটা প্রমাণ করতে পারতেন। সম্ভবত চট্টগ্রামের ভাষার সঙ্গে আর বেশি। উপরে উল্লেখ করা প্রবন্ধেই রবীন্দ্রনাথই লিখেছেন, “ আসামিরা চ-কে দন্ত্য স ( ইংরেজি s) জ-কে দন্ত্য জ ( ইংরেজি z) রূপে উচ্চারণ করে , পূর্ববাংলাতেও সেই নিয়ম । তাহারা শ-কে হ বলে, পূর্ববঙ্গেও তাই। তাহারা বাক্য-কে ‘বাইক্য’, মান্য-কে ‘মাইন্য’ বলে, এ সম্বন্ধেও তাহার প্রভেদ দেখি না।”( (পৃঃ ৭৪১, ভাষাবিচ্ছেদ;ঐ) উপেন রাভা বা বেনুধর রাজখোয়া কেউ ওতো দূর অব্দি তাকানই নি, কেননা তাঁদের দৃষ্টিকে নিয়ন্ত্রিত করেছে গেল এক দেড় শতকের অসমের রাজনৈতিক ইতিহাস আর মানচিত্র। সিলেট ১৮৭৪থেকে অসমের একেজেলা ছিল। আজো তার একটা অংশ অসমেরই অংশ। কিন্তু উপেন রাভা হাকাসামের, “পুৰণি ভুল ধাৰণাই এই অঞ্চলৰ কথিত ভাষা-উপভাষাক বঙলা বুলিহে অভিহিত কৰি চৰকাৰী ব্যৱস্থা লোৱা হৈছে।” এই কথাতে অন্য বাঙালিতো বটেই সিলেটি মাত্রকেই ক্ষেপিয়ে তুলবার পক্ষে যথেষ্ট। অথচ তাঁর উদ্দেশ্য এক বৃহত্তর ঐক্য গড়ে তোলা।
গেল বছর (১ সেপ্টেম্বর,২০০৯) তিনি আমাদের তিনসুকিয়া কলেজে ভাষা উপভাষার উপর এক বক্তৃতা দিতে আমন্ত্রিত হয়ে এসছিলেন। সেই সভাতে সিলেটি শ্রোতার সংখ্যা ছিল অতি নগন্য,ময়মনসিংহী কেউ তো ছিলেনই না। তাদের তুষ্ট করবার কোনো প্রশ্নই উঠেনা। তবুও তিনি বেশ জোর দিয়েই নানা ভাষাতাত্বিক উদাহরণ দিয়ে দিয়ে বলেছেন, কৌনোজ থেকে আসা বহু মূলস্রোতের অসমিয়াদের থেকেও সিলেটিরা, ময়মনসিংহের লোকেরা এই অসমের মাটিতে বেশি প্রাচীন। বেশি ‘খিলঞ্জিয়া’। মজার কথাটা হলো, এই সত্য কথাটা অসমের বহু সিলেটিও জানেনই না। তিনিতো ‘বাংলাদেশি’ বলে ময়মনসিংহীদের হেনস্থা করবার প্রয়াসের বিরুদ্ধেও তাঁর ক্ষোভ প্রকাশ্যেই জানিয়ে গেলেন।
উপেন রাভার এই ‘সৎ উদ্দেশ্য’কে বহু সিলেটি তথা বাঙ্গালি সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখতে চাইবেন। তাঁরা ভেবে নেবেন যে যতই ভালো ভালো কথা বলুন লিখুন অসমিয়া মাত্রেই উগ্রজাতীয়তাবাদি। এই বাঙালিদের জন্যে এবারে আমরা বাংলার উগ্রজাতীয়তাবাদিদের খবর জানাবো।
বরাক উপত্যকার ভাষাকে বাংলা বলে চালিয়ে দেবার চেষ্টাকে নিয়ে উপেন রাভার আক্ষেপের প্রতিধ্বনি শোনা যাবে বাংলার তথা কথিত কামরূপী উপভাষা তথা কামতাপুরি ভাষা নিয়ে সুধীর কুমার বিষ্ণুর করা এই মন্তব্যে , “ কামরূপী উপভাষাকে একটি প্রাচীন ও স্বতন্ত্র ভাষা রূপে দাবি করা হয়েছে, এর পেছনে দু’টি কারণ আছে বলে আমার মনে হয়। প্রথমত, মাতৃভাষা সম্পর্কে মানুষের আবেগকে কাজে লাগিয়ে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনের চেষ্টা, দ্বিতীয়ত, ভাষা ও উপভাষা সম্পর্কে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির অভাব।” (পৃঃ ১৫৮, কামরূপী উপভাষা; সুধীর কুমার বিষ্ণু; উত্তর বঙ্গের ভাষা; সম্পাদক-রতন বিশ্বাস।)পাঠককে আমরা মনে করিয়ে দিতে চাই অসমের বরাকউপত্যকার রাজনৈতিক আর সামাজিক অবস্থান থেকে পশ্চিম বাংলার উত্তর ভাগের চেহারা চরিত্র খুব একটা পৃথক নয়। পিছিয়ে পড়া উত্তর বাংলাতেও কামতাপুরি ভাষার আন্দোলনকে কঠোর ভাবে দমন করে আসছে সেখানকার সরকার আর বাঙালি মধ্যবিত্ত। তবু বরাকে যারা ভাষার প্রশ্নে প্রচণ্ড আবেগিক, যারা মুলতঃ লেখক বুদ্ধিজীবি, রাজনীতির সঙ্গে চোখে পড়ার মতো সম্পর্ক যাদের অতি অল্প তাদের আমরা সেই উত্তর বঙ্গের বাস্তবতার সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করতে দেখিই না। তাঁরা মাঝে মধ্যে স্লোগান তোলেন বটে , “মাতৃভাষা প্রাণের ভাষা। এ ভাষায় আছে অধিকার সকল জাতির সকল জনতার।” কিন্তু সেটি কতটা আন্তরিক তাঁর পরীক্ষা দেবার এখনো অনেক বাকি। বরাকের মণিপুরি ভাষাকে সরকারি ভাষা করবার প্রস্তাব সম্ভবত এখনো তাদের কোনো কল্পনাতেই নেই। কেউ সে প্রস্তাব দিলেও তিনি কতটা সমাদৃত হবেন তা এখনো দেখার বাকি। তাঁরা বরং অতি আগ্রহী কলকাতার প্রতি। কারণ কলকাতাই বাংলার সাংস্কৃতিক রাজনীতির রাজধানী! যার একটা শাখা তারা খুলে চালাতে চাইছেন শিলচরে। কথাগুলো কটু, অপ্রিয়। কিন্তু সত্য।
খুব কম বাঙালিই সুধীর বিষ্ণুর মন্তব্যে সহজে কোনো ত্রুটি দেখতে পাবেন, বরং বৃহৎ বাঙালি ঐক্যের স্বার্থকে উর্ধে তুলে ধরবার জন্যে বাহবাই দেবেন। তবু যদি কেউ ভেবে থাকেন যে অধ্যাপক সুধীর বিষ্ণু নিশ্চয়ই কোনো এলেবেলে লোক তাদের জন্যে আমরা এবারে এক মোক্ষম উদাহরণ তুলে ধরব। সেটি আর কেউ নন, স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের থেকে । রবীন্দ্রনাথের যে উদ্ধৃতি দু’টো এ অব্দি তুলে দিলাম যাতে মনে হতে পারে যে তিনিও ভাষাদু’টোর মিত্রতার জয়ধ্বজা তুলবার মহান ব্রত কাঁধে তুলে নিয়েছেন, তাঁর সেই লেখার মধ্যেই পাওয়া যাবে বেনুধর রাজখোয়া বা উপেন রাভা হাকাসামের মন্তব্যগুলোর শেকড় বাকড়ের খোঁজ , “... আসাম ও উড়িষ্যায় বাংলা যদি লিখন পঠনের ভাষা হয় তবে তাহা যেমন বাংলা সাহিত্যের পক্ষে শুভজনক হইবে তেমনিই সেই দেশের পক্ষেও। কিন্তু ইংরেজের কৃত্রিম উৎসাহে বাঙ্গলার এই দুই উপকণ্ঠবিভাগে একদল শিক্ষিত যুবক বাংলা প্রচলনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহধ্বজা তুলিয়া স্থানীয় ভাষার জয়কীর্তন করিতেছেন।” অসমিয়া বা ওড়িয়া ভাষাতে যে কোনো বড় কাজ করা যেতে পারে সেটি রবীন্দ্রনাথ তখন ( ১৩০৫ বাংলা) বিশ্বাসই করতে পারতেন না । তিনি লিখেছেন, “ এ কথা আমাদের স্মরণ রাখা উচিত যে দেশীয় ভাষা আমাদের রাজভাষা নহে, যে ভাষার সাহায্যে বিদ্যালয়ের উপাধি বা মোটা বেতন লাভের আশা নাই। অতএব, দেশীয় সাহিত্যের একমাত্র ভরসা তাহার প্রজাসংখ্যা, তাহার লেখক ও পাঠক সাধারণের ব্যাপ্তি। খন্ড বিচ্ছিন্ন দেশে কখনোই মহৎ সাহিত্য জন্মিতে পারে না। তাহা সংকীর্ণ গ্রাম্য প্রাদেশিক আকার ধারণ করে। তাহা ঘেরো এবং আটপৌরে হইয়া উঠে, তাহা মানব-রাজদরবারের উপযুক্ত নয়।” (পৃঃ ৭৪১, ভাষাবিচ্ছেদ;ঐ)
এ বছর সমগ্র অসমেও রবীন্দ্রনাথের সার্ধশতবর্ষ যথেষ্ট সম্মানের সঙ্গে পালিত হচ্ছে আর হবে। অসমিয়া মানুষও তার উদ্যোগ নিচ্ছেন। ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার প্রায় প্রতিটি সঙ্গীত বিদ্যালয়ে রবীন্দ্রসঙ্গীতের পাঠ দেয়া হয়ে থাকে। তিনি যে প্রতিটি অসমিয়া মনে জ্যোতি প্রসাদ বিষ্ণুরাভার থেকে মোটেও কম শ্রদ্ধার আসনে বসে নেই তার কারণ ঘটনাক্রম সেই ১৩০৫ সনে রবীন্দ্রনাথের আশা করা মতো ঘটেনি, রবীন্দ্রনাথও তাঁর তখনকার অভিমত আঁকড়ে ধরে থাকেন নি। ঐ প্রবন্ধটি লেখার সময় অব্দি এমন কি ১৯০৫এর বাংলা ভাগ বিরোধী আন্দোলনের সময় অব্দি তিনি সমকালীন উগ্র ভারতীয় তথা বাঙালি জাতীয়তাবাদের সঙ্গে ছিলেন। এমনকি ইউরোপীয় জাতি-রাষ্ট্রের ধারণার প্রতিও তাঁর অগাধ শ্রদ্ধা ছিল। ওই প্রবন্ধেই তিনি লিখছেন, “ বৃটিশ দ্বীপে স্কটল্যান্ড, আয়র্ল্যান্ড ও ওয়েলসের স্থানীয় ভাষা ইংরেজি সাধুভাষা হইতে একেবারেই স্বতন্ত্র। তাহাদিগকে ইংরেজির উপভাষাও বলা যায় না। উক্ত ভাষাসকলের প্রাচীন সাহিত্যও স্বল্পবিস্তৃত নহে। কিন্তু ইংরেজের বল জয়ী হওয়ায় প্রবল ইংরেজিভাষাই বৃটিশ দ্বীপের সাধুভাষারূপে গণ্য হইয়াছে। এই ভাষার ঐক্যে বৃটিশ যে উন্নতি ও বললাভ করিয়াছে, ভাষা পৃথক থাকিলে তাহা কদাচ সম্ভব হইত না।” এটি এক উজ্জ্বল প্রমাণ যে ভারতে ‘জাতি গঠনে’র ধারণাটি একটি ইউরোপীয় আমদানি। রবীন্দ্রনাথের নিজেরই পরের রচনাগুলোতে তার স্বীকৃতি ও উল্লেখ অজস্র আছে। জাতি রাষ্ট্রের ধারণা এক ইউরোপীয় এবং বর্বর ধারণা। যেখানেই সে ধারণা গেছে সঙ্গে করে মৃত্যু আর ধ্বংস ছাড়া আর কিছুই নিয়ে যায় নি। আমরা সবাই জানি এখানে যে ‘ইংরেজের বলে’র তিনি ভূয়সী প্রশংসা করছেন তাকেই তিনি ‘অজগর সাপের ঐক্য নীতি’ বলে পরের জীবনে ক্ষোভ প্রকাশ করছেন। জীবনের শেষে ‘সভ্যতার সংকট’ অব্দি আসতে আসতে সেই ক্ষোভ অভিশাপে পরিণত হয়েছে। কেবল অসমীয়ারা ক্ষুন্ন হয়ে আছে বলেই তিনি অসমীয়াকে স্বতন্ত্র ভাষা বলে মেনে নিয়েছেন তা নয়। তিনিই প্রথম আবিষ্কার করেছেন ‘বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য’ই আমাদের দেশের মূল সুর।পরের স্বাতন্ত্র্য স্বীকার করে নিয়ে তাকে আপন করবার প্রতিভাটা ভারতের নিজস্ব প্রতিভা। আমরা যে রচনার থেকে তাঁর উদ্ধৃতিগুলো দিলাম সে লেখাটিও তাই পরে পরিত্যক্ত হয়েছিল। শুধু ঐতিহাসিক সত্যতার দায়ে ১২৫তম জন্মজয়ন্তীর সময় প্রকাশিত সুলভ সংস্করণের সম্পাদকেরা একে পরিশিষ্টে ঠাই দিয়েছেন।
অসমীয়া ভাষাতে গ্রন্থ প্রকাশের বিষয়ে লক্ষীনাথ বেজবরুয়ার সঙ্গে কথা প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ কিছু বিরূপ মন্তব্য করেছিলেন। তাঁর আশঙ্কা ছিল এমন করে সবাই যদি বাংলা ছাড়তে শুরু করে তবে আর বাংলা সাহিত্য বলে কিছু টিকে থাকবে না। এই কথাগুলো অসমিয়া পন্ডিতদের মধ্যে বহুবার বহুভাবে আলোচিত হয়েছে। লোক সংস্কৃতির প্রখ্যাত গবেষক, অসম সাহিত্য সভার প্রাক্তন সভাপতি অধ্যাপক বীরেন্দ্রনাথ দত্তের কথাতে রবীন্দ্রনাথের এই সব মন্তব্য “ কিছুদূৰ বৈষয়িক ধৰণৰহে আছিল। আৰু সেয়া আছিল কবিৰ আগ বয়সৰ কথা । ৰবীন্দ্রনাথেৰ পৰিণত চিন্তাত আন এখন ছবিহে ফুটি উঠে । প্রত্যেক আঞ্চলিক ভাষাই সমৃদ্ধি লাভ কৰক আৰু তাৰ মাজতেই সাংস্কৃতিক-ভাষিক বিস্তৃতি লাভ কৰক-কবিয়ে মনে প্রাণে তাকেই কামনা কৰিছিল” ( অসমীয়া আৰু বাঙালীৰ সম্পর্কঃ এক ঐতিহাসিক বিহঙ্গম দৃষ্টি; সাতসৰী, ১৬-৩১ ডিসেম্বর সংখ্যা,২০০৭, পৃঃ২০)
যারা ভাবেন যে কোনো এক ভাষাতে বেঁধে ফেলতে পারলেই এক সর্বভারতীয় ঐক্য দাঁড়িয়ে যাবে তাদের সে উগ্রজাতিয়তাবাদি ধারণার বিরুদ্ধে যে রবীন্দ্রনাথ যে কেমন সোচ্চার ছিলেন তার কথা বলতে গিয়ে ওই একই লেখাতে বীরেন্দ্রনাথ প্রভাত কুমারের ‘রবীন্দ্র জীবনকথা’ থেকে এক উদ্ধৃতি দিয়েছেন, “ কবি বলেন, ভারত ব্যাপী মিলনের একটা ভারতীয় ভাষা করবার কথা হচ্ছে। তাঁর মতে এতে করে যথার্থ সমন্বয় হতে পারে না, হয়তো একাকারত্ব ( uniformity ) হতে পারে, কিন্তু একত্ব (unity) হতে পারে না। দড়ি দিয়ে বাঁধা , মিলনের প্রয়াস মাত্র। সে মিলন শৃঙ্খলের মিলন অথবা বাহ্য শৃঙ্খলার মিলন মাত্র। তবে প্রবাসী বাঙালিদের উদ্দেশে কবি বললেন, তাঁরা যেন যে দেশে বাস করেন সে দেশ সম্বন্ধে উদাসীন না থাকেন। তিনি বললেন, প্রায়ই দেখা যায় বাংলার বাইরে যেখানে বাঙালিরা থাকেন তার ভাষা সাহিত্য তথ্যাদি সম্বন্ধে তাঁদের একটা ঔদাসীন্য আছে; এই উদাসীনতা বা অবজ্ঞা অজ্ঞতারই নামান্তর। বাঙালির প্রধান রিপু এই আত্মাভিমান।”
ঔদাসীন্যের কথা যখন এলোই তবে উল্লেখ করে রাখা মন্দ হবে না যে রবীন্দ্রনাথের ভাষাবিজ্ঞানেরও ভালোই অধ্যয়ন ছিল। প্রখ্যাত ভাষাবিজ্ঞানী সুকুমার সেনের কথায়, ঐ অধ্যয়নগুলোর কথা মনে রাখলে, “রবীন্দ্রনাথকে বাঙ্গালী ভাষাবিজ্ঞানীদের মধ্যে প্রথম বলিতেই হয়।” ( বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস; চতুর্থ খন্ড; পৃঃ৪১৫) তাঁর সেই অধ্যয়নের মধ্যে অসমিয়া ভাষাও রয়েছে। ‘বিলাক-বোৰ’ ইত্যাদি অসমিয়া বহুবচন প্রত্যয়ের উৎস সন্ধানে তিনি বেশ নিবিড় অনুসন্ধান চালিয়েছিলেন। অসমিয়া ভাষা নিয়ে নাথান ব্রাউনের ব্যাকরণ তাঁর আয়ত্বে ছিল।
এখন কথা হলো, উপেন রাভা হাকাচামের মতো অসমিয়া কিম্বা সুধীর বিষ্ণুর মতো বাঙালি ভাষাবিদেরা কি তাদের ‘শৃঙ্খলের মিলন’ তত্ব ছাড়তে রাজি রয়েছেন? রাজি আছেন কি, ‘একাকারত্বে’র ( uniformity ) তত্বকে ধুলোয় মিলিয়ে একত্ব (unity) প্রতিষ্ঠার পথে পা বাড়াতে? উনিশে মে’র পঞ্চাশ বছরকে সামনে রেখে এক দল সাংস্কৃতিক কর্মী সারা বরাকের শহরগুলোতে বিশেষ করে শিলচরে একটি স্লোগান দিচ্ছেন দেখা যাচ্ছে, ‘হৃদয়ে রবীন্দ্রনাথ চেতনায় উনিশ’। ভালো কথা। কিন্তু এমন চিহ্নায়নের নানান অর্থ হতে পারে। আমজনতার কাছে যে সোজা অর্থটা সোজাসুজি পৌঁছুবে তা এই যে রবীন্দ্রনাথ বাংলা ভাষার কবি, উনিশ সেই ভাষার অধিকার রক্ষার জন্যে রক্ত দেবার দিন। সুতরাং যে কোনো মূল্যেই বাংলার জন্যে লড়াইটা চালিয়ে যেতেই হবে। তাতেও মন্দ কিছু নেই।
কিন্তু হৃদয়ে রবীন্দ্রনাথ কথাটার অর্থতো অনেক ব্যাপক। কেবল বাংলা ভাষার অধিকারের কথা বলা হলো গে রবীন্দ্রনাথকে হত্যা করা। মনে কি পড়ে রবীন্দ্রনাথের সেই আক্ষেপ, ‘সাত কোটি সন্তানেরে হে মুগ্ধ জননী, রেখেছো বাঙালি করে ,মানুষ করোনি।” সেদিকে খেয়াল আছে তো? ‘বাঙালির প্রধান রিপু এই আত্মাভিমান’ –এর বিরুদ্ধেও লড়াইটা সমানে হয়ে উঠবে কি? উঠছে কি? মণিপুরি, ডিমাসাদের হৃদয়ের কথাতে কান পাতা হচ্ছে কি? রবীন্দ্রনাথের কথাগুলো অসমিয়া হৃদয়েও পৌঁছে দেবার কাজটা হয়ে উঠবে তো? বাঙালিদের মনে অসমিয়া জাতীয়তাবাদের আগ্রাসনের আতঙ্ক রয়েছে। কিন্তু অসমিয়া মনেও যে বাঙ্গালির আত্মাভিমানের আতঙ্ক রয়েছে তার প্রতি কোনো সম্মান আর সহানুভূতি রয়েছেতো? অষ্টাদশ শতকের তিন দশক প্রাদেশিক ভাষা হিসেবে বাংলার স্বীকৃতি থাকবার পর যখন তাকে তুলে দেয়া হয়েছিল তখন বহু বাঙালি এর বিরোধীতা করেছিলেন এই যুক্তিতে যে অসমীয়ার স্বতন্ত্র ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পাবার কোনো যোগ্যতাই নেই। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অসমিয়া চালু করতে গিয়ে আশুতোষ বন্দোপাধ্যায়কেও দিনেশ সেনের মতো পন্ডিত মানুষের বিরোধীতার অনেক কাঠখড় পোহাতে হয়েছে সেই ইতিহাস আমরা জানি তো? আমরা কি সত্য তার কোনো সমাধান বের করেছি, না বের করতে আগ্রহী? মুসলমানেরা আদমসুমারিতে নিজের মাতৃভাষা বাংলা লেখালে অসমিয়ারা আর অসমিয়া লেখালে বাঙালিরা কি ‘বিশ্বাসঘাতক’ বলে গাল দিয়েই যাব, না এর উর্ধে গিয়েও কিছু ভাবব?
বছর কয় আগে ভাষার দাবিতে কামতাপুরিদের ডাকা এক বন্ধের সময় আমার এক বামপন্থী অসমিয়া সহকর্মীর সঙ্গে ওদের মাতৃভাষা কী, তাই নিয়ে তর্ক হচ্ছিল। তিনি বলছিলেন, ওদের ডাকা বন্ধের কোনো বৈধতা নেই। ওরা অসমিয়া ভাষাকে ভাঙ্গবার ষড়যন্ত্র করছে। আমি বলছিলাম, “ওদিকে আপনাদের পশ্চিম বাংলার কমরেডরা বলবেন ওরা ‘বাঙালি’, এদিকে আপনারা অসমের কমরেডরা বলবেন ওরা ‘অসমিয়া’। ওদিকে বুদ্ধদেব সরকার বলবে ওরা ‘বাঙালি’, এদিকে তরুণ গগৈ সরকার বলবে ওরা ‘অসমিয়া’। ওরা বেচারা যাবে কোনদিকে ? ভালো হয় না কি ওরা কি সেটা ওদেরই ঠিক করতে দেয়া?” তিনি খুব চটে গেছিলেন। যুক্তিতে না পেরে বলছিলেন , “আপনি আসলে অসমিয়া স্বার্থ বোঝেন না। বোঝবেন কী করে? নিজেই তো বাঙালি উগ্রজাতিয়তাবাদ ছাড়তে পারেন নি।“ আমি বললাম, “সেটি কীরকম?” উনি বললেন, “আপনি এখনো ‘অহমিয়া’ বলে যাচ্ছেন! বলুন অসমিয়া ,যেমন বলেন ‘অস’মিয়া’ ( oxomia)।” আমি যতই বল্ আমি এখনো অসমিয়া ‘স’ উচ্চারণ করতে শিখিনি,; উনি বলে গেলেন , “আপনি ইচ্ছে করেই বলছেন না! বলুন ‘অসমিয়া!’”
ভাবছি আমার এই লেখা পড়বার পর আমার অসমিয়া কিম্বা বাঙালি বন্ধু, যারা ভাষার প্রশ্নে খুবই স্পর্শকাতর, জোর গলায় ধমকে দিয়ে বলবেন নাতো, ‘থামুন মশাই! চুপ করুন। একদম বাজে কথা বলবেন না! এক্কেবাৰে কথা নক’ব!” রবীন্দ্রনাথ যেভাবে অসমিয়া হৃদয় জয় করে নিলেন আমরা কি তার থেকে শিক্ষা নিয়ে পরস্পরের হৃদয় জয় করতে এক্কেবারেই অপারগ? অক্ষম?!
(লিখে শেষ ঃ ১৪-০৫-১০)
3 comments:
যদ্দুর মনে পড়েঃ
"তেলের শিশি ভাঙল বলে
*খুকুর* পরে"---
খোকার নয়।
ধন্যবাদ, আমিও তাই লিখে কেটে ফেলেছিলাম। আসলে এতো তাড়াহুড়তে লিখে একটা কাগজে পাঠাতে হলো যে আর বই খুলে দেখা হয় নি। তা ,আপনার নামোল্লেখ করলেন না কেন?
hi
Post a Comment