প্যারীচরণ
দাস (১৮৪৬-১৮৮৭)
( মাইকেল
মধুসূদনোত্তর যুগের শ্রীহট্টের প্রথম এবং শ্রীহট্ট কাছাড়ের দ্বিতীয় আধুনিক কবি প্যারীচরণের ‘পদ্যপুস্তক’ ৩য়
ভাগে রয়েছে এই কবিতা। উৎসঃ প্যারীচরণ দাসঃ জীবন ও কাব্যকৃতি; জন্মজিৎ রায়; নাইন্থ
কলাম, একাদশ বর্ষ, মে ২০১১)
শ্রীহট্ট
লক্ষীর
হাট, আনন্দের ধাম,
স্বর্গাপেক্ষা
প্রিয়তর এ ভূমির নাম।
জন্মভূমি,
তেঁই ইহা আমার নিকটে
জিনিয়া
ত্রিদশালয় গৌরব প্রকটে।।
বিদেশের
বর্ণনায় মুগ্ধ তনু মন,
মোহবশে
দেশপানে চাইনে কখন ।
ভ্রান্তিমদে
মাতি আমি যথা তথা যাই,
স্বদেশের
পানে হায়! ফিরিয়া না চাই।।
কি
ছার নন্দনবন কল্পনা কল্পিত,
হয়
কি প্রকৃত তাহে প্রসূন কলিত?
মিছে
শুনে কবি তথা অলির গুঞ্জন,
কবির
কল্পনা মাত্র মন্দারের বন।।
প্রকৃতির
ভাণ্ডারেতে শ্রীহট্টের মাঝে
কতশোভা
মন লোভা সর্বত্র বিরাজে।
প্রতিভা
প্রসূত নয় প্রকৃতির বিষয়,
দেখ
না পথিক গিয়ে মনে যদি লয়?
ধবল
তুষার শৈল, মরু ভয়ানক,
আগ্নেয়
পর্বত, হ্রদ, ঘূর্ণিত উদক,
ঘন
ঘোর নাদি পাত জলের কল্লোল ,
নীরনিধি
সাগরের উত্থলি হিল্লোল
উত্তুঙ্গ
সুমেরু শৃঙ্গ ভীষণ দর্শন,
দর্শকের
হয় যাতে ভয় উদ্দীপন,
ছাড়িয়া
বারেক ভাই করি আগমন
শ্রীহট্টের
চারুশোভা কর দরশন।।
যেদেশেতে
শরমার বালিময় চরে
হেমন্তে
সারস বক সুখে কেলি করে
স্রোতহীন
তটিনীর নিরমল জলে
সাঁতারে
মরালকুল অতি কুতূহলে
কলনাদে
রাজঁহাস জলে করে খেলা
কুন্দশ্বেত
বলাকার মিলে মঞ্জুমেলা।
আর
কত জলচর বিহঙ্গের কুল
নয়নের
তৃপ্তিকর নাহি যার তুল।।
যে
দেশের বনশোভা অতুলন ভবে,
প্রকাণ্ড
দীর্ঘল দ্রুম আপন গৌরবে
উচ্চশিরঃ;
ঝোপঝাড়ে সুষমার সীমা
বিভূষণা
বনমধু লতার মহিমা।।
কতশত
বনফল কাননে ফলিত,
কত
শত পুষ্পকলি কন্দরে কলিত।
বিপিনের
কলকণ্ঠ সুগায়কগণ
নিত্যপ্রাতে
বিভুগণ করে সংকীর্তন।।
অদূরে
পাহাড় শোভে নীলনভঃ তলে,
কত
নদী নির্ঝরিণী-উপবীত গলে,
অপূর্ব
গম্ভীর মূর্তি প্রশান্ত দর্শন
দেখ
দূরে, যেন যোগী যোগে নিমগন।।
কমনীয়
দুর্বাদলে কষায়িতমুখ
তরুতলে
মৃগনাভ ভুঞ্জে শান্তিসুখ ।
সুলোচনা
কুরঙ্গিণী চঞ্চল চরণে
দ্রুত
আসি তোষে তার অঙ্গ কণ্ডুয়নে।।
যে
দেশেতে কমলার শোভা চমৎকার
ললিত
ললাম লাল বর্ণের বাহার।
কি
কোমল অঙ্গ! তায় সুবাস সঞ্চার,
কি
মধুর রস! পানে তৃপ্তি সবাকার ।।
কমলা
কুসুম আহা কিবা মনোহর,
মধুলোভে
মধুকর পাশে নিরন্তর।
অদূরে
বিপিন মাঝে নয়নরঞ্জন
মধুচক্রে
পথিকের কেড়ে লয় মন।।
ভারতে
কোথাও আর খুঁজে মিলা ভার
কমলা
মধুর সম দ্রব্য মিষ্ট তার।
হায়
বৃথা পুরাকালে নয়নের নীরে
তিতিলা
দানব কুল জলধীর তীরে।।
না
পাইয়া সুধা ( যবে ঈষৎ হাসিয়া
ভুবন
মোহিনী মুখে, দিলেন বাটিয়া,
মোহিনীমোহন
কান্তি দেবে দেবসীধু)।
ছিল
না কি এ সংসারে কমলার মধু?
যে
দেশে জনমে অতি মিষ্ট আনারস
সিন্ধুমথা
সুধাসম মিষ্ট যার রস।
কাঁঠাল
রসাল পেঁপে আদি ফল নানা
প্রভূত
সম্ভূত কালে কে করে গণনা।।
শ্যামল
ক্ষেত্রে শোভে শস্য নানা জাতি,
কেদারে
কেদারে শুন কৃষকের গীতি।
ইক্ষু
ক্ষেত্রে ইক্ষু যথা বীরের বিশিখ,
পাতাগুলি
সমুন্নত ঊর্ধদিগে শিখ।।
পাহাড়ে
অগরু আছে আতরের মূল,
যার
গন্ধে বিলাসীর পরাণ আকুল!
চাহার
পাতার আর রবরের গাছে
ইতিপূর্বে
কে জানিত এতগুণ আছে?
গবয়
মহিষ হাতি বৎসরে বৎসরে
শত
শত ধরা পড়ে বিলাসের তরে।
তথাপি
বিলাস বাঞ্ছা পূর্ণ নাহি হয়,
নিষ্ঠুর
মানব মন কভু তুষ্ট নয়।।
শৈলপুত্রী
শৈবালিনী প্রবাহে মিশিয়া
আকর
কাঞ্চনকণা নাচিয়া নাচিয়া
আসে
চলি; গড়ি গড়ি গজমুক্তা মালা,
পায়
সদা পিতৃস্থানে এ যৌতুক বালা।।
তড়াসেতে
নলিনীর শোভা চমৎকার
মৃদুমন্দ
সমিরণে দোলে বারে বার।
মকরন্দ
লোভে অলি গুঞ্জে চারিধারে
বায়ুভরে
দোলে দল বসিতে না পারে।।
হাস্যমুখী
কুমুদিনী উৎপনিনী সনে,
মধুলোভা
মধুপের আনন্দ গুঞ্জনে,
হইত
তুলনা তারা উদিত কখনে
নীলাভ
নীরদ মালা সঙ্কুল গগনে।।
শততঃ
শ্রীহট্ট শ্রীর অচল আবাস,
প্রকৃতির
প্রীতিনেত্রে তাহাই প্রকাশ।
জঘন্য
মানব , যেই করে আচরণ
পরদ্বারে
ভিক্ষাবৃত্তি থাকিতে আপন।।
সুবোধ
সন্তান তারে বলে জ্ঞানীজনে,
ভুঞ্জে
যেই ঘরে যাহা আনন্দিত মনে,
অতএব
স্বদেশের স্বভাবদর্শন
কর
জ্ঞানী ত্যজি নিন্দামাদক সেবন।।
মেলিয়া
নয়ন হের মন-প্রাণলোভা
স্বর্গীয়
সৌন্দর্য সার স্বদেশের শোভা।
হায়
রে সৌভাগ্য সদা হবে কি এমন
দেখিয়া
ওরূপ রুচি জুড়াইব মন।।
No comments:
Post a Comment