( ৩১ মার্চ, ২০১১ গুয়াহাটির কটন কলেজের বাংলা বিভাগে দেবার জন্যে তৈরি বক্তৃতা।লেখাটা আজ ২৪শে এপ্রিল, ১১এবং আগের রোব্বারে দৈনিক জনকণ্ঠে বেরুলো)
পূর্বোত্তরের বাংলা সাহিত্য নিয়ে আমার অধ্যয়ন বড় বিচ্ছিন্ন। এর কোনো ধারাবাহিকতা নেই, নেই কোনো মনোযোগ। কৈশোরের সাহিত্যের প্রতি ভালোবাসা আমাকে শেষটায় এনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে নানা সমাজতাত্বিক জিজ্ঞাসার সামনে। সেসব জিজ্ঞাসা আমাকে এতো ব্যস্ত করে রাখে যে সাহিত্যের অধ্যাপনাটা আমার পেশা হলেও নেশা হতে পারে নি, সাহিত্য কর্মতো নয়ই। সুতরাং সাহিত্যের তত্ব আর তথ্য নিয়ে আমার অজ্ঞতাকে আপনারা নিজগুণে ক্ষমা করে দেবেন। আমাকে এমন এক বিদ্বজ্জন সমাজে টেনে এনে যে সম্মান উদ্যোক্তারা দিলেন তার ভার বহন করবার যোগ্যতা আমার কতটুকু রয়েছে সেই নিয়েও আমার সন্দেহ বেশ গভীর।
সাহিত্য নিয়ে আমার সমাজতাত্বিক জিজ্ঞাসাগুলোও এমন বিধঘুটে যে যারা শুনেন তাঁরা বিশেষ উত্তর দিতে চান না। নতুবা ক্ষমা ঘেন্না করে দেন আর কি। সাহিত্যর বহু প্রচলিত প্রশ্ন যেগুলো ইউরোপীয় তাত্বিকেরা দশকওয়ারি হিসেবে উৎপাদন করেন, এবং আমাদের কলকাতার তাত্বিকেরা সেগুলো পরিস্রুত করে ভারতের বাজারে অথবা 'নাবাজারে' চালান দেন, সেগুলো আমার কিছু কিছু জানা আছে। কিন্তু এর কোনোটাই যে আমাদের পূর্বোত্তর ভারতের কবি-লিখিয়েদের মৌলিক সমস্যার কোনো সমাধান দিতে পেরেছে আমি দেখিনি। ব্যাপরটি আমাকে হতাশ করেছে বহুদিন। আমাদের লেখকেদের অনেক সময় পূর্বোত্তরের পশ্চাদপদতা তার জাতিগত ভেদবিভেদ নিয়ে বেশ চিন্তিত হাহাকার করতে দেখি। কিন্তু, সেই পশ্চাদপদতার জন্যে শিল্পকর্মের কোনো সমস্যা হচ্ছে এই সত্য মানতে বেশিরভাগ লেখক এক্কেবারেই নারাজ। তাঁদের কথা হচ্ছে ভালো লিখলে তার পাঠক আছে। সে লেখক হোন নগরের কিম্বা পর্বত অরণ্যের। এই ধারণা যে একেবারেই অসত্য তা হয়তো নয়, কেননা তাঁদের অনেকেরই স্বদেশ বা বিদেশে বা অন্যপ্রদেশে লেখা বেরোয়। কিন্তু, আমি যখন আমার ছাত্রদের ওদের কথা জিজ্ঞেস করি, ছাত্রেরা কিচ্ছুটি জানে না। আমি যখন আমার সহকর্মীদের তাঁদের কথা জিজ্ঞেস করি, দেখি তাঁরা জানেন না। যখন বন্ধুদের জিজ্ঞেস করি, দেখি তাঁরা জানেন না। প্রতিবেশি রাজ্যের রাজধানী যাকে লোকে বাংলা সাহিত্য সংস্কৃতির পীঠ বলে সেখানকার বন্ধুদের গিয়েও জিজ্ঞেস করি দেখি তাঁরা জানেন না। কেউ জানে না, কেউ চেনে না। হাত গুনা কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে। গেল দু'বছরে বাংলার প্রধান কেন্দ্রটি থেকে যারাই এই উপত্যকার নানা অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত হয়ে এসছেন, আমি খুব মনোযোগ দিয়ে দেখেছি এরা প্রায় প্রত্যেকে বলেছেন এখানকার লেখালেখি সম্পর্কে তাঁরা বিশেষ কিছু জানেন না। 'দেশে'র মতো কাগজ যার এই অঞ্চলে আছে এক বিশাল বাজার তার সম্পাদক শিলচরে গিয়ে অবাক হয়ে গেছেন এতো কাগজ এখানে বেরোয় দেখে, এতো লোকে এখানে লেখে দেখে। এই সংবাদগুলো আমরা সব্বাই এখানকার কাগজেই পড়েছি। মহাশ্বেতা দেবীর সাক্ষাৎকার নিতে গিয়ে প্রণাম করতে গেলে আমাদের শ্রদ্ধেয় মাষ্টার মশাই উষারঞ্জন যেভাবে প্রত্যাখাত হয়েছেন, সেই সংবাদ 'ব্যতিক্রমে' পড়ে আমি ব্যক্তিগতভাবে অপমানিত বোধ করে একা একা হজম করে চুপচাপ বসেছিলাম। কারণ মহাশ্বেতা মহান লেখিকা আর আমাদের মাষ্টার মশাই কেউ না কিচ্ছুটি না। এইতো সাধারণ্যে ধারণা ! আমার মনে আছে ইনি যখন অনুবাদ সাহিত্যে সাহিত্য একাদেমী পান তখন আমার জেলার বহু সহকর্মী বাংলার অধ্যাপকদের শুরুতে বিশ্বাসই করাতে পারিনি। ভাবখানা এই যে ছোঁড়া বলে কি! অসমের কোনো বাঙালি আবার সাহিত্য একাদেমী পায় বুঝি!
এই কথাগুলো যদি শিলচরে উচ্চারণ করতাম, আমি জানি এতোক্ষণে 'প্রতিষ্ঠান' বলে একটা শব্দ অনেকের মনে দানা বেঁধে খোঁচাখোঁচি করতে শুরু করত। গুয়াহাটিতে বোধহয় যতদূর জানি 'প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা'র লড়াইটা তত জোরালো নয়। যারা সেই লড়াইয়ের সৈনিক তাঁরা নিশ্চিত এই প্রশ্ন করতেন, এই সব প্রতিষ্ঠার প্রশ্ন নিয়ে আমার জিজ্ঞাসার পেছনে মোহটা কিসের? এমন প্রশ্নের উত্তর দিতেও রুচি হয় না। নিজের ভাষা সাহিত্যের প্রচার প্রসার চাইতে যাওয়াটা লজ্জাটা কোথায় সেকথাটাই আজো বুঝে উঠতে পারি নি।
পূর্বোত্তর ভারত, বাকি ভারত বা বাংলাদেশের বেশ কিছু ছোট কাগজ আর অত্যন্ত ভালো কিন্তু সাধারণ্যে স্বল্প পরিচিত লেখকেরা যে পরষ্পরকে চেনেন , সে আমাদের জানা আছে। আমাদের এও জানা আছে, ভালো লেখক আর ভালো লেখার বিচার করে কোনো কাগজের সম্পাদক কিম্বা প্রতিষ্ঠান নয়, কাল, মহাকাল। কিন্তু এহ বাহ্য!
একবার এক ছাত্রীর মুখে শুনেছিলাম, সে জীবনানন্দ দাসের উপর খুব তথ্যবহুল এক প্রবন্ধ পড়তে গিয়ে বলছে, “আমরা যারা বাংলাদেশে জন্মেছি...।” 'রূপসী বাংলা'র মতো মহৎ কবিতার কবিকে খুব বেশি করে পড়বার আর আমাদের কবিকে একেবারেই না পড়বার বিপদ হচ্ছে যে আমরা আমাদের ছাত্রদের এই বোধটুকুও দিতে পারছিনা যে সে বাংলাদেশে জন্মায় নি! দেখুন বিপদ। তার পর আর আমাদের অধ্যাপনা নেশা হয়ে দাঁড়ায় কী করে! আমাদের পাঠ্যক্রমেও যে এখানকার রচনাবলী এসে ঢুকবে তার জন্যে আগে মাস্টারমশাইদের সেইসব লেখককুলের কথা জানতে হবে তো।
আমাদের যারা প্রতিষ্ঠানের বিরোধিতা করবার মন্ত্রে সেই কৈশোরে দীক্ষা দিয়েছিলেন। তাঁরা যে কখনো এই বিপদের দিকটা নিয়ে বিশেষ ভেবেছেন, এমনটি দেখিনি । বস্তুত তাদের নিজেদের 'প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা'র তত্ব কতটা স্বদেশী ছিল আর কতটা বিদেশী, কতটা এই প্রদেশের আর কতটা তাদের কল্পিত জন্মভূমি 'বাংলাদেশের' এই প্রশ্নও আজ তোলাই যায়। তাদের চোখের সামনে প্রতিষ্ঠান মাথা উঁচুর থেকে উঁচু করে গেছে, আর নিজেরা তাঁরা একের পর এক মাথা নত করে করে পথ ছেড়ে ছেড়ে সরে গেছেন। হেরেছেন তবু যুদ্ধ ছাড়েন নি। কোনো বিকল্প প্রতিষ্ঠান দিয়ে যার বিরোধিতা করছিলেন তাকে প্রত্যহ্বান জানাতে পারেন নি। প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার কথা এলেই সাহিত্যের বামপন্থার কথা এসেই যায়। বিকল্প প্রতিষ্ঠান গড়া নিয়ে গোটা বিশ শতকে এই পূর্বোত্তর ভারতে প্রতিষ্ঠান বিরোধীদের সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে বিশেষ কোনো ধ্যান ধারণা ছিল না । 'সাহিত্যের' মতো কিছু ছোট ছোট ব্যতিক্রম রয়েছে। সেগুলোর সমস্ত অবদান স্বীকার করেও বলছি, সত্যিকার অর্থে প্রতিষ্ঠানের টিকিটি এরা কেউ নাড়াতে পারেন নি।
প্রতিষ্ঠান বিরোধীদের অনেকেই নিজেদের বামপন্থী পরিচয় নিয়ে গৌরব বোধ করেন। কিন্তু এদের এই অবস্থানের সঙ্গে পোস্টমডার্নদের অবস্থানের মূলগত কোনো বিরোধ নেই। পোস্টমডার্নরা যেমন বলেন ‘গ্র্যান্ডন্যারেটিভ’ আর সম্ভব নয়—এরা সেটি বলছিলেন অন্যভাষায় অন্য চিহ্ন প্রক্রিয়া ব্যবহার করে। যেমন ধরুন, ‘দেশ-আনন্দবাজারে’র বিকল্প এরা দাঁড় করাচ্ছিলেন ‘লিটিলম্যাগ।’ সে আরো মারাত্মক! লিটিলম্যাগ হতেই পারে। কিন্তু সে একে আন্দোলনের আদর্শ করে ফেলাটা বড় বিভ্রান্তিকর। পশ্চিমবাংলাতে যে ঢাউস আকারের তিনচারশ টাকার লিটিল ম্যাগাজিনগুলোতে বহু পড়াশোনা করা বিদ্বজ্জনেরা লেখেন তেমন কাগজ করার সাহস করা শিলচর-গুয়াহাটি-আগরতলাতে বেশ বিপদ আছে। আর কিনে পড়তে গেলেও যে বেকার ছেলেটি ট্যুশন পড়িয়ে মাসের শেষে শ’তিনেক টাকা রোজগার করে তার বুকে লাগবে; আর খোঁজে পেতে গেলেও তাকে বেশ পড়াশোনা করা ছেলে হতে হবে। তার জন্যে সে শুধু পাকা মাইনের চাকরি পাবার স্বপ্ন দেখে দিন গুনতে পারে। কিন্তু চাইলেই পান কিনতে গিয়ে একটা ‘দেশ’ পত্রিকা কিনে বাড়ি চলে যেতে পারে। এইখানেই লিটিল মেগাজিনের ব্যর্থতা। এর আছে গোষ্ঠী চরিত্র, কোনো গণ চরিত্র আদৌ নেই। যদিও অনেকে লিটিম্যাগের সাহিত্যকেই বলেন জনতার সাহিত্য।
আমাদের ছেলেবেলা 'দেশ আনন্দবাজারে’র বিরুদ্ধে বাম সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে আকছার গালিগালাজ শুনেছি। আজকাল ব্রহ্মপুত্র উপত্যকাতেও আনন্দবাজার-আজকালের ব্যবসা তেমন চলে বলে মনে হয় না, বরাক উপত্যকাতেতো একেবারেই না। আজকাল গোটা অসমে বাংলা ছোটকাগজের সংখ্যা ৭৭টিরও বেশি। তথ্যটি আমি দিচ্ছি প্রবন্ধের কাগজ ‘নাইন্থ কলাম’ থেকে। পূর্বোত্তরে সংখ্যাটি ১১৮ বা তারো বেশি। এগুলো আনন্দবাজারকে ঠেলে বের করতে পারেনি। করেছে যে দশ বারোটি রঙিন চকচকে বাংলা কাগজ বেরোয় গুয়াহাটি, ডিব্রুগড়, শিলচর, করিমগঞ্জ, ধর্মনগর, আগরতলা এবং শিলং শহর থেকে—তারা । এবং সম্ভবতঃ গেল দু’বছরে গুয়াহাটি শহর থেকে ‘ব্যতিক্রম’ বা ‘অন্যদেশ’ নামের কাগজগুলো যে দুর্দণ্ড প্রতাপে আমাদের ভাবনাগুলোকে ভাষা দিতে শুরু করেছে তাতে শীঘ্রই ‘দেশ-নবকল্লোলে’র মতো কাগজগুলোও এখান থেকে হয় পাততাড়ি গোটাতে শুরু করবে, নতুবা দৈনিক সকলাবেলার মতো এক পূর্বোত্তরীয় সংস্করণ বের করে টিকে থাকতে হবে। 'ব্যতিক্রম' এখানকার এক বড় প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানও বটে। তেমনি নাম নিতে পারি ত্রিপুরার অক্ষর প্রকাশনীর। এই এরা সাহিত্যের জন্যে যে পরিবেশ তৈরি করে দিচ্ছেন, তাতেই লিটিলম্যাগগুলোও বাড়ছে এতো দ্রুত লয়ে। নইলে 'নগর কলকাতা'র 'বাম'পন্থার রপ্তানী করা 'প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা 'র তত্ব এতোদিন আমাদের পথে বসিয়ে রেখেছিল। একেও তাই আমার মনে হয় আরো এক 'প্রতিষ্ঠান' যার ক্ষয় অবধারিত । আগর তলা থেকে প্রকাশিত 'কাগজের নৌকো'তে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে কবি বন্ধু অমিতাভ দেব চৌধুরী গেলবছরে লিখছিলেন, “...আজকের সমাজে অনেকে নিজের প্রতিবাদী কিম্বা দায়বদ্ধ চরিত্র অটুট রাখার জন্যেই মুখিয়ে থাকেন। দায়বদ্ধতা কিম্বা প্রতিবাদও, এখানে এসে পণ্য হয়ে উঠে। হ্যাঁ, অবশ্যই ব্যক্তির ভাবমূর্তীর চাপে।” এই কথাতে আমরা আবার পরে আসছি।
এই যে স্থান-কাল পাল্টালে শব্দগুলোর মানের বদল ঘটে যাচ্ছে, বা কিছু মানেকে সচেতনভাবে রক্ষা করা কিম্বা অন্তর্ঘাত করবার প্রয়াস হচ্ছে একে নাম দিতে পারি 'চিহ্নায়ন' প্রক্রিয়া। কথাগুলো বললেই 'আধুনিকোত্তরবাদে'র কথা মনে পড়ে যায়। । আমরা যে এক ক্রম সম্প্রসারণমান আবিচ্ছিন্ন অথচ বিশৃঙ্খল বিশ্বে বাস করি--এ নিয়ে কোনো সংশয় থাকা উচিৎ নয়, একে শুধু বোঝার চেষ্টা করা যেতে পারে। ব্যাপারটা এখন ইন্টারনেটের যুগে অনেক প্রত্যক্ষ। তাই ফরাসী বা বিলেতিরা আধুনিকোত্তরবাদের জন্ম দিয়েছে আর বলছে এখন আর কোনো 'মহা আখ্যান' গড়ে তোলা সম্ভব নয়।আমাদের আগেকার 'প্রতিষ্ঠান বিরোধী'রা তাতে চোখে চড়ক গাছ দেখছেন আর সউৎসাহে সে দলে যোগ দিয়েছেন বা দিচ্ছেন।
কিন্তু, আমার নিজের প্রায়ই সগৌরবে মনে হয়, আমরাতো এখনো 'রামায়ণে'র যুগে বাস করি। রবীন্দ্রনাথ আমাদের 'মহাআখ্যান'--কবে ফুরোবেন কেউ জানি না। দেরিদা-ফুকো--লাকারা ফুরিয়ে যাবেন। আমরা সাহিত্যের ইতিহাস পড়ি। কিন্তু, যদি শুধু 'রামায়ণে'র কিম্বা 'কোরানে'র কিম্বা তথাকথিত মধ্যযুগের 'চন্ডীমঙ্গলে'র ইতিহাস ভালো করে পড়তে পারতাম --কী করে সেগুলো রূপান্তরিত, পুনঃসৃজিত হচ্ছে, কারা পড়ছেন, দেখছেন শুনছেন এবং কোথায় কোন কোন ভাষাতে--তবে চিহ্ন বিজ্ঞানের জনক আমরা হতে পারতাম। হইনি, তার কারণ 'বিলেত' বলে যে প্রতিষ্ঠানটি রয়েছে সে আবার 'নগর কলকাতা'র ঘাড়টিকে জন্ম থেকেই বাঁকা করে রেখে দিয়েছে। আর নগর কলকাতা আমাদের দিয়েছে অনেক বটে, কিন্তু দিয়ে দিয়ে ভিখিরি আর ছিন্নমূল করে ছেড়েছে । বিলেতি ভাষাতে কোট না করলে আমাদের পান্ডিত্য সিদ্ধ হয় না।
আধুনিকোত্তরবাদিরা অনিশ্চয়তাবাদের কথা বলেন, বলেন বিশৃঙ্খলার কথা। তারা এন্ট্রপির কথা পড়েছেন। আমরাও পড়েছি। কিন্তু জলের তাপ শূন্য ডিগ্রীতে নামিয়ে আনলে যে সে বরফ হয়ে যায় এবং সেই বরফে বিলেতেরও উত্তরের মহাদেশের কেউ কেউ ঘর বানিয়েও বসত করেন--সে তথ্যও দিব্বি চেপে গেছেন। শৃঙ্খলা বিশৃঙ্খল বিশ্বের একটি অন্তর্লীন সত্য। আর তাই কেবল প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা কিম্বা 'মহাআখ্যানে'র বিরোধিতা কোনো সম্পূর্ণ তত্বই নয়। 'বিকল্প প্রতিষ্ঠান' একটি চিরন্তন এবং ঐতিহাসিক সম্ভাবনা । ইতিহাসের প্রতিটি মোড়ে তার সম্ভাবনা ছিল, আছে এবং থাকবে।
আর বিকল্প প্রতিষ্ঠানের কথা বললেই আমাদের পূর্বোত্তর ভারতের স্বতন্ত্র অস্তিত্বের কথা পাড়তেই হয়। কেন? সেরকম প্রশ্নের উত্তরে গেল এক দশকে বহু জায়গাতে বহু কথা লেখা হয়ে গেছে। যেমন সম্প্রতি প্রকাশিত 'নাইন্থ কলামে'র 'অসমের বাংলা কবিতা' সংকলনের মুখবন্ধে সম্পাদকেরা লিখছেন, “ বাংলার 'সাংস্কৃতিক উত্তাপকেন্দ্র' থেকে দূরবর্তী এই অঞ্চলে কাব্যচর্চার ভুবন পল্লবিত হয়েছে নিজস্ব ধারায়। গড়ে উঠেছে বাংলা কাব্যের ভিন্ন এক প্রেক্ষিত। এই কাব্যধারা নিজস্ব চরিত্র ও বৈশিষ্ট্যে স্বতন্ত্র” তাই আমাদের বন্ধু অভিজিৎ চক্রবর্তীতো তাঁর সম্পাদিত কাগজের নামই দিয়ে রেখেছেন, “কবিতার পূর্বোত্তর”। বর্তমান লেখক, সেখানেও চিঠির আকারে আর অন্যত্র নিবন্ধের আকারে এই নিয়ে আগেও লেখা লেখি করেছি। আমাদের সেই সন্মিলিত প্রয়াসকে অমিতাভ ভাষা দিয়েছেন এভাবে। 'কাগজের নৌকো'তে সেই পূর্বোক্ত সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, “...একটা বয়স পর্যন্ত আমি কলকাতার ছিলাম, আমার সমস্ত ভাব-পৃথিবী কলকাতা-কেন্দ্রিক ছিল। তারপর একটা সময় এল জীবনে যখন বুঝতে পারলাম, আমি ঠিক কলকাতার নয় বা আমার থাকা-না থাকার ওপর কলকাতা কিছুই যায় আসে না। ততদিনে ত্রিপুরার শ্যামল ভট্টাচার্য, পল্লব ভট্টাচার্য ও প্রবুব্ধ সুন্দর কর, ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার সঞ্জয় চক্রবর্তী ও অভিজিৎ চক্রবর্তী, শিলচর থেকে তিনসুকিয়ায় নতুন তাঁবু গেঁড়ে বসা সুশান্ত কর সবাই উত্তরপূর্বাঞ্চলীয় সাহিত্য নামক এক ধারণাকে হাতের কড়ির শেষদান হিসেবে আঁকড়ে ধরেছে। আমার ধারণা তাদের সঙ্গে মিলে গেল। আমরা একটা জায়গায় এক হয়ে গেলাম। এর আগে দেবাশিষ তরফদার—যাঁর বেড়ে উঠা কেবল মাত্র বরাক উপত্যকা কেন্দ্রিক ছিল না, -অস্পষ্টভাবে হলেও, এই উত্তরপূর্বাঞ্চলীয় সাহিত্যের দিকে এক অঙ্গুলি নির্দেশ করেছিলেন। আমাদের বাস্তবতা যে বাঙালির অপরাপর ভুবনগুলির থেকে আলাদা,...এই কথাটা সম্ভবত দেবাশিস তরফদারই প্রথম পয়েণ্ট আউট করেছিলেন। পরে দেখা গেল এই বিষয়টি নিয়ে আমরা অনেকেই বিভিন্ন জায়গায় থেকেও, একই রকম ভাবছি।” 'অসীমান্তিক' গল্পের সংকলন যারা পড়েছেন তাঁরা জানেন ওখানে হাসান আজিজুল হকের উচ্চারণ আরো তীক্ষ্ণ আর ধারালো, “বলতে পারি, আবেগে আক্ষেপে সংক্ষেপে আর্তনাদ করে জানাতে পারি, কোনো বিভাজন মেনে নেয়া হবে না, কোনো বিভাজনই প্রকৃত নয়। কিন্তু সত্য হলো বিভাজন ঘটে গেছে। … সংস্কৃতি ও সাহিত্যের ক্ষেত্রে ভৌগোলিক বিভাজন কার্যকর নয় একথা ভাবালুতা-আশ্রয়ী খানিকটা সত্য হলেও শেষ পর্যন্ত কিন্তু সত্য নয়। অভ্যাস মাফিক আবেগ মাখা ঐক্যের কথা বলা হয়, সঙ্গে সঙ্গে আবার ধরাছোঁয়া বাঁচিয়ে পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্যের স্বতন্ত্র ইতিহাস সুরচিত হচ্ছে দেখতে পাচ্ছি। ১৯৪৭ সালে পৌঁছেই নিজের নিজের ঘর দেখা দিচ্ছে, আলাদা হয়ে যাচ্ছে হেঁসেল। বাংলাদেশ ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যের ধারাবাহিকতা মেনে নেয়া হয় তারপর থেকে তার নিজের ইতিহাস শুরু করে। উত্তরপূর্ব ভারতের বাংলাভাষা চর্চা বা সাহিত্য-ফসল আলাদা করে চোখে পড়েনি, যেন তার অস্তিত্বই নেই, যা বা যেটুকু আছে তা বুঝি পশ্চিম বঙ্গের সাহিত্যের সঙ্গে মিশে গেছে। পরিতাপ করি আর ক্ষোভ জানাই পরিস্থিতি কিন্তু এই রকম।”
আজ সে পরিস্থিতি পাল্টাতে শুরু করেছে? কী রকম? পশ্চিম বাংলা কি আমাদের স্বীকার করে নিতে শুরু করেছে? না, বাংলাদেশ? এরকম প্রশ্ন কেউ করে ফেললে বুঝব, আমার বক্তব্যের কোনোটাই আমি তুলে ধরতে পারিনি। হ্যাঁ, ওখানকার দুএকটা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের সাহিত্য পাঠ্যক্রমে ঢুকেছে। কিন্তু তাতে সার্বিক হালচাল কিছু পাল্টায় নি পাল্টাবেও না। পাল্টেছে, আমাদের এখানে, এই মাটিতে। দৈনিক কাগজগুলোর কথাতো আগেই বললাম। এবার তাকান টিভির দিকে। নব্বুইয়ের দশকের প্রথম বছরগুলোতে বিশ্বায়নের সঙ্গে সঙ্গে যখন উপগ্রহ চ্যানেলগুলো এসছিল স্টার টিভি, এম টিভি দিয়ে ওরা যাত্রা শুরু করেছিল। পন্ডিতেরা বলছিলেন এসব বিশ্বায়নের উপরিকাঠামো গঠনের ষঢ়যন্ত্র। পশ্চিমের সংস্কৃতি আমাদের দেশজ সংস্কৃতির বারোটা বাজিয়ে ছেড়ে দেবে। হয়তো, খানিকটা তাতে সত্য ছিল। কিন্তু, ঘটনা কী চেহারায় এগুলো? সেই আদ্যিকালের ইংরেজি চ্যানেলগুলো প্রান্তে চলে গেল। আমরা ব্রহ্মপুত্র উপত্যকাতে বসেও একসময় কলকাতার বাংলা চ্যানেলগুলো দেখতে পেলাম। এভাবে বাংলার মূলস্রোতের সঙ্গে আমরা পরিচিত হলাম। যে অসমে এক সময় ভাষার জন্যে প্রাণ দিতে হয়েছে, সেখানে কিছু চ্যানেল বাংলা এবং বডোতো বটেই সাদ্রি, ডিমাসার মতো ছোট ছোট এবং কোত্থাও মর্যাদা না পাওয়া ভাষাগুলোতে চব্বিশঘন্টা ধরে সংবাদ অনুষ্ঠানাদি প্রচার শুরু করল। এমন ঘটনা নগর কলকাতাতেও কেউ কল্পনাই করতে পারে না। ছোট ছোট শহরে গড়ে উঠা চ্যানেল এখন নগর কলকাতা যাদের ভুলে গেছিল--সেই অসমের বাঙালিদের আত্মপ্রকাশের এক একটা মঞ্চ দিয়ে দিল। স্রষ্টা আর ভোক্তার তফাৎ এতোটাই ঘুচে গেল যে আমাদের শহরগুলো থেকে গোটা ভারতে দেখা গেল আত্মবিশ্বাসে ভরপুর দেবজিৎ, অভিজ্ঞান, অমিত, সপ্তপর্ণাদেরও মুখ। হয়তো, সুমন নচিকেতা, লোপামূদ্রাদের সামনে এরা এখনো ধূমকেতু, কিন্তু এইতো সবে শুরু। এই চেনেলগুলো সাহিত্যের তেমন উপকার প্রত্যক্ষভাবে করেনি বটে, কিন্তু ভাষার ব্যবহারের মধ্যি দিয়ে এগুলো যে আমাদের মেধাগুলোর আত্মবিশ্বাস বাড়াবার একটা ক্ষেত্র তৈরি করে দিচ্ছে সেটিকে অস্বীকার করা যাবে কী করে? তিনসুকিয়ার মতো শহরে বাংলা কাগজ , বই উন্মোচিত হচ্ছে টিভি স্টুডিওতে বসে এমন সরাসরি অভিজ্ঞতা আমাদের রয়েছে।
জ্ঞান অর্জনের পথে শ্রব্য-দৃশ্যমাধ্যমগুলোর ভূমিকাকে আমরা কোনো স্বীকৃতি দিতে এখনো কুন্ঠিত। অথচ এরাই আমাদের মতো প্রান্তিক অবস্থানে আর ভাষিক আধিপত্যের চাপের তলাতে থাকা মানুষগুলোর জন্যে পথের নতুন দিগন্ত খুলে দিচ্ছে সে কথা যেন আমরা বুঝেও বুঝে উঠতে চাইনা। বই সম্পর্কে এক জনপ্রিয় কথাকে সংস্কারের মতো গড়ে উঠতে দেয়া হয়েছে, বইয়ের মতো বন্ধু বুঝি আর নেই। খুব ভালো কথা। কিন্তু সেই বন্ধুটিকে কাছে পেতে যে আমাদের কতটা ঘানি ঠেলতে হয় সে নিয়ে কিন্তু মনে মনে আমরা সবাই জানি। আমরা কি জানি, যে এই ভারতে কলকাতাতে যেখানে প্রথম ছাপা বই বেরুচ্ছিল সেখানে বইকেও একটা সময় লোকে খুব ভালো চোখে নেয় নি? মনে করা হচ্ছিল এবারে আর জাত ধর্ম বলে কিছু থাকবে না। এমনও হয়েছিল,যে কেউ কেউ বই ছেপে আত্মরক্ষার জন্যে এই মিথ্যেটা প্রচ্ছদে লিখেও দিচ্ছেন যে, এই গ্রন্থের কালি গঙ্গাজলে শোধন করা হইয়াছে। তারপর থেকে আমাদের সন্মিলিত ধারণা প্রায় এরকম যে জ্ঞান মাত্রেই থাকে বইএর দুই মলাটের ভেতরে সংগঠিত -সুসংবদ্ধ। যত পড়া যায়, তত জানা যায়। শুনেও যে জ্ঞান বাড়াবার একটা প্রাক-ছাপাখানা প্রাচীন রামায়ণী ঐতিহ্য আমাদের ছিল সেই তথ্য আমরা এক্কেবারেই ভুলে গেলাম। যদিও মাস্টার মশাইদের কথা শোনা আর সেই সঙ্গে বেতের বাড়ির ঐতিহ্য আমাদের এখনো আছে বহাল তবিয়তে। তাছাড়া শুনে-দেখে-পড়ে আমাদের জ্ঞান বাড়ে আর কৈ। আমরা তো সংগৃহীত করি কিছু বিশৃঙ্খল তথ্য মাত্র। সেগুলো শৃঙ্খলিত জ্ঞানে পরিণত হয় শুধু আমাদের কাজের প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে। যার যত বড় কাজ তাঁর তত বড় জ্ঞান।
সেই বিশৃঙ্খল তথ্য বিশ্বের এক আধুনিকতম আধার হচ্ছে ইন্টারনেট। টিভির থেকেও বড়। তাকে নইলে টিভিরও চলে না। যাদবপুরের মতো প্রযুক্তিবিদ্যার কেন্দ্রে গিয়েও দেখেছি ওখানকার অধ্যাপকেরা কম্পিউটারে বাংলা লেখেন শুধু পাওয়ার পয়েন্টে স্লাইডশো দেখাতে। আমাদের অধ্যাপকেরা অতি অল্পই এখনো এর বেশি এগুতে পেরেছেন। আমারা এখনো ইংরেজি হরফে বাংলা লিখতে বেশ স্বচ্ছন্দ বোধ করি। যখন কিনা যুগ এতোটাই এগিয়ে গেছে যে আপনি করতে পারেন ঠিক উলটো। বাংলা হরফে ইংরেজি লিখে দূর দেশের বন্ধুকে মুহূর্তের পাঠাতে পারেন বার্তা। উত্তরভারতের হিন্দিভাষিরাও কেউ আজকাল ইংরেজি হরফে হিন্দি লেখেন কিনা আমার সন্দেহ আছে। এতো ভুরি ভুরি হিন্দি সাইট আর ব্যক্তিগত ব্লগ রয়েছে যে সে এক সমূদ্র। কিন্তু বাংলাভাষাতে বাংলাদেশ ভারত থেকে এগিয়ে গেছে বহু বহু দূর। সেদেশে এখন দ্বিতীয় এক ভাষা আন্দোলন চলছে দ্রুত গতিতে। আর তার নেতা হচ্ছেন তরুণ মেহেদি হাসান খান।
কম্পিউটার বুঝি ইংরেজি ছাড়া কিছু বোঝে না, এই এক ঔপনিবেশিক বোধ হলো অন্যতম কারণ যে গেল দুই দশকে ইংরেজি মাধ্যমের স্কুলে গোটা দেশ ছেয়ে গেছে। পন্ডিতেরা আশংকা করছেন আরো দশক দুই পর বাংলা সহ ভারতীয় ভাষাগুলোর অস্তিত্ব থাকবে কি না। এই যে আতঙ্কের পরিবেশটা তৈরি হয়েছে এর কারণ কিন্তু কম্পিউটার নয়, আপনারা মানুন বা নাই মানুন কালি-কাগজ , ছাপা বই এবং সেগুলোর থেকে উদ্গত রাজনীতি ভাষারাজনীতি । ছাপা বইয়ের আগে, উপভাষা মান্যভাষার তর্কটাও ছিল না। বইএর দরকারে ঐ তর্কটা সামনে এলো, উপভাষাগুলো চলে গেল প্রান্তে। কিন্তু সেই তর্কটা ওখানে থেমে গেলনা কিন্তু, এলো জাতীয় ভাষা রাষ্ট্র ভাষা রাজ্যভাষার তর্ক। এর মধ্যে ব্যয়সংকোচ, সুগমপ্রবেশের যুক্তিগুলো ছিল। কিন্তু আগেকার দিনে যেমন সংস্কৃত ছাড়া সাহিত্য চর্চা হবে না, বামুন ছাড়া কেউ পড়বে না, এমন যুক্তি ছিল, আধিপত্যের সেই রাজনীতিই কিন্তু ভাষা পেয়ে গেল ঐ মান্যভাষা-জাতীয়ভাষার তর্কে। বাকি ভাষাগুলো চলে গেল প্রান্তে, বিলীন হবে নাতো কি মুক্ত আকাশে সুনীল হবে? ইন্টারনেট সেই প্রান্তের ভাষাগুলোকে আবার নিয়ে আসছে চিহ্নপ্রক্রিয়ার কেন্দ্রে। সামনের সারিতে। বন্দী ভাষাকে করছে মুক্ত। অভ্রের স্লোগানই হচ্ছে 'ভাষা হোক উন্মুক্ত!' অচিরেই ভাষা রাজনীতির চেহারাটাকে ইন্টারনেট আর কম্পিউটার দেবে পালটে।
২০০৯ সনে অক্টোবরে ইণ্টারনেট কোরপোরেশন ফর এসাইন্ড নেমস এন্ড নাম্বারস ( আই সি এ এন এন) বলে একটি প্রতিষ্ঠান, যাদের সদর দপ্তর সিওলে--তারা ইন্টারনেটের চল্লিশ বছরের ইতিহাসে এক যুগান্তরকারী ঘটনা ঘটিয়েছেন। এতে তারা আশা করছেন, ইন্টারনেটের সত্যিকার আন্তর্জাতিকীকরণ ঘটবে। তাঁরা লাতিন কোডিং ব্যবস্থাকেই পালটে দেবার কাজ সম্পূর্ণ করেছেন। 'ইংরেজিতে শুধু বিশ্বময় ছড়ানো যাবে'---এতোদিনকার এই লালিত বিশ্বাসকেই তাঁরা ধ্বসিয়ে দিয়েছেন। কোনো রাষ্ট্র চাইলেই তারা সে ব্যবস্থাটি সে দেশকে দিচ্ছেন। ভারত সরকার ইতিমধ্যে সে আবেদন করেছেন এবং পূর্ণদ্যোমে কাজও শুরু করে দিয়েছেন। ইন্টারনেটের সমস্ত বিষয়কে ভারতীয় ভাষাগুলোতে অনুবাদের ব্যবস্থা করবার কাজ এগুচ্ছে। ছোট ছোট কিছু ভাষাতে তা সম্পূর্ণও হয়ে গেছে। তার সমান্তরালে আরো বেশ কিছু কাজ এগুচ্ছে। লিনাক্সের ভারতীয় ভাষাগুলোর সংস্করণ বহুদিন হলো বেরিয়ে গেছে।'ফায়ারফক্স' ব্রাউজারেরও তাই। গোগল অনেক ভারতীয় ভাষা লেখা পড়ার সফটওয়ার ছেড়েছে বহুদিন হলো। এগুলো যে কেউ পেতে এবং ব্যবহার করতে পারেন বিনামূল্যে। ইংরেজিতে আর ব্যবসা এগুবে না জেনে মাইক্রোসফট সেভেন এবং উইন্ডো সেভেনও এখন বাঙালি -অসমিয়া হয়ে গেছে। এগুলো যখন হচ্ছিল না বা হয় নি তখনই অনেকগুলো ইউনিকোড ব্যবস্থা এসে গেছিল ভারতীয় ভাষাগুলো লেখা পড়ার জন্যে। একা 'বারাহা'দিয়ে আপনি ভারতের যে কোনো ভাষা লিখতে ও পড়তে পারেন। কিন্তু বাংলা, অসমিয়া, মণিপুরি লিখবার জন্যে অভ্র তার থেকেও আকর্ষণীয়। ব্যবহার বান্ধব এই সফটওয়ার নির্মাতা মেহেদি হাসান খান এক বাংলাদেশী তরুণ। শুধু ভাষার জন্যে কম্পিউটার ব্যবহার করবার স্বার্থে বাংলাদেশের সফটওয়ার প্রযুক্তি যে কী দ্রুত হারে বাড়ছে-- না দেখলে বিশ্বাস করা যাবে না। লিনাক্সের বাঙালি পরামর্শদাতারা প্রায় সব্বাই বাংলাদেশের লোক। কম্প্যুটারকে তারা বাঙালি করে ছেড়েছেনতো বটেই--তাদের সুবাদে বিশ্বময় ছড়িয়ে যাবার স্বাধীনতা পেয়ে গেছে অসমিয়া, মণিপুরি, বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি, হাজং, চাকমাদের মাতৃভাষা। রাজবংশীর মতো ভাষাকে বাংলা কিম্বা অসমিয়া বলে আটকে রাখবার দিন ফুরোলো বলে।
কী হয়, সেই ভাষা দিয়ে? যাদের আমাদের সৃজনী চিন্তার ভাষা বাংলা কিন্তু কম্প্যুটারে সেটির ব্যবহার জানা নেই, তাদের ধারণা মেইল করা , ইংরেজি হরফে চ্যাট করা, অরকুটে, ফেসবুকে বন্ধু বাড়ানো ছাড়া আর কিছু ওয়েব সাইট খোঁজে বেড়ানোই এর কাজ। আসলে কম্প্যুটার তথা ইন্টারনেট এখন আপনার সিনেমা-থিয়েটার হল, সঙ্গীত মঞ্চ, রেডিও, লেখার ঘর, পড়ার ঘর, লাইব্রেরী, বইয়ের দোকান, বাজার , স্কুল, বিশ্ববিদ্যালয়। আপনি যদি ব্লগ লিখতে পারেন তবে সেখানে আপনি লেখক সম্পাদক প্রশাসক সবটাই।
আপনার এই আক্ষেপ করবার কোনো দরকারই নেই যে আমরা এই পূর্বোত্তরের মানুষেরতো আর এতো সাধ্যি নেই যে আমরা আরেকটা কলেজস্ট্রীট গড়ে তুলব। কলেজ স্ট্রীট এতো দ্রুত আপনাকে ঢাকা কিম্বা টোকিওর পাঠকের কাছে পৌঁছে দিতে পারে না, যতটা পারে ইন্টারনেট। ফলে যে নগর কলকাতা এতোদিন শুধু লিখত বাকি বাংলা পড়ত, নগর কলকাতা গাইত বাকি বৃহত্তর বাংলা শুনত, নগর কলকাতা অভিনয় করত বাকি বাংলা তা দেখতো--বৌদ্ধিক আধিপত্যের এই সমীকরণ যাচ্ছে উলটে। হাজার পৃষ্ঠার চারশ টাকার লিটিল ম্যাগ শুধু বুদ্ধিজীবিদের জন্যে প্রকাশ করেও যারা প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার বড়াই করেন বা করতেন তাদের দিকে চোখটি না ফেলে গট গট করে বিশ্বজয়ের পতাকা উড়িয়ে দিচ্ছে 'উড়ালপুল', 'খোয়াব', 'সৃষ্টি', 'কৌরব', 'গুরুচন্ডালী', 'ইচ্ছামতি', 'কঁচিকাচা', 'কর্ণিকা', 'দ্রোহ', 'অলসদুপুর' 'বাঙালনামা'র মতো ওয়েব কাগজগুলো। আপনি বিনে পয়সায় পড়তে পারেন। শুনতেও পারেন, কেননা অনেকেই সেখানে সঙ্গীত বক্তৃতাও তুলে দিচ্ছেন, নিজেদের লেখালেখির সঙ্গে। এই ভাবেই পুরোনো সেই পটের কথা আর ওঝাপালার ঐতিহ্যকে নিয়ে এসছেন ফিরিয়ে। কফি হাউসের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই বটে, থাকবে কী করে? সেতো এখন ওয়েব ম্যাগাজিন হয়ে গেছে। রোজ লেখা বেরুচ্ছে। রোজ পড়া হচ্ছে--সেই আড্ডায় যোগ দিচ্ছে তিনসুকিয়া থেকে তিউনেশিয়ার বাঙালি। পশ্চিমবাংলাথেকে নিয়ন্ত্রিত হয় তেমনি আরেক আড্ডার নাম 'লোটা কম্বল'; বাংলাদেশে আছে 'সচলয়াতন', সামহোয়ার ইন, মুক্তমনা, প্রথম আলো, চতুর্মাত্রিক, আমার ব্লগ। 'আমার ব্লগে' আপনার লেখা পছন্দ না হলে 'বাঙাল ভাষা'তে পাঠক আপনাকে গালিও দিতে পারে। আর 'মুক্তমনা' পড়লে তসলিমা নাসরিণকে নিয়ে আনন্দবাজারীয় নাটকটা আপনার কাছে স্পষ্ট হয়ে যাবে। সে নাটকের দিন ফুরোলো। সবই এখন 'মুক্তমনা'। কোনো কিছু আর গোপন নেই। বেড়া নেই কোনো।
রবীন্দ্রনাথের দেড়শত বছরের সবচাইতে সেরা অর্জন যদি আমাদের কিছু থেকে থাকে তবে এই যে তাঁর লেখার প্রায় সবটাই এখন মেলে ইন্টারনেটে। এতো ঢাউস রচনাবলী আপনি কিনবেন কী করে, রাখবেন কই, সেনিয়ে সামান্যও মাথাব্যথা না ঘটিয়ে আপনি খোঁজে নিন ইণ্টারনেটে। যেখানে থাকুন যেভাবে থাকুন , নেট আছে তো রবীন্দ্রনাথ আপনার সঙ্গে আছেন।
ব্লগ লিখতে যদি আপনার আগ্রহ জন্মায়, অথচ না জানেন কী করে কী করতে হয়--আপনাকে পরামর্শ দেবার জন্যে রয়েছে 'বাংলাহ্যাক্স', 'টেকটনিক্স', 'আমার প্রযুক্তি ' এমন আরো অনেক। বাংলা লিখতে আপনি কি বানান ভুল করেন? দেখে নেবার জন্যে সংসদের অভিধান সহ আছে প্রচুর একভাষিক দ্বিভাষিক অভিধান।
এই বিশাল যজ্ঞশালাতে অসম তথা পূর্বোত্তরের জায়গাটা কোথায়? সত্য বলতে প্রায় শূণ্য। আমাদের বরাক উপত্যকার বন্ধুরা ভাষা নিয়ে খুব আবেগিক। কিন্তু আমার হাসি পায় যখন দেখি, ওরা সেই আবেগের কান্নাকাটিটা করেন ইংরেজি হরফে। যে দুএকটা ইংরেজি সাইট আছে শিলচর শহরের সেগুলোতে আপনি প্রেমিক প্রেমিকার সন্ধান পেয়ে যেতে পারেন, প্রেমের বাংলা কবিতার সন্ধান পাবেন না। অথচ, ওখানে বাংলা লেখার জন্যে কেউ আপনাকে জেলেও পুরবে না, আঙুল মটকাবে না, কলম কেড়ে নেবার ভয়টাও এক্কেবারেই নেই। কী মজা দেখুন, ফেসবুক যখন বিখ্যাত হয়ে গেল মিশরের বিপ্লবের অনুঘটকের কাজ করে , আমাদের শিলচরে তখন সে কুখ্যাত হয়ে গেল এক প্রেমিকের প্রেমিকা হত্যার প্রয়াসের জন্যে! আমাদের মেজাজ আর মানসিকতাটাকে চিনে নেয়া্টা তাই জরুরি।
পূর্বোত্তর ভারতে প্রথম ইউনিকোড সম্পদ অসমিয়া ভাষার 'অভিধান' 'শব্দ' । ২০০৬ সনে আবুধাবীতে কর্মরত প্রবাসী অভিযন্তা বিক্রম মজিন্দার বরুয়া তাঁর আরো দুই বন্ধুকে নিয়ে সেটি শুরু করেন। পরে সেটি পূর্বত্তরের প্রায় সব ভাষার অভিধানে পরিণত হয়। গেল বছর থেকে এতে বাংলা, হিন্দি, নেপালিও ঢুকে গেছে। পূর্বোত্তরের ভাষাগুলোর এক তুলনামূলক অধ্যয়নের দুর্দান্ত আকরে পরিণত হচ্ছে এই অভিধানটি। ইতিমধ্যে তাতে ৩৫০০০ এর বেশি অসমিয়া শব্দ এসে গেছে। বিক্রমেরা বিহু ডট ইন বলে একটা সন্মিলিত ব্লগও চালাতেন। কিন্তু তাতে তাঁরা লিখতেন খুব কম, লিখলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে লিখতেন ইংরেজিতে।
গেল বছর জানুয়ারীতে ফ্রেন্ডস অব আসাম এন্ড সেভেন সিসটার্স সংক্ষেপে 'ফাস' আয়োজিত প্রবাসী পূর্বত্তরীয়দের সম্মেলন 'নেইমস ২০১০'র পাশাপাশি 'শব্দে'র এক সভা বসে গুয়াহাটিতে। সেখানে আলাপ শুরু হয়েছিল 'শব্দে' সক্রিয় কর্মী বাড়াবার সমস্যা নিয়ে। সেখানেই ঠিক হয়, বন্ধুদের নিজেদের মাতৃভাষাতে ব্লগ লিখতে উৎসাহিত করতে পারলেই একটা অভিধানের দরকার বাড়বে। বাড়বে স্বেচ্ছাসেবী কর্মী। তার পর দীর্ঘ ছ'মাস নেদারল্যন্ড প্রবাসী অসমীয়া লেখক সমাজকর্মী ওয়াহিদ সালেহ, এবছর যিনি প্রবাসী ভারতীয় সম্মানে ভূষিত হলেন , তাঁর নেতৃত্বে এক জিমেলগ্রুপে আলোচনা চলে কী করে অসমিয়া উপকরণ নেটে বাড়ানো যায়। এই আন্দোলনের শেষে গড়ে উঠল একটা সাইট যার নাম 'ই-জোনাকি' যুগ, ফেসবুক গ্রুপ যার নাম 'অসমীয়াত কথা বতরা'। তাতে লাভ হয়েছে এই যে এখন শব্দের প্রায় প্রত্যেকের একটি করে সুদৃশ্য অসমীয়া ব্লগ আছে। 'সুগন্ধী পখিলা', 'শতদল', আমি অসমীয়া, 'খার নোখোয়ার কলম' 'জালপঞ্জী', জীবনর বাটত, 'মই আরু মোর পৃথিবী' ইত্যাদি আরো অনেক। এর মধ্যে দিল্লী প্রবাসী হিমজ্যোতি তালুকদারের 'মই আরু মোর পৃথিবী' এবং যামিনি অনুরাগের শুরু করা সন্মিলিত ব্লগ 'সুগন্ধী পখিলা' সবচে জনপ্রিয় আর সুশোভিত ব্লগ। এনাজরি ডট কম বলে একটি অসমীয়া সাহিত্য সম্ভার গেল বছর থেকে যাত্রা শুরু করলেও এরা প্রথমে লেখাগুলো হয় দিত ছবির আধারে, নতুবা ইংরেজিতে। 'ই-জোনাকি' যুগের প্রভাবে এরাও এখন সরাসরিই ইউনিকোড ব্যবহার করেন। অরিন্দম চৌধুরীর সম্পাদিত কাগজ দ্য সানডে ইন্ডিয়ানের বাংলা ওয়েব সংস্করণ ছিলই,এখন অসমিয়া সংস্করণ এসে গেছে। বাংলাতেও আর কোনো কাগজ ইউনিকোড ব্যবহার করে বলে আমরা জানিনা। আনন্দবাজার রয়েছে। কিন্তু ওদের ব্যবস্থাটি এতো আত্মকেন্দ্রিক এবং জটিল যে সাধারণ মানুষ পড়বার ঝক্কি নেন বলে মনে হয় না। আরেকটি সুখবরতো না দিলেই নয় ,যে গুয়াহাটির এক তরুণ বনজিৎ পাঠক গেল ২১শে ফেব্রুয়ারি, ২০১১ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে 'কুঁহিপাত'নামে একটি অসমিয়া ফন্ট নির্মাণ করে মুক্তকরে দিয়েছেন। এবারে তিনি সেটি যাতে বাংলা, মণিপুরি, হাজং, চাকমা লিখতেও ব্যবহার করা যায় তার উপর কাজ করছেন।
অসমের প্রায় প্রতিটি বাংলা অসমীয়া দৈনিকের ওয়েবসাইট রয়েছে। কিন্তু তারা পৃষ্ঠাগুলো তোলেন ছবির আধারে, ইউনিকোডে নয়। আর পরের দিন বা পরের সপ্তাহেই স্থানসংকুলানের জন্যে সেগুলো সরিয়ে ফেলেন। সংরক্ষিত হয় না। তার মানে , প্রায়োগিক দিক থেকে তাঁরা এখনো পিছিয়েই আছেন। এটি কতটা তাদের সাধ আর কতটা সাধ্যির জন্যে হচ্ছে সে নিয়ে প্রশ্ন করাই যায়। যে দু'একটা বাংলা সাহিত্যের ওয়েবসাইট রয়েছে বিষয়গুলো কোনোটারই হয় ইউনিকোডে নেই অথবা অন্যকে দিয়ে ছবির আধারে তৈরি , নিত্য নবীকরণ করবার কেউ নেই। সুতরাং এখন আর খোলে না। শিলচরের চন্দ্রিমা দত্তের 'কবিতার চন্দ্রিমা' কিম্বা আগরতলার কল্যাণ চক্রবর্তীর 'ভাষা' সাইটের দশা এই। পূর্বোত্তর থেকে প্রথম বাংলা ব্লগার আমি আর রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী এবং প্রাবন্ধিক শুভপ্রসাদ মজুমদার। শুভপ্রসাদ আগে তাঁর লেখালেখিগুলো পিডিএফে করে স্ক্রাইবডে তুলে দিতেন। আর নিয়মিত লিখতেন সচলয়াতন সন্মিলিত ব্লগে। পরে 'অশুভ'নামে নিজের একটি ব্লগ করেন। এর পর এখন কবি কবি সপ্তর্ষি বিশ্বাস, জয়িতা দাস ব্লগ লেখাতে যোগ দিয়েছেন। সপ্তর্ষির ব্লগের নাম 'আমারসোনারবাংলা আমিতোমায় ভালোবাসি' এবং 'খাতা কবিতার'। 'খাতাকবিতা'তে তিনি তাঁর পড়া ভালো লাগা নানা কবিদের কবিতাগুলো তুলে রাখেন। সপ্তর্ষি অনির্বান ধরিত্রীপুত্র এবং দেবাশিস তরফদারের নামে আরো দুটো ব্লগ নিজেই সম্পাদনা করেন। এর প্রথমটি 'মন্থরতাবিষয়ক ' দ্বিতীয়টি 'পুনরাবৃত্ত' । জয়িতার ব্লগের নাম 'ইচ্ছামতি'। জয়িতারই ছোট ভাই অসম বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞানের অধ্যাপক হিমাদ্রি শেখর দাস আরো এক পা এগিয়ে। তিনি তাঁর 'হিমাদ্রি' ব্লগে বিজ্ঞান নিয়ে আর কুসংস্কারের বিরুদ্ধে নিয়মিত লিখছেন বাংলা ভাষাতে। 'স্বাভিমান' নামে একটি ব্লগ রয়েছে অরূপ বৈশ্যের, যাতে তিনি নানা সামাজিক আর্থরাজনৈতিক বিষয়গুলো নিয়ে বাংলা ইংরেজিতে লিখে থাকেন। সম্প্রতি নিজের বই লেখালেখি নিয়ে ব্লগ শুরু করছেন কবি অমিতাভ দেব চৌধুরীও। তাঁর ব্লগের নাম 'বাজেখাতা'।
আমার নিজের অনেকগুলো ব্লগ রয়েছে। তার মধ্যে একটির নাম 'সুশান্ত', অন্যটি 'প্রজ্ঞান' । প্রজ্ঞান মূলত দ্বিভাষিক 'ইংরেজি ও অসমিয়া' সেখানে আমার কলেজ থেকে সম্পাদিত নিয়মিত কাগজ 'প্রজ্ঞান' সম্পর্কিত নানা বিষয় তুলে দেয়া হয়। দুটোই পূর্বোত্তর ভারতের জনপ্রিয় ব্লগগুলোর অন্যতম। বাংলাদেশের 'আমার ব্লগ' এবং কলকাতার 'কফি হাউসের আড্ডা' নামের দুটো সন্মিলিত ব্লগেও আমি নিয়মিত লেখালেখি করে থাকি। এছাড়াও বাঙালনামা, গুরুচন্ডালী, সৃষ্টি, অলসকথার দুপুরের মতো ওয়েব মেগাজিনেও কখনো সখনো।এছাড়াও আমার রয়েছে ঈশানকোনের কথা, ঈশানকোনের কাহিনি এবং কাঠের নৌকো। ঈশানকোনের কাহিনিতে আমি দীর্ঘদিন ধরে অরূপা পটঙ্গীয়া কলিতার বিখ্যাত উপন্যাস 'ফেলানি' বাংলাতে অনুবাদ করছি। পাঠকেরা সেখানেই সেটি পড়ছেন। অভিমত দিচ্ছেন। এবং সে অনুযায়ী সেটি সংশোধিত হয়ে হয়ে এগুচ্ছে। স্বয়ং লেখিকা এটি পড়ে পড়ে যাচ্ছেন। এবং প্রায়শঃই নিজের অভিমত জানাচ্ছেন। এই অনুবাদের কথা তিনি উপন্যাসটির সাম্প্রতিক সংস্করণে উল্লেখও করেছেন। কিন্তু যেটির কথা আমি এখানে বিশেষ করে বলতে চাইব, সেটির নাম 'কাঠের নৌকা' । শক্তিপদ ব্রহ্মচারীর কবিতাগ্রন্থের নামে তৈরি এই ব্লগে আমরা যে উদ্যোগটি নিচ্ছি তা এই যে পূর্বোত্তরের যে কোনো প্রকাশক কিম্বা সম্পাদক তাঁদের সম্পাদিত প্রকাশিত পত্রিকা বা গ্রন্থের পিডিএফ পাঠিয়ে দিলেই আমরা সেটি সেখানে তুলে দিয়ে গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে দিচ্ছি। কবি বন্ধু অমিতাভ দেবচৌধুরী ইতিমধ্যে এই ব্লগে আমার এক ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবে কাজ করছেন। ইতিমধ্যে তাঁর দু'তিনটি মূল্যবান কবিতা আর নিবন্ধ গ্রন্থ ছাড়াও আমরা তুলেছি প্রতিশ্রোত, মহাবাহুর মতো ছোট কাগজের সাম্প্রতিক সংখ্যাগুলো।তুলেছি কবি বিজয় ভট্টাচার্য্যের, তিমির দে'র সাম্প্রতিক গদ্য গ্রন্থ। সমর দেবের উপন্যাস। ভিকি পাব্লিশার্স ইতিমধ্যে 'কাঠের নৌকো'তে তাদের আটখানা প্রকাশিত গ্রন্থ পাঠিয়ে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। আরো পাঠাবার প্রতিশ্রুতি রয়েইছে। আমরা চাইব, যারা দুটো কথা বাংলাতে লিখতে পারেন আর যাদের হাতে ইন্টারনেট রয়েছে তারা বাংলাতেই সেখানে লিখুন। ইংরেজি হরফে বাংলা লেখা বন্ধ করুন। ইন্টারনেট আপনার হাতে থাকলে বাকি কাজগুলো হচ্ছে বিনামূল্যে। আগামীদিনে ইন্টারনেটও প্রায় বিনামূল্যের হয়েই যাবে। অন্তত গ্রন্থের কারবার থেকে এর ব্যয় হবে অতি সামান্য। স্থানে কালে এর বিস্তার আর গভীরতা হবে ব্যাপক। সবচে' বড় কথা গ্রন্থকীটের মতো একে কোনো কম্পিউটার কীট কখনো ধ্বংস করতে পারবে না। বাংলা ভাষা সাহিত্য যেখানে ডানা মেলে অবাধে উড়তে পারে সেখানে আপনারা ডানা মেলবেনই বা না কেন? এর তো একটাই কারণ হতে পারে, পুরোনো অভ্যেস। পালিত পাখি যেমন ছেড়ে দিলে আবারো খাঁচাতে ফিরে ফিরে আসে! আমি অনেক অনেককে বলেছি। আমার হাজারো বাঙালি বন্ধু আছে দেশে বিদেশে যাদের সঙ্গে আমার বার্তালাপ হয় বাংলা ভাষাতে , বাংলা হরফে। লেখাপড়া নিয়ে আড্ডা হয় বাংলাতে। তাদের মধ্যে পূর্বোত্তরের বন্ধু ঐ হাতে গুনা কয়েকজন। তাঁরা এখনো, ইংরেজি হরফের প্রতি ভালোবাসাটা ছেড়ে উঠতে পারেন নি। শিলচর স্টেশনের নাম কেন ভাষাশহীদ স্টেশন হলো না এই নিয়েও তাঁরা তাদের হাহাকার চীৎকারের ভাষাটা কিন্তু ইংরাজি।
আমার ইচ্ছে ছিল কী করে কাজগুলো করবেন সেই নিয়ে দুটো কথা বলবার । কিন্তু সেই সময়ও নেই, মনে হয় না আপনাদের ধৈর্যও রয়েছে। সে নাহয় হবেখন ইন্টার নেটে। আগ্রহীরা আমাকে মেল করতে পারেনঃ karsushanta40@gmail.comএ । ফেসবুক, অরকুটে খোঁজে নিলেও পেয়ে যাবেন। আর আজকের এই বক্তৃতাটাও ইতিমধ্যেই উঠে গেছে আমার ব্লগে। লগ অন করুনঃ http://sushantakar40.blogspot.com. আপনাদের স্বাগত।