(বেলাভূমি' করিমগঞ্জ, অসমের এক বৃদ্ধাবাসের নাম।
এর পক্ষে নিয়মিত বেরোয় এক কাগজ 'সেবা'। সম্পাদনা করেন অপর্ণা দেব। গেল মে,
২০১২ সংখ্যাতে আমার এই লেখাটি বেরিয়েছিল।)
কমিউনিষ্ট ইস্তাহারে মার্ক্স এঙ্গেলস লিখেছিলেন, “ পরিবার ও শিক্ষা নিয়ে, সন্তান এবং মা-বাবার পবিত্র সম্পর্ক নিয়ে বোর্জুয়াদের সমস্ত
উচ্চবাচ্যকে আধুনিক শিল্প তার কাজকর্ম দিয়ে ক্রমেই বিরক্তিকর ঘ্যনাঘানানিতে পরিণত
করে। সর্বহারাদের সমস্ত পারিবারিক সম্পর্ককে ভেঙ্গে চুরমার করে দেয় , তাদের সন্তানেদের পরিণত করে পণ্যে আর শ্রমের হাতিয়ারে ।” তাঁরা আরো প্রশ্ন তুলেছিলেন, “ এখনকার
বোর্জুয়া পরিবারগুলো কোন ভিতের উপর দাঁড়িয়ে আছে?
পুঁজির উপর, ব্যক্তগত লাভালাভের উপর। এর সবচে’ বিকশিত রূপে পরিবার বলতে শুধু বোর্জুয়াদেরই অবশিষ্ট থাকে । এর বিপরীতে
সর্বহারাদের জন্যে আর কোনো পরিবার অবশিষ্ট থাকে না, থাকে
গণ-বেশ্যালয় ।”
নব্বুইর দশকের প্রথম
দিকে করিমগঞ্জের ‘অক্ষর’ একখানা গল্প সংকলন বের করেছিল। তাতে
একখানা গল্প লিখেছিলেন স্বপ্না ভট্টাচার্য । গল্পটির নাম ‘উজান’। খুব কম লেখেন। কিন্তু তাঁর ঐ গল্পটি এই দুই দশক পরেও আমি ভুলে যেতে
পারিনি । যারা
পড়েছেন, যদি কোনো তত্ব দিয়ে তাদের পাঠ আচ্ছন্ন না হয়ে থাকে আমি নিশ্চিত, ভুলতে পারেন নি। কারণ, পারিবারিক সম্পর্কের
পবিত্রতার ধারণাকে পুঁজিবাদী সভ্যতার ‘বিরক্তিকর
ঘ্যানঘ্যানানিতে পরিণত’ করবার প্রয়াসের বিরুদ্ধেই যেন এক
প্রত্যাহ্বান উচ্চারিত হয়েছিল স্বপ্নার এই গল্পে। সাধারণত যেটি হয়, আমাদের 'প্রতিবাদী' গল্পকারেরা “‘বিরক্তিকর ঘ্যানঘ্যানানি’র চোটে সেই সম্পর্কগুলো নিয়েই প্রশ্ন তুলতে শুরু করেন । অন্ধকার পথে নামিয়ে
দিয়েই তাঁরা সরে পড়েন। স্বপ্না সে পথে হাঁটেন নি । কিন্তু পণ্য সভ্যতার লীলাটি ঠিক
উন্মোচন করেছেন, সজ্ঞানে বা অজ্ঞানে। সেটি আড়ালে থাকে নি
।
ক্ষিতীন্দ্রমোহন বহু
কাল পরে করিমগঞ্জের গাঁয়ের বাড়ি থেকে এসছিলেন পিসতুতো ফুলদিদি প্রীতিলতার শিলচরের
বাড়ি, যদি বলেকয়ে ছানিপড়া চোখের জন্যে একখানা চশমা করিয়ে নিয়ে যেতে পারেন।
ভাগ্নে সমর, যাকে কোলেকাঁখে গল্প বলে কয়ে একসময় মানুষ
করেছিলেন ক্ষিতীন্দ্রমোহন, যে তাঁকে ‘গল্পমামু’ বলে ডাকত,
সেই সমর এখন এক বড়সড় বদলির চাকরি করে। তার ছেলে এখন কালিম্পঙে বোর্ডিং স্কুলে
থেকে পড়ে । এতো বছর পরেও সেই সমর তার গল্পমামুকে ভুলেনি । গল্পমামু ফিরে যাবে শোনে তার
মায়ের মতোই সেও বিচলিত হয় ।মামীর হাতের নাড়ু খাবার বায়না ধরে । এত সব দেখে, যার জন্যে
এসছিলেন ক্ষিতীন্দ্রমোহন সেইটেই বলে উঠতে পারলেন না। যার জন্যে ফুলদিদিকে অনেক
কেঁদেকুটে চিঠি লিখে দিয়েছিলেন ভাতৃবঁধু চারুশশী-- সেই চিঠিটাই দেয়া হলো না। পকেটের চিঠি পকেটেই থেকে গেল।
বুক ভরা স্নেহ সম্মান আর আদরে আপ্লুত গল্পমামু যেমন এসছিলেন, তেমনি ফিরে
গেলেন। দেয়ানেয়ার ভারে সেই ভালোবাসাকে ফিকে হতে দিলেন না । এইটুকুই সম্বল যা তিনি
টিকিয়ে রাখতে পারেন। আর কিছুই তাঁর নেই। সব হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়েছেন। তাঁর নিজেরও
একটি ছেলে আছে । সেই ‘হীরু আমরারে দেখে না...।” কিন্তু আমরা পাঠকেরা জেনে গেলাম
তাঁর ছানি পড়া চোখে চশমা চড়ল না, আর কবে এই ভালোবাসার জনদের সাথে দেখা হবে তার কোনো
ঠিকানা রইলনা। তাঁর ভালোবাসার ফুলদিদিও ভালো নেই। ছেলের বদলির চাকরি । ‘বদলি আসন্ন ।
ফুলদি কিছুটা উদ্বিগ্ন! শিলচর ছেড়ে যেতে চান না।”
গল্পটির এই
প্রেক্ষাপটটাই যে কোনো পাঠককে কাছে টানার জন্যে যথেষ্ট। কিন্তু, বরাক
উপত্যকা তথা পূর্বোত্তর ভারতের যে মানুষগুলো দেশভাগের পর ভিটে মাটি ছেড়ে এসছেন
তাদের কাছে এই গল্প আরো ভালো লাগবে যে এতে তাঁরা নিজেদের ইতিবৃত্তই আবিষ্কার
করবেন। শিলচর শহরের মানুষ আবিষ্কার করবেন এই শহরের গড়ে উঠার গেল আধা শতাব্দীর
ইতিবৃত্তও বটে । মুসলমানের তাড়া খেয়ে দেশছাড়ার কথা রয়েছে । কিন্তু সে ঘৃণার
তাড়ার থেকে ভালোবাসার সাড়াটাই গল্পের মূল স্বরের সঙ্গে প্রসঙ্গটিকে যুক্ত করেছে ।
দেশভাগের এও এক চেপে যাওয়া ইতিহাস বটে । “ পাশের বাড়ির মাজর খলিফা একদিন দাওয়ায়
বসে পুজোর প্রসাদ খেতে খেতে বলেছিল—কর্তা ঠাকুর—কেনে পইড়া রইছইন! হককলে গেলা---আপনার দাদাও গেলা—কর্তামার লাইগ্যা আমার ডর লাগে । মুখের দিকে চাইয়া বুঝইন না? সময় থাকতে যাইন গিয়া দাদার কাছে---আমিও শান্তি পাই!” ঠিক তেমনি, ‘হীরু আমরারে দেখে না...” এটা গল্পের অনেক স্বরের একটা মাত্র। তার স্ত্রী পোয়াতি ছিল বলে তাকে
ফেলে শিলচর আসতে পারেন নি চারুশশী আর ক্ষিতীন্দ্রমোহন,
যখন ফুলদিদির স্বামী উমানাথ মারা যান।
এই গল্পে ভিটে মাটি
ছেড়ে একাধিক উচ্ছেদের গল্প আছে। তার প্রথমটিতো এই, দেশভাগ। যার থেকে আমরা
মুসলমানকে গালি দিয়েই স্বস্তি জোগাড় করে নিই। শেষেরটি ‘হীরু
আমরারে দেখে না...” সুতরাং ক্ষিতীন্দ্রমোহনের কী হবে; আর সমরের বদলির চাকরি বলে ফুলদিদিকে শিলচর যেতে হবে, অথচ তিনি যেতে চান না। তিন বিপন্ন বৃদ্ধ আর বৃদ্ধার গল্প। একদিকে
স্বচ্ছল দায়িত্ববান পুত্র সমর আরেকদিকে দরিদ্র দায়িত্বজ্ঞানহীন পুত্র হীরু । কিন্তু কেউই
মা-বাবার পায়ের তলার সর্ষেকে দূর করতে পারে না। এইখানেই আজকের ছেলেমেয়েরা বুড়ো
মা-বাবার দায়িত্ব নেয় না--- এই সরল সমীকরণ ম্যাড়মেড়ে হয়ে যায়। পরিবারের, আত্মীয়
স্বজনের প্রতিটি মানুষ যেন ছায়াপথে পড়া গ্রহ-নক্ষত্রের দল, পরস্পরের থেকে ছড়িয়ে পড়াই যাদের নিয়তি। ফুলদিদি প্রীতিলতা থেকে থেকেই
তাই হাহাকার করেন, “ সমরের বিয়া অইল, রীতার বিয়া দিলাম, পোলারা ঘর বানাইল, সমরের বাবা গত হইলা, একটাবার আইলায়না ভাই!
দিদিরে ইভাবে ভুলছ!”
শুধু বৃদ্ধরাই বা
কেন? সমরের বড় ভাই শেখর এয়ার ফোর্সে ইঞ্জিনীয়ার। ঘুরে ঘুরে বেড়ায়। বোন রীতা
বিয়ের পরে কলকাতায় । সমরে ছেলে লেখা পড়ার জন্যে কালিম্পঙে । বৌমা সুধার কষ্ট
হয়। গল্পমামা জিজ্ঞেস করেন, “ ...দিন আর কত বদলিত? সবই খালি বদলায়! বউমার কষ্ট হয় নানি?” বউমা
সুধা উত্তর দেয়, “...কিন্তু কিতা
করমু কইন, মানাইয়া নেওন লাগে-- ” এই দিন বদলের গল্প ‘উজান’, কিন্তু চরিত্রগুলো সেই বদলের নিয়ন্তা
নয়। এই বদলকে তারা মনে নেয় না, মানিয়ে নেয় মাত্র। প্রশ্ন
উঠতেই পারে আর ওঠা উচিত--- তাদের স্বাধীনতা কতটুকু?
চরিত্রগুলোর এই পরাধীনতার গল্প ‘উজান’ । এই পরাধীনতার বিরুদ্ধে লড়াইতে ভালোবাসাটাই তাদের জোর। এইটেই শুধু
বদলায় নি গল্পে, আর
সব বদলায়।
মাজর খলিফার ডর একটা
ছিল বটে। কিন্তু সেটি আসল কারণ নয় যে দেশ ছেড়ে চলে এসছিলেন ক্ষিতীন্দ্রমোহন । বাবার আমলেই টোল
বন্ধ হয়ে এসছিল। পুজো আর্চাও কমে আসছিল। ভাগীদারদের থেকে ফসলও আদায় হচ্ছিল না ।
তাই যখন শুনলেন হবিগঞ্জের কুমুদ উকিলের ছেলে শিলচরে দত্ত কোম্পানি নামে ইটভাটা
খুলেছে আর দেখাশোনার জন্যে বিশ্বস্ত লোক চায়, তিনি
চলে এলেন। মেহেরপুরে বাড়ি করলেন। সেই ইটভাটাতেই একদিন গ্রাহক হিসেবে আসা
উমাকান্তের সঙ্গে প্রথম ঘনিষ্ট আলাপ এবং আত্মীয়তাকে নতুন করে ঝালিয়ে নেয়া । এতো
হলো আবাস বদল। মাঝে তিনি নিজের চোখেই দেখলেন ভাষা বদলের ফরমান আর তার বিরুদ্ধে
লড়াই। ১৯৬১র ভাষা আন্দোলনে নিজেও পথ হেঁটেছিলেন মিছিলে ।
ভাষা রইল কিন্তু
শিলচরের বাসা রইল না। শিলচর মেডিকেল কলেজ হবার সময় ইটের জোগান দিয়ে ভালো লাভ
তুলেছিল ভাটাটি । কিন্তু এক বছরের তুমুল বর্ষা আর পরের বছরের অকাল বন্যার তোড়ে
কোম্পানিটি উঠে যায় , সেই সঙ্গে মেহেরপুরের বাস। তাঁর দাদারা থাকতেন করিমগঞ্জের প্রত্যন্ত
গ্রাম শ্রীপুরে । সামান্য
ধানের জমি সম্বল করে সেখানে চলে গেলেন। আর দাঁড়াতে পারেননি নিজের পায়ে । ছন বাঁশের ঘর । অতি
বৃষ্টিতে জল পড়ে । গেল বর্ষাতে আনাজ পাতি করা যায়নি । পুকুরের মাছ গেছে ভেসে । কৈ
মাছ ধরতে গিয়ে পা পিছলে চার মাস বিছানায়। ওষুধপাতির বালাই নেই। দু’বেলা খেতে
দিতে হীরুর বৌএর গঞ্জনা । তার উপর চোখ গেছে । বাঁচোখে দেখেন না কিছুই । সেই চোখের জন্যে
চশমা জোগাড় করতে সমরকে ধরতে হবে । চারুশশী চিঠি লিখে দিয়েছেন প্রীতিলতাকে । তাই তার এতোকাল পর
আবার শিলচর আসা । পথঘাট চেনাই যায় না । সেই শিলচরে এখন আসাম টাইপ ঘরও নেই, এখানে ওখানে
একতলা- দুতলা- তেতলা বাড়ি।তারই একটি একতলার সুন্দর বাড়ি ‘প্রীতিকুঞ্জ’ ।
উমানাথের মতো যারা
উপায় করতে পেরেছেন তাঁরা শিলচরে টিকেছেন এটা বোঝাই যায়। কিন্তু টেকে না তাঁর
ছেলেরা । তাদের একজনের বদলির চাকরি । অন্যজন এয়ার ফোর্সের ইঞ্জিনীয়ার। মেয়ে বিয়ে
করে কলকাতায়। মা শিলচর ছেড়ে যেতে চান না । এরা কেউ সর্বহারা নন। ক্ষিতীন্দ্রমোহন
প্রায় সেই শ্রেণিতে অবনমনের দিকে পা বাড়িয়ে রইলেও, উমানাথের পরিবারতো উড়ছে
আকাশে। তারপরেও এই তথ্য মিথ্যে হবার নয় যে এরা কেউ দিন বদলের মালিক নন। বদলটাকে
তারা মানিয়ে নেন , মনে নেন না।
দিন বদলের মালিক
যারা তারা তাদের পরিণত করে পণ্যে আর শ্রমের হাতিয়ারে। উদ্বৃত্ত হলে ছুঁড়ে ফেলে
দেয়। Use and Throw !
যেমন
ফেলে দিয়েছিল দেশছাড়া উদ্বাস্তুদের, যেমন ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে বৃদ্ধ
ক্ষিতীন্দ্রমোহনদের । আর তাদের পরিবারগুলো ভেঙ্গে চূর্ণবিচূর্ণ করে দেয়, যেমন বলেছিলেন মার্ক্স এবং
এঙ্গেলস। গণবেশ্যালয়টি একটি অতিশয়োক্তি বটে । মিথ্যেও নয় আবার সর্বত্র সত্যও নয়, কিন্তু এটি
সত্য যে পরিবার বলে তাদের আর কোনো কিছুই অবশিষ্ট থাকে না!
আমরা গল্পটির কথা
ফাঁদলাম এই কথা লিখবার জন্যে যে আমাদের সমাজে বৃদ্ধরা ক্রমেই নিঃসঙ্গ হয়ে যাচ্ছেন
তাকে বদলে যাওয়া দিনের একটা ব্যামো বলে বিচ্ছিন্ন করে দেখবার কোনো উপায় নেই। অন্তত
এভাবে দেখলে ব্যামোর কারণটি কিছুতেই নির্ণয় করা যায় না, সুতরাং
অনির্ণীত থাকে তার ঔষধও। যে ভালবাসার ভারে গল্পটি শেষ হয়েছে বাস্তবের জগতে সেই ভার
প্রত্যক্ষ কোনো সমাধান এনে দিতে পারে না । সমাধানের সন্ধানে অনুপ্রেরণা যোগাতে
পারে মাত্র ।
‘জন্মভূমি’, ‘মাতৃভূমি’ বলতে যে ‘পবিত্র’ ধারণাগুলোর
সঙ্গে আমরা খুব আবেগিক তাকে ইচ্ছেয় বা অনিচ্ছেয় পেছনে ফেলে চলে আসতে হয়ছে আমাদের
পূর্বপ্রজন্মকে। তারপর সেই জন্মভূমির প্রতি কোনোধরণের ভালোবাসার প্রকাশকেও
ভাবালুতা, কখনোবা ‘দেশদ্রোহীতা’
রূপে দেখবার দীক্ষা এবং শিক্ষাকেও আমরা মেনে নিয়েছি, কখনোবা মনেও নিয়েছি। সেই দেশভাগ বহু পরিবারকে বা আত্মীয়স্বজন নিয়ে গড়ে
উঠা বহু বৃহত্তর পরিবারগুলোকে এক ধাক্কাতে ভেঙ্গেছিল। আমাদের গল্পে
ক্ষিতীন্দ্রমোহনের আগেই চলে এসছিলেন তাঁর দাদা । ইটভাটাতে আচমকা দেখা হলে পর
উমানাথ জিজ্ঞেস করেন, ‘কই আছিল বাড়ি?’ ‘মৌলভী বাজার। আপনের?’ ‘ধুলিয়াখাল, রতনপুর--’ ‘কইন কিতা মাশয়। ঠিক ধরছি তাইলে, আপনে দেখি আমার শ্বশুরের দেশের মানুষ...” দু’দশক আগেও আমরা দেখেছি আমাদের পিতৃপ্রজন্ম এভাবেই খুঁজে নিতেন তাঁদের
ভেঙ্গে যাওয়া বৃহত্তর পরিবার।
ভেঙ্গে যাওয়া
পরিবারগুলোর সবাই এপারে এসেই জায়গা জমি করে বসত ভিটে করতে পারেন নি। ষাট-সত্তরের
দশকেও শিলচর-করিমগঞ্জের ভাড়া বাড়িগুলোতে যে পরিবারগুলোকে পাওয়া যেত দেখা তারা
ছিলেন নিম্নবিত্ত, দুই এক কোঠা নিয়ে থাকতেন। কিন্তু সেখানেই যায়গা করে নিত এক বিশাল
একান্নবর্তী পরিবার। এগুলো দেশবাড়ির রেশ মাত্র, আরো
ভেঙ্গে পড়বার জন্যে দিন গুনছিল। এক রেডিওতে দল বেঁধে নাটক শুনতেন, সন্ধ্যেবেলা পুরুষেরা যখন দশপঁচিশের আসর জমাতেন, সেন বৌদি চা চাপালে, চক্রবর্তী বৌদি মালপো
ভাজতেন খেলার আসর জমিয়ে তুলবেন বলে। রোববারে তারা সিনেমা দেখতে যেতেন কখনোবা ‘সামাজিক বই’ উত্তম কুমারের ‘হারানো সুর’ । সঙ্গে যেত পাশের পাড়ির লীলা, নীলা, পঁচিশজনের টিকিট করবার দায় ওদের
পিসতুতো দাদা গোপাল কৃষ্ণের। যারা জায়গা-জমি করে নিতে পেরেছিলেন তারা সে বাড়িকে
সাজাতেন ফেলে আসা ‘দেশে’র বাড়ির
আদলে । আমের গাছ, জামের গাছ,
গোয়াল ঘর, পুকুর ঘাট। যেন এর আর হারাবার কিছু নেই। আজ
সেরকম বাড়িগুলোর পুকুর হয় বুজে গেছে, নয় ধ্বসে গেছে। যে
ছেলে মেয়েদের দুষ্টুমির দাপটে এককালে মায়েরা, জেঠিরা
অতিষ্ট ছিলেন, আজ তারা হারিয়ে গেছে দূর শহরে। মা পড়ে আছেন, তো জেঠাইমা উড়ে গেছেন। আজকের ভাড়া বাড়িতে সেই ছেলেরা মেয়েরা থাকে একা
স্বামী কিম্বা স্ত্রী নিয়ে । সারদিন কাজের শেষে তাদের ছেলেকে বা মেয়েকে ‘কিচ্ছা’ বলে ভুলিয়ে রাখবার সময় তাদের নেই ।
তার আছে সিলেবাসের চাপ, কাজেই বাধা মাইনের টিউটর। সেই
ছেলেকে শ্রমের বাজারের দক্ষ হাতিয়ার হয়ে উঠতে হবে । এই শুধু স্বপ্ন বেঁচে আছে, যে স্বপ্নটাও বাজারের তৈরি। বাজারের উপযোগী হয়ে উঠলেই সেই বাজারে সে
হারিয়ে যাবে । পেছনে পড়ে রইবে তার বৃদ্ধ মা বাবা, যদি
ততদিন তারাও পরস্পর সঙ্গে থাকেন, বিবাহ বিচ্ছেদ না ঘটান
এবং একটা ফ্ল্যাট বাড়ি করে উঠতে পারেন। লোকে আবেগিক হয়ে বলে, ‘বৃদ্ধাবাস’ এক পশ্চিমি সংস্কৃতি , সে আমাদের জন্যে নয়। আমাদের পৈতৃক ভিটে কিম্বা ফ্ল্যাটই হয়ে উঠে
প্রাচ্যের ‘বৃদ্ধাবাস।’ এক বুক
দীর্ঘশ্বাস নিয়ে সেই ‘বৃদ্ধাবাস’ গোপনে গোপনে আবারও তৈরি হয় বাজারে বিক্রি হবার জন্যে অথবা সে ধ্বসে
যাবার জন্যে দিন গুনে।
একান্নবর্তী পরিবার
এক সামন্তীয় ঐতিহ্য । হ্যাঁ
সামন্তীয়, যেখানে নিজে শ্রম করে অথবা না করেই সন্মিলিত শ্রমের ফসল ভোগ করাটাই
সাধারণ রীতি। সেই ফসল বা আয় পরিবারে আসে ‘বড়কর্তা’র হাত ধরে, বাকিরা তাঁর নেতৃত্বের উপর
নির্ভরশীল। তাই তাঁর নির্দেশই পরিবারে শেষ কথা । সামন্তীয় আয়ের উৎস শুকিয়ে যেতেই
বা পালটে যেতেই সে পরিবারগুলো ভেঙ্গে ভেঙ্গে গেছে বা যাচ্ছে । এবং প্রতিটি সদস্য
শ্রমবাজারের যোগান দাতাতে পরিণত হচ্ছে । যে পূঁজির বাজারের মালিকানাতে ভাগ বসাতে
পেরেছে তার কথা আলাদা, আমরা তাদের কথা এখানে পাড়ব না। এই
গেল কয়েক দশকে আমরা পরিবারগুলোকে দেখেছি উলম্বে ভেঙ্গে যেতে । বাবা-কাকারা আলাদা
চুলো করে নিতে। তার পরেই দ্রুত দেখছি সেগুলো আনুভূমিক ভাবে ভেঙ্গে যাচ্ছে আর ছড়িয়ে
ছিটিয়ে যাচ্ছে । একে আটকানো যাবে কী করে? একান্নবর্তী পরিবারে, একসময় ছেলে রোজগেরে হয়ে বিয়ে করবে সেই প্রথাও ছিল না। রোজগার এতোটাই
নিশ্চিত যে উত্তরাধীকারটাই ছিল বড় মাথার বড় ব্যথা । সুতরাং জন্মাতেই বিয়ের আলাপ।
নাতি-নাতিনকে মানুষ করবার দায় ঠাকুরদাদা- ঠাকুরমার। পারিবারিক বাঁধন ছিল তিন বা
চার প্রজন্মকে টেনে ধরে । ছেলে যখন রোজগেরে বাবা তখনো আরো বড় রোজগেরে, ঠাকুর দাদা তখন বিশ্রাম নিলেও তিনিই হচ্ছেন মুখ্য উপদেষ্টা ।
বিয়ে-সন্তান-পরিবার
এই ধারণাগুলোকে তখনো শেষ বিচারে অর্থনীতিই নিয়ন্ত্রণ করত বটে, কিন্তু
সেগুলো ঢেকে যেত ধর্মীয় বা শাস্ত্রীয় ব্যাখ্যার আড়ালে। তাই ধারণাগুলোকে এখনো
আমাদের মনে হয় পরম্পরার বিষয়। আজ সেই আড়ালগুলো গেছে একেবারেই খসে । ছেলে রোজগেরে না হলে
আজকাল বিয়ে করে না । বিয়ে করবার বা তাকে বিয়ে দেবার কেউ সাহস করে না । বিয়ের বয়স
বাড়বার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ব্যর্থপ্রেমের হত্যা আর আত্মহত্যা । বিয়ে করা বৌকে
খাওয়াবার সাধ্যি বাবার নেই, ঠাকুরদাতো সেই কবেই অক্ষম অথবা নেই। সেই অক্ষম
ঠাকুরদাদাকে প্রতিস্থাপন করছেন বিবাহিত স্ত্রীরা । আগে তাদের যে মেয়েদের শ্রম শুধু
পরিবারের ভেতরের শ্রমশক্তি উৎপাদনের কাজে লাগত, এবং কোনো
সামাজিক স্বীকৃতি পেত না, এখন সেই তাদেরকেও নিজের শ্রম
বাজারে বিক্রি করে পরিবারের আয় বাড়াতে হচ্ছে। সুতরাং বাড়ছে মেয়েদেরও বিয়ের বয়স , সেই সঙ্গে অবশ্যই শিক্ষাতে আগ্রহ এবং স্বনির্ভরতা। কিন্তু, যে সন্তান আগে বাড়িতে মা-ঠাকুমার সঙ্গে বড় হতো তাকে সঙ্গ দেয় বাড়ির ‘কাজের মেয়ে’ অথবা ‘প্রাইভেট
টিউটর’। ‘প্রাইভেট টিউটর’
আর স্কুলের চড়া ফীজ জমা দিতে দিতে ক্লান্ত সন্তানের অভিবাবকের
সেই জো নেই যে নিজের বৃদ্ধ পিতা-মাতার দায় বহন করেন। তার উপর যদি তারা এক ছাদের
তলাতে থাকেন তবেতো । তারাতো আছেন ‘প্রাচ্যের বৃদ্ধাবাসে’
–সেই ‘পৈত্রিক ভিটে’য় । শুনতে বাজে শোনায়, কিন্তু সত্য হলো
---পরিবারের মানবিক সম্পর্কগুলোর কিছুই আজ আর অবশিষ্ট নেই, সে পরিণত হয়েছে সমাজের প্রাথমিক অর্থনৈতিক এককে। বাজারের উঠানামার
সঙ্গেই তার ভবিতব্য লেখা হয়ে আছে । আমরা তার মোহে আচ্ছন্ন হয়ে আছি, আমাদের অন্যরকম করে ভাববারটি সময় নেই। সময়গুলো অব্দি বাজারে বাঁধা
রয়েছে, আমাদের ইচ্ছেয় অথবা অনিচ্ছেয়। আমরা এর আদর করে নাম
দিয়েছি ‘আধুনিকতা’।
বাজার আমাদের
পরিবারকে ভেঙ্গে ব্যক্তিমানুষকে আর তার শ্রমকে সামাজিক করে ফেলেছে। কিন্তু সেই
শ্রম সে সামাজিক সম্পদের সৃষ্টি করে তাকে যথেচ্ছ ভোগ করবার স্বাধীনতা কিন্তু তাদের
হাতে যাদের হাতে নিয়ন্ত্রণ। সেই নিয়ন্ত্রকদের হাতের মুঠোতে গুনা যায়। আমাদের
মধ্যবিত্তের মাসের শেষে হিসেব মেলে না । বিশাল সংখ্যার নিম্নবিত্তের দিনের শেষেও
হাতে কিছু অবশিষ্ট থাকে না । সে সব পরিবারে মেয়েবিয়ে হয় না, বাজারে
বিক্রি হয়। কিশোর ছেলে মা-বাবার কোল ছেড়েই কোথাও কোনো ছোট বা বড় মালিকের শ্রমদাসে
পরিণত হয়। নারীবাদিরা বলেন , মেয়েদের শরীরের উপর তাদের
কোনো অধিকার নেই। সত্য বলেন। সঙ্গে এও সত্য যে সন্তানের উপর মা-বাবার, মা-বাবার উপর সন্তানেরও কোনো অধিকার নেই। যে ভালবাসাকে জীইইয়ে রাখে-- সে
আমাদের গল্পের ‘সমর’। যে তাও
টেকাতে ব্যর্থ--- সে আমাদের গল্পের ‘হীরু’। ‘সমর’দের মতো সন্তানেরা উপদেশ মাত্র , ‘হীরু’রা আমাদের বিদ্বেষ—এদের কেউ কোনো সমাধান নয়।
সমাধান, সেই
প্রশ্নেঃ বাড়ির বাইরে গিয়ে যে সমাজের জন্যে আমি শ্রম দেব,
যে সমাজকে শ্রম দেবার জন্যে বেড়ে উঠবে আমার সন্তান , যে
সমাজকে শ্রম দিয়ে ক্লান্ত হয়েছেন আমার পিতা-মাতা--- তাদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, স্বাচ্ছন্দ্য, সুখ এবং নিরাপত্তার দায়িত্ব নেবার মতো মানবিক হবে না কেন সমাজ নিজে ? সন্তানের শিক্ষা, আর পিতার স্বাস্থ্য এবং
সর্বোপরী আমাদের সবার জন্যে সামান্য আশ্রয়টুকুও আমাকে বাজার থেকে কিনে নিতে হবে
কেন?
শুনে মনে হবে, এক
ইউটোপীয়ার অরূপকথা শোনাচ্ছি। কিন্তু চারপাশে বাজারময় অমানবিক এক সমাজে বাস করে আমরা যখন ভাঙ্গা পরিবারের
সদস্যদের মানবতার অবক্ষয়ের বাণী শোনাই --মনে কি হয় না তখন সে বাণী প্রলয়কালের
পরিহাস মাত্র? অন্ধ হলে কি প্রলয় বন্ধ থাকে?
-------
কিছু প্রয়োজনীয় লিঙ্কঃ
3 comments:
ভালো,খুবই ভালো । লেখাটা আমি ছাপতে চাই । আমাকে পারলে একটা কপি পিডিএফ করে মেল করো ।
অমিতাভ দেব চৌধুরী
সারছে! কিন্তু এটা যে 'সেবা'র জিনিস ! ওরা পরের সংখ্যাতে ছাপবে বলে নিয়েই গেছে।
আপনে পড়ায় আমার ডর গেল গি। আমার মানে যেলা আলোচনা দেখি, আর নিজে যেভাবে লেখি--একটা ডর থাকে। মানে, আমিউ ওলা ভাবি না কিতা, সব আবুল তাবুল। এর লাগি , ই লেখা আপনে ছাড়া আর কোনো গল্প লেখকরে পড়াইছি না। মৃন্ময়দার নিশ্চয় ভালা লাগছে। এর লাগিউতো ছাপবা। কিন্তু তাইন আবার নিজে কিচ্ছু কইন না, বৌদিরে দিয়া কওয়াইন।
Post a Comment